আইডিয়াল জুয়েলরি (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত

শেয়ার করুনঃ

এক

আজ সকাল থেকেই প্রমথ মারমুখো হয়ে আছে। আমি আর একেনবাবু নাকি অ্যাপার্টমেন্টটাকে আস্তাকুঁড় বানিয়ে ফেলেছি। এদিক-ওদিক কাগজপত্র ফেলার বদভ্যাস আমার আছে ঠিকই, কিন্তু একেনবাবুর তুলনায় আমার অপরাধ নিতান্তই গৌণ। উনি থালা-ভর্তি খাবার শোবার ঘরে নিয়ে যান, খাওয়া শেষ হলে অনেক সময়েই এঁটো থালা কিচেন সিঙ্কে রাখতে ভুলে যান। নোংরা জামাকাপড় লন্ড্রি বাস্কেটে না ফেলে হয় খাটের তলায়, নয় আলমারির কোণে গুঁজে রাখেন। বই নামিয়ে বুক শেলফে তোলেন না। এই রকম নানা অপরাধের মধ্যে যেটা প্রমথকে সবচেয়ে বেশি উত্ত্যক্ত করে, সেটা হল ওঁর আধ-খাওয়া কফির কাপগুলো টেবিলে, মেঝেতে, বুকশেলফে– যত্রতত্র ছড়িয়ে রাখার অভ্যাস।

 

যাইহোক, আজ সকালে আমাদের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে প্রমথ বসার ঘরটাকে ভদ্রস্থ করার কাজে লেগেছে। প্রমথর কাজে আমি নাক গলাই না, কারণ ওর গোছানোর একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, সেটা আবার মাঝে মাঝেই বদলায়। আমি যাই করি না কেন, সেটা ঠিক তখনকার গোছানোর ধারার সঙ্গে মেলে না, ফলে অশান্তি হয়। তাই সোফায় বসে একটা গল্পের বই পড়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তার কি কোনো জো আছে? একেনবাবু অ্যাস ইউয়াল নিউ ইয়র্ক টাইমস খুলে বকবক করে কানের মাথা খাচ্ছেন!

 

“দেখেছেন স্যার, পাকিস্তানের আইএসআই-এর কাণ্ড!”

 

এমনভাবে কথাটা বললেন যে জিজ্ঞেস করতেই হয়, “কী কাণ্ড?”

 

“লাখ লাখ ডলার-এর জাল নোট এদেশে ছেড়েছে। সাহসটা দেখুন! ইন্ডিয়াতে ছাড়লে ধরা পড়ার চান্স কম থাকত, তা বলে এদেশে!”

 

“কী করে জানলেন লাখ লাখ?”

 

“এখানে একটু অনুমান করেছি স্যার… জ্যাকসন হাইট্স-এ একটা জালনোট পাওয়া গেছে বাংলাদেশি দোকানদারের কাছে। সে বলেছে নোটটা পেয়েছে এক পাকিস্তানি খদ্দেরের কাছ থেকে। একটা নোট জাল করে তো কেউ লাভ করবে না।”

 

“লাভ না হোক, ক্ষতিও হচ্ছে না… কিছু ডলার তো বাঁচছে।” একেনবাবুকে খোঁচাবার জন্যেই কথাটা বললাম।

 

“কী যে বলেন স্যার!” বলেই বুঝলেন এটা ঠাট্টা। “বাট দিস ইজ নট গুড ফর দ্য কম্যুনিটি। এখানকার সাদারা বাদামি চামড়ার সব্বার ওপর চটবে।”

 

কয়েক মিনিট মাত্র চুপচাপ, তারপরেই… “এই যে স্যার, আইএসআই হতেই হবে.. জাল নোটের একটা বান্ডিল উদ্ধার হয়েছে একটা রেস্টুরেন্ট-এর টয়লেট রুম থেকে। মালিক জানে না কে ওটা ওখানে রেখেছে! বলছিলাম না স্যার, আমেরিকায় এসব জাল ব্যাপারটা চলে না!”

 

আমার বিরক্তি লাগল, “আচ্ছা, আপনি বার বার আইএসআই বলছেন কেন?”

 

“আসলে স্যার, ওদের খুব এক্সপার্টিজ আছে এ ব্যাপারে।”

 

আমাদের কথাবার্তাগুলো প্রমথর কানে কতটা যাচ্ছিল জানি না। নিজের কাজ থামিয়ে বলল, “ভেরেন্ডা না ভেজে, আমায় একটু সাহায্য কর তো। আর ওস্তাদি না করে ঠিক যে ভাবে বলছি, সেভাবে কর।” তারপর একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আর আপনিও।”

 

প্রমথর মেজাজ যখন সপ্তমে চড়ে থাকে, আমি ওকে ঘাঁটাই না। তড়িঘড়ি বই রেখে যখন উঠছি, একেনবাবু পা নাচাতে নাচাতে প্রশ্ন করলেন, “স্যার, কথাটা ভেরেন্ডা না এরণ্ড?”

 

আমি বললাম, “আপনার আস্পর্ধা তো কম নয়। দেখছেন ও খেপে আছে!”

 

“না না স্যার, আমিও উঠছি। আসলে কিনা ওটা নিয়ে আমার বরাবরই একটা কনফিউশন আছে!”

 

“এরও আর ভেরেন্ডা দুটোই এক,” প্রমথ বলল। “আর দুটোই আপনাদের মতো ইউজলেস। বাপি, তুই বাথরুমটা ধর। আমি বাইরের ঘর পরিষ্কার করছি, আর একেনবাবু আপনি নিজের ঘর পরিষ্কার করে দয়া করে আমাকে উদ্ধার করুন।”

 

“তা করছি স্যার, কিন্তু এরণ্ডকে ইউজলেস বলবেন না, রেড়ির তেলের সোর্স ওটা। ব্রজদুলালবাবু তো ওই তেল বেচেই ক্যাস্টর অয়েল কিং হয়ে গেলেন।”

 

“রেড়ির তেলই ক্যাস্টর অয়েল নাকি?” তথ্যটা আমার কাছে নতুন।

 

“তোরা কাজ করবি না বকবক করবি,” বলে প্রমথ কড়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে ডোর বেল বাজল।

 

দুই

এটাকে কাকতালীয় ছাড়া আর কী বলব জানি না, দরজা খুলেই একেনবাবু, “কী সৌভাগ্য স্যার, আসুন আসুন,” বলে যাঁকে ঘরে ঢোকালেন, তিনি আর কেউ নন– ব্রজ-ক্যাস্টর অয়েল-এর মালিক কোটিপতি ব্রজদুলাল দত্ত! কাঁচা-পাকা চুল, আশু মুখুজ্জে টাইপের গোঁফ, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, গলাবন্ধ নেহরু জ্যাকেট. দেখামাত্রই চিনতে পেরেছিলাম। চিনতে পারার কারণটাও বলি। বছর দুয়েক আগে এক মাসের জন্য কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেই সময়ে প্রৌঢ় ব্রজদুলালবাবুর দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে প্রচুর কেচ্ছা-কাহিনি বড়ো বড়ো হেডলাইন দিয়ে পত্রিকায় ছাপা হচ্ছিল। নীচে পাশাপাশি থাকত এক তরুণী আর ব্রজদুলালবাবুর ছবি। মোটামুটি যা উদ্ধার করেছিলাম সেটা হল, ব্রজদুলালবাবু পিঠের ব্যথায় প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকতেন। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, হাকিমি… সব ফেল! এমন কী ফিজিক্যাল থেরাপিস্টদের স্ট্রেচিং এক্সারসাইজও। সেই সময়ে এক তরুণী এলেন ব্রজদুলালবাবুর জীবনে। ভলাপচুয়াস সেক্সি চেহারার এক মাসাজ থেরাপিস্ট। ব্রজদুলালবাবু বন্ধুদের বলতেন, মেয়েটির আঙুলে নাকি জাদু আছে। ব্রজদুলালের সব ব্যথা-বেদনার উপশম ঘটত সেই আঙুলের কোমল কঠিন স্পর্শে। তারপর থেকেই ব্যথাটা ঘন ঘন উঠত, মেয়েটিকেও আসত হত ঘন ঘন। নিন্দুকদের ধারণা পুরোটাই ধাপ্পা। ব্যথা নিশ্চয় ছিল, কিন্তু যত না ব্যথা তার থেকে বেশি দরকার ছিল সুন্দরী তরুণীর উষ্ণ সান্নিধ্য। চারমাসের মধ্যেই মাসাজ থেরাপিস্ট হয়ে গেলেন ব্রজদুলালবাবুর শয্যাসঙ্গিনী। শাস্ত্রমতেই বিবাহ। পঞ্চান্ন বছরের পাত্র, পঁচিশ বছরের পাত্রী। পঞ্চান্ন বছরের কাউকে কোনো মতেই বৃদ্ধ বলা চলে না। কিন্তু তাও বৃদ্ধস্য তরুণী ভার‍্যা বলে হাসিঠাট্টা চলত। সেখানেই কিন্তু ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি হয়নি। ব্রজদুলাল-পত্নির বিবাহ-বহির্ভূত কিছু ইন্টারেস্ট মনে হয় ছিল। ইন্টারনেটের সৌজন্যে সেই সব খবর পড়তাম। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই খবর রটল ব্রজদুলাল-পত্নি সন্তানসম্ভবা! ভুয়ো খবর। কিন্তু অনাগত সন্তানের পিতা কে? এ নিয়েও কিছুদিন বিভিন্ন নেট ফোরামে মুখরোচক আলোচনা চলেছিল। যাক সে কথা, ব্রজদুলালবাবুর কেচ্ছা কাহিনির খবরগুলো জানতাম, একেনবাবু যে ব্রজদুলালবাবুকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন, সেটা জানা ছিল না!

 

নিউ ইয়র্কে খবর না দিয়ে কারোর বাড়িতে কেউ এসে উদয় হয় না। বোঝাই যায় ভদ্রলোক এইসব ফর্মালিটির ধার ধারেন না। প্রমথ ওঁকে না চিনলেও, ওঁর কেতাদুরস্ত পোশাক, কাঁচা-পাকা চুল এবং চলাফেরার আভিজাত্য থেকে বুঝে গেল, উনি একজন কেউকেটা। চট করে ঘরে গিয়ে গেঞ্জির ওপরে একটা শার্ট চাপিয়ে এল।

 

পরিচয়পর্ব শেষ হলে ব্রজদুলালবাবু একেনবাবুকে বললেন, “আপনার কাছে একটা সাহায্যের জন্য এসেছি।”

 

“নিশ্চয় স্যার, বলুন কী করতে পারি?”

 

ভদ্রলোক চকিতে আমার আর প্রমথর দিকে তাকালেন। “ব্যাপারটা খুবই প্রাইভেট, একটু আলাদা ভাবে আপনাকে বলতে চাই।”

 

“আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার, আমার সমস্ত কেসেই ওঁরা জড়িত থাকেন। আমাকে বলাও যা ওঁদের বলাও তা।”

 

আমার একটু অস্বস্তিই লাগছিল, একজন বয়স্ক লোক যখন প্রাইভেসি চাচ্ছেন। আমি নিজেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। প্রমথও আমার দেখাদেখি উঠে পড়ল।

 

একটা হাত তুলে আমাদের উঠতে বারণ করলেন ব্রজদুলালবাবু। রুমাল বার করে নাক-মুখ ঢেকে বেশ কয়েকবার হাঁচলেন।

 

“এক গ্লাস জল হবে?”

 

“নিশ্চয়।”

 

তাড়াতাড়ি জল এনে দিতেই সাইড পকেটে রাখা পিল-বক্স থেকে একটা বড়ি মুখে দিয়ে পুরো জলটা খেলেন। “আপনাদের অ্যাপার্টমেন্টে কোনো ফুল আছে?”

 

প্রমথর গার্লফ্রেণ্ড ফ্রান্সিস্কা গতকাল একগুচ্ছ ডালিয়া ফুল নিয়ে এসেছিল। নিশ্চয় প্রমথর শোবার ঘরে ওটা আছে।

 

“হ্যাঁ, আছে। আপনার কি ফুলে অ্যালার্জি?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

 

“কতগুলো ফুলে। তবে এই ওষুধটা খেয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।” প্রমথ ইতিমধ্যে বুদ্ধি করে একটা টিস্যুর বাক্স নিয়ে এসেছে, খুব চট করে অ্যালার্জি চলে যায় না।

 

“থ্যাঙ্ক ইউ, একটা টিস্যু তুলে নাকটা মুছলেন। চশমা খুলে চোখটা চুলকালেন বেশ কয়েকবার, তারপর চশমা পরে বললেন, “আসলে ব্যাপারটা একটু এমব্যারাসিং।” বলে একটু চুপ করে আবার নাকটা মুছলেন। সশব্দে হাঁচলেন আরেকবার।

 

প্রমথ ওয়েস্ট বাস্কেটটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে টিস্যুটা ফেলতে পারেন।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ।”

 

“একটু কফি খাবেন স্যার?”

 

“না না, ঠিক আছে,… আসলে কী ভাবে শুরু করব ভাবছি… একটা দোকানে কাফলিংক কিনতে গিয়েই ঝামেলাটা শুরু। আমার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। মেয়েটা যে এভাবে আমায় ফাঁসাবে, কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু এখন তো সেগুলো ভেবে লাভ নেই।”

 

“দাঁড়ান স্যার, এভাবে বললে আমার মাথায় ঠিক ঢুকবে না। আপনি প্রথম থেকে একটু ডিটেল-এ বলুন। কোনো কিছু বাদ দেবেন না, অদরকারি মনে হলেও না।”

 

“বলছি,” একটু ইতস্তত করে ব্রজদুলালবাবু শুরু করলেন ওঁর কাহিনি। এখানে এসেছিলাম দিন পনেরো আগে। বিজনেসের কিছু কাজ ছিল… দিন সাতেকের ব্যাপার। তারপরে স্ত্রীকে নিয়ে একটু বেড়াব। ও আগে আমেরিকায় আসেনি, তাই একমাস এদেশে কাটাব প্ল্যান ছিল। বিজনেসের কাজ মানে সারাদিন কাজের পর ককটেল, ডিনার সবকিছু শেষ হতে হতে বেশ রাত হচ্ছিল। ট্যাক্সি না ধরে একটু হেঁটেই হোটেলে ফিরতাম। সঙ্গী হত শ্রীবাস্তব। শ্রীবাস্তব বেশ কয়েক বছর হল আমার কোম্পানিতে কাজ করছে। ও শুধু আমার মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের হেড নয়, বলতে গেলে আমার কাছের লোক। আমার পছন্দ-অপছন্দ সব কিছুরই খোঁজ রাখে। ও-ই একদিন হাঁটতে হাঁটতে বলল “আইডিয়াল জুয়েলরি’র কথা, দোকানটার স্পেশালিটি নাকি ডায়মন্ড কাফলিংক।”

 

“কাফলিংক স্যার?”

 

“হ্যাঁ। যেগুলো ড্রেস শার্টে ব্যবহার করা হয়।” একেনবাবুর চোখে বিস্ময় দেখে ব্রজদুলালবাবু বিশদ করলেন।

 

“না না স্যার, কাফলিংক তো হলিউডের অনেক স্টারদের ব্যবহার করতে দেখেছি, বোতামের বদলে ফুলশার্টের হাতায় লাগায়। আমাদের দেশে তেমন দেখিনি।”

 

“ঠিকই বলেছেন। নিজে কোনো দিনই কাফলিংক ব্যবহার করিনি, কিন্তু ওটা কালেক্ট করা আমার বাতিক। সুন্দর কাফলিংক দেখলেই আমি কিনি। বাইরের ঘরে আমার একটা সুন্দর এটাজেয়ার আছে..।”

 

“এটাজেয়ার’-টা কী স্যার?”

 

“বলছি,” বলে ব্রজদুলালবাবু টিস্যু তুলে নাকটা আরেকবার ঝাড়তে গেলেন।

 

সেই ফাঁকে প্রমথ বিজ্ঞের মতো বলল, “ওটা একটা ফ্রেঞ্চ শব্দ। অর্থ হল খোলা তাক, সাজিয়ে রাখার জিনিসের জন্য।”

 

“ওই এটাজেয়ার-এ আপনার কাফলিংকগুলো রাখতেন স্যার?”

