নৃত্যশিল্পীর মৃত্যু-তদন্তে একেনবাবু – সুজন দাশগুপ্ত
এক
শনিবার সকাল থেকেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। এ বৃষ্টি নাকি দু-দিন চলবে, কাল বিকেলের আগে আকাশ পরিষ্কার হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সকালের খাওয়া শেষ। প্রমথ ভীষণ মনোযোগ দিয়ে উর্দু-টু-ইংলিশ ডিকশনারি পড়ছে। ও হিন্দি গানের কথা একেবারেই বুঝতে পারে না, কিন্তু উলটোপালটা কথা বসিয়ে গাওয়া চাই। সেই নিয়ে গতকাল একটু খোঁচা দিয়েছিলাম। সেটা বোধহয় বুকে লেগেছে।
একেনবাবু একটা ঘিয়ে রঙের শার্ট পরে টিভি দেখছেন, বহুদিন ধরেই শার্টে দুটো বোতাম মিসিং। গুচ্ছের বোতাম বাড়িতে আছে কিন্তু লাগাননি, ও-দুটো নাকি ক্রিটিক্যাল বোতাম নয়! ‘ক্রিটিক্যাল বোতাম’-এর মানে জানতে চাইবেন না, যা শুনেছি রিপোর্ট করছি।
টিভি-তে স্থানীয় সংবাদে একটি বাঙালি ছেলে ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে কিছু বলছে। আমি বা প্রমথ কেউই মন দিয়ে শুনছি না।
“বেশ গর্ব হয় না স্যার, লোকাল নিউজ-এ বাঙালি কেমন সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে!”
“বলছে তো ওয়েদার।” প্রমথর বক্রোক্তি।
“কেন স্যার, ওয়েদার প্রেডিক্ট করা তো ভীষণ কঠিন কাজ। শুনেছি পিএইচডি না থাকলে টিভি-তে চান্সই পাওয়া যায় না।”
“পিএইচডি তো বাপিরও আছে।”
প্রমথরও আছে, কিন্তু এটা অ-সম্মানার্থে প্রয়োগ
একেনবাবু আমার সম্পর্কে বোধহয় ইতিবাচক কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ডোর বেল বাজল। আমিই উঠে দরজা খুললাম।
বয়স্ক ভদ্রলোক। কাঁচা-পাকা চুল, চোখে গোল্ড-ফ্রেমের পাতলা চশমা, প্যান্টের নীচটা ভিজে সপসপ করছে। মুখ-চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে অত্যন্ত বিচলিত। বন্ধ করা ফোল্ডিং ছাতার জল যে চুইয়ে চুইয়ে প্যান্টের ওপর দিকেও পড়ছে- খেয়াল করছেন না।
অনাবশ্যক উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “এটাই কি একেনবাবুর বাড়ি?”
“হ্যাঁ।”
“উনি আছেন?”
“আছেন, ভেতরে আসুন… ছাতাটা ওইখানে রাখুন।” দরজার পাশেই ভেজা ছাতা রাখার প্লাস্টিকের বালতিটা দেখালাম। ইতিমধ্যে একেনবাবু সোফা ছেড়ে উঠে এসেছেন। প্রমথও উঠে দাঁড়িয়েছে।
“নমস্কার স্যার, আমিই একেন্দ্র সেন।”
“আপনি! আপনিই গোয়েন্দা একেনবাবু?”
“হ্যাঁ, স্যার।”
“ও,” বিস্ময়টা সামলে ভদ্রলোক বললেন, “আমি রজত মুখার্জী। আপনার প্রফেশনাল হেল্প লাগবে।”
“আগে তো স্যার ঘরে এসে বসুন। এঁদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি বাপিবাবু, ফিজিক্সের প্রফেসর। আর পেছনে যিনি দাঁড়িয়ে, উনি কেমিস্ট্রির প্রফেসর প্রমথবাবু।”
প্রমথ যে পোস্ট-ডক শেষ করে এখন অধ্যাপনা করছে সেটা বোধহয় আগে লিখিনি।
আমাদের দায়সারা নমস্কার জানিয়ে রজতবাবু ঘরে ঢুকে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। “একটু জল হবে?”
জল এনে দিতেই ঢক ঢক করে পুরোটা খেলেন।
“এবার বলুন স্যার, কীসের জন্যে এসেছেন। এঁদের সামনেই বলতে পারেন। আমরা সবাই এক টিম-এ, মানে একসঙ্গে কাজ করি।”
“আমার ভাগ্নি রিঙ্কি গতকাল হঠাৎ মারা গেছে! …তিন দিন আগেও ‘স্পাইস অ্যান্ড গ্রিল’ রেস্টুরেন্টে আমার সঙ্গে ডিনার খেয়েছে… অসুখবিসুখ কিচ্ছু নেই— হেলদি একটা মেয়ে! ওর মা একেবারেই চাচ্ছিল না এদেশে আসুক, আমার ওপর ভরসা করেই আসতে দিয়েছিল… আমার মানসিক অবস্থাটা কল্পনা করতে পারছেন?” বলতে বলতেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রজতবাবু, গলাটা একটু ভেঙে গেল। বোধহয় প্রেশারের রোগী।
“মনে হয় পারছি স্যার, আপনি শান্ত হোন। তা উনি মারা গেলেন কীভাবে?”
“গত বুধবার রাতে লিঙ্কন সেন্টারে ওর কথাকলি নাচের প্রোগ্রাম ছিল…” নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে চললেন, “প্রোগ্রাম করে পরের দিন সকালেই কলকাতার ফ্লাইট ধরল। কলকাতায় যখন নামল, ভীষণ অসুস্থ। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হাসপাতাল। হাসপাতালে কিছুক্ষণ জ্ঞান ছিল, তারপরই কোমাতে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ!” গলাটা বুজে এল রজতবাবুর। অস্ফুট স্বরে বললেন, “শি ওয়াজ ওনলি টোয়েন্টি নাইন!”
লিঙ্কন সেন্টারে হেঁজিপেঁজি কেউ পারফর্ম করে না। এই বার মনে পড়ল, ক’দিন আগে ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল ডান্স ফেস্টিভ্যাল শুরু হবার খবর নিউ ইয়র্ক টাইমসে পড়েছিলাম। ভারতনাট্যম, কথাকলি, ওড়িশি, ইত্যাদি বেশ কয়েকটা নাচের উল্লেখ ছিল। সেই নিয়ে আমাদের মধ্যে কথাও হয়েছিল। কথাকলি প্রোগ্রামে পারমিতা চ্যাটার্জীর নাম দেখে একেনবাবু বলেছিলেন, “খুবই কনফিউজিং স্যার, কথাকলি তো কেরালার ছেলেদের নাচ!”
“আপনার মুণ্ডু!” প্রমথ ধমকে বলেছিল। “কলকাতাতেই বালকৃষ্ণ মেননের কাছে অনেক মেয়ে নাচ শিখত। আমার বড়োপিসিই শিখেছিল।”
“আপনিও এটা জানতেন স্যার?” আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন একেনবাবু। “কেন জানব না! আর কথাকলি-র ফিল্ডে পারমিতা চ্যাটার্জী যথেষ্ট পরিচিত। তেরো বছর বয়স থেকে স্টেজে পারফর্ম করছে।”
পারমিতাকে কেন্দ্র করে একটা স্ক্যান্ডেলও শুনেছিলাম। ঠিক কী, সেটা অবশ্য মনে পড়ল না।
রজতবাবুর কথায় একেনবাবু বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার, ম্যাডাম পারমিতা চ্যাটার্জীর কথাকলির প্রোগ্রাম তো একটা হয়েছিল! আপনার ভাগ্নি কি তাতে ছিলেন স্যার?”
“ওটা আমার ভাগ্নিরই সোলো পারফরমেন্স ছিল। আমি রিঙ্কি বলি, ওর ভালো নাম পারমিতা চ্যাটার্জী।”
“ও মাই গড স্যার, পারমিতা ম্যাডাম আপনার ভাগ্নি! তা মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ডাক্তাররা কী বলছেন স্যার?”
“বুকে জল জমেছিল, শ্বাসকষ্ট, রেস্পিরেটরি ফেইলিওর—এটুকুই শুনলাম। পরিষ্কার করে তো কেউ কিছু বলে না।”
“আগে কি ওগুলো নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল স্যার?”
“না, সেরকম তো কিছু ছিল না। অ্যালার্জিতে খুব ভুগত। সর্দি-কাশি একটু বেশিই হত… বাড়াবাড়ি হলেই ওষুধ খেত। শরীর নিয়ে খুবই কেয়ারফুল ছিল ও। এইভাবে হঠাৎ রিঙ্কির চলে যাওয়া… এটা… এটা কখনোই স্বাভাবিক হতে পারে না। বিশেষ করে…” একটু ইতস্তত করলেন রজত মুখার্জী।
“বিশেষ করে’ কী স্যার?”
“যেদিন ওকে নিয়ে আমি খেতে গিয়েছিলাম মনে হয়েছিল কিছু আমাকে বলতে চাইছে। জিজ্ঞেসও করেছিলাম, ‘কিছু বলবি?” এড়িয়ে গিয়েছিল।”
“আপনার কোনো ধারণা আছে কী নিয়ে ম্যাডাম কথা বলতে চেয়েছিলেন?”
“না। প্রথমে ভেবেছিলাম এদেশে আসার ক’দিন আগে দেশে যে মেসেজটা পেয়েছিল সেই ব্যাপারে। ওটা নয় জেনে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, আর ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি।”
“কীসের মেসেজ স্যার?”
“ও হ্যাঁ, সেটা তো বলা হয়নি। সোশ্যাল সিন-এ রিঙ্কির বড়ো রকমের প্রেজেন্স ছিল। ফলোয়ার আর ফ্যান-গোষ্ঠী ছিল প্রচুর…”
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাপারটার সঙ্গে একেনবাবু কতটা পরিচিত জানি না। ওঁর নামে ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট দেখেছি, যাতে ছবি নেই আর সব কিছু ব্লকড। সে নিয়ে একবার ধরেছিলাম। ‘আছে নাকি স্যার!’ ভাব দেখালেন আকাশ থেকে পড়েছেন!
ওঁর ক্লু-লেস মুখ দেখে রজত মুখার্জীর নিশ্চয় সন্দেহ হল। জিজ্ঞেস করলেন, “বুঝতে পারছেন আশাকরি?”
“খানিকটা বুঝলাম, অনেক অ্যাডমায়ারার ছিল— তাই তো স্যার?”
“এক্স্যাক্টলি। তাদের কেউ কেউ ওকে মেসেজ পাঠিয়ে বিরক্তও করত। বহু ম্যারেজ প্রোপোজালও পেয়েছিল। এছাড়া আসত নোংরা নোংরা মেসেজ, যেগুলো ও পাওয়ামাত্র ডিলিট করত। এসব ওর মা কুমকুমের কাছেই আবছা আবছা শুনেছি, আমাকে কিছু বলত না। এদেশে আসার দিন কয়েক আগে রিঙ্কি একটা মেসেজ পেয়েছিল, যেটা দেখে কুমকুম ভয় পেয়ে ওকে আমেরিকা আসতে বারণ করে। আমিই কুমকুমকে ভরসা দিয়েছিলাম, আমিও তো যাচ্ছি ভয়ের কী আছে!”
“মেসেজটা কী ছিল স্যার?”
“জানি না। তবে কুমকুম ভয় পেলেও রিঙ্কি ওটাকে পাত্তা দেয়নি। ডিলিট করেছিল।”
“তাও ওটা উদ্ধার করা যাবে।” প্রমথ বিজ্ঞের মতো একেনবাবুকে বলল।
রজতবাবুর কথা শুনছিলাম, আর সেইসঙ্গে পারমিতার স্ক্যান্ডেলটা ঠিক কী ছিল মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। শুনলাম একেনবাবু জিজ্ঞেস করছেন, “এই মেসেজটা ছাড়া মৃত্যুর ব্যাপারে আর কাউকে কি সন্দেহ করছেন স্যার?”
“সেইভাবে সন্দেহ কাউকেই করছি না, তবে এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলেও আমি মেনে নিতে পারছি না। আপনি প্লিজ এর অনুসন্ধানের ভার নিন। আপনার যা প্রাপ্য আমি দেব… ডলারেই দেব। আমার সফটওয়্যার কোম্পানির ব্রাঞ্চ আছে কুইন্সে। ওখানকার ম্যানেজার অভীক মিত্র আপনার ফি আর অন্যান্য খরচা বাবদ যা বিল হবে সব মেটাবে।”
“বুঝলাম স্যার, কিন্তু এভাবে তো ঠিক তদন্ত শুরু করা যায় না, আমার অনেক ইনফর্মেশনের দরকার।”
“তা জানি। এখানে আমাকে পাবেন না, কালকেই দেশে ফিরতে হবে। কিন্তু ইমেল, মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপ— সব কিছুতেই আমাকে ধরতে পারবেন। আপনার মোবাইল নম্বরটা বলুন, আমার কনট্যাক্ট ইনফর্মেশনগুলো এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
বেচারা একেনবাবু। নতুন আই-ফোন নিয়ে মাঝে মাঝে দেখি হিমশিম খান। প্রমথ একেনবাবুকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাল।
“আপনি বরং আমার এই নম্বরে পাঠান, ওঁর ফোনটা গণ্ডগোল করছে। বলে নিজের নম্বরটা দিল।
ভদ্রলোক যখন প্রমথকে নাম-ধাম পাঠাচ্ছেন একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে আপনার ভাগ্নি কোথায় উঠেছিলেন স্যার?”
“উঠেছিল আমাদের অফিসের গেস্ট হাউসে। সেখানে থেকে চলে যায় ওর দুই বন্ধুর কাছে। যাবার আগের রাতে আমার সঙ্গেই গেস্ট হাউসে ছিল।”
“এই বন্ধুদের সঙ্গে কি যোগাযোগ করা যাবে স্যার?”
“নিশ্চয়। দু-জনকেই আমি চিনি, তৃণা আর অনুরাধা। আমার ম্যানেজার অভীকও চেনে, ওর কাছে সব ডিটেলস পাবেন। অভীকের নম্বরটাও মেসেজ করে দিচ্ছি।”
আবার মোবাইলে খুট খুট করে একটা নম্বর পাঠালেন প্রমথকে।
“বন্ধুরা কি সবাই ম্যানহাটানে থাকেন স্যার?”
“এক জন কাছেই থাকে, অন্য জন ব্রুকলিনে। অভীককে আমি বলে যাব নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সব জানিয়ে দেবে। সেইসঙ্গে কাজের জন্য আপনাকে কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে দেবে। পাঁচ হাজার ডলার হলে চলবে তো?”
“টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন কেন স্যার, টাকাটা বড়ো কথা নয়, কিন্তু কাজটা আমি করতে পারব কিনা সেটা তো দেখতে হবে।”
“সে কি! রিঙ্কির মৃত্যু নিয়ে আপনি তদন্ত করবেন না!”
“না না, তা নয় স্যার। আসলে তদন্ত করার কিছু আছে কিনা, সেটাই তো জানা নেই স্যার। মৃত্যুটা তো স্বাভাবিকও হতে পারে, মানে কোনো অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন।”
“সেটাই তদন্ত করে বলুন!” তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাকে এখন যেতে হবে, দেশে রওনা দেবার আগে বেশ কিছু কাজ বাকি আছে। আপনি কিন্তু ভারটা নিচ্ছেন,” কথাগুলো বলে একেনবাবুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন।
“আপনি একটু বসুন স্যার, আমার দুয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে এখনই করার আছে।”
ভদ্রলোক বসলেন না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বললেন, “করুন।”
“আপনি কি এখানে ভাগ্নির নাচ দেখতে এসেছিলেন?”
“এইসময়ে আসার একটা কারণ সেটা। তা ছাড়া একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিকানা নিয়েছি, তার কাজকর্ম কীরকম চলছে সেটাও দেখে গেলাম।” বলতে বলতে আবার ইমোশনাল হয়ে পড়লেন রজতবাবু।
“একেনবাবু, ভাগ্নিই ছিল আমার স-অ-ব। আমি চলে গেলে ওকেই এসবের ভার নিতে হত… আর আমাকে ফাঁকি দিয়ে ও-ই আগে চলে গেল!” দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন রজতবাবু
একটু চুপ করে থেকে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখানে কবে এসেছিলেন স্যার?”
“দিন তিনেক আগে।”
“ঠিক আছে স্যার, আর আপনাকে বিরক্ত করব না।”
রজত মুখার্জী চলে যেতেই প্রমথ বলল, “এত অনেস্টি দেখান কেন মশাই! টাকাটা তো নিয়ে নেবেন, কাজটা করুন বা না করুন।”
“আপনি না স্যার, সত্যি!”
দুই
পরের দিন খুব ভোরে প্রমথর মোবাইলে একেনবাবুর ফোন। মোবাইলটা একেনবাবুকে এগিয়ে দিল প্রমথ। অন্যদিকে অভীক মিত্র। রজত মুখার্জী ওঁকে পাঁচ হাজার ডলার পাঠাতে বলেছেন। ডলার ট্রান্সফার করার জন্য একেনবাবুর অ্যাকাউন্ট নম্বর দরকার, সেইসঙ্গে ব্যাঙ্কের নাম, ঠিকানা আর ব্যাঙ্কের রাউটিং নম্বর। শুধু একটা অনুরোধ একেনবাবু যেন একটা ইনভয়েস পাঠান। টেররিস্টদের উৎপাত বাড়ার জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর সরকার আজকাল অনেক নজরদারি করে, কাগজপত্রগুলো যেন ঠিকঠাক থাকে।
একেনবাবু জানালেন, ইনভয়েস পাঠানোর আগে উনি অভীকবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চান, কাজটা উনি নেবেন কিনা এখনও মনস্থির করেননি।
.
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একেবারে চেক নিয়ে অভীক এসে হাজির। হ্যান্ডসাম ইয়ংম্যান, আমাদেরই বয়সি, একটু যেন নার্ভাস। পরিচয়পর্ব শেষ হতেই একেনবাবুকে বলল (আমাদের বয়সি বলে আর ‘করলেন’, ‘বললেন’ ইত্যাদি লিখছি না), “আমাকে কিন্তু স্যার বলে গেছেন রিঙ্কির ব্যাপারে আপনার সঙ্গে ওঁর ফাইনাল কথা হয়ে গেছে। আর ইনভয়েসের ব্যাপার… ওটা পরে একসময় পাঠিয়ে দিলেও চলবে। জাস্ট ফর্মালিটি।”
এবার বুঝলাম অভীকের নার্ভাসনেসের কারণটা। হয়তো ভেবেছে ইনভয়েস পাঠাতে হবে শুনে একেনবাবু বিগড়ে গেছেন। তবে ‘রিঙ্কি’ নামটা খট করে কানে বাজল। হাজার হোক বস-এর ভাগ্নি।
একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ম্যাডামকে চেনেন স্যার?”
“ম্যাডাম!”
“মানে ম্যাডাম পারমিতাকে।”
“রিঙ্কি হিসেবে চিনি, আমাদের পাড়ার মেয়ে সেই বাচ্চা বয়স থেকে ওকে দেখেছি।”
“আপনার বয়স কত স্যার, আপনিও তো ইয়ং?”
হঠাৎ বয়স কত শুনে একটু হতচকিত হলেও অভীক উত্তর দিল, “থার্টি সিক্স, কেন বলুন তো?”
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল চব্বিশ-পঁচিশ। তা হলে ঠিক আছে স্যার, সাত বছরের তফাত যখন…” একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন।
অভীকের মুখ দেখে মনে হল, এ আবার কার হাতে পড়লাম! চকিতে আমার আর প্রমথর দিকে তাকাল।
“আপনার কি মনে হয় স্যার, মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়?”
“আমার!”
“হ্যাঁ স্যার, আপনার মতটাই জানতে চাচ্ছি।”
“জানি না, তবে আমাদের এমডি সাহেবের বিশ্বাস এতে কোনো ফাউল প্লে আছে।”
“ইন্টারেস্টিং। আপনার সেই সন্দেহটা হয়নি স্যার, তাই তো?”
“সত্যি কথা বলতে কি হয়নি। তবে এটা ঠিক মৃত্যুটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।”
“ম্যাডাম খুব হেলদি, মানে সুস্থ-সবল ছিলেন, তাই তো স্যার?”
“একদম। আগের রাত্রে টানা দু-ঘণ্টার প্রোগ্রামে নাচল। পরের দিন সকালে যখন প্লেনে উঠল তখনও ফিট ছিল। মাথাধরা ছিল, তবে ওটা ওর প্রায়ই ধরত।”
“তার মানে স্যার আপনি ম্যাডামকে নিউ ইয়র্ক ছাড়ার দিনও দেখেছিলেন?”
“হ্যাঁ, সি-অফ করতে গিয়েছিলাম স্যারের সঙ্গে!”
“নাচ শেষ হবার পরও ঠিক ছিলেন?”
“একদম। স্যারই বরং খুব টায়ার্ড ছিলেন। রিঙ্কি তাই প্রোগ্রাম শেষ হওয়ামাত্র স্যারকে নিয়ে গেস্ট হাউসে চলে যায়। আমি পরে গ্রিনরুম থেকে তুলে ওর ব্যাগটা গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিই। স্যারকেও তখন এক বার দেখে আসি।”
“গেস্ট হাউসেই রজতবাবু ছিলেন স্যার?”
“হ্যাঁ, উনি এদেশে এলে ওখানেই ওঠেন।”
“আর কেউ ছিলেন?”
“বাকি দুটো রুমে দু-জন অফিস-গেস্ট ছিলেন। আমাদের গেস্ট হাউসে চারটেই রুম।”
“তাহলে তো স্যার খুবই কনফিউজিং।”
“মানে?”
“একদম ফিট অবস্থায় প্লেনে উঠে বারো-চোদ্দো ঘণ্টার মধ্যে এত অসুস্থ হয়ে অনেকটা আগাথা ক্রিস্টি-র ‘মার্ডার ইন দ্য ক্লাউড’-এর মতো।”
“মার্ডার বলছেন কেন?” অভীক সচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আরে না স্যার, গল্পের সঙ্গে ম্যাডামের মৃত্যুর সঙ্গে কোনোই যোগ নেই… প্লেনের প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল-সুস্থ অবস্থায় প্লেনে উঠে মৃত্যু। ফেমাস গল্প, আপনিও নিশ্চয় পড়েছেন স্যার?”
“মার্ডার ইন দ্য ক্লাউড’? না, পড়িনি।”
“দারুণ গল্প ছিল স্যার, পুরোটা অবশ্য মনে নেই,” একেনবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন। “তবে খুনি ধরা পড়েছিল এ্যরকুল পরোর কেরামতিতে।”
আমরা একেনবাবুর বকবকানিতে অভ্যস্ত, অভীক নয়। তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার ওপর প্রমথ ঠাট্টা করে বলল, “তাতে কী হয়েছে, আপনি তো আছেন!”
“কী যে বলেন স্যার, কোথায় পরো আর কোথায় আমি! আমার বিদ্যেতে কি এসব কুলায়, তা ছাড়া মার্ডারই হয়তো হয়নি!”
“এই রে! এসব শোনার পর অভীক কিন্তু আপনাকে চেকটা দেবেন না। “ “না না, তা কেন!” অভীক লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে চেকটা
বার করল।
“দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি যে চেকটা দিচ্ছেন তার একটা প্রমাণ রেখে দিই, পরে ‘আমি তো আর পহরো নই’ বলে একেনবাবু দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না।” বলে মোবাইলে ওদের ছবি তুলল।
একজনের মৃত্যু নিয়ে এইরকম হালকা কথাবার্তা আমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছিল না। অভীকও নিশ্চয় মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিল। কিন্তু সেই সেন্সিটিভিটি প্রমথর নেই। ভাগ্যিস অভীক পুরো ব্যাপারটা ভালোভাবেই নিল। হেসে বলল, “আমি জানি একেনবাবু অত্যন্ত বিনয়ী। ওঁর কীর্তিকাহিনি কিছু কিছু পড়েছি।”
কীর্তিকাহিনি পড়া মানে আমার লেখা পড়েছেন! গর্বভরে প্রমথর দিকে তাকাতেই ও মুখ বেঁকাল।
“আচ্ছা স্যার, এখানে যে দু-জনের বাড়িতে পারমিতা ম্যাডাম ছিলেন, তাঁদের আপনি চেনেন?”
“হ্যাঁ, তৃণাকে খুব ভালো করেই চিনি। অনুরাধাদের ততটা নয়।”
“ম্যাডাম তৃণা কোথায় থাকেন?”
“ম্যানহাটানেই- ভেরিক স্ট্রিটে।”
“ওটা তো আমাদের এখান থেকে খুবই কাছে,” আমি বললাম।
“ওঁর সঙ্গে দেখা করা যাবে?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।
“নিশ্চয়। কবে যেতে চান বলুন, আমি বন্দোবস্ত করে দেব। ফোনে ওকে ধরা মুশকিল, অচেনা কারোর ফোন তোলে না, আর মেসেজ বক্স সব সময়েই ফুল।
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্যার- দেখা করতে চাই।”
“ঠিক আছে। এক্সকিউজ মি,” বলে অভীক উঠে একটু সরে গিয়ে কাকে জানি মোবাইলে ফোন করল। তারপর এসে বলল, “আজ বিকেল পাঁচটার পর তৃণা বাড়িতে থাকবে। এর মধ্যে না হলে পরে অন্য কোনো একটা দিনও কথা বলতে পারবে, আমাকে শুধু একটু জানিয়ে দেবেন। আচ্ছা, আমাকে কি থাকতে হবে?”
“না স্যার।”
“তাহলে তো কোনো অসুবিধাই নেই।”
একেনবাবু আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, আপনারা আজ ফ্রি?”
“আমি নই। তবে দরকার তো আপনার গাড়িধারী বাপিকে।” প্রমথ বলল।
“কী যে বলেন স্যার!”
“আমার অসুবিধা নেই।” একেনবাবুকে বললাম।
.
ভেরিক স্ট্রিটের ঠিকানা আর ফোন নম্বর অভীক দিয়ে দিল। ঠিক হল ছ’টা নাগাদ আমরা যাব।
“আর ম্যাডাম অনুরাধা?”
“অনুরাধা আর ভাস্কর থাকে ব্রুকলিনের বন্ড স্ট্রিট-এ। আমি ওদের ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। আজকেই জানিয়ে দেব আপনারা যোগাযোগ করবেন। একটা কথা, কালকে সারাদিন আমাকে বাইরে থাকতে হবে একটা কাজে। অসুবিধা নেই তো?”
“না স্যার, অসুবিধার কী আছে!”
তিন
শেষ পর্যন্ত আমরা তিন জনই গেলাম। ভেরিক স্ট্রিটের পুরোনো একটা বিল্ডিং-এ তৃণার স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট মানে খাওয়া-বসা-শোওয়া সব একই ঘরে। অ্যাটাচড বাথরুম, একদিকে রান্নার ছোট্ট জায়গা, পাশে সিংক আর রেফ্রিজারেটর। তৃণা বোধহয় একটু আগে গুচ্ছের জামাকাপড় ধুয়ে ড্রায়ারে শুকিয়ে এনেছে, সেগুলো ক্লজেটে ঢোকাচ্ছে। এসব অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ অনেক সময় বেসমেন্টে কয়েন-অপারেটেড ওয়াশিং মেশিন আর ড্রায়ার থাকে ভাড়াটেদের সুবিধার জন্য।
“কিছু মনে করবেন না, ঘরটা একেবারেই অগোছালো, এক্ষুনি ঘরে ঢুকেছি।”
“না না, আমরাই একটু আগে এসে পড়েছি, সরি।” নিজেদের পরিচয় দিয়ে আমিই বললাম।
“সপ্তাহের এই দিনটাতেই লন্ড্রি করি। আজ ভিড় ছিল বলে দেরি হয়ে গেল। চা খাবেন তো আপনারা?”
“একেবারেই না।” তাড়াহুড়ো করে আমিই উত্তর দিলাম, পাছে একেনবাবু হ্যাংলার মতো “হ্যাঁ” বলে বসেন! ছোট্ট জায়গায় চা বানানো, কাপ-ডিশ ধোয়া, তারপর সেগুলো গুছিয়ে তুলে রাখার ঝামেলা তো কম নয়!
ভালো করে তাকালাম তৃণার দিকে। একমাথা ঘন চুলের গভীরে একদিকে ছোট্ট সিঁথি। অবিন্যস্ত এলোমেলোভাবে চুলগুলো কাঁধের ওপর ঝুলছে।
“বেশি সময় আপনার নষ্ট করব না ম্যাডাম,” একেনবাবু এই প্রথম কথা বললেন।
“না না সময় নষ্ট করার কী আছে! আপনারা প্লিজ বসুন।”
“আসলে ম্যাডাম আমরা এসেছি আপনার বন্ধু মিস পারমিতার মৃত্যুর ব্যাপারে।”
“হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পেরেছি, অভীক বলেছে। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে কী সাহায্য করতে পারি!”
“শুধু কয়েকটা প্রশ্ন ম্যাডাম। মিস পারমিতা নিউ ইয়র্কে এসে তো আপনার এখানেই উঠেছিলেন, তাই না?”
“না, এখানে এসে ওঠেনি, চলে যাবার আগে মাত্র এক রাত ছিল।”
“তাহলে কোথায় এসে উঠেছিলেন?”
“উঠেছিল ওদের গেস্ট হাউসে, সেখান থেকে ব্রুকলিন-এ অনুরাধার বাড়িতে… অভীকের কাছে যা শুনেছি।”
“ও হ্যাঁ ঠিক, ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা ম্যাডাম, অভীকবাবুকে কি আপনি অনেকদিন চেনেন?”
“সেই ছেলেবেলা থেকে— দাদার বন্ধু ছিল।”
‘বন্ধু ছিল’ কথাটা কানে বাজল। কিন্তু সে নিয়ে প্রশ্ন করাটা অভদ্রতা। একেনবাবু ওসবের ধার ধারেন না। “বন্ধু ছিল’ বললেন, এখন কি আর নন?
“দাদা বেঁচে নেই।”
“এবার বুঝলাম ম্যাডাম, সরি। আচ্ছা, মিস পারমিতাকে আপনি কতদিন চিনতেন?”
“ক্লাস ওয়ান থেকে একসঙ্গে লা-মার্টস-এ পড়েছি।”
“শুধু স্কুলের বন্ধু?”
“না, পাড়ারও বন্ধু। ও যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ে ওর বাবা হঠাৎ মারা যান। মাসিমা ওকে নিয়ে চলে আসে আমাদের পাড়ায় ওর মামাবাবুর বাড়িতে।”
“তাহলে তো খুবই বন্ধু। আচ্ছা, যে সময়টা ম্যাডাম পারমিতা আপনার বাড়িতে ছিলেন, ওঁর শরীর ঠিকঠাক ছিল?”
“ঠিকই তো ছিল। যেদিন ওর প্রোগ্রাম, তার আগের দিন এসেছিল। রাত্রে মামাবাবু ওকে ডিনার খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। আমি যেতে পারিনি একটা কাজ ছিল বলে। পরের দিন লাঞ্চের পর ওকে লিঙ্কন সেন্টারে নিয়ে গেলাম। প্রোগ্রাম শেষ হতেই মামাবাবুর সঙ্গে চলে গেল।”
“পরের দিন কি ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল?”
“হ্যাঁ, তবে খুবই অল্প সময়ের জন্য।”
“তখনও ঠিক ছিলেন?”
“মাথা ধরে আছে বলেছিল। কিন্তু ওটা ওর বহুদিনের রোগ, নতুন কিছু নয়।”
“আই সি, …তার মানে প্লেনে ওঠার আগে পর্যন্ত কিছুই ঘটেনি, যদি কিছু ঘটে থাকে প্লেনেই ঘটেছে।”
“কী ঘটেছে ভাবছেন?” একটু উদবিগ্ন হয়েই তৃণা জিজ্ঞেস করল।
“শরীর তো একটা যন্ত্র ম্যাডাম, কখন কীসে বিগড়ায় কেউ কি কিছু বলতে পারে!” বলতে বলতেই একেনবাবু তৃণার ঘরের চারিদিকটা এক বার দেখে বললেন, “এটা তো স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ম্যাডাম? একটাই ঘর?”
“হ্যাঁ।”
“আপনারা কি বাড়িতেই রান্না করে খেতেন?”
“না, বাড়িতে আমি রান্না প্রায় করিই না, বড়োজোর ব্রেকফাস্ট আর চা-কফি। মাঝে মাঝে স্যুপ-টুপ বানাই।”
“যেদিন উনি নাচতে গেলেন ব্রেকফাস্ট কোথায় করেছিলেন ম্যাডাম?”
“প্যানকেক খেতে চেয়েছিল বলে কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
“আর লাঞ্চ?”
“খুবই লাইট লাঞ্চ, বাড়িতেই একটু স্যুপ বানিয়ে নিয়েছিলাম।”
“বুঝলাম, ম্যাডাম। আর একটা প্রশ্ন, ওঁর সঙ্গে নিশ্চয় অনেক লটবহর ছিল – নাচে তো অনেক কিছু লাগে।”
একেনবাবু কী হিন্ট দিচ্ছেন বুঝতে পারল তৃণা। “না, নাচের সাজপোশাক আর অন্যান্য জিনিস ছিল ওদের গেস্ট হাউসে। এখানে এসেছিল শুধু একটা সুটকেস নিয়ে, রাখার কোনো অসুবিধা হয়নি।”
এর পরে এলোমেলো দুয়েকটা কথাই হল। তৃণার বাড়ি থেকে বেরিয়েই একেনবাবু অনুরাধাকে ফোন করলেন। ঠিক হল পরের দিন বিকেল পাঁচটায় যাবেন।
রাত্রে ডিনার খেতে খেতে প্রমথ একেনবাবুকে বলল, “একটা জিনিস খেয়াল করেছেন, তৃণা ওর দাদার বন্ধু অভীককে অভীকদা না বলে অভীক বলছিল?”
“বিগ ডিল,” আমি বললাম,
আমি বললাম, “এদেশে ছেলেরাও অনেক সময় বাবাকে নাম ধরে ডাকে।”
“স্টুপিডের মতো কথা বলিস না, তৃণা মেমসাহেব নয়।”
“এটা বলে কী প্রমাণ করতে চাস?”
“কিছুই না, কানে বাজল তাই বলছি। তবে তৃণা আর অভীকের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকলে আমি অবাক হব না। দেখলি না, কেমন বলামাত্র চট করে তৃণাকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিল। কী বলেন একেনবাবু?”
“তা তো হতেই পারে স্যার, দু-জন অবিবাহিত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আর নারী।”
“ঠিক বলেছেন, সবাই তো আর বাপি-টাইপের নয়।”
“তোরা চুপ করবি! যত্ত সব ননসেন্স আলোচনা!”
চার
এ যাত্রায় প্রমথ যোগ দিল না, আমি আর একেনবাবুই গেলাম। ব্রুকলিনের বন্ড স্ট্রিটে আগে আমি আসিনি। অনুরাধাদের অ্যাপার্টমেন্টটা পাঁচ তলায়। যখন পৌঁছোলাম অনুরাধার বর ভাস্কর অফিস থেকে ফেরেনি। পারমিতার থেকে অনুরাধা কয়েক বছরের ছোটো। নাচ শিখেছিল একই গুরুর কাছে। বোঝাই যায় পারমিতাকে হিরো-ওয়ারশিপ করত। কথাকলি জগতে এটা অপূরণীয় ক্ষতি সজল চোখে বার বার বলল।
“রিঙ্কিদি নিউ ইয়র্কে আসছে শুনেই ফোন করেছিলাম আমাদের কাছে এসে থাকার জন্যে। প্রথমে আসতে পারবে না বলেছিল। পরে নিজের থেকেই এল দিন চারেক থাকবে বলে। কিন্তু দু-দিন যেতে না যেতেই ওর ছেলেবেলার বন্ধু তৃণাদি বার বার ফোন করে প্রায় জোর করেই ওকে নিয়ে গেল। রিঙ্কিদির যাবার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু পুরোনো বন্ধু বলে কথা।”
“ম্যাডাম পারমিতার সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয় ম্যাডাম?”
“প্রায় তিন বছর, যে-দিন থেকে গুরুজির ডান্স অ্যাকাডেমিতে ভরতি হই। তার পরেই তো বিয়ে হয়ে এখানে চলে এলাম। কিন্তু আমাকে ‘ম্যাডাম’ বলবেন না প্লিজ। আমি আপনার থেকে অনেক ছোটো, আর তুমি করে বলবেন।”
যে কথা আমি সব সময়ে বলি, সেটাই একটু ঘুরিয়ে কৌতুক করলাম, “ম্যাডাম’ আর ‘স্যার’ হল একেনবাবুর ট্রেড-মার্ক, আর ‘আপনি’টাও— ওগুলো থেকে কিন্তু মুক্তি পাওয়া যায় না।”
এটা বলাতে আর কিছু না হোক, অনুরাধার অস্বস্তি মনে হয় একটু কমল। একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি ম্যাডাম পারমিতার নাচ দেখতে গিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ। তবে ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ায় একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই মেক-আপ লাগানোর অংশটা মিস করেছি।”
“সেটা কী ম্যাডাম?”
“কথাকলিতে লাল, সবুজ, হলুদ, নানান রং মুখে লাগানো হয়। অনেক সময়ে ডান্সাররা নিজেরাই লাগায়। এককালে দর্শকদের সামনে খোলা স্টেজে কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়ে ঘটা করে রং লাগানোর কাজটা করা হত। এখন লোকেদের অত ধৈর্য নেই, সময়ও নেই। তাই কাজটা গ্রিনরুমেই সারা হয়, স্টেজে উঠে নাচের ঠিক আগে মিনিট পাঁচেক সময় নেওয়া হয় ফাইনাল টাচ-আপ-এর জন্য।”
“বুঝলাম ম্যাডাম, ট্র্যাডিশন রক্ষা হল আবার দর্শকদের ধৈর্যচ্যুতিও ঘটল না।“
“ঠিক। সবাই যে এভাবে করে তা নয়, তবে আমরা গুরুজির ছাত্র-ছাত্রীরা এইভাবেই শিখেছি।”
আমি নাচের ভক্ত নই, কথাকলি আগে দেখিওনি। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর্টিস্টরা মুখে রং লাগাবে, আর দর্শকদের বসে বসে সেটা দেখতে হবে? টোটাল ননসেন্স!
একেনবাবু অবশ্য বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং ম্যাডাম।”
আমার মাথায় তখন একটা প্রশ্ন ঘুরছিল, পারমিতা তার ছেলেবেলার বন্ধুর বাড়িতে না উঠে তিন বছরের পরিচিত অনুরাধার বাড়িতে এসে উঠল কেন। উত্তরটা পেয়ে গেলাম যখন অনুরাধার বর ভাস্কর বাড়িতে ঢুকল। আরে এই ভাস্করই তো গতকাল টিভির ‘মর্নিং আমেরিকা’ প্রোগ্রামে লুইসিয়ানা আর ফ্লোরিডায় বন্যা নিয়ে এক্সপার্ট রিপোর্ট দিচ্ছিল! আমাদের থেকে বয়সে একটু ছোটোই হবে।
একেনবাবু দারুণ উত্তেজিত। ভাস্কর ঘরে ঢোকামাত্র বলে উঠলেন, “আরে স্যার, আপনাকে তো আমি টিভি-তে দেখেছি!”
একেনবাবুর উত্তেজনা দেখে ভাস্কর হেসে ফেলল। “তাই নাকি! আপনি?”
“আমি স্যার একেন, একেন্দ্র সেন, আর ইনি অধ্যাপক বাপি দে।”
“বুঝতে পেরেছি, আপনাদের কথাই অভীকদা বলেছে। আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।”
“তাতে কী হয়েছে স্যার, আপনারা টিভি-র লোক…।”
“না, না, আমি ঠিক টিভি-র লোক নই। ক্লুমবার্গ নিউজ ডিভিশনে আছি, রিসার্চ করি গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে।”
“ওরে বাবা, খুবই ইন্টারেস্টিং কাজ স্যার, পরে একদিন ভালো করে শুনতে হবে। আজ এসেছি ম্যাডাম পারমিতার মৃত্যুর ব্যাপারে।”
“সেটাই অভীকদা বলল। কিন্তু বুঝতে পারছি না, কীভাবে আমরা সাহায্য করতে পারি!”
“আমিও জানি না স্যার। শুধু আমাকে বলুন, আপনি ম্যাডাম পারমিতাকে কতদিন চেনেন?”
“তা বেশ কয়েক বছর। পারমিতাদি আমার ছোড়দির বন্ধু, সেই সূত্রেই পরিচয়।”
“ম্যাডাম তৃণাও কি আপনার ছোড়দির বন্ধু?”
“পরিচিত। ওঁর সঙ্গে যাওয়া-আসা তেমন ছিল না, যেটা পারমিতাদির সঙ্গে ছিল। পারমিতাদি আর ছোড়দি প্রায় অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিল। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, পারমিতাদির মৃত্যু নিয়ে এত চিন্তা করছেন কেন? কিছু কি সন্দেহ করছেন? “এটা কেন বললেন স্যার, সন্দেহ করার কি কোনো কারণ আছে?”
“না না, তা নয়। আসলে পারমিতাদির জীবন তো নানান ট্র্যাজেডিতে ভরা…।”
“ওসব কথা তুলছ কেন?” অনুরাধা অস্বস্তিভরে বলল।
“কী মুশকিল, পারমিতাদির মৃত্যুর তদন্ত করছেন ওঁরা— ওঁদের তো সব কিছু জানা দরকার, সত্যি-মিথ্যে সব কিছুই। তাই না?” আমাদের দিকে তাকিয়ে কথাটা শেষ করল ভাস্কর।
“একদম ঠিক বলেছেন স্যার। পারমিতা ম্যাডাম সম্পর্কে যা যা শুনেছেন সব কিছুই আমাদের বলুন।”
“বলছি। তবে শোনা কথা, অনেক অসত্য, গুজব এর মধ্যে থাকতে পারে। শুধু থাকতে পারে না, আমার বিশ্বাস আছে।” বলে অনুরাধাকে বলল, “একটু চা হবে নাকি?”
“সবার জন্যেই হবে। আপনারা কি চায়ে দুধ-চিনি নেন?” উত্তরটা জেনে অনুরাধা অদৃশ্য হল।
অনুরাধা চলে যেতেই ভাস্কর একটু নীচু গলায় জানাল, “এগুলো বললে, অনু খুব আপসেট হয়। রিঙ্কিদিকে ও অসম্ভব ভালোবাসে। কোনো ভুল বা অন্যায় রিঙ্কিদি করতে পারে, বিশ্বাস করে না। যাক গে, যা বলছিলাম…”
“উনি যদি খুব আপসেট হয়ে যান, তাহলে এখন নাই-বা বললেন। পরে আমাদের বাড়িতে এসে…”
“সেটাই ভালো হবে। অভীকদা বলেছে কোথায় আপনারা থাকেন। আমি বরং কাল কাজে যাবার আগে আপনাদের ওখানে এক বার ঢুঁ মারব। যদি আটটা নাগাদ যাই, অসুবিধা আছে?”
“এতটুকু নয় স্যার। এখন বরং অন্য গল্প করা যাক। ভালোকথা, ম্যাডাম তৃণাকে আপনি কতটা চেনেন?”
“ছোড়দি ভালো চেনে, আমিও চিনি। রিঙ্কিদির সঙ্গে স্কুলে পড়ত। দু-জনের মধ্যে খুব ভাবও ছিল একসময়, তবে বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ ছিল না। কয়েক দিন আগে তৃণাদি যখন ফোন করেছিল রিস্কিদি প্রথম বার ফোন ধরেনি। দু-তিন বার করার পর ধরেছিল। তখন অবশ্য অনেকক্ষণ কথা হয়।”
“কারণটা স্যার?”
দেখলাম ভাস্কর একটু ইতস্তত করছে।
“ঠিক আছে, না হয় কালকেই বলবেন।”
এইসব কথাবার্তার মধ্যেই অনুরাধা চা নিয়ে এল। চা না খেয়ে তো আর ওঠা যায় না, কিছুক্ষণ বসলাম।
পাঁচ
পরের দিন সকালে কাঁটায় কাঁটায় আটটার সময়ে ভাস্কর এল। প্রমথ তখন সেকেন্ড রাউন্ডের কফি বানাচ্ছে। খুশবাইয়ে ঘর ম-ম করছে।
“বাঃ, সময়মতোই তো এসে পড়েছি,” ভাস্কর সোফায় বসতে বসতে বলল।
একেনবাবু প্রমথর সঙ্গে ভাস্করের পরিচয় করিয়ে দিলেন। মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত লোকদের প্রমথ আবার পছন্দ করে না। তাই আগে থেকেই ভাস্করের আসার কারণটা ওকে বলে রেখেছিলাম, যাতে উলটোপালটা কিছু না বলে।
ভাস্কর অসম্ভব কথা বলতে ভালোবাসে, অনেক তথ্যই বিতরণ করে। কোনটে বিশ্বাসযোগ্য, কোনটে নয়— সেটা যাচাই করা কঠিন। প্রথমেই একটা বম্বশেল ফাটাল— পারমিতার সত্যিকারের বাবা নাকি রজত মুখার্জী, যাঁকে আমরা ওর মামাবাবু বলে জানি।
একেনবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “তাই নাকি স্যার! ভেরি ইন্টারেস্টিং।”
প্রমথ ধূমায়িত কফি ভাস্করের সামনে রেখে জিজ্ঞেস করল, “এটা কীভাবে জানা গেল, কোনো ডিএনএ টেস্টিং থেকে?”
প্রমথর এই চ্যালেঞ্জে অবশ্য ভাস্কর দমল না। “এটা সবাই সন্দেহ করে। কুমকুম মাসিমা মানে রিঙ্কিদির মা রজতবাবুর বাড়িতেই থাকেন, ওঁর স্বামীকে কেউ দেখেনি…।”
“সে কি, আমি তো শুনেছিলাম, ওঁর স্বামী মারা যাওয়াতে উনি ওঁর দাদার কাছে এসে থাকতেন!”
মুচকি হাসল ভাস্কর, “দাদা! ওসব তো প্রচার।” কথাটা বলে কফিতে চুমুক দিল।
প্রমথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল… এইভাবে চললে সত্যি-মিথ্যা কোনো তথ্যই মিলবে না। আমি আড়ালে চোখ পাকালাম। একেনবাবুও প্রমথকে উদ্দেশ করে হিন্ট দিলেন, “আমরা স্যার আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর জেনে কী হবে!” তারপর ভাস্করকে বললেন, “ব.5 দরজার ভেতরে ক। ঘটছে না ঘটছে, আমরা তার কতটুকু জানি। সত্যি স্যার, কত কিছুর খোঁজ রাখেন আপনি!”
ভাস্কর খুশি হল, এরকম একজন অ্যাপ্রিশিয়েটিভ শ্রোতা পেয়ে। তবে প্রমথকেও স্বীকৃতি দিল, “সব কিছুই কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কিছু কিছু প্রশ্ন তো থাকেই। তবে রিঙ্কিদিকে যে পুলিশ আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেবার জন্য গ্রেফতার করেছিল, সেটা সত্যি। পরে অবশ্য ছেড়ে দেয়। আচ্ছা বলুন তো, কেউ সুইসাইড করার আগে কাউকে দায়ী করে গেলে কেন এই ঝামেলা পোয়াতে হয়! সুইসাইড তো জোর করে কেউ কাউকে করাচ্ছে না। সুইসাইড হল স্বেচ্ছামৃত্যু।
কার প্রসঙ্গে ভাস্কর এই তথ্যটা দিল, ঠিক বুঝলাম না। তবে এই আইনের পেছনে যে কিছু যুক্তি নেই তা নয়। যেমন, পারিবারিক নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যা। কিন্তু সে নিয়ে কথা বাড়ানো অর্থহীন।
একেনবাবু অবশ্য কথাটাকে যেতে দিলেন না। “দায়ী করার কোনো কারণ লেখা ছিল স্যার?”
“সেটা জানি না, কিন্তু অনুমান করতে পারি প্রেমঘটিত। রিঙ্কিদি সারাজীবনই
অনেকের সঙ্গে প্রেম করে গেছে— এক জনকে ছেড়ে আরেক জনকে ধরেছে। এই ধরনের নির্বিচার ডাম্পিং সব সময়েই ডিভাস্টেটিং। হয়তো তারই ফল এই আত্মহনন।
“খুবই দুঃখের কথা স্যার, তবে সেটা না করে রেগে গিয়ে অন্য পার্টিকে খতম করলে ব্যাপারটা আরও বাজে হত… দু-দুটো প্ৰাণ নষ্ট।”
“একদম ঠিক বলেছেন। এটা শুনে মনে পড়ে গেল, এক প্রাক্তন প্রেমিক তো রিঙ্কিদিকে গ্রিনরুমে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করতে গিয়েছিল। সময়মতো সিকিউরিটি লোকটাকে ধরে ফেলেছিল বলে রক্ষা! সেই নিয়ে কেস হয়, বিচারে লোকটার জেলও হয়। বেশ হইচই হয়েছিল কিছুদিন।”
এইটেই আমি কোনো বাংলা পত্রিকায় কোথাও পড়েছিলাম, ক’দিন আগে যেটা মনে করার চেষ্টা করছিলাম! লোকটার সঙ্গে পারমিতার কিছু ঘনিষ্ঠ ছবিও পত্রিকাতে বেরিয়েছিল!
“আচ্ছা স্যার, যিনি সুইসাইড করেছিলেন, তাঁর কথা কিছু জানেন?”
“না, আমি তখন দিল্লিতে আমার পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আর যে খোঁজখবর রাখত, সেই ছোড়দি তখন কলকাতায় থাকত না, বিয়ে করে ইংল্যান্ড চলে গিয়েছিল।”
“আপনি গতকাল বলেছিলেন তৃণা ম্যাডামের ফোন পারমিতা ম্যাডাম ধরতে চাননি, তার কারণটা কিন্তু কালকে আপনি বলেননি স্যার।”
“ও হ্যাঁ, পারমিতাদি আর তৃণাদির মধ্যে ঝগড়া লাগে এক পুরুষবন্ধুকে নিয়ে। এত ঝগড়া যে তৃণাদি নাকি রাগ করে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দিয়েছিল! হয়তো তৃণাদির প্রেমিককে রিঙ্কিদি কবজা করেছিল, কে জানে! তৃণাদি তো আর বিয়েই করেনি।”
“সেই যুক্তিটা বোধহয় টিকবে না স্যার, আপনার পারমিতাদিও তো বিয়ে করেননি।”
“তা ঠিক। আচ্ছা, আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, আপনি তো রিঙ্কিদির মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করছেন শুনলাম, পুলিস কি কিছু সন্দেহ করছে?”
“আই হ্যাভ নো ক্লু স্যার।”
“ওয়াইল্ড গুজ চেজ। আপনি এখানে বসে একা কী করতে পারবেন! অভীকদাও ওর বসের খ্যাপামিতে খুবই বিরক্ত। ওকে নাকি বলে গেছেন মানি শুভ নট বি এনি অবজেক্ট, খুনিকে ধরতেই হবে! আমাকে দুঃখ করে বলছিলেন, ‘এদিকে হার্লেমে ব্লাস্টিং চলছে- হান্ড্রেড মিলিয়ন ডলারের প্রোজেক্ট, আর বস বলে গেছেন একেনবাবুর সঙ্গে সঙ্গে যেন থাকি, কী ঝামেলা বল তো!’ সরি, কিছু মনে করবেন না আপনাকে কথাটা বলে ফেললাম!”
“আরে না না স্যার, তাতে কী হয়েছে। বলে ভালো করেছেন, চেষ্টা করব : ওঁকে না জ্বালাতে।”
“তাতে আপনার তদন্তের ক্ষতি হলে কিন্তু ভালোর থেকে ওর মন্দ হবে। এটা আপনাকে বলে দিয়েছি শুনলে অভীকদা আমার ওপর রাগ করবে।”
“কাউকে কিচ্ছু বলব না স্যার।”
এবার আমি প্রশ্ন করলাম ভাস্করকে, “ব্লাস্টিং-এর ব্যাপারটা কী? আমি তো শুনেছিলাম রজতবাবু সফটওয়্যারের বিজনেস করেন এদেশে।”
“তা তো করেনই। এই বছরই অভীকদার পরামর্শে একটা কনস্ট্রাকশন বিজনেসে পার্টনারশিপ নিয়েছেন। আসল টাকা নাকি রিয়েল এস্টেট আর কনস্ট্রাকশনে। হার্লেমে পুরোনো টেনামেন্ট ভাঙা হচ্ছে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি হবে বলে। তার জন্যই ব্লাস্টিং চলছে।”
“এবার বুঝলাম।”
“আপনি বুঝলেন, কিন্তু আমি বুঝলাম না।” ভাস্কর বলল।
“মানে?”
“মিস্টার মুখার্জীর তিন কুলে কেউ নেই, এত টাকা কার জন্য রেখে যাবেন! ভাগ্নি বলুন, মেয়ে বলুন সেও তো চলে গেল! আমি জানি রিঙ্কিদিও এর বিরুদ্ধে ছিল।”
“কীসের বিরুদ্ধে স্যার?”
“এই নতুন ব্যাবসা শুরু করার বিরুদ্ধে। রিঙ্কিদির বিজনেস ব্যাপারটাই ভালো লাগে না। নাচ-টাচ নিয়েই মেতে থাকে। আবার আরেকটা ঝামেলায় জড়ানো। এই নিয়ে রিঙ্কিদির সঙ্গে খটাখটিও হয়েছে রজত আঙ্কলের। কিন্তু আঙ্কলের আবার অভীকদার ওপর খুব আস্থা। যাই হোক, এবার আমি উঠি। সাড়ে ন’টায় একটা মিটিং আছে। আর যদি কিছু জানতে চান, আমাকে ফোন করবেন। নম্বরটা সেভ করে রেখেছেন তো?”
“করব স্যার, নম্বরটা আছে আমার কাছে।”
.
ভাস্কর চলে যাবার পর প্রমথ একেনবাবুকে বলল, “বকবকানিতে আপনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এই ভাস্কর। ফালতুও বকে বেশ।”
“সব কথা বোধহয় ফালতু নয় স্যার,” একেনবাবু ওঁর ফোনটার দিকে তাকাতে ভাতে বললেন।
জিজ্ঞেস করলাম, “কী বলতে চাচ্ছেন?”
“এই যে স্যার,” ফোনটা দেখিয়ে উত্তর দিলেন, “রাখালের পাঠানো ইনফর্মেশনগুলো পড়ছি। ওকে বলেছিলাম পারমিতা ম্যাডাম সম্পর্কে যা যা খবর সংগ্রহ করতে পারে জানাতে। ওখানেও একটা ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে… রাখাল সেটারই চার্জে।”
“আপনি মশাই সামথিং, এসব যে শুরু করেছেন আমাদের তো বলেনওনি!” প্রমথ রাগ দেখাল।
“কী মুশকিল স্যার, এই তো এখন বলছি!”
“ননসেন্স! কী লিখেছেন রাখালবাবু এখন বলুন। আর ঢেকে-চেপে নয়, যা যা আছে সব।”
“ঢাকব কেন স্যার, সবই বলছি। আত্মহত্যার কেসে মিস পারমিতাকে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারটাও আছে। সুতরাং ভাস্করবাবু ভুল কিছু বলেননি। তবে একটা খবর উনি বলেননি।”
“সেটা কী?” এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“এক বন্ধুর বেবিকে আদর করার সময়, হাত থেকে বেবি পড়ে যায়। ফলে সিভিয়ার পার্মানেন্ট ইনজুরি। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ঝামেলা এড়াতে পুলিশে রিপোর্ট করেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অ্যাক্সিডেন্ট বলে আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি। বন্ধুও তার বেবিকে নিয়ে লন্ডনে ফিরে যায়।”
“মাই গড, এই হয়তো ভাস্করের সেই ছোড়দি!” আমি বললাম। “আপনি কি মনে করেন ইচ্ছে করেই এই ঘটনার কথা ভাস্কর বলেনি, না জানার তো কথা নয়।”
“দুম করে একটা কনক্লুশন করে ফেললি!”
প্রমথর মন্তব্যের প্রতিবাদে আমি বললাম, “কেন, ভাস্করের ছোড়দি তো ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিল, যায়নি?”
“প্রতিদিনই অনেকের ছোড়দি ইংল্যান্ডে যায়, সো হোয়াট!”
এটা একটা যুক্তি হল! ব্যাটাকে তুলোধোনা করতে যাচ্ছি, তার আগেই প্রমাকে উদ্দেশ করে একেনবাবু বললেন, “আরেক কাপ কফি হলে জমত স্যার, তাই না বাপিবাবু?”
“এত ঘন ঘন কফি পায় কেন আপনার?
“কারণ স্যার, আপনার কফি হচ্ছে স্বর্গীয়।
‘এইসব তেল আপনার ‘ফ্রেন্ড দ্য গ্রেট’ বাপিকে মারবেন!” কথাটা বলল বটে, কিন্তু কিচেনে গেল কফি গ্রাইন্ড করতে।
ছয়
বিকেল বেলা অভীক যখন এল, প্রমথ তখন আবার উর্দু-টু-ইংলিশ ডিকশনারি নিয়ে বসেছে। আমি একটা পেপারের প্রুফ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। তারই মধ্যে একেনবাবু বকবক করে আমাদের মাথা খাচ্ছেন!
অভীক ঢুকেই প্রমথকে বলল, “ছবিটার জন্য থ্যাংক ইউ।”
“ইউ আর ওয়েলকাম। …একেনবাবুর কাছ থেকে কিন্তু এখনও ধন্যবাদ পাইনি। ছবিটা পেয়েছেন কিনা তাও জানি না।”
“কীসের ছবি স্যার?”
“আপনার হাতে চেক তুলে দেবার ছবি। ভুলে গেছেন নিশ্চয়?”
“আরে না না স্যার, ভুলব কেন, পেয়েছি! সত্যি ছি ছি, আপনাকে তো ধন্যবাদটাই জানানো হয়নি। ধন্যবাদ স্যার।”
“লেট হলেও অ্যাকসেপ্টেড। এবার আপনি অভীকবাবুকে জিজ্ঞেস করুন উনি কি শুধু ধন্যবাদ দিতে এসেছেন, না কাজটা কদ্দূর এগিয়েছে জানতে এসেছেন?” অভীক একটু লজ্জা পেল। “না না, তা নয়।” একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার যা যা ইনফর্মেশনের দরকার পেয়েছেন তো?”
“হ্যাঁ, সবাই যতটুকু সাহায্য করার করছেন। আচ্ছা, আপনিও তো পারমিতা ম্যাডামকে ভালো করেই চিনতেন, তাই না?
“ছেলেবেলায় চিনতাম পাড়ার মেয়ে হিসেবে। বড়ো হয়ে যাবার পর তো আর পাড়ার মেয়ে নয়, বস-এর ভাগ্নি। সুতরাং একটা দূরত্ব হয়েছিল।”
“ভাস্করবাবুর কথা শুনে মনে হল পারমিতা ম্যাডামের সঙ্গে অনেকেরই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হয়েছিল, এ ব্যাপারে আপনি কি কিছু জানেন স্যার?”
“ভাস্কর, এ ব্যাপারে অনেক ভালো জানবে। আমি আবছা আবছা শুনেছি। ইচ্ছে করেই শুনতে চাইনি পাছে বস এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে বসেন। ওঁর কাছে তো লুকোতে পারব না।”
“কার কাছ থেকে শুনেছিলেন স্যার?”
“সে কি আর মনে আছে, এর-ওর কাছ থেকে তো নানারকম উড়ো কথাই কানে আসে।”
“তা তো বটেই স্যার। আচ্ছা, আপনি কি তৃণা ম্যাডামের দাদাকে চিনতেন?”
“চিনতাম, কিন্তু খুব ভালো করে নয়।”
“আপনাদের পাড়াতেই তো থাকতেন স্যার!”
“তা থাকত, কিন্তু ও একটু আলাদা থাকত, আমাদের সঙ্গে তেমন মিশত না। তৃণাদের বাড়িতে বড়ো হলেও ও কিন্তু আপন দাদা ছিল না, মাসতুতো দাদা।”
“উনি মারা গেলেন কীভাবে?”
“শুনেছিলাম সুইসাইড। এর বেশি সত্যিই কিছু জানি না।”
“কোনো গুজবও শোনেননি স্যার?”
“গুজব তো অনেক কিছুই রটে, সব তো আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। সেই জন্যেই বলতে বাধছে।”
“তাও একটু শুনি না স্যার?”
একটু ইতস্তত করে অভীক বলল, “আসলে আমার মনে হয় ওর মাথাটাই খারাপ ছিল। শুনেছি মেয়েদের অনেক অশ্লীল মেসেজ পাঠাত, রিঙ্কিকেও নাকি পাঠিয়েছিল। ড্রাগস ও অন্যান্য বদভ্যাস ছিল। নিজের বোনের সঙ্গেও নাকি অবৈধ সম্পর্ক পাতাবার চেষ্টা করেছিল, যেটা সম্পূর্ণ অসত্য।”
“নিজের বোন মানে তৃণা ম্যাডাম!”
“হ্যাঁ।”
“তারপর?”
“পাড়ায় এসব জানাজানি হবার পর খুবই বিশ্রী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পাড়াতেই ওকে টিটিকিরি দেওয়া আর হেনস্তা করা শুরু হয়। তবে তার সঙ্গে সুইসাইডের কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা জানি না।”
একেনবাবু কোনো মন্তব্য করলেন না। একটু চুপ করে থেকে বললেন, “ভালোকথা স্যার, রজতবাবু তো বোধহয় বিয়ে করেননি, তাই না?”
“যদ্দূর জানি করেননি।”
“ওঁর কোনো ভাই নেই, তাই তো স্যার?”
“আমার জ্ঞানত নেই।”
‘মাসতুতো, জ্যাঠতুতো… মানে ‘তুতো’ টাইপের স্যার?”
“বলতে পারব না।”
“ধরে নিচ্ছি ভাগ্নিই সব কিছু পেতেন ওঁর মৃত্যুর পর।”
“সেইরকমই আমরা ভেবেছিলাম। তবে দূর সম্পর্কের ভাইদের ব্যাপারটা তৃণা হয়তো বলতে পারবে। ওর তো খুব যাতায়াত ছিল ওই বাড়িতে।”
“কিন্তু ম্যাডাম তৃণার সঙ্গে তো বোধহয় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল পারমিতা ম্যাডামের… নইলে ওঁর বাড়িতে না উঠে, অনুরাধার বাড়িতে গিয়ে উঠলেন!”
ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে কোনো মন্তব্য না করে অভীক বলল, “সেটা তৃণার বাড়িতে জায়গার অভাব বলে। প্রথমে এসে তো গেস্ট হাউসেই উঠেছিল। কিন্তু গেস্ট হাউসটা একদম ফাঁকা ছিল বলে একা একা থাকতে চায়নি।”
“যেদিন প্লেনে ওঠার কথা তার আগের রাত্রে তো গেস্ট হাউসেই ছিলেন স্যার?”
“তা ছিল, কারণ তখন স্যার ছিলেন, তা ছাড়া আরও দু-জন গেস্ট ছিলেন। একা থাকার ব্যাপার ছিল না।” .
“ভালোকথা স্যার, আপনি তো পারমিতা ম্যাডামের নাচ দেখতে গিয়েছিলেন?
“হ্যাঁ।” একটু থেমে অভীক বলল, “আমি না গেলে, নাচই হত না।”
“কেন স্যার?”
“ওর নাচের জামাকাপড়, মেক-আপ, নাচের অলংকার-টলংকার সব কিছু তো গেস্ট হাউসেই ছিল। অত জিনিস বন্ধুদের বাড়িতে রাখবে কোথায়? আমিই ওগুলো তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
“এবার বুঝলাম স্যার। ভালোকথা, গেস্ট হাউসটা এক বার দেখতে পারি?”
“নিশ্চয়। কিন্তু ওখানে কিছু পাবেন বলে মনে হয় না। ঘরগুলো তো ক্লিন করার কথা গেস্টরা চলে গেলে।”
“আমিও নিশ্চিত স্যার কিছু পাব না, তবে অধিকন্তু ন দোষায়।”
“বেশ তো কখন যেতে চান বলুন, আমি নিয়ে যেতে পারি।”
“এখন যদি যাই, তাহলে তো আপনাকে আবার গেস্ট হাউসে যেতে হবে।”
“তাতে কী হয়েছে, এমনিতেই আমাকে এক বার গেস্ট হাউসে যেতে হত। একজন গেস্ট একটু আগে মেসেজ পাঠালেন ওঁর ফ্ল্যাশ ড্রাইভ গেস্ট রুমে ফেলে গেছেন! ওটা আজকেই ওভারনাইট ডেলিভারি করে পাঠাতে হবে… কী ঝামেলা বলুন তো!”
এবার আমাকে ধরলেন একেনবাবু। “যাবেন নাকি স্যার? গাড়িতে গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে।”
অভীক বলল, “গাড়ি লাগবে কেন, সাবওয়ে আর বাস ধরে চলে যাব, পার্কিং-এর ঝামেলা নেই। বড়োজোর সোয়া ঘণ্টার পথ।”
আমি জানি সাবওয়ে বা বাস কোনোটাই একেনবাবু পছন্দ করেন না। আমার দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কী স্যার, আপনারা যাবেন না?”
প্রমথও খুব ভালোভাবে জানে কেন একেনবাবু দু-দু বার একই প্রশ্ন করছেন, তাও অম্লানবদনে বলল, “গেস্ট হাউস তো আপনি দেখতে চান, আমরা ভিড় বাড়িয়ে কী করব!”
“কী যে বলেন স্যার, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন!”
.
শেষে আমরা সবাই গেলাম আমার গাড়িতেই। গেস্ট হাউসটা কুইন্সের কিউ গার্ডেনস-এ। ভাগ্যিস গেস্টমশাই ওঁর ফ্ল্যাশ ড্রাইভ ফেলে চলে গিয়েছিলেন! পারমিতা যে-রুমে ছিল তার লাগোয়া বাথরুমে এগজস্ট ফ্যান সশব্দে চলছে, জানলাটাও একটু খোলা!
অভীক বিরক্ত হয়ে বলল, “দেখেছেন কাণ্ড! গেস্টরা সবাই চলে যাবার পর আমার অফিস অ্যাসিস্টেন্টের কাজ এগুলো সব চেক করা। নিশ্চয় এটা জ্যানিটরের কাণ্ড! বাথরুম ক্লিন করতে এসে কীর্তিটা করেছে। ওর সুপারভাইজারকে রিপোর্ট করতে হবে… এনার্জি নষ্ট এবং তার ওপর ক্রাইম ইনভাইট করা।”
“এখানে চুরি-টুরি খুব হয় নাকি স্যার?”
“খুব হয় কিনা জানি না। আমাদের এই গেস্ট হাউস পাঁচ বছরের পুরোনো… টাচ উড, এখন পর্যন্ত কিছু চুরি হয়নি।”
“ক্লিনিং সার্ভিসের লোকেরা কি সব বিশ্বাসযোগ্য?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“এখন পর্যন্ত তো কোনো সমস্যা হয়নি। গেস্টরা কিছু ফেলে গেলে ড্রয়ারে বা ক্লজেটে ঢুকিয়ে রেখে যায়। নতুন গেস্ট আসার আগে আমরা সেগুলো সরিয়ে রাখি।”
.
কথাটা ঠিক, একেনবাবু ক্লজেটটা খুলতেই চোখে পড়ল কতগুলো মাস্ক খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। আজকাল পলিউশনের জন্যে আমিও মাঝেমধ্যে কলকাতায় মাস্ক নিয়ে যাই। তবে এগুলোর কোয়ালিটি অনেক ভালো। অভীক বলল, “ইসস, কলকাতায় অ্যালার্জিতে খুব কষ্ট পেত বলে রিঙ্কির জন্যে কিনেছিলাম। নিয়ে যায়নি দেখছি।”
একেনবাবু একটা মাস্ক হাতে নিয়ে বললেন, “খুব ভালো কোয়ালিটির, কিন্তু এখন তো আর লাগবে না স্যার, এগুলোর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন উনি।”
.
ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা পাওয়া গেল তিন নম্বর গেস্ট স্যুইটে, নাইট টেবিলের ড্রয়ারের ভেতর। কিংস্টন-এর তৈরি। তবু নিশ্চিত হবার জন্য অভীক ফোন করল। ঠিকই, ওটাই ফেলে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক।
“না পাওয়া গেলে লজ্জার ব্যাপার হত।” অভীক ওটা পকেটস্থ করে বলল, “এখন এটাকে পাঠিয়ে দিলেই আমার মুক্তি। …আপনি আর কিছু দেখতে চান, একেনবাবু?”
“না স্যার, এই তো দেখলাম। মোট চারটে স্যুইট, তাই তো?”
“হ্যাঁ, এ ছাড়া একটা কমন কিচেন। সকালে একজন হাউসকিপার এসে, চা-কফি বানিয়ে দেয়। দেখতে চান?”
“এলাম যখন দেখেইনি স্যার।”
কিচেনে কী দেখার আছে বুঝলাম না। কিছুই প্রায় নেই। রেফ্রিজারেটরে কয়েকটা হাফ-অ্যান্ড-হাফ, জ্যাম-জেলি, মাখন ইত্যাদি। ওভারহেড ক্যাবিনেট-এ কয়েকটা সিরিয়ালের বাক্স, আরও হাবিজাবি কিছু ছিল- মনে রাখার মতো কিছুই নয়। আসাটা যে অর্থহীন হবে আমি জানতাম। আসলে একেনবাবু কোথাও যাবার সুযোগ পেলেই ছোটেন!
গেস্ট হাউস থেকে গাড়িতে সবাই যখন ফিরছি অভীক মাঝপথে এক জায়গায় নেমে চলে গেল ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা ক্যুরিয়ার করতে।
সাত
পারমিতার মৃত্যুর পর পাঁচ-ছ’ দিন পার হয়ে গেছে। এবার মনে হয় একেনবাবু ফেল মেরেছেন। আমরা নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। একেনবাবু সকাল সকাল চিন্তিত মুখে কোথাও যাচ্ছেন, ঠিক কী করছেন জানি না। মাঝে মাঝেই এরকম উনি করেন। নিশ্চয় ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কোনো কাজ নিয়ে এক্সট্রা টু-পাইস কামাচ্ছেন, যেখানে আমাদের কোনো ভূমিকা নেই। আগে এরকম হঠাৎ হঠাৎ অদৃশ্য হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করতাম। প্রমথ ধমকাত, ‘তুই কি একেনবাবুর গার্জেন? পুরোদস্তুর অ্যাডাল্ট, পুলিশে চাকরি করতেন, খুবই ঘুঘুলোক— শুধু বোকা-বোকা সেজে থাকেন… এত দিনেও সেটা বুঝলি না?”
.
কাল শুতে শুতে একটু রাত হয়েছে, সকালে ঘুম-ঘুম চোখে উঠে দেখি প্ৰমথ খুবই মুডে আছে। কিচেনে খুটখাট চলছে। আমাকে দেখে বলল, “আজ ব্রেকফাস্ট মেনু হচ্ছে মোগলাই পরোটা আর কষা মাংস।”
কষা মাংস গত রাত্রে বানিয়েছিল, কিন্তু আমাদের কাউকে খেতে দেয়নি। ওর থিয়োরি ঘণ্টা দশেক মজতে না দিলে স্বাদ ভালো হয় না। প্রমথর থিয়োরি ভুল না ঠিক সে নিয়ে আমি তর্ক করতে চাই না। কিন্তু রান্না হয়ে গেছে অথচ খেতে পাচ্ছি না… ব্যাপারটা আমার অসহ্য লাগে! উপায় কী, কুক যেখানে আপত্তি তুলছে! এমন সময়ে ডিং-ডং বেল। সক্কাল বেলাতে কে এল! দরজা খুলে দেখি ফ্ৰান্সিস্কা।
“আরে এসো এসো, হোয়াট এ সারপ্রাইজ!”
গত রাত্রে প্রমথর খাদ্য সংরক্ষণ করার কারণটা এতক্ষণে বুঝলাম। নির্ঘাত ফ্র্যান্সিস্কাকে নেমন্তন্ন করেছে স্পেশাল মোগলাই ব্রেকফাস্ট হচ্ছে বলে, সেটাই ব্যাটা আমাদের জানায়নি! কাঁচা বাংলায় অভিযোগ করতেই প্রমথর উত্তর, “আগে জানতে পারলে কী লাভ হত?”
“ঘরটা একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতে পারতাম!”
“বাঃ, সেটা তো ভালোকথা। প্রতিদিনই তাহলে ধরে নে ফ্র্যান্সিস্কা আসছে।”
নিজের নামটা শুনে ফ্র্যান্সিস্কা আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কী নিয়ে কথা বলছ তোমরা?”
“তুমি আসছ জানলে বাপি নাকি ঘরটা ক্লিন করত।”
ফ্র্যান্সিস্কা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সো সুইট!” তারপর বলল, “লেট মি হেল্প ইউ।”
“আরে না না, তুমি বসো, আমি করছি।”
“থাক। কাউকেই কিছু করতে হবে না। বাপি, তুই আমাকে কয়েকটা ডিম ভেঙে দে।”
“দেখি, কী করছে ও!” বলে ফ্র্যান্সিস্কাও কিচেনে ঢুকল।
.
মোগলাই পরোটা খাসা বানায় প্রমথ, তবে ঠিক দেশের মোগলাই পরোটা নয়- মেক্সিক্যান তরতিল্লা দিয়ে তৈরি, প্রমথর নিজস্ব ক্রিয়েশন। কর্ন ফ্লাওয়ার তরতিল্লা নয়, গমের আটার তরতিল্লা। প্রথমে ভালো করে ডিম ফেটিয়ে তাতে পিঁয়াজ কুচি, লঙ্কা কুচি আর নুন মেশাতে হয়। এরপর ফ্ল্যাট প্যান-এ অল্প আঁচে তরতিল্লার একটা সাইড নামমাত্র ভেজে, সেটা উলটে ফেটানো ডিম ঢেলে তিনটে সাইড মুড়ে ত্রিভুজ বানিয়ে সেটাকে উলটে একটু ভাজলেই প্রমথ-স্পেশাল। মানতেই হবে খেতে বেশ, আর তার সঙ্গে কষা মাংস থাকলে তো কথাই নেই!
ইতিমধ্যে একেনবাবু ঘুম থেকে উঠেছেন।
“গুড মর্নিং, ম্যাডাম।”
“গুড মর্নিং, ডিটেকটিভ। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠলে?”
“আসলে ম্যাডাম, ক’দিন হল একটু রাত জেগে কাজ করেছি।”
কী কাজ করছেন, সেটা কিন্তু আমরা কেউ জানি না।” ফ্র্যান্সিস্কাকে কথাটা জানিয়ে একেনবাবুকে পাকড়াল প্রমথ, “রজতবাবুর কাছ থেকে যে কড়কড়ে ছ’হাজার হাতিয়ে নিলেন, সেটা নিয়ে কিছু করেছেন?”
“পাঁচ হাজার স্যার।”
“ওই হল পাঁচ আর ছয়-এ এমন কী তফাত?”
“না স্যার, বাপিবাবু তো এসব নিয়ে পরে লিখবেন। ভুল ইনফর্মেশন যাতে না দেন, তাই বললাম।”
“ননসেন্স!
“থ্যাংক ইউ একেনবাবু, গল্পে আমি পাঁচই লিখব।” প্রমথকে খোঁচা দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না।
ফ্র্যান্সিস্কা বেচারা এসব ব্যাপার কিছুই জানে না। একটা কনফারেন্সে ক’দিন বাইরে ছিল।
‘কী নিয়ে কথা বলছ তোমরা?”
“তোমার ডিয়ার ডিটেকটিভকেই জিজ্ঞেস করো, আমাদের তো কিছু বলেন না।” প্রমথ উত্তর দিল।
“ডোন্ট বি সিলি!”
“আসলে ম্যাডাম একজন গ্রেট ডান্সার কিছুদিন আগে মারা গেলেন, তার কিছু খোঁজখবর করার দায়িত্ব ছিল।”
“খোঁজখবর পেলে কিছু?”
“একটু একটু পেলাম ম্যাডাম…।”
“সেই জন্যেই কি আজকে আমাদের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন?” প্রমথর ব্যঙ্গোক্তি, “আমাদের পক্ষে তো সেটা খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার!”
“কী যে বলেন স্যার, আপনাদের সঙ্গেই তো ব্রেকফাস্ট খাই… দু-এক দিন বাদ পড়ে শুধু। এরকম খাসা কফি আর কোথায় জুটবে?”
“থাক আর তেল মারতে হবে না।”
ফ্রান্সিস্কা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “টেল মাড়টে’ মানে?”
“অয়েলিং, অর্থাৎ…” কথাটা শেষ করতে পারলাম না, প্রমথও কিছু বলতে যাচ্ছিল… একেনবাবুর মোবাইল বেজে উঠল। ফোনটা নিয়ে উনি জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কতগুলো কথা ভালো করেই শুনতে পেলাম।
“আরেব্বাস, এটা তো দারুণ খবর স্যার! …আচ্ছা আমি পাঠাচ্ছি, দেখুন চিনতে পারে কিনা। “ পরের কথাগুলো বাইরে একটা অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজে ঠিক কানে এল না। ফোন কানে নিয়েই উনি নিজের ঘরে গেলেন।
“কী ব্যাপার বলো তো, ডিটেকটিভ তো একজন গ্রেট ডান্সার কিছুদিন আগে মারা গেছেন বলে চলে গেলেন!”
“হ্যাঁ, সেই মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করার ভারই একেনবাবুকে দেওয়া হয়েছে।” বলে সংক্ষেপে এখন পর্যন্ত যা যা হয়েছে সবই ফ্র্যান্সিস্কাকে বললাম। পাত্র-পাত্রী কাউকেই বাদ দিলাম না। এখন পর্যন্ত বিশেষ কিছু ঘটেনি, সুতরাং মিনিট দশেকের মধ্যেই পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডই ফ্র্যান্সিস্কা পেয়ে গেল। তার মধ্যেই প্রমথর মোগলাই পরোটা বানানো শেষ।
একেনবাবু ফিরলেন তারও মিনিট দুই পরে।
“কার সঙ্গে কথা বলছিলেন এতক্ষণ ধরে? এদিকে মোগলাই পরোটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!”
“প্রথমে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট, সেটা শেষ হতে না হতেই ফ্যামিলির ফোন স্যার।” ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে কাঁচুমাচু মুখে সাফাই গাইলেন।
“বউদির ফোন, তাহলে তো আপনার সাতখুন মাপ। নিন বসুন, এবার খেয়ে আমাদের উদ্ধার করুন।”
চেয়ারে বসে একেনবাবু বললেন, “বুঝলেন স্যার, অভীকবাবুকে আসতে বললাম। ভাবলাম প্রোগ্রেস রিপোর্টটা দিয়ে দিই।”
“কীসের প্রোগ্রেস রিপোর্ট?”
“বাঃ, যার জন্যে উনি পাঁচ হাজার ডলার দিলেন!”
“সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে?”
“পুরোটা নয় স্যার।”
“তাহলে!”
“কয়েকটা খটকা আছে স্যার, সেগুলো ক্লিয়ার করতে হবে।”
“কখন আসছে? আমি কিন্তু আর মোগলাই পরোটা বানাতে পারব না, আপনার ভাগটা ওকে দেবেন।” প্রমথ ঘোষণা করল।
“না না স্যার, উনি এক ঘণ্টা বাদে আসছেন।”
“শুনুন একেনবাবু, ফ্র্যান্সিস্কা কিন্তু আপনার মুখ থেকে তদন্ত সম্পর্কে শুনতে চায়, আমি শুধু ওকে ব্যাকগ্রাউন্ডটা দিয়েছি।” একেনবাবুকে বললাম।
“ইয়েস। আই অ্যাম ওয়েটিং…” ফ্রান্সিস্কা একেনবাবুর দিকে সাগ্রহে তাকাল।
“বলব ম্যাডাম, অভীকবাবু এলেই এখন পর্যন্ত যতটুকু বুঝেছি পুরোটাই বলব। তার আগে খেয়ে নিই নইলে প্রমথবাবুর খারাপ লাগবে, এত কষ্ট করে রান্না করেছেন!”
একেনবাবুর কথায় ফ্র্যান্সিস্কা হেসে উঠল।
প্রমথ চটল। “আপনার এই ন্যাকামি সহ্য করতে পারি না। আমার কষ্ট হবে বলে খাচ্ছেন, না নিজের লোভে খাচ্ছেন!”
“দুটোই স্যার।” হাসি হাসি মুখে বললেন একেনবাবু।
এইসব গল্পগুজবের মধ্যেই খাওয়াটা শেষ হল। তার মধ্যেই টিং করে একেনবাবুর একটা মেসেজ এল। মুখ দেখে বুঝলাম সুখবর।
প্রমথ বলল, “কী ব্যাপার?”
“আরেক কাপ কফি কি হবে স্যার?”
আট
কফি ফ্র্যান্সিস্কাই বানাল। প্রমথর কফির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে একমাত্র ফ্র্যান্সিস্কার বানানো কফি। ও এলে সকালেই তিন-চার রাউন্ড হয়ে যায়। কফির কাপটা একেনবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ডিটেকটিভ, এবার শুরু করো।”
টাইমিংটা চমৎকার, এর মধ্যে অভীকও এসে গেল।
“বসুন স্যার, বসুন। ম্যাডাম ফ্র্যান্সিস্কার বানানো কফি খান, একেবারে স্বৰ্গীয়!
“থ্যাংক ইউ ডিটেকটিভ।”
অভীক ফ্র্যান্সিস্কাকে চেনে না। পরিচয় করিয়ে দিতেই “হ্যালো,” বলে একটু নড করল।
সবাই কফি নিয়ে বসলাম।
“একেবারে পারফেক্ট টাইমিং স্যার আপনার। আমি এঁদের পারমিতা ম্যাডামের ডেথ-এর প্রোগ্রেস রিপোর্ট দিতে যাচ্ছিলাম। আপনি পরে এলে আবার প্রথম থেকে দিতে হত, আপনিই তো এই কাজের জন্য আমাকে টাকা দিয়েছেন।”
“আমি না, আমার বস।
“ওই হল স্যার,” কফিতে চুমুক দিয়ে একেনবাবু শুরু করলেন, “প্রথমেই বলি, পারমিতা ম্যাডামের মৃত্যুটা ন্যাচারাল নয়, ওটা খুন খুন।”
“সে কি!” অভীক খুবই অবাক হল।
“হ্যাঁ, স্যার। অটোপ্সি-তে ধরা পড়েছে।”
অটোপ্সির ব্যাপারটা বোধহয় অভীক জানত না। “অটোপ্সি! কী ধরা পড়েছে?”
“বলছি স্যার, যে কোনো অপরাধ বা খুনে তিনটে জিনিস জড়িয়ে থাকে, মিন্স, মোটিভ এবং অপরচুনিটি। ‘মিস’ হল যেটা দিয়ে অপরাধটা করা হয়, যেমন বন্দুক দিয়ে খুন করা হলে বন্দুক, বিষ দিয়ে হত্যা করা হলে বিষ। আর,
‘মোটিভ’ হল অপরাধ বা খুন করার পেছনে যে কারণটা থাকে। আর অপরচুনিটি হল অপরাধ বা খুন করার সুযোগ। অন্য দুটো থাকলেও, সুযোগ না থাকলে অপরাধটা করা যায় না।”
“উফফ, এসব ফালতু বকে সবার সময় নষ্ট করছেন কেন!” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল।
“চুপ করো।” ফ্র্যান্সিস্কাই প্রমথকে একমাত্র কনট্রোল করতে পারে।
“থ্যাংক ইউ ম্যাডাম,” একেনবাবু বলে চললেন, “পারমিতা ম্যাডামের মৃত্যুটা খুবই কনফিউজিং। ঊনত্রিশ বছরের একজন সুস্থ-সবল লেডি আগের রাত্রে স্টেজে উঠে সোলো নাচলেন। পরদিন সকালে যখন প্লেনে উঠলেন, তখনও সুস্থ…” বলে অভীকের দিকে হাত দেখালেন, “এগুলো ওঁর কাছ থেকেই শোনা। কিন্তু প্লেনে কলকাতা যাওয়ার পথে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হাসপাতালে যেতে হল! তারপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জীবন শেষ!
“কী ঘটেছিল প্লেনে? উনি কি কোনো স্পেশাল খাবার অর্ডার করেছিলেন, যেটা বচুলিজম টক্সিনে বিষাক্ত ছিল? প্লেনে কোনো বিষাক্ত পোকা কামড়েছিল? কোনো কিছুর সংস্পর্শে এসেছিলেন প্লেনে যার থেকে প্রাণঘাতী অ্যাার্জি! স্ট্রোক? হার্ট সংক্রান্ত কোনো প্রব্লেম? এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্যেই কলকাতার পুলিশ পোস্ট-মর্টেম করছিল। একটা সন্দেহ আমার প্রথম থেকেই হচ্ছিল স্যার, খুন হয়ে থাকলে সেটা করা হয়েছে বিষ ব্যবহার করে, যেটা দ্রুত কাজ করে এবং সহজে শরীরে ঢোকানো যায়। স্ট্রিকনাইন, ব্যাট্রাকোটক্সিন, ভিএক্স, রাইসিন… বিষের কি অভাব আছে! অটোপ্সির রেজাল্টটা দিন দুই আগে জানতে পেরে বুঝলাম আমার সন্দেহটা ঠিক। মৃত্যুর কারণ, রাইসিন।”
“রাইসিন! সেটা কী?” ফ্র্যান্সিস্কা জিজ্ঞেস করল।
“মারাত্মক বিষ ম্যাডাম, রেড়ির তেলের বীজে পাওয়া যায়।”
“রেড়ির তেল?”
“ক্যাস্টর অয়েল।” এবার উত্তর দিল প্রমথ। “বীজ থেকে ক্যাস্টর অয়েল বের করার পর যে লেই পড়ে থাকে তাতে খুব অল্প পরিমাণ রাইসিন থাকে। সেটাকে পিউরিফাই করে দারুণ বিষাক্ত রাইসিন পাউডার পাওয়া যায়। কেমিস্ট্রির জ্ঞান থাকলে কাজটা খুব একটা শক্ত নয়। আমি নিজে দেখিনি, তবে একসময় নাকি ইউটিউবেই রাইসিন বানানোর পুরো প্রসেসটা ছিল।
“ও মাই গড!”
“রাইসিনের বিষক্রিয়া খুব ইন্টারেস্টিং ম্যাডাম, সেটা নির্ভর করছে কীভাবে শরীরে ওটা ঢুকছে। খাবারের সঙ্গে ঢুকলে একরকম, নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢুকলে আরেকরকম।…”
“আপনি কি রাইসিনের বিশেষজ্ঞ নাকি!” প্রমথ মন্তব্য করল।
“তা নয় স্যার। তবে পুলিশ অ্যাকাডেমির এক সেমিনারে শুনেছিলাম লন্ডনে বুলগেরিয়ার সরকার-বিরোধী নেতা জিয়র্জি মারকভকে খুন করা হয়েছিল ছাতার মধ্যে লুকোনো এয়ার গান দিয়ে গুলি ছুড়ে। ক্ষুদ্র ফাঁপা গুলি, যার মধ্যে ছিল রাইসিনের কয়েকটা মাত্র দানা। কয়েকটা দানাই মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। সেই সেমিনারে ই শুনেছিলাম নাকে রাইসিনের গুঁড়ো বা বাষ্প ঢুকলে, কী হয়! পারমিতা ম্যাডামের উপসর্গের সঙ্গে যার খুবই মিল। তাই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে আমি ফোন করে সতর্ক করেছিলাম অন্যান্য বিষের সঙ্গে রাইসিন-এর ব্যাপারেও। রাইসিন হলে খানিকটা বুঝতেও পারছিলাম কাদের পক্ষে এই খুনটা করা সম্ভব। কিন্তু হাতেনাতে ধরতে পারার মতো প্রমাণ মিলছিল না, আর মোটিভটাও স্পষ্ট ধরতে পারছিলাম না। সন্দেহের বশে তো কাউকে ধরা যায় না।”
“এখন কি তুমি নিঃসন্দেহ?” প্রশ্নটা ফ্র্যান্সিস্কা করল।
“মোটিভের ব্যাপারে এখনও নই ম্যাডাম। কিন্তু তার আগে বলি, কিছুদিন আগেও সম্ভাব্য খুনিদের লিস্ট ছিল দীর্ঘ। যেমন ধরুন, তৃণা ম্যাডাম। পারমিতা ম্যাডামকে খুন করার ওঁর একটা মোটিভ ছিল, কারণ ওঁর মাসতুতো দাদার সুইসাইড করার পেছনে সম্ভবত জড়িত ছিল পারমিতা ম্যাডামের প্রচার বা অপপ্রচার। তৃণা ম্যাডামের মাতো দাদা যে ওঁকে অশ্লীল মেসেজ পাঠাতেন, সেটা পারমিতা ম্যাডাম নিশ্চয় অনেককে জানিয়েছিলেন, যার জন্য অভীকবাবুর কানেও সেটা এসেছিল। তাই না অভীকবাবু?”
“হ্যাঁ, তবে আপনাকে এও বলেছিলাম সবই গুজব। সত্যি কিনা জানি না।”
“ঠিক স্যার। সেই মাসতুতো দাদার পাগলামির কথাও আপনি বলেছিলেন। তাই ভাবছিলাম, মেসেজগুলো কি পাগলামি করে পাঠিয়েছিলেন, না পারমিতা ম্যাডাম কিছুদিন প্রেম করে ওঁকে ডাম্প করেছিলেন বলে রাগের বশে? আবার ভাস্করবাবু বলেছিলেন, পারমিতা ম্যাডাম আর তৃণা ম্যাডামের মধ্যে ঝগড়া লাগে এক পুরুষবন্ধুকে কেন্দ্র করে। সেটা ছোটোখাটো ঝগড়া নয়, ওঁদের মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল! এখন প্রশ্ন, সেই পুরুষবন্ধুই কি ছিলেন তৃণা ম্যাডামের মাসতুতো দাদা? তৃণা ম্যাডামের মাসতুতো দাদার ওঁকে ছেড়ে তৃণা ম্যাডামের সঙ্গে জড়িত হওয়া সহ্য করতে না পেরে অশ্লীল মেসেজ পাবার মিথ্যে কাহিনি ফেঁদে বসেন। অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারটাও রাষ্ট্র করা হয়… এই অবৈধ সম্পর্কের গুজবটাও স্যার আপনার কাছেই শুনেছি… যার নিদারুণ পরিণতি হল লোকলজ্জায় তৃণা ম্যাডামের মাসতুতো দাদার আত্মহত্যা। সুতরাং পারমিতা ম্যাডামকে হত্যা করার একটা মোটিভ তৃণা ম্যাডামের থাকা মোটেই আশ্চর্যের নয়।
“এবার ভাস্করবাবুর কথা বলি। উনি নিজেও ছিলেন আরেক জন সাসপেক্ট। আপনি কি জানেন স্যার, পারমিতা ম্যাডামের হাত ফসকে ওঁর ছোড়দির বাচ্চার ব্রেন ড্যামেজ হয়েছিল? পারমিতা ম্যাডাম সম্পর্কে অনেক কথা বললেও, এটা কিন্তু ভাস্করবাবু বলেননি। নিজের ছোট্ট ভাগ্নের এত বড়ো ক্ষতি— কেয়ারলেসনেস-এর জন্য হলেও ক্ষমা করা যায় না…”
“এটা কিন্তু আমি শুনিনি। একটা অ্যাক্সিডেন্টের কথা আমি শুনেছিলাম। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ভাস্করের কোনো যোগ আছে বলে তো জানতাম না!” অভীক বলল। “ঠিক, এটাও সম্ভবত ভুল অনুমান স্যার। এটা ধরে এগোনো মানে নড়বড়ে ব্রিজ ধরে এগোনো। এবার বলি, তৃতীয় সাসপেক্ট-এর কথা। তাঁর নাম আমরা জানি না। শুধু জানি, তিনি এমন একটি ভয়াবহ মেসেজ পাঠিয়েছিলেন যেটা জেনে পারমিতা ম্যাডামের মা ওঁকে এদেশে আসতে দিতে চাননি। মোবাইল ফোনের মেসেজ পরীক্ষা করে অবশ্য সেটা কে করেছিলেন বার করা যাবে।”
“সেটা কি করা হচ্ছে?” ফ্রান্সিস্কা জিজ্ঞেস করল।
“জানি না ম্যাডাম। তবে এই মুহূর্তে ব্যাপারটা অ্যাকাডেমিক।”
“তার মানে?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“কারণ আমার ধারণা স্যার, আমি বুঝতে পেরেছি এই খুনটা কে করেছেন।”
একেনবাবু মাঝে মাঝে এমন রহস্য করেন যে আমারই বিরক্তি লাগে।
“সেটা কী করে বুঝলেন আপনি! আমি তো এখনও বুঝতে পারছি না।”
“আপনি তো স্যার সব ডেটা এখনও পাননি।”
“তাহলে সেটা দিন!”
“দেব স্যার?” অভীকের দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন। একেনবাবুর আচরণে অভীকও অবাক।
“একটা হিন্ট দিচ্ছি স্যার। রাইসিন শরীরে ঢুকেছিল ফুসফুস দিয়ে, মানে নিঃশ্বাসের সঙ্গে।”
“সেটা কী করে সম্ভব, যদি না হেয়ার স্প্রে জাতীয় কিছুতে রাইসিন ঢোকানো থাকে বা রাইসিন মেশানো পাউডার মুখে না মাখে।” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল।
“কাছাকাছি এসে গেছেন স্যার, ফেসপেইন্টেও তো রাইসিন পাউডার মেশানো থাকতে পারে। তার অল্প একটু নিঃশ্বাসের সঙ্গে যদি ফুসফুসে যায়, তাহলে শ্বাসকষ্ট, গা গোলানো, বুকে জল জমা ইত্যাদি শুরু হবে। পরে কোমায় চলে গিয়ে মৃত্যু। পুরো ব্যাপারটা ঘটতে অবশ্য সময় লাগবে… চব্বিশ থেকে ছত্রিশ ঘণ্টার মতো। খানিকটা প্লাস-মাইনাস অবশ্য হতে পারে।”
“রাইসিন আছে কি নেই, সেটা তো ফেসপেইন্টের বাটিগুলো পরীক্ষা করলেই পাওয়া যাবে!” প্রমথ বলল।
“জানি স্যার, কিন্তু বাটিগুলোই যে পাওয়া যাচ্ছে না! পুলিশ অনেক খুঁজেছে।”
“তাহলে তো এটাও থিয়োরিই হয়ে রইল!” অভীক বলল।
“তা রইল স্যার, তবে নাচের পোশাক, অলংকার, মুখের রং, রং লাগাবার তুলি, সবগুলোই গেস্ট হাউসে ছিল। আপনার দায়িত্ব ছিল সেগুলো লিঙ্কন সেন্টার-এ নিয়ে আসার আর ফেরত নিয়ে যাবার, তাই না স্যার?”
“হ্যাঁ, কিন্তু পেইন্টগুলো ফেরত নেবার কথা ছিল না। ওগুলো এদেশে কেনা সস্তা ফেসপেইন্ট আর তুলি, রিঙ্কি ওগুলো ফেলে দিতেই বলেছিল।” এবার বিরক্ত হয়ে বলল অভীক।
“ঠিকই বলেছিলেন স্যার, দেশে নিশ্চয় অনেক ভালো ফেসপেইন্ট উনি ব্যবহার করেন। তবে দেশে যেটা ওঁর কাজে লাগত, সেই মাস্কগুলোই ফেলে চলে গেলেন! যাই বলুন স্যার, মাস্কগুলো কিন্তু আপনি ভালো কিনেছিলেন।”
“আপনার এই কথাটা বলার মানে!” এবার বেশ রেগে গেল অভীক।
“মানে ওগুলোতে অ্যাক্টিভেটেড চারকোল ফিল্টার ছিল দেখে বলছি। আমি কী ভাবছিলাম জানেন স্যার, ফেসপেইন্টের কৌটো বা বাটিতে রাইসিন পাউডার মেশানো খুবই রিস্কি। ওপর থেকে পাউডার ঢালা যাবে না, বাতাসে উড়ে নাকে ঢুকবে। তার মানে যিনি এই কাজটি করেছেন, তাঁকে খুব সতর্ক হতে হবে। সস্তা পেপার মাস্ক পরে রাইসিন পাউডার হ্যান্ডেল করা মূর্খামি। অন্ততপক্ষে অ্যাক্টিভেটেড চারকোল ফিল্টার লাগানো মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। আর তখনই মনে হল স্যার, কলকাতায় পলিউশনের জন্য ওগুলো ব্যবহার করার অর্থ মশা মারতে কামান দাগা। ওগুলো স্যার আপনি কেন কিনেছিলেন, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন?”
পরিষ্কার দেখলাম অভীকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “আমি অত গবেষণা করে মাস্ক কিনিনি একেনবাবু। দোকানে যেটা চোখে পড়েছে, সেটাই কিনেছি… আর ওগুলোর দাম এমন কিছু বেশি না যে রিঙ্কি অ্যাফোর্ড করতে পারবে না।”
“এটা ঠিক বলেছেন স্যার। যে পরিমাণ টাকা খরচা করে আপনি কন্সট্রাকশন বিজনেস ওঁদের হয়ে কিনেছেন, তা দিয়ে বোধহয় এরকম কোটি কোটি মাস্ক কেনা যায়।”
এবার সোফা থেকে উঠে পড়ল অভীক, “আপনি এবার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন, আমি চললাম।”
একেনবাবুও উঠে দাঁড়ালেন, “ঠিক আছে স্যার, যান। শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। আপনি পাঁচটা মাস্ক কিনেছিলেন- প্লাস্টিকের প্যাকেটে লেখা ছিল ‘প্যাক অফ ফাইভ’, কিন্তু গুনে দেখলাম মাত্র চারটে রয়েছে। আরেকটা গেল কোথায়?”
এমন সময়ে একেনবাবুর মোবাইলটা বেজে উঠল। “এসে গেছেন স্যার? আমি এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
একেনবাবু নিজেই বাইরের দরজা খুলতে খুলতে অভীককে বললেন, “উত্তর দিতে হবে না স্যার। যা দিতে চান ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে দেবেন, উনি ওঁর দলবল নিয়ে দরজার বাইরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। ওঁকে একটু বুঝিয়ে বলবেন, রাইসিন পাউডারের যে প্যাকেটটা কিছুদিন আগে আপনি কিনেছিলেন, সেটা কোথায় রেখেছেন। ওগুলো তো হ্যাজার্ডাস জিনিস স্যার, পুলিশ জানতে চাইবে।”
দরজা খুলতেই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের এক চ্যালা অভীককে হ্যান্ড-কাফ পরাতে পরাতে মিরান্ডা ওয়ার্নিং দিল, “ইউ হ্যাভ দ্য রাইট টু রিমেইন সাইলেন্ট। এনিথিং ইউ সে ক্যান অ্যান্ড উইল বি ইউজড…” ইত্যাদি ইত্যাদি।
“থ্যাংক ইউ একেন্ড্রা, সি ইউ লেটার,” বলে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট অভীককে নিয়ে বিদায় নিলেন।
নয়
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম! ফ্র্যান্সিস্কার তো বিস্ফারিত চোখ।
“আপনি কবে সন্দেহ করা শুরু করেছিলেন অভীককে,” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“খটকাটা স্যার শুরু হয়েছিল যখন গেস্ট হাউসে গিয়ে দুটো জিনিস দেখি।”
“কোন দুটো?”
“এক নম্বর হল বাথরুমের জানলা খোলা আর এগজস্ট ফ্যান চলছে। অর্থাৎ বাথরুমের ভেতরের বাতাস বার করে বাইরের বাতাস ভেতরে আনা হচ্ছে। শুধু কি দুর্গন্ধ দূর করার জন্যে, না বাথরুমের বাতাস কোনো কারণে বিষাক্ত ছিল?
“দু-নম্বর ক্লজেটে অ্যাক্টিভেটেড চারকোল ফিল্টার লাগানো মাস্ক। দেখামাত্র বুঝেছিলাম ওগুলো কলকাতার পলিউশনের জন্য নয়। ওই ধরনের মাস্ক খানিকক্ষণের জন্য হলেও বিষাক্ত গ্যাস থেকে প্রোটেকশন দিতে পারে। তার ওপর একটা মাস্ক মিসিং! তার মানে ওটা ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু কীসের জন্য? চিন্তাভাবনা শুরু হল আর তখনই ফেসপেইন্ট, রাইসিন এগুলো মাথায় এল। ফেসপেইন্টে রাইসিন থাকলে পারমিতা ম্যাডাম যখন গ্রিনরুমে বা স্টেজে ফেসপেইন্ট লাগাবেন এবং পরে নাচা শুরু করবেন, তখন রঙে মেশানো রাইসিনের কিছু অংশ শ্বাস নেবার সময়ে ফুসফুসে ঢুকবে। তারও বেশি ঢুকবে যখন পারমিতা ম্যাডাম রং তোলার জন্য বাথরুমে গিয়ে গরম জলে মুখ ধোবেন, কারণ রাইসিনের ভাপ তখন নাকে যাবে। এটাই নিশ্চয় অভীকবাবু অনুমান করেছিলেন। আর সেই জন্যেই ম্যাডাম পারমিতা চলে যাবার পর বাথরুমের বাতাস বিষমুক্ত করার জন্য এগজস্ট ফ্যান চালিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা জানি না। তবে মিসিং মাস্কটা যে উনি রাইসিন পাউডার মেশানোর জন্যে ব্যবহার করেছিলেন, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।”
“কী করে আপনি জানলেন অভীকই রাইসিন পাউডার ব্যবহার করেছিল?” প্রমথ প্রশ্ন করল।
“কী মুশকিল, সেটা তো আপনার দৌলতে স্যার!”
“আমার দৌলতে!”
“হ্যাঁ, মনে আছে স্যার, অভীকবাবু যেদিন আমাকে চেক দিচ্ছিলেন আপনি আমাদের দু-জনের ছবি তুলে হোয়াটস অ্যাপ-এ আমাকে পাঠালেন?”
“মনে থাকবে না কেন!”
“আজ সকালে খাবার আগে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট যখন জানালেন হার্লেমে এক ড্রাগ-অ্যাডিক্ট ধরা পড়েছে রাইসিন বানানোর জন্যে এবং স্বীকার করেছে একজনকে ইতিমধ্যেই খানিকটা বিক্রি করেছে, আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘরে গিয়ে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে হোয়াটস অ্যাপ-এ ওই ছবিটা ফরোয়ার্ড করে দিয়ে অভীকবাবুকে আসতে বললাম। আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম অভীকবাবুই ওটা কিনেছিলেন। ওঁদের কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে হার্লেমে। কনস্ট্রাকশন বিজনেসে নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড কানেকশন কারও কারও থাকে। সেক্ষেত্রে এই ধরনের জিনিস জোগাড় করার ব্যাপারে অল্প-বিস্তর সাহায্য উনি পেতেই পারেন। যাই হোক, ধৃত লোকটি যে অভীকবাবুকে আইডেন্টিফাই করেছে সেই মেসেজটা পেলাম যখন আমরা খাচ্ছি।”
“আপনি আবার হোয়াটস অ্যাপ-এ এত পোক্ত হলেন কবে?”
“কী যে বলেন স্যার, সবই তো আপনাদের শিক্ষা।”
“একটা জিনিস কিন্তু আমার কাছে ক্লিয়ার নয়। মিন্স আর অপরচুনিটি ছিল বুঝতে পারছি, মোটিভটা কী ছিল?” প্রশ্নটা এবার আমিই করলাম।
“এখন যা বলছি, সেটা আমার অনুমান। কনস্ট্রাকশন বিজনেসে ঢোকা নিয়ে পারমিতা ম্যাডামের শুধু আপত্তি ছিল তাই নয়, উনি বোধহয় সন্দেহ করেছিলেন এর মধ্যে অভীকবাবুর কিছু ব্যক্তিগত লেনদেন ও স্বার্থ জড়িত। দু-দশ ডলারের ব্যাপার নয়, আমি বলছি মিলিয়নস অফ ডলারের কথা। নইলে একজন সফটওয়্যারের ম্যানেজার হঠাৎ করে মালিককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিশাল কনস্ট্রাকশন বিজনেসে পার্টনারশিপ নেওয়াবেন কেন? অভীকবাবুও নিশ্চয় আঁচ করেছিলেন পারমিতা ম্যাডামের সন্দেহের ব্যাপারটা। হাতেনাতে ধরা পড়ার আগে যত তাড়াতাড়ি ওঁকে সরিয়ে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। এগুলো সব ক্লিয়ার হবে পুলিশ যখন কোম্পানির কাগজপত্র পরীক্ষা করা শুরু করবে, ডলার নিয়ে নয়-ছয় করা চোখে পড়বে। আসলে মার্ডারের সবচেয়ে বড়ো মোটিভ হচ্ছে মানি আর…।” পরের কথাটা ফ্র্যান্সিস্কা থাকায় আর বলতে পারলেন না একেনবাবু। লজ্জা-লজ্জা মুখে বসে রইলেন।
প্রমথ কি ছাড়বে! “আঃ, বলেই ফেলুন না সেক্স।”
“কী যে বলেন স্যার, এখানে তো শুধু মানি।”
ফ্র্যান্সিস্কা এতক্ষণ একেনবাবুর ব্যাখ্যান চুপ করে শুনছিল, শেষ হতে না হতেই একেনবাবুর গালে চকাস করে চুমু দিয়ে বলল, “ডিটেকটিভ, তুমি সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট।”
