লালচুল সমিতি (শার্লক হোমস) – আর্থার কোনান ডয়েল
এক
এই ঘটনাটা ঘটেছিল গত বছরের শরৎকালের গোড়ায়। একদিন শার্লক হোমসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখি যে, সে বেশ মোটাসোটা লালমুখ এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে খুব নিবিষ্ট হয়ে কথাবার্তা বলছে। আমার চোখ পড়ল ভদ্রলোকের মাথার দিকে। তাঁর মাথার চুল একদম টকটকে লাল। অসময়ে এসে পড়ে তাঁর কাজের অসুবিধে ঘটানোর জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করতেই হোমস আমাকে প্রায় একরকম জোর করেই ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
শার্লক হোমস খুশি খুশি গলায় বলে উঠল, “ওয়াটসন, বড় ভাল সময়ে এসে পড়েছ।”
“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে, তুমি কোনও জরুরি কাজে ব্যস্ত রয়েছ।”
“ঠিক ধরেছ। খুব জরুরি কাজে ব্যস্ত রয়েছি।”
“তা হলে আমি না হয় ততক্ষণ পাশের ঘরে বসিগে।”
“আরে ব্যাপারটা জরুরি বলেই তো বলছি যে, তুমি এসে পড়ায় বেশ ভাল হল।”
তারপর সেই ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে হোমস বলল, “মিঃ উইলসন, ইনি আমার সহকারী ডাঃ ওয়াটসন। এঁর সাহায্যে আমি অনেক জটিল সমস্যার সুচারু সমাধান করেছি। মনে হচ্ছে যে আপনার এই রহস্যের তদন্তেও এঁর সাহায্য আমার দরকার হবে।”
হোমসের কথায় ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে উঠে হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকালেন। বেশ মাংসল ভারী মুখ। ছোট ছোট গোল চোখ চর্বিতে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে।
“ওয়াটসন, তুমি ওই সোফাটায় বোসো।”
হোমস তার নিজের আরামকেদারায় আধশোয়া হয়ে তার অভ্যাসমতো দু’হাতের আঙুলের ডগাগুলো ঠেকাতে লাগল।
“ওয়াটসন, তোমার সঙ্গে আমার চরিত্রের মিল কোথায় জানো? আমাদের একঘেয়ে প্রাত্যহিক জীবনের বাঁধা রুটিনের বাইরে যে-সব অদ্ভুত, অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে, তার প্রতি আমাদের দু’জনেরই একটা টান দুর্বলতা যা-ই বলা আছে। আর তা না হলে তুমি আমার এই সব সামান্য রহস্য সমাধানের ঘটনাগুলো অত যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতে না। ঠিক কিনা বলো?”
আমি বললাম, “তুমি তো জানো যে, রহস্যের সমাধানে তোমার যে কৌশল—যা আসলে তোমার অসামান্য বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ শক্তি আর বিশ্লেষণক্ষমতা—তা আমার কী রকম ভাল লাগে।”
আমাকে বাধা দিয়ে হোমস বলল, “তোমার বোধহয় মনে আছে, মিস মেরি সাদারল্যান্ডের অত্যন্ত সহজ সরল সমস্যাটা তদন্ত করবার সময়ে কথাপ্রসঙ্গে তোমাকে বলেছিলাম যে, আমাদের চারপাশে রোজই এমন সব অদ্ভুত, এমন সব আশ্চর্য ঘটনা ঘটে চলেছে যা কল্পনাই করতে পারা যায় না। সত্যি কথা বলতে কী, বাস্তব জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা অভিনবত্বে কাল্পনিক রহস্যকাহিনীকেও হার মানায়।”
“হ্যাঁ। আমার মনে আছে। আর এও মনে আছে যে, এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত হতে পারিনি।”
“কিন্তু ডাক্তার, শেষ পর্যন্ত তোমাকে আমার কথা মেনে নিতেই হবে। আমি তোমার সামনে একটার পর একটা এমন অকাট্য প্রমাণ এমন নির্ভুল তথ্য এনে হাজির করব যে, শেষকালে ওই প্রমাণ আর তথ্যের চাপে তোমার সব যুক্তি ভেঙে একদম টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এই মিঃ জাবেজ উইলসনের কথাই ধরো না। ইনি আমাকে এঁর জীবনের খুব সম্প্রতি-ঘটা এক অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন। এ রকম অদ্ভুত ব্যাপার আমি আগে কখনও শুনিনি। আমি তোমাকে অনেকবার বলেছি যে, বড় বড় খুন, ডাকাতি বা ওই ধরনের অপরাধমূলক ঘটনার ভেতরে কোনও নতুনত্ব বা চমক থাকে না। কিন্তু ছোটখাটো অনেক ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেক সময়ে খুব বিপদে পড়তে হয়। কখনও কখনও এমনও হয়, এই সব অতি সাধারণ ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে এত তুচ্ছ বলে মনে হয় যে, সেগুলির সঙ্গে কোনও দুষ্কর্মের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ আছে বলে ভাবতেই পারা যায় না। এতক্ষণ পর্যন্ত মিঃ উইলসনের মুখে ওঁর কথা যতটা শুনেছি তাঁর থেকে এ ব্যাপারটা আদৌ কোনও অপরাধমূলক ঘটনা কিনা সে সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ হতে পারছি না। তবে ওঁর অভিজ্ঞতা যে দারুণ ইন্টারেস্টিং সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মিঃ উইলসন, আপনি যদি দয়া করে আপনার বক্তব্য আর একবার গোড়া থেকে বলেন তো খুব ভাল হয়। ভাববেন না যে ডাঃ ওয়াটসনকে শোনাবার জন্যে আবার আপনাকে সব কথা বলতে বলছি। আমি নিজেই এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিবরণ আপনার মুখ থেকে আবার শুনতে চাই, যাতে সামান্যতম কোনও সূত্রও আমার নজর এড়িয়ে না যায়।
“সাধারণত আমি যখন কোনও সমস্যার কথা শুনি তখন সর্বদা চেষ্টা করি সেই ঘটনার মধ্যে থেকে এমন কোনও সূত্র বের করতে, যার সঙ্গে আমার জানা কোনও ঘটনার মিল আছে। আর যখনই সে রকম কোনও সূত্র পেয়ে যাই, তখনই আমার জানা ওই ধরনের হাজার হাজার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করে আমি ওই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করি। কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে, আপনার এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করা যায়, এমন কোনও ঘটনার কথা আমার জানা নেই।”
হোমসের কথা শুনে সেই শাঁসেজলে চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি বেশ একটু গর্বিত ভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে তাঁর কোটের পকেট থেকে একটা বহু-ভাঁজ-করা ময়লা খবরের কাগজ বের করলেন। তারপর সেই কাগজটা তাঁর হাঁটুর ওপর সম্পূর্ণ বিছিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠায় কী যেন খুঁজতে লাগলেন। আর সেই সুযোগে আমিও ভদ্রলোককে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। ইচ্ছে, হোমসের পদ্ধতির নকলে আমিও ভদ্রলোক সম্বন্ধে কিছু আন্দাজ করতে পারি কিনা দেখা।
আমাদের মক্কেলের চেহারা, পোশাক, হাবভাব অবিকল আর-পাঁচজন ব্রিটিশ ব্যবসাদারের মতোই। গোলগাল, ধীর-স্থির, চোখেমুখে একটু মুরুব্বিয়ানার ভাব। তাঁর পরিধানে চেককাটা ঢোলা ট্রাউজার্স, আধময়লা ফ্রক-কোটের বুকের বোতামগুলো খোলা। তার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে ময়লা ওয়েস্টকোট আর তাতে একটা মোটা তামার অ্যালবার্ট চেন। চেনের থেকে একটা চৌকো আকারের ধাতব পদার্থ ঝুলছে। তাঁর টপহ্যাটটা বহুদিনের ব্যবহারে বেশ জীর্ণ হয়ে গেছে। আর চেয়ারের ওপরে রাখা তাঁর ওভারকোটের খয়েরি রংটা একদম চটে গেছে। খুব খুঁটিয়ে দেখেও তাঁর অস্বাভাবিক লাল রঙের চুল আর চোখে মুখে হতাশা এবং বিরক্তি ছাড়া কিছুই লক্ষ করলাম না।
হঠাৎ খেয়াল হল যে, শার্লক হোমস আমাকে দেখছে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে হেসে বলল, “এই ভদ্রলোককে জীবনের এক সময়ে কঠোর শারীরিক শ্রম করতে হয়েছে। এঁর নস্যি নেবার অভ্যেস আছে। ইনি ফ্রি-মেসন দলের সভ্য। চিনদেশে ঘুরে এসেছেন। আর সম্প্রতি খুব লেখালেখির কাজ করছেন। এর বাইরে আমি আর কিছু জানতে পারিনি।”
ভয়ানক রকম চমকে উঠে মিঃ জাবেজ উইলসন শার্লক হোমসের দিকে তাকালেন।
“কী আশ্চর্য! এসব কথা আপনি কেমন করে জানলেন বলুন তো? মিঃ হোমস, আপনি কি ম্যাজিক জানেন ? সত্যি করে বলুন তো কী করে জানলেন যে, আমি শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতাম। ঠিক বলেছেন, এক সময়ে আমি জাহাজ তৈরির কারখানায় ছুতোরের কাজ করতাম।”
“যে-কেউ আপনার হাতের দিকে ভাল করে লক্ষ করবে সেই বুঝবে যে আপনার ডান হাতের পেশি বাঁ হাতের পেশির চেয়ে মোটা, প্রায় এক সাইজ বড়। এটা তখনই হতে পারে যদি আপনি আপনার ডান হাতকে বাঁ হাতের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করিয়ে থাকেন।”
“বুঝলাম। কিন্তু নস্যি নেওয়ার আর ফ্রি-মেসন সংস্থার ব্যাপারটা কী করে জানলেন?”
“সে কথা খুলে বলব না। বললে আপনার বুদ্ধির অপমান করা হবে। বিশেষত আপনি যখন আপনার দলের সুস্পষ্ট নিয়ম না মেনে বুকে ওই রকম ‘টাই-পিন’ লাগিয়েছেন।
“ও হো! এইটের কথা আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু লেখার কথা আপনি কী করে বুঝলেন?”
“আপনার ডান হাতের জামার কাছে প্রায় পাঁচ-ইঞ্চি পরিমাণ খুব চকচকে আর বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছে একটা বেশ মোটা গোল দাগ পড়েছে .ডেস্ক বা টেবিলের ওপর ভর দিয়ে রাখার জন্যে।”
“এটাও বোঝা গেল। কিন্তু চিনে যাওয়ার ব্যাপারটা ?”
“আপনার ডান হাতের কবজির ঠিক ওপরে একটা মাছের উলকি আঁকা রয়েছে। ওই ধরনের মাছ শুধুমাত্র চিনদেশেই আঁকা হয়ে থাকে। বিচিত্র ধরনের উলকি আঁকার পদ্ধতির ওপর আমার কিছু পড়াশোনা আছে। এ বিষয়ে আমি একটা পুস্তিকাও লিখেছি। ওই মাছের আঁশে যে খুব ফিকে গোলাপি রং দেওয়া হয়েছে তা একমাত্র চিনে শিল্পীরাই পারে। আমি আরও নিশ্চিত হলাম যখন দেখলাম আপনার ঘড়ির চেনে একটা চিনের মুদ্রা লাগানো।”
হোমসের কথা শুনে মিঃ উইলসন খুব একচোট হেসে বললেন, “সত্যি প্রথমটায় আপনি আমাকে খুব ঘাবড়ে দিয়েছিলেন। আমি তো থ। ভাবছিলাম কী অলৌকিক কাণ্ড! এখন দেখছি সবটাই তো জলবৎ তরল।”
“বুঝলে ওয়াটসন, সবাইকে সব কথা খুলে বলে আমি বোধহয় আমার নিজের ক্ষতি করছি। লোকে যে-জিনিসটা বুঝতে পারে না সেটাকে খুব বড় করে দেখে। এই রকম করে সকলকে সব কথা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বললে বাজারে আমার যে সামান্য খাতির আর খ্যাতি হয়েছে তা দু’দিনে তলিয়ে যাবে।…আপনি কি সেই বিজ্ঞাপনটা খুঁজে পেলেন, মিঃ উইলসন।”
“হ্যাঁ। এই যে।” তিনি বিজ্ঞাপনের কলমের একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখালেন। “এই সেই বিজ্ঞাপন। আপনি নিজেই পড়ন,” বলে মিঃ উইলসন কাগজটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
আমি তাঁর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে বিজ্ঞাপনটা পড়লাম। বিজ্ঞাপনটা এই রকম:
লালচুল সমিতির সদস্যদের জন্য
আমেরিকার পেনসিলভানিয়া রাজ্যের লেবানন শহরের পরলোকগত এজেকিয়া হপকিনসের প্রদত্ত টাকায় সমিতির সদস্যদের জন্য সাপ্তাহিক চার পাউন্ড বেতনের একটি চাকরির সুযোগ করা সম্ভব হয়েছে। কাজ খুবই সামান্য। পাঁচিশ বছর বয়সের ওপর সমস্ত লালচুল লোক যারা শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ ও সক্ষম তারা সকলেই প্রার্থী হতে পারে। সোমবার বেলা এগারোটার পরে ৭ নং পোপস কোর্টে, ফ্লিট স্ট্রিটে সমিতির সদর দফতরে মিঃ ডানকান রসের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ করতে হবে।
বিজ্ঞাপনটা আগাগোড়া বারদুয়েক পড়েও মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। হোমসকে জিজ্ঞেস করলাম, “এর মানে কী?”
“ব্যাপারটা খুবই অভিনব নয় কি?” বলে হোমস মুচকি হেসে তার আরামকেদারায় দুলতে লাগল। আমি জানি যে যখন কোনও কারণে হোমস খুব খুশি হয় তখনই সে এই রকম দোল খেতে খেতে মুচকি হাসে। তার এত খুশি হওয়ার কারণ কী?
তারপর মিঃ উইলসনের দিকে তাকিয়ে হোমস বলল, “এবার আপনার কথা বলুন। একদম গোড়া থেকে বলবেন। কোনও কিছু বাদ দেবেন না। আপনার নিজের কথা, আপনার সংসারের কথা, কী ভাবে এই বিজ্ঞাপনটা আপনার নজরে পড়ল, এটা পেয়ে আপনার কী মনে হল, সব কথা খুলে বলবেন।…তার আগে, ওয়াটসন, বিজ্ঞাপনটা কত তারিখে কোন কাগজে বেরিয়েছিল দেখো তো।”
“এটা বেরিয়েছিল ‘দি মর্নিং ক্রনিকল’ পত্রিকায়। আর তারিখ হচ্ছে ২৭ এপ্রিল, ১৮৯০। অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক দু’ মাস আগে।”
“বেশ।…মিঃ উইলসন, এবার আপনি বলতে শুরু করুন।”
রুমাল দিয়ে ঘাড়-মুখ মুছতে মুছতে মিঃ উইলসন বলতে লাগলেন, “আপনাকে তো বলেছি মিঃ শার্লক হোমস যে, আমার একটা ছোট বন্ধকির কারবার আছে। কোবুর্গ স্কোয়ারে আমার দোকান। কারবার আমার সামান্যই। ইদানীং কারবারে বেশ মন্দা যাচ্ছে। যা আয় হয় তাতে আমার কোনও রকমে চলে যায়। আগে আমার দোকানে দু’জন কর্মচারী ছিল। এখন একজন আছে। যে আছে তাকে যদি পুরো মাইনে দিতে হত তা হলে তাকে রাখা সম্ভব হত কিনা জানি না। নেহাত বন্ধকি কারবার শেখবার আগ্রহেই সে কম মাইনেতে কাজ করতে রাজি হয়েছে।”
হোমস বলল, “তা এই ভালমানুষ ছেলেটার নাম কী?”
“ভিনসেন্ট স্পলডিং। না, আপনি যেরকম ভাবছেন সেরকম বাচ্চা ছেলে নয়। অবশ্য ওর বয়স কত তা ঠিক আমি জানি না। কিন্তু বেশ চালাকচতুর ও চটপটে। আমি জানি, ও যেরকম কাজের ছেলে তাতে ও যদি অন্য কোথাও কাজ করত তা হলে আমার কাছে যা পাচ্ছে তার দ্বিগুণ পেতে পারত। কিন্তু ও যদি এই অল্প মাইনেতে সুখী থাকে তো এসব কথা বলে ওর মাথা খারাপ করে দেওয়ার কোনও মানে হয় কি?” বলে মিঃ উইলসন আমাদের দিকে তাকালেন।
“সে তো বটেই। তবে আপনার কর্মচারী-ভাগ্য খুবই ভাল বলতে হবে। এ যুগে ক’জন মালিক এ রকম কর্মচারী পায়? এ তো যাকে বলে বামুনের গোরু। খাবে কম, দুধ দেবে বেশি। আপনার এই কর্মচারীটি আপনার ওই লালচুল সমিতির বিজ্ঞাপনের চেয়ে কোনও অংশে কম অদ্ভুত নয়।”
শার্লক হোমসের কথার উত্তরে মিঃ উইলসন বললেন, “তা বলে ভাববেন না যে, ও একেবারে দেবদূত, কোনও দোষ নেই। ছবি তোলার নেশায় ও একেবারে বুঁদ হয়ে আছে। একটু ফুরসত পেলেই ছবি তুলবে আর আমার বাড়ির তয়খানায় নেমে গিয়ে ফিলম ডেভেলপ করতে লেগে যাবে। এই এক দোষ ছাড়া ওর আর কোনও দোষ নেই। কাজের লোক। হাতটান নেই।”
“ও কি এখনও আপনার কাছেই কাজ করছে?” শার্লক হোমস প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ। আমার সংসার বলতে তো আমি, ওই ভিনসেন্ট আর একটি অল্প বয়সি মেয়ে। সে আমাদের ঘরদোর পরিষ্কার করে, রান্নাবান্না করে। আমার স্ত্রী মারা গেছেন অনেকদিন আগে। আমার কোনও ছেলেমেয়ে নেই। আমাদের এই ছোট সংসারে কোনও গণ্ডগোল নেই। হঠাৎ মাসদুয়েক আগে একদিন ভিনসেন্ট এই খবরের কাগজখানা নিয়ে দোকানে হাজির হল।
‘ও হো মিঃ উইলসন, যদি কোনও ফুসমন্তরে আমার চুলের রং লাল হয়ে যেত তো কী ভালই না হত।’
‘এ কথা কেন বলছ ভিনসেন্ট ?’
‘কেন বলছি? এই তো আজকের কাগজেই লালচুল সমিতির একটা চাকরির বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। ওঃ, যার বরাতে এই চাকরিটা জুটবে সে ফোকটে বেশ মোটা টাকা পেয়ে যাবে। আমি শুনেছিলাম যে ওদের নাকি যত সদস্য তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি টাকা আছে। ওরা নাকি টাকা কী ভাবে খরচ করবে ভেবে পায় না। তাই তো বলছি যে, যদি ভগবানের দয়ায় আমার সব চুল এই মুহূর্তে টকটকে লাল হয়ে যায় তো কে বলতে পারে যে ওই চাকরির শিকেটা আমার ভাগ্যে ছিঁড়বে না।?’
“এখন আসল কথা কী জানেন মিঃ হোমস, আমি খুব ঘরকুনো প্রকৃতির লোক। আর তার ওপর আমাদের ব্যবসাটাও এমন যে, আমাদের তো কারবারের খাতিরে বাইরে যেতেই হয় না, উলটে খদ্দেররাই আমার কাছে আসে। তার ফলে কখনও কখনও এমন হয় যে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাড়ির চৌকাঠের বাইরে যাওয়া হয় না। তাই বাইরের জগতের খবরাখবর আমি বিশেষ রাখি না। সেই জন্যে ভিনসেন্টের কথায় আমার কৌতুহল হল।
“আমার কথায় বেশ আশ্চর্য হয়ে ভিনসেন্ট বলল, ‘সে কী! আপনি এর আগে লালচুল সমিতির নাম শোনেননি?’
‘না তো।’
‘ভারী আশ্চর্যের কথা। আরে আপনি নিজেই তো ওই চাকরিটার জন্যে আবেদন করতে পারেন।’
‘পয়সাকড়ি কী রকম দেবে?’
‘তা বছরে দু’শো পাউন্ড তো দেবেই। আর কাজও নাকি খুব হালকা। নিজের অন্যান্য কাজকর্মের ক্ষতি না করে এই চাকরি করা সম্ভব হবে।’
“আপনারা বুঝতেই পারছেন যে, এ কথা শুনে আমার খুব আগ্রহ হল। মনে হল যে, ব্যবসায় এই মন্দার সময়ে যদি উপরি দুশো পাউন্ড আয় করা যায় তো মন্দ কী? তাই আমি ভিনসেন্টকে বললাম আমাকে সব কথা খুলে বলতে।
“আমাকে বিজ্ঞাপনটা দেখিয়ে ভিনসেন্ট বললে, ‘এই ঠিকানায় গিয়ে খোঁজ করলেই আপনি সব কথা জানতে পারবেন। আমি যা জানি তা হল এজেকিয়া হপকিনস বলে এক পাগলাটে আমেরিকান কোটিপতি এই সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন। এঁর নিজের মাথার চুল লাল ছিল বলে লালচুল লোকেদের প্রতি এঁর একটা আন্তরিক টান ছিল। ইনি এঁর স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি এই সমিতিকে দান করে গেছেন লালচুল লোকেদের সাহায্যের জন্যে। এখন এই সমিতির পরিচালন-ভার পড়েছে এক ছোট কমিটির ওপর। এই কমিটি সঞ্চিত অর্থের টাকা খরচা করে লালচুলদের উপকারের জন্যে। আমি যতদূর শুনেছি কাজ নামমাত্র, তবে মাইনে ভাল।’
“আমি বললাম, ‘কিন্তু লালচুল লোকের সংখ্যা তো কিছু কম নয়। প্রচুর লোক আবেদন করবে।’
‘আপনি যত লোক ভাবছেন, তত লোক নিশ্চয়ই নেই। আর তা ছাড়া দরখাস্ত করতে গেলে বয়স পঁচিশের ওপরে এবং লন্ডন শহরের বাসিন্দা হতে হবে। এই আমেরিকান ভদ্রলোক প্রথম জীবন কাটিয়ে ছিলেন এই আমাদের লন্ডনে। তাই তাঁর উইলে স্পষ্ট নির্দেশ আছে যে, লন্ডন শহরের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা ছাড়া চুলের রং তো যেমন-তেমন হলে হবে না। একদম টকটকে লাল হতে হবে। আমার মনে হয় আপনি যদি আবেদন করেন তো চাকরিটা আপনারই হবে। অবশ্য তাঁর আগে ভাবতে হবে যে মাত্র কয়েকশো পাউন্ডের জন্যে বাড়ির বাইরের কোনও কাজ করতে যাওয়া আপনার পোষাবে কিনা’।’
এই পর্যন্ত বলে মিঃ উইলসন আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা তো দেখতে পাচ্ছেন আমার চুল কী রকম গাঢ় লাল। তাই ভাবলাম একবার দেখাই যাক না। প্রতিযোগিতায় যে আমি প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ব না সে বিশ্বাস আমার ছিল। ভিনসেন্ট যখন ব্যাপারটা সম্বন্ধে এতই ওয়াকিবহাল তখন ও আমাকে হয়তো খানিকটা সাহায্য করতে পারে এই ভেবে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে বলে ওকে আমার সঙ্গে আসতে বললাম। হঠাৎ এ রকম ছুটি পেয়ে ও তো খুবই খুশি হল। দোকান বন্ধ করে আমরা বিজ্ঞাপনে যে ঠিকানা দেওয়া ছিল সেই দিকে রওনা হলাম।
“সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। এ রকম দৃশ্য অতীতে কখনও দেখিনি, আর ভবিষ্যতেও দেখব কিনা সন্দেহ। লন্ডন শহরের উত্তর-দক্ষিণ পুব-পশ্চিম চারদিক থেকে যার চুলে একটু লালের আভামাত্র আছে এমন সব লোক সেখানে এসে হাজির। গোটা ফ্লিট স্ট্রিট জুড়ে কেবল লালমাথা আর লালমাথা। আর পোপস কোর্টকে দেখাচ্ছিল ঠিক যেন এক ফলওয়ালার বৃহৎ কমলালেবু ভরতি ঝুড়ি। ওই বিজ্ঞাপন দেখে যে অত লোক হাজির হবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আর তাদের চুলেরও কত বিচিত্র রং। কারও বা চুলের রং খড়ের মতো, কারও বা ইঁটের মতো, কারও বা লেবুর মতো, কারও বা মেটের মতো, কারও বা মাটির মতো। কিন্তু ভিনসেন্ট যা বলেছিল খুব কম লোকের চুলই আমার মতো গাঢ় টকটকে লাল। আমি ওই ভিড় দেখে পালিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভিনসেন্ট কিছুতেই আমাকে ফিরে আসতে দিল না। ভিনসেন্টের আচ্ছা কেরামতি। ওই ভিড়ের মধ্যে একে পাশ কাটিয়ে, তাকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে, ওর বগলের তলা দিয়ে আমাকে নিয়ে সে আপিসের দরজায় এসে হাজির হল। সেখানে গিয়ে দেখি দু’দল লোক সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একদল সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, তাদের সকলের মুখ উৎসাহ আর আশায় চকচক করছে। আর একদল সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। তাদের কারও মুখ বেজার, কারও কারও মুখে গভীর হতাশা। যাক, কোনওমতে তো আমরা ওই প্রথম সারি মানে ওপরে ওঠবার দলে ঢুকে পড়লাম। আর তারপর এক সময় আপিসঘরের দরজার কাছে পৌঁছে গেলাম।”
এই পর্যন্ত বলে মিঃ উইলসন বেশ বড় এক টিপ নস্যি নাকে গুঁজে দিলেন। সেই সঙ্গে পরের ঘটনাগুলো মনে মনে ঠিক করে সাজিয়ে নিলেন।
দুই
জাবেজ উইলসনের প্রতিটি কথাই খুব মন দিয়ে শুনছিল শার্লক হোমস। ভদ্রলোককে এবারে সে বলল, “আপনার অভিজ্ঞতা খুবই অদ্ভুত, বস্তুত এর কোনও তুলনাই হয় না। আমি যত শুনছি, ততই আমার কৌতুহল বেড়ে যাচ্ছে। আপনি সব খুলে বলুন। কোন তথ্যটা দরকারি আর কোনটা নয়, সে আমি বুঝে নেব। অপ্রয়োজনীয় মনে করে কোনও কিছুই আপনি যেন দয়া করে বাদ দেবেন না।”
“আপিসটা আহামরি কিছু নয়। একটা পাইন কাঠের টেবিল আর গোটাদুয়েক চেয়ার। একটা চেয়ার খালি আর একটায় বসেছিলেন একজন বেঁটেখাটো লোক। দেখলাম তাঁর চুল বোধহয় আমার চেয়েও লাল। তিনি প্রত্যেক প্রার্থীর সঙ্গে দু’-একটা করে কথা বলছেন আর তাদের একটা-না-একটা খুঁত বের করে বিদায় দিচ্ছেন। যাই হোক, এক সময়ে আমাদের পালা এল।
“ভিনসেন্ট আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি মিঃ জাবেজ উইলসন। ইনি আপনাদের লালচুল সমিতির চাকরির জন্যে আবেদন করতে চান।’
“উত্তরে ভদ্রলোক বললেন, ‘বাঃ বাঃ, বেশ বেশ। এঁকে দেখে মনে হচ্ছে এঁর সব রকম যোগ্যতাই আছে।’
“তারপর ভদ্রলোক আমার কাছে সরে এসে দূরে সরে গিয়ে ঘাড় কাত করে নানা ভাবে আমার চুলের দিকে এমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন যে, আমার নিজেরই কেমন লজ্জা করতে লাগল। তারপর তিনি দৌড়ে এসে আমার দু’হাত ধরে ঝাকুনি দিতে দিতে আমাকে অভিনন্দন জানালেন।
‘না। আর বিবেচনা করার কোনও প্রয়োজন নেই। তবে তাঁর আগে আমাকে একটা ছোট্ট পরীক্ষা করতে হবে।’
“আমি কিছু বোঝবার আগেই ভদ্রলোক আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দু’ হাত দিয়ে আমার চুল ধরে এমন জোরে টানতে লাগলেন যে, যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করে উঠলাম।
‘এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ঠেকে শিখেছি মশাই’, ভদ্রলোক বললেন, ‘এর আগে দু’-দু’বার জোচ্চোরের পাল্লায় পড়েছিলাম। একজন এসেছিল চুলে লাল রং লাগিয়ে, আরেকজন লাল পরচুলা পরে এসেছিল।’
“তারপর তিনি জানলা দিয়ে মুখ বের করে চেঁচিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, প্রার্থী মনোনীত হয়ে গেছে। তাঁর কথায় নীচে যারা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল তারা বেশ কিছুক্ষণ হইচই চিৎকার চেঁচামেচি করে শেষকালে হতাশ হয়ে ফিরে গেল।
‘আমার নাম ডানকান রস। আমি নিজেও একজন এই সমিতির বেতনভোগী কর্মী। আপনি নিশ্চয়ই বিবাহিত মিঃ উইলসন? আপনার সংসারে কে-কে আছেন?’
“আমি বিপত্নীক শুনে মিঃ রসের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ‘তা হলে তো একটু মুশকিল হল মিঃ উইলসন। এই সমিতির মূল উদ্দেশ্য হল লালচুল লোকের সংখ্যা বাড়ানো। আর তাদের সংসার যাতে সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকে তাই দেখা। বিপত্নীক হয়ে আপনি তো খুব মুশকিলে ফেলে দিলেন দেখছি।’
“এই কথা শুনে মিঃ হোমস আমি তো খুবই দমে গেলাম। মনে হল এ যে শেষকালে তীরে এসে তরী ডুবল। চাকরিটা ফসকে গেল।
“খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মিঃ রস বললেন, ‘সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম থাকে। আপনার ওই অসাধারণ লালচুলের জন্যে কেবলমাত্র আপনার বেলায় আমরা নিয়মটা একটু শিথিল করব। যাক এখন বলুন কবে নাগাদ আপনি কাজ শুরু করবেন?’
“এবার আমি একটু ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘সামান্য একটু অসুবিধে হচ্ছে…মানে আমার নিজের একটা ছোটখাটো ব্যবসা আছে।’
‘আপনি তাঁর জন্যে মোটেই ভাববেন না। দোকানের দেখাশোনার ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন।’ ভিনসেন্ট বলে উঠল।
‘আমাকে কখন আসতে হবে?’
‘আপনাকে কাজ শুরু করতে হবে সকাল দশটায় আর দুটোর সময়ে ছুটি হবে।’
“এতে মিঃ হোমস আমার খুব সুবিধে হল। আমাদের বন্ধকির কারবার সাধারণত সন্ধের পরেই বেশি হয়। তার মধ্যে আবার বৃহস্পতি-শুক্রবারেই খদ্দেরের ভিড়টা বেশি হয়। কেন না অনেক কলকারখানায় ওই দু’দিন হল মাইনের দিন। তাই সকাল দশটা থেকে বেলা দুটো অবধি কাজ করতে আমার কোনও অসুবিধে নেই। আর তা ছাড়া যদি কোনও ছুটকো খদ্দের ওই সময়ে দোকানে এসে পড়ে তো ভিনসেন্টই তার ব্যবস্থা করতে পারবে।
‘ওই সময়ে কাজ করতে আমার কোনও অসুবিধা হবে না। তা আপনারা মাইনে কী রকম দেবেন?
‘সপ্তাহে চার পাউন্ড।’
‘কাজটা কী?’
‘খুবই হালকা।’
‘তবু কাজের ধরনটা জানতে পারলে ভাল হয়।’
‘বলছি। কিন্তু তার আগে আপনাকে দুটো কথা বলি। প্রথম কথা হল যে, ওই সময়টুকু আপনাকে আপিসে হাজির থাকতেই হবে। কোনও অজুহাতে আপিস ছেড়ে বাইরে যাওয়া চলবে না। বাইরে গেলেই আপনার চাকরি খতম।’
‘চার ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকা আমার পক্ষে এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়।’
‘আরও একটা কথা আছে। চাকরির দ্বিতীয় শর্ত হল কোনও কারণে, সে শারীরিক অসুস্থতা হোক বা অন্য কোনও কাজের জন্যেই হোক, কামাই করা চলবে না। আপনাকে প্রত্যহ আপিসে আসতে হবে ও নির্দিষ্ট সময়ে আপিসে বসে কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে এজেকিয়া হপকিনসের উইলের নির্দেশ খুব পরিষ্কার।’
‘সবই তো শুনলাম। কিন্তু কাজটা কী সেটা তো বলছেন না।’
‘আপনাকে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে নকল করতে হবে। ওই থাকে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার প্রথম খণ্ড রয়েছে। আপনাকে নিজের কাগজ, কালি, কলম আর ব্লটিং পেপার আনতে হবে। ওই টেবিল-চেয়ারে বসে আপনাকে কাজ করতে হবে। আপনি কি আগামী কাল থেকে কাজ শুরু করবেন?’
‘হ্যাঁ,’ আমি বললাম।
‘খুব ভাল কথা। আমি আশা করি যে, এই কাজ আপনার ভাল লাগবে।’ তারপর আমাদের তিনি বিদায় দিলেন। আর আমরাও বাড়ির দিকে পা চালালাম। সেদিন সকাল থেকে পরপর যে-সব কাণ্ড ঘটে গেল তাতে আমার মাথার ঠিক ছিল না। হঠাৎ এই উপরি আয়ের সুযোগ পেয়ে আমার মনে তখন ফুর্তি আর ধরে না। অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার মন কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। কী করেছি কী বলেছি নিজেই মনে করতে পারছি না।
“তারপর বাড়ি ফিরে ঠান্ডা মাথায় সব কথা বার বার চিন্তা করে আমার মনে হল যে, আগাগোড়া সব ব্যাপারটাই বোধহয় বিরাট একটা ধাপ্পা। যদিও এই ধাপ্পার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে তা আমি অনেক ভেবে-চিন্তেও বুঝতে পারলাম না। কেউ যে বিনা কারণে পয়সা খরচা করে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা নকল করাবে এটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভিনসেন্টকে আমার সন্দেহের কথা বলাতে ও অবশ্য আমাকে অনেক ভাবে ব্যাপারটা বোঝাতে চেষ্টা করল। তবুও আমার মনের সন্দেহ গেল না। সে রাত্তিরে শুতে যাবার আগে সমস্ত ব্যাপারটা একটা বাজে ধাপ্পা বলে আমি উড়িয়ে দিলাম।
“পরের দিন ঘুম থেকে উঠতেই গত রাত্রের কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম একবার দেখে আসাই ভাল। তাই বেলা দশটার কিছু আগে একটা নতুন কলম, এক বোতল কালি, ব্লটিং পেপার আর ফুলসক্যাপ কাগজ বগলদাবা করে পোপস কোর্টের দিকে গেলাম।।
“সেখানে হাজির হয়ে দেখি আমি মিথ্যে আশঙ্কা করেছিলাম। সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। আমি যেতেই মিঃ রস আমাকে আমার জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা চেয়ার-টেবিলটা দেখিয়ে কাজে লাগিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে একেবারে ‘A’ থেকে লিখতে বললেন। আমিও সময় নষ্ট না করে লিখতে শুরু করে দিলাম। আমি লিখতে আরম্ভ করেছি দেখে মিঃ রস চলে গেলেন। কাঁটায় কাঁটায় দুটোর সময় মিঃ রস এসে আমার কাজের প্রশংসা করে ও আমাকে শুভকামনা জানিয়ে বিদায় দিলেন। বলতে ভুলে গেছি এই দশটা থেকে দুটোর মধ্যে মিঃ রস অবশ্য বারকয়েক আমার কাজের কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা জানতে এসেছিলেন।
“এই ভাবেই একটা-দুটো করে দিন কাটল। শনিবার দিন ম্যানেজার এসে আমাকে আমার সপ্তাহের মাইনে দিয়ে গেল। তার পরের সপ্তাহেও সাতটা দিন ঠিক একই ভাবে কাটল। একই ভাবে পর পর বেশ কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেল। আমি ঠিক বেলা দশটায় গিয়ে হাজির হলাম, থাকতাম বেলা দুটো অবধি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল যে মিঃ রস আমার কাজের তদারকি করতে আসা কমিয়ে দিলেন। শেষকালে এমন হল যে, ওঁর সঙ্গে আমার আর দেখাই হত না। আমি কিন্তু তাই বলে কখনও চেয়ার ছেড়ে উঠতাম না বা কাজে ফাঁকি দিতাম না। এই উপরি টাকাটা পাওয়ায় আমার খুব সুবিধে হচ্ছিল। তাই আমি মিঃ রসের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতাম।
“একই ভাবে আট আটটা সপ্তাহ অর্থাৎ পুরো দুটি মাস কেটে গেল। ইতিমধ্যে আমি Abbots, Archery, Armos, Architecture শেষ করে Athica পর্যন্ত নকল করে ফেলেছি। আর কয়েকদিন পরেই ‘A’ শেষ হয়ে ‘B’ শুরু হবে। কাগজের জন্যে আমার কিছু খরচ হয়েছে বটে কিন্তু এর মধ্যে আমার লেখায় একটা পুরো শেলফ ভরতি হয়ে গেছে। একদিন হঠাৎ সব গোলমাল হয়ে গেল।”
“মানে?” শার্লক হোমস ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“মিঃ হোমস, সমিতির আপিস বন্ধ হয়ে গেল। আর সেই ঘটনাটা ঘটেছে আজ সকালে। যথারীতি সকাল দশটার সময় কাজ করতে গিয়ে দেখি আপিস ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে আর দরজার পাল্লায় পিন দিয়ে একটা পোস্টকার্ডের আকারে কাগজ লাগানো। এই যে সেই কাগজটা।”
ভদ্রলোক কাগজটা আমাদের দেখালেন। কাগজটা সাধারণ ছোট নোটবুকের কাগজের মতো বলে মনে হল। তাতে এই রকম লেখা—
‘লালচুল সমিতি বন্ধ হয়ে গেল।
৯ অক্টোবর, ১৮৯০।’
ভদ্রলোকের হাতে-ধরা কাগজটা দেখতে দেখতে আমাদের নজর একসঙ্গে পড়ল ভদ্রলোকের মুখের দিকে। আশাভঙ্গ হওয়ায় তাঁর মুখ দেখে শাস্তি পাওয়া লোভী ছেলের কথা মনে হল। আমরা দু’জনে একসঙ্গে জোরে হেসে উঠলাম। সেই মুহূর্তে আমার সমস্ত ব্যাপারটা একটা কৌতুক বলে মনে হল।
আমাদের অকারণ হাসিতে রেগে গিয়ে মিঃ উইলসন বললেন, “এটাতে এত হাসির কী আছে বুঝতে পারলাম না। আর আমার কথায় যদি হাসি ছাড়া অন্য কিছু বলতে বা করতে আপনারা না পারেন তো বলুন আমি উঠি।”
শার্লক হোমস তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “না, না মিঃ উইলসন, আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না। আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আপনার এ ব্যাপারটা তদন্ত করবার ভার আমি নিলাম। তবে এ কথাও আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে, ব্যাপারটা বেশ মজারও বটে।” সে কথা থাক। এখন বলুন ওই নোটিশটা দেখে আপনি কী করলেন।”
“আমি তো বুঝলেন একেবারে হতভম্ব। কী করা উচিত তাই ভেবে ঠিক করতে পারছিলাম না। ওই বাড়িতে আরও যে-সব আপিস রয়েছে সেখানে খোঁজ করেও কোনও হদিস পেলাম না। অনেক ভেবেচিন্তে মনে হল যে, বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করলে হয়তো কিছু খবর পাওয়া যেতে পারে। বাড়িওয়ালা একতলায় থাকেন। তাঁর কাছে খোঁজ করাতে তিনি বললেন যে, লালচুল সমিতি বা ওই ধরনের কোনও কিছুর কথা তাঁর জানা নেই। ডানকান রসের নাম করাতে তিনি বললেন যে, ওই নামের কাউকে তিনি চেনেন না। তখন আমি বললাম, “ওই যিনি চার নম্বর ফ্ল্যাটে থাকতেন—’
‘কে? ওই লালচুল ভদ্রলোক ?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাই বলুন। তাঁর নাম তো মিঃ উইলিয়ম মরিস। তিনি তো একজন সলিসিটর। তাঁর নিজের অফিসঘর তৈরি হয়নি বলে কয়েক সপ্তাহের জন্যে আমার ওই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিলেন। এই তো গতকালই তিনি আমার ফ্ল্যাট ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠে গেলেন।’
‘আচ্ছা, কোথায় গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে বলতে পারেন?’
‘আপনি তাঁর নতুন আপিসে গিয়ে দেখা করুন। মিঃ মরিস তাঁর নতুন আপিসের ঠিকানা আমার কাছে দিয়ে গেছেন। এই তো তাঁর ঠিকানা ১৭ নং কিং এডোয়ার্ড স্ট্রিট। জায়গাটা সেন্ট পলসের কাছেই।’
“আমি তো মিঃ হোমস, সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা গেলাম ১৭ নং কিং এডোয়ার্ড স্ট্রিটে। সেখানে গিয়ে কী দেখলাম জানেন ? সেটা একটা ছোট কারখানা। সেখানে কেউই মিঃ রস বা মিঃ মরিস বলে কোনও লোককে চেনে না।”
“তখন আপনি কী করলেন মিঃ উইলসন,” হোমস প্রশ্ন করল।
“তখন আর কী করব। বাড়ি ফিরে এলাম। ভিনসেন্টকে সব কথা বললাম। সেও খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। তারপর বোধহয় আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই বলল যে, হয়তো ডাক মারফত কোনও খবর আসতে পারে। কিন্তু ওর কথা আমি মেনে নিতে পারলাম না। আমার কেমন একটা জেদ চেপে গেল। ব্যাপারটা কী আমাকে জানতেই হবে। কী করব ভাবতে ভাবতে আমার আপনার কথা মনে পড়ল। আমি অনেকের কাছে শুনেছি যে, আমাদের মতো গরিব লোকদের বিপদেআপদে আপনি নানা ভাবে সাহায্য করেন। তাই সোজা আপনার কাছে চলে এলাম।”
“খুব ভাল করেছেন। আপনার ব্যাপারটায় আমি বেশ আগ্রহ বোধ করছি। এ ‘কেস’টা আমি নিলাম। যতটুকু শুনলাম তাতে মনে হচ্ছে যে, ব্যাপার বেশ গুরুতর।”
“নিশ্চয়ই গুরুতর। আমার সপ্তাহে চার চার পাউন্ড আয় কমে গেল বলে কথা।”
অল্প হেসে হোমস বলল, “কিন্তু এই অভিনব সমিতির ওপর আপনার তো রাগের কোনও কারণ নেই। এরা তো আপনার কোনও অনিষ্ট করেনি। উলটে আপনি যে শুধু বত্রিশ পাউন্ড আয় করেছেন তাই নয়, এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে নকল করে নানান বিষয়ে আপনার জ্ঞান কত বেড়েছে বলুন তো?”
“সে কথা অবশ্য ঠিক। কিন্তু তবু কী জানেন, আমাকে জানতেই হবে এরা কে। আর কেনই বা শুধু শুধু বত্রিশ পাউন্ড খরচা করে তারা আমার সঙ্গে এ ধরনের রসিকতা—যদি অবশ্য এটাকে রসিকতা বলা যায়—করল।”
“আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আপনি পরে পাবেন। তার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন তো। আমার প্রথম প্রশ্ন: আপনার ওই ভিনসেন্ট স্পলডিং, যে আপনাকে ওই বিজ্ঞাপনটা দেখায় সে কতদিন আপনার ওখানে কাজ করছে।”
“ও তার প্রায় মাসখানেক আগে থেকে কাজে লেগেছে।”
“আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, ও আপনার চাকরিতে ঢুকল কী করে?”
“আমি কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। সেই বিজ্ঞাপন দেখে ও দরখাস্ত করেছিল।”
“বেশ। এবার তিন নম্বর প্রশ্ন। ওই কি একমাত্র দরখাস্ত করেছিল ?”
“না! তা কেন হবে? প্রায় জনা-চোদ্দো দরখাস্ত করেছিল।”
“বেশ। আপনি ওকে নিলেন কেন?”
একটু হেসে মিঃ উইলসন বললেন, “দুটো কারণে। প্রথমত ওকে দেখে বেশ চটপটে আর কাজের লোক বলে মনে হল। আর দ্বিতীয়ত, অন্য সকলের চাইতে ও কম মাইনেতে কাজ করতে রাজি হল।”
হোমস বলল, “কত কমে? অর্ধেক মাইনেতে?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা এই ভিনসেন্ট স্পলডিংকে দেখতে কেমন? তাঁর চেহারার একটা মোটামুটি বর্ণনা দিতে পারেন ?”
“দেখতে? তা বেঁটেই বলা যায়। স্বাস্থ্য ভাল। খুব চটপটে। তবে যাকে বলে মাকুন্দ। কপালে একটা দাগ আছে। একবার এক দুর্ঘটনায় অ্যাসিড পড়ে যায়।”
উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে হোমস বলল, “তাই নাকি, তাই নাকি। খুব আশ্চর্য তো। আচ্ছা আপনি কি লক্ষ করেছেন ওর কানে দুল পরবার ফুটো আছে কিনা?”
“হ্যাঁ, দেখেছি। এ সম্বন্ধে ওকে প্রশ্নও করেছি। ও বলল যে, ছোটবেলায় এক বেদে ওর কানে ফুটো করে দেয়।”
খুব চিন্তিত হয়ে শার্লক হোমস বলল, “হুঁ। আচ্ছা ও কি এখনও আপনার কাজ করছে ?”
“হ্যাঁ। এই তো ওর ওপর দোকানের ভার দিয়ে আমি এখানে এলাম।”
“আচ্ছা, আপনি যখন দোকানে থাকতেন না তখন ও দোকানের দেখাশোনা কী রকম করত?”
“খুব ভাল।তবে আপনাকে তো আগেই বলেছি যে, সকালের দিকে কাজ প্রায় থাকে না বললেই চলে।”
“ঠিক আছে, মিঃ উইলসন। আজ হল শনিবার, দিনদুয়েক বাদে, ধরুন সোমবার নাগাদ আমি আপনাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাতে পারব।”
তিন
মিঃ উইলসন চলে যাবার পরে হোমস আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তারপর ওয়াটসন, ব্যাপার কী বুঝলে বলো?” আমি খোলাখুলি ভাবেই স্বীকার করলাম যে, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। “এ তো দেখছি ভীষণ জটিল রহস্য।”
“কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় বলে,” শার্লক হোমস বলল, “আপাতদৃষ্টিতে যে-সমস্যা যত রহস্যময় যত উদ্ভট বলে মনে হয় আসলে সেটা তত জটিল না-ও হতে পারে। বরঞ্চ খুব সাদামাটা খুব তুচ্ছ সমস্যাই অনুসন্ধান করতে গিয়ে জটিল হয়ে উঠতে পারে। একটা উদাহরণ দিলে তুমি ব্যাপারটা ভাল করে বুঝতে পারবে। কোনও খুব সুন্দর বা খুব কুৎসিত মুখ মনে রাখা খুব সহজ। কিন্তু খুব সাদামাটা সম্পূর্ণ সাধারণ একদম বিশেষত্বহীন মুখ মনে রাখা বড় শক্ত। কিন্তু মিঃ উইলসনের ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি ফয়সালা করতে হবে।”
“কী করবে ভাবছ?”
“এখন বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেব। অন্তত পক্ষে তিন পাইপ তামাক না পোড়ালে কিছু হবে না। দয়া করে ঘণ্টা-খানেক চুপচাপ বোসো। বাজে কথা বলে বিরক্ত কোরো না।”
মোটা কালো পাইপটা ধরিয়ে হাঁটু দুটো গুটিয়ে আরামকেদারায় আধশোয়া হয়ে হোমস চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে ধূমপান করতে লাগল। এই ভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেল। আমি ভাবলাম হোমস বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সত্যি কথা বলতে কী আমার নিজেরই ঢুলুনি আসছিল। হঠাৎ হোমস তড়াক করে লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। তারপর ম্যান্টেলপিসের ওপর পাইপটা রেখে আমাকে বলল, “আজ বিকেলে সেন্ট জেমস হলে খুব ভাল বাজনা আছে। শুনতে গেলে মন্দ হয় না, কী বলো ওয়াটসন? সন্ধেবেলায় তোমার ক’-জায়গায় রোগী দেখতে যেতে হবে?”
আমি বললাম, “হোমস, তুমি তো জানো যে আমার ‘প্র্যাকটিস’ সে রকম কিছু সাংঘাতিক নয়। আর তা ছাড়া আজ সন্ধেটা আমার ছুটি।”
“তা হলে এসো চটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে আমরা একটু এদিক-ওদিক ঘুরব। তারপর সুবিধেমতো কোথাও ডানহাতের কাজ সেরে নিয়ে বাজনা শুনতে যাব।..বুঝলে ওয়াটসন, ফরাসি কি ইতালীয় সংগীতের চেয়ে জার্মান সংগীত আমার বেশি ভাল লাগে। জার্মান সংগীতের যে গম্ভীর ভাব তা মনকে শান্ত করে। ভাবায়। ওয়াটসন, আমি এখন ভাবতে চাই, বুঝলে, ভাবতে চাই।”
আমরা গাড়ি করে অল্ডারসগেট পর্যন্ত গেলাম। সেখান থেকে দু’-চার মিনিট হাঁটলেই স্যাক্স কোবুর্গ স্কোয়ার। আমাদের আজ সকালের মক্কেল মিঃ উইলসনের পাড়া। দেখলেই বোঝা যায় যে, স্যাক্স কোবুর্গ স্কোয়ার খুব পুরনো পাড়া। অত্যন্ত ঘিঞ্জি আর কেমন যেন অপরিষ্কার। সারিবন্দি বাড়িগুলোর সামনে লোহার রেলিং-ঘেরা ছোট একটা পার্ক। পার্কটা ঘাস আর আগাছায় ভরা। বাড়িগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে আমরা হাঁটছিলাম। কোণের বাড়িটার কাছে আসতে নজরে পড়ল দরজার ওপর সাদা হরফে লেখা: মিঃ জাবেজ উইলসন। বুঝলাম, এই আমাদের লালচুল মক্কেলের বাড়ি আর দোকান। উইলসনের বাড়ির সামনে এসে হোমস একদৃষ্টিতে সেই বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর সে খুব ধীরে ধীরে রাস্তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত বার বার পায়চারি করতে লাগল। তার চোখ আশপাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছিল। এই ভাবে বেশ কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করবার পর সে আবার মিঃ উইলসনের বাড়ির কাছে ফিরে এল। তারপর উইলসনের বাড়ির সামনে দাঁড়াল আর ফুটপাতের ওপর তার হাতের লাঠিটা ঠক ঠক করে বারকয়েক ঠুকল। ব্যাপার কী হচ্ছে আমি বোঝবার আগেই হোমস গটগট করে গিয়ে মিঃ উইলসনের দরজায় ধাক্কা দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বেরিয়ে এল বেশ সুশ্রী একটি অল্পবয়সি ছেলে।
আমাদের দিকে তাকিয়ে সে হেসে বলল, “আসুন, আসুন।”
শার্লক হোমস ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, “এখান থেকে স্ট্র্যান্ডে যাবার রাস্তাটা যদি আমাদের বলে দেন—
“এখান থেকে সোজা গিয়ে ডানদিকের তৃতীয় যে রাস্তা সেটা ধরে এগিয়ে যাবেন। তারপর বাঁদিকে চতুর্থ যে রাস্তাটি পড়বে সেটা ধরে সোজা যেতে হবে।” ছোকরা আর দ্বিতীয় কোনও কথা না বলে ভেতরে ঢুকে গেল।
হাঁটতে হাঁটতে হোমস বলল, “অতি ধুরন্ধর ছোকরা। আমার হিসেবে এ ছোকরা লন্ডনের যত ঘড়িয়াল লোক আছে তাদের তালিকায় চতুর্থ স্থান পাবার যোগ্য আর দুঃসাহসের দিক দিয়ে দেখলে এ বোধহয় তৃতীয় স্থান পাবে। এর কীর্তিকলাপ কিছু কিছু আমার কানে এসেছে।”
“বোঝা যাচ্ছে লালচুল সমিতির সঙ্গে মিঃ উইলসনের এই কর্মচারীটির বেশ ভাল রকম যোগাযোগ আছে। তুমি নিশ্চয় রাস্তা জানবার ছুতো করে ওকে দেখতে গিয়েছিলে।”
“না, ওকে দেখতে যাইনি।”
“তা হলে কী করতে গিয়েছিলে?”
“ওর হাঁটুর কাছে ট্রাউজার্সের অবস্থাটা কী রকম সেটা দেখতে।”
“কী দেখলে ?”
“যা দেখব বলে ভেবেছিলাম।”
“তুমি ফুটপাথে ও রকম ঠকঠক করে লাঠি ঠুকছিলে কেন?”
“বন্ধু, এখন কথা না বলে সবকিছু ভাল করে দেখে নাও। এখন আমরা শত্ৰু-সীমানায় গুপ্তচরবৃত্তি করছি। সুতরাং, সাবধান। স্যাক্স কোবুর্গ স্কোয়ার সম্বন্ধে আমাদের মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে। এবার চলো আশপাশের রাস্তাটাস্তাগুলো একটু ঘুরে আসি।”
স্যাক্স কোবুর্গ স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে আমরা যে-রাস্তায় এসে পড়লাম সেটা লন্ডন শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে যাবার একটা প্রধান রাস্তা। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে যে এই বড় রাস্তার ভিড়, এই অবিরাম গাড়িঘোড়ার হইচই আর হট্টগোল থেকে কয়েক মিনিট গেলেই স্যাক্স কোবুর্গ স্কোয়ার যেন এক ঘুমন্ত পুরী। অথচ এখানে লোকের ভিড়ে ফুটপাতে হাঁটাই শক্ত। আর রাস্তায় যানবাহন চলাচলে এক মিনিটও বিরাম নেই।
বড় রাস্তায় এসে শার্লক হোমস একটা কোণে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমাকে বলল, “জানো ওয়াটসন, লন্ডনের প্রত্যেক পাড়ার সম্বন্ধে খুঁটিনাটি সব খবর জানা আমার একটা বাতিক বলতে পারো। ওই যে ওইদিকে দেখছ ওটা হল মার্টমারের সিগারেট-পাইপ-তামাকের দোকান, তার পরেরটা খবরের কাগজ আর পত্র-পত্রিকার স্টল, তারপর সিটি অ্যান্ড সাবার্বান ব্যাঙ্কের কোবুর্গ শাখা, তারপরে একটা নিরিমিষি খাবারের দোকান আর তারও পরে হল ম্যাকফার্লেনের গাড়ির কারখানা। ওইখানে গিয়ে এই সারিটা শেষ হয়ে গেল। চলো ওয়াটসন, এখনকার মতো আমাদের এখানকার কাজ শেষ। এইবার স্যান্ডুইচ সহ কফি পান করে সেন্ট জেমস হলে গিয়ে বাজনা শোনা যাক। বেহালার কাছে কি কোনও বাজনা লাগে? বেহালার ছড়ের টানে টানে যে সুরের জগৎ তৈরি হয় সেখানে কোনও উইলসন নেই, কোনও লালচুল সমিতি নেই। আছে শুধু আনন্দ আর আনন্দ।”
হোমস নিজে যে একজন ভাল বেহালা-বাজিয়ে তাই নয়, সে একজন প্রকৃত সংগীতরসিক। সংগীতপাগল বললেই বোধহয় ঠিক বলা হয়। হলে ঢোকবার অল্পক্ষণের মধ্যেই সে একেবারে তন্ময় হয়ে গেল। মনে হল এখন বোধহয় বিশ্বসংসারের সবকিছুই সে ভুলে গেছে। হোমসের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাকে এই অবস্থায় দেখলে কে বলবে যে এই লোকটিই আবার অসামান্য বুদ্ধি আর কুশলতায় ইউরোপের কত চতুর কত জঘন্য অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে। আমি অনেক সময় দেখেছি যে, কোনও তদন্ত করবার সময় হোমস যদি হঠাৎ এই রকম চুপচাপ হয়ে যায় তার মানেই হল যে সে অপরাধীকে ধরবার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত আছে। তাই এখন তার ওই অবস্থা দেখে আমার মনে হল যে, কোনও লোকের সর্বনাশ হতে আর বেশি দেরি নেই।
“ডাক্তার, তুমি কি এখান থেকে সোজা বাড়ি যাবে?”
“তা হলে আমার একটু সুবিধে হত।”
“ঠিক আছে। আমাকে এখন কয়েকটা অত্যন্ত জরুরি কাজ করতে হবে। তাতে অনেক সময় লাগবে। কোবুর্গ স্কোয়ারে তুমি বোধহয় বুঝতেই পেরেছ, ভীষণ সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটতে চলেছে।”
“কী রকম সাংঘাতিক?”
“খুব বড় ধরনের অপরাধ ঘটতে চলেছে। তবে মনে হচ্ছে যে, ঠিক সময়ে হাজির থেকে আমরা অপরাধীদের সব প্ল্যান বানচাল করে দিতে পারব। আজকে রাত্তিরে তোমার সাহায্য আমার চাই।”
‘ক’টার সময় আমাকে হাজির হতে হবে বলো?”
“ধরো দশটা নাগাদ।”
“যো হুকুম। আমি ঠিক দশটায় বেকার স্ট্রিটে গিয়ে হাজির হব।”
“ভাল কথা। শেষ পর্যন্ত হয়তো গোলমালও হতে পারে। তোমার মিলিটারি রিভলভারটা মনে করে নিয়ে এসো।”
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই আমাকে হাত নেড়ে বিদায় দিয়ে হোমস লোকের ভিড়ে মিশে গেল।
আমি জানি যে, আমি অসাধারণ বুদ্ধিমান নই ঠিকই, তবে নির্বোধও নই। আমি সাধারণ লোক। কিন্তু শার্লক হোমসের সঙ্গে যখনই কোনও তদন্তে যাই তখনই আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা বলে মনে হয়। এই মিঃ উইলসনের ব্যাপারটাই ধরা যাক। হোমস যা শুনেছে যা দেখেছে আমিও সে সবই দেখেছি শুনেছি। কিন্তু তার কথা থেকে মনে হল যে, সে শুধু সমস্ত ব্যাপারটা বুঝেই ফেলেনি, এর পরে কী ঘটতে চলেছে সেটাও আন্দাজ করে ফেলেছে। বাড়ি ফেরার পথে মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটা নানা দিক থেকে পরীক্ষা করেও আমি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। কী উদ্দেশ্যে আজ আমাদের নৈশ অভিযান? কীসের আশঙ্কায় হোমস আমাকে রিভলভার নিতে বলল ? কোথায় আমাদের যেতে হবে? সেখানে আমরা কী করব? হোমসের কথা থেকে শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি যে, মিঃ উইলসনের ওই সহকর্মীটি একটি সাংঘাতিক লোক—বেশ গভীর জলের মাছ!
রাত্তির সওয়া-ন’টা নাগাদ আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্কের ভেতর দিয়ে অক্সফোর্ড স্ট্রিট ধরে বেকার স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে লাগলাম। বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে দেখি দরজার কাছে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে। বাড়ির মধ্যে পা দিতেই শুনতে পেলাম ভেতরে কারা যেন কথাবার্তা বলছে। ঘরে ঢুকে দেখলাম যে, হোমস দু’জন ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ খোশমেজাজে কথাবার্তা বলছে। ওঁদের একজনকে চিনতে পারলাম—পিটার জোনস, লন্ডন পুলিশের একজন বড় কর্তা। অন্য ভদ্রলোকটিকে চিনতে পারলাম না। আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হল না। তাঁর দিকে তাকাতে আমার দুটো জিনিস নজরে পড়ল। প্রথমত তাঁর মুখের কাঁদো কাঁদো ভাব আর দ্বিতীয় তাঁর অত্যন্ত দামি পোশাক আর খুব চকচকে টুপি।
আমাকে দেখে হোমস বলল, “যাক এবার আমরা তৈরি।” তারপর তার পুরু পশমের কোটের বোতাম লাগিয়ে নিয়ে সে দেওয়াল থেকে তাঁর ভারী চাবুকটা পেড়ে নিল। “পিটার জোনসকে তো তুমি চেনো ওয়াটসন। আর এঁর সঙ্গে তোমার বোধহয় পরিচয় নেই। ইনি মিঃ মেরিওয়েদার, আমাদের আজকের নৈশ অভিযানের সঙ্গী।”
জোনসের স্বভাবই হল অন্য লোকের পিঠ চাপড়ে মুরুব্বিয়ানা করা। আমাকে দেখে সে একটু হেসে বলল, “ডাক্তার, তা হলে আমরা আরেকবার শিকার করতে যাচ্ছি। আমাদের বন্ধু একজন খুবই বড় শিকারি। কিন্তু মুশকিল হল যে, শিকারের পেছনে তিনি এই বুড়ো কুকুরটাকে লেলিয়ে দেন।”
মিঃ মেরিওয়েদার বেজার মুখে বললেন, “এত কাণ্ড করে শেষকালে যেন বুনো হাঁসের পেছনে মিথ্যে ছোটাছুটি করে খালি হাতে ঘরে ফিরতে না হয়।”
জোনস বেশ গম্ভীর ভাবে বলল, “আপনি মিঃ শার্লক হোমসের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেন। যদিও মিঃ হোমসের কাজের ধারা সম্পূর্ণ নিজস্ব, একটু বেশিমাত্রায় কল্পনানির্ভর, আর মিঃ হোমস যদি রাগ না করেন তো বলি, মাঝে মাঝে একটু কেমন যেন আজগুবিও বটে, তবুও এ কথা বলব যে, একজন ভাল গোয়েন্দার যে-যে গুণ থাকা দরকার সে সবই তাঁর আছে। সত্যি কথা বলতে কী, দু’-একবার, যেমন শোলটো খুনের মামলায় কিংবা আগ্রার জহরত চুরির মামলায় আমাদের মানে সরকারি পুলিশের আগেই অপরাধীকে তিনি ধরে ফেলেছিলেন।”
“মিঃ জোনস, আপনি যখন নিজের মুখে বলছেন তখন আমি সব কথাই মেনে নিচ্ছি। তবে কী জানেন, সাতাশ বছরের মধ্যে এই প্রথম আমি আমার শনিবারের তাসের আড্ডায় হাজির হতে পারলাম না।”
মিঃ মেরিওয়েদারের কথার উত্তরে হোমস বলল, “আজকের রাত্তিরে যে-খেলা হবে সে রকম রক্ত-জল-করা কোনও খেলা আপনি আগে কখনও খেলেননি। আর এ খেলায় জিতলে আপনি তিরিশ হাজার পাউন্ডের মতো ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবেন। আর জোনস, তোমার কী লাভ হবে জানো? যাকে ধরবার জন্যে তুমি এত দিন চেষ্টা করে আসছ আজ তাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করতে পারবে।”
“কাকে, জন ক্লে-কে?” উৎসাহে জোনসের চোখমুখ জ্বল জ্বল করে উঠল।
“উহ, কী দুর্ধর্ষ চোর, জালিয়াত, খুনি। মিঃ হোমস, ক্লে-কে গ্রেফতার করতে পারলে আমার যা আনন্দ হবে তা আর বোধহয় কিছুতেই হবে না।” তারপর মিঃ মেরিওয়েদারের দিকে তাকিয়ে জোনস বলল, “মিঃ মেরিওয়েদার, জন ক্লে-র বয়স কম বটে কিন্তু সে একটা বিরাট দলের পাণ্ডা। বিচিত্র এই ছোকরার ইতিহাস। ওর ঠাকুরদা ছিলেন ডিউক। শুনে আশ্চর্য হবেন যে, রাজপরিবারের সঙ্গে ওর কী যেন একটা সম্পর্ক আছে। জন ইটন স্কুল থেকে পাশ করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। ও খুব ভাল ছাত্র ছিল। তারপর কী করে জানি না ও চলে এল এই অপরাধ জগতে। অদ্ভুতকর্মা ছোকরা। যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই কুশলী। অনেক ব্যাপারে ওকে আমরা সন্দেহ করেছি, কিন্তু প্রমাণের অভাবে ওর টিকিটি ছুঁতে পারিনি। ও বেশিদিন একটা জায়গায় থাকে না। আজ যদি ও স্কটল্যান্ডে কোনও ডাকাতি করে তো ক’দিন পরেই দেখা যাবে যে, কর্নওয়ালে অনাথ ছেলেমেয়েদের আশ্রমের জন্যে টাকা তুলছে। অনেকদিন ওর পেছনে আমি লেগে আছি কিন্তু কখনও ওকে কবজা করতে পারিনি।”
হোমস বলল, “হতাশ হয়ো না। আশা করছি যে, আজ রাত্তিরে তোমার মনের আশা পূর্ণ হবে। তুমি জানো না আমার নিজেরও জন ক্লে-র সঙ্গে কয়েকটা ব্যাপারে বোঝাপড়া আছে। জোনস, তুমি ঠিক বলেছ, ও একটা বিরাট দলের কর্তা। যাক, দশটা বেজে গেছে। এবার আমাদের বেরোতে হয়। জোনস, তুমি আর মিঃ মেরিওয়েদার প্রথম গাড়িটায় বোসো। আমি আর ওয়াটসন পরের গাড়িটায় উঠব।”
গাড়িতে উঠে হোমস মুখে তালা-চাবি দিয়ে দিল। তারপর কখন একসময় বিকেলে সেন্ট জেমসে শুনে আসা একটা সুর আপনমনে গুনগুন করে ভাঁজতে লাগল। গ্যাসের নরম আলোয় আলোকিত লন্ডন শহরের বিভিন্ন রাস্তায় গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে আমরা কতক্ষণ চলেছি কে জানে। এক সময় খেয়াল হল যে আমরা ফ্যারিংডন স্ট্রিটে এসে পড়েছি।
এতক্ষণ পরে হঠাৎ হোমস মুখ খুলল, “আমরা প্রায় এসে পড়েছি। এই মিঃ মেরিওয়েদার একটা ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর। আজকের এই ব্যাপারের সঙ্গে ওঁদের অনেক লাভ-ক্ষতি জড়িয়ে আছে। আর জোনসকে সঙ্গে নিয়েছি তার কারণ হল যে, লোকটা ভাল, ঘটে যদিও বুদ্ধির ছিটেফোঁটা নেই। গোয়েন্দার কাজে ও একেবারেই অচল। কিন্তু ওর গুণ হল যে, ও ভীষণ জেদি আর প্রচণ্ড সাহসী। আমরা এসে পড়েছি। ওই যে ওরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।”
গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাতে অবাক হয়ে দেখলাম যে, আজ সকালে স্যাক্স কোবুর্গ স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে আমরা বড় রাস্তার যেখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেইখানেই এসেছি। গাড়িভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আমরা মিঃ মেরিওয়েদারের পেছন পেছন হেঁটে একটা সরু গলিতে ঢুকলাম। খানিকটা যাবার পর মিঃ মেরিওয়েদার একটা খিড়কি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। আমরাও তাঁকে অনুসরণ করলাম। দরজার পরেই একটা লম্বা সরু বারান্দা। বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা বেশ মজবুত লোহার গেট। গেট খুলে ঢুকতেই দেখলাম এবড়েখেবড়ো পাথরের কয়েক ধাপ সিঁড়ি এঁকেবেঁকে নীচে নেমে গেছে। সিঁড়ির শেষে আবার এক বিরাট দরজা। মিঃ মেরিওয়েদার ছোট একটা লণ্ঠন জ্বেলে সেই দরজা খুললেন। আমরা ভেতরে ঢুকতেই তিনি আবার দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর তিনি আমাদের একটা অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে গলি দিয়ে নিয়ে চললেন। এই গলির শেষে আরও একটা বিরাট দরজা। সেই দরজাটা খুলে আমরা যেখানে এলাম সেটা মাটির তলায় একটা বিরাট ঘর। ভাল করে দেখতে দেখতে নজরে পড়ল ঘরটার চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে বিভিন্ন আকারের সব বাক্স।
লণ্ঠনের আলোয় ঘরটা তন্ন তন্ন করে দেখে হোমস বলল, “হ্যাঁ, ওপর থেকে এ ঘরটাকে বেশ সুরক্ষিতই বলা যায়। চট করে কেউ ঢুকতে পারবে না।”
“তলা থেকেও কেউ ঢুকতে পারবে না মিঃ হোমস।” তারপর নিজের কথার সত্যতা প্রমাণ করবার জন্যে মিঃ মেরিওয়েদার মেঝেতে দু’-চারবার ঠকঠক করে লাঠি ঠুকেই আশ্চর্য হয়ে বললেন, “কী আশ্চর্য, মেঝেটা কেমন যেন ফাঁপা ফাঁপা লাগছে।”
হোমস চাপা ভর্ৎসনার সুরে বলল, “দয়া করে চেঁচাবেন না। চিৎকার-চেঁচামেচি করে আপনি দেখছি আমাদের আজকের নৈশ অভিযানের সব প্ল্যান মাটি করবেন। আপনি অনুগ্রহ করে কোনও কথা না বলে যে-কোনও একটা বাক্সের ওপর চুপচাপ বসে থাকুন।”
চার
মিঃ মেরিওয়েদার কোনও কথা না বলে একটা বড় কাঠের বাক্সের উপর বসলেন। গম্ভীর মুখ দেখে বোঝা গেল যে, তিনি বেশ অপমানিত বোধ করছেন। হোমস একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও ঝুঁকে পড়ে, কখনও মেঝেতে শুয়ে পড়ে লণ্ঠনের আলোয় মাঝখানের সূক্ষ্ম জোড়াগুলি পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। এই ভাবে যখন ঘরের সম্পূর্ণ মেঝেটা তাঁর পরীক্ষা করা হয়ে গেল, তখন সে বেশ প্রফুল্ল ভাবে বলল, “আমাদের হাতে ঘণ্টাখানেকের মতো সময় আছে। উইলসন ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত ওরা অপেক্ষা করবে। কিন্তু তারপর ওরা আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করবে না। কেননা যত তাড়াতাড়ি ওরা কাজ হাসিল করতে পারবে, এখান থেকে পালাবার তত বেশি সময় পাবে। ওয়াটসন, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ যে, আমরা এই মুহূর্তে লন্ডন শহরের একটা বড় ব্যাঙ্কের সিটি ব্রাঞ্চের সেফ ডিপোজিট ভল্টের মধ্যে রয়েছি। মিঃ মেরিওয়েদার এই ব্যাঙ্কের পরিচালক-সভার সভাপতি। আর তিনি এখনই তোমাকে বুঝিয়ে দেবেন কেন জন ক্লে-র মতো ঘাগি অপরাধীর নজর পড়েছে এই সেফ ডিপোজিট ভল্টের উপর।”
ফিসফিস করে মিঃ মেরিওয়েদার আমাকে বললেন, “এ সবের মূলে আছে আমাদের ফরাসি সোনা। আর এই সোনা চুরি যেতে পারে বলে আমাদের অনেকবার হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে। আমরাও যতদূর সম্ভব সতর্ক আছি।”
“ফরাসি সোনা আবার কী জিনিস?”
“বলছি। কয়েক মাস আগে হঠাৎ খুব জরুরি ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আমরা ব্যাঙ্ক অব ফ্রান্সের কাছ থেকে প্রায় তিরিশ হাজার পাউন্ডের মতো নেপোলিয়ন ফ্ৰাঁ ধার করতে বাধ্য হই। কিন্তু যাই হোক ওই টাকাটা আমাদের খরচা করতে হয়নি। কিন্তু সে টাকাটা যে আমাদের কাছেই আছে এবং এখনও ফেরত পাঠানো হয়নি সে খবরটা কিন্তু চাপা থাকেনি। এই যে কাঠের বাক্সটা দেখছেন ডঃ ওয়াটসন, যেটার ওপর আমি বসে আছি, এর ভেতরে তামার পাতের ভাঁজে ভাঁজে অন্তত দু’-হাজার সোনার নেপোলিয়ন ফ্রাঁ আছে। সাধারণ ভাবে ব্যাঙ্কের শাখায় যত সোনা মজুত রাখা হয় তার চেয়ে ঢের বেশি পরিমাণ সোনা আমাদের ব্যাঙ্কে রয়েছে। এই নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।”
“সে তো বটেই,” হোমস বলল। “এইবার কিন্তু আমাদের তৈরি হতে হবে। আমি অনুমান করছি যে, যা ঘটবার তা আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘটবে। এইবার লণ্ঠনটা ঢাকা দিয়ে দিতে হবে।”
“সে কী! আমাদের অন্ধকারে বসে থাকতে হবে,” মিঃ মেরিওয়েদার যেন একটু ভয় পেয়ে গেলেন।
“উপায় নেই মিঃ মেরিওয়েদার। আমি তো পকেটে এক প্যাকেট তাস এনেছিলাম। ভেবেছিলাম চারজনে তাস খেলে সময় কাটানো যাবে। কিন্তু এখানে এসে যা দেখছি তাতে আমি নিঃসন্দেহ যে, শত্রুপক্ষের সব আয়োজন সম্পূর্ণ। যে-কোনও মুহূর্তে তারা কাজ শুরু করতে পারে। সুতরাং এখন এখানে আলো জ্বালিয়ে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তারা সাবধান হয়ে যাবে। এখন আমাদের ঠিক করে নিতে হবে আমরা কে কে কোথায় থাকব। একটা কথা আপনাদের বলে রাখি। এরা যেমন বেপরোয়া তেমনই নিষ্ঠুর। যদিও আমাদের এখানে দেখে তারা খানিকটা হকচকিয়ে যাবে ঠিকই, তবুও আমরা যদি যথেষ্ট সাবধান না হই তা হলে কিন্তু আমাদের বিপদ হতে পারে। আমি এই বাক্সটার পেছনে দাঁড়াব। আপনারা ওই বাক্সগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকবেন। আমি ওদের মুখের ওপর আলো ফেললেই আপনারা ছুটে আসবেন। ওদের আমরা একেবারে ঘিরে ফেলব। ওরা যদি গুলি ছোড়ে, ওয়াটসন, তুমিও সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুড়বে।”
আমি রিভলভারের সেফটি ক্যাচটা খুলে সেটা বাক্সর ওপর রেখে নিজে বাক্সর আড়ালে দাঁড়ালাম। হোমস তার হাতের লণ্ঠনটা ঢেকে দিল। আর অমনি ঝুপ করে গাঢ় অন্ধকারে সবকিছু ঢেকে গেল। সত্যি কথা বলতে কী অন্ধকার যে ও রকম জমাট আর নিরেট হতে পারে আমার সে ধারণা ছিল না। শুধু আড়াল করা লণ্ঠন থেকে যে অত্যন্ত মৃদু তাপ বেরোচ্ছিল তাতে মনে মনে এই ভেবে সান্ত্বনা পাচ্ছিলাম যে যাই হোক হাতের কাছে একটা আলো আছে আর দরকারে সেটাকে কাজে লাগানো যাবে। কী জানি কী ঘটবে এই ভাবতে ভাবতে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল বলেই হোক অথবা ওই মাটির নীচের অন্ধকার ঠান্ডা ঘরের বদ্ধ বাতাসের ভ্যাপসা গন্ধের জন্যেই হোক মনের মধ্যে কেমন একটা উদ্বেগ হচ্ছিল।
খুব নিচু গলায় হোমস বলল, “ওদের পালাবার একটি মাত্রই রাস্তা আছে। সেটা হল ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্যাক্স কোবুর্গ স্কোয়ার ধরে। জোনস, তোমাকে যা করতে বলেছিলাম তা করেছ?”
“হ্যাঁ। ওই বাড়ির সদর দরজায় একজন ইন্সপেক্টর আর দু’জন কনস্টেবল হাজির আছে।”
“যাক। তা হলে পালাবার রাস্তা বন্ধ। এখন আমাদের কাজ চুপচাপ বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করা।”
সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে সময় যেন আর কাটতেই চায় না। পরে অবশ্য আমি হিসেব করে দেখেছি যে আমরা সেফ ডিপোজিট ভল্টে ছিলাম বড় জোর দেড় ঘণ্টা। কিন্তু তখন মনে হচ্ছিল যে কতক্ষণ যে বসে আছি তার ঠিকঠিকানা নেই। মনে হচ্ছিল রাত বোধহয় কেটে গিয়ে ভোর হতে আর দেরি নেই। ঠায় একভাবে বসে থেকে হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তবু পাছে শব্দ হয় এই ভয়ে আমি একটুও নড়াচড়া করিনি। সেই অন্ধকার ঘরে অজানা বিপদের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আমার কান এত সূক্ষ্ম হয়ে উঠেছিল যে, আমি যে কেবল আমার সঙ্গীদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম তাই নয়, প্রত্যেকের নিশ্বাস নেবার ও ছাড়ার আলাদা ছন্দও ধরতে পারছিলাম। জোনস বেশ ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নিচ্ছিল। কিন্তু মেরিওয়েদারের নিশ্বাসের শব্দ খুবই ক্ষীণ। আমি যে-বাক্সটার আড়ালে ছিলাম সেখান থেকে ঘরের মেঝেটা খুব ভাল ভাবে দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা অতি ক্ষীণ আলোর রশ্মি যেন ফুটে উঠল।
প্রথমে মনে হল মেঝের ওপর একটা আলো দপ করে জ্বলেই নিভে গেল। ক্রমে সেটা বড় হতে হতে একটা লম্বা উজ্জ্বল হলদে রেখার আকার নিল। তারপর আমি কিছু বোঝবার আগেই হঠাৎ যেন মাটি ফুড়ে একটা ফরসা অল্পবয়সি ছেলের হাত উঠে এল। প্রায় এক মিনিটের মতো সেই হাতটা চার পাশে হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজে যেমন নিঃশব্দে উঠে এসেছিল তেমনই নিঃশব্দে আবার ভেতরে ঢুকে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে আবার সব অন্ধকার হয়ে গেল। শুধু পাথরের মেঝের একটা ছোট্ট ফুটো দিয়ে তলা থেকে আলোর আভা দেখা যাচ্ছিল। হাতটা অদৃশ্য হয়ে যাবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাটির তলা থেকে হঠাৎ একটা ঘড়ঘড় শব্দ হল। বিস্ময়ের ঘোর কাটবার আগেই দেখলাম মেঝের একটা পাথর সরে সেখানে একটা মাঝারি আকারের চৌকো গর্ত হয়ে গেছে। সেই গর্ত দিয়ে বেশ জোরালো আলো এসে ঘরে পড়ল। তারপর গর্ত দিয়ে উঁকি মারল নিখুঁত ভাবে দাড়ি-গোঁফ কামানো একটি অল্পবয়সি ছোকরার মুখ। ছেলেটি অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় দু’হাতের ওপর ভর দিয়ে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে ওপরে উঠে এল। উঠে এসেই সে হাত বাড়িয়ে আর একজনকে টেনে তুলল। সঙ্গীটি তারই মতো ছোটখাটো। কিন্তু তাঁর মাথার চুল রক্তের মতো লাল।
প্রথম ছোকরাটি বলল, “সব ঠিকঠাক আছে। তুমি ছেনি আর থলেগুলো আনতে ভোলোনি তো? কী সর্বনাশ! আর্চি তুমি পালাও। আমি এদিকটা দেখছি।”
সে কিছু দেখবার আগেই শার্লক হোমস এক লাফে তার জামার কলারটা শক্ত করে চেপে ধরল। আর তার সঙ্গী গর্ত দিয়ে লাফ মারতেই একটা ফ্যাঁস করে শব্দ হল। জোনসের হাতে খানিকটা জামা ধরা রয়েছে। লণ্ঠনের আলোয় একটা রিভলভারের নল চকচক করে উঠতেই হোমস তাঁর চাবুক দিয়ে লোকটার কবজিতে প্রচণ্ড জোরে এক ঘা দিতেই রিভলভারটা ঠং করে মেঝেতে ছিটকে পড়ল।
“এখান থেকে পালাবার চেষ্টা বৃথা জন ক্লে”—হোমস বলল।
একটুও বিচলিত না হয়ে ক্লে বলল, “হুঁ, তাই তো দেখছি। তবে আমি খুশি যে, আমার সঙ্গীর খানিকটা জামা তোমরা ধরতে পেরেছ। তাকে পারোনি।”
“তাকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে লোক সদর দরজায় হাজির আছে।” হোমস ক্লে-র দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
“তাই নাকি? তা হলে তো তোমার বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়।”
হোমস বলল, “ধন্যবাদ। তবে তোমার বুদ্ধিরও প্রশংসা করছি। সত্যি, তোমার ওই লালচুল সমিতির আইডিয়াটা অসাধারণ।”
ক্লে উত্তর দেবার আগে জোনস বলে উঠল, “নাও আর বেশি চিন্তা কোরো না, এখনই তোমার সঙ্গীর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। তোমার ও বন্ধুটি দেখলাম গর্তের মধ্যে ঢুকতে খুব ওস্তাদ। এখন লক্ষ্মীছেলের মতো হাতদুটো বাড়িয়ে দাও, হাতকড়াটা লাগাই।”
উত্তরে জন ক্লে যা বলল তা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। “হাতকড়া লাগাতে পারো। তবে তোমার ওই নোংরা হাত যেন আমার গায়ে না লাগে। আর তুমি হয়তো জানো না যে, আমার শরীরে রাজরক্ত আছে। আমি খুশি হব যদি তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবার সময় ‘মহাশয়’, ‘অনুগ্রহপূর্বক’ বা ওই ধরনের সম্ভ্রমসূচক শব্দ ব্যবহার করো।”
বেশ ব্যঙ্গ করে জোনস বলল, “বুঝেছি মহাশয়। এখন আপনি যদি অনুগ্রহ করে ওপরে গিয়ে দয়া করে গাড়িতে বসেন তো মহাশয় আমি কৃতার্থ হই।”
“ঠিক আছে,” বলে আমাদের তিনজনকে বিদায় জানিয়ে জন ক্লে জোনসের সঙ্গে চলে গেল। আমরাও ওদের পেছন পেছন চললাম।
“সত্যি মিঃ হোমস, কী ভাবে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব তা বুঝতে পারছি না।”
“কিন্তু ওদের উদ্দেশ্যটা তুমি বুঝলে কী করে?”
“পারলাম ও অর্ধেক মাইনেতে কাজ করতে রাজি হয়েছে বলে। উইলসনের নিজের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভাল নয়। তা হলে তাকে তার বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে সেখানে ওরা কী করতে পারে? আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তারা যে জিনিসের সন্ধান করছে সেটা হয়তো তার বাড়ির কাছাকাছি আছে। কিন্তু সেটা কী? ভাবতে ভাবতে আমার মিঃ উইলসনের একটা কথা মনে পড়ল। উনি বলে ছিলেন যে ওঁর কর্মচারীটির ছবি-তোলার ভীষণ নেশা। অবসর পেলেই সে তয়খানার ডার্করুমে ছবি ডেভেলপ করতে চলে যায়। তয়খানা! মানে মাটির তলার ঘর। তৎক্ষণাৎ একটা বড় জট খুলে গেল। তখন আমি ওই কর্মচারীটির সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম। জানলাম যে এবারে এক মহা ধুরন্ধর লোকের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। তখন আমি ভাবতে লাগলাম যে, এই লোকটি দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওই তয়খানায় কী করে? ভাবতে ভাবতে একটা সঙ্গত ব্যাখ্যা মনে এল, ও নিশ্চয়ই একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে। কিন্তু কেন?
“এই রকম অবস্থায় আমরা অকুস্থলে গেলাম। তুমি তখন জিজ্ঞেস করেছিলে যে কেন আমি ফুটপাতে ঠক ঠক করে লাঠি ঠুকছিলাম। আমি বুঝতে চাইছিলাম যে, তয়খানাটা বাড়ির কোন দিকে গেছে, সামনে না পেছনে। বুঝলাম সামনের দিকে নয়। তখন আমি দরজায় ধাক্কা দিলাম। যা আশা করেছিলাম, ওই কর্মচারীটি দরজা খুলে দিল। যদিও ইতিপূর্বে ক্লে-র সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার সংঘাত হয়েছে, কিন্তু আমরা কখনও পরস্পরের মুখোমুখি হইনি। তা ছাড়া ওর হাঁটুটা দেখাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। দেখছিলাম যে, ওর হাঁটুর কাছে প্যান্টের কাপড়টা কোঁচকানো, ধুলোবালি লাগা। আমি নিঃসন্দেহ হলাম যে, দীর্ঘক্ষণ ধরে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে ওই দাগ হয়েছে।
“তারপর হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের কাছে এসে যখন সিটি অ্যান্ড সাবার্বান ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চটা নজরে পড়ল তখনই আমি সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। বাজনার পর তুমি যখন বাড়ি চলে গেলে তখন আমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে গিয়ে ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করলাম। তাঁর ফল কী হল তা তো তুমি স্বচক্ষে দেখলে।”
আমি বললাম, “কিন্তু আজ রাত্তিরেই যে ওরা সেফ ডিপোজিট ভল্ট ভাঙবে সেটা তুমি কী করে জানলে?”
“যখন লালচুল সমিতি বন্ধ হয়ে গেল তখনই বুঝলাম যে, জাবেজ উইলসনকে ওদের আর প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ওদের সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শেষ। কিন্তু সুড়ঙ্গটা খুঁড়ে তো বেশি দিন ফেলে রাখা যায় না। যা করবার তা তাড়াতাড়ি করতে হবে। তখন আমার মনে হল যে, আজ শনিবারই ওদের পক্ষে সব চেয়ে ভাল। কাল রবিবার। ব্যাঙ্ক বন্ধ। চুরির খবর কেউ জানবে না। ওরাও বমাল সমেত কোনও নিরাপদ জায়গায় গা-ঢাকা দেবার জন্যে পুরো দুটো দিন সময় পাবে। সুতরাং ওদের যা কিছু করবার তা আজ রাত্রেই করতে হবে।”
হোমস চুপ করল। আমি বললাম, “চমৎকার। তোমার বিশ্লেষণে এতটুকু ফাঁক নেই কোথাও।”
