বড়লোকের কাণ্ড (শার্লক হোমস) – আর্থার কোনান ডয়েল

শেয়ার করুনঃ

১৮৮৭ সালের বসন্তকালে হোমস বেশ শক্ত রকমের অসুখে পড়ে গেল। আজ যে ঘটনার কথা বলছি সেটা যখন ঘটে হোমস কিন্তু তখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি। অবশ্য এর ঠিক আগে দুটো খুব জটিল সমস্যার সমাধান করে হোমস বেশ নাম কিনেছিল। এর একটা হচ্ছে দ্য নেদারল্যান্ড সুমাত্রা কোম্পানির রহস্য, আর একটা হচ্ছে ব্যারন মোপেরটিউসের ঘটনা। এ ঘটনা দু’টোর কথা এখনও অনেকেরই মনে আছে। আর ওই কেস দু’টোর সঙ্গে বহু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নও জড়িয়ে আছে। তাই ওই কেস দুটোর সম্বন্ধে সব কথা খুলে বলবার সময় এখনও আসেনি। আজ যেটা লিখছি সেটাও কিছু কম চমক লাগানো বা কম জটিল নয়।

 

ডায়েরির পাতা ওলটাতে ওলটাতে দেখছি যে, ১৪ এপ্রিল লিয়ন্স থেকে আমার নামে একটা জরুরি টেলিগ্রাম আসে। টেলিগ্রামে লেখা ছিল যে, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শার্লক হোমস ডুলাং হোটেলে রয়েছেন। শীঘ্র আসুন। টেলিগ্রামটা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই হোমস যে-হোটেলে ছিল সেখানে পৌঁছে গেলাম। প্রথমেই হোমসকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলাম। মারাত্মক কোনও অসুখ না হলেও শরীর বেশ খারাপ হয়েছে। বুঝলাম যে, গত দু’মাসের হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে হোমসের লোহার শরীরও কাবু হয়ে পড়েছে। পরে হোমস আমাকে বলেছিল, গত দু’মাসে সে প্রতিদিন গড়ে পনেরো ঘণ্টা পরিশ্রম করেছে। আর কাজের সময় তার স্নান-খাওয়ার কথা মনেই থাকে না। এত প্রচণ্ড খাটাখাটুনি করে হোমস রহস্যের মীমাংসা করল বটে কিন্তু নিজে পড়ে গেল অসুখে। সারা ইউরোপ হোমসের নামে পাগল। আমি যখন হোমসের ঘরে গেলাম তখন মেঝের কার্পেটে পা ফেলার জায়গা পর্যন্ত নেই। মেঝে-ভরতি টেলিগ্রাম আর টেলিগ্রাম। চেনা, আধচেনা, অচেনা লোকে অভিনন্দন জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছে। কিন্তু হোমসের কোনও হুঁশ নেই। সে একদম চুপচাপ। তিন তিনটে দেশের বিরাট পুলিশবাহিনী একসঙ্গে মিলেমিশে বহু চেষ্টা করেও যে দুর্দান্ত প্রতারককে ধরতে পারেনি, তাকে বুদ্ধির খেলায় প্রতি পদে পদে ঠকিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলার এই যে অসাধারণ কৃতিত্ব তাও হোমসকে এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি। হোমসকে এত কাহিল অবস্থায় আগে কখনও দেখিনি।

 

তিন দিন বাদে আমরা বেকার স্ট্রিটে ফিরে এলাম। ডাক্তার হিসেবে আমার মনে হচ্ছিল যে, এই সময় হোমস যদি লন্ডনের বাইরে কোনও খোলামেলা জায়গায় হাওয়া বদলাতে যেত তো সেটা ওর শরীরের পক্ষে তো বটেই মনের পক্ষেও ভাল হত। বছরের এই সময়টা আমারও ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। আমার বন্ধু কর্নেল হেটার সারের কাছে রাইগেটে একটা বাড়ি কিনেছে। সে প্রায়ই আমাকে তার ওখানে বেড়াতে যেতে বলে। আফগানিস্তানে হেটারের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। আমি চিকিৎসা করে ওকে সারিয়ে তুলেছিলাম। শেষ বার যখন হেটারের সঙ্গে দেখা হয় তখন ও আমাকে বলেছিল যে, আমি যদি হোমসকে সঙ্গে নিয়ে তার ওখানে আসি তাতে তার তো কোনও অসুবিধে হবেই না, উলটে সে খুব খুশি হবে। আমি কায়দা করে কথাটা একদিন হোমসের কাছে পাড়লাম। হোমস প্রথমটায় রাজি হয়নি। পরে যখন শুনল যে, হেটার আমাদেরই মতো বিয়েটিয়ে করেনি তখন রাইগেটে যেতে রাজি হয়ে গেল। আমি হোমসকে বললাম, “ভয় পেয়ো না, তুমি ওখানে স্বাধীন ভাবেই থাকতে পারবে।” লিয়নস থেকে ফেরার ঠিক সাত দিন পরে আমরা রাইগেটে গেলাম। হেটার যাকে বলে অনেক পোড়-খাওয়া সৈনিক। জীবনে তার অভিজ্ঞতা প্রচুর। আমি জানতাম যে, হোমসের সঙ্গে হেটারের বন্ধুত্ব হতে দেরি হবে না। হলও ঠিক তাই।

 

যে দিন রাইগেটে গেলাম সে দিন রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা হেটারের অস্ত্রাগারে বসে ছিলাম। হোমস একটা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসেছিল। আর আমি হেটারের অস্ত্রশস্ত্র নেড়েচেড়ে দেখছিলাম।

 

কথায় কথায় হেটার বলল, “যদি কোনও গোলমাল হয় তাই আজ থেকে একটা পিস্তল সঙ্গে নিয়ে শুতে যাব ঠিক করেছি।”

 

আমি অবাক হয়ে বললাম, “গোলমাল?”

 

“হ্যাঁ। কিছু দিন ধরে হাঙ্গামা হচ্ছে। বুড়ো অ্যাক্টন এ অঞ্চলের বিরাট ধনী লোক। টাকার কুমির বলতে পারো। গত সোমবার তার বাড়িতে চুরি হয়েছে। বিশেষ কোনও ক্ষতি হয়নি বটে, তবে চোর ধরা পড়েনি।”

 

“চুরির ব্যাপারে কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি?” হোমস নড়েচড়ে বসে হেটারকে জিজ্ঞেস করল।

 

“না। এখনও পর্যন্ত সে রকম কিছু পাওয়া যায়নি। তবে এ হচ্ছে পাড়াগাঁয়ের ছিঁচকে চুরি। আপনি হালে যে ভাবে বিরাট আন্তর্জাতিক জালিয়াতির পাণ্ডাকে ধরে ফেললেন তারপর এত তুচ্ছ ব্যাপারের কথা আপনাকে বলতেই লজ্জা করে।”

 

হেটারের কথায় হোমস মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল। তবে তার ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি দেখে বুঝলাম যে, সে মনে মনে খুবই খুশি হয়েছে।

 

হোমস বলল, “এই চুরির ব্যাপারে ইন্টারেস্টিং কিছু নজরে পড়েছিল কি?”

 

“না, আমার তো কিছু মনে হচ্ছে না। চোরেরা লাইব্রেরি ঘরটা তছনছ করেছিল। তবে তাদের পরিশ্রম পোষায়নি। বইপত্র উলটে পালটে, লেখবার টেবিলের ড্রয়ারের তালা ভেঙে শেষ পর্যন্ত চোরেরা যা হাতাতে পেরেছিল তা হল পোপের ‘হোমার’-এর এক খণ্ড, দুটো রুপোর জল-করা বাতিদান, একটা হাতির দাঁতের পেপারওয়েট আর একটা ব্যারোমিটার।”

 

আমি বললাম, “অদ্ভুত সব জিনিস চুরি গেছে তো?”

