নতুন চাকরি (শার্লক হোমস) – আর্থার কোনান ডয়েল
আমার বিয়ের কিছু দিন পরেই আমি প্যাডিংটন অঞ্চলে ডাক্তারি করতে শুরু করলাম। এই অঞ্চলে ডাঃ ফারকার প্র্যাকটিস করতেন। ডাঃ ফারকারের রীতিমতো ভাল প্র্যাকটিস ছিল। ইদানীং তার প্র্যাকটিস অবশ্য পড়ে গিয়েছিল। তার এক নম্বর কারণ হল ডাঃ ফারকারের বয়স হয়েছে, আর দু’নম্বর কারণ তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। ডাঃ ফারকার ‘সেন্ট ভাইটাসেস ড্যান্স’ গোছের স্নায়ুরোগে বড়ই কষ্ট পাচ্ছেন। আমার মনে হয় যে, তাঁর রুগি কমে যাবার আসল কারণ এটাই। সাধারণ লোকে বোধহয় ভাবতে লাগল যে ডাক্তারবাবু যদি নিজের অসুখই সারাতে না পারেন তো অন্য লোকের অসুখ সারাবেন কী করে? আর সেইজন্যে ডাঃ ফারকারের অসুখ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্র্যাকটিসও কমতে লাগল। ডাঃ ফারকারের জায়গায় আমি যখন এলাম তখন তাঁর আয় বছরে মাত্র তিনশো পাউন্ড। অথচ গোড়ায় গোড়ায় তার আয় ছিল বছরে বারোশো পাউন্ডেরও বেশি। তবে আমি ঘাবড়াইনি। আমার বয়স কম আর আমি খাটতেও পারি খুব। আমার মনে ভরসা আছে যে, কিছু দিনের মধ্যেই আমি প্র্যাকটিস জমাতে পারব।
প্র্যাকটিস করতে গিয়ে প্রথম মাস-তিনেক আমার যাকে বলে দম ফেলবার সময় ছিল না। আর তাই আমি বেকার স্ট্রিটের দিকে যেতে পারিনি। শার্লক হোমসের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। শার্লক হোমস আবার মহা ঘরকুনো। কাজের জন্যে ছাড়া তাকে ঘর থেকে বেরোতে আমি কখনও দেখিনি। সেটা জুন মাসের কথা। ব্রেকফাস্ট সেরে আমি ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের নতুন সংখ্যাটা পড়ছিলাম। এমন সময় সদর দরজার ঘণ্টাটা বেজে উঠল। তার পরেই শার্লক হোমসের ভরাট গলার স্বর আমার কানে যেতেই রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হোমস বলল, “ওয়াটসন, অনেক দিন পরে তোমাকে দেখে কী আনন্দই যে হচ্ছে, কী বলব। মিসেস ওয়াটসন আছেন কেমন? আমাদের সেই ‘সাইন অব ফোর’-এর ব্যাপারটার সব চুকে গেছে তো?”
হোমসের হাতটা আমার মুঠোয় জাপটে ধরে বললাম, “ধন্যবাদ। আমাদের খবর মোটামুটি ভাল।”
একটা রকিং চেয়ারে বসে হোমস বলল, “ডাক্তারি পেশার চাপে পড়ে তোমার গোয়েন্দাগিরির শখ একেবারে উবে যায়নি আশা করি।”
আমি বললাম, “ঠিক তার উলটো। কাল রাত্তিরেই আমি আমার পুরনো ডায়েরির পাতা উলটে উলটে দেখে কেসগুলো কী ভাবে সাজানো যায় তাই ভাবছিলাম।”
“তুমি কি তোমার ডায়েরি লেখা বন্ধ করে দিয়েছ?”
“না, মোটেই নয়। তোমার সঙ্গে গোয়েন্দাগিরি করতে পেলে আমি আর কিছুই চাই না।”
“ধরো যদি ব্যাপারটা আজকেই হয়?”
“হ্যাঁ। আমি রাজি।”
“ধরো, যদি বার্মিংহাম অবধি যেতে হয়?”
তুমি বললে আমি নিশ্চয়ই যাব।”
“তোমার প্র্যাকটিসের কী হবে?”
“কাছাকাছি আমার পরিচিত এক ডাক্তার আছেন। তিনি কোথাও গেলে আমি তাঁর রুগিদের দেখাশোনা করি। আমি বললে তিনি আমার রুগিদের চিকিৎসা করবেন।”
“বেশ, বেশ। খুব ভাল।” হোমস চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আমাকে খুব ভাল করে দেখতে লাগল। “কিছু দিন আগে তোমার শরীর খারাপ হয়েছিল দেখছি। গরমকালে সর্দি লাগলে ভীষণ ভোগায়।”
“হ্যাঁ, খুব ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল। গত সপ্তাহে তিন দিন ঘরবন্দি ছিলাম। কিন্তু অসুখের কোনও চিহ্নই আর আমার শরীরে আছে বলে আমার মনে হয় না।”
“হ্যাঁ, সে কথা ঠিক বলেছ। তোমাকে বেশ ভালই দেখাচ্ছে।”
“তা হলে শরীর খারাপের খবর তুমি জানলে কী করে?”
“বন্ধু হে, তুমি তো আমার কাজের ধরনধারণ জানো।”
“তুমি অনুমানের ওপর ভর করে বললে?”
“নিশ্চয়ই।”
“কী ভাবে অনুমান করলে?”
“তোমার চটির অবস্থা দেখে।”
হোমসের কথায় আমি আমার পেটেন্ট লেদারের নতুন চটির দিকে তাকালাম। “চটি দেখে কী ভাবে অনুমান—” হোমস আমাকে চুপ করিয়ে দিল।
হোমস বলল, “তোমার চটিজোড়া নতুন। মনে হয় অল্প কিছুদিন আগে কিনেছ। তোমার চটির সুকতলার ধারে ধারে ঝলসানির দাগ দেখতে পাচ্ছি। প্রথমে ভেবেছিলাম চটিটা ভিজে গিয়েছিল বলে আগুনের তাতে শুকোতে গিয়ে এই রকম হয়েছে। কিন্তু দেখলাম যে, চটির তলায় দোকানের ছাপ মারা পাতলা কাগজটা আটকে আছে। চটিটা যদি জলে ভিজে যেত তা হলে কাগজটা খুলে যেত। তা হলে তুমি নিশ্চয়ই আগুনের দিকে পা বাড়িয়ে বসেছিলে। আর যদিও এ বছর জুন মাসে বৃষ্টি অন্য বছরের তুলনায় বেশিই হচ্ছে, তা হলেও সুস্থ শরীরে। তুমি নিশ্চয়ই ওই ভাবে বসে থাকতে না।”
হোমস যখন তার কোনও একটা সিদ্ধান্তের কারণগুলো বুঝিয়ে বলে, তখন মনে হয় সব ব্যাপারটাই সোজা। এর মধ্যে বাহাদুরি কিছু নেই। হোমস আমার মনের কথাটা টের পেয়েছিল বোধহয়।
অল্প একটু হেসে হোমস বলল, “ওয়াটসন, সব কথা খুলে বলে আমি আমার নিজেরই ক্ষতি করছি। লোকে কার্যকারণ সম্পর্কটা না ধরতে পারলে বেশি রকম সমীহ করে।” বুঝলাম হোমস মনে দুঃখ পেয়েছে। তারপর একটু থেমে বলল, “তা হলে তুমি বার্মিংহাম। যাচ্ছ তো?”
“নিশ্চয়ই। কিন্তু মামলাটা কীসের?”
“ট্রেনে যেতে যেতে তোমাকে সব কথা খুলে বলব। আমার মক্কেল বাইরে গাড়িতে বসে আছেন। তুমি চটপট তৈরি হয়ে নাও।”
“এক মিনিট।” আমি আমার পাশের বাড়ির ভদ্রলোককে দেবার জন্যে একটা চিরকুট লিখে ফেললাম। তারপর দৌড়ে ওপরে গিয়ে আমার স্ত্রীকে সব কথা বলে এলাম। আমি নেমে এসে দেখলাম, হোমস বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে।
পাশের বাড়ির দরজার পেতলের নেমপ্লেটটা দেখিয়ে হোমস বলল, “তোমার প্রতিবেশী একজন ডাক্তার?”
“হ্যাঁ। আমার মতো উনিও এখানে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন আর-একজনের জায়গায়।”
“যার জায়গায় উনি এসেছেন তিনি কি পুরনো কোনও ডাক্তার?”
“হ্যাঁ, আমি যাঁর জায়গায় এসেছি তিনি আর সেই ভদ্রলোক একসঙ্গে এখানে ডাক্তার হয়ে আসেন৷ ওঁরা যখন এখানে আসেন তখন এদিকে লোকজনের বাস সবেমাত্র শুরু হয়েছে।”
“তুমিই জিতে গেছ। তুমি যাঁর জায়গায় এসেছ তাঁর প্র্যাকটিস বেশি ছিল।”
“আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু তুমি জানলে কী করে?”
“সিঁড়ির ধাপগুলো দেখে বন্ধু, স্রেফ সিঁড়ির ধাপগুলো দেখে। তোমার বাড়িতে ঢোকবার সিঁড়িগুলো এই বাড়ির সিঁড়ির চেয়ে অন্তত তিন ইঞ্চি বেশি ক্ষয়ে গেছে। যাই হোক, গাড়ির মধ্যে এই যে ভদ্রলোককে দেখছ, এঁর নাম মিঃ হল পাইক্রফট। ইনিই আমার মক্কেল। ওহে বাবু, গাড়িটা জোরে হাঁকাও দেখি, ট্রেন ছাড়তে বেশি দেরি নেই।”
গাড়ির ভেতরে একজন অল্পবয়সি ভদ্রলোক বসেছিলেন। ভদ্রলোকের স্বাস্থ্য বেশ ভাল। গায়ের রং ধপধপে ফরসা। মুখচোখে সাধাসিধে নিরীহ ভাব। তাঁর মুখের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে ঠোঁটের ওপর খোঁচা খোঁচা হলদে গোঁফ। ভদ্রলোক কালো স্যুট আর চকচকে টপহ্যাট পরেছিলেন। চালাকচতুর চটপটে কাজের লোক বললে এক কথায় যা বোঝায় ভদ্রলোক তাইই। এঁদের সাধারণভাবে ‘ককনি’ বলা হয়। কিন্তু আমি জানি যে, আমাদের সেনাবিভাগের সুনাম এই ককনিদের জন্যেই। আর আমাদের দেশের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই তো ককনি। এই ভদ্রলোকের গোলগাল লাল মুখের ভাবটা বেশ হাসিখুশি। তবে ঠোঁটের দু’পাশের ভাবটা দেখলে মনে হয় যেন এই কেঁদে ফেললেন বুঝি। সব মিলিয়ে ভদ্রলোকের মুখের ভাবটা বেশ মজার। তবে ভদ্রলোকটি যে কেন শার্লক হোমসের কাছে এসেছেন, এ কথাটা জানতে পারলাম ট্রেন ছাড়বার পর।
আমরা একটা ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে বসলাম। হোমস বলল, “আমাদের বার্মিংহাম পৌঁছোতে ঠিক এক ঘণ্টা দশ মিনিট সময় লাগবে। মিঃ হল পাইক্রফট, আপনি আপনার যে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা আমাকে শুনিয়েছেন সেই কথা যদি আমার বন্ধুকে আর একবার শোনান তো বড় ভাল হয়। আপনি কোনও কিছুই বাদ দেবেন না, বরং যদি আর কোনও কথা মনে পড়ে যায় সেটাও জুড়ে দেবেন। সব ঘটনা আর একবার আগাগোড়া শুনলে আমার কাজেরও সুবিধে হবে।…বুঝলে ওয়াটসন, এটা এমনই একটা ঘটনা যে, এর মধ্যে অনেক সমস্যা থাকতে পারে আবার কোনও সমস্যা নাও থাকতে পারে। তবে যে-ধরনের উদ্ভট ব্যাপার আমরা পছন্দ করি এটা সেই ধরনের ব্যাপার। আচ্ছা মিঃ পাইক্রফট, আপনি শুরু করুন।”
আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে ভদ্রলোকটি নিজের কথা বলতে লাগলেন।
“সবচেয়ে দুঃখের কথা এই যে, এ ব্যাপারে আমি সাঙ্ঘাতিক রকম বোকামি করে ফেলেছি কিনা তা বুঝতে পারছি না। হয়তো ব্যাপারটা সে রকম কিছু নয় আর আমিও কিছু বেঠিক কাজ করিনি। কিন্তু আমার যদি চাকরিটা যায় আর তার বদলে কিছুই না পাই তা হলে বুঝব যে, আমার চেয়ে আহাম্মক এ দেশে আর কেউ নেই। ডাঃ ওয়াটসন, আমি গল্প ভাল বলতে পারি না। তাই ঘটনা যা ঘটেছে সেটা আপনাকে সাধাসিধে ভাবে বলছি।
“আমি ড্রেপারস গার্ডেনসের কক্সটন অ্যান্ড উডহাউসের আপিসে চাকরি করতাম। এ বছরের গোড়াতে ভেনেজুয়েলায় বেশ কিছু টাকা লগ্নি করে এবং সেই টাকা লোকসান করে আমাদের কোম্পানির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি ওখানে পাঁচ বছর চাকরি করেছি। কক্সটনসাহেব আমাকে একটা খুব ভাল সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন। কিন্তু হলে কী হবে, আপিস একদিন বন্ধ হয়ে গেল।
“আমরা সাতাশ জন কেরানি বেকার হয়ে গেলাম। আমি এখানে-ওখানে চাকরির চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার মতো আরও অনেক লোক বেকার। কোথাও কোনও আশার আলো নজরে পড়ছিল না। আমি কক্সটন অ্যান্ড উডহাউস থেকে সপ্তাহে তিন পাউন্ড মাইনে পেতাম। আমি তার থেকে প্রায় সত্তর পাউন্ড জমিয়ে ছিলাম। এক সময় সেই জমানো টাকা সব খরচ হয়ে গেল। অবস্থাটা এমন দাঁড়াল যে কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে ডাকে যে দরখাস্ত পাঠাব সে উপায়ও রইল না। ডাকটিকিট কেনবারও পয়সা নেই। আপিসপাড়ায় হেঁটে হেঁটে জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে গেল। কিন্তু কোথায় চাকরি!
“শেষে একদিন লম্বার্ড স্ট্রিটের স্টকব্রোকার কোম্পানি ‘মসন অ্যান্ড উইলিয়ামস’-এ একটা চাকরির সন্ধান পেলাম। আপনারা জানেন কিনা জানি না, এই মসন অ্যান্ড উইলিয়ামস খুব নামজাদা কোম্পানি। লন্ডনের বোধহয় সবচেয়ে ধনী কোম্পানি। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, ডাক-মারফত দরখাস্ত পাঠাতে। আমি তো কোনও রকমে ডাকটিকিট জোগাড় করে সার্টিফিকেট দিয়ে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলাম। তবে চাকরিটা যে পাব এমন কোনও আশা মনের মধ্যে ছিল না। কী আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল। আমাকে পরের সোমবার আপিসে গিয়ে দেখা করতে হবে। যদি অন্য কোনও বাধা-বিঘ্ন না হয় তো ওই দিনই আমাকে চাকরিতে যোগ দিতে হতে পারে। কী ভাবে যে এই চাকরি পাওয়ার ব্যাপারটা হয়, তা ভাবলে সত্যি আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। আমি এমনও শুনেছি যে, আপিসের বড়কর্তা নাকি ডাঁই-করা আবেদনপত্রগুলো থেকে চোখ বন্ধ করে একটা তুলে নেন আর তারই চাকরি হয়। সে কথা যাক। আমার খুবই আনন্দ হল এই ভেবে যে, এত দিন পরে আমার সামনে আবার একটা সুযোগ এল। মাইনেও বেড়ে গেল সপ্তাহে এক পাউন্ড করে। আর কাজ কক্সটনের ওখানে যা করতাম, তাই-ই।
“এইবার আপনাকে যা বলব তা শুনে আপনিও খুব আশ্চর্য হয়ে যাবেন। আমি হ্যাম্পস্টেড অঞ্চলে পটারস টেরেসের সতেরো নম্বর বাড়িতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি। যে-দিন চাকরির ব্যাপারটা পাকাপাকি হয়ে গেল সে দিন সন্ধেবেলায় ঘরে বেশ আরাম করে বসে পাইপ খাচ্ছিলাম। মনটাও বেশ খুশি খুশি ছিল। হঠাৎ আমার বাড়িওয়ালি একটা কার্ড নিয়ে এসে হাজির হলেন। কার্ডের ওপরে লেখা ছিল: ‘আর্থার পিনার, ফাইনানসিয়াল এজেন্ট’। এই নামের কোনও লোককে আমি চিনি না। এ রকম কোনও নামও আমি আগে শুনিনি। তাই বুঝে উঠতে পারলাম না আমার সঙ্গে এই লোকটির কী দরকার থাকতে পারে। যাই হোক, আমি বাড়িওয়ালিকে বললাম লোকটিকে ওপরে আমার কাছে নিয়ে আসতে। যে-লোকটি ঘরে ঢুকলেন তাঁর গড়ন মাঝারি। মাথায় কালো চুল, দাড়ি কালো, চোখের তারাও বেশ কালো। নাকটা অনেকটা ইহুদিদের মতো। ভদ্রলোকের হাঁটাচলার ভঙ্গিটি তড়বড়ে। কথাগুলো কাটা কাটা। ভদ্রলোক যেন সব সময়েই সকলকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি বাজে কথার লোক নন। তাঁর সময়ের দাম আছে।
“তিনি বললেন, “আপনিই মিঃ হল পাইক্রফট তো?”
“ভদ্রলোকের দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘“আপনি আগে কক্সটন অ্যান্ড উডহাউস কোম্পানিতে কাজ করতেন?’
‘“হ্যাঁ।’
‘“আপনি খুব সম্প্রতি মসনের আপিসে যোগ দিয়েছেন?’
‘“হ্যাঁ।’ আপনি ঠিকই বলেছেন।’
‘“বেশ।’ তারপর একটু থেমে ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনার কাজের কথা আমি নানান লোকের কাছে শুনেছি। সকলেই আপনার ভীষণ রকম প্রশংসা করে। পারকারকে চেনেন তো, কক্সটনের ম্যানেজার ছিল? আপনার কথা বলতে শুরু করলে তাকে তো আর থামানো যায় না।’
“বুঝতেই পারছেন ডাঃ ওয়াটসন, এসব কথা শুনে আমার বেশ আনন্দই হল। আমি আপিসের কাজে কোনও দিন কোনও রকম গাফিলতি তো করিইনি, উলটে যতদূর সম্ভব ভাল করে কাজ করবার চেষ্টা করেছি। তবে আমাকে নিয়ে যে আপিসপাড়ায় এ রকম আলোচনা হয় এ কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
‘“আপনার স্মৃতিশক্তি নিশ্চয়ই খুব ভাল, ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।
‘“মোটামুটি ভালই।’
‘“আপনি তো এত দিন বেকার ছিলেন। শেয়ারবাজারের খোঁজখবর রাখেন কি?’
‘“হ্যাঁ। স্টক এক্সচেঞ্জের পাতাটা রোজ সকালে পড়ি।’
‘“ঠিক। একেই বলে কাজের লোক। এ ধরনের লোকেরাই জীবনে বড় হয়। আমি যদি আপনাকে দু’-চারটে প্রশ্ন করি, রাগ করবেন না তো? আচ্ছা বলুন তো দেখি, আয়ারশায়ারের কী দর?’
‘“একশো পাঁচ থেকে একশো সওয়া-পাঁচ।’
‘“আর নিউজিল্যান্ড কনসলিডেটের?’
‘“একশো চার।
‘“আচ্ছা, ব্রিটিশ ব্রোকেন হিলসের?’
‘“সাত থেকে সাড়ে-সাত।’
‘“দু’হাত ছুড়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘চমৎকার। আমি যা শুনেছিলাম তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। বাপু হে, মসনের আপিসে কেরানি হবার জন্যে তোমার জন্ম হয়নি।’
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন পাইক্রফট। তারপর ফের শুরু করলেন তাঁর কথা। “ভদ্রলোকের কথা শুনে তো আমি অবাক। যে-চাকরি আমি পেয়েছি, ইনি তো তাকে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন না, অথচ এই চাকরি জোগাড় করতে আমার কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। তাই বললাম, ‘মিঃ পিনার, অধিকাংশ লোক কিন্তু আমার চাকরি সম্পর্কে অমন কথা মনে করে না। নিজের কথা বলতে পারি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই যে চাকরিটি আমি জুটিয়েছি, এতেই আমি সত্যি সত্যি খুব খুশি।’ কিন্তু আমার কথা শুনে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। ‘আরে ছোঃ ছোঃ। তোমাকে আরও ওপরে উঠতে হবে। এই চাকরি মোটেই তোমার উপযুক্ত নয়। আচ্ছা, আমার কথাটা তোমাকে খুলেই বলি। আমি তোমাকে যে-প্রস্তাব দিচ্ছি তা মোটেই তোমার যোগ্যতার উপযুক্ত নয়। তবে মসন তোমাকে যা দিচ্ছে তার তুলনায় অবশ্য অনেক ভাল। ভাল কথা, তুমি কবে থেকে মসনের চাকরিতে যোগ দিচ্ছ?’
‘“সোমবার।’
‘“হা-হা, আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে, সোমবার তুমি সেখানে কাজে যোগ দিতে যাচ্ছ না।’
‘“মসনের ওখানে সোমবার যাচ্ছি না?’
‘“না হে, না। ওই দিন তুমি ফ্রাঙ্কো মিডল্যান্ড হার্ডওয়ার কোম্পানির ম্যানেজার হিসেবে সবকিছু দেখাশোনা করবে। ব্রাসেলস আর সানরেমোর আপিস দুটো বাদ দিলে ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের একশো চৌত্রিশটি শাখা আছে।’
“ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি তো থ। ‘আমি তো এই আপিসের নাম শুনিনি,’ আমি ভদ্রলোককে বললাম।
‘“খুবই সম্ভব। ব্যাপারটা আমরা যথাসম্ভব গোপন রেখেছি। এর বেশির ভাগ টাকাটাই লগ্নি করেছেন কয়েক জন লোক, যাঁরা বাইরের লোককে অংশীদার করতে চান না। আমার ভাই হ্যারি পিনার এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। এই কোম্পানিটাকে দাঁড় করানোর পেছনে তার হাত অনেকখানি। সে যখন জানতে পারল যে আমি ইংল্যান্ডে আসছি, তখন আমাকে বলেছিল যে, চোখকান খোলা, কাজের অথচ কমবয়সি কোনও লোকের সন্ধান রাখতে। পারকার আমাকে তোমার কথা বলেছিল, সেইজন্যে আমি এখানে এসে হাজির হয়েছি। অবশ্য প্রথমে আমরা তোমাকে পাঁচশো পাউন্ডের বেশি দিতে পারছি না—’
“বছরে পাঁচশো পাউন্ড?’
‘“গোড়ায় তাই। তবে বিক্রির ওপর শতকরা এক ভাগ কমিশন তুমি পাবে। আর সেটাও তোমার মাইনের চেয়ে বেশি হবে তো কম হবে না।’
‘“কিন্তু হার্ডওয়ার সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণাই নেই।’
‘“সেটা কোনও কথাই নয়। তুমি তো ব্যবসার কাজকর্ম জানো।’
“আমার তো মাথা ভোঁ-ভোঁ করতে লাগল। আমি চেয়ারে বসতে পারছিলাম না। হঠাৎ আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগল।
“আমি বললাম, ‘দেখুন আপনাকে সত্যি কথা বলা উচিত। মসন আমাকে বছরে দুশো পাউন্ড দেবে ঠিকই, তবে বাজারে ওদের নাম আছে। মুশকিল হচ্ছে যে, আপনাদের কোম্পানির সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না।’
“ভদ্রলোক খুব খুশি হয়ে বলে উঠলেন, ‘বাঃ, বাঃ, বেশ চালাক ছোকরা তো তুমি। ঠিক তোমার মতো লোকই আমরা খুঁজছি। তোমার বেলায় শুধু কথায় চিঁড়ে ভেজানো যাবে না। ঠিকই তো! যদি তুমি আমাদের কোম্পানিতে যোগ দিতে চাও, তবে এই যে একশো পাউন্ডের নোটটা দেখছ এটা তোমার জামার পকেটে রেখে দাও। এটা তোমাকে মাইনের থেকে আগাম দেওয়া হল।’
‘“ধন্যবাদ। আমাকে কবে কাজে যোগ দিতে হবে?’
‘“কাল একটা নাগাদ অবশ্যই বার্মিংহাম চলে এসো। আমি তোমাকে একটা চিঠি দিয়ে দিচ্ছি, সেটা আমার ভাইকে দেখাবে। ১২৬ বি, করপোরেশন স্ট্রিটে আমরা একটা কাজ চালাবার জন্যে আপিস ভাড়া নিয়েছি। তোমার চাকরির পাকাপাকি ব্যবস্থা অবশ্য আমার ভাইই করবে। তবে চিন্তা কোরো না, সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’
‘“সত্যি মিঃ পিনার, কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব তা ভাবতে পারছি না,’ আমি বললাম।
‘“কিছু বলবার দরকার নেই। তুমি তোমার যোগ্যতায় এই চাকরি পেয়েছ। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নিতে হবে। একটা সাদা কাগজে এই কটি কথা তোমাকে লিখতে হবে: আমি নিজের ইচ্ছেয় পাঁচশো পাউন্ড মাইনেতে ফ্রাঙ্কো মিডল্যান্ড হার্ডওয়ার কোম্পানির ম্যানেজারের চাকরিতে যোগ দিচ্ছি।’
“আমি মিঃ পিনারের কথামতো একটা কাগজে কথাগুলো লিখে দিলাম। তিনি কাগজটা পকেটে পুরে নিলেন।
‘“আর একটা কথা আছে। মসনের ব্যাপারটা কী করবে?’
“আনন্দের চোটে মসন কোম্পানির কথা আমার খেয়াল ছিল না। ‘আমি চিঠি লিখে ইস্তফা দিয়ে দেব।’
‘“ঠিক ওই কাজটি কোরো না। তোমাকে নিয়ে মসনের ম্যানেজারের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গেছে। আমি তোমার সম্পর্কে একটু খোঁজখবর করতে গিয়েছিলাম। লোকটা এমন অসভ্যের মতো ব্যবহার করল যে, বলা যায় না। বলে কিনা যে আমি তোমাকে ওদের ওখান থেকে ভাঙিয়ে নেবার চেষ্টা করছি। রাগে আমার শরীর একেবারে জ্বলে যাচ্ছিল। ভাগ্য ভাল যে, দু’-চার ঘা লাগিয়ে দিইনি।’ আমি বললাম, ‘সত্যি যদি কাজের লোক চাও তো ভাল মাইনে দাও।’ তার উত্তরে লোকটা বললে, ‘আরে বাদ দাও। ও তোমার বেশি মাইনের চাকরি ছেড়ে আমাদের কম মাইনের চাকরি করবে।’ আমি বললাম, ‘বেশ, পাঁচ পাউন্ড বাজি ধরছি। তোমরা ওর কাছ থেকে কোনও খবরই পাবে না।’ লোকটা বলল, ‘বেশ, রাজি। ওকে আমরা আঁস্তাকুড় থেকে তুলে এনেছি। ও চট করে আমাদের ছেড়ে যাবে না।’
“বিশ্বাস করুন ডাঃ ওয়াটসন, কথাগুলো শুনে আমার এত খারাপ লাগল যে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ‘আচ্ছা অভব্য লোক তো। লোকটাকে আমি এর আগে কোনও দিন দেখিনি পর্যন্ত। ও ভেবেছে কী? ঠিক আছে, আপনার কথামতোই আমি কাজ করব। ওদের কোনও খবরই দেব না।’
‘“ঠিক। তা হলে তুমি আমাকে কথা দিচ্ছ তো যে, ওদের সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগ করবে না। তবে এই নাও তোমার আগাম বেতন একশো পাউন্ড আর এই চিঠি। ঠিকানাটা মনে রেখো, ১২৬ বি, করপোরেশন স্ট্রিট। কাল দুপুর একটার সময় তোমাকে হাজির হতে হবে।…আমার ভাইয়ের জন্যে একজন সত্যিকারের কাজের লোক জোগাড় করতে পেরে আমার যে কত আনন্দ হল তা বলে বোঝাতে পারব না। আজ তবে চলি। আশা করি তোমার উন্নতির এই সবে শুরু।
“মিঃ পিনারের সঙ্গে আমার এ ছাড়া আর কোনও কথা হয়নি। ডাঃ ওয়াটসন, আপনি নিশ্চয়ই আমার মনের অবস্থা কল্পনা করতে পারছেন। আনন্দের চোটে আমার তো সারা রাত ভাল ঘুমই হল না। আমার এত সৌভাগ্য আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বার্মিংহাম যাবার প্রথম যে ট্রেনটা পেলাম সেটায় চেপেই রওনা হলাম। আমার একটার সময় পৌঁছোবার কথা। আমি তার ঢের আগে পৌঁছে গেলাম। আমি প্রথমে নিউ স্ট্রিটের হোটেলে আমার জিনিসপত্র নিয়ে উঠলাম। তারপর সেই ঠিকানার খোঁজে বেরোলাম।
“একটা বাজবার পনেরো মিনিট আগেই সেই ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম। আমার মনে হয়েছিল একটু আগে থেকেই হাজির থাকা হয়তো ভাল। ১২৬ বি বাড়িটায় যেতে গেলে দুটো বড় দোকানের মাঝখানে একটা সরু গলি দিয়ে যেতে হয়। গলিটা দিয়ে এগিয়ে গেলেই সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলে তলায় তলায় নানান আপিস। সিঁড়ির এক পাশের দেওয়ালে আপিসের নাম আর কোন তলার কোন ফ্ল্যাটে সেই আপিস তা লেখা আছে। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কো মিডল্যান্ড হার্ডওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের নাম নেই। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আগাগোড়া সব ব্যাপারটাই কি ধাপ্পা? সব কেমন গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। এমন সময় ওপর থেকে একজন ভদ্রলোক নেমে এলেন। আমার কাছে কাল রাত্তিরে যে-ভদ্রলোক গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে এঁর চেহারায় অদ্ভুত মিল আছে। শুধু এঁর দাড়ি-গোঁফ নিখুঁত ভাবে কামানো আর মাথায় অল্প টাক।
“ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি মিঃ হল পাইক্রফট?’
“আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘“ও হো। আমি তো আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। আপনি অবশ্য একটু আগেই এসে পড়েছেন। আজ সকালেই আমি আমার ভাইয়ের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি। সে তো আপনার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ।’
‘“আমি আপিসের ঘরটা খুঁজছিলাম, এমন সময় আপনি এসে পড়লেন।’
‘“আমরা এখনও আমাদের নাম এখানে লাগাইনি। গত সপ্তাহেই তো এই ঘরটা ভাড়া নিয়েছি। তা ছাড়া এখানে তো আমরা অস্থায়ী ভাবে আছি। আসুন, ওপরে বসেই আপনার সঙ্গে সব কথা হবে।’
“ভদ্রলোকের পিছনে পিছনে উঁচু উঁচু সিঁড়ি দিয়ে আমরা একদম চিলেকোঠায় পৌঁছে গেলাম। সেখানে দুটো ঘর। ঘরগুলোর মেঝেয় কার্পেট নেই, জানলায় কোনও পরদা টাঙানো নেই। আমার ধারণা হয়েছিল, কোম্পানির আপিসটা বেশ বড়সড় হবে, সারি সারি টেবিল, সেখানে অনেক লোক কাজ করছে। ও হরি, কোথায় কী! ঘরে একটা সাধারণ টেবিল আর টেবিলের দু’পাশে দুটো খুবই সস্তার চেয়ার। টেবিলের ওপরে একটা লেজার আর নীচে একটা বাজে কাগজ ফেলার ঝুড়ি।
“আমার মুখ দেখে ভদ্রলোক বুঝতে পেরেছিলেন আমি খুবই হতাশ হয়েছি। ‘ঘাবড়াবেন না মিঃ পাইক্রফট। রোম একদিনে গড়ে ওঠেনি। আমাদের টাকাপয়সার ঘাটতি নেই। আমরা এখনও পর্যন্ত সব গুছিয়ে উঠতে পারিনি। বসুন। কই আপনার চিঠিটা দেখি।’
“আমি চিঠিটা বের করে ভদ্রলোককে দিলাম। ভদ্রলোক খুব মন দিয়ে চিঠিটা পড়লেন।
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন মিঃ পাইক্রফট। তারপর ফের বলতে শুরু করলেন তাঁর কাহিনী। “ভদ্রলোক চিঠিটা পড়ে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমার ভাই আর্থার দেখছি খুবই খুশি হয়েছে। লোকচরিত্র বুঝতে ওর জুড়ি নেই। আর্থার সব কথাতেই লন্ডনের তুলনা দেয় আর আমি বার্মিংহ্যামের। এক্ষেত্রে আমি তার মতই মেনে নেব।…আপনার চাকরি পাকা হয়ে গেছে বলে ধরে নিন।’
“আমি বললাম, ‘আমাকে কী করতে হবে?’
‘“আপনাকে আমাদের প্যারিস শহরের হেড আপিসের সব দায়িত্ব নিতে হবে। এই আপিস থেকে ফ্রান্সে আমাদের যে একশো চৌত্রিশটা শাখা আছে সেসব জায়গায় ইংল্যান্ডে তৈরি বাসনকোসন পৌঁছে দেওয়া হবে। কেনাকাটা যা কিছু তা এই সপ্তাহেই সাঙ্গ হবে। ইতিমধ্যে আপনি বার্মিংহ্যামে থেকে সব ব্যাপারটা তদারকি করবেন।’
‘“কী ভাবে?’
“আমার কথার জবাবে ভদ্রলোক টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা লাল রঙের বড় বই বের করলেন। ‘এটা প্যারিসের ডাইরেক্টরি। এতে প্রত্যেক লোকের নামের সঙ্গে সে কী করে তা লেখা আছে। আপনি এটা বাসায় নিয়ে গিয়ে এই ধরনের জিনিসপত্র যারা বিক্রি করে তাদের নামের পাশে দাগ দেবেন। এই তালিকাটা আমার ভীষণ দরকার।’
‘“কিন্তু ব্যবসাদারের নামের তালিকা তো আলাদা ভাবে পাওয়া যায়,’ আমি একটু আশ্চর্য হয়েই বললাম।
‘“না। সেগুলোতে খুব ভুলভাল থাকে। ওদের কাজের ধরন আমাদের মতন নয়। এই কাজটা ভাল করে করুন। সোমবার বারোটার সময় আমার চাই। ঠিক আছে মিঃ পাইক্রফট, আপনি তা হলে এখন আসুন। কাজে আপনার উৎসাহ আর উদ্যম থাকলে দেখবেন যে কোম্পানি আপনাকে কী করে।’
“সেই ঢাউস বইটা বগলদাবা করে আমি তো হোটেলে ফিরলাম। মনের মধ্যে নানা রকম ভাবনাচিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। বুঝলাম যে, চাকরিটা আমি পেয়েছি। আর তার প্রমাণ হিসেবে আমার পকেটে তখনও একশো পাউন্ডের নোটটা রয়েছে। কিন্তু আপিসের ছিরি দেখে, সিঁড়ির নীচে আপিসের নাম না দেখে মনটা দমে যেতে লাগল। যাই হোক, কী আর করব। এখন এখানেই আমাকে লেগে থাকতে হবে। রবিবার দিন আমি সারাক্ষণই কাজ করলাম। সোমবার সারা সকাল চেষ্টা করে ‘H’ পর্যন্ত হল। আমি আমার কর্তার কাছে গেলাম। সেই ফাঁকা ঘরে উনি একলা বসেছিলেন। আমার কথা শুনে বললেন, ‘ঠিক আছে, বুধবার লিস্টটা করে আনুন।’ বুধবার দিনও কাজটা শেষ হল না। কাজটা শেষ হল শুক্রবার, মানে গত কাল কাগজপত্র নিয়ে আমি মিঃ হ্যারি পিনারের কাছে গেলাম।
‘“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কাজটা যে এত বড় তা একদম বুঝতে পারিনি। এই লিস্টটা খুব কাজে লাগবে।’
“আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, কাজটা শেষ করতে অনেক সময় লাগল।’
‘“আপনাকে আর-একটি কাজ করতে হবে। অনেক ফার্নিচারের দোকানেও বাসনপত্র বিক্রি হয়। আপনাকে সেই দোকানগুলোর নামের লিস্ট করতে হবে।’
‘“খুব ভাল।’
‘“কাল সন্ধে সাতটা নাগাদ এসে আপনি বরঞ্চ কাজ কী রকম এগোচ্ছে সেটা আমাকে জানিয়ে যাবেন। তবে অতিরিক্ত পরিশ্রম করবেন না। সন্ধেবেলা যদি ঘণ্টা-দুয়েক মিউজিক হল থেকে ঘুরে আসেন তো কাজেরও কোনও ক্ষতি হবে না। আর শরীর-মন দুইই ভাল থাকবে।’
“কথাটা বলেই ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন। আমার নজরে পড়ল তাঁর বাঁ দিকের দ্বিতীয় দাঁতটা সোনা-বাঁধানো। দেখেই আমার শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল।’
শার্লক হোমস বেজায় খুশি হয়ে হাত ঘষতে লাগল। আর আমি ব্যাপার কী বুঝতে না পেরে আমাদের মক্কেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“ডঃ ওয়াটসন, আপনি নিশ্চয়ই অবাক হয়ে গেছেন! আসল কথাটা হচ্ছে এই, আমার কাছে লন্ডনে প্রথম যে-লোকটি এসে ছিলেন, তিনি আমি মসনের ওখানে যাব শুনে যখন হেসে উঠেছিলেন তখন দেখতে পেয়েছিলাম যে, তাঁর বাঁ দিকের দ্বিতীয় দাঁতটি সোনা বাঁধানো। দেখতে পেয়েছিলাম মানে আলো পড়ে দাঁতটা ঝকঝক করে উঠেছিল। দু’জনের চেহারার, গলার স্বরের মিলের সঙ্গে বাঁধানো দাঁতের মিলটা বড্ড বেশি নজরে পড়ল। দু’জনের চেহারায় যেটুকু অমিল সেটা পরচুলা বা দাড়ি-গোঁফ ছাঁটবার কায়দায় হতে পারে। আমি বুঝতে পারলাম, এরা আসলে একই লোক। দু’ভাইয়ের চেহারায় বা গলার স্বরে মিল থাকতেই পারে। তবে তাদের দু’জনের একই পাটির একই দিকের একই দাঁত সোনা-বাঁধানো হওয়াটা কি একটু বেশি রকমের মিল হয়ে যায় না? যাই হোক, উনি তো আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সব কথা ভাবতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে গেল। কোনও রকমে তো হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলে ফিরে ঠান্ডা জলে ভাল করে মাথাটাথা ধুয়ে সব ব্যাপারটার একটা সমাধান করবার চেষ্টা করতে বসলাম। কেন লোকটা আমাকে লন্ডন থেকে বার্মিংহ্যামে পাঠিয়ে দিল? কেন ও এই ভাবে গোপনে আমার আসবার আগে বার্মিংহ্যামে এসে হাজির হল। কেন ও নিজেই নিজেকে একটা চিঠি লিখল? আমার মাথা ঘুলিয়ে যেতে লাগল। যতই ভাবতে লাগলাম, কোনও সমাধান পেলাম না। হঠাৎ আমার মনে হল, আমার কাছে যে-ব্যাপারটা এত গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে সেটা মিঃ শার্লক হোমস হয়তো সহজেই নিষ্পত্তি করে ফেলতে পারবেন। আমি কোনও রকমে রাত্তিরে ট্রেন ধরে লন্ডনে এসে পৌঁছেছি। তারপর আজ সকালে মিঃ হোমসের সঙ্গে দেখা করি। এখন আপনারা দু’জনে বার্মিংহ্যামে তদন্ত করে যদি আমার প্রশ্নের জবাবটা বলে দেন তো নিশ্চিন্ত হতে পারি।”
পাইক্রফট তাঁর অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা শেষ করলেন। এরপর খানিকক্ষণ সবাই চুপচাপ। শার্লক হোমস গম্ভীর মুখে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। তার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছিল যে, সে খুশিতে একেবারে ডগমগ করছে। তারপর চেয়ারের সিটে হেলান দিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বেশ মজার কাণ্ড, তাই না ওয়াটসন? এই কেসের কতকগুলো পয়েন্ট বেশ জটিল। ফ্রাঙ্কো মিডল্যান্ড হার্ডওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের আপিসে বসে মিঃ আর্থার হ্যারি পিনারের সঙ্গে আলাপ করতে পারলে তোমার আমার দু’জনেরই একটা বেশ নতুন অভিজ্ঞতা হবে বলে মনে হয়।”
“কিন্তু তা কী করে হবে?” আমি জানতে চাইলাম।
“খুব সহজেই,” হল পাইক্রফট খুশি খুশি ভাবে বললেন, “আপনারা দু’জন হলেন আমার বন্ধু। আপনাদের চাকরি নেই। তাই আমি আপনাদের আমার নতুন আপিসের ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের কাছে নিয়ে এসেছি। এতে আর গোলমালের কী আছে? এটাই তো স্বাভাবিক।”
হোমস বলল, “ঠিকই তো। ভদ্রলোকের দেখা পাওয়াটা দরকার। ওঁর সঙ্গে দেখা হলে বোঝা যাবে যে ওঁর মতলবটা কী। আপনার মধ্যে ওই ভদ্রলোক এমন কী গুণ দেখলেন যে আপনাকে ডেকে চাকরি দিলেন? নাকি…।” হোমস সেই যে মুখে চাবি-তালা লাগিয়ে দিল, নিউ স্ট্রিটে পৌঁছোবার আগে আর একটি কথাও বলল না।
সন্ধে সাতটার সময় আমরা কর্পোরেশন স্ট্রিট ধরে সেই আপিসের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
আমাদের মক্কেল বললেন, “খুব বেশি আগে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। উনি আমার সঙ্গে দেখা করতেই ওখানে আসেন।”
হোমস বলল, “এটা একটা ভাববার কথা বটে।”
পাইক্রফট উত্তেজিত ভাবে বললেন, “দেখুন, দেখুন, যা বলেছি ঠিক কিনা। ওই যে আমাদের আগে আগে উনি চলেছেন।”
পাইক্রফট একটি বেঁটেখাটো লোককে দেখিয়ে দিলেন। উলটো দিকের ফুটপাত দিয়ে ভদ্রলোকটি ভিড়ের মধ্যে বেশ তাড়াতাড়ি হাঁটছিলেন। একটি অল্পবয়সি ছোকরা ছুটে ছুটে খবরের কাগজের সন্ধের সংস্করণ বিক্রি করছিল। মিঃ পিনার একটা খবরের কাগজ কিনে সেটাকে বগলদাবা করে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন।
“ওই উনি ঢুকে গেলেন। ওই বাড়িটায় অনেক কোম্পানির আপিস আছে। আমার সঙ্গে আসুন। মনে হয় সহজেই আপনাদের ওঁর কাছে নিয়ে যেতে পারব।”
মিঃ হল পাইক্রফটের ঠিক পিছনে পিছনে আমরা সিঁড়ি দিয়ে পাঁচতলা অবধি উঠলাম। পাঁচতলায় একটা ঘরের দরজা আধা-ভেজানো। পাইক্রফট সেই দরজায় টোকা দিলেন।
ভেতর থেকে আওয়াজ এল ‘চলে আসুন।’ আমাদের মক্কেলের কথা খাঁটি। ঘরটায় আসবাবপত্র বলতে প্রায় কিছুই নেই। যে-লোকটিকে আমরা রাস্তায় দেখেছিলাম, এখন তিনি ঘরের একমাত্র টেবিলের কাছে বসে ছিলেন। টেবিলের ওপরে খবরের কাগজটা খোলা রয়েছে। ভদ্রলোকের মুখের অবস্থা দেখে আমি তো অবাক। একবার আমার মনে হল যে, ভদ্রলোক খুবই অসুস্থ। তার পরেই মনে হল যে, ভদ্রলোক প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করছেন। আবার পরক্ষণেই মনে হল যে, তিনি যেন সাংঘাতিক ভয় পেয়েছেন। তিনি দরদর করে ঘামছিলেন। চোখগুলো বড় বড়। তাঁর চোখের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল কোনও কিছুই যেন তাঁর নজরে পড়ছে না। তিনি পাইক্রফটের দিকে তাকিয়েছিলেন বটে, তবে তাঁকে মোটেই চিনতে পারেননি।
“মিঃ পিনার, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?” পাইক্রফট চেঁচিয়ে উঠলেন।
“হ্যাঁ। শরীরটা বিশেষ ভাল নেই। আপনার সঙ্গে এঁরা কারা?” মিঃ পিনার থেমে থেমে বললেন। আমরা বুঝতে পারলাম যে, কথা বলতে ওঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। কথা বলতে বলতে তিনি জিভ দিয়ে ঠোঁটদুটি ভিজিয়ে নিচ্ছিলেন।
“এঁদের একজন মিঃ হ্যারিস। ইনি বার্মন্ডসে থাকেন। আর একজন মিঃ প্রাইস, এখানকারই লোক। এঁরা দু’জনেই আমার বন্ধু। দু’জনেই খুব কাজের লোক। কিন্তু দু’জনেই এখন বেকার। এঁরা আপনার কাছে এসেছেন যদি আমাদের কোম্পানিতে এঁদের কোনও চাকরি আপনি করে দিতে পারেন।”
একটু শুকনো হাসি হেসে মিঃ পিনার বললেন, “হ্যাঁ, চাকরি হতে পারে বই কী। মনে হচ্ছে আপনাদের চাকরি হয়েই যাবে। মিঃ হ্যারিস, আপনি কী কাজ করেন?”
হোমস বলল, “আমি একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট।”
“তাই নাকি। হ্যাঁ, আমাদের তো একজন অ্যাকাউন্ট্যান্টের দরকার হবে। তা মিঃ প্রাইস আপনি?”
আমি বললাম, “আমি একজন সাধারণ কেরানি।”
“আমার মনে হচ্ছে, আপনাকেও আমাদের দরকার হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনাদের পাকা খবর দিয়ে দেব। এখন তা হলে আপনারা আসুন। ভগবানের দোহাই, আমাকে একটু একা থাকতে দিন।”
শেষের কথাগুলো যেন তাঁর ভেতর থেকে ফুঁড়ে বেরিয়ে এল। নিজেকে উনি যে ভাবে এতক্ষণ সামলে রেখেছিলেন সেটা আর পারলেন না। হোমস আর আমি পরস্পরের দিকে তাকালাম। মিঃ পাইক্রফট টেবিলের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন।
“মিঃ পিনার, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে এখানে এই সময়ে আমাকে কাজের কথা বলার জন্যে আসতে বলেছিলেন বলেই এসেছি।”
“তা ঠিক, মিঃ পাইক্রফট, তা ঠিকই,” মিঃ পিনার শান্ত ভাবে বললেন, “আপনি বরঞ্চ এখানে একটু অপেক্ষা করুন। আপনার বন্ধুদেরও আপনার সঙ্গে থাকতে বলুন। আমি মিনিট-তিনেকের মধ্যেই ফিরে আসছি।”
ধীরেসুস্থে চেয়ার ছেড়ে উঠে ভদ্রলোক ঘরের ভেতরের দিকের একটা দরজা দিয়ে ঢুকে গেলেন। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
হোমস ফিসফিস করে বলল, “কী ব্যাপার? উনি গা-ঢাকা দিলেন নাকি?”
পাইক্রফট বললেন, “অসম্ভব।”
“কেন?”
“ওই দরজাটা দিয়ে ভেতরের ঘরে যাওয়া যায়।”
“সে ঘর দিয়ে বাইরে যাওয়া যায় না?”
“না।”
“ঘরটা বেশ সাজানোগোছানো কি?”
“কালও ঘরটা একদম খালি ছিল।”
“তা হলে ও ঘরে উনি কী করতে গেলেন? এ ব্যাপারটার মধ্যে এমন একটা কিছু রয়েছে যা আমি ঠিক ধরতে পারছি না। স্রেফ ভয় পেয়ে পিনার বারোআনা পাগল হয়ে গেছেন। কেন উনি এত ভয় পেলেন?”
“উনি হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছেন যে, আমরা গোয়েন্দা,” আমি বললাম।
পাইক্রফট বললেন, “তাই হবে।”
হোমস মাথা নাড়ল। “উনি আমাদের দেখে ভয় পাননি। আগে থেকেই ভয় পেয়েছিলেন। হতে পারে যে…”
হোমসের কথায় বাধা পড়ল। ভেতরের ঘর থেকে একটা অদ্ভুত ‘র্যাট-ট্যাট র্যাট-ট্যাট’ শব্দ ভেসে এল।
পাইক্রফট বললেন, “আরে, আরে, নিজেই দরজা বন্ধ করে আবার নিজেই দরজা ঠুকছেন কেন?”
আবার সেই শব্দটা শোনা গেল। এবার আরও জোরে। আমরা সকলে একদৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হোমসের দিকে তাকাতে দেখলাম যে, তার মুখচোখ একেবারে পাথরের মূর্তির মতো স্থির। শুধু চোখের তারাদুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ শোনা গেল আর তার পরেই কাঠের ওপর দমাদম করে ঘা দেবার শব্দ। হোমস একদৌড়ে ঘরের এ দিক থেকে ও দিকে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। হোমসের দেখাদেখি আমরাও দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলাম। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। আমাদের চাপে দরজার কবজাগুলো ভেঙে গেল। মড়মড় করে দরজাটা পড়ে গেল। আমরা ভেতরে ঢুকে গেলাম।
ঘরটায় কেউ নেই।
একটু পরেই আমাদের ভুল ভাঙল। ঘরের এক কোণে আর-একটা দরজা। আমরা যে-ঘর থেকে এলাম সেই ঘরের দিকেই দরজাটা। হোমস এক লাফে গিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল। ঘরের মেঝেতে একটা কোট আর ওয়েস্টকোট পড়ে রয়েছে। আর পেছন দিকে একটা হুকের সঙ্গে নিজের গ্যালিসকে দড়ির মতো করে গলায় বেঁধে ঝুলছেন হার্ডওয়্যার ম্যানেজিং কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। তাঁর হাঁটু দুমড়ে গেছে। মাথাটা ঝুলে পড়েছে। দরজার সঙ্গে গোড়ালির ঠোকাঠুকির শব্দই আমরা শুনতে পেয়েছিলাম। আমি পিনারের কোমর জাপটে ধরে ওঁকে সোজা করে রাখলাম। হোমস আর পাইক্রফট দু’জনে মিলে গ্যালিসের ফাঁসটা আলগা করতে লাগল। ইলাস্টিক বলে জিনিসটা গলায় একেবারে চেপে বসে গেছে। তারপর আমরা ওঁকে ধরাধরি করে বাইরের ঘরটায় নিয়ে এলাম। ভদ্রলোককে মেঝেয় শুইয়ে দিলাম। মুখের রং একেবারে স্লেটের মতো হয়ে গেছে। নীলচে ঠোঁটদুটো শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে।
হোমস বলল, “কী রকম বুঝছ ওয়াটসন?”
আমি ঝুঁকে পড়ে ভদ্রলোককে ভাল করে পরীক্ষা করছিলাম। ভদ্রলোকের নাড়ি খুব ক্ষীণ। তবে শ্বাসপ্রশ্বাস খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। বন্ধ চোখের পাতাদুটো কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
“আমরা ঠিক সময়ে গিয়ে পড়েছিলাম। আর-একটু দেরি হলে কী হত বলা যায় না। যাকে বলে টাচ অ্যান্ড গো আর কি। এখন ঘরের জানলাটা খুলে দাও আর জলের কুঁজোটা আমাকে এগিয়ে দাও।”
ভদ্রলোকের জামাটা খুলে দিয়ে আমি তাঁর ঘাড়ে-মুখে বেশ ভাল করে জল দিয়ে দিলাম। আর তারপরে তাঁর হাতদুটো উঁচু-নিচু করতে লাগলাম যতক্ষণ না তিনি স্বাভাবিক ভাবে নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারেন।
“এইবার আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে,” বলে আমি ভদ্রলোকের পাশ থেকে সরে এলাম।
ট্রাউজার্সের পকেটে হাত পুরে হোমস খুব গম্ভীর মুখে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েছিল। হোমস বলল, “আমার মনে হয়, এখন আমাদের উচিত পুলিশকে ব্যাপারটা জানানো। তবে কিনা আবার এটাও মনে হয় যে, কেসটার সমাধান করে ফেলার পর পুলিশকে জানানোই বোধহয় বেশি ভাল।”
পাইক্রফট মাথা চুলকে বললেন, “আমার কাছে সব ব্যাপারটাই তো রহস্যময়। কী কাজের জন্যে ওরা আমাকে এত দূরে টেনে এনেছিল আর কেনই বা…”
হোমস একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “আরে, সে অতি সাধারণ কথা। কিন্তু শেষকালের এই ব্যাপারটার কোনও হদিস পাচ্ছি না।”
“বাকি যা কিছু সব আপনি বুঝে ফেলেছেন।”
“হ্যাঁ। গোড়ার ব্যাপারটা তো জলের মতো সোজা। ওয়াটসন কী বলছ?”
আমি কোনও কথা না বলে মাথা নাড়লাম। বললাম, “না, আমি এ রহস্যের সমাধান তো দূরে থাক, কোনও কিছুই বুঝতে পারিনি।”
“যদি তুমি ঘটনাগুলোকে পর পর সাজিয়ে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করো তো তা হলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
“তুমি কী বুঝলে বলো তো?”
“সমস্ত ব্যাপারটার মূলে রয়েছে দুটো জিনিস। এক হচ্ছে, মিঃ পাইক্রফটকে দিয়ে সে যে এই কোম্পানির কাজই করবে এই কথাটা লিখিয়ে নেওয়া। এটা কি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে না?”
“সত্যি কথা বলতে কী আমি তো কিছু দেখছি না।”
“ধরো, কেন ওরা ও রকম করল। এটা তো প্রথা নয়। এ সব কাজকর্ম মুখের কথাতেই হয়। তবে এক্ষেত্রে কেন লেখাপড়া করার দরকার ছিল? তোমরা কি বুঝছ না যে, মিঃ পাইক্রফটের হাতের লেখার একটু নমুনা তাদের দরকার হল? আর এ ভাবে ছাড়া কী ভাবেই তারা নমুনা জোগাড় করতে পারত।”
“কিন্তু কেন?”
“ঠিক প্রশ্ন করেছ। কেন, কেন তারা এ রকম করল? এই প্রশ্নের সঠিক জবাব পেলে আমরা কেসটার অনেকটা সমাধান করে ফেলতে পারব। তবে একটা কারণ হতে পারে যে, মিঃ পাইক্রফটের লেখার ছাঁদটা নকল করা কারও পক্ষে খুবই দরকার হয়ে পড়েছিল। আর সেই জন্যেই ওই চালাকিটা করতে হয়েছিল। এটা যদি মেনে নিই, তা হলে এর থেকে আর একটা জিনিসও পরিষ্কার হয়ে যায়। সে জিনিসটা হল, কেন মিঃ পিনার বলেছিলেন যে, আপনি চাকরি করবেন না বলে মসন কোম্পানিকে জানাবেন না। তিনি চেয়েছিলেন যে, অন্য কেউ মিঃ হল পাইক্রফট সেজে সোমবার দিন মসন কোম্পানির ম্যানেজারের কাছে যাবে। ম্যানেজার ভদ্রলোক তো মিঃ পাইক্রফটকে দেখেননি, তাই সেদিক দিয়ে কোনও অসুবিধে নেই।”
“হা ভগবান! কী বোকামিটাই না আমি করেছি।” পাইক্রফট কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন।
“ধরুন, যে-লোক মিঃ হল পাইক্রফট সেজে গেল, তার হাতের লেখার যদি পাইক্রফটের হাতের লেখার সঙ্গে কোনও মিল না থাকে তো সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যাবে। তাই ওই নমুনা দেখে সেই জোচ্চোর হাতের লেখা মকশো করে নেবার সময় পাবে। আমার ধারণা, ওই আপিসের কেউই আপনাকে চেনে না।”
“না, কেউ না।”
“তা হলে তো ঠিকই হয়েছে। লন্ডনে থাকলে পাছে আপনি জেনে যান যে, হল পাইক্রফট নামে একজন মসন কোম্পানির আপিসে কাজ করছে, তাই ওদের প্রথম কাজই হল আপনাকে লন্ডন থেকে সরিয়ে দেওয়া। আর সেই জন্যে ওরা অত বেশি মাইনে কবুল করে আগাম দিয়ে আপনাকে মিডল্যান্ডসে পাঠিয়ে দেয়। আর সেখানে আপনাকে এমন কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল, যাতে আপনি লন্ডনমুখো আর না হতে পারেন। আপনি লন্ডনে এলেই তো ওদের খেল খতম। এ সবই, যাকে বলে, জলবৎ।”
“কিন্তু ওই লোকটা কেন নিজের ভাই সেজে থাকবে?”
“এটা বোঝা খুব শক্ত নয়। ওরা দু’ভাই-ই এই ব্যাপারটায় জড়িত। আর এক ভাই এখন পাইক্রফট সেজে আপিসে চাকরি করছে। এই লোকটি আপনার কাছে যায়, আবার পরে আপনার কর্তা হিসেবে এখানে আসে। এটা করতেই হয়েছিল, কেন না, এখানে অন্য কোনও লোককে আপিসের কর্তা খাড়া করলে তাকে সব ব্যাপারটা জানাতে হত। সেটা এরা চায়নি। তাই যতদূর সম্ভব চেহারাটা পালটে নিয়েছিল। ভেবেছিল যে, দু’জনের চেহারার সাদৃশ্য বংশগত সাদৃশ্য বলে আপনার মনে হবে। আর ঘটনাচক্রে ওই সোনা-বাঁধানো দাঁতটা আপনার চোখে না পড়লে মনে কোনও রকম সন্দেহই হত না।”
হল পাইক্রফট হাত ছুড়তে লাগলেন। “হা অদৃষ্ট, আমাকে তো আচ্ছা বোকা বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওই জাল হল পাইক্রফট মসন কোম্পানির আপিসে কী করছে? মিঃ হোমস, এখন আমরা কী করব? আপনি বলুন কী করা উচিত?” পাইক্রফট উত্তেজিত হয়ে বললেন।
“আমরা এক্ষুনি তার করে মসন কোম্পানিকে সব কথা জানিয়ে দেব।”
“শনিবার দিন ওদের আপিস বারোটার সময় বন্ধ হয়ে যায়।”
“ভাববেন না। দারোয়ান বা কেয়ারটেকার নিশ্চয়ই থাকবে।”
“ঠিক বলেছেন। অনেক মূল্যবান জিনিস আর কাগজপত্র গচ্ছিত থাকে বলে ওদের মাইনে-করা রক্ষী আছে। এ কথা লন্ডনে থাকতে শুনেছি।”
“খুব ভাল। আমরা তাকে তার করে জেনে নেব সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। আর আপনার নামের কোনও কেরানি ওদের ওখানে কাজ করছে কিনা। এ সবই বুঝতে পারছি। যেটা বুঝতে পারছি না সেটা হল, মানিকজোড়ের একজন কেন কথা নেই বার্তা নেই গলায় দড়ি দিয়ে মরতে চাইছিল।”
“খবরের কাগজ,” কে যেন ভাঙা খ্যাসখেসে গলায় আমাদের পিছন থেকে বলে উঠল। তাকাতেই দেখলাম লোকটি উঠে বসেছে। তার মুখটা অদ্ভুত রকমের সাদা আর বীভৎস দেখাচ্ছিল। তবে তার চোখের দিকে নজর পড়তে বুঝলাম যে, এখন ও অনেকটা প্রকৃতিস্থ হয়েছে। লোকটি নিজের গলায় সন্তর্পণে হাত বোলাচ্ছিল।
“খবরের কাগজ। ঠিকই তো!” শার্লক হোমস চেঁচিয়ে উঠল, “আমি একটা ইডিয়ট, গাধা। এখানে আসবার আগে ব্যাপারটা নিয়ে আমি এত ভাবছিলাম যে, কাগজটা আমার নজরেই পড়েনি। ঠিক রহস্যের মূল চাবিকাঠি নিশ্চয়ই এই খবরের কাগজেই আছে। হোমস খবরের কাগজটা টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
“ওয়াটসন, দেখো, দেখো,” হোমস চেঁচিয়ে বলল, “এটা একটা লন্ডনের কাগজ। ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের প্রভাতী সংস্করণ। এই তো এই তো, যে খবরটা আমরা চাইছিলাম। খবরের শিরোনামটা দেখো, ‘শহরে বিরাট অপরাধ। মসন অ্যান্ড উইলিয়াম কোম্পানির অফিসে খুন! বিরাট চুরির চেষ্টা! অপরাধী ধরা পড়েছে!’ ওয়াটসন, আমরা সকলেই কী হয়েছে জানতে ভীষণ উৎসুক। কাগজের খবর তুমি আমাদের জোরে জোরে পড়ে শোনাও।”
দুপুরে শহরে রোমহর্ষক চুরি! একজনের মৃত্যু। অবশেষে আসামি গ্রেফতার। কিছুকাল যাবৎ শহরের সবচেয়ে নামী বাণিজ্যিক আপিস মসন অ্যান্ড উইলিয়ামস কোম্পানি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দামি নথিপত্র, শেয়ার কাগজ, বন্ড—যার দাম দশ লক্ষ স্টার্লিংয়েরও বেশি হবে, নিজেদের কাছে জমা রেখে আসছেন। অফিস কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিরাট দায়িত্ব সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন। আর সেই জন্যে সবচেয়ে আধুনিক ধরনের সিন্দুক তো তাঁরা এনেছেন বটেই, তার ওপর বন্দুকধারী পাহারাওয়ালাও রেখেছেন। তারা চব্বিশ ঘণ্টা অফিসের চার পাশে টহল দেয়। খবর পাওয়া গেছে যে, গত সপ্তাহে মিঃ হল পাইক্রফট নামে একজন এই কোম্পানিতে কেরানি হিসেবে যোগ দেয়। পুলিশ জানতে পেরেছে যে, এই পাইক্রফট আর কেউ নয়, নামকরা জালিয়াত বেডিংটন। যে-কোনও ধরনের তালা বা সিন্দুক খুলতে বেডিংটনের জুড়ি নেই। বেডিংটন আর তার ভাই টানা পাঁচ বছর জেলে ঘানি টেনে মাত্র অল্প কিছুদিন আগে ছাড়া পেয়েছে। যে-কোনও ভাবেই হোক, বেডিংটন বেনামে দরখাস্ত করে মসন কোম্পানিতে চাকরিটা জোগাড় করে। ঠিক কী ভাবে যে সে চাকরিটা বাগায় তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি। তবে এই চাকরির সুযোগ নিয়ে সে অফিসের সিন্দুকের তালাগুলো কী ধরনের, স্ট্রং-রুমটাই বা কোথায় সব খবর জেনে নেয়।
শনিবার দিন মসন কোম্পানির অফিস বারোটায় ছুটি হয়ে যায়। তাই পুলিশ সার্জেন্ট টসন যখন একটা কুড়ি মিনিটের সময় থলি হাতে একজন লোককে মসন কোম্পানির অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেন, তখন তাঁর মনে খটকা লাগে। সার্জেন্ট লোকটির পিছু নেন। পরে কনস্টেবল পোলকের সাহায্যে তাকে ধরে ফেলেন। লোকটি অবশ্য সহজে ধরা দেয়নি। সার্জেন্ট টসন আর কনস্টেবল পোলকের সঙ্গে প্রাণপণে যুঝে শেষকালে সে ধরা দেয়। সার্জেন্ট টসন অনুমান করেন যে, মসন কোম্পানিতে একটা বড় রকমের চুরি হয়েছে। লোকটির কাছ থেকে প্রায় এক লক্ষ পাউন্ড মূল্যের শেয়ার ও বন্ড পাওয়া যায়। এরপর পুলিশ কোম্পানির ঘর তল্লাশি করে। সেখানে একটা সিন্দুকের মধ্যে মৃত অবস্থায় এক প্রহরীকে পাওয়া যায়। ভারী কোনও কিছু দিয়ে মাথার পিছনে জোরে আঘাত করায় তার মৃত্যু হয়েছে। মৃতদেহটা এমন ভাবে রাখা ছিল যে, সোমবার দিন অফিস না খোলা পর্যন্ত সেটি কারও চোখে পড়ত না। পুলিশের অনুমান, অফিস ছুটি হয়ে যাবার পর বেডিংটন এসে ওই দরোয়ানকে বলে সে একটা জিনিস ফেলে গেছে। দরোয়ান তার কথায় বিশ্বাস করে তাকে অফিস ঘরে ঢুকতে দিলে সে দরোয়ানকে খুন করে। তারপর সিন্দুক আর স্ট্রং-রুমের চাবি ভেঙে জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসে। সার্জেন্ট টসনের মনে সন্দেহ না হলে ব্যাপারটার এত তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি তো হতই না, আর বেডিংটনকেও চট করে ধরা যেত না। বেডিংটনেরা দুই ভাই। তারা সব সময়ে একসঙ্গে কাজ করে। আশ্চর্যের কথা, এ ব্যাপারে তার ভাইয়ের কোনও হাত আছে কিনা তা জানা যায়নি। পুলিশ অবশ্য তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এতক্ষণ একটানা চেঁচিয়ে পড়ে আমি চুপ করলাম।
মেঝেয় বসে-থাকা লোকটিকে দেখিয়ে হোমস বলল, “এখন আমরা পুলিশের কাজ অবশ্যই খানিকটা হালকা করে দিতে পারি।…তবে ওয়াটসন, মানুষের স্বভাব কী অদ্ভুত! রাহাজানি জালিয়াতি খুন করতে এদের বাধে না, কিন্তু নিজের ভাই পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, খুন করার জন্যে তার ফাঁসি হবে জেনে এ লোকটা গলায় দড়ি দিয়ে মরতে যাচ্ছিল।…যাই হোক, এ ব্যাপারে আমাদের আর কিছু করবার নেই। মিঃ পাইক্রফট, আপনি থানায় খবর দিন। আমি আর ওয়াটসন একে ততক্ষণ পাহারা দিই।”
