নীলকান্তমণি রহস্য (শার্লক হোমস) – আর্থার কোনান ডয়েল
বড়দিনের ঠিক দু’দিন পরে সকালের দিকে আমি শার্লক হোমসের বাসায় গেলাম। হোমসকে বড়দিনের প্রীতি আর শুভেচ্ছা জানাবার জন্যেই আমার যাওয়া। গায়ে একটা টকটকে লাল রঙের ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে হোমস সোফায় বসেছিল। সোফার ডান ধারে হাতের কাছে তার পাইপগুলো পর পর সারবন্দি ভাবে সাজিয়ে রাখা। আর যে-সোফাটায় সে বসেছিল তার চারধারে আজকের প্রায় সব ক’টা খবরের কাগজ মেঝের কার্পেটের ওপর এলোমেলো ভাবে ছড়ানো। সোফার কাছেই একটা কাঠের চেয়ার। সেই চেয়ারের ঠেসান দেবার উঁচু জায়গাটা থেকে বহু পুরনো ধুলো-পড়া ফাট-ধরা শক্ত একটা ফেল্ট হ্যাট ঝোলানো। চেয়ারটার বসবার জায়গায় ফরসেপ আর লেন্স রাখা আছে। আমি বুঝতে পারলাম যে, খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখবার জন্যেই ওই টুপিটাকে ওইখানে ওই ভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
“ব্যস্ত রয়েছ দেখছি। কাজে বাধা দিলাম মনে হচ্ছে,” আমি বললাম।
“মোটেই নয়। উলটে তোমার সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথাবার্তা বলতে পারব ভেবে ভাল লাগছে।”
আঙুল দিয়ে টুপিটা দেখিয়ে হোমস আমাকে বলল, “এ ব্যাপারটা অবশ্য যাকে বলে জলের মতো সোজা। তবে কী জানো, কয়েকটা পয়েন্ট আছে, সেগুলো যে শুধু ইন্টারেস্টিং তাই নয়, তার থেকে অনেক কিছু শেখবারও আছে।”
আমি একটা আরামকেদারা ঘরের জ্বলন্ত চুল্লির গনগনে আগুনের কাছে টেনে নিয়ে বসে হাত-পা গরম করতে লাগলাম। বাইরে সাংঘাতিক বরফ পড়ছে। জানলার সব শার্শি পুরু বরফে একেবারে ঢেকে গেছে।
আমি বললাম, “দেখে যদিও মনে হচ্ছে খুবই সাধারণ একটা টুপি তবু আমি জোর করে বলতে পারি যে, এই টুপিটার সঙ্গে কোনও রহস্যময় ঘটনার যোগ আছে। আর এই টুপির সূত্র ধরেই তুমি সেই রহস্যের জাল ছিঁড়ে ফেলে অপরাধীকে ধরে ফেলবে।”
“আরে না, না। এটার সঙ্গে কোনও অপরাধের যোগাযোগ নেই,” শার্লক হোমস হাসতে হাসতে বলল। “এটাকে বলতে পারো একটা আজব কাণ্ড। দেখো, মাত্র কয়েক মাইল জায়গার মধ্যে চল্লিশ লক্ষ লোক যদি সদাসর্বদাই গুঁতোগুঁতি ধাক্কাধাক্কি করে তা হলে এমন কিছু কিছু উদ্ভট ঘটনা ঘটতেই পারে যা সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই যে লন্ডনে এত লোক সারা দিন কাজেকর্মে ঘোরাঘুরি দৌড়োদৌড়ি করছে, কখনও আনন্দে হইচই করছে কখনও গোলমাল করছে—এই সব কাণ্ডকারখানার মাঝখানে এমন ঘটনা ঘটা খুবই সম্ভব যা ভীষণ রকম অস্বাভাবিক মনে হলেও তাকে কোনও ভাবেই অপরাধমূলক ব্যাপার বা ক্রাইম বলা যায় না।”
“তা যা বলেছ। সত্যি কথা বলতে গেলে শেষ যে ছ’টা তদন্তের কথা আমার ডায়েরিতে লেখা তার মধ্যে তিনটে তো আইনের চোখে যাকে অপরাধ বলা যায় সে রকম কোনও ঘটনাই নয়,” আমি বললাম।
“খুবই ঠিক কথা। তুমি আইরিন অ্যাডলারের কাগজপত্র, মিস মেরি সাদারল্যান্ড আর ওই যেটাকে তুমি ‘ওষ্ঠবক্র রহস্য’ নাম দিয়েছ, সেগুলোর কথা বলছ তো? আমার বিশ্বাস যে এই টুপির ব্যাপারটাও ওই রকমেরই একটা ‘নির্দোষ’ ধরনের কাণ্ড হবে।…তুমি পুলিশ কমিশনার পিটারসনকে চেনো তো?”
“হ্যাঁ, চিনি বই কী।”
“এটা ওঁর সম্পত্তি।”
“এই টুপিটা পিটারসনের?”
“না, না। এই টুপিটা পিটারসন পেয়েছে। টুপির মালিক যে কে সেটা অবশ্য আমরা এখনও জানতে পারিনি। আমি বলি কী, এটাকে একটা ছেঁড়া-ফাটা টুপি হিসেবে না দেখে একটা ধাঁধা বা সমস্যা হিসেবে দেখো। আচ্ছা, প্রথম কথা হল এটা এখানে এল কী করে? বড়দিনের দিন ভোরে এই টুপিটা আর একটা বেশ মোটাসোটা নধরকান্তি হাঁস আমার কাছে আসে। সেই হাঁসটা অবশ্য এখন পিটারসনের রান্নাঘরে হাঁড়িতে ফুটছে। অল্প কথায় ব্যাপারটা এই রকম। পিটারসনকে তুমি তো জানো। বেশ সৎ, পরিশ্রমী লোক। বড়দিনের দিন ভোর চারটে নাগাদ সে টটেনহ্যাম কোর্ট রোড ধরে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ রাস্তার গ্যাসের আলোয় তার নজরে পড়ল যে, একজন বেশ লম্বা লোক সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তার আগে হেঁটে চলেছে। লোকটির পিঠে একটা বেশ হৃষ্টপুষ্ট হাঁস ঝোলানো। গুজ স্ট্রিটের কাছাকাছি যখন এসে পড়েছে তখন পিটারসন দেখল যে ওই লোকটির সঙ্গে একদল গুন্ডাজাতীয় লোকের কথাকাটাকাটি হচ্ছে। হঠাৎ গুন্ডাদলের একজন ধাক্কা মেরে ওই টুপিটা ফেলে দিল। তখন লোকটি তার হাতের লাঠিটা বাঁইবাঁই করে ঘোরাতে শুরু করল। আর তার ফলে ওইখানে একটা দোকানের শোকেসের কাচ লাঠির ঘায়ে ভেঙে যায়। এই সব দেখে পিটারসন লোকটিকে ওই গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে সেই দিকে দৌড়ে যায়। কিন্তু মজা হল এই যে, একজন পুলিশের পোশাক-পরা লোককে ছুটে আসতে দেখে আর দোকানের কাচ ভেঙে ফেলার জন্যে ওই লোকটি ভয় পেয়ে তার কাঁধের হাঁসটিকে ওইখানে ফেলে দিয়ে একটা গলির ভেতরে ছুটে পালায়। ওইখানে এত সরু সরু গলি আছে। যে সমস্ত পাড়াটা যেন একটা গোলকধাঁধা। পিটারসনকে ছুটে আসতে দেখে ইতিমধ্যে ওই গুন্ডাগুলোও পিঠটান দেয়। তাই রঙ্গমঞ্চে পৌঁছে পিটারসন এই টুপিটা আর সেই হাঁসটাকে পড়ে থাকতে দেখে।”
“পিটারসন নিশ্চয় টুপি আর হাঁসটা মালিকের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসে?”
“না হে, না। আসল গোলমালটা তো সেইখানেই। হাঁসটার বাঁ পায়ে অবশ্য একটা কার্ড আটকানো ছিল। তাতে লেখা, মিসেস হেনরি বেকারকে। আর টুপিটার ভেতরে এইচ বি এই দুটি অক্ষর লেখা ছিল। কিন্তু মুশকিল কী জানো? লন্ডন শহরে অন্তত হাজারখানেক বেকার পদবির লোক আছে। তাদের মধ্যে আবার খুব কম হলেও শ’খানেক লোকের নাম হেনরি। সুতরাং আসল মালিককে খুঁজে বের করে মাল ফেরত দেওয়া মোটেই সোজা কথা নয়।”
“পিটারসন তখন কী করল?”
“সেই দিনই সকালে সে হাঁস আর টুপিটা নিয়ে আমার কাছে এসে হাজির। পিটারসন জানে যে, যে-কোনও রকম সমস্যার সমাধান করতে আমার খুব ভাল লাগে। তুমি আসবার একটু আগে পর্যন্ত হাঁসটা আমার জিম্মায় ছিল। আমার মনে হল যে আর বোধহয় ওই হাঁসটা রাখা ঠিক হবে না। ওটাকে এবার রান্নাঘরে পাঠানোই উচিত। তাই যেহেতু পিটারসন ওটাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল সেই ওটার সদ্গতি করছে, আর আমি অপরিচিত সেই লোকটির টুপি নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, যদি কোনও কিছু করা যায়।”
“কিন্তু টুপি আর হাঁসের মালিক কি খবরের কাগজে কোনও বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন দেননি?”
“না?”
“তা হলে কোন সূত্র ধরে তুমি তার সন্ধান পাবে বলে আশা করছ?”
“যেটুকু তথ্য বিচার-বিবেচনা করে বের করতে পারি।”
“এই টুপিটা থেকে?”
“নিশ্চয়ই।”
“যাহ্। তুমি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ। এই ছেঁড়া-ফাটা টুপিটা থেকে কী তথ্য তুমি পাবে বলে আশা করো ?”
“তুমি তো আমার কাজের ধরন জানো। এই নাও লেন্স। তুমি নিজে পরীক্ষা করে দেখো এটা থেকে এর মালিক সম্বন্ধে কী কী খবর জানতে পারো।”
একরকম বাধ্য হয়েই আমি টুপিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতে লাগলাম। খুবই সাধারণ একটা গোল কালো টুপি। টুপিটা অনেক দিন ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় জরাজীর্ণ অবস্থা। টুপিটার ভেতরে লাল রঙের সিল্কের কাপড়ের অস্তর। তবে রংটা প্রায় উঠেই গেছে। টুপিটার ভেতরে কোনও কোম্পানির নাম নেই। তবে হোমস যে রকম বলেছিল একদিকে এইচ বি হরফদুটো লেখা। টুপিটার দু’দিকে ফুটো করা আছে। বোঝা যায় ওখানে চামড়ার সরু পটি লাগানো ছিল। পটিটা ছিঁড়ে গেছে। টুপিটায় ধুলো জমে রয়েছে। রং চটে গেছে। বেশ কয়েক জায়গায় ফাট ধরেছে। কালি লাগিয়ে রংচটা জায়গাগুলোকে কালো করবার চেষ্টা করা হয়েছে।
টুপিটা ফেরত দিয়ে আমি বললাম যে, কোনও সূত্রই আমার চোখে পড়েনি।
“ও কী বলছ! তোমার চোখের সামনেই সব কিছু রয়েছে। গোলমালটা কী হচ্ছে জানো, তুমি যা দেখছ তার থেকে কোনও সিদ্ধান্ত করতে পারছ না। আসলে তোমার এই পারছি না পারব না মনোভাবের জন্যেই তুমি ব্যাপারটা ধরতে পারছ না।”
“বেশ, আমি না হয় পারছি না, তুমি কী বুঝেছ সেটাই বলো শুনি।”
হোমস টুপিটা তুলে নিল। তারপর সেটার দিকে বেশ খানিকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। “এই টুপিটা থেকে যত কথা জানতে পারা উচিত ছিল ততটা হয়তো জানা যাবে না। তবে কতকগুলো ব্যাপার বেশ স্পষ্ট। আর কতকগুলো ব্যাপার ঠিক ততটা পরিষ্কার না হলেও মোটামুটি ভাবে যে ঠিক তা একরকম জোর করেই বলা যায়। যেমন ধরো, লোকটি বেশ বুদ্ধিমান। বছর তিনেক আগে পর্যন্ত সে বেশ পয়সাওলা লোকই ছিল। তবে এখন তার টাকাপয়সার বেশ টানাটানি যাচ্ছে। লোকটি যাকে বলে বেশ হুঁশিয়ার। মানে সে যখন কোনও কাজ করে তখন বেশ ভেবেচিন্তেই কাজ করে। তবে এখন সে কিছুটা বেহিসেবি হয়ে পড়েছে। তার এই টাকাপয়সার টানাটানি আর বেহিসেবি ভাব দেখে আমার মনে হচ্ছে যে তার স্বভাবও খারাপ হয়েছে। আর সেই কারণেও বোধহয় তার স্ত্রীর সঙ্গে বেশ ঝগড়াঝাঁটি চলছে।”
“হোমস!”
আমার কথা গ্রাহ্য না করে হোমস বলে চলল, “তবে লোকটি বেশ রাশভারী প্রকৃতির। অলস। নড়াচড়া করতে পছন্দ করে না। কোথাও বিশেষ যায় না। শরীরও এখন খুব আর শক্ত-সমর্থ নেই। লোকটি মাঝবয়সি। অল্প কিছুদিন আগে চুল কেটেছে। মাথায় লাইম ক্রিম মাখে। বলতে ভুলে গেছি, চুলে পাক ধরেছে। টুপিটা নিরীক্ষণ করে মোটামুটি ভাবে এই ক’টা কথা জোর করে বলা যায়। আর একটা কথাও বলতে পারি। খুব সম্ভবত ওর বাড়িতে গ্যাসের লাইন নেই।”
“তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?”
“মোটেই নয়। এই যে কথাগুলো তোমাকে বললাম তারপরও কি তুমি ব্যাপারটা ধরতে পারছ না?”
“এ কথা হয়তো ঠিক যে আমি একটা নিরেট বোকা। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার কথার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই ধরতে পারছি না। যেমন ধরো, কী করে তুমি বুঝলে যে লোকটি বেশ বুদ্ধিমান।”
হোমস টুপিটা তার মাথার ওপর বসাল। টুপিটা তার ভুরু পর্যন্ত ঢেকে দিল।
“দেখো, এটা হচ্ছে আকারের কথা। যার মাথায় এতখানি ব্রেন আছে সে আর যাই হোক বোকা নয়।”
“লোকটির অবস্থা যে খারাপ যাচ্ছে এটা জানলে কী করে?”
এই টুপিটা প্রায় বছর তিনেকের পুরনো। আর সেইজন্যেই টুপিটার ধারগুলো কুঁচকে গেছে। টুপিটা বেশ দামি। ভাল করে লক্ষ করলে দেখবে যে, টুপিটার অস্তরের কাপড়টাও বেশ দামি। শুধু তাই নয়, টুপিটার বাইরে যে সিল্কের বেড়টা দেওয়া আছে সেটাও খুব দামি ফিতে। ভদ্রলোক বছর তিনেক আগে এই দামি টুপিটা কিনে ছিলেন। এখন টুপিটা প্রায় ফেলে দেবার মতো অবস্থায় এসেছে, তবুও তিনি টুপিটা বদলাননি। এর থেকে অনুমান করা শক্ত নয় যে, তাঁর অবস্থা ভাল যাচ্ছে না।”
“হ্যাঁ, এখন অবশ্য মনে হচ্ছে যে তুমি যা বলছ তা হয়তো ঠিকই। তবে লোকটি আগে বেশ গোছালো হুঁশিয়ার ধরনের ছিল, আর এখন খানিকটা বেহিসেবি হয়েছে, এ কথা তুমি জানলে কী করে?”
শার্লক হোমস হেসে উঠল। “তিনি যে একসময়ে হুঁশিয়ার লোক ছিলেন তার প্রমাণ হল এইটে,” বলে সে টুপিটার দু’পাশে দুটো চাকতি আর আংটা দেখাল। এই জিনিসটা টুপির সঙ্গে লাগানো থাকে না। এটা ফরমাশ দিয়ে করাতে হয়। এটার সঙ্গে একটা পটি লাগানো থাকে সেটা চিবুকের সঙ্গে লেগে থাকে। হাওয়ার চোটে টুপিটা যাতে মাথা থেকে উড়ে না যায় সেইজন্যে লোকটি এটা ফরমাশ দিয়ে তৈরি করিয়েছিল। এর থেকেই বোঝা যায় যে, লোকটি বেশ ভেবেচিন্তে সব কাজ করত। কিন্তু দেখো, এই ইলাস্টিকের পটিটা ছিড়ে যাবার পরে আর নতুন পটি লাগানো হয়নি। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, ওই বিবেচনা করে কাজ করার অভ্যেসটা তার চলে গেছে। কিন্তু আবার উলটো দিক দিয়ে দেখো টুপিটার যেখানে যেখানে ফেটে বা ছিঁড়ে গেছে, সেখানে কালো কালি লাগানো, যাতে করে কারও নজরে না পড়ে। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে যে, অবস্থা পড়ে গেলেও ওর আত্মসম্মান বোধ নষ্ট হয়নি।”
“হুঁ। তোমার বিশ্লেষণ যে নির্ভুল তা মানতেই হয়।”
“আর লোকটি যে মাঝবয়সি, তার চুলে পাক ধরেছে, দু’-চার দিন আগে চুল কেটেছে আর চুলে লাইম ক্রিম লাগায়, এ সব কথাগুলো টুপিটার অস্তরটা দেখলেই বোঝা যায়। লেন্স দিয়ে দেখলেই দেখতে পাবে নাপিতের কঁচিতে কাটা ছোট ছোট চুল অস্তরের সঙ্গে একেবারে আটকে আছে যেন আঠা দিয়ে জোড়া। আর টুপিটা শুঁকলেই লাইম ক্রিমের গন্ধ পাবে। তা ছাড়া টুপিটায় যে-ধুলো লেগে রয়েছে তা রাস্তার নোংরা ধুলো নয়। এই ধরনের হলদে মোটা দানার ধুলো ঘরবাড়ির ভেতরেই হয়। এর মানে হল টুপিটা বহু দিন ঘরের ভেতরে টাঙানো ছিল। আর টুপির ভেতরে লক্ষ করলে দেখবে ঘামের দাগ পড়ে গেছে। সুতরাং টুপির মালিকের মাথা ভীষণ ঘামে। আর এই ভীষণ ভাবে মাথা ঘেমে যাওয়াটা আর যাই হোক ভাল স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।”
“বেশ, তা না হয় হল। কিন্তু ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া চলছে এ কথাটা বুঝলে কী করে?”
“দেখতেই পাচ্ছ টুপিটায় কী পরিমাণ ধুলো জমেছে। তার মানে কেউ ওটাকে বুরুশ করেনি। কোনও লোক যখন ওই রকম ধুলো পড়া টুপি পরে বাড়ি থেকে বের হয় তখন বুঝতে হবে যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুবই রাগারাগি চলছে।”
“কিন্তু এও তো হতে পারে যে, লোকটি বিয়েই করেনি।”
“তা কী করে হবে? মনে নেই হাঁসটার পায়ে আটকানো কার্ডটায় কী লেখা ছিল। মিঃ বেকার নিশ্চয়ই তার স্ত্রীকে খুশি করবার জন্যে ওই মোটাসোটা হাঁসটা কিনেছিল।”
“তোমার তো দেখছি সব প্রশ্নের জবাবই তৈরি আছে। কিন্তু ওর বাড়িতে যে গ্যাস লাইন নেই সে কথা তুমি জানলে কী করে?”
“একটা বা দুটো চর্বির দাগ যে-কোনও কারণেই হতে পারে। কিন্তু টুপিটার পাঁচ পাঁচ জায়গায় চর্বির দাগ থেকে বুঝলাম যে লোকটি প্রায়ই জ্বলন্ত চর্বির কাছাকাছি আসে। আর একটু ভাবতেই উত্তরটা পেয়ে গেলাম। রাত্তিরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠবার সময় তার এক হাতে টুপি আর অন্য হাতে মোমবাতি থাকে। গ্যাস থেকে এই ধরনের চর্বির দাগ পড়ে না।…কী, এখন খুশি তো?”
“তোমার এই বিশ্লেষণ বেশ তাক-লাগানো বটে। তবে তুমি নিজেই বললে যে এ ঘটনাটার সঙ্গে কোনও ক্রাইম বা অপরাধের যোগ নেই। আর এই হাঁসটা হারানো ছাড়া কোনও লোকেরই কোনও ক্ষতি হয়নি। তাই তোমার এত বুদ্ধি বৃথাই খরচ হল,” আমি হাসতে হাসতে বললাম।
হোমস আমার কথার উত্তরে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে ঘরের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল।
হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল পুলিশ কমিশনার পিটারসন। তার চোখমুখ দেখে মনে হল, কোনও ব্যাপারে সে এমন আশ্চর্য হয়েছে যে, তারই ধাক্কায় সে বেচারা একেবারে বেসামাল। হাঁফাতে হাঁফাতে সে বলল, “সেই হাঁসটা! মিঃ হোমস, সেই হাঁসটা!” শুনে হোমস বলল, “হ্যাঁ, সেই হাঁসটা! তা সেটার হয়েছে কী ? ফের জ্যান্ত হয়ে , ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সেটা কি রান্নাঘরের জানলা দিয়ে উড়ে পালাল ?” কথাটা বলে হোমস একটু নড়েচড়ে বসল, যাতে সে পিটারসনের মুখটা আর একটু ভাল করে দেখতে পায়।
“এই যে দেখুন না, মরা হাঁসের পেটের ভেতর থেকে আমার স্ত্রী কী পেয়েছেন।”
পিটারসন তার হাত আমাদের সামনে মেলে ধরল। তার হাতেই তেলোয় একটা খুব চকচকে নীল পাথর। পাথরটা আকারে একটা মটরশুঁটির দানার মতো, হয়তো একটু ছোটও হতে পারে। কিন্তু পাথরটা এত ভীষণ জ্বলজ্বলে যে, মনে হচ্ছিল পিটারসনের হাত থেকে আলো যেন ঠিকরে পড়েছে।
হোমস মুখ দিয়ে একটা শব্দ করল। “পিটারসন, এ যে একেবারে গুপ্তধন পাওয়া। তুমি কী পেয়েছ তুমি জানো কি?”
“এটা একটা হিরে। আর হিরে তো খুব দামি পাথর। এটা দিয়ে খুব সহজেই কাঁচ কাটা যায়।”
“এটা যত দামি পাথর আছে তার মধ্যে সব চাইতে দামি।”
“এটা মরকারের কাউন্টেসের সেই নীলকান্তমণি নাকি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ঠিক বলেছ। দু’-চার দিনের মধ্যে ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় রোজ যে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে তা পড়ে পড়ে এই পাথরটার আকার-আকৃতি আমার নখদর্পণে বলতে পারো। এটা যাকে বলে অতুলনীয়। এর আর জোড়া নেই। বাজারে এটার যে কত দাম হবে তা আন্দাজ করাও শক্ত। তবে এটা খুঁজে দিতে পারলে যে হাজার পাউন্ড পুরস্কার দেবার কথা বলা হয়েছে তা এই পাথরটার দামের কুড়ি ভাগের এক ভাগও নয়।”
“এক হাজার পাউন্ড! আরেব্বাস!” পিটারসন এই বলেই একটা চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে একবার আমার আর একবার হোমসের মুখের দিকে তাকাতে লাগল।
“পুরস্কার হিসেবে হাজার পাউন্ডের কথা বলা হয়েছে। তবে আমি যতদূর জানি তাতে বলতে পারি যে ওই নীলকান্তমণিটা ফিরে পাবার জন্যে কাউন্টেস তাঁর সম্পত্তির অর্ধেকও দিয়ে দিতে পারেন।”
আমি বললাম, “আমার যতদূর মনে পড়ছে এটা কসমোপলিটান হোটেল থেকে চুরি হয়ে যায়।”
“ঠিকই বলেছ। আজ থেকে পাঁচ দিন আগে, মানে ২২ ডিসেম্বর এটা চুরি যায়। জন হর্নার নামে একজন কলের মিস্ত্রিকে এটা চুরি করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। হর্নারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এতই গুরুতর যে, তাকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। দাঁড়াও, আমার কাছে বোধহয় কাগজপত্র সবই আছে।” হোমস তার চেয়ারের চারপাশে যে-সব কাগজ ছড়ানো ছিল সেগুলো ঘাঁটতে শুরু করল। তারপর একটা কাগজকে বেশ সমান ভাবে দু’ভাঁজ করে নিয়ে তার থেকে পড়তে লাগল:
কসমোপলিটান হোটেল থেকে দামি পাথর চুরি। ছাব্বিশ বছর বয়সি কলের জলের মিস্ত্রি জন হর্নারের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করা হয়েছে যে, সে মরকারের কাউন্টেসের বিখ্যাত ‘ব্লু কারবাঙ্কল’ নামে পরিচিত অত্যন্ত মূল্যবান পাথরটি চুরি করেছে। হোটেলের ওপরতলাগুলির তদারকির ভার যার ওপর সেই জেমস রাইডারই এই অভিযোগ করেছে। কাউন্টেসের ঘরের একটা ভাঙা চুল্লি ঝালাই করবার জন্যে রাইডার হর্নারকে ডেকে নিয়ে আসে। হর্নার যখন কাজ করছিল রাইডার তখন ওই ঘরেই ছিল। হঠাৎ তাকে কাজের জন্যে অন্য জায়গায় যেতে হয়। ফিরে এসে রাইডার দেখে হর্নার চলে গেছে। কিন্তু সে লক্ষ করে যে ঘরের দেরাজটা ভাঙা। আর টেবিলের ওপরে একটা ছোট্ট মরক্কো চামড়ার কৌটো খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। পরে জানতে পারা যায় যে, ওই কৌটোতেই ‘ব্লু কারবাঙ্কল’ রাখা ছিল। রাইডার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঘটনার কথা সকলকে জানিয়ে দেয়। সেই দিনই সন্ধেবেলায় পুলিশ হর্নারকে গ্রেফতার করে। যদিও তার ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাথরটা পাওয়া যায়নি। কাউন্টেসের নিজের ঝি ক্যাথরিন কুসাক সাক্ষী দিতে গিয়ে বলে যে, রাইডারের চিৎকার শুনে সে ঘরে ছুটে গিয়ে দেখে যে, কাউন্টেসের দেরাজ ভাঙা আর টেবিলের ওপর কৌটো খোলা। মোটমাট ক্যাথরিন কুসাক রাইডারের কথায় সায় দেয়। এরপর বি ডিভিশনের ইন্সপেক্টর ব্র্যাডস্ট্রিট হর্নারের গ্রেফতারের ব্যাপারে সাক্ষী দিয়ে বলে যে, তাকে গ্রেফতার করতে গেলে সে প্রচণ্ড বাধা দেয় আর বার বার বলতে থাকে যে, তার কোনও দোষ নেই। সে এ ব্যাপারের কিছুই জানে না। হর্নারের বিরুদ্ধে আগে ছিঁচকে চুরির অভিযোগ থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট তখনই কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা বিচারের জন্যে আদালতে পাঠিয়ে দেন। ম্যাজিস্ট্রেটের কামরায় হর্নার আগাগোড়া খুবই অস্থির আর উত্তেজিত ছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের রায় শুনে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তাকে ধরাধরি করে ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট থেকে নিয়ে যেতে হয়।
“হুঁ, এই তো গেল পুলিশ কোর্টের খবর।” খবরের কাগজের পাতাটা পাশে সরিয়ে রেখে হোমস বলল। হোমসের হাবভাব দেখে আমার মনে হল যে, সে যেন বেশ ভাবনায় পড়ে গেছে।
“এখন যে-প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজে বের করতে হবে সেটা হল কী ভাবে ওই পাথরটা চুরি গেল আর কী করেই বা সেটা টটেনহ্যাম কোর্ট রোডের একটা বাড়ির রান্নাঘরে একটা মরা হাঁসের পেট থেকে বেরোল।…এখন তো দেখতে পাচ্ছ ওয়াটসন যে আমাদের ওই বিশ্লেষণের ব্যাপারটা কত গুরুতর চেহারা নিয়েছে। এখন আর ওই ব্যাপারটা মোটেই নির্দোষ নেই। এই দেখো পাথরটা। পাথরটা পাওয়া গেছে একটা হাঁসের পেট থেকে। আর হাঁসটা হচ্ছে মিঃ হেনরি বেকারের, মানে সেই লোকটির যার পুরনো ছেঁড়া-ফাটা টুপিটা আমাদের হাতে এসেছে। আর তার সম্বন্ধে কিছু কিছু কথা আমি তোমাকে বলেছি এবং যে কথাগুলো তুমি তেমন গ্রাহ্য করোনি। এখন আমাদের প্রথম কাজ হল ওই লোকটিকে খুঁজে বের করা। তারপর আমাদের জানতে হবে যে, ওই রহস্যময় ব্যাপারের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগাযোগ আছে কিনা। আর তা করতে হলে প্রথমেই সবচেয়ে সোজা রাস্তাটা আমাদের নেওয়া উচিত। আমরা সব সান্ধ্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেব। যদি বিজ্ঞাপনে কোনও ফল হয় তো অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।”
“বিজ্ঞাপনটা কী ভাবে দেবে ভাবছ?”
“আমাকে একটা কাগজ আর পেনসিল দাও। দাঁড়াও, এই ভাবে লিখলে কেমন হয়—
গুজ স্ট্রিটের মোড়ে একটা হাঁস আর একটা ফেল্ট টুপি পাওয়া গেছে। মিঃ হেনরি বেকার, ২২১ বি বেকার স্ট্রিটে সন্ধে সাড়ে ছ’টার পর নিজে এসে দেখা করলে তার জিনিস ফেরত পাবেন।
“কী, সব বেশ পরিষ্কার করে গুছিয়ে বলা হয়নি?”
“তা হয়েছে। তবে কথা হচ্ছে এ বিজ্ঞাপন কি তার নজরে পড়বে?”
“দেখো, একজন গরিব লোকের পক্ষে এই ভাবে একটা হাঁস ফেলে আসা সোজা ব্যাপার নয়। বেশ বড় রকমের একটা লোকসানই বলা যায়। একে তো দোকানের কাচের শার্সি দৈবাৎ ভেঙে ফেলে বেচারা ঘাবড়ে যায়, তার ওপর আবার পুলিশের পোশাক-পরা পিটারসনকে ছুটে আসতে দেখে সেই জায়গা থেকে পালানোর কথা ছাড়া আর কিছুই সে ভাবতে পারেনি। আমার মনে হয় যে, পরে ওই ভাবে হাঁসটা ফেলে আসার জন্যে সে নিশ্চয়ই খুব আপশোস করছে। আর তা ছাড়া আমরা তো বিজ্ঞাপনে নাম দিয়ে দিচ্ছি। তাই ও নিজে যদি না-ও দেখে তো ওর চেনা শোনা কেউ দেখতে পেলে নিশ্চয়ই ওকে বিজ্ঞাপনের কথা বলবে।…পিটারসন, এই বিজ্ঞাপনটা কোনও বিজ্ঞাপন কোম্পানির মারফত আজই ছাপাবার ব্যবস্থা করো।”
“কোথায় দিতে বলছেন?”
“গ্লোব, স্টার, পলমল, সেন্ট জেমসেস্ গেজেট, ইভনিং নিউজ, স্ট্যান্ডার্ড, একো, এগুলোতে দাও। আর, এ ছাড়া অন্য যেখানে দিতে চাও দিয়ো।”
“ঠিক আছে। আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।…আর ওই পাথরটা?”
“ওটা আমি আমার কাছে রেখে দিচ্ছি। হ্যাঁ ভাল কথা, বিজ্ঞাপন দিয়ে যখন ফিরে আসবে তখন সেই হাঁসটার সাইজের একটা হাঁস কিনে এনো। যে-লোকটির হাঁসটা এখন তোমার রান্নাঘরে ডেকচিতে টগবগ করে ফুটছে, সে এলে তাকে তো একটা কিছু দিতে হবে।”
পিটারসন চলে যাবার পর হোমস সেই পাথরটা আলোর সামনে ধরল।
“দারুণ জিনিস। দেখছ কেমন চকচক করছে। এটার চারদিক দিয়ে আলো একেবারে ঠিকরে বেরোচ্ছে। বুঝতেই পারছ যত গণ্ডগোলের মূল হল এই পাথরটি। সত্যি কথা বলতে কী, দামি পাথর বোধহয় এমনই টোপ যা অপরাধীরা না গিলে পারে না। পৃথিবীতে যতগুলো বিখ্যাত দামি পাথর আছে তাদের প্রতিটার জন্যেই কত যে চুরি আর খুনজখম হয়েছে তা বোধহয় বলে শেষ করা যায় না। এই পাথরটার কথাই ধরো না। এর বয়স মাত্র কুড়ি বছর। এটা পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণ চিনের আময় নদীর তীরে। এ পাথরটার বিশেষত্ব হল যে, এটা দেখতে হবহু কারবাঙ্কলের মতো, শুধু রংটা চুনির মতো লাল নয়, নীল। এর বয়স কম বটে, কিন্তু এর ইতিহাস বড় সাধারণ নয়। এটির জন্যে ইতিমধ্যেই দু’জন খুন হয়েছে, একজনকে অ্যাসিড ছুড়ে মারা হয়। একজন আত্মহত্যা করেছে। আর এটা যে কত বার চুরি গেছে তা বোধহয় বলে শেষ করা যায় না। এত কাণ্ড ঘটে গেছে শুধু মাত্র চল্লিশ গ্রেন ওজনের এক টুকরো স্ফটিকায়িত কাঠকয়লার জন্যে। যাকগে, এখন এটাকে ভাল করে তুলে রেখে কাউন্টেসকে একটা চিঠি লিখে সব কথা জানিয়ে দিই।”
“তোমার কি এই হর্নার লোকটাকে নির্দোষ বলে মনে হয়?”
“আমি বলতে পারছি না।”
“আর ওই হেনরি বেকার লোকটি কি এই ব্যাপারের মধ্যে আছে নাকি?”
“আমার মনে হয় হেনরি বেকার বোধহয় নির্দোষ। আমার বিশ্বাস ওই হাঁসটা যে সোনার চেয়েও দামি এ কথা বোধহয় ও জানতই না। অবশ্য আমার এ ধারণাটা ঠিক না বেঠিক সেটা জানতে পারব যদি আমার এই বিজ্ঞাপনটা তার নজরে পড়ে।”
“ততক্ষণ তা হলে তুমি কিছুই করছ না?”
“না, কিছুই না।”
“তবে আমি একচক্কর রুগি দেখে আসি। সন্ধে ছ’টা নাগাদ ফিরে আসব। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা না জানতে পারলে ঘুম হবে না।”
“বহুত আচ্ছা। তা হলে রাত্তিরে ডান হাতের কাজটা এখানেই সারবে। আজ বনমুরগি আছে। তবে যে-সব কাণ্ড ঘটছে তাতে মিসেস হাডসনকে বলে রাখতে হবে মুরগিটা যেন ভাল করে খুঁজেটুজে দেখে।”
এক জায়গায় একটু আটকে পড়েছিলাম। যখন বেকার স্ট্রিটে ফিরে এলাম তখন সাড়ে ছ’টা বেজে গেছে। সদর দরজার কাছে আসতে দেখলাম লম্বামতো একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার কোটের গলা পর্যন্ত বোতাম আটকানো। আমি তার পিছনে এসে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেল। আমরা দু’জনে ঢুকে গেলাম। আমরা সোজা হোমসের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
হোমস তার আরামকেদারা ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে বেশ একগাল হেসে অপরিচিত লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি নিশ্চয়ই মিঃ হেনরি বেকার ? আগুনের পাশের ওই চেয়ারটায় বসুন। আজকে খুব ঠান্ডা পড়েছে। আপনি দেখছি উপযুক্ত জামাকাপড় পরেননি।…আরে আরে ওয়াটসন, তুমিও ঠিক সময়েই এসে পড়েছ দেখছি। আচ্ছা মিঃ বেকার, এই টুপিটা কি আপনার?”
“হ্যাঁ, এ টুপিটা আমারই বটে।”
লোকটির শরীর বেশ মজবুত। লম্বা। কাঁধ বেশ চওড়া। মাথাটা প্রকাণ্ড। লোকটির মুখে-চোখে বেশ বুদ্ধির ছাপ৷ ছুঁচলো কাঁচা-পাকা দাড়ি। নাকের ডগা আর গালদুটো লাল। লক্ষ করলাম মাঝে মাঝেই তার হাতদুটো কেঁপে উঠছে। তার গায়ের গলাবন্ধ ফ্রক কোটটা বহু পুরনো। কোটের ভেতর দিয়ে তার হাতের কবজি দেখা যাচ্ছিল। বুঝলাম তার কোটের ভিতরে শার্ট নেই। লোকটি খুব থেমে থেমে আস্তে কথা বলছিল। আর যা বলছিল তা-ও বেশ ভেবে চিন্তেই বলছিল। কথার ধরন থেকে বোঝা যায় যে, সে মোটামুটি শিক্ষিত। তবে এখন যে-কোনও কারণেই হোক সে বেশ অসুবিধের মধ্যে আছে।
“আপনার জিনিসগুলো ক’দিন হল আমাদের কাছেই আছে। আমি ভেবেছিলাম যে আপনি হয়তো কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন। আপনি কোনও বিজ্ঞাপন দেননি তো?”
লোকটি মাথা নিচু করে লজ্জিত ভাবে হেসে বলল, “এখন আর আগেকার মতো পকেটের জোর তো নেই। আর আমার মনে হয়েছিল যে, গুন্ডার দল হাঁস আর টুপি নিয়ে ভেগেছে। ওগুলো পাবার আর কোনও আশা নেই ভেবে বিজ্ঞাপন দিয়ে আর মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করতে চাইনি।”
“সেটা অবশ্য একটা কথা বটে। ভাল কথা, আমরা কিন্তু হাঁসটা রেঁধে খেয়ে ফেলেছি।”
“খেয়ে ফেলেছেন!” লোকটি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। মনে হল ভেতরে ভেতরে সে খুবই চটেছে।
“হ্যাঁ। নইলে ওটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তবে টেবিলের ওপরে ওই যে হাঁসটা দেখছেন ওটা বোধহয় আপনার হাঁসটার মতোই হবে। ওটাতে কি আপনার কাজ চলবে?”।
টেবিলের দিকে তাকিয়ে মিঃ বেকার বেশ খুশি হয়েই জবাব দিল, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।”
“তবে আপনার সেই হাঁসটার পালক পা সবই রাখা আছে। যদি—”।
লোকটি হো হো করে হেসে উঠে বলল, “ওইগুলো সে রাতের অ্যাডভেঞ্চারের সাক্ষী হিসেবে খুবই দামি বটে, কিন্তু ওগুলো আর কী কাজে লাগবে জানি না। আপনি অনুমতি দিলে আমি ওই চমৎকার গোটা হাঁসটাই নিয়ে যাই।”
হোমস আমার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে কাঁধদুটো অল্প ঝাঁকাল। তারপর লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তা হলে এই নিন আপনার টুপি আর ওই আপনার হাঁস।
ভাল কথা, যদি আপত্তি না থাকে তো ওই হাঁসটা কোথায় কিনেছিলেন বলবেন কি? আমি আবার ওই হাঁস-মুরগির ব্যাপারে ভীষণ ইন্টারেস্টেড কিনা। সত্যি কথা বলতে কী ওরকম নধরকান্তি হাঁস আমি খুব কমই দেখেছি।”
“বলছি,” বলে হেনরি বেকার উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে তার জন্যে রাখা হাঁসটা তুলে নিয়ে বগলদাবা করল। “মিউজিয়ামের কাছে ‘আলফা ইন্’ বলে একটা রেস্টুর্যান্ট আছে। আমরা কয়েকজন সেখানে রোজই সন্ধের দিকে জড়ো হই। দিনের বেলাটা অবশ্য আমি মিউজিয়মেই থাকি। এ বছর আলফা ইনের মালিক উইন্ডিগেট ‘গুজ ক্লাব’ বলে একটা ক্লাব তৈরি করেছিল। উদ্দেশ্য—সপ্তাহে সপ্তাহে কয়েক পেনি করে দিলে ক্রিসমাসের সময় একটা করে হাঁস পাওয়া যাবে। আমি আমার চাঁদা নিয়মিত দিয়ে গেছি। তার পরের ব্যাপার তো সবই আপনার জানা।”
হোমসকে অনেক বার ধন্যবাদ দিয়ে বেশ ঘটা করে অভিবাদন জানিয়ে হেনরি বেকার চলে গেল। লোকটির রকমসকম দেখে আমার বেজায় হাসি পাচ্ছিল। লোকটি চলে গেলে হোমস বলল, “তা হলে হেনরি বেকারের পালা সাঙ্গ হল। বোঝা গেল, আসল ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গ কিছুই উনি জানেন না। ওয়াটসন, তোমার কি খিদে পেয়েছে?”
বললাম, “না, কিন্তু কেন বলো তো?”
“তবে চলো একটু ঘুরে আসা যাক। আমাদের হাতে যে সূত্র হঠাৎই এসে পড়েছে, তা একবার যাচাই করে দেখে আসি।”
“উত্তম প্রস্তাব।”
বাইরে বেরিয়ে দেখি প্রচণ্ড ঠান্ডা। মাফলারে গলা বেশ ভাল করে ঢেকে আমরা ওভারকোটের সব বোতাম আটকে নিলাম। আকাশে তারাগুলো সব চকচক করছে। আকাশে কোথাও এক টুকরো মেঘ নেই। রাস্তায় যে-সব লোকজন হাঁটছে তাদের নিশ্বাসের শব্দ ঠিক পিস্তলের গুলি ছোড়ার ফট ফট শব্দের মতো শোনাচ্ছিল। ফুটপাতে জুতোর খটখট আওয়াজ তুলতে তুলতে আমরা উইমপোল স্ট্রিট ধরে হারলি স্ট্রিট হয়ে উইগমোর স্ট্রিট পেরিয়ে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে এসে পড়লাম। মিনিট পনেরোর মধ্যে আমরা ব্লুম্স্বেরি অঞ্চলের আলফাইনের কাছে এসে পড়লাম। যে রাস্তাটা হবোর্নের দিকে গেছে তারই কোণে এটা একটা ছোট রেস্টুর্যান্ট। হোমস দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দু’কাপ গরম কফির অর্ডার দিল। হোটেলের মালিকটি যাকে বলে লালমুখো।
“তোমার হাঁসের মাংস যে রকম ভাল খেতে, তোমার কফিও যদি সে রকম হয় তা হলে তো দারুণ ব্যাপার হবে,” হোমস বলল।
আলফা ইনের মালিক রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে বলল, “আমার হাঁস ? মানে—”
“হ্যাঁ। এই তো আধ ঘণ্টা আগেই আমি মিঃ হেনরি বেকারকে বলছিলাম। বেকার তো তোমার গুজ ক্লাবের একজন সভ্য।”
“ও, তাই বলুন। এখন বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সে তো আমার হাঁস নয়।”
“তাই নাকি? তবে ওগুলো কার হাঁস।”
“কভেন্ট গার্ডেনের এক দোকানদারের কাছ থেকে আমি দু’ডজন কিনে এনেছিলাম।”
“আচ্ছা। ওখানকার কয়েকজন মাংসওলার সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। তা এগুলো কার দোকানের?”
“এগুলো ব্রেকেনরিজের দোকান থেকে নিয়েছিলাম।”
“না, ওকে আমি চিনি না। আচ্ছা আজ উঠি। তোমার ব্যবসা দিনে দিনে জমে উঠুক এই কামনা করি।”
রেস্টুর্যান্ট থেকে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি বরফের মতো ঠান্ডা কনকনে জোর বাতাস দিচ্ছে। এই বাতাসের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে হোমস বলল, “চলো এবার তবে ব্রেকেনরিজের সন্ধান করা যাক।…বুঝলে ওয়াটসন, যদিও আমরা একটা হাঁসের পেছনে ধাওয়া করেছি এ কিন্তু নিছক বুনো হাঁস তাড়া করা নয়। মনে রেখো এর সঙ্গে একজন লোকের ভাগ্য, তার ভাল-মন্দ জড়িয়ে রয়েছে। আমরা যদি এ কথা প্রমাণ করতে না পারি যে, সে কোনও দোষ করেনি তা হলে খুব কম হলেও তার অন্তত সাত বছর জেল হবে। অবশ্য এমনও হতে পারে যে, আমাদের অনুসন্ধানের ফলেই তার দোষ প্রমাণ হবে আর তার সাজা হবে। কিন্তু সে যাই হোক, আসল কথা হচ্ছে যে, আমাদের হাতে এমন একটা সূত্র, বলতে পারো প্রায় বরাত জোরেই এসে গেছে, যার খবর পুলিশ পায়নি। তাই এ ব্যাপারের শেষ পর্যন্ত আমাদের দেখতেই হবে। সুতরাং, চলো বন্ধু, এখন দক্ষিণ দিকে হাঁটা দিই।”
আমরা হবোর্ন ছাড়িয়ে এন্ডেল স্ট্রিট ধরে চললাম। তারপর বিভিন্ন রাস্তার গোলকধাঁধা পার হয়ে আমরা কভেন্ট গার্ডেনের বাজারে এসে পৌঁছোলাম। একটা বড় দোকানের সাইনবোর্ডে বেশ মোটা মোটা হরফে ব্রেকেনরিজের নাম লেখা। ব্রেকেনরিজের মুখটা লম্বাটে, ঘোড়ার মতো। তবে নাক-চোখ বেশ ধারালো। আমরা যখন তার দোকানে গিয়ে হাজির হলাম তখন সে আর তার বাচ্চামতো এক সহকারী দোকান বন্ধ করার জোগাড় করছিল।
“গুড ইভমিং। আজ ঠান্ডাটা বেশ জব্বর পড়েছে,” হোমস বলল।
কোনও কথা না বলে অল্প মাথা ঝাঁকিয়ে সে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। দোকানের মাল রাখবার সাদা মার্বেল পাথরের টেবিলটা দেখিয়ে হোমস বলল, “সব হাঁসই বিক্রি হয়ে গেছে দেখছি।”
“কাল সকালে যতগলো চাই, এমনকী পাঁচশোটা হলেও দিতে পারব।”
“তাতে আমার কাজ হবে না।”
“তা হলে ওই যে সামনের দোকানটায় আলো জ্বলছে, ওখানে গেলে পাওয়া যেতে পারে।”
“কিন্তু আমাকে যে বিশেষ করে এই দোকান থেকেই নিতে বলেছে।”
“কে বলেছে?”
“আলফা রেস্টুর্যান্টের মালিক।”
“বুঝেছি। তাকে আমি ডজন-দুই মাল দিয়েছিলাম বটে।”
“হাঁসগুলো দারুণ ছিল। ভাল কথা, ওগুলো কোথাকার হাঁস ?”
“হোমসের এই কথায় দোকানদার যে রকম রেগে ঝাঁঝিয়ে উঠল, তাতে তো আমি হতবাক।
ঘাড় বেঁকিয়ে হাতের আস্তিন গুটিয়ে দস্তুরমতো রুখে উঠে সে বলল, “আপনি…আপনি কী বলতে চাইছেন শুনি? যা বলবার তা সোজাসুজি বলুন তো?”
“কোনও বাঁকা কথা তো বলিনি। বলছিলাম যে, আলফা রেস্টুর্যান্টের মালিককে যে হাঁসগুলো পাঠানো হয়েছিল সেগুলো কোথা থেকে জোগাড় করা হয়েছিল।”
“ও, তাই নাকি, এই কথা। যদি বলি বলব না—কী করবেন শুনি ?”
“এটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। না বলতে চাইলে বোলো না। তবে এই সাধারণ কথায় হঠাৎ এত রেগে যাবার মতো কী হল সেটা বুঝতে পারলাম না।”
“রেগে যাব না? যদি আপনাকেও কেউ এই রকম ভাবে বিরক্ত করত তো আপনিও রেগে যেতেন। আরে বাবা ভাল জিনিস ভাল দামে কিনব, ভাল দামে বিক্রি করব। ব্যস ঝামেলা চুকে গেল। তা নয়, কোথাকার এক উটকো ফ্যাসাদ! সেই হাঁসগুলো কোথা গেল ? কাকে বিক্রি করেছ? কত করে বিক্রি করেছ? যত সব আবোলতাবোল প্রশ্ন। লোকগুলো এমন ভাব দেখাচ্ছে যে, পৃথিবীতে ওই ক’টা ছাড়া আর যেন কোনও হাঁসই নেই।”
দোকানদারের কথায় কোনও আমল না দিয়ে হোমস বলল, “যারা ওই হাঁসগুলো নিয়ে তোমাকে বিরক্ত করেছে তাদের আমি চিনি না। তবে তুমি যদি আমার কথার জবাব না দাও তো আমাদের বাজিটা আর জেতা হবে না। এই হাঁস-মুরগির ব্যাপারে আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বাজি লড়তে রাজি। আমি একজনের সঙ্গে বাজি রেখেছি যে ওগুলো পাড়াগাঁয়ের হাঁস।”
“তা হলে আপনি বাজিতে হেরেছেন। ওগুলো শহর থেকে জোগাড় করা।”
“অসম্ভব। তা হতেই পারে না।”
“আমি বলছি এগুলো শহরের ফার্ম থেকে কেনা হাঁস।”
“তোমার কথা মানতে পারছি না।”
“আপনি কি মনে করেন হাঁস মুরগির ব্যাপারে আপনি আমার চাইতে বেশি বোঝেন ? জানেন আমি ছোটবেলা থেকে এ কাজ করছি। আমি বলছি যে, যে-হাঁস আলফার ম্যানেজারকে পাঠানো হয়েছিল তা পাড়াগাঁয়ের নয়, শহরের ফার্মে বড় করা।”
“বাজে কথা বোলো না।”
“বাজে কথা? বেশ, আপনি আমার সঙ্গে বাজি লড়বেন?”
“সে তুমি বোঝো; তোমার পয়সা তুমি লোকসান করবে কি না। তবে আমি যে ঠিক বলছি সে ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই। ঠিক আছে, ধরো এক সভরেন বাজি। তাতে আর কিছু না হোক এই শিক্ষা পাবে যে, বাজে তক্ক করতে নেই।”
হোমসের কথায় দোকানদার বেশ একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসল। তারপর তার সহকারীকে বলল, “বিল, আমাদের খাতাটা নিয়ে এসো তো।”
বিল ছোকরা একটা ছোট নোটবই আর একটা বড় লেজার খাতা এনে টেবিলের ওপর আলোর সামনে রাখল।
“এইবার সবজান্তা মশাই,” হোমসের দিকে তাকিয়ে দোকানদার বলল, “এই ছোট খাতাটা দেখুন।”
“হ্যাঁ, তো কী হল?”
“আমি যাদের কাছ থেকে মাল কিনি তাদের নাম এই খাতাতে লেখা আছে। দেখতে পাচ্ছেন ? এই পাতায় পাড়াগাঁর যে-সব লোকের কাছ থেকে মাল কিনি তাদের নাম লেখা আছে। আর নামের পাশে যে সংখ্যাটা লেখা রয়েছে সেটা হচ্ছে লেজার খাতার পাতার নম্বর। সেখানে কেনাবেচার সব হিসেব লেখা আছে। আর ওই পাতায় লালকালিতে লেখা নাম—সেগুলো আমার সব শহুরে পোলট্রি ফার্ম মালিকদের নামের তালিকা। এইবার এই তিন নম্বরের নামটা চেঁচিয়ে পড়ুন শুনি।”
“মিসেস ওকশট। ১১৭ ব্রিকস্টন রোড। ২৪৯,” হোমস চেঁচিয়ে পড়ল।
“ঠিক। এবার লেজার খাতার ২৪৯ পাতাটা খুলে দেখুন।”
হোমস ২৪৯ পৃষ্ঠা খুলল।
“ওই তো লেখা রয়েছে—মিসেস ওকশট, ১১৭ ব্রিকস্টন রোড, ডিম-হাঁস-মুরগি জোগানদার।”
“বেশ। নীচে ওটা কী লেখা রয়েছে যেন?”
“২২ ডিসেম্বর। চব্বিশটা হাঁস প্রতিটা সাত শিলিং ছ পেন্স দরে।”
“ঠিক তো? তবে এবার কী হল? তলায় ওটা কী লেখা রয়েছে?”
“আলফার মালিক মিঃ উইন্ডিগেটকে প্রতিটা বারো শিলিং দরে বিক্রি করা হল।”
“তা হলে সবজান্তামশাই, এবার কী বলছেন?”
দেখে মনে হল যে, হোমস সত্যিই খুব দুঃখিত হয়েছে। তারপর অত্যন্ত বেজার মুখ করে একটা সভরেন পকেট থেকে বের করে টেবিলের ওপর ফেলে দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। তার হালচাল দেখে মনে হল সমস্ত ব্যাপারটায় সে এতই বিরক্ত হয়েছে যে, এ বিষয়ে আর কোনও কথাই বলতে চায় না। দোকান থেকে বেরিয়ে কোনও দিকে না তাকিয়ে গটগট করে খানিকটা হেঁটে গিয়ে একটা ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়াল। তারপর হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল।
“যখনই ওই রকম দাড়ি-গোঁফওলা লোকের পকেট থেকে লাল মলাটের বই উঁকি দিতে দেখবে তখনই তুমি নিশ্চিত ভাবে জানবে যে, সহজেই তাকে বাজি ধরাতে পারবে। আমি যদি ওকে একশো পাউন্ড দিতাম তা হলে ও এত খবর আমাকে দিত কি না সন্দেহ। ওই বাজি খেলে এক সভরেন জেতার আনন্দে ও গড়গড় করে সব কথা বলে ফেলল।…বুঝলে ওয়াটসন, মনে হচ্ছে যে, সমস্যার সমাধান প্রায় হাতের মুঠোয় এসে পড়েছে। এখন কথা হচ্ছে যে, মিসেস ওকশটের সঙ্গে আজ রাত্রেই দেখা করব না কাল সকালে দেখা করব। যতটুকু বুঝতে পারছি আমরা ছাড়াও আরও কোনও কোনও লোক ওই হাঁস সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে।”
একটা প্রচণ্ড গোলমালে হোমসের কথা চাপা পড়ে গেল। আমরা যে-দোকানটা থেকে একটু আগেই বেরিয়ে এসেছি সেইখান থেকেই গোলমালটা আসছে। ভাল করে নজর করতে দেখলাম যে দোকানের দরজার গোড়ায় একজন ছুঁচোমুখো লোক ভিজে-বেড়ালের মতো জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর ঘুসি বাগিয়ে ব্রেকেনরিজ তার সামনে খুব চোটপাট করছে। ব্রেকেনরিজের গলা শুনতে পেলাম। “তোমরা তোমাদের ওই হাঁস নিয়ে গোল্লায় যাও, জাহান্নামে যাও। আমি তোমাদের কিচ্ছু জানি না। এই শেষ বারের মতো বলে দিচ্ছি, আর যদি ওই হাঁসের কথা আমার কাছে তোলো তো তোমাদের পেছনে কুকুর লেলিয়ে দেব। যাও, মিসেস ওকশটকে ডেকে নিয়ে এসো। যা বলবার, আমি তাকেই বলব। তোমাকে বলব কেন? আমি কি হাঁসগুলো তোমার কাছ থেকে কিনেছিলাম?”
সেই ভিজে-বেড়াল লোকটি প্রায় কাঁদো কাঁদো ভাবে বলল, “না না, তা নয়। তবে কিনা ওই হাঁসগুলোর মধ্যে একটা আমার ছিল।”
“সে তুমি মিসেস ওকশটের সঙ্গে বোঝাপড়া করো।”
“মিসেস ওকশটই তো তোমার সঙ্গে দেখা করতে বললেন।”
“মিসেস ওকশট কেন, প্রুশিয়ার রাজা বললেও ভারী আমার বয়ে গেল। এ নিয়ে আমি ঢের ব্যতিব্যস্ত হয়েছি, আমি বলছি এ ব্যাপারের কোনও কিছু আমি জানি না। যাও, এখন এখান থেকে ভাগো!” ব্রেকেনরিজ তার দিকে তেড়ে আসতেই লোকটা পিঠটান দিল।
“যাক, শেষ পর্যন্ত ব্রিকস্টন রোড পর্যন্ত যাবার দরকার না-ও হতে পারে। চলো একটু এগিয়ে দেখা যাক ওই লোকটার কাছ থেকে কোনও খবর পাওয়া যায় কিনা,” হোমস চুপি চুপি আমাকে বলল।
রাস্তায় কিছু বেকার লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জটলা করছিল। তাদের পাশ কাটিয়ে হোমস তাড়াতাড়ি পা চালাল। একটু পরেই হোমস পেছন থেকে তার জামা ধরে আস্তে টানল। অসম্ভব রকম চমকে গিয়ে ফিরে তাকাল সে। রাস্তার আলোয় দেখলাম তার মুখ ভয়ে একদম সাদা।
সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোনও রকমে বলল, “কে আপনি? কী চান ?”
হোমস খুব মিষ্টি করে বলল, “মাফ করবেন, একটু আগে ওই দোকানদারের সঙ্গে আপনার যে কথা হচ্ছিল, তা আমার কানে এসেছে। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আমি হয়তো আপনাকে কিছু সাহায্য করতে পারি।” লোকটা তাতে আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “আপনি…কে আপনি? এ ব্যাপারে আপনি কী জানেন?” হোমস আবারও মিষ্টি করে বলে, “আমার নাম শার্লক হোমস। অন্যেরা যা জানে না, সেই সব খবর জানাই আমার পেশা।”
“কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও কিছু তো আপনার জানবার কথা নয়।”
“ভুল বুঝবেন না। এ ব্যাপারের আগাগোড়া সবই আমার জানা। যে-হাঁসগুলো ব্রিকস্টন রোডের মিসেস ওকশট ব্রেকেনরিজকে বিক্রি করেছিল, যেগুলো ব্রেকেনরিজ আবার আলফা রেস্টুর্যান্টের মালিককে বিক্রি করেছিল, আবার সেগুলো তার ক্লাবের মেম্বারদের মধ্যে বিলি করেছিল, যাদের মধ্যে একজন হল মি. হেনরি বেকার, সেই হাঁসগুলোর হদিস আপনি জানতে চাইছেন, তাই নয় ?”
“আঃ হা! আমি মনে মনে বোধহয় আপনাকেই খুঁজছিলাম। আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না যে, এ ব্যাপারটা আমার পক্ষে কী ভীষণ জরুরি। জীবন-মরণ সমস্যাও বলতে পারেন।”
একটা ভাড়া গাড়ি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। শার্লক হোমস গাড়িটাকে ডাকল।
“তা হলে চলুন কোথাও একটু আরাম করে বসে সমস্ত ব্যাপারটা আলোচনা করা যাক। এই দারুণ ঠান্ডায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার কোনও মানে হয় না। তবে সবার আগে আপনার পরিচয়টা জানতে পারলে ভাল হত।”
একটু থতমত খেয়ে লোকটি বলল, “আমার নাম জন রবিনসন।”
শার্লক হোমস একটু হেসে বলল, “না, না, আপনার আসল নামটা বলুন। যিনি নিজের আসল পরিচয় গোপন রাখতে চান, তাঁর সঙ্গে কাজ করে সুখ নেই।”
লোকটির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। “আমার নাম জেমস রাইডার।”
“ভাল, ভাল। হোটেল কসমোপলিটানের একজন কর্মচারী। আচ্ছা চলুন এখন গাড়িতে ওঠা যাক। আপনি যা যা জানতে চান আমার মনে হয় সে সব খবরই আমি দিতে পারব।”
রাইডার একবার আমার আর একবার হোমসের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। তার মুখ দেখে আমার মনে হল যে, তার মনে ভয় আর লোভের একটা টানাপোড়েন চলছে। সে বুঝে উঠতে পারছিল না আমাদের সঙ্গে এলে তার লাভ হবে না ক্ষতি হবে। দোনামোনা করতে করতে সে গাড়িতে চড়ে বসল। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে গেলাম। গাড়িতে আর বিশেষ কোনও কথাবার্তা হল না। তবে আমাদের সঙ্গীটি যে রকম অস্থির ভাবে তার হাত খোলা বন্ধ করছিল আর ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছিল তাতে বোঝা যাচ্ছিল যে, সে মনে মনে ভয়ানক রকম উদ্বিগ্ন।
ঘরে পা দিয়ে হোমস বেশ খুশি হয়ে বলল, “আহ্। বাইরের হাড়কাঁপানো ঠান্ডার পর ঘরের এই আগুন ভীষণ আরামদায়ক লাগছে। মিঃ রাইডার, আপনি দেখছি ঠান্ডায় খুবই কাবু হয়ে পড়েছেন। এই বেতের চেয়ারটায় ভাল করে বসুন। রাস্তার জুতোটা বদলে আসি, তারপর কথাবার্তা হবে।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে এসে হোমস বলল, “বেশ। আপনি জানতে চাইছেন যে, সেই হাঁসগুলো কোথায় গেল, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
না। আমার মনে হয় হাঁসগুলোর সম্বন্ধে নয়, আপনি জানতে চাইছেন বিশেষ একটি হাঁসের কী হল? আর সেই হাঁসটার শুধু লেজের দিকে একটা কালো ডোরা ছাড়া সবটাই সাদা। তাই তো?”
রাইডার যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়বে বলে আমার মনে হল। “আপনি…আপনি জানেন সে হাঁসটা কোথায়?”
“সেটা এখানে এসেছিল।”
“এখানে?”
“হ্যাঁ। আর দেখা গেল সেটা একটা অসাধারণ হাঁস। সুতরাং ওই হাঁসটার সম্বন্ধে আপনার যে কৌতুহল থাকবে তাতে আমি মোটেই আশ্চর্য হইনি। আর জানেন, সেই মরা হাঁসটা একটা ডিম পেড়েছিল ? একটা খুব সুন্দর চকচকে নীল রঙের ডিম। ওটা আমি আমার মিউজিয়মে রেখে দিয়েছি।” রাইডার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সে টলে পড়ে যেত, দেওয়াল ধরে ফেলে কোনও রকমে সামলে গেল। হোমস একটা লোহার হাতবাক্স খুলল। বাক্স থেকে নীলকান্তমণিটা বের করে তার হাতে রাখল। সেটা খুব উজ্জ্বল তারার মতো চকচক করছিল। খুবই শুকনো মুখ করে রাইডার পাথরটার দিকে চেয়ে রইল। তার চোখের পাতা পড়ছিল না। সে ঠিক বুঝতে পারছিল না যে পাথরটা তার নিজের সম্পত্তি বলে দাবি করা ঠিক হবে কিনা।
খুব ঠান্ডা ভাবে হোমস বলল, “রাইডার, তোমার খেল খতম। না, না, চুপ করে দাঁড়াও। না হলে পেছনের আগুনে পড়ে যাবে। ওয়াটসন, ওকে ধরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দাও তো। এ ধরনের চুরি করতে গেলে যে ধরনের কড়া ধাতের লোক হওয়া দরকার এ মোটেই সে জাতের নয়। একে একটু ব্র্যান্ডি খাইয়ে দাও।…হ্যাঁ, এবার একে মানুষের মতো দেখাচ্ছে।”
আমারও মনে হয়েছিল লোকটা হয়তো মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়েই যাবে। এখন ব্রান্ডি খেয়ে মনে হল যেন একটু চাঙ্গা বোধ করছে। সে হোমসের দিকে কাতর ভাবে চেয়ে রইল।
“ব্যাপারটা কী ভাবে ঘটেছে তার মোটামুটি একটা হদিস আমি পেয়েছি। তোমার কাছে নতুন করে জানবার কিছু আমার নেই। তবে যদি কোনও কিছু বাদ পড়ে থাকে সেইজন্যে সবটা তোমার কাছে ঝালিয়ে নিলে ক্ষতি নেই।…রাইডার, তুমি নিশ্চয়ই কাউন্টেসের এই নীলকান্তমণির খবর আগে থেকে জানতে?”
“ক্যাথরিন কুসাক আমাকে এই পাথরটার কথা বলে,” গলা দিয়ে একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ করতে করতে রাইডার বলল।
“আচ্ছা। কাউন্টেসের সেই কাজের মেয়েটি। হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাবার লোভ তোমার চেয়ে ঢের উঁচুদরের মানুষেই সামলাতে পারে না, তুমি তো কোন ছার। কিন্তু বড়লোক হবার জন্যে যে রাস্তাটা ধরেছ সেটা ভাল নয়, নোংরা রাস্তা। তুমি মোটেই গোবেচারি নও। মাথাটি তোমার পেজোমিতে ভরা। তুমি নিশ্চয়ই জানতে যে, হর্নার লোকটা আগে একবার চুরি করে ধরা পড়েছিল। তাই তুমি ভেবেচিন্তে ব্যাপারটা এমন ভাবে সাজিয়ে ছিলে যে, দোষটা যাতে করে সহজে ওরই ঘাড়ে পড়ে। তাই তুমি নিজে, অথবা তুমি আর তোমার শাগরেদ কুসাক মিলে কাউন্টেসের ঘরে সামান্য ভাঙাচোরা করে রেখেছিলে আর তুমিই হর্নারকে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলে। সে কাজ সেরে চলে গেলে তোমরা ঘরের দেরাজ ভেঙে পাথরটা চুরি করে হইহট্টগোল শুরু করে দাও। আর তার ফলে হর্নার শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যায়। আর তখন তুমি—”
হোমসকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রাইডার সটান ঘরের কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়ে তার পা জাপটে ধরল। “দয়া করুন। আমার বুড়ো বাপ-মা’র কথা ভাবুন। এ কথা শুনলে দুঃখে তাঁরা মারাই পড়বেন।…আমি এর আগে কখনও কোনও অন্যায় করিনি। ভগবানের দিব্যি বলছি, আর আমি কখনও এ রকম কাজ করব না। আমি দিব্যি করছি। আমি বাইবেল ছুঁয়ে শপথ করছি। আমাকে রক্ষা করুন, এটা যেন কোর্ট-কাছারি পর্যন্ত না গড়ায়।”
হোমস কঠিন ভাবে বলল, “চেয়ারে উঠে বোসো। এখন তো খুব নাকিকান্না কাঁদছ। যখন হর্নারকে মিথ্যে চুরির অপরাধে জড়িয়েছিলে তখন তো ভাবোনি যে, কী জঘন্য অন্যায় করতে যাচ্ছ। একজন নির্দোষ লোককে মিথ্যে মিথ্যে বদনাম দিয়ে জেলে দেবার ব্যবস্থা করছিলে।”
“মিঃ হোমস, আমি এই দেশ ছেড়ে পালাব। তা হলে হর্নারের বিরুদ্ধে কোনও—।”।
“হুঁ। যাক, সে কথা পরে ভাবা যাবে। এখন তার পরের ঘটনাগুলো বলো দেখি। কী ভাবে ওই পাথরটা হাঁসের পেটে গেল আর কী করেই বা ওই হাঁসটা খোলা বাজারে বিক্রি হয়ে গেল। সত্যি বলবে। যদি আমার মনে হয় যে তুমি সত্যি কথা বলছ তা হলেই আমি বিবেচনা করে দেখব তোমাকে বাঁচানো উচিত কি না।”
রাইডার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল। “যা যা ঘটেছিল সব কথাই আমি আপনাকে খুলে বলছি। হর্নারকে তো পুলিশে ধরে নিয়ে গেল। আমার তখন চিন্তা হল কোথায় পাথরটাকে রাখা যায়। আমি বুঝতে পারছিলাম না পুলিশ আমার ঘর তল্লাশি করতে আসবে কিনা বা কখন আসবে। হোটেলে এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে পাথরটা লুকিয়ে রাখা যায়। তখন আমি একটা কাজের ছুতো করে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সোজা গেলাম আমার বোনের বাড়ি। আমার বোন ওকশটকে বিয়ে করে ব্রিকস্টন রোডের একটা বাড়িতে থাকে। সেখানে তারা হাঁস-মুরগির ব্যবসা করে। আমি যখন বোনের বাড়ি যাচ্ছিলাম তখন রাস্তার সব লোককেই আমার গোয়েন্দা-পুলিশ বলে মনে হচ্ছিল আর এও মনে হচ্ছিল যে, তারা সকলেই আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। সেদিনের সেই প্রচণ্ড ঠান্ডার রাত্রেও আমার কপাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছিল। আমাকে দেখে বোন তো অবাক। ‘কী ব্যাপার! তোমার শরীর খারাপ হয়েছে নাকি? তোমার চোখমুখ বসে গেছে। তুমি ঘামছ।’ আমি তাকে বললাম যে, হোটেলে একটা চুরি হয়ে গেছে। মনটা তাই ভাল নেই। তারপর তার বাড়ির পেছনের দিকে উঠোনে বসে পাইপ টানতে টানতে ভাবলাম কী করা যায়।
“মড্সলি বলে আমার এক বন্ধু আছে। দুষ্ট লোকের খপ্পরে পড়ে জেলটেল খেটেছে। সম্প্রতি সে ‘পেন্টনভিল’ থেকে তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় ছাড়া পেয়েছে। একবার কথায় কথায় সে আমাকে বলেছিল যে চোরাই মাল বিক্রি করার বা পাচার করার সব ঘাঁতঘোঁত তার জানা আছে। আমি জানতাম যে, সে আমাকে সাহায্য করবে। আমি তার এমন দু’-একটা গোপন খবর জানি যা পুলিশের জানা নেই। তাই ঠিক করলাম কিলবার্নে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করব। ও ঠিক বাতলে দেবে কী ভাবে ওই পাথরটাকে বিক্রি করা যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে ওই পাথরটা ওর কাছে নিয়ে যাই কী করে? যে-কোনও সময়ে পুলিশ আমার খোঁজ করতে পারে। আর তখন আমাকে তল্লাশি করলে চোরাইমাল সমেত ধরা পড়ব। আমি উঠোনের যে-জায়গায় ছিলাম সেইখানে একপাল হাঁস ঘোরাঘুরি করছিল। হঠাৎ আমার মাথায় ঝাঁ করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। পাথরটা লুকিয়ে রাখবার এমন একটা উপায় বের করলাম যা কোনও গোয়েন্দা পুলিশের সাধ্য নেই যে খুঁজে বের করে।
“কয়েক সপ্তাহ আগে আমার বোন আমাকে বলেছিল যে, ক্রিসমাসের সময় বড়দিনের উপহার হিসেবে আমি তার যে-কোনও একটা হাঁস পছন্দ করে নিতে পারি। আমি এখনই হাঁসটা পছন্দ করে নেব, আর হাঁসটার মধ্যে পাথরটা পুরে কিলবার্ন চলে যাব। উঠোনের একদিকে একটা চালাঘর। আমি একটা বড়সড় হাঁসকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে ওই চালাঘরের মধ্যে নিয়ে গেলাম। হাঁসটা একেবারে দুধের মতো সাদা। শুধু লেজের কাছটায় একটা কালো ডোরাকাটা দাগ। আমি হাঁসটাকে জাপটে ধরলাম। তারপর সেটার ঠোঁট দুটো জোর করে ফাঁক করে গলার মধ্যে পাথরটা ঢুকিয়ে দিলাম। হাঁসটা কোঁক করে একটা ঢোঁক গিলল। বুঝতে পারলাম যে পাথরটা গলা দিয়ে নেমে গেল। হাঁসটা আমার হাত থেকে পালাবার জন্যে ছটফট করতে লাগল। এমন সময় আমার বোন বেরিয়ে এল। ‘হাঁসটাকে তুমি কী করছ জেমস?’ আমি বললাম, ‘কিছু নয়। তুমি তো বড়দিনের সময় আমাকে একটা হাঁস দেবে বলেছিলে, তাই দেখছিলাম কোনটা নেওয়া যায়।’ ‘ও তাই বলো। সে তো আমরা ঠিক করেই রেখেছি। আমরা সেটার নাম দিয়েছি জেমসের হাঁস। ওই তো ওই দিকে যে বড় হাঁসটা দেখছ ওইটে তোমার জন্য রাখা আছে। ওই জাতের হাঁস ছাব্বিশটা আছে। একটা তোমার জন্যে, একটা আমাদের জন্যে, বাকি চব্বিশটা বিক্রির জন্যে।’ ‘ম্যাগি, যদি তোমার আপত্তি না থাকে তো এইমাত্র যে-সাদা হাঁসটা ধরেছিলাম সেইটে নেব।’ ‘কিন্তু ওটার চাইতে আমরা যে হাঁসটা ঠিক করে রেখেছি সেটা অনেক বড়। ওটাকে খাইয়েদাইয়ে মোটাসোটা করেছি।’
‘তা হোক গে। আমি ওইটেই নেব। আর আজই নেব।’ ‘সে তোমার ইচ্ছে।’ বুঝলাম আমার বোন দুঃখ পেয়েছে। ‘কোনটা নেবে বলছ?’ ‘ওই যে লেজের কাছে কালো ডোরাকাটা সাদা হাঁসটা। ওই যে মাঝখানে রয়েছে—ওইটে নেব।’ ‘ঠিক আছে, ওটাকে মেরে নিয়ে যাও।’
“আমি আর একটুও দেরি না করে হাঁসটাকে মেরে বোনের বাড়ি থেকেই কিলবার্ন চলে গেলাম। আমার চালাকির কথা শুনে আমার বন্ধু তো হেসেই অস্থির। তারপর আমরা দু’জনে মিলে হাঁসটার পেট চিরে ফেললাম। তারপর আমার তো চোখ কপালে উঠে গেল। পেটের মধ্যে কেন হাঁসটার শরীরের কোথাও কোনও পাথর নেই। বুঝলাম সাংঘাতিক রকমের একটা ভুল হয়েছে। হাঁসটাকে ওইখানে ওই অবস্থায় ফেলে রেখে আমি আবার ছুটতে ছুটতে বোনের বাড়িতে এলাম। বাড়ির পেছনে উঠোনের যে-জায়গায় ওই হাসের খাঁচাটা ছিল সেখানে গিয়ে দেখি খাঁচা খালি। একটা হাঁসও নেই।
‘ম্যাগি ওই হাঁসগুলো গেল কোথায়?’ ‘দোকানদার কিনে নিয়ে গেছে।’ ‘কোন দোকানদার?’ ‘কভেন্ট গার্ডেনের ব্রেকেনরিজ।’ ‘আচ্ছা ম্যাগি, তোমার আরও একটা লেজে কালো ডোরাকাটা হাঁস ছিল কি? মানে আমি যে রকম হাঁস নিয়েছি সে রকম হাঁস কি আর ছিল?’
‘হ্যাঁ, জেমস। ওই রকম হাঁস একজোড়া ছিল। ও দুটোকে আলাদা আমি নিজেও করতে পারতাম না।’ ম্যাগির কথায় সব ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝলাম গণ্ডগোলটা কোথায় হয়েছে। আর সময় নষ্ট না করে আমি সেখান থেকে সোজা ব্রেকেনরিজের দোকানে গেলাম। তার সঙ্গে কথা বলে জানলাম যে সব সব হাঁস বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু কাকে বিক্রি করেছে সে কিছুতেই বললে না। আপনারা তো শুনতেই পেলেন একটু আগে ব্রেকেনরিজ কী বলল। এদিকে আমার বোনের ধারণা হয়েছে যে আমার মাথার গোলমাল হয়েছে। আমার নিজেরই এক এক সময় মনে হচ্ছে যে, আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাব। আমি ভাবছি আমার কী হল। আমি চোর বনে গেলাম। অথচ মজা হচ্ছে এই যে, যে-জিনিসটার জন্যে আমি চোর হয়ে গেলাম সেই জিনিসটাই আমার হাতে এল না। হা অদৃষ্ট।”
রাইডার কেঁদে ফেলল। আমরা কেউ কোনও কথা বললাম না। শুধু হোমস টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে টকটক করে শব্দ করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে হোমস ঘরের দরজা খুলে রাইডারকে বলল, “বেরিয়ে যাও।”
“কী…কী বললেন? ভগবান আপনার ভাল করবেন।”
“একটি কথা নয়। বেরিয়ে যাও।”
আর কোনও কথা বলবার দরকার হল না। রাইডার এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরে বসেই আমরা শুনতে পেলাম, সে সিঁড়ি দিয়ে দুড়দাড় শব্দ করে নেমে গেল।
পাইপে আগুন ধরাতে ধরাতে হোমস বলল, “ওয়াটসন, পুলিশ তাদের কাজের গাফিলতি দেখিয়ে দেবার দায়িত্ব আমাকে দেয়নি; আর তা ছাড়া হর্নারের শাস্তি হবার কোনও আশঙ্কাই নেই। রাইডার গা-ঢাকা দিলেই হর্নারের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ টিকবে না। হয়তো কাজটা ঠিক আইনসংগত হল না। তবে লোকটাকে বাঁচানো গেল। ও আর কখনও এমন কাজ করবে না। এখন ওকে জেলে পাঠালে ও একটা খারাপ ধরনের অপরাধী হয়ে যেত। তা ছাড়া ক্রিসমাস হল ক্ষমার সময়। বরাতজোরে আমাদের দরজায় একটা সমস্যা এসে গিয়েছিল, সেটা সমাধান করতে পেরেই আমরা খুশি। এখন চলো অন্য এক রহস্যের সমাধান করা যাক। সেখানেও অবশ্য প্রধান চরিত্র হল একটা বনমুরগি।”
