এখন একলাটি আমার সেই বোটের জানলার কাছে – চিঠি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শেয়ার করুনঃ

Loading

এখন একলাটি আমার সেই বোটের জানলার কাছে - চিঠি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

 

 

শিলাইদহ,

৯ই ডিসেম্বর।

 

এখন একলাটি আমার সেই বোটের জানলার কাছে অধিষ্ঠিত হয়ে বহুদিন পরেএকটু মনের শান্তি পেয়েছি। স্রোতের অনুকূলে বোট চল্‌চে, তার উপর পাল পেয়েচে— দুপুরবেলাকার রোদ্দুরে শীতের দিনটা ঈষৎ তেতে উঠেছে, পদ্মায় নৌকো নেই—শূন্য বালির চর, হলদে রং, একদিকে নদীর নীল আর একদিকে আকাশের নীলের মাঝে একটি রেখার মত আঁকা রয়েচে — জল কেবল উত্তরে বাতাসে খুব অল্প অল্প চিক্ চিক্ করে কাঁপচে, ঢেউ নেই। আমি এই খোলা জানলার ধারে হেলান দিয়ে বসে আছি ; আমার মাথায় অল্প অল্প বাতাস লাগ্‌চে বেশ আরাম করচে। অনেকদিন তীব্র রোগভোগের পর শরীরটা শিথিল দুর্ব্বল অবস্থায় আছে, এইরকম সময় প্রকৃতির এই ধীর স্নিগ্ধ শুশ্রূষা ভারি মধুর লাগ্‌চে—এই শীতশীর্ণ নদীর মত আমার সমস্ত অস্তিত্ব যেন মৃদু রৌদ্রে পড়ে অলসভাবে ঝিক্ ঝিক্ করচে, এবং যেন অৰ্দ্ধেক আনমনে চিঠি লিখে যাচ্চি। প্রতিবার এই পদ্মার উপর আস্থার আগে ভয় হয় আমার পদ্মা বোধ হয় পুরোনো হয়ে গেছে – কিন্তু যখনি বোট ভাসিয়ে দিই, চারিদিকে জল কুল কুল করে উঠে——চারিদিকে একটা স্পন্দন কম্পন আলোক আকাশ মৃহু কলধ্বনি, একটা সুকোমল নীল বিস্তার, একটি সুনবীন শা শ্যামল রেখা, বর্ণ এবং নৃত্য এবং সঙ্গীত এবং সৌন্দর্য্যের একটি নিত্য উৎসব উদ্ঘাটিত হয়ে যায় তখন আবার নতুন করে আমার হৃদয় যেন অভিভূত হয়ে যায় । এই পৃথিবীটি আমার অনেকদিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালবাসার লোকের মত আমার কাছে চিরকাল নতুন ; আমাদের দুজনকার মধ্যে একটা খুব গভীর এবং সুদূরব্যাপী চেনাশোনা আছে । আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্ব্বে যখন তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্য্যকে বন্দনা করচেন, তখন আমি এই পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলুন। তখন পৃথিবীতে জীবজন্তু কিছুই ছিল না, বৃহৎ সমুদ্র দিনরাত্রি দুলচে, এবং অবোধ মাতার মত আপনার নবজাত ক্ষুদ্র ভূমিকে মাঝে মাঝে উন্মত্ত আলিঙ্গনে একেবারে আবৃত করে ফেল্‌চে—তখন আমি এই পৃথিবীতে আমার সমস্ত সৰ্ব্বাঙ্গ দিয়ে প্রথম সূর্যালোক পান করেছিলুম, নবশিশুর মত একটা অন্ধ জীবনের পুলকে নীলাম্বরতলে আন্দোলিত হয়ে উঠেছিলুম, এই আমার মাটির মাতাকে আমার সমস্ত শিকড়গুলি দিয়ে জড়িয়ে এর স্তন্যরস পান করেছিলুম । একটা মূঢ় আনন্দে আমার ফুল ফুটত এবং নব পল্লব উদ্‌গত হত । যখন ঘনঘটা করে বর্ষার মেঘ উঠত তখন তার ঘনশ্যাম ছায়া আমার সমস্ত পল্লবকে একটি পরিচিত করতলের মত স্পর্শ করত। তার পরেও নব নব যুগে এই পৃথিবীর মাটিতে আমি জন্মেছি। আমরা দুজনে একলা মুখোমুখি করে বসলেই আমাদের সেই বহুকালের পরিচয় যেন অল্পে অল্পে মনে পড়ে। আমার বসুন্ধরা এখন “একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য অঞ্চল” পরে ঐ নদীতীরের শস্যক্ষেত্রে বসে আছেন ; আমি তাঁর পায়ের কাছে কোলের কাছে গিয়ে লুটিয়ে পড়চি—অনেক ছেলের বহুসস্তানবতী মা যেমন অৰ্দ্ধমনস্ক অথচ নিশ্চল সহিষ্ণুভাবে আপন শিশুদের আনাগোনার প্রতি তেমন দৃকপাত করেন না—তেমনি আমার পৃথিবী এই দুপুরবেলায় ঐ আকাশপ্রান্তের দিকে চেয়ে বহু আদিমকালের কথা ভাবচেন আমার দিকে তেমন লক্ষ্য করচেন না, আর আমি কেবল অবিশ্রাম বকে যাচ্চি। এইভাবে একরকম কেটে যাচ্চে। প্রায় বিকেল হয়ে এল। এখন শীতের বেলা কি না, দেখতে দেখতে রোদ্দুর পড়ে যায় ।

 

0
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

বিদ্যাকল্পে গল্প ও অডিও স্টোরি প্রকাশ করার জন্য আজই যুক্ত হন