 

প্রমথ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আমারও মজা লাগছিল কাফলিংক সংগ্রহও কারো হবি হতে পারে শুনে!

 

ব্রজদুলালবাবুর নিশ্চয় সেটা চোখ এড়ায়নি। আমাদের দিকে তাকিয়েই বললেন, “আপনারা আমার বাড়িতে আসেননি… দেখলে বুঝতেন কী দারুণ আমার কালেকশন! গতবছর একটা হিরে-বসানো কাফলিংক তো চুরিই হয়ে গেল। তারপর থেকে বাইরের ঘরেও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছি।”

 

তারপর মুখ ঘুরিয়ে একেনবাবুকে বললেন, “হ্যাঁ যেটা বলছিলাম… ‘আইডিয়াল জুয়েলরি’ দোকানটা ম্যানহাটানে নয়, হার্লেমে। হার্লেমের অনেক জায়গাই এক সময় জঘন্য ছিল– ড্রাগ অ্যাডিক্ট আর গুন্ডা-বদমায়েশদের জায়গা। ইদানীং ভদ্রস্থ হয়েছে শুনেছিলাম। দোকানটা দেখার ইচ্ছে থাকলেও রাতে ওখানে যাওয়া সমীচীন হবে কিনা ভাবছিলাম। শ্রীবাস্তব বলল ক’দিন আগেই ওখানে গেছে, জায়গাটা এমন কিছু খারাপ নয়।

 

হোটেলে না ফিরে একটা ট্যাক্সি ধরলাম। শ্রীবাস্তবই ডিরেকশন দিয়ে নিয়ে গেল। রাতে বেশির ভাগ দোকানপাটই বন্ধ হয়ে গেছে বা ঝাঁপ নামাচ্ছে। ভাগ্যক্রমে আইডিয়াল জুয়েলরি তখনও খোলা। ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে আমি নামলাম।

 

‘আমি তো দেখেছি, আপনি দেখুন, বলে শ্রীবাস্তব গাড়িতেই বসে রইল। সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দু-জনে নেমে এলে ড্রাইভার হয়ত ভাড়া চাইবে। আর ভাড়া পেলেই অদৃশ্য হবে।

 

অত রাত্রে দোকানে আর ঢুকলাম না। বাইরে থেকেই ডিসপ্লেগুলো দেখলাম। বেশ কয়েকটা দামি ডায়মন্ড কাফলিংক চোখে পড়ল। তার মধ্যে একটা কার্টিয়ের কোম্পানির স্যাফায়ার ডায়মন্ড কাফলিংক। এটার বিজ্ঞাপন ম্যাগাজিনে দেখেছি, ৩০ হাজার ডলারের মতো দাম। এরা বিক্রি করছে মাত্র ২৫ হাজারে! যে মেয়েটি কাউন্টারে দাঁড়িয়েছিল খুবই সুন্দরী, নাক-চোখ-মুখ দেখে মনে হল ইরানী। ইরানে মাঝেমধ্যেই যাই, ওদের ফিচারগুলো ভালোই চিনি। ভাবলাম একবার ঢুকি, ভালো করে কাফলিংকগুলো দেখি। কিন্তু শ্রীবাস্তব ট্যাক্সিতে বসে আছে। বরং জিজ্ঞেস করি কালকে খোলা থাকবে কিনা। ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটা বলল, কাল দশটা থেকে সাতটা পর্যন্ত খোলা।

 

ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, কালকে আসব।

 

বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, সেদিন রাত্রে ওই কাফলিংকটা আমি স্বপ্নে দেখলাম, সেই মেয়েটাকেও দেখলাম! এক বন্ধুর সঙ্গে পরদিন দুপুরে লাঞ্চ ছিল। গল্প করতে করতে একটু দেরিই হল। লাঞ্চের পরে বন্ধু টেনে নিয়ে গেল ব্রডওয়েতে ওর আর্টিস্ট বান্ধবীর এক্সিবিশনে। অখাদ্য সব ছবি। তারই একটা কিনলাম গলাকাটা দাম দিয়ে। ওরাই প্যাক করে দেশে পাঠিয়ে দেবে, বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। সেখান থেকে হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। আগে থেকেই একটা লিমো ঠিক করে রেখেছিলাম। হার্লেমে নিয়ে যাবে, আর ফেরত নিয়ে আসবে। সেদিন আবার বাইরে বেশ বরফ পড়ছে, রাস্তায় লোক প্রায় নেই বললেই চলে। যতটা সময় লিমোর লাগার কথা তার বেশি সময়ই লাগল। যখন দোকানের কাছে গিয়ে পৌঁছোলাম তখন রাত সাতটা বেজে কয়েক মিনিট পার হয়ে গেছে। এমনিতেই এই রাস্তায় দোকান কম আর এদিকের দোকানগুলো বোধহয় তাড়াতাড়িই বন্ধ হয়। আলো বলতে শুধু রাস্তার আলো। লিমোটাকে দাঁড় করিয়ে আইডিয়াল জুয়েলরির সামনে গেলাম। দরজা বন্ধ, কিন্তু মেয়েটা দেখলাম ভিতরে আছে আর দরজার বাইরে সিকিউরিটি শাটার তখনও বন্ধ করা হয়নি। দরজা ঠেলে ঢুকতেই মেয়েটা বলল, “দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।

 

‘সরি আমার আসতে দেরি হয়ে গেছে। গতকাল তোমাদের উইন্ডো ডিসপ্লেতে কার্টিয়ের স্যাফায়ার ডায়মন্ড কাফলিংক দেখেছিলাম সেটা কিনতে এসেছি।’

 

‘আমাদের ক্যাশ ক্লোজ হয়ে গেছে, আই কান্ট সেল ইউ নাউ। আর ওটার দাম পঁচিশ হাজার ডলার… জানো তো?

 

আমার বাদামি চামড়া দেখে মেয়েটা হয়তো ভাবছে কেনার মুরোদ আছে কি না।

 

ইয়েস,’ বলে আমার এখানকার অফিসের বিজনেস কার্ড মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিলাম। তোমরা ক্রেডিট কার্ড নাও তো?”

 

মেয়েটা বিজনেস কার্ডটা দেখলাম মন দিয়ে দেখল। বলল, ‘দু-হাজার ডলার পর্যন্ত, তার বেশি হলে ব্যাঙ্ক চেক।

 

ব্যাঙ্ক চেক মানে আমাদের ক্যাশিয়ার’স চেক বা ড্রাফট, অর্থাৎ আজ দোকান খোলা থাকলেও কিনতে পারতাম না। আমাদের ব্যাঙ্ক তো ছ’টার আগেই বন্ধ হয়ে যায়।

 

“ঠিক আছে, ওটা আমাকে একটু দেখাও, কালকে ব্যাঙ্ক চেক নিয়ে আসব বা কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব, সে নিয়ে যাবে।’

 

‘শিওর। মেয়েটা কাউন্টারের নীচ থেকে ওটা বার করে আমার হাতে দিল। বুঝলাম দোকান বন্ধ হলেও এ-রকম খদ্দের হাতছাড়া করতে চায় না।

 

নেড়েচেড়ে মনে হল মালটা জেনুইন। ওকে কাফলিংকটা ফেরত দিলাম। হ্যাঁ, কালকে টাকা পাঠিয়ে দেব।

 

মেয়েটি একটু চিন্তিত স্বরে বলল, এই একটাই মাত্র আছে আমাদের কাছে, ডিজাইনটা এখন ডিসকন্টিনিউড। তুমি আসার আগে বিক্রি হয়ে গেলে দিতে পারব না।’

 

মেয়েটার দিকে এবার ভালো করে তাকালাম। শার্প ফিচার, ঘন কালো চুলের অনেকটাই ঢাকা সবুজ সিল্কের স্কার্ফে, নীলচে-সবুজ চোখ, ডিপ ভি-নেক ড্রেস… মোটকথা মনে দাগ কাটার মতো চেহারা।

 

আমি সহজে ছাড়লাম না। এটা আমার দরকার, আমি ক্যাশ অ্যাডভান্স করতে পারি এটার জন্য।

 

‘তুমি এই সোফায় একটু বোসো, এক কাপ কফি খাও। আমি স্টোর মালিককে ফোন করে দেখি, কী বলেন।

 

কফি পটটা সামনেই ছিল। সেখান থেকে গরম কফি একটা কাপে ঢেলে আমাকে এগিয়ে দিল। তারপর ‘এক মিনিট’ বলে দোকানের পিছনে একটা দরজা খুলে ভেতরে গেল। একটু বাদেই ফিরে এসে বলল, “না, অ্যাডভান্স নিতে পারব না, স্টোর পলিসি।

 

‘তাহলে?

 

আমি নাছোড়বান্দা দেখে মেয়েটা বলল, “তুমি কখন টাকা পাঠাতে পারবে?”

 

কালকে দশটার সময়… ব্যাঙ্ক খুললেই।

 

মেয়েটা তখনও কথা দিচ্ছে না কাফলিংকটা ধরে রাখবে। আমরাও দশটার সময় দোকান খুলি, তখন যদি কেউ এসে যায়…।

 

আমি তখন বললাম, “শোনো, তুমি বিশ্বাস করতে পারো আমি আসব। …ঠিক আছে, তোমার কাছে তিন-চারশো ডলারের কোনো কাফলিংক আছে?”

 

‘আছে।

 

‘দেখাও।

 

মেয়েটি একটু অবাক হয়েই সাড়ে তিনশো ডলারের একটা কাফলিংক বার করল।

 

আমি মানিব্যাগ থেকে টাকা বার করতে করতে বললাম, এতে অন্তত বুঝবে আমি একজন জেনুইন কাস্টমার। কালকে সকালে আমি ব্যাঙ্ক চেক নিয়ে আসব কার্টিয়ের স্যাফায়ার ডায়মন্ড কাফলিংক-এর জন্য। তখন এটা ফেরত দিয়ে যাব।’

 

‘ফেরত তো নিতে পারব না, মেয়েটা কাউন্টারের পিছনে বড়ো করে লেখা একটা সাইন দেখাল ‘নো রিটার্ন, নো এক্সচেঞ্জ।

 

‘না নিলে, না নেবে।’ বলে বিরক্ত হয়ে গুনে গুনে ওর হাতে তিনটে একশো ডলার আর একটা পঞ্চাশ ডলারের নোট দিলাম।

 

মেয়েটা হতবাক! বলল, “ঠিক আছে, তোমাকে একটা কাঁচা রসিদ দিচ্ছি। যদি চাও কালকে ব্যাঙ্ক চেকের সঙ্গে এটা নিয়ে এলে টাকাটা ফেরত দিয়ে দেব। মালিককে কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলবে না… কারণ এটা আমি করতে পারি না।

 

‘তোমার নামটা কী?

 

ফারা, মেয়েটা সাদা একটা কাগজে রসিদ লিখতে লিখতে উত্তর দিল। তারপর দেখলাম, কী জানি খুঁজছে।

 

‘দাঁড়াও, এর বাক্সটা বোধহয় স্টক-রুমে পড়ে আছে, নিয়ে আসছি। বলেই মেয়েটা আবার ভিতরে অদৃশ্য হল। গেল তো গেলই… আমি অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে পড়ছি। মাথাটাও একটু ঝিমঝিম করছে। কিছুক্ষণ ভেতরের এই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ‘হ্যালো’, ‘হ্যালো’ করলাম। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। একটা স্টক-রুম, কেউ নেই। আরেকটা দরজা, সেটা খুললাম। ঘরে নীল একটা আলো জ্বলছে, কিন্তু সেখানেও মেয়েটা নেই। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই… যখন জ্ঞান ফিরে এল, দেখি দোকানের সেই সোফাতেই শুয়ে আছি। মেয়েটা সামনে দাঁড়িয়ে। আমি চোখ মেলতেই উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আর ইউ ফিলিং ওকে নাউ?”

 

আমি তখনও একটু ঘোরের মধ্যে। তুমি কোথায় ছিলে?”

 

‘এই কাফলিংক বক্সটা আনতে ভেতরে গিয়েছিলাম, এসে দেখি তুমি চোখ বুজে সোফায় শুয়ে আছ।

 

‘আমি তো তোমাকে খুঁজতে ভেতরে গিয়েছিলাম। তোমাকে দেখতে না পেয়ে একটা নীল বাতি জ্বালানো ঘরে ঢুকে হঠাৎ মাথা ঘুরে গিয়েছিল।

 

মেয়েটা আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন আমি প্রলাপ বকছি। আমার কি ডিমেনশিয়া হচ্ছে! কিন্তু আমার তো পরিষ্কার মনে পড়ছে মেয়েটিকে ফলো করার কথা, প্রথমে স্টক-রুমে, তারপর নীল আলোয় ভরা ঘরে ঢোকা। এটা ঠিক, ইদানীং আমি খুব ভুলে যাচ্ছি। আমার স্ত্রী আমাকে প্রায়ই সেটা মনে করায়। এই তো গতকালই আমি বাথরুমে গেছি দাঁত মাজতে, স্ত্রী বলছে আমি নাকি বাথরুমেই যাইনি! হাতঘড়িতে দেখলাম সাতটা বেজে দশ মিনিট। সুতরাং মাত্র মিনিট পাঁচেক পার হয়েছে দোকানে এসেছি! এরই মধ্যে কি এত কিছু ঘটে যেতে পারে! হয়ত পুরোটাই আমার দিবাস্বপ্ন ছিল! নিজেকে সামলে নিয়ে কাফলিংকের বাক্সটা হাতে নিলাম।

 

মেয়েটি মনে হল দুশ্চিন্তা করছে। জিজ্ঞেস করল, “তুমি নিজে নিজে যেতে পারবে, না একটা ট্যাক্সি ডেকে দেব?’

 

‘না, যেতে পারব।’ বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। দোকানের সামনেই লিমো দাঁড়িয়ে ছিল। সোজা হোটেলে।

 

হোটেলে পৌঁছোনোর খানিক বাদে আমার স্ত্রী ঘরে ফিরল। আমি এই ঘটনাটা ওকে আর বললাম না। বললে আমার ডিমেনশিয়া হওয়ার থিওরিটাই জোরদার হত। যাইহোক পরের দিন সাড়ে ন’টায় ব্যাঙ্ক খুললে পঁচিশ হাজারের একটা ব্যাঙ্ক চেক দিয়ে শ্রীবাস্তবকে পাঠিয়ে দিলাম। নাম ফারা, মেয়েটার একটা ডেসক্রিপশন দিয়ে দিলাম। ওই গিয়ে চেকটা দিয়ে কাফলিংকটা নিয়ে এল। অন্য কাফলিংকটা আর ফেরত পাঠাইনি। মাত্র সাড়ে তিনশো ডলারের ব্যাপার। আর মালিকের সামনে ওটা দিলে মেয়েটা হয়তো একটু ঝামেলায় পড়তে পারে। এটা হল তিনদিন আগের ঘটনা।”

 

 

তিন

একটানা কথাগুলো বলে ব্রজদুলালবাবু একটু হাঁপাচ্ছেন।

 

“একটু কফি বা চা দেব স্যার?”

 

“না, না, আমি ঠিকই আছি। বরং আর এক গ্লাস জল দিন।”

 

আমি উঠে জল এনে দিলাম।

 

টিস্যু পেপারে আরেকবার নাক ঝেড়ে সাইড পকেটে রাখা পিল-বক্স থেকে আরেকটা পিল মুখে দিয়ে অনেকটা জল খেলেন। তারপর গ্লাসটা রেখে বললেন, “আচ্ছা, কতটা বলেছি বলুন তো?”

 

“তিনদিন আগের কথা… মিস্টার শ্রীবাস্তব কাফলিংকটা কিনে নিয়ে এলেন হোটেলে।” একেনবাবু খেই ধরিয়ে দিলেন।

 

“ও হ্যাঁ, আসল ব্যাপারটা ঘটল তার পরের দিন। আমার কাছে একটা চিঠি এল, ভেতরে তিনটে ছবি। একটা ছবিতে আমি সেই মেয়েটাকে টাকা দিচ্ছি, দ্বিতীয় ছবিতে সেই মেয়েটা নগ্ন শরীরে একটা খাটে শুয়ে আছে আর আমি সেই খাটের সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ঝুঁকে আছি। তৃতীয়টা আরও বাজে একটা ছবি। প্রথম ছবিটা ঠিক, কিন্তু দ্বিতীয় আর তৃতীয় ছবি কী ভাবে উঠল সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তার মানে কি আমি দিবাস্বপ্ন দেখিনি, মেয়েটার খোঁজে দোকানের ভেতরে ঢুকেছিলাম! কিন্তু সেখানে তো মেয়েটাকে শুয়ে থাকতে দেখিনি, তার ওপর উলঙ্গ অবস্থায়!

 

“চিঠি পাবার কয়েক ঘণ্টা বাদে একটা ফোন পেলাম। ফ্যাসফ্যাসে গলায় একটা লোক বলল, পরের দিন দুটোর সময় কাফলিংকটা ফেরত দিতে হবে। কোথায় কী ভাবে দিতে হবে, তার ইনস্ট্রাকশন ফোনে আসবে। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেই ওদের কাছে যা যা ছবি আছে সব সোশাল মিডিয়াতে তুলে দেওয়া হবে।

 

“এই ভয়টাই করছিলাম। ফোন কল পেয়ে আমি একেবারে বিধ্বস্ত। জানাজানি হলে এই বয়সে আরেকটা লজ্জার ব্যাপার হবে। আমি শ্রীবাস্তবকে ব্যাপারটা বললাম। শ্রীবাস্তব বলল, “আপনি ২৫ হাজার ডলার দিয়ে কিনেছেন। এর মানে তো আপনাকে ব্ল্যাকমেল করে সেই টাকাটাই ওরা ফেরত নিচ্ছে! কাফলিংকটা পেলেই যে ছবিগুলো নেট-এ তুলবে না, তার গ্যারান্টি কি? এরপর হয়তো ক্যাশ চাইবে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, ছবিগুলো যদি ফেক হয়, তাহলে তুলুক না… আপনিও আইনি ব্যবস্থা নেবেন।

 

“আমিই ওকে বললাম, আমার কাছে এই কাফলিংকটা এমন কোনো ব্যাপার নয়। স্রেফ শখের কেনা ছিল। আমার রেপুটেশন তার থেকে অনেক বড়ো। নতুন করে তাতে কোনো কাদা লাগুক চাই না। তুমি বরং আমাকে সাহায্য করো ওটা ফেরত দেবার ব্যাপারে। ওকে এটা বলার পর আপনার কথা মনে পড়ল, কিন্তু ফোন নম্বর বা ঠিকানা জানা ছিল না। খোঁজখবর করে ঠিকানাটা আজকে পেলাম। তাই সোজা চলে এলাম।”

 

“বেশ করেছেন স্যার। কিন্তু কতগুলো ব্যাপার একটু ভালো করে জেনে নিই। কাফলিংকটা কি আপনি ইতিমধ্যে দিয়ে দিয়েছেন?”

 

“হ্যাঁ, আসলে উপায় ছিল না। গতকাল ডেডলাইন ছিল। আমি নিজে দিইনি, শ্রীবাস্তব দিয়েছে। কিন্তু আমি দূর থেকে দেখেছি। পোর্ট অথরিটির মেইন টিকিট প্লাজার কাছে রেস্ট-রুমের সামনে একটা বালতি রাখা ছিল, সেখানে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে পুরে কাফলিংকটা রাখার কথা ছিল। সময় দেওয়া ছিল দশটা থেকে দশটা পাঁচের মধ্যে। রাখতেই একজন সাফাইয়ের লোক এসে বালতিটা নিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হল।”

 

“বুঝলাম স্যার, কিন্তু আমাকে এখন কী করতে বলেন?”

 

“আমার এখন চিন্তা হচ্ছে, আবার যদি টাকা চায়। কারণ, ছবিগুলো সবই তো ওদের কাছে!”

 

“তা চাইতেই পারে।”

 

“তাহলে?”

 

“আপনি একটা কাজ করুন স্যার। নিউ ইয়র্ক পুলিশের কাছে ব্যাপারটা রিপোর্ট করুন।”

 

বুঝতে অসুবিধা হল না, পুলিশকে খবর দেবার ব্যাপারে ব্রজদুলালবাবুর খুবই অনিচ্ছা। নারীঘটিত কোনো ব্যাপার পুলিশের কানে ওঠে উনি চান না। জিজ্ঞেস করলেন, “আর কী করা যেতে পারে ব্ল্যাকমেল-এর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য?”

 

“একটু ভাবতে হবে স্যার। ভালোকথা, যে দোকান থেকে আপনি কাফলিংকটা কিনেছিলেন, সেখানে কি গিয়েছিলেন মেয়েটার খোঁজ করতে?”

 

“না, ভয় হচ্ছিল গেলে হয়তো আরও ঝামেলায় পড়ব।”

 

“দোকানের ঠিকানা আছে আপনার কাছে?”

 

“তা আছে।” বলে পকেট থেকে একটা কাগজ বার করলেন ব্রজদুলালবাবু। ২৫ হাজার ডলারের একটা রিসিটের ওপরে ছাপা, আইডিয়াল জুয়েলরি, ১৩৪ স্ট্রিট ওয়েস্ট এর একটা ঠিকানা।

 

“এটা কপি, আপনি রাখতে পারেন। অরিজিনালটা আমার কাছে আছে।”

 

“ঠিক আছে। এবার টাকা চাইলে, টাকা না দিয়ে আমাকে জানাবেন। তখন দেখি স্যার কিছু করতে পারি কিনা।”

 

“এখন আর কিছু করতে পারেন না?”

 

“কাফলিংকটা তো দিয়েই দিয়েছেন স্যার!”

 

“না না, কাফলিংকের কথা বলছি না। ওটা গেছে ধরেই নিয়েছি। আমি বলছি ছবিগুলো ফেরত পাবার ব্যাপারে।”

 

আমাদের দেখিয়ে একেনবাবু বললেন, “এঁরা ভালো বলতে পারবেন… কিন্তু ডিজিটাল যুগে সেটা কি আর সম্ভব স্যার।”

 

“তার মানে সারা জীবন আমাকে ভয়ে ভয়ে কাটাতে হবে!”

 

“এত দুশ্চিন্তা করছেন স্যার। আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে ছবিগুলো জাল। তাই না?”

 

“শুধু টাকা দেবার ছবিটা ঠিক। অন্যগুলো নয়, অন্তত আমার জ্ঞানত নয়।”

 

“তাহলে ওটা নিয়ে চিন্তা করবেন না স্যার। আমি ভাবছি অন্যকথা, আপনি অতগুলো টাকা দিয়ে কাফলিংক কিনলেন আর সেটা ভাঁওতা দিয়ে কেউ নিয়ে গেল– এটা তো স্যার অপরাধ!”

 

“আপনি ধরতে পারবেন ওদের?”

 

“পুলিশের সাহায্য আমাকে নিতেই হবে স্যার, আপনি নিজে রিপোর্ট করুন বা না করুন। বাজে ছবি দেখিয়ে আপনাকে প্রতারণা করবে, এটা মেনে নেবেন কেন?”

 

“বেশ আপনি যা ভালো বোঝেন করবেন। আমি এখানে টাইম স্কোয়ারে আছি– হিলটন-এর ডাবল ট্রি সুইটস-এ। রুম নম্বর, মোবাইল, সব এখানে লিখে দিয়েছি। অনেক সময়েই আমি ফোন তুলি না, তাই আমার অ্যাসিস্টেন্ট শ্রীবাস্তবের মোবাইল নম্বরটাও রয়েছে।” বলে আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন।

 

“ভালোকথা, কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে যাই আপনাকে?”

 

“ওটা নিয়ে এত ভাবছেন কেন স্যার, আগে কাজটা তো হোক।”

 

ব্রজদুলালবাবু চলে যেতেই প্রমথ বলল, “কী মনে হয়… বুড়ো আবার ফষ্টিনষ্টি করতে গিয়েছিল?”

 

“কে জানে স্যার!”

 

“আপনার একটা কথার অর্থ কিন্তু ধরতে পারলাম না।” আমি বললাম।

 

“কোনটা স্যার?”

 

“ওই যে আপনি ব্রজদুলালবাবুকে বললেন ‘এবার টাকা চাইলে আপনাকে জানাতে’? জানালে করতেনটা কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“একটা গল্পে পড়েছিলাম স্যার, ব্ল্যাকমেলারকে ধরা হয়েছিল জাল নোটের বান্ডিল দিয়ে। জাল নোটগুলো ব্যাঙ্কে জমা দিতে গিয়েই লোকটা ধরা পড়েছিল!”

 

একেনবাবু ঠিক কী বলছেন আমার মাথায় ঢুকল না। “কী যা-তা বলছেন! জালনোটের বান্ডিল পাবেন কোত্থেকে?”

 

“কেন স্যার, ক’দিন আগেই পত্রিকায় দেখলেন না একটা জাল নোটের বান্ডিল পাওয়া গেছে! ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে বলে যদি সেখান থেকে কিছু ব্যবহার করা যেত..”

 

ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? উদ্ধার-করা জাল নোট ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আবার বাজারে ছাড়তে দিতেন?”

 

“ঠিকই, মনে হয় না স্যার।”

 

“তাহলে?”

 

“ভাবছি স্যার… আপনার ক্লাস শেষ হচ্ছে কখন?”

 

“আজকে ক্লাসের পরে একটা মিটিং আছে, কিন্তু পাঁচটার মধ্যে ফ্রি হয়ে যাব।”

 

“তাহলে স্যার চলুন না, আইডিয়াল জুয়েলরি দোকানটা একবার দেখে আসি। ঠিকানাটা তো আছে।”

 

 

চার

মিটিং শেষ করে গাড়ি বার করে আইডিয়াল জুয়েলরি-তে পৌঁছোতে একটু দেরি হল। দোকানটা মান্ধাতা আমলের পুরোনো বিল্ডিং-এর এক তলায়। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় না খুব দামি কাফলিংক এরা রাখে। ভিতরে ঢুকে দেখি সামনের ছোটো উইন্ডো থেকে ডিসপ্লেগুলো সরানো হচ্ছে। যিনি সরাচ্ছেন, তিনি একজন মোটাসোটা মাঝ-বয়সি ভদ্রলোক। কাঁচা-পাকা চুল, মোটা ভুরু, নাকের ওপর একটা বড়ো আঁচিল। কোনো মেয়ে সেলস পার্সন চোখে পড়ল না।

 

“মে আই হেল্প ইউ? আজ আমাদের আর্লি ক্লোজিং… পাঁচ মিনিটের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে।” বাকি ডিসপ্লেগুলো একটা বাক্সে ঢুকিয়ে ভদ্রলোক কথাটা বললেন।

 

“স্যার, কয়েকদিন আগে একজন ম্যাডাম আমাকে কয়েকটা হিরে বসানো কাফলিংক দেখিয়েছিলেন, তিনি কি আছেন?”

 

একেনবাবুর পোশাকপরিচ্ছদ দেখে তিনি যে দামি কাফলিংক খুঁজতে পারেন ভাবা কঠিন।

 

“আপনাকে?” অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভদ্রলোকের প্রশ্নে অবিশ্বাসটা ধরা পড়ল।

 

“হ্যাঁ স্যার।”

 

“কতদিন আগের কথা বলছেন?”

 

“তা প্রায় দিন চারেক।”

 

“আপনি বোধহয় ফারা-র কথা বলছেন। আপনি কোন কাফলিংক দেখেছিলেন মনে আছে?”

 

“কার্টিয়ের স্যাফায়ার ডায়ামন্ড…।”

 

“সরি, ওটা বিক্রি হয়ে গেছে।” একেনবাবু কথা শেষ করার আগেই ভদ্রলোক বললেন।

 

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। যিনি কিনেছিলেন তিনি বললেন ম্যাডাম ফারা-কে ওটা ফেরত দিয়েছেন।”

 

“হতে পারে না, আমরা রিটার্ন নিই না, স্টোর পলিসি।” গলার স্বরে বেশ দৃঢ়তা।

 

“তাহলে কি ভুল শুনলাম স্যার! আচ্ছা ম্যাডামের সঙ্গে কী ভাবে যোগাযোগ করা যায় বলতে পারেন?”

 

“বলতে পারব না।”

 

“উনি তো এখানে কাজ করেন স্যার। কবে আসবেন?”

 

‘ফারা ক’দিন হল আসছে না। কোথায় আছে তাও জানি না।” বেশ বিরক্ত হয়েই কথাটা এবার বললেন।

 

ঠিক এই সময়েই বেশ কয়েকজন কাস্টমার দোকানে ঢোকায় ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা শুরু করলেন। একেনবাবু কিন্তু তখনও দাঁড়িয়ে আছেন।

 

আমি তাড়া দিলাম, “চলুন।”

 

“হ্যাঁ স্যার।” বলে আমার সঙ্গে এগোলেন, কিন্তু দৃষ্টি দেখলাম দোকানের পেছনে দরজাটার দিকে রয়েছে।

 

গাড়ি পার্ক করেছিলাম পাশের রাস্তায় একটা পার্কিং মিটারের সামনে। হার্লেমে এভাবে গাড়ি পার্ক করতে অস্বস্তি হয়। জানি আমার এই পুরোনো গাড়ি কেউ চুরি করবে না, তবে স্রেফ মজা করার জন্যেও তো গাড়ির কাঁচ ভেঙে দিতে পারে বা টায়ার ফাঁসিয়ে দিতে পারে! প্রমথর মতে আমার এই অস্বস্তির কারণ কুসংস্কার। কালোদের আমি ভয় পাই আর হার্লেমে কিছু কিছু অঞ্চলে কালোদের আধিক্য। আমাকে খোঁচায়ও, ‘তুই নিজেও তো কালো, তাহলে কালোদের নিয়ে এত দুর্ভাবনা কেন?”

 

থাক ওসব কথা। গাড়িটা অক্ষত অবস্থাতেই আছে। গাড়িতে উঠে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম। “এবার কী করতে চান?”

 

“আমি একটু কনফিউসড স্যার। কিছু একটা আছে ওই কাফলিংকে..ব্রজদুলালবাবুকে ব্ল্যাকমেল করা, ফারা ম্যাডামের হঠাৎ অদৃশ্য হওয়া… দোকানদার ভদ্রলোক মনে হল আমাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চান না!”

 

“অবশ্যই চায় না। তবে রিটার্ন না নেওয়ার কথাটা ঠিক বলেছে। রিটার্ন নিলে টাকা ফেরত দিতে হয়। ব্ল্যাকমেল করে মাল হাতাতে পারলে মালটাও থাকে পয়সাও খরচা হয় না।”

 

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। কিন্তু মালটা তো নেই বললেন।”

 

“ব্ল্যাকমেল করে যে মাল হাতিয়েছে, দোকানে সেটা রাখবে কেন? নিশ্চয় অন্য কোথাও সরিয়ে রেখেছে!”

 

“হতে পারে, বাট ইট ইজ ভেরি কনফিউসিং স্যার! আর ম্যাডাম ফারাই বা গেলেন কোথায়? ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে একটু ফোন করে দেখি যদি কোনো খবর জোগাড় করতে পারেন।”

 

.

 

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট মনে হয় বাইরে কোথাও ছিলেন, মেসেজ পেয়ে একটু বাদেই ফোন করলেন। একেনবাবু আইডিয়াল জুয়েলরি আর ফারা-র কথা বলতেই কিছু একটা বললেন যেটা শুনে একেনবাবু উত্তেজিত।

 

“বলেন কি স্যার, আপনি শিওর!… আমরা তো আইডিয়াল জুয়েলরি থেকেই ফিরছি। ওরা কিন্তু কিছুই জানে না… আজকেই… হ্যাঁ স্যার, আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছোব.. আসবেন? নিশ্চয় স্যার,… ঠিক আছে তখন কথা হবে।”

 

গাড়ি চালাচ্ছিলাম, ঠিক বুঝলাম না কী আলোচনা হচ্ছে। ফোন শেষ হলে একেনবাবু বললেন, “ঘণ্টা কয়েক আগে একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে। মনে হয় দিন কয়েক আগেই খুন করা হয়েছে। বডিটা সম্ভবত ম্যাডাম ফারার, কিন্তু ফর্মাল আইডেন্টিফিকেশন হয়নি।”

 

কথাটা শুনে আমি স্তম্ভিত! “বলেন কি! কোথায় পাওয়া গেল?”

 

“হার্লেমে। ডিটেল কিছু বললেন না। কোনো একটা মিটিং-এ যাচ্ছেন। সেটা শেষ হলে কফি খেতে আসবেন আমাদের বাড়িতে, তখন জানতে পারব।”

 

ইদানীং এই কফি খেতে আসাটা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের একটা অছিলা। গোলমেলে কোনো কেস থাকলে সোজা এসে হাজির হন। আসেন কফি খেতে। কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একেনবাবুর পরামর্শ নেন।

 

প্রমথ খ্যাপায়, “স্টুয়ার্ট সাহেবের তো পরের ধনে পোদ্দারি, আপনার মাথা ঘেঁটে কেস সলভ করে নিজে বড় সাহেবদের বাহবা নিচ্ছেন! আপনার তাতে কী ঘোড়াড্ডিম হচ্ছে!”

 

“কী যে বলেন স্যার, কত সাহায্য করেন উনি!”

 

“বাপির একটা ট্র্যাফিক ভায়লেশনের কেস মাফ করেছেন, আর তো কিছু করতে দেখিনি!” প্রমথ ছাড়ে না।

 

“শুনছেন স্যার, প্রমথবাবু না সত্যি!”

 

 

পাঁচ

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট এলেন সাড়ে সাতটা নাগাদ। খুব ভালো মুডে। আজ সকালেই ওঁর প্রমোশন হয়েছে। এখন থেকে উনি হলেন ‘বরো’ ইনভেস্টিগেটিভ চিফ, অর্থাৎ নিউ ইয়র্কের সবগুলো বরো– ম্যানহাটান, ব্রঙ্কস, ব্রুকলিন, কুইন্স এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ড-এর তদন্তের সব কাজ তদারকি করার দায়িত্ব পেয়েছেন।

 

“তারমানে কি স্যার আপনি চিফ ডিটেকটিভ?”

 

“আরে না,” বলে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নিউ ইয়র্ক পুলিশের স্ট্রাকচার বোঝাবার চেষ্টা করলেন… খানিকটা মাথায় ঢুকল, অনেকটাই না। এই কাহিনির জন্য সেটা প্রয়োজনীয়ও নয়। আইডিয়াল জুয়েলরি সংক্রান্ত যে-সব আলোচনা হল সেগুলোই সংক্ষেপে লিখি। ফারা-র মৃত্যুর ব্যাপারটা আলোচনার প্রথমে এলেও, সেটা পরে বলছি।

 

আইডিয়াল জুয়েলরির ব্ল্যাকমেল-এর ব্যাপারটা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জানতেন না। দোকানটার ব্যাপারে ওঁর আগ্রহ সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে। ইদানীং হার্লেমে বেশ কিছু দোকানে বে-আইনি জুয়োখেলা চলছে। সন্দেহ করা হচ্ছে এই জুয়ো-চক্রের একটা সেন্টার হল আইডিয়াল জুয়েলরি। জুয়োখেলা শুরু হয় দোকান বন্ধ হবার পর। আদি অকৃত্রিম ক্র্যাপস গেম থেকে শুরু করে, স্লট মেশিন, রুলেট, অনলাইন ফ্যান্টাসি গেম… সব কিছুই চলে! ভিতরের সিসিটিভি তখন বন্ধ থাকে। খেলা শেষ হলে আবার চালু করা হয়। অর্থাৎ এই জুয়ো খেলার কোনো ভিডিও প্রমাণ থাকে না।

 

বছর দশেক আগে ব্রুকলিনে কয়েকটা দোকানে এ ধরনের জুয়ো চলত। হাজার কুড়ি তিরিশ ডলার লেনদেন হত প্রতি সপ্তাহে। হাউস বা দোকান তার থেকে রাখত হাজার পাঁচেক। সেগুলো বন্ধ করা গেছে। কিন্তু হার্লেম অনেক অর্গানাইজড। গ্যাম্বলিং সেন্টারগুলো মনে হয় ইন্ডিপেন্ডেন্ট নয়, সম্ভবত চালাচ্ছে কোনো মাফিয়া-টাইপ ফ্যামিলি। আট-দশটা দোকানে মিনি-ক্যাসিনো বসিয়ে ভালোই রোজগার করছে। আইডিয়াল জুয়েলরি এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো। আন্ডারগ্রাউন্ড অপারেশনটা তদারক করা হচ্ছে সম্ভবত এই দোকানটা থেকেই। যে-কেউ এসব দোকানে গিয়ে জুয়া খেলতে পারে না, তাদের মেম্বার হতে হয়। মেম্বারদেরও ভালো করে সার্চ করে দোকানে ঢোকানো হয়… নো গান, নো ক্যামেরা। চট করে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে হয় যাতে কারো চোখে না পড়ে। এত সব জেনেও এদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না কেন? সেটা করা যেত খেলা চলার সময় হঠাৎ হানা দিতে পারলে, কিন্তু তার জন্য ওয়ারেন্ট চাই। নইলে সেটা হবে ইল্লিগ্যাল ব্রেক-ইন, কোর্টে কেস দাঁড়াবে না। আর ওয়ারেন্টের জন্য একজন জজকে প্রথমে বোঝাতে হবে যে এই সন্দেহের একটা যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি আছে। জজরা আবার প্রাইভেসিতে এত বিশ্বাসী, কাজটা খুব সহজ নয়।

 

এইবার ফারার প্রসঙ্গে আসি। ফারার মৃতদেহ পাওয়া গেছে হার্লেমের একটা পরিত্যক্ত স্কুল বিল্ডিং-এর পাশে। বিল্ডিংটা ভাঙা হচ্ছে, দুটো ডাম্পস্টার-এর মাঝখানে বডিটা রাখা ছিল। সেই জন্যেই ক’দিন কারোর চোখে পড়েনি। লুঠ করাই মনে হয় উদ্দেশ্য ছিল, রেপ এর কেস নয়। হ্যান্ডব্যাগ, জুয়েলরি– সবই অদৃশ্য। ড্রাগ অ্যাডিক্টরা দশ-কুড়ি ডলারের জন্যেও খুন করে। নিশ্চয় ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিল, বাধা দেওয়ায় ছুরি মেরেছে। বডিটার প্রিলিমিনারি আইডেন্টিফিকেশন হয়ে গেছে। করেছে নিউ ইয়র্কের ইরানিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের একজন মেম্বার। মেয়েটি ওদের পাড়াতেই থাকত, কাজ করত আইডিয়াল জুয়েলরিতে। মনে হয় যখন কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিল, তখনই ব্যাপারটা ঘটেছে। ফারার ভাইকে খবর দেওয়া হয়েছে ফর্মালি বডিটা আইডেন্টিফাই করতে।

 

একেনবাবু মন দিয়ে সব শুনছিলেন। এবার মুখ খুললেন, “আপনি স্যার, জানেন কি না জানি না এই ম্যাডাম ফারার কাছ থেকে আমার পরিচিত ইন্ডিয়ান বিজনেসম্যান একটা দামি কাফলিংক কিনেছিলেন।”

 

“তাই নাকি!”

 

“হ্যাঁ স্যার, ব্রজদুলালবাবু, মানে এই বিজনেসম্যানকে দিন দুই আগে ব্ল্যাকমেল করা হয় ম্যাডাম ফারার সঙ্গে কতগুলো ঘনিষ্ঠ, বলতে পারেন অশ্লীল ছবি দেখিয়ে। কাফলিংক ফেরত না দিলে নাকি সেগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে!”

 

“তারপর?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট খুবই ঔৎসুক্য নিয়ে প্রশ্নটা করলেন।

 

“ব্রজদুলালবাবু ঝামেলা এড়াতে কাফলিংক ফেরত দিয়ে দেন। পুলিশকেও ব্যাপারটা জানাননি। কারণ ওঁকে ভয় দেখানো হয়েছিল পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই ছবিগুলো ইন্টারনেটে তুলে দেওয়া হবে।”

 

“ছবিগুলো কি আমি দেখতে পারি?”

 

“নিশ্চয় স্যার, আমি তার বন্দোবস্ত করতে পারি।”

 

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে দেখে মনে হল একটু চিন্তিত।

 

“আপনি কিছু ভাবছেন স্যার?”

 

একেনবাবুর কাছে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট সাধারণত কিছু লুকোন না। বললেন, “হ্যাঁ।”

 

আমরা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকালাম।

 

“নিশ্চয় এই কাফলিংকটাই ছিল এভিডেন্স… এখন সেটা গন ফর এভার!”

 

“তার মানে?”

 

“আইডিয়াল জুয়েলরির একটা কাফলিংকে স্পাই ক্যামেরা ঢোকানো ছিল… কারা কারা আসছে, কী করছে রেকর্ড করার জন্য। সেটাই মনে হচ্ছে বদমায়েশরা অদৃশ্য করেছে।”

 

“দাঁড়ান স্যার, আপনি কী করে জানলেন সেটা?”

 

“এফবিআই-এর এক এজেন্ট দোকানটার ওপর নজরদারি করার জন্য কয়েকদিন আগে একটা দামি কাফলিংক কিনে তাতে স্পায়িং ডিভাইসটা ঢুকিয়ে ছিল। পরে পছন্দ হচ্ছে না বলে কাফলিংকটা ফেরত দিয়েছিল।”

 

আমি বললাম, “কিন্তু আইডিয়াল জুয়েলরি তো রিটার্ন নেয় না!”

 

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট মুচকি হেসে বললেন, “সেই এজেন্টটি ইয়ং এবং দারুণ হ্যান্ডসাম। কিছু একটা করে ম্যানেজ করেছিল নিশ্চয়। অবভিয়াসলি দুষ্কৃতিকারীদের কেউ এই স্পায়িং ডিভাইসের কথা জানতে পেরেছিল, যার জন্য এই ব্ল্যাকমেল।”

 

“আমি একটু কনফিউসড স্যার, সেটা জানল কী করে?”

 

“সেটা আর জানতে পারব না। যেটা জানি, যে-এজেন্ট স্পাইং ক্যাম-রেকর্ডার ঢুকিয়েছিল আর ওই এজেন্টের পার্টনার যে গত পরশু ওটা কিনতে গিয়ে দোকানে পায়নি, তারা দুজনেই মিস্টিরিয়াসলি ডেড!”

 

“মিস্টিরিয়াসলি স্যার?”

 

“হ্যাঁ, একটা বিশাল ট্রাকের ধাক্কায় ওদের গাড়ি চুরমার হয়ে গেছে। ঘটেছে গভীর রাত্রে, ট্রাকটা অদৃশ্য। ট্রাকটার খোঁজ করা হচ্ছে। তবে আমার মনে হচ্ছে এটা অ্যাকসিডেন্ট নয়, এটা খুন। করেছে একটা মাফিয়া গ্যাং, যাদের ইনফর্মার এফবিআই তেও আছে।”

 

“আই সি। তবে একটা প্রশ্ন স্যার, এফবিআই এর মধ্যে জড়াচ্ছে কেন, গ্যাম্বলিং তো পুলিশের সমস্যা!”

 

“ঠিক পুলিশের সমস্যা আর নয়। কিছুদিন আগে একটা বড়োসড়ো জাল নোটের বান্ডিল ম্যানহাটানেই পাওয়া গিয়েছিল। এই জালনোটের ব্যবসা– অর্থাৎ, ওগুলো বানানো, ব্যবহার করা, বাজারে ছাড়া সব হচ্ছে ফেডারেল ক্রাইম যা এফবিআই-এর এক্তিয়ারে পড়ে। কয়েকটা জাল নোট-এর সঙ্গে আইডিয়াল জুয়েলরির যোগ ওদের এজেন্ট আবিষ্কার করেছে। ঠিক কী করে আমি নিজেও জানি না। কিন্তু ওদের অবস্থাও আমাদের মতো। এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই যেটা ফেডারেল জজের কাছে পেশ করে খানাতল্লাশের ওয়ারেন্ট বার করতে পারে।”

 

“এবার বুঝলাম স্যার।”

 

“যাইহোক, তোমার এই বিজনেসম্যান-এর সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। আজকে তো আর হবে না, কিন্তু কাল সকালে।”

 

“ঠিক আছে স্যার, আমি ওঁকে ফোন করছি।” বলে একেনবাবু বোঁ করে ওঁর ঘরে চলে গেলেন। হাড় কেপ্পন লোক, টেলিফোন লাইনে ফোন করলে খরচা বাঁচে।

 

খানিক বাদে বেরিয়ে এসে বললেন, “না স্যার, ফোনে ওঁকে ধরতে পারছি না। ওঁর এক অ্যাসোসিয়েট শ্রীবাস্তবের সঙ্গে কথা হল। তিনিও একই হোেটলে আছেন আর এই ব্ল্যাকমেলের ব্যাপারটা জানেন। ব্রজদুলালবাবু আটটার আগে ঘুম থেকে ওঠেন না। তার পরে আসতে বললেন। তাছাড়া ব্রজদুলালবাবুর স্ত্রীও হোটেলে আছেন, সেটাও জানালেন। ব্যাপারটা একটু সেন্সেটিভ তো, তাই বোধহয়। আমি বলেছি কালকে সকালে আমরা আসব।”

 

“ঠিক আছে, আমি তোমাদের হোটেলে মিট করব। কোন হোটেল?”

 

“হিলটন-এর ডাবল ট্রি স্যুইটস টাইম স্কোয়ারে।

 

 

ছয়

প্রমথ যেতে পারল না। আমি আর একেনবাবু যখন গিয়ে পৌঁছোলাম তার আগেই মনে হল ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট পৌঁছে গেছেন। বেশ কিছু পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেখে সন্দেহ হল, একটা কিছু গণ্ডগোল হয়েছে! সন্দেহটা ভুল নয়। হোহাটেলের লবিতে ঢুকতেই পুলিশ আটকাল। ভাগ্যক্রমে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের এক চেলা, নামটা মনে নেই, একেনবাবুকে চিনতেন। তিনিই আমাদের ঢুকতে দিলেন। দোতলায় ব্রজদুলালবাবুর স্যুইট।

 

সেখানে পৌঁছে দেখলাম ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দরজার মুখে দাঁড়িয়ে। আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “ইয়োর বিজনেসম্যান ফ্রেন্ড ইজ নো মোর। এক ঘণ্টা আগে কেউ ওকে মার্ডার করেছে। স্ট্যান্ড-টু-ডেথ! আমার দু-জন কলিগ তোমাদের এ নিয়ে কিছু প্রশ্ন করবে।”

 

“নিশ্চয় স্যার, যতটুকু জানি নিশ্চয় বলব।”

 

.

 

এই ফ্লোরে মনে হল অনেকগুলো স্যুইট। আমাদের তারই একটাতে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নিয়ে গেলেন। খানিক বাদেই সাধারণ পোশাকে দু-জন ঘরে ঢুকলেন। তাঁদের একজন ডেভ বলডুইন, এফবিআই-এর ফিল্ড অফিসার। দ্বিতীয় জন হলেন ৩০নং প্রিসিঙ্কট-এর ক্যাপ্টেন ল্যারি স্টকটন। আমাদের আলাদা আলাদা বিবৃতি নেওয়া হল পাশের একটা ছোটো ঘরে। প্রথমে একেনবাবুর, তারপর আমার। আমাকে প্রশ্ন করলেন ল্যারি। ব্রজদুলালবাবুর সঙ্গে আমার আর একেনবাবুর কী কী কথা হয়েছে তা আদ্যোপান্ত জানতে চাইলেন। তারপর প্রশ্নের বাঁকটা একটু অন্যদিকে গেল। ব্রজদুলালবাবুর বিয়ে কতদিন হয়েছে, ওঁর স্ত্রীর কোনো বন্ধুদের চিনি কিনা, মিস্টার শ্রীবাস্তব সম্পর্কে কিছু জানি কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

বুঝতে অসুবিধা হল না, ওঁরা ব্যাপারটা পরকীয়া অ্যাঙ্গেল থেকেও দেখছেন। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যারি বুঝতে পারলেন পরকীয়া অ্যাঙ্গেল যদি কিছু থেকেও থাকে, আমার কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। আমি ওঁদের দুজনের কাউকেই চিনি না। আর একেনবাবুও মিস্টার শ্রীবাস্তবের সঙ্গে শুধু একবারই ফোনে কথা বলেছেন।

 

ওঁদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে বাইরের ঘরে এসে চোখে পড়ল একজন যুবক ও যুবতী শঙ্কিত মুখে সোফায় বসে আছে। একেনবাবু নেই। যুবকটি আমাকে দেখে উঠে এল।

 

“আপনি কি মিস্টার একেন সেন?”

 

“না।”

 

বলতে বলতেই দেখি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে একেনবাবু ঘরে ঢুকছেন।

 

বললাম, “যাঁকে খুঁজছেন, ইনিই হচ্ছেন সেই একেনবাবু।”

 

“আপনিই একেনবাবু!”

 

“হ্যাঁ, স্যার।”

 

“আমি শ্রীবাস্তব, ব্রজদুলালবাবু ছিলেন আমার বস।”

 

“বুঝতে পেরেছি স্যার, আপনার সঙ্গেই তো ফোনে কাল কথা হল।”

 

“ঠিক। আসলে আপনার ওপর স্যারের খুব আস্থা ছিল। সুকন্যা, মানে স্যারের স্ত্রী খুব ভয় পাচ্ছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে এই মার্ডার কেসে যদি ওকে জড়িয়ে ফেলা হয়! পুলিশ নানান ভাবে ওকে জেরা করছে। আমাকেও করছে।” গলার স্বরটা কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে শ্রীবাস্তবের।

 

সোফায় বসে থাকা যুবতীটিই নিশ্চয় সুকন্যা, ব্রজদুলালবাবুর স্ত্রী। হাতে ছোট রুমাল, ঘন ঘন চোখ মুছছেন। অসহায় ভীত সন্ত্রস্ত চেহারা। সুন্দরী ঠিক নন, কিন্তু শোকাচ্ছন্ন চেহারাতেও সেক্সিনেসটা ঢাকা পড়েনি।

 

“কী মুশকিল স্যার, পুলিশ তো এগুলো করবেই তদন্তের স্বার্থে। এতে ভয় পাবার তো কিছু নেই!” একেনবাবু একটু জোর গলাতেই বললেন, যাতে সুকন্যার কানে যায়।

 

“তাও আপনি যদি ওর সঙ্গে একটু কথা বলেন। আসলে সুকন্যা শুধু স্যারের স্ত্রী নয়, আমি ওকে চিনি বহু দিন ধরে।”

 

“কথা তো নিশ্চয় বলতে পারি স্যার। কিন্তু এই তদন্তে আমার তো কোনো হাত নেই।”

 

“তা জানি, কিন্তু ও যদি জানে ওর স্বার্থ আপনি দেখবেন, তাহলে মনে ভরসা পাবে।”

 

“স্বার্থ তো দেখেন স্যার উকিল। ঠিক আছে স্যার, আমি নিশ্চয় কথা বলছি ওঁর সঙ্গে। তার আগে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।”

 

একেনবাবু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে কী বললেন জানি না, কিন্তু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দেখলাম সম্মতি দিলেন। একেনবাবু এসে ব্রজদুলালবাবুর স্ত্রীকে নমস্কার করে বললেন, “ম্যাডাম, আমার নাম একেন সেন, আমি আপনার স্বামীর পরিচিত।”

 

ব্ৰজদুলালবাবুর স্ত্রী সুকন্যা ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, “আপনার নাম আমি শুনেছি। আপনি প্লিজ ওঁকে কে হত্যা করল বার করুন। আমার খুব ভয় করছে। আমার মনে হচ্ছে এরা আমাকে আর সুধীরকে সন্দেহ করছে।”

 

“সুধীর কে ম্যাডাম?”

 

উনি সুধীরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শ্রীবাস্তব, ওকে আমি সুধীর বলে ডাকি।”

 

“এটা কেন ভাবছেন ম্যাডাম?”

 

“যে-ভাবে আমাদের প্রশ্ন করছে, তাতে তো সে-রকমই মনে হচ্ছে। ওঁর অফিস এখানে থাকলেও অফিসের কাউকেই তেমন ভাবে আমি চিনি না। আপনার ওপর ওঁর অনেক আস্থা ছিল। আমার তরফ থেকে আপনি এই তদন্তের ভার নিন। প্লিজ।”

 

একেনবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন। “বেশ, ম্যাডাম, নিচ্ছি। কিন্তু আপনাকে কিছু প্রশ্ন আমার করতে হবে। এখন তো করা যাবে না। এখানে পুলিশদের কাজ শেষ হোক, তারপর কথা বলব।”

 

সুকন্যার শুকনো মুখ দেখে একেনবাবু আশ্বস্ত করলেন, “আপনি ভয় পাবেন না ম্যাডাম। এরা দোষীদেরই ধরবে, নির্দোষীকে নয়।”

 

একেনবাবুর কথায় মনে হল সুকন্যা একটু স্বস্তি পেয়েছেন।

 

“এখন আমরা আসছি ম্যাডাম। মিস্টার শ্রীবাস্তবের নম্বর আমার কাছে আছে, আমিই আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।”

 

.

 

সকালবেলায় আজ ভালো করে ব্রেকফাস্টও খাওয়া হয়নি। সুকন্যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লবিতে নেমে একেনবাবুকে বললাম, “কি মশাই, হোটেলের কফিশপ-এ একটু কিছু খেয়ে নিলে হত না?”

 

“খেপেছেন স্যার, এই হোটেলে খাওয়া মানে তো টাকার শ্রাদ্ধ! তার চেয়ে চলুন বাইরে ছোটোখাটো কোনো জায়গায় যাই। একটা ডানকিন ডোনাটের দোকান দেখলাম স্যার। সস্তায় ভালো ব্রেকফাস্ট পাওয়া যায় ওখানে।”

 

“ভালো কতটা হবে জানি না। কিন্তু আপনি যখন বলছেন সস্তা, সেটা মানতে আমি রাজি।”

 

আমরা যখন বেরোচ্ছি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টও আমাদের সঙ্গ নিলেন।

 

“আপনি স্যার ওঁদের সঙ্গে থেকে গেলেন না যে!”

 

“আরে না, এটা তো হল ল্যারির সমস্যা, মার্ডারটা ওর এরিয়াতে ঘটেছে। আর এফবিআই তো আছে সাহায্য করতে। ওদের এখনও ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। মার্ডার ভিক্টিমের স্ত্রীকে আরেকটা সুইট-এ সরিয়ে দেবে, ঘরটা সিল করবে, দুয়েকটা স্টাফকে প্রশ্ন-টশ্ন করবে। আমি ভাবলাম অফিসে ফেরার আগে তোমাদের সঙ্গে একটু গল্প করে যাই।” তারপর মুচকি হেসে বললেন, “তুমি তো মনে হচ্ছে বিজনেসম্যানের ইয়ং উইডোর হয়ে খুনির খোঁজ করবে!”

 

“আসলে স্যার, ম্যাডাম ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন ওঁকে সাসপেক্ট করা হচ্ছে ভেবে।”

 

“তা ঠিক। কিন্তু সাসপেক্ট করাটা কি খুব ভুল? তোমাদের এই বিজনেসম্যান একজন মধ্যবয়স্ক লোক। স্ত্রী কমবয়সি যুবতী, যার সঙ্গে বিজনেসম্যানের ইয়ং অ্যাসোসিয়েটের সম্পর্কটা মনে হয় বেশ ঘনিষ্ঠ। বিজনেসম্যান না থাকলে দু-জনে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ-ডিনার করে। হাবেভাবে ওদের অন্তরঙ্গতা খুব স্পষ্ট, হোটেলের অনেকেই সেটা কনফার্ম করেছে।”

 

“ওঁরা কি স্যার নিজেদের বন্ধু-সম্পর্কটা অস্বীকার করছেন?”

 

“তা নয়, কিন্তু একে অন্যের বিষয়ে উত্তর দিতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। বোঝাই যাচ্ছে ওদের এই রাঁদেভগুলো বিজনেসম্যানের অজান্তে হয়েছে।”

 

“ইন্টারেস্টিং স্যার, ভেরি ইন্টারেস্টিং। কিন্তু স্যার খুনটা হয়েছে কী ভাবে? আপনি তো বললেন স্ট্যান্ড-টু-ডেথ।”

 

“ঠিক, বিজনেসম্যান যখন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছিলেন, তখন কেউ সামনে এসে বুকে ছুরি মেরেছে।”

 

“মাই গড ঘরে ঢুকল কী করে? ছুরিটা পাওয়া গেছে?”

 

“না, আততায়ী কোনো চিহ্ন রেখে যেতে চায়নি, ওটা নিয়েই অদৃশ্য হয়েছে।”

 

“ম্যাডাম তখন কোথায় ছিলেন?”

 

“ওঁর বক্তব্য সকালে স্নান শেষ করে নীচে কফিশপে ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন স্বামীর দেহ চেয়ারে হেলানো অবস্থায়। বুকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। হি ওয়াজ ডেড। দেখেই উনি চিৎকার করতে শুরু করেন। একজন পোর্টার করিডর দিয়ে যাচ্ছিল। সে এসে ব্যাপারটা দেখে রিসেপশনে ফোন করে। সেখান থেকেই কেউ পুলিশে খবর দেয়।”

 

“ক’টা নাগাদ ঘটেছিল ব্যাপারটা?”

 

“দাঁড়াও, দাঁড়াও। এই ডানকিন ডোনাট-এ গিয়ে তো এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে না! তুমি বরং আমার অফিসে চলো, তোমার সঙ্গে একটা ডিল করি।”

 

“ডিল?”

 

“আগে চলো তো আমার অফিসে। ডোনাট আর কফি না হয় আমার অফিসেই খাবে।”

 

.

 

মিনিট কুড়ির মধ্যেই আমরা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের অফিসে পৌঁছোলাম। সবার জন্য কফি আর ডোনাট-এর অর্ডার দিয়ে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বললেন, “হ্যাঁ যে ডিল-এর কথা বলছিলাম… তোমাকে আমি এই মার্ডারের ব্যাপারে যা জানি সব জানাব, যাতে তুমি তোমার ক্লায়েন্ট, মানে ওই উইডো লেডিকে সাহায্য করতে পারো। তার বদলে তুমি আমাকে সাহায্য করবে আইডিয়াল জুয়েলরির জুয়োচক্র-জট খোলার ব্যাপারে। আমি এ ব্যাপারে বিশেষ এগোতে পারছি না, এদিকে চাপ আসছে উপর থেকে। ডিল?”

 

“হ্যাঁ স্যার, ডিল। আমার ক্ষমতায় যা কুলোয় সবটুকু করব।”

 

“গুড, তাহলে এই মার্ডারের ব্যাপারে যতটুকু উদ্ধার হয়েছে বলি..” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট শুরু করলেন, “যেটা তোমাকে আগেই বলেছি, বিজনেসম্যানের স্ত্রীর বিবৃতি অনুসারে খুন হবার সময়ে তিনি ঘরে ছিলেন না, স্নান করে নীচে কফি শপ-এ খেতে গিয়েছিলেন। এটা ঠিক, সকালে উনি মৃতের বিজনেস অ্যাসোসিয়েট শ্রীবাস্তবের সঙ্গে কফিশপ-এ ব্রেকফাস্ট করেছিলেন। এটাও সম্ভবত ঠিক, উনি স্নান করেই কফি শপে গিয়েছিলেন, কারণ শাওয়ার স্টল ভিজে, কার্টেন ভিজে, এবং র‍্যাকে রাখা তোয়ালে ভিজে। অর্থাৎ সেটা ব্যবহার করা হয়েছিল সকালে। কিন্তু এর থেকে প্রমাণ হচ্ছে না, খুনের সময়ে উনি ঘরে ছিলেন না।

 

রুম-সার্ভিসের অর্ডার দিয়েছিলেন বিজনেসম্যান নিজে। গত আট-দশদিন ধরে বিজনেসম্যানই ব্রেকফাস্টের জন্য রুম-সার্ভিস নিচ্ছেন, সুতরাং সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সাধারণত অর্ডার করেন ফ্রায়েড এগ, টোস্ট, সসেজ আর হ্যাঁশ ব্রাউন। এদিনও সেটাই করেছিলেন। সঙ্গে টমাটো জুস আর কফি। রুম সার্ভিসের যে স্টাফ খাবার দিয়ে গেছে, সেও ঘরে আর কাউকে বা অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি। বিজনেসম্যান অন্যান্য দিনের মতো একাই বসার ঘরে ছিলেন। খাবারের ট্রে টেবিলে রেখে যখন ও চলে আসছে, বিজনেসম্যান দরজাটাকে ‘আন-লকড’ রেখে যেতে বলেন! রুম সার্ভিসের ছেলেটির মনে হয়েছিল কারোর জন্য উনি অপেক্ষা করছেন… দরজা খোলার জন্য খাওয়া ছেড়ে যাতে ওঁকে উঠতে না হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় ডোর-ল্যাচটা ও খুলে রেখেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, কার জন্য বিজনেসম্যান অপেক্ষা করছিলেন? লোকটি কি তোমার ক্লায়েন্ট, মানে ওই ইয়ং উইডোর ফিঁয়াসে না অন্য কেউ!”

 

কথাটা শুনে আমার একটু অবাক লাগল। জিজ্ঞেস করলাম, “ইয়ং উইডোর জন্যেও তো হতে পারত?”

 

“মনে হয় না। প্রতি সকালেই বিজনেসম্যানের স্ত্রী নীচে খেতে যান, এই রিকোয়েস্ট রুম-সার্ভিস স্টাফকে আগে কখনো করেননি।”

 

এমন সময়ে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের টেবিলের একটা ফোন বেজে উঠল।

 

“আমাকে এখুনি ছুটতে হবে। পুলিশ চিফ এমার্জেন্সি মিটিং ডেকেছেন।”

 

.

 

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাবার পর কফি আর ডোনাট এল। সেগুলো সদ্ব্যবহার করলাম। আজ আমার কোনো ক্লাস ছিল না। থাকার মধ্যে ছিল রিসার্চ প্রজেক্টের একটা কাজ। ঘণ্টা দুয়েকের বেশি লাগার কথা নয়। একেনবাবুকে সেটা বলতেই উনি বললেন, “ঠিক আছে স্যার, আমিও সেই ভাবেই আপনার অফিসে আসব। আপনার কাজ শেষ হলে একসঙ্গে হোটেলে গিয়ে সুকন্যা ম্যাডামের সঙ্গে আরেকটু কথা বলব।”

 

আমি ‘না’ আর করলাম না। মনে হচ্ছে একটা ইন্টারেস্টিং কেসে জড়িয়ে পড়ছি। প্রমথটা সব অ্যাকশন মিস করছে। পরে গল্প শুনে আফশোস করবে।

 

আমার কাজ শেষ হতে না হতেই দেখি একেনবাবু অফিসে এসে হাজির। এসে বললেন, “চলুন স্যার, সুকন্যা ম্যাডাম ঘরেই আছেন। ওঁর নতুন ঘরের নম্বরটা দিয়েছেন।”

 

 

সাত

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছোলাম সুকন্যা তখন একজন বয়স্কা মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলেন। দূর-সম্পর্কের মাসি, নিউ ইয়র্কে ছেলের কাছে বেড়াতে এসেছিলেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছেন। একেনবাবু ঠিক করলেন ওঁদের ডিস্টার্ব না করে শ্রীবাস্তবের সঙ্গে একটু কথা বলবেন।

 

শ্রীবাস্তব নিজের ঘরে ছিলেন না। হোটেলের বিজনেস সেন্টারে বসে কতগুলো কাগজপত্র দেখছিলেন। খোঁজখবর করে সেখানে গিয়ে পৌঁছোতে আমাদের দেখে অবাক হয়ে একটা শুকনো হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করলেন।

 

“ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম, কিন্তু ঘরে বোধহয় ওঁর মাসি বসে আছেন, তাই ভাবলাম, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলি।”

 

“নিশ্চয়।”

 

“আচ্ছা, ব্ৰজদুলালবাবুকে কিছুদিন আগে কেউ ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছিল, সে ব্যাপারে আপনি কতটুকু জানেন?”

