আসল খুনির সন্ধানে (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত

শেয়ার করুনঃ

এক

একেনবাবুর ঘ্যানঘ্যানানি সহ্য করতে না পেরে শনিবার আবার এশিয়া সোসাইটিতে যেতে হল। এশিয়া সোসাইটির প্রধান কাজ সায়েবদের কাছে এশিয়ার কালচার তুলে ধরা। তারজন্য প্রায়ই ওরা কিছু না কিছু একটা করে বক্তৃতা, আলোচনা, গান, বাজনা, সিনেমা, এক্সিবিশন, কী নয়? একবার কারো চাপে পড়ে এশিয়া সোসাইটির মেম্বার হয়েছিলাম, পরে চাঁদা-টাদা আর দিইনি। কিন্তু অনুষ্ঠানের নোটিসগুলো নিয়মিত পাই।

 

প্রথম লাইনেই ‘আবার’ কথাটা কেন যোগ করলাম বলছি, কারণ কয়েকদিন আগেই বিনয় দত্তের আর্ট এক্সিবিশনে গিয়ে সবাই অপদস্থ হয়েছিলাম। একেনবাবু আবার যাবার বায়না করছেন দেখে প্রথম ধমকটা প্রমথই দিল।

 

“আপনার লজ্জা করে না মশাই! জাস্ট তিনদিন আগে আপনার জন্য বিনয় দত্তের কাছে আমাদের সবার কী বেইজ্জতিই না হল!”

 

“আসলে স্যার আর্ট ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না,” কাঁচুমাচু মুখে স্বীকার করলেন একেনবাবু। “বিশেষ করে উনি যে ধরনের ছবি আঁকেন… বিমূর্ত কী জানি…।”

 

“অভিব্যক্তিবাদ। কিন্তু সেটা পড়েই তো গিয়েছিলেন নেচে নেচে। আর এটাও তো এনশেন্ট আর্ট নিয়ে… ভালো করে নোটিসটা পড়েছেন? The Future of the Past Collecting Ancient Art in the 21st Century.”

 

“কী মুশকিল স্যার, এটা তো আর্ট নয়, অ্যান্টিক সংগ্রহ নিয়ে। আর্ট ডিলার, কিউরেটর, আইনজ্ঞ, আর্ট-বিশেষজ্ঞরা ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করবেন। খুব জানা দরকার।”

 

“যত্তসব ননসেন্স!”

 

প্রমথ আসবে না বলেছিল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এল। তবে আগের থেকেই ঘোষণা করে রেখেছে, দু-ঘণ্টা ধরে আলোচনা শুনতে ও রাজি নয়, বড়োজোর আধঘণ্টা। একেনবাবু তাতে গাঁইগুঁই করেননি।

 

আমাদের অবশ্য এক মিনিটও শুনতে হল না। এশিয়া সোসাইটি থেকে যখন এক ব্লক দূরে একেনবাবুর মোবাইলটা বেজে উঠল।

 

“বলুন স্যার… খুব জরুরি? আমরা এখন এশিয়া সোসাইটির খুব কাছে… আপনার বাড়িতে? সবাই? দাঁড়ান স্যার, ওঁদের একটু জিজ্ঞেস করি।”

 

“কার ফোন?”

 

একেনবাবু ফোনটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বললেন, “ডাক্তার অবনী গুপ্তের। ওঁর বাড়িতে আমাদের একটু আসতে বলছেন।”

 

“কেন, কী ব্যাপার?”

 

“জানি না স্যার, তবে খুব জরুরি, এখুনি কথা বলতে চান।”

 

বাঁচা গেল! পণ্ডিতদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল! সানন্দে মাথা নেড়ে দু-জনেই সম্মতি জানালাম।

 

“ঠিক আছে স্যার, আমরা তিনজনই আসছি।”

 

.

 

অবনী গুপ্তের বাড়ি এশিয়া সোসাইটির খুবই কাছে। নিউ ইয়র্কের এই অঞ্চলে টাকাওয়ালা লোকেরা থাকে। ভদ্রলোক কত বড়ো ডাক্তার বলতে পারব না, তবে দুর্দান্ত ব্যাবসাদার। ম্যানহাটান, কুইন্স আর ব্রুকলিন– এই তিন জায়গা মিলিয়ে আট-দশটা ওষুধের দোকানের মালিক। এছাড়া নিউ জার্সিতে দু-দুটো নার্সিং হোম চালান। এবার ওঁর নজর কলকাতায়। একটা ফাইভ-স্টার নার্সিং হোম খোলার জন্য জমি কিনেছেন, বিল্ডিং-এর কাজ প্রায় কমপ্লিট। কলকাতার বাঘা বাঘা অনেক ডাক্তার নাকি যোগ দিচ্ছেন সেখানে। অন্তত সেটাই গুজব।

