ছদ্মবেশী সময় (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত
প্রাক্কথন
এই লেখাটা নিয়ে পরিচিত এক দাদার কাছে গিয়েছিলাম। সাহিত্যের লোক, লেখা- ফেখা বোঝেন। একটু পড়েই বললেন, “এসব কী? শুরুতেই ‘প্রমথ, একেনবাবু, আর আমি!” তোমার কী ধারণা, পাঠকরা তোমাদের সবাইকে চেনে! ক’জন তোমার লেখা আগে পড়েছে? আগে চরিত্রগুলোর পরিচয় দাও, তারপর গল্প শুরু করো। আর শোনো, সিরিয়াসলি লেখালিখি করতে চাইলে তোমার উচিত ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর একটা কোর্স করে নেওয়া।”
“ক্রিয়েটিভ রাইটিং!”
“অবাক হচ্ছ কেন, তোমাদের ইউনিভার্সিটিতেই তো করানো হয়!”
“না, না, তা নয়, লিখছি তো গোয়েন্দা কাহিনি!”
“তো? গোয়েন্দা কাহিনি কি সাহিত্য নয়, শুধুই প্লট-ড্রিভন হাবিজাবি? ক্যারেক্টার-ড্রিভন হতে পারে না? ডায়ালগ বা ডেস্ক্রিপ্টিভ এলিমেন্ট থাকবে না?”
আমার কাঁচুমাচু মুখ দেখে বোধহয় ওঁর করুণা হল। বললেন, “ঠিক আছে, আগে বলো প্রমথ কে?”
মনে মনে বললাম, ‘এক্কেবারে আপনার টাইপ, বাক্যবাণে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে আনন্দ পায়।’ মুখে বললাম, “আমার ছেলেবেলার বন্ধু, কেমিস্ট্রিতে পোস্ট ডক সবে শেষ করেছে।
“একেনবাবু?”
“কী মুশকিল, উনিই তো গোয়েন্দা, আপনি ওঁকে চেনেনও!”
“আমার চেনাটা বড়ো কথা নয়। পাঠকদেরও তো চিনতে হবে। আমি তো তোমাকেও চিনি। কিন্তু তুমি যে বাপি দে, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়াও, সেটা ক’জন জানে?”
সেইসময় অপরিচিত কয়েক জন আড্ডা দিতে এসে পড়ায় রক্ষা পেলাম। বাড়ি ফিরে এসে যখন ভাবছি লেখাটা নতুন করে আরম্ভ করব কিনা, একেনবাবু ভরসা দিলেন, “কিচ্ছু পালটাবেন না, স্যার। সাহিত্য না-হলেও আপনার লেখা পড়ে তো বোঝা যায়।”
এক
সকাল বেলায় প্রমথ, একেনবাবু, আর আমি বসে কফি খাচ্ছি, হঠাৎ টিং শব্দ। একেনবাবুর হোয়াটসঅ্যাপ-এর মেসেজ অ্যালার্ট।
দেখলাম, একেনবাবু ভুরু কুঁচকে লেখাটা পড়ছেন আর মাথা চুলকোচ্ছেন। প্রমথ পাশেই বসেছিল, এক ঝলকে মেসেজটা দেখে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
“রিচার্ড র্যান্ডো।”
“আঃ, নামটা তো এখানেই লেখা, কিন্তু লোকটি কে?”
“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের খুব পরিচিত স্যার, আমার সঙ্গে মাত্র বার দুয়েক দেখা হয়েছে। কিন্তু উনি যে ইন্ডিয়ায় জানতাম না স্যার!”
“কেন সাহেবরা কি ইন্ডিয়াতে যায় না?”
“না না স্যার, তা নয়…”
“তাহলে?”
প্রমথ এমন ত্যাড়াবাঁকা প্রশ্ন করতে থাকে যে আসল উত্তর পেতে খামোখা দেরি হয়। তাই বললাম, “লোকটা যে কে সেটাই কিন্তু জানা হচ্ছে না!”
“বলছি স্যার, আগে আরেক কাপ কফি হোক।”
“আপনি মশাই সামথিং!” বলে প্রমথ উঠে কিচেনে গেল কফির দানা গুঁড়ো
করতে। পেছন পেছন আমরাও গেলাম।
কিচেনে দঁড়িয়েই র্যান্ডো কাহিনি শুনলাম।
.
“অনেক দিন আগের কথা, এক বছরও হয়নি আমি এদেশে এসেছি, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মিস্টার র্যান্ডোর সঙ্গে। একটা পরামর্শের জন্য ভদ্রলোক এসেছিলেন। চলে যাবার পর স্টুয়ার্ট সাহেব বলেছিলেন, ‘হলিউডের স্ট্রাগলিং স্ক্রিপ্ট রাইটার। ওঁর একটা স্ক্রিপ্ট চুরি গেছে, কিন্তু আমি এখানে বসে কী করতে পারি!’
“কাঁচা-পাকা চুল, ছেঁড়া জিন্স, ছাই-রঙা সোয়েটশার্ট—এই লোকটা হলিউডের স্ক্রিপ্ট রাইটার? আমি তো স্যার অবাক! কিন্তু স্ট্রাগলিং কেন? তখনই জানলাম হলিউডে এইসব কাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার, শুধু ট্যালেন্ট থাকলেই হয় না। পরে অবশ্য ওঁর সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল। দু-বছর বাদে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আর আমি একটা কাজে ওল্ড ওয়েস্টবেরি-তে গেছি। বিশাল বিশাল পুরোনো বাড়ি, জানতামও না স্যার ওটা লং-আইল্যান্ডের সবচেয়ে দামি অঞ্চল। হঠাৎ একটা বাড়ির বাগানে কাউকে দেখে ক্যাপ্টেন গাড়ি থামালেন। সেই রিচার্ড র্যান্ডো! র্যান্ডো সাহেব ছাড়লেন না, টেনে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কফি খাওয়ালেন।”
“তার মানে তো হলিউডে স্ক্রিপ্ট বেচে ভালোই কামিয়েছিলেন!” প্রমথ মন্তব্য করল।
“না স্যার, তা নয়। কথায় কথায় উনিই বললেন, হলিউডে সুবিধা হয়নি, বড়োলোক হয়েছিলেন ওঁর এক নিঃসন্তান মামার বিশাল সম্পত্তি পেয়ে।”
“ভাগ্যবান লোক, এরকম মামা তো সবার জোটে না!”
“কিন্তু হঠাৎ এই হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “আপনার ফোন নম্বর পেলেন কোত্থেকে?”
“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টই নিশ্চয় দিয়েছেন। দেখি স্টুয়ার্ট সাহেবকে একটা ফোন করে।”
ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একটা মিটিং-এ ব্যস্ত, পাওয়া গেল না।
.
কফি নিয়ে সবাই খাবার টেবিলে বসলাম। স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা হচ্ছিল তারই খেই ধরে প্রমথ বলল, “এই স্ক্রিপ্ট বা স্ক্রিন-প্লে চুরি করা কিন্তু হলিউডে মাঝে মাঝে হয়। মনে নেই, সত্যজিৎ রায়ের প্লট ঝেড়ে স্পিলবার্গ ‘দ্য এলিয়েন’ বানিয়েছিল? একবার কাউকে কিছু জমা দিলেই হল—এর হাত ওর হাত হয়ে পাবলিক প্রপার্টি হয়ে যায়!
“হ্যাঁ, সেরকমই একটা গুজব রটেছিল বটে, “ আমি বললাম, “তবে কাউকে কিছু দেবার আগে একটু সতর্ক হলে এগুলো এড়ানো যায়।”
“তার মানে?”
“ধর, কাউকে চিঠি দিয়ে স্ক্রিপ্ট বা কনসেপ্ট পাঠাবার আগে চিঠিশুদ্ধ তার একটা কপি নিজেকেই রেজিস্টার্ড পোস্ট-এ পাঠিয়ে সেটা এলে না খুলে রেখে দেওয়া। খামে পোস্ট অফিসের ডেট-দেওয়া স্ট্যাম্প থেকে কপিরাইটের ক্লেইম প্রমাণিত হবে।”
“তার জন্য পোস্ট অফিস লাগবে কেন?” প্রমথ প্রশ্ন তুলল। “ইমেল-এ অ্যাটাচ করে পাঠালেই তো প্রমাণ হয়ে যাবে কবে পাঠানো হয়েছে!”
“তা যাবে, ইমেলে-এ যদি স্ক্রিপ্ট নেয়। তবে আমাদের দেশে ওসব করলেও ঘোড়াড্ডিম হবে, দেশে কপিরাইটই কেউ মানে? আগাথা ক্রিস্টির অনুবাদ কলেজ স্ট্রিটে অজস্র পাবি। অথচ আজ পর্যন্ত আগাথা ক্রিস্টির ট্রাস্টিরা কাউকে বাংলা অনুবাদের পারমিশন দেয়নি… শুধু মাত্র কয়েকটা গল্পই কপিরাইটের আওতায় পড়ে না, কারণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৪ সালের আগে। কিন্তু তাতে আটকেছে কিছু?”
“১৯২৪ আবার কোত্থেকে পেলি? উলটোপালটা একটা সাল বলে দিস!”
“নেট-এ পেয়েছি।”
“আচ্ছা স্টুপিড তুই! নেট-এ যা পাবি তাই সত্যি?”
একেনবাবু চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিলেন আর বসে বসে পা নাচাচ্ছিলেন।
“কী মশাই, মৌনব্রত নিলেন যে বড়ো?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“শুনছিলাম স্যার আপনাদের কথা। আপনারা সত্যি স্যার জ্ঞানের পাহাড়!”
“থামুন মশাই, তার জন্য নিশ্চয় পা নাচাচ্ছিলেন না?”
“আসলে স্যার ভাবছিলাম, র্যান্ডো সাহেবের অ্যাটর্নিকে এক বার ফোন করব কিনা।”
“নিশ্চয় করবেন। এ নিয়ে এত ভাববার কী আছে?
“তবু এক বার জিজ্ঞেস করে নিই স্টুয়ার্ট সাহেবকে, উনি নিশ্চয় এই তলব করার কারণটা জানেন।”
বেশি ভাবাভাবি করতে হল না, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের ফোন এল। একেনবাবু র্যান্ডো সাহেবের মেসেজ পাওয়ার কথা বলতেই ক্যাপ্টেন অনেক কিছু বললেন। আমরা শুধু একেনবাবুর কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। ‘তাই নাকি স্যার!’ ‘আচ্ছা… ইন্টারেস্টিং,’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।
ফোন শেষ হতেই প্রশ্ন করলাম, “কী বললেন?”
“র্যান্ডো সাহেব বছর কয়েক ধরে ইন্ডিয়াতে আছেন। সেখানে একটা সমস্যায় পড়েছেন বলে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন।”
“‘আমাদের’ মানে ‘আপনার।’ এই বহুবচন ব্যবহার করার হ্যাবিটটা ছাড়ুন তো! তা সমস্যাটা কী?” প্রমথ প্রশ্ন করল।
“সেটা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জানেন না, কিন্তু মিস্টার র্যান্ডোর অ্যাটর্নি জানেন। যাঁর নাম-ঠিকানা র্যান্ডো সাহেব ওঁর মেসেজ-এ পাঠিয়েছেন।”
“এত ধোঁয়াশার মধ্যে না রেখে মেসেজটা কী ছিল পড়ুন তো!”
একেনবাবু মোবাইলটা পকেট থেকে বার করে দেখালেন। ছোট্ট মেসেজ :
আশা করি আমাকে মনে আছে। আমি এখন শান্তিনিকেতনের কাছে থাকি। ব্যক্তিগত একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার সাহায্য চাই। আথ্রাইটিসে কাবু বলে নিউ ইয়র্কে যেতে পারছি না। আপনি যদি ইন্ডিয়াতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন, সমস্যাটা গুছিয়ে বলব। ফোনে কিছু বলতে চাই না। বার্ড, কোজেন, অ্যান্ড গিবসন-এর অফিসে আমার নাম করলে এখানে আসার ডিটেলস আর অন্যান্য খরচাপাতি আপনাকে দিয়ে দেবে। ভালো থাকবেন।
শুভেচ্ছান্তে, রিচার্ড র্যান্ডো
নীচে অ্যাটর্নি বার্ড, কোজেন, আর গিবসন অফিসের নম্বর।