 

“আমার ধারণা অনেকটাই জানি। উনি পঁচিশ হাজার ডলার দিয়ে একটা কাফলিংক কিনেছিলেন আইডিয়াল জুয়েলরি থেকে। স্যার ছিলেন একজন সিরিয়াস কাফলিংক কালেক্টর। একদিন এক বিজনেস মিটিং-এ কাফলিংকের কথা উঠতে একজন দোকানটার কথা বলেন। সেটা শুনে জায়গাটা আমি দেখে এসেছিলাম। ছোটো দোকান, কিন্তু কাফলিংকের বেশ ভালো কালেকশন। পরে স্যারকে নিয়ে আমি একদিন ওখানে গিয়েছিলাম। এরমধ্যে স্যার নিজেই একদিন যান। ফিরে এসে আমাকে বলেন আইডিয়াল জুয়েলরির নামে একটা পঁচিশ হাজার ডলারের ব্যাঙ্ক চেক কাটতে। চেকটা আমাদের কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকেই কাটতে হয়, কারণ এদেশে স্যারের নিজের অ্যাকাউন্ট নেই। তবে টাকাটা নেওয়া হয় স্যারের ডিসক্ৰিশানারি ফান্ড থেকে। এই কাফলিংক নিয়ে পরে একটা সমস্যা হয়। যে মেয়েটি কাফলিংক বিক্রি করেছিল, স্যার-এর সঙ্গে তোলা তার কয়েকটা ঘনিষ্ঠ ছবি দেখিয়ে একজন কাফলিংকটা ফেরত চায়। ফেরত না পেলে ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। স্যার ভীষণ ভয় পেয়ে যান। কী করা যায়, এই নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনাও হয়। আমি বলেছিলাম কাফলিংক ফেরত না দিতে, স্যার রাজি হন না। শেষে দুজনে মিলে ব্ল্যাকমেলারের কথা মেনে পোর্ট অথরিটির টার্মিনালে তার জানানো নির্দিষ্ট জায়গায় ওটা দিয়ে আসি।”

 

“দাঁড়ান স্যার, ছবিগুলো কী ভাবে দেখিয়েছিল?”

 

“ছবিগুলো এসেছিল একটা খামে।”

 

“কোন ঠিকানায়? হোটেলের?

 

“না, স্যারের নামে আমাদের এখানকার অফিসের ঠিকানায় কেউ এসে দিয়ে গিয়েছিল।”

 

“ইন্টারেস্টিং। একটা কথা স্যার, যে ছবিগুলো ওরা দেখিয়েছিল, সেগুলো কি আপনার কাছে আছে?”

 

শ্রীবাস্তব কী জানি ভাবল, তারপর বলল, “স্যার জীবিত নেই, তাই এগুলো দেখাতে বোধহয় এখন আর কোনো বাধা নেই।”

 

পাশে রাখা ফাইল ফোল্ডার থেকে তিনটে ছবি এগিয়ে দিল।

 

প্রথম ছবিতে ব্রজদুলালবাবু একটি সুন্দরী মেয়েকে কিছু দিচ্ছেন,… মনে হচ্ছে টাকা। দ্বিতীয় ছবিটা একটু ঝাপসা। মেয়েটি উলঙ্গ অবস্থায় শুয়ে আছে। বিছানার একদিকে একটা আলো, অন্যপাশে একটা ফুলদানিতে একগুচ্ছ ফুল। ব্রজদুলালবাবুর পিছনটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়েটির বুকে চুমু খাচ্ছেন। তৃতীয় ছবিটা আরও ঝাপসা… মেয়েটিকে জড়িয়ে অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় যিনি শুয়ে আছেন, তাঁকে দেখতে অনেকটা ব্রজদুলালবাবুর মতোই।

 

“দুটো ছবি কিন্তু খুব ঝাপসা… এগুলো তো বানানোও হতে পারে স্যার।”

 

“আমারও তাই মনে হয়েছিল, কিন্তু স্যার ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। উনি ইদানীং ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন। প্রায়ই ভুলে যান একটু আগে কী করেছেন… মাঝেমাঝেই একটা কনফিউশন আর ডিজওরিয়েন্টেশনের মধ্যে থাকেন। স্যারের মনে হয়েছিল কোনো একটা ঘরে ঢুকে হয়তো এগুলো করেছিলেন!”

 

“আপনার কী মনে হয় স্যার?”

 

“আমার বিশ্বাস এগুলো কারসাজি করে বানানো। স্যারকে নিয়ে নানান গসিপ হয়, কিন্তু আমি যতদিন ওঁকে চিনি, অনৈতিক কিছু করতে দেখিনি। বিশেষ করে এই সময়ে, যখন জীবনের বেশিদিন বাকি নেই।”

 

“তার মানে? এটা ঠিক বুঝলাম না।”

 

“স্যার ক্যানসারে ভুগছিলেন, সেটা ব্রেইন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বড়োজোর আর মাস ছয়েক বাঁচতেন, হয়তো বা আরেকটু বেশি। বেশিদিন উনি থাকবেন না আমরা ধরেই নিয়েছিলাম। কিন্তু এইভাবে হঠাৎ শেষ হয়ে যাবেন ভাবিনি।” শেষ কথাটা বলতে বলতে শ্রীবাস্তবের গলা ধরে এল।

 

“এগুলো কি আপনি পুলিশকে জানিয়েছিলেন?”

 

“না। পুলিশ শুধু প্রশ্ন করেছে আর তার উত্তর চেয়েছে। ওঁদের ফোকাস ছিল আমার আর সুকন্যার ওপরে, আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে।”

 

“কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক মানে?”

 

“আপনি সুকন্যার স্বার্থ দেখছেন, সেক্ষেত্রে আমি কিছু লুকোব না। আমি সুকন্যাকে ভালোবাসি সুকন্যার সঙ্গে স্যারের বিয়ে হওয়ার আগের থেকেই। নানান কারণে আমাদের বিয়েটা হয়নি। স্যার যখন সুকন্যাকে বিয়ে করেন, তার আগেই ওঁর ক্যানসার ধরা পড়ে। আমরা জানতাম একদিন দু-জনেই দুজনকে পাব, শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু সুকন্যাকে ভুল বুঝবেন না, স্যারকে ও বঞ্চনা করেনি। আমার সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়নি, বিশ্বাস করুন। স্যারও আমাদের ভালোবাসার কথা জানতেন। আমাকেও স্নেহ করতেন।.. আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করছেন না?”

 

“কী যে বলেন স্যার, তবে এটা মানতে অনেকেরই অসুবিধা হবে।”

 

“সেটাই। পুলিশের ধারণা এই খুনের সঙ্গে সুকন্যা আর আমি যুক্ত!”

 

“আসলে কি জানেন স্যার, ব্রজদুলালবাবুর মৃত্যুতে আর্থিক ভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা তো আপনার আছে, মানে ম্যাডামের অ্যাঙ্গেল থেকে।”

 

“আমরা সেটা জানি। কিন্তু সেই সন্দেহ দূর করব কী করে সেটাই জানি না!”

 

“ট্রু স্যার, ভেরি ট্রু। কিন্তু সন্দেহই তো যথেষ্ট নয়।” মাথা চুলকোলেন একেনবাবু।

 

“তার মানে?”

 

“শুনুন স্যার, মোটিভের সঙ্গে মিনস এবং অপরচুনিটিও দরকার। আপনি যে মৃত্যুর সময় ওঁর ঘরে ছিলেন সেটা প্রমাণ করতে হবে, ব্রজদুলালবাবুকে যে ছুরি দিয়ে খুন করা হয়েছে, সেটা খুঁজে বার করতে হবে। অন্য কাউকে দিয়ে খুন করানো হলে টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপারটা বার করতে হবে, তাই না? সেটা কি পুলিশ পারবে স্যার?”

 

শ্রীবাস্তব চুপ করে রইলেন। একেনবাবু ওঁর টিমে না বিপক্ষ দলে শ্রীবাস্তব বোধহয় সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন।

 

“একটা কথা স্যার, সুকন্যা ম্যাডাম এই ছবিগুলোর কথা জানেন?”

 

উত্তরটা দিতে শ্রীবাস্তব একটু অস্বস্তি বোধ করল। “হ্যাঁ, ছবিগুলো হঠাৎ করেই ওর নজরে এসেছিল।”

 

“কী ভাবে স্যার?”

 

“আমার এই ফাইল ফোল্ডারে মেসি-জ থেকে কেনা কাটলারি সেট-এর একটা রিসিট ছিল। সেটটা কিনে আনার পর ওর পছন্দ হয়নি। ফেরত দেবার জন্য যখন দোকানের রিসিট খুঁজছিল, আমিই বলেছিলাম স্যারের পার্সোনাল ফোল্ডারে ওটা রয়েছে। আমার খেয়াল ছিল না, ছবিগুলোও ওখানেই রাখা আছে।”

 

“দেখে কি রিয়্যাকশন হল স্যার?”

 

“ভীষণ রেগে গিয়েছিল! এত রাগতে আগে ওকে দেখিনি। স্যার আন-ফেইথফুল, এটা ও মানতে পারছিল না। আমি বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম ছবিগুলো জাল। স্যার যে আইডিয়াল জুয়েলরিতে কাফলিংক কিনতে গিয়েছিলেন, মেয়েটা সেখানকারই সেলসগার্ল। নিশ্চয় ওখানেই দু-জনের ছবি তুলে এগুলো কেউ ফটোশপ করেছে। ভাবছে ব্ল্যাকমেল করে কিছু টাকা পাবে।”

 

“উনি কি সেটা মেনে নিয়েছিলেন?”

 

“প্রথমে মানতে চায়নি, পরে শান্ত হয়েছিল।”

 

“কাফলিংকটা যে আপনারা ফেরত দিয়েছিলেন, সেটা ম্যাডাম জানেন?”

 

“না।”

 

“কেন স্যার?”

 

“ওরা যে কাফলিংকের জন্য ব্ল্যাকমেল করছে ও জানত না। ও খুবই বুদ্ধিমতি, কাফলিংক ফেরত দেওয়া হয়েছে শুনলে দুয়ে-দুয়ে এক করে বুঝে যেত ছবিগুলো বানানো নয়।”

 

“এবার বুঝলাম, স্যার। পুলিশকে এগুলো দেখিয়েছেন?”

 

“না।”

 

“কেন নয় স্যার? কেউ যে ব্রজদুলালবাবুকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছিল, সেটা তো পুলিশের কাছে একটা দরকারি তথ্য।”

 

“আসলে ছবিগুলোর বিষয়টা প্রকাশ্যে আনতে চাইনি। পুলিশকে জানালে ওরা হয়তো স্যারকে হত্যা করার আরও একটা মোটিভ খুঁজে পেত… স্বামী অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে কিছু করছে… হত্যা করার সেটাও তো একটা মোটিভ হতে পারে।”

 

“ভালো কথা স্যার, বিয়ের আগে সুকন্যা ম্যাডাম কী করতেন?”

 

“মাসাজ থেরাপি করত। এক বছর ডাক্তারিও পড়েছিল, বাবা মারা যাওয়ায় টাকাকড়ির অভাবে আর পড়তে পারেনি।”

 

“ব্রজদুলালবাবু তো সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতেন, ম্যাডাম কি তখন হোটেলেই থাকতেন?”

 

“না, না, ওর জন্য একটা লিমো ঠিক করা ছিল। ইচ্ছেমতো বেড়াত, বাজার-টাজার করত। মিটিং না থাকলে আমিও গেছি ওর সঙ্গে। রাত্রে আমরা সবাই ঘুরেছি একসঙ্গে। স্যারের চিন্তা ছিল যাতে ও একা একা বোর্ড না হয়।”

 

একেনবাবু এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “কেউ কি ব্রজদুলালবাবুর খোঁজ করেছিল গত দু-একদিনের মধ্যে?”

 

“গতকাল অফিসে একজন ফোন করেছিল। স্যার ব্যস্ত ছিলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী দরকার?’ লোকটা বলল, তোমার বসের একটা কাফলিংক ফেরত দেবার কথা ছিল, কিন্তু দেননি। লোকটার গলার স্বর আর বলার ভঙ্গিতে আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, কোন কাফলিংক?’ লোকটা বলল, তোমার বস সেটা ভালো করে জানেন।’ আমি বললাম, “সেটা ফেরত দেওয়া হয়েছে। আমি নিজে দিয়ে এসেছি।’ লোকটা বলল, ‘লায়ার!’ আমিও ফোনটা কেটে দিলাম।

 

“এগুলো তো সব আপনার পুলিশকে জানানো উচিত ছিল। আপনি তো চান পুলিশ আসল খুনিকে ধরুক। চান না?”

 

শ্রীবাস্তব কাঁচুমাচু মুখ করে বসে রইল।

 

এমন সময়ে শ্রীবাস্তবের মোবাইলে কেউ ফোন করল। “হ্যালো,” বলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ওঁরা আমার সঙ্গে কথা বলছেন। ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

 

ফোনটা বন্ধ করে বললেন, “সুকন্যা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, আমরা এখনই যাচ্ছি।” বলে একেনবাবু উঠে পড়লেন।

 

হলওয়ে দিয়ে যেতে যেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝছেন মশাই?”

 

“ভাবছি স্যার।”

 

“কী ভাবছেন?”

 

“প্রেম আর জেলাসি অতি বিষম বস্তু, স্যার। অথবা শ্রীবাস্তব অতি ঘোড়েল একটি লোক… আমাদের ঘোল খাওয়াবার চেষ্টা করছেন।”

 

 

আট

আমরা যখন দরজায় নক করলাম, সুকন্যা একাই ঘরে ছিলেন।

 

একেনবাবু বললেন, “সরি ম্যাডাম। আপনাকে আরেকটু বিরক্ত করব। এর মধ্যেই। আমরা শ্রীবাস্তব স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি, খুব হেল্পফুল ম্যাডাম। আপনি তো ওঁকে ভালো করে চেনেন?”

 

কথাটা শুনে সুকন্যার ভুরু একটু যেন কোঁচকাল। “হ্যাঁ, সুধীর আমার ভালো বন্ধু।”

 

“শ্রীবাস্তব স্যার বললেন আপনার স্বামী একটা দামি কাফলিংক কিনেছিলেন কয়েকদিন আগে। আপনি কি সেটা জানতেন ম্যাডাম?”

 

“হ্যাঁ, আমি জেনেছিলাম, কারণ তার জন্য ২৫ হাজার ডলারের একটা ব্যাঙ্ক চেক কাটতে হয়েছিল। এই নিয়ে সুধীরের সঙ্গে যখন ওঁর কথা হচ্ছিল আমি ঘরে ছিলাম।”

 

“একটা কাফলিংকের জন্য অতগুলো টাকা! আমি ম্যাডাম কল্পনা করতে পারি না।”

 

“এর থেকেও দামি কাফলিংক উনি কিনেছেন। কাফলিংক জমানো ছিল ওঁর নেশা। একজন কাউন্টের কাফলিংক উনি ১০০ হাজার ডলার দিয়ে কিনেছিলেন।”

 

“সেই কাফলিংকটা এখন কোথায় ম্যাডাম?”

 

“কলকাতায়।”

 

“আমি বলছি, এই নতুন কেনা কাফলিংকের কথা।”

 

“ঠিক জানি না। সুধীরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলল ও-ও জানে না।”

 

“অত দামি একটা কাফলিংক উনি কোথায় রাখতে পারেন?”

 

“অনেক সময় দামি এবং দরকারি জিনিস উনি কোম্পানির সেফ-এ রাখেন। সুধীরই কাজটা করে। সেই জন্যেই আমার অবাক লাগল সুধীর জানে না।”

 

“একটা কথা ম্যাডাম, আপনি কি সুধীরবাবুর ফোল্ডারে কয়েকটা ছবি দেখেছিলেন… মানে আপনার স্বামী আর একটি মেয়ের?”

 

সুকন্যা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। “আজেবাজে বানানো ছবি! আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানো আগেও হয়েছে… নতুন কিছু নয়।”

 

“কবে দেখেছিলেন মনে আছে ম্যাডাম?”

 

“দিন দুই আগে।”

 

“তারপরে আপনি হোটেলের বাইরে গিয়েছিলেন?”

 

“হ্যাঁ, একটা কাটলারি সেট ফেরত দিতে গিয়েছিলাম।”

 

“একা?”

 

“না, ওঁর অফিসের একটি মেয়ের সঙ্গে।”

 

“আর কোথাও যাননি?”

 

“না।”

 

“মিস্টার শ্রীবাস্তব, মানে সুধীরবাবুকে আপনার স্বামী কতদিন চিনতেন ম্যাডাম?”

 

“বছর দুয়েক।”

 

“যদ্দুর জানি ম্যাডাম, আপনার সঙ্গেও তো স্যারের পরিচয় বছর দুয়েক। তাই না?”

 

“না, আমি তার আগে থেকে চিনতাম। ওঁর সঙ্গে সুধীরের পরিচয় হয় আমাদের বিয়ের পর।”

 

“অল্পদিনের পরিচয় হলেও সুধীরবাবুর ওপর আপনার স্বামীর খুব আস্থা ছিল মনে হয়। তাই না, ম্যাডাম?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“সুধীরবাবুও আপনার স্বামীকে খুব পছন্দ করতেন।”

 

“করত।”

 

“এই প্রশ্নটার জন্য কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে সুধীরবাবুর সম্পর্কটা ঠিক কিরকম ছিল?”

 

সুকন্যা চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, মুখটা থমথমে। তারপর খুব আস্তে আস্তে কিন্তু খুব সুস্পষ্ট ভাবে বললেন, “আমরা দুজনে দুজনকে ভালোবাসি। ভুল বুঝবেন না, আমার স্বামীকে আমি ঠাকাইনি। তিনিও এই সম্পর্কের কথা জানতেন। আমি যখন ওঁর জীবনে আসি, তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত। শরীরের নানান ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। ওঁকে সেবা করতে এসেই ওঁর জীবনে জড়িয়ে পড়ি। আমি জানতাম ওঁর আয়ু বছর দুই আড়াইয়ের বেশি নয়। যদিও উনি মানতেন না… মনের জোরে চলতেন… আপনি আমাকে কী ভাবছেন জানি না, কিন্তু…।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম, এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন নয়। এবার বলুন তো, আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”

 

“না, আমি পুলিশকেও সেটা জানিয়েছি। সে-রকম কাউকে আমি মনে করতে পারি না।”

 

“আপনার স্বামী যখন খুন হন আপনি তখন কোথায় ছিলেন?”

 

“আমি নীচে কফিশপে ছিলাম। ওখানেই আমি আর সুধীর ব্রেকফাস্ট করি। আমার স্বামী একা ব্রেকফাস্ট খেতে পছন্দ করতেন, তারপর দেশের অফিসে অনেকের সঙ্গে কথা বলতেন।”

 

“আই সি। আচ্ছা, আপনার স্বামী কি কাউকে এক্সপেক্ট করছিলেন সকালে?”

 

“আমাকে কিছু বলেননি। অন্যান্য দিন সুধীর সকালে আসে। ওঁর সঙ্গে কাজের দুয়েকটা কথা হয়। ও ব্রেকফাস্ট অর্ডার করে, আমি আর সুধীর নীচে কফিশপ-এ খেতে যাই। কিন্তু আজ সকালে সুধীর ফোন করে বলল, ওর আসতে একটু দেরি হবে। আমি যেন সোজা কফিশপ-এ চলে আসি, ও সেখানে মিট করবে। আমার স্বামী যখন ব্রেকফাস্ট অর্ডার করছেন তখনই আমি বেরিয়ে যাই। তারপর কে এসেছে কোনো ধারণাই নেই।”

 

“আর একটা প্রশ্ন ম্যাডাম… আপনি যখন কফিশপে-এ গিয়ে পৌঁছোলেন, তার কতক্ষণ বাদে মিস্টার শ্রীবাস্তব সেখানে আসেন?”

 

“বেশিক্ষণ নয়, মিনিট কয়েকের মধ্যেই।”

 

“মিনিট কয়েক মানে কি দু-মিনিট, পাঁচ মিনিট, না তার বেশি?”

 

“মিনিট দুয়েকই হবে, তার বেশি নয়।”

 

“ম্যাডাম, আপনি পান খেতে ভালোবাসেন?” হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে সুকন্যা অবাক হয়ে তাকালেন।

 

সামনে কাচের কফি টেবিলে একটা প্লেটে গোটা দুই সাজা পান লবঙ্গ দিয়ে আটকাননা।

 

একেনবাবু পানগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার ফ্যামিলিও খুব ভালোবাসেন। মানে আমার বেটার হাফ, ম্যাডাম। তবে এখানকার পানে দেশের স্বাদ নেই।”

 

“হ্যাঁ, একটু অন্যরকম ঠিকই।”

 

“তবে নেই-মামার থেকে কানা-মামা ভালো। এই রকম ফাইভ স্টার হোটেলে যে পান পাচ্ছেন, সেটাই তো দারুণ ব্যাপার!”

 

“হ্যাঁ, লাকিলি আমিনার সঙ্গে পরিচয় হল, ও প্রতিদিন আমার জন্য পান নিয়ে আসে লেক্সিংটন স্ট্রিটের একটা দোকান থেকে।”

 

“আমিনা!”

 

“বাংলাদেশের মেয়ে, এখানে হাউস কিপিংয়ের কাজ করে।”

 

একেনবাবু জুলু জুলু চোখে পানের দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে সুকন্যা জিজ্ঞেস করলেন, “খাবেন একটা পান?”

 

“আরে না ম্যাডাম। মাত্র দুটো তো আছে!”

 

“তাতে কী হয়েছে! আমিনাকে বললেই আরও কয়েকটা নিয়ে আসবে।”

 

আর বলতে হল না। একেনবাবু একটা মুখে পুরে চোখ বুজে চিবোতে চিবোতে বললেন, “বাঃ, দারুণ টেস্ট ম্যাডাম!”

 

“আপনিও একটা নিন না!” সুকন্যা আমাকে বললেন।

 

“থ্যাঙ্কস, আমি পান খাই না।”

 

.

 

হোটেল থেকে ফেরার পথে একেনবাবু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে ফোন করলেন।

 

“স্যার, আপনি আপনার লোকদের একটু খোঁজ করে দেখতে বলবেন, পোর্ট অথরিটির ‘লস্ট এন্ড ফাউন্ড’ ডিপার্টমেন্ট-এ কোনো সাফায়ার ডায়মন্ড-এর কাফলিংক জমা পড়েছে কিনা। জমা পড়লে আমাকে জানাবেন।”

 

“আপনার মাথায় কী ঘুরছে বলুন তো?” আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম।

 

“আসলে আমি একটু কনফিউসড স্যার। কে সত্যি বলছে, কে মিথ্যে বলছে… কিছুই পরিষ্কার বুঝতে পারছি না!”

 

“আমি কিন্তু বুঝতে পারছি ছবিগুলোর মধ্যে দুটো ছবি ফেক।”

 

“কী করে বুঝলেন স্যার?”

 

“ব্রজদুলালবাবু ফুলের আশেপাশে এলেই অ্যালার্জিতে কাবু হন। আর বিছানা পাশে ফুলদানিতে অতগুলো ফুল, কিন্তু তাও মেয়েটির সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি চালাচ্ছেন!”

 

“মন্দ বলেন নি স্যার। তবে কিনা আমরা জানি না, ফুলগুলো সত্যি ফুল না প্লাস্টিকের।”

 

এটা আমি ভাবিনি, তাই চুপ করে রইলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “পোর্ট অথরিটিতে কাফলিংকের খোঁজ করছিলেন কেন?”

 

“কয়েকটা পসিবিলিটি আছে। একটা হল, কাফলিংকটা শ্রীবাস্তববাবু ভুল জায়গায় ফেলেছিলেন আর ক্লিনার সেটা লস্ট আর ফাউন্ড-এ জমা দেয়। সম্ভাবনাটা ক্ষীণ, কিন্তু অনেস্টম্যান তো এদেশে আছে স্যার। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল, শ্রীবাস্তববাবু কাফলিংকটা নিজেই আত্মসাৎ করেছেন। তার বদলে হাবিজাবি কিছু বালতিতে ফেলেছেন, ব্রজদুলালবাবু দূর থেকে তা দেখেননি। সেক্ষেত্রে কেউ ফোন করে বলতেই পারে যে কাফলিংক তারা পায়নি।”

 

“কিন্তু শ্রীবাস্তব গল্পটা আমাদের করতে যাবে কেন?”

 

“সেটাই ভাবছি স্যার। হয়তো পুলিশই ঠিক পথে এগোচ্ছে স্যার, খুনটা করেছেন মিস্টার সুধীর শ্রীবাস্তব।

 

“কিংবা সুকন্যা।”

 

“সবই সম্ভব স্যার। সুকন্যা ম্যাডাম তো স্যার সুধীরবাবুর প্রেমে হাবুডুবু। তাঁকে তাড়াতাড়ি আপন করে পাবার ইচ্ছে, সেই সঙ্গে যোগ করুন আনফেইথফুল বুড়ো স্বামীর আচরণ। খুব যে রেগে গিয়েছিলেন, সে তো সুধীরবাবুই জানালেন। ম্যাডাম ডাক্তারি পড়তেন, ছুরির ব্যবহার নিশ্চয় জানতেন।”

 

“কল্পনাই যখন করছেন, তাহলে ফারাকেই বা বাদ দিচ্ছেন কেন। তাকেও তো সুকন্যা খুন করতে পারে।”

 

“অপরচুনিটিটা নেই স্যার, অন্তত আমাদের যা বলেছেন, সেটা সত্যি ধরলে।”

 

“সত্যি যে বলেছে, তার প্রমাণ কী?”

 

“ঠিক স্যার, ভেরি কনফিউসিং। “

 

একেনবাবুর অন্য কী একটা কাজ ছিল, উনি বাড়িতে ঢুকলেন না। বাড়ি ফিরে দেখি প্রমথ মহোদ্যমে রান্না করছে। আমাকে দেখা মাত্র হুকুমে হুকুমে প্রাণান্ত করল। তার ফাঁকে ফাঁকেই সারাদিন কী কী হয়েছে শুনল। ল্যাবের এক্সপেরিমেন্ট-এর জন্য এগুলো সব মিস করছে… তারজন্য বিশ্বসুন্ধু সবার বাপান্ত করল। টিপিক্যাল প্রমথ!

 

 

নয়

পরদিন সকাল সকাল দুটো ক্লাস ছিল। ক্লাস শেষ করে যখন অফিসে ফিরলাম, একেনবাবু আমার ঘরে।

 

“কী ব্যাপার, কাল কোথায় ছিলেন গভীর রাত পর্যন্ত?”

 

উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করলেন “আপনার কি আর ক্লাস আছে স্যার?”

 

“না, কেন?”

 

“তা হলে চলুন।”

 

“কোথায়?”

 

“সুকন্যা ম্যাডামের কাছে।”

 

“ব্যাপারটা কী?”

 

“হোটেলের লন্ড্রি রুমে তোয়ালে জড়ানো রক্তমাখা ছুরি পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা ওটা দিয়েই ব্রজদুলালবাবুকে খুন করা হয়েছে। কাজ শেষ করে ছুরিটা তোয়ালের মধ্যে ঢুকিয়ে লন্ড্রিট দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ মিস্টার শ্রীবাস্তবকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মিনিট পাঁচেকের জন্য মিস্টার শ্রীবাস্তবের কোনো অ্যালিবাই নেই। আর নেই খুব ক্রিটিক্যাল সময়ে, সুকন্যা ম্যাডামের সঙ্গে খেতে আসার আগে! ম্যাডাম সুকন্যা ভীষণ বিচলিত… আমাদের ডেকেছেন।”

 

“আমাদের’ মানে তো আপনাকে, বহুবচন লাগাচ্ছেন কেন! কিন্তু দোষী ধরা পড়লে আপনি আর কী করবেন?”

 

“রাইট স্যার। ও আরও একটা ব্যাপার, পোর্ট অথরিটির লস্ট এন্ড ফাউন্ড অফিসে কোনো কাফলিংক পাওয়া যায়নি।”

 

“আপনি কি ভেবেছিলেন কিছু পাওয়া যাবে?”

 

“না স্যার, পাওয়া গেলে অবাকই হতাম, তখন একটু অন্যভাবে চিন্তা করতে হত।”

 

একেনবাবু ঠিক কী বলতে চাচ্ছেন বুঝলাম না। কিন্তু এ নিয়ে আর প্রশ্ন করলাম না।

 

.

 

হোটেলে সুকন্যার ঘরে পৌঁছোনোর আগেই দেখলাম একটি ভারতীয় চেহারার মেয়ে ট্রলিতে অজস্র তোয়ালে, চাদর, ইত্যাদি নিয়ে হলওয়েতে হাঁটছে… বোঝাই যাচ্ছে হোটেলের হাউসকিপিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করে।

 

“একটু চান্স নিই, স্যার,” বলে একেনবাবু চেঁচিয়ে ডাকলেন, “আমিনা?”

 

একেনবাবুর ডাক শুনে মেয়েটি চমকে ফিরে তাকাল।

 

“আপনি আমিনা?” একেনবাবু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

 

কেমন জানি ভীত মুখে বলল, “হ্যাঁ, আমারে খোঁজেন?”

 

“আপনাকেই খুঁজছি, ম্যাডাম।”

 

“নো ম্যাডাম, আই হাউসকিপার।”

 

“বাংলায় বলুন, আমরা বাঙালি।”

 

বাংলা শুনে মনে হল আমি একটু স্বস্তি পেল। “আমি এখানে কাজ করি স্যার।”

 

(আমিনার বাংলাদেশি উচ্চারণ আমি লিখতে পারব না, আমি আমার মতো করে কথাগুলো লিখছি।)।

 

“সেটা আমি জানি। আপনার কথা সুকন্যা ম্যাডাম বলেছেন। আপনি তো ওঁর জন্য পান কিনে আনেন প্রতিদিন।”

 

“হ্যাঁ, ম্যাডাম পান ভালোবাসেন।”

 

“আপনি থাকেন কোথায়?”

 

“প্যাটারসনে।”

 

“কদ্দিন এখানে চাকরি করছেন?”

 

“প্রায় মাস পাঁচেক হল। আপনি কি পুলিশের লোক?”

 

“সেটা কেন মনে হচ্ছে?”

 

“আপনাকে তো দেখলাম পুলিশের সাহেবদের সঙ্গে।”

 

“আমি ম্যাডাম সুকন্যার জন্য কাজ করছি… ব্রজদুলালবাবুর মৃত্যুর ব্যাপারে।”

 

“খুব ভালো লোক ছিলেন স্যার।”

 

“আপনাকে পুলিশ প্রশ্ন করেছিল?”

 

“না। আমি তো ইংরেজি ঠিক জানি না, উত্তরও দিতে পারতাম না।”

 

“আপনি কি এখন কাজে যাচ্ছেন?”

 

“না, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে।”

 

“বেশ, তাহলে দুয়েকটা প্রশ্ন করি। যেদিন ব্রজদুলালবাবু মারা গেলেন সেদিন আপনি সকালে গিয়েছিলেন ঘর পরিষ্কার করতে?”

 

“না। সাহেব আর ম্যাডামদের ঘর আমি পরিষ্কার করি দশটা নাগাদ। তবে সামনের একটা ঘর পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম।”

 

“ক’টা নাগাদ?”

 

“সাড়ে আটটার সময়।”

 

“আপনি কি দরজা বন্ধ করে ঘর পরিষ্কার করেন?”

 

“না, সব সময় দরজা খুলে রেখে পরিষ্কার করতে হয়।”

 

“সেখান থেকে কি ব্রজদুলালবাবুর দরজা দেখা যায়?”

 

“না, ঘরটা স্যারের পাশের ঘরের উলটোদিকে।”

 

“হলওয়েতে কাউকে দেখেছিলেন? মিস্টার শ্রীবাস্তব বা আর কারোকে?”

 

“শ্রীবাস্তব স্যার নিজের ঘরে ছিলেন… ওঁর কম্পিউটারে কিছু একটা কাজ করছিলেন। আমাকে বলেছিলেন একটু পরে এসে ঘরটা পরিষ্কার করে যেতে।”

 

“সেটা বুঝলাম। তারমানে আর কাউকে দেখেননি?”

 

“না, একজনকে দেখেছিলাম তোয়ালে হাতে, মনে হয় একজন গেস্ট।”

 

“সাহেবের ঘর থেকে কিছু শুনেছিলেন?”

 

“হ্যাঁ, কিন্তু কথাবার্তা হচ্ছিল ইংরেজিতে, তাই ঠিক বুঝিনি।”

 

“মনে করার চেষ্টা করুন… যে কোনো কথা, অর্থ না জানলেও চলবে।”

 

“একটা লোকের গলা শুনছিলাম। ধমকের সুরে কিছু বলছিল কী একটা খালিন বা ওরকম কিছু। উত্তরে স্যার কিছু বলছিলেন। কিন্তু ওই কথাটাই বার কয়েক শুনেছিলাম। তারপরেই ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালাই, আর কিছু শুনতে পাইনি।”

 

“ঘর পরিষ্কার করার পর কি আপনি শ্রীবাস্তবের ঘরে গেলেন?”

 

“না। আমার ম্যানেজার ফোন করে বললেন তিন তলায় আরেকটা ঘর পরিষ্কার করতে। সেটা করে যখন দোতলায় নামি, তখন দেখি স্যারের দরজা খোলা … অনেক পুলিশ। আমি ভয় পেয়ে ওখানে আর দাঁড়াইনি।

 

“ম্যাডামের সঙ্গে দেখা হল কখন?”

 

“দুপুরবেলা আমাকে শ্রীবাস্তব স্যার ফোনে ডাকলেন। বললেন ম্যাডামকে নতুন রুম নম্বরে গিয়ে পান দিয়ে আসতে।”

 

“পান পেলেন কোথায়?”

 

“আমার কাছে থাকে স্যার। আমি খুব পান খাই।”

 

“ভেরি ইন্টারেস্টিং। আচ্ছা, আপনি তো স্যার আর ম্যাডামের ঘর পরিষ্কার করছেন বেশ কিছুদিন, আপনি ওঁদের ঘরে দামি কিছু পড়ে থাকতে দেখতেন?”

 

“স্যার, আমি কোনো দামি জিনিস ছুঁই না। যদি কিছু চোখে পড়ে, দামি বলে মনে হয়, ঠিক যেখানে দেখি সেখানে রেখে দিই।”

 

“আপনি কোনো কাফলিংক দেখেছিলেন?”

 

“ওই কথাটাই তো শুনেছিলাম স্যার, আমিনা উত্তেজিত হয়ে বলল। খাফলিন’… কী স্যার ওটা?”

 

“বোতামের মতো দেখতে। হাতের আস্তিনে থাকে।” একেনবাবু আমার শার্টের বোতামের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন। তবে খুব সুন্দর আর বড়ো আঙটির মতো দেখতে হয়।”

 

“হ্যাঁ স্যার, একটা আধখোলা খামের মধ্যে আঙটির মতো কয়েকটা বোতাম আর একটা খোলা বাক্স বাইরের টেবিলে দেখেছিলাম। আমি ম্যাডামকে বলেছিলাম। ম্যাডাম সেটাকে ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে বলেছিলেন।”

 

“ঝোলা ব্যাগ?”

 

“ক্লজেটে একটা ব্যাগ ঝোলানো থাকত। স্যার নিজের জিনিস এদিক-ওদিক ফেলে ছড়িয়ে রাখতেন আর ভুলে যেতেন, ম্যাডাম আমাকে চোখে কিছু পড়লে ঝোলা ব্যাগে রাখতে বলতেন। পরে সেখান থেকে স্যারকে বার করে দিতেন।”

 

“সেই ঝোলা ব্যাগটা কোথায়?”

 

“ম্যাডামের নতুন রুমে। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে আমি ওটা রেখে এসেছি।”

 

“চমৎকার, তাহলে চলুন ম্যাডামের ঘরে ওটা এখনও আছে কিনা দেখি।”

 

ঘরে সুকন্যা পাংশু মুখে বসে আছেন। একেনবাবু ঢুকেই বললেন, “ম্যাডাম, দুর্ভাবনা করবেন না। আমি একটা জিনিস ক্লজেটে রেখেছে, সেটা এখনও আছে কিনা আগে দেখি।”

 

সুকন্যার হতভম্ব মুখ দেখে বুঝলাম ওঁর কোনো ধারণাই নেই, কী নিয়ে কথা হচ্ছে।

 

ক্লজেটে ঝুলন্ত কাপড়ের ঝোলা হাতড়ে আমিনা একটা খাম বার করল। তারমধ্যে থেকে বেরল একটা বাক্স, ভেতরে দুটো কাফলিংক। কারুকার্য করা গিল্টি সোনার, মধ্যিখানে একটা হিরের চোখ। একেনবাবুর চোখে উত্তেজনা। ফোন করলেন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নিশ্চয় খুব কাছেই ছিলেন, কয়েকমিনিটের মধ্যেই এফবিআই র ফিল্ড অফিসার ডেভ বলডুইনকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। কাফলিংকটা দেখেই ডেভ বলে উঠলেন, “বিঙ্গো! কোত্থেকে পেলেন?”

 

“ব্রজদুলালবাবুর ঘরেই ছিল, হাউস কিপার সরিয়ে রেখেছিল।”

 

“এটাই সেই স্পাই-কাফলিংক?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জিজ্ঞেস করলেন ডেভকে।

 

ডেভ মন দিয়ে কাফলিংকের মুখটা পরীক্ষা করে বললেন, “তাই তো মনে হচ্ছে। এখুনি এটাকে ল্যাব-এ পাঠাচ্ছি, ছবিগুলো প্রিন্ট করতে।”

 

“আপনি স্যার, ছবিগুলো একবার হাউসকিপার আমিনাকে দেখিয়ে দেবেন। ও মনে হয় সাহায্য করতে পারবে খুনিকে আইডেন্টিফাই করতে। তবে বাংলা জানে এমন কাউকে ডাকবেন, ও ভালো ইংরেজি বোঝে না।”

 

“অতি অবশ্য, অতি অবশ্য।” তড়িঘড়ি সবাই বিদায় নিলে একেনবাবু সুকন্যাকে বললেন, “ম্যাডাম মনে হয় এখন আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”

 

 

দশ

কয়েকদিন বাদে আমাদের ডাক পড়ল এফবিআই-এর ফিল্ড অফিসে। ডেভ বলডুইন হলেন হোস্ট। ওদের কনফারেন্স রুমের টেবিলে কফি, ডোনাট, কেক, ফুটস ইত্যাদি সাজানো। সেখানে ল্যারি স্টকটন আর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টও হাজির। ল্যারি আর ডেভ-এর করমর্দনে একেনবাবুর হাত মুচড়ে যাবার জোগাড়। ল্যারি বললেন, “স্পাই ক্যামেরার ভিডিও থেকে প্রায় সবাইকেই শনাক্ত করা গেছে। হাউস কিপিং-এর আমিনা দেখিয়ে দিয়েছে হলওয়েতে সাড়ে আটটার সময় তোয়ালে হাতে কাকে ও দেখেছে। কাঁচা-পাকা চুল, মোটা ভুরু, নাকের ওপর একটা বড়ো আঁচিল. আইডিয়াল জুয়েলরির মালিক। তোয়ালে জড়ানো যে ছুরিটা পাওয়া গেছে তার হাতল থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলেনি ঠিকই। ভালো করেই আততায়ী সেটা মুছেছে, কিন্তু ফরেন্সিক এক্সপার্টদের টাচ-ডিএনএ-এর যে টেকনিক আছে, সেটা আততায়ী জানে না।”

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সেটা কী?”

 

উত্তরটা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দিলেন। “আমাদের শরীরের চামড়া থেকে সবসময়েই স্কিন সেল ঝরছে। তোয়ালেতে তার কয়েকটা পাওয়া গেলেই সেগুলো থেকে পিসিআর অ্যানালিসিস করে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা যায়। তবে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি, লোকটা সব স্বীকার করেছে।

 

আমি জানি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে একেনবাবুর আগেই কথা হয়েছে… কিন্তু ড্রামাটিক এফেক্ট-এর জন্য ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বললেন, “একেন, এঁদের এবার বুঝিয়ে বলো কী ভাবে কাফলিংকটা পেলে?”

 

“কী যে বলেন স্যার, আমি একা কেন, এঁরা সবাই না থাকলে কি আর হত?”

 

“আরে বিনয়টা ছেড়ে বলো।”

 

“আসলে স্যার, এক সেট নয়, দু-সেট কাফলিংক এর মধ্যে জড়িত ছিল। একটা দামি, আরেকটা সস্তা। দামিটা ছিল কার্টিয়ের কোম্পানির স্যাফায়ার ডায়মন্ড কাফলিংক, যেটা কেনাই ছিল বিজনেসম্যান ব্রজদুলালবাবুর উদ্দেশ্য। কিন্তু দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে প্রথম দিন সেটা কিনতে পারেননি। একটা সস্তা কাফলিংক আন-অফিশিয়ালি ক্যাশ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। কথা ছিল পরের দিন দোকান খুললে ব্যাঙ্ক চেক নিয়ে এসে দামি কাফলিংকটা কিনবেন, তখন ওই সস্তা কাফলিংকটা ফেরত দিয়ে সেই ক্যাশ টাকাটা নিয়ে নেবেন। বলা যেতে পারে ওটা ছিল খানিকটা আর্নেস্ট মানি। ব্রজদুলালবাবু ওই সস্তা কাফলিংকটা আর ফেরত পাঠালেন না। তিন-চারশো ডলার ওঁর কাছে কিছুই নয়! কিন্তু কাফলিংকটা সস্তা হলেও ওর মধ্যেই স্পাই ক্যামেরা ঢোকানো হয়েছিল। আপনাদের এক এজেন্ট কয়েকদিন আগে ওটা কিনে তার মধ্যে মাইক্রো-ক্যামেরা ঢুকিয়ে মালটা ফেরত দিয়েছিল। আইডিয়াল জুয়েলরি রিটার্ন গুডস নেয় না, কিন্তু ম্যাডাম ফারা নিয়েছিলেন আপনাদের ফিল্ড অফিসারের চার্মে মোহিত হয়ে। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট সেটাই আমাকে বলেছেন। নিশ্চয় সেটা সম্ভব, আমার কিন্তু ধারণা মালিকের অনুমতি নিয়েই ম্যাডাম ফারা ফেরত নিয়েছিলেন… খুব বেশি দামের জিনিস তো নয়! আর ওতে যে স্পাই ক্যামেরা ঢোকানো হয়েছে মালিক প্রথমে হয়তো সন্দেহ করেননি। সন্দেহ থাকলে ওটাকে নষ্ট করতেন।

 

“দ্বিতীয় এজেন্ট যখন পরের দিন দোকানে গেলেন ওই কাফলিংকটার খোঁজে, তখনই মনে হয় সন্দেহের শুরু। দ্বিতীয় এজেন্টের আসল পরিচয় হয়তো ওরা জানত। ওটা এমন কোনো স্পেশাল কাফলিংক নয়, কিন্তু ঠিক ওটাই এই এজেন্টের কেন দরকার? এদিকে ম্যাডাম ফারাও পড়লেন মুশকিলে। তিনি তো জানতেন দোকানে ওটা নেই। ব্রজদুলালবাবুকে কাঁচা রসিদ দিয়ে ক্যাশে বিক্রি করেছিলেন। মালিক শুধু জানতেন ওটা ফেরত এসেছে এবং বিক্রিরও কোনো রেকর্ড নেই। মোটমাট ম্যাডাম ফারা ধরা পড়ে সবকিছু স্বীকার করলেন। উনি যে মালিকের অজান্তে ওটা ব্রজদুলালবাবুকে দিয়েছেন সিসিটিভিতেই দেখা গেল! মালিকের গ্যাং মেম্বাররা তখন সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত… কাফলিংকে স্পাইং ডিভাইস আছে, পুলিশের হাতে পড়ার আগেই যে করে হোক ওটাকে উদ্ধার করতে হবে। কে কাফলিংকটা প্রথমে কিনেছিল, তাকে খুঁজে বার করা হল সিসিটিভি-র ছবি থেকে। ম্যাডাম ফারার সঙ্গে তাঁর হয়তো পরিচয়ও হয়েছিল। তবে কী ভাবে ওই প্রথম এজেন্টকে এতো তাড়াতাড়ি খুঁজে বার করা হল, আই হ্যাভ নো ক্ল। একটা সম্ভাবনা, দ্বিতীয় এজেন্টের পরিচয় ওরা জেনে গিয়েছিল বলে লুকিয়ে লুকিয়ে ফলো করছিল। হঠাৎ করে প্রথম এজেন্ট তার সঙ্গে দেখা করতে আসায় খুনের কাজটা সহজ হয়ে যায়। ম্যাডাম ফারাকে হত্যা করা হল উনি পুলিশের হয়ে কাজ করছেন সন্দেহে। বাকি রইল বিজনেসম্যান ব্রজদুলালবাবুর কাছ থেকে কাফলিংকটা দ্রুত উদ্ধার করা। তখনই ব্ল্যাকমেল শুরু হল। ব্রজদুলালবাবু ভাবলেন দামি কাফলিংক ফেরত চাইছে। না, ওরা চাইছিল সস্তা কাফলিংকটা। তাই কাফলিংক ফেরত দিয়েও মুক্তি পেলেন না। আমি ভাগ্যক্রমে ওটা পেলাম হোটেলের হাউস কিপিং লেডি আমিনার জন্য। তিনি ওটা যত্ন করে সরিয়ে

 

ডেভ বলডুইন বললেন, “একটা জিনিসই বুঝলাম না, দুটো কাফলিংক চাইলেই তো চুকে যেত… দুটোই যখন বিজনেসম্যানের কাছে ছিল!”

 

“আমিও সেটাই ভাবছিলাম স্যার। মনে হয় গ্যাং-এর সবাই তখন এতো ভীত ও উত্তেজিত, কুইক অ্যাকশন নিতে গিয়ে সবদিক খেয়াল রাখতে পারেনি। ভাগ্যিস পারেনি স্যার।”

 

“তোমার জন্যেই জুয়োচক্রটা আবিষ্কার হয়েছে। আইডিয়াল জুয়েলরির মালিকই এটার মূল পাণ্ডা।” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বললেন। “কিন্তু একেন তোমাকে এবার একটা প্রশ্ন করি। আইডিয়াল জুয়েলরি নিয়ে এফবিআই-এর এত মাথাব্যথা কেন… অনুমান করতে পারো?”

 

“আপনি আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন স্যার!”

 

“আরে না, বলো না।”

 

“আপনিই তো স্যার বলেছিলেন জাল টাকা সংক্রান্ত।”

 

“কিন্তু কী সেটা?”

 

“আমার ধারণা স্যার, এই জুয়োচক্র চালিয়ে বাজে টাকা এক্সচেঞ্জ করা হচ্ছিল ভালো টাকার সঙ্গে।”

 

ডেভ বলডুইনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “কী ভাবে?”

 

“খুবই সহজ স্যার। যারা বাজি ধরছে তারা দিচ্ছে ভালো টাকা, জিতলে দেওয়া হচ্ছে নকল টাকা। হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফিট।”

 

“বুঝলাম না,” আমি বললাম। “বাজি জিতে নকল টাকা পেলে তো লোকেরা কমপ্লেন করতে পারে পুলিশের কাছে।”

 

“স্যার অপরাধ করতে গিয়ে টাকা খোয়ালে কি কমপ্লেন করা যায়। নিউ ইয়র্ক সিটির আইন অনুসারে তো স্যার এগুলো হচ্ছে ইল্লিগ্যাল বেটিং… তাই কি না!” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দেখলাম গর্ব গর্ব মুখ করে ল্যারি আর ডেভের তাকাচ্ছেন… ভাবটা কী বলেছিলাম!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


সূচিপত্র