উডব্রিজ শহরে (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত

শেয়ার করুনঃ

এক

বৃহস্পতিবার বিকেলবেলা দীপেনের একটা ফোন পেলাম।

 

“কাল বিকেলে চলে আয়, একা একা বড় বোর হচ্ছি। প্রমথকেও নিয়ে আয়।”

 

দীপেনের পরিচয়টা আগে দিই। আমাদের যাদবপুরের বন্ধু, ক্যাল-টেক থেকে পিএইচ ডি করে ইউ.সি বার্কলে, মানে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাসে পড়াত। মাস ছয়েক হল রাটগার্স-এ এসেছে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হয়ে। রাটগার্স নিউ জার্সির স্টেট ইউনিভারসিটি, ইউসি বার্কলের মতো অত নাম নেই। এসেছে এই আশায় কয়েক বছরের মধ্যে ফুল-প্রফেসর হয়ে যাবে! ওর বউ দীপান্বিতা এখন দেশে। পুজো শেষ হলে ফিরবে।

 

দীপেন একেনবাবুর কথা জানত না। বলতেই বলল, “তাহলে তো আরও ভালো। আমার চারটে বেডরুম, কোনো সমস্যা নেই– আরামেই থাকবি এখানে। বিচিত্রা ক্লাবের পুজো নাকি খুব বড় হয়, সেখানে সবাই মিলে যাব। আমি কিন্তু তোদের সবার নাম রেজিস্ট্রি করে ফেলছি।”

 

“রেজিস্ট্রি মানে? বারোয়ারি পুজো নয়?”

 

“সবাই আসতে পারে, কিন্তু রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এত ভিড় হয়, আগে থেকে কতজন আসছে না জানলে সামলাতে পারে না। রান্নাবান্নার ব্যাপার আছে তো।”

 

“বুঝলাম, কিন্তু গ্যাঁট-গচ্চা কত দিতে হবে?”

 

“সেটা জানার তোর কী দরকার, তোদের আমি নেমন্তন্ন করতে পারি না?”

 

দীপেন বরাবরই লায়ন হার্টেড।

 

আমার নিউ জার্সিতে বেশি যাওয়া হয় না। সত্যি কথা বলতে কী, নিউ জার্সি আমার কাছে ম্যাদামারা লাগে– বিশেষ করে ম্যানহাটানের তুলনায়। বেডরুম কমুনিটি, অ্যাকশন বলে কিছু নেই। এই কথা প্রমথ শুনলেই মুখ বেঁকায়। বলে, “এখানে যেন কত এক্সাইটিং কাজ করিস!”

 

পুজোয় নিউ জার্সি যাবার সম্ভাবনায় সবচেয়ে উত্তেজিত একেনবাবু।

 

“চলুন স্যার, চলুন। একটা নতুন এক্সপেরিয়েন্স হবে। ব্রুকলিন আর কুইন্সের পুজো তো অনেকবার দেখলাম।”

 

“এত আনন্দ কেন, বিনি পয়সায় পুজো দেখা হচ্ছে বলে?” প্রমথ খোঁচা দিল।

 

“কী যে বলেন স্যার, পুজোয় যাব আর তার জন্য দক্ষিণা দেব না?” তারপর আমাকে

 

“ও নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না, তিনটে টিকিট কিনলে ফোর্থটা ফাউ… আপনি নিখরচায় যাবেন।” মজা করেই বললাম।

 

একেনবাবু সব সময় রসিকতা বোঝেন না। বললেন, “তাহলে স্যার যাবার পথে কফি আমি খাওয়াব।”

 

দীপেন থাকে রাটগার্স ইউনিভার্সিটির কাছেই হাইল্যান্ড পার্কে কোন পথ কখন নিতে হবে সেটা নির্ভর করবে কোথায় যানজট বেশি। আমার জিপিএস-এর একটা ভালো অ্যান্স আছে, ভিড়ভাট্টা এড়ানোর পথ বাতলায়। তাতে দেখলাম হল্যান্ড টানেল নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সোয়া ঘণ্টার মতো লাগল পৌঁছোতে।

 

দীপেনের বাড়ি দেখে সবাই আমরা মুগ্ধ। প্রায় চার হাজার স্কোয়ার ফুটের দোতলা বাড়ি! বেডরুমগুলো সব ওপরে। নীচের তলায় অতিথি-আপ্যায়নের জন্য বিশাল ড্রয়িং রুম। আপন লোকদের সঙ্গে গল্পগুজব করার জন্য যে লিভিং বা ফ্যামিলি রুম, সেটাও খুব ছোটো নয়। রান্নাঘরের পাশে ব্রেকফাস্ট করার জায়গা, এছাড়া ফর্মাল ডাইনিং রুম তো আছেই। একটা বড়োসডো প্যানট্রি দিয়ে গ্যারাজে যাবার দরজা, সেখানে ওয়াশিং মেশিন আর ড্রায়ার রয়েছে। আগে যাঁরা এখানে থাকতেন তাঁরা মনে হয় প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন, পিছনে শুধু ঘাস আর জঙ্গল, তারই মধ্যে কয়েকটা বড়ো বড়ো গাছ। প্রায় আধ-একর জমির ওপর বাড়ি, খুবই ইমপ্রেসিভ! আমাদের চোখে বিস্ময় দেখে নিজেই বলল, কী করে এতো বড়ো বাড়ি কিনতে পারল। ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়ি বিক্রি করে প্রচুর প্রফিট করেছে, সেই টাকায়।

 

নিউ জার্সির এদিকে আমার বেশি আসা হয় না। নিউ জার্সির উত্তর দিকে, যেটাকে বলা হয় নর্থ জার্সি, সেখানে কয়েকবার গেছি, লেক ভালহাল্লায় মায়ের এক বন্ধু থাকত। অনেক উঁচু উঁচু টিলা ওই দিকটাতে। এটা নিউ জার্সির মধ্যিখানে, অর্থাৎ সেন্ট্রাল জার্সি। এদিকটা বেশ সমতল। বহু বঙ্গসন্তান সেন্ট্রাল জার্সি অঞ্চলের বিভিন্ন শহরে থাকে। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান থেকে আসা এত লোক এই অঞ্চলে যে এডিসন টাউনের ওক ট্রি রোডের বাজারকে এখন লিটল ইন্ডিয়া বলা হয়। এগুলো সব দীপেনের তথ্য। আমাদের কাছে লিটল ইন্ডিয়া হল ম্যানহাটানের লেক্সিংটন রোডের খানিকটা অংশ বা কুইন্সের জ্যাকসন হাইট্স-এর দোকানগুলো।

 

বিচিত্রার পুজো হয় সমারসেট-এর ইউক্রেনিয়ান কালচার সেন্টারে। জায়গাটা দীপেনের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়। গিয়ে দেখি বিশাল পার্কিং লট-এর সামনে সাইন লাগানো ‘এন-জে-পি-সি’ দুর্গাপুজো। একজন সিকিউরিটি গার্ড গেট পাহারা দিচ্ছে।

 

“খুবই কনফিউসিং স্যার,” একেনবাবু বললেন, “আপনি বলছেন এটা বিচিত্রার পুজো, কিন্তু পুজোর টিকিটেও তো এন-জে-পি-সি লেখা। নাম কিন্তু কোথাও নেই।”

 

“ঠিক জায়গায় এনেছিস তো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

দীপেনও মনে হল একটু আশ্চর্য। “হ্যাঁ, এই ঠিকানাই তো দিয়েছিল আমাকে।”

 

“কটা পুজো হয় নিউ জার্সিতে?” এবার প্রমথর প্রশ্ন।

 

“অনেকগুলো। কিন্তু এটাই আমাকে ত্রিদিব রেকমেন্ড করল, ও-ও আসছে এখানে।”

 

“ত্রিদিব? মানে আমাদের যাদবপুরের ত্রিদিব?”

 

“রাইট। ও এখন এখানে বেশ কয়েকটা ফার্মাসির মালিক।”

 

বাঙালি ব্যবসা করছে শুনলে বেশ ভালো লাগে। আমাদের রক্তে শুধু চাকরির নেশা, ব্যবসার কথা ভাবতেই পারি না।

 

“কিন্তু ওষুধের দোকানের তো বিশাল বিশাল চেন, তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তো কঠিন ব্যাপার!” আমি বললাম।

 

“করে তো খাচ্ছে। শুধু খাচ্ছে না, ওর বাড়ি দেখলে মুখ হাঁ হয়ে যাবে।”

 

“আর হাঁ হয়ে দরকার নেই… মনে হচ্ছে আমাদের হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরার জন্যেই এখানে ডেকেছিস।” আমি হাসতে হাসতে বললাম। যদিও মনের মধ্যে একটা খোঁচা লাগছিল। ত্রিদিবটা একটা আকাট ছিল। কোনো মতে বিএসসিতে অত্যন্ত বাজে রেজাল্ট করে ফার্মাসিতে ঢুকেছিল। সেটাও সোজা পথে বোধহয় নয়।

 

প্রমথ আমার দিকে তাকিয়ে ঠেস দিয়ে বলল “চিরদিনই শুধু গেঁড়ের মতো পড়াশুনো করে গেলি।” ভাবটা নিজে যেন করেনি।

 

আমাদের সামনে বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে লট-এ ঢোকার অপেক্ষা করছে। গার্ড টিকিট দেখে দেখে গাড়ি ঢুকতে দিচ্ছে। আমাদের টিকিট দেখেও ঢুকতে দিল।

 

দীপেন গেট দিয়ে গাড়ি ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “ঠিক জায়গাতেই তার মানে এসেছি। এখন মনে পড়ছে, ত্রিদিব এই নিয়ে কী জানি বলছিল… কোনো টেকনিক্যাল কারণে এন-জে-পি-সি নামটা ব্যবহার করা হয়। কে জানে, হয়তো ভুল বলছি!”

 

“ট্যাক্স-ফ্যাক্সের ব্যাপার নিশ্চয়,” প্রমথ তো সবজান্তা।

 

আমরা পুজোতে এসেছি দীপেনের নতুন হন্ডা সিআরভি চড়ে। আমার পুরনো টয়োটা করোলা তার কাছে নস্যি। কিন্তু পার্কিং লটে দেখলাম মার্সেডিজ, লেক্সাস, বি এম ডব্লু-র ভিড়। নাঃ নিউ জার্সির বাসিন্দাদের টাকা আছে বটে!

 

“এরা বেশির ভাগই নিশ্চয় এইচ-ওয়ানবি ভিসা-র পার্টি।” প্রমথর বক্রোক্তি।

 

আমি খেয়াল করেছি এইচ-ওয়ানবি ভিসার লোকদের ওপর প্রমথর একটা জাতক্রোধ আছে। কেন, সে কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়, স্রেফ হিংসা ছাড়া। প্রমথর বক্তব্য এরা পড়াশুনো করতে আসে না। টেক-ফার্মে চাকরি নিয়ে আসে। স্বল্প মেয়াদি ভিসা… যে ক’বছর চাকরি করে, ভালো মাইনে পায়। এখানেই টাকাগুলো ওড়ায়, ধারে দামি গাড়ি কেনে আর নাকি ফুটানি মারে!

 

আমি জানি এগুলোর বেশির ভাগই অসত্য, কিন্তু প্রমথকে কে বোঝায়? আসলে কোনো একটা পার্টিতে একটি ছেলেকে (প্রমথর ধারণা এইচ-ওয়ানবি ভিসাধারী) বলতে শুনেছিল, ‘দূর দূর, যারা এখানে পড়াশুনো করতে আসত, তারা দেশে সুবিধা করতে পারেনি বলেই আসত। কোনো মতে এদেশে সস্তা একটা গাড়ি কিনতে পারলে আর কোনো মাস্টারির চাকরি মিললেই বর্তে যেত। ওরা লাইফের কী জানে!

 

এটা শোনার পরে প্রমথ কী করে রাগ সামলেছিল জানি না। কিন্তু সেই থেকে এই এইচ-ওয়ানবি-দের ও সহ্য করতে পারে না। এটা যে শুধু একজন লোকের মত– সেটা ও কিছুতেই মানবে না। কারণ যারা সেখানে ছিল, সবাই তাতে সায় দিয়েছিল। ওর শেষের এই কথাটা আমি কোনোমতেই মানি না। ওরকম একটা মন্তব্য শোনার পর প্রমথ অন্যদের রিয়্যাকশন দেখতে দাঁড়িয়েছিল, আমি বিশ্বাস করি না। তার ওপর আমি একদিন বলতে গিয়েছিলাম, লোকটা ভুল তো কিছু বলেনি, সেই শুনে আমাকে এই মারে কি সেই মারে!