 

হেটার বলল, “চোর হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে বোধহয় সরে পড়েছে!”

 

হোমস সোফায় আরাম করে বসে বলল, “চুরি-যাওয়া জিনিসের ধরন দেখে স্থানীয় পুলিশের তো বোঝা উচিত ছিল। ব্যাপারটা তো পরিষ্কার!”

 

আমি হাত তুলে হোমসকে বারণ করলাম, “হোমস, তুমি এখানে শরীর সারাতে এসেছ। শরীরের এই অবস্থায় তুমি আর নতুন কোনও রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাবে না।”

 

হোমস হতাশ ভাবে হেটারের দিকে তাকাল। তার ভাবটা হল—দেখলেন তো, আমার কী অবস্থা! এরপর আমরা অন্য ব্যাপার নিয়ে কথাবার্তা বলতে লাগলাম।

 

কিন্তু ভাগ্যের কী অদ্ভুত পরিহাস! পরদিনই এমন ঘটনা ঘটে গেল যে, আমার ডাক্তারি উপদেশ আর কোনও কাজেই এল না। আমরা আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারলাম না। আমরা বিশ্রাম নিতে এসেছিলাম, বিশ্রাম নেওয়া মাথায় উঠল। আমরা প্রাতরাশ সারছিলাম। হঠাৎ উদ্‌ভ্রান্তের মতো হেটারের নায়েব এসে হাজির।

 

সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আপনি কি খবরটা শুনেছেন স্যার? কানিংহামদের বাড়িতে সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে।”

 

কফিতে চুমুক দিতে দিতে হেটার বলল, “কী হয়েছে? চুরি?”

 

“খুন!”

 

ঠক করে কফির কাপটা টেবিলে নামিয়ে হেটার বলল, “সে কী! কে খুন হল? জে. পি. না তার ছেলে?”

 

“ওঁরা কেউ খুন হননি। খুন হয়েছে ওঁদের কোচোয়ান উইলিয়ম। গুলি একেবারে হৃৎপিণ্ড এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলে গেছে। বেচারা সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়েছে।”

 

“ওকে গুলি করল কে?”

 

“সেই চোরটা। গুলি ছুড়েই লোকটা পালিয়েছে। চোরটা রান্নাঘরের জানলা ভেঙে ঘরে ঢুকেছিল। উইলিয়ম দেখতে পেয়ে তাকে ধরে ফেলে, আর তখন ও উইলিয়মকে গুলি করে পালায়। মনিবের সম্পত্তি বাঁচাতে গিয়ে বেচারা প্রাণটা দিল।”

 

“কখন হয়েছে?”

 

“কাল রাত বারোটার কাছাকাছি।”

 

“ঠিক আছে, একবার ওদের ওখান থেকে ঘুরে আসতে হবে,” বলে হেটার কফির কাপ তুলে নিয়ে কফি খেতে লাগল। হেটারের নায়েব চলে গেল।

 

হেটার আমাদের বলল, “বিচ্ছিরি ব্যাপার। বুড়ো কানিংহাম এ অঞ্চলের একজন হোমরাচোমরা মানুষ। বুড়ো খুব কষ্ট পাবে। উইলিয়ম ওদের বহু দিনের পুরনো লোক। লোকটা যেমন কাজের তেমনই বিশ্বাসী। অ্যাক্টনদের বাড়িতে যারা চুরি করেছিল এটা নির্ঘাত তাদেরই কাজ।”

 

হোমস খুব চিন্তিত ভাবে বলল, “মানে, যারা সেই অদ্ভুত জিনিস চুরি করে পালিয়েছে?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“হুম। আসলে হয়তো ব্যাপারটা খুবই সরল। তবে ওপর ওপর দেখলে খাপছাড়া বলে মনে হয় না কি? কোনও চোরের দল যদি এ কাজ করে থাকে তবে সহজ বুদ্ধিতে মনে হয় যে, তারা একই জায়গায় বার বার চুরি করতে আসবে কেন? এখান থেকে দুরে কোথাও গিয়ে চুরি করাটাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। কেন না তাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা কম। কাল রাত্তিরে আপনি যখন পিস্তল নিয়ে শুতে যাবার কথা বলছিলেন তখন আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এই রকম জায়গায় চুরি-ডাকাতি হবে ভাবা যায় না। কিন্তু দেখছি আমার এখনও অনেক কিছু শিখতে বাকি আছে।”

 

হেটার বলল, “আমার ধারণা, চোরেরা আমাদের রাইগেট অঞ্চলের লোকই হবে। আর তা যদি হয় তো তাদের নজর গোড়াতেই পড়বে বড়লোকদের ওপর। অ্যাক্টন আর কানিংহাম হচ্ছে এখানকার সবচেয়ে নামজাদা লোক।”

 

হোমস বলল, “এরাই বোধহয় সবচেয়ে বড়লোকও।”

 

“এক সময় তো তাই ছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ওদের মধ্যে মামলা চলছে। আর মামলা চালাতে গিয়ে ওদের টাকা জলের মতো খরচ হচ্ছে। অ্যাক্টন নাকি কানিংহামদের সম্পত্তির অর্ধেকের মালিকানা দাবি করছে। উকিলরা এই সুযোগে দু’হাতে টাকা লুটছে।”

 

হোমস হাই তুলতে তুলতে বলল, “যদি এ কাজ এই অঞ্চলের কোনও ডাকাত করে থাকে তো তাকে ধরে ফেলা শক্ত হবে না। যাকগে, ওয়াটসন, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি এ ব্যাপারে নাক গলাব না।”

 

হোমসের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেটারের নায়েব ঘরের দরজা খুলে বলল, “ইন্সপেক্টর ফরেস্টার দেখা করতে এসেছেন।”

 

যে-পুলিশ ইন্সপেক্টরটি ঘরে ঢুকলেন তাঁর বয়স কম, তবে চোখেমুখে বুদ্ধি আর উৎসাহের ছাপ ফুটে আছে। হেটারের দিকে তাকিয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন, “গুড মর্নিং মিঃ হেটার। আশা করি অসময়ে এসে আপনাকে বিরক্ত করিনি। আমরা শুনলাম যে, বেকার স্ট্রিট থেকে মিস্টার শার্লক হোমস আপনার কাছে এসেছেন।”

 

হেটার মাথা নেড়ে হোমসকে দেখিয়ে দিল। ইন্সপেক্টর সামনে ঝুঁকে পড়ে হোমসকে অভিবাদন জানালেন। “মিঃ হোমস, আশা করি আমরা এই খুনের ব্যাপারে আপনার সাহায্য পাব।”

 

হোমস আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “ওয়াটসন, অদৃষ্টের পরিহাস!” তারপর ইন্সপেক্টরকে বলল, “আপনি আসবার ঠিক আগেই ওই ব্যাপারে আমরা কথাবার্তা বলছিলাম। ইন্সপেক্টর, আপনি বোধহয় কিছু খাঁটি খবর দিতে পারবেন।” হোমস যে ভাবে আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসল তাতে আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে, হোমসকে ঠেকানো যাবে না।

 

“অ্যাক্টনের বাড়িতে যে-চুরি হয়েছে তার তদন্ত করতে গিয়ে আমরা সত্যি কথা বলতে কী কোনও সূত্রই পাইনি। তবে কালকের ব্যাপারে আমাদের হাতে প্রচুর সূত্র এসেছে। কোনও সন্দেহ নেই যে, দুটোই একই দলের কাজ। একটা লোককে দেখা গেছে।”

 

“আচ্ছা?”

 

“হ্যাঁ স্যার। তবে মুশকিল হচ্ছে যে, উইলিয়ম কিরানকে গুলি করে মেরেই লোকটা একেবারে হরিণের মতো দৌড় লাগিয়েছিল। মিঃ কানিংহাম লোকটাকে শোবার ঘরের জানালা দিয়ে একনজর দেখতে পেয়েছিলেন। আর অ্যালেক কানিংহাম ওকে দেখেছিলেন পেছনের গলি থেকে। গোলমালটা বাধে পৌনে বারোটা নাগাদ। মিঃ কানিংহাম তখন সবে শুয়েছেন আর মিস্টার অ্যালেক তখন ড্রেসিং গাউন গায়ে চাপিয়ে সবেমাত্র পাইপ খেতে শুরু করেছেন। তাঁরা দু’জনেই কোচোয়ান উইলিয়মের গলা পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিলেন। উইলিয়াম তখন ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছিল। চিৎকার শুনে ব্যাপার কী দেখার জন্যে মিস্টার অ্যালেক দৌড়ে নীচে নেমে যান। সিঁড়ির শেষ ধাপের কাছে এসে মিস্টার অ্যালেক দেখতে পান যে, পেছন দিকের গলির দরজাটা খোলা আর সেখানে দু’জন লোক ঝটাপটি ধস্তাধস্তি করছে। সেই সময় এক জন লোক গুলি ছোড়ে আর তার ফলে অপর লোকটি আঘাত পেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সেই সুযোগে খুনি বাগানের মধ্যে দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে পালায়। লোকটা বাগান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই শোবার ঘরের জানলা দিয়ে মিঃ কানিংহাম ওকে দেখে ফেলেন। তার পরেই লোকটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মিঃ অ্যালেক খুনির পিছনে ধাওয়া না করে আহত লোকটিকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর সেই জন্যে খুনেটা বিনা বাধায় পালিয়ে যায়। আমরা যেটুকু খবর পেয়েছি তা হল লোকটির দোহারা চেহারা, খুব লম্বাও নয় আবার বেঁটেও নয়। কালো রঙের পোশাক পরেছিল। এর কোনওটাই সূত্র হিসেবে কিছু নয়, তবে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি। লোকটা অন্য কোনও জায়গা থেকে এসে থাকলে ধরা পড়বেই পড়বে।”

 

হোমস বলল, “উইলিয়ম ওই সময়ে ওখানে কী করছিল? মরার আগে সে কি কিছু বলতে পেরেছিল?”

 

“না। কোনও কথাই বলতে পারেনি। উইলিয়ম আর তার মা ওখানেই থাকে। লোকটা ছিল খুব বিশ্বাসী। আমার মনে হয় শুতে যাবার আগে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখার জন্যেই ও ওখানে গিয়েছিল। অ্যাক্টনের বাড়িতে চুরি হবার পর থেকে সকলেই হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। ডাকাতটা বোধহয় সবেমাত্র দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছিল, দরজার তালা ভাঙা হয়েছে, আর তখনই উইলিয়ম গিয়ে পড়ে।”

 

“উইয়িলম কি বেরোবার আগে ওর মা’কে কিছু বলেছিল?”

 

“ওর মায়ের অনেক বয়স, কানেও খাটো। ওর কাছ থেকে কোনও কথাই জানতে পারিনি। এখন আবার এই সংবাদ শুনে বুড়ি একেবারে জবুথবু হয়ে গেছে। তবে একটা খুব বড় সূত্র আমাদের হাতে এসেছে। এইটে দেখুন।”

 

ইন্সপেক্টর তাঁর নোটবই খুলে এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ বের করে সেটা আমাদের সামনে তুলে ধরলেন।

 

“এই টুকরোটা মৃত উইলিয়মের বুড়োআঙুল আর তর্জনীর মধ্যে ধরা ছিল। মনে হচ্ছে এটা একটা বড় কাগজের ছেঁড়া অংশ। কাগজটা পড়লেই দেখবেন যে, যে-সময়ের কথা লেখা রয়েছে সেই সময়েই উইলিয়ম খুন হয়। হয় উইলিয়ম কাগজটা খুনির হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে যায়, নয়তো খুনিই উইলিয়ামের হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিতে যায়। আর সেই টানাটানিতেই এটা ছিঁড়ে গেছে। পড়লে মনে হয় এটায় যেন কোনও দেখাসাক্ষাতের কথা লেখা ছিল।”

 

হোমস কাগজের টুকরোটা ইন্সপেক্টরের হাত থেকে তুলে নিল। টুকরোর একটা ফোটোকপি পাঠকের সুবিধের জন্যে ছেপে দিলাম।

 

ইন্সপেক্টর বলে চললেন, “যদি ধরে নিই যে এটা একটা দেখাসাক্ষাতের কথা তা হলে বুঝতে হবে যে, উইলিয়ম বাইরে বেশ সাধু সেজে থাকলেও আসলে একটি ভিজেবেড়াল। খুনির সঙ্গে ওর ভেতরে ভেতরে যোগসাজস ছিল। ডাকাতটার সঙ্গে উইলিয়মের ওখানেই দেখা হয়, কে বলতে পারে, উইলিয়মই ওকে দরজা ভাঙতে সাহায্য করেছিল কিনা, তারপর হয়তো ওদের মধ্যে কোনও কারণে ঝগড়াঝাটি লেগে যায়।”

 

হোমস ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে খুব খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখে বলল, “এই কাগজটা সত্যিই খুব ইন্টারেস্টিং। আমি যা ভেবেছিলাম তা তো নয়। এ বেশ গভীর জল।”

 

এরপর হোমস আর কোনও কথা না বলে মাথা হেঁট করে চিন্তা করতে লাগল। হোমস যে এই খুনের ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো মাথা ঘামাচ্ছে তা দেখে তরুণ পুলিশ ইন্সপেক্টর মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।

 

খানিক পরে ইন্সপেক্টরকে লক্ষ্য করে হোমস বলল, “আপনি একটু আগে বলছিলেন যে, ডাকাতদের সঙ্গে বাড়ির চাকরের যোগসাজস ছিল, আর এই কাগজটা ওদেরই কেউ কাউকে লিখেছিল ওখানে ও সময়ে দেখা করতে বলে, সেটা যে একদম অসম্ভব তা নয়। কিন্তু এই লেখাটা দেখে মনে হচ্ছে…,” কথাটা শেষ না করেই হোমস আবার মাথা নিচু করল। বুঝলাম যে, লেখাটা হোমসকে ভাবিয়ে তুলেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে হোমস যখন মুখ তুলল তখন তার দিকে তাকিয়ে আমি তো অবাক। তার চোখেমুখে আগেকার সেই ঝকমকে ভাবটা ফিরে এসেছে। চোখদুটো ছুরির মতো চকচক করছে। এক মুহূর্তে হোমস যেন তার হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছে। হোমস চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। উৎসাহে সে একেবারে টগবগ করছে।

 

“ইন্সপেক্টর, আপনাকে আমি সব কথা বলব। তার আগে আমি সবকিছু একবার ভাল করে দেখে নিতে চাই। আজ পর্যন্ত যা-যা ঘটেছে তা কিন্তু মোটেই তুচ্ছ ব্যাপার নয়। এর মধ্যে এমন অনেক কিছু আছে যা আমাকে সত্যিই সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে। কর্নেল, যদি কিছু মনে না করেন তো আপনি আর ওয়াটসন এখানে বসে গল্পগুজব করুন, আমি ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে নিয়ে চারধার একবার ঘুরে আসি। সব শুনে আমার কয়েকটা কথা মনে হচ্ছে। সেগুলো ঠিক কি ভুল আমি একবার যাচাই করে দেখতে চাই। আমাদের দেরি হবে না। আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরেই আসব।”

 

পাক্কা দেড়টি ঘণ্টা কেটে গেল। হোমসের টিকির দেখা নেই। কী হল ভাবছি, এমন সময় ইন্সপেক্টর এসে হাজির। “মিঃ হোমস ওই দিকের মাঠে পায়চারি করছেন। আপনাদের আমার সঙ্গে সেখানে যেতে বললেন। তাঁর ইচ্ছে আমরা চার জন একই বাড়ির ভেতরে ঢুকি।”

 

“বাড়ির ভেতরে ঢুকব? কার বাড়ির? মিঃ কানিংহামের?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“কিন্তু কেন?”

 

ইন্সপেক্টর খুবই হতাশ ভাবে কাঁধ নাচালেন, “কেন তা আমি বলতে পারব না। নিজেদের মধ্যে কথা বলেই বলছি, কিছু মনে করবেন না, আমার মনে হচ্ছে মিঃ হোমস এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেননি। এমন উদ্ভট উদ্ভট কাণ্ড করছেন যে কী বলব! থেকে থেকে আবার ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠছেন।”

 

ইন্সপেক্টরকে আশ্বস্ত করে আমি বললাম, “আপনি ঘাবড়াবেন না। আমি বরাবর দেখে আসছি যে, হোমসের পাগলামির মধ্যেও একটা যুক্তির পরম্পরা থাকে। কারণ না থাকলে সে কোনও কাজই করে না।”

 

ইন্সপেক্টর নিচু গলায় বললেন, “লোকে অবশ্য ভাবতে পারে যে, ওঁর কাজকর্মের ধারায় পাগলামিটাই বেশি। সে যাই হোক, এখন কাজ শুরু করার জন্যে উনি ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আপনারা যদি তৈরি থাকেন তো চলুন আমরা বেরিয়ে পড়ি।”

 

আমরা যখন মাঠে এসে পৌঁছোলাম তখন হোমস ট্রাউজার্সের পকেটে হাত পুরে মুখ বুকের সঙ্গে প্রায় ঠেকিয়ে দিয়ে পায়চারি করছিল।

 

আমাদের দেখে হোমস বলল, “বেশ গোলমেলে ব্যাপার। ওয়াটসন, শহর থেকে দূরে হাওয়া বদলাতে আসা সার্থক হয়েছে। সকালটা আজ খুব আনন্দে কাটল।”

 

কর্নেল বললেন, “মনে হচ্ছে যেখানে খুন হয়েছে সেখানে আপনি গিয়েছিলেন।”

 

“হ্যাঁ। ইন্সপেক্টরের সঙ্গে এক চক্কর ঘুরে এলাম।”

 

“কিছু সুরাহা হল?”

 

“হ্যাঁ, তা হয়েছে বই কী। অনেক নতুন জিনিস দেখলাম। চলুন, যেতে যেতে সব কথা বলব। প্রথমে উইলিয়মের মৃতদেহটা পরীক্ষা করলাম। লোকটা গুলিতেই মারা গেছে।”

 

“আপনি কি গুলিতে মারা যাবার কথাটা বিশ্বাস করেননি?”

 

“তা নয়। তবে গোয়েন্দাকে সবকিছু যাচাই করে নিতে হয়। আর এই যাচাই করাটা বৃথা যায়নি। মিঃ কানিংহাম আর তাঁর ছেলের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তাঁরা দু’জনেই বাগানের ঠিক কোন জায়গা দিয়ে বেড়া টপকে খুনি পালিয়েছিল, তা দেখিয়ে দিলেন। এই খবরটা খুবই কাজের হয়েছে।”

 

“তা তো বটেই।”

 

“তারপর আমরা গেলাম উইলিয়মের বুড়ি মায়ের কাছে। তাঁর কাছে অবশ্য নতুন কিছু জানতে পারিনি। একে তো থুত্থুড়ে বুড়ি, তার ওপর আবার এই ব্যাপারে একেবারে ভেঙে পড়েছেন।”

 

“তা বেশ। কিন্তু তদন্তের ফল কী হল?”

 

“তদন্তের ফলে এটা জানতে পেরেছি যে, এটা একটা অদ্ভুত ধরনের ক্রাইম। তবে আশা করি, সদলবলে ওখানে হাজির হয়ে আমরা এই রহস্যের কিনারা করতে পারব। ইন্সপেক্টর আর আমি দু’জনেই একমত যে, মৃত ব্যক্তির হাতে যে-কাগজের টুকরোটা পাওয়া গেছে তাতে তার মৃত্যুর সঠিক সময়টা লেখা আছে। আর এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।”

 

“হ্যাঁ। এই তথ্য থেকে আমরা একটা সূত্র পেয়ে যেতে পারি।”

 

“এটাই একটা সূত্র। যে-ই চিঠিটা লিখে থাকুক সে-ই উইলিয়ামকে অত রাত্রে ঘর থেকে বের করে এনেছিল। কিন্তু চিঠির বাকি অংশটা কোথায় গেল?”

 

ইন্সপেক্টর বললেন, “বাকি অংশটার জন্যে আমি চার দিক তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।”

 

“কাগজটা মৃত উইলিয়মের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বোঝা যাচ্ছে এই কাগজটা ফিরে পাওয়ার জন্যে কেউ খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কেন? নিশ্চয়ই কাগজটাতে এমন কিছু ছিল যাতে পত্রলেখকের পরিচয় ফাঁস হয়ে যেত। কথা হচ্ছে, কাগজটা মৃতের হাত থেকে টেনে নিয়ে সে করল কী? নিশ্চয়ই কাগজটা সে তার জামার পকেটে পুরে ফেলবে। কাগজটার একটা কোণ যে ছিড়ে গেছে সেটা খুব সম্ভব সে খেয়াল করেনি। যদি টুকরো কাগজের বাকি অংশটা কোনও ভাবে জোগাড় করতে পারা যায় তবে রহস্যের বারো আনাই সমাধান হয়ে যাবে।”

 

“সে কথা ঠিক। তবে অপরাধীকে ধরতে না পারলে তার পকেট হাতড়ানো যাবে কী করে?”

 

“হ্যাঁ। সে ব্যাপারটা অবশ্য ভেবে দেখতে হবে। তা ছাড়া একটা বড় কথা, চিঠিটা উইলিয়মকে পাঠানো হয়েছিল। চিঠিটা যে লিখেছিল সে নিজেই নিশ্চয়ই এটা পৌঁছে দেয়নি। তা হলে সে তো মুখেই কথাটা বলে আসতে পারত। চিঠি লেখার দরকার হত না। চিঠিটা কে পৌঁছে দিয়েছিল? নাকি চিঠিটা ডাকে এসেছিল?”

 

ইন্সপেক্টর বললেন, “আমি খোঁজখবর করেছিলাম। গতকাল বিকেলের ডাকে উইলিয়ম একটা চিঠি পেয়েছিল। সে খামটা নষ্ট করে ফেলে।”

 

ইন্সপেক্টরের পিঠ চাপড়ে হোমস বলল, “দারুণ! আপনি পোস্টম্যানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন? সত্যি আপনার সঙ্গে কাজ করে আনন্দ আছে। যাক, আমরা উইলিয়মের বাড়ির কাছে এসে পড়েছি। কর্নেল, আপনারা যদি আসেন তো খুনের জায়গাটা আপনাদের দেখিয়ে দিই।”

 

যে-বাড়িতে উইলিয়ম থাকত সে বাড়ির পাশ দিয়ে আমরা চলে গেলাম। বাড়িটা ছাড়িয়ে একটু গেলেই একটা রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে ওকগাছের সারি। সেই রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে কুইন অ্যানের আমলের একটা পুরনো বাড়ি। হোমস আর ইন্সপেক্টর আমাদের নিয়ে এগিয়ে চলল। বাড়ির পাশে একটা দরজা। সেই দরজার পরে বাগান। বাগানের বেড়ার