বুড়ো আঙুলের কথা (শার্লক হোমস) – আর্থার কোনান ডয়েল

শেয়ার করুনঃ

আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পর থেকে শার্লক হোমসের কাছে যে সমস্ত ‘কেস’ সমাধানের জন্যে এসেছে তার মধ্যে কেবলমাত্র দুটো কেসের সন্ধান আমি আনি। একটা হল মিঃ হেদারলির বুড়োআঙুলের সমস্যা, আর একটা হল কর্নেল ওয়ারবার্টনের পাগলামির রহস্য। কোনও রহস্যের সমাধান করতে গেলে যে-ধরনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর প্রখর বিচারশক্তির দরকার পড়ে সেই দিক থেকে দেখলে ওয়ারর্বাটন-সমস্যা বেশ জটিল আর রহস্যময়। তবে হেদারলির কাণ্ডটা একেবারে শুরু থেকেই এমন অদ্ভুত, আর যাকে খবরের কাগজের ভাষায় বলা যেতে পারে ‘নাটকীয়’, যে ওই ব্যাপারটাই আগে লিখব বলে ঠিক করেছি। তবে ওই ব্যাপারে তদন্ত করবার সময়ে হোমস তার অসাধারণ বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর বিশ্লেষণ শক্তির কোনওটাই খাটাবার বিশেষ কোনও সুযোগ পায়নি। হেদারলি-কাহিনী দৈনিক সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। তবে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠার মাত্র আধকলমে সমস্ত ঘটনাটা এমন জোড়াতালি দিয়ে ছাপা হয়েছিল যে, তাতে আসল ঘটনাটা যে ঠিক কী ধরনের সে কথাটা ভাল ভাবে বোঝা যায়নি। সমস্ত ঘটনাটা আস্তে আস্তে ধাপে ধাপে যেমন যেমন ঘটেছে সেটা যদি ঠিক পর পর পাঠকের চোখের সামনে ধরা যায়, মানে যেমন যেমন নতুন সূত্র পাওয়া গেছে তার সঙ্গে কী ভাবে তদন্তের ধারাটা বদলে যাচ্ছে, তা হলে মূল রহস্য আর রহস্য সমাধানের মজাটা পাঠক পুরোপুরি বুঝতে পারবে। ঘটনাটা আমাকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। সে আজ বছর দুয়েক আগেকার কথা। কিন্তু এখনও ওই ঘটনার কথা ভাবলে আমি কিংর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই।

 

যে-ঘটনাটার কথা আজ লিখতে বসেছি সেটা আমার বিয়ের অল্প কিছু দিন পরে ঘটেছিল। ১৮৮৯ সালের গরমকাল। আমি তখন আমাদের বেকার স্ট্রিটের বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় এসে পুরোদমে প্রাইভেট প্র্যাকটিস আরম্ভ করে দিয়েছি। তবে ফুরসত পেলেই হয় পুরনো আস্তানায় আড্ডা দিতে যাই, না হয় তো হোমসকে টেনে আনি আমার নতুন বাসায়। সত্যি কথা বলতে কী, অল্প দিনের মধ্যে আমার বেশ ভাল পশার জমে গেল। আমার বাসাটা প্যাডিংটনের কাছেই। আর তার ফলে আমার রোগীদের বেশির ভাগই রেলের চাকুরে। এদের মধ্যে একজনকে আমি একবার খুব কঠিন অসুখ থেকে সারিয়ে তুলি। আর তাতে সে আমার এমন ভক্ত হয়ে গেল যে, সুযোগ পেলেই যেখানে-সেখানে আমার ঢাক পিটিয়ে বেড়াত। আর তার চেনাজানা আধাচেনা লোককে প্রায় একরকম জোর করে চিকিৎসার জন্যে আমার কাছে পাকড়ে আনত।

 

সেদিন সকালে আমার ঘরের কাজের লোকটি শোবার ঘরের দরজায় টুকটুক করে টোকা দিতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করাতে সে বলল যে, প্যাডিংটন থেকে দু’জন লোক দেখা করতে এসেছে। তারা চেম্বারে বসে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাতটা তখনও বাজেনি। রেলের কর্মচারী যখন ডাক্তার দেখাতে আসে তখন বুঝতে হবে ব্যাপারটা বেশ গুরুতর। তাই তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নীচে নেমে এলাম। নীচে নামতেই আমার পুরনো মক্কেলকে দেখতে পেলাম। দরজার সামনে সে পাহারাওলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষ করলাম চেম্বারের দরজা বন্ধ। সে তার ডান হাতের বুড়োআঙুল দিয়ে আমার চেম্বারটা দেখিয়ে দিয়ে আমাকে চুপি চুপি বলল, “আমিই ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। এমনিতে লোকটাকে খারাপ বলে মনে হল না।”

 

“ব্যাপারটা কী?” আমি কৌতূহলী হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম। ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল যে, সাধারণ মানুষ নয়, কোনও অদ্ভুত বিকটাকৃতি জন্তুকে ও কায়দা করে আমার চেম্বারে বন্দি করে ফেলেছে।

 

“একজন নতুন রুগি। আমি ভাবলাম ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসাই ভাল। না হলে ও হয়তো আপনার কাছে না এসে অন্য কোনও ডাক্তারের কাছে চলে যাবে। যাই হোক ওকে ভালয় ভালয় এখানে হাজির করা গেছে।…আচ্ছা ডাক্তারবাবু আমি এখন চললাম। এখনই আবার ডিউটি শুরু হয়ে যাবে।”

 

আমি তাকে কোনও কথা বলবার আগেই আমার ভক্ত দালালটি ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

 

দরজা ঠেলে আমার চেম্বারে ঢুকলাম। একজন ভদ্রলোক টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারে বসে রয়েছেন। ভদ্রলোক ভাল হেদার টুইডের পোশাক পরে আছেন। তাঁর কাপড়ের টুপিটা আমার বইয়ের র‍্যাকের ওপর রাখা। ভদ্রলোকের একটা হাত রুমালে জড়ানো। রুমালে রক্তের দাগ। ভদ্রলোকের বয়স কম। আমার মনে হল এঁর বয়স খুব বেশি হলে গোটা পঁচিশ হবে। চেহারাটি বেশ শক্ত সমর্থ। তবে তাঁর মুখটা দেখে মনে হল কেমন যেন ফ্যাকাশে, ম্লান। ভদ্রলোককে দেখে আমার মনে হল, যে-কোনও কারণেই তোক তিনি ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত। জোর করে মনের সে ভাবকে চেপে রাখছেন।

 

আমাকে দেখে ভদ্রলোকটি বললেন, “ডাক্তারবাবু সাতসকালে আপনাকে ঘুম থেকে তুললাম বলে মাপ চাইছি। কাল রাত্তিরে আমার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি আজ ভোরের ট্রেনে ফিরেছি। প্যাডিংটন স্টেশনে নেমে একজন ডাক্তারের খোঁজ করায় একটি লোকে আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এল। আপনার কাজের লোকটির হাতে আমার একটা ‘কার্ড’ দিয়েছিলাম। কিন্তু দেখছি যে, সে কার্ডটা এখানে টেবিলেই রেখে গেছে, আপনাকে দেয়নি।”

 

কার্ডটা তুলে নিয়ে চোখ বুলোলাম। লেখা রয়েছে: মিস্টার ভিক্টর হেদারলি। হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার। ১৬এ ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট (চার তলা)। আমার সত্যিকারের সাতসকালের মক্কেলের পরিচয় পেলাম। নিজের চেয়ারটায় বসতে বসতে বললাম, “আপনাকে বসিয়ে রেখেছি বলে খারাপ লাগছে। আপনি সারারাত ট্রেন জার্নি করেছেন। বুঝতে পারছি বেশ কাহিল বোধ করছেন। তার ওপর রাত্তিরে ট্রেন জার্নি করার মতো বিচ্ছিরি ব্যাপার আর কিছু নেই।”

 

“না, কালকের রাতটা আমার মোটেই একঘেয়ে বা বৈচিত্র্যহীন ভাবে কাটেনি।” কথা শেষ করেই ভদ্রলোক হাসতে শুরু করলেন। প্রথমটায় আমার মনে হল যে, ভদ্রলোকের হাসিটা বেশ দিলখোলা ধরনের। কিন্তু একটু পরেই বুঝলাম যে, হাসিটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। ভদ্রলোক টেনে টেনে হাসতে লাগলেন। তিনি চেয়ারের ওপর এমন সাংঘাতিক ভাবে দুলতে লাগলেন যে, আমার ভয় হল উনি হয়তো গড়িয়ে পড়েই যাবেন। ব্যাপারটা বুঝতে আমার দেরি হল না।

 

“চুপ করুন,” বেশ কড়া ভাবে ধমক লাগিয়ে বললাম, “একদম চুপ করুন!” তারপর আমি সোরাই থেকে এক গ্লাস জল গড়ালাম। আমার ধমকে কোনও কাজ হল না। ভদ্রলোক তখনও পাগলের মতো হেসেই চলেছেন। কোনও বিশেষ কারণে মন যদি খুব চঞ্চল বা উত্তেজিত হয় তখন নিজের মনকে শান্ত করতে গিয়ে অনেকে এই রকম পাগলের মতো কাণ্ড করেন। ডাক্তারি ভাষায় একেই বলে হিস্টিরিয়া। যাই হোক খানিক পরে ভদ্রলোক নিজে থেকেই চুপ করলেন। তাকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক নিজের এই আচরণে খুবই লজ্জা পেয়েছেন। আরও লক্ষ করলাম যে, তাঁর মুখে অসম্ভব ক্লান্তির ছাপ।

 

ভদ্রলোক আস্তে আস্তে বললেন, “আমি নেহাতই পাগলামি করে ফেলেছি।”

 

আমি জবাব দিলাম, “না, না। আপনি এটা খেয়ে ফেলুন। ভাল লাগবে।” ভদ্রলোকের দিকে জলমেশানো ব্র্যান্ডির গ্লাসটা এগিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক সেটা এক চুমুকে শেষ করে ফেললেন। তাঁর মুখ-চোখ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠল।

 

“আহ্৷” ভদ্রলোক একটা আরামের নিশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন, “ডাক্তারবাবু, আমার বুড়োআঙুলটা মানে যে জায়গায় আমার বুড়োআঙুলটা ছিল সেটার অবস্থাটা দেখবেন কি?”

 

ভদ্রলোক রুমালটা খুলে নিয়ে হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ডাক্তার হিসেবে আমি অনেক বীভৎস কাটা-ছেঁড়া দেখেছি। কিন্তু এখন যা দেখলাম তাতে আমি রীতিমতো চমকে গেলাম। হাতের চেটো থেকে চারটে আঙুল বেরিয়ে আছে। বুড়োআঙুলটা নেই। বুড়োআঙুলের জায়গায় খানিকটা রক্ত জমে ডেলা পাকিয়ে গেছে। আমার মনে হল বুড়োআঙুলটা কোনও ভাবে গোড়া থেকে উপড়ে গেছে।

 

“কী কাণ্ড! এ তো মারাত্মক জখম হয়েছে দেখছি। খুব রক্ত পড়েছে,” আমি বললাম।।

 

“হ্যাঁ, রক্ত খুব পড়েছে। ঘটনাটা যখন ঘটে তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হয় বেশ কিছু সময় আমি অজ্ঞান অবস্থাতেই ছিলাম। জ্ঞান হলে দেখলাম যে, তখনও রক্ত পড়ছে। আর কিছু না করতে পেরে রক্ত বন্ধ করবার জন্যে পকেটের রুমাল বেশ করে ওই কাটা জায়গাটায় জড়িয়ে নিয়ে রুমালটা একটা কাঠের টুকরো দিয়ে বেশ শক্ত করে পেঁচিয়ে নিয়ে কবজির সঙ্গে বেঁধে নিলাম।”

 

“খুব ভাল করেছেন। আপনার তো মশাই ডাক্তার মানে সার্জেন হওয়া উচিত ছিল।”

 

“এটা আপনি বাড়িয়ে বলছেন। তবে এটাও তো একধরনের হাইড্রলিকসের ব্যাপার, আর সেটা আমার আওতায় পড়ে।”

 

কাটা জায়গাটা ভাল করে দেখে আমি বললাম, “মনে হচ্ছে খুব ভারী অথচ ধারালো কোনও কিছুর আঘাতে আপনার আঙুলটা এই ভাবে কেটে গেছে।”

 

“ভারী রামদা জাতের জিনিসের দ্বারা হয়েছে।”

 

“তা এ রকম সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটল কী করে?”

 

“এটা তো কোনও অ্যাক্সিডেন্ট নয়!’

 

“তবে আপনি কি বলছেন যে আপনাকে কেউ মারতে এসেছিল ?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“আপনার কথায় আমার তো বেশ চিন্তা আর ভয় হচ্ছে।” এই কথা বলে আমি ভদ্রলোকের ক্ষতস্থানটা ধুয়ে ওষুধ লাগিয়ে বেশ ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। ভদ্রলোক চুপ করে বসে রইলেন। তবে তার যে যন্ত্রণা হচ্ছে তা বুঝতে পারছিলাম। কেন না এক একবার তিনি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরছিলেন। ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী, এখন কেমন লাগছে?”

 

“দারুণ। আপনার ব্র্যান্ডির গুণে আর ব্যান্ডেজের কায়দায় আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছি। বিশ্বাস করুন, যে রকম সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটেছিল তাতে আমি ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ি…”

 

ওঁকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম, “দেখুন, এখন ওসব কথা আলোচনা না করাই ভাল। আপনার শরীর খারাপ হতে পারে।”

 

“না, আমার শরীর খারাপ হবে না। তা ছাড়া সব কথা এক্ষুনি পুলিশকে জানাতে হবে। সত্যি কথা বলতে কী, আমার বুড়োআঙুলটা উড়ে না গেলে পুলিশ বিশ্বাস করা তত দূরে থাক, আমার সব কথা ডাহা গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিত। কেন না আগাগোড়া ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত যে, আজগুবি বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা যাকে প্রমাণ বলে সে রকম কোনও কিছু আমার হাতে নেই। আসল সমস্যাটা কী জানেন, পুলিশ যদি আমার কথা বিশ্বাসও করে তা হলে আমার কাছ থেকে যতটুকু তারা জানতে পারবে তা এতই কম আর ভাসা ভাসা যে, সেই সংবাদের উপর নির্ভর করে ব্যাপারটার ফয়সালা করা যাবে বলে মনে হয় না।”

 

আমি বললাম, “হুঁ। যদি আপনার এই সাংঘাতিক দুর্ঘটনার সঙ্গে কোনও রহস্যের গন্ধ থাকে আর সেই রহস্যের সমাধান যদি সত্যি সত্যি করতে চান তা হলে পুলিশের কাছে যাবার আগে আমার বন্ধু শার্লক হোমসের কাছে আপনার যাওয়া উচিত।”

 

ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ, ওঁর নাম শুনেছি। উনি যদি আমার এ ব্যাপারে তদন্ত করতে রাজি হন তো আমি খুবই খুশি হব। তবে কী জানেন, পুলিশকে সব কথা বলব বলে আমি মনে মনে ঠিক করেছি। আপনি যদি মিঃ হোমসকে একটা চিঠি লিখে দেন তো সেটা নিয়ে আমি দেখা করতে পারি।”

 

“না চিঠি দেব না। আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।”

 

“তা হলে আমি আপনার কাছে চিরকালের জন্যে ঋণী হয়ে থাকব।”

 

“বেশ। একটা গাড়ি ডাকাই। একসঙ্গে বেরোনো যাবে। আশা করি আমরা ঠিক চায়ের সময়ে গিয়ে হাজির হতে পারব। কিন্তু আপনি কি যাতায়াতের ধকল সহ্য করতে পারবেন ?”

 

“খুব পারব। আর তা ছাড়া সব কথা খুলে না বলতে পারলে আমার স্বস্তি হবে না।”

 

“ঠিক আছে। আমি গাড়ি ডাকতে লোক পাঠাচ্ছি। আপনি এই ঘরে একটু বসুন। আমি একবার ভেতর থেকে আসছি।” আমি ওপরে গিয়ে আমার স্ত্রীকে সব কথা খুলে বললাম। তারপর পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে গাড়ি ডাকিয়ে ভদ্রলোককে নিয়ে বেকার স্ট্রিটের দিকে রওনা হলাম।

 

শার্লক হোমস এই সময় কী করে আমার জানা ছিল। দেখলাম ঠিক তাই। হোমস আরামকেদারায় বসে পাইপ টানছিল আর ‘টাইমস’ পত্রিকার ব্যক্তিগত বিভাগের বিজ্ঞাপনগুলো মন দিয়ে পড়ছিল। আমাদের দেখে হোমস খুব খুশি হয়েছে বলে মনে হল। সঙ্গে সঙ্গে সে আমাদের জন্যে টোস্ট, ডিম আর চা আনাল। আমরা বেশ জমিয়ে প্রাতরাশ সারলাম। চা খাওয়া শেষ হলে হোমস খুব যত্ন করে আমাদের সদ্য-পরিচিত বন্ধুটিকে একটা আরামকেদারায় বসিয়ে দিল। তারপর তার মাথার কাছে একটা বালিশ গুঁজে দিল, যাতে তার বসে থাকতে কষ্ট না হয়। হোমস ভদ্রলোকের হাতের কাছে একটা তেপায়া ছোট টেবিলে জল আর ব্র্যান্ডি এনে রাখল।

 

“বুঝতে পারছি মিঃ হেদারলি, আপনার ওপর দিয়ে খুব বড় রকমের ঝড়ঝাপটা গেছে। এটাতে আরাম করে বসুন। এটা আপনার নিজের বাড়ি বলে মনে করবেন। তারপর ধীরেসুস্থে আপনার সব কথা আমাকে খুলে বলুন। তবে হ্যাঁ, যখনই ক্লান্ত বোধ করবেন। তখনই চুপ করে বিশ্রাম নেবেন, যতক্ষণ না বেশ চাঙ্গা বোধ করেন। আর এই ব্র্যান্ডি দু’-এক চুমুক করে খেলে আপনি একটু বল পাবেন।”

 

“অনেক ধন্যবাদ মিঃ হোমস। ডাঃ ওয়াটসন কাটা জায়গাটা ব্যান্ডেজ করে দেবার পরই আমার অর্ধেক দুর্বলতা চলে গিয়েছিল। আর এখন আপনার এখানে পেটপুরে প্রাতরাশ করে আমি পুরোদস্তুর ‘ফিট’। আমি জানি আপনার সময়ের দাম আছে, তাই বেশি সময় নেব না। একেবারে আসল কথায় আসি।”

 

হোমস তার নিজস্ব আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসল। যারা হোমসকে চেনে না তারা হোমসকে এই রকম ভাবে দেখলে ভাববে যে, সে নির্ঘাত ঘুমোচ্ছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা ঠিক উলটো। বিপুল আগ্রহে সে তার মক্কেলের প্রত্যেকটি কথা শুনছে, বিচার করছে, বিশ্লেষণ করছে। আমি হোমসের উলটো দিকের একটা চেয়ার দখল করলাম। হেদারলি বলতে শুরু করল। আমরা শুনতে লাগলাম।

 

ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন, “গোড়াতেই বলি, আমি যাকে-বলে নিছক একলা লোক। আমার নিজের লোক বলতে এ-সংসারে কেউ নেই। লন্ডনের এক মেসবাড়িতে একটা ঘরে বাস করি। পেশায় আমি একজন হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার। গ্রিনিচের নামকরা ‘ভেনার অ্যান্ড ম্যাথিসন’ কোম্পানিতে আমি সাত বছর ধরে খুব ভাল ভাবে কাজ শিখেছি। বছর-দুয়েক আগে যখন আমার শিক্ষানবিশির পাট চুকছে তখনই আমার বাবা মারা যান। আমার হাতে পৈতৃক সম্পত্তির দরুন কিছু টাকা এসে গেল। মতলব করলাম নিজেই ব্যবসা করব। ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে আপিস খুলে বসলাম।

 

“যারা ব্যবসা করছেন তাঁরা জানেন যে গোড়ায় গোড়ায় কী নিদারুণ কষ্ট করতে হয়, কী অসীম ধৈর্য ধরতে হয়। তার ওপর আমার বরাতটাই খুব খারাপ। এই দু’বছরে আমার কাছে সাকুল্যে চার জন মক্কেল এসেছিল। তিন জন পরামর্শ করতে এসেছিল আর এক জন এসেছিল সামান্য একটা কাজ করাতে। গত দু’ বছরে ব্যবসা থেকে আমার আয় বলতে এইমাত্র। এই সময়ে আমার মোট উপার্জনের পরিমাণ মাত্র সাতাশ পাউন্ড দশ শিলিং। প্রত্যেক দিন সকাল সাড়ে ন’টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত মক্কেলের জন্য তীর্থের কাকের মতো হাপিত্যেশ করতে করতে আমি মনে মনে বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ছিলাম। শেষকালে এমন হল যে আমি ঠিক করলাম আমার দ্বারা ব্যবসা হবে না। সুতরাং পাততাড়ি গোটাতে হবে।

 

“গতকাল বিকেলে আমি আপিসঘর থেকে উঠব উঠব করছি, এমন সময় আমার বেয়ারা এসে বলল যে এক ভদ্রলোক বিশেষ কাজে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। বেয়ারার হাতে ভদ্রলোক তাঁর কার্ড পাঠিয়ে ছিলেন। কার্ডের ওপর নাম লেখা ছিল কর্নেল লাইসান্ডার স্টার্ক। আমার বেয়ারার প্রায় পিছনে পিছনে কর্নেল এসে ঘরে ঢুকলেন। মাঝারি উচ্চতার লোকটি অসম্ভব রোগা। অত রোগা লোক আমি এর আগে দেখিনি। ভদ্রলোকের শরীরে মেদ এত কম যে, মনে হয় যে-কোনও সময়ে পাতলা চামড়ার আস্তরণ ছিড়ে তার শরীরের হাড়গুলো বেরিয়ে আসবে। তবে রোগা হলেও ভদ্রলোক রুগ্‌ণ নন। তার চলাফেরার ভঙ্গি, মুখ চোখের পরিষ্কার ভাব দেখলে বোঝা যায় তিনি বেশ সুস্থ। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালে প্রথম যেটা নজরে পড়ে তা হল তাঁর খাড়া নাক। ভদ্রলোকের পোশাক জমকালো নয় বটে, তবে বেশ দামি। আমার মনে হল ভদ্রলোকের বয়স গোটা চল্লিশেক হবে।

 

“মিঃ হেদারলি ?’ ভদ্রলোকের কথা বলার ধরনটা খানিকটা জার্মানদের মতো। ‘আমি শুনেছি যে আপনি কেবলমাত্র বড় ইঞ্জিনিয়ার নন, একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। আপনাকে বিশ্বাস করে কোনও কথা বললে সে কথা আপনি পাঁচজনকে বলে বেড়ান না।’

 

“ওঁর কথার কোনও জবাব না দিয়ে আমি শুধু মাথা নিচু করলাম। মনে মনে বেশ আনন্দ হল। নিজের প্রশংসা শুনতে কারই বা খারাপ লাগে বলুন? আমি বললাম, ‘কার কাছ থেকে আপনি আমার কথা শুনেছেন জানতে পারি কি?’

 

“সে কথা নাই শুনলেন। তবে তিনি আমাকে বলেছেন যে আপনি বিয়ে-থা করেননি। সংসারে আপনার নিজের বলতে কেউ নেই। আর আপনি লন্ডন শহরে থাকেন।

 

“আমার সম্বন্ধে আপনার সব খবরই খাঁটি,’ আমি বললাম। ‘তবে আমার কাজের সঙ্গে এ সবের কী যোগ আছে সেটা বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা হয়েছিল যে আপনি আমার সঙ্গে কোনও ব্যবসায়িক কথাবার্তা বলতে এসেছেন।’

 

“আমি একটা কাজের ব্যাপারেই আপনার কাছে এসেছি। তবে যে কথাগুলো বললাম সেগুলো ওই কাজের প্রসঙ্গেই বললাম। আর কেন যে বললাম তা আপনি এখনই বুঝতে পারবেন। আমি আপনার সাহায্য চাই। ব্যাপারটা গোপনীয়। সবকিছু চুপি চুপি সারতে হবে, যাতে কাকপক্ষী না টের পায়। আমার নিজের ধারণা এই ধরনের গোপন কাজের ভার সাংসারিক লোকেদের দিলে ব্যাপারটা গোপন থাকে না, ফাঁস হয়ে যায়। সেদিক থেকে আপনার ওপর বিশ্বাস করা যায়।’

 

“আমি যদি আপনাকে কথা দিই যে ব্যাপারটা গোপন থাকবে তো কথাটা কেউ জানবে সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন,’ আমি বললাম।

 

“আমার কথায় লোকটি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি খুব কঠিন। মনে হল ভদ্রলোক আমাকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে কিনা বুঝে উঠতে পারছেন না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘তা হলে আপনি আমাকে কথা দিচ্ছেন ?’

 

“হ্যাঁ, আমি কথা দিচ্ছি।’

 

“সবকিছু একদম গোপন রাখতে হবে। ভবিষ্যতে কখনও কারওর কাছে কোনও অবস্থায় ট্যাঁ-ফোঁ করা চলবে না।’

 

‘“আমি তো আপনাকে গোড়াতেই সে কথা দিয়েছি।’

 

“খুব ভাল,’ বলেই এক লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা একটানে খুলে ফেললেন। বারান্দাটা খাঁ-খাঁ করছে। সেখানে জনপ্রাণী নেই।

 

“দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে তিনি বললেন, ‘যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। অনেক সময়ে বেয়ারারা আড়ি পেতে গোপন কথাবার্তা সব শোনে। এখন আমরা খোলাখুলি ভাবে সব আলোচনা করতে পারি।’ ভদ্রলোক যে-চেয়ারটায় বসে ছিলেন সেটা সরিয়ে আমার মুখের কাছে এনে বসলেন।

 

“একেই ভদ্রলোকের চেহারা দেখলে মনে হয় যে তাঁর শরীরে হাড়গুলো ঢেকে রাখবার জন্যে যতটুকু মাংসের দরকার তার চাইতে এক রতি মাংস বেশি নেই, তার ওপর তাঁর এই অদ্ভুত আচরণ আর নিষ্ঠুর দৃষ্টি দেখে আমার কেমন একটা ভয় ভয় করতে লাগল। ভদ্রলোককে আমার খারাপ লাগল। তাই খদ্দের হারাবার ভয় সত্ত্বেও আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘আপনার যা বলার সেটা যদি তাড়াতাড়ি বলেন তো ভাল হয়। আমার সময়ের দাম আছে।’ কথাটা বলা অবশ্য আমার ঠিক হল না। কিন্তু কী করব? মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।

 

‘“একরাত্রের কাজের জন্যে আপনাকে পঞ্চাশ গিনি দিলে কি আপনার পোষাবে?”

 

‘“তা পুষিয়ে যেতে পারে।’

 

‘“বলছি বটে এক রাত্তিরের কাজ, আসলে কাজটা সারতে আপনার হয়তো ঘণ্টাখানেকের বেশি লাগবে না। একটা হাইড্রলিক স্টাম্পিং মেশিন খারাপ হয়ে গেছে। সেটা কী করলে ফের চালু করা যাবে সে সম্বন্ধে আপনার পরামর্শ চাই। মেশিনটার ঠিক কোন জায়গাটা খারাপ হয়েছে আপনি যদি সেটা দেখিয়ে দেন তো আমরা নিজেরাই সারিয়ে নিতে পারব। এ কাজটা আপনার কেমন মনে হচ্ছে?’

 

‘“শুনে তো মনে হচ্ছে কাজটা বেশ হালকা। আর এর জন্যে বেশ ভাল পারিশ্রমিকই দেওয়া হচ্ছে।”

 

“তা যা বলেছেন। আমরা চাই আপনি আজই রাত্তিরের শেষ ট্রেনে চলে আসুন।’

 

‘“কোথায় যেতে হবে ?’

 

‘“বার্কশায়ারে এফোর্ড বলে একটা জায়গা আছে, সেইখানে। জায়গাটা অক্সফোর্ডশায়ারের প্রায় লাগোয়া। রেডিং থেকে মাত্র সাত মাইল দূরে। প্যাডিংটন থেকে শেষ ট্রেনে চাপলে আপনি রাত সোয়া-এগারোটা নাগাদ পৌঁছে যাবেন।’

 

‘“বেশ।’

 

‘“আমি গাড়ি নিয়ে স্টেশনে আপনার জন্যে হাজির থাকব।’ ট্রেন থেকে নেমে বাকি রাস্তাটা আমাদের গাড়িতে যেতে হবে?’ হ্যাঁ, আমরা একটু ভেতরের দিকে যাচ্ছি। এফোর্ড স্টেশন থেকে আমরা যেখানে থাকি সেটা মাইল সাতেক মতো হবে।’

 

‘“তবে তো দেখছি গিয়ে পৌঁছোতে পৌঁছোতে মাঝরাত্তির হয়ে যাবে। অত রাত্রে নিশ্চয়ই লন্ডনে ফেরবার আর কোনও ট্রেন নেই। রাতটা তা হলে ওখানেই কাটাতে হবে।’

 

‘“আমরা আপনাকে একটা মাথা গোঁজার মতো জায়গা দিতে পারব।’

 

‘“তা ঠিক। তবে আমার একটু অসুবিধে হবে। অন্য সময়ে গেলে হয় না?’

 

‘“না, অনেক ভেবেচিন্তেই আমরা ওই সময়টা ঠিক করেছি। আর যে অসুবিধের কথা বলছেন সেই সব ভেবেই তো আপনার মতো কমবয়সি অভিজ্ঞতাও কম এমন একজন লোককে আমরা অত টাকা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ওই টাকায় তো আমরা একজন খুব বড় দরের হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে যেতে পারতাম। সে কথা থাক। আপনার যদি সুবিধে না হয় তো বলুন আমি অন্য কোনও লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করি।’

 

“ভদ্রলোকের কথা শুনে আমার চোখের সামনে পঞ্চাশ গিনি ভেসে উঠল। টাকাটা পেলে আমার কাজে লাগবে। তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘না, না, সে রকম কোনও অসুবিধে হবে না। আর যেটুকু হবে সেটা ম্যানেজ করে নেব। তবে যে কাজের জন্য যাব সেটার সম্পর্কে আরও কিছু জানতে পারলে আমার সুবিধে হত।’

 

‘“সে তো ঠিক কথা। তার ওপর যে ভাবে আপনাকে সবকিছু গোপন রাখার জন্যে বলেছি তাতে ব্যাপারটা কী জানবার কৌতুহল হওয়া আপনার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। আর এও ঠিক সব কথা আপনাকে না জানিয়ে আপনাকে দিয়ে কোনও কাজ আমি করিয়ে নিতে চাই না।…আশা করি আমাদের কথাবার্তা আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে কেউ শুনছে না?’

 

‘“না।’

 

‘“বেশ। ব্যাপারটা হচ্ছে এই রকম। তার আগে জিজ্ঞেস করি ‘ফুলারস আর্থ’ কাকে বলে আপনার জানা আছে কি?’