 

অবনী গুপ্ত শুধু অর্থবান নন, খুবই আত্মম্ভরি। এমন কি অভদ্র বলেও বাঙালি মহলে দুর্নাম আছে। আমাদের সঙ্গে অবশ্য ভালো ব্যবহার করেন, কারণ একেনবাবু। একবার একটা নারীঘটিত ব্যাপার নিয়ে কেউ ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেছিল। অবনী গুপ্ত ধোয়াতুলসীপাতা না হলেও ওই ব্যাপারে বোধহয় কেউ ফাঁসিয়েছিল। একেনবাবু সেই ব্ল্যাকমেলারকে হাতেনাতে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে ওঁর বাড়িতে বড়ো কোনো পার্টি হলে আমরাও নিমন্ত্রিত হই। ওঁর ব্যবসাগুলোতে সিকিউরিটি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলেই একেনবাবুর পরামর্শ চান। পয়সাকড়ি অবশ্য দেন না, তবে ভালোমন্দ খাওয়ান– সেটাই বা কম কি!

 

কলকাতায় এই নার্সিং হোম খোলা নিয়েও একেনবাবুর সঙ্গে আলোচনা করেছেন অবনী গুপ্ত। বিশেষ করে বাড়িটা করতে গিয়ে যে-সব ঝামেলা হয়েছে, সেই নিয়ে। এখন ওঁর চিন্তা ইন্ডিয়ার এই ব্যবসা কতটা লাভজনক হবে! ইন্সিওরেন্স কোম্পানিগুলো বেছে তাদের সঙ্গে সমঝোতায় আসা, কারো ইন্সিওরেন্স না থাকলে তাকে ভর্তি করা হবে কিনা ঠিক করা… কারণ, ফেলো কড়ি মাখো তেল ব্যাপারটা সব সময় খাটে না। কত কড়ি অ্যাডভান্স? বিশেষ করে এমার্জেন্সি সিচুয়েশনে পেশেন্টকে একবার ভর্তি করে নিলে চিকিৎসায় কত খরচা হবে আগে থেকে বলা যায় না। সেক্ষেত্রে টাকা আদায় একটা সমস্যা, আর রোগীর মৃত্যু হয়ে গেলে তো কথাই নেই।…

 

আমি এইসব আলোচনায় ছিলাম না, আবছা আবছা যা শুনেছি তাই লিখলাম। দিন পনেরো আগে কোথাও যাবার পথে মিনিট পাঁচেকের জন্য আমাদের বাড়িতে থেমেছিলেন। আসলে একেনবাবুর কাছে ওঁর একটা প্রশ্ন ছিল। উনি নাকি কয়েকদিন আগে শুনেছেন চিকিৎসায় গাফিলতির নামে হাসপাতাল বা নার্সিং হোমগুলোতে যে-সব ভাঙচুর চলে, মৃত রোগীর আত্মীয়স্বজন বা পাড়াপড়শিরা সব সময় তা করে না। পিছনে টাকার ব্যাপারও থাকে। লোকাল গুন্ডাদের হাতে পাঁচ-দশ হাজার ধরিয়ে দিয়ে এই ভাঙচুরগুলো করানো যায়! কথাটা কি ঠিক?

 

একেনবাবু এইসব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। “হ্যাঁ স্যার, পত্র-পত্রিকায় তো অনেক কিছুই বার হয়, সত্যি না মিথ্যা…।”

 

“মিথ্যে কেন হবে, এতে তো লাভ আছে। বেশির ভাগ সময়েই হাসপাতাল বা নার্সিং হোম ঝুট-ঝামেলা এড়ানোর জন্য লাখ লাখ টাকার পাওনাই মকুব করে দেয়, লাখ লাখের বদলে পাঁচ-দশ হাজারেই কাজ মিটে যায়! সুতরাং আমাদেরও এ লাইনে কিছু একটা ভাবতে হবে, মানে গুন্ডা কানেকশনের ব্যাপারে…।”

 

“কী যে বলেন স্যার!”

 

এই সময়ে আমার একটা ফোন এসে যাওয়ায় পরের কথাগুলো শুনিনি। ফোন যখন শেষ হল আলোচনাও শেষ। চলে যেতে যেতে অবনী গুপ্ত শুনি আফশোস করেছেন, কলকাতায় নার্সিং হোম খোলার ঝুটঝামেলায় কেন নিজেকে জড়িয়েছেন বলে!

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *