আজ সমস্তদিন নদীর উপর ভেসে চলেছি – ছিন্নপত্র – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গোয়ালন্দের পথে,
২১ শে জুন,
১৮৯২,
আজ সমস্তদিন নদীর উপর ভেসে চলেছি। আশ্চর্য এই বোধ হচ্চে যে, কতবার এই রাস্তা দিয়ে গেছি এই বোটে চড়ে জলে জলে বেড়িয়েছি এবং নদীর দুইতীরের মাঝখান দিয়ে ভেসে যাবার যে একটা বিশেষ আনন্দ আছে সে উপভোগ করেছি কিন্তু দিনদুই ডাঙায় বসে থাকলে সেটা ঠিকটা আর মনে থাকে না। এইযে একলাটি চুপকরে বসে চেয়ে থাকা—দুইধারে গ্রাম ঘাট শস্যক্ষেত্র চর, বিচিত্র ছবি দেখা দিচ্চে এবং চলে যাচ্চে, আকাশে মেঘ ভাস্চে এবং সন্ধ্যের সময় নানারকম রং ফুছে ;— নৌকো চলেছে, জেলেরা মাছধরচে, অহর্নিশি জলের একপ্রকার আদরপরিপূর্ণ তরল শব্দ শোনা যাচ্চে—সন্ধেবেলায় বিস্তৃত জলরাশি শ্রান্ত নিদ্রিত শিশুর মত একেবারে স্থির হয়ে যাচ্চে এবং উন্মুক্ত আকাশের সমস্ত তারা মাথার উপরে জেগে চেয়ে আছে— গভীররাত্রে যেদিন ঘুম নেই সেদিন উঠে বসে দেখি অন্ধকারাচ্ছন্ন দুই কুল নিদ্রিত, মাঝে মাঝে কেবল গ্রামের বনে শৃগাল ডাক্চে, এবং পদ্মার নীরব খরস্রোতে ঝুপ্ঝাপ করে পাড় খসে খসে পড়ছে—এই সমস্ত পরিবর্তনশীল ছবি যেমন যেমন চখে পড়তে থাকে অমনি মনের ভিতরে একটা কল্পনার স্রোত বইতে থাকে এবং তার দুইপারে তটদৃশ্যের মত নব নব আকাঙ্ক্ষার চিত্র দেখা দিতে থাকে। হয়ত সম্মুখের দৃশ্যটা খুব একটা চমৎকার কিছু নয়—একটা হল্দে রকমের তৃণতরুশূন্য বালির চর ধু ধু করচে—তারি গায়ে একটা জনশূন্য নৌকো বাঁধা রয়েছে এবং আকাশের ছায়ায় ফিকে নীলবর্ণ নদী বয়ে চলে যাচ্চে—দেখে মনের ভিতরে কি রকম করে বলতে পারিনে । বোধ হয় সেই ছেলেবেলায় যখন আরব্য উপন্যাস পড়তুম, সিন্ধবাদ নানা নূতন দেশে বাণিজ্য করতে বাহির হত, ভৃত্যশাসিত আমি তোষাখানার মধ্যে রুদ্ধ হয়ে বসে বসে দুপুর বেলায় সিন্ধবাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতুম তখন যে আকাঙ্ক্ষাটা মনের মধ্যে জন্মেছিল সেটা যেন এখনো বেঁচে আছে, ঐ বালিচরে নৌকো বাঁধা দেখ্লে সেই যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে । ছেলেবেলায় যদি আরব্য উপন্যাস রবিনসন ক্রুসো না পড়তুম, রূপকথা না শুতুম, তাহলে নিশ্চয় বলতে পারি ঐ নদীতীর এবং মাঠের প্রান্তের দূর দৃশ্য দেখে ঠিক এমনভাব মনে উদয় হত না— সমস্ত পৃথিবীর চেহারা আমার পক্ষে আর এক রকম হয়ে যেত । এইটুকু মানুষের মনের ভিতরে বাস্তবিক কাল্পনিকে জড়িয়ে মড়িয়ে কি যে একটা জাল পাকিয়ে আছে ! কিসের সঙ্গে যে কি গেঁথে গেছে—কত গল্পের সঙ্গে ছবির সঙ্গে ঘটনার সঙ্গে সামান্যের সঙ্গে বড়র সঙ্গে জড়িয়ে গিঁঠপড়ে আছে— প্রতিদিন অজ্ঞাতে জড়িয়ে যাচ্ছে! একটা মানুষের একটা বৃহৎ জীবনের জাল খুলতে পারলে কত ছোট এবং কত বড়র মিশল আলাদা করা যায় !