খুনের আগে খুনী খোঁজা! (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত

শেয়ার করুনঃ

এক

এবারে গ্রীষ্মের ছুটিতে কলকাতায় বেড়াতে এসে আমাদের পুরনো আড্ডাটা আবার জমে উঠেছে। প্রতি সন্ধ্যাতেই আমি একবার একেনবাবুর বাড়িতে ঢু মারি। প্রমথও আসে। শনি-রবিবার ওঁর বাড়িতে সকালে আমাদের চা আর জলখাবার বাঁধা। একেনবাবু পুলিশের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় পুরোনো একজন সহকর্মীকে নিয়ে একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। পার্টনার অবশ্য এখনও চাকরি করছেন, খাতায় কলমে নামটা হল তাঁর স্ত্রীর। ছুটিতে এসে ওঁর বেতনহীন সহকারী হলাম আমি আর প্রমথ। তবে বেতন হিসেবে যদি একেনবউদির অফুরন্ত স্নেহ, ভালোবাসা এবং স্বহস্তে রান্না চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় ধরা যায়, তাহলে তার পরিমাণ মোটেই উপেক্ষণীয় নয়।

 

শনিবার সকালে গরম গরম শিঙাড়া আর জলভরা সন্দেশ নিয়ে একেনবাবু, আমি আর প্রমথ চা খাচ্ছি। একেনবউদি ভেতরে গেছেন, একেনবাবু ঝালমুড়ির বায়না তুলেছেন বলে।

 

প্রমথর মুখ পত্রিকার আড়ালে, কিন্তু মাঝেমাঝেই বাক্যবাণ ছাড়ছে।

 

“আপনি মশাই যা-তা, এত খাবার সামনে, তাও ঝালমুড়ির জন্য পোঁ ধরলেন, দেখুন তো বউদিকে আবার ছুটতে হল!”

 

“আসলে স্যার, আপনারা আসেন, তাই এই শনি-রবিটা ভালো করে খাই।”

 

“আর অন্যদিন বউদি আপনাকে কিছু খেতে দেন না?”

 

“তা নয় স্যার।”

 

“তাহলে?”

 

“আপনার সঙ্গে স্যার কথায় পারা মুশকিল।”

 

ঠিক সেই সময়ে একেনবউদি এক বাটি ঝালমুড়ি নিয়ে ঢুকলেন।

 

“কি ভাই, এত মন দিয়ে কী পড়ছেন?” প্রমথকে প্রশ্ন করলেন একেনবউদি।

 

এইবার প্রমথ কাগজটা নামাল।

 

“দেখছিলাম বউদি, একেনবাবুকে কোনো কাজে লাগাতে পারি কিনা, নইলে তো আপনাকে সারাদিন জ্বালিয়ে মারবেন।”

 

“কিছু পেলেন?” মুখ টিপে হেসে একেনবউদি জিজ্ঞেস করলেন।

 

“একটা কেস আছে, কিন্তু সিম্পল চুরির কেস, একেনবাবুর মন ভরবে না।”

 

“তবু শুনি না।”

 

“সতীশ মিত্রের অফিসে চুরি।”

 

“সতীশ মিত্র, মানে উকিল সতীশ মিত্র? গড়িয়াহাটে যাঁর বিশাল বাড়ি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“ঠিক। ওঁর অফিস থেকে নানান ফাইলপত্তর চুরি হয়েছে।”

 

“দেখি,” বলে আমি প্রমথর হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিলাম। সতীশ মিত্রের নাম বেশ কিছুদিন হল খবরের কাগজে খুব বেরোচ্ছে। শাসকদলের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলায় তিনিই প্রধান উকিল।

 

দেখলাম, ইতিমধ্যেই রাজনীতির খেলা শুরু হয়েছে। বিরোধী নেতারা বলছে যে, এটা সাধারণ চুরি নয়, মামলার দরকারি নথিপত্র চুরি করার জন্যই শাসকদল এটা করিয়েছে। পুলিশের বক্তব্য দেরাজ একটা ভাঙা হয়েছে বটে, কিন্তু বিশেষ কিছু খোয়া যায়নি, কারণ তার আগেই বাড়ির কাজের লোক আওয়াজ পেয়ে উপর থেকে নেমে আসায়, চোর পালিয়েছে।

 

“এই নিয়ে এখন বন্ধ না হলে বাঁচি,” আমি বললাম। হলে কাল আমাদের দীঘা যাওয়া মাটি।

 

বলতে ভুলে গেছি, আমরা অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম দিন কয়েকের জন্য দীঘায় যাব। রোববার সকালে রওনা দেবার কথা।

 

“তুই একটা ইডিয়ট,” প্রমথ বলল। “রবিবার কখনো বন্ধ হয়, তাহলে ফায়দাটা কোথায়? বন্ধ হলে সোমবার বা শুক্রবার। আমরা যাচ্ছি রোববার, ফিরছি মঙ্গলবার, সুতরাং সেফ।”

 

বন্ধ-এর কথায় একেনবাবু উত্তেজিত হলেন। ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে টিভিটা চালালেন। টিভি-তে অবশ্য এ নিয়ে কিছুই শুনলাম না। মিনিট দশেক পঞ্চায়েতের ইলেকশন নিয়ে নানান বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা শোনার পর প্রমথ দুত্তোর বলে উঠে টিভিটা বন্ধ করল।

 

এমন সময়ে বাইরের দরজায় বেল। একেনবাবুর বাড়ির কাজের মেয়ে নমিতা এসে খবর দিল, এক ভদ্রলোক একেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চান, খুব জরুরি।

 

“দেখো, আবার কী ঝামেলা এল,” বলে একেনবউদি ভেতরে চলে গেলেন।

 

 

দুই

একটু বাদে লাঠি হাতে একটু কুঁজো হয়ে যে ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন তাঁর বয়স ষাট পঁয়ষট্টি হবে। দেখে মনে হয় শৌখিন লোক। কাঁচাপাকা চুল, গায়ে কাজ-করা সবুজ সিল্কের দামি পাঞ্জাবি। চোখে গোল্ড রিমের হাই পাওয়ারের চশমা, তাও দেখতে বোধহয় একটু কষ্ট হচ্ছে। আমাদের তিন জনকে দেখে বললেন, “আমি একটু একেনবাবুর সঙ্গে কথা বলব।”

 

প্রমথ সামনে ছিল, একেনবাবুকে দেখিয়ে বলল, “ইনিই একেনবাবু।”

 

“আপনি!” ভদ্রলোকের কথার সুরে বিস্ময়, সংশয়, নিরাশা ইত্যাদি অনুভূতিগুলির মিশ্রণ। এতে এখন আর অবাক হই না, একেনবাবুও মনে হয় মজাই পান।

 

আগন্তুকের বিস্ময়সূচক ‘আপনি’-র উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ স্যার, বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?”

 

ভদ্রলোক ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর পকেট থেকে একটা নোটের বান্ডিল বার করে একেনবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা রাখুন।”

 

ভদ্রলোকের মাথায় নিশ্চয় গোলমাল আছে, নইলে এভাবে কোনো কথাবার্তা না বলে, কেউ টাকা এগিয়ে দিতে পারে! না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

 

“এটা?”

 

“কুড়ি হাজার আছে, অ্যাডভান্স।”

 

“তা-তো বুঝলাম স্যার, কিন্তু কাজটা কী?”

 

“আমার খুনিকে আপনাকে খুঁজে বার করতে হবে।”

 

লোকটা যে সম্পূর্ণ উন্মাদ, সে বিষয়ে এবার আর সন্দেহ রইল না।

 

একেনবাবু মাথাটা একটু চুলকে বললেন, “আমি একটু কনফিউসড স্যার, আপনার খুনিকে খুঁজে বার করব!”

 

“ঠিকই শুনেছেন।”

 

“কিন্তু আপনি তো বেঁচে আছেন স্যার!”

 

“এখনও আছি, কিন্তু বেশিদিন থাকব না।” প্রমথ আর চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, “একদিন তো আমরা সবাই মরব।” ভদ্রলোক প্রমথর দিকে একটা চকিত অবজ্ঞা-দৃষ্টি দিয়ে একেনবাবুকে বললেন, “আমাকে খুন করার চেষ্টা চলছে আমি জানি। পুলিশের উপর আমার ভরসা নেই, খুনই হয়তো হব। তাই আগে থেকেই তদন্তের ভারটা আপনাকে দিয়ে যেতে চাই।”

 

“কারা চেষ্টা চালাচ্ছেন স্যার, মানে আপনাকে খুন করার?”

 

“সেটা জানলে আর আপনার সাহায্য চাইছি কেন?” ভদ্রলোকের গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ল।

 

“এবার বুঝলাম স্যার। আপনি জানেন খুন করার চেষ্টা চলছে, কিন্তু ঠিক কারা চালাচ্ছে সেটা জানেন না।”

 

“এক্সাক্টলি।”

 

“কিন্তু কীভাবে বুঝলেন স্যার, আপনাকে খুন করার চেষ্টা চলছে?”

 

উত্তরে ভদ্রলোক একটা বড়ো সাদা খাম এগিয়ে দিলেন।

 

“পড়ুন।”

 

খামের মধ্যে তিনটে চিঠি। চিঠির উপর এক নম্বর, দু-নম্বর আর তিন নম্বর লেখা।

 

সাদা কাগজে কালো কালিতে লেখা প্রথম চিঠিটা:

 

শ্যামল দত্ত: তোমার পাপের শাস্তির দিন রবিবার রাত্রে….

 

ব্যাস আর কিছু নয়।

 

দ্বিতীয় চিঠিটাও একই ভাবে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা।

 

শ্যামল দত্ত: দানধ্যানে প্রায়শ্চিত্ত হয় না, পাপের শাস্তি পেতেই হবে, অন্তিম দিনের জন্য প্রস্তুত হও– এই রবিবার।…

 

তৃতীয় চিঠিটা, কম্পিউটারে ছাপানো। কোনো সম্বোধন নেই। শুধু লেখা: রবিবারই শেষ রজনী। — ব্যাস আর কিছু নেই।

 

আমরা যখন চিঠিটা পড়ছি, ভদ্রলোক বললেন, “প্রথম চিঠিটা আমার লেটার বক্সে কেউ রেখে গিয়েছিল ঠিক ছ’দিন আগে। পরের চিঠিটা তিনদিন আগে, সেটাও ছিল লেটার বক্সে। শেষ চিঠিটা পেয়েছি কাল রাতে। বিগ বাজারে গিয়েছিলাম, কেউ আমার গাড়ির মধ্যে রেখে গিয়েছিল।”

 

চিঠিটা উলটেপালটে দেখে একেনবাবু বললেন, “আপনি স্যার শ্যামল দত্ত?”

 

ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে শ্যামল দত্ত, কিন্তু তাও একেনবাবুর প্রশ্নটা করা চাই। এইজন্যেই প্রমথ একেনবাবুকে তুলোধোনা করে। বলে, “একটা সিম্পল জিনিস আপনার মাথায় ঢুকতে দু-ঘণ্টা লেগে যায়, আবার মোস্ট কমপ্লেক্স প্রব্লেম আপনি সলভ করেন, আপনি মশাই বিধাতার এক অদ্ভুত সৃষ্টি!

 

প্রশ্নটা শুনে ভদ্রলোক মনে হল একটু বিরক্তই হলেন। কী জানি বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে বললেন, “হ্যাঁ।”

 

“পাপের শাস্তি…” একেনবাবু আস্তে আস্তে আবার পড়লেন, তারপর ঘাড় চুলকে বললেন, “এটার অর্থ কী? কী পাপ? বুঝতে পারছেন কিছু স্যার?”

 

“না, অন্তত জ্ঞানত কোনো পাপ-কাজ করেছি বলে তো জানি না।”

 

“পুলিশকে স্যার চিঠিগুলোর কথা জানিয়েছেন?”

 

“ওদের জানিয়ে কিছু লাভ হয়?” ভদ্রলোক এবার একটু উত্তেজিত হলেন। “প্রথম চিঠিটা পেয়ে ভেবেছিলাম কেউ ফাজলামি করছে। কিন্তু দ্বিতীয় চিঠিটা পেয়ে একটু দুশ্চিন্তা হল। থানায় গিয়েছিলাম। ডিউটি অফিসার যিনি ছিলেন, পাত্তাই দিলেন না। বললেন, ‘মশাই, এসব ফালতু জিনিস নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমাদের নেই। আমি বললাম, ‘এ-রকম হুমকি দেওয়া চিঠিকে আপনি ফালতু বলছেন? উনি ঠাট্টা করলেন, “নিশ্চয় পুজোয় চাঁদা-টাদা দেননি, তাই ক্লাবের ছেলেরা পেছনে লেগেছে।

 

“আমি দু-হাজার টাকা চাঁদা দিই পুজোয়, কিন্তু লোকটার সঙ্গে এ নিয়ে কিছু বলতে প্রবৃত্তি হল না। তারপর এই তৃতীয় চিঠি। আমি এখন শিওর ব্যাপারটা সত্যিই সিরিয়াস। ক’দিন আগে পত্রিকায় আপনার কথা পড়েছিলাম, নিউ ইয়র্কের নানান মার্ডার মিস্ট্রি সলভ করে আপনি কলকাতায় ফিরে এসেছেন। তাই সোজা আপনার কাছে চলে এলাম।”

 

“কিন্তু পুলিশ হয়তো ভুল বলেনি স্যার, হতে পারে কেউ স্রেফ আপনাকে ভয় দেখিয়ে মজা পাচ্ছে। হত্যার হুমকি দিয়ে যদি কেউ টাকা চাইত, তাহলে অবশ্য দুশ্চিন্তার কারণ থাকত।”

 

কথাটা শ্যামলবাবুর মোটেই মনঃপূত হল না। গলাটা একটু চড়িয়েই বললেন, “শুধু লেটার বক্সে চিঠিগুলো পেলে হয়তো কথাটা মানতাম, কিন্তু শেষ চিঠিটা পেয়েছি গাড়িতে, তার মানে আমার অজান্তে কেউ আমার পেছনে ঘুরছে। সেটা শুধু স্রেফ মজা করার জন্য?”

 

“সেটাই একটু স্ট্রেঞ্জ স্যার, মানছি। আপনার ড্রাইভার কাউকে দেখেনি?”

 

“সে ব্যাটা এক দেশওয়ালির সঙ্গে বসে খইনি খাচ্ছিল। গাড়ির দরজাও লক করেনি। যদিও আমি বার বার ওকে বলেছি, গাড়ি লক না করে দূরে কোথাও যাবি না। কিন্তু কে কার কথা শোনে!”

 

“কতদিন আপনার চাকরি করছে ড্রাইভারটি?”

 

“কাজ করেছিল বহুকাল। ইদানীং নেশাভাঙ করে কাজে ফাঁকি দিচ্ছিল, ধমক-ধামকে কাজ হচ্ছিল না। কিন্তু এই ঘটনার পর ওকে তাড়িয়েছি, আমারই খাবে, অথচ হুকুম মানবে না, এটা তো বরদাস্ত করতে পারি না।”

 

“তা তো বটেই স্যার। কিন্তু, চিঠিটা বিগ বাজারেই আপনার গাড়িতে কেউ রেখেছিল, সেটা কী করে বুঝলেন?”

 

“কারণ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে সেটা ছিল না।”

 

“আপনি শিওর স্যার?”

 

“হ্যাঁ। আমার সিটের উপর ওটা পড়েছিল।”

 

“কিন্তু বাড়িতে যখন গাড়িতে উঠলেন, তখন তো অন্যমনস্ক হয়ে চিঠির উপরেও বসতে পারেন।”

 

“আপনি আমায় বিশ্বাস করছেন না?” ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হয়ে বললেন।

 

“না স্যার, অবিশ্বাসের কোনো ব্যাপার নয়। আসলে এই তিন নম্বর চিঠিটার কাগজটা একটু দোমড়ানো-মোচড়ানো, তাই প্রশ্নটা মনে এল।”

 

ভদ্রলোক একটু যেন থতমত খেলেন। তারপর উত্তেজিত হয়ে বললেন, “না, আমার পরিষ্কার মনে আছে ওঠার সময়ে সিটে কিছু ছিল না।”

 

এই সামান্য প্রশ্নে এত উত্তেজিত হবার কি আছে বুঝলাম না। তবে লোকটা খ্যাপা, সুতরাং নর্মাল লজিকে ওঁর ব্যবহার ব্যাখ্যা করা যায় না।

 

“তাহলে স্যার ছিল না,” একেনবাবু বললেন।

 

“আপনার কথার ধরন দেখে মনে হচ্ছে যে, আপনিও ওই পুলিশের মতো আমার চিন্তাটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আপনি কেসটা নেবেন কিনা, বলুন!”

 

“কী মুশকিল স্যার, নেব না তো বলিনি। কিন্তু…”

 

““কিন্তু কী?”

 

“ধরুন স্যার, কিছুই যদি না ঘটে।”

 

একেনবাবু কী বলতে চাচ্ছেন শ্যামল দত্ত মনে হয় আঁচ করলেন। বললেন, “অর্থাৎ আমি যদি না মরি, তাই তো? এই টাকা আমি আর ফেরত চাইব না। এটা কনসাল্টেশন ফি হিসেবে রাখবেন। তাতে আপনার আপত্তি আছে?”

 

“সে কি স্যার, আপত্তি কেন থাকবে! ঠিক আছে স্যার, আপনার এই কেসটা নিচ্ছি।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ।” ভদ্রলোক মনে হল একটু স্বস্তি পেয়ে আরাম করে বসলেন।

 

একেনবাবু চিঠিগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনার কোনো শত্রু আছেন যিনি আপনার মৃত্যু চান?”

 

“দেখুন, আমি ব্যবসায়ী, অনেকের সঙ্গে আমার লেনদেন, তাতে দু-একজন নিশ্চয় আমার উপর সন্তুষ্ট নয়। তাদের কেউ কেউ আমার মৃত্যু কামনা করতেই পারে, কিন্তু খুন করতে চাইবে বলে তো আমার মনে হয় না।”

 

“এই কেউ কেউ-রা কারা?

 

শ্যমলবাবু চুপ করে খানিকক্ষণ ভাবলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “না, অকারণে কাউকে আমি জড়াতে চাই না।”

 

“আপনার কোনো বিজনেস পার্টনার আছেন?”

 

“বেশির ভাগ বিজনেসেরই আমি সোল প্রোপ্রাইটার। দুটো পার্টনারশিপ ব্যবসা আছে। একজন পার্টনার হলেন, শিবদাসবাবু– শিবদাস রায়। দ্বিতীয়জন হলেন, শৈবাল চৌধুরী।” নামদুটো বলে শ্যামলবাবু যোগ করলেন, “দু-জনেই অ্যাবাভ এনি সাসপিশন।”

 

“আই সি। আচ্ছা স্যার, আপনি মারা গেলে আপনার সম্পত্তি কে পাবে?”

 

ভদ্রলোক এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। “আমি অবিবাহিত, থাকার মধ্যে আছে আমার এক ভাইপো। দাদা মারা যাবার পরে ছোঁড়াটার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বেশি নেই। পড়াশুনো ছেড়ে একটা যাত্রা না নাটকের দলে ঢুকে একেবারে বখে গেছে। আর আছে আমার একটি বিশ্বস্ত অনুচর বিনয়। বিনয় প্রায় আটবছর আমার কাছে আছে। আমিই ওকে কলেজে পড়িয়েছি। এখন আমার কাজকর্ম দেখাশোনা করে। আমার সম্পত্তি আমি বিনয়কে উইল করে দিয়েছি। তবে ভাইপোকে বঞ্চিত করিনি, লাখ দুয়েক টাকা ওর জন্যেও রেখেছি।”

 

“আপনার উইলের কথা কি স্যার আপনার ভাইপো আর বিনয় জানেন?”

 

“আলবাত জানে, লুকিয়ে আমি কোনো কাজ করি না। তবে…” কিছু একটা বলতে গিয়ে শ্যামল দত্ত হঠাৎ চুপ করে গেলেন।

 

“তবে কী স্যার?”

 

“ভাবছি এটা ঠিক হল কিনা?”

 

“কোনটে স্যার?”

 

“মানে এই উইলটা। ভাইপোটা যত নচ্ছারই হোক, যে-দাদা আমাকে মানুষ করেছে। তারই একমাত্র ছেলে। আমার চেনা-জানা দু-একজন বলছেন বিনয়কে সব কিছু উইল করে দেওয়াটা বিবেচনার কাজ নয়। আপনার কী মনে হয়?”

 

শ্যামলবাবুর কথা যত শুনছিলাম, ততই অবাক হচ্ছিলাম। উইল করে সেটা ঠিক করেছেন কিনা সেই নিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিতর সামনে স্বগতোক্তি করা, আবার তার মতামত নেওয়া!

 

“উইল তো স্যার আপনার ইচ্ছে, যা চান তাই করবেন।”

 

“ঠিক, আর বিনয় চমৎকার ছেলে।”

 

“বিনয়কে আপনি কতদিন চেনেন?”

 

“ওই যে বললাম, আট বছর।”

 

“আপনার কাছে আসার আগে বিনয়বাবু কোথায় থাকতেন?”

 

“একটা অনাথ আশ্রমে। সেখানে যখন ওর সঙ্গে আমার দেখা হয় তখন ও স্কুল ফাইনাল দিচ্ছে। ওকে দেখে আমার ভালো লেগে গেল। আশ্রমের মেট্রনের সঙ্গে কথা বলে ওকে আমি নিয়ে আসি।”

 

“বিনয়ের বাবা-মা নেই?”

 

“মা ছিল। বাপের কথা কেউ জানে না। আমার সঙ্গে ওর দেখা হবার কিছুদিন আগে ওর মা মারা যায়।”

 

“ওঁর অন্য কোনো আত্মীয়স্বজন নেই?”

 

“না। কিন্তু বিনয় সম্পর্কে এত প্রশ্ন করছেন কেন, আপনি কি বিনয়কে সন্দেহ করছেন? হি ইজ এ ফাইন বয়।”

 

“কী মুশকিল স্যার, কিছুই তো ঘটেনি, সন্দেহ করার কি আছে!”

 

“কিন্তু তাও তো ওকে নিয়ে প্রশ্ন করছেন!” শ্যামলবাবু নিজের অসন্তোষ আর চাপলেন না।

 

“ঠিক আছে স্যার, করব না। তবে একটা কথা, আপনার মনে যখন খুন হওয়া নিয়ে একটা খটকা লেগেছে, আপনি কোনো সিকিউরিটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করুন। একজন বডি গার্ড নিয়ে ঘুরুন কিছুদিন।”

 

শ্যামলবাবুর কথাটা বোধহয় মনঃপূত হল। “আমিও সেটাই ভাবছিলাম। আচ্ছা চলি।” বলে উঠে যাবার উদ্যোগ করলেন।

 

“এই চিঠি তিনটে আমি রেখে দিতে পারি স্যার?”

 

“নিশ্চয়।”

 

“দাঁড়ান, স্যার, একটা রসিদ দিয়ে দিই।”

 

“কীসের রসিদ? এই চিঠি তিনটের জন্য!”

 

“না স্যার, এই যে টাকাটা দিলেন তার।”

 

“সিদ নিয়ে আমি কী করব! শুধু কাজটা মনে করে করবেন।”

 

“কী যে বলেন স্যার, দীর্ঘদিন বাঁচবেন আপনি। আপনার লাঠিটা ফেলে যাচ্ছেন স্যার।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ,” বলে ভদ্রলোক লাঠিটা তুলে নিলেন। “ও, হ্যাঁ,” পকেট থেকে একটা কাগজ বার করলেন শ্যামলবাবু, “আমার উকিলের ঠিকানা আর ফোন নম্বর। ওঁকে আমি বলে যাব আমি বেঁচে থাকি বা না-থাকি আপনার সব খরচাপাতি যেন উনি দিয়ে দেন।”

 

একেনবাবুকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শ্যামল দত্ত চলে গেলেন।

 

একেনবাবুর কাছ থেকে শ্যামল দত্তের দেওয়া কাগজে উকিলের নামটা দেখলাম। সতীশ মিত্র। নীচে বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বর। আর কিছু লেখা নেই।

 

“সতীশ মিত্র! এর অফিসে চুরি হবার খবরই তো সেদিন পত্রিকায় দেখলাম!” আমি বলে উঠলাম।

 

“তাই তো দেখছি স্যার।”

 

“বাঃ, এতো চমৎকার যোগাযোগ!” প্রমথ বলল, “এই ছুতোয় উকিল মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে, তার চুরির ব্যাপারটারও ফয়সল্লা করুন। আরও টু-পাইস ঘরে আসবে।”

 

“কী যে বলেন স্যার!”

 

“ভুলটা কী বললাম মশাই? ভালো কথা, এই শ্যামল দত্ত লোকটা মরুক-বাঁচুক, আই ডোন্ট কেয়ার, বিশ হাজার টাকা ফোকোটে পেয়েছেন… আজ রাতেই বউদিকে ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে ভালোমন্দ খাওয়ান। চাইলে আমরাও যেতে পারি।”

 

“অত তাড়াহুড়ো করিস না,” আমি বললাম। “নোটগুলো জাল কিনা, সেটা আগে জানা দরকার। সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে রহস্যজনক লাগছে।”

 

একেনবাবু দেখলাম মন দিয়ে নোটগুলো পরীক্ষা করছেন। “না স্যার, জেনুইন জিনিসই মনে হচ্ছে।”

 

“তাহলে বউদিকে জানিয়ে দেওয়া যাক রান্নাবান্নার ঝামেলা আজ না করতে। কাল সকালেই তো আবার সবাই দীঘা রওনা দিচ্ছি! বউদি, বউদি!” বলে প্রমথ চিৎকার জুড়ল।

 

ও বলতে ভুলে গেছি, আমার আর প্রমথর এই দীর্ঘ যাত্রা একেনবাবুদের দশম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে। একেনবাবুকে আমরাই জোর করেছিলাম বউদিকে নিয়ে দীঘায় যেতে, কিন্তু একেনবউদির ভীষণ লজ্জা! একেনবাবু আবার লজ্জাটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, হিন্দু বিবাহ মতে ওঁদের বিয়েটা ঠিক সিদ্ধ নয়। সেটার বার্ষিকী উদ্যাপন করাটা একেবারেই ঠিক হবে না।

 

শুনে প্রমথ খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠেছিল, “কী আজেবাজে বকছেন! না কি এটা আপনার খরচ বাঁচাবার ফন্দি?”

 

“আরে না স্যার, কতই বা খরচ! আসলে আমার আর ও-র মধ্যে সম্পর্কটা সপিণ্ড।”

 

“সপিণ্ড-টা কী?”

 

“সপিণ্ড সম্পর্কের বিচার হয় স্যার মায়ের দিক থেকে তিন পুরুষ আর বাবার দিক থেকে পাঁচ পুরুষ ধরে। একজন যদি অন্যজনের সপিণ্ড সম্পর্কের কেউ হয়, অথবা তৃতীয় কেউ যদি দু-জনের সপিণ্ড সম্পর্কের পড়ে তাহলে বিয়েটা সিদ্ধ হয় না।”

 

“হোয়াট ননসেন্স, দক্ষিণভারতে তো মামা-ভাগ্নিতেও বিয়ে হচ্ছে।”

 

“ওটা স্যার লোকাচার, হিন্দু বিয়ের আইনে লোকাঁচারকে মানা হয়।”

 

“এইসব ফালতু জিনিস কোত্থেকে জানলেন?”

 

কী করব স্যার, এইসব আইনগুলো একটু জানতে হয়, পুলিশে কাজ করতাম না!”

 

“তাহলে আর কী করা, আপনার অসিদ্ধ বউকে নিয়েই দীঘাতে আনন্দ করে আসুন।” আমি বললাম।

 

কথাটা শুনে একেনবউদি লজ্জায় লাল হয়ে বললেন, “ওঁর কথা ছাড়ন তো! বিয়ের পর কোত্থেকে আবিষ্কার করেছে আমার ঠাকুরদা-র ঠাকুরদা নাকি ওঁরও ঠাকুরদা-র ঠাকুরদা।”

 

প্রমথ বলল, “বউদি, আমরা কি আপনার কর্তার কোনো কথায় কান দিই, ওঁর অর্ধেক জিনিসই তো বানানো।”

 

“তাহলে ভাই আপনারা দু-জন আমাদের সঙ্গে চলুন।”

 

 

তিন

আমরা ছিলাম নিউ দীঘায়। জায়গাটা পুরোনো দীঘার চেয়ে পরিচ্ছন্ন, লোকজনও কম। তবে দীঘার সেই বিখ্যাত ঝাউবন এখন প্রায় নেই বললেই চলে। নীল সমুদ্রের বুকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা দেখলাম মুগ্ধ হয়ে। একদিন কাছাকাছি কাননগড়ে অমরাবতীর কৃত্রিম লেকে বোটিং করে এলাম। একেনবাবুর মতো লোক যিনি কোথাও গেলে ঘ্যানঘ্যান করে মারেন, তিনিও একদিন বলে ফেললেন, “যাই বলুন স্যার, মাঝে মাঝে কলকাতার বাইরে এলে, শরীর-মন দুটোই ঝরঝরে হয়ে যায়। তবে খাবারটাই ট্রাবল দেয়।”

 

“তাই বলে বউদিকে দিয়ে রান্না করানোর ফ্যাচাং তুলবেন না!” প্রমথ একটু ধমকের সুরে বলল।

 

“কী যে বলেন স্যার, ও-ও তো রিল্যাক্স করতে এসেছে।”

 

“আপনার এই সূক্ষ্ম অনুভূতি এখনও আছে দেখে মোহিত হলাম।” প্রমথ কখনোই একেনবাবুর পেছনে না লেগে পারে না।

 

একেনবাবু অবশ্য এসব গায়ে মাখেন না।

 

.

 

মঙ্গলবার কলকাতায় এসে আমরা যখন পৌঁছোলাম, তখন প্রায় বিকেল পাঁচটা।

 

একেনবাবু বাড়িতে ঢোকামাত্র স্নান করতে ছুটলেন। একেনবউদি বললেন, “আপনারা ভাই সবাই আজ রাতের খাওয়া খেয়ে যাবেন।”

 

“আজকেই আবার রাঁধবেন বউদি?” প্রমথ বলল।

 

“দেখছিলেন তো বাইরের খাবার খেয়ে ওঁর অবস্থা!”

 

“আপনি বউদি বড় ইনডাজ করেন একেনবাবুকে, সেইজন্যেই মাথায় চড়ে বসেন।”

 

“ঠিক আছে ভাই, আর করব না,” বলে বউদি সস্নেহে প্রমথর তাকিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন।

 

আমি আর প্রমথ টেবিলের উপরে স্থূপাকৃত গত কয়েকদিনের পত্রিকাগুলো তুলে নিলাম।

 

দীঘাতে এ ক’দিন খবরের কাগজ পড়ার কোনো মুডই ছিল না। হোটেলে খাওয়া দাওয়া আর ঘুম ছাড়া সমুদ্রের বীচ-এ বসেই কাটিয়েছি। কলকাতা আছে কি নেই– ভুলে গিয়েছিলাম।

 

পত্রিকার প্রথম পাতাতেই আমার চোখ আটকে গেল।

 

বউবাজারের ধনী ব্যবসায়ী শ্যামল দত্তের সন্দেহজনক মৃত্যু!

 

আমি চেঁচিয়ে প্রমথকে বললাম, “কী সর্বনাশ প্রমথ, সেই ভদ্রলোক মারা গেছেন।”

 

আমি নামটাও বলিনি, কিন্তু প্রমথ বুঝল ঠিক। বলল, “বলিস কিরে –খুন?”

 

প্রমথ সামনের চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসল।

 

হেডিং-এর নীচে সংক্ষিপ্ত খবর।

 

শ্যামল দত্তর মৃতদেহ বাঘাযতীন স্টেশনের কাছে রেললাইনের ধারে রবিবার দুপুরে পাওয়া গেছে। আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশ সন্দেহ করছে এটা আত্মহত্যা নাও হতে পারে। লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা চলছে। মৃত্যুর কারণ জানার জন্য ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে।

 

ব্যাস আর কিছু নেই।

 

প্রমথ বলল, “মাই গড, ভদ্রলোকের সন্দেহ তাহলে ভুল নয়, আমরাই পাত্তা দিচ্ছিলাম না।”

 

একেনবাবু স্নান সেরে বেরোতেই আমরা পত্রিকাটা ওঁকে দিলাম।

 

একেনবাবু পত্রিকাটা পড়ে বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার!”

 

“কী করবেন এখন,” প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো কেসটা নিয়েছেন!”

 

“তা নিয়েছি স্যার, কিন্তু এটা যে আত্মহত্যা নয়, সেটা তো আমরা জানি না।”

 

“আপনি কী বলতে চান মশাই? রবিবার আমাকে কেউ খুন করবে বলে আপনাকে। ভাঁওতা দিয়ে ভদ্রলোক নিজে আত্মহত্যা করেছেন! উনি খ্যাপা, না আপনি খ্যাপা?”

 

“তা নয় স্যার। পুলিশ আগে ওদের কাজটা শেষ করুক। খুন প্রমাণিত হলে তো আমাকে কাজে লাগতেই হবে।”

 

“অর্থাৎ বউদির হাতের রান্না না খাওয়া পর্যন্ত আপনি কিছু করবেন না, এই তো?”

 

একেনবাবু আমার দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে বললেন, “প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!”

 

আমি প্রমথকে বললাম, “ওঁকে একটু সুস্থির হয়ে বসতে দিবি? এক্ষুনি না ছুটলেও তো চলে।”

 

“তোর মুণ্ডু,” বলে প্রমথ রান্নাঘরে গেল। বোধহয় চায়ের তদারক করতে।

 

প্রমথ যেতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝছেন?”

 

“ভেরি কনফিউসিং স্যার, ভেরি কনফিউসিং।”

 

.

 

চা খাবার পর একেনবাবু নিজেই পকেট থেকে মোবাইল বার করলেন। তাতে চার্জ নেই। তখন উঠে দেয়ালের পাশে রাখা টেলিফোন তুলে কাকে জানি ফোন করলেন। অন্যপক্ষের কথা বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু এটুকু বুঝলাম শ্যামল দত্তের মৃত্যু নিয়েই কথা হচ্ছে। এও বুঝলাম, যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি খুব একটা কো-অপারেটিভ নন। খানিকক্ষণ কথা বলার পর কিছুটা হতাশ হয়েই একেনবাবু চেয়ারে এসে বসলেন।

 

“কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?”

 

একেনবাবু সোজাসুজি কথাটার উত্তর দিলেন না। বললেন, “রাখাল ছুটিতে, তাই একটা ঝামেলা।”

 

রাখালবাবু সি.আই.ডি-র লোক। এককালে একেনবাবুর কলিগ ও শাগরেদ দুই-ই ছিলেন।

 

“কেন, যে ফোন ধরল, সে আপনাকে চেনে না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“চিনবে না কেন স্যার। তবে সবাই তো একরকম নয়।”

 

এ নিয়ে আর কিছু জানা যাবে না, তাই প্রশ্ন করলাম না।

 

.

 

এ-রকম কোনো একটা ঘটনা ঘটলে, বিশেষ করে বাংলা পত্রিকায় বেশ কয়েকদিন ধরে খুব মাতামাতি হয়। তদন্ত কদুর এগিয়েছে তা নিয়ে অনেক খবরাখবর বেরোয়। তার কতটা সত্যি অবশ্যই একটা প্রশ্ন। আসলে এ ধরনের খবর পাবলিক খুব পছন্দ করে। কাগজে কিছু বেরোনো মানেই সেটা ধ্রুব-সত্য। সেই সত্য অনুসারে এটি হত্যাকাণ্ড। এর প্রত্যক্ষদর্শীও নাকি রয়েছে। এক রিক্সাওয়ালা নাকি একটি যুবককে দেখেছিল একজন বৃদ্ধকে ধরাধরি করে রেললাইনের ধার দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।… পাঠকরা ভাবতেও চায় না, এ ধরনের স্পর্শকাতর এবং গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে পুলিশ রিপোর্টারদের এসব জানাবে কেন?

 

 

চার

পরদিন দুপুরে একেনবাবুর ফোন পেলাম। উনি আর প্রমথ উকিল সতীশ মিত্রের বাড়িতে সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ যাবেন, আমি আসব কিনা। ঠিক হল, গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে পেট্রল পাম্পের সামনে ছ’টার একটু আগে আমি যাব, সেখানে উনি আর প্রমথ আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।

 

সতীশ মিত্রের বাড়ি পেট্রল পাম্প থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। উনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শ্যামল দত্ত একেনবাবুকে ওঁর মৃত্যুর তদন্তের ভার দিয়ে গেছেন শুনে উনি তো অবাক! আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকালেন, আমরা হয় উন্মাদ অথবা ওঁর সঙ্গে বদ-রসিকতা করতে এসেছি! যাইহোক, ভাগ্যক্রমে একেনবাবুর নামটা ওঁর কাছে অপরিচিত নয়। তাই ধৈর্য ধরে পুরো ব্যাপারটা শুনলেন। তারপর বললেন, শ্যামল দত্ত ওঁকে কোনো ইনস্ট্রাকশন দিয়ে যাননি। এও বললেন যে, শ্যামলদত্ত এঁকে দিয়ে তাঁর উইলটা করিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন আগে।

 

“তাতে কি উনি ওঁর সমস্ত সম্পত্তি বিনয়বাবুকে দিয়ে গিয়েছেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“হতে পারে, আমার মনে নেই।” ওঁর সংক্ষিপ্ত উত্তর শুনে মনে হল, এ নিয়ে উনি আলোচনা করতে চান না।

 

“উইলটা কি আপনার কাছেই আছে স্যার?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

 

“কেন বলুন তো?”

 

“না, মানে কয়েকদিন আগে আপনার এখানে একটা চুরি হয়েছিল, তাই ভাবলাম ওটা যদি চুরি হয়ে থাকে।”

 

“না, চুরি যায়নি। আর চুরিও এখান থেকে কিছু হয়নি। পত্রিকাগুলো তিলকে তাল করেছে। আর কিছু জানতে চান?”

 

“তাহলে উইলটা আপনার কাছেই আছে?”

 

“না, শ্যামলবাবু কিছুদিন আগে ওটা ফেরত নিয়ে গেছেন।”

 

“কেন স্যার?”

 

“তা বলতে পারব না। আমার জুনিয়ারকে ফোন করেছিলেন। এ বিষয়ে আমি আর কিছু জানি না। জুনিয়ারও জানে না, কারণ ওকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।”

 

“শ্যামলবাবু থাকতেন কোথায় স্যার?”

 

সতীশ মিত্রের ভ্রু কুঞ্চিত হল। “কসবায়। আপনাদের ঠিকানা দেননি?”

 

“না স্যার, শুধু আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে গিয়েছেন।”

 

“স্ট্রেঞ্জ! যাক, আর কিছু জানতে চান?”

 

ভদ্রলোকের সময়ের দাম আছে, আর আমাদের জন্য সময় নষ্ট করতে চান না মনে হল।

 

“আচ্ছা স্যার, আসি।” একেনবাবু উঠে পড়লেন, সেই সঙ্গে আমরাও।

 

উকিল মশাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেসটা কী বলুন তো, শ্যামলবাবু পরিষ্কার বলে গেলেন যে সতীশ মিত্রের কাছে উনি তদন্তের জন্য যা টাকা লাগে রেখে যাবেন, অথচ সতীশ মিত্র বলছেন কিছুই জানেন না!”

 

“মনে হয় টাকাটা উকিল মশাই মেরে দিয়েছেন। যার টাকা তিনি তো আর খোঁজ নিতে আসবেন না।” প্রমথ সবকিছুই নেগেটিভলি দেখে।

 

“আরেকটা সম্ভাবনা হল,” আমি বললাম, “হয়তো সতীশ মিত্রকে ইনস্ট্রাকশন দেবার আগেই উনি খুন হয়েছেন।”

 

“কে জানে স্যার, একেনবাবু একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, “তবে ডেফিনিটলি কনফিউসিং।”

 

“আপনি কিছু একটা ভাবছেন,” প্রমথ একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল।

 

“তা একটু ভাবছি স্যার।”

 

“ঝেড়ে কাশুন না, আপনার ভাবনাটা আমাদেরও একটু ভাবতে দিন।”

 

“আজ সকালে রাখালকে ধরতে পেরেছি, কাজে জয়েন করেছে। ওর কাছে শুনলাম পুলিশ শ্যামলবাবুর মৃত্যুটা আত্মহত্যা বলেই ভাবছে।”

 

“আত্মহত্যা!”

 

“তাই তো বলল, স্যার।”

 

“তাই যদি হবে, তাহলে ভদ্রলোক আমাদের কাছে খুন হতে যাচ্ছেন কাহিনি ফাঁদলেন কেন? বিশ হাজার টাকাই বা দিলেন কেন? মেকস নো সেন্স!”

 

“সেটাই তো কনফিউসিং স্যার।”

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আত্মহত্যা সন্দেহ করার কারণটা কী?”

 

“মারা যাবার কিছু আগে তিনি একটা এস.এম.এস পাঠিয়েছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’ বলে।”

 

“কাকে পাঠিয়েছিলেন?”

 

“বিনয়বাবুকে।”

 

“বিনয়? মানে যাকে উনি ওঁর সম্পত্তি দিয়ে গেছেন!”

 

“ঠিক স্যার।”

 

“এস.এম.এস-টা যে উনিই করেছেন তার প্রমাণ কী?”

 

“শ্যামলবাবুর ফোন থেকেই করা হয়েছে স্যার।”

 

“তা বুঝলাম,” প্রমথ বলল, “কিন্তু কেউ তো ওকে খুন করেও ওঁর ফোন থেকে এস.এম.এস করতে পারে। পারে না?”

 

“তা পারে স্যার।”

 

“তাহলে?”

 

“পুলিশের কাছে খবর উনি প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারে ভুগছিলেন, ডাক্তাররা ওঁকে তিনমাসের মতো সময় দিয়েছিল। মৃত্যুকে বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারতেন না, তার ওপর ক্যানসারের যন্ত্রণা!”

 

আমি আর প্রমথ চুপ করে রইলাম। পুলিশের চিন্তাটা অযৌক্তিক নয়, কিন্তু এক্ষেত্রে শ্যামলবাবুর আমাদের কাছে এসে ওই সব বলার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

 

একেনবাবু আস্তে আস্তে বললেন, “যে লোকটা কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যাচ্ছে, তাকে কেউ খুন করতে চাইবে কেন? কী লাভ?”

 

“হয়তো যে খুন করেছে খবরটা জানত না। অথবা, এটা আপনার সেই আইডিয়াল জুয়েলরির কাফলিংক-এর কেসের মতো… খুন করা হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে।” আমি বললাম।

 

“হতে পারে স্যার।”

 

“আবার নাও হতে পারে, প্রমথ বলল। “পুলিশ এক্ষেত্রে হয়তো ঠিকই বলছে– এটা পিওর এন্ড সিম্পল কেস অফ সুইসাইড। যদিও তাতে একেনবাবুর ক্ষতি।”

 

“তার মানে?”

 

“ওঁর ফি-টা মাঠে মারা যাবে।”

 

“ফি-টা দিচ্ছে কে? দেবার তো কোনো লোক নেই। কী মশাই, চুপ করে আছেন কেন?”

 

“কী আর বলব স্যার,” বলে একেনবাবু মুখে কুলুপ আঁটলেন।

 

 

পাঁচ

শ্যামল দত্তর মৃত্যু নিয়ে হয়তো আমরা কেউই আর মাথা ঘামাতাম না, যদি না হঠাৎ শিবদাস রায় বলে এক ভদ্রলোক বৃহস্পতিবার সকালে আমাদের আড্ডায় এসে হাজির হতেন। শিবদাস রায় নামটা চেনা চেনা কেন লাগছিল সেটা পরিষ্কার হল যখন জানলাম উনি শ্যামলবাবুর বিজনেস পার্টনার ছিলেন। শিবদাসবাবু জানালেন, শ্যামলবাবু ওঁকে বলে গিয়েছেন, যদি কোনো কারণে ওঁর হঠাৎ মৃত্যু হয়, তার তদন্তের জন্য যা খরচাপাতি লাগে একেনবাবুকে যেন দেন।

 

যাক, একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, শ্যামলবাবু অন্তত একজনকে একেনবাবুকে কাজে নিযুক্ত করার কথাটা জানিয়েছেন।

 

শিবদাসবাবুও দেখলাম সমস্ত ব্যাপারটাতে বেশ কনফিউসড। কেন শ্যামলবাবু খুন হবেন বলে ভয় পাচ্ছিলেন শিবদাসবাবু জানতেন না। শ্যামলবাবুকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করতে হবে কেন! সন্তোষজনক কোনো উত্তর পাননি। শিবদাসবাবু জানতেনও না শ্যামলবাবুর ক্যানসারের কথা! জেনেছেন বিনয়ের কাছ থেকে শ্যামলবাবুর মৃত্যুর পর। একেনবাবুর কাছে উনি এসেছেন ওঁর পার্টনার ও বন্ধুর অনুরোধ রক্ষা করতে। তবে শিবদাসবাবুর কাছ থেকে জানতে পারা গেল শ্যামলবাবু উইল করে ভাইপো সত্যব্রতর জন্য দু-লাখ টাকা ছাড়া পুরো সম্পত্তিই বিনয়কে দিয়ে গেছেন।

 

“উনি কি ওঁর উইল পালটাবার কথা ভেবেছিলেন?”

 

সঠিক উত্তর শিবদাসবাবু দিতে পারলেন না। তবে বললেন, “ভাইপোর ভাগটা একটু বাড়াবার কথা বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিল। যেদিন মারা যায়, তার দিন দুই আগে বলেছিল নতুন একটা উইল করেছে বা করছে। খুব মন দিয়ে কথাটা শুনিনি, জোর করে বলতে পারব ন। করে থাকলে ওঁর উকিল সতীশ মিত্র জানবেন।”

 

একেনবাবু বললেন, “সতীশ মিত্র কিন্তু সে-রকম কিছু বলেননি।”

 

“তাহলে হয়তো করছি’ বলেছিল, শেষ পর্যন্ত করেনি।”

 

“উইল করতে তো উকিল লাগে না, দু-জন সাক্ষী থাকলেই যথেষ্ট, প্রমথ গম্ভীর ভাবে বলল।

 

“তাই নাকি? রেজিস্ট্রি-টেজিস্ট্রি করতে হয় না?” শিবদাসবাবু প্রশ্ন করলেন।

 

বিজ্ঞের মতো সাক্ষীর কথাটা বললেও প্রমথও নিশ্চয় জানে না। জানলে প্রশ্নের উত্তরে নির্বাক হয়ে থাকার পাত্র সে নয়!

 

যাইহোক, শিবদাসবাবু একেনবাবুকে বললেন, তদন্তের কাজে টাকা যা প্রয়োজন ওঁকে জানাতে। বিশ হাজার টাকার অ্যাডভান্স দেওয়ার কথা উনি জানেন। সেটা শেষ হলেই উনি আবার কিছু অ্যাডভান্স করে যাবেন।

 

এখন পর্যন্ত একবার উকিল সতীশ মিত্রের বাড়ি যাওয়া আর দুয়েকটা ফোন কল ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করা হয়নি। সুতরাং আবার আগাম টাকা নেবার প্রশ্ন নেই।

 

শিবদাসবাবুর কাছ থেকে বিনয়বাবুর ফোন নম্বর আর ঠিকানাটা সংগ্রহ করা গেল। সত্যব্রতর ঠিকানাটা ওঁর জানা নেই। তবে জেনে যত তাড়াতাড়ি পারেন জানিয়ে দেবেন বললেন। শ্যামলবাবুর আর এক বিজনেস পার্টনার শৈবাল চৌধুরী আবার শিবদাসবাবুর বন্ধু। ওঁর ঠিকানা আর ফোন নম্বরও শিবদাসবাবুর কাছ থেকে পাওয়া গেল।

 

“ভালোকথা স্যার, ওঁর ডাক্তার কে ছিলেন?”

 

“ওর নানান সমস্যা ছিল, অনেকের কাছেই যেত। সবার নাম বলতে পারব না। তবে ছোটোখাটো অসুখে আমি আর ও দু-জনেই ডাক্তার অমল সেন-এর কাছে যেতাম।”

 

এক অমল সেনের চেম্বার আমি দেখেছি, দেশপ্রিয় পার্কের কাছে শরৎ বসু রোডের উপর।

 

“ঘাঁর চেম্বার শরৎ বসু রোডে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“হ্যাঁ, উনিই।”

 

“সবার ঠিকানাই তো দিলেন স্যার, এবার আসল লোকের ঠিকানাটা দিন।”

 

“আসল লোক! ও..” ভদ্রলোক এবার বুঝতে পারলেন, “এই নিন আমার কার্ড। এতে আমার মোবাইলের নম্বরও আছে। যখন দরকার মোবাইলেই করবেন, নইলে আমাকে ধরা মুশকিল।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।” শিবদাসবাবু যখন চলে যাচ্ছেন, একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, আপনার সঙ্গে শ্যামলবাবুর শেষ দেখা কবে হয়?”

 

শিবদাসবাবুকে একটু ভাবতে হল, “তা প্রায় দিন পনেরো আগে।”

 

“তখনই আপনাকে আমার কথা বলেছিলেন?

 

“না না, আপনার কথা বলেছিলেন ফোনে, এই কয়েকদিন আগে। আসলে ওর শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছিল না। নইলে আগে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের দেখা হত। অফিসে আসত নিয়মিত।”

 

“ঠিক আছে স্যার, আপনাকে আর আটকাব না।”

 

.

 

শিবদাসবাবু চলে যাবার পর একেনবাবু দেখি চোখ বুজে ঘন ঘন পা নাচাচ্ছেন।

 

একেনবাবুর চিন্তা শুরু হলে ঘন ঘন পা নাচানো সুরু হয়। প্রমথ ওঁকে বহুবার বলেছে, ‘এই বিশ্রি হ্যাবিটটা ছাড়ন তো মশাই।’

 

একেনবাবু প্রতিবারই করুণভাবে বলেছেন, “কী করব স্যার, আপনা-আপনিই নাচে।

 

“ননসেন্স! এগুলো হচ্ছে ভলান্টারি মাসল, আপনা-আপনি নাচলেই হল!’

 

তাতে ক্ষণকালের জন্য নাচানি থেমেছে ঠিকই, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার নবোদ্যমে শুরু হয়েছে। প্রমথ যে প্রমথ, সেও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। পৃথিবীতে নাকি কিছু কিছু লোক আছে যাদের মানুষ করা সম্ভব নয়।

 

আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ভাবছেন বলুন তো?”

 

একেনবাবু পা নাচানি থামিয়ে বললেন, “একটু চা পেলে মন্দ হত না।”

 

“আপনারই তো বাড়ি মশাই এটা, বাপিকে বলছেন কেন!” তারপরেই হাঁক দিয়ে প্রমথ বলল, “বউদি, আপনার পতিদেবতার চা লাগবে।”

 

দূর থেকে উত্তর এল, “এই তো খেলেন।”

 

“এইসব দাম্পত্য খিটিমিটির মধ্যে আমাকে জড়াবেন না, আমি শুধু অনুরোধটা রিলে করছি।”

 

সহাস্য উত্তর এল, “আচ্ছা ভাই, সবাইকেই দিচ্ছি।”

 

একেনবউদির আবার প্রমথকে খুব পছন্দ। ওঁর ধারণা প্রমথর জন্যেই ওঁর কর্তা একটু সিধে থাকেন।

 

“চা তো আসছে, এবার বলুন কী ভাবছেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“স্টুয়ার্ট সাহেব সব সময়ে ওঁর লোকদের বলতেন, ফলো দ্য মানি ট্রেইল অথবা ফাইন্ড দ্য উওম্যান।”

 

“আপনার আস্পর্ধা তো কম নয় মশাই, বউদির করা চা খাচ্ছেন, আর বউদির জাতকে গালমন্দ করছেন! সব ক্রাইমের পেছনেই মেয়ে জড়িত, এটা একটা কথার কথা হল!” প্রমথ বলল।

 

“কী যে বলেন স্যার, এটা কি আমার কথা! স্টুয়ার্ট সাহেবের কথা। আর মেয়ে ছাড়া টাকার কথাটাও তো আছে।”

 

“শ্যামলবাবুর চেহারা দেখে তো মনে হল না খুব একটা উওম্যানাইজার বলে,” আমি বললাম। “কিন্তু টাকার ব্যাপার থাকতে পারে। বিনয় যদি আঁচ করে শ্যামলবাবু উইল পালটে ভাইপোকে একটা বড়ো অংশ দিতে চলেছেন, তাহলে সেটা উকিলের কাছে জমা পড়ার আগে শ্যামলবাবুকে সরিয়ে দেওয়াটা নিশ্চয় একটা সম্ভবনা।”

 

“তুই বলছিস বিনয়ই খুন করেছে?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

 

“আমি একটা পসিবিলিটির কথা ভাবছি। আপনি কী বলেন একেনবাবু?”

 

“অবশ্যই সেটা একটা সম্ভাবনা স্যার।”

 

একেনবাবু আমার কথায় সায় দিচ্ছেন দেখে আমি উৎসাহিত হলাম। বললাম, “শুধু সম্ভাবনা নয়, আমার মনে হচ্ছে এটাই ঘটেছে। নইলে যে লোকটা এমনিতেই তিন-চার মাস বাদে মারা যাচ্ছে, তাকে খুন করে কী লাভ? লাভটা এইখানে যে উনি তিন মাস বাঁচলে বিনয়বাবুর আর্থিক ক্ষতি।”

 

“তুই বলছিস, এস.এম.এস-টা বিনয়ই ওঁর মোবাইল থেকে করেছিল?”

 

“নিশ্চয়, পুলিশকে ধোঁকা দেবার জন্য যে এটা আত্মহত্যা।”

 

“দ্যাটস টু সিপ্লিস্টিক এন্ড অবভিয়াস!” প্রমথ আমাকে উড়িয়ে দিল। পুলিশ যদি এত সহজেই ধোঁকা খায়, তাহলে এদেশে কোনো খুনি ধরা পরবে না!” তারপর একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার চেলা রাখালবাবু কী বলেন?”

 

“আপনি স্যার বড় লজ্জা দেন, রাখাল আমার চেলা হবে কেন! তবে রাখাল আজ বিকেলে আসছে।”

 

“তাহলে আমরাও আসব। আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?”

 

“শুনছেন স্যার, প্রমথবাবুর কথা। আপনারা আসবেন তার জন্য আবার পারমিশন লাগবে?”

 

 

ছয়

পুলিশের থিওরিটা কী, সেটা অবশ্য কিছুটা আমরা আঁচ করতে পারলাম রাখালবাবুর কথায়। পুলিশ প্রথমে শ্যামলবাবু খুন হয়েছিলেন বলেই সন্দেহ করছিল। তার একটা কারণ, ওঁর উইলটা পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ওঁর ভাইপোই সেটা আবিষ্কার করে ওঁর খাটের নিচ থেকে। উইল হারানোর সমস্যা মেটার পর তিনটে জিনিস পুলিশের চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এক নম্বর হল, শ্যামলবাবু ক্যানসারে খুবই শারীরিক কষ্ট পাচ্ছিলেন। খুব হেভি ডোজে পেইন কিলার খেয়ে দৈনন্দিন কাজ ম্যানেজ করছিলেন। এ ভাবে বাঁচার অর্থ হয় না, এই কথা বিনয় এবং ওঁকে দেখাশুনা করার জন্য যে-দুটি কাজের লোক ছিল তাদের একাধিক বার বলেছেন। দ্বিতীয়ত, উনি ব্যথার জন্য অফিসে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন। ঘরে বসে হাঁফিয়ে উঠে এক-আধবার বাইরে যেতেন। এই বাইরে গিয়েই কারোর সঙ্গে দেখা হয় এবং কোনো একটা দুঃসংবাদ পান। তাতে তিনি খুবই বিচলিত হয়ে বাড়িতে ফেরেন। দুঃসংবাদটা ঠিক কী, বিনয় বা ওঁর বাড়ির কাজের লোকদের কেউই বলতে পারেনি। শরীরের কষ্ট ছাড়াও মানসিক কষ্টটাও ওঁর পক্ষে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। তৃতীয়ত, মৃত্যুর দিন উনি ভোরবেলা কাউকে না জানিয়েই একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। সাধারণত উনি একজন কাউকে সঙ্গে নিতেন। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে বিনয়কে যে এস.এম.এস পাঠিয়েছিলেন, সেটা তো খবরেই বেরিয়েছে। কিন্তু..

 

এইবার বুঝলাম এই ‘কিন্তু’-টার জন্যেই রাখালবাবুর আগমন।

 

রাখালবাবু এত সহজে এটাকে সিম্পল আত্মহত্যা বলে মানতে রাজি নন। তবে উনি নিজে এই তদন্তের দায়িত্বে নেই। যে তদন্ত করছে, সে রাখালবাবুর সহকর্মী। রাখালবাবু তাঁকে উৎসাহ দিচ্ছেন আত্মহত্যার পেছনে কোনো চাপ ছিল কিনা অনুসন্ধান করতে। এমন কী হত্যার সম্ভাবনাটাও সম্পূর্ণ উপেক্ষা না করতে। কার সঙ্গে দেখা হওয়ায় শ্যামলবাবু ওই রকম বিচলিত হয়ে ফিরেছিলেন? ওঁর আত্মহত্যার পেছনে কি সেই লোকটির কোনো অবদান ছিল? কেউ কি শ্যামলবাবুকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছিল?

 

একেনবাবু রাখালবাবুকে জানালেন শ্যামলবাবু মৃত্যুর আগে তিনটি চিঠি পেয়েছিলেন। তিনটি চিঠিতেই ওঁকে রবিবার খুন করা হবে জানানো হয়েছিল, আর খুন উনি রবিবারই হন। রাখালবাবু শুনে নিশ্চিত হলেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু কেন এই খুন? সেটাই এখন মস্ত বড় প্রশ্ন। একেনবাবুর কাছ থেকে চিঠিগুলো নিয়ে রাখালবাবু মন দিয়ে পড়লেন। তারপর বললেন, “এই চিঠিগুলো কি আমি নিয়ে যেতে পারি স্যার?”

 

“নিশ্চয়, কিন্তু ভাই একটা শর্তে?”

 

“কী শর্ত?”

 

“তোমার এই সহকর্মীটি যেন আমার প্রশ্ন-টশ্ন থাকলে ঠিকমতো উত্তরটা দেন।”

 

“একদম ভাববেন না দাদা, আপনার যা প্রশ্ন থাকবে আমায় জানাবেন, আমি উত্তর এনে দেব।”

 

রাখালবাবু চলে যেতে প্রমথ বলল, “আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই, চিঠিগুলো দিয়ে দিলেন– ওতে তো অনেক ক্লু লুকিয়ে থাকতে পারে?”

 

তা পারে স্যার।”

 

“তাহলে?”

 

“আমি তো হ্যান্ড-রাইটিং এক্সপার্ট নই স্যার। সেই পুলিশেরই সাহায্য নিতে হত। রাখালের কাছ থেকে সেটা এখন পাওয়া যাবে।” বলে পকেট থেকে মোবাইলটা বার করলেন।

 

“আপনি মশাই মহা ধান্দাবাজ! এদিকে ভাব দেখান ভাজামাছটি উলটে খেতে জানেন না।”

 

একেনবাবু মোবাইলে কাকে জানি ধরার চেষ্টা করছিলেন, প্রমথর কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়লেন, ভাবটা প্রমথবাবুকে নিয়ে আর পারা যায় না!

 

“হ্যালো, বিনয়বাবু আছেন?… আমাকে চিনবেন না, আমার নাম একেন সেন। শ্যামলবাবু আমাকে একটা কাজের ভার দিয়ে গিয়েছেন, সেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।… কী কাজ? সেটা দেখা হলে বলব।… কালকে আপনি বাইরে যাচ্ছেন? আজকে সময় হবে?… ঠিক আছে স্যার, আজকেই আসব।… এই ধরুন আধ ঘণ্টার মধ্যে।”

 

ফোনটা বন্ধ করে একেনবাবু বললেন, “স্যার, আপনার সঙ্গে গাড়ি আছে?”

 

“আছে।”

 

“তাহলে চলুন, একটু বিনয়বাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি।”

 

 

সাত

বিনয়ের বয়স পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে হবে। শ্যামবর্ণ, দোহারা চেহারা। একেনবাবু আমাদের পরিচয় দিয়ে আসার কারণটা যখন বললেন, তখন সতীশ মিত্রের মতো বিনয়ও খুবই অবাক হল। চিঠি পাঠিয়ে কেউ যে ওঁকে খুন করবে বলেছিল, সেটা বিনয় একেবারেই জানত না।

 

“কী আশ্চর্য, আমাকে তো উনি এসব কিছুই বলেননি!”

 

“ওঁর হাবেভাবেও আপনি কিছু টের পাননি?”

 

বিনয় এক মুহূর্ত চুপ করে আস্তে আস্তে বলল, “একথা ঠিক যে, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে কিছু একটা ঘটেছিল! উনি বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটাচ্ছিলেন। আমি কারণটা জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোনো উত্তর দেননি। আমিও পীড়াপীড়ি করিনি। কিন্তু এর পেছনে যে এসব চলছে…” গলাটা ধরে এল। কথাটা আর শেষ করতে পারল না। খুবই শোকগ্রস্ত বুঝতে অসুবিধা হল না। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বিনয় বলল, “উনি আমার পিতৃতুল্য ছিলেন। অসুখে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন, সেই কষ্ট সহ্য না করতে পেরে চলে যাওয়া হয়তো কিছুটা বুঝি, কিন্তু এখন আপনি যা বলছেন সে তো ভয়ঙ্কর কথা! আপনি তাহলে সন্দেহ করছেন…” “খুন হয়েছেন’ কথাটা বিনয় উচ্চারণ করতে পারল না।

 

“চিঠির সঙ্গে মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নাও থাকতে পারে,” বিনয়কে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন একেনবাবু। তারপর বললেন, “আমি শুনেছি স্যার, ডাক্তার ওঁর আয়ু আর মাত্র কয়েক মাস আছে বলেছিলেন, সেটা কি সত্যি?”

 

“আমাকে আবার স্যার বলছেন কেন,” বিনয় সঙ্কোচের সঙ্গে বলল।

 

“ওটা ওঁর অভ্যাস। নিজের স্ত্রীকেও ম্যাডাম বলেন, গায়ে মাখবেন না,” এই প্রথম প্রমথ মুখ খুলল।

 

“আপনি জানতেন স্যার যে ওঁর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে?”

 

“হ্যাঁ, ডাক্তাররা ওঁকে বড়োজোর মাস ছয়েক সময় দিয়েছিলেন। এরমধ্যে যা যা করণীয় করে নিতে বলেছিলেন।”

 

“এসব ক্ষেত্রে সাধারণত করণীয়র মধ্যে তো একটা উইল থাকে স্যার। কোনো উইল কি উনি করেছিলেন বলে আপনি জানেন?”

 

বিনয় একটু ইতস্তত করে বলল, “ওঁর একটা আগেই করা ছিল।”

 

“আই সি। ওঁর তো অজস্র সম্পত্তি স্যার, কারা পাচ্ছেন?”

 

“প্রায় সবই আমাকে দিয়ে গেছেন,” বিনয়কে বেশ নিষ্প্রভ শোনাল।

 

“আপনি ছাড়া ওঁর আর কোনো আপনজন নেই স্যার?”

 

“ওঁর এক ভাইপো আছেন। তাকেও কিছু টাকা দিয়ে গেছেন।”

 

“ওঁর ভাইপোর নাম ঠিকানা আপনার জানা আছে?”

 

বিনয় ড্রয়ার খুলে একটা কার্ড বার করে দিল।

 

সত্যব্রত দত্ত, নীচে যোধপুর পার্কের একটা ঠিকানা আর ফোন নম্বর। একেনবাবু পকেট থেকে পেন বার করে নিজের ডায়েরিতে সেটা লিখতে যাচ্ছেন দেখে বিনয় বলল, “আপনি কার্ডটা রেখে দিন। ওঁর আরও একটা কার্ড আমার কাছে আছে।”

 

“উনি কী করেন স্যার?”

 

“অভিনয়। থিয়েটার, টেলিফিল্ম, মাঝেমাঝে যাত্রাতেও করেন।”

 

একেনবাবু কার্ডটা পকেটস্থ করে বললেন, “আচ্ছা স্যার, আজ তাহলে চলি।”

 

আমরা যখন দরজার কাছাকাছি বিনয় জানতে চাইল, “আমি কি এই চিঠিগুলোর কথা পুলিশকে জানাব?”

 

“পুলিশ জানে,” বলে কান চুলকোতে চুলকোতে কয়েক পা এগিয়ে একেনবাবু হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন। “ভালোকথা স্যার, যাবার আগে একটু জেনে যাই, আপনি কত বছর হল এখানে আছেন?”

 

প্রশ্নের আকস্মিকতায় বিনয় একটু বিস্মিত। “প্রায় আট বছর।”

 

“তার আগে?”

 

“ক্রিশ্চান মিশনারিদের একটা অনাথ আশ্রমে ছিলাম।”

 

“আপনার বাবা-মা?”

 

“বাবাকে দেখিনি। মা খুব অভাবের মধ্যে ছিলেন, আমাকে বছর পাঁচেক বয়সে আশ্রমে রেখে দিয়ে চলে যান। সেখানেই বড় হয়েছি।”

 

“মা-কে আপনি আর দেখেননি স্যার?”

 

“না।”

 

“কোন আশ্রমে ছিলেন আপনি?

 

“ফাদার লাফিয়ের আশ্রমে।”

 

“সেটা কোথায়?”

 

“কটক থেকে মাইল দশেক দূরে পারিপোতা বলে একটা জায়গায়।”

 

“আর একটা কথা, শ্যামলবাবু নাকি ওঁর উইলটা কিছুদিন আগে উকিল সতীশ মিত্রের কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন, সেটা কোথায় আছে জানেন?”

 

“নিয়ে আসার ব্যাপারটা আমি জানতাম না। কিন্তু ওটা পাওয়া গেছে ওঁর তোষকের নীচে। সত্যব্রতবাবুই খুঁজে পেয়ে পুলিশকে দিয়েছেন।”

 

“যেটা পাওয়া গেছে সেটা আপনি দেখেছেন?”

 

“হ্যাঁ, কেন বলুন তো?”

 

“উইলটা নকল নয় তো?”

 

“না, না, নকল কেন হবে!”

 

“উইলের আর কোনো কপি আছে আপনার কাছে?

 

“আমার কাছে! না-তো।”

 

“ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, শ্যামলবাবু যেদিন সকালে মারা যান, সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন?”

 

“আমাকে শিবদাসবাবু ডেকেছিলেন একটা জরুরি ব্যাপারে আলোচনার জন্য।”

 

“কী ব্যাপারে?”

 

“সেটাই বলতে পারব না। ওঁর বাড়ি গিয়ে শুনি উনি বাড়ি নেই। তার পরেই তো অঘটন ঘটল। আর জানা হয়নি ব্যাপারটা কী। হয়তো অতটা জরুরি নয়, নইলে জানাতেন।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, চলি। আপনার সময় আর নষ্ট করব না।”

 

“সময় নষ্টের কি আছে, যদি দরকার হয় আবার আসবেন। এই সময়ে বাড়িতেই সাধারণত থাকি।”

 

.

 

বাইরে বেরিয়ে প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “আপনি মশাই বিনয়ের কুষ্ঠি-ঠিকুজি নিয়ে এত মেতেছেন কেন?”

 

“কে জানে স্যার, সবার সম্পর্কেই আমার জানতে ইচ্ছে করে।”

 

“বুল শিট,” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি দিনকে দিন বেশি প্যাঁচালো হচ্ছেন।”

 

“দেখছেন স্যার, আমার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন, “প্রমথবাবুকে সত্যি কথা বলাও বিপদ।”

 

“তাহলে আর কষ্ট করবেন কেন, মিথ্যেই বলুন।”

 

“আপনিও স্যার, প্রমথবাবুর মতো কথা বলছেন।”

 

আমি মুচকি হাসলাম।

 

“একটা কথা বলি স্যার।”

 

“বলে ফেলুন,” প্রমথ বলল।

 

“আপনাদের হাতে কি আরেকটু সময় আছে?”

 

“ঝেড়ে কাশুন না মশাই, ভনিতা না করে।”

 

“তাহলে ওই সত্যব্রতবাবুর সঙ্গে একটু দেখা করে যেতাম।”

 

“এখন তো সন্ধে পার হতে চলল, অ্যাক্টর মানুষ– ওকে কি এত সহজে পাবেন?”

 

“দেখছি স্যার।”

 

একেনবাবুর ভাগ্য সুপ্রসন্ন, সত্যব্রতকে ধরা গেল। আমাদের সঙ্গে দেখা করতেও ওঁর আপত্তি নেই।

 

.

 

সত্যব্রত থাকে যোধপুর পার্কের পোস্ট অফিসের কাছে। দোতলা বাড়ি, নীচের তলায় একটা গানের স্কুল। সত্যব্রত আমাদের বয়সি বা আমাদের থেকে একটু ছোটোই হবে। শ্যামলবাবুর ভাইপো বোঝা যায়, মুখে শ্যামলবাবুর আদল আছে। আমাদের আসার কারণটা জেনে বলল, “আমার সঙ্গে তো কাকার প্রায় কোনো সম্পর্কই ছিল না, এ বিষয়ে কী বলব!”

 

“আপনার সঙ্গে কাকার শেষ দেখা কবে হয়েছিল স্যার?”

 

“মাস তিনেক আগে। উনিই ডেকে পাঠিয়েছিলেন।”

 

“কেন জানতে পারি স্যার?”

 

“উনি একটা উইল করেছিলেন, সেটা জানাতে।”

 

“আপনাকে নিশ্চয় কিছু দিয়ে গেছেন?”

 

সত্যব্রত একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “নামমাত্র, লাখ দুয়েক। পুরোটাই দিয়ে গেছেন ওঁর পেয়ারের লোক বিনয়কে। অথচ…।” সত্যব্রত একটু থামলেন।

 

“অথচ?”

 

“কাকুকে মানুষ করেছিলেন আমার বাবা। বাবা না থাকলে ওঁকে পথে পথে ঘুরতে হত।”

 

“আপনার সঙ্গে কি ওঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না?”

 

“ছিল। উনি আমাকে আইন পড়িয়ে ওকালতি ব্যবসাতে ঢোকাতে চেয়েছিলেন। ওঁর চাপে পড়ে পড়েছিলাম, পরীক্ষায় পাশও করেছিলাম। কিন্তু উকিলগিরি করা আমার ধাতে নেই। অভিনয় করতে ভালো লাগে, সেটাই করতে শুরু করলাম। ওঁর আপত্তিতে কান দিইনি, তাতেই বিগড়ে গেলেন। একদিন জানিয়েই দিলেন মুখদর্শন করতে চান না আমার। আমিও যাইনি ওঁর কাছে।”

 

“মুখদর্শন তো শেষে করলেন স্যার।”

 

“তার মানে?”

 

“মানে উইলের কথা জানাতে।”

 

“ও হ্যাঁ।”

 

“বিনয়বাবু সম্পর্কে আপনি কী জানেন স্যার?”

 

এমন সময়ে ওঁর একটা ফোন এল। “এক সেকেন্ড,” বলে ফোনে কার সঙ্গে একটু কথা বললেন। মনে হল বেশ বিরক্ত। “আরে ফোনে কেন, মোবাইলে করবে তো!… ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি আসছি.” ফোন শেষ করে একেনবাবুকে বললেন, “নতুন নতুন লোক সব প্রডাকশনে এসেছ.. কমপ্লেন করছে, ‘ফোনে আপনাকে পাচ্ছি না!’ বুঝুন, মোবাইল রয়েছে কী করতে? মোবাইল ছাড়া আমাদের ধরা যায়! যাইহোক, কী জানি বলছিলেন?… বেশি সময় কিন্তু দিতে পারব না, আজ রাতে খানিক বাদেই আমার শু্যটিং।”

 

“জিজ্ঞেস করছিলাম স্যার, বিনয়বাবু সম্পর্কে আপনি কী জানেন?”

 

“প্রায় কিছুই না। একটা অনাথ আশ্রম থেকে হঠাৎ ঘটা করে নিয়ে এলেন। তারপর তাকে বি.কম পাশ করালেন। সেই থেকে বিনয়ই ওঁর কাজকর্ম সব কিছু দেখছে এবং আমার ধারণা এরমধ্যে বেশ কিছু হাতিয়ে নিয়েছে।”

 

“এখন তো আর হাতাবার দরকার নেই স্যার, সব কিছুই উনি পাচ্ছেন।”

 

“তাই তো মনে হয়।”

 

“মনে হয় কেন বলছেন স্যার?”

 

“কার কাছে জানি শুনলাম, কাকু উইলটা বাতিল করে নতুন উইল করার কথা ভাবছিলেন।”

 

“সেই উইলে কি আপনাকে বেশি কিছু দেবার কথা ভাবছিলেন?”

 

“আমি কী করে বলব! শোনা কথা।”

 

“কার কাছে শুনেছিলেন?”

 

বোধহয় শিবদাসবাবুর কাছ থেকে কিংবা ওঁরই অফিসের কারোর কাছ থেকে। সত্যি কথা বলতে কী, কাকুর সম্পত্তির উপর আমার কোনো লোভ নেই। লোভ থাকলে ওঁর উইলটা খুঁজতাম না। উইলটা আমিই ওঁর ঘর থেকে খুঁজে পেয়ে পুলিশকে দিই।”

 

“তাইতো শুনলাম স্যার।”

 

“আমাকে দু-লাখ টাকা দিয়ে গেছেন। না দিলেও চলত। আমার এই বাড়ি আছে। অ্যাক্টিং করে আর স্ত্রীর গানের স্কুল থেকে ঠাকুরের কৃপায় মন্দ আসে না। আমাদের ভালোই কেটে যায়।”

 

“নীচের স্কুলটা আপনার স্ত্রী-র স্যার?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“উনিই গান শেখান স্যার?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“বাঃ, দারুণ তো স্যার! আপনি অভিনেতা, উনি গায়িকা!”

 

একেনবাবুর এই সব অর্থহীন বকবকানিতে আমরা অভ্যস্ত, কিন্তু সত্যব্রত নয়, তাই একটু অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল।

 

“আমি কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছি স্যার, আপনারা হলেন শিল্পী-দম্পতি।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ।”

 

“আচ্ছা স্যার, বিনয়বাবুর স্ত্রীও গান-টান গান?”

 

“ওর কোনো স্ত্রী আছে বলে তো জানি না। হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

 

“এমনি স্যার। আপনার স্ত্রী আছে জানতাম না, তাই ভাবলাম ওরও হয়তো স্ত্রী আছে।“

 

একেনবাবুর এই প্রশ্নের না আছে মাথা না আছে মুণ্ডু, আমিই অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম। প্রমথ বলল, “চলুন একেনবাবু, ওঁকে তো শু্যটিং-এ যেতে হবে!”

 

“ও হ্যাঁ স্যার। আচ্ছা, আসি স্যার, নমস্কার।”

 

নীচে নেমে এসে প্রমথ একেনবাবুকে এই মারে কি সেই মারে, “আপনি একটা যাচ্ছেতাই মশাই, কী উলটোপালটা কথা বলতে শুরু করেছেন, গাঁজা ভাঙ খেয়েছেন নাকি?”

 

একেনবাবু বললেন, “আসলে স্যার বিনয়বাবু সম্পর্কে কতগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল। তাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম।”

 

“বিনয়বাবু সম্পর্কে প্রশ্ন বিনয়বাবুকে করুন, সত্যব্রতকে কেন করছেন? কী ভাবলেন বলুন তো আপনাকে?”

 

 

আট

সত্যব্রতবাবুর সঙ্গে দেখা হবার দু-দিন পরে রাখালবাবু আমাদের সান্ধ্য-আড্ডায় এসে একটা বম্বশেল ফাটালেন। পুলিশ নাকি মোটামুটি নিশ্চিত যে শ্যামলবাবুকে খুন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিনয়কে খুনি সন্দেহে ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। বিনয়কে সন্দেহ করার কারণ একাধিক। প্রথমত, শ্যামলবাবু নতুন একটা উইল করতে যাচ্ছিলেন, তাতে বিনয়ের জন্য অল্প কিছু রেখে বেশির ভাগই সত্যব্রতবাবুকে দেবার প্ল্যান ছিল। বিনয় সেটা ঘটতে দিতে চায়নি। দ্বিতীয়ত, বিনয় পুলিশকে জানিয়েছিল যে, বিনয়কে শ্যামলবাবু এস.এম.এস পাঠিয়েছিলেন মৃত্যুর খানিকক্ষণ আগে। কিন্তু মোবাইল কোম্পানির কাছে খবর নিয়ে জানা গেছে যে, ভোরবেলাতে বিনয়ের মোবাইল ফোনটা বাঘাযতীন স্টেশনের কাছে ছিল। বিনয় এখন বলছে যে, ওর ফোনটা সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছিল না। দুপুরবেলা আবিষ্কার করে ওটা সোফার উপরেই ছিল, একটা পত্রিকার নীচে। তখনই এস.এম.এস মেসেজটা দেখে এবং সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানায়। তৃতীয়ত, সকালবেলা যখন শ্যামলবাবুর মৃত্যু হয়েছে, তখন বিনয় বাড়িতে ছিল না। বিনয় বলেছে যে, শিবদাসবাবু ওকে একটা জরুরি ব্যাপারে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শিবদাসবাবুর মনে পড়ছে না যে উনি বিনয়কে ডেকেছিলেন বলে। ইনফ্যাক্ট শিবদাসবাবুই শ্যামলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে সেদিন সকালে এসেছিলেন, তখন শ্যামলবাবু বা বিনয় কাউকেই পাননি। সবচেয়ে যেটা ড্যামেজিং– সেটা হল, প্রত্যক্ষদর্শী এক রিক্সাওয়ালার কথা। সে বলেছে একজন নীলপাঞ্জাবি-পরা লোক একজন বৃদ্ধকে ধরাধরি করে বাঘাযতীন স্টেশনের কাছে রেললাইনের ধার দিয়ে হাঁটছিল। বিনয়ও সেদিন নীলপাঞ্জাবি পরে বেরিয়েছিল।

 

আমি প্রমথকে বললাম, “কীরে আমি যখন বলছিলাম বিনয়ই খুন করেছে, তখন তো আমার কথাটাকে উড়িয়ে দিলি এখন দ্যাখ, আমার লজিকে কোনো ভুল ছিল কিনা।”

 

প্রমথ ভাঙবে, কিন্তু মচকাবে না। বলল, “যেটা প্রথমে লজিক্যাল মনে হয়, সেটাই শেষপর্যন্ত বেঠিক হয়। মিস্ট্রি নভেলগুলো ভালো করে পড়িস? পড়লে দেখতিস, পুলিশরা তোর মত অতি-সরল যুক্তি ব্যবহার করে একজনকে ধরে, পরে দেখা যায় যে সে সম্পূর্ণ নির্দোষ।”

 

আর্গুমেন্ট খণ্ডন করার এ-রকম অর্থহীন প্রচেষ্টা প্রমথও খুব একটা করে না। আজ করে শুধু আমাকেই অপমান করল না, পুলিশের লোক রাখালবাবুকেও করল।

 

আমি বললাম, “তুই একটা ইডিয়ট। আমাকে অপমান করছিস কর, রাখালবাবুকে জড়াচ্ছিস কেন?”

 

“উনি তো তদন্ত করছেন না, ওঁকে অপমান করব কেন।” প্রমথর নির্বিকার উত্তর।

 

একেনবাবু দেখলাম চুপচাপ পা নাচাচ্ছেন। আমি বললাম, “কী মশাই, কী ভাবছেন?”

 

“কিছু না স্যার। আচ্ছা ভাই রাখাল, শ্যামলবাবুর উইলটা কার কাছে আছে?”

 

“পুলিশের হেফাজতে।”

 

“তোমরা নিশ্চিত, যেটা আছে সেটাই ওঁর শেষ উইল?”

 

“অন্য কোনো উইলের খবর তো কেউ জানে না।”

 

“ভাগ্যিস উইলটা পাওয়া গেল,” একেনবাবুর পা দেখলাম ঘন ঘন নাচছে। একটা কিছু ভাবছেন বোঝা যাচ্ছে। একবার শুধু বললেন, “বুঝলে ভাই, এই বিনয় সম্পর্কে একটু জানা দরকার।”

 

 

নয়

একেনবাবুর বিনয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ যে কতটা প্রবল, সেটা পরদিনই বুঝলাম। নানা জায়গায় ফোন করে তিনি আবিষ্কার করেছেন যে ফাদার লাফিয়ে কী কাজে জানি কলকাতায় এসেছেন। আছেন ওয়াইএমসিএ-তে। শুধু তাই নয় ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও বাগিয়ে নিয়েছেন। সন্ধ্যায় আমার ছোটমাসির বাড়ি যাবার কথা ছিল, সেটা ক্যানসেল করে একেনবাবু আর প্রমথকে নিয়ে রওনা দিলাম। ওয়াইএমসিএ এস.এন ব্যানার্জি রোড আর জওহরলাল নেহরু রোড দু-জায়গাতেই আছে। কোথায় ফাদার আছেন প্রশ্ন করাতে একেনবাবু বললেন, “দুটো ওয়াইএমসিএ আছে নাকি?”

 

প্রমথ বলল, “কি ডিটেকটিভ হয়েছেন মশাই, ঠিকানা পর্যন্ত খুঁজে বার করতে জানেন না!”

 

যাইহোক মোবাইল ফোনটা কাজে লাগল। আবার ফাদারকে ফোন করে জানা গেল যে, এস.এন ব্যানার্জি রোডে আছেন।

 

প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “হঠাৎ বিনয় সম্পর্কে এত জানার আগ্রহ হচ্ছে কেন বলুন তো?”

 

একেনবাবু কথাটার উত্তর দিলেন না।

 

.

 

ফাদার লাফিয়ের বয়স হয়েছে। বেলজিয়ামের লোক, কিন্তু ভারতবর্ষে আছেন প্রায় চল্লিশ বছর। বছর দশেক আসামে ছিলেন, গত তিরিশ বছর উড়িষ্যাতে একটা হাসপাতাল আর অনাথ আশ্রমের দায়িত্ব নিয়ে আছেন। ফাদার লাফিয়ে শুধু বিনয়কে নয়, শ্যামলবাবুকেও ভালোভাবে চিনতেন। শ্যামলবাবু এককালে উড়িষ্যাতে কন্ট্রাক্টরি করতেন। শ্যামলবাবুর মৃত্যুর খবরে খুবই দুঃখিত হলেন। বিনয় কেমন আছে জিজ্ঞেস করলেন। বিনয়কে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে এবং কেন করেছে শুনে উনি মর্মাহত! সাধারণত কলকাতায় এলে বিনয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, এবার দু-দিনের জন্য এসেছেন বলে আর করেননি।

 

“আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না বিনয় এ-রকম কাজ করতে পারে।” বার বার এই কথাটাই বললেন ফাদার।

 

একেনবাবু ফাদার লাফিয়েকে বিনয় সম্পর্কে অজস্র প্রশ্ন করলেন। তার থেকে যা উদ্ধার হল, তা হল: বিনয়ের যখন বছর পাঁচেক বয়স তখন বিনয়ের মা বিনয়কে অনাথ আশ্রমে রেখে যান। সাধারণত মা-বাবা কেউ বেঁচে থাকলে বাচ্চাদের আশ্রমে রাখা হত না। কিন্তু বিনয়ের মা-র বাচ্চাকে নিয়ে অনেক সমস্যা হচ্ছিল বলে ফাদার ওকে রাখতে সম্মত হন। সেই থেকে ও আশ্রমেই ছিল। পড়াশুনোয় খুব ভালো ছিল বিনয়। শ্যামলবাবু এরমধ্যে উড়িষ্যা থেকে চলে এলেও ফাদারের সঙ্গে শ্যামলবাবুর মাঝেমাঝেই ফোনে কথাবার্তা হত। ফাদারই কথা প্রসঙ্গে বিনয়ের কথা শ্যামলবাবুকে বলেন। মেধাবি ছাত্র জেনে শ্যামলবাবু নিজে থেকেই বিনয়ের কলেজে পড়াশুনোর দায়িত্ব নিতে চান। তাতে সুবিধাই হল, কারণ অনাথ আশ্রমে আঠেরো বছরের বেশি কাউকে রাখা হত না।

 

“বিনয়বাবুর মা-র সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি স্যার?”

 

“না, বাচ্চাকে রেখে যাবার পর সে আর আসেনি।”

 

“খোঁজখবর করেনি ছেলের?”

 

“হয়তো করেছে, কিন্তু আমি জানি না। আসলে আমার সেক্রেটারি ছিল অবিনাশ গুপ্ত। সে বিনয়ের মাকে একটু চিনত। তার কাছে যদি খবর নিয়ে থাকে।”

 

“অবিনাশবাবু এখন কোথায় থাকেন?”

 

“অবিনাশ অল্প কিছুদিন হল রিটায়ার করে কলকাতাতেই আছে।”

 

“ওঁর ঠিকানা বা ফোন নম্বর কি আছে আপনার কাছে?”

 

ফাদার একটা ডায়েরি বের করে একটু খুঁজে একটা ফোন বার করলেন। আমি সেটা মোবাইলে তুলে নিলাম। কারণ একেনবাবু মোবাইলে নম্বর সেভ করতে এখনও হিমশিম খান। প্রায়ই আমার বা প্রমথর সাহায্য চান।

 

ফাদার লাফিয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একেনবাবু বললেন, “স্যার, একটু অবিনাশবাবুকে ফোন করুন।”

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার বলুন তো, কী মাথায় ঘুরছে আপনার?”

 

“কিছুই না স্যার। যখন নম্বরটা পেলাম, কাছাকাছি যদি থাকেন, তাহলে একটু কথা। বলে যেতাম।”

 

বেশ কয়েকবার রিং-এর পর অবিনাশবাবুই ফোনটা ধরলেন। ভদ্রলোক মনে হল আমাদের সঙ্গে কথা বলতে উৎসুক নন। কিন্তু ফাদার লাফিয়ের কাছ থেকে আসছি শুনে শেষে রাজি হলেন। অবিনাশবাবুর বাড়িটা খুব একটা দূরে নয়। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছোনো গেল।

 

অবিনাশবাবুর বেশ বয়স হয়েছে দেখলেই বোঝা যায়। টাক মাথা, যে কয়েকটা চুল অবশিষ্ট আছে– সবই সাদা। কথায় কথায় জানলাম, বিয়ে-থা করেননি। চাকরি জীবনের পুরোটাই উড়িষ্যাতে কাটিয়েছেন। রিটায়ার করেছেন মাত্র কয়েক মাস আগে। রিটায়ার করার পর কী খেয়াল হল কলকাতায় চলে এলেন! আত্মীয়স্বজন বলতে কেউই প্রায় নেই। শ্যামলবাবুই কলকাতায় একটা থাকার জায়গা খুঁজে দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে এসে ভুল করেছেন। তার ওপর ক’দিন আগে প্রায় গাড়ি চাপা পড়ে মারা যাচ্ছিলেন! শুধু তাই নয়, ওঁর কেমন দৃঢ় ধারণা হয়েছে কেউ ওঁকে চাপা দিতে চেয়েছিল!

 

ভদ্রলোক কথাগুলো বলছিলেন হাত-পা নেড়ে খুবই উত্তেজিত ভাবে। প্রমথ দেখলাম মুচকি মুচকি হাসছে। আমারও হাসি পাচ্ছিল ওঁর বলার ধরন দেখে। কিছু কিছু লোক অবশ্য এ-রকম প্যারানয়াতে ভোগে। সব সময় তাদের ধারণা কেউ তাদের অনিষ্ট করার চেষ্টা করছে!

 

একেনবাবুর অম্লান বদন। “কী করে বুঝলেন স্যার, আপনাকে চাপা দেবার চেষ্টা করছে?”

 

“কী আশ্চর্য, বুঝব না! গাড়িটা গলির মুখে দাঁড়িয়েছিল। আমি যেই গলিতে ঢুকেছি, তেড়ে এল আমার দিকে! আমি যেদিকে যাই, সেদিকেই গাড়ির মুখ ঘোরায়! যখন প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, তখন কোনো মতে একটা বারান্দায় লাফিয়ে উঠে বাঁচি।”

 

এর ব্যাখ্যা অন্য রকমও হতে পারে– আনাড়ি ড্রাইভার, মাতাল ড্রাইভার, ইত্যাদি। তবে ভদ্রলোক এ ধরনের ব্যাখ্যাতে যে সন্তুষ্ট হবেন না, সেটা বলাই বাহুল্য।

 

যাইহোক, এই ঘটনার পর থেকে অবিনাশবাবু নিজের বিনাশ রোধ করার জন্য পারতপক্ষে বাড়ির থেকে বেরোচ্ছেন না। ওঁর সারা জীবনের শখ ছিল রিটায়ার করে কলকাতায় এসে নিশ্চিন্ত মনে নাটক-সিনেমা দেখে কাটাবেন। বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে ডুবে থাকবেন, কিন্তু কোথায় কী!

 

আমাদের শ্রোতা পেয়ে অবিনাশবাবু নিজের জীবন-কাহিনি হয়তো আরও বিস্তারিত বলতেন, কিন্তু একেনবাবু আলোচনাটা শুধু শ্যামলবাবু আর বিনয়ের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টাতে ওঁর গল্পে বারবার ছেদ পড়ল। তবে প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু পেতে আরও অনেক আনুষঙ্গিক কাহিনি শুনতে হল বসে বসে। আসলে ভদ্রলোক কথা বলার লোক পেয়ে প্রায় আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন। বললেন, “বুঝলেন, প্রথমে যখন ফোন করলেন, তখন একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল– আসলে ওই গাড়ির ব্যাপারটার পর থেকে, সবার ওপর বিশ্বাস হারিয়েছি। ভাগ্যিস আপনারা এলেন!”

 

যাইহোক, কতগুলো শকিং তথ্য পাওয়া গেল ওঁর কাছ থেকে। প্রথম তথ্য হল বিনয়ের মা শ্যামলবাবুর বাড়িতে কাজ করত। শ্যামলবাবু যখন কন্ট্রাক্টরি ব্যবসা শুরু করে অনাথ আশ্রমের জন্য কতগুলো নতুন উইং তৈরি করছিলেন, তখন অবিনাশবাবুর সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ হয়। দু-জনেই অবিবাহিত, তাই একসঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। এরমধ্যে একদিন অবিনাশবাবুকে শ্যামলবাবু জানান, উনি ভানু অর্থাৎ ওঁর কাজের মেয়ে ভানুমতাঁকে বিয়ে করবেন ঠিক করেছেন। অবিনাশবাবু কথাটা শুনে থ! অনেক বাধা দিয়েছিলেন, কিন্তু শ্যামলবাবু শোনেননি। শ্যামলবাবুর চাপাচাপিতে অবিনাশবাবুই একটি পুরুত ডেকে হিন্দুমতে বিয়েটা দেন। কিন্তু বিয়ের কয়েকদিন বাদেই বিরাট ঝামেলা শুরু হয়। ভানুমতীর আগে যে একটা বিয়ে ছিল, ভানুমতী সেটা বলেনি। নিশ্চয় ইচ্ছা করেই বলেনি। বছর চারেক বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু বর মারধোর করত বলে পালিয়ে এসে শ্যামলবাবুর বাড়িতে কাজ নিয়েছিল। ওর প্রথম স্বামী গ্রামের লোকজন নিয়ে এসে হাজির শ্যামলবাবুকে মারবে বলে। সে এক বিশ্রি ব্যাপার। কোনো মতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ওদের হাত থেকে শ্যামলবাবু নিস্তার পান। ভানুমতাঁকেও ওর স্বামী গ্রামে নিয়ে যায়। এর কয়েকমাস বাদেই শ্যামলবাবু উড়িষ্যার ব্যবসা গুটিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। তবে অবিনাশবাবুর সঙ্গে চিঠিপত্রে ওঁর যোগাযোগ ছিল। এরপর বেশ কয়েক বছর বাদে অবিনাশবাবুর বাড়িতে হঠাৎ ভানুমতী এসে উদয় হয়। বলে বর ওকে ছেড়ে চলে গেছে, স্রেফ ভিক্ষে করে ওকে দিন কাটাতে হচ্ছে–অবিনাশবাবু যদি ওকে আশ্রয় দেন! অবিনাশবাবু রাজি হননি। অবিনাশবাবু একা থাকেন, ভানুমতী শুধু যুবতী তাই নয়, ওর বর আর তার সাঙ্গপাঙ্গোরা কীরকম হেনস্তা শ্যামলবাবুকে করেছিল সেটা ওঁর বিলক্ষণ মনে ছিল। অবিনাশবাবু যখন কিছুতেই রাজি হলেন না, তখন ভানুমতী কাতর অনুরোধ জানাল ওর ছেলে বিনয়কে যদি অবিনাশবাবু অনাথ আশ্রমে রেখে দেন। অবিনাশবাবুর তখন একটু দয়াই হয়। তিনি শুধু বিনয়কে আশ্রমে ভর্তি করার বন্দোবস্ত করলেন তাই নয়, ভানুমতাঁকে কিছু টাকাও দিলেন। পরে ভানুমতীর এই দুরবস্থার কথা শ্যামলবাবুকে জানাতে শ্যামলবাবুও মাঝে মাঝে কিছু টাকা অবিনাশবাবুকে পাঠাতেন ভানুমতাঁকে দেবার জন্য।

 

“বিনয় কি শ্যামলবাবুর ছেলে স্যার?”

 

অবিনাশবাবু একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “সেটা আমিও ভেবেছিলাম, কিন্তু বোধহয় নয়।”

 

“কী করে বুঝলেন স্যার?”

 

“ওর যে জন্ম তারিখ ভানুমতী দিয়েছিল, সেটা শ্যামলবাবুর বাড়ি থেকে চলে যাবার বছর দেড়েক পরে।”

 

“ওদের হিসেবেরও তো গণ্ডগোল হতে পারে।”

 

“তা পারে,” অবিনাশবাবু বললেন।

 

“আপনাদের অনাথ আশ্রমের খাতায় কার নাম লেখা আছে ওর বাবার নাম হিসেবে?”

 

“কারোর নাম নেই।”

 

“আপনি বললেন স্যার, ভানুমতী খেতে পাচ্ছিল না, কিন্তু অন্যান্য বাচ্চাদের না রেখে শুধু বিনয়কেই রাখতে চাইল কেন?”

 

“ওর শুধু ওই একটাই বাচ্চা ছিল।”

 

“আই সি স্যার। শ্যামলবাবুর এই ব্যাপারটা, মানে ভানুমতীর ব্যাপারটা আর কেউ জানে?”

 

“একজন জানে, সে হল শ্যামলবাবুর ড্রাইভার রামশরণ।”

 

“সে এখন কোথায়?”

 

“সে এক কাণ্ড। আমার কাছে ক’দিন আগে রামশরণ এসেছিল, শ্যামলবাবু নাকি ওকে। তাড়িয়ে দিয়েছেন।”

 

“কেন স্যার?”

 

“সেটা আমি বলতে পারব না। ও যা বলল, সেটা শুনে মনে হল এক দেশোয়ালি ভাইয়ের সঙ্গে দারু পিয়ে একটু মাতাল হয়ে শ্যামলবাবু সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলেছিল। সেই খবর কানে যেতে, শ্যামলবাবু ‘তুই নেমকহারাম’ বলে ওর কোনো কথা কানে না তুলে গলাধাক্কা দিয়ে বিদেয় করেছেন।”

 

বুঝতে পারলাম অবিনাশবাবু ড্রাইভারটিকে তাড়ানোর আসল কারণটা জানেন না। শ্যামলবাবু ওঁর শেষ চিঠিটা পান ড্রাইভারটি বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারতে ব্যস্ত ছিল বলে। তবে একেনবাবু দেখলাম সে প্রসঙ্গ তুললেন না। বরং জিজ্ঞেস করলেন, “কী আজেবাজে কথা জানেন?”

 

“না, সেটা জিজ্ঞেস করিনি। মাতাল অবস্থায় তো অনেক কিছুই লোকে বলে!”

 

“খবরটা শ্যামলবাবুর কানে গেল কী করে স্যার?”

 

“সেটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। রামশরণের ধারণা ওর দেশোয়ালি ভাই কথাগুলো তার মালিককে বলেছে, যিনি নাকি আবার শ্যামলবাবুর ভাইপো!”

 

“আপনার কাছে রামশরণ এল কেন স্যার?”

 

“রামশরণ জানে শ্যামলবাবু আমার বিশেষ বন্ধু। আমার পারিপোতা-র বাড়িতে ও বহুবার এসেছে, এখানেও এসেছে বার দুয়েক। তাই চাইছিল যদি শ্যামলবাবুকে বলে ওকে চাকরিতে আবার বহাল করাই।”

 

“আপনি কি শ্যামলবাবুর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছিলেন স্যার?”

 

“না, ওঁকে ধরতে পারিনি। তারপর ক’দিন আমার মোবাইলটাও কাজ করছিল না। কেউ ফোন করলেও ধরার উপায় ছিল না। তারপর তো জানলাম তিনি আর বেঁচে নেই!”

 

“বিনয়বাবুর সঙ্গে এর মধ্যে আপনার কথা হয়েছে?”

 

“না, ওর নম্বরটা আমার জানা নেই, শুধু শ্যামলবাবুর নম্বরটাই জানতাম। ওদের বাড়িটাও চিনি না যে যাব।”

 

.

 

ফেরার পথে যখন একেনবাবুকে বাড়িতে নামাচ্ছি, তখন শুনলাম একেনবাবু রাখালবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। পেছনে একটা গাড়ি এত জোরে জোরে হর্ন বাজাচ্ছিল যে, আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। আবছা যা শুনলাম তা হল, একেনবাবু জানতে চাইছেন গাড়িতে কোনো ফাইবার পাওয়া যায় কিনা দেখতে। আর তিনজনের ফোন ট্রেস করা হয়েছে। নাকি।

 

কিছু কথা কানে আসেনি বলে, দুটো প্রশ্নই আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকল। কিন্তু একেনবাবু গাড়ি থেকে নেমে গেছেন। সুতরাং কালকে সকালে যখন চা খেতে আসব, তখনই জেনে নেওয়া যাবে।

 

 

দশ

পরদিন সকালে যখন একেনবাবুর বাড়িতে পৌঁছোলাম, তখন প্রমথও দেখলাম ট্যাক্সি থেকে নামছে। একেনবাবু বউদিকে নিয়ে চা খাচ্ছিলেন। হাতে একটা লাল মলাটের বই। আমাদের দেখে বললেন, “আসুন স্যার, আসুন। কী খাবেন বলুন?”

 

“আপনাকে বলে লাভটা কী,” প্রমথ বলল, “বন্দোবস্ত করার মালিক তো বউদি।”

 

“আরে সেইজন্যেই তো আপনাদের সাহায্য চাইছি? আপনারা খাবেন, আমিও প্রসাদ পাব।”

 

“শুনলেন তো ভাই ওঁর কথা, উনি চাইলে আমি যেন কিছু করি না!”

 

“না, করাই উচিত বউদি, কোনো গ্র্যাটিচুড নেই আপনার কর্তার।”

 

বউদি মুচকি হেসে উঠে পড়লেন।

 

“আচ্ছা একটু বেগুন ভাজা আর লুচি করলে কেমন হয়?” একেনবাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে অ্যাপ্রুভাল খুঁজলেন।

 

“ওরকম ভাববাচ্যে কিছু চলবে না,” প্রমথ ধমক দিল। “লুচি খেতে চান তো নিজে রান্নাঘরে যান।”

 

আমি বললাম, “তোর সাহস তো কম নয়, একেনবাবুকে রান্নাঘরে পাঠাচ্ছিস!”

 

“ঠিক বলেছিস, আমিই বরং যাই বউদিকে সাহায্য করি।”

 

“কোনো সাহায্য লাগবে না ভাই, আপনারা বসে বসে গল্প করুন, তাহলেই আমার। সাহায্য হবে।”

 

“আপনি প্রমথকে স্পয়েল করছেন বউদি, আমি বললাম। গুণের মধ্যে একটাই ছিল– একটু রান্না করতে পারত, সেটাও নষ্ট হচ্ছে!”

 

“রান্নার হাত কি নষ্ট হয় ভাই,” বলে বউদি অদৃশ্য হলেন।

 

একেনবউদির বাড়িতে রান্নার করার একটি মেয়ে আছে, তাও বউদি নিজের হাতে আমাদের রান্না না করে খাওয়ালে তৃপ্তি পান না। প্রমথর অবশ্য ধারণা একেনবাবুর বকবকানির হাত থেকে রক্ষা পেতে উনি রান্নাঘরে অদৃশ্য হন।

 

বউদি চলে যেতেই একেনবাবু বললেন, “যাই বলুন স্যার, চায়ের সঙ্গে গরম গরম লুচি আর লম্বা করে কাটা বেগুন ভাজা– এর কোনো তুলনা হয় না।”

 

“তা-তো বটেই,” প্রমথ বলল, “বিশেষ করে সোফায় বসে হাত-পা নাড়ানোর আগেই কেউ যদি সেটা সামনে এনে হাজির করে। আপনি মশাই একটা যাচ্ছেতাই!”

 

“কেন স্যার?”

 

“বউদি যে এত খেটে মরছেন, সেটা একবারও ভাবেন?”

 

একেনবাবু বললেন, “আসলে স্যার, ও আবার এইসব করতে খুব ভালোবাসে, না করতে পারলেই কষ্ট পায়।”

 

“আপনার মুণ্ডু প্রিভিলেজ পেতে পেতে বোধবুদ্ধি সব গোল্লায় গেছে!”

 

“শুনছেন স্যার,” একেনবাবু আমার দিকে তাকালেন।

 

“প্রমথর কথায় কান দেবেন না, ও বিশ্বনিন্দুক। তা এত সকালে মন দিয়ে পড়ছিলেন কী?”

 

উনি উত্তর দেবার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।

 

“হ্যালো, ও রাখাল! বলো ভাই, কোনো খবর পেলে? পাওয়া গেছে? আর ফোন? দুটো বাঘাযতীন স্টেশনের কাছে ছিল? আর অন্য ফোনটা? চমৎকার। আরে না না, এ আর এমন কী? হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলে এসো।”

 

“কি ব্যাপার?”

 

“সত্যব্রতবাবুকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।”

 

“কেন?”

 

“শ্যামলবাবুকে হত্যার অভিযোগে।”

 

“বিনয়বাবু?”

 

“ওঁকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।”

 

“দাঁড়ান মশাই, দাঁড়ান! বুঝতে পারছি এর মধ্যে একেনাদ্বিতীয়ম, মানে অদ্বিতীয় একেনবাবুর হাত আছে। ব্যাপারটা খুলে বলুন তো এক্কেবারে গোড়া থেকে। ও বউদি চলে আসুন, আপনার পতিদেবের কীর্তি-কাহিনি একটু শুনে যান!”

 

বউদি তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে এসে বললেন, “কী হল?”

 

“আরে এসে বসুন, লুচি পরে হবে।”

 

“আমি সব দেখিয়ে দিয়ে এসেছি, এখন নমিতাই সব করতে পারবে। আমাদের অভয় দিয়ে বউদি বসলেন।

 

একেনবাবু শুরু করলেন, “আসলে স্যার, শ্যামলবাবু যখন এসে বললেন যে, ওঁর খুনিকে খুঁজে বার করতে হবে, তখনই আমার গোলমাল লাগছিল। হ্যাঁ, যে খুন করার চেষ্টা করছে, তাকে ধরতে বলার অর্থ হয়। খুন হবার আর সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু খুনটা করার পর সে ধরা পড়লেও ভদ্রলোকের লাভটা কী? হ্যাঁ স্যার, সমাজের নিশ্চয় একটা লাভ আছে– কেউ অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু সেটাই কি কারণ? আরেকটা হতে পারে, উনি খুব ভালো করেই জানেন কে খুন করবে। সে যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়, সেটাই আমার সাহায্য নিয়ে নিশ্চিত হতে চান। হাসবেন না স্যার, বিচিত্র এই পৃথিবী!

 

“তারপর স্যার, শ্যামলবাবু খুন হলেন। পুলিশ প্রথমে ভাবল আত্মহত্যা, তারপর সন্দেহ করল বিনয়কে। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ ছিল। অজ্ঞাতকুলশীল বিনয়কে শ্যামলবাবু ওঁর সম্পত্তির প্রায় পুরোটাই দান করেছিলেন। যখন উকিলের কাছ থেকে উইলটা এনে বদলাবার কথা ভাবছিলেন ঠিক তার আগেই খুন হলেন। টাইমিংটা ইম্পর্টেন্ট। শ্যামলবাবুর আয়ু বেশি দিন ছিল না, বড়জোর কয়েকমাস। সুতরাং যিনি খুন করেছেন, তিনি শ্যামলবাবুর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলেন না। শ্যামলবাবু মৃত্যুর আগে উইল পালটালে সবচেয়ে ক্ষতি হত বিনয়বাবুর, এটা বিচার করলে সন্দেহটা বিনয়বাবুর উপরেই পরে। তবে একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে যে, উইলে যাই থাকুক না কেন, সেটা না পাওয়া গেলে তার কোনো মূল্য নেই। অর্থাৎ উইলটা না পাওয়া গেলে বিনয়বাবুর ভাগ্যে কিছুই জুটত না, সম্পত্তির পুরোটাই পেতেন শ্যামলবাবুর একমাত্র ওয়ারিশ ভাইপো সত্যব্রতবাবু। অথচ সেই সত্যব্রতবাবুই সম্পত্তির লোভ উপেক্ষা করে উইলটা খুঁজে বার করলেন। কেন করলেন স্যার, সেটা নিয়েই আমি ভাবছিলাম। উইলটা না পাওয়া গেলে সন্দেহের তীরটা বিনয়বাবুর বদলে সত্যব্রতবাবুর দিকেই পড়ত, সেটা ঠিক। কিন্তু তা পড়ুক না স্যার, সত্যব্রতবাবু যদি নির্দোষ হন, তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? চুপাচাপ না বসে থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কেন তিনি উইলটা আবিষ্কার করলেন! তিনি কি এতই মহানুভব? দ্যাট ট্রাবলড মি স্যার, ট্রাবলড মি এ লট। তারপর অবিনাশবাবুর সঙ্গে কথা বলার পর পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে ক্লিয়ার হল। বুঝতে পারছেন স্যার আমি কি বলছি?”

 

“না,” আমি মাথা নাড়লাম।

 

“কী মুশকিল, অবিনাশবাবু বলেছিলেন না যে, ওঁর সন্দেহ হয়েছিল বিনয়বাবু শ্যামলবাবুর অবৈধ সন্তান! সেই একই সন্দেহ নিশ্চয় শ্যামলবাবুর ড্রাইভারটিরও হয়েছিল। এই সন্দেহটাই নিশ্চয় মদের ঘোরে ড্রাইভারটি সত্যব্রতবাবুর ড্রাইভারকে বলেছিল, পরে সেটা সত্যব্রতবাবুর কানেও ওঠে। যার সঙ্গে কথা বলে শ্যামলবাবু ভীষণ উত্তেজিত হয়েছিলেন স্যার, সেই ব্যক্তিটি আমার বিশ্বাস সত্যব্রতবাবু। তিনিই কাকার সঙ্গে ভানুমতীর সম্পর্কের কথা তোলেন, হয়তো বিনয়ের প্রসঙ্গও। সেই কারণেই বহুদিনের বিশ্বস্ত ড্রাইভারকে শ্যামলবাবু তাড়ালেন। এখন বিনয়বাবু যদি সত্যিই ভানুমতীর গর্ভজাত শ্যামলবাবুর সন্তান হতেন, সেক্ষেত্রে অবৈধ সন্তান হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে শ্যামলবাবুর সম্পত্তির উপর পূর্ণ অধিকার তাঁর থাকত, সত্যব্রতবাবুর ভাগ্যে জুটত শূন্য। এই ভয়টাই সত্যব্রতবাবুর হয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্যার, কাকা উইল করে ওঁকে সম্পত্তি না দিয়ে গেলে উনি কিছুই পাবেন না। বিনয়বাবুকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার একমাত্র উপায় হল শ্যামলবাবুকে দিয়ে উইল পালটানো অথবা বিনয়বাবুকে শ্যামলবাবুর হত্যাকারী বলে প্রমাণ করা। বিনয়বাবু খুনি প্রমাণিত হলে সম্পত্তি পাওয়ার সুযোগ হারাবেন, তখন সম্পত্তির ষোলো-আনা মালিকানা হবে সত্যব্রতবাবুর। আমার থিওরি হল স্যার, প্রথমে সত্যব্রতবাবু ভানুমতীর প্রসঙ্গ তুলে শ্যামলবাবুকে লোকলজ্জার ভয় দেখিয়ে উইল পালটাবার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। সেই চাপেই বোধহয় শ্যামলবাবু ভাইপোর হাতে উইলটা তুলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “তুই এটা ছিঁড়ে ফেল, নতুন উইল করে তোকে সব কিছু দিয়ে যাব।’

 

কিন্তু সত্যব্রতবাবু কাকাকে বিশ্বাস করেননি। সত্যব্রতকে সম্পত্তি উইল করে, পরে তিনি আরেকটা নতুন উইল করে আগের উইলটা বাতিল করতে পারেন। সেই ভেবেই স্যার সত্যব্রতবাবু অন্য পথ ধরলেন। তিনি শুধু নিখুঁত অভিনেতা নন, অতি ধুরন্ধর ব্যক্তি। প্রথমে শ্যামলবাবু সেজে আমাকে কাজে নিযুক্ত করলেন, যদি পুলিশ এটাকে ভুল করে আত্মহত্যা ভেবে বসে– সেটা ঠেকাতে। বাকি রইল কাকাকে খুন করে বিনয়বাবুকে হত্যাকারী হিসেবে ফাঁসানো। মৃত্যুর দিন স্যার শ্যামলবাবু একা বেরিয়েছিলেন, কারণ ভানুমতীর বিষয়ে ওঁর সঙ্গে সত্যব্রতর আলোচনা আর কেউ শুনুক তিনি তা চাননি। কাছাকাছি কোথাও দু-জনের দেখা হয়েছিল। বিনয়বাবু যে রঙের পাঞ্জাবি সাধারণত পরেন সেইরকম একটা পাঞ্জাবি ছিল সত্যব্রতবাবুর গায়ে। বিনয়বাবুর অজান্তে তাঁর মোবাইলটাও সত্যব্রতবাবু হাতিয়েছিলেন। সেটিকে ‘অন’ করে রেখেছিলেন স্যার, যাতে তার গতিবিধি মোবাইল কোম্পানির সুইচিং সেন্টারের ডেটা থেকে বার করতে পারা যায়। কথা বলার সুবিধা হবে এই অছিলায় সত্যব্রতবাবু কাকাকে গাড়িতে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বাঘাযতীন স্টেশনের কাছে পৌঁছেন। সেখানে গাড়ি থামিয়ে শ্যামলবাবুকে জোর করে নামিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ফেলে দেন। তারপর কাকার ফোন থেকে বিনয়কে একটা এস.এম.এস পাঠিয়ে তৃতীয় এক ব্যক্তি যিনি আগে থেকেই ওখানে ছিলেন, তাঁর হাতে বিনয়ের মোবাইলটা দিয়ে সত্যব্রতবাবু বাড়ি ফিরে যান।”

 

“তৃতীয় ব্যক্তি!”

 

“হ্যাঁ স্যার, তৃতীয় ব্যক্তি একজন ছিলেন। সেই তৃতীয় ব্যক্তি হলেন শিবদাসবাবু। তিনিই বিনয়বাবুর মোবাইলটা ফেরত এনে সোফায় রেখে দেন। শুধু তাই নয় আরেকটা কাজও সেদিন সকালে শিবদাসবাবু করেছিলেন। বিনয়কে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবার জন্য। বিনয়বাবু বাড়িতে থাকলে স্যার, তার একটা অ্যালিবাই থাকত। এক্ষেত্রে সেটা আর রইল না। শিবদাসবাবুর আমার কাছে এসে শ্যামলবাবুর হত্যাকারীকে খুঁজে বার করতে বলাটাও স্যার ওদের প্ল্যানের একটা অংশ, যাতে পুলিশ বিনয়বাবুকে ধরতে না পারলেও আমি পারি। শিবদাসবাবু যে ওখানে ছিলেন, সেটা ওঁর মোবাইল ট্রেস করে পাওয়া গেছে। শুধু দুটো ভুল সত্যব্রতবাবু করেছিলেন স্যার। এক নম্বর হল, নিজের মোবাইলটা উনি ‘অফ’ করে রেখেছিলেন।”

 

“সেটা তো বুদ্ধিমানের কাজ, ওঁর ফোনের ট্রেস পাওয়া যাবে না।”

 

“তাই কি স্যার? শার্লক হোমসের সেই বিখ্যাত গল্প ‘সিলভার ব্লেজ’-এর কথা ভাবুন… কুকুর কেন চেঁচায়নি? অচেনা লোক দেখলে যেটা করা স্বাভাবিক সেটা করেনি! সুতরাং অপরাধী চেনা লোক। এটাও খানিকটা সে-রকম। যাঁকে সব সময় মোবাইলে পাওয়া যায়, তিনি সেটা না নিয়ে ঘুরছেন… বিশ্বাস করাটা কঠিন। বিশেষ করে শ্যামলবাবু ট্রেন চাপা পড়ার দশ মিনিট বাদেই হঠাৎ ওটার ট্রেস পাওয়া গেছে বাঘাযতীন থেকে খানিকটা দূরের একটা টাওয়ারে।”

 

“আর দ্বিতীয় ভুল?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

 

“দ্বিতীয় ভুলটা করেছিলেন, প্রথম দিন আমার বাড়িতে যখন এসেছিলেন।”

 

“সে ভুলটা আবার কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

শ্যামলবাবু, যিনি লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারেন না, সোজা উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করছিলেন। আমিই তখন ওঁকে বললাম, উনি লাঠিটা ফেলে যাচ্ছেন। যিনি সব সময় লাঠি নিয়ে ঘোরেন, তাঁর পক্ষে এই ভুলটা অস্বাভাবিক। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তারপর জেনেছিলাম যে, সত্যব্রতবাবু একজন অভিনেতা। তখনই সন্দেহটা দানা বাঁধতে শুরু করে।”

 

“একটা জিনিস আমি বুঝছি না। তিন-তিনটে চিঠির কথা সত্যব্রত আনল কেন, একটা চিঠিই তো যথেষ্ট ছিল?”

 

উত্তরটা প্রমথ দিল। “আচ্ছা ইডিয়ট তুই! লোকটা ভালো অভিনেতা, লেখক তো নয়! নিশ্চয় ভেবেছিল একটার বদলে তিনটে চিঠি দিলে রহস্যটা পোক্ত হবে!”

 

“তোর মুণ্ডু! আর শিবদাসবাবু ওর সঙ্গে যোগ দিলেন কেন?”

 

“খুবই সিম্পল। বিনয় ব্যবসাটা ভালো বোঝে। ওর বদলে সত্যব্রত ব্যবসার পার্টনার হলে শিবদাসবাবুর টুপি পরাতে সুবিধা হবে। মাথায় ঢুকল?… যাইহোক, একেনবাবু, চমৎকার ডিটেকশন আপনার, কিন্তু ধোপে টিকবে তো?”

 

“টিকবে স্যার টিকবে। সত্যব্রতবাবুর গাড়িতে শ্যামলবাবুর জামার ফাইবার পাওয়া গেছে, বিনয়বাবুর মোবাইলে শিবদাসবাবুর ফিঙ্গারপ্রিন্ট। রাখালের নির্দেশে বেশ থরো জব করেছে কলকাতার পুলিশ।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


সূচিপত্র