 

“আমি কোনও উত্তর দেবার আগেই ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন, ‘কাপড় পরিষ্কার করতে বা কাপড়ের শোষণশক্তি বাড়াবার জন্যে এই ধরনের কাদামাটি ব্যবহার করা হয়। ফুলারস আর্থের বাজারদর আর চাহিদা খুব বেশি। ইংল্যান্ডে দু’-একটা জায়গা ছাড়া এ জিনিস পাওয়া যায় না।’

 

“এইবার আমি সুযোগ পেতে বললাম, ‘এসব কথা আমার জানা আছে।’

 

‘“কিছুদিন আগে রেডিংয়ের মাইল-দশেকের মধ্যে আমি একটা ছোটখাটো বাড়ি সমেত জমি কিনি। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম যে, আমার জমির তলায় ফুলারস আর্থ আছে। ভাল করে পরীক্ষা করে বুঝলাম যে, আমার জমির নীচে খুব অল্প পরিমাণ ফুলারস আর্থই আছে। আরও বুঝলাম যে, আমার ডান দিকে আর বাঁ দিকে যে জমি রয়েছে সেখানে প্রচুর পরিমাণে ওই বস্তু সঞ্চিত আছে। আমার জমিটা হচ্ছে ওই জমিদুটোর মধ্যে বন্ধনসূত্র। তবে যে-হেতু এই বন্ধনসূত্র খুবই সরু সেইজন্য আমার জমির তলায় ওই জিনিস বেশি নেই। মুশকিল হচ্ছে ওই জমির মালিকানা অন্য লোকের। ওরা জানে না যে ওদের জমির তলায় সোনার চাইতে দামি জিনিস রয়েছে। আমি কী ভাবে ওই জমি দুটো কেনা যায়, মনে মনে সেই মতলব ভাঁজতে লাগলাম। কিন্তু সমস্যা হল টাকা। আমার হাতে অত টাকা নেই। আর কোনও রাস্তা না পেয়ে আমি আমার দু’-এক জন বন্ধুকে সব কথা বললাম। তারা বলল যে আগে আমরা আমাদের জমির তলায় যতটা ‘ডিপোজিট’ আছে সেটা তুলে নিই। তারপর সেটা বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে পাশের জমিদুটো কিনে ফেলা যাবে। আমরা সেইমতো কাজ আরম্ভ করেছি। কাজটা অল্প দিন হল শুরু করেছি। কাজের সুবিধের জন্যে আমরা একটা হাইড্রলিক প্রেসার মেশিন কিনেছি। সেই মেশিনটা বিগড়েছে। তাই আমরা আপনার কাছে পরামর্শের জন্যে এসেছি। এখনও পর্যন্ত আমরা সব ব্যাপারটা গোপনে রেখেছি। হঠাৎ যদি পাড়ার লোকেরা খবর পায় যে, আমাদের বাড়িতে হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার এসেছে তা হলে তো তারা কী ব্যাপার জানতে চাইবে। সব কথা ফাঁস হয়ে যাবে। লোকের কৌতূহল হবে। হইচই হবে। ফলে আমাদেরও ওই জমি কিনে বড়লোক হবার মতলব ভেস্তে যাবে। আর সেই জন্যেই আপনাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিচ্ছি আজ রাত্তিরে আপনি যে এফোর্ড যাচ্ছেন সে কথা কাউকে ঘুণাক্ষরে বলবেন না।…আশা করি আমার সব কথা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পেরেছি।’

 

‘“আপনার সব কথাই আমি বুঝতে পেরেছি। যে-কথাটা বুঝতে পারিনি সেটা হল যে ফুলারস আর্থ তুলতে আপনারা হাইড্রলিক প্রেশার ব্যবহার করছেন কেন? আমার ধারণা যে খনি থেকে যে ভাবে কেটে কেটে চাঙড় তোলা হয় ফুলারস আর্থও সেই ভাবে তোলে।’

 

“আমার কথায় কান না দিয়ে ভদ্রলোকটি বললেন, ‘আমরা আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ করি। মাটির তালকে চাপ দিয়ে আমরা ইটের আকার করে নিই। তাতে করে লোকেরা কিছু সন্দেহ করে না। যাই হোক, সেটা অবান্তর ব্যাপার। আসল কথা হচ্ছে যে, আমি আপনাকে সব কথা বলেছি। বুঝতেই পারছেন মিঃ হেদারলি, আমি আপনাকে কতখানি বিশ্বাস করে সব গোপন কথা বললাম। সুতরাং আমিও আশা করব যে আপনি আপনার কথা রাখবেন।…ঠিক আছে, আজ রাত্রে এফোর্ডে ফের আপনার সঙ্গে দেখা হবে।’ এই কথা বলে ভদ্রলোক উঠে পড়লেন।

 

‘“আমি ঠিক সময়েই পৌঁছোব।’

 

‘“কিন্তু এ সব কথা আর যেন কেউ না জানে,’ বলে ভদ্রলোক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর শেকহ্যান্ড করে চলে গেলেন। ভদ্রলোকের হাতটা যেমন ঠান্ডা তেমনই চটচটে।

 

“ভদ্রলোক চলে যাবার পরে সব ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় ভাবতে আমার খুব আশ্চর্য লাগল। এতক্ষণ যা বললাম তা শুনে আপনারাও নিশ্চয়ই আশ্চর্য হচ্ছেন। তবে শেষকালে বেশ আনন্দই হল। কেন না কাজের তুলনায় মজুরিটা বেশ ভাল। এই কাজটুকু করতে আমি যে-মজুরি নিতাম এরা আমাকে তার দশগুণ বেশি দিচ্ছে। তবে যখনই সেই ভদ্রলোকের কথা মনে হচ্ছিল, তখনই কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। আমি তাঁর কথা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তা ছাড়া ফুলারস আর্থের ব্যাপারটাও আমার কাছে গোলমেলে ঠেকছিল। বিশেষত আমার যাবার কথাটা কাউকে না বলবার জন্যে যে ভাবে উনি পেড়াপেড়ি করছিলেন সেটা রীতিমতো সন্দেহজনক। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সব ভাবনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে রাতের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে আমি এফোর্ডের দিকে যাত্রা করলাম।

 

“রেডিং স্টেশনে প্লাটফর্ম বদলে যখন এফোর্ডের ট্রেনে চাপলাম তখন গাড়ি ছাড়তে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। এফোর্ড স্টেশনে যখন নামলাম তখন এগারোটা বেজে গেছে। স্টেশনটা ছোট। আলো কম। কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। এফোর্ড স্টেশনে আমি ছাড়া আর কেউ নামল না। গোটা প্লাটফর্মটায় একজন প্রায়-ঘুমন্ত রেলের লোক ছাড়া কাউকে দেখতে পেলাম না। স্টেশনের বাইরে আসতেই আমার মক্কেলের সঙ্গে দেখা হল। ছায়ার মতো গেটের একপাশে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে কোনও কথাবার্তা না বলে তিনি আমার হাত ধরে প্রায় একরকম টেনে নিয়ে চললেন। কাছেই একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি আমাকে গাড়িতে তুলে দিলেন। তারপর নিজে উঠে গাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ করে গাড়ির গায়ে টোকা দিতেই গাড়ি চলতে শুরু করল।”

 

স্টেশনের বাইরে ঘোড়ারগাড়ি দাঁড়িয়েছিল, হেদারলির মুখে এই কথা শুনে হোমস জিজ্ঞেস করল, “এক-ঘোড়ার গাড়ি?”

 

“হ্যাঁ, এক-ঘোড়ার গাড়ি।

 

“আপনি কি ঘোড়াটার গায়ের রংটা লক্ষ করেছিলেন?”

 

“গাড়িতে ওঠবার সময় পাদানিতে পা রাখতে গিয়ে গাড়ির আলোয় হঠাৎই নজর পড়েছিল। ঘোড়াটার রং বাদামি।”

 

“ঘোড়াটা কি বেশ চাঙ্গা ছিল, না ক্লান্ত ছিল ?”

 

“না, বেশ টগবগ করছিল।’

 

“ঠিক আছে। আপনাকে আর বাধা দেব না। বলুন।”

 

“আমাদের নিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করল। তা প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো সময় গাড়িতে কাটল। কর্নেল লাইসান্ডার ক্লার্ক বলেছিলেন যে, স্টেশন থেকে মাইল সাতেক যেতে হবে। গাড়ির গতি আর যতক্ষণ সময় আমরা গাড়িতে ছিলাম তা হিসেব করে আমার মনে হয় আমরা খুব কম করে বারো মাইল পথ চলে এসেছি। কর্নেল আমার পাশেই বসেছিলেন। যত বারই তাঁর দিকে চেয়ে দেখলাম তত বারই দেখলাম তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ওই দিকের রাস্তার অবস্থা খারাপ। গাড়ির চাকা গর্তের মধ্যে পড়ে লাফিয়ে উঠছিল। একবার কথাবার্তা বলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কর্নেল হুঁ-হাঁ করেই চুপ করে গেলেন। বাধ্য হয়ে আমাকেও চুপ করে যেতে হল। গাড়ির বাইরেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। গাড়িটায় সাদা কাচের শার্সি লাগানো। মাঝে মাঝে একটা-আধটা আলোর আভা দেখা যাচ্ছিল মাত্র। তারপর এক সময় মেঠো পথ ছেড়ে আমাদের গাড়ি নুড়ি-বিছানো রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল। শেষকালে গাড়িটা থামল। গাড়িটা থামতেই কর্নেল লাফিয়ে নেমে পড়লেন। আমি তারপর গাড়ি থেকে নামলাম। আমি কর্নেলের পেছনে আসছিলাম, হঠাৎ কর্নেল আমাকে আচমকা এক হেঁচকা টান দিয়ে একটা দরজার দিকে টেনে নিলেন। কিছু বোঝবার আগেই আমি একটা বন্ধ গাড়ি থেকে একটা হলঘরের মধ্যে চালান হয়ে গেলাম। বাড়িটা কেমন সেটা পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। আমরা হলে পা দিতেই হলের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির চাকার চাপা ঘড়ঘড় শব্দ কানে এল। বুঝলাম, আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা চলে গেল।

 

“বাড়ির ভেতরটা একদম ঘুটঘুট্টে অন্ধকার। কর্নেল একটা দেশলাই হাতড়াতে হাতড়াতে নিজের মনেই কী যেন বলছিলেন। এমন সময় হলের আর-এক দিকের দরজা খুলে গেল। সেই ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ল। আস্তে আস্তে আলোটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আলো হাতে এলেন এক ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলাকে দেখতে খুব ভাল। তাঁর জামাকাপড়ও বেশ দামি। তিনি কর্নেলকে অন্য কোনও ভাষায় কী যেন বললেন। তাঁর কথা আমি বুঝতে পারলাম না। তবে ভদ্রমহিলার কথার উত্তরে কর্নেল কিছু বললেন। কী বললেন সেটাও বুঝতে পারলাম না। আমার কেমন যেন মনে হল একটানা খানিকক্ষণ ঘোঁত ঘোঁত শব্দ শুনলাম। তবে কর্নেলের কথায় সেই ভদ্রমহিলা এমন চমকে গেলেন যে আর একটু হলেই আলোটা তাঁর হাত থেকে পড়ে যেত। তারপর কর্নেল সেই ভদ্রমহিলার কানে কানে কিছু বলে তাঁকে একরকম জোর করে তিনি ঘরের যে-দিক দিয়ে ঢুকেছিলেন সেই দিক দিয়ে নিয়ে গেলেন। একটু পরেই কর্নেল ফিরে এলেন।

 

“হলের লাগোয়া একটি ঘরের দরজা খুলে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘মিঃ হেদারলি, আপনি দয়া করে এ ঘরে একটু বসুন। আমি আসছি।’

 

“ঘরের ভেতরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তবে ছোট ঘর। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিলের ওপরে কয়েকটা বই রাখা ছিল। সব বইগুলিই জার্মান ভাষায় লেখা। কর্নেল তার হাতের জ্বলন্ত মোমবাতিটা একটা হারমোনিয়ম বাক্সের ওপরে বসিয়ে দিলেন। তারপর ‘আমি এক্ষুনি আসছি’ বলে তিনি অন্ধকারের মধ্যে মিশে গেলেন।

 

“সময় কাটাবার জন্যে টেবিল থেকে বইগুলো তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম। আমার অল্প জার্মান জ্ঞান থেকে বুঝতে পারলাম যে দুটো সায়েন্সের বই আর একটা কবিতার বই। বইগুলো রেখে দিয়ে জানলার দিকে এগিয়ে গেলাম। মনে করলাম যদি বাইরের দিকে কিছু দেখা যায়। জানলার কাছে গিয়ে দেখলাম যে, জানলার ওক কাঠের ভারী পাল্লা দুটো একদম সেঁটে বন্ধ করা। সমস্ত বাড়িটা আশ্চর্য রকম চুপচাপ। একমাত্র শব্দ যা আমার কানে আসছিল তা হল পুরনো ক্লকের টিকটিক শব্দ। ক্লকটার শব্দ ছাড়া গোটা বাড়িটায় আর কোনও সামান্যতম শব্দও শোনা যাচ্ছিল না। হঠাৎ মনটা কেমন করে উঠল। এই জার্মানদের পরিচয় কী? এই প্রায়-পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এরা কী করছে? কেন এদের এই গোপনতা ? এ জায়গাটাই বা কোথায়। এদের কথা থেকে যতদুর বুঝতে পেরেছি জায়গাটা এফোর্ড থেকে প্রায় দশ-বারো মাইল দূরে হবে। কিন্তু জায়গাটা এফোর্ডের পুবে না পশ্চিমে, উত্তরে না দক্ষিণে, সে বিষয়ে কোনও জ্ঞানই আমার নেই। তবে মনটা এই ভেবে ঠান্ডা হল যে, রেডিং শহরটা যদি দশ-বারো মাইলের মধ্যে হয় তবে জায়গাটা লোকালয় থেকে একদম দূরে নাও হতে পারে। একটা ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ হলাম যে, জায়গাটা শহর নয়, পাড়াগাঁ। মনকে চাঙ্গা করতে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলাম। মনে হল, পঞ্চাশ গিনি উপার্জন করবার জন্যে রীতিমতো কষ্ট করতে হচ্ছে।

 

“আমি কিছু টের পাবার আগেই ঘরের দরজাটা কখন নিঃশব্দে খুলে গেল। দেখলাম সেই ভদ্রমহিলা দরজায় দাঁড়িয়ে। ভদ্রমহিলা হলঘরের দিক থেকে এসেছেন। দেখলাম হলঘরটা অন্ধকার। আমার ঘরে যে-মোমবাতিটা জ্বলছিল তার আলোটা গিয়ে পড়েছে ভদ্রমহিলার মুখে। ভদ্রমহিলা মোটামুটি সুন্দরী। কিন্তু তাঁর মুখের দিকে তাকাতে যেটা চোখে পড়ল সেটা হল তাঁর মুখের ভাব। তার মুখে সাংঘাতিক রকম ভয় আর দুশ্চিন্তার ভাব ফুটে উঠেছে। আমার বুঝতে কষ্ট হল না, দারুণ ভয়ের মধ্যে তাঁর সময় কাটে। তাঁকে দেখে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। একটু ভয় ভয় করতে লাগল। হাতের ইঙ্গিতে তিনি আমাকে কথা বলতে বারণ করলেন। আমার কানের কাছে মুখ এনে তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কিছু বললেন। কথা বলবার সময় তিনি বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে হলের দিকে দেখছিলেন। তাঁর চোখের চাউনি কোনও মানুষের চোখের চাউনি নয়। সে দৃষ্টি যেন শিকারির তাড়া খাওয়া প্রাণভয়ে ভীত কোনও জন্তুর চোখের চাউনি।

 

“তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি হলে চলে যেতাম। আপনি থাকবেন না। এখানে আপনার কিছু করবার নেই।’ কথাগুলো খুব শান্ত ভাবে বলবার চেষ্টা করলেও তিনি ভেতরে ভেতরে এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না।

 

‘“কিন্তু দেখুন,’ আমি বললাম, ‘যে-কাজ করতে এসেছি সেটাই তো এখনও করা হয়নি। মেশিনটা না দেখে আমি যাই কী করে আপনিই বলুন না?’

 

“আমার কথায় কান না দিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, ‘ওটা না দেখলেও আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। পেছন দিকে একটা দরজা আছে। সেটা দিয়ে বড় রাস্তায় যাওয়া যাবে। সেখানে আপনাকে বাধা দেবার কেউ নেই।’ হঠাৎ তার খেয়াল হল যে আমি তার কথা শুনছি বটে, তবে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছি না। তাই তিনি কোনও রকম সংকোচ না করে আমার হাত দুটো ধরে বললেন, ‘ভগবানের নামে বলছি, এখনও সময় আছে, পালান। এরপর কিন্তু পালাবার উপায় থাকবে না।’

 

“আমার স্বভাব একটু একগুঁয়ে ধরনের। বিশেষত কোনও কিছুতে বাধা পেলে সে কাজটা করবার জন্যে আমার জেদ বেড়ে যায়। আমার মনে পঞ্চাশ গিনির চিন্তাটা বড় হয়ে উঠল। মনে মনে চিন্তা করলাম, এই যে এত কষ্ট করে এত রাত্রে অজ পাড়াগাঁয়ে এলাম এর সবটাই কি পণ্ডশ্রম হবে? এই ভদ্রমহিলা যাঁকে আমি চিনি না, জানি না, এঁর কথা শুনে যে কাজ করতে এসেছি সেটা না করে পারিশ্রমিক না নিয়ে চুপি চুপি পালানোটা কি ঠিক হবে? মনে হল ভদ্রমহিলার হয়তো মাথার গোলমাল আছে। উনি হয়তো আমাকে আরও কিছু বলতেন, এমন সময় বাড়ির মধ্যে কোথায় যেন একটা দরজা বন্ধ করার শব্দ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার শব্দ হতে লাগল। ভদ্রমহিলা কান খাড়া করে সেই শব্দ শুনলেন। তারপর যেমন নিঃশব্দে এসেছিলেন তেমনই নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমার মনে হল যে আমি তাঁর কথা না শোনায় তিনি ভীষণ হতাশ হয়েছেন।

 

“একটু পরেই কর্নেল লাইসেন্ডার স্টার্কের সঙ্গে আর একজন ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রলোক বেশ বেঁটে আর মোটা। গালে চাপদাড়ি। ভদ্রলোকের নাম মিঃ ফার্গুসন।

 

“মিঃ ফার্গুসনকে দেখিয়ে কর্নেল বললেন, ‘ইনি আমার সহকারীও বলতে পারেন, আবার ম্যানেজারও বলতে পারেন।…ঘরটা ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে কেন? আমার মনে হচ্ছে আমি ওই দরজাটা বন্ধ করে গিয়েছিলাম। আপনার ঠান্ডা লেগে যায়নি তো?’

 

‘“মোটেই নয়। সত্যি কথা বলতে কী, আমার বেশ গরম বোধ হচ্ছে।’

 

“আমার দিকে কর্নেল এমন ভাবে তাকালেন যে আমার মনে হল তিনি আমার কথা ঠিকমতো বিশ্বাস করতে পারছেন না। বললেন, ‘চলুন যাওয়া যাক আপনাকে মেশিনটা দেখিয়ে দিই।’

 

‘“দাঁড়ান, টুপিটা মাথায় দিয়ে নিই।’

 

‘“দরকার নেই। মেশিনটা এই বাড়িতেই বসানো আছে।’

 

‘“কী কাণ্ড! আপনারা কি বাড়ির মধ্যেই ফুলারস আর্থ খুঁড়ছেন নাকি।’

 

‘“না তা নয়। আমরা এখানে মেশিনটা রেখেছি ফুলারস আর্থকে চাপ দিয়ে সাইজমাফিক করার জন্যে। থাক সে কথা। আমরা চাই যে আপনি মেশিনটা দেখে বলে দিন যে কেন এটা বিগড়েছে।’

 

“আর কোনও কথা না বলে আমরা সিঁড়ির দিকে গেলাম। আলো হাতে সবার আগে আগে চললেন কর্নেল। তাঁর পেছনে আমি আর আমার পিছনে ফার্গুসন। বাড়িটা বহু কালের। আমার মনে হল বাড়িটা যেন একটা গোলকধাঁধার ছকে তৈরি। লম্বা লম্বা বারান্দা। ঘরের মধ্যে দিয়ে আর একটি ঘরে যেতে হয়। সরু সরু গলি। এদিকে-ওদিকে অনেক সিঁড়ি। ঘরের দরজা নিচু নিচু। একটু অসাবধান হলেই মাথা ঠুকে যায়। কোনও ঘরের মেঝেতেই কার্পেট নেই। বাড়িটার একতলার ঘরগুলো ছাড়া অন্য তলার কোনও ঘরে আসবাবপত্র নজরে পড়ল না। উলটে দেখলাম অনেক জায়গায় দেওয়ালের প্লাস্টার খসে গেছে। আমি একটা কিছুই-হয়নি গোছের ভাব দেখাতে লাগলাম। কিন্তু ভদ্রমহিলার কথাগুলো বার বার মনে পড়তে লাগল। আমি চোখ-কান খোলা রেখে বেশ হুঁশিয়ার ভাবে চারদিকে নজর রাখতে রাখতে ওদের সঙ্গে চললাম। ফার্গুসন একটা গোমড়ামুখো লোক। কথাটথা একদম বলে না, বা বলতে চায় না। তবে তার চেহারা দেখে বুঝলাম যে লোকটা আর কিছু না হোক আমার জাতভাই বটে।

 

“এক সময়ে কর্নেল একটা ছোট দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দরজাটা তালা লাগানো ছিল। কর্নেল একটা চাবি দিয়ে তালাটা খুললেন। ছোট্ট চৌকো আকারের ঘর। এত ছোট যে তিন জন লোক একসঙ্গে ঢুকতে পারে না। কর্নেল আর আমি ভেতরে গেলাম। ফার্গুসন বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

 

“কর্নেল আমাকে বললেন, “আসলে কিন্তু আমরা দাঁড়িয়েছি মেশিনটার খোলের মধ্যে। এখন যদি কেউ ভুল করে মেশিনটা চালিয়ে দেয় তো বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটে যাবে। যেটাকে আপনি ঘরের ছাদ বলে মনে করেছেন, সেটা কিন্তু যে পিস্টনটা নেমে আসে তার তলার অংশটা। ওটা প্রচণ্ড শক্তিতে নেমে আসে এই মেঝেতে। এই মেঝেটা কিন্তু সিমেন্ট দিয়ে তৈরি নয়। এটা মেটাল ফ্লোর বা ধাতু দিয়ে তৈরি মেঝে। এর পাশে কয়েকটা সিলিন্ডার আছে। সেগুলো জল-ভরতি। পিস্টনের ধাক্কাটা গিয়ে পড়ে ওই সিলিন্ডারের ওপরে। তারপর কী হয় সে তো আপনার ভালই জানা আছে। এখন গোলমালটা কী হয়েছে জানেন? মেশিনটা বেশ মসৃণ ভাবে চলছে না। কেমন যেন আটকে আটকে যাচ্ছে। আর তার ফলে যতটা চাপ হওয়া উচিত ততটা চাপ তৈরি হচ্ছে না।…এখন আপনি সব দেখেটেখে বলুন যে কী করলে এটা আবার ভাল ভাবে চালু হবে।’

 

“আমি কর্নেলের হাত থেকে আলোটা নিয়ে নিলাম মেশিনটা ভাল করে দেখবার জন্যে। এটা একটা বিরাট আকারের হাইড্রলিক প্রেশার মেশিন। এটার সাহায্যে যে কী প্রচণ্ড পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করা যাবে তা বুঝতে আমার কিছুমাত্র অসুবিধে হল না। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মেশিনটা চালাবার হাতলটা টানলাম। সঙ্গে সঙ্গে মেশিনটা চালু হল আর একটা হুস শব্দ আমার কানে এল। তক্ষুনি ব্যাপারটা বুঝে গেলাম। ভেতরে কোথাও ফুটো হয়ে গেছে। তার ফলে সিলিন্ডারগুলো যে ভাবে কাজ করা উচিত সে ভাবে কাজ করছে না। আর তাই যতটা পরিমাণ চাপ তৈরি হওয়া উচিত তা হচ্ছে না। ভাল করে দেখতে দেখতে নজরে পড়ল যে একটা রবারের বুশ শুকিয়ে গিয়েই এই কাণ্ড হচ্ছে। বুশটা শুকিয়ে গেছে বলে পাইপটা গেছে ঢিলে হয়ে আর সেই জন্যেই যতটা চাপ হওয়া দরকার ততটা হচ্ছে না। আমি বুশটা দেখিয়ে দিলাম। কর্নেল বেশ ভাল করে জায়গাটা দেখে নিয়ে আমার কথা শুনলেন, তারপর প্রশ্ন করে করে জেনে নিলেন কী করলে এটাকে ঠিকমতো চালু করা যাবে। সবকিছু ওঁকে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে আমি ফের মেশিনঘরে ফিরে এলাম। আমার ফিরে আসার কারণ হল মেশিনটাকে ভাল করে দেখা। মেশিনটা দেখে আমার বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না যে, ফুলারস আর্থের ব্যাপারটা আগাগোড়া বানানো—স্রেফ একটা ধাপ্পা। ওই কাজের জন্যে যে এত শক্তিশালী মেশিন কেউ ব্যবহার করে তা নিরেট গাধা ছাড়া আর কেউ মানবে না। মেশিনঘরটার দেওয়াল কাঠের আর মেঝেটা একটা বিরাট আকারের লোহার গামলা। গামলাটার দিকে চোখ নামাতেই লক্ষ করলাম গামলার ওপরে ধুলোর মতো গুঁড়ো গুঁড়ো ধাতুর আস্তরণ পড়েছে। হঠাৎ আমি শুনতে পেলাম জার্মান ভাষায় কে যেন কিছু বলল। মাথা তুলতে দেখলাম কর্নেল চোখমুখ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

 

“খুব কড়া ভাবে ধমকে উঠে কর্নেল আমাকে বললেন, ‘ওখানে কী হচ্ছে?

 

“গোড়া থেকেই কর্নেলের আচার-আচরণে আমি তাঁর উপর খুব খুশি ছিলাম না। তার ও আমাকে ঠকানো হয়েছে বুঝতে পেরে মেজাজটা গেল বিগড়ে। বললাম, ‘মনে মনে আপনার ফুলারস আর্থের গল্পের তারিফ করছিলাম। তবে কী জানেন, ঠিক কোন কাজে এ মেশিনটা ব্যবহার করা হচ্ছে, জানতে পারলে আমি হয়তো আরও একটু ভাল পরামর্শ দিতে পারতাম।’ কথাটা বলেই আমি জিভ কামড়ালাম। বুঝলাম মাথা গরম করে বেফাস কথা বলেছি। আমার কথা শুনেই কর্নেলের মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল; চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল।

 

‘“ঠিক আছে। তাই হোক, মেশিনটা সম্বন্ধে ভাল করেই জানো।’ কী ঘটতে চলেছে আমি সেটা বোঝবার আগেই কর্নেল এক পা পিছিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে দড়াম করে বন্ধ করে দিলেন। শুনতে পেলাম দরজার তালাটা চাবি দিয়ে আটকে দেওয়া হল। দৌড়ে দরজার কাছে গেলাম। পাগলের মতো দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলাম, লাথি মারতে লাগলাম, চেঁচাতে লাগলাম। কর্নেল, কর্নেল, দয়া করে দরজা খুলুন।’

 

হেদারলি বলে যেতে লাগলেন তাঁর কাহিনী। “হঠাৎ ঘরের নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা শব্দ আমার কানে এল। শব্দটা কানে যেতেই ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে গেল। মেশিনটা কেউ চালু করে দিয়েছে। হাইড্রলিক প্রেসারের সিলিন্ডারগুলো হিসহিস শব্দে চালু হয়ে গেছে। বুঝলাম, কর্নেলই মেশিনটা চালিয়ে দিয়েছেন। মেঝের ওপরে তখনও লণ্ঠনটা জ্বলছিল। লণ্ঠনটা এখানে নামিয়ে রেখে লোহার গামলায় জমে-থাকা গুঁড়োগুলো পরীক্ষা করতে গিয়েছিলাম। সেই কম আলোতে আমি দেখতে পেলাম যে ঘরের কালো ছাদটা খুব আস্তে আস্তে নেমে আসছে। এই যন্ত্রটা যে কী ধরনের অসম্ভব চাপ সৃষ্টি করতে পারে আমার চাইতে ভাল করে বোধহয় কেউ জানে না। এর চাপে এক মিনিটের মধ্যে আমি তালগোল পাকিয়ে একটা জড়পিণ্ড হয়ে যাব। দরজার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে আমি কনের্লকে দরজা খুলে দেবার জন্য বার বার অনুনয়বিনয় করতে লাগলাম। কিন্তু মেশিনের শব্দে আমার সব অনুরোধ চাপা পড়ে গেল। এখন ঘরের ছাদটা আমার মাথা থেকে মাত্র ফুট দুই-তিন ওপরে। আমি হাত দিয়ে যন্ত্রটাকে ছুঁতে পারছিলাম। হঠাৎ আমার মনে হল যে, আমার মৃত্যু যন্ত্রণাটা কত বেশি হবে, সেটা নির্ভর করবে কোন অবস্থায় মেশিনটা আমাকে পিষে ফেলবে তার ওপরে। আমি যদি উপুড় হয়ে শুয়ে থাকি তো মেশিনটা আমার মেরুদণ্ডটা গুঁড়িয়ে চুরমার করে দেবে। যন্ত্রণাটা কম হবে যদি আমি চিত হয়ে শুয়ে থাকি। কিন্তু চিত হয়ে শুয়ে মেশিনটা একটু একটু করে নেমে আসছে দেখেও কি স্থির হয়ে থাকতে পারব ? ছাদটা আরও খানিকটা নেমে এসেছে। এখন আর খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারছিনা। হঠাৎ আমার মনে বাঁচবার আশা হল। আমার চোখ পড়ল দেওয়ালের ওপর।

 

“আগেই বলেছি যে, ঘরের ছাদ আর মেঝেটা লোহার কিন্তু দেওয়ালগুলো সব কাঠের। হঠাৎ মনে হল কাঠের দেওয়ালের মাঝখানে একটা ফুটো দিয়ে যেন আলোর ক্ষীণ রশ্মি দেখা যাচ্ছে। ফুটোটা একটু একটু করে বড় হতে লাগল। প্রথমটায় আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, সেখানে কোনও দরজা আছে। পরের মুহূর্তেই আমি কোনও রকমে এক লাফে ঘরের যে-দিক দিয়ে আলোর রেখা আসছিল সেদিকে গিয়ে পড়লাম। দরজার কাছে পৌঁছেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। আর প্রায় তখনই ঘরের ভেতরে লণ্ঠনটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল আর লোহায় ধাক্কা লাগবার শব্দ কানে এল। বুঝতে বাকি রইল না। অল্পের জন্যেই এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম!

 

“যখন জ্ঞান হল তখন দেখলাম কে যেন আমার হাত ধরে ঝাঁকানি দিচ্ছে। চোখ মেলে তাকাতে দেখলাম যে একটা সরু বারান্দায় শুয়ে আছি। আর একজন ভদ্রমহিলা ঝুঁকে পড়ে আমাকে দেখছেন। ভদ্রমহিলার হাতে একটা মোমবাতি। মোমবাতির আলোয় ভদ্রমহিলাকে চিনতে পারলাম। আমার সেই অপরিচিতা হিতৈষিণী, যিনি গোড়াতেই আমাকে পালাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

 

“ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, ‘উঠুন, উঠুন। ওরা এক্ষুনি এখানে এসে পড়বে। আর আপনি যে ও ঘরে নেই সেটা টের পেয়ে যাবে। আর একটুও দেরি করবেন না। দয়া করে তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে আসুন।’ এবার কিন্তু আমি তার কথায় অবাধ্য হলাম না। কোনও রকমে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর তার পিছনে পিছনে সেই বারান্দা বরাবর ছুটতে লাগলাম। বারান্দার শেষে একটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে পেলাম একটা চওড়া বারান্দা। বারান্দাতে পৌঁছোতেই চেঁচামেচির শব্দ কানে এল। কারা যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। মনে হল ওপরতলা থেকে কেউ যেন কিছু বলল। তার কথায় আর একজন সাড়া দিল। আমার মনে হল যে, দ্বিতীয় লোকটি আমরা যে তলায় রয়েছি সেই তলাতেই কোথাও আছে। আমার গাইড ভদ্রমহিলা যেন একটু ঘাবড়ে গেলেন। ঠিক কী করা উচিত হবে বুঝতে না পেরে তিনি আমাকে একটা ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে গেলেন। সেটা একটা শোবার ঘর। ঘরের জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ছে।

 

‘“এই হচ্ছে আপনার বাঁচবার একমাত্র রাস্তা। জানলাটা একটু উঁচু তবুও মনে হয় আপনি এখান থেকে লাফিয়ে পালাতে পারবেন।’

 

“ভদ্রমহিলা যখন কথা বলছিলেন তখনই আমার নজর গিয়ে পড়েছিল বারান্দার উলটো দিকে। একটা আলো দেখা যাচ্ছিল। দেখতে পেলাম যে, কর্নেল লাইসেন্ডার স্টার্ক এক হাতে লণ্ঠন আর এক হাতে মাংসওয়ালারা যে রকম ভারী দা মাংস কাটবার জন্যে ব্যবহার করে, সে রকম একটা দা নিয়ে ছুটে আসছে। আমি আর অপেক্ষা না করে এক দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে জানলাটা খুলে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। বাগান থেকে জানলাটা কম করে ফুট তিরিশ উঁচু হবে। চাঁদের আলোয় পরিপাটি করে রাখা বাগানটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। চারদিক নিস্তব্ধ। আমি জানলার ফ্রেমটা ধরে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিলাম না। ভাবলাম যে, যদি শয়তানটা ভদ্রমহিলার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তো আজ ওর একদিন কি আমার একদিন। গুন্ডাটা ভদ্রমহিলাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কিন্তু আটকাবার জন্যে ভদ্রমহিলা লোকটাকে দু’ হাত দিয়ে জাপটে ধরলেন।

 

ভদ্রমহিলা ইংরেজিতে বললেন, ‘ফ্রিৎস, তোমার কি মনে নেই গত বার তুমি আমাকে কী কথা দিয়েছিলে? তুমি যে বলেছিলে এ কাজ আর তুমি করবে না। এই ভদ্রলোক কোনও কথা কাউকে বলবেন না। আমি কথা দিচ্ছি যে, আজ রাত্তিরে যে সব ব্যাপার ঘটল সে সব কথা উনি কাউকে বলবেন না।’

 

‘“তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে এলিস?’ জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে কর্নেল বলল। ‘তুমিই আমাদের ডোবাবে দেখছি। ও সব জেনে গেছে। আমাকে ছেড়ে দাও বলছি।’

 

“ভদ্রমহিলাকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে কর্নেল লোকটা জানলার দিকে ছুটে এল। কর্নেলকে তেড়ে আসতে দেখে আমি কার্নিস থেকে সরে গিয়ে ঝুলে পড়লাম। জানলার ফ্রেমটা তখনও হাত দিয়ে ধরেছিলাম। হঠাৎ আমার হাতে এক প্রচণ্ড আঘাত লাগল। দারুণ যন্ত্রণায় হাত সরিয়ে নিতেই আমি ঝপ করে নীচে পড়ে গেলাম।

 

“নীচে পড়ে গিয়ে আমার খুবই লাগল। তবে ভাগ্য ভাল বলতে হবে, হাত-পা ভাঙেনি। তাই জোর করে নিজেকে সামলে নিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে প্রাণপণ শক্তিতে দৌড়োতে লাগলাম। কেন না, এ খেয়াল ছিল যে, আমি বিপদের হাত থেকে রেহাই পাইনি। ছুটতে ছুটতে মনে হল শরীরটা বেশ ঝিমঝিম করছে। হঠাৎ শরীরটা কেমন দুর্বল লাগতে লাগল। হাতটা দপদপ করছিল। কষ্টও হচ্ছিল খুব। হাতটার দিকে তাকাতেই দেখলাম আমার বুড়োআঙুলটা একদম উড়ে গেছে আর কাটা জায়গাটা দিয়ে ভলভল করে রক্ত পড়ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে কাটা জায়গাটা বাঁধতে গেলাম। আর তখনই মাথাটা কেমন করে উঠল। আমি একটা ঝোপের মধ্যে পড়ে গেলাম।

 

“কতক্ষণ যে অজ্ঞান অবস্থায় পড়েছিলাম বলতে পারি না। তবে যে বেশ খানিকক্ষণ জ্ঞানহীন ছিলাম সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। যখন জ্ঞান হল দেখলাম চাঁদ ডুবে গেছে আর চারদিকে ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে। আমার জামাকাপড় ভিজে সপসপ করছে। সারা রাত শিশির পড়েছে আমার গায়ে। কোটের হাতায় রক্ত লেগে রয়েছে। হাতটা তখনও দপদপ করছে। আমার প্রথম চিন্তা হল কী করে ওখান থেকে পালানো যায়। মনে হল, আমার শত্রুরা কাছাকাছি থাকতে পারে। এখানে বসে থাকলে তাদের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারি। চারদিকে তাকাতে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমার চারদিকে সেই বাড়িটা বা বাগানটা দেখতে পেলাম না ! আমি বড় রাস্তার ধারে একটা ঝোপের কোণে পড়েছিলাম। দেখলাম একটু দূরে একটা একতলা বাড়ি। রাস্তা দিয়ে সেই বাড়িটার দিকে গেলাম। বাড়িটার কাছে এসে দেখি সেটা রেলস্টেশন। গতকাল রাত্রে এই স্টেশনে আমি নেমেছিলাম। আমার বুড়োআঙুলটা যদি কাটা না পড়ত তা হলে গোটা ব্যাপারটা একটা দুঃস্বপ্ন বলে উড়িতে দিতে পারতাম।

 

“কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আমি স্টেশনে গেলাম। লন্ডন ফেরার ট্রেনের খবর নিলাম। জানলাম আধঘণ্টার মধ্যে রেডিং থেকে একটা ট্রেন আসছে। কাল রাত্তিরে যখন স্টেশনে নেমেছিলাম তখন যে-লোকটিকে ডিউটিতে দেখেছিলাম এখনও তারই ডিউটি চলছে। আমি তাকে কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম যে, কর্নেল লাইসেন্ডার স্টার্ক বলে কাউকে সে চেনে কিনা। সে ওই নামের কাউকে চেনে না। তাকে জিজ্ঞেস করলাম গতকাল আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে যে-গাড়ি এসেছিল সেটা সে দেখেছে কিনা। না, সে দেখেনি। তার কাছ থেকে খবর নিয়ে জানলাম যে, থানা স্টেশন থেকে পাক্কা তিন মাইল দূর। তখন আমার শরীরের যে রকম অবস্থা তাতে তিন মাইল পথ হাঁটা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। ঠিক করলাম, লন্ডনে ফিরে গিয়ে পুলিশকে সব কথা জানাব। ছ’টার একটু পরেই আমি লন্ডনে পৌঁছে গেলাম। লন্ডনে পা দিয়েই আমি প্রথম গেলাম ডাক্তারের কাছে। সেখানে কাটা জায়গাটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ডাক্তারবাবুর দয়ায় এলাম আপনার কাছে। এই রহস্যের তদন্তের ভার আপনাকে দিলাম। আপনি যা বলবেন তাই করব।”

 

এই আশ্চর্য ঘটনা শুনে আমরা বেশ খানিকক্ষণ কোনও কথা না বলে চুপ করে বসে বইলাম। তারপর শার্লক হোমস উঠে গিয়ে একটা বড় আকারের বই শেলফ থেকে নামিয়ে আনল। আমি জানি যে এই রকম বাঁধানো খাতায় সে নানা রকমের কাগজ থেকে কাটিং সেঁটে রাখে।

 

হোমস হেদারলিকে বলল, “আপনাকে একটা বিজ্ঞাপন পড়ে শোনাই। বছরখানেক আগে সব খবরের কাগজেই বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছিল। শুনুন। হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার মিঃ জেরেমিয়া হেলিঙের (বয়স ২৬) সন্ধান গত ৯ তারিখ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাত্রি দশটার সময় বাসা থেকে বেরিয়েছেন। তারপর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি। তার পরনে এই ধরনের জামাকাপড়…ইত্যাদি ইত্যাদি। হুঁ, এইটে হল শেষ যেবার কর্নেল হাইড্রলিক প্রেশার সারিয়েছেন সেবারের ব্যাপার।”

 

হেদারলি বলে উঠল, “উফ, কী সাংঘাতিক কাণ্ড। এতক্ষণে সেই ভদ্রমহিলার কথার মানেটা বোঝা গেল।”

 

“ঠিক ধরেছেন। কর্নেল একটি জঘন্য ক্রিমিন্যাল। আগেকার দিনের জলদস্যুরা যেমন জাহাজ লুঠপাট করেই ক্ষান্ত হত না, জাহাজের সবাইকে মেরে ফেলত, কর্নেলও সেই জাতের। এর খপ্পরে যেই পড়বে তাকেই খতম করে দেবে। যাই হোক, এখন প্রতিটি সেকেন্ড আমার কাছে দামি। যদি আপনি ‘ফিট’ মনে করেন তো আমরা এক্ষুনি কাজ শুরু করে দিই। আমাদের যেতে হবে এফোর্ড। কিন্তু তার আগে অবশ্য আমাদের যেতে হবে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে।”

 

ঘণ্টা-তিনেক পরে আমরা রেডিং থেকে বার্কশায়ের সেই অজ পাড়াগাঁয়ের দিকে যাবার জন্যে ট্রেন ধরলাম। আমরা বলতে শার্লক হোমস, মিঃ হেদারলি, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর ব্র্যাডস্ট্রিট, একজন সাদা পোশাকের কনস্টেবল আর আমি। ব্র্যাডস্ট্রিট তার দু’ হাঁটুর ওপরে ওই অঞ্চলের একটি মিলিটারিদের ব্যবহারের ম্যাপ বিছিয়ে এফোর্ডকে কেন্দ্র করে কম্পাস দিয়ে একটা বৃত্ত আঁকতে ব্যস্ত ছিল।

 

“ব্যস হয়ে গেল। এই গোল দাগের মধ্যে এফোর্ডের দশ মাইলের মধ্যে যা-কিছু তা সবই আছে। যে-জায়গাটা আমরা খুঁজছি সেটা মনে হয় এই দাগের কাছাকাছি কোথাও হবে। মিঃ হেদারলি, আপনার ধারণা জায়গাটা এফোর্ড থেকে মাইল-দশেক দূরে হবে?” ব্র্যাডস্ট্রিট বলল।

 

“হ্যাঁ, তা হবে। গাড়িতে করে যেতেই আমাদের প্রায় এক ঘণ্টা লেগেছিল।”

 

“আপনি বলছেন যে আপনি যখন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন তখন তারা আপনাকে তুলে নিয়ে এসেছিল।”

 

“নিশ্চয়ই তারা আমাকে তুলে এনেছিল। তা ছাড়া সেই তন্দ্রার ঘোরে আমার কেমন মনে হচ্ছিল যে আমাকে যেন কারা কোথায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”

 

আমি বললাম, “কিন্তু আমার কাছে যেটা অদ্ভুত ঠেকছে সেটা হল যে বাগানের ভেতর আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েও ওরা আপনাকে না মেরে ছেড়ে দিল কেন? তা হলে কি সেই ভদ্রমহিলার কাকুতিতে গুন্ডাগুলোর মনে দয়া হয়েছিল ?”

 

হেদারলি বলল, “না, আমার কিন্তু তা মনে হয় না। মানুষের চোখমুখের ভাব যে অত নিষ্ঠুর হতে পারে তা আমার ধারণাই ছিল না। ও রকম মুখ আমি আগে কখনও দেখিনি।”

 

হেদারলি চুপ করতেই ব্র্যাডস্ট্রিট বলল, “যাকগে, আর একটু পরেই সব ব্যাপারটার ফয়সালা হয়ে যাবে। এখন এই যে বৃত্তটা টেনেছি এর মধ্যে ঠিক কোথায় যে ওদের সন্ধান পাব সে কথাটা জানতে পারলে ভাল হত।”

 

প্রায় ফিসফিস করে হোমস বলল, “মনে হচ্ছে জায়গাটা আমি দেখিয়ে দিতে পারি।”

 

ব্র্যাডস্ট্রিট বলল, “তাই নাকি? আপনি এরই মধ্যে জেনে গেছেন কোথায় গেলে ওদের হদিস পাওয়া যাবে। আচ্ছা দেখা যাক কার সঙ্গে আপনার মতের মিল হয়। আমি বলছি আমাদের দক্ষিণ দিকে যেতে হবে। মনে হচ্ছে ওই দিকে লোকজনের বিশেষ বসবাস নেই।”

 

হেদারলি বলল, “আমার মনে হয় আমাদের পুব দিকে যেতে হবে।”

 

সাদা পোশাকের পুলিশটি বলল, “আমার মত হচ্ছে পশ্চিম দিকে যাওয়াই ভাল। ও দিকে কয়েকটা গ্রামের মতো রয়েছে।”

 

আমি বললাম, “উত্তর দিকে গেলে ওদের ধরতে পারা যাবে। ও দিকে পাহাড়টাহাড় নেই। হেদারলির কথা থেকে জানতে পেরেছি যে, ওদের কোনও উঁচু-নিচু পথে যেতে হয়নি।”

 

ইন্সপেক্টর ব্র্যাডস্ট্রিট হাসতে হাসতে বলল, “কারও সঙ্গে তো কারও মতের মিল হল না। দেখছি আমরা বৃত্তটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছি। মিঃ হোমস এখন কার দিকে ভোট দিচ্ছেন?”

 

“আপনারা সবাই ভুল করেছেন।”

 

“তা কী করে সম্ভব। আমরা সকলেই কী করে ভুল করতে পারি।”

 

“হ্যাঁ, আপনারা সবাই ভুল করেছেন। জায়গাটা আমি দেখিয়ে দিচ্ছি দেখুন।” হোমস সেই গোল দাগের ঠিক মাঝখানের কেন্দ্রবিন্দুতে তার আঙুল ঠেকাল। “এইখানে আমরা ওদের খোঁজ পাব।”

 

“কিন্তু আমরা যে দশ-বারো মাইল রাস্তা গেলাম সেটা কী ব্যাপার হল ?” বিস্মিত হয়ে হেদারলি প্রশ্ন করল।

 

“খুব সোজা। আপনারা যতটা রাস্তা গিয়েছিলেন ততটা রাস্তাই আবার ফিরে এসেছেন। আপনি বলেছেন যে যখন আপনি গাড়িতে উঠলেন তখন ঘোড়াটা বেশ টগবগ করছিল। আপনি বলুন তো ওই মেঠো পথে দশ-বারো মাইল রাস্তা গাড়ি টেনে আনলে ঘোড়াটা অত তাজা থাকত কি?”

 

হোমসের কথা শুনে ব্র্যাডস্ট্রিট বলল, “হ্যাঁ, এটা অবশ্য খুবই সাধারণ চাল বটে। তবে দলটা যে বেশ সাংঘাতিক সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।”

 

“সে কথা হাজার বার সত্যি। এরা জাল টাকার ফলাও ব্যবসা চালাচ্ছে। আর ওই মেশিনটা দিয়ে কয়েন তৈরি করতে যে ধাতব পদার্থ লাগে তাই বানাত। জানেন বোধহয় এখন রুপো ব্যবহার করা হয় না।”

 

“আপনার অনুমান খাঁটি, মিঃ হোমস। আমরা বেশ কিছু দিন ধরে জাল টাকাপয়সার খবর পাচ্ছি। এরা প্রচুর জাল খুচরো বাজারে ছেড়েছে। আমরা অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছি যে, রেডিংয়ের কাছাকাছিই এদের ঘাঁটি। তবে বহু চেষ্টা করেও এদের আসল ঠিকানাটা জোগাড় করতে পারিনি। এরা যেমন ধূর্ত আর তেমনই হুঁশিয়ার। এদের টিকির সন্ধান পাওয়াই অসম্ভব। যাক, আজ বরাতজোরে সেই অসম্ভব সম্ভব হতে চলেছে। এবার আর বাছাধনদের রেহাই নেই।”

 

কিন্তু অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে, ইন্সপেক্টর ব্যাডস্ট্রিট এ খেপেও ওদের কবজা করতে পারলেন না। এফোর্ড স্টেশনে পা দিতেই আমরা দেখলাম যে কালো পুরু ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে ওপরে উঠছে।

 

ব্র্যাডস্ট্রিট বলল, “কোনও বাড়িতে আগুন লেগেছে?”

 

স্টেশনমাস্টার বললেন, “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।”

 

“বাড়িটা কার?”

 

“ডাক্তার বেচারের।”

 

হঠাৎ হেদারলি বলল, “ডাক্তার বেচার কি জার্মান? তিনি কি খুব রোগা? তাঁর নাক কি খুব খাড়া ?”

 

হেদারলির কথা শুনে স্টেশনমাস্টার হেসে উঠলেন। “না আপনি ভুল করছেন। ডাক্তার বেচার খাঁটি ইংরেজ। আর তার চেহারাও বেশ শাঁসেজলে। তবে লোকে বলে তার বাড়িতে তারই এক রুগি থাকে। সে নাকি বিদেশি, আর তার শরীরও ভাল নয়।”

 

স্টেশনমাস্টারকে আর কোনও কথা বলতে না দিয়ে যে-দিকে আগুন লেগেছিল আমরা সেই দিকে ছুটলাম। রাস্তাটা একটা টিলার ওপরে উঠে গেছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হয়ে দেখলাম একটা প্রকাণ্ড বাড়িতে আগুন লেগেছে। বাড়িটার জানলা-দরজার ফাঁক দিয়ে এখনও আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। সামনের বাগানে তিন-তিনটি বড় বড় দমকল আগুন নেভাবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

 

হেদারলি উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। “এই তো সেই বাড়ি। এই যে সেই নুড়ি-ফেলা রাস্তা। আর ওই যে ঝোপ দেখছেন ওইখানেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।”

 

হোমস বলল, “শেষ পর্যন্ত অবশ্য আপনি ওদের ওপর শোধ নিতে পেরেছেন। হাইড্রলিক প্রেশারে আপনার লণ্ঠনটি যায় ভেঙে। আর তার থেকেই কাঠের দেওয়ালে আগুন ধরে যায়। আর তখন আপনার শত্রুরা আপনাকে ধাওয়া করতেই এত ব্যস্ত ছিল যে, আগুন লাগার ব্যাপারটা তাদের নজর এড়িয়ে যায়। যাক। এখনও এই লোকজনের ভিড়ের মধ্যে ভাল করে নজর করে দেখুন তো যাদের সন্ধান করতে আমরা এখানে এসেছি তাদের কাউকে দেখতে পান কিনা। অবশ্য আমার মনে হচ্ছে তারা অনেকক্ষণ আগেই এখান থেকে সরে পড়েছে।”

 

হোমসের কথাই শেষ পর্যন্ত ঠিক হল। আজ পর্যন্ত সেই দু’জন লোকের বা সেই ভদ্রমহিলার কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। যেটুকু খবর পাওয়া গিয়েছিল তা হল যে সেই দিনই ভোরবেলায় একজন লোক একটা বিরাট বিরাট বাক্স বোঝাই গাড়িতে চেপে কয়েকজন লোককে রেডিংয়ের দিকে যেতে দেখে। ব্যস, সেই শেষ। তারপর বহু চেষ্টা করেও হোমস তাদের সন্ধান করতে পারল না।

 

সন্ধে নাগাদ দমকলের লোকেরা আগুন নিভিয়ে ফেলল। বাড়ির একটা জানলার ফ্রেমে একটা কাটা বুড়োআঙুল দেখে দমকলের লোকেরা তো রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। বাড়িটার ছাদ ধসে পড়ার জন্যে যে যন্ত্রটাকে নিয়ে এত কাণ্ড সেটা একদম টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। পাওয়া গেল শুধু সিলিন্ডার আর লোহার নলের দোমড়ানো কিছু টুকরো আর বাড়ির একটা আউটহাউসে প্রচুর লোহা আর নিকেল। কিন্তু একটাও জাল পয়সা পাওয়া গেল না। বোধহয় সেগুলো ওই গাড়িতে বিরাট বিরাট বাক্সে পুরে সরিয়ে ফেলতে পেরেছিল ওরা। কিন্তু কী ভাবে হেদারলি বাগান থেকে রাস্তার ঝোপে গিয়েছিল সেটা অবশ্য জায়গাটা ভাল করে পরীক্ষা করতেই পরিষ্কার হয়ে গেল। এক জায়গায় মাটিটা একটু নরম ছিল। সেখানে দু’ জোড়া পায়ের ছাপ পাওয়া গেল। এক জোড়া ছাপ বেশ বড় মাপের আর এক জোড়া ছাপ খুবই ছোট। বোঝা গেল সেই ইংরেজটি আর ভদ্রমহিলাই হেদারলিকে বাগান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

 

হেদারলি কাতর স্বরে বলল, “আমার সবটাই লোকসান। কাজ করে পয়সাও পেলাম না আবার বুড়োআঙুলটাও গেল।”

 

হোমস হেসে বলল, “কিন্তু কত বড় অভিজ্ঞতা হল বলুন তো? এই অভিজ্ঞতার জন্যে বাকি জীবন আপনি দারুণ রকম উপভোগ করতে পারবেন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *