বার্কলে হত্যা-রহস্য (শার্লক হোমস) – আর্থার কোনান ডয়েল
আমার বিয়ের অল্প কয়েক মাস পরের কথা। গরমকাল। রাত্তিরবেলায় শুতে যাবার আগে পাইপ খেতে খেতে একটা উপন্যাস নিয়ে বসেছিলাম। বোধহয় একটু ঢুলুনিও আসছিল। আজ সারা দিন বড় পরিশ্রম হয়েছে। আমার স্ত্রী আগেই শুতে গেছেন। সদর দরজায় খিল দেবার শব্দ কানে এল। বুঝলাম কাজের লোকেরাও যে-যার ঘরে শুতে চলে গেল। আমি চেয়ার থেকে উঠে পড়লাম। ঠুকে ঠুকে পাইপের ছাই ফেলে দিয়ে পাইপটা পরিষ্কার করতে যাব হঠাৎ সদর দরজায় ঘণ্টা বেজে উঠল।
ঘড়ি দেখলাম। বারোটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। এত রাত্রে নিশ্চয়ই কেউ বেড়াতে আসবে না। অবশ্যই কোনও রুগি। আর তার মানে সারা রাত্তির জেগে বসে থাকা। মুখটা বেজার করে আমি দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে আমি তো অবাক। দরজার সামনে দাড়িয়ে শার্লক হোমস।
“ওহ্ ওয়াটসন,” হোমস বলল, “তুমি শুয়ে পড়েছ কিনা সেই কথা ভাবতে ভাবতে আসছিলাম।”
“আচ্ছা, আচ্ছা, তুমি আগে ভেতরে এসো তো!”
“তুমি যে আমাকে দেখে আশ্চর্য হয়েছ, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু তুমি যেন স্বস্তিও পেয়েছ মনে হচ্ছে। হুম। আর তুমি দেখছি এখনও আর্কেডিয়া তামাকই খাচ্ছ। বিয়ের আগের অভ্যেস ছাড়তে পারোনি। তোমার কোটের হাতায় যে-থোপা থোপা ছাই লেগে রয়েছে, এ ধরনের ছাই আর্কেডিয়া তামাক ছাড়া হয় না। ওয়াটসন, তোমাকে দেখলেই বোঝা যায় যে, তুমি ইউনিফর্ম পরতে অভ্যস্ত। যত দিন তুমি তোমার জামার হাতায় রুমাল জড়ানোর অভ্যেস না ছাড়ছ, তত দিন তোমাকে সাধারণ নাগরিক বলে চালানো যাবে না। আজকের মতো আমাকে থাকবার জায়গা দিতে পারো?”
“এ কথা বলতে!”
“তুমি আমাকে বলেছিলে যে, এক জনকে থাকতে দেবার মতো ব্যবস্থা আছে। দেখতে পাচ্ছি, তোমার ঘরে কোনও অতিথি নেই। তোমার হ্যাট-র্যাক দেখেই আমি এই কথা বলছি।”
“তুমি যদি থাকো, তার চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে।”
“খুব ভাল। তা হলে তোমার হ্যাট-র্যাকের একটা আংটা আমি অধিকার করলাম। এ হে হে, তুমি দেখছি ব্রিটিশ মিস্ত্রিকে কাজে লাগিয়েছ। ওরা তো নিষ্কর্মার ধাড়ি। নর্দমার কাজ করাচ্ছ নাকি?”
“না, গ্যাস।”
“আহা! দেখো, লোকটা তোমার মেঝের লিনোলিয়ামে জুতোর পেরেকের দাগ করে দিয়েছে। ওই যেখানটায় আলো পড়েছে ওখানে দেখলেই দেখতে পাবে। না, না, তুমি ব্যস্ত হোয়ো না। আমি ওয়াটারলু স্টেশনে খেয়ে নিয়েছি। তোমার সঙ্গে গল্প করতে করতে একটু ধূমপান করব।”
হোমস একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমার কাছে এসে বসল। আমি হোমসকে আমার পাইপের পাউচটা এগিয়ে দিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম যে, হোমস এত রাত্রে আমার বাড়িতে বেড়াতে আসেনি। নিশ্চয়ই সে কোনও তদন্তের ব্যাপারে এসেছে। তাই হোমস কী বলে শোনবার জন্যে চুপ করে বসে রইলাম।
আমাকে একবার ভাল করে দেখে নিয়ে হোমস বলল, “তোমার দেখছি এখন কাজের চাপ খুব বেশি যাচ্ছে।”
“হ্যা। আজকে খুব পরিশ্রম হয়েছে। তুমি আমাকে খুব বোকা ভাববে, তবুও বলছি, তুমি এ কথাটা কী করে বললে বুঝতে পারছি না।”
হোমস খুকখুক করে হাসল।
“দেখো ওয়াটসন, তোমার স্বভাব আমি জানি। যখন তোমার হাতে বেশি রুগি থাকে না, তখন তুমি তোমার চরণবাবুর গাড়িতে বেড়াও। আর রুগি বেশি থাকলে তুমি গাড়ি করে ঘোরো। দেখছি তোমার জুতো জোড়া বেশি নোংরা হয়নি। এর থেকে বুঝতে পারছি যে, তোমার হাতে এখন অনেক রুগি, আর তুমি এখন গাড়ি চেপে রুগি দেখে বেড়াচ্ছ।”
“দারুণ,” আমি না বলে পারলাম না।
“তুচ্ছ ব্যাপার,” হোমস বলল, “সাধারণ লোককে ভড়কে দেওয়া খুব শক্ত নয়। কোনও একটা সমস্যার মূল সূত্রটা যে ধরতে পেরেছে সে ব্যাপারটা সহজে বুঝে যাবে আর সেই কথা বলে যারা সেই সূত্রটা লক্ষ করেনি তাদের চমকে দেবে। তোমার সম্বন্ধে এক্ষুনি যে-কথাটা বললাম সেটা একটা উদাহরণ বলতে পারো। আমার যে তদন্তের কথাগুলো তুমি লিখেছ, সেগুলো কিন্তু এই ধরনের কাণ্ড। পাঠকের কাছ থেকে তুমি কিছু কিছু তথ্য গোপন করেছ। ইচ্ছে করে যে তুমি তথ্য গোপন করেছ তা নয়। ঘটনাচক্রে পাঠক সব কথা জানতে পারেননি। তাই রহস্যের সমাধানও তারা করতে পারেননি। এখন আমার নিজের অবস্থা হয়েছে তোমার ওই পাঠকদের মতো। একটা অদ্ভুত রহস্যের অনেক সূত্র আমার হাতের মুঠোয়। কিন্তু এই ছড়ানো সূত্রগুলোকে একটা পাট্যার্নে সাজাতে গেলে যে যোগসূত্রটা দরকার সেটার হদিসই আমি করতে পারছি না। রহস্যটা যেমন জটিল, তেমনই ইন্টারেস্টিং। তবে ঘাবড়াবার কিছু নেই ওয়াটসন। রহস্যের চাবি বা মূলসূত্র যাই বলো না সেটা আমি পাবই পাব।” হোমসের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। মুখটা এক মুহূর্তের জন্যে উত্তেজনায় থমথম করে উঠল। তবে চোখের পলকের মধ্যেই আবার হোমসের হাবভাব স্বাভাবিক হয়ে গেল। হোমস যে কী সাঙ্ঘাতিক জেদি তা বুঝতে পারলাম। ওপর থেকে হোমসকে দেখলে মনে হয় বেশ শান্তশিষ্ট, তাই তার ব্যক্তিত্ব যে কী প্রবল তা সহজে বোঝা যায় না। হোমসের আসল পরিচয় আমার সামনে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। এখন আবার হোমসের মুখ রেড ইন্ডিয়ান সর্দারের মতো ভাবলেশহীন, নির্বিকার।
“যে-তদন্তটা এখন হাতে নিয়েছি,” হোমস বলল, “সেটার বেশ বিশেষত্ব আছে। সত্যি কথা বলতে কী, বিশেষত্বগুলোর মধ্যেও বেশ নতুনত্ব আছে। ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভেবেছি, কিছু খোঁজখবরও করেছি। মনে হচ্ছে শিগগিরই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাই বলছি যে, তদন্তের এই শেষ পর্বে তুমি যদি আমার সঙ্গে থাকো তো আমার খুব সুবিধে হবে।”
“এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে বলো,” আমি বললাম।
“তুমি কি আমার সঙ্গে কাল অল্ডারশট যেতে পারবে?”
“অসুবিধে হবে না। জ্যাকসনকে বলে দেব। ও আমার রুগিদের দেখাশোনা করবে।”
“খুব ভাল কথা। এগারোটা দশে যে ট্রেনটা ওয়াটারলু স্টেশন থেকে ছাড়ে ওই ট্রেনটা ধরব।”
“তা হলে তো অনেক সময় আছে।”
“বেশ। এখন যদি তোমার ঘুম না-পেয়ে থাকে তো ঘটনাটা কী, আর কী করতে হবে তা তোমাকে বলি শোনো।”
“তুমি আসবার আগে ঘুম এসেছিল। এখন আমার ঘুম ছুটে গেছে।”
“খুব ভাল কথা। খুব সংক্ষেপে অথচ দরকারি কোনও কথা বাদ না দিয়ে ব্যাপারটা তোমাকে বলছি। মন দিয়ে শোনো। হয়তো এ সম্পর্কে কিছু কিছু কথা তোমার কানে গেছে। অল্ডারশটে রয়্যাল ম্যালোজ রেজিমেন্টের কর্নেল বার্কলের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলছি। ওই ঘটনাটার তদন্ত আমি করছি।”
“না। আমি তো কিছুই শুনিনি।”
“অসম্ভব নয়। ঘটনাটা ঘটেছে মাত্র দুদিন আগে। আর তা ছাড়া অল্ডারশটের বাইরে এ ঘটনার কথা বিশেষ জানাজানি হয়নি। ঘটনাটা হচ্ছে এই:
“তুমি তো জানোই যে, আমাদের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মধ্যে রয়্যাল ম্যালোজ’ রেজিমেন্টের দারুণ সুনাম। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আর সিপাহি বিদ্রোহের সময় এরা প্রায় অসাধ্য সাধন করেছিল। গত সোমবার রাত পর্যন্ত এই রেজিমেন্টের প্রধান ছিলেন জেমস বার্কলে। জেমস বার্কলে একজন প্রাইভেট হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এই রেজিমেন্টে সাধারণ বন্দুকধারী সৈন্য হিসেবে ওঁর চাকরি-জীবন শুরু। তারপর আস্তে আস্তে নিজের বুদ্ধি, সাহস আর যোগ্যতায় উনি রেজিমেন্টের প্রধান হন।
“জেমস বার্কলে যখন সবেমাত্র একজন সার্জেন্ট তখন তার বিয়ে হয়। বিয়ে হয় মিস ন্যানসি ডেভয়ের সঙ্গে। ন্যানসি ওই রেজিমেন্টেরই একজন বড় অফিসারের মেয়ে। একজন সার্জেন্টের সঙ্গে সিনিয়র অফিসারের মেয়ের বিয়ে হওয়াতে রেজিমেন্টের মধ্যে একটু কানাকানিও হয়েছিল। তবে এ নিয়ে বিশেষ কোনও গোলমাল হয়নি। গোলমাল না হওয়ার বড় কারণ ন্যানসি। ন্যানসি সকলের সঙ্গে সমান ভাবে মেলামেশা করতেন। রেজিমেন্টের অন্য অফিসার বা সার্জেন্টের স্ত্রী-রা তো তাকে পছন্দ করতেনই, জেমসের বন্ধুবান্ধবরাও তাকে পছন্দ করতেন। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ন্যানসি এখন এত বয়সেও দেখতে খুব সুন্দর। বুঝতেই পারছ, আজ থেকে তিরিশ বছর আগে তিনি আরও সুন্দরী ছিলেন।
“বার্কলেদের বিবাহিত জীবন খুব সুখী ছিল। ওই রেজিমেন্টেরই মেজর মারফির কাছ থেকে আমি যা জানতে পেরেছি, তা হল, ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি তো দূরের কথা, কখনও কথা কাটাকাটি হতেও কেউ শোনেনি। রেজিমেন্টের সকলে ওঁদের আদর্শ স্বামী-স্ত্রী বলে মনে করে। তাই হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো দুর্ঘটনায় সকলেই হতভম্ব।
“কর্নেল বার্কলের চরিত্রের কতকগুলো অদ্ভুত দিক ছিল। এমনিতে তিনি বেশ হাসিখুশি আমুদে লোক। কিন্তু কখনও কখনও তিনি এমন ব্যবহার করতেন যে, বোঝা যেত তাঁর প্রকৃতি খুব নিষ্ঠুর। বার্কলের চরিত্রের আর-একটা দোষ হল যে, তিনি কারও ওপর কোনও কিছুর জন্যে প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পেলে ছাড়তেন না। কিন্ত ন্যানসির সঙ্গে জেমস কখনও খারাপ ব্যবহার করেননি। জেমস সম্বন্ধে আর-একটা কথা মেজর মারফিও বলেছেন, আর অন্য অফিসাররাও আমাকে বলেছেন। সেটা হল, জেমস বার্কলে মাঝে মাঝেই ভীষণ মনমরা হয়ে পড়তেন। কখনও কখনও এমনও হয়েছে যে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে করতে হঠাৎ কোথাও কিছু নেই, জেমস একদম চুপ। তখন জেমসকে দেখলে মনে হত যে, অদৃশ্য কোনও হাত যেন তার মুখ থেকে হাসি আর আনন্দ একেবারে মুছে নিয়েছে। দিনের পর দিন জেমস গুম মেরে বসে থাকতেন। জেমসের সঙ্গে যাঁদের বেশ অন্তরঙ্গতা ছিল, তাদের কাছ থেকে আরও একটা অদ্ভুত কথা জানতে পেরেছি। অন্ধকার হয়ে গেলে জেমস কিছুতেই একলা থাকতে চাইতেন না। একজন বয়স্ক মানুষের, বিশেষত একজন উচ্চপদস্থ সৈনিকের পক্ষে অন্ধকারকে এ রকম ছেলেমানুষের মতো ভয় করার কী। কারণ থাকতে পারে, তা নিয়ে সকলের কৌতূহলের শেষ ছিল না।
“দ্য রয়্যাল ম্যালোজ-এর প্রথম ব্যাটেলিয়ন বেশ কিছু দিন হল অল্ডারশটেই রয়েছে। বিবাহিত অফিসাররা সাধারণত ব্যারাকে থাকেন না। কর্নেল জেমস এইখানেই ‘লাচিন’ বলে একটা ভিলায় থাকতেন। বাড়িটা বেশ হাতাওয়ালা। বাড়ির পশ্চিম দিকে বড় রাস্তা চলে গেছে। বাড়ি থেকে রাস্তা তিরিশ গজের বেশি নয়। বার্কলেদের ছেলেমেয়ে নেই। বাড়িতে লোক বলতে ওঁরা দু’জন আর এক জন কোচোয়ান আর জনাদুয়েক কাজের মেয়ে। ওদের বাড়িতে বাইরের লোকজনের বিশেষ যাতায়াত নেই।
“এইবার গত সোমবার রাত্তির ন’টা থেকে দশটার মধ্যে লাচিনে কী ঘটনা ঘটেছিল সেই কথায় আসব।
“মিসেস বার্কলে রোমান ক্যাথলিক। ওঁদের বাড়ির কাছে গিল্ড অব সেন্ট জর্জ নামে একটা সংস্থা আছে। এঁদের সঙ্গে আবার ওয়াট স্ট্রিট চ্যাপেলের যোগাযোগ আছে। এই সংস্থার কাজ হচ্ছে পুরনো জামাকাপড় জোগাড় করে সেই সব জামাকাপড় সত্যি সত্যি যারা গরিব তাদের দিয়ে দেওয়া। ক্যাথলিক বলেই বোধহয় মিসেস বার্কলের সঙ্গে ওই সংস্থার খুব ভাল যোগাযোগ আছে। গত সোমবার আটটার সময় ওই গিল্ডের একটা মিটিং ছিল। রাতের খাওয়া চটপট সেরে নিয়ে মিসেস বার্কলে মিটিং করতে যান। মিসেস বার্কলে যাবার আগে তার স্বামীকে বলে যান যে, তিনি সকাল সকাল ফিরবেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে উনি প্রথম যান মিস মরিসনের কাছে। ওঁদের পাশের বাড়িতেই মিস মরিসন থাকেন। তারপর ওঁরা দু’জনে মিটিং করতে যান। মিটিং চলেছিল প্রায় চল্লিশ মিনিট। রাত পৌনে ন’টা নাগাদ মিসেস বার্কলে বাড়ি ফিরে আসেন। ফেরবার সময় তিনি মিস মরিসনকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
“লাচিন ভিলার কথা তো আগে বলেছি। বাড়িটার লনের ঠিক সামনে একটা ঘর আছে। সকালবেলায় এই ঘরটায় বার্কলেরা বসতেন। ঘরের সামনে, তিরিশ গজ চওড়া লন। তারপরে একটা লোহার রেলিং দেওয়া নিচু পাঁচিল। পাঁচিলের পরেই বড় রাস্তা। ঘরটায় রাস্তার দিকে একটা দরজা। বাড়ি ফিরে মিসেস বার্কলে সোজা ওই ঘরে চলে যান। সন্ধেবেলায় ওই ঘরটায় কেউ যায় না বলে ঘরটা অন্ধকার ছিল। মিসেস বার্কলে ঘরের আলো জ্বালেন। তারপর জেনেট স্টুয়ার্ট বলে ওঁদের কাজের মেয়েটিকে ডেকে এক কাপ চা আনতে বলেন। মেয়েটি ওঁর কথায় বেশ অবাক হয়ে যায়। এ রকম অসময়ে চা-খাওয়া মিসেস বার্কলে মোটেই পছন্দ করেন না। কর্নেল খাবার ঘরে বসে ছিলেন। মিসেস বার্কলে ফিরে এসে ওই ঘরে বসেছেন জেনে তিনি ওই ঘরে যান। কোচোয়ান ওঁকে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে ওই ঘরে যেতে দেখে। ব্যস, তারপর জেমস বার্কলকে কেউ আর জীবিত দেখেনি।
“মিনিট দশেক পরে জেনেট স্টুয়ার্ট চা নিয়ে আসে। ঘরের কাছে আসতেই জেনেট শুনতে পায় কর্তা-গিন্নিতে জোর কথাকাটাকাটি হচ্ছে। এতে সে খুবই আশ্চর্য হয়ে যায়। ঘরের দরজায় টোকা দিতে থাকে। কিন্তু কেউই তাকে ভেতরে চলে আসতে বলছেন না দেখে সে দরজা ঠেলে খুলতে যায়। দরজা খোলে না। ভেতর থেকে বন্ধ। তখন সে রাঁধুনি আর কোচোয়ানকে ডেকে আনে। ওরা তিন জনে ফিরে আসে। তখনও ঘরের মধ্যে কথা হচ্ছিল। ওরা তিন জনেই বলেছে যে, ওরা জেমস বার্কলে আর ন্যানসি বার্কলের গলা শুনেছে। জেমস খুব আস্তে আস্তে দু’-একটা কথা বলছিলেন। কিন্তু ন্যানসি বার্কলে খুব উত্তেজিত হয়ে জোরে জোরে কথা বলছিলেন। ওঁর সব কথাই পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। ন্যানসি বার্কলে মাঝে মাঝেই বলে উঠছিলেন, ‘তুমি একটা কাপুরুষ’, ‘এখন তুমি কী করবে!’ ‘কী কাজ তুমি করেছ বলো তো?’ ‘নীচ, কাপুরুষ।’ এই রকম টুকরো টুকরো কথা শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ পুরুষ কণ্ঠের একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল। তারপরই একটা দড়াম করে শব্দ আর মহিলা কণ্ঠের আর্তনাদ!
“সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা হয়েছে আশঙ্কা করে কোচোয়ান ছুটে গিয়ে দরজাটা খোলবার চেষ্টা করল। দরজা খুলল না। এদিকে ঘর থেকে মহিলা কন্ঠের চিৎকার শোনা যেতে লাগল। কোচোয়ান অনেক চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারল না। ব্যাপার দেখে কাজের মেয়েরা এতই ঘাবড়ে গিয়েছিল যে তারা কোচোয়ানকে কোনও সাহায্যই করতে পারল না। হঠাৎ কোচোয়ানের হুঁশ হল। সে লনের দিকে ছুটে গেল। তারপর লনের দিকের দরজা দিয়ে যে-ঘরে ন্যানসি আর জেমস কথা বলছিলেন সে ঘরে ঢুকল। ন্যানসি আর তখন চিৎকার করছিলেন না, একটা সোফায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। জেমস মাটিতে পড়েছিলেন। রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। একটা আরামচেয়ারে পা আটকে তিনি পড়ে রয়েছেন। মাথায় জোর আঘাত লেগে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হয়েছে।
“কোচোয়ান যখন দেখল, কর্নেল মারা গেছেন, তখন তার মনে হল যে, খবরটা সবাইকে দেওয়া দরকার। তখন সে বাড়ির ভেতরে যাবার জন্যে ঘরের দরজা খুলতে গেল। কিন্তু দরজার ‘লক’ ভেতর থেকে চাবি বন্ধ। মজার কথা হচ্ছে, চাবিটা কোথাও পাওয়া গেল না। তখন কোচোয়ান যে-দিক দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল ফের সেই দিক দিয়েই বেরিয়ে গিয়ে ডাক্তার আর পুলিশ অফিসারকে ডেকে আনল। ন্যানসিকে ধরাধরি করে তাঁর ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ওয়াটসন যে, সবাই ন্যানসিকে এই অদ্ভুত ঘটনার জন্যে সন্দেহ করতে লাগল। কর্নেলের মৃতদেহকে একটা সোফার ওপর শুইয়ে রেখে পুলিশ অকুস্থল পরীক্ষা করতে লাগল।”
একটু চুপ করে থেকে হোমস শুরু করল, “জেমসের মাথার ক্ষতটা দেখে পুলিশের অনুমান হল ভোঁতা অথচ ভারী কোনও অস্ত্র দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করার ফলে কর্নেল জেমস বার্কলে মারা পড়েছেন। অস্ত্রটা যে কী তাও বোঝা গেল। মৃতদেহের কাছেই মেঝের ওপর হাড়ের হাতল লাগানো কাঠের একটা ডান্ডা পড়েছিল। কাঠটায় অদ্ভুত রকমের নকশা করা। কর্নেল নানান দেশ থেকে নানা রকমের সব অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করেছিলেন। পুলিশের ধারণা হল যে, এটাও একটা সেই রকমের অস্ত্র। তবে বাড়ির কাজের লোকেরা বলল যে, এই জিনিসটা তারা কখনও দেখেনি। তবে তার থেকে কিছু প্রমাণ হয় না। বিচিত্র ধরনের সব জিনিসের মধ্যে এটা তাদের চোখে না-ও পড়ে থাকতে পারে। ঘরে এ ছাড়া আর কিছু সূত্র পুলিশের নজরে পড়েনি। তবে ঘরের চাবিটা জেমসের বা ন্যানসির কারও কাছ থেকেই পাওয়া গেল না। শেষকালে একজন চাবিওয়ালাকে ডেকে দরজা খুলতে হল।
“এই রকম অবস্থায় মঙ্গলবার সকালে মেজর মারফির কথায় আমি অল্ডারশটে যাই পুলিশকে তদন্তের কাজে সাহায্য করবার জন্যে। আমার মুখ থেকে যতটুকু শুনলে, তাতেই তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ যে, কর্নেল জেমস বার্কলের মৃত্যু-রহস্য বেশ জটিল। ঘটনাস্থলে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম যে, ব্যাপার যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও জটিল।
“ঘটনাস্থলে যাবার আগে আমি কাজের লোকদের জেরা করতে লাগলাম। তারা যা বলল সে কথা তোমাকে আগেই বলেছি। জেনেট স্টুয়ার্ট একটা কথা বলল। তোমাকে আগেই বলেছি যে, চা নিয়ে এসে জেনেট যখন দেখল কর্তা-গিন্নির ভেতরে ঝগড়াঝাটি হচ্ছে, তখন সে অন্য লোকদের ডেকে আনতে যায়। প্রথমবার যখন সে একা ছিল, তখন সে ওদের গলা শুনতে পেয়েছিল বটে, তবে কী বলছেন সেটা বুঝতে পারেনি। ওঁরা খুব চুপি চুপি কথা বলছিলেন। দু-একটা কথা জেনেট শুনতে পেয়েছিল কিনা এ কথা জানবার জন্যে আমি পীড়াপীড়ি করাতে সে বলল যে, ন্যানসি নাকি দু’বার ‘ডেভিড’ নামটা বলেছিলেন। এটা একটা খুব বড় সূত্র। হয়তো এই নামটা থেকে ঝগড়ার শুরু। তোমার মনে আছে বোধহয় কর্নেলের নাম জেমস।
“কর্নেলের মৃত্যুর ব্যাপারে একটা জিনিস বাড়ির লোকেদেরই নয়, পুলিশকেও বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। সেটা হল, কর্নেলের মুখের চেহারা। স্রেফ ভয় পেয়ে তার মুখটা এমন বীভৎস হয়ে উঠেছিল যে, সেই মুখ দেখেই ভয়ে দু’জন অজ্ঞান হয়ে যায়। আমাকে অনেকেই বলেছেন মানুষের মুখ যে ও রকম হতে পারে, তা তারা না দেখলে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন কী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। আর তাতেই তিনি ও রকম ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। এই ব্যাপারটা পুলিশের থিয়োরির সঙ্গে খাপ খেয়ে গেল। পুলিশের ধারণা, ন্যানসি যে তাকে খুন করতে আসছেন, তা জেমস বার্কলে দেখতে পেয়েছিলেন। আঘাতটা মাথার পিছন দিকে লাগার কারণ আর কিছু নয়, তিনি মাথাটা সরাতে গিয়েছিলেন। এ সবই অবশ্য পুলিশের ধারণা। ন্যানসির কাছ থেকে কোনও কথা জানতে পারা যায়নি। ন্যানসির ‘ব্রেনফিভার’ হয়েছে। তাঁর মধ্যে পাগলামির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তবে ডাক্তার বলেছেন যে, এটা সাময়িক। তিনি আবার সেরে উঠবেন।
“মিস মরিসন যিনি সে দিন ন্যানসি বার্কলের সঙ্গে মিটিংয়ে যান ও একসঙ্গে ফেরেন, পুলিশ তাঁকেও প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু ন্যানসি বার্কলে যে কেন অত রেগে গিয়েছিলেন তা মিস মরিসন পুলিশকে বলতে পারেননি।
“ওয়াটসন, সব কথা শুনে আমি বসে বসে পাইপ খেতে লাগলাম। আমি মনে মনে সব ঘটনা, বিচার বিশ্লেষণ করে দরকারি তথ্যগুলোকে আলাদা করবার চেষ্টা করতে লাগলাম। সবচেয়ে বড় সূত্র হল হারানো চাবিটা। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও চাবিটা পাওয়া যায়নি। জেমস বা তার স্ত্রী কেউই চাবিটা নেননি। তা হলে চাবিটা কেউ সরিয়েছে এ কথাটা জলের মতো সহজ। এর থেকে এটাও আঁচ করা যায় যে, সে সময়ে ঘরে নিশ্চয়ই অন্তত আরও এক জন লোক ছিল। আর এই লোকটি নিশ্চয় লনের দিকে যে-দরজা আছে সেটা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। আমার মনে হল, ঘরটা আর লনের দিকটা ভাল করে দেখলে এই রহস্যময় তৃতীয় লোকটির সম্বন্ধে কিছু কথা হয়তো জানা যাবে। তুমি তো আমার কাজের ধারা জানো। আমি আমার নিয়মমতো একটার পর একটা পরীক্ষা শুরু করলাম। শেষকালে কিছু কিছু কথা জানতে পারলাম। তবে যা জানতে পারব ভেবেছিলাম, তার সঙ্গে যা জানতে পারলাম তার কোনও যোগ নেই। সত্যি সত্যিই এক জন লোক ঘরে ঢুকেছিল। রাস্তার দিকের পাঁচিল টপকে লন মাড়িয়ে সে এসেছিল। পাঁচিলের কাছে আমি তার পায়ের ছাপ দেখতে পাই। লনেও একই পায়ের ছাপ। তবে একটু অস্পষ্ট। ঘরে ঢোকবার কাচের দরজার কাছেও দু’ জোড়া পায়ের ছাপ। একই পায়ের ছাপ। লোকটি লনের দিক দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল। তবে এবারে পায়ের ছাপগুলো বেশ গভীর। মনে হয় কোনও কারণে লোকটি এক দৌড়ে লন পার হয়ে যায়। তবে লোকটি আমাকে মোটেই ভাবায়নি। ভাবিয়েছে তার সঙ্গীটি।”
“তার সঙ্গী,” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
হোমস তার পকেট থেকে বেশ বড় আকারের একটা টিসু কাগজ বের করে নিজের হাঁটুর ওপর ছড়িয়ে দিল।
“এটা দেখে কী বুঝছ বলো দেখি,” হোমস আমাকে জিজ্ঞেস করল। কাগজটা ভরতি ছোট কোনও জন্তুর পায়ের ছাপ। পাচটা ছাপ খুব স্পষ্ট। পায়ের ছাপ থেকে বোঝা যায় জন্তুটার লম্বা লম্বা নখ আছে। পায়ের ছাপ আকারে বড় চামচের মতো।
“কুকুর নাকি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“কুকুর কি পরদা বেয়ে উঠতে পারে বলে শুনেছ? এই জন্তুটা যে জানলার পরদা বেয়ে উঠেছিল তার প্রমাণ আমি পেয়েছি।”
“তা হলে কি বাঁদর?”
“কিন্তু এ তো বাঁদরের পায়ের ছাপ নয়।”
“তা হলে এটা কী?”
“এটা কুকুর নয়। বেড়ালও নয়। বাঁদরও নয়। আমাদের চেনাজানা কোনও জন্তু নয়। আমি মাপগুলোকে ধরে জন্তুটার চেহারার একটা আদল তৈরি করবার চেষ্টা করেছি। এই চারটি ছাপ দেখো। জন্তুটা স্থির হয়ে দাড়িয়েছিল। দেখো, সামনের পা থেকে পিছনের পায়ের দূরত্ব পনেরো ইঞ্চির কম নয়। এর সঙ্গে ঘাড় আর মাথার মাপটা যোগ করো। জন্তুটা অন্তত দু’ফুট লম্বা হবে। লেজ থাকলে আরও লম্বা হবে। আচ্ছা, এবার আর-একটা জিনিস দেখো। এই ছাপগুলো হচ্ছে চলার ছাপ। দুটো ছাপের মধ্যে খুব বেশি হলে তিন ইঞ্চি ফাক। তা হলে যে-ছবিটা পেলাম সেটা এমন একটা জন্তুর যার দেহটা বেশ লম্বা কিন্তু পাগুলো বেঁটে বেঁটে। জন্তুটার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। আমাদের সুবিধের জন্যে দু-একটা লোম ফেলে যেতে পারত তো? তবে চেহারাটা মোটামুটি আমি যে রকম বললাম, সেই রকমই হবে। জন্তুটা মাংসাশী। আর পরদা বেয়ে উঠতে পারে।”
“মাংসাশী জন্তু কী করে জানলে?”
“বলেছি যে জন্তুটা জানলার পরদা ধরে উঠেছিল। ওই জানলায় একটা ক্যানারি পাখির খাঁচা ছিল। জন্তুটা নিশ্চয়ই ক্যানারি পাখিটা খাবার জন্যেই উঠেছিল।”
“এটা কী ধরনের জন্তু তা হলে?”
“জন্তুটার পরিচয় জানতে পারলে তদন্তটা অনেক দূর এগিয়ে যেত। মনে হয় এটা ভোঁদড়জাতীয় কোনও জন্তু হবে। কিন্তু এর চেহারাটা বেশ বড়।”
“কিন্তু খুনের সঙ্গে এই জন্তুটার সম্পর্ক কী?”
“সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে আমরা যে অনেক কথাই জানতে পেরেছি, সেটা তো তুমি স্বীকার করবে? আমরা জানতে পেরেছি যে, যখন জেমস বার্কলে আর ন্যানসি বার্কলে ঘরের মধ্যে ঝগড়া করছিলেন, তখন ঘরে আলো জ্বলছিল, ঘরের সব পরদা তোলা ছিল। আর সেই সময়ে পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়েছিল একটি লোক। লোকটি তাদের ঝগড়া করতে দেখেছে। আমরা আরও জানতে পেরেছি যে, লোকটি একটা অদ্ভুত জন্তুকে সঙ্গে করে লন পার হয়ে ঘরে ঢোকে। তারপর হয় ওই লোকটি কর্নেলকে আঘাত করে, নয়তো লোকটিকে দেখে কর্নেল ভয় পেয়ে পড়ে যান এবং চেয়ারের পায়ায় তাঁর মাথা ঠুকে যায়। আর সেই আঘাতেই তিনি মারা যান। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা যে, ওই তৃতীয় লোকটি দরজার চাবিটি নিয়ে পালায়।”
আমি বললাম, “দেখো হোমস, তুমি যে-সব কথা জানতে পেরেছ তাতে রহস্যের কোনও সমাধান তো হলই না, উলটে সবকিছু আরও ঘোরালো হয়ে গেল।”
“তুমি ঠিকই বলেছ। ব্যাপারটা যত গোলমেলে মনে করেছিলাম তার চাইতে ঢের বেশি গোলমেলে। আমি সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে আবার নতুন করে ভেবেছি। আমার মনে হচ্ছে, তদন্তটা অন্য ভাবে করতে হবে। এখন সে কথা থাক। তোমাকে অনেকক্ষণ জাগিয়ে রেখেছি। ওয়াটসন, শুয়ে পড়োগে। বাকি কথা কাল ট্রেনে যেতে যেতে হবে।”
আমি বললাম, “না। তুমি আমার কৌতুহল বাড়িয়ে দিয়েছ। বাকিটা না শুনলে আমার ঘুম হবে না।”
“ঠিক আছে,” বলে হোমস আবার বলতে শুরু করল, “এ কথা ঠিক যে, সাড়ে সাতটা নাগাদ মিসেস ন্যানসি বার্কলে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, তখন তার সঙ্গে মিঃ বার্কলের কোনও রাগারাগি হয়নি। কোচোয়ান তাঁদের স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলতে শুনেছে। আবার এটাও ঠিক যে, যাতে স্বামীর মুখোমুখি হতে না হয়, তাই বাড়ি ফিরে তিনি ওই ঘরটায় ঢুকেছিলেন। যে-কোনও কারণেই হোক তার মন চঞ্চল ছিল বলে তিনি এক পেয়ালা চা খেতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্বামী সে ঘরে আসেন। আর তার পরই তাদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি লেগে যায়। তা হলে বোঝা যাচ্ছে যে, সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে রাত ন’টার মধ্যে এমন কিছু ঘটেছিল, যার ফলে ন্যানসি তার স্বামীর ওপর ভীষণ চটে যান। মিস মরিসন সারাক্ষণ মিসেস বার্কলের সঙ্গে ছিলেন। আমার স্থির বিশ্বাস হয় যে, এই সময়টুকুর মধ্যে যা কিছুই ঘটে থাকুক না কেন, তা মিস মরিসন জানেন।
“আমি প্রথমে মনে করেছিলাম যে, সবকিছুর পেছনে মিস মরিসনের হাত আছে। আর তাই নিজে ভাল সাজবার জন্যে তিনি সব ঢোক গিলে বসে আছেন। রা পর্যন্ত কাড়ছেন না। তবে এ ধারণাটা শেষ পর্যন্ত বাদ দিতে হল ওই ‘ডেভিড’ নামের জন্যে। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হলাম। যে-সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেছে, তার জন্যে কোনও ভাবেই মিস মরিসনকে যে দায়ী করা যায় না, তা ঠিক। তবে কেন যে এই কাণ্ডটা ঘটল তার কারণ তিনি নিশ্চয়ই জানেন। আমি মিস মরিসনের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তাঁকে সব কথা বুঝিয়ে বললাম। আরও বললাম যে, তিনি যদি এখনও চুপ করে থাকেন তো মিসেস বার্কলের হয়তো ফাঁসি হয়ে যাবে।
“মিস মরিসনকে দেখলে মনে হয়, খুব লাজুক আর ভাবুক স্বভাবের। কিন্তু ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম যে, মহিলা বেশ বুদ্ধিমতী। আমার কথা শুনে উনি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘বেশ, সব কথাই বলছি। ন্যানসি আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন যে, এ কথা আমি কাউকে বলব না। আর আমি যদি কাউকে কোনও কথা দিই তো সে কথার নড়চড় হয় না। তবে এ ব্যাপারে যেহেতু ন্যানসি অসুস্থতার জন্যে কোনও কথাই বলতে পারছেন না আর তার ওপর যখন আপনি বলছেন যে, বেচারার ফাঁসি হয়ে যেতে পারে, তখন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করাটা দোষের নয়। সোমবার সন্ধেবেলায় যা যা ঘটেছিল সব কথাই আপনাকে বলব।
“‘আমরা পৌনে ন’টা নাগাদ ওয়াট স্ট্রিট মিশন থেকে ফিরছিলাম। হাডসন স্ট্রিট পার হয়ে আমাদের আসতে হয়। রাস্তাটা খুব নির্জন। হাডসন স্ট্রিটে মাত্র একটা স্ট্রিটলাইট আছে। সেটা রাস্তার বাঁ দিকে। আমরা যখন আলোর কাছাকাছি এসেছি তখন দেখলাম, উলটো দিক থেকে কুঁজোমতো একটি লোক আসছে। তার কাধে একটা বাক্স। আমার মনে হল, লোকটি বোধহয় বিকলাঙ্গ। লোকটি হাঁটু দুমড়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে হাঁটছিল বলেই আমার ওই ধারণা হয়েছিল। আমরা যখন সেই লোকটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন সে আমাদের দিকে তাকাল। আমরা তখন রাস্তার আলোর কাছে চলে এসেছি। আমাদের দেখেই লোকটি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর প্রায় চিৎকার করে বলল, এ কী! ন্যানসি যে। লোকটির কথা শুনে মিসেস বার্কলের মুখ একদম কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। তাঁর মুখে একটি কথা নেই। ওঁর শরীর টলছিল। ন্যানসি রাস্তার ওপরেই পড়ে যেতেন যদি না ওই লোকটি টপ করে ওঁকে ধরে ফেলত। আমি ‘পুলিশ’ ‘পুলিশ’ বলে চেঁচাতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু লক্ষ করলাম, ন্যানসি সেই লোকটার সঙ্গে পরিচিত লোকের মতো কথাবার্তা বলছেন।
“‘কাঁপা কাঁপা গলায় ন্যানসি তাকে বলছিলেন, ‘আমার ধারণা হয়েছিল যে তিরিশ বছর আগে তুমি মারা গেছ।’
“‘তাই বটে!’ লোকটা এমন গম্ভীর ভাবে এই কথাটা বলল যে, তা শুনে আমার কেমন ভয় করতে লাগল। ওর মুখের দিকে তাকালে ভয় করে। ভয়ংকর ওর মুখ। আরও ভয়ংকর ওর চাউনি। চোখদুটো যেন জ্বলছে। তারপর থেকে বেশ কয়েক বার স্বপ্নের ভেতর ওর মুখ দেখে ভয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। মাথা ভরতি চুল। খোঁচা খোঁচা গোঁফ-দাড়ি। দাড়ি-গোঁফ-চুলে পাক ধরেছে। গায়ের রং তামাটে। শরীরে চামড়া কুঁচকে গেছে। ঠিক যেন শুকনো আপেল।
“‘ন্যানসি আমাকে বললেন, তুমি আস্তে আস্তে এগোও। আমি এর সঙ্গে কথা বলেই আসছি। না, না, ভয় পাবার কিছু নেই।’ ন্যানসি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার মুখ একদম শুকিয়ে গিয়েছিল। কথা বলবার সময় তাঁর ঠোট কাঁপছিল।
“‘ন্যানসির কথামতো আমি খানিকটা এগিয়ে গেলাম। ওরা দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট কথা বলল। তারপর ন্যানসি চলে এলেন। ন্যানসিকে দেখে আমি তো অবাক। ওঁর চোখ দিয়ে তখন যেন আগুন ঠিকরোচ্ছিল। আমি লোকটি কী করছে দেখবার জন্যে পিছন ফিরে তাকালাম। ল্যাম্পপোস্টে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে যে ভাবে ঘুসি পাকিয়ে হাত ছুড়ছিল, তাতে মনে হল যে, লোকটির নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সারা রাস্তা ন্যানসি আর কোনও কথা বললেন না। আমার বাড়ির দোরগোড়ায় এসে ন্যানসি আমাকে বললেন যে, লোকটি তার পরিচিত। ‘এখন ওর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে যে আমার দেখা হয়েছে। বা কোনও কথা হয়েছে, এ কথা তুমি কিন্তু কাউকে বোলো না ভাই।’ আমি ন্যানসিকে বললাম, ‘আমি কথা দিচ্ছি এ ঘটনা আর কেউ জানবে না।’ এরপর ন্যানসি বাড়ি চলে গেলেন।’
“মিস মরিসন বললেন, ‘আপনাকে আমি সব কথাই খুলে বললাম। এসব কথা পুলিশকে বলিনি, কেন না ব্যাপারটা যে ন্যানসির পক্ষে এতখানি গুরুতর হয়ে উঠবে সেটা বুঝতে পারিনি। এখন বুঝছি যে, এ ঘটনার কথা প্রকাশ পেলে ন্যানসিরই ভাল হবে।’
“বুঝলে ওয়াটসন, মিস মরিসনের কথায় আমি অন্ধকারের মধ্যে আলোর হদিস পেয়ে গেলাম। যে-জিনিসগুলোকে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না, সেগুলো সব ঠিক ঠিক মিলে গেল। ঘটনাগুলো পর পর যেমন ঘটেছে, তাও খানিকটা আন্দাজ করতে পারলাম। এখন আমার কাজ হল এই লোকটিকে খুঁজে বের করা। লোকটির সঙ্গে দেখা হওয়াতেই যে, ন্যানসি তাঁর স্বামীর ওপর ভয়ানক রেগে যান সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই। আমি জানতাম যে, লোকটি যদি অল্ডারশটে এখনও থাকে তো তাকে খুঁজে বের করা মোটেই শক্ত কাজ নয়। অল্ডারশটে অসামরিক সাধারণ লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তাই একজন বিকলাঙ্গ লোককে খুঁজে বের করতে বিশেষ কষ্ট করতে হবে না। আমি সারা দিন অল্ডারশটে ঘুরে বেড়ালাম। আজ সন্ধেবেলায় তাকে খুঁজে বের করেছি। যে-রাস্তাতে ন্যানসি আর তার বন্ধু ওকে দেখতে পেয়েছিলেন, ও সেই রাস্তাতেই থাকে।”
হোমস বলে চলল, “লোকটির নাম হেনরি উড। দিন-পাঁচেক সে যে-বাড়িতে ভাড়া এসেছে আমি সে বাড়িতে গেলাম। তারপর বাড়িওয়ালার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বললাম যে, রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে এসেছি। ভাড়াটেদের সম্বন্ধে খোঁজখবর করতে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি হেনরি উডের সম্বন্ধে অনেক খবর পেলাম। লোকটি নানা রকমের খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। রাত্তিরবেলায় সরাইখানায় ঘুরে ঘুরে খেলা দেখিয়ে বেড়ানোই ওর পেশা। ওর সঙ্গে একটা বাক্স থাকে। সেই বাক্সে ওর একটা পোষা জন্তু আছে। এ রকম অদ্ভুত ধরনের কোনও জন্তুই ভদ্রমহিলা কোথাও দেখেননি। জন্তুটাকে দেখলে তার খুব ভয় করে। জন্তুটা নানান ধরনের খেলা দেখাতে পারে বলে সেই ভদ্রমহিলা শুনেছেন। হেনরি উডের শরীরটা এমন বিকৃত যে, সে যে বেঁচে আছে, এইটেই ভদ্রমহিলার খুব আশ্চর্যের কথা বলে মনে হয়। লোকটি মাঝে মাঝে অদ্ভুত ভাষায় কী সব বলে ওঠে, তা কেউ বুঝতে পারে না। গত দু’ রাত্তির লোকটি নাকি ঘরের মধ্যে কেবল ‘উহ্, আহ’ করেছে আর কেঁদেছে। টাকাপয়সার ব্যাপারে লোকটি খুব সৎ। তবে ওর যে-টাকাটা জমা আছে, তার মধ্যে একটা অচল টাকা আছে। ভদ্রমহিলা আমাকে সেই টাকাটা এনে দেখালেন।…ওয়াটসন, সেটা একটা ভারতীয় টাকা।
“এখন অবস্থাটা বুঝতে পারছ তো? কেন আমি তোমার সাহায্য চাইছি, সেটাও বুঝেছ আশা করি। বোঝাই যাচ্ছে যে, হেনরি উড ন্যানসি আর মিস মরিসনকে অনুসরণ করে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে ন্যানসি আর জেমসকে ঝগড়া করতে দেখে। তারপর সে যে-ঘরে বার্কলেরা ঝগড়া করছিল, সেই ঘরে ছুটে যায়। এই সময়ে ওর পোষা জন্তুটা কোনও ভাবে বাক্স থেকে বেরিয়ে পড়ে। এই পর্যন্ত সবকিছুই জলের মতো সোজা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারপর। তারপর যা ঘটেছিল সেটা একমাত্র ওই হেনরি উডই জানে।”
“সেই কথাটা তুমি ওর কাছ থেকে জানতে চাও।”
“ঠিক তাই। আর চাই যে সেই সময় তৃতীয় একজন লোক সাক্ষী হিসেবে থাকুক।”
“আর আমিই হব সেই সাক্ষী।”
“হ্যাঁ। আশা করি তুমি রাজি আছ। যদি উড সব কথা খুলে বলতে রাজি হয় তো ভাল। না হলে অবশ্য ওকে পুলিশের হাতে দিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করবার থাকবে না।”
“কিন্তু ওখানে গিয়ে আমরা যে ওকে দেখতে পাব তার কোনও ভরসা আছে কি?”
“সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত হতে পারো। আমি ব্যবস্থা করেছি। আমি আমার বেকার স্ট্রিটের খুদে গোয়েন্দাদের এক জনকে ওর পেছনে লাগিয়ে দিয়েছি। সে জোঁকের মতো উডের সঙ্গে লেগে থাকবে। ওয়াটসন, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে উডকে হাডসন স্ট্রিটের বাসায় কাল আমরা পাবই। যাই হোক, আর তোমাকে আটকাব না। তুমি শুয়ে পড়ো।”
হোমসের সঙ্গে যখন অল্ডারশেটে গিয়ে পৌঁছোলাম তখন দুপুর। আমরা সোজা হাডসন স্ট্রিটের দিকে চললাম। হোমস কখনও তার মনের ভাব প্রকাশ করে না। তবে মনে মনে সে যে খুবই উত্তেজিত তা তার মুখ দেখে আন্দাজ করতে পারছিলাম। যখনই আমি হোমসের সঙ্গে কোনও তদন্তে যাই, আমার ভয়ানক উত্তেজনা হয়। এবারও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। একটা অপেক্ষাকৃত ছোট রাস্তায় এসে হোমস বলল, “এই হল হাডসন স্ট্রিট।” দেখলাম রাস্তার দু’দিকে দোতলা বাড়ির সারি।
“ওই তো সিম্পসন দাঁড়িয়ে আছে।”
অল্পবয়সি একটি ছেলে আমাদের দিকে দৌড়ে এসে বলল, “ও ঘরেই আছে মিঃ হোমস।” ছেলেটার পোশাক আরব দেশের ছেলেদের মতন।
হোমস ছেলেটার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “খুব ভাল, সিম্পসন খুব কাজের ছেলে।…এসো ওয়াটসন, এই বাড়ি।”
একটা কার্ডে হোমস কেন দেখা করতে এসেছে সে কথা লিখে ভৈতরে পাঠিয়ে দিল। একটু পরেই আমাদের ডাক এল। আমাদের সঙ্গে হেনরি উডের দেখা হল। বাইরে যদিও বেশ গরম, উড কিন্তু ঘরের চুল্লিতে আগুন জ্বালিয়ে বসেছিল। আমরা যখন ঘরে পা দিলাম তখন ছোট্ট ঘরটা একেবারে উনুনের মতো গরম হয়ে ছিল। হেনরি উড একটা চেয়ারে তেড়াবেঁকা ভাবে বসেছিল। এ রকম অদ্ভুত বিকলাঙ্গ কোনও লোক আমি এর আগে দেখিনি। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, হেনরি উডের চেহারাটা বিকৃত হলেও তার মুখ দেখলে বোঝা যায় যে, এক সময় তার মুখ সুন্দর ছিল। হেনরি উড আমাদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কোনও কথা না বলে হেনরি আমাদের বসতে বলল।
হোমস বেশ নরম গলায় বলল, “আপনি তো মিঃ হেনরি উড! কিছু দিন আগে ভারতবর্ষ থেকে ফিরেছেন, তাই না? আমি কর্নেল বার্কলের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি।”
“আমার সঙ্গে ওই ব্যাপারের কী সম্পর্ক?”
“সেইটে জানতেই তো আপনার কাছে এসেছি। আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন সত্যি কী ঘটেছিল তা যদি জানা না যায় তো মিসেস বার্কলের বিচার হবে। মিসেস বার্কলের তো আপনার পরিচিত।”
হোমসের কথা শুনে হেনরি উড ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।
সে চিৎকার করে উঠল, “আপনি কে আমি জানি না। আপনি এ সব কথা কী করে জানলেন, তাও আমি জানি না। আপনি কি সত্যি কথা বলছেন? ভগবানের দোহাই, বলুন যা বললেন তা সত্যি কিনা।”
“নিশ্চয়ই। মিসেস বার্কলে একটু সেরে উঠলেই পুলিশ ওঁকে গ্রেফতার করবে।”
“হায় ভগবান। আপনি কি পুলিশ?”
“না।”
“তা হলে এ ব্যাপারে আপনার এত মাথাব্যথা কীসের?”
“যাতে ন্যায় বিচার হয়, তা দেখা সকলের কর্তব্য নয় কি?”
“তা হলে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন যে, মিসেস বার্কলে সম্পূর্ণ নির্দোষ।”
“তবে কি আপনিই অপরাধী?”
“না, আমি অপরাধী নই।”
“কর্নেল জেমস বার্কলেকে খুন করল কে?”
“ভাগ্যের হাতে ও মারা গেছে। তবে জেনে রাখুন, যদি ও আমার হাতে খুন হত, তবে সেটাই হত ন্যায় বিচার। যদি নিজের বিবেকের তাড়ায় ওর এ দশা না ঘটত, তবে সে দিন ও যে আমার হাতে মরত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আপনি আমাকে সব কথা খুলে বলতে বলেছেন। বেশ, তবে শুনুন আমার সব কথা। আর এ কথা জানাজানি হলে আমার কোনও নিন্দে হবে না।
“আজকের আমাকে দেখে আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না যে, একদিন এই আমি ছিলাম ১১৭ নম্বর পদাতিক বাহিনীর সবচেয়ে সেরা অফিসার। আর আমাকে দেখতে ছিল খুব সুন্দর। আর আজকে দেখুন আমার পিঠটা হয়ে গেছে উটের মতো। বুকের পাঁজরা বেরিয়ে গেছে। আমাদের বাহিনী তখন ভারতবর্ষে ছিল। ধরা যাক, সে জায়গাটার নাম ভারতি। বার্কলে, সে দিন যে মারা পড়েছে, আমাদের বাহিনীতেই ছিল। আমাদের বাহিনীর এক সিনিয়র অফিসারের মেয়ে হল ন্যানসি ডেভয়। ও রকম ভাল মেয়ে খুব কম দেখা যায়। সবাই তাকে ভালবাসত। আমার সঙ্গে ন্যানসির যে বিয়ে ঠিক ছিল, এ কথা প্রায় সকলেই জানত। আমাদের বিয়েও হত যদি না সিপাইবিদ্রোহ শুরু হয়ে যেত।
“সেই সময় ভারতিতে আমাদের ক্যান্টনমেন্টে অল্প কিছু সৈন্য আর অনেক অসামরিক লোকজন ও মহিলা ছিলেন। প্রায় দশ হাজার বিদ্রোহী সেনা আমাদের ঘেরাও করল। আমাদের সঙ্গে মহিলারা না থাকলে আমরা যুদ্ধ করতাম। কিন্তু তাদের কথা ভেবে আমরা চুপচাপ রইলাম। এই ভাবে দিন পনেরো কেটে গেল। আমাদের খাবার জলের সমস্যা দেখা দিল। আমরা একটা উড়ো খবর পেয়েছিলাম যে, কর্নেল নিল প্রচুর সৈন্যসামন্ত নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে আসছেন। কিন্তু তিনি কবে আসবেন, তা কেউ জানে না। এদিকে জলের অভাবে আমাদের প্রাণ নিয়ে টানাটানি। তখন ঠিক হল যে, আমাদের মধ্যে থেকে একজন রাতের অন্ধকারে চুপিসারে এখান থেকে বেরিয়ে বিদ্রোহীদের চোখে ধুলো দিয়ে কর্নেল নিলের সঙ্গে দেখা করে আমাদের বিপদের কথা জানিয়ে আসবে। তারপর যা করার কর্নেল নিল করবেন। আমি বললাম, আমি যাব। সকলে রাজি হল। ওই অঞ্চলের রাস্তাঘাট জেমস বার্কলের একেবারে মুখস্থ। ও আমাকে একটা ছক কেটে দিল। সেইমতো আমি সেই দিনই রাত দশটার সময়ে আমাদের ব্যারাকের দেওয়াল টপকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। হাজারখানেক লোকের জীবন-মরণের চাবিকাঠি আমার হাতে।
“আমাকে যেতে হবে একটা মরা নদীর সোঁতা ধরে। ওই দিক দিয়ে গেলে বিদ্রোহী ফৌজদের চোখে ধূলো দেওয়া যাবে। প্রায় বুকে হেঁটে খুব সন্তর্পণে আমি এগিয়ে চললাম। বেশ খানিকটা যাবার পর একটা বাঁক। বাঁক ফিরতেই জনাছয়েক বিদ্রোহী আমাকে ঘিরে ফেলল। আর সঙ্গে সঙ্গে মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
“জ্ঞান হবার পর আরও একটা আঘাত পেলাম। আঘাতটা আমার দেহে নয়, মনে। বিদ্রোহীদের কথাবার্তা থেকে বুঝলাম, আমি যে এই পথে যাব তা ওরা আগে থেকেই জানত। খবরটা পেয়েছিল ওরা ব্যারাকের এক ভারতীয় ভৃত্যের কাছ থেকে। সংবাদটা পাঠিয়ে ছিল জেমস বার্কলে।
“জেমস বার্কলে যে কী করতে পারে বা না পারে, সে আলোচনা এখন আর করে লাভ নেই। এর পরে কী হল তাই বলি। পরের দিন কর্নেল নিল তাঁর ফৌজ নিয়ে এসে পড়লেন। যুদ্ধে বিদ্রোহীরা হেরে পালাল। ভারতির বন্দিরা মুক্ত হল। তবে আমি বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি রইলাম। পালাবার সময় ওরা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল। সে সময়ে আমার ওপর দিয়ে কী অত্যাচার যে গেছে, তা বলে বোঝাতে পারব না। আমি পালাতে চেষ্টা করলাম। ধরা পড়ে গেলাম। তার ফলে অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। বিদ্রোহীদের একদল আমাকে নিয়ে নেপাল গেল। সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে তারা এল দার্জিলিং। দার্জিলিঙে ওদের সঙ্গে পাহাড়িদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বিদ্রোহীরা হেরে যায়। পাহাড়িরা আমাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়। কিছু দিন ওদের সঙ্গে থাকবার পর আমি একদিন পালালাম। আমি দক্ষিণ দিকে না গিয়ে উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ঘুরতে ঘুরতে প্রথমে গেলাম আফগানিস্তানে। তারপর সেখান থেকে এলাম পঞ্জাবে। আমি আমার দেশের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও চেষ্টা করিনি। আমি ভারতীয়দের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাম। নানা রকম ছোটখাটো ম্যাজিক আর জীবজন্তুর খেলা দেখিয়ে বেড়াতাম। আমি ভাবতাম আমার এই বিকৃত দেহটা নিয়ে পুরনো বন্ধুবান্ধবদের কাছে গিয়ে কী লাভ! জেমস বার্কলে আমার ওপর যে-অন্যায় করেছে, তা আমি ভুলিনি। এই অন্যায়ের শোধ নেবার জন্যেও পুরনো পরিচিতদের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করত না। আমি ভাবতাম, সকলে, এমনকী ন্যানসিও যে ভাবছে আমি মারা গেছি, সেটাই ভাল। আমার হাঁটাচলাটা অনেকটা শিম্পাঞ্জির মতো হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণেই আমি পরিচিত লোকেদের কাছে যেতে চাইতাম না। আমি যে বেঁচে নেই, এটা সকলেই ধরে নিয়েছিল। আমিও তাদের ভুল ভাঙাবার চেষ্টা করিনি। এই রকম অবস্থায় শুনলাম যে, ন্যানসির বিয়ে হয়ে গেছে জেমস বার্কলের সঙ্গে। ন্যানসির বাবা অবশ্য বরাবরই চেয়েছিলেন যে, জেমসের সঙ্গে ন্যানসির বিয়ে হোক। এরপর জেমসের উন্নতি হতে লাগল। সব কথাই আমার কানে আসত। আমি কাউকে কোনও কথা বলিনি।
“বয়স বাড়লে সকলেরই বোধহয় দেশের ওপর টানটা বেড়ে যায়। কিছুদিন ধরেই আমার দেশে ফেরার ইচ্ছেটা বেড়ে যাচ্ছিল। শেষকালে একদিন জমানো টাকাপয়সা দিয়ে টিকিট কিনে জাহাজে চেপে বসলাম। এখানে এসে আমি যেখানে সৈন্যবাহিনীর আস্তানা আছে, সেখানে গিয়ে আমার খেলা দেখিয়ে বেড়াই। যা পাই তাতে আমার খরচখরচা চলে যায়।”
হোমস বলল, “আপনার জীবনের ঘটনা উপন্যাসের চেয়েও অদ্ভুত। আমি জানি যে, আপনার সঙ্গে মিসেস বার্কলের দেখা হয়েছিল। আপনারা দুজনেই দু’জনকে চিনতে পেরেছিলেন। আমার ধারণা সেই রাত্রে আপনি মিসেস বার্কলেকে অনুসরণ করে ওঁর বাড়ি পর্যন্ত যান। তারপর আপনি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মিসেস বার্কলে যে-ঘরটায় বসেছিলেন সে ঘরটা রাস্তা থেকে দেখা যায়। খানিক পরে সেই ঘরে কর্নেল বার্কলে আসেন। দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হয়। আর আপনি নিজেকে সামলাতে না পেরে লন পার হয়ে সোজা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েন।”
“আপনি ঠিক বলেছেন। আমি ঘরে ঢুকলাম। আমাকে দেখে বার্কলের চোখের চাউনিটা এমন হয়ে গেল, যা আমি কোনও মানুষের চোখে আগে দেখিনি। বার্কলে উলটে পড়ে গেল। পড়বার আগেই ও মারা গিয়েছিল। ওর পাপের জন্যেই ও মারা গেল। আমার চেহারা দেখে বিবেকের দংশনেই বার্কলে মারা পড়ল।”
“তারপর কী হল?”
“ন্যানসি অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ওর হাতে ঘরের চাবিটা ছিল। আমি চাবিটা ওর হাত থেকে নিয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম যে, ওকে ওর ঘরে শুইয়ে দেব। পরে মনে হল, এক্ষুনি যদি কেউ এসে আমাকে এখানে দেখতে পায় তো সব দোষটা আমার ঘাড়ে পড়বে। দোষের চেয়ে বড় কথা, এত দিন যে-সব কথা কাউকে বলিনি সে সব কথা জানাজানি হয়ে যাবে। আমি চাবিটা পকেটে পুরে ফেলি। ইতিমধ্যে টেডি বাক্স থেকে বেরিয়ে জানলার পরদা বেয়ে উঠছিল। ওকে বাক্সে পুরে পালিয়ে আসবার সময় তাড়াহুড়োতে আমার লাঠিটা ফেলে আসি।”
হোমস বলল, “টেডি কে?”
হেনরি উড সামনে ঝুকে চেয়ারের কাছে রাখা একটা বাক্সর ঢাকাটা সামান্য ফাক করতে লালচে-খয়েরি রঙের একটা জন্তু বেরিয়ে এল। জন্তুটার চোখদুটো লাল রঙের। ভারী চমৎকার।
হোমস বলল, “নেউল।”
উড় বললেন, “অনেকে বেজিও বলে। তবে আমি বলি সাপুড়ে। সাপ ধরতে ওস্তাদ। কেউটে সাপ হলে তো কথাই নেই। আমার একটা বিষদাঁত-ভাঙা কেউটে সাপ আছে। রোজ রাত্তিরে আমি টেডির সাপ ধরার খেলা দেখাই। লোকে খুব মজা পায়।…আপনারা আর কিছু জানতে চান?”
“না। যদি মিসেস বার্কলেকে খুনের দায়ে কোর্টে হাজির করা হয়, তবে আমাকে আবার আপনার কাছে আসতে হবে।”
“তা হলে আমি নিজে থেকেই সব কথা বলব।”
“তা যদি না হয় তো পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। বার্কলে আপনার ওপর ঘোরতর অন্যায় করেছেন ঠিকই, তবে গত তিরিশ বছর ধরে তো তিনিও কম কষ্ট পাননি। বিবেকের মার বড় মার…আরে ওই যে মেজর মারফি যাচ্ছেন। আচ্ছা, মিঃ উড, আমরা আজকের মতো চলি। কাল থেকে কী হল, সে খবরটা জানতে আমি উদ্গ্রীব হয়ে আছি।”
মোড়ের কাছে এসে আমরা মেজর মারফিকে ধরে ফেললাম।
“মিঃ হোমস যে,” মেজর মারফি বললেন, “আপনি শুনেছেন বোধহয় যে, ব্যাপারটা সব চুকেবুকে গেছে।”
“কী রকম?”
“আজকে ইনকোয়েস্ট হয়ে গেল। ডাক্তারি রিপোর্টে জানা গেল মৃগী রোগ থেকেই কর্নেলের মৃত্যু হয়েছে। খুব সহজ ব্যাপার।”
হোমস মুচকি হেসে বললেন, “হ্যাঁ, অদ্ভুত সোজা ব্যাপার।…চলো, ওয়াটসন, অল্ডারশটে আমাদের কাজ ফুরিয়েছে।”
ফেরবার সময়ে আমি হোমসকে বললাম, “একটা জিনিস বুঝলাম না। কর্নেলের নাম জেমস। আর এই লোকটির নাম তো হেনরি। ডেভিড লোকটি তা হলে কে?”
হোমস বলল, “দেখো ওয়াটসন, আমি যদি শতকরা একশো ভাগ নির্ভেজাল বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী হতাম তো এ নামটা থেকেই এই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারতাম। তুমি বাইবেলের স্যামুয়েলের অংশের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় ভাগ উলটে দেখলেই উত্তরটা পেয়ে যাবে।”