 

 

দুই

একটা বড়ো হলে পুজো হচ্ছে। ভীষণ ভিড়। ঠাকুর দর্শন আমার উদ্দেশ্য নয়, এসেছি চেনাজানা যদি কাউকে পাই আড্ডা দেব। হলঘরে ঢুকে সেটা অসম্ভব! একেনবাবুর টানাটানিতে দীপেন আর প্রমথ হলে ঢুকল। আমি দেখলাম বাইরে লবিতে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। সিঁড়িতে বা নীচের চত্বরেও কম লোক নেই। সেখানেই দেখা হয়ে গেল ত্রিদিবের সঙ্গে। ত্রিদিব কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা মারছিল, আমাকে দেখে হইহই করে উঠল। পরিচয় হল ওর বন্ধুদের সঙ্গে। সবগুলো নাম এখন মনেও করতে পারব না। তবে যাদের সঙ্গে পরিচয় হল তাদের একজন ছাড়া কেউই এদেশে পড়াশুনা করতে আসেনি, চাকরি নিয়েই এসেছে। অর্থাৎ তাদের সবাই-ই প্রমথর তালিকায় ‘অসহ্য’ গ্রুপের। আমার কিন্তু চমৎকার লাগল তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। প্রত্যেকেই নিউ জার্সিতেই থাকে, তবে বিভিন্ন শহরে।

 

এরমধ্যে একেনবাবু এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। একেনবাবু গোয়েন্দা শুনে সবাই দারুণ উৎসাহিত। এদের মধ্যে জনা দুয়েক দেখলাম একেনবাবুর নাম জানেন।

 

“আপনিই মুনস্টোন মিস্ট্রি ক্রাক করেছিলেন না?” যিনি বললেন তাঁর নাম অনিন্দ্য। ওই দলের মধ্যে একমাত্র তিনিই পড়াশুনো করতে এদেশে এসেছিলেন। তবে মাস্টার্স করে আর পিএইচ ডি-র দিকে এগোননি। সিএফএ করে একটা ফাইনানশিয়াল কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলেন। সেখানে ক্লায়েন্টদের ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট না কী সব জানি করতেন। এখন নিজের কোম্পানি খুলেছেন ফাইনানশিয়াল অ্যাডভাইস দেবার জন্য। স্টক্স আর বন্ডস, মানে শেয়ার মার্কেটে টাকা ঢালার ব্যাপারটা আমি ভালো বুঝি না। এটুকু বুঝি যে ব্যাঙ্কে টাকা জমা রাখলে যতটা সুদ পাওয়া যায়, তার থেকে অনেক বেশি পাওয়া যায় ঠিকঠাক স্টক বা বন্ড সময়মতো কিনে বেচতে পারলে! এই ঠিকঠাক আর ‘সময়মতো কথা দুটো খুবই অর্থবহ। উলটোপালটা হলে ফতুর হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।

 

একেনবাবু অবশ্য অনিন্দ্যকে সবিনয়ে বললেন, “না না স্যার আমি একা নয়, তবে টিমে ছিলাম। বাপিবাবু, প্রমথবাবুও আমার সঙ্গে ছিলেন।” ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু বিনয়ে কাজ দিল না। ওখানে দাঁড়ানো সবাই ঘেঁকে ধরল কী ভাবে রহস্যের উঘাটন হয়েছিল। সেই নিয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব চলল। এর মধ্যে ক্যামেরা কাঁধে কিশোর বলে একজন একেনবাবুর কাছে একটা কার্ড চাইল।

 

কিছুদিন আগে একেনবাবুকে দিয়ে যে কার্ড বানানো হয়েছে তার থেকে একটা বার করে দিলেন। কার্ড ছাড়াও ফোন নম্বরের আদান প্রদান করলেন। একেনবাবুর কথা ইতিমধ্যেই পুজো মণ্ডপে রাষ্ট্র হয়ে গেছে, বেশ কিছু কৌতূহলী চোখ দেখলাম। অরিন্দম ও তার স্ত্রী কেতকী, অজয় ও অজয়ের স্ত্রী অনিন্দিতা, শৈবাল ইত্যাদি, আরও কয়েক জনের সঙ্গে পরিচয় হল। মেয়েদের মধ্যে অনিন্দিতার সঙ্গেই একটু আধটু কথা হল। দীপেন দেখলাম ওদের ভালো করেই চেনে। অনিন্দিতা দীপেনের স্ত্রী দীপান্বিতার সঙ্গে কলকাতায় পড়েছে। সেই সূত্রেই এই দলের সঙ্গে চেনাজানাটা বেশি। শৈবালের স্ত্রীকে অবশ্য দেখলাম না, অনিন্দ্যর স্ত্রীকেও নয়– হয়তো হলের ভিতরে ছিল।

 

মোটকথা পুজো দেখার চেয়ে আড্ডাটাই বেশি হল। আমাদের প্ল্যান ছিল শনিবারই ফিরে আসা, কিন্তু দীপেন ছাড়ল না, “রাতে আমার সঙ্গে থেকে যা, রোববার ফিরিস।”

 

এমন করে বলল, না বলতে পারলাম না।

 

রাত্রে খাবার অর্ডার করব ঠিক করেছিলাম। প্রমথ ঘোষণা করল ও রান্না করবে। দীপেন দু-বছরও হল বিয়ে করেনি, এর মধ্যে যে শুধু রান্নাবান্না ভুলে গেছে তা নয়, কোথায় মশলাপাতি আছে তাও জানে না। প্রমথ আবার রান্নায় শর্টকাট করে না, রান্নার প্রতিটি উপাদান ওর কাছে অপরিহার্য। দীপেন দু-দু বার ফোন করল কলকাতায় কোথায় পোস্ত আছে, কোথায় কালোজিরে আছে ইত্যাদি জানতে। ওর বউ দীপান্বিতাকে আমি আবছা চিনতাম, আমার মাসিদের পাড়ার মেয়ে। আমাদের থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো। পড়াশুনোয় খুবই ভালো ছাত্রী, একটু সিরিয়াস টাইপ। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে পড়াশুনো করতে এসে দীপেনের সঙ্গে পরিচয়। কিছুদিন প্রেমের পরে বিবাহ।

 

প্রমথ রান্না করছে আর আমাদের আড্ডা চলছে। একথা সেকথার পর যাদের সঙ্গে পুজোয় দেখা হল তাদের প্রসঙ্গ এল। ওদের মধ্যে অজয়কেই দীপেন মোটামুটি চেনে। অন্যদের সঙ্গে উপর উপর আলাপ। বড়ো বড়ো সোশ্যাল ফাংশনে ওদের সঙ্গে গল্পগুজব করলেও সামাজিক ভাবে তেমন মেলামেশা নেই।

 

“সে কি রে! আমার তো ওদের সঙ্গে গল্প করে দিব্বি লাগল। আমাদেরই বয়সি, হইচই করা পার্টি।”

 

“আমার ঠিক জমে না।”

 

“কেন জমে না?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

 

দীপেন কাটাতে চাইছিল। প্রমথ ছাড়ল না, “দুম করে একটা স্টেটমেন্ট করলি, কিন্তু সেটা ব্যাক-আপ করছিস না, ব্যাপারটা কী?”

 

কিন্তু কিন্তু করে দীপেন শেষে বলল, “দীপান্বিতা বিরক্ত হয় ওদের সঙ্গে মিশতে। আসলে বুঝলি তো, ওদের পার্টিগুলো একটু ওয়াইল্ড হয়। মদ-টদ খেয়ে, কে যে কী করে ঠিক ঠিকানা নেই। বিশেষ করে অনিন্দিতা একটু…” বলেই লজ্জা পেল দীপেন। বলল, “থাক গে…” বলে থেমে গেল।

 

বোঝা গেল আরও কোনো ব্যাপার আছে যা দীপেন বলতে চায় না। প্রমথ তাও কি ছাড়বে?

 

“মদ বেশি খেলে একটু আধটু মাতলামো তো সবাই করে। কিন্তু থাক গে’ কথাটা বললি কেন?”

 

“আরে দূর, বাদ দে!” তারপর একটু চুপ করে বলল, “আসলে অনিন্দিতা দীপান্বিতাকে একটু হিংসা করে আমরা এখানে পার্মানেন্টলি থাকতে পারছি বলে। অনিন্দিতা দেশে ফিরতে চায় না, কিন্তু অজয়কে তো ফিরতেই হবে আর এক বছর বাদে… ওদের ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। এটা ঠিক অনিন্দিতা একটু ফ্লার্টিশ, গায়ে পড়া টাইপ, আর দীপান্বিতা ভীষণ কনসার্ভেটিভ। ও একেবারেই চায় না আমি ওদের সঙ্গে মিশি। সেই জন্যেই ওদের পার্টিগুলোতে যাওয়া হয় না। …সরি, এগুলো তোদের বলা অনুচিত। এসব আবার রাষ্ট্র করিস না।”

 

 

তিন

পুজোর এক সপ্তাহ বাদেই একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন।

 

“মনে আছে আমাকে, পুজোয় আলাপ হয়েছিল। আমি অনিন্দ্য।”

 

“কী মুশকিল এক সপ্তাহের মধ্যে নাম ভুলে যাব, এত ভুলো মন তো হয়নি এখনও, কী খবর?

 

“এই উইক এন্ডে কিছু করছ?” একদিনের আলাপেই কখন ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ হয়ে গিয়েছিল!

 

“বিশেষ কিছু নয়। কেন বলো তো?

 

“আসলে দীপেনকে লাঞ্চে ডেকেছি। ও-তো ফোর্সড ব্যাচেলর, আর আমি খাঁটি সার্টিফায়েড ব্যাচেলর। দীপেনের কাছে শুনলাম তোমরাও ব্যাচেলর, শুধু একেনবাবু নন। কিন্তু ওঁর স্ত্রীও তো কলকাতায়। তাই ভাবলাম শুধু ছেলেরা একসঙ্গে বসে দুপুরটা কাটাই।”

 

লাঞ্চের জন্য এখন নিউ জার্সি ঠ্যাঙাব! ‘তুমি’ করে সম্বোধন করলেও তেমন করে চিনিও না। আমার তরফ থেকে নিস্তব্ধতা লক্ষ্য করে অনিন্দ্য বলল, “আরে শোনো, আমি কিন্তু খারাপ রাঁধি না। দীপেন সাক্ষী… জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো। সর্ষে দিয়ে ইলিশ রান্না করব, একটা ভালো সাইজের ইলিশ পেয়েছি।”

 

“এ-রকম প্রস্তাব দিলে তো ‘না’ করা মুশকিল। কিন্তু আবার এত কষ্ট করবে?”

 

“এত বড়ো ইলিশ তো আমি আর দীপেন একা একা খেতে পারব না, এলে আমার উপকারই করবে।”

 

“তোমার সঙ্গে কথায় পারব না। আচ্ছা, প্রমথ আর একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখি।”

 

ইলিশ শুনে একেনবাবু এক পায়ে খাড়া। ফ্রান্সিস্কা নেই, তাই প্রমথও মনে হল। নিমরাজি।

 

অনিন্দ্যকে বলে দিলাম, “যাব। ঠিকানাটা টেক্সট করে দাও।”

 

.

 

একটা মিষ্টি জার্মান ওয়াইন রিসলিন-এর বোতল (প্রমথর সাজেশন, ফ্রান্সিস্কার ফেভারিট) নিয়ে রওনা দিলাম অনিন্দের বাড়ির দিকে।

 

গার্ডেন স্টেট পার্কওয়েতে উডব্রিজ-এর এক্সিট নিতেই একেনবাবু বললেন, “আরে, জ্যাক তো এখানকার পুলিশ চিফ?”

 

“জ্যাক?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

 

“হ্যাঁ স্যার, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের ডিপার্টমেন্টে সার্জেন্ট ছিল। নিউ জার্সির উডব্রিজ শহরে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের চিফের চাকরি নিয়ে এসেছিল। আমাকে একবার আসতেও বলেছিল ওর অফিস দেখে যেতে।”

 

“দেখতে যাবেন নাকি?”

 

“কী যে বলেন স্যার, কোথায় সর্ষে ইলিশ আর কোথায় ডিপার্টমেন্টের স্যান্ডউইচ!”

 

.

 

উডব্রিজ শহরে ছোট্ট ছিমছাম একটা বাড়ি। অনিন্দ্য ছাড়া আরেকটা প্রাণী ওখানে থাকে। মনুষ্য নয়, গোল্ডেন রিট্রিভার। বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই দৌড়ে গাড়ির পাশে এসে দু পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অন্য দুটো পা গাড়ির দরজায় রাখল। তারপর জানলায় মুখ ঠেকিয়ে ভৌ ভৌ শুরু করল। পিছন পিছনই অনিন্দ্য এসে হাজির। ওর গলার কলসটা চেপে ধরে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলল, “সিট।”

 

সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মী ছেলের মতো কুকুরটা বসে পড়ল।

 

“স্টে,” বলে অনিন্দ্য এসে গাড়ির দরজা খুলে বলল, “ভয়ের কিছু নেই, খুব ফ্রেন্ডলি কুকুর। চুপ করে বসে থাকবে যতক্ষণ না ‘জি-ও’ বলছি। বললে উঠে এসে সবার কাছে আদর খেতে আসবে। কুকুর ভয় পাও না তো?”

 

“আমি না, কিন্তু জি-ও?”

 

“শব্দটা বললাম না। বললেই তো…”

 

প্রমথর বাড়িতে কুকুর ছিল। একেনবাবুও দেখলাম কুকুর ভয় পান না। আমরা নামতেই দেখলাম কুকুরটা কুঁ কুঁ করে মনিবের অনুমতি চাইছে ওঠার জন্য।

 

‘গো’ বলা মাত্র লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে আদর করে অস্থির।

 

আমি ওকে একটু আদর করে বললাম “কী নাম ওর?”

 

“খুশ।”

 

“খাসা নাম। নামের মর্যাদা রেখেছে। কিন্তু এভাবে ও খোলাই থাকে? কোনো বেড়া তো দেখছি না, পালিয়ে যায় না?”

 

“ইলেকট্রিক ফেন্স একটা আছে। তবে ও এমনিতেই এই চত্বরের বাইরে যায় না।

 

“খুব পাহারাদার বলে তো মনে হচ্ছে না।”

 

“ঠিকই বলেছ। ওকে এনেছিলাম বাড়ি পাহারা দেবে বলে। কোথায় কী? কেউ এলেই এত অভ্যর্থনা করে যেন কুটুম্ব বেড়াতে এসেছে। তবে কি না, ও থাকায় নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয় না।”

 

“গোল্ডেন রিট্রিভার আমার খুব পছন্দের কুকুর।” খুশকে আদর করতে করতে প্রমথ বলল। “ওরা জেন্টল অ্যাজ এ নান, কোথায় জানি পড়েছিলাম।”

 

“একদম ঠিক, কিন্তু বড় শেড করে। সোফা থেকে শুরু করে মেঝের কার্পেট পর্যন্ত ওর লোম। সকাল বিকেল ভ্যাকুয়াম করতে করতে প্রাণ যায়!”

 

কথাটা ঠিক আমার প্যান্টেও দেখলাম কয়েকটা সোনালি লোম এর মধ্যেই লেগে গেছে।

 

.

 

সত্যিই ভালো রাঁধে অনিন্দ্য। তৃপ্তি করে ইলিশ খেলাম। এছাড়াও ছোলার ডাল, চচ্চড়ি, আরও বেশ কিছু পদ করেছিল। খেতে খেতে গল্প হল। খাবার পরে কফি নিয়ে বসলাম। দেখতে দেখতে প্রায় ঘণ্টা কয়েক আড্ডা হল।

 

পুজোর সময় যাদের সঙ্গে ভাসা ভাসা পরিচয় হয়েছিল, অনিন্দ্যর সঙ্গে গল্প করে তাদের অনেক বিশদ পরিচয় পেলাম। দীপেনও এত ভালো জানত না। অনিন্দ্যর সঙ্গে ওদের সবারই খুব দহরম মহরম। উইক এন্ডে নিয়মিত একসঙ্গে কারোর না কারোর বাড়িতে আড্ডা দেয়। এই উইক এন্ড একসঙ্গে সবাই বাইরে কাটাবে বলে কোথায় জানি গেছে, অনিন্দ্যর একটা কাজ ছিল বলে যায়নি।

 

শৈবাল, অরিন্দম, অজয় সবাই আই-টি ফার্মে কাজ করে। কিন্তু কেউই রেগুলার কর্মী নয়, কনসাল্টেন্ট। কনসাল্টেন্ট মানে এদের কোনো একটা বিশেষ প্রজেক্টে কাজ করানোর জন্য এদেশে আনা হয়। কনসাল্টেন্টরা পেনশন, প্রভিডেন্ড ফান্ড (এদেশের ফোর-ওয়ান কে), ইন্সিওরেন্স ইত্যাদি পায় না, তার বদলে খুব মোটা রকম আওয়ারলি পে দেওয়া হয়। একদিক থেকে বিচার করলে দু-পক্ষেরই লাভ। যাদের ভিসার মেয়াদ এমনিতে কয়েক বছর মাত্র, তাদের পক্ষে চমৎকার ডিল।

 

ওদের মধ্যে সবচেয়ে সাকসেসফুল নিঃসন্দেহে ত্রিদিব সাকসেস যদি টাকার হিসেবে হয়। একমাত্র ত্রিদিবেরই গ্রিন কার্ড আছে, অর্থাৎ পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট। সম্ভবত এখন সিটিজেন, দশ বছর হল এদেশে আছে। আটটা খুব চালু ওষুধের দোকান, টি-কে ফার্মাসি-র মালিক। এখন ফ্র্যাঞ্চাইজিং বিজনেসে নেমেছে। টি-কে ফার্মাসি ব্র্যান্ড নেম দিয়ে আরও অনেকগুলো ফার্মাসি ছোটো ছোটো শহরে খোলা হচ্ছে। এগুলোর মালিক হবে বিভিন্ন লোক, কিন্তু টি-কে ফার্মাসির গুড উইল আর ফার্মাসির বিশাল ওষুধের স্টক ব্যবহার করতে পারার সুবিধার জন্য মোটা রকম লাইসেন্স ফি ত্রিদিবকে দিচ্ছে।… হয়তো আরও অনেক সুবিধা এর সঙ্গে জড়িত, অনিন্দ্য সবটা জানে না বা বুঝতে পারে না।

 

অনিন্দ্যের কথাবার্তায় এটুকু বুঝলাম অনিন্দ্য ত্রিদিবকে খুব একটা পছন্দ করে না। সরাসরি অবশ্য কিছু বলল না। কথায় কথায় জানাল, ত্রিদিবের স্ত্রী ত্রিদিবকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। বলেই বোধহয় একটু লজ্জা পেল। “নানা কারণেই তো একজনকে ছেড়ে আরেকজন চলে যেতে পারে, তাই না?”

 

অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ। আমরা তিনজনেই চুপ। এরপর যেটা বলল, সেটা আরও কনফিউসিং। ত্রিদিব খুবই পপুলার, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে।

 

এটা শোনার পর, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগবে, সেটাই কি ওর স্ত্রী-র ওকে ছেড়ে যাবার কারণ?

 

এ নিয়ে প্রশ্ন করাটা শোভন নয়। তবে বন্ধু-পত্নীদের ওকে পছন্দ করার কারণটা পরে স্পষ্ট হল। ত্রিদিব বেশ কয়েকজন বন্ধুর স্ত্রীকে চাকরি দিয়েছে। অরবিন্দের স্ত্রী, অজয়ের স্ত্রী এবং আরও দু-একজনকে। এমনিতে এই সব স্ত্রীদের ডিপেন্ডেন্ট ভিসা, স্বামীর ডিপেন্ডেন্ট হিসেবে এসেছে বলে। ওই ভিসায় কেউ চাকরি করতে পারে না। অথচ সকলেই ওয়েল এজুকেটেড। দেশে অনেকেই চাকরি করত, রোজগারও মন্দ করত না। এখানে এসে কাজকর্ম না করে বসে থাকাটা সবার পক্ষেই কষ্টকর! ত্রিদিব ওর কোম্পানিতে সবাইকে কাজে লাগিয়েছে। কাগজে কলমে নয়, সেটা করা বে-আইনি। ক্যাশ টাকা দেয় মাইনের বদলে। দু-নম্বরি খাতার ব্যাপার নিশ্চয়। কিন্তু অল অ্যামং ফ্রেন্ডস, এই নিয়ে কেউ কিছু বলে না।

 

 

চার

ন’দিন বাদে সোমবার সকালে যে খবরটা পেলাম সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। ফোন করেছিল দীপেন। খুবই উত্তেজিত!

 

“অনিন্দ্য খুন হয়েছে!”

 

“অনিন্দ্য মানে! আমাদের অনিন্দ্য? গত সপ্তাহে যার কাছে খেতে গিয়েছিলাম?”

 

“হ্যাঁ, সেই।”

 

“তুই শিওর?”

 

“একটু আগেই লোকাল নিউজে বলল। ওর বাড়ির সামনে থেকে রিপোর্ট করছিল। সকালবেলায় বাড়িতে ওর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। যে মেয়েটি অনিন্দ্যর বাড়ি পরিষ্কার করতে আসে, সেই ওর বডিটা দেখতে পায়। তবে খুন কি না বলেনি। কিন্তু আত্মহত্যা কেন করতে যাবে ও? ফোর্ডের পুলিশ তদন্ত করছে। প্রতিবেশীরা কেউই অনিন্দ্যের সম্পর্কে বিশেষ জানে না। পুলিশ ওর পরিচিতদের খুঁজছে যারা অনিন্দ্য সম্পর্কে কিছু খবর পুলিশকে দিতে পারে।”

 

“ও মাই গড!”

 

“অজয়ের কাছ থেকে এখুনি ফোন পেলাম। কিশোর অজয়কে এর মধ্যেই ফোন করেছে। অবভিয়াসলি বন্ধুরা সবাই খুবই আপসেট আর ভয়ও পেয়েছে। এইসবের মধ্যে কোনো মতে জড়িয়ে পড়লে, কী হবে সেই সব ভেবে। একেনবাবু কি উডব্রিজ পুলিশ ফোর্সের কাউকে চেনেন?”

 

আমি বললাম, “ওদের পুলিশ চিফকে একেনবাবু চেনেন। তুই দাঁড়া, আমি একেনবাবুকে দিচ্ছি।”

 

প্রমথ আর একেনবাবু রান্নাঘরে। প্রমথ কফি বানাচ্ছিল, একেনবাবু সঙ্গ দিচ্ছিলেন। আমি ফোনটা নিয়ে একেনবাবুর হাতে দিয়ে বললাম, “অনিন্দ্য খুন হয়েছে, দীপেন ফোনে।”

 

“সেকি স্যার!” একেনবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন। তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, কখন এটা ঘটল?” দীপেন কী বলছিল আমি শুনতে পারছিলাম না।

 

“..ঠিক আছে স্যার। আমি ওখানকার পুলিশ চিফকে খুব ভালো করে চিনি। যোগাযোগ করব। আগে বাপিবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।”

 

ওদিক থেকে উত্তেজিত দীপেন কী বলছে শুনতে পেলাম না। একেনবাবু কিছুক্ষণ হ্যাঁ হুঁ করলেন। শেষে বললেন, “ভাববেন না স্যার, আমি খোঁজ নিচ্ছি।”

 

ফোন শেষ হলে প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “কী শুনলেন দীপেনের কাছে?”

 

“ডিটেল দীপেনবাবু খুব একটা জানেন না। সকালে টিভি-তে শুনেছেন গুলি লেগে মারা গেছেন। পুলিশ এখনও বলেনি, খুন না সুইসাইড। দীপেনবাবুর ধারণা খুন।”

 

“সেটা ধারণা করার কারণ?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

 

“জানি না স্যার। উনি এত আপসেট, সে প্রশ্নটা করিনি। আসলে এগুলো সামনাসামনি জিজ্ঞেস করাটাই ভালো। কিন্তু তার আগে স্যার একবার মিস্টার জ্যাককে ফোন করি।”

 

“জ্যাক, মানে ওখানকার পুলিশ চিফ?”

 

“হ্যাঁ, স্যার। আগেও বেশ কয়েকবার বলেছেন ওঁর অফিসে যেতে। সুতরাং অভ্যর্থনা পাব।”

 

“বিনে পয়সায় আপনার হেল্প পেলে, কোন ছাগল অভ্যর্থনা করবে না।”

 

“কী যে বলেন স্যার, মিস্টার জ্যাক সে-রকম লোকই নন।”

 

এবার আমার মনে পড়ে গেল জ্যাককে। ক্রু-কাট করা দোহারা চেহারা মাঝারি হাইটের একটা ছেলে। ছেলেই বলছি আমাদের থেকে একটু ছোটোই হবে। ওকে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের ল্যাংবোট বলতাম।

 

“আপনি কি আজ ওর ওখানে যাবার কথা ভাবছেন?”

 

“আমার ভাবনা তো স্যার শুধু ভাবনা। আপনি ‘হ্যাঁ’ বললে তবেই না কিছু হয়!”

 

এটা বলার কারণ, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে আমিই শুধু গাড়িধারী। একেনবাবু হাড় কিপ্পন, মরে গেলেও গাড়ি কিনবেন না। প্রমথ এমনিতে খরচে, কিন্তু ওর বক্তব্য এক বাড়িতে দুটো গাড়ি থাকার অর্থ নেই। ও নিয়ে কিছু বললেই বলে, তোর তো একটা আছে। পেট্রলের খরচা আমি শেয়ার করব। আচ্ছা, সেটা কি চাওয়া যায়! আমি অবশ্য বিরক্ত হই না। মেহনতের কাজ ও অনেক করে… রান্না করা, বাজার করা, ঘর পরিষ্কার ইত্যাদি। তার জন্য অবশ্য আমাদের সাহায্য করতে হয়, কিন্তু উদ্যোগটা ওর। আর ওদের জন্য গাড়ি বার করতে হয় কালেভদ্রে, ম্যানহাটানের বাইরে যখন যাই– নিউ জার্সি, কুইন্স, কানেক্টিকাট, এইসব জায়গায়।

 

কলেজ থাকলেও আজ আমার ক্লাস নেই, অর্থাৎ যাওয়ার অসুবিধা নেই। প্রমথ যে প্রমথ যাকে ল্যাব থেকে সরানো যায় না, ও-ও দেখলাম রাজি। একেনবাবু জ্যাককে ফোন করলেন। জ্যাক খুবই খুশি। জ্যাক নিজেই নাকি একেনবাবুকে ফোন করতে যাচ্ছিল সাহায্য চেয়ে। শুধু ভাবছিল ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে দিয়ে অনুরোধটা করাবে কিনা। আসলে উডব্রিজ-এর ইন্ডিয়ান কম্যুনিটি খুবই বর্ধিষ্ণু। ওখানেই হল ওক ট্রি রোড, যেটাকে বলা হয় লিটল ইন্ডিয়া। সেই রাস্তার দু-ধারে সারি সারি দেশি দোকান, যেখান থেকে উডব্রিজ শহরের প্রচুর আয়। মেয়র থেকে শুরু করে সিটি কাউন্সিলের সবাই দেশিদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়। যদি কেউ ভেবে বসে দেশি বলে পুলিশ তদন্তে গাফিলতি করছে, তাহলে ঝামেলা। জ্যাককে তাই মেয়রের নির্দেশ যত দ্রুত সম্ভব ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করার।

 

দীপেনকে ফোন করে বললাম, একেনবাবুকে নিয়ে আমরা আসছি। প্রথমে পুলিশ চিফের কাছে তারপর ওর বাড়িতে ঢু মারব।

 

 

পাঁচ

জ্যাকের অফিসে যেতেই হ্যান্ডশেক করে আমাদের একটা ছোট্ট কনফারেন্স রুমে নিয়ে গেল। ঘরটা ড্রিপ-কফির গন্ধে ম-ম করছে। প্রচুর ডোনাট আর ডেনিশ পেস্ট্রি সাইড টেবিলে সাজানো। ঘরে ঢুকে হড়বড় করে একেনবাবুকে বলল, “আপনার সাহায্য আমাদের ভীষণ ভাবে দরকার, উডব্রিজের পুলিশ গোয়েন্দা ডিপার্টমেন্ট খুবই ছোটো, একজন মাত্র ডিটেকটিভ। দুটো মার্ডার নিয়ে তার নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। তার ওপর এই মার্ডার। মেয়র নিজে এই খুনটাতে বিশেষ ভাবে ইন্টারেস্ট নিচ্ছেন। আমি আপনার কথা ওঁকে বলেছি। উনি চান আপনি কনসাল্টেন্ট হিসেবে সাহায্য করুন। আমরা এজন্য যথাযোগ্য পারিশ্রমিক আপনাকে দিতে পারব। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আপনাকে কী দিতেন আমি জানি না, কিন্তু আমি নিশ্চিত, এখানে আমরা যা দিতে পারব, সেটা তার থেকে বেশি ছাড়া কম হবে না। তাছাড়া এটা ম্যানহাটান থেকে অনেক দূরে, তারজন্য একটা কনভেনিয়েন্স অ্যালান্সও মেয়র দেবেন বলে জানিয়েছেন।”

 

“কী যে বলেন স্যার। যিনি মারা গেছেন তিনি আমাদের পরিচিত, তাঁর সম্মানেই তো আমি সাহায্য করতাম।”

 

“এটা শুধু সাহায্য নয়, পুরো দায়িত্বই আপনার। আপনাকে আমরা একটা টেম্পোরারি ব্যাজ দিচ্ছি।”

 

জ্যাক একেবারে প্রস্তুত হয়েই ছিল, পকেট থেকে বার করে একেনবাবুকে একটা ব্যাজ আর একটা খাম দিল। এর মধ্যে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আছে। এই কনফারেন্স রুমটা আপনার টেম্পোরারি অফিস।

 

মূহুর্তের মধ্যে সব কিছু অফিশিয়াল!

 

“আরেকটা কথা স্যার, বাপিবাবু, প্রমথবাবু আর আমি, আমরা তিনজনের একটা টিম। ওঁরা কিন্তু আমার কাজের মধ্যে থাকবেন, নইলে আমি নেই।”

 

জ্যাক মনে হল এতে একটু প্যাঁচে পড়েছে। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “ঠিক আছে, আন-অফিশিয়াল।”

 

“তা তো বটেই। ও আরেকটা কথা স্যার, আমার তো গাড়ি নেই, আর বাপিবাবুকে তো প্রতিদিন আসতে বলতে পারি না।”

 

“আপনার সারথি এখানেই আছে,” বলে কাকে জানি ইন্টারকম-এ আসতে বললেন। এক মিনিটের মধ্যে গোলগাল বেঁটে মতো একজন ইউনিফর্মধারী কনফারেন্স রুমে এসে হাজির।

 

“এ হল সার্জেন্ট আর্মান্ডো গার্সিয়া। আর্মান্ডোই তদন্ত শুরু করেছিল। এখন থেকে অফিশিয়ালি আপনাকে সাহায্য করবে। যেখানে যাঁদের কাছে যেতে চান, ও নিয়ে যাবে।”

 

স্প্যানিশ পদবি, নামের উচ্চারণ হওয়া উচিত আর্মান্দো। তাই আর্মান্দো বলেই এখানে লিখছি। আর্মান্দোর উচ্চারণে একটা পরিষ্কার বিদেশি টান আছে। জ্যাক একেনবাবু সম্পর্কে আর্মান্দোকে কী বলেছে জানি না, কিন্তু অত্যন্ত সম্ভ্রম করে সে কথা বলছে দেখলাম। আরেকটা স্বভাব দেখে মজা লাগল। শুধু একেনবাবু নয়, সবার নামের আগেই একটা করে মিস্টার জুড়ছে। যাক গে, অপ্রাসঙ্গিক কথাগুলো বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। জ্যাক একেনবাবুকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ধরিয়ে দিয়ে, কী একটা কাজে অদৃশ্য হল।

 

একেনবাবু আর্মান্দোকে বললেন, “আমি তো ব্যাপারটা সম্পর্কে বিশেষ প্রায় কিছুই জানি না, টেলিভিশনে যা বলা হয়েছে সেটুকুই শুধু জানি। একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দেবেন স্যার?”

 

“নিশ্চয় মিস্টার একেন,” আর্মান্দো ওর নোটবই খুলে পড়ে পড়ে বলতে লাগল। “আজ সকাল আটটা বেজে পাঁচ মিনিটে আমরা মিস্টার কিশোর বলে একজনের ফোন পাই। তিনি জানান ওঁর মনে হচ্ছে ওঁর বন্ধু মিস্টার অনিন্দ্য খুন হয়েছেন। কোথায়, প্রশ্ন করতে আমাদের ঠিকানা দেন। আমরা ওঁকে আমাদের না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলি। অকুস্থলে গিয়ে দেখি মিস্টার কিশোর বাড়ির বাইরে ভীষণ নার্ভাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দরজা খোলাই ছিল। ওঁকে বাইরে দাঁড়াতে বলে আমরা বাড়িতে ঢুকি। মিস্টার অনিন্দ্য সোফার কাছে মেঝেতে পড়ে আছেন, বুকের শার্ট রক্তে ভেজা, কার্পেটেও রক্ত। ঘরটা দেখে মনে হল না কোনো কিছু তছনছ হয়েছে। বাইরের ঘর, বাথরুম, কিচেন, হোম-অফিস, দুটো বেডরুম, সবগুলোই ঠিকঠাকই আছে। এটা ডাকাতি নয়। পুলিশের ডাক্তার আমাদের সঙ্গে ছিলেন। রিগোর মর্টিস দেখে যা মনে হয়েছে গত রাত্রে সম্ভবত আটটা থেকে বারোটার মধ্যে কোনো এক সময়ে মৃত্যু হয়েছে। গুলি চালানো হয়েছে খুব কাছ থেকে। নাইন মিলিমিটার বুলেট। দরজার তালা অটুট। অর্থাৎ আততায়ীকে মিস্টার অনিন্দ্য চিনতেন। ঘরে ঢুকতে দিয়েছিলেন। মিস্টার অনিন্দ্যর একটি কুকুর ছিল, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

 

“এখন পর্যন্ত আমরা শুধু মিস্টার কিশোরের সঙ্গেই কথা বলেছি। তাঁর বয়ান অনুসারে গতকাল এঁদের এক বন্ধু, মিস্টার অরিন্দমের বিবাহবার্ষিকীর পার্টি ছিল উডব্রিজের নিউ হিলটন হোটেলে। মিস্টার অনিন্দ্যও নিমন্ত্রিত ছিলেন। মিস্টার কিশোরও সেই পার্টিতে ছিলেন। ন’টা বেজে গেছে তাও অনিন্দ্য আসছেন না দেখে মিস্টার কিশোর নিউ হিলটন থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে অনিন্দ্যকে ফোন করেন, কিন্তু ফোন বেজেই যায়। বাড়ি ফিরে রাত্রি বারোটার সময় আবার মিস্টার কিশোর মিস্টার অনিন্দ্যকে ফোন করেন, তখনও নো রিপ্লাই। আজ অফিস যাবার পথে মিস্টার কিশোর মিস্টার অনিন্দ্যর বাড়িতে থামেন। মিস্টার কিশোরের কাছে মিস্টার অনিন্দ্যর বাড়ির চাবি থাকে। বেল বাজিয়ে কেউ খুলছে না দেখে উনি চাবি দিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে দেখেন দরজা খোলা। তখনই ঘরে ঢুকে মিস্টার অনিন্দ্যর রক্তাক্ত দেহ মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ফোন করেন।

 

“মিস্টার কিশোর অবশ্য ভেবেছিলেন অনিন্দ্যর পার্টিতে না আসার কারণ গত সপ্তাহে ওঁদের এক বন্ধু, মিস্টার ত্রিদিবের বাড়ির এক পার্টিতে ঝগড়ার ফল। সেখানে আরেক বন্ধু, মিস্টার অজয়ের সঙ্গে মিস্টার অনিন্দ্যর একটা বিশ্রী ঝগড়া মেটাতে অন্য এক বন্ধু, মিস্টার অরিন্দমও জড়িয়ে পড়েছিলেন।”

 

বেচারা আর্মান্দো! থেমে থেমে এই বাঙালি নামগুলো উচ্চারণ করতে হিমশিম খাচ্ছিল। “সরি, অনেকগুলো ক্যারেক্টার এখানে, নামগুলো কি আরেকবার শুনবেন মিস্টার একেন?”

 

“না না স্যার, আমি দিব্বি বুঝতে পারছি। আপনি বলে যান।”

 

“ও হ্যাঁ,” নোটবুক খুলে, আর্মান্দো আবার শুরু করল। “মিস্টার অজয় আর মিস্টার অনিন্দ্য ঝগড়া করছিলেন। আর মিস্টার অরিন্দমও তাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মদ খেয়ে অবশ্য বন্ধুদের মধ্যে এ-রকম চেঁচামেচি আগেও হয়েছে। কিন্তু সেদিনের ওই ঝগড়াটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের। দু-জনে বেসমেন্টের পার্টিরুম থেকে বেরিয়ে ঝগড়া চালাতে ওপরের একটা ঘরে গিয়েছিলেন। ঝগড়ার কারণ মিস্টার কিশোর ঠিক জানেন না। মিস্টার অরিন্দমও ওপরে গিয়েছিলেন ওঁদের মিটমাট করাতে, কিন্তু পারেননি। মিস্টার অনিন্দ্য রাগ করে মিস্টার ত্রিদিবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। মিস্টার অজয় এত রেগে গিয়েছিলেন যে গর্জাচ্ছিলেন, ‘আই উইল কিল দ্যাট স্কাউন্ড্রেল। খানিক বাদে অবশ্য মিস্টার অজয় শান্ত হন, কিন্তু ঝগড়ার কারণটা বিশদ করেন না। প্রাইভেট ব্যাপার মনে করে কেউই আর চাপাচাপি করেননি।”

 

এবার নোটবই বন্ধ করে আর্মান্দো যোগ করল, “এ নিয়ে আর বিশেষ কিছু এগোয়নি, কারণ চিফ ওকে বলেছিলেন মিস্টার একেন তদন্তের দায়িত্ব নেবেন। তবে একজন সাসস্পেক্ট নিশ্চয় মিস্টার অজয়, কারণ তিনি মিস্টার অনিন্দ্যকে খুন করার কথা বলেছিলেন।”

 

“বুঝলাম স্যার। প্রথমত আমার মিস্টার কিশোরের কনট্যাক্ট নম্বর লাগবে। ভালো কথা, কুকুরটার খবর পাওয়া গেছে কি?”

 

“ও হ্যাঁ। একটু আগেই জানতে পেরেছি। কুকুরটা মিস্টার অনিন্দ্যর এক প্রতিবেশীর বাড়িতে আছে। প্রতিবেশীর মেয়েটি অনেক রাত্রে ওকে বাইরে দেখে বাড়িতে নিয়ে যায়। মিস্টার অনিন্দ্য যখন অফিসে থাকতেন, ওই মেয়েটিই কুকুরটিকে দেখাশোনা করত। দুপুরে খেতে দিত, হাঁটাত, ওর সঙ্গে খেলত। মিস্টার অনিন্দ্য ট্যুরে গেলে প্রতিবেশীর বাড়িতেই কুকুরটি থাকত। প্রতিবেশীর নাম ডনাল্ড ফোর্ড, মেয়েটির নাম আইলীন।”

 

“একটা কথা স্যার, এই প্রতিবেশী এতো রাত্রে কুকুরটা বাইরে ঘুরছে দেখে বাড়িতে ঢুকে খোঁজ করেনি?”

 

“এ-রকম আগেও ঘটেছে স্যার। মিস্টার অনিন্দ্য কুকুরকে বাইরে ছেড়ে দিয়ে খুব দেরি করে বাড়ি ফিরেছেন। এঁদের মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে। কুকুরটা কান্নাকাটি করলে ওঁরা ঘরে নিয়ে আসেন। তবে একটা কথা প্রতিবেশীর মতে ন’টার সময়ও কুকুরটা বাইরে ছিল না। ওঁরা তখন বাইরে যাচ্ছিলেন। ফিরেছিলেন রাত এগারোটা নাগাদ। ধরে নিচ্ছি খুনি যখন ঘরে ঢুকেছিল, তখনই কুকুরটা নিশ্চয় বেরিয়ে আসে। সেক্ষেত্রে খুনটা ন’টার পরে ঘটেছে।”

 

“এই দু-জনের নম্বর আমার লাগবে স্যার।”

 

আর্মান্দো আইলীন আর কিশোর দু-জনের নম্বরই দিল।

 

একেনবাবুর অনুরোধে আর্মান্দোই কিশোরকে ফোন করল। একেনবাবুর নাম করতেই কিশোর বোধহয় বলল, “আমি ওঁকে চিনি।”

 

তারমানে দুর্গাপুজোতেই পরিচয় হয়েছিল, শুধু মনে করতে পারছিলাম না! আর্মান্দোর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে একেনবাবু বললেন, “স্যার, কেমন আছেন?”

 

উত্তরটা অবশ্য শুনতে পেলাম না। সংক্ষেপে অনিন্দ্যর মৃত্যুর ব্যাপারে ওঁকে কী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বুঝিয়ে বললেন। তারপর জানতে চাইলেন, অজয় আর অরিন্দমের ফোন নম্বরটা।

 

আর্মান্দোকে অজয়ের নম্বরটা দিয়ে বললেন, “এঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। এখানে বলতে পারলেই ভালো হয়।”

 

আর্মান্দো কিন্তু কনফারেন্স রুম থেকে অজয়কে ফোন করল না। নম্বরটা নিয়ে কনফারেন্স রুমের বাইরে যেতেই, আমি আস্তে করে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কি করা যায়? অজয় তো উডব্রিজে থাকে না!”

 

একেনবাবু কিছু বলার আগেই প্রমথ বলে উঠল, “নিউ ইয়র্কে তো করা যায়। ধরে নিচ্ছি নিউ জার্সিতেও যায়। না করা গেলে আর্মান্দোই বলবে, তুই এতো চিন্তা করছিস কেনা!”

 

কয়েক মিনিটের মধ্যেই আর্মান্দো ফিরে এল। “মিস্টার অজয় মিনিট পনেরোর মধ্যে এখানে আসছেন। আপনারা এখানেই বসুন। উনি এলেই আমি এখানে নিয়ে আসব।”

 

বসে বসে কী আর করব! মিনিট পনেরো ধরে আমরা কফি আর কিছু ডোনাট ধ্বংস করলাম। সত্যি কথা বলতে কী, খাচ্ছিলাম ঠিকই কিন্তু মনটা বিষয়। সাতদিন আগে যার বাড়িতে হইহই করে গল্প করে গেলাম, সে আজ নেই! আজ একেনবাবুর ডাক পড়েছে তার খুনিকে খুঁজে বার করার! বার বার অনিন্দ্যর মুখটা মনে পড়ছিল। সত্যি, আমাদের জীবনটা কী ফ্র্যাজাইল!

 

পনেরো মিনিটও বসতে হল না, আর্মান্দো অজয়কে নিয়ে ঘরে ঢুকল। চোখেমুখে খুবই অস্বস্তি, খানিকটা ভয়ও। পুলিশ স্টেশনের কনফারেন্স রুমে আমাদের দেখে দারুণ বিস্মিত! আর্মান্দো বলল, “মিস্টার একেন আমাদের কনসাল্টেন্ট ডিটেকটিভ, উনিই মিস্টার অনিন্দ্যর মৃত্যুতে তদন্ত করছেন। উনিই প্রশ্ন করবেন।”

 

আমার কেন জানি মনে হল একেনবাবু তদন্ত করছে শুনে অজয় একটু ভরসা পেল। বলল, “বিশ্বাস করুন একেনবাবু, আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। এই কয়েক ঘণ্টা আগে কিশোর ফোন করে বলল অনিন্দ্যর ডেডবডি বাড়িতে পড়ে আছে! ও সেখানেই আছে, পুলিশকে খবর দিয়েছে। পুলিশ হয়তো আমাদের সবাইকেই জেরা করবে। আমি তখন অন্য বন্ধুদের ফোন করে খবরটা জানাই। তারাও আমার মতোই শকড।”

 

“তা তো বুঝলাম স্যার, কিন্তু আপনি ফোন পেয়েও ওখানে গেলেন না যে?”

 

“আমি যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অনিন্দিতা, মানে আমার স্ত্রী বলল, “তুমি পৌঁছোবার আগেই পুলিশ এসে জায়গাটা সিল করে দেবে। বরং তুমি বাড়িতেই থাকো, দরকার হলে পুলিশ নিশ্চয় সবার সঙ্গে কথা বলবে।”

 

“বুঝলাম স্যার। আচ্ছা, গতকাল আপনাদের বন্ধুদের একটা পার্টি ছিল হিলটনে, ঠিক কি?”

 

“হ্যাঁ, অরিন্দমের ওয়েডিং অ্যানিভার্সারির পার্টি।”

 

“সেখানে অনিন্দ্যবাবুর আসার কথা ছিল না?”

 

“হ্যাঁ, আসার তো কথা ছিল…।”

 

“ধরে নিচ্ছি, উনি আসেননি।”

 

“না, আসেনি। ভেবেছিলাম কোনো বিশেষ কারণে হয়তো আটকা পড়েছে, যানজট, অফিসের কাজ, অসুস্থ বোধ করা, অনেক কিছুই হতে পারে। কিন্তু ফোন করেও ওকে ধরতে পারা যাচ্ছিল না।”

 

“আপনি ফোন করেছিলেন স্যার?”

 

“না, আমি করিনি। আসলে..” অজয় একটু ইতস্তত করে বলল, “আগের সপ্তাহে অনিন্দ্যর সঙ্গে আমার একটু ঝগড়াই হয়েছিল। দু-জনেই ড্রিঙ্ক করে একটু হাই হয়ে গিয়েছিলাম। অনিন্দ্য রাগ করে পার্টি ছেড়ে চলেও গিয়েছিল।”

 

“ঝগড়াটা ঠিক কী নিয়ে হয়েছিল স্যার?”

 

“ওটা একটা পার্সোনাল ব্যাপার।”

 

“আপনি নাকি স্যার ওঁকে খুন করবেন বলেছিলেন?”

 

কথাটা শুনে অজয়ের মুখটা কালো হয়ে গেল। “ওটা কথার কথা, হাই হয়ে থাকলে উলটোপালটা অনেক কথাই তো এসে যায় মুখে।”

 

“তা তো বটেই স্যার,” দেখলাম একেনবাবু এটা নিয়ে আর আলোচনা করলেন না।

 

“একটা প্রশ্ন স্যার, আপনি কি পার্ট চলার সময় সারাক্ষণই হিলটনে ছিলেন?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“একবারও বেরোননি স্যার?”

 

“একটু বেরিয়েছিলাম, আমার সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল। হিলটনের স্টেশনারি শপ-এ ছিল না। তাই বাইরের একটা দোকানে গিয়েছিলাম।”

 

“ক’টা নাগাদ বেরিয়েছিলেন স্যার আর কতক্ষণ বাইরে ছিলেন?”

 

“দোকানটা কাছেই ছিল, ‘স্টপ-এন-গো’–মিনিট দশেকের পথও নয়। কখন। বেরিয়েছি ঘড়ি ধরে বলতে পারব না। সাড়ে আটটা নাগাদ হবে।”

 

“কতক্ষণ বাইরে ছিলেন?”

 

“বড়োজোর মিনিট কুড়ি-পঁচিশ। একটু দেরি হয়েছিল দোকানে ভিড় ছিল বলে।”

 

“ঠিক আছে স্যার। আপাতত এইটুকুই থাক। পরে হয়তো আপনার সঙ্গে আরও কিছু কথা বলতে হতে পারে।”

 

অজয় যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “একটা কথা স্যার…।”

 

অজয় দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

 

“বলুন।”

 

“আপনার কি কোনো হ্যান্ডগান আছে?”

 

“হ্যাঁ, আছে।” প্রশ্নটাতে অজয়ের চোখে বিস্ময় এবং ভয়, দুটোই।

 

উত্তরটা শুনে আমি অবাক হলাম। আমার পরিচিতদের মধ্যে কারোর হ্যান্ডগান আছে জানা ছিল না।

 

একেনবাবু কিছু বলার আগে অজয় বলল, “গতবছর আমাদের বাড়িতে একটা বার্গারি হয়েছিল। আমার স্ত্রী খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তাই আত্মরক্ষার জন্য কিনেছিলাম।”

 

“তা তো বটেই স্যার। ঠিক আছে স্যার, পরে কথা হবে।”

 

.

 

অজয় চলে গেলে প্রমথ একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “ঝগড়ার কারণটা পার্সোনাল’ বলে এড়িয়ে গেল, আপনি চেপে ধরলেন না কেন?”

 

“কী লাভ হত স্যার, কিছু একটা বানিয়ে বলে দিতেন। ওগুলো তো ভেরিফাই করা কঠিন।”

 

আমারও মনে হল, অতি সহজে অজয়কে একেনবাবু ছেড়ে দিলেন। আর্মান্দো বাংলা বোঝে না, কিন্তু এতো চট করে ইন্টারোগেশন শেষ হয়ে গেল দেখে ও-ও যেন একটু অবাক!

 

একেনবাবু আর্মান্দোকে বললেন, “আমি একটু অনিন্দ্যবাবুর বাড়িতে যেতে চাই। সেখান থেকে এক বন্ধুর বাড়ি যাব।”

 

একেনবাবু আর্মান্দোর সঙ্গে পুলিশের গাড়িতে উঠলেন। আমি প্রমথকে নিয়ে চললাম অনিন্দ্যর বাড়ির দিকে। বাড়ির ঠিকানা আমার জিপিএস-এ ঢোকানোই ছিল। পুলিশ স্টেশনের কাছেই। মিনিট দশেক লাগল পৌঁছোতে।

 

ড্রাইভয়েতে দুটো গাড়ি। একটা নিশ্চয় আর্মান্দোর। আরেকটা কার? আগের দিন ড্রাইভওয়েতে গাড়ি থামাতে না থামাতে যে থাবা বাগিয়ে গাড়ির ওপর উঠে গাড়ির দরজার কাঁচে নাক লাগিয়ে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ফেলছিল, আজকে সেই খুশ নেই। তার মালিক বা বাবা অনিন্দ্যও নেই। বাড়ির সামনের বারান্দাটা পুলিশের হলুদ টেপ দিয়ে আটকানো। সামনে দু-জন পুলিশ দাঁড়িয়ে। বুঝলাম দ্বিতীয় গাড়িটা ওদেরই কারোর।

 

আর্মান্দোর সঙ্গে একেনবাবুর কী কথা হয়েছে জানি না। একেনবাবু আমাদের অপেক্ষা করতে বলে আর্মান্দোর সঙ্গে হলুদ ফিতে সরিয়ে অনিন্দ্যর বাড়িতে ঢুকলেন। কিন্তু বেশীক্ষণের জন্য নয়। খানিক বাদেই বেরিয়ে এসে বললেন, “চলুন স্যার, দীপেনবাবুর বাড়ি যাওয়া যাক।”

 

একেনবাবু গাড়িতে উঠতেই প্রমথ বলল, “কী ব্যাপার পুলিশের কাজ নিয়ে আমাদের পরিত্যাগ করলেন যে বড়ো?”

 

“কী যে বলেন স্যার, আপনারা সবাই আমার সঙ্গে তো আছেনই। আসলে আর্মান্দোর কর্তৃপক্ষ একটু ঝামেলা করছে … ভয় পাচ্ছে পুলিশের লোক ছাড়া তদন্তে অন্য কেউ থাকলে পরে কোর্টে গিয়ে ঝামেলা হবে।”

 

ন্যায্য কথা। প্রমথও আর কথা বাড়াল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝলেন বাড়িতে ঢুকে?”

 

“জ্যাক ঠিকই বলেছে। মনে হয় না রবারি বলে।”

 

“তাহলে খুনটা হল কেন? কেই-বা করল?”

 

“কে জানে স্যার!”

 

“আপনার কি মনে হয় বন্ধুদের কেউ? একজন সাসপেক্ট তো অজয়।” প্রমথ বলল।

 

“তিনটে জিনিস দরকার স্যার, মোটিভ, অপরচুনিটি আর মিনস। যে গুলিতে অনিন্দ্যবাবুর মৃত্যু ঘটেছে সেটা যদি অজয়বাবুর হ্যান্ডগান থেকে বেরিয়ে থাকে, তাহলে মিনস আছে। মোটিভও তো আছে মনে হচ্ছে, তবে সেটা কতটা স্ট্রং পরিষ্কার নয়। কিন্তু অপরচুনিটি পাওয়া যাচ্ছে না, যদি অজয়বাবুর কথা সত্যি হয়। অজয়বাবু বাইরে ছিলেন মিনিট কুড়ি-পঁচিশের জন্য। নিউ হিলটন হোটেল থেকে অনিন্দ্যবাবুর বাড়ি প্রায় মিনিট পনেরোর পথ, যদি সেখানে সোজা গিয়ে খুনও করে আসেন, তাহলেও তিরিশ মিনিট।”

 

“যাহা পঁচিশ, তাহাই তিরিশ। আর অজয় যে ঠিক বলছে, তার প্রমাণ কী, সেটা তো জানতে হবে?”

 

“ঠিক স্যার।”

 

“এবার তাহলে কী করবেন?”

 

“কী আর করব স্যার, দীপেনবাবুর বাড়ি গিয়ে ওঁর সঙ্গে লাঞ্চ খাব।”

 

 

ছয়

দীপেন চাইনিজ খাবার কিনে এনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বুঝতে পারছিলাম অনিন্দ্যর মৃত্যু ওকে খুবই নাড়া দিয়েছে। আমাদেরও খারাপ লাগছিল, কিন্তু চিলি চিকেন আর ফ্রায়েড রাইস-এর ডাক উপেক্ষা করা যায় না। দীপেন খুব অল্পই খেল। খেতে খেতেই একেনবাবু দীপেনকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, অজয়বাবু সম্পর্কে আপনি কী জানেন?”

 

“অজয়কে খুব ভালো করে চিনি বলব না। তবে এখানে এসে ওর বাড়িতেই প্রথম গিয়েছি। ওর স্ত্রী অনিন্দিতা যে দীপান্বিতার সঙ্গে কলেজে পড়ত বলেছিলাম বোধহয় আপনাকে।”

 

“হ্যাঁ স্যার, মনে হয় বলেছিলেন। তা কী করেন অজয়বাবু?”

 

“ইন্টারনেট সিকিউরিটির একটা কোম্পানিতে কাজ করে শুনেছি।”

 

“আচ্ছা, আপনি স্যার সেদিন এও বলেছিলেন… আপনার ফ্যামিলি বিরক্ত হন ওঁদের সঙ্গে মিশতে…।”

 

“ফ্যামিলি?”

 

“মানে তোর স্ত্রী দীপান্বিতা।” আমি বললাম, “একেনবাবু স্ত্রী-কে ফ্যামিলি বলেন।”

 

“ও আচ্ছা। আসলে দীপান্বিতা বেশি হই-হুঁল্লোড় পছন্দ করে না। শুনেছিলাম, বিচিত্রা ক্লাবের মধ্যেই অজয়দের একটা এক্সক্লিউসিভ গ্রুপ আছে। ওদের পার্টি, আড্ডা সব সেই গ্রুপের মধ্যে, আর পার্টিগুলো একটু ওয়াইল্ড হয়। মদ-টদ খেয়ে কে যে কী করে ঠিকঠিকানা নেই।”

 

“কার কাছ থেকে শুনেছিলেন স্যার?”

 

“অনিন্দ্যই কথায় কথায় একদিন বলেছিল।”

 

“অনিন্দ্যবাবু কি ওই গ্রুপে ছিলেন?”

 

“হ্যাঁ। তবে অনিন্দ্য অন্যদের সঙ্গেও আলাদা ভাবে মিশত। ইন ফ্যাক্ট, এখানে এসে অনিন্দ্যর বাড়িতেই আমরা সবচেয়ে বেশি গেছি। ট্যালেন্টেড ছেলে ছিল। রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসত। খুব ভালো স্কেচ করত। আমার আর দীপান্বিতার স্কেচ করেছিল একদিন। মিনিট পনেরোর মধ্যে আমাদের মুখটা এত সুন্দর করে আঁকল যে অবিশ্বাস্য!” বলতে বলতে চোখটা ওর সজল হলে উঠল।

 

“ওর নেগেটিভও নিশ্চয় কিছু ছিল স্যার।”

 

“তা ছিল, কাণ্ডজ্ঞান একটু কম।”

 

“মানে স্যার?”

 

“পেটে কথা রাখতে পারত না। যেটা বলার নয়, স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সেটা বলে ফেলত। বিশেষ করে পেটে একটু মদ পড়লে তো কথাই নেই। দীপান্বিতা তাতে অনেক সময়ে বিরক্ত হত, কিন্তু জানত ওর মনটা ভালো ছিল। সেইজন্য আমাদের যাতায়াতটা বন্ধ হয়নি।”

 

“আর কিশোরবাবু? তিনিও কি ওই গ্রুপের মধ্যে ছিলেন?”

 

“কোন গ্রুপ?”

 

“অজয়বাবুদের।”

 

“হ্যাঁ। কিশোরকে আমি তেমন চিনি না, তবে ও অনিন্দ্যর খুব ভালো বন্ধু ছিল, আর ভালো ছবি তুলত।”

 

“হ্যাঁ, উনিই স্যার অনিন্দ্যবাবুর ডেডবডি আবিষ্কার করেছিলেন।”

 

“অজয় তাই বলল। আরও বলল, আপনি তদন্ত করছেন এই মার্ডারের। একটু আগে ওর সঙ্গে থানায় কথাও বলেছেন।”

 

“তা একটু সাহায্য করছি স্যার।”

 

“অজয় কিন্তু খুব নার্ভাস, আপনি ওর আর অনিন্দ্যর ঝগড়া নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন দেখে।”

 

“আরে না স্যার ঝগড়া তো সব সময়েই হয় বন্ধুদের মধ্যে।”

 

“তা না, অজয় বলল, সবাই একটু হাই হয়েছিল ত্রিদিবের বাড়িতে, সেইজন্য খুন-টুন করার কথা তুলেছিল… আসলে ড্রাঙ্ক হলে কে যে কী বলে! ওর খুব চিন্তা আপনি সেটা কী ভাবে নিয়েছেন। এমনিতে ও আমাকে ফোন করে না। আজ এই নিয়ে দু-বার। বাপি আর প্রমথ আমার ছেলেবেলার বন্ধু আর আপনারা সবাই একসঙ্গে থাকেন জেনেই ফোনটা করেছিল মনে হয়।”

 

“উনি খামোখা ভয় পাচ্ছেন স্যার। তবে আরও দুয়েকটা প্রশ্ন ছিল… ওঁর সঙ্গে দেখা হলে ভালোই লাগত। আর থানায় প্রশ্ন করছি না বলে কথা বলতে উনি হয়তো রিল্যাক্স বোধ করবেন।”

 

“দাঁড়ান, দেখছি বাড়িতে আছে কিনা।” বলেই দীপেন ওয়াশরুমে গেল মুখ ধুতে। একটু বাদেই ফিরে এসে বলল, “অজয়কে ধরার চেষ্টা করলাম। একটা জরুরি দরকারে কাজে গেছে। অনিন্দিতা, মানে ওর স্ত্রী আপনাকে বিশেষ করে আসতে বলল। ও ভীষণ নার্ভাস, কিশোর ছাড়া একমাত্র অজয়কেই পুলিশ জেরা করছে দেখে!”

 

অজয়ের অ্যাপার্টমেন্ট খুব একটা দূরে নয়। আসলে মিডলসেক্স কাউন্টির ইস্ট ব্রান্সউইক, ব্রান্সউইক, র-ওয়ে ইত্যাদি শহরগুলো ঘেঁষাঘেঁষি করে একের পিঠে এক হয়ে রয়েছে। অনিন্দিতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পুজোয় দেখা হয়েছিল। চেহারাটা আবছা মনে ছিল। পুজোয় শাড়ি পরেছিলেন, আজকে জিনস আর মেরুন রঙের ট্যাঙ্ক টপ। প্রসাধন ছাড়াই আকর্ষণীয় চেহারা, তবে বোঝা যাচ্ছে খুবই নার্ভাস।

 

“অজয়কে ফোন করে বললাম আপনারা আসছেন। এমনিতে সোমবার ওর কাজের চাপ বেশি… তারওপর সকালে পুলিশ স্টেশনে যেতে হল। তাও চেষ্টা করবে আসতে।”

 

“না না, তার কোনো দরকার নেই ম্যাডাম।”

 

ম্যাডাম’ শুনে সবার যা রিয়্যাকশন অনিন্দিতার সেটাই হল।

 

প্রমথ বলল, “ওঁকে ঠেকাতে পারবেন না। শিশু বয়সের অভ্যাস।”

 

একটু যেন হাসলেন অনিন্দিতা। তারপর একটু থেমে থেমেই বললেন, “আপনারা বোধহয় ওকে সন্দেহ করছেন।” বলেই একেনবাবুর দিকে এক ঝলক তাকালেন।

 

“আরে কী মুশকিল ম্যাডাম, এতটুকু নয়! প্রশ্ন তো করতেই হয়।”

 

“হ্যাঁ ও বলল, অনিন্দ্যর সঙ্গে ওর ঝগড়া নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন।”

 

“তা চেয়েছিলাম, ম্যাডাম।”

 

“আসলে আমাদের পার্টিতে কেউ কেউ একটু বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেলে। অজয়ও ব্যতিক্রম নয়। তখন সাধারণ ব্যাপারও অসাধারণ হয়।”

 

“আপনি কি জানেন ম্যাডাম ব্যাপারটা কী?”

 

“আমি ঠিক জানি বলতে পারব না, তবে অনুমান করছি।”

 

“অনুমানটাই বলুন ম্যাডাম।”

 

দেখলাম অনিন্দিতা ইতস্তত করছেন। “দেখুন আমার এটা বলতে অসুবিধা নেই, কিন্তু অজয়ের পক্ষে এটা কারোর কাছ থেকে শোনা অত্যন্ত হার্টফুল।”

 

“ম্যাডাম, বুঝতে পারছি খুবই পার্সোনাল ব্যাপার, বললেও চলবে।”

 

“না, আমি বলব। অজয়ের কাছে এটা অসম্মান হতে পারে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা পরিষ্কার না হলে অজয়ের এই রাগের কারণটার অন্য রকম মানে করে ওকে এই খুনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হবে।” …হঠাৎ অনিন্দিতা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল।

 

অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, নির্বাক হয়ে থাকাই ভালো।

 

একটু চুপ করে একটা বড় শ্বাস নিয়ে অনিন্দিতা শুরু করল, “আমার শ্বশুরমশাইয়ের মেয়েদের ব্যাপারে একটা দুর্নাম ছিল। অজয় একজনকে মাসিমা বলত, পরে জেনেছি তিনি ছিলেন শ্বশুরমশাইয়ের রক্ষিতা। মাসিমা বাড়িতে আয় হয়ে এসেছিলেন আমার অসুস্থ শাশুড়ির সেবা করতে। অজয়ের বয়স যখন বছর পাঁচেক শাশুড়ি মারা যান। শাশুড়ির মৃত্যুর পরও মাসিমা বাড়িতে থেকে অজয়কে বড়ো করেন। আমার বিয়ের আগে আমাদের বাড়ির ধারণা ছিল উনি শাশুড়িমায়ের দূর সম্পর্কের দিদি বা বোন। যাহোক এসব কথা এখানে কারোর জানার কথা নয়। সেদিন পার্টিতে সবাই একটু ড্রাঙ্ক হয়েছিল। হঠাৎ কে আলোচনা শুরু করল মনে নেই… বিষয়টা হল, কেউই জোর করে বলতে পারে না কে তার আসল বাবা। শুধু তার মা-ই জানে ছেলের আসল বাবা কে। খুবই সিলি কথাবার্তা… হাসিঠাট্টা দিয়েই শুরু হয়েছিল। এমন সময়ে কে জানি বলল, “যাক, আসল মা কে জানলেই তো হল। কিছুর মধ্যে কিছু নয়, অনিন্দ্য হঠাৎ অজয়কে বলল, কিন্তু অনেকে তো জানে না তার আসল মা কে? সেক্ষেত্রে?” অজয় বলল, ‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’

 

অনিন্দ্য বলে উঠল, “মাসিমা যদি মা হয়?” এই নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু। কে জানি অজয়কে এর মধ্যে বোঝাবার চেষ্টা করল, “তুই এটা পার্সোনালি নিচ্ছিস কেন, তোর বাপ নিয়ে তো প্রশ্ন তুলছে না?’ এরপর আর তর্কাতর্কি নয়, রীতিমতো চিৎকার, গালাগাল আর ধাক্কাধাক্কি! আমরা মেয়েরা কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ত্রিদিব আর অরিন্দম দেখছিলাম ওদের সামলাবার চেষ্টা করছে। এই আস্তে, কী হচ্ছে মেয়েদের সামনে! কে কার কথা শোনে!

 

এরপর অজয় যখন অনিন্দ্যকে প্রায় টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, ত্রিদিব অরিন্দমকে পাঠাল ওদের সামলাতে। খানিক বাদে দেখি অনিন্দ্য একা ঘরে এসে ওর কোটটা নিয়ে কাউকে কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।”

 

“অজয়বাবু তখন কোথায় ছিলেন ম্যাডাম?”

 

“দরজার ঠিক বাইরে। অরিন্দম তখনও অজয়কে শান্ত করছে।”

 

“তখনই কি অজয়বাবু বলেছিলেন, “আই উইল কিল দ্যাট স্কাউন্ড্রেল?”

 

“হ্যাঁ, যখন অনিন্দ্য দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে।”

 

“কিশোরবাবু তখন কোথায় ছিলেন?”

 

“কিশোর পার্টির ছবি তুলছিল। ও খুব ছবি তুলতে ভালোবাসে, আমাদের সঙ্গেই বসেছিল। ত্রিদিবও আমাদের সঙ্গে ছিল। ও হোস্ট, হোস্টের দায়িত্ব পালন করছিল।”

 

একেনবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ম্যাডাম, আপনি যে কথাটা আমাদের বললেন। এটা কি এখানে আর কেউ জানে?”

 

“কোন কথাটা?”

 

“এই অজয়বাবুর মাসিমার ব্যাপারটা।”

 

“কারোরই তো জানার কথা নয়,” অনিন্দিতা বলল, “এখানকার সবার সঙ্গেই আমার পরিচয় এদেশে এসে।”

 

“আমি তো শুনেছিলাম দীপান্বিতা ম্যাডাম, মানে দীপেনবাবুর স্ত্রী আপনার সঙ্গে কলেজে পড়তেন?”

 

“ও হ্যাঁ, কিন্তু ও আমাকে চিনত বিয়ের আগে। এসব নিয়ে ওর সঙ্গে কোনো কথা আমার হয়নি।”

 

দীপান্বিতার প্রসঙ্গ আসায় দীপেন দেখলাম অস্বস্তি বোধ করছে।

 

“তোমাকে কি দীপান্বিতা কিছু বলেছিল এ বিষয়ে?” অনিন্দিতা প্রশ্ন করল দীপেনকে।

 

“না, না, আমি কিছুই জানি না,” ব্যস্ত হয়ে জবাব দিল দীপেন, “দীপান্বিতা কিছুই বলেনি এ ব্যাপারে।”

 

একেনবাবু দীপেনের উত্তর শুনে অনিন্দিতাকে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, আপনাদের ক’টা গাড়ি ম্যাডাম?”

 

অনিন্দিতা অবাক হয়ে তাকাল প্রশ্নের পারম্পর্য বোঝার চেষ্টা করতে।

 

“ক’টা গাড়ি!”

 

“হ্যাঁ, ম্যাডাম। এখানে, মানে নিউ জার্সিতে তো শুনেছি সবারই দুটো গাড়ি। এখানে বাস-টাস তো বেশি চলে না।”

 

“হ্যাঁ, আমাদের দুটো গাড়ি।”

 

“কোনটা অজয়বাবু চালান?”

 

“মার্সিডিজটা অজয় চালায়। একসঙ্গে কোথাও গেলে ওটাই আমরা নিই। আমি নিজে ছোটো গাড়িটা চালাই– সুবারু।”

 

“ম্যাডাম আপনার বাড়ির ঠিক সামনে তো দেখলাম একটা মার্সিডিজ।”

 

“ও হ্যাঁ, অজয় আজকে ছোটো গাড়িটা নিয়ে গেছে।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ, ম্যাডাম। পুলিশের একজন হয়তো একবার আসবে। তবে আমাকে যা বলেছেন, তা আবার বলার দরকার নেই। আমি শুধু একবার কিশোরবাবুর কাছে যাব। উনি কি খুব দূরে থাকেন?”

 

“না, না, একেবারেই না। আজকে ওকে পাবেনও, অফিস যায়নি। একটু আগেই আমার সঙ্গে কথা হল। আপনি একবার ফোন করুন না, যাতে বাড়িতে থাকে। ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে?”

 

“হ্যাঁ, ম্যাডাম। থ্যাঙ্ক ইউ, আমরা আজ আসি।”

 

একেনবাবুর পিছন পিছন আমরা বেরিয়ে এলাম। একেনবাবু কিশোরকে ফোন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এখন আসতে পারেন কিনা। উত্তর নিশ্চয়, হ্যাঁ।

 

একেনবাবু আমাদের বললেন, “এক সেকেন্ড স্যার, আমি আর্মান্দো সায়েবকে একটা ফোন করছি।” বলে আমাদের থেকে একটু আড়ালে গিয়ে আর্মান্দোর সঙ্গে দু-একটা কথা বললেন। ফিরে এসে দীপেনকে বললেন, “আপনার তাড়া নেই তো স্যার, তাহলে চলুন, কিশোরবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।”

 

“না, না, চলুন। এমনিতেই কিছু করবার আজ মন নেই।”

 

 

সাত

কিশোর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ও-ও মনে হল সকাল থেকেই বিধ্বস্ত হয়ে আছে। বার বার বলল, “কী যে হল, কিছু বুঝতে পারছেন একেনবাবু?”

 

“কনফিউসিং তো বটেই স্যার। তবে কি না আমি এসেছি, আপনার কাছে কিছু ছবি দেখতে।”

 

“মানে?”

 

“মানে স্যার, আমি শুনেছি আপনি খুব ভালো ফটোগ্রাফার। যেখানেই যান ছবি-টবি তোলেন।”

 

“ভালো ফটোগ্রাফার কিনা জানি না, ছবি তোলা আমার বহুদিনের হবি। এখন তো মোবাইলেও ভালো ছবি তোলা যায়। ভালো ক্যামেরারও দরকার হয় না।”

 

“আমি স্যার ছবি-টবি সে-রকম বুঝি না, আমি এসেছি শুধু পার্টির ছবি দেখতে?”

 

“কোন পার্টির?

 

“অরিন্দমবাবুর অ্যানিভার্সারির পার্টি। তুলেছিলেন ছবি সেখানে?”

 

“হ্যাঁ, তুলেছি… এই তো, বলে আলমারি থেকে ডিজিট্যাল ক্যামেরাটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, প্রায় চল্লিশটা ছবি তুলেছিলাম সেদিন।”

 

“সব ছবি আপনি তুলেছেন?”

 

“সব। এই ক্যামেরা আমি কাউকে ধরতে দিই না। কোনটে দেখতে চান?

 

“প্রথম দিকের ছবিগুলো। যদি অজয়বাবুর কোনো ছবি থাকে সেখানে?”

 

“আছে।” বলে ক্যামেরা থেকে খুঁজে খুঁজে ছবিগুলো বার করতে থাকল। প্রায় পাঁচটা ছবি। আলাদা নয়, গ্রুপের মধ্যে। ডার্ক স্যুট পরা অজয়, খুব সুন্দর ছবি। এগুলোকে একটু বড়ো করা যায় না?”

 

“কেন যাবে না? নিন, এইটে ক্লিক করতে থাকুন, আর এই বাটনটা ছবিকে সেন্টারিং করার জন্য। আর এইটে নেক্সট, এইখানে ক্লিক করলে পরের ফ্রেমের ছবিটা দেখতে পাবেন।”

 

“ক্যামেরাটা ধরব স্যার… মানে আপনি যে একটু আগে বললেন…।”

 

কিশোর এক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝল। তারপর একটু হেসেই বলল, “সেটা ছবি তোলার ব্যাপারে, ছবি দেখার ব্যাপারে নয়।”

 

প্রমথও একেনবাবুকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। একেনবাবু ঠিক কী দেখতে চান, বুঝলাম না। কিন্তু খুব মন দিয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকলেন। মাঝে মাঝে এত ম্যাগ্নিফাই করে ফেলছিলেন যে ছবির ছবিত্ব বলে কিছু থাকছিল না। হঠাৎ ছবি দেখা বন্ধ করে জিজ্ঞস করলেন, “ভালো কথা স্যার, অজয়বাবু নাকি কিছুক্ষণের জন্য পার্টি ছেড়ে বাইরে গিয়েছিলেন?”

 

“হ্যাঁ, সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল। সিগারেট এখনও ছাড়তে পারছে না। মাঝে মাঝেই ওকে ধুয়ো গিলতে হয়, বারণ করলেও শোনে না।”

 

“কতক্ষণ বাইরে ছিলেন উনি?”

 

“এক্সাক্টলি বলতে পারব না। না দাঁড়ান, বেরোনোর আগে আমাকে বলে গিয়েছিল। তখন সম্ভবত সাড়ে আটটা। তার একটু আগেও হতে পারে। কারণ আমার মনে আছে, হিলটনের কনভেনিয়েন্ট স্টোর-এ পায়নি। তাই ওকে বলেছিলাম, তাড়াতাড়ি যেতে। স্টপ এন-গো, ন’টায় বন্ধ হয়ে যায়। যদি সিগারেট ওখানে না পায় তাহলে আরও দূরে যেতে হবে।”

 

“কখন ফিরেছিলেন?”

 

“সাড়ে ন’টার অনেক আগেই হবে। কারণ অরিন্দমদের নাই অ্যানিভার্সারির কেক কাটিং ঠিক সাড়ে ন’টার সময় হবে প্ল্যান ছিল।”

 

“আপনার ঠিক মনে আছে, সাড়ে আটটায় বেরিয়েছিলেন?”

 

“সেটাই ধারণা, কিন্তু জোর করে বলতে পারব না, একটু অনুমান করছি। তাড়াতাড়ি ওকে যেতে বলেছিলাম, এটুকু মনে আছে। আর সাড়ে ন’টার আগে ফিরেছিল।”

 

“ঠিক আছে কেক কাটার ছবিগুলো দেখান।”

 

“নেক্সট বাটনটা ক্লিক করতে থাকুন পেয়ে যাবেন।”

 

“ও হ্যাঁ, তাই তো স্যার।”

 

একেনবাবু ক্লিক করে করে ছবিগুলো দেখছেন, মাঝে মাঝে খুট খুট করে এনলার্জ করছেন। আমার কিছুই করার নেই। সময় কাটাবার জন্য কিশোরের বইয়ের র‍্যাকের দিকে মন দিলাম। কিশোর মনে হল ট্র্যাভেল বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক। সারা র‍্যাক জুড়েই ট্র্যাভেল-এর বই। আমি ইজরায়েল ট্র্যাভেল-এর বইটা তুলে পাতা উলটোতে থাকলাম। একটু বাদে শুনি একেনবাবু জিজ্ঞেস করছেন, “আচ্ছা স্যার, এই ছবিগুলো কি আমায় ইমেল করতে পারেন?”

 

“সবগুলো?” কিশোরের গলায় একটু যেন বিস্ময়।

 

“সবগুলো তো অনেক সময় লাগবে। আপনি বরং ত্রিদিববাবুর, অরিন্দমবাবুর, অজয়বাবুর ছবিগুলো পাঠান। প্রথম দিকের আর কেক কাটার পরের দিকের।”

 

“আপনার ইমেল অ্যাড্রেসটা বলুন।”

 

অ্যাড্রেস বলা মাত্র কিশোর খুট খুট করে ছবিগুলো সিলেক্ট করে জিজ্ঞেস করল, “কী রকম রেসলুশন চান?”

 

“যত বেশি হয়, ততোই ভালো।”

 

“ঠিক আছে।” একটু বাদেই বলল, “চলে গেছে সব।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ।”

 

“আর আপনার সময় নষ্ট করব না। শুধু আর কয়েকটা প্রশ্ন, আপনি কি সারাক্ষণই পার্টিতে ছিলেন?”

 

“হ্যাঁ।

 

“শেষবার, মানে আজকে সকালটা বাদ দিলে… কবে গিয়েছিলেন অনিন্দ্যবাবুর বাড়িতে?”

 

“দিন দশেক আগে।”

 

“অজয়বাবু আর অনিন্দ্যবাবুর ঝগড়ার পর যাননি?”

 

“না, অফিসের কাজে দিন তিনেকের জন্য মিশিগান যেতে হয়েছিল। ফিরেছি বৃহস্পতিবার। ক্লান্ত ছিলাম, তবে ফোনে কথা হয়েছিল। তখনই বলল ও শুক্রবার পার্টিতে আসবে না। আমি অনেক বোঝানোর পর বলল, ঠিক আছে আসবে।”

 

“ঝগড়ার কারণটা জানতেন স্যার?”

 

“ফ্র্যাঙ্কলি না। সিলি কথাবার্তা হচ্ছিল। হঠাৎ অজয় চটে যায়। প্রাইভেট কোনো ব্যাপার নিশ্চয়, কিন্তু অতো রেগে যাবার কী কারণ বুঝিনি।”

 

“ও আরেকটা কথা স্যার, ত্রিদিববাবু আর অরিন্দমবাবুর নম্বরটা জানি না। আপনি একটু দেবেন?”

 

“নিশ্চয়।” কিশোর ফোন থেকে বার করে দুটো নম্বরই দিল।

 

“জানি না, আজ ওঁদের পাব কিনা…”।

 

“অরিন্দমকে পাবেন না। দু-দিনের ছুটি নিয়ে ওরা খুব ভোর বেলায় ওয়াশিংটন ডিসি তে গেছে। আমি যখন অনিন্দ্যর খবর জানাতে ফোন করেছি, তখন ওরা মেরিল্যান্ডে। তবে ত্রিদিবকে অফিসে পাবেন। ওর অফিস কাছেই। বাড়িও অফিস থেকে দূরে নয়। ও সাতদিনই কাজ করে।”

 

“অফিসটা কোথায়?”

 

“আমি অফিস বিল্ডিংটা জানি, অনেকগুলো অফিস ওখানে। ঠিক কোনটা জানি না।” দীপেন বলল।

 

“চেনার কোনো অসুবিধা নেই।” কিশোর বলল। “রিসার্ভ পার্কিং স্পেস-এ যেখানে অ্যালফা রোমিও গাড়ি দেখবেন, তার সামনের দরজা দিয়ে ঢুকলেই প্রথম অফিস হল ত্রিদিবের।”

 

অ্যালফা রোমিও নামটা বোধহয় একেনবাবু আগে শোনেননি। আমি বললাম, “খুব এক্সপেনসিভ গাড়ি, এই অঞ্চলে বেশি নেই।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, এখন চলি, পরে কথা হবে।” বলে কয়েক পা গিয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন।

 

“কাল পার্টি থেকে কখন ফিরলেন স্যার?”

 

“রাত সাড়ে এগারোটায়।”

 

“একা?”

 

“হ্যাঁ, একাই। মানে অজয় আমার সঙ্গে ছিল। অরিন্দম আর কেতকী খুব সকালে ডিসি চলে যাবে বলে আগের দিনই অজয় আর আমাকে বলে রেখেছিল পার্টির শেষে ক্লিন আপ-এ হেল্প করতে। আমরা তাই থেকে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে অজয়কে নামিয়ে বাড়ি ফিরি।”

 

“অনিন্দিতা ম্যাডাম?”

 

“ও অন্য কারো কাছ থেকে রাইড নেয়। সবাই তো আমরা কাছাকাছি থাকি।”

 

“তা তো বটেই স্যার।” বলে চলে যাবার জন্য আবার পা বাড়ালেন। তারপর একটু মাথা চুলকে আবার ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, আপনার তো স্যার আজ অফিস ছিল?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“কিন্তু আপনি তো স্যার যাননি?”

 

“আসলে আমি অফিসেই যাচ্ছিলাম। অনিন্দ্যকে কেন গত রাতে ফোনে ধরতে পারিনি মাথায় ছিল। তাই অফিস যাবার পথে ওর বাড়িতে থেমেছিলাম। তারপর ওই ভয়াবহ দৃশ্য! প্রথমে পুলিশে ফোন করি, তারপর অফিসেও জানিয়ে দিই যে আসতে পারব না… বন্ধু খুন হয়েছে।”

 

“আপনি জানতেন স্যার যে, অনিন্দ্যবাবু খুন হয়েছেন!”

 

“মানে?”

 

“আত্মহত্যাও তো হতে পারে স্যার?”

 

কথাটা শুনে কিশোর কেমন জানি হতবাক হয়ে গেল!

 

“মানে, আমি…।”

 

“ঠিক আছে স্যার, আপনি আপনার অনুমানের কথা বলেছেন, তাই তো?”

 

কিশোর মাথা নাড়ল।

 

কিশোরবাবুকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে একেনবাবু বেরিয়ে এলেন। আবার আর্মান্দোকে ফোন করলেন– এবারও আড়ালে গিয়ে। মনে হল বোধহয় দীপেনকে জানাতে চান না কথাগুলো। আমার আর প্রমথর কাছে এভাবে কিছু গোপন করেন না।

 

বিকেল প্রায় চারটে। একেনবাবুকে বললাম, “এরপর বেশি দেরি করলে টানেল বা হাইওয়ে যাই নিই না কেন ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ব।”

 

“না না স্যার, আমরা দীপেনবাবুর বাড়ি থেকে সোজা বেরিয়ে পড়ব।”

 

“কালকে এখানে আসবেন কী করে, আমার কিন্তু কালকে ক্লাস!”

 

“স্যার, কালকের কথা কালকে। এখন তো বাড়ি যাই।”

 

দীপেন চা খেয়ে যেতে বলল। কিন্তু ওকে ‘না’ বলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ফেরার পথে প্রমথ বলল, “সত্যি গা জ্বলে যায়, গণ্ডমূর্খ ব্যাটা ত্রিদিব অ্যালফা রোমিও চড়ছে, আর আমাকে বাপির এই ঝাড়ঝাড়ে টয়োটাতে ঝাঁকুনি খেতে খেতে যেতে হচ্ছে!”

 

“দেখছেন একেনবাবু, আমার গাড়িতে যাচ্ছে আবার গালমন্দও করছে।”

 

“এই গাড়ি স্যার কিছুমাত্র খারাপ না। ফাংশানাল স্যার, গাড়ি তো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবার জন্য। দিব্যি তো চলে এলাম স্যার নিউ জার্সিতে, এখন আবার ফিরেও যাচ্ছি।”

 

“থাক, আর বাপিকে তেল মারতে হবে না। কাল থেকে আপনি অন ইওর ওউন, বাপির ক্লাস আছে।”

 

“জানি তো স্যার, ওদের বলে দিয়েছি। ওরা আজকের আসার খরচাও দেবে।”

 

“বাঃ। ওটা আবার কেঁপে দেবেন না, বাপিকে দিয়ে দেবেন।”

 

“কী যে বলেন স্যার, ঝাঁপব কেন?”

 

“না, এই প্রসঙ্গটা আগে তোলেননি বলে একটু সন্দেহ হচ্ছিল।”

 

প্রমথটা ইদানীং প্রায়ই সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমি ধমক দিলাম, “তুই চুপ করবি?”

 

“বেশ করব। তোরই উপকার করছিলাম। না চাইলে করব না।”

 

“আচ্ছা একেনবাবু, লুকিয়ে লুকিয়ে আর্মান্দোর সঙ্গে কী কথা বলছিলেন? আর লুকিয়ে লুকিয়ে কেন? আমাদের বিশ্বাস করেন না?”

 

“কী যে বলেন স্যার, আপনাদের বিশ্বাস না করলে আমার চলে?”

 

“ধ্যাত্তেরিকা, প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নে হয় না। উত্তরটা দিন।” প্রমথ ধমক লাগাল।

 

“কয়েকটা জিনিস স্যার। এক হল ম্যাডাম অনিন্দিতার কাছ থেকে অজয়বাবুর হ্যান্ডগানটা নিয়ে একটু পরীক্ষা করা… অনিন্দ্যবাবুর গায়ে লাগা বুলেট ওই হ্যান্ডগান থেকে বেরিয়েছিল কিনা, আর…।”

 

“দাঁড়ান, দাঁড়ান,” আমি একেবুকে থামিয়ে দিলাম। “আপনি কি অজয়কে সন্দেহ করছেন?”

 

“মোটিভ তো একটা আছে স্যার, কিন্তু কত জোরদার সেটা জানি না।”

 

“সেটা তো এক, আর?”

 

“আর স্যার জানতে, অনিন্দিতা ম্যাডামের মনে আছে কিনা, কতক্ষণ অজয়বাবু পার্টি ছেড়ে বাইরে ছিলেন।”

 

“হাউ অ্যাবাউট কিশোর? ওকি ধোয়া তুলসি পাতা?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

 

“কিশোরবাবু তো কিছু করেছেন বলে মনে হয় না।”

 

“কারণ?”

 

“ওই যে ছবিগুলো দেখলাম।”

 

“তাতে কী হল?”

 

“চল্লিশটা ছবি স্যার, তিন-চার মিনিট অন্তর অন্তর তোলা পার্টির ছবি। নিজেই ছবি তোলেন। আমি টাইম স্ট্যাম্পগুলো দেখেছি স্যার। উনি ক্লিয়ার। কোথাও কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের জন্য যাননি।”

 

“কয়েকটার মধ্যে মাত্র দুটোর উত্তর পেলাম। আর কী জিজ্ঞেস করলেন আর্মান্দোকে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

 

“ও হ্যাঁ, গাড়িগুলোও একটু চেক করতে বললাম। “স্টপ-এন-গো’-র সিকিউরিটি ক্যামেরাও চেক করতে বললাম– ক’টার সময় অজয়বাবু ওখানে পৌঁছেছিলেন বা আদৌ ওখানে গিয়েছিলেন কিনা দেখতে।”

 

“গাড়ি চেক করতে! তার মানে কী?

 

“স্যার সব কিছুরই কি মানে হয়! বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!”

 

“আপনি মশাই সামথিং।”

 

আমাদের বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগল। আজকের পুরো দিনটাই গেল। আমার তবু ক্লাস ছিল না। প্রমথকে ওর ল্যাব ফাঁকি দিতে হল। সেটা এমন কোনো বিরাট ব্যাপার নয়। উইক এন্ডে ও যা কাজ করে সেখানে একদিন না যাওয়াটা কিছুই নয়। তাও খোঁটা দিল একেনবাবুকে। “আমার একটা দিন তো নষ্ট করলেন, কাজ যে কী এগিয়েছেন কিছুই তো বুঝলাম না!”

 

“এগুলো কি স্যার একদিনে হয়, গোয়েন্দাগিরির কাজ তো ঘড়ি ধরে চলে না।”

 

“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন, বাপির আর আমার কাজ শুধু ঘড়ি ধরে হয়। টাইম পাঞ্চ করে কলেজে ঢুকি আর টাইম পাঞ্চ করে বেরোলেই হয়ে যায়?”

 

“কী যে বলেন স্যার, আপনারা বিদ্বান লোক, আপনাদের কাজ তো সব মাথার মধ্যে।”

 

“থাক আর কথা ঘোরাতে হবে না। আপনি কথার উত্তরটা দিলেন না। এখন পর্যন্ত কাউকে সন্দেহ হয়?”

 

“আজকে কিছুটা জানতে পারব স্যার। তখনই জানাব স্যার।”

 

“সেটা তো জানি তখন কী বলবেন।”

 

“কী বলব স্যার?”

 

“বলবেন, আমি আর বাপি সন্দেহের ঊর্ধ্বে!”

 

“প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন একেনবাবু।

 

“একটু কফি কর তো, বাজে না বকে,” আমি প্রমথকে ধমকালাম।

 

“তুই কর না, অর্ডার না দিয়ে!”

 

“আমি করলে তোরা কেউই মুখে দিতে পারবি না।”

 

“এই জ্ঞানটা অন্তত হয়েছে,” বলে প্রমথ কিচেনে গেল।

 

এমন সময় একেনবাবুর ফোন।

 

“হ্যান্ডগানটা পেয়েছেন স্যার? ওটাই ব্যবহার করা হয়েছে? ব্যালিস্টিক রেজাল্ট কবে পাবেন?… ‘স্টপ-এন-গো’-র সিসিটিভি চেক করেছেন স্যার? গাড়ি?…”

 

অর্থাৎ আর্মান্দো বা জ্যাকের সঙ্গে কথা বলছেন। একটু বাদেই কথা শেষ করে ফিরে এলেন।

 

“কী বলল আপনার চিফ জ্যাক?”

 

“চিফ জ্যাক না স্যার, মিস্টার আর্মান্দো। অনিন্দিতা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনিন্দিতা ম্যাডামই হ্যান্ডগানটা বার করে পুলিশকে দিয়েছেন। গ্লক ১৯ হ্যান্ডগান-এ বারুদের গন্ধ লেগেছিল। বোঝাই যাচ্ছে ওটা ব্যবহার করা হয়েছিল দু-একদিনের মধ্যে। কিন্তু কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলেনি ম্যাডামের আঙুলের ছাপ ছাড়া। তবে বডিতে যে গুলি লেগেছে, সেটা এই হ্যান্ডগান থেকে ছোঁড়া হয়েছে কিনা, সেটা বার করতে ব্যালিস্টিক টেস্ট করতে হবে, সময় লাগবে।”

 

“তার মানে তো কুকীর্তিটা অজয়ই করেছে।”

 

“কে জানে স্যার…”

 

“কে জানে স্যার’ মানে?”

 

“মানে হ্যান্ডগানটা অজয়বাবুর, সম্ভবত সেটা ব্যবহারও করা হয়েছে, কিন্তু প্রমাণ করতে হবে অজয়বাবু অকুস্থলে ছিলেন এবং তিনিই গুলি করেছেন।”

 

“কী উলটোপালটা বকছেন মশাই? অজয়ই তো অদৃশ্য হয়েছিল পার্টি থেকে… হয়নি?”

 

“তা হয়েছিলেন স্যার। কিন্তু উনি তো বলেছেন মিনিট কুড়ি-পঁচিশের জন্য। এরমধ্যে অনিন্দ্যবাবুর বাড়ি গিয়ে খুন করে ফিরে আসতে অন্তত আধঘণ্টা লাগা উচিত।”

 

“সেটা তো ওর কথা?” আমি বললাম। “আর কেউ কি জোর দিয়ে বলেছে মাত্র কুড়ি পঁচিশ মিনিটের জন্য বেরিয়েছিলেন?”

 

“তা নয়। তবে ‘স্টপ-এন-গো’-র সিসিটিভিতে ওকে দেখা গেছে ন’টার মিনিট দশেক আগে। আর উনি পার্টিতে ফিরে এসেছিলেন সাড়ে ন’টার একটু আগে –এটা আমরা জানি।”

 

“কিন্তু উনি তো ‘স্টপ-এন-গো’ থেকে অনিন্দ্যর বাড়িতে গিয়ে মার্ডার করে ফিরে আসতে পারেন। পারেন না?”

 

“সহজেই পারতেন স্যার, যদি ‘স্টপ-এন-গো’ অনিন্দ্যবাবুর বাড়ির দিকে পড়ত। কিন্তু ওটা উলটো দিকে। তাই এক্ষেত্রে টাইমিংটা খুব টাইট!”

 

“এটা আপনি কী করে বলছেন! অনিন্দ্য খুন হয়েছে ঠিক কখন, সেটা কি আপনি জানেন?”

 

“না স্যার। আসলে এক্সাক্ট টাইম অফ ডেথ খুব সহজে বলা যায় না। তবে ন’টার সময় কুকুরটা তো বাইরে ছিল না।”

 

একেনবাবুর কথাটা প্রথমে ধরতে পারলাম না। তারপর প্রতিবেশীর ন’টার সময়ে খুশ-কে না দেখার কথা মনে পড়ল।

 

“তাহলে?”

 

“দাঁড়ান স্যার, আগে কফিটা খাই আর ইমেল খুলে দেখি কিশোরবাবুর ছবিগুলো এসেছে কি না।”

 

“মাথামুণ্ডু কী পাবেন ছবিতে?”

 

“কে জানে স্যার… অনেক সময় হঠাৎ কিছু চোখে পড়ে যায়…।”

 

 

আট

একেনবাবুকে আর প্রশ্ন করে লাভ নেই। মনে হল উনি অজয়কে হিসেবের খাতা থেকে বাদ দিতে একটু যেন উদগ্রীব। ওঁর মাথায় কী ঘুরছে ‘দেবা ন জানন্তি’। আমি আমার নিজের ইমেল নিয়ে বসলাম। সোমবারে এত ইমেল আসে! বেশির ভাগই, কলেজ সংক্রান্ত… অত্যন্ত বোরিং। এই সময়টাতে প্রমথর বানানো কড়া কফি মিরাকলের কাজ করে। দুর্দান্ত কফি বানিয়েছে আজকে। প্রমথও আমার পাশে বসে ওর ল্যাপটপ খুলে বসল। একেনবাবু কফি নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

 

কফিতে কয়েক চুমুক মাত্র দিয়েছি, একটু বাদেই একেনবাবুর গলা শুনতে পেলাম। একটু যেন উত্তেজিত! “গাড়িতে ছাপ পেয়েছেন? চমৎকার। গাড়িটা ধোওয়া হয়েছিল কবে?..দিন চারেক আগে? ব্যাস এবার ম্যাচ করে কি না দেখুন। অজয়বাবু আর সেই সঙ্গে ত্রিদিববাবু আর ম্যাডাম অনিন্দিতাকে জেরা করুন। গুড ওয়ার্ক মিস্টার আর্মান্দো।… হ্যাঁ হ্যাঁ গাড়ি পাঠিয়ে দিন কালকে সকালে, আমি যাচ্ছি।”

 

জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার, রহস্যের সমাধান এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?”

 

“মনে তো হচ্ছে স্যার। তবে ম্যাচ না করা পর্যন্ত তো সঠিক বলা যাচ্ছে না।”

 

“কী ম্যাচ করা পর্যন্ত? হ্যান্ডগানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট তো শুধু অনিন্দিতার পাওয়া গেছে!” প্রমথ বলল।

 

“আরে না স্যার, উনি তো সারাক্ষণই পার্টিতে ছিলেন!”

 

“তাহলে?”

 

“বলছি স্যার, কিন্তু এগুলো এখনও প্রিলিমিনারি থিঙ্কিং। কয়েকদিন লাগবে কনফার্ম করতে।”

 

“ক্রিপ্টিক্যালি না বলে একটু বিশদ করে বলুন।”

 

“বলছি স্যার। কিন্তু আরও এক কাপ কফি হলে ভালো হয় স্যার। এটা শেষ হয়ে গেল!”

 

“জ্বালিয়ে খান মশাই আপনি! ঠিক আছে রান্নাঘরে আসুন। সাসপেন্সে রেখে আমাদের টেনশন বাড়ানো চলবে না।”

 

রান্নাঘরে একেনবাবু শুরু করলেন। “আমি মন দিয়ে এনলার্জ করে কিশোরবাবুর তোলা ছবিগুলো কেন দেখছিলাম জানেন?”

 

“মুখের এক্সপ্রেশন দেখতে?”

 

“না স্যার, কারোর কোট বা শাড়িতে লোম লেগে আছে কিনা দেখতে। আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না, খুশ-এর গা থেকে অসম্ভব লোম ঝরে। কালো কোট হলে তো লাগবেই এমনিতেই ওগুলো প্যান্ট বা জামায় লেগে যায়। কালো কোট পরা সত্ত্বেও অজয়বাবু কোটে কিন্তু আমি লোম খুঁজে পাইনি। কিন্তু দেখুন এই ছবি..” বলে একেনবাবু ল্যাপটপ খুলে একটা ম্যাগ্নিফায়েড ছবি দেখালেন। সত্যিই কিছু কিছু বাদামি-কালো লোম লেগে আছে একটা ডার্ক-রু কোটে।… এটা হল ত্রিদিববাবুর কোট। ছবিটা ছোট করতেই ত্রিদিবকে দেখতে পেলাম। এর মধ্যে আমার কাছে শুনে মিস্টার ফার্নান্দো অজয়বাবুর গাড়ি পরীক্ষা করেছে, সেখানে কিছু পায়নি। কিন্তু ত্রিদিববাবুর অ্যালফা রোমিও-তে ড্রাইভার-সিটের পাশের জানলায় কুকুরের নাকের ছাপ পেয়েছে।”

 

“কুকুরের নাকের ছাপ?”

 

“হ্যাঁ স্যার, কুকুরের নাকের ছাপ। ওটা মানুষদের ফিঙ্গার প্রিন্টের মতো একটা আইডেন্টিফায়ার। প্রায় ৮০ বছর ধরে ক্যানাডাতে এটা ব্যবহার করা হচ্ছে হারানো কুকুরদের খুঁজে বার করতে। ত্রিদিববাবুর গাড়ি দিন চারেক আগে ধোয়া হয়েছে। সুতরাং এটা একটা ফ্রেশ প্রিন্ট। এটার সঙ্গে যদি খুশ-এর নাকের ছাপ মিলে যায়, তাহলে প্রমাণ করা যাবে ত্রিদিববাবু অনিন্দ্যবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। কারণ খুশ গাড়ি দেখলেই জানলায় মুখ ঠেকিয়ে অভ্যর্থনা করে।”

 

“তাতে হলটা কী? বাপির গাড়িতেও তো ওই স্টুপিড নাকের ছাপ মিলবে! আর বাপির প্যান্টেও নিশ্চয় কিছু লোম পাওয়া যাবে, তাই না?” প্রমথ বলল।

 

“আমার প্রশ্ন, অজয়বাবুর হ্যান্ডগানটা ত্রিদিববাবু পেলেন কী করে?” আমি যোগ করলাম।

 

“আপনারা ঠিক প্রশ্নই করছেন। এখন আমি কী ভাবছি বলি স্যার… অজয়বাবু কি ত্রিদিববাবুকে হ্যান্ডগানটা ধার দিয়েছিলেন? দিয়ে থাকলে কেন? কিন্তু আরও একজন দিতে পারেন, তিনি হলেন অনিন্দিতা ম্যাডাম। তিনি ভালো করেই জানতেন হ্যান্ডগানটা কোথায় আছে, চট করে কেমন আর্মান্দো সাহেবকে বার করে দিলেন! কিন্তু অনিন্দ্যবাবু খুন হলে অনিন্দিতা ম্যাডামের লাভটা কী? তখনই আমার মনে পড়ল দীপেনবাবুর কথা। দীপেনবাবুর স্ত্রী অনিন্দিতাকে চিনতেন দীর্ঘকাল ধরে। একটা ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন অনিন্দিতা সম্পর্কে আমার শুনে মনে হয়েছিল উনি ওয়াইল্ড পার্টি ভালোবাসেন, গায়ে পড়া টাইপ, ফ্লার্ট করেন… পরকীয়াতে উৎসাহ দেন কিনা অবশ্য বলেননি। তবে দীপেনবাবুকে ওঁদের দুজনের কাছ থেকেই দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। মনে হয় সেটা গৌরবে বহুবচন স্যার… আসলে অনিন্দিতার কাছ থেকেই দূরে থাকতে বলেছিলেন। এখন ভেবে দেখুন স্যার, ত্রিদিববাবু একজন সুদর্শন কৃতি ব্যাবসাদার। অজস্র টাকার মালিক, স্ত্রী নেই। ত্রিদিববাবুর অফিসে অনিন্দিতা কাজ করতে যান। সেখানে তাঁর প্রেমে পড়া বিচিত্র নয়। ত্রিদিববাবু এদেশের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট বা সিটিজেন নিশ্চয় হবেন… এখানে যখন ব্যবসা করছেন। অজয়বাবুকে দেশে ফিরতেই হবে, কারণ আর এক বছর মাত্র ভিসার মেয়াদ। ওঁদের ছেলেপুলে নেই। সুতরাং ম্যাডামের পিছুটান বলতে একমাত্র অজয়বাবু। তখনই আমার মনে হল স্যার এই খুনের সঙ্গে অনিন্দিতা ম্যাডামেরও জড়িত থাকা অসম্ভব নয়। অজয়বাবুর সঙ্গে অনিন্দ্যবাবুর ঝগড়ার মূলেও অনিন্দিতা ম্যাডামই ছিলেন। অজয়বাবুর বাবা সম্পর্কে যে কথাগুলো আমাদের বলেছেন, সেগুলো নিশ্চয় ত্রিদিববাবুকে অনিন্দিতা ম্যাডামই জানিয়েছিলেন। আর সেটাই ত্রিদিববাবু অনিন্দ্যবাবুকে শুনিয়েছিলেন। কিন্তু অনিন্দ্যবাবুকে কেন? কারণ ওঁরা দুজনেই জানতেন অনিন্দ্যবাবু পেটে কথা রাখতে পারেন না। মদ পেটে পড়াতে যা জানেন সেটা হুড়হুড় করে বলতে শুরু করেন। সেটাই। ঘটল, আর তাতে অজয়বাবু অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। এই নিয়ে দরজা বন্ধ করে ওঁদের মধ্যে প্রবল তর্কবিতর্ক শুরু হল। শেষে অজয়বাবু বললেন, ‘আই উইল কিল দ্যাট স্কাউন্ট্রেল’! হতে পারে মাতালের উক্তি। কিন্তু সন্দেহের বীজ বেশ ভালো ভাবেই রোপন করা হল। এখন অজয়বাবুর হ্যান্ডগানটা ত্রিদিববাবুকে ব্যবহার করতে দিয়ে যদি অজয়কে খুনি প্রমাণ করা যায়, তাহলে ত্রিদিববাবুর সঙ্গে ওঁর মিলনটা খুবই সহজে হতে পারে। এটা খুব নেগেটিভলি বলছি। কিন্তু এ ছাড়া অন্য এক্সপ্লানেশন মনে করতে পারছি না।”

 

প্রমথ বলল, “এই নাকের ছাপের থিওরিটা পেলেন কোত্থেকে?”

 

“কী মুশকিল স্যার, আপনারাই শুধু রিসার্চ করতে পারেন? গুগুল সার্চ করুন না!”

 

একটু বাদেই আবার ফোন। আইলীনের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ খুশ-এর নাকের ছাপ নিয়েছে। প্রাথমিক ভাবে মিল পাওয়া গেছে। এক্সপার্টদের ডাকা হচ্ছে।

 

কাহিনির উপসংহারটা খুবই দুঃখজনক। অনিন্দিতা আর ত্রিদিবকে জেরা জ্যাকই করেছে। একেনবাবু নিজেকে জড়াতে চাননি। দু-জনেই অপরাধ স্বীকার করেছে। আধঘণ্টার জন্য ত্রিদিব পার্টি থেকে অদৃশ্য হয়েছিল। কেউই সেভাবে খেয়াল করেনি, কারণ কাজের জন্যে মাঝে মাঝেই আড্ডা ছেড়ে ফোন নিয়ে বাইরে কথা বলতে যেত। তবে খুনটা খুব পরিকল্পনা করেই করা। হ্যান্ডগানটা অনিন্দিতা ত্রিদিবকে অ্যানিভার্সারি পার্টিতে যাবার আগেই দিয়ে এসেছিল। কাজটা সেরে ত্রিদিব ফেরত দিয়েছিল সেই রাত্রে যখন গাড়ি করে অনিন্দিতাকে বাড়িতে নামিয়ে দেয়। দুজনেই এখন জেলে। অজয় দেশে ফিরে গেছে। এই সবের পরে বিচিত্রা ক্লাবের পুজোয় মনে হয় না আর আমাদের যাওয়া হবে বলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


সূচিপত্র