চরম সংঘর্ষ (শার্লক হোমস) – আর্থার কোনান ডয়েল
আমার মন খুব খারাপ হয়ে আছে। তবুও যে আজ জোর করে কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি, তার কারণ আমার বন্ধু শার্লক হোমসের অসাধারণ ক্ষমতার শেষ কাহিনীটি আপনাদের সকলকে শোনাব বলে। শার্লক হোমসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় হঠাৎই। সেই প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে আর নৌবাহিনীর নথি চুরির ঘটনা পর্যন্ত, যে-সব তদন্তের সময়ে আমি হোমসের সঙ্গে ছিলাম, সেগুলোর কথা আমি আপনাদের শুনিয়েছি। জানি সেগুলো আরও ভাল করে লেখা যেতে পারত। আমি আমার মতো করে লিখেছি। আমি ভেবেছিলাম যে, নৌবাহিনীর নথি চুরির ঘটনাটা, যে-রহস্যের সমাধান না করতে পারলে একটা সাংঘাতিক রকমের আন্তর্জাতিক জটিলতার সৃষ্টি হত, দিয়েই আমার লেখকজীবনের ইতি ঘটাব। ওই তদন্তের পর যা ঘটেছে তা কোনও দিন লিখব না। গত দু’বছর ধরে আমার জীবনে যে-শূন্যতা নেমে এসেছে সে কথা প্রকাশ করব না। কিন্তু বিশেষ একটা কারণে নিজেকে দেওয়া কথা ভাঙতে হল। কারণ, একটা চিঠি। চিঠিটা লিখেছেন কর্নেল জেমস মরিয়ার্টি। চিঠিতে তিনি তার ভাইয়ের হয়ে খুব সাফাই গেয়েছেন। প্রকৃত ঘটনা যা ঘটেছে, তা একমাত্র আমিই জানি। আর এখন আমি বুঝতে পেরেছি যে, সত্যকে চেপে রেখে কখনও লাভ হয় না। আমি যতদূর জানি, তাতে ওই ঘটনার কথা মাত্র কয়েক জায়গায় বেরিয়েছে। খবরটা প্রথম বার হয় জেনিভা জার্নালে। তারিখটা ৬ মে, ১৮৯১। তার পরের দিন, মানে ৭ মে, রয়টারের পুরনো একটা খবর সমস্ত ইংরেজি দৈনিকে বেরিয়েছিল। আর সম্প্রতি বেরিয়েছে এই চিঠিটা। প্রথম দুটোই খুব ছোট্ট খবর। কিন্তু যে চিঠিটার কথা বলেছি সেটা বেশ বড়, তবে সেটা ভুল আর মিথ্যে খবরে ভরা। প্রফেসর মরিয়ার্টি আর শার্লক হোমসের মধ্যে ঠিক কী ঘটেছিল, সেকথা একমাত্র আমিই জানি।
আমার বিয়ের পর, বিশেষ করে যখন আমি ডাক্তারি প্র্যাকটিস করতে শুরু করলাম, সেই সময় থেকে শার্লক হোমসের সঙ্গে আমার দেখাশোনা আগের মতো অত বেশি হত না। হোমস যখনই কোনও তদন্ত হাতে নিত, তখনই সে আমার কাছে চলে আসত। শেষের দিকে হোমস তদন্তের ব্যাপারেও আমার কাছে আসা কমিয়ে দিল। ডায়েরির পাতা উলটে দেখছি যে, ১৮৯০ সালে মাত্র তিনটি কেসের কথা লেখা আছে। ১৮৯০ সালের শেষের দিকে, আর ১৮৯১ সালের শেষকাল পর্যন্ত হোমস ফরাসি সরকারের হয়ে খুব গোপনীয় একটা কাজ করেছে। এ খবরটা আমি দৈনিক পত্রিকা পড়ে জেনেছিলাম। এরপর আমি হোমসের কাছ থেকে দুটো চিঠি পাই। একটা নরবোন থেকে লেখা। আর একটা নিমে থেকে লেখা। হোমসের চিঠি পড়ে আমি বুঝেছিলাম যে, ওকে এখন আরও কিছু দিন ফ্রান্সে থাকতে হবে। তাই ২৪ এপ্রিল সন্ধেবেলায় হঠাৎ যখন হোমস আমার চেম্বারে এসে হাজির হল, তখন আমি তো অবাক। লক্ষ করলাম যে, হোমস আরও রোগা হয়েছে। গায়ের রংও ময়লা হয়ে গেছে।
আমার চাউনি থেকে হোমস বোধহয় বুঝতে পেরেছিল, আমি কী বলতে চাইছি। তাই বলল, “হ্যাঁ, কিছু দিন খুব ধকল যাচ্ছে বলে শরীরটা কাহিল দেখাচ্ছে। কাজের চাপও পড়েছে সাংঘাতিক।… আমি যদি ওই জানলাটা বন্ধ করে দিই তোমার অসুবিধে হবে কি?”
ঘরের মধ্যে শুধু একটা টেবিলল্যাম্প জ্বলছিল। সেটা টেবিলের ওপরে রাখা ছিল। হোমস আসবার আগে আমি একটা বই পড়ছিলাম। হোমস সাবধানে পা টিপে টিপে দেওয়াল ঘেঁষে এগিয়ে গেল। জানলাটা বন্ধ করে ছিটকিনি শক্ত করে লাগিয়ে দিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কি ভয় করছে?”
“হ্যাঁ, করছে।”
“কীসের ভয়?”
“এয়ারগানের।”
“হোমস, তুমি কী বলছ?”
“ওয়াটসন, আমার ধারণা তুমি আমাকে ভাল করেই চেনো। তুমি জানো যে, আমি ভিতু স্বভাবের লোক নই। তবে এটাও ঠিক, বিপদের আঁচ পেয়ে তো সাবধান না হওয়াটা সাহসের অভাবের নয়, বোকামির পরিচয়। দেশলাইটা দাও তো।” সিগারেট ধরিয়ে হোমস এমন একটা লম্বা টান লাগাল যে, মনে হল ধূমপান করে সে একটু ধাতস্থ হল।
“এত রাত্রে এসে তোমাকে বিব্রত করছি ভেবে আমার খুব খারাপ লাগছে। ভাল কথা, আমি কিন্তু যাবার সময় তোমার সদর দরজা দিয়ে বেরোব না। তোমার বাড়ির পিছনে যে বাগান আছে, সেই বাগানের পাঁচিল টপকে বেরিয়ে যাব,” হোমস বলল।
“এ সবের মানে কী, হোমস?” আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
হোমস তার হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। টেবিলল্যাম্পের আলোয় দেখলাম যে, ওর আঙুলের দুটো গাঁটে ভীষণ আঘাত লেগেছে। গভীর ক্ষত হয়ে সেখান থেকে রক্ত পড়ছে।
একটু হেসে হোমস বলল, “দেখছ তো আমি মিথ্যে ভয় পাইনি। সমস্ত ব্যাপারটা এমনই নিদারুণ সত্যি যে, একজনের হাতই ভেঙে যাবার জোগাড়। মিসেস ওয়াটসন কি ভেতরে?”
না, কয়েক দিনের জন্যে বেড়াতে গেছে।”
‘তাই নাকি! তা হলে তো তুমি একলাই রয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“তা হলে আমার পক্ষে সুবিধেই হল। আমি তোমাকে সপ্তাহখানেকের জন্যে আমার সঙ্গে কন্টিনেটে বেড়াতে যেতে বলব ভেবেছিলাম।”
“কোথায় যাবে?”
“যে-কোনও জায়গাতেই যেতে পারি। আমার কাছে সব জায়গাই সমান।”
হোমসের এই কথাগুলো আমার কানে খুব অদ্ভুত ঠেকল। এসব আবার কেমন ধরনের কথা। অকারণে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার লোক তো হোমস নয়। হোমসের চেহারা দেখে, আর তার কথাবার্তা শুনে আমার মনে হল, যে-কারণেই হোক সে মনে মনে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। আমার মনের কথা বোধহয় আমার মুখ দেখেই সে টের পেয়েছিল। হাতদুটো জোড় করে হাঁটুর ওপর কনুই রেখে সব ব্যাপারটা খুলে বলল।
হোমস বলল, “তুমি বোধহয় প্রফেসর মরিয়ার্টির নাম শোনোনি?”
‘না তো।”
“হ্যাঁ। ওটাই হচ্ছে লোকটার বাহাদুরি। সমস্ত লন্ডন শহর জুড়ে লোকটা রয়েছে, অথচ আশ্চর্যের কথা ওর সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না। আর, এই জন্যে লোকটা সমস্ত অপরাধ আর অপরাধীদের মাথায় উঠে বসে আছে। ওয়াটসন তোমাকে আমার মনের কথা খুলে বলছি। আমি যদি ওই লোকটাকে ধরতে পারি, যদি আমাদের সমাজকে ওই লোকটার হাত থেকে বাঁচাতে পারি, তবে জানব যে, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমি চুপচাপ বসে থাকব। তোমাকে বলছি যে, হালফিল স্ক্যান্ডিনেভিয়ার রাজবাড়ির আর ফরাসি সরকারের হয়ে যে-তদন্ত করলাম, তার দরুন আমি যে টাকা পেয়েছি তাতে বাকি জীবনটা পায়ের ওপর পা তুলে বসে বসে কাটিয়ে দিতে পারব। তুমি তো জানো, চুপচাপ বসে রসায়নশাস্ত্রের আলোচনা করাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ। কিন্তু ওয়াটসন, আমি তো বিশ্রাম নিতে পারছি না। প্রফেসর মরিয়ার্টি বহাল তবিয়তে লন্ডন শহরের রাস্তায় বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে এ কথা জেনে আমি তো আমার ঘরের কোণে চুপ করে বসে থাকতে পারব না।”
“এই মরিয়ার্টি লোকটা কী করেছে?” আমি জানতে চাইলাম।
“লোকটার জীবন খুব অদ্ভুত। ভাল বংশের ছেলে। লেখাপড়াতেও খুব ভাল। বিশেষ করে গণিতশাস্ত্রে লোকটির অদ্ভুত ব্যুৎপত্তি। মাত্র একুশ বছর বয়সে ও বাইনোমিয়াল থিয়োরেমের ওপর একটা অসামান্য প্রবন্ধ লিখেছিল। প্রবন্ধটা শুধু ইংল্যান্ডে নয়, ইউরোপের সব জায়গায় খুব প্রশংসা পেয়েছে। এই প্রবন্ধের সুবাদেই ওকে একটা ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের প্রধান অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত করা হয়। সকলেই ভেবেছিল যে, মরিয়ার্টি ভবিষ্যতে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ হয়ে উঠবে। কিন্তু ওর রক্তে একটা শয়তানির ধারা আছে। এটা ওর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। লেখাপড়া শিখে ওর বজ্জাতি তো কমলই না, উলটে আরও বেড়ে গেল। বুদ্ধিমান লোক যদি খারাপ হয় তো সে যে কতদূর খারাপ হতে পারে, তা কল্পনা করা যায় না। ওর সম্বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নানান খারাপ কথাবার্তা রটতে লাগল। শেষকালে এমন হল যে, ও চাকরি ছাড়তে বাধ্য হল। চাকরি ছেড়ে লন্ডনে চলে এল। লন্ডনে এসে ও একটা মিলিটারিদের জন্যে ইস্কুল খুলল। ওর সম্বন্ধে এই খবর সকলেই জানে। এরপর তোমাকে যা বলব সে খবর একমাত্র আমিই জানি।।
“ওয়াটসন, তুমি তো জানো যে লন্ডনের দাগি আসামিদের সম্পর্কে আমি যত খবর রাখি, তত খবর আর কেউ রাখে না। কিছু দিন ধরে আমার মনে হচ্ছিল যে, লন্ডন শহরে যে-সব অপরাধের ঘটনা ঘটছে, তার পেছনে কোনও একজন আছে। কেউ যেন পেছন থেকে সবকিছুকে চালাচ্ছে। আইনের শাসনকে কলা দেখিয়ে একটার পর একটা অপরাধকর্ম করাচ্ছে। যদি বা কোনও অপরাধী ধরাও পড়ে তো তাকে কোনও-না-কোনও ভাবে ছাড়িয়ে আনে। একটা নয়, দুটো নয়, অনেকগুলো কেস—সে জালিয়াতির মামলাই হোক, চুরি-ডাকাতি কিংবা খুনের ব্যাপারই হোক, দেখে আমার এই ধারণাই হয়েছে। যদিও এই সব রহস্যের তদন্ত করতে আমার ডাক পড়েনি, তবুও এই কেসগুলোর সম্বন্ধে আমি অনেক ভেবেছি। আর তার থেকে আমার এই ধারণা জন্মেছে। তারপর থেকেই এই রহস্যের জাল ভেদ করার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করতে করতে একটা সূত্র আমার হাতে এল। সেই সূত্র ধরে আস্তে আস্তে গোলকধাঁধার মতো জটিল আঁকাবাঁকা পথ ঘুরে শেষকালে আমি রহস্যের মূলে পৌঁছোতে পারলাম। দেখলাম যে, সবকিছুর মূলে রয়েছে গণিতের বিখ্যাত পণ্ডিত প্রফেসর মরিয়ার্টি।
“ওয়াটসন, লোকটা অপরাধ জগতের নেপোলিয়ন। চার পাশে যে-সব দুষ্কর্ম ঘটছে, তার বেশির ভাগের মূলে আছে ও। আর এই শহরে যে-সব অপরাধের ফয়সালা পুলিশ করতে পারেনি, তার সবগুলোর পেছনেই আছে ওই মরিয়ার্টি। লোকটা আসলে একটা জিনিয়াস। খুব উঁচু দরের দার্শনিক। ওর চিন্তাশক্তি আর বিশ্লেষণ ক্ষমতাও অসাধারণ। লোকটা মাকড়সার মতো। চুপচাপ বসে থাকে আর বিচিত্র নকশায় জাল বুনে যায়। সে জাল যে কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে, তা কল্পনা করতে পারবে না। তবে এই জালের কোনও একটা সুতোয় সামান্যতম টান পড়লেই ও বুঝতে পারে। বসে বসে মতলব ভঁজা ছাড়া কোনও কাজই ও নিজের হাতে করে না। ওর একটা বিরাট দল আছে। আর তারা কাজ করে ছকমাফিক। যে-কোনও কুকর্ম করতে হলে, যেমন কাউকে খুন করতে হলে, কোনও বাড়ি থেকে কোনও দামি কাগজপত্র সরাতে হলে, স্রেফ খবরটা মরিয়ার্টির কাছে পৌঁছে দিলেই হবে। সেই কাজের একটা ছক তৈরি হবে, আর তার পরই কাজটা হয়ে যাবে। যে-লোকটি এ কাজ করবে, সে যদি কোনও কারণে ধরা পড়ে যায় তার জামিনের জন্যে টাকার ব্যবস্থা হবে। আদালতে তার হয়ে সওয়াল করবার জন্যে আইনজীবী এসে যাবে। কিন্তু যে-লোকটি পরদার আড়ালে থেকে এ সব করবে, তাকে কেউ ছুঁতে পারবে না। এ রকম যে একজন আছে, সে কথাও কেউ চট করে বিশ্বাস করবে না। আমি যখন স্থির নিশ্চিত হলাম যে, এ রকম একটা সংগঠন রয়েছে, তখন থেকে এই সংগঠনকে ধ্বংস করতে, আর এই সংগঠনের নেতাকে ধরবার জন্যে উঠে পড়ে লাগলাম।
“কিন্তু মরিয়ার্টি তার চার পাশে আত্মরক্ষার এমন এক বেড়াজাল বিছিয়ে রেখেছে যে, বহু চেষ্টা করার পর আমার মনে হতে লাগল, ওর বিরুদ্ধে বোধহয় এমন কোনও প্রমাণ জোগাড় করতে পারব না, যা আদালতের সামনে পেশ করে বলা যাবে, লোকটা একজন কুখ্যাত অপরাধী। ওয়াটসন, আমি কী ভাবে কাজ করি তা তো তুমি জানো। কিন্তু তিন তিন মাস অবিরাম চেষ্টা করবার পর আমার মনে হল যে এত দিনে বোধহয় এমন একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা পেলাম যে, বুদ্ধিতে আমার সমান সমান। ওর কুকর্মের জন্যে আমার মরিয়ার্টির সম্বন্ধে যে-খারাপ ধারণা ছিল, সেটা বদলে গেল। আমি ওকে তারিফ করতে লাগলাম। এই রকম যখন অবস্থা, তখন ও একটা ভুল করে বসল। ছোট্ট ভুল। আর আমি যখন ওর পেছনে লেগে রয়েছি, তখন সেই ধরনের ভুল করা ওর উচিত হয়নি। সেই ছোট্ট ভুলটাই বিরাট চেহারা নিল। এত দিন ধরে যে-সুযোগ খুঁজছিলাম তা মিলে গেল। সেই ভুলের সূত্র ধরে আমি মরিয়ার্টির চার পাশে আমার জাল ছড়াতে লাগলাম। এইবার শুরু হয়েছে আমার জাল গোটাবার পালা। আর দিনতিনেক পরে, মানে ধরো সামনের সোমবার, সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে যাবে। দলবলসমেত প্রফেসর মরিয়ার্টিকে পুলিশ ধরে ফেলবে। আর তারপর শুরু হবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে, যাকে বলে রোমহর্ষক বিচার। কম করে চল্লিশটা রহস্যের সমাধান হবে। ওদের সকলেরই ফাঁসি হবে। কিন্তু আমরা যদি সামান্যতম তাড়াহুড়োও করি তা হলে ওরা জাল কেটে বেরিয়ে যাবে। ওদের টিকিটি পর্যন্ত ছোঁয়া যাবে না। ঘাটে এসে তরী ডুববে।
“কথা হচ্ছে যে, আমি যা করেছি তা যদি মরিয়ার্টি আঁচ করতে না পারত, তো সবই ঠিকঠাক চলত। কিন্তু মরিয়ার্টিও অসাধারণ বুদ্ধিমান লোক। ওকে ফাঁদে ফেলবার জন্যে আমি যা যা করেছি, তা সবই ও জানতে পেরেছে। ও বার বার চেষ্টা করেছে, যাতে আমার পাতা ফাঁদ থেকে ও কেটে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক বারই আমি ওর থেকে এক ধাপ এগিয়ে থেকেছি বলে ওর সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ওয়াটসন, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। মরিয়ার্টিকে ধরবার জন্যে আমি যে-সব ফন্দি এঁটেছি, আর আমার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে ও যা যা করেছে, তার যদি খুঁটিনাটি বিবরণ লেখা যায় তো সেটা গোয়েন্দাগিরির ইতিহাসে একটা সাত নয়, তিন সাতে একুশ কাণ্ড রামায়ণ হবে। এর আগে কাউকে ধরবার জন্যে আমাকে এত পরিশ্রম কখনও করতে হয়নি। ও যদি যায় ডালে ডালে, তো আমি যাই পাতায় পাতায়। আজ সকালে সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছি। মরিয়ার্টিকে ধরবার জন্যে আর মাত্র তিনটি দিন আমার দরকার। সকালবেলা আমার ঘরে বসে সমস্ত ব্যাপারটা মনে মনে আলোচনা করছিলাম, এমন সময় আমার ঘরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল মরিয়ার্টি স্বয়ং।
“তুমি তো জানো ওয়াটসন, যে আমি খুব কড়া ধাতের মানুষ। কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা নেই মরিয়ার্টিকে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, আমি বেশ বড় রকমের একটা ধাক্কা খেলাম। যে-লোকটিকে ধরবার জন্যে আমি দিনরাত্তির মতলব ভাঁজছি, সে কী না সশরীরে আমারই বসবার ঘরের দরজায় এসে হাজির। মরিয়ার্টিকে চিনতে আমার ভুল হয়নি। ওর চেহারা আমার খুবই চেনা। লোকটা যেমন লম্বা, তেমনই রোগা। ওর ধবধবে ফরসা চওড়া কপাল গোল হয়ে মাথার খুলির সঙ্গে মিশে গেছে। চোখদুটো বসা। মনে হয় যেন দুটো গর্ত। রোগা, শুকনো দাড়ি-গোঁফ কামানো মুখ, দেখলেই মনে হয় যেন পণ্ডিত-অধ্যাপক। অতিরিক্ত পড়াশোনা করার দরুন ওর কাঁধদুটো ঝুলে পড়েছে। গলা আর মুখ সর্বদাই সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে। আর অধ্যাপনা করেছে বলেই ওর মাথা সব সময়েই ডান দিকে বাঁ দিকে ঘুরে যায়। দেখলেই মনে হয়, যেন একটা অতিকায় সরীসৃপ চার পাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। মরিয়ার্টি খুব আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।”
একটু চুপ করে থেকে হোমস শুরু করল, “বেশ কিছুক্ষণ পরে ও নিজেই কথা বলতে শুরু করল। ‘আপনার করোটির ওপর দিকটায় যত বৃদ্ধি হওয়া উচিত ছিল ততটা হয়নি দেখছি। ড্রেসিং গাউনের পকেটের মধ্যে গুলি-ভরতি রিভলভারের ট্রিগার নিয়ে নাড়াচাড়ার পরিণাম কিন্তু সাংঘাতিক হতে পারে।’
“মরিয়ার্টি দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার বিপদ হতে পারে। মরিয়ার্টির বাঁচবার একমাত্র রাস্তা হল, আমাকে চির দিনের জন্যে চুপ করিয়ে দেওয়া। তাই চকিতের মধ্যে ড্রয়ার থেকে রিভলভারটা বের করে ড্রেসিং গাউনের পকেটে পুরে ফেলি। জামার তলায় রিভলভারটা আমি ওর দিকে তাক করে রেখেছিলাম। মরিয়ার্টি চোখ পিটপিট করে হাসছিল। কিন্তু ওর চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা দেখে আমার মনে হল, রিভলভারটা টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছি।
“আপনি মনে হচ্ছে আমাকে চেনেন না,’ ও বলল।
“আমি বললাম, ‘ঠিক তার উলটো। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, আপনাকে আমি বেশ ভাল রকমই চিনি। অনুগ্রহ করে বসুন। আমি আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দিতে পারি। আপনার যদি কিছু বলবার থাকে তো আপনি তা বলতে পারেন।’
“আমি আপনাকে কী কথা বলতে চাই সেটা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পেরেছেন,’ মরিয়ার্টি বলল।
‘“তা হলে আমার উত্তরটাও আপনি নিশ্চয় অনুমান করতে পেরেছেন,’ আমি বললাম।
‘“আপনার মত পালটাবে না?
‘“কোনওমতেই নয়।’
“মরিয়ার্টি ফস করে পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে আমি টেবিল থেকে রিভলভারটা তুলে নিলাম। ও কিন্তু পকেট থেকে একটা ছোট সাইজের নোটবই বের করল। মনে হল নোটবইটায় কিছু সাল তারিখ লেখা আছে।
‘“চৌঠা জানুয়ারি আপনি আমার এলাকায় ঢুকে পড়েন,’ ও বলল।
‘“তেইশে জানুয়ারি আপনি আমার কাজে বাধা দেন। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি আপনার জন্যে আমি রীতিমতো বেকায়দায় পড়ে যাই। এতে আমার খুবই অসুবিধে হয়েছিল। মার্চ মাসের শেষে আপনার জন্যে আমার একটা মতলব একদম ভেস্তে যায়। আর আপনার এই নাকগলানো স্বভাবের জন্যে এপ্রিল মাসে আমার এমন অবস্থা হয়েছে যে, আমার স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়ানোই দায় হয়ে উঠেছে। আমাকে হয়তো হাজতবাস করতে হতে পারে। এই অবস্থা তো আমি বরদাস্ত করতে পারি না।’
“আমি বললাম, ‘তা এ ব্যাপারে আপনার কি কোনও প্রস্তাব আছে?’
“মাথা নাড়তে নাড়তে মরিয়ার্টি উত্তর দিল, ‘মিঃ হোমস, এ ব্যাপারটা নিয়ে আপনি আর মাথা ঘামাবেন না। ব্যাপারটা ছেড়ে দিন, মানে আপনাকে ছেড়ে দিতেই হবে।’
‘“ছেড়ে দেব, তবে সোমবারের পর।‘
“মরিয়ার্টি মুখ দিয়ে চক চক শব্দ করে উঠল। তারপর বলল, ‘এই ব্যাপারের ফল শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে তা আপনার মতো বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে বোঝা তো শক্ত নয়। ফল একটাই। আর সেই জন্যেই আপনার সরে দাঁড়ানো দরকার। আপনি এমন সব কাজ করেছেন যে, যার জন্যে আমার সামনে একটা রাস্তাই খোলা আছে। সত্যি কথা বলতে কী, যে ভাবে আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রচণ্ড রকম মানসিক পরিশ্রম করেছেন দূর থেকে বসে, তা আমি সত্যি সত্যিই তারিফ করছি। বিশ্বাস করুন, আপনার সম্পর্কে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হলে আমি আন্তরিক ভাবেই দুঃখিত হব। আপনি হাসছেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন এটা আমার মনের কথা।’
“আমি বললাম, ‘আমার জীবিকা যা, তাতে বিপদ যে-কোনও সময়েই ঘটতে পারে।’
‘“এটা তো বিপদ নয়,’ মরিয়ার্টি বলল, ‘এ নিশ্চিত ধ্বংস। আপনি তো কোনও এক ব্যক্তির পথের কাঁটা নন, আপনি একটি প্রতিষ্ঠানের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আর সে প্রতিষ্ঠান যে কত বড়, কী ভীষণ শক্তিশালী, তা আপনার মতো বুদ্ধিমান লোকের পক্ষেও বোঝা অসম্ভব। না, মিঃ হোমস, আপনি সরে দাঁড়ান। তা না হলে কিন্তু আপনি পায়ের চাপে গুঁড়িয়ে যাবেন।’
“আমি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালই লাগছিল, কিন্তু আমার অন্য জায়গায় একটা বিশেষ দরকারি কাজ রয়েছে। সেখানে না গেলে কাজে অবহেলা করা হবে।’
“মরিয়ার্টিও চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে কোনও কথা না বলে সে খুব দুঃখিত ভাবে মাথা নাড়তে লাগল।
“শেষকালে বলল, ‘কী আর করা যাবে। খুবই দুঃখের ব্যাপার। তবে আমার দিক থেকে যা করবার তা আমি করেছি। আপনি যে-প্ল্যান ছকেছেন তার সবই আমি জানি। এও জানি যে, সোমবারের আগে আপনি কিছুই করতে পারবেন না। আপনি ভাবছেন যে, আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। আমি কখনওই কাঠগড়ায় দাঁড়াব না। আপনি আমাকে বুদ্ধির খেলায় হারাতে চান। আমি বলছি আপনি আমাকে হারাতে পারবেন না। আপনার যদি আমাকে শেষ করে দেবার মতো বুদ্ধি থাকে তো এটা ভুলবেন না যে, আমিও আপনাকে শেষ করে দেব।’
“আমি বললাম, ‘মিঃ মরিয়ার্টি, আপনি আমাকে অনেক কথা বলেছেন। আমি আপনাকে একটা কথাই বলতে চাই। আমি যদি নিশ্চিত হই যে, আমার মৃত্যুর বদলে আপনার মৃত্যু হবে, তবে বিশ্বাস করুন, সাধারণের কথা ভেবে আপনার এই প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে যাব।”
“রাগে গরগর করতে করতে মরিয়ার্টি বলল, ‘আমার মৃত্যুর কথা বলতে পারি না, তবে আপনার দিন যে ফুরিয়ে এসেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’
“আর কোনও কথা না বলে চোখ পিটপিট করতে করতে মরিয়ার্টি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
“মরিয়ার্টির সঙ্গে এই আমার অদ্ভুত সাক্ষাৎকার। তোমাকে বলতে বাধা নেই, এই ঘটনাটার পর থেকে আমার মন খুব চঞ্চল হয়ে আছে। মরিয়ার্টি খুব আস্তে আস্তে ভেবে চিন্তে কথা বলে। ওর কথা শুনলে মনে হয় যে, ও মনের কথা বলছে। কোনও রকম অহংকার বা গায়ের জোর ফলানোর চেষ্টা নেই। ওর কথাবার্তা সাধারণ খুনে-গুন্ডাদের মতো নয়। তুমি অবশ্য বলবে যে, আমি মরিয়ার্টির কথা পুলিশকে জানাচ্ছি না কেন। তার কারণ, আমার স্থির বিশ্বাস আঘাতটা আসবে তার দলের লোকেদের মারফত। আর আমার ধারণা যে ভুল নয়, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি হাতেনাতে।”
“তোমার ওপর ইতিমধ্যেই আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে?”
“ওয়াটসন, মরিয়ার্টি এমন একজন লোক, যে একটি মুহূর্তও বাজে খরচ করে না। দুপুরের দিকে আমি একটা কাজ সারতে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে গিয়ে ছিলাম। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট যেখানে ওয়েলবেক স্ট্রিটের সঙ্গে মিশেছে সেই মোড়ের মাথায় একটা দু’ঘোড়ায় টানা গাড়ি আচমকা হুড়মুড় করে আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়ছে দেখে, আমি তড়াক করে ফুটপাতে উঠে পড়ে কোনও রকমে বেঁচে গেছি। আর একটু দেরি হলে চাপা পড়ে যেতাম। গাড়িটা মেরিলিবোন লেন থেকে বেরিয়ে চোখের পলকের মধ্যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল। এরপর আমি ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। ভেরে স্ট্রিট ধরে হাঁটছি, এমন সময় একটা বাড়ির ওপর থেকে আস্ত একটা ইট খসে পড়ল। ইটটা আমার পায়ের কাছে পড়ে গুঁড়িয়ে গেল। আমি পুলিশ ডেকে বাড়িটা পরীক্ষা করালাম। বাড়িটায় মিস্ত্রি লাগবে বলে বাড়ির ওপর তলায় টালি আর ইট জড়ো করে রাখা হয়েছে। পুলিশ আমাকে বোঝাতে চাইছিল যে, হঠাৎ হাওয়ায় একটা ইট খসে পড়ে গেছে। কিন্তু আসল কথাটা যে কী, তা তো আমি জানি। মুশকিল হল এই, আমার হাতে কোনও প্রমাণ নেই। আমি একটা গাড়ি ধরে আমার দাদার ওখানে চলে গেলাম। সেখানেই আমি সারা দুপুরটা কাটালাম। দাদার ওখান থেকে তোমার কাছে আসছি. আসবার সময় রাস্তায় লাঠিধারী এক গুন্ডা আমায় তাড়া করেছিল। লোকটাকে পাকড়াও করে আমি পুলিশের জিম্মায় দিয়ে দিয়েছি। তবে একটা কথা খুব জোর দিয়েই তোমাকে বলতে পারি। আমি ঘুসি মেরে যে লোকটার সামনের দাঁতগুলো ভেঙে দিয়েছি তার সঙ্গে এই গণিত-বিশেষজ্ঞের কোনও রকম যোগাযোগের কথা পুলিশ কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবে না। দেখোগে যাও, তিনি এখন মাইল-দশেক দূরে কোথাও চুপচাপ বসে ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর সব জটিল সমস্যার সমাধান করছেন। এখন বুঝতে পারছ। তো ওয়াটসন, কেন আমি তোমার ঘরে ঢুকেই জানালাগুলো বন্ধ করে দিতে চেয়েছি। আর কেনই বা আমি চলে যাবার সময় সামনের দরজা দিয়ে না বেরিয়ে বাগানের পাঁচিল টপকে পেছন দিয়ে চলে যেতে চাইছি।”
হোমসের সাহসকে আমি মনে মনে তারিফ করেছি। কিন্তু আজ যখন হোমস একটার পর একটা ঘটনা, যা আজ সারা দিন ঘটে গেছে, তার কথা বলছিল তখন আমি একদম হতবাক। কী অদ্ভুত মনের জোর, আর কী আশ্চর্য সাহস ওর!
আমি বললাম, “আজকের রাতটা তুমি এখানেই থেকে যাবে তো?”
“না হে, না। আমি তোমার এখানে থাকলে তুমিও বিপদে পড়তে পারো। আমার সব ফন্দি আঁটা হয়ে গেছে। ব্যাপার যা গড়িয়েছে, তাতে মরিয়ার্টিকে গ্রেফতার করার জন্যে আমার থাকবার দরকার নেই। এই কাজটা পুলিশই সেরে ফেলতে পারবে। তবে বিচারের সময় আমার থাকা দরকার, না হলে হয়তো ওর সাজা হবে না। সব দিক বিবেচনা করে মনে হচ্ছে অন্তত যতক্ষণ না পুলিশ মরিয়ার্টিকে গ্রেফতার করতে পারছে, ততক্ষণ আমার পক্ষে গা-ঢাকা দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমার খুব আনন্দ হবে, যদি এই সুযোগে তোমার সঙ্গে ক’দিনের জন্যে ইউরোপ বেড়িয়ে আসতে পারি।”
“এখন আমার কাজের চাপ বেশ হালকা। তার ওপর আমার একজন প্রতিবেশী ডাক্তার আছেন প্রয়োজনে তিনি আমার রুগিদের দেখাশোনা করতে পারবেন। তোমার সঙ্গে আমি যেতে চাই।”
“কাল সকালেই যেতে পারবে?”
“যদি দরকার হয় তো তাই যাব।”
“হ্যাঁ, কালকে যাওয়াটা বিশেষ দরকার। এবার আমার কথাগুলো তুমি খুব মন দিয়ে শোনো। তোমাকে আমি জোড়হাত করে একটি অনুরোধ করছি। আমার কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে। সামান্য নড়চড়ও যেন না হয়। মনে রাখবে, আমার সঙ্গে যোগ দিয়ে তুমি এমন একজনের সঙ্গে লড়তে নামলে, যে কেবল সমস্ত ইউরোপের ক্রাইম জগতের চূড়ামণি তাই নয়, তার মতো ধূর্ত অপরাধী দ্বিতীয়টি আর নেই। এখন যা বলছি মন দিয়ে শোনো। তোমার মালপত্র যা নেবে তা আজ রাত্তিরেই বিশ্বাসী কোনও লোককে দিয়ে ভিক্টোরিয়ায় পৌঁছে দেবে। কোথায় যাচ্ছ তা তোমার লাগেজের গায়ে লিখবে না। সকালে তৈরি হয়েই গাড়ি ডাকতে পাঠাবে। যাকে গাড়ি ডাকতে পাঠাবে, তাকে বিশেষ করে বলে দেবে যে সে যেন প্রথম যে-গাড়িটা দেখবে সেটাকেই না ডাকে। দ্বিতীয় গাড়িটাকেও যেন না ডাকে। প্রথম দুটো গাড়ি বাদ দিয়ে যে-গাড়িটা দেখবে সেটাকে যেন ডেকে আনে। গাড়িটা এলেই সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে পড়বে। কোচোয়ানকে বলবে স্ট্র্যান্ড বরাবর যেন সে লোদার আর্কেডের দিকে যায়। এই কথা ক’টা কাগজে লিখে তাকে দিয়ে দেবে। বলবে যে, কাগজের টুকরোটা যেন না ফেলে দেয়। গাড়িভাড়াটা হাতে রেখে দেবে। গাড়ি থামবার সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া ঢুকিয়ে দিয়ে তুমি একদৌড়ে আর্কেডের ভেতর দিয়ে উলটো দিকে চলে যাবে। এমন ভাবে হিসেব করে বেরোবে যে, যাতে তুমি ঠিক সওয়া ন’টার সময় ওই জায়গায় পৌঁছোতে পারো। উলটো দিকে পৌঁছোলেই দেখতে পাবে যে, ফুটপাতের গায়ে একটা ছোট ব্রুহাম দাঁড়িয়ে আছে। ব্রুহামের কোচোয়ানের গায়ে দেখবে কালো কোট। কোটের কলারের কাছে লালের ছোপ। ওই গাড়িটায় উঠলে তুমি কন্টিনেন্টাল এক্সপ্রেস ছাড়ার আগেই ভিক্টোরিয়া পৌঁছে যাবে।”
“তোমার সঙ্গে আমার কোথায় দেখা হবে?”
“স্টেশনে। গাড়ির সামনের দিক থেকে দু’নম্বর ফার্স্ট ক্লাস কামরাটা আমাদের জন্যে রিজার্ভ করা থাকবে।”
“তা হলে ট্রেনেই আমাদের দেখা হবে?”
“হ্যাঁ।”
রাতটা আমার বাড়িতে থাকবার জন্যে আমি হোমসকে অনেক অনুরোধ করলাম। হোমস আমার কথায় কান দিল না। হোমসের কথা শুনে বুঝলাম যে, ও আমার বাড়িতে থাকলে আমিও বিপদে পড়তে পারি এই ভেবেই ও আমার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতে কিছুতেই রাজি নয়। এরপর আমাদের আগামী কালের প্ল্যান আমাকে আর একবার ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে হোমস উঠে পড়ল। তারপর আমার সঙ্গে আমার বাড়ির পেছন দিকের বাগানে এসে বাগানের পাঁচিল টপকে বেরিয়ে গেল। আমার বাগানের পাঁচিল টপকালেই মর্টিমার স্ট্রিট। রাস্তায় পা দিয়েই হোমস শিস দিয়ে একটা গাড়ি ডাকল। তার পরই গাড়িতে চড়ে হোমস চলে গেল শুনতে পেলাম।
পরদিন সকালে উঠেই আমি হোমসের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম। খুব সাবধানে একটা গাড়ি ডেকে আনালাম। আমাদের শত্রু যদি কোনও গাড়ির ফাঁদ পেতে আমাদের ধরতে চায়, তো সেই ফাঁদে পা না দেওয়ার জন্যেই আমাদের এই সতর্কতা। ব্রেকফাস্ট শেষ করেই আমি গাড়ি চেপে লোদার আর্কেডের দিকে চললাম। হোমস ঠিক যেখানে বলে দিয়েছিল, সেইখানে গাড়ি থেকে নেমে আমি একদৌড়ে উলটো দিকে গেলাম। একটা ব্রুহাম দাঁড়িয়ে ছিল। ব্রুহামের কোচোয়ান লোকটা অসম্ভব মোটা। একটা কালো রঙের ওভারকোট পরে ছিল। আমি গাড়িতে পা দেওয়ামাত্র লোকটা গাড়িটা জোরে ভিক্টোরিয়া স্টেশনের দিকে হাঁকিয়ে দিল। ভিক্টোরিয়া স্টেশনে পৌঁছে আমি গাড়ি থেকে নামতেই সেই কোচোয়ান গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিমেষের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। লোকটা আমার দিকে একবার তাকাল না পর্যন্ত।
এতক্ষণ সবকিছু আমাদের পরিকল্পনামতো ঠিকঠাক চলছিল। আমার মালপত্র ঠিকমতো রাখা ছিল। যে-কামরাটায় আমরা যাব বলে হোমস ঠিক করেছিল, সে কামরাটা সহজেই খুঁজে পেলাম। সেইটাই একমাত্র প্রথম শ্রেণির কামরা যেটার গায়ে রিজার্ভেশন কার্ড লাগানো ছিল। আমার একমাত্র চিন্তার ব্যাপার হল, হোমসকে বের করা। হোমস কই? হোমসের টিকির দেখা নেই। স্টেশনের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, গাড়ি ছাড়তে আর সাত মিনিট মাত্র বাকি। বৃথাই আমি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে-থাকা সব লোকের মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। হোমসের পাত্তা নেই। এরই মাঝখানে আমি একজন ইতালীয় ধর্মযাজককে একটু সাহায্য করলাম। ভদ্রলোকের ইংরেজি জ্ঞান খুবই খারাপ। তাঁর কথা কুলি কিছুতেই বুঝতে পারছে না। একে বিদেশি তার ওপর আবার খুব বুড়ো। আমি তাই কুলিকে ডেকে বুঝিয়ে বললাম যে, ভদ্রলোকের সব মালপত্র প্যারিস পাঠিয়ে দিতে হবে। তারপর প্ল্যাটফর্মের চার দিকে একবার ভাল করে দেখে নিয়ে আমি গাড়িতে উঠে পড়লাম। কামরায় ফিরে এসে যা দেখলাম তাতে আমি অবাক। রিজার্ভেশন কার্ড ঝোলানো থাকা সত্ত্বেও কুলিটা সেই ইতালিয়ান পাদরিকে আমাদের গাড়িতে বসিয়ে দিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও আমি সেই ভদ্রলোককে বোঝাতে পারলাম না যে, তিনি এই গাড়িতে উঠে অত্যন্ত অন্যায় করেছেন। ভদ্রলোক ইংরেজি প্রায় জানেন না বললেই চলে, তবে আমি ইতালিয়ান আরও কম জানি। তাই খানিকটা হতাশ হয়েই চুপ করে গেলাম। তা ছাড়া হোমসের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ভেতরে ভেতরে খুব চিন্তাও হচ্ছিল। বিপদের একটা আশঙ্কা আমার শরীরের মধ্যে দিয়ে ঠান্ডা স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছিল। হোমসের এখনও পর্যন্ত না আসার একটা কারণই হতে পারে। নিশ্চয়ই রাত্রিতে শত্রুপক্ষের লোক কোনও রকমে ওকে ধরে ফেলেছে। গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ইঞ্জিনের বাঁশি বেজে উঠেছে। গাড়ি ছাড়তে আর বেশি দেরি নেই। এমন সময় “ওয়াটসন,” সেই চেনা গলা শুনতে পেলাম, “তুমি আমাকে প্রভাতী শুভকামনাটা পর্যন্ত জানালে না।”
আমি ভয়ানক চমকে গিয়ে ফিরে তাকালাম। সেই বৃদ্ধ ধর্মযাজক আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ঠিক এক মুহূর্তের জন্য সেই বৃদ্ধ লোকটির, মুখের কুঁচকে-যাওয়া চামড়া টেনে গেল। নাকটা সোজা হয়ে গেল। বয়সের ভারে ঝুলে-পড়া ঠোঁটদুটো শক্ত হয়ে গেল। চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি বিদ্যুৎচমকের মতো একবার শানিত হয়ে উঠল। সারা শরীর টান টান হয়ে উঠল। কিন্তু ঠিক এক মুহূর্তের জন্য হোমস দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল। তার পরেই আবার সেই বৃদ্ধ লোকটি ফিরে এল।
“ওফ্ কী সাংঘাতিক কাণ্ড! আমি তো তোমাকে একদম চিনতেই পারিনি।”
আমার কানে কানে হোমস বলল, “আমাদের কিন্তু খুব সাবধান থাকতে হবে। ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে যে ওরা আমাদের পেছনে ধাওয়া করেছে। আহ, ওই তো মরিয়ার্টি।”
গাড়িটা সবেমাত্র চলতে শুরু করেছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ভিড়ের মধ্যে দিয়ে একটা লম্বা লোক পাগলের মতো ছুটে আসছে। লোকটা এমন ভাবে হাত নাড়ছিল যে, মনে হল ওর হাত নাড়ার জন্যে গাড়ি থেমে যাবে। কিন্তু মরিয়ার্টি দেরি করে ফেলেছে। গাড়ি প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে রীতিমতো জোর ছুটতে শুরু করেছে।
“দেখছ তো ওয়াটসন, সব রকম সতর্কতা নেওয়া সত্ত্বেও আমরা খুব কান-ঘেঁষে বেরিয়ে গেছি,” হোমস হাসতে হাসতে বলল। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে ওর জোব্বা আর টুপিটা খুলে একটা হাতব্যাগের মধ্যে পুরে রাখল। “আজকের কাগজ পড়েছ, ওয়াটসন।”
“না।”
“তা হলে বেকার স্ট্রিটের ঘটনার কথা জানো না দেখছি।”
“বেকার স্ট্রিট? সেখানে কী হয়েছে?” আমি রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
“কাল রাত্তিরে ওরা আমাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। অবশ্য তাতে বড় ধরনের কোনও ক্ষতি হয়নি।”
“তুমি কী বলছ হোমস! নাহ্, বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে ওরা। এসব সহ্য করা যায় না।”
হোমস একটু দম নিয়ে ফের শুরু করল, “ওদের ভাড়াটে গুন্ডা পুলিশের হাতে ধরা পড়বার পর ওরা নিশ্চয়ই আমি কী করছি-না-করছি সে খবর পায়নি। তা না হলে ওরা আমি ফিরে গেছি মনে করে আমাদের ঘরে আগুন লাগাতে যেত না। বোঝা যাচ্ছে যে, ওরা তুমি কী করো না করো সে খোঁজখবরও রাখছিল। আর সেই জন্যেই মরিয়ার্টি ভিক্টোরিয়া স্টেশনে এসেছিল। ওয়াটসন, এখানে আসবার সময় তুমি এমন কোনও কাজ নিশ্চয়ই করোনি, যার থেকে আমাদের শত্রুরা কোনও খবর পেতে পারে।”
“তুমি যা করতে বলে ছিলে, আমি হুবহু তাই করেছি।”
“তুমি ব্রুহাম গাড়িটা দেখতে পেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল।”
“তুমি কি কোচোয়ানকে চিনতে পেরেছিলে?”
“না তো!”
“আমার দাদা মাইক্রফট। এ ধরনের কাজে পয়সা দিয়ে কোনও লোককে কাজে লাগানোর বিপদ আছে। নিজেদের কোনও লোককে কাজের ভার দিলে কাজটাও হয় ভাল, আর ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবার ভয় থাকে না। এখন আমাদের ঠিক করতে হবে, কী ভাবে মরিয়ার্টির চোখে ধূলো দেওয়া যায়!”
আমি বললাম, “একে তো এটা এক্সপ্রেস ট্রেন, তার ওপর এটার সঙ্গে ইংলিশ চ্যানেলের ফেরির কানেকশন আছে। তাই মনে হয়, মরিয়ার্টির পক্ষে আমাদের নাগাল পাওয়া আর বোধহয় সম্ভব নয়।”
“বন্ধু হে, হয় তুমি আমার কথায় কান দাওনি, নয়তো তুমি আমার কথা ভুলে গেছ। আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, এই লোকটা বুদ্ধিতে আমার সমকক্ষ। তোমার কি মনে হয় যে, আমি যদি কোনও অপরাধীর পেছনে ধাওয়া করতাম, আর অবস্থাটা যদি ঠিক এই রকমই দাঁড়াত তা হলে আমি হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম? তা হলে কেন তুমি মরিয়ার্টিকে এত বোকা ভাবছ?”
“ও লোকটা কী করবে?”
“আমি হলে যা করতাম তাই করবে।”
“তুমি হলে কী করতে?”
“স্পেশ্যাল ট্রেন ভাড়া করতাম।”
“কিন্তু তাতে তো সময় লাগবে, দেরি হবে?”
“মোটেই নয়। আমাদের গাড়ি ক্যান্টারবেরিতে থামবে। তা ছাড়া ফেরি বোট ছাড়তে অন্তত পনেরো মিনিট দেরি হবেই। তার মধ্যে ও আমাদের কাছাকাছি এসে যাবে।”
“ব্যাপার দেখে-শুনে মনে হচ্ছে যে, আমরাই যেন অপরাধী, পালিয়ে বেড়াচ্ছি। তার চেয়ে ওকে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেওয়াটাই ভাল বলে মনে হয়।”
“না, তা হলে আমার তিন মাসের সব পরিশ্রমই বৃথা যাবে। বড় মাছ ধরা পড়বে ঠিকই, তবে চুনোপুঁটিগুলো সব জালের ফাঁক দিয়ে গলে পালাবে। সোমবার সবসুষ্ঠু টেনে তুলব। তার আগে কাউকে গ্রেফতার করার কথা ভাবছি না।”
“তা হলে কী করতে চাও?”
“আমরা ক্যান্টারবেরিতে নেমে পড়ব।”
“তারপর?”
“ক্যান্টারবেরি থেকে চলে যাব ইংল্যান্ডের ও প্রান্তে। সেখান থেকে চলে যাব নিউ হ্যাভেনে। সেখান থেকে ডিয়েপ্পে। এ রকম অবস্থায় আমি হলে যা করতাম, মরিয়ার্টিও তাই করবে। ও সোজা প্যারিসে যাবে। সেখানে আমাদের মালপত্তরের ওপর নজর রাখবে। অন্তত দিন দুই ও প্যারিসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। ইতিমধ্যে আমরা খেয়ালখুশিমতো বেড়াতে বেড়াতে, গ্রামের লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে লাকসেমবার্গ ও বাসেল হয়ে সুইজারল্যান্ড পৌঁছে যাব।”
আমি জীবনে প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছি। তাই মালপত্তর সঙ্গে না থাকাতে আমার অন্তত কোনও অসুবিধা হবে না। কিন্তু আমার যেটা খারাপ লাগল, সেটা হল এই যে, যে-লোকটার শয়তানির কোনও পরিমাপ হয় না, তারই জন্যে আমাদের এই ভাবে প্রায় চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। যাই হোক, বুঝতে পারলাম যে, ঘটনাটা আদ্যন্ত হোমসের কাছে যত পরিষ্কার, আমার কাছে ততটা পরিষ্কার নয়। আমরা তো ক্যান্টারবেরি স্টেশনে নেমে পড়লাম। স্টেশনে খবর নিয়ে জানতে পারলাম যে, নিউ হ্যাঁভেন যাবার গাড়ি পাওয়া যাবে এক ঘণ্টা পরে।
আমি বিষন্ন ভাবে রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একটু আগেই এই লাইন ধরে আমাদের মালপত্তর নিয়ে এক্সপ্রেস ট্রেনটা চলে গেছে। কত দুরে গেছে গাড়িটা এতক্ষণে? হঠাৎ হোমস আমার জামার হাতায় টান দিয়ে আপ লাইনের দিকে তাকাল।
হোমস বলল, “দেখতে পাচ্ছ?”
দূরে কেন্টের বনজঙ্গলের ওপর ধোঁয়ার রেখা দেখা যাচ্ছিল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই একটামাত্র কামরা টানতে টানতে একটা ইঞ্জিন ঊর্ধ্বশ্বাসে স্টেশনের দিকে ছুটে এল। আমরা পড়ি-কি-মরি করে গাদা করে রাখা পার্সেলের পেছনে লুকিয়ে পড়লাম। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝমঝম করতে করতে প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে দিয়ে ইঞ্জিন আর কামরাটা বেরিয়ে গেল। আমাদের মুখে গরম হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগল।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে ট্রেনটা যখন বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে তখন হোমস বলল, “ওই মরিয়ার্টি চলে গেল। বুঝলে ওয়াটসন, আমাদের ওই বন্ধুর বুদ্ধিতে ঘাটতি আছে। যদি এই অবস্থায় আমি কী করব সেটাও আঁচ করতে পারত, আর সেইমতো ব্যবস্থা নিতে পারত, তো সেটাই হত সত্যিকারের বাহাদুরি।”
“মরিয়ার্টি যদি আমাদের নাগাল পায় তো ও কী করবে বলে তোমার মনে হয়?”
“তা হলে যে ও আমাকে মেরে ফেলতে সব রকম চেষ্টা করবে, সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহই নেই। এ খেলায় দু’দলের খেলোয়াড়কেই খেলে যেতে হবে। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে যে, আমরা দুপুরের খাওয়াটা সকাল সকাল এখানেই সেরে নেব, না হ্যাভেন পৌঁছোনো পর্যন্ত উপোস করে থাকব?”
শেষ পর্যন্ত আমরা ওই দিন রাত্রেই ব্রাসেলস রওনা হয়ে গেলাম। ব্রাসেলসে দু’দিন থেকে তৃতীয় দিন আমরা ব্রাসেলস থেকে বেরিয়ে স্ট্রাসবুর্গ পৌঁছোলাম। সোমবার দিন সকালে হোমস লন্ডন পুলিশের সদর দফতরে একটা টেলিগ্রাম পাঠাল। টেলিগ্রামের উত্তর সন্ধেবেলা আমাদের হোটেলে এসে পৌঁছোল। হোমস খামটা ছিঁড়ে টেলিগ্রামের কাগজটা বের করে পড়ে খামসমেত কাগজটাকে মুড়ে বিরক্ত হয়ে ফায়ার প্লেসে ছুড়ে ফেলে দিল।
“আমারই বোঝা উচিত ছিল,” হোমস হতাশ হয়ে বলল, “ও পালিয়েছে।”
“কে পালিয়েছে, মরিয়ার্টি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“পুলিশ মরিয়ার্টি ছাড়া ওর দলের আর সব্বাইকে ধরে ফেলেছে। মরিয়ার্টি ওদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে পালিয়েছে। অবশ্য আমি যখন ইংল্যান্ড থেকে চলে আসি, তখন বুদ্ধির খেলায় পরাস্ত করে ওকে ধরবার মতো কেউই আর নেই, সে কথাও ঠিক। তবে আমি তো শিকার একরকম ওদের হাতে তুলে দিয়ে এসেছিলাম। ওয়াটসন, আমার মনে হয়। তোমার এখন ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়াই উচিত।”
“কেন?”
“কেন না এরপর থেকে আমার সঙ্গে থাকলে তুমিও সাংঘাতিক বিপদে পড়বে। ওই লোকটার জীবনের সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। এখন যদি ও লন্ডনে ফিরে যায়, তো ধরা পড়বেই। লোকটার স্বভাবচরিত্র বুঝতে যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে, তো জোর করে বলতে পারি যে, এখন ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ হবে, আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়া। আমার সঙ্গে ওর যে কথাবার্তা হয়েছিল, সে সময়েও এই কথা ও আমাকে বলেছিল। আমি সব দিক ভেবেচিন্তেই বলছি যে, তোমার লন্ডনে ফিরে প্র্যাকটিস করাই উচিত।”
হোমসের কথায় আমি কান দিলাম না। হোমস আমার অনেক দিনের বন্ধুই নয়, আমরা একসঙ্গে অনেক বিপদের মোকাবিলা করেছি। অনেক বার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। আমরা স্ট্রাসবুর্গের হোটেলের ডাইনিংরুমে বসে প্রায় আধঘণ্টা এই নিয়ে কথাবার্তা বলতে লাগলাম। অনেক কথাকাটাকাটির পর শেষ পর্যন্ত ওই রাত্রেই আমরা জেনিভার পথে রওনা হলাম।
এক সপ্তাহ ধরে আমরা রোন উপত্যকায় ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। তারপর লেউক হয়ে জেমি গিরিপথের দিকে গেলাম। সমস্ত গিরিপথই বরফে ঢাকা। সেখান থেকে ইন্টারলোকেন হয়ে মাইরিংগেনের দিকে আমরা এগিয়ে গেলাম। এ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে। সমতল ভূমিতে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। চারদিক সবুজের সমারোহে ভরে উঠেছে। মাথার ওপর পাহাড়ের চুড়োগুলো তখন সাদা বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে রয়েছে। তবে এমন সুন্দর রাস্তা, প্রকৃতির শোভা, সব বেশ উপভোগ করলেও হোমসের মনের মধ্যে যে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল তা বুঝতে পারছিলাম। বিপদের ছায়া তাকে সর্বদাই ধাওয়া করছে, সে কথাটা হোমস এক মুহূর্তের জন্যেও ভোলেনি। আলপসের শান্ত গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাবার সময়, নির্জন গিরিপথের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে হোমস যে রকম সতর্ক ভাবে চারদিকে তাকাত, যে-কোনও লোককে দেখলেই যে রকম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চাইত তার থেকে বুঝতে পারতাম, আমরা যত দূরেই যাই না কেন, যে দুষ্টগ্রহ আমাদের পেছনে তাড়া করে ফিরছে, তার হাত থেকে আমাদের নিস্তার নেই।
আমার মনে আছে যে-দিন জেমি গিরিপথ পার হয়ে আমরা যখন নির্জন ডাউবেনসে হ্রদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমাদের ডান দিকের পাহাড় থেকে একটা পাথরের চাঁই গড়িয়ে এসে হ্রদের জলে পড়ল। হোমস সঙ্গে সঙ্গে এক দৌড়ে পাহাড়ের একটা উঁচু খাঁজে উঠে গলা বাড়িয়ে চারদিকে দেখতে লাগল। যে-লোকটি আমাদের পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সে অবশ্য বার বার বলতে লাগল যে, এতে আশ্চর্য হবার বা ভাববার কোনও কারণ নেই। বছরের এই সময়ে পাহাড়ের ওপর থেকে দু’-চারটে পাথরের চাঁই এই রকম ভাবে গড়িয়ে পড়েই থাকে। হোমস তার কথার কোনও জবাব না দিয়ে কেবল হাসতে লাগল। ওকে দেখে মনে হল, মনে মনে যে-আশঙ্কা ও করছিল, সেটা সত্যি হওয়ায় সে বোধহয় খুশিই হয়েছে।
যদিও হোমস সব সময়েই খুব সাবধানে চলাফেরা করছিল, ও কিন্তু তা বলে মোটেই দমে যায়নি। সত্যি কথা বলতে কী, ওকে এত ফুর্তিতে থাকতে আমি অন্তত আগে কখনও দেখিনি। ও প্রায়ই বলত যে, প্রফেসর মরিয়ার্টির হাত থেকে সমাজকে যদি বাঁচাতে পারে তবে ও গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেবে। ওর মনে আর কোনও খেদই থাকবে না।
“জানো ওয়াটসন, আমার মনে হয়, আমি বৃথাই এত দিন বেঁচে থাকিনি। আজকেই যদি আমার গোয়েন্দাগিরির ইতি হয়ে যায় তো, তার জন্যে এতটুকু ক্ষোভ থাকবে না আমার। আমি আছি বলে লন্ডন এত বাসযোগ্য সুন্দর শহর হয়েছে। আমার তদন্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এর কোনও একটা কেসেও যে অন্যায় করেছে তার পক্ষ আমি নিইনি। অপরাধীকে কখনও প্রশ্রয় দিইনি। কিছু দিন ধরেই আমার মনে হচ্ছে, মানুষের সমাজে যত না সমস্যা আছে, তার চাইতে ঢের বেশি সমস্যা, ঢের বেশি রহস্য আছে প্রকৃতির রাজ্যে। এই সব প্রাকৃতিক রহস্যই আজকাল আমার মনকে বেশি করে টানে। ওয়াটসন, যে-দিন আমি ইউরোপের সবচাইতে দক্ষ, সব চাইতে বুদ্ধিমান ধুরন্ধর অপরাধীটিকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারব, সেই দিনই আমার ছুটি। আর তোমারও লেখার পালা সাঙ্গ হবে।”
এরপর আমার নিজের খুব বেশি বলার আর কিছু নেই। তাই এর পরে যা যা ঘটেছে তা সংক্ষেপে লিখে যাব। এ ব্যাপারে কোনও কথা লিখতেই আমার মন চায় না। কলম সরে না। নেহাত কর্তব্যের তাগিদ পড়ছে বলেই লেখা। তাই, লিখছি যখন তখন খুঁটিনাটি কোনও তথ্যই বাদ দেব না।
তেসরা মে তারিখে আমরা মাইরিংগেনে পৌঁছোলাম। গ্রামটি ছোট। আমরা পিটার স্টাইলারের ‘এংলিশের হোফ’-এ উঠলাম। সরাইখানার মালিক লোকটি খুব ভাল। বুদ্ধিমান। খাসা ইংরেজি বলে। লোকটি লন্ডনের গ্রোভনর হোটেলে বছর তিনেক ওয়েটারের কাজ করেছিল। ওর পরামর্শমতো আমরা চৌঠা তারিখ দুপুরের পর বেরিয়ে পড়লাম। ইচ্ছে, পাহাড় পেরিয়ে সন্ধের আগেই ‘রোজেনলাউই’ গ্রামে পৌঁছে যাব। রাতটা ওই গ্রামেই কাটিয়ে দেব। আমাদের বার বার বলে দেওয়া হয়েছিল পাহাড়ের মাঝামাঝি যে রাইখেনবাখ জলপ্রপাত আছে, একটু ঘুরপথ হলেও সেটা যেন দেখে যাই।
রাস্তাটা সত্যিই ভয়ানক। পাহাড়ের ওপর থেকে বরফগলা জল হুড়হুড় করে নেমে এসে নীচে পড়ছে। সেই অতলস্পর্শী খাদ থেকে গুঁড়োগুঁড়ো জলকণা ধোঁয়ার মতো হু হু করে উঠে আসছে। মনে হয়, যেন একটা বিরাট বাড়িতে আগুন লেগে প্রচন্ড ধোঁয়া বেরোচ্ছে। যে-খাদের মধ্যে জলটা পড়ছে সেটা খুবই গভীর। তার চারপাশে কালো পাহাড়। ওপর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন কালো পাথর কেটে তৈরি করা একটা অতিকায় কাপ। সেই কাপ উপচে চার পাশে জল পড়ছে। আর সেই জল বিভিন্ন স্রোতে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ওপর থেকে অবিরাম এসে পড়ছে। সেই ভয়ংকর স্রোতের দিকে, সেই গম্ভীর গর্জনে নীচের থেকে উঠে আসা জলকণার দিকে চোখ গেলে হাত-পা ঝিমঝিম করে, মাথা ঘুরে যায়। আমরা প্রপাতের ধারে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে জলপ্রপাতের শব্দ শুনছিলাম। হঠাৎ মনে হল এটা প্রপাতের শব্দ নয়, একটা আধা-মানুষ আধা-জন্তুর চিৎকার।
জলপ্রপাতটা যাতে ভাল করে দেখা যায়, সেজন্য প্রপাতের বেড়ের অর্ধেকটা পর্যন্ত রাস্তা আছে। রাস্তাটা হঠাৎই শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং ওই পথে গেলে আবার ওই পথেই ফিরে আসা ভিন্ন কোনও উপায় নেই। ওই রাস্তা দিয়ে প্রপাতটা ভাল করে দেখে আমরা যখন ফিরে আসছি, তখন দেখলাম একটা বাচ্চা সুইস ছেলে দৌড়োতে দৌড়োতে আমাদের দিকে আসছে। ছেলেটার হাতে একটা চিঠি। চিঠির খামে, আমরা যে-হোটেলে ছিলাম, সেই হোটেলের নাম ঠিকানা লেখা। চিঠিটা হোটেলের কর্তা লিখেছে। চিঠিটা পড়ে দেখলাম যে, আমরা হোটেল থেকে চলে আসবার একটু পরেই এক ইংরেজ ভদ্রমহিলা অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় হোটেলে এসে পৌঁছেছেন। তাঁর এখন-তখন অবস্থা। ভদ্রমহিলা শীতকালটা ‘ডাভোস প্লাতস’-এ কাটিয়ে লুসার্ন যাচ্ছিলেন তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। হঠাৎ তাঁর প্রচণ্ড রক্তবমি হতে আরম্ভ করে। অবস্থা এতই খারাপ হয়ে পড়ে যে, মনে হয় ভদ্রমহিলার আয়ু বুঝি ফুরিয়ে এসেছে। এই সময় যদি কোনও ইংরেজ ডাক্তারকে খবর দেওয়া যেত, তা হলে ভদ্রমহিলাকে হয়তো একটু আরাম দেওয়া সম্ভব হতে পারত। চিঠির পরে স্টাইলার লিখেছে যে, আমি যদি খবর পেয়ে এক বার আসি হলে সে আমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। কেন না ভদ্রমহিলা কোনও সুইস ডাক্তারকে দেখাবেন না বলে ঠিক করেছেন। ভদ্রমহিলার চিকিৎসার একটা ব্যবস্থা না করতে পারা পর্যন্ত স্টাইলার খুবই মনের অশান্তিতে রয়েছে।
এ ধরনের কোনও অনুরোধের উত্তরে চট করে ‘না’ বলা খুব মুশকিল। বিদেশে এই ভাবে আমার স্বদেশীয় কোনও মহিলা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন, তা চিন্তা করাই যায় না। কিন্তু হোমসকে একা ছেড়ে যেতেও আমার মন চাইছিল না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল যে, আমি যতক্ষণ না মাইরিংগেন গ্রাম থেকে ফিরে আসি, ততক্ষণ এই সুইস ছেলেটি হোমসের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। হোমস বলল যে, সে আর কিছুক্ষণ ওই জলপ্রপাতের কাছে থাকবে তারপর আস্তে আস্তে রোজেনলাউই-এর দিকে যাবে। সন্ধেবেলায় সেখানে তার সঙ্গে আমার দেখা হবে। এরপর আমি মাইরিংগেন গ্রামের দিকে গেলাম। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে নেমে আসতে আসতে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলাম, হাতদুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে হোমস একদৃষ্টিতে জলপ্রপাতের দিকে তাকিয়ে আছে। হোমসের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা।
যখন আমি সমতল ভূমিতে প্রায় পৌঁছে গেছি, তখন আমি আবার পেছন ফিরে তাকালাম। এখান থেকে জলপ্রপাতটা আর দেখা যাচ্ছে না। তবে পাহাড়ের গায়ের যে-রাস্তা দিয়ে ওই জলপ্রপাতের দিকে যেতে হয়, সেই রাস্তাটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমার মনে আছে, ওই রাস্তা দিয়ে এক জন লোককে খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে যেতে আমি দেখেছিলাম। সবুজ গাছে-ঢাকা পাহাড়ের গায়ে কালো পোশাক-পরা লোকটির চেহারা আমি পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলাম। লোকটিকে আমি দেখেছিলাম। তার ওই ভাবে হাঁটাটাও আমার চোখে পড়েছিল বটে, তবে আমার মনে অন্য চিন্তা তখন এত বেশি ছিল যে, লোকটির সম্বন্ধে আমার কোনও কৌতূহলই হয়নি।
মাইরিংগেন পৌঁছোতে আমার এক ঘণ্টার একটু বেশি সময় লেগেছিল। বুড়ো স্টাইলার হোটেলের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।
আমি তার কাছে ছুটে গিয়ে বললাম, “ভদ্রমহিলার অবস্থা এখন কেমন?”
আমার কথা শুনে স্টাইলারের মুখের যে-অবস্থা হল তাতে আমার বুঝতে অসুবিধে হল না যে, আমার হৃৎপিণ্ডটা বোধহয় ছিঁড়ে গেল।
জামার পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আমি বললাম, “আপনি কি এই চিঠি লেখেননি? এই হোটেলে কি মরো মরো অবস্থায় কোনও ইংরেজ মহিলা আসেননি?”
হোটেলের মালিক বলল, “না। তবে চিঠিতে দেখছি আমার হোটেলের ছাপ রয়েছে। ওহো, বুঝতে পেরেছি, আপনারা চলে যাবার একটু পরেই যে-ইংরেজ ভদ্রলোকটি এখানে এসে ছিলেন, তিনিই এই চিঠি লিখেছেন। তিনি বললেন…”।
হোটেল মালিকের কথা শোনবার ধৈর্য বা সময় কোনওটাই আমার ছিল না। আমার শরীরের ভেতরে একটা ভয়ভাব ক্রমেই আমাকে চেপে ধরছিল। আমি গ্রামের রাস্তা দিয়ে দৌড়োতে শুরু করলাম সে দিকে, যেখান থেকে একটু আগেই আমি ফিরেছি। পাহাড় থেকে নামবার বেলা আমার এক ঘণ্টার একটু বেশি সময় লেগেছিল। ফেরার সময় আমার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও রাইখেনবাখ জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছোতে আমার দু’ঘণ্টা লেগে গেল। যেখানে আমি হোমসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, ঠিক সেই জায়গায় পাথরের গায়ে হোমসের পাহাড়ে ওঠার নিত্যসঙ্গী লোহার ফলা-লাগানো আলপেনস্টক লাঠিটা রাখা রয়েছে। কিন্তু হোমসের চিহ্ন নেই। আমি চিৎকার করে হোমসের নাম ধরে ডাকতে লাগলাম। কেউ সাড়া দিল না। কেবল আমার চিৎকারই পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
আলপেনস্টকটা দেখে আমার মন একদম ভেঙে গেল। যে-ভয় করছিলাম, সেটাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়ে উঠল। হোমস তা হলে রোজেনলাউইয়ের দিকে যায়নি। এই তিন ফুট চওড়া রাস্তায়, যার এক দিকে খাড়া পাহাড়, আর এক দিকে গভীর খাদ, হোমস দাঁড়িয়ে ছিল যখন ওর শত্রু ওর নাগাল পেয়েছিল। সেই সুইস ছেলেটারও টিকি দেখতে পেলাম না। ছেলেটা নিশ্চয় মরিয়ার্টির দলের। মরিয়ার্টি আসতেই ছেলেটা সরে পড়েছে। মরিয়ার্টি আর হোমসের দেখা হয়েছিল এই জায়গায়। কিন্তু তারপর কী হয়েছিল? তার পরের ঘটনার কথা কে আমাদের শোনাবে?
আমি খানিকক্ষণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। যে-সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে তা আমাকে একেবারে বিহ্বল করে দিয়েছিল। সবকিছুই কেমন অর্থহীন বলে মনে হচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার মন যখন একটু শান্ত হল, আমি তখন হোমসের কাজের পদ্ধতির কথা ভাবতে লাগলাম। যে-মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে, সেটা কী ভাবে ঘটল তা বোঝবার জন্যে আমি হোমসের ধরন নকল করতে লাগলাম। কিন্তু হায়! সব ব্যাপারটাই জলের মতো সোজা। আমি আর হোমস যখন ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিলাম, তখন আমরা এক বারও খাদের কিনারার কাছে যাইনি। সেই সময় আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে আলপেনস্টকের দাগ ছিল। খাদের কিনারার কালচে মাটি জলকণার দরুন সব সময়েই ভিজে, কাদা কাদা। সেখানকার মাটি এমনই নরম যে, পাখি চলে গেলেও তার পায়ের ছাপ পড়বেই। খাদের কিনারায় দিকে দু’সারি পায়ের দাগ চলে গেছে। দু’সারি পায়ের দাগই আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে জলপ্রপাতের ধারা যে-দিকে পড়ছে, সেই দিকে চলে গেছে। দুটোর কোনওটাই আর ফিরে আসেনি। খাদের কিনারার ফুটখানেক জায়গার মাটিটা যেন কেউ আচ্ছা করে চষে দিয়েছে। সেখানকার কাঁটাগাছের ঝোপের মাঝে মাঝে ধস্তাধস্তির চিহ্ন। কোথাও কোথাও ঝোপ ভেঙে গেছে। আমি সেইখানে শুয়ে পড়ে জলপ্রপাতের তলার দিকটা দেখতে লাগলাম। আমার চার পাশে কেবলই জলকণা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি চলে যাবার পর বেশ খানিকটা সময় কেটে গেছে। জলপ্রপাতের নীচেটা এখন পাতলা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। এখানে-ওখানে কালো পাথরের ওপর রোদের আভাস পড়ে চিকচিক করছে। শুধু দুরন্ত জলের ধারা যেখানে আছড়ে আছড়ে পড়ছে, সেখানে সাদা ফেনা চকচক করছে। আমি চিৎকার করলাম। কিন্তু জলধারার গর্জন ছাড়া কিছুই শুনতে পেলাম না।
বিধাতার বোধহয় ইচ্ছে ছিল যে, আমার বন্ধু ও সঙ্গীর শেষ সম্ভাষণ থেকে আমি যেন বঞ্চিত না হই। আগেই বলেছি যে, হোমসের আলপেনস্টকটা একটা বড় পাথরের গায়ে ঠেসান দিয়ে রাখা ছিল। এই পাথরের ঢিবির ওপরে একটা কিছু চকচক করছিল। কী চকচক করছে দেখবার জন্যে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম হোমসের প্রিয় রুপোর সিগারেটের কেসটা রয়েছে। আমি কেসটা তুলে নিতেই কেসের তলায় রাখা একটা কাগজ উড়ে এসে মাটিতে পড়ল। তুলে নিয়ে দেখলাম হোমসের নোটবই থেকে ছিঁড়ে নেওয়া তিনটে পাতা ভাঁজ করে রাখা। আরও দেখলাম একটা চিঠি। চিঠিটা আমাকে লক্ষ করে লেখা। আমি হোমসের মনের জোর দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সে একটুও চঞ্চল হয়নি। হাতের লেখা পরিষ্কার, গোটা গোটা। লাইনগুলো সোজা। মনে হয় যেন বেকার স্ট্রিটের নিজের ঘরে বসে লেখা।
হোমস লিখেছে:
প্রিয় ওয়াটসন,
মিঃ মরিয়ার্টির সৌজন্যে আমি তোমাকে এই চিঠি লিখবার সুযোগ পেয়েছি। মিঃ মরিয়ার্টি ততক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। ওঁর সঙ্গে আমার অনেক বিষয়ে কথাবার্তা হল। এইবার সবকিছুর চূড়ান্ত ফয়সালা হবে। মিঃ মরিয়ার্টি একটু আগে আমাকে বলছিলেন, কী ভাবে তিনি ইংল্যান্ডের পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসেন এবং আমাদের পেছনে ধাওয়া করেন। এই কথা তাঁর মুখে শুনে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে আমার যে উচ্চ ধারণা ছিল তা যে সত্যি, প্রমাণ হয়েছে। আমার এই ভেবে আনন্দ হচ্ছে যে, মিঃ মরিয়ার্টির হাত থেকে আমি সমাজকে মুক্ত করতে পারছি। তবে তার জন্যে আমাকে যে দাম দিতে হচ্ছে তাতে আমার বন্ধুদের, বিশেষ করে ওয়াটসন, তোমার খুব কষ্ট হবে। আমি অবশ্য তোমাকে আগেই বলেছিলাম যে, আমার জীবনে এক চরম সংকট ঘনিয়ে আসছে। আর এই ভাবে আমার জীবন শেষ হওয়ার চাইতে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। যদি তোমাকে সত্যি কথা বলি তো আমাকে স্বীকার করতে হবে, মাইরিংগেন থেকে যে চিঠি এসেছিল সেটা যে জাল তা আমি বরাবরই জানতাম। আর এই রকম কিছু একটা ঘটবে অনুমান করেই আমি তোমাকে মাইরিংগেন যাবার জন্যে অত ঝোলাঝুলি করেছিলাম। ইন্সপেক্টর প্যাটারসনকে বলবে মরিয়ার্টির দলকে অভিযুক্ত করবার জন্যে যে-সব সাক্ষী প্রমাণ দরকার তা সবই ‘M’ লেখা খোপে একটা নীল খামের মধ্যে রাখা আছে। খামের ওপরে মরিয়ার্টির নামও লেখা আছে। ইংল্যান্ড থেকে আসবার আগে আমার সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা করে এসেছি। সে দলিল আমার দাদা মাইক্রফটের কাছে আছে। মিসেস ওয়াটসনকে আমার প্রীতি শুভেচ্ছা জানিয়ো। আর বন্ধু, তুমি জেনো যে, আমি তোমার চির অনুরক্ত।—ইতি, শার্লক হোমস।
এরপর আমার আর কিছু লিখবার নেই। বিশেষজ্ঞরা ওই জায়গাটা পরীক্ষা করে যা বলেছেন, তার থেকে বোঝা যায়, ওই বিপদসংকুল জায়গায় ওদের দু’-জনের মধ্যে যে নিদারুণ দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয় তার ফলে যা হবার তাই-ই হয়েছিল। দু’জনেই গড়িয়ে পড়ে যায়। ওই অতলান্ত গহ্বরে যেখানে উঁচু পাহাড় থেকে তীব্র তোড়ে জল এসে পড়ছে, সেখান থেকে ওদের দু’-জনের কারও দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ওখানে ইউরোপের সব চাইতে জঘন্য অপরাধী আর সবার সেরা গোয়েন্দা চির দিনের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ল। সেই সুইস ছোকরার আর কোনও পাত্তা পাওয়া যায়নি। আমাদের গতিবিধি নজরে রাখবার জন্যে মরিয়ার্টি পয়সা দিয়ে যে-সব লোককে বহাল করেছিল, ওই ছোকরা অবশ্যই তাদের একজন। তবে হ্যাঁ, মরিয়ার্টির নিজের দল একদম শেষ হয়ে গিয়েছিল। হোমস তাদের বিরুদ্ধে যে-সব তথ্য সংগ্রহ করে রেখেছিল, তাতেই ওদের শাস্তি হয়ে গেল। হোমসের মৃত্যু বৃথা হয়নি। অবশ্য নাটের গুরু যিনি, তাঁর সম্বন্ধে খুব বেশি আলোচনা আদালতে হয়নি। আমিও সব কথা এত খোলাখুলি ভাবে হয়তো কোনও দিনই লিখতাম না, যদি না কেউ বোকামি করে আগবাড়িয়ে হোমসের সম্বন্ধে বাজে কথা লিখে মরিয়ার্টি যে একজন ভাল লোক এই কথাটা প্রমাণ করতে যেত। হোমস, যার মতো সহৃদয়, যার মতো বিচক্ষণ লোক আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি, তার সম্বন্ধে মিথ্যে কথা আর যেই পারুক, আমি সহ্য করতে পারব না।
