প্রাইসলেস বুদ্ধ (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত

শেয়ার করুনঃ

এক

একেনবাবুর গলাব্যথা আর কাশি হয়েছে। ফলে আমাদের কান ঝালাপালা!

 

“কী মনে হয় স্যার, টনসিলাইটিস না ফ্লু? ব্রঙ্কাইটিস হল না তো, আমার আবার খুব সর্দি বসার ধাত! রাতে বুকটা বেশ ঘড়ঘড় করেছে— তাই ভাবছি। ব্রঙ্কাইটিস অবশ্য আগে হয়েছে, নিউমোনিয়া না হলেই বাঁচি!”

 

কাশির ফাঁকে ফাঁকে সারা সকাল ধরে এই চলছে।

 

ঘ্যানঘ্যান আর সহ্য না করতে পেরে প্রমথ বলল, “এত যখন আপনার দুশ্চিন্তা তখন ডাক্তারের কাছে যান না! নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরবেন।”

 

“তা মন্দ বলেননি স্যার।” গলায় মাফলারটা একটু খুলে আবার ভালো করে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে মাথা নাড়লেন একেনবাবু। “তবে কিনা ওষুধটা আমি জানি। কলকাতা হলে অ্যাজিথ্রল-এর একটা কোর্স নিয়ে নিতাম। তিন দিনও লাগত না, একেবারে ফিট। আচ্ছা স্যার, এখানে অ্যাজিথ্রল পাওয়া যায় না?”

 

“যাবে না কেন! অ্যাজিথ্রল মনে হয় অ্যাজিথ্রোমাইসিন, ওটাকে এখানে জি-প্যাক বলে। তবে প্রেসক্রিপশন লাগবে। এদেশে এসব ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি। কিন্তু খামোখা অ্যাজিথ্রোমাইসিন খাবেন কেন? জ্বর-ফর কিছু হয়নি!”

 

“হবে স্যার, হবে। এগুলো হল জ্বরের পূর্বলক্ষণ।”

 

একেনবাবু খুব কনফিডেন্টলি কথাটা বলে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর উইক- ইন-রিভিউ সেকশনটা তুলে পড়তে শুরু করলেন। খানিক বাদেই, “অসুখ হলে কলকাতা হচ্ছে আইডিয়াল প্লেস।” পত্রিকায় মুখটা ঢাকা, ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে একেনবাবু মন্তব্য করলেন।

 

“কী যা-তা বকছেন, পৃথিবীর লোক নিউ ইয়র্কে আসে চিকিৎসার জন্য!” আমি বললাম।

 

“না স্যার, বড়ো অসুখের কথা বলছি না। এই আমার টাইপের অসুখের কথা বলছিলাম।”

 

“তার জন্যেই-বা কলকাতা ভালো হতে যাবে কেন?”

 

“কলকাতায় এইসব প্রেসক্রিপশন-ট্রেসকিপশনের ঝামেলা নেই। টাকা ফেলুন, যে ওষুধ চান তাই পাবেন।”

 

সেটা ভালো কি মন্দ অবশ্যই তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু একেনবাবুর সঙ্গে এই সাতসকালে তার ফয়সালা করতে আমি রাজি নই। চুপচাপ পত্রিকা পড়ে চললাম। প্রমথ কফি করতে ব্যস্ত। তাই প্রসঙ্গটা আর গড়াল না।

 

খানিক বাদে কফি খেতে খেতে একেনবাবু হঠাৎ বললেন, “না স্যার, এক বার ঘুরেই আসি।”

 

প্রমথ অবাক হয়ে তাকাল। “কোত্থেকে ঘুরে আসবেন?”

 

“ওই যে স্যার, আপনারা বললেন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত! আপনাদের চেনাজানা কেউ আছে কম ভিজিট নেন?”

 

“এখানে সবারই প্রায় এক রেট,” আমি বললাম। “ডাক্তার খান্নার কাছে যেতে পারেন। দরকার পড়লে ওঁর কাছেই আমি যাই।”

 

“কত ভিজিট স্যার?”

 

“পঁয়ষট্টি ডলার নিতেন। এখন হয়তো একটু বেড়েছে।”

 

“পঁয়ষট্টি ডলার! দেবেন তো সেই অ্যাজিথ্রোমাইসিন!”

 

“নাও দিতে পারেন।” প্রমথ খুব গম্ভীরভাবে বলল। “হয়তো ডক্সিসাইক্লিন খেতে বলবেন, কিংবা লেভোফ্লোক্সাসিন। ছোটোখাটো ব্যাপার মনে করলে হয়তো গুড ওল্ড পেনিসিলিন ঠুকে দেবেন। যে-ওষুধই দিন, সেটা কিনতে আপনার লাগবে আরও ষাট কি সত্তর ডলার। সুতরাং, ডাক্তার আর ওষুধ মিলে কম সে কম একশো তিরিশই ধরে নিন। তাও তো আমি কম করে বলছি, তাই না বাপি? ডাক্তার খান্না আবার সুযোগ পেলেই একটা ইনজেকশন ঝেড়ে আরও পঁচিশ ডলার এক্সট্রা বাগান। যাক গে, ধরা যাক একশো তিরিশ ডলারই। ডলারের রেট এখন কত— পঁয়তাল্লিশ? তার মানে…” প্রমথ মনে মনে একটু হিসেব করে বলল, “প্রায় পাঁচ হাজার নশো টাকা— ছ’ হাজারই ধরুন।”

 

কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে প্রমথর জুরি নেই।

 

“ছ’ হাজার!” একেনবাবুর গলাটা প্রায় আর্তনাদের মতো শোনাল। “তার থেকে আমার নিউমোনিয়াই ভালো স্যার!” কথাটা বলেই আবার খক খক শুরু করলেন।

 

“আপনার ইন্সিয়োরেন্স নিশ্চয় কিছুটা কভার করবে,” আমি ওঁকে একটু প্রবোধ দেবার জন্য বললাম।

 

“না স্যার, আমার ইন্সিয়োরেন্সটা কঠিন অসুখের পক্ষে ভালো। কিন্তু এই সবে বোধহয় টাকা দেবে না।”

 

“তাহলে তো চিন্তাই নেই। ভালো করে অসুখটা বাধান, যাতে হাসপাতালে যেতে হয়। ব্যস, ইন্সিয়োরেন্সের পয়সায় হাসপাতাল ঘুরে আসবেন। রান্না-ফান্না কাজকম্ম কিচ্ছু করতে হবে না, শুয়ে-বসে দিব্যি ক’টা দিন কাটিয়ে দেবেন।”

 

প্রমথটা সত্যি মাঝে মাঝে বড্ড অসভ্যতা করে! আমি ওকে ধমকাতে যাচ্ছি, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল।

 

“হ্যালো।”

 

“কে, প্রমথ?” গলাটা কাঁপা কাঁপা।

 

“না, আমি বাপি।”

 

“বাপি, আমি সমর। তোরা খবর পেয়েছিস কিনা জানি না, বিভাস চৌধুরী মারা গেছেন।”

 

“হোয়াট, কী বলছিস!”

 

“কাল রাতে ওঁর অ্যাপার্টমেন্টে হঠাৎ আগুন লাগে। উনি আর বেরোবার সুযোগ পাননি। পুরো বিল্ডিংটাই ছাই হয়ে গেছে।

 

“মাই গড!”

 

“আমি এক্ষুনি হাসপাতালে যাচ্ছি, পারলে তুইও আয়। প্রমথকে খবরটা দিয়ে দিস।”

 

“দেব, কিন্তু…”

 

সমর ইতিমধ্যে লাইনটা কেটে দিয়েছে।

 

প্রমথ আর একেনবাবু দু-জনেই উদ্‌গ্রীব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার মুখ দেখে নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে খবরটা শুভ নয়। আশ্চর্যের কথা এই কালকেই বিভাস চৌধুরীকে নিয়ে কত আলোচনা হল। একেনবাবু ভদ্রলোককে চিনতেন না। বললেন, ‘ওঁর সঙ্গে এক বার আলাপ করিয়ে দিন স্যার, মনে হচ্ছে উনি একজন জিনিয়াস।” তখন কি এক বারও ভেবেছি আজ উনি আর থাকবেন না!

 

প্রমথ জিজ্ঞেস করল। “কার ফোন?”

 

“সমরের। বিভাস চৌধুরী মারা গেছেন!”

 

.

 

নিউ ইয়র্কে অনেক বাড়িই কাঠের। ম্যানহাটানের হাই-রাইজগুলোর কাঠামো বা স্ট্রাকচার স্টিলের হলেও দেয়াল, মেঝে, ইত্যাদিতে প্রচুর কাঠ থাকে। চট করে সেগুলোতে আগুন লেগে যেতে পারে। বাড়ি পুড়ে যাবার খবর পত্রিকায় অনেক পড়েছি, টিভিতেও দেখেছি। কিন্তু চেনা-পরিচিতদের বাড়িতে যে এরকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ভাবিনি, যদিও না ভাবার কোনো কারণ নেই। মুশকিল হল এসব বাড়িতে আগুন এক বার লাগলে হু-হু করে ছড়িয়ে যায়, তাড়াহুড়ো না করলে পালাবার সুযোগ পাওয়া যায় না। বিভাস চৌধুরী তো আবার থাকতেন দোতলায়। ওঁর বাড়িটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। বহু পুরোনো ছ’তলা একটা বাড়ি। বাড়িটার ফ্রেম কাঠের কিনা জানি না। তবে বাইরেরটা না হলেও ভেতরের ফ্রেমগুলো নিশ্চয় কাঠেরই হবে, ফ্লোরগুলো তো ছিল সব কাঠের। অত বড়ো বাড়িতে থাকবার অ্যাপার্টমেন্ট বলতে প্রত্যেক ফ্লোরে ছিল মাত্র একটা করে, বাদবাকি সবই হচ্ছে অফিস। একমাত্র বিভাস চৌধুরীর ছাড়া অন্যান্য অ্যাপার্টমেন্টগুলো এখন ফাঁকা পড়ে আছে। অর্থাৎ পুরো বিল্ডিং-এ রাত্রে মাত্র এক জন বাসিন্দা! ফায়ার অ্যালার্ম নিশ্চয় কাজ করেনি। নিউ ইয়র্কের প্রতিটা বাড়িতেই ফায়ার অ্যালার্ম থাকে। তবে থাকা আর সময়মতো কাজ করা দুটো স্বতন্ত্র প্রশ্ন। আমাদের বাড়ির অ্যালার্মই তো কাজ করছে না, অনেকদিন হয়ে গেল। ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবার আগে কয়েক দিন অ্যালার্মটা করুণ আর্তনাদ করেছে, কিন্তু উদ্যোগ নিয়ে নতুন ব্যাটারি এখনও লাগানো হয়নি। অবশ্য ফায়ার অ্যালার্ম বাজলেও-বা কী? এক তলায় আগুন লাগলেও আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের অ্যালার্ম বাজতে বাজতে পালাবার পথ থাকবে কিনা সন্দেহ। নতুন বিল্ডিংগুলোতে কমন অ্যালার্ম সিস্টেম আছে শুনেছি। আমাদের বাড়িটা বহু পুরোনো। ফায়ার এস্কেপের জন্য বাইরের যে সিঁড়িটা আছে সেটাও ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিতে হবে। সত্যি, কী আত্মসর্বস্ব হয়ে গেছি! বিভাস চৌধুরী মারা গেছেন, আর আমার চিন্তা শুধু নিজেকে নিয়ে!

 

প্রমথ এদিকে সমরকে ধরার চেষ্টা করছে ঘটনাটা বিস্তারিত জানার জন্য। কোন হাসপাতালে বডিটা আছে জানতে পারলে আমরা চলে যেতে পারতাম। যদিও সেখানে গিয়ে কী করব ধারণাই নেই! বিভাস চৌধুরীর আত্মীয়স্বজনদের খবর দেওয়া দরকার, কিন্তু তাঁরা কে বা কোথায় থাকেন জানি না। নিকট আত্মীয়দের খবর না দেওয়া পর্যন্ত পুলিশ দেহটা দাহ করার অনুমতি দেবে না। তবু যাওয়াটা দরকার ওঁর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য।

 

একেনবাবু চোখ বুজে বসে আছেন, কী ভাবছেন জানি না। আমার মাথায় খালি বিভাস চৌধুরী ঘুরছে। আমাদের থেকে বেশ কয়েক বছরের সিনিয়র ছিলেন। কম্পিউটার সায়েন্সের লোক। সায়েন্স বিল্ডিং-এর তিন তলায় উনি বসতেন। আমার ঘর থেকে মাত্র কয়েকটা ঘর পরে ছিল ওঁর অফিস। কথা কিন্তু কদাচিৎ হয়েছে। আমার ধারণা রিসার্চের ক্ষতি হবে বলে তিনি কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাইতেন না। যখনই ওঁর ঘরের সামনে দিয়ে গেছি, দেখেছি তন্ময় হয়ে কম্পিউটারে কাজ করছেন। আর ঘরটা দেখলে অফিসঘর বলে মনে হত না, মনে হত কম্পিউটারের কোনো দোকান। ভিডিয়ো মনিটরই গোটা চারেক, তা ছাড়া দামি স্ক্যানার, লেজারের কালার প্রিন্টার… আরও হাবিজাবি অনেক কিছু। সমরের মতে অফিসে যা আছে, তার তিন গুণ গ্যাজেট ওঁর বাড়িতে। সমর বিভাস চৌধুরীকে ভালোই চিনত, ও নিজে কম্পিউটার সায়েন্সের ছেলে তো। ওর কাছেই শুনেছিলাম, কম্পিউটার ফিল্ডে বিভাস চৌধুরীর নাকি দারুণ নাম। ভদ্রলোকের গবেষণার বিষয় ছিল প্যাটার্ন রেকগনিশন। কথাটা শুনতে গালভারী, কিন্তু এই কাজটা নিজের অজান্তেই আমরা করি। একটা ছবি দেখে কত সময় বলি, “আরে, এটা তো আগেই দেখেছি!’ অর্থাৎ আগে যা দেখেছি, সেটা আমাদের মনে গেঁথে আছে। পরে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেটা মনে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী করে সেগুলো আমরা মনে রাখছি বা বাস্তবের ছবিটা তার সঙ্গে মেলাচ্ছি, সেটা আবছা-আবছা ভাবে বলতে পারলেও খুব স্পষ্ট করে বলতে মনে হয় পারব না। প্যাটার্ন রেকগনিশনের গবেষকদের কাজ হল সেটাই কম্পিউটারকে পরিষ্কার করে শিখিয়ে দেওয়া। সেক্ষেত্রে কম্পিউটার নির্ভুলভাবে এত দ্রুত কাজটা করবে, আমরা কল্পনাও করতে পারব না! এই নিয়েই একেনবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। একেনবাবু ক’দিন আগে ওয়াশিংটন ডিসি-তে এফবিআই-র অফিসে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে আমাকে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলছিলেন কী করে ওখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলানো হয়। কাগজে লাগানো আঙুলের ছাপ কম্পিউটার স্ক্যানারে ঢুকিয়ে কয়েকটা বোতাম টেপার পরেই স্ক্যানারের সঙ্গে লাগানো মনিটরে উঠবে ওটা এফবিআই ডেটাবেসের কোনো ছাপের সঙ্গে মিলছে কিনা। একেনবাবু নিজে পরীক্ষা করার জন্য কাগজে -নিজের আঙুলের ছাপ লাগিয়ে স্ক্যানারে ঢুকিয়েছিলেন। সবিস্ময়ে দেখলেন মনিটরে উঠেছে একেন্দ্র সেন, ডেট অফ বার্থ (তারিখটা আর দিলাম না), সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া, লাস্ট ডেট অফ এন্ট্রি টু ইউএসএ… ইত্যাদি ইত্যাদি। একেনবাবু ভুলেই গিয়েছিলেন, প্রথম বার যখন ট্রেনিং নিতে এদেশে আসেন, ওঁকে আঙুলের ছাপ দিয়ে ঢুকতে হয়েছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বলুন তো স্যার, এফবিআই ডেটাবেসে কতগুলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে?”

 

‘আমার কোনো ধারণাই নেই। দশ লক্ষ?” একটু বাড়িয়েই সংখ্যাটা বলেছিলাম।

 

‘আড়াই কোটিরও বেশি।”

 

‘কী বলছেন যা-তা! সারা আমেরিকাতেই তো ছাব্বিশ কোটি লোক। তাদের মধ্যে দশ পার্সেন্ট ক্রিমিন্যাল?”

 

‘না না, তা হবে কেন স্যার! আমার ছাপ আছে, আমি শিওর, আপনার ছাপও আছে। ইমিগ্রেন্ট হয়ে যারা এদেশে ঢুকেছি, সবার ছাপ আছে।”

 

তখন মনে পড়ল ইমিগ্রেশনের জন্য অ্যাপ্লাই করার সময় একবার আঙুলের ছাপ দিতে হয়েছিল বটে।

 

‘কল্পনা করুন স্যার, কেমন ধাঁ করে আমার ছাপটা বার করে ফেলল! আমাদের দেশে এক্সপার্টরা তো মাসের পর মাস লাগিয়ে দেবে। অনেক সময়ে তফাতগুলো এত সূক্ষ্ম, আপনি-আমি চেষ্টা করলেও ধরতে পারব না। না স্যার, এই কান্ট্রি অ্যামেজিং, ট্রুলি অ্যামেজিং!’

 

তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলেছিলেন, ‘আসলে স্যার বড়ো বড়ো কম্পিউটার থাকলে কী না করা যায়!”

 

তখনই আমি বিভাস চৌধুরীর কথা বলেছিলাম। কথাটা অবশ্য সমরের কাছ থেকে শোনা। উনি প্যাটার্ন মেলানোর একটা যুগান্তকারী অ্যালগরিদম, মানে পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। ছোটোখাটো কম্পিউটার এমনকী পার্সোনাল কম্পিউটারেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যাবে। একেনবাবু সেটা শুনে দারুণ উৎসাহিত হয়েছিলেন। …যাক সে-কথা, বিভাস চৌধুরী তো আর নেই— ওসব ভেবে কী হবে!

 

“ইউনিভার্সিটি হসপিটালে বডি নিয়ে গেছে”, প্রমথর কথায় সংবিৎ ফিরল। সমর নয়, আর কারও কাছ থেকে এক্ষুনি খবরটা পেয়েছে। আমরা দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম।

 

.

 

হসপিটাল আমার বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের পথ। গিয়ে দেখি কলেজের অনেকেই খবর পেয়ে এসেছেন। সবাই শক্ড। থমথমে আবহাওয়া, তবে কোনো কান্নাকাটি নেই। বডিটা দেখতে পেলাম না, কাপড় দিয়ে ঢাকা। ওটার নাকি পোস্টমর্টেম হবে। আগুনে পুড়ে কারও মৃত্যু হলে সেটাই দস্তুর কিনা জানি না। পুলিশ কি কিছু সন্দেহ করছে? কানাঘুষো শুনলাম এটা নাকি অ্যাক্সিডেন্ট নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে আসন, কেউ আগুন লাগিয়েছে! কোত্থেকে খবরটা এসেছে বার করতে পারলাম না।

 

আমাদের ডিন বডিটা দেখেছেন, একেবারেই পুড়ে গেছে, কিছুই বোঝার জো নেই। বডিটা বিভাস চৌধুরীর কিনা- সে ব্যাপারেই-বা কীভাবে নিশ্চিত হবে পুলিশ? প্রমথকে সেটা বলতেই ধমক লাগাল, “আইডেন্টিফিকেশনের এখন অনেক জেনেটিক মেথড আছে।”

 

দুই

সোমবার সকালে ঘুম ভেঙে গেল খুব ভোরে। আমার কাছে খুব ভোর মানে অবশ্য পাঁচটা। বরাবরই আমি একটু ঘুমকাতুরে, আটটা-ন’টার আগে সাধারণত উঠি না। সেই জন্যই চেষ্টা করি দুপুরের ক্লাসগুলো নিতে, যাতে শুধু আটটা-ন’টা কেন, ইচ্ছে করলে আরও কয়েক ঘণ্টা আরাম করে বিছানায় গড়াতে পারি।

 

ঘড়িতে পাঁচটা দেখে আমি আবার চোখ বোজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না। এত ভোর, কিন্তু জুন মাস বলে বাইরে যথেষ্ট আলো। ইতিমধ্যেই বেশ কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছে! হাত-মুখ ধুয়ে কফি বানাতে গিয়ে দেখি বাড়িতে দুধ নেই। সকালে এক কাপ কফি না হলে আবার ভীষণ মাথা ধরে যায়। প্রমথর মতে এটা সাইকোলজিক্যাল। ওর সঙ্গে তর্ক করার অর্থ হয় না, একই কথা সাত বার রিপিট করবে। কারণ যাই হোক, মাথা ধরাটা তো মিথ্যে নয়! নাঃ, কফি আমাকে খেতেই হবে। নীচে প্রমথর কাছে নিশ্চয় দুধ পাওয়া যাবে। প্রমথ আর একেনবাবু থাকেন আমার ঠিক নীচের অ্যাপার্টমেন্টে। ওদের অ্যাপার্টমেন্টের ডুপ্লিকেট চাবিটা আমার কাছে থাকে। আমার অ্যাপার্টমেন্টের চাবিও ওদের দিয়েছি। বলতে গেলে দুটো অ্যাপার্টমেন্টকেই আমরা একটা বাড়ি হিসেবে ব্যবহার করি, রান্না-খাওয়া সবসময় একসঙ্গেই হয়।

 

কিন্তু চাবি খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, কাল রাতে ওদের ওখানেই আমার চাবিগুলো সব ফেলে এসেছি। এত আচ্ছা ফ্যাসাদ হল! ওরা যদিও সাধারণত আমার থেকে আগে ওঠে, কিন্তু এত সকালে নিশ্চয় ওঠেনি। বেল বাজিয়ে ঘুম ভাঙানো যেতে পারে অবশ্য। একেনবাবু তাতে মাইন্ড করবেন না। কিন্তু প্রমথ গাল দিয়ে আমার ভূত ভাগিয়ে ছেড়ে দেবে। বিশেষ করে যখন শুনবে যে আমার সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম কফির জন্য ওর ঘুম ভাঙিয়েছি।

 

কী আর করা। দুধ ছাড়াই এক কাপ কফি খেলাম। কিন্তু ঠিক জুত হল না। মোড়ের মাথায় টমির পিৎজার ঠিক পাশে একটা গ্রোসারি স্টোর আছে চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। সেখান থেকে পারতপক্ষে কিছু কিনি না, সব কিছুর গলাকাটা দর। নিরুপায় হয়ে আজ সেখানেই গেলাম। দরজাটা খোলা রেখে যেতে হল, চাবি নেই। তবে এই ভোরে কে আর চুরি করতে আসবে! চোরেরা নিশ্চয় নাইট ডিউটি দিয়ে এখন শুয়ে পড়েছে।

 

মাত্র সাড়ে পাঁচটা। কিন্তু তাও দেখলাম দোকানে বেশ কয়েক জন খরিদ্দার। নিউ ইয়র্কের লোকরা কি ঘুমোয় না? দুধ কিনলাম। একটা ট্রে-তে কতগুলো চকোলেট ক্রোসাঁ সাজানো ছিল। চকোলেট ক্রোসাঁ হচ্ছে মুচমুচে রুটি আর ভেতরে চকোলেটের পুর। চকোলেট আমার দারুণ প্রিয়। লোভে পড়ে তারও দুটি কিনলাম। দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসছি, দেখি একজন ভারতীয় ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে ঢুকছেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখাচোখি হল। চেনা চেনা মুখ, কিন্তু মনে করতে পারলাম না কে। আমার দিকে তাকিয়ে ‘হায়’ বললেন। আমিও বললাম ‘হায়।” এদেশে অবশ্য চেনা-অচেনা সবাইকে ‘হায়’ বলা যায়। উনি যে আমাকে চেনেন- সেটা নাও হতে পারে। তবু চেনা চেনা লাগা সত্ত্বেও কাউকে না চিনতে পারলে আমার ভারি অস্বস্তি হয়। সারাটা পথ ভাবতে ভাবতে এলাম। বাড়িতে যখন ঢুকছি তখন নামটা মনে পড়ল। আরে, উনি তো মিস্টার মেহেতা! ভদ্রলোক একজন ট্র্যাভেল এজেন্ট, আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক ব্লক দূরেই ওঁর এজেন্সি। গত ডিসেম্বরেই ওঁর ওখানে গিয়েছিলাম প্রমথর টিকিটের ব্যাপারে। ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ করে দেশে যাবার টিকিট পাওয়া যায় না। অনেক ঝামেলা করে উনি প্রমথকে টিকিট পাইয়ে দিয়েছিলেন।

 

অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেই এক বার ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। এভাবে দরজা লক না করে তো কোথাও আগে যাইনি! ইন্সপেকশন শেষ করে কফি বানিয়ে রোববারের নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর লেট এডিশন নিয়ে বসলাম। কালকে হুড়োহুড়ির মধ্যে অর্ধেকও পড়া হয়নি! হঠাৎ খেয়াল হল শনিবার রাত্রে যখন আগুন লেগেছে, তখন বিভাস চৌধুরীর খবর নিশ্চয় থাকবে। বেশ খানিকক্ষণ খুঁজে খবরটা চোখে পড়ল। মাত্র কয়েক লাইন। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক মারা গেছেন উল্লেখ আছে। কিন্তু নাম-ধাম কিছু নেই, ধরে নিচ্ছি পুলিশ তখনও নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি। আমার অবশ্য মনে হল এক্ষেত্রে নাম গোপন রাখা অর্থহীন। অনেকেই তো আমরা জানি মৃত অধ্যাপক কে

 

বিভাস চৌধুরীর নাম নেই ঠিকই, কিন্তু আরেকটা নাম চোখে পড়ল যাঁকে আমি চিনি। খবরটাও বেশ বড়ো করে ছাপানো হয়েছে। নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট কিউরেটর তোশি নাকাজিমা আত্মহত্যা করেছেন। যোগাযোগটা একটু অদ্ভুত, কারণ তোশিকে আমি প্রথম দেখি বিভাস চৌধুরীর ঘরে। শুনেছিলাম ওঁরা দু-জনেই নাকি এক সময় বার্কলেতে পড়তেন। বার্কলে হল ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার একটা বিখ্যাত ক্যাম্পাস। তোশির সঙ্গে এর পরে অবশ্য আমার অনেক বারই দেখা হয়েছে। এত বড়ো কাজ করেন, নামিদামি লোকদের সঙ্গে দহরম-মহরম, কিন্তু ভারি মিশুকে ও ভদ্র। একবার আমি আর প্রমথ একেনবাবুকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। মিউজিয়ামে একেনবাবু সঙ্গে থাকা মানে একটা টর্চার। অফুরন্ত মাল্টি-ডিরেকশানাল কোয়েশ্চেন, একবার এটা, একবার সেটা- যার মাথামুণ্ডু কিছুই নেই। তোশি যে শুধু আমাদের সঙ্গে সারাক্ষণ ছিলেন তা নয়, একেনবাবুর সব প্রশ্নের উত্তর ঠান্ডা মাথায় দিয়ে গিয়েছিলেন। একেনবাবু একেবারে মুগ্ধ। ওঁর অবশ্য অল্পেতেই মুগ্ধ হবার হ্যাবিট আছে! ফেরার পথে বলেছিলেন, “জ্ঞানের পাহাড় স্যার, আর কী বিনয়ী!”

 

আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরটা পড়লাম। কেন আত্মহত্যা করেছেন মোটেই পরিষ্কার নয়। লং আইল্যান্ডে ওঁর বাড়ির ল্যান্ডলেডি ডরোথি স্মিথ নাকি তোশিকে শনিবার রাত বারোটা নাগাদ ফিরতে দেখেন। ডরোথি স্মিথ এক তলায় থাকেন, তোশি দোতলায়। ডরোথি তাঁর অতিথিদের বিদায় জানাতে দরজা খুলে কথা বলছিলেন, তখন তোশিকে দেখেন সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছেন। তোশির আচরণ ওঁর একটু অদ্ভুত লাগে, কারণ অন্য সময় দেখা হলে উনি সবসময় হাসেন, মাথা ঝুঁকিয়ে বাও করে ‘হায়’ বলেন। ওই দিন কোনো কথা না বলে উঠে যান। তোশির মুখ দেখে ডরোথির মনে হয় কোনো কারণে উনি খুব বিচলিত। যাই হোক, অতিথিরা চলে যাবার পর মিনিট পাঁচেকও হয়নি, ওপর থেকে ডরোথি একটা শব্দ শোনেন। ওঁর মনে হয় গুলির শব্দ, আর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে ফোন করেন। পুলিশ যে রিভলবারটা ঘরে পেয়েছে সেটা নাকি তোশিরই। পুলিশের সন্দেহ এটা সুইসাইড। মূল খবর এইটুকুই। এছাড়া তোশির একটা ছোট্ট জীবনী ছাপা হয়েছে, সেইসঙ্গে নিউ ইয়র্কের জাপান অ্যাসোসিয়েশন সোমবার বিকেল ছ’টায় ব্রুকশায়ার ফিউনারেল হোমে স্মরণসভার আয়োজন করেছে তার ঘোষণা। এত তাড়াতাড়ি? অবাকই লাগল!

 

জীবনীটা চট করে পড়ে নিলাম। জাপান থেকে বার্কলেতে এসেছিলেন পড়াশুনো করতে। পড়াশুনো শেষ করে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন, তারপর নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামে যোগ দেন। নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামে উনি নাকি ফিলাটেলি সেকশনের হেড ছিলেন। বড়ো কাজ করতেন জানতাম, কিন্তু এটা জানতাম না। খবরটা শেষ হয়েছে ওঁর শান্ত ও মধুর ব্যবহারের প্রশংসা করে। এটা ওঁকে যারা একবার দেখেছে তারাই জানবে। এরকম ধীর-স্থির ঠান্ডা মাথার একজন লোক হঠাৎ কেন আত্মহত্যা করলেন সেটাই প্রশ্ন। মানুষের মনের মধ্যে কী চলছে বুঝতে পারা এত কঠিন! বাইরে থেকে দেখে কারোর সম্পর্কে একটা ধারণা করি, মুহূর্তের মধ্যে সেই ধারণা কীরকম ভেঙে চুরমার হয়ে যায়!

 

.

 

আটটা নাগাদ একেনবাবু আর প্রমথ ওপরে এল। প্রমথর মুখ অত্যন্ত ব্যাজার। প্রতি সোমবারই এটা হয়। দু-দিন ছুটির পর আবার কাজ করতে যেতে হবে বলে সোমবার হচ্ছে ওর ‘হেল-ডে’। ওদের তোশির খবরটা দিতেই একেনবাবু বললেন, “মাই গুডনেস স্যার, ওরকম একজন শান্ত-মাথা পণ্ডিত লোক খামোখা সুইসাইড করতে গেলেন কেন?”

 

একেনবাবু বোধহয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, প্রমথ খ্যাঁকখেঁকিয়ে উঠল, “কেন মশাই, সুইসাইড কি শুধু মাথা-গরম মূর্খরাই করে?” তারপর আমায় জিজ্ঞেস করল, “তুই খবরটা পেলি কোত্থেকে?”

 

ওদের নিউ ইয়র্ক টাইমসটা দেখালাম। নিঃশব্দে নিউজটা পড়ে দু-জনের উদ্দেশেই একেনবাবু বললেন, “কি স্যার, ফিউনারেলে যাবেন নাকি?”

 

“ধ্যেত, কবর-ফবরের মধ্যে আমি নেই,” বলতে বলতে কুকি-জার খুলে প্রমথ একটা কুকি মুখে পুরল।

 

“কবরের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? লেখা আছে স্মরণসভা। তা ছাড়া তোশি তো খ্রিশ্চান নয়, নিশ্চয় বৌদ্ধ বা শিন্টো-ফিন্টো কিছু হবে।” বললাম বটে, কিন্তু শিন্টো সম্প্রদায়ের কেউ মারা গেলে কী করা হয় আমার কোনো ধারণাই নেই।

 

“চলুন স্যার। চেনাজানা মানুষ, তার ওপর উনি হচ্ছেন এশিয়ান!”

 

একেনবাবু এমনিতে বাঙালি দি গ্রেট। কিন্তু আজকাল দেখি খুব ‘আমরা এশিয়ান, আমরা এশিয়ান’ করেন। ঠিক হল বিকেলে আমরা সবাই যাব। প্রমথ শুধু ঘোষণা করল, “ফিউনারেল হচ্ছে দেখলে কিন্তু ব্যাক করব, আগে থেকেই তোদের বলে দিচ্ছি।”

 

প্রমথ ডেডবডি দেখতে ভালোবাসে না। আমিও যে বাসি তা নয়। এদেশে আবার ফিউনারেল হোমে ডেডবডিতে সুগন্ধ ঢেলে, রংচং মাখিয়ে এমনভাবে সাজিয়ে রাখে মনে হবে জীবন্ত — শুধু ঘুমিয়ে আছে। এই ব্যাপারটাকে এদেশে ‘এমবাম’ করা বলে, যাতে দাহ বা সমাধির আগে মৃতের পুরোনো রূপটা শেষ বারের মতো সবাই দেখে যেতে পারে। কেন জানি না, মরদেহটাকে ওভাবে সাজিয়ে সবাইকে দেখানো

 

আমার একদম পছন্দ হয় না।

 

তিন

ব্রুকশায়ার ফিউনারেল হোম হল লং আইল্যান্ডে-আমার বাড়ির থেকে বেশ অনেকটা দূরে। পৌঁছোতে পৌঁছোতে আমাদের একটু দেরিই হল। তবে দেরি শুধু আমাদেরই হয়নি, তখনও দেখি অনেক লোক আসছে। সবার হাতেই ফুলের তোড়া। আমরাই এসেছি বোকার মতো খালি হাতে। কী আর করা!

 

হলঘরে ঢোকার মুখে খোলা একটা বড়ো খাতা, সবাই সেখানে নিজের নাম-ধাম লিখছে। এদেশে সব কিছুরই একটা রেকর্ড রাখা চাই। কী এসে যায় কে এল বা না এল। যাঁর জন্য আমরা এসেছি তিনি তো আর দেখছেন না! আমি এক বার ভাবলাম সই করব না। কিন্তু যে লোকটা খাতার পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে পেনটা এগিয়ে দিয়ে এমনভাবে ‘স্যার’ বলল যে তখন না করাটা নিতান্তই অভদ্রতা।

 

হলঘরে লোক গিজগিজ করছে। এক প্রান্তে একটা বিশাল টেবিলে তোশির ফোটোর চারপাশে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। কফিন-টফিন কোথাও নেই। বাঁচা গেল! সেটাই অবশ্য অনুমান করেছিলাম। মৃত্যুর পর দিন তিনেক না কাটলে সাধারণত কবর বা ক্রিমেশন হয় না। এটা স্মরণসভাই। থমথমে গুরুগম্ভীর আবহাওয়া। এদিক-ওদিক অনেক জাপানি মুখ। তাদের মধ্যে নিশ্চয় তোশির আত্মীয়স্বজনও আছে। আমরা তো কাউকেই চিনি না, কাকেই-বা সান্ত্বনা দেব!

 

স্টেজের ঠিক নীচে ঘরের এককোণে একটা ডায়াস। সেখানে এক লালমুখো সাহেব দাঁড়িয়ে টাই ঠিক করছিলেন। তিনিই প্রথমে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। মনে হল নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামের কেওকেটা। তোশির অজস্র প্রশংসা করলেন। বললেন, “তোশি শুধু জ্ঞানী ছিলেন না, একজন সমাজ-সচেতন মানুষ ছিলেন। হার্লেমের দুঃস্থ বাচ্চাদের জন্য নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামেই উনি অনেক প্রোগ্রাম চালু করেছিলেন। তোশির অভাব কোনোদিনই পূরণ হবে না—” বার বার কথাগুলো বললেন। শেষে অবশ্য যোগ করলেন, “পৃথিবী থেমে থাকে না। তোশির অসম্পূর্ণ কাজগুলো এখন অন্যদের সম্পূর্ণ করতে হবে…।”

 

সাহেবের গলার স্বর এত ঘ্যানঘ্যানে আমার ঘুম পাচ্ছিল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম একেনবাবুর চোখও ঢুলুঢুলু। প্রমথর অবস্থাটা দেখতে যাচ্ছি, তখন চোখে পড়ল আমাদের সামনের সারিতে একেবারে বাঁ-কোনায় বসে আছেন মিস্টার মেহেতা। না, এবার আমার চিনতে এতটুকু সময় লাগল না।

 

এরপর ছোটোখাটো দুয়েকটা বক্তৃতা চুকে যাবার পর যখন বের হচ্ছি, তখন দেখি মিস্টার মেহেতাও বেরোচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “চিনতে পারছেন?”

 

উনি জবাব দিলেন, “কী মুশকিল, কাস্টমারদের না চিনলে আমাদের চলে! আজ খুব ভোর ভোর উঠেছিলেন দেখলাম!”

 

“তা উঠেছিলাম। আপনিও তো উঠেছিলেন?”

 

“আমরা ব্যাবসা করি, আমরা কি অত ঘুমোতে পারি!” মিস্টার মেহেতা রহস্য করলেন।

 

ইতিমধ্যে সবাই রাস্তায় নেমে এসেছি। প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “আপনি তোশিকে চিনলেন কী করে? উনিও কি আপনার কাছ থেকে টিকিট কাটতেন?”

 

“না,” মাথা নাড়লেন মিস্টার মেহেতা। “ওঁর সঙ্গে আলাপ একটা ব্যাবসার ব্যাপারে।”

 

“আপনার তো ট্র্যাভেলিং-এর ব্যাবসা জানতাম। অন্য কিছুও আছে নাকি?”

 

“তা আছে, মিস্টার সমাদ্দার,” মিস্টার মেহেতার মুখে মৃদু হাসি। “আমার একটা স্ট্যাম্পের ডিলারশিপ আছে। মিস্টার নাকাজিমা ছিলেন আমার একজন বড়ো অ্যাডভাইজার। প্রচুর জ্ঞান ছিল ওঁর এই ফিল্ডে।”

 

“আমিও স্যার স্ট্যাম্প জমাতাম একসময়।”

 

“তাই নাকি?” মিস্টার মেহেতা একেনবাবুর দিকে তাকালেন। ওঁর চোখে কৌতূহলের থেকে উপেক্ষার ভাবটাই বেশি। একেনবাবুর চেহারা বা ব্যক্তিত্ব— কোনোটাই প্রথম দর্শনে শ্রদ্ধার উদ্রেক করে না। পরিচয় করিয়ে দিলাম, কিন্তু কতটা বিশ্বাস করলেন বুঝলাম না। ভাবলেন নিশ্চয় মজা করছি!

 

“ক্লাস টেন অবধি স্যার রেগুলার স্ট্যাম্প জমিয়েছি। স্কটসের ক্যাটালগটাও আমার কাছে ছিল।” একেনবাবু ওঁর বিদ্যে জাহির করতে পেরে ভীষণ খুশি।

 

“ওরে বাব্বা, তাহলে তো আপনি সিরিয়াস স্ট্যাম্প কালেক্টর!” মিস্টার মেহেতা বললেন। ওঁর গলায় ঠাট্টার সুর স্পষ্ট। এদেশে যে লোকটা স্ট্যাম্পের ডিলার, সে নিশ্চয় দামি দামি স্ট্যাম্প নিয়ে কারবার করে। স্কুলের ছাত্রদের স্ট্যাম্প জমানোটা তাদের ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। কিন্তু একেনবাবুকে সেটা কে বোঝাবে!

 

“তা একসময় জমিয়েছি,” মিস্টার মেহেতাকে একেনবাবু বললেন। “মিস্টার নাকাজিমাও যে স্ট্যাম্পের অথরিটি সেটা জানতাম না। জানলে …

 

আমি আর থাকতে পারলাম না। বললাম, “চলুন একেনবাবু, ওঁর নিশ্চয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

 

মিস্টার মেহেতা বললেন, “না, না, দেরি কিছু নয়। তবে একদিন আসবেন আপনার বন্ধুকে নিয়ে। ওঁর স্ট্যাম্পে যখন এত ইন্টারেস্ট, আমি কিছু কালেকশন দেখাব।”

 

মিস্টার মেহেতা চলে যেতেই প্রমথ একেনবাবুকে কড়কাল। “আপনি তো মশাই আচ্ছা যা হোক! লোকটা হচ্ছে স্ট্যাম্পের ডিলার। নির্ঘাত হাজার হাজার ডলারের স্ট্যাম্প নিয়ে কারবার করে। আর আপনি কিনা ওকে আপনার হাই স্কুলের কালেকশনের কথা বলছেন!”

 

ধমক খেয়েও একেনবাবু চুপ করলেন না। “আমার হাই স্কুলের কালেকশন কিন্তু খুব খারাপ ছিল না, স্যার!”

 

“থামুন মশাই, আর শুনতে চাই না।”

 

একেনবাবু এবার আমাকে সাক্ষী মানলেন, “প্রমথবাবু রাগ করছেন, স্যার। কিন্তু আমার একটা স্ট্যাম্প ছিল যেটার দাম স্কটস ক্যাটালগে লেখা ছিল পাঁচশো ডলার। আমি বলছি স্যার কুড়ি বছর আগেকার কথা। এখন নিশ্চয় তার দাম অনেক গুণ বেড়ে গেছে।”

 

আমি বললাম, “সে কী! অত দামের স্ট্যাম্প আপনার কাছে ছিল, আর আপনি বিক্রি করেননি!”

 

“তখন তো জানতামই না কাকে বিক্রি করা যায়।”

 

“এখনও আছে ওটা?”

 

“আছে স্যার, দেশে গিন্নির ভল্টে।” তারপর একটু থেমে বললেন, “বুঝলেন স্যার, ভালো হল আজ এখানে এলাম।” বলেই বোধহয় একটু লজ্জা পেলেন। “মানে মিস্টার নাকাজিমার মৃত্যুটা খুবই দুঃখের— সেটা বলছি না। কিন্তু এই যে, মিস্টার মেহেতার সঙ্গে পরিচয় হল।”

 

প্রমথ ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “মানে আপনার স্ট্যাম্পটা বেচে এবার টু- পাইস বাগাবার সুযোগ পাবেন- এই তো? একেই বলে কারোর পৌষ মাস, কারোর সর্বনাশ!”

 

“ছি, ছি, স্যার, কী যে বলেন!”

 

.

 

আমরা যখন বাড়ি ফিরলাম তখন রাত প্রায় ন’টা। সবাই এত টায়ার্ড যে রান্না করতে ইচ্ছে করল না। প্রমথ বলল, “বহুদিন পিৎজা খাইনি। চল টমিজ-এ যাই।” উত্তম প্রস্তাব। টমিজ ইদানীং একটা ভেজিটেরিয়ান পিৎজা চালু করেছে— মাশরুম, হট পেপার, পেঁয়াজ, আর ব্রকলি দিয়ে। পিৎজাতে মোৎজারেলা চিজ তো থাকবেই। কিন্তু তা ছাড়াও আরও কয়েকটা চিজ মিশিয়ে জিনিসটা যা তৈরি করে-একেবারে বাঘের বাচ্চা টেস্ট! পিৎজা শুনে একেনবাবু অবশ্য একটু ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছিলেন। উনি একেবারে ভেতো বাঙালি। কিন্তু শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলেন।

 

সোমবার ন’টা বলেই বোধহয় টমিজ পিৎজারিয়া একেবারেই ফাঁকা। মালিক টমি টেলিফোনে ইটালিয়ান ভাষায় কারোর সঙ্গে খোশগল্প করছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে এমনভাবে হাতটা ঘোরাল যার অর্থ যেখানে খুশি বসো। আমরা সাধারণত বসি ডান দিকের শেষ টেবিলটাতে—একেবারে জানলা ঘেঁষে। সেই টেবিলে দেখলাম একজন বসে আছে। অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারিনি। প্রমথ বলল, “আরে, ও তো আমাদের সমর।”

 

সমর উলটো দিকে মুখ করে বসেছিল বলে আমাদের দেখতে পায়নি। প্রমথ ওর ঘাড়টা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “এই ব্যাটা, একা একা খেতে এসেছিস যে?”

 

ও চমকে বলল, “আরে তোরা!”

 

সমরের সঙ্গে প্রমথর খুব দোস্তি। ওরা হল ব্রিজের পার্টনার। একসময় দু-জনে মিলে নানান কম্পিটিশনে খেলতে যেত। আজকাল হয় উৎসাহ কমেছে, নয় আর সময় পায় না।

 

“অর্ডার দিয়েছিস?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

 

“এইমাত্র দিলাম।”

 

“কী দিলি?”

 

“তাতে তোর কী?” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম। “খাবে তো ও!”

 

“আঃ, চুপ কর তো! মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে খাব। কী দিয়েছিস বল।”

 

“পেপারোনি।”

 

“গুড! তাহলে আমরা একটা ভেজিটেরিয়ান, আর একটা সসেজ? কি রে বাপি, আর কিছু লাগবে?”

 

“না, দুটোই যথেষ্ট।”

 

“আপনি মশাই চুপ কেন? কিছু সাধ থাকে তো বলে ফেলুন, পরে নইলে পস্তাবেন।”

 

“কী যে বলেন, স্যার! আপনারা এসব ব্যাপারে এক্সপার্ট।”

 

ইতিমধ্যে টমির চ্যালা এসে দাঁড়িয়েছে। প্রমথ তাকে অর্ডার দিয়ে সমরকে বলল, “তোশি মারা গেছেন শুনেছিস?”

 

সমর চমকে বলল, “তোশি? কোন তোশি— তোশি নাকাজিমা?”

 

“হ্যাঁ। ওর ফিউনারেল থেকেই তো আমরা আসছি।”

 

“ফিউনারেল নয়, স্মরণসভা।” আমি শুদ্ধ করে দিলাম।

 

সমরের মুখ একেবারে হাঁ। বলল, “কী বলছিস যা-তা।”

 

আমি বললাম, “কালকের নিউ ইয়র্ক টাইমসে তো বড়ো করে বেরিয়েছে- চোখে পড়েনি?”

 

“কাল যা দিন গেছে, পত্রিকা খোলার সময় পাইনি! আর আজ তো সারাদিন লাইব্রেরিতে। বাট দিস ইজ শকিং- পর পর বিভাসদা, তোশি। কী হয়েছিল জানিস?”

 

“সুইসাইড,” আমি বললাম।

 

“আই কান্ট বিলিভ ইট!”

 

“তুই তো ওঁকে ভালোই চিনতিস, তাই না?”

 

“তা চিনতাম। মানে আমি ওঁকে চিনতাম বিভাদোর সূত্রে। ওঁরা খুব বন্ধু ছিলেন।”

 

“একেই বলে নিয়তি স্যার, দু-জনেই কেমন একসঙ্গে চলে গেলেন।” একেনবাবু স্বগতোক্তি করলেন।

 

“আপনি কি এর মধ্যে কোনো যোগ খুঁজে পাচ্ছেন নাকি?” প্রমথ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

 

“না, না স্যার। কথার কথা বললাম আর কী!” একেনবাবু থতমত খেয়ে উত্তর দিলেন।

 

“উনি সুইসাইড করতে গেলেন কেন?” সমর নিশ্চয় তার উত্তরটা আমাদের কাছ থেকে আশা করে না, তাও প্রশ্নটা করল।

 

“হু নোজ! স্মরণসভায় সে নিয়ে তো কিছু শুনিনি।” প্রমথ ঘাড় ঝাঁকাল।

 

সমরকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোর সঙ্গে ওঁর লাস্ট দেখা হয়েছিল কবে?”

 

“এই তো ক’দিন আগে।”

 

“তখন কেমন ছিলেন উনি, দেখে কি কিছু মনে হয়েছিল… ডিপ্রেশন বা হতাশায় ভুগছেন?”

 

“একদমই না— বরং উলটো। আমাকে আর বিভাসদাকে টেনে নিয়ে গেলেন এশিয়া সোসাইটিতে ওঁর ছেলেবেলার বন্ধুর আর্ট এক্সিবিশন দেখাতে। যেতে যেতে কত মজার গল্প করলেন।”

 

“মানুষের কখন যে কী হয় স্যার!” একেনবাবু মন্তব্য করলেন।

 

“ওঁর আচরণের মধ্যে সবসময় একটা ছেলেমানুষি ভাব ছিল,” সমর একটু অন্যমনস্কভাবেই বলল। “অথচ কী রেসপন্সিবল পজিশনে ছিলেন! নিজের কাজ ভীষণ ভালোবাসতেন। নেশা আর পেশা এক হয়ে গেলে যা হয় আর কী।”

 

“পেশায় তো কিউরেটর ছিলেন, নেশাটা কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“নেশার জন্যই তো ওঁর ওই পেশা,” সমর উত্তর দিল। “আসলে উনি কম্পিউটার সায়েন্সের লোক ছিলেন। ইনফ্যাক্ট বিভাসদা আর উনি একসঙ্গেই পিএইচডি করেন। কিন্তু ওঁর স্ট্যাম্পের নেশা এত ছিল যে লাইন চেঞ্জ করে খুব অল্প মাইনেতে হিউস্টন বা ডালাসের একটা মিউজিয়ামে ফিলাটেলি সেকশনে কাজ নেন।”

 

“দ্যাটস স্ট্রেঞ্জ।” প্রমথ বলল।

 

“কেন?” সমর জিজ্ঞেস করল।

 

“লাইনই যদি চেঞ্জ করবেন, তাহলে অত কষ্ট করে পিএইচডি করলেন কেন?” উত্তরটা আমিই দিলাম, “মানুষের মনে যখন কিছু আসে, তখন অত হিসেব- নিকেশ করে আসে না!”

 

“শুধু তাই নয়,” সমর বলল, “আমি বরং বলব উনি খুব ভুল পথ বাছেননি। এই নিউ ইয়র্কেই হাজার গণ্ডা কম্পিউটার সায়েন্সের লোক আছে—কে তাদের চেনে? কিন্তু স্ট্যাম্পের জগতে নিউ ইয়র্কে এমন কেউ নেই যে তোশিকে চেনে না।”

 

“তুই কী করে জানলি?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

 

“একবার আমি আর বিভাসদা ওঁর সঙ্গে একটা স্ট্যাম্প অকশনে গিয়েছিলাম। ওখানেই দেখলাম বড়ো বড়ো স্ট্যাম্প কালেক্টাররা তোশিকে কত সম্মান করে। দু-এক জন তো অ্যাডভাইস চাইল নিলামে কদ্দূর পর্যন্ত ডাকা উচিত। আর আমি হেঁজিপেঁজি দু-দশ ডলারের স্ট্যাম্প যারা জমায় তাদের কথা বলছি না। নিলামের স্ট্যাম্পগুলোর মধ্যে ধর একটা ছিল বিখ্যাত ইনভার্টেড জেনি এয়ারমেল।

 

আমি জীবনে ইনভার্টেড জেনি এয়ারমেলের নাম শুনিনি। তবে সমর এমনভাবে নামটা বলল যে বুঝলাম স্ট্যাম্প জগতের একটি রত্নই হবে।

 

“আপনি স্যার মনে হচ্ছে স্ট্যাম্প সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন।” একেনবাবুর কথাটা প্রশ্ন না মন্তব্য ঠিক বোঝা গেল না।

 

সমর বলল, “অনেক কিছু জানি বলার স্পর্ধা নেই— তবে এক-আধটা বই পড়েছি।”

 

সমর হচ্ছে বইয়ের পোকা। হেন জিনিস নেই যা পড়ে না। প্রমথর মতে ও হচ্ছে লিভিং এনসাইক্লোপিডিয়া।

 

“আসলে স্যার আমিও একসময় স্ট্যাম্প জমাতাম।”

 

“আঃ, আবার আপনি হাই স্কুলের স্ট্যাম্প জমানোর কথা শুরু করেছেন!” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল।

 

“তা নয় স্যার, আমি বাপিবাবুকে বলছিলাম আমার কাছে একটা স্ট্যাম্প ছিল, ক্যাটালগে যার দাম দেখেছিলাম পাঁচশো ডলার। আমি স্যার কুড়ি বছর আগেকার কথা বলছি।” তারপর সমরের দিকে তাকিয়ে একেনবাবু প্রশ্নের সুরে বললেন, “এখন নিশ্চয় স্যার ওটাকে বিক্রি করলে দু-তিন হাজার পাব?”

 

“হয়তো পাবেন,” সমর একটু যেন অন্যমনস্ক

 

“হয়তো কেন স্যার, আপনার কি মনে হচ্ছে নাও পেতে পারি?”

 

সমরের এসব প্রশ্ন সম্ভবত ভালো লাগছে না! দুই পরিচিত জনের মৃত্যুতে মন নিশ্চয় খারাপ। ভাবলাম অন্য কোনো প্রসঙ্গ এনে কথাটা ঘোরাই। তার অবশ্য দরকার হল না। প্রমথ বলল, “চুপ করুন তো মশাই! দু-দুটো লোক ডেড, আর আপনি আপনার দু-পয়সার ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে পাঁচালি পাড়ছেন!”

 

একেনবাবুর থাবা খেয়ে চুপ করে যাওয়াটা সমরের বোধহয় খারাপ লাগল। বলল, “আমি বলতে চাচ্ছিলাম সব কিছু নির্ভর করছে আপনার স্ট্যাম্প কী অবস্থায় আছে তার ওপর। ক্যাটালগে সাধারণত সুপারফাইন মিন্ট কন্ডিশনে যে স্ট্যাম্পগুলো আছে তার দাম দেওয়া থাকে।”

 

“মিন্ট কন্ডিশন মানে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“যেটা কোনোদিন ব্যবহার করা হয়নি, অর্থাৎ ক্যানসেলড নয়—ওপরে কোনো পোস্ট অফিসের ছাপ নেই।

 

“আর সুপারফাইন?”

 

“সুপারফাইনের অর্থ স্ট্যাম্পটা একেবারে নিখুঁত অবস্থায় আছে। অর্থাৎ‍ চারদিকের পারফোরেশনগুলো নষ্ট হয়নি। স্ট্যাম্পটা ওয়েল সেন্টারড, মানে তার ছবিটা ঠিক একেবারে মধ্যিখানে বসানো। পেছনের আঠা সম্পূর্ণ অটুট। স্ট্যাম্পে কোনো ভাঁজ নেই, দাগ নেই। যেমনভাবে তৈরি হয়েছিল, ঠিক তেমনভাবেই আছে।”

 

“আর তা যদি না থাকে?

 

“তাহলে দেখতে হবে কন্ডিশন কতটা খারাপ। তার ওপর নির্ভর করবে দাম।”

 

“দামের কতটা তফাত হতে পারে স্যার?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

 

“এর সহজ কোনো উত্তর নেই। নির্ভর করছে বাজারে ও ধরনের ক’টা স্ট্যাম্প আছে তার ওপর। ধরুন, সুপারফাইন মিন্ট কন্ডিশনে যে স্ট্যাম্পের দাম হাজার ডলার সেই স্ট্যাম্পই একটু বাজে অবস্থায় হয়তো একশো ডলারে পাওয়া যাবে। ক্যানসেলড—অর্থাৎ পোস্ট অফিসের ছাপ থাকলে হয়তো দশ-কুড়ি ডলারে। অবশ্য কিছু কিছু স্ট্যাম্পের বেলায় মিন্ট আর ক্যানসেলডের মধ্যে অল্পই তফাত, কারণ কোনোটাই সহজলভ্য নয়। সবই হল ডিমান্ড আর সাপ্লাইয়ের প্রশ্ন।”

 

“আমারটা স্যার মিন্ট কন্ডিশনে নয়,” একেনবাবুর গলাটা মনে হল একটু বিমর্ষ।

 

“তার মানেই যে সস্তা তা নয়।” সমর একটু সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। “আপনার কাছে স্ট্যাম্পটা আছে?”

 

“না, স্যার।”

 

“থাকলে কোনো ডিলারের কাছে নিয়ে যেতে পারতেন- নিউ ইয়র্কে বহু স্ট্যাম্প ডিলার আছে। মোটামুটি আইডিয়া পেতেন।”

 

“আজকেই একজন স্ট্যাম্প ডিলারের সঙ্গে আলাপ হল স্যার, মিস্টার

 

মেহেতা। চেনেন নাকি ওঁকে?”

 

“নিশ্চয়। ওঁর তো একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিও আছে।”

 

“উনি কি রিলায়েবল লোক স্যার? মানে আপনি যতটুকু জানেন?”

 

“আমার কোনো ধারণাই নেই। তোশি আজ বেঁচে থাকলে আপনাকে বলতে পারতেন।”

 

চার

একেনবাবুকে সকাল থেকে দেখছি না। দেখলে একটা খুব গরম খবর দিতে পারতাম। নিউ ইয়র্ক মিউজিয়াম থেকে নাকি ‘প্রাইসলেস বুদ্ধ’ নামে একটা বিখ্যাত স্ট্যাম্প চুরি গেছে! উনি হয়তো নামটা শুনে থাকবেন— এত যখন ‘স্ট্যাম্প কালেক্টর’ বলে নিজেকে জাহির করেন। আমার কাছে ‘ইনভার্টেড জেনি এয়ারমেল’ও যা ‘প্রাইসলেস বুদ্ধ’ও তাই— শুধু কয়েকটা শব্দ। তবে দামটা দেখে চক্ষু চড়কগাছ! কুড়ি হাজার ডলার! রিপোর্টারের কথায় ‘দ্য মার্কেট প্রাইস অফ দ্য প্রাইসলেস বুদ্ধ ইজ এস্টিমেটেড টু বি ওভার টোয়েন্টি থাউজেন্ড ডলার্স’! একটা ছোট্ট কাগজের টুকরোর এত দাম!

 

প্রাইস অফ দ্য প্রাইসলেস বুদ্ধ- কথাগুলো পড়তে পড়তে আমার প্রমথ কথা মনে হল। ওর মতে এভরিথিং হ্যাজ এ প্রাইস। প্রাইসলেসেরও যে প্রাইস আছে দেখলে নিশ্চয় ও খুব মজা পাবে। প্রমথ আবার আজ তাড়াহুড়ো করে কলেজ চলে গেছে। ল্যাবে এক ভিজিটার আসছে- তার জন্য ওকে তদারকি করতে হবে। আসতে আসতে সেই বিকেল।

 

চুরিটা নিঃসন্দেহে বড়ো খবর, কিন্তু আমার মাথায় আরও কয়েকটা জিনিস ঘুরছে। তোশি ছিলেন নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামের ফিলাটেলি সেকশনের প্রধান। ফিলাটেলি সেকশন হল যেখানে স্ট্যাম্পের সংগ্রহগুলো থাকে। সেখান থেকে এরকম একটা দামি স্ট্যাম্প অদৃশ্য হল, আর সেটা ধরা পড়ল তোশির মৃত্যুর ঠিক পর পরই! সামথিং ইজ রং সামহোয়্যার। নিউ ইয়র্ক টাইমসেও এটা উল্লেখ করেছে। পুলিশ যে জোর তদন্ত শুরু করেছে সে খবরটাও আছে।

 

হয়তো তোশির কোনো কারণে হঠাৎ অনেক টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল। আর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে উনি স্ট্যাম্পটা চুরি করে বিক্রি করেছিলেন। পরে ধরা পড়ে যাবার লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন! কিন্তু এটা ভাবা কি যুক্তিযুক্ত? কুড়ি হাজার ডলার অনেক হলেও তোশির মতো লোকের কাছে এটা এমন কোনো বড়ো অঙ্ক নয় যে জোগাড় করতে সমস্যা হবে। আরও একটা সম্ভাবনা আছে। ধরা যাক মিউজিয়ামেরই কেউ স্ট্যাম্পটা চুরি করেছিল। তোশি ধরে ফেলেছিলেন কে করেছে। তোশি তাকে বলেছিলেন স্ট্যাম্পটা ফেরত নিয়ে এলে উনি থানা-পুলিশ করবেন না। লোকটা তা না করে তোশিকে খুন করে। কী করে লোকটা তোশির ঘরে ঢুকে খুন করে পালাল, সেটা পরিষ্কার নয়। তবে এরকম কিছু ঘটা মোটেই অসম্ভব নয়! তোশি যেরকম ভদ্রলোক— অপরাধীকে শোধরাবার সুযোগ দেওয়া ওঁর পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। তোশির মন নাকি গত দু-দিন ভীষণ খারাপ ছিল, ওঁর ল্যান্ডলেডি ডরোথি স্মিথ জানিয়েছেন। এইসব কারণেই কি? আসলে পুরো ব্যাপারটাই কনফিউজিং!

 

আমি কলেজ গেলাম বটে, কিন্তু মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে। যাবার পথে রাস্তার ধারে নিউজ স্ট্যান্ডে একটা খেলো পত্রিকা চোখে পড়ল। প্রথম পাতাতেই বিরাট করে তোশির একটা ফোটো। তার নীচে লেখা ‘ডিড হি স্টিল দ্য স্ট্যাম্প?” আমি এই পত্রিকাটা এক-আধ সময় উলটে পালটে দেখেছি। চাঞ্চল্যকর খবর ছাড়া আর কিছু এরা ছাপে না। তখনই ঠিক করলাম একেনবাবু এলে ওঁকে উদ্বুদ্ধ করব এই চুরির ব্যাপার নিয়ে একটু মাথা ঘামাতে। একেনবাবুর অনেক দোষ—উলটোপালটা বকেন, জামাকাপড়ের ছিরিছাঁদ নেই, সিগারেট খোর (আমার আর প্রমথর তীব্র আপত্তিতে সিগারেট খাওয়া একটু কমেছে), ঘ্যানঘ্যান করে লোককে পাগল করে দেন, কিন্তু নিঃসন্দেহে তিনি দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা। গত তিন বছরে এটা সার বুঝেছি। শুধু আমরা নই, নিউ ইয়র্ক পুলিশের হোমরাচোমরা কর্তারাও সেটা জানেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভদের প্রতি তাঁদের যে বৈরী মনোভাব, একেনবাবুর ক্ষেত্রে সেটা নেই। বেশ অনেকগুলো কেসে ওঁরাই এগিয়ে এসে একেনবাবুর সাহায্য চেয়েছেন। তার প্রধান কারণ একেনবাবু কাউকেই ছোটো করার চেষ্টা করেন না। নিজে রহস্যের সমাধান করেও ভাব দেখান সকলের জন্যেই সেটা সম্ভব হয়েছে!

 

বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখি সারা ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরতি। একেনবাবুর ঠ্যাং কফি টেবিলে তোলা, মুখে সিগারেট, চোখ বন্ধ। ইদানীং তাড়া দিয়ে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ওঁর সিগারেট খাওয়া বন্ধ করিয়েছি। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “একী আপনি এখানে আবার সিগারেট খাচ্ছেন?”

 

“তাই তো স্যার, একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে এই চুরির ব্যাপারটা আমাকে বড্ড বদার করছে।”

 

“চুরি? কোন চুমি?”

 

“এই প্রাইসলেস বুদ্ধের কেসটা স্যার। আপনি আজ নিউ ইয়র্ক টাইমস দেখেননি?”

 

কথাটা শুনে আমি যে কী খুশি হলাম বোঝাতে পারব না। বললাম, “কী আশ্চর্য, আমি আজ কলেজ যেতে যেতে ভাবছিলাম আপনাকে বলব ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখতে! হাজার হোক, তোশিকে আমরা চিনতাম, তাঁর নামে পত্রিকাতে এসব লেখা…।”

 

“আমারও সেই পয়েন্ট স্যার। সেই জন্যই আমি ইনস্পেকটর ল্যান্ডির কাছে গিয়েছিলাম।”

 

“ইনস্পেকটর ল্যান্ডি! তিনি তো হোয়াইট প্লেইসে আছেন!”

 

“না স্যার। কয়েক মাস হল ওখানকার চাকরি ছেড়ে নিউ ইয়র্ক পুলিশে ঢুকেছেন। ওঁর ওপরেই মিস্টার নাকাজিমার তদন্তের ভার পড়েছে।”

 

কথাটা শুনে আমি একেনবাবুকে আমার মার্ডার থিয়োরিটা বললাম। সেটা শুনে একেনবাবু বললেন, “আপনার লজিকগুলো ঠিক আছে স্যার। কিন্তু ইনস্পেকটর ল্যান্ডি একেবারে নিশ্চিত তোশির মৃত্যু হচ্ছে আত্মহত্যা।”

 

“চুরির ব্যাপারটাও কি উনি দেখছেন?”

 

“মনে হয় না স্যার, উনি হচ্ছেন হোমিসাইডের লোক। তবে যারা দেখছে তাদের চিনি। তবু ভাবলাম স্যার, একটু খোঁজখবর করি। মিস্টার নাকাজিমার অনারের প্রশ্নটা তো রয়েছেই, তা ছাড়া স্যার, আমি জানি আপনারা হাসবেন, কিন্তু স্ট্যাম্পের ব্যাপারে আমার একটা উইকনেস আছে।”

 

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, “আপনি হাই স্কুলে স্ট্যাম্প জমাতেন- এই তো? না, আমি মোটেই হাসব না। আর প্রমথ যদি হাসার চেষ্টা করে আমরা দু-জনে মিলে ওর মাথায় ডান্ডা মারব।”

 

“কী যে বলেন স্যার! “

 

কিছুক্ষণ বাদেই প্রমথ ফিরল। ও কিছুই জানত না। সব কিছু শুনে দেখলাম বেশ উত্তেজিত। বলল, “বলুন, কোথায় যেতে চান, সাঁ করে নিয়ে যাব।

 

প্রমথর এক বন্ধু তার হন্ডা সিভিক গাড়িটা প্রমথর জিম্মায় রেখে ছুটিতে গেছে। সেই থেকে আমার টয়োটা টারসেলে আর চড়ছে না। আমার গাড়ি নাকি ঘটর ঘটর করে চলে, আর ওর গাড়ি যায় সাঁ করে।

 

একেনবাবু বললেন, “দাঁড়ান স্যার দাঁড়ান, যাবার আগে কোথায় যাব সেটা তো একটু ভেবে নিই।”

 

প্রমথ বলল, “আপনি বসে বসে ভাবুন, আর চোর সেই সুযোগে মালসমেত হাওয়া হোক। আপনি মশাই বাপির সঙ্গে বড্ড বেশি মিশছেন। জেমস বন্ডের মুভি দেখেননি! এখন অ্যাকশনের প্রয়োজন, ঘরে বসে বাপির মতো অঙ্ক কষা নয়।”

 

আমি বললাম, “এই ব্যাটা, তুই আমার পেছনে লাগছিস কেন?”

 

প্রমথ দেখলাম বেশ মুডে আছে। বলল, “তোরা ভাব, আমি ততক্ষণ রান্না চাপাই। চিকেনের ঝোল আর রাইস। কি বলিস?”

 

বললাম, “ফাইন।”

 

“আমি একটু সাহায্য করি স্যার?”

 

“খেপেছেন! আপনি আমার সর্বনাশ না করে বরং চোরের সর্বনাশ করুন।” একেনবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রমথবাবুকে নিয়ে স্যার পারা গেল না।”

 

প্রমথ তখন হেমন্তের পুরোনো আধুনিক গান ‘অলির কথা শুনে…’ গাইতে গাইতে আলু-পেঁয়াজ কাটতে শুরু করেছে।

 

আমরা যখন ডিনার খাচ্ছি তখন ফোনটা এল। শিরো মাৎসুয়োকা নামে এক ভদ্রলোক একেনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চান। একেনবাবু উঠে বারান্দায় গিয়ে কয়েক মিনিট কথা বলে ফিরে আসতে জিজ্ঞেস করলাম, “ভদ্রলোকটি কে? কী চান?”

 

“তোশির চেনাজানা কেউ হবেন। কী জানি একটা দরকারি কথা আছে, কিন্তু ফোনে বলতে চান না। বললেন কাল সকালে আমরা এক বার ওঁর কাছে আসতে পারব কিনা।”

 

“হঠাৎ আপনাকে ফোন করলেন যে?”

 

“পুলিশের কাছে খবর পেয়েছেন স্যার আমরাও চুরিটা নিয়ে ইনভেস্টিগেট করছি। মনে হয় সেই জন্যেই। যাবেন নাকি স্যার?”

 

“কোথায় থাকেন?”

 

“ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়াতে।”

 

ওয়ালডর্ফ! আমাদের মুখটা হাঁ হয়ে গেল! ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া হচ্ছে নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে নামিদামি হোটেল। ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে দারুণ ধনী!

 

পাঁচ

শিরো মাৎসুয়োকা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি লোকের বয়স ভালো আন্দাজ করতে পারি না। তাও মনে হল সত্তরের কম হবে না। শান্তশিষ্ট ছোটোখাটো মানুষ। বোঝাই যায় খুব বনেদি লোক, আর ভীষণ ভদ্র। আমরা ঢুকে পরিচয় দিতেই উঠে দাঁড়িয়ে বাও করে বসতে বললেন। তারপর আমাদের প্রত্যেকের নাম বার দুই শুনে আস্তে আস্তে ভালো করে উচ্চারণ করলেন। ওঁর উচ্চারণ খুব স্পষ্ট, ইংরেজিতেও একটা আমেরিকান টান আছে। মনে হয় এদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বেশ অনেক দিনের

 

প্রথমেই আমরা কষ্ট করে ওঁর কাছে এসেছি বলে অনেক ধন্যবাদ দিলেন। পুলিশ তাদের কাজ করছে। কিন্তু আমরা যে এগিয়ে এসেছি তোশির সম্মান রক্ষার জন্য সেটা মনে হল ওঁর কাছে ইম্পর্টেন্ট। বার বার বললেন, তোশির মতো সৎ, কর্মঠ, ভদ্র ও শ্রদ্ধাশীল লোক পৃথিবীতে বেশি নেই। তার মৃত্যুর পর এইভাবে তার ওপর চুরির অপবাদ আনার মতো অসম্মানজনক কাজ আর কিছুই হতে পারে না। বুঝলাম এখানকার পত্রপত্রিকাগুলোর খবর ওঁর কানে গেছে।

 

“আপনারা টাকার জন্য কোনো চিন্তা করবেন না। আপনাদের কাজ করতে যা টাকা লাগে আমি দেব। অনেক না হলেও কিছু টাকা আমার আছে। এই বয়সে সেটা নিয়ে আমি কীই-বা আর করব।” বলে ওঁর কার্ড আমাদের এগিয়ে দিলেন।

 

একেনবাবু কার্ডটা নিয়ে বললেন, “থ্যাংক ইউ স্যার। তবে কিনা উনি আমাদের বন্ধু ছিলেন। এটুকু করতে না পারলে স্যার আমাদেরই খারাপ লাগবে।”

 

মিস্টার মাৎসুয়োকা আমাদের সবার দিকে এক বার তাকালেন। কথাটা শুনে উনি খুব প্রীত হয়েছেন মনে হল। ধীর স্বরে বললেন, “তোশির বন্ধুভাগ্য দেখছি এদেশেও ভালো ছিল।”

 

আমরা চুপ করে রইলাম।

 

“আপনাদের জন্য একটু চা বলি,” বলে দরজার পাশে দাঁড়ানো পরিচারককে নিজের ভাষায় কী একটা হুকুম করলেন। “আপনাদের জন্য ইন্ডিয়ান টি বললাম। জানি জাপানি চা ভারতীয়রা পছন্দ করে না।”

 

চা শুনে আমার হঠাৎ মনে এল জাপানি টি সেরিমনির কথা। জাপানিদের কাছে চা খাওয়াটা নাকি মস্ত একটা অনুষ্ঠান পর্ব- হাজার তার আদবকায়দা। ইন্ডিয়ান টি বলেই বোধহয় সেরিমনিটা আর হল না। পরিচারকটি দেখলাম দেয়ালের পাশে দাঁড় করানো একটা টেবিলের দিকে এগোচ্ছে। টেবিলে একটা ফুলদানিতে একগুচ্ছ ফুল, আর পাশে দুটো ভারি সুন্দর টি পট আর কয়েকটা কাপ। বুঝলাম আমরা আসব বলে আগেই চায়ের বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে।

 

চা আসার পর তাতে একটা চুমুক দিয়ে মিস্টার মাৎসুয়োকা বললেন, “আমি এতদিন নিউ ইয়র্ক আসতাম দুটো আকর্ষণে- একটা তোশি আরেকটা প্রাইস লস বুদ্ধ। তোশিকে আমি জন্মাতে দেখেছি, আর প্রাইসলেস বুদ্ধের কথা শুনে এসেছি আমার জন্ম থেকে। দুটো আকর্ষণের কোনোটাই আর রইল না।”

 

বুঝলাম বৃদ্ধ মানসিকভাবে বেশ বিধ্বস্ত!

 

মিস্টার মাৎসুয়োকা বলে চললেন, “তোশিকে আর পাব না। সে স্বেচ্ছায় চলে গেছে। কেন অবশ্য জানতে পারলাম না। সে দুঃখ কোনোদিন যাবে না। তবে আমার একমাত্র আশা আপনারা প্রাইসলেস বুদ্ধকে খুঁজে বার করবেন। মরার আগে আমি আরেক বার ওটাকে এসে দেখে যেতে চাই।”

 

আমরা কেউ কিছুক্ষণ কোনো কথা বললাম না। একেনবাবুই প্রথম মুখ খুললেন। বললেন, “আপনি স্ট্যাম্প খুব ভালোবাসেন স্যার?”

 

বৃদ্ধ শুধু একটু তাকালেন। বলার প্রয়োজন নেই, দৃষ্টিতেই উত্তরটা স্পষ্ট। তারপর বললেন, “তোশিকে হাতে ধরে আমিই স্ট্যাম্প চিনতে শিখিয়েছিলাম। ওর অবশ্য জমানোর দিকে ঝোঁক ছিল না। কিন্তু ও ছিল স্ট্যাম্পের জহুরি।”

 

“আপনি নিজে বোধহয় স্যার স্ট্যাম্প জমান।”

 

“তা জমাই, বলতে পারেন ওটাই আমার একমাত্র নেশা।”

 

প্রমথ হঠাৎ দুম করে বলে বসল, “প্রাইসলেস বুদ্ধের দাম পত্রিকায় দেখলাম প্রায় কুড়ি হাজার ডলার! আমি তো ভাবতেই পারি না স্ট্যাম্পের দাম এত হয় কী করে!”

 

প্রমথটা একটা গাড়ল। যে ভদ্রলোক প্রাইসলেস বুদ্ধ এত ভালোবাসেন, তার সামনে কথাটা এভাবে কখনো বলা উচিত!

 

মিস্টার মাৎসুয়োকা অবশ্য খুব শান্তভাবেই উত্তর দিলেন, “স্ট্যাম্পের দাম সব আমাদের মনে। আপনি কুড়ি হাজারের কথা বলছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে দামি স্ট্যাম্প হল ব্রিটিশ গায়ানার ওয়ান সেন্ট ম্যাজেন্টা। এক মিলিয়ন ডলার- সেও প্রায় এক যুগ আগের দাম।”

 

“মাই গড!” আমি বললাম, “কে এত টাকা দিয়ে কিনল?”

 

মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, “কেউ জানে না।”

 

উত্তরটা শুনে আমি অবাক! এক মিলিয়ান ডলার খরচা করে একজন স্ট্যাম্পটা কিনেছে, কিন্তু কেউ তার নাম জানে না— এটা কি একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা?

 

আমার মনের ভাবটা বুঝতে পেরে মিস্টার মাৎসুয়োকা বললেন, “স্ট্যাম্পের জগতে এগুলো আকছার হয়। কালেক্টাররা নিজেদের নাম গোপন রেখে এজেন্টদের দিয়ে নিলামে স্ট্যাম্প কেনেন। কিনে সেগুলোকে সিন্দুকে বন্ধ করে রাখেন। এইভাবে কত ভালো ভালো স্ট্যাম্প সবার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।”

 

এইরকম খ্যাপামির কারণ ঠিক বুঝলাম না। কারণ কিছু যদি থেকেও থাকে সেটা আর জানা হল না। তার আগেই প্রমথ প্রশ্ন করল, “ওয়ান সেন্ট ম্যাজেন্টার আর কোনো কপি নেই? “

 

“না। সবাইকে এখন ওটার ছবি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।”

 

“প্রাইসলেস বুদ্ধের কি কোনো কপি আছে স্যার?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

 

মিস্টার মাৎসুয়োকা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “শুধু একটাই থাকার কথা, কিন্তু আজও আমি খুঁজে পাইনি।”

 

“সেটাও কি স্যার কেউ কিনে লুকিয়ে রেখেছেন?”

 

“যদ্দূর মনে হয়, না। ওটা কোনোদিনই নিলামে ওঠেনি।”

 

“আমি কিন্তু স্যার একটু কনফিউজড,” একেনবাবু বললেন।

 

“কেন বলুন তো?”

 

“আপনি স্যার বলছেন স্ট্যাম্পের আরেকটা কপি ছিল। কী করে আপনি এত শিওর হলেন?”

 

“তার কারণ স্ট্যাম্পের অন্য কপিগুলো আমাদের সম্রাটের আদেশে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।”

 

এবার শুধু একেনবাবু নয়, আমরা সবাই কনফিউজড!

 

“বুঝতে পারছি কথাটা শুনে আপনারা খুব অবাক হচ্ছেন। কারণ প্রাইস লস বুদ্ধের ইতিহাসটা আপনারা কেউ জানেন না,” কথাটা বলে মিস্টার মাৎসুয়োকা চায়ে আরেকটা চুমুক দিলেন।

 

ইতিহাসটা কী— সেটা আর আমাদের জিজ্ঞেস করতে হল না। উনি নিজেই আরম্ভ করলেন, “আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে আমাদের মহামান্য সম্রাট একটা স্ট্যাম্প তৈরি করার আদেশ দেন যাতে বুদ্ধের মুখ আঁকা থাকবে। সেটা সৃষ্টি করার দায়িত্ব পড়ে আকিরা কোবায়াশি নামে একজন বিখ্যাত শিল্পী ও এনগ্রেভারের ওপর। তখনকার দিনে অনেক স্ট্যাম্পই তৈরি হত এনগ্রেভ প্রিন্টিং করে।”

 

“এনগ্রেভ প্রিন্টিং কী স্যার?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

 

“এক ধরনের ছাপার পদ্ধতি। এ দিয়ে খুব সূক্ষ্ম কাজের নকশা সৃষ্টি করা যায়, যা নকল করা প্রায় দুঃসাধ্য।”

 

“কীভাবে এটা করা হয় স্যার?” আবার একেনবাবুর প্রশ্ন। গল্পটা বার বার থামছে দেখে প্রমথ দেখলাম বিরক্ত হচ্ছে।

 

“আমি সেটা খুব ভালো জানি তা নয়। আমার যেটুকু জ্ঞান তা হল, একটা লোহার পাতে খোদাই করে এনগ্রেভার প্রথমে ছাপার নকশাটা তৈরি করে। তারপর সেটাতে কালি লাগিয়ে কাগজে ছাপ দেওয়া হয়।”

 

আমি অবশ্য এনগ্রেভ প্রিন্টিং-এর ব্যাপারটা জানতাম। এদেশের ডলারের নোটগুলো সব এনগ্রেভ প্রিন্টিং করা। সেই সূত্রেই কোথায় জানি এ নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম। বৃদ্ধ একটু সরলীকরণ করেছেন বলে সেটাকে বিশদ করতে যাচ্ছি— প্রমথ খাঁটি বাংলায় ধমক লাগাল, “তুই চুপ করবি? বিদ্যে-জাহির একটু পরেই না হয় করিস।”

 

মিস্টার মাৎসুয়োকা বিজাতীয় ভাষায় কচকচি শুনে একটু থতমত খেয়ে প্রমথ দিকে তাকালেন। প্রমথ নিমেষে গলার সুর পালটে বলল, “বলুন, যা বলছিলেন।”

 

বৃদ্ধ এদিকে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। বললেন, “কী জানি বলছিলাম?”

 

“প্রাইসলেস বুদ্ধের কথা।” প্রমথ মনে করিয়ে দিল।

 

“ও হ্যাঁ। কোবায়াশি তাঁর সূক্ষ্ম আঁচড়ে বুদ্ধের যে মুখটা সৃষ্টি করলেন শিল্পের দিক থেকে তা তুলনাহীন, কিন্তু যেটা তিনি ভুলে গেলেন, সেটা হল নীচে স্ট্যাম্পের দাম লিখতে। শিল্পী মানুষ- এসব ছোটোখাটো জিনিস তাঁর পক্ষে মনে রাখা সম্ভব নয়। এদিকে এনগ্রেভিংটা শেষ করার পর পরই কোবায়াশির মৃত্যু হল। ওঁর মৃত্যুর পর স্ট্যাম্পটা যখন প্রথম ছাপা হল, দেখা গেল তাতে কোনো দাম লেখা নেই। দামহীন স্ট্যাম্প বাজারে ছাড়লে সমস্যা হবে এই ভেবে সম্রাট স্ট্যাম্পগুলো এবং ছাপার পাত, দুটোই ধ্বংস করার হুকুম দিলেন। সব কিছুই ধ্বংস হল, শুধু দুটো স্ট্যাম্প কোবায়াশির ছেলেকে দেওয়া হয়েছিল তার বাবার শেষ সৃষ্টি বলে। স্ট্যাম্পে কোনো প্রাইস দেওয়া নেই, তাই নাম হয়ে গেল ‘প্রাইসলেস বুদ্ধ’। দুটোর মধ্যে একটার খবর স্ট্যাম্প জগতের লোকেরা জানে। নানা হাত ঘুরে সেটা নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামে আসে। অন্যটা যে কোথায় এখনও রহস্য। মাঝে মাঝে খবর পাওয়া যায় কেউ না কেউ সেটা পেয়েছে। কিন্তু প্রতি বারই ধরা পড়ে গেছে সেগুলো জাল।

 

“অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং স্টোরি!” একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন।

 

“আরেকটু চা দিতে বলি?” মিস্টার মাৎসুয়োকা আমাদের অনুমতি চাইলেন।

 

আমরা একবাক্যে বললাম, “হ্যাঁ।” প্রথমত চা-টা উপাদেয়, তার ওপর এই বৃদ্ধের সঙ্গ। মিস্টার মাৎসুয়োকা নিঃসন্দেহে একজন ভেরি ইন্টারেস্টিং ম্যান।

 

দ্বিতীয় পর্ব চা আসার পর, মিস্টার মাৎসুয়োকা বললেন, “আপনারা নিশ্চয় অবাক হচ্ছেন কেন আপনাদের এত তাড়াহুড়ো করে ডেকেছি?”

 

সত্যি কথা বলতে কী, আমি সেটা ভুলেই মেরে দিয়েছিলাম। বোধহয় ওঁর কথাগুলো শুনতে এত ভালো লাগছিল যে আর কিছু শোনার থাকতে পারে সেটা ভাবিনি। একেনবাবু বললেন, “তা একটু হয়েছি, স্যার।”

 

“তাড়াহুড়োর কারণ হল আজ বিকেলেই আমি টোকিও ফিরে যাচ্ছি। তবে এটা ঠিক শুধু এগুলো বলার জন্যে আপনাদের ডাকিনি। যদিও স্ট্যাম্পের ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে আমি যা আনন্দ পাই আর কিছুতে তা পাই না।” বৃদ্ধ একটু দম নিলেন। আবহাওয়াটা হঠাৎ যেন একটু থমথমে হয়ে গেল। বৃদ্ধ চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললেন, “একটা খবর মনে হল আপনাদের জানানো দরকার। যদিও জানি খবরটা একসময় না একসময় আপনারা পেতেন, কিন্তু সেটা পেয়ে আপনাদের হয়তো ভুল ধারণা হত।”

 

“খবরটা কী স্যার?”

 

“আমি নিজে বহুদিন ধরে প্রাইসনেস বুদ্ধের খোঁজ করছি। মানে দ্বিতীয় কপিটার। এবার আসার আগে খবর পেয়েছিলাম নিউ ইয়র্কে এক ডিলারের কাছে নাকি ওটা আছে। তাই এসেই তোশিকে ওটার খোঁজ করতে বলি।” কথাটা বলে বৃদ্ধ একমুহূর্তের জন্য থামলেন। মুখ দেখেই বুঝলাম ভেতরের একটা বেদনা উনি চাপার চেষ্টা করছেন। “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, “ বৃদ্ধ বলে চললেন, “স্ট্যাম্পটা অদৃশ্য হওয়ার খবরটা শুনে আমার খালি মনে হচ্ছে স্ট্যাম্পের এই অদৃশ্য হবার সঙ্গে তোশির মৃত্যুর কোনো যোগ আছে কিনা। এটা আমাকে কী ব্যথা দিচ্ছে তা আপনাকে বোঝাতে পারব না। কিন্তু আমি কিছুতেই দুটোকে মেলাতে পারছি না।”

 

আমার খুব খারাপ লাগল। মনে হল এ দুটোর সঙ্গে হয়তো কোনো যোগই নেই, অথচ কী ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন বৃদ্ধ!

 

“তোশির সঙ্গে আপনার শেষ কথা কবে হয় স্যার?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

 

“বুধবার। কিন্তু ফোনে। আমি হিউস্টনে গিয়েছিলাম একটা কাজে। সোমবার সকালে ফিরেছি।”

 

“তখন স্ট্যাম্প নিয়ে কি কোনো কথা হয়েছিল?”

 

“হ্যাঁ। তোশি বলে যার কাছে স্ট্যাম্পটা আছে বলে শুনেছে সে নাকি বাইরে। শুক্রবারের আগে সে ফিরবে না। আমি ওকে বলি যে করে হোক আমাকে স্ট্যাম্পটা জোগাড় করে দিতেই হবে। আমি এই মঙ্গলবারই ওটা সঙ্গে করে টোকিও নিয়ে যেতে চাই। ও একটু ইতস্তত করছিল— এত দামি স্ট্যাম্প, একটু ভালো করে দেখে-শুনে তো নিতে হবে! ব্যস, এইটুকুই। হিউস্টন থেকে এখানে আসার আগে ওকে আমি ফোন করি। তখন পুলিশ ফোন ধরে জানায় তোশি আর নেই।”

 

“স্ট্যাম্প ডিলারটির নাম কি আপনাকে উনি বলেছিলেন?”

 

“না। তবে হতে পারে যে লোকটি ভারতীয়। কারণ তোশি মনে হচ্ছে বলেছিল বুদ্ধের দেশের লোক।”

 

নির্ঘাত ভারতীয়। কারণ তোশি সবসময়ই ভারতীয়দের বুদ্ধের জ্ঞাতি বলতেন। তাহলে কি মিস্টার মেহেতার কাছে স্ট্যাম্পটা আছে?

 

ছয়

কলেজ থেকে ফিরে দেখি প্রমথর সঙ্গে একেনবাবু আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখে বললেন, “ভাগ্যিস এসে গেলেন স্যার, নইলে আপনাকে ছাড়াই যেতে হত।”

 

“কোথায় যাবার কথা বলছেন?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

 

“মিস্টার মেহেতার কাছে স্যার। ওঁর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছেন প্রমথবাবু। প্রাইসলেন বুদ্ধের ব্যাপারটাতে যদি একটু এগোনো যায়— আর সেইসঙ্গে আমার স্ট্যাম্পটা…”

 

প্রমথ তৎক্ষণাৎ সাবধান করল। “শুনুন মশাই, আপনি যদি ফের ওই স্ট্যাম্পের কথা তোলেন, তাহলে আমি যাচ্ছি না।”

 

একেনবাবু বোধহয় একটু ঘ্যানঘ্যানানির প্ল্যান করছিলেন, প্রমথ সেটা অঙ্কুরে বিনাশ করার জন্যে বলল, “না, আমি সিরিয়াসলি বলছি। নো মোর হাই স্কুল স্ট্যাম্প বিজনেস।”

 

“ঠিক আছে স্যার, ঠিক আছে।” একেনবাবুর গলার একটু অভিমানের সুর।

 

মোহন মেহেতার ট্র্যাভেল এজেন্সিতে আমি বার কয়েক গেছি কিন্তু ওঁর এই দোকানটাতে আগে কখনো ঢুকিনি। দোকানটা একই বিল্ডিং-এ। তিন তলায় একটা বড়ো ঘর জুড়ে। বাইরে পেতলের ফলকে লেখা ‘মেহেতা স্ট্যাম্প অ্যান্ড কয়েন কোম্পানি।” কাচের শোকেসে নানা দেশের টাকাপয়সা আর স্ট্যাম্প সাজানো। একদিকে দেয়াল ঘেঁষে একটা বড়ো সাইজের ডেস্ক। তার সামনে কিছু চেয়ার। একটু দূরে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো মস্ত বড়ো একটা ভল্ট। শোকেসের জিনিসগুলো যে খেলো তা নয়, কিন্তু অনুমান করলাম সত্যিকারের মূল্যবান যা কিছু তা নিশ্চয়ই ওই ভল্টের মধ্যেই রাখা।

 

মোহন মেহেতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। “আসুন, আসুন,” বলে অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর একেনবাবুকে দেখিয়ে বললেন, “ইনি তো সেদিন জানতে পারলাম সিরিয়াস স্ট্যাম্প কালেক্টর, আপনাদেরও স্ট্যাম্পের ব্যাপারে উৎসাহ আছে নাকি?”

 

“না,” প্রমথ জবাব দিল। “আমরা এসেছি শুধু ওঁকে সঙ্গ দিতে।

 

“ভালো করেছেন, এই যে এখানে সবাই বসুন,” বলে ডেস্কের সামনে আমাদের নিয়ে গেলেন। বসার পর মিস্টার মেহেতা আগ্রহ নিয়ে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “এবার বলুন, কীসে আপনার ইন্টারেস্ট?”

 

“আমি ঠিক শিওর নই, স্যার,” একেনবাবু বললেন। আসলে তোশির মৃত্যুটা নিয়ে আমি একটু কনফিউজড।”

 

উত্তরটা মিস্টার মেহেতা মনে হয় একেবারেই কল্পনা করেননি। বিস্ময়টা চেপে বললেন, “শুধু আপনি কেন মিস্টার সেন, আমরা সবাই কনফিউজড। হি ওয়াজ এ জেম অফ এ চ্যাপ!”

 

“রাইট স্যার। ভালো ভালো লোকেরাই কেমন জানি চট করে চলে যান…” বলে একেনবাবু আচমকা থেমে গেলেন।”

 

মিস্টার মেহেতা কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর বললেন, “আপনি নিশ্চয় ঠিক এ-কথাটা বলার জন্য এত দূর আসেননি?”

 

“না স্যার,” স্বীকার করলেন একেনবাবু। “আমি যে কেন এসেছি, আমার নিজেরই গুলিয়ে যাচ্ছে স্যার। এই প্রাইসলেস বুদ্ধের ব্যাপারটাই ধরুন— এটাও কি কম কনফিউজিং?”

 

“প্রাইসলেস বুদ্ধ মানে মিউজিয়াম থেকে চুরির ঘটনাটা বলছেন?”

 

“এক্সাক্টলি স্যার!”

 

“এর মধ্যে কনফিউশনের কী আছে?” মিস্টার মেহেতা বেশ বিস্মিত

 

“না, মানে মিস্টার তোশির এই আকস্মিক মৃত্যু, আর প্রায় একইসঙ্গে চুরি…। যাক গে স্যার। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমি এসেছিলাম খোঁজ নিতে আপনার কাছে প্রাইসলেস বুদ্ধের কি কোনো কপি আছে?”

 

প্রশ্নটা শুনে মিস্টার মেহেতা একটু গম্ভীর হলেন। “তা আছে,” বলে যোগ করলেন, “ওটা কিন্তু মিউজিয়াম থেকে চুরি করা নয়।”

 

“কী যে বলেন স্যার, ছি ছি! আমি সেটা ভেবে বলিনি। আসলে আমার প্রশ্ন করা উচিত ছিল মিস্টার তোশি ওঁর মৃত্যুর আগে আপনার কাছে স্ট্যাম্পটার খোঁজে এসেছিলেন কিনা।”

 

“আপনি কোত্থেকে খবর পেয়েছেন জানি না, কিন্তু খবরটা ঠিক।” মিস্টার মেহেতা বললেন, “তোশি স্ট্যাম্পটা খোঁজ করেছিলেন।”

 

“ব্যাপারটা কি একটু খুলে বলবেন স্যার?”

 

“বিশদ করে বলার মতো কিছুই নেই। তোশি আমাকে কয়েক দিন আগে ফোন করে জানান ওঁর পরিচিত একজন ভদ্রলোক প্রাইসলেস বুদ্ধের খোঁজ করছেন, আমি স্ট্যাম্পটা বিক্রি করতে রাজি আছি কিনা। আমি বললাম, উচিত দাম পেলে নিশ্চয় বিক্রি করব- কেনা-বেচাই তো আমার ব্যাবসা।”

 

“কবে উনি ফোন করেছিলেন স্যার?”

 

“কবে? দাঁড়ান একটু ভাবি। শনিবার? রাইট, শনিবার সকালে।”

 

“তারপর?”

 

“প্রথমে কথা ছিল তোশি আমার এখানে স্ট্যাম্পটা দেখতে আসবেন সন্ধে আটটা নাগাদ। আটটার একটু আগে আমি দোকানে এসে আনসারিং মেশিনে তোশির মেসেজ পাই, উনি কোবাই রেস্টুরেন্টে যাচ্ছেন, আমিও যেন সেখানে যাই।

 

“কোবাই কোথায় স্যার?”

 

“ঠিক কোথায় বলতে পারব না। এটুকু জানি হোবোকেনে। তোশি অবশ্য ডিরেকশনটা মেসেজে রেখেছিলেন, বেশ ঘুরপথ। তবে আমার আর যাওয়া হয়নি।”

 

“সেকি স্যার, পথ হারালেন নাকি?”

 

“না, না, তা নয়। আসলে বেরোতে গিয়েই গাড়িটা গড়বড় শুরু করল। তখন কোবাইয়ে ফোন করে বলি তোশি এলে ওঁকে জানাতে আমি দোকানে ওঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকব— উনি যেন চলে আসেন।”

 

একেনবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “আচ্ছা স্যার, মিস্টার তোশির এখানে আসার কথা ছিল… হঠাৎ না এসে আপনাকে কোবাইয়ে যেতে বললেন কেন?”

 

“এর সঠিক উত্তর আমার জানা অসম্ভব। তবে আমি জানি তোশি কোবাইয়ে খেতে খুব ভালোবাসতেন। আমি কোনোদিন জাপানি রেস্টুরেন্টে যাইনি শুনে বলেছিলেন একদিন ওখানে নিয়ে গিয়ে আমাকে খাওয়াবেন।”

 

“উনি কি কোবাই থেকে আপনার এখানে আসেন?”

 

মিস্টার মেহেতা একটু চুপ করে রইলেন। “না, ওঁর সঙ্গে আমার আর দেখা বা কথা হয়নি।”

 

“উনি কোবাই থেকে আপনাকে ফোন করেননি?”

 

“যদি করেও থাকেন, কোনো মেসেজ রাখেননি। আমি বেশ কিছুক্ষণ এখানে ছিলাম না। গাড়িটা মেকানিক সারাচ্ছিল, সেখানেই ঘোরাঘুরি করছিলাম।”

 

“আপনি এখানে আবার কখন আসেন স্যার?”

 

“তা প্রায় সাড়ে আটটা।”

 

“আপনি শিওর মিস্টার তোশি এর মধ্যে আপনার এখানে আসেননি?”

 

“তোশি যা ডিরেকশন দিয়েছিলেন তাতে এখান থেকে কোবাই অন্তত চল্লিশ মিনিটের পথ। আমি নিশ্চিত উনি আসেননি।”

 

“আপনি কি জানেন স্যার উনি কোবাইয়ে গিয়েছিলেন কিনা?”

 

“না, আমার কোনো ধারণাই নেই। সেটা জানা কি খুব ইম্পর্টেন্ট মিস্টার সেন?” মিস্টার মেহেতা এবার যেন একটু বিরক্ত হয়েছেন মনে হল।

 

“ইউ আর রাইট স্যার। ভালোকথা, তোশি কি জানিয়েছিলেন কে আপনার প্রাইসলেস বুদ্ধ কিনতে চান?”

 

“না।”

 

“তাহলে আমিই আপনাকে খবরটা দিয়ে দিই স্যার। ভদ্রলোকের নাম মিস্টার মাৎসুয়োকা। আজ সকালেই আলাপ হল। মনে তো হল ওঁর এখনও খুব ইন্টারেস্ট ওটা কেনার।”

 

“তাই নাকি?” মিস্টার মেহেতার মুখটা এবার উজ্জ্বল হল।

 

“উনি বোধহয় স্যার অলরেডি প্লেনে- জাপানে যাবার পথে। যাই হোক, আমার কাছে ওঁর ঠিকানাটা আছে। আপনাকে আমি দিয়ে দেব।”

 

“বাঃ, তাহলে তো খুব ভালো হয়। থ্যাংক ইউ।”

 

“কী যে বলেন স্যার। আপনি হচ্ছেন দেশের লোক, এটুকু না করলে কি হয়!”

 

প্রমথ বলল, “স্ট্যাম্পটা বিক্রি হলে এঁকে না হয় একটু কমিশন দিয়ে দেবেন।

 

মিস্টার মেহেতা কথাটা শুনে হেসে ফেললেন, “নিশ্চয় দেব।”

 

একেনবাবু ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছেন, “স্যার, আপনার স্ট্যাম্পের কালেকশন কিছু দেখতে পারি?”

 

“নিশ্চয়, আসুন।” বলে শোকেসের সামনে নিয়ে গিয়ে আমাদের ঘুরে ঘুরে স্ট্যাম্প দেখাতে লাগলেন। শোকেসের স্ট্যাম্পগুলো শুনলাম খুব দামি নয়, তাও কিছু কিছুর দাম পাঁচশো ডলারের ওপরে! তার মধ্যে একটা স্ট্যাম্প দেখে একেনবাবু দারুণ উত্তেজিত। “স্যার, এটা তো হাওয়াইয়ান মিশনারি সিরিজের!”

 

মিস্টার মেহেতা মুচকি হাসলেন। “ঠিক ধরেছেন। কিন্তু এটা সেরকম দামি নয়!”

 

“সে কী স্যার, আমি তো শুনেছিলাম ওগুলোর দাম হাজার হাজার ডলার!”

 

“আপনি ভাবছেন হাওয়াইয়ান মিশনারির দু-সেন্টের নীল স্ট্যাম্পটার কথা।”

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সেটার দাম কত?”

 

“তা প্রায় সাড়ে তিনশো হাজার ডলারের মতো হবে।”

 

“মাই গড!”

 

প্রমথ সবজান্তার মতো মুখ করে বলল, “এত অবাক হচ্ছিস কেন, ব্রিটিশ গায়ানার ওয়ান সেন্ট ম্যাজেন্টা তো এক মিলিয়ান ডলার।”

 

“ঠিক বলেছেন,” মাথা নাড়লেন মিস্টার মেহেতা। “আপনি মনে হচ্ছে স্ট্যাম্পের খবর কিছু কিছু রাখেন।”

 

আমার এক বার ইচ্ছে করল প্রমথর জ্ঞানের রহস্যটা ফাঁস করে দিই। কিন্তু দিলাম না। তার বদলে মিস্টার মেহেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কাছে কি সেই দু-সেন্টের স্ট্যাম্পটা আছে?”

 

“খেপেছেন, অত টাকা কোথায় পাব? তা ছাড়া যে স্ট্যাম্প নিয়ে খুনখারাবি পর্যন্ত হয়েছে- ওর মধ্যে আমি নেই!”

 

“খুনখারাবি?” আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

 

“সে কি, আপনি জানেন না?”

 

“না।”

 

“তাও তো বটে, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম স্ট্যাম্পে আপনার ইন্টারেস্ট নেই।

 

আমি বললাম, “এই ভয়েই কি ওয়ান সেন্ট ম্যাজেন্টা যিনি কিনেছেন তিনি তাঁর নাম কাউকে জানাননি?”

 

“এ খবর আপনাদের কে দিল?”

 

“মিস্টার মাৎসুয়োকা। কেন খবরটা কি ভুল?”

 

“না, ভুল নয়। তবে নাম লুকিয়ে স্ট্যাম্প কেনার উদ্দেশ্যটা অন্য।”

 

“কী উদ্দেশ্য?”

 

“এতে স্ট্যাম্প নিয়ে একটা রহস্য সৃষ্টি হয়, ফলে সেই স্ট্যাম্প সম্পর্কে লোকের আগ্রহটা বাড়ে। স্ট্যাম্পের তো আলাদা কোনো দাম নেই। লোকের ইন্টারেস্ট যত বেশি হবে, স্ট্যাম্পের দাম ততই বাড়বে। ওয়ান সেন্ট ম্যাজেন্টার কথাই ধরুন না। ওটা কোথায় কেউ জানে না, তাই ওটা পাওয়ার জন্য সবাই পাগল! ওটা যদি এখন নিলামে ওঠে, দেখবেন কত লোক বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে সেখানে হাজির হবে।”

 

ইন্টারেস্টিং। মিস্টার মেহেতার কথাটা সত্যি ভাবার মতো। এঁকেই বলে ব্যবসায়ী বুদ্ধি!

 

“প্রাইসলেস বুদ্ধটা তো স্যার দেখলাম না,” একেনবাবু বললেন।

 

“ওটা আমি বাইরে রাখি না। আমার দামি স্ট্যাম্পগুলো সব ওই ভল্টে। আজ ভল্টটা খুলতে পারব না। চাবি বাড়িতে ফেলে এসেছি। আরেক দিন আসবেন, দেখাব।”

 

সাত

পরদিন কলেজে আমার ঘরে বসে খাতা দেখছি, সমর এল। বলল, “খবর শুনেছিস?”

 

“খবর! কী খবর?”

 

“সেদিন বিভাসদার বাড়িতে আগুন লাগার কারণ জানা গেছে। ঘটনাটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়, আসন।”

 

“হোয়াট?”

 

“হ্যাঁ। কেউ এক তলায় পেট্রোল ঢেলে দেশলাই জ্বালিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।”

 

“কেন?”

 

“সেটা পরিষ্কার নয়। তবে ইন্সিয়োরেন্সের টাকার জন্য হওয়ার চান্সটাই বেশি। এক তলায় যে ইটালিয়ান বইয়ের দোকানটা ছিল, সেটা একদমই চলছিল না। কিন্তু দামি দামি বই দোকানে নাকি অনেক ছিল। তাই পুলিশ সন্দেহ করছে ওর মালিকই সম্ভবত কীর্তিটি করেছে। আগুনে নষ্ট হয়ে গেছে বলে বইগুলোর পুরো দাম এখন ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানিকে দিতে হবে।”

 

“মাই গড! কিন্তু এটা তো শুধু আগুন লাগানো নয়, এটা তো মার্ডার!”

 

“মার্ডারটা অ্যাক্সিডেন্ট, কারণ বিভাসদার বাড়ি থাকার কথা ছিল না। আমরা সবাই জানতাম উনি বস্টন যাচ্ছেন।”

 

“তুই বলছিস দোকানের মালিক সেটা জানত?”

 

“শিওর। বিভাসদার সঙ্গে লোকটার প্রায়ই কথা হত।”

 

“তার মানে বিভাস চৌধুরী নেই ভেবেই আগুনটা জ্বালানো হয়েছিল?”

 

“আই থিংক সো। তবে লোকটা নিজে বোধহয় জ্বালায়নি। কারণ পুলিশের খবর হল শুক্রবার বিকেল থেকেই দোকানের মালিক মেয়ের কাছে উইকএন্ড কাটাতে গিয়েছিল। মেয়ে থাকে লং আইল্যান্ডে!”

 

“তুই এত কথা কার কাছ থেকে শুনলি?”

 

“আমাদের ডিন বলছিলেন। পুলিশ আর ফায়ার ডিপার্টমেন্টে অনেকের সঙ্গে ওঁর চেনাশোনা। তাদের কারোর কাছ থেকেই নিশ্চয় জেনেছেন। একেনবাবুকে একটু বল না, উনি নিশ্চয় আরও খোঁজখবর আনতে পারবেন।”

 

“তা বলব। কিন্তু কী আশ্চর্য বল তো, বিভাস চৌধুরী বস্টন চলে গেলে এভাবে মৃত্যুটা ঘটত না!”

 

“ঠিক। শুক্রবার সকালেও বিভাসদার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তখন পর্যন্ত তো না যাবার কোনো সম্ভাবনার কথা শুনিনি!”

 

বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখি একেনবাবু খুব মন দিয়ে ‘The World Encyclo- pedia of Stamps’ পড়ছেন। আমি একটু ঠাট্টা করে বললাম, “কী ব্যাপার, আপনি যে প্রাইসলেস বুদ্ধের খোঁজ করতে গিয়ে ছোটোখাটো রিসার্চ শুরু করে দিয়েছেন?” একেনবাবু বইটা মুড়ে রেখে বললেন, “ফ্যাসিনেটিং বই স্যার, মনটাকে একেবারে ধরে রাখে!

 

“তা বুঝলাম। কিন্তু স্ট্যাম্প থেকে মনকে সরিয়ে এবার আপনাকে আরেকটা জিনিসের খোঁজ করতে হবে।” ওঁকে সমরের খবরগুলো জানাতে যাচ্ছি, দেখলাম ইতিমধ্যেই সব কিছু ওঁর কানে পৌঁছেছে। শুধু পৌঁছোনো নয়, উনি স্যাল বেত্রো- যিনি সেই ইটালিয়ান বইয়ের দোকানের মালিক, তাঁর সঙ্গে কথাও বলে এসেছেন।

 

“স্যাল বেত্রোকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেনি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“না না স্যার, অ্যারেস্ট করবে কেন! একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেছে শুধু। আসলে স্যার এদেশে দোকানে আগুন লাগলে সন্দেহ জাগে মালিকের ওপরে। তবে এক্ষেত্রে মোটিভটা স্ট্রং নয়।”

 

“এটা কেন বলছেন?”

 

“কারণ ভদ্রলোকের দোকানটার দরকার ছিল, টাকার নয়।”

 

“তার মানে?”

 

“মিস্টার বেত্রোর বয়স প্রায় সত্তর। কোটিপতি মানুষ। নিউ ইয়র্ক শহরেই ওঁর তিন-তিনটে বাড়ি। বইপাগল লোক, বইয়ের দোকানটাই ছিল ওঁর একমাত্র নেশা। সেই জন্য আর কাউকে না পাঠিয়ে উনি নিজে প্রতিদিন ওখানে এসে বসতেন।”

 

“তাহলে আগুনটা লাগাল কে?”

 

“সেটা একটা পাজল স্যার। পুলিশের থিয়োরি হল এটা মিস্টার বেত্রোর কোনো শত্রুর কাজ। মিস্টার বেত্রোকে আজ যা দেখলাম, তাতে সেই শত্রুর খুবই আনন্দ হওয়ার কথা। ভদ্রলোক খুব ভেঙে পড়েছেন। বইয়ের শোক তো বটেই, তা ছাড়া বিভাস চৌধুরীকেও ভদ্রলোক খুব পছন্দ করতেন মনে হল।”

 

“আপনি পুলিশের থিয়োরির কথা বললেন। আপনার নিজের কোনো থিয়োরি আছে?”

 

“না স্যার। আমার মনে হয়, এটাই এখন পর্যন্ত বেস্ট থিয়োরি। তবে কিনা মানুষ আগেও আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।”

 

“কথাটা একটু বুঝিয়ে বলবেন? আপনিও তো দেখছি রহস্যের সৃষ্টি করছেন?”

 

“না, মানে স্যার এই মিস্টার বেত্রোর কথা ভাবছিলাম। ভালোকথা, প্রমথবাবুকে দেখছি না!”

 

প্রমথ বহু বছর বাঁচবে। একেনবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই ও ঘরে ঢুকল। আবার আমাদের একপ্রস্থ আলোচনা হল। প্রমথ একটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট তুলল। আগুনটা নাকি লেগেছিল ন’টা নাগাদ। তখন নিশ্চয় বিভাস চৌধুরী ঘুমোতে যাননি। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন না কেন?

 

এঁর সত্যিকারের উত্তর আমরা কেউই জানি না। তবে প্রথমেই ধরে নেওয়া হয়েছে বিভাস চৌধুরী জেগেছিলেন, সেটা সত্যি নাও হতে পারে। তা ছাড়া যদি অনেক পেট্রোল ঢালা হয়ে থাকে, তাহলে বাড়ির কাঠ আর বইয়ের কাগজ- এই তিনটের কম্বিনেশনে আগুন একেবারে দাউদাউ করে উঠেছিল। আচমকা চারদিকে ওরকম আগুন দেখলে মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। কী করণীয় বুঝতে বুঝতেই পালাবার সময়টুকু তিনি হয়তো হারিয়েছিলেন।

 

একেনবাবু হঠাৎ উঠে একটা ফোন করলেন। যাঁকে ফোন করলেন তিনি নেই, তাই অ্যানসারিং মেশিনে দেখলাম মেসেজ রাখছেন। “একেন্দ্র সেন বলছি স্যার, বাপিবাবু আর প্রমথবাবুর বন্ধু। একটা কথা কালকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম, আপনার যদি এঁর মধ্যে সময় হয়…” মেসেজটা বোধহয় শেষ করার সময় পেলেন না! আমাদের দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে বললেন, “যাঃ স্যার, কানেকশানটা কেটে গেল।”

 

“কাকে ফোন করছিলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“মিস্টার মেহেতাকে। কিন্তু অ্যানসারিং মেশিন হঠাৎ কানেকশনটা কেটে দিল স্যার!”

 

“আপনার গলার স্বর বোধহয় পছন্দ হয়নি,” প্রমথ টিপ্পনী কাটল।

 

“টাইমিংটা কম করে সেট করা আছে আর কি।” আমি বললাম।

 

অ্যানসারিং মেশিনের মেসেজ রাখার টাইমগুলো কম-বেশি করে সেট করা যায়। একেনবাবুর মতো অবস্থা আমারও আগে হয়েছে। মেসেজ শেষ করার আগেই কাট।

 

একেনবাবু মাথা চুলকোচ্ছেন দেখে প্রমথ বলল, “কী এমন হাতি-ঘোড়া খবর দেওয়ার দরকার ওঁকে?”

 

“আপনি শুনলে রাগ করবেন স্যার।”

 

“আপনার সেই স্ট্যাম্প?” প্রমথ কড়া স্বরে প্রশ্ন করল।

 

“আসলে গিন্নিকে ওটা পাঠাতে বলেছি,” একটু কাঁচুমাচু মুখে একেনবাবু বললেন। “হয়তো কিছুই পাওয়া যাবে না। তবে মিস্টার মেহেতা লাইনের লোক, একটু যদি চেষ্টা করে দেখেন।”

 

প্রমথ একেনবাবুর কথাগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, “চল বাপি, রান্না শুরু করি।”

 

আট

নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামে তোশির রাইট হ্যান্ড ম্যান ছিলেন জন ট্র্যাভার্স নামে একজন লোক। তোশির মৃত্যুর পর উনিই এখন ফিলাটেলি সেকশনটা দেখাশোনা করছেন। তোশির কাছেই ওঁর নামটা শুনেছিলাম, কিন্তু আলাপ-পরিচয় হয়নি। একেনবাবু যখন হঠাৎ বললেন, “চলুন স্যার, মিস্টার ট্র্যাভার্সের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।” আমি একটু অবাকই হলাম। “কেন বলুন তো, আপনি কি এই চুরিতে উনিও যুক্ত বলে সন্দেহ করছেন নাকি?”

 

“না না, স্যার। তবে কিনা কথায় কথায় দু-একটা জিনিস বেরিয়ে পড়তে পারে যেটা নিয়ে আমরা হয়তো কিছুই ভাবিনি।”

 

প্রমথ খুব মন দিয়ে ফ্রি-তে পাওয়া কমিউনিটি নিউজপেপার থেকে স্টোর-কুপন কাটছিল। কুপন কাটা থামিয়ে একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “গোয়েন্দামশাই মনে হচ্ছে এবার একটু হাবুডুবু খাচ্ছেন, তাই খড়কুটো যা পাচ্ছেন সেটাই ধরার চেষ্টা করছেন?”

 

“তা একটু খাচ্ছি স্যার। আসলে খুনি ধরা সহজ, চোর ধরা অনেক কঠিন।”

 

“তা যাওয়াটা কখন হবে?”

 

“আপনাদের সবার যখন সুবিধা। আমি সেইমতো মিস্টার ট্র্যাভার্সকে ফোন করব।”

 

ঠিক হল বিকেল তিনটে নাগাদ যাব। আমার তখন ক্লাস নেই। প্রমথ বলল ওই সময় ওরও ল্যাব ফাঁকি দিতে কোনো অসুবিধে নেই। এরপর অবশ্য সব নির্ভর করছে মিস্টার ট্র্যাভার্সের ওপর- ওঁর তখন সময় থাকবে কিনা।

 

.

 

আমরা আড়াইটে নাগাদ কলেজ থেকে রওনা দিলাম। পথে মিস্টার মেহেতার ট্র্যাভেল এজেন্সি পড়ে। সেখানে গাড়িটা থামানোর জন্য একেনবাবু একটু বায়না ধরেছিলেন। কিন্তু কারণটা জানি বলে আমি আর প্রমথ পাত্তা দিলাম না। তা ছাড়া এইসময় ওখানে পার্কিং পাওয়া খুব কঠিন। ভাগ্যিস থামিনি, না থেমেও গাড়ির ভিড়ে মিউজিয়ামে পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় তিনটেই বাজল।

 

জন ট্র্যাভার্স আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লম্বা-পাতলা চেহারার শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। চোখে মোটা লেন্সের চশমা। উশকোখুশকো ব্লন্ড চুল কপালের ওপর এসে পড়েছে। জিনস, স্নিকার, টিশার্ট… একেবারে অ্যানথ্রোপলজিস্ট মার্কা চেহারা। ঘরটা তোশির। মাস তিনেক আগে যেরকম দেখেছিলাম, ঠিক সেরকমই আছে। শুধু তোশি নেই। কেমন একটু অদ্ভুত লাগল।

 

কিছু কিছু আমেরিকান আছে যাদের ব্যবহার এত সুন্দর আর স্বচ্ছ, অল্পক্ষণের মধ্যেই মনে হয় বহুদিনের চেনা। খেয়ালও হয়নি কখন ‘হ্যালো’, ‘হাউ আর ইউ’ ছেড়ে আড্ডা মারতে শুরু করেছি! জনও তোশির মতো বিদগ্ধ। অনেক দেশ ঘুরেছেন। ভারতবর্ষ সম্পর্কেও দেখলাম প্রচুর জ্ঞান। গল্পগুজবের ফাঁকে একেনবাবু প্রাইসলেস বুদ্ধের কথা তুললেন। জন দুঃখ করে বললেন চুরিটা মিউজিয়ামের পক্ষে কী প্রচণ্ড ক্ষতিকর! বলতে গেলে একটা ইতিহাস প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া। একেনবাবু তখন বললেন, “কেন স্যার, মিস্টার মেহেতার কাছে তো স্ট্যাম্পের একটা কপি আছে, সেটা কিনলেই তো হয়!”

 

“হ্যাঁ, তা অবশ্য হয়।” কথাটা সায় দিয়েই বলা, কিন্তু উৎসাহের অভাবটা স্পষ্ট।

 

“মনে হচ্ছে স্যার, এটাতে একটু কিন্তু কিন্তু আছে?”

 

“আপনি ঠিকই ধরেছেন। আসলে এসব ব্যাপারে একাধিক সমস্যা। প্রথমত, ইন্সিয়োরেন্স থাকলেও প্রাইসলেস বুদ্ধের ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে পেতে বহুদিন লাগবে। শেষ পর্যন্ত যখন পাওয়া যাবে, তখন তা দিয়ে মিস্টার মেহেতার স্ট্যাম্প কিনতে পারা যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ। তা ছাড়া আমরা তো চোখ বুজে কোনো স্ট্যাম্প কিনতে পারি না। অথেন্টিসিটি, মানে আসল-নকল বিচারের ব্যাপারও আছে।”

 

“সেটা কি খুব বড়ো সমস্যা স্যার?”

 

“কীসের কথা বলছেন, অথেন্টিসিটি?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“সেটা সব সময়েই সমস্যা। আর্ট বলুন, স্ট্যাম্প বলুন, অ্যান্টিক বলুন, সব কিছুতেই এত জালজোচ্চুরি!” কথাটা বলেই জন যোগ করলেন, “আমি অবশ্য মিস্টার মেহেতা সম্পর্কে কিছু বলছি না।”

 

“না না, স্যার, আমি বুঝতে পারছি।”

 

“দাঁড়ান, একটা মজার জিনিস দেখাই,” বলে জন দুটো ডলার নোট ড্রয়ার থেকে বার করলেন। “একটু দেখে বলুন তো কোনটে আসল আর কোনটে নকল?”

 

আমরা তিন জনই নোট দুটো নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম। দেখতে হুবহু এক। এমনকী নোট দুটো ছুঁলেও মনে হয় একই ধরনের টেক্সচার! প্রথমে আমিই স্বীকার করলাম আমার সাধ্যি নেই তফাত বোঝার। প্রমথও পারল না। একেনবাবু বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে অবশেষে হাল ছাড়লেন।

 

জন তখন একটা বড়ো ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে নোট দুটোর ডান কোনায় একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, “দেখুন তো এটা দিয়ে কোনো তফাত দেখতে পান কিনা?”

 

ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর আমরা সবাই আবিষ্কার করলাম কয়েকটা জায়গায় দাগের রকমফের আছে।

 

একেনবাবু বললেন, “তফাতটা তো বুঝতে পারছি স্যার, কিন্তু কোনটে আসল?”

 

জন ম্যাগনিফাইং গ্লাস ধরে একটু দেখে বললেন, “এইটে।”

 

একেনবাবু দুটো নোট আবার হাতে নিয়ে বললেন, “অ্যামেজিং স্যার। চোখে আঙুল দিয়ে তফাতটা না দেখিয়ে দিলে কিছুই বুঝতে পারতাম না। এখনও খালি চোখে বুঝছি না।”

 

আড্ডা দিতে দিতে বিকেল পার হয়ে গেল। কথার ফাঁকে একেনবাবু জনকে টুক করে জিজ্ঞেস করলেন মিউজিয়াম থেকে স্ট্যাম্প চুরি করা খুব কঠিন কিনা।

 

“খুবই কঠিন। দিনের বেলায় সবসময় ঘরে গার্ড পাহারা দিচ্ছে। বিকেলে মিউজিয়াম বন্ধ করার আগে প্রত্যেকটা এক্সিবিট ভালো করে চেক করা হয়। তারপর দরজায় চাবি পড়ে।”

 

“কিন্তু রাত্রে যদি কেউ চাবি খুলে ঢোকে?”

 

“মিউজিয়ামের মধ্যে ঢুকলে লাভ হবে না। কারণ প্রত্যেকটা ঘরে আলাদা ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি আছে। সিকিউরিটি কোড ঠিকমতো না টিপে ঘরে ঢুকলেই অ্যালার্ম বাজবে।”

 

“কোডগুলো কারা জানেন স্যার?”

 

“স্ট্যাম্প সেকশনের কোডটা আমি জানি। আর জানেন মিউজিয়াম-সিকিউরিটির যিনি হেড।”

 

“আপনি যে চেক করার কথা বলছিলেন, সেটা কারা করেন স্যার?”

 

“সাধারণত সেকশনের ভার যাঁর ওপর তিনিই করেন। এখন যেমন স্ট্যাম্পের সেকশনটা আমি করছি।”

 

“কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি যা বর্ণনা করলেন, তাতে মনে হচ্ছে প্রাইসলেস বুদ্ধ তোশি নিজে ছাড়া আর কেউই সরাতে পারেন না।”

 

কথাটাতে জন ট্র্যাভার্স একটু অসন্তুষ্ট হলেন। “আপনি তোশিকে বোধহয় ভালো করে চিনতেন না, তাই কথাটা বলছেন। আমি বলেছি চুরি করাটা কঠিন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে অসম্ভব!”

 

ফেরার পথে একেনবাবু জোরজার করে আমাদের থামিয়ে মিস্টার মেহেতার অফিসে গেলেন। আমি আর প্রমথ কেউই গাড়ি থেকে নামলাম না। কিন্তু অনেকক্ষণ আসছেন না দেখে শেষ পর্যন্ত তাড়া দিতে নামতে হল। মিস্টার মেহেতার মুখে দেখলাম একটু চাপা হাসি। বুঝলাম একেনবাবুর স্ট্যাম্পের ব্যাখ্যান শেষ হয়েছে।

 

আমাকে দেখেই একেনবাবু বললেন, “আমার হয়ে গেছে স্যার, চলুন।”

 

আমি মিস্টার মেহেতাকে হাত নেড়ে বললাম, “চলি।”

 

একেনবাবু দরজার দিকে হাঁটা দিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “একটা কথা স্যার, আপনি শিওর যে তোশি আপনাকে সেদিন এক বারই ফোন করেছিলেন?”

 

সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ বলেই বোধহয় মিস্টার মেহেতার কথাটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। তারপর বললেন, “হ্যাঁ, কেন বলুন তো?”

 

“আমার কেন জানি মনে হল স্যার, দু-বার ফোন করেছিলেন।”

 

“হোয়াই?”

 

“কে জানে স্যার, মাথাটা এত গুলিয়ে যাচ্ছে আজকাল। যাক গে, তার মানে আপনি ওঁর একটা মেসেজই পেয়েছিলেন?”

 

“রাইট।”

 

“যেটাতে আপনাকে উনি কোবাইয়ে যেতে বলেছিলেন?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“ক’টা নাগাদ মেসেজটা পেয়েছিলেন স্যার?”

 

“আটটার একটু আগে। আপনাকে তো আমি কালকেই এটা বলেছি!” মিস্টার মেহেতা শুধু হতভম্ব নন, একটু বিরক্তও।

 

“বলেছিলেন কি স্যার? ও, তাহলে ঠিক আছে। থ্যাংক ইউ স্যার।” বলে একেনবাবু আবার হাঁটা দিলেন।

 

মিস্টার মেহেতা এমনভাবে একেনবাবুর পেছনে তাকালেন যেন একটা অর্ধোন্মাদ দর্শন করছেন। তার জন্য অবশ্য আমি ওঁকে দোষ দিতে পারি না!

 

নয়

একেনবাবু আজ সকাল থেকে একটু অন্যমনস্ক। প্রমথ বলল, “কী ব্যাপার বলুন তো মশাই, এত চিন্তা কীসের?”

 

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, মিস্টার চৌধুরীর বাড়িতে কে আগুন লাগিয়েছে সেটা ধরা পড়ল?”

 

প্রমথ বলল, “অবাক করলেন মশাই, থানা-পুলিশ তো আপনার ডিপার্টমেন্ট। আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

 

“কী যে বলেন স্যার, এটা তো ফায়ার ব্রিগেডের ইনভেস্টিগেশন। এই ব্যাপারটা নিয়ে সমরবাবু অনেক খোঁজখবর রাখেন, আর সমরবাবু আপনার খুব বন্ধু বলে কথাটা মনে হল।”

 

“তা রাখে। কিন্তু আপনার হঠাৎ আগুন নিয়ে মাথাব্যথা কেন?”

 

“নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে স্যার। চুরির ব্যাপারটা নিয়ে এত মাতামাতি করছি। এদিকে মিস্টার চৌধুরী আগুনে পুড়ে মারা গেলেন… আমি না চিনলেও আপনাদের তো পরিচিত। কী হল, না হল…।”

 

আমি ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “অত না ভেবে একটা ফোন করুন না পুলিশ স্টেশনে। আপনার তো কানেকশনের অভাব নেই— ওরা নিশ্চয় জানবে।”

 

“তা করা যায় অবশ্য।” কথাটা বললেন বটে, কিন্তু চেয়ার থেকে উঠলেন না। “আসলে স্যার পুলিশের ধারণা, মিস্টার চৌধুরীর মৃত্যুটা অ্যাক্সিডেন্ট।”

 

কথাটা আগেও ওঁর কাছে শুনেছি, তাই অবাক হলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “কেন, আপনার ধারণা অন্য কিছু নাকি?”

 

“কে জানে স্যার।”

 

প্রমথ বলল, “দাঁড়ান মশাই, দাঁড়ান। পুলিশের বিশ্বাস স্যাল বেত্রোর কোনো শত্রু এই অপকর্মটা করেছে। এতে তো আমি অন্যায্য কিছু দেখছি না। ওরকম একটা টাকাওয়ালা লোকের একাধিক শত্রু থাকা সম্ভব। তাদের কেউ না কেউ নিশ্চয় আগুন লাগাতে পারে।”

 

“তা পারে স্যার।”

 

“তাহলে?”

 

একেনবাবু একটু মাথা চুলকোলেন।

 

আমি প্রমথকে বললাম, “আরেকটা পসিবিলিটি তুই চিন্তা করছিস না।”

 

“সেটা আবার কী?”

 

“ধর, এটা কোনো বিকারগ্রস্ত লোকের কীর্তি। কিছুদিন আগে ডেট্রয়েটে এরকম একটা লোক ধরা পড়ল না? অকারণে অনেকগুলো বাড়িতে আগুন লাগিয়েছিল বলে!”

 

“আরেকটা সম্ভাবনাও কিন্তু আছে স্যার। মানে জাস্ট সম্ভাবনা হিসেবে।”

 

“ঝেড়ে কাশুন।”

 

“যদি ভাবা যায় কেউ মিস্টার চৌধুরীকে মারার জন্যই আগুন লাগিয়েছিল।”

 

“কী যা-তা বকছেন মশাই। বিভাস চৌধুরী কি মাফিয়ার লোক না সিক্রেট এজেন্ট যে এরকমভাবে খুন হবেন?”

 

“কী যে বলেন স্যার, আপনারা সম্ভাবনার কথা তুলছেন বলে আমিও একটা যোগ করলাম আর কি।”

 

প্রমথ এতে সন্তুষ্ট হল না। “দেখুন মশাই, প্রোবাবিলিটি আর পসিবিলিটি বলে দুটো কথা আছে। আপনি যা বলছেন তা নিশ্চয়ই পসিবল। কিন্তু প্রোবাবল নয়।”

 

“তা মানছি স্যার।” বলে একেনবাবু চুপ করে গেলেন।

 

এমন সময় একেনবাবুর একটা ফোন এল। উচ্চারণটা এশিয়ান। এই জন্য বলছি যে চাইনিজ, জাপানি বা কোরিয়ান – সবার উচ্চারণই আমার প্রায় একরকম লাগে। ফোনে কয়েক মিনিট কথা বলে একেনবাবু ফিরে এসে বললেন, “না স্যার, মিস্টার মেহেতা ঠিকই বলেছিলেন।”

 

জিজ্ঞেস করলাম, “কী ঠিক বলেছিলেন?”

 

“মানে মিস্টার তোশির কোবাই রেস্টুরেন্টে যাবার কথা। যে ফোনটা এল, সেটা কোবাইয়ের মালিকের। মিস্টার তোশি ওখানে সাড়ে আটটা নাগাদ পৌঁছেছিলেন। সেখানে মিস্টার মেহেতার মেসেজ পেয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যান।”

 

আমি একটু অবাক হলাম। “আপনার তাতে কোনো সন্দেহ ছিল নাকি?”

 

“না না স্যার, সন্দেহ কেন?” তারপর বললেন, “আচ্ছা স্যার মিস্টার তোশির বাড়ি এখান থেকে কত দূর হবে?”

 

“পত্রিকায় তো পড়েছিলাম লং আইল্যান্ডে, সেক্ষেত্রে অন্তত এক ঘণ্টার পথ। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

 

“বলছি স্যার। আগে একটা ফোন করে আসি।” বলে আবার অদৃশ্য হলেন।

 

প্রমথ বলল, “নাঃ, লোকটা দেখছি একেবারেই খেপে গেছে!”

 

মিনিট কয়েকের মধ্যেই একেনবাবু ফিরে এলেন। “এই যে স্যার, আমার সঙ্গে একটু আসবেন?”

 

আমরা দু-জনেই অবাক। “কোথায়?”

 

“আসুন না স্যার, আপনারা বড্ড প্রশ্ন করেন।”

 

সাধারণত প্রমথ এরকম আবদারে ধমক লাগায়। আজ কিচ্ছু না বলে সোজা জুতো-মোজা পরতে শুরু করল। আমারও কেমন মনে হল ব্যাপারটা সিরিয়াস তাই রেডি হয়ে নিলাম।

 

দশ

মিস্টার মেহেতা ফাইল ক্যাবিনেট খুলে কীসব জানি ঘাঁটছিলেন। আমাদের দেখে খুবই অবাক। “কী ব্যাপার?”

 

“আসলে স্যার এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, “ ঘাড়টা বাঁ-হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে একেনবাবু বললেন। “হঠাৎ একটা প্রশ্ন মনে এল। ভাবলাম আপনার কাছে এসে একটু ক্লিয়ার করেই যাই। খুব ডিস্টার্ব করলাম কি স্যার?”

 

ফাইল ক্যাবিনেটটা আস্তে করে বন্ধ করলেন মিস্টার মেহেতা। “আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে মিস্টার সেন, আজ একটু তাড়া আছে।”

 

“জানি স্যার, আপনি হচ্ছেন বিজি ম্যান। আমি একদম সময় নেব না।” বলে একেনবাবু ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।

 

মুখে খালি ‘স্যার’ ‘স্যার’ করলে কী হবে, কার্টসি বস্তুটা যে কী সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই একেনবাবুর নেই। থাকলে হুট করে এভাবে মিস্টার মেহেতার এখানে আসতেন না, আর এরকম অভ্যর্থনা পাওয়ার পর দুম করে এভাবে বসতেন না। বলা বাহুল্য, আমি আর প্রমথ দাঁড়িয়ে রইলাম।

 

ডেস্কের ওপর দু-একটা কাগজ পড়েছিল। সেগুলোকে প্রথমে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে চাবি লাগিয়ে ড্রয়ারটা বন্ধ হয়েছে কিনা পরীক্ষা করলেন মিস্টার মেহেতা। তারপর রিস্টওয়াচটার দিকে এক পলক তাকিয়ে মিস্টার মেহেতা বললেন, “আমার হাতে কিন্তু পাঁচ মিনিটেরও কম সময়। বলুন কী জানতে চান?”

 

একেনবাবু আধবোজা চোখে, কড়ে আঙুল দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন, “সেদিন আপনি বলেছিলেন স্যার, শনিবার সন্ধ্যায় মিস্টার তোশির এখানে আসার কথা ছিল প্রাইসলেস বুদ্ধটা কেনার ব্যাপারে। ঠিক কিনা?”

 

“হ্যাঁ বলেছিলাম।” উত্তরটা দিয়ে মিস্টার মেহেতা আমার আর প্রমথর দিকে তাকালেন, ভাবটা এ কোথাকার উন্মাদ!

 

‘ক’টার সময় ওঁর আসার কথা ছিল স্যার?”

 

“মিস্টার সেন, আপনি এই এক প্রশ্ন আমাকে অন্তত দু-বার আগে করেছেন। দু-বারই আপনাকে আমি উত্তরটা দিয়েছি। আপনি কি আশা করছেন এবার আপনাকে আমি অন্য কোনো উত্তর দেব?”

 

“না, না, তা নয় স্যার। আসলে কতগুলো জিনিস নিয়ে আমার একটু খটকা লাগছে।”

 

“যেমন?”

 

“চট করে ঠিক বোঝাতে পারব না স্যার। কিন্তু মিস্টার তোশির এই আত্মহত্যাটা আমাকে বড়ো ফাঁপরে ফেলেছে।”

 

“কেন মিস্টার সেন, মানুষ কি আত্মহত্যা করে না?” একেনবাবুর চোখে চোখ রেখে মিস্টার মেহেতা প্রশ্নটা করলেন।

 

“না না, তা কেন স্যার, নিশ্চয় করে।”

 

“তাহলে আপনার সমস্যাটা কোথায়? আপনার কি ধারণা তোশি মানুষ নয়?”

 

“আমি বুঝতে পারছি স্যার, আপনি কী বলছেন।” একেনবাবু একটু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন।

 

“না, আপনি বুঝতে পারছেন না।” গলাটা বেশ কঠোর করে বললেন মিস্টার মেহেতা। “বুঝতে পারলে একটা সাধারণ আত্মহত্যাকে আপনি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস বানিয়ে তুলতেন না। আপনি নিজের সময় নষ্ট করছেন, তার থেকেও বড়ো কথা আমার সময় নষ্ট করছেন।”

 

“আই অ্যাম সরি স্যার।” কথাটা একেনবাবু বললেন বটে কিন্তু চেয়ার থেকে উঠলেন না। বরং আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বসুন না স্যার, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

 

প্রমথ বোধহয় যাচ্ছেতাই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আমি চোখ পাকিয়ে ওকে সামলালাম।

 

“আপনি যদি আরেকটু ধৈর্য ধরেন স্যার, আমার মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন‍ই বাকি আছে।” মিস্টার মেহেতাকে বললেন একেনবাবু।

 

এরপরও যে একেনবাবুর কোনো প্রশ্ন বাকি থাকবে মিস্টার মেহেতা সেটা বোধহয় কল্পনাও করেননি। একেনবাবুর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কোনো কথা না বলে দেয়ালে বসানো ভল্টটার দিকে এগিয়ে গেলেন।

 

“প্রশ্নগুলো করি স্যার? কথা দিচ্ছি, জাস্ট দু-মিনিট।”

 

হাতল ঘুরিয়ে ভল্টটা ঠিকমতো বন্ধ কিনা পরীক্ষা করতে করতে নীরস গলায় মিস্টার মেহেতা বললেন, “করুন।”

 

“থ্যাংক ইউ স্যার,” একেনবাবু বললেন। “হ্যাঁ, যেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল….. আমার এখন বেশ মনে পড়ছে আপনি বলেছিলেন মিস্টার তোশির আটটা নাগাদ এখানে আসার কথা ছিল। কিন্তু আপনি এও বলেছিলেন, আটটার একটু আগে দোকানে এসে আপনি অ্যানসারিং মেশিনে একটা মেসেজ পান যে উনি এখানে না এসে কোবাইয়ে যাচ্ছেন। কোবাইয়ে যাবার ডিরেকশনটাও উনি আপনার জন্য রেখেছিলেন।”

 

“দ্যাটস রাইট।” মিস্টার মেহেতা ফিরে এসে ওঁর ডেস্কে ঠেসান দিয়ে কথাটা বললেন।

 

“আপনি আরও বলেছিলেন স্যার, উনি একটাই মেসেজ রেখেছিলেন।”

 

“সেটা আমি এখনও বলছি।”

 

“আপনি কি স্যার আপনার অ্যানসারিং মেশিনটা পালটেছেন বা ওটাতে কিছু চেঞ্জ করেছেন?”

 

একেনবাবুর কি মাথাখারাপ হল? এবার শুধু মিস্টার মেহেতা নয়, আমি আর প্রমথও অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে আছি।

 

“না, কিন্তু তাতে আপনার কোনো আপত্তি আছে?” মিস্টার মেহেতার গলায় শ্লেষের ভাবটা পরিষ্কার।

 

“না স্যার। তবে কিনা ব্যাপারটা এতে আরও কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল।”

 

“তার মানে?”

 

“মানে স্যার, আমি আপনার অ্যানসারিং মেশিনে সেদিন একটা মেসেজ রাখার চেষ্টা করলাম। নিজের নাম আর মাত্র কয়েকটা কথা বলতে না বলতেই কানেকশন কেটে গেল। আমি তো স্যার কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। বাপিবাবু পরে আমাকে বললেন, মেসেজ বক্সে মেসেজ রাখার টাইম নাকি আগে থেকেই সেট করা যায়। তাই আমি বুঝতে পারছি না অত বড়ো মেসেজ মিস্টার তোশি কী করে আপনার অ্যানসারিং মেশিনে রাখলেন?”

 

দেখা গেল মিস্টার মেহেতা বেশ হতচকিত। কিন্তু সামলে নিলেন। “এগুলো হচ্ছে মাইনর ডিটেল মিস্টার সেন। তোশি মেসেজ রেখেছিল, সেটা তো ভুল নয়। একটা না দুটো, তাতে কী এসে যাচ্ছে? আপনার যদি সন্দেহ থাকে তাহলে কোবাইয়ে খোঁজ করুন না। তারা নিশ্চয় জানাতে পারবে তোশি ওখানে গিয়েছিল কিনা।”

 

“আমি খোঁজ নিয়েছি স্যার। মিস্টার তোশি ওখানে গিয়েছিলেন। আপনার ফোনের কথাও ওঁরা বলেছেন।”

 

“তাহলে?”

 

“শুধু একটাই খটকা স্যার। সেটা হল মিস্টার তোশি আপনাকে যেতে বলেছিলেন, না আপনি মিস্টার তোশিকে যেতে বলেছিলেন।”

 

“আপনার এই ছোটোখাটো খটকাগুলোর বিহিত কিন্তু আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়, মিস্টার সেন। আপনার আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?”

 

“না স্যার, থ্যাংক ইউ।” একেনবাবু চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন।

 

একেই বোধহয় বলা যায় বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া। মন বলছিল একটা বড়ো কিছু ঘটবে। কিন্তু কোথায় কী? করলেন খামোখা কতগুলো অসংলগ্ন প্রশ্ন—যার প্রত্যেকটা উত্তর সবার জানা। সত্যি! একেনবাবুর কি মাথাখারাপ হল? এভাবে এসে বোকার মতো প্রশ্ন করে নিজেকেই তো ছোটো করলেন! প্রমথর মুখ দেখলাম অসম্ভব গম্ভীর। ওকে চিনি। এখান থেকে বাইরে যাওয়ামাত্র একেনবাবুকে ও তুলোধোনা করবে।

 

আমরা বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রথমে প্রমথ, তারপর আমি, একেবারে শেষে একেনবাবু। হঠাৎ একেনবাবু থেমে গেলেন। ঘাড় ঘষতে ঘষতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “ও হ্যাঁ স্যার, আরেকটা কথা। এটা কিন্তু আপনার পক্ষে খুবই সুখবর।

 

“সুখবর?” মিস্টার মেহেতা ঠিক বুঝলেন না একেনবাবু কী বলতে চান। “হ্যাঁ স্যার। খবর পেলাম নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামের প্রাইসলেস বুদ্ধটা আসলে জাল ছিল।” গলাটা একটু চাপা করে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথাটা বললেন একেনবাবু।

 

মিস্টার মেহেতার ভুরুটা কোঁচকাল। “তার মানে?”

 

“মিস্টার মাৎসুয়োকার সঙ্গে কথা হচ্ছিল স্যার। শিরো মাৎসুয়োকা। চেনেন তো ওঁকে?”

 

“কী কথা হচ্ছিল?” মিস্টার মেহেতা মনে হল একটু উদ্বিগ্ন।

 

“এই প্রাইসলেস বুদ্ধের কথা। ওঁর আবার এ ব্যাপারে একটু অবসেশন আছে কিনা। ওল্ড ম্যান স্যার, কিন্তু এখনও স্ট্যাম্পটা পাবার আশা ছাড়েননি। জাপান থেকে ফোন করেছিলেন। আপনার কথা অবশ্য ওঁকে আমি বলেছি। ওয়ান্ডারফুল ম্যান স্যার। স্ট্যাম্পের ইতিহাস একেবারে গুলে খেয়েছেন— ওশন অফ নলেজ। কিন্তু স্যার দাম্ভিকতা নেই।”

 

“আঃ, কথাটা কী হচ্ছিল বলবেন তো!” এবার আর উদ্বিগ্নতা চেপে রাখতে পারলেন না মিস্টার মেহেতা।

 

“ও, হ্যাঁ স্যার। উনি একেবারে নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছেন যে প্রাইসলেস বুদ্ধটা জাল। মানে আপনারটা নয়- নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামেরটা।”

 

“দ্যাটস ননসেন্স!”

 

“না স্যার, আজই আমার সঙ্গে ওঁর কথা হয়েছে। আসলে প্রাইসলেস বুদ্ধের এনগ্রেভ প্রিন্টিং-এর মাস্টার প্লেটটা নাকি পাওয়া গেছে। সেটার একটা ছাপ দেখে উনি বুঝতে পেরেছেন।”

 

“কী বুঝতে পেরেছেন?” মেহেতার চোখে একটা অবিশ্বাসের ভাব।

 

“ব্যাপারটা হল স্যার, মিস্টার মাৎসুয়োকা প্রাইসলেস বুদ্ধ ভালোবাসেন বলে মিস্টার তোশি তার খুব ভালো একটা ছবি তুলে ওঁকে উপহার দিয়েছিলেন। এটা কিন্তু কেউ জানে না স্যার। ব্যাপারটা পুরোপুরি আন-অফিসিয়াল। মিস্টার তোশি কাউকে না জানিয়েই ছবিটা তুলেছিলেন। যাই হোক উনি যখন মারা গেছেন তখন লোকে জানলেই-বা কী এসে গেল—ঠিক কিনা স্যার? তবে ছবিটা একেবারে দারুণ! মিস্টার মাৎসুয়োকার দুধের স্বাদ অন্তত ঘোলে মিটেছে।” কথাটা বলে একেনবাবু আচমকা কেমন জানি থেমে গেলেন।

 

“তারপর কী?”

 

“হ্যাঁ স্যার, সেই ছবিটার সঙ্গে এনগ্রেভিং প্লেটের ছাপটা উনি মিলিয়ে দেখেছেন। সবগুলোই ঠিক শুধু বুদ্ধের মুখের কয়েকটা আঁচড়ে একটু গণ্ডগোল আছে! অবশ্য আপনার তাতে ভালোই হল স্যার। াের এখন বমাল ধরা পড়লে আপনার স্ট্যাম্পটা সেই অদ্বিতীয়ই থেকে যাচ্ছে!”

 

একেনবাবুর শেষ কথাতে মিস্টার মেহেতার উৎফুল্ল হবার কথা কিন্তু উনি কীরকম জানি মিইয়ে গেছেন।

 

“একটা অনুরোধ আছে স্যার।”

 

“কী?”

 

“আপনার প্রাইসলেস বুদ্ধটা কি এক বার দেখতে পারি?”

 

“কেন?”

 

“একটা জিনিস একটু পরীক্ষা করতাম স্যার।”

 

“কী পরীক্ষা করবেন?” মিস্টার মেহেতা একটু সচকিত।

 

“মিস্টার মাৎসুয়োকা বুদ্ধের থুতনির নীচে একটা খুব ছোট্ট দাগের কথা

 

বলেছেন, সেটা মিউজিয়ামের স্ট্যাম্পটাতে নেই— সেই দাগটা কীরকম সেটা একটু দেখতাম স্যার।”

 

মিস্টার মেহেতা বললেন, “স্ট্যাম্পটা এখানে নেই।” গলাটা মনে হল একটু কেঁপে গেল।

 

“কোথায় আছে স্যার?”

 

“আমার বাড়িতে।”

 

“অত দামি স্ট্যাম্প স্যার, এখানে আপনার ভল্টে না রেখে বাড়িতে রেখেছেন?”

 

“কেন তাতে আপনার কোনো আপত্তি আছে?” মিস্টার মেহেতা বেশ রূঢ়ভাবে কথাটা বললেন।

 

“না, তা নয় স্যার, তবে ব্যাপারটা একটু কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল।”

 

“কমপ্লিকেটেড?”

 

“তার মানে এখন আমাকে আপনার বাড়ি যেতে হবে স্ট্যাম্পটা দেখতে।”

 

“আর ইউ ম্যাড মিস্টার সেন?”

 

“কেন স্যার?”

 

“কেন সেটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? আপনার সমস্যাটা কী? কেন আপনি এভাবে আমার সময় নষ্ট করছেন?”

 

“না স্যার, আপনাকে ফাঁকি দেবার উপায় নেই। বরং সত্যি কথাটাই বলি। আসলে আমার একটু সন্দেহ হচ্ছে।”

 

“সন্দেহ, কীসের সন্দেহ?”

 

“আমার মনে হচ্ছে স্যার আপনি স্ট্যাম্পটা আমাকে দেখাতে চান না।”

 

“ওহ গড, হোয়াট ননসেন্স!”

 

“না স্যার, সিরিয়াসলি বলছি। আপনি বোধহয় ভয় পাচ্ছেন পাছে কিছু আবিষ্কার হয়ে যায়।”

 

“ভয় পাব কেন? কী আবিষ্কার হবে, আমি কি স্ট্যাম্পটা চুরি করেছি?” মিস্টার মেহেতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

 

কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎ একটা সিগারেট ধরালেন একেনবাবু। “ব্যাড হ্যাবিট স্যার, এখনও ছাড়তে পারলাম না।” কথাটা বোধহয় আমাদের সবার উদ্দেশেই বললেন।

 

মিস্টার মেহেতার ইতিমধ্যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। ডেস্কে একটা কিল মেরে বললেন, “চুলোয় যাক আপনার হ্যাবিট, আমার প্রশ্নের জবাব দিন!

 

সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে একেনবাবু বললেন, “শুধু চুরি নয় স্যার, আমার ধারণা তার থেকে অনেক বড়ো অপরাধ আপনি করেছেন। বিভাস চৌধুরী আগুনে পুড়ে মারা যাননি। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, আর হত্যাকারী হচ্ছেন আপনি।”

 

হোয়াট! প্রমথ আর আমি অবাক হয়ে দু-জনে দু-জনের দিকে তাকাচ্ছি। একেনবাবুর এই মূর্তি আমি আগেও দেখেছি। চোখে-মুখে একটা গভীর আত্মপ্রত্যয়। উনি জানেন উনি যা বলছেন তার থেকে বড়ো সত্য আর কিছু হতে পারে না। এদিকে মিস্টার মেহেতার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি যে কোনো মুহূর্তে প্রলয় ঘটবে। ওঁর সারা শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে, চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোচ্ছে। আমার তো ভয়ই করছে লাফিয়ে উঠে রোগাপটকা একেনবাবুর টুটি না টিপে ধরেন। মিস্টার মেহেতা অবশ্য গামা পালোয়ান নন। আমি আর প্রমথ দু-জনে মিলে ওঁকে কবজা করতে পারব। কিন্তু ডেস্ক-ড্রয়ারে যদি রিভলবার বা ছুরি থাকে! ভাগ্যক্রমে আমি ওঁর থেকে খুব একটা দূরে নয়। দরকার হলে একটা ডাইভ দিয়ে ওঁকে ধরতে পারব। প্রমথও দেখলাম পজিশন নিচ্ছে। শুধু একেনবাবুর কোনো বৈকল্য নেই। স্থির দৃষ্টিতে মিস্টার মেহেতার দিকে তাকিয়ে উনি বলে চললেন, “হ্যাঁ স্যার। আপনি বিভাস চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে হত্যা করে মিউজিয়ামের প্রাইসলেস বুদ্ধটা তুলে নিয়ে আসেন। তারপর অপকর্মটা ঢাকার চেষ্টা করেন ভদ্রলোকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে। গুড প্ল্যান স্যার, ভেরি গুড প্ল্যান। শুধু একটাই সমস্যা। আপনি জানতেন না মিউজিয়ামের ওই স্ট্যাম্পটাও ছিল নকল। এখন আপনার স্ট্যাম্পটা বার করে পরীক্ষা করলেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। ঠিক কিনা স্যার?”

 

একেনবাবু কী মাথামুণ্ডু বলছেন বোঝার আগেই শুনলাম মিস্টার মেহেতার চিৎকার, “গেট আউট! এই মুহূর্তে গেট আউট!”

 

একেনবাবু নড়লেন না। দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে ডাকলেন, “ইনস্পেকটর ল্যান্ডি!”

 

বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়! কখন নিঃশব্দে ইনস্পেকটর তাঁর দলবল নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করিনি।

 

উনি সদলবলে ঘরে ঢুকতেই একেনবাবু বললেন, “আপনার কাছে তো সার্চ ওয়ারেন্ট আছে স্যার, তাই না?”

 

মাথা নাড়লেন ইনস্পেকটর।

 

“চমৎকার স্যার। তাহলে প্রথমে দেখা যাক, প্রাইসলেস বুদ্ধটা ভল্টে আছে কিনা। সেখান থেকে বোঝা যাবে মিস্টার মেহেতা কত দূর সত্যবাদী।”

 

“ভল্টের চাবিটা দিন,” সাড়ে ছ’ফুট লম্বা ইনস্পেকটর ল্যান্ডি মিস্টার মেহেতার একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আদেশ করলেন। মিস্টার মেহেতার মুখটা একেবারে ছাইয়ের মতো সাদা। চেয়ারটা শক্ত করে ধরে আছেন।

 

“চাবিটা!” আরেক বার ধমকে উঠলেন ইনস্পেকটর ল্যান্ডি।

 

পকেট থেকে বার করে চাবিটা দিলেন মিস্টার মেহেতা। ভল্টের দরজাটা যখন খোলা হচ্ছে তখন মিস্টার মেহেতা আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। হাউহাউ করে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করলেন, আর সেইসঙ্গে অসংলগ্ন প্রলাপ, “আমি চাইনি… সত্যিই চাইনি… কিন্তু আমার আর কোনো পথ খোলা ছিল না… বিশ্বাস করুন…।”

 

পুলিশ এখন তাদের কাজ শুরু করবে। আমি আর প্রমথ ওখানে এখন অবাঞ্ছিত। একেনবাবু বাড়ি ফিরলে ওঁর কাছ থেকে শুনতে হবে পুরো বৃত্তান্ত।

 

এগার

আমরা বাড়ি ফেরার মিনিট দশেকের মধ্যেই একেনবাবু ফিরলেন।

 

“আমি সম্পূর্ণ কনফিউজড। ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলুন তো। কী করে আপনি বুঝলেন বিভাস চৌধুরীর মৃত্যুর সঙ্গে প্রাইসলেস বুদ্ধের যোগাযোগ আছে?”

 

প্রমথও সায় দিল। কিন্তু সেইসঙ্গে একটা খোঁচা দিতে ভুলল না। “পয়েন্টগুলো একটু সহজ করে বুঝিয়ে বলবেন যাতে বাপির মাথায় ঢোকে। নইলে পরে লেখার সময় ও উলটোপালটা করে ফেলবে।”

 

“কী যে বলেন স্যার, প্রফেসর মানুষ!”

 

“প্রফেসর হয়েছে বলে কি দিগ্‌গজ হতে হবে নাকি! যাক সে-কথা, এবার বলুন তো চটপট।”

 

একেনবাবু শুরু করলেন। “একটা জিনিস স্পষ্ট স্যার, মিস্টার তোশির মতো ভদ্রলোক প্রাইসলেস বুদ্ধ চুরি করবেন না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে উনি স্ট্যাম্পটা মিউজিয়াম থেকে সরাননি।”

 

“তার মানে?”

 

“বলছি স্যার। মিস্টার মাৎসুয়োকা মিস্টার তোশিকে প্রাইসলেস বুদ্ধের একটা কপি সোমবারের মধ্যে জোগাড় করে দিতে বলেছিলেন। মিস্টার তোশি খবর পেয়েছিলেন মিস্টার মেহেতার কাছে স্ট্যাম্পের একটা কপি আছে। প্রশ্ন হচ্ছে সেটা আসল না নকল। আসল বা নকল ধরার একমাত্র উপায় হচ্ছে জানা আসল স্ট্যাম্পের সঙ্গে সেটাকে মিলিয়ে দেখা। ঠিক কিনা স্যার?”

 

“রাইট,” প্রমথ বলল।

 

আমি বুঝলাম একেনবাবু কোনদিকে এগোচ্ছেন। “তার মানে কি আপনি বলতে চান মিস্টার মেহেতার স্ট্যাম্পটা মিলিয়ে দেখার জন্য মিউজিয়াম থেকে প্রাইসলেস বুদ্ধ কাউকে না জানিয়েই নিয়ে এসেছিলেন তোশি? কিন্তু সেটা তো বেআইনি। তোশি কেন সেটা করতে গেলেন?”

 

“আমারও সেটা মনে হয়েছিল স্যার। কিন্তু মিস্টার তোশির দিকটা বিবেচনা করুন। উনি মিস্টার মাৎসুয়োকাকে বাবার মতো ভক্তি করেন। তাঁর অনুরোধ মিস্টার তোশির কাছে দেবতার আদেশ, সেটা ওঁকে রাখতেই হবে। আর এটা তো ঠিক চুরি করা নয়। মিস্টার তোশি শনিবার সন্ধ্যায় প্রাইসলেস বুদ্ধকে গোপনে মিউজিয়াম থেকে বার করে আনবেন ঠিকই, কিন্তু রাত্রে মিস্টার মেহেতার স্ট্যাম্পটা মেলানো হয়ে গেলেই তো পরদিন মিউজিয়াম খোলার আগেই যথাস্থানে ওটা রেখে আসবেন! কার কী এসে যাচ্ছে তাতে?”

 

“বুঝলাম, তারপর?”

 

“তার পরের খবর আমরা সবাই জানি স্যার। শনিবার রাত্রে মিস্টার তোশি হঠাৎ আত্মহত্যা করলেন। কারণটা কী হতে পারে? প্রাইসলেস বুদ্ধ-কে কি কোনো কারণে উনি হারিয়েছিলেন? সেক্ষেত্রে পরদিন সকালে স্ট্যাম্পটাকে স্বস্থানে রেখে দিতে পারবেন না! এই নিয়ে তদন্ত হবে এবং দোষটা ওঁর ওপরেই পড়বে। চুরির অপবাদ মাথা পেতে নেওয়ার থেকে আত্মহত্যার পথটাই উনি বাছলেন। কিন্তু এটা ভেবেই আমার মনে হল কী করে প্রাইসলেস বুদ্ধ-কে উনি হারালেন? তখনই সম্ভাবনাটা মাথায় এল। মনে আছে স্যার, মিস্টার মাৎসুয়োকা বলেছিলেন, এই স্ট্যাম্পে অনেক সূক্ষ্ম আঁচড়, তার কোনটা ঠিক মিলছে না ধরতে পারা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু মানুষের চোখ যেটা সহজে ধরতে পারে না, কম্পিউটার সেটা পারে স্যার। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল মিস্টার বিভাস চৌধুরীর কথা। বাপিবাবু, আপনিই তো বলেছিলেন উনি কম্পিউটার দিয়ে কঠিন কঠিন প্যাটার্ন মেলাতে পারেন, তাই না?”

 

“দ্যাটস ট্রু।”

 

“এটা মনে আসার পর থেকেই জটগুলো সব খুলতে শুরু করল। আমি ঘটনাগুলোকে পরপর সাজালাম। মিস্টার তোশি নিশ্চয় বন্ধু বিভাস চৌধুরীকে ধরেছিলেন সাহায্য করার জন্য। মিস্টার তোশি নিজে স্ট্যাম্প চেনার জহুরি ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে যদি কম্পিউটারেরও সাহায্য পাওয়া যায়, তাহলে অনেক বেশি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। বন্ধুর অনুরোধে বিভাসবাবু শেষ মুহূর্তে বাইরে যাবার প্ল্যান পালটালেন। এসব জিনিস অবশ্য একটু গোপনেই করতে হবে। কিন্তু তাতে অসুবিধে নেই। আমার মনে পড়ে গেল সমরবাবু বলেছিলেন বিভাস চৌধুরীর বাড়িতেই কম্পিউটারের সব গ্যাজেট থাকত। মিস্টার মেহেতা যখন শুনলেন শুধু মিস্টার তোশি নন, কম্পিউটারও ব্যবহার করা হবে ওঁর স্ট্যাম্পটা যাচাই করার জন্য, তখন তিনি দারুণ ঘাবড়ালেন। ওঁর স্ট্যাম্পটা যে জাল ছিল আমার কোনো সন্দেহ নেই। তবে উনি বোধহয় ভেবেছিলেন চোখের পরীক্ষায় ওটা উতরে যাবে। কিন্তু এখন তো মহা সমস্যা হল। ওঁর জালজোচ্চুরি সব ধরা পড়ে যাবে। আর যাবে এমন একজনের কাছে যাঁর কথায় বড়ো বড়ো স্ট্যাম্প ডিলাররা ওঠে-বসে! উনি নিজে স্ট্যাম্প নিয়ে কারবার করেন, ওঁর কাছে এটা বাস্তবিকই জীবন-মরণ সমস্যা।

 

আটটা নাগাদ ওঁর জাল স্ট্যাম্পটা নিয়ে বিভাস চৌধুরীর কাছে যাবার কথা ছিল। মিস্টার তোশিও ওই সময়েই আসবেন। কম্পিউটারে দুটো স্ট্যাম্প পরীক্ষা করে মেলাতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ হলে, দরদাম নিয়ে কথা হবে। মিস্টার মেহেতা চট করে তাঁর প্ল্যান ঠিক করলেন। মিস্টার বিভাস চৌধুরীকে আটটার একটু আগেই ফোন করে বললেন মিস্টার তোশি আসামাত্র তাঁকে কোবাই রেস্টুরেন্টে পাঠিয়ে দিতে। ঠিক কী অজুহাত দিয়েছিলেন সেটা আন-ইম্পর্টেন্ট। মিস্টার তোশির কোবাইয়ে যাওয়া আর ফিরে আসার মধ্যে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময়। ওই সময়টুকু মিস্টার মেহেতার দরকার ছিল। ধরে নিচ্ছি মিস্টার তোশি কোবাই রেস্টুরেন্টে যাবার আগে মিউজিয়ামের স্ট্যাম্পটা ওঁর বিশেষ বন্ধু বিভাসবাবুর কাছে রেখে গিয়েছিলেন কম্পিউটারে স্ক্যান করে রাখার জন্যে। পরে যাতে মিস্টার মেহেতার স্ট্যাম্পের সঙ্গে ওটা ম্যাচ করানো যায়। মিস্টার তোশি বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ বাদে মিস্টার মেহেতা ওঁর নকল স্ট্যাম্পটা নিয়ে মিস্টার বিভাস চৌধুরীর কাছে গেলেন। বিভাসবাবুকে স্ট্যাম্পটা দিয়ে মিস্টার মেহেতা মিস্টার তোশির স্ট্যাম্পটা দেখতে চাইলেন। অতি সাধারণ একটা অনুরোধ। মিস্টার চৌধুরী সেটা বার করে দেখালেন। সেটাকে হস্তগত করে মিস্টার মেহেতা মিস্টার চৌধুরীকে খুন করলেন…।”

 

“কীভাবে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“আমার বিশ্বাস গলায় ফাঁস লাগিয়ে স্যার, সেটাই সহজ পথ।”

 

“মাই গড।”

 

“লাভ-লোকসানের জন্য মানুষ কী নিদারুণ হিংস্র অমানুষ হতে পারে স্যার কল্পনা করাও কঠিন! যাই হোক, খুন করার পর মিস্টার মেহেতা নিজের নকল স্ট্যাম্পটা ওখানে রেখে মিস্টার তোশির আনা আসল স্ট্যাম্পটা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। …”

 

“বেরিয়ে এসে আগুনটা লাগান, তাই তো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“সেটাই আমার ধারণা স্যার।”

 

“বুঝলাম না, আগুনই যদি লাগালেন… তাহলে ওঁর জাল স্ট্যাম্পটা ওখানে রেখে আসার লজিকটা কী?” প্রমথ প্রশ্ন তুলল।

 

“এটা আমার থিয়োরি স্যার… ফায়ার ব্রিগেড যদি দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলত, তাহলে ওই স্ট্যাম্পটা পুলিশ দেখতে পেত। তারা বুঝত না, ওটা আসল না নকল। এমনকী মিস্টার তোশিও হয়তো বুঝতে পারতেন না। মিস্টার মেহেতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতেন।”

 

“এখন মনে হয় বুঝতে পারছি ব্যাপারটা,” আমি বললাম। “আগুন তো দ্রুত নেভেনি… আর মিস্টার তোশি রাত্রে কোবাই থেকে বিভাস চৌধুরীর বাড়িতে এসে যখন পোড়া বাড়িটা দেখলেন, বুঝতে পারলেন প্রাইসলেস বুদ্ধ আর নেই! ভগ্নহৃদয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করতে নিজেকে হত্যা করলেন। ঠিক কিনা?”

 

“আপনারা তো সব সময়েই ঠিক বলেন স্যার।”

 

.

 

এখানে একটু যোগ করতে হবে, একেনবাবুর প্রাইসলেস বুদ্ধের রহস্য উদ্ঘাটন পুরোপুরি নির্ভুল নয়। মিস্টার মেহেতা খুনি হতে পারেন, কিন্তু আর্সেনিস্ট নন। আগুন যে লোকটা লাগিয়েছিল তাঁর সঙ্গে মিস্টার মেহেতার কোনো সম্পর্কই ছিল না। আর যেহেতু পুরো বাড়িটাই পুড়ে গেছে, জাল স্ট্যাম্পটা ওখানে না রেখে এলেও চলত। তাতে অবশ্য মিস্টার মেহেতার লাভ কিছুই হত না। উনি এখন খুনের আসামি হয়ে জেলে। ওঁর নিজের স্বীকারোক্তি, ভল্ট থেকে উদ্ধার হওয়া মিউজিয়ামের প্রাইসলেস বুদ্ধ, ওঁর করা বা পাওয়া ফোন কলের রেকর্ড ইত্যাদি, ইত্যাদি… সব কিছুই গেছে ওঁর বিপক্ষে।

 

প্রমথর মতে আর্সনিস্টের পরিচয় বার করতে ভুল করে একেনবাবু এই কেসে একশোতে একশো পাননি, সত্তর পেয়েছেন। একেনবাবু অবশ্য খুশি, “পাশ তো করেছি স্যার।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


সূচিপত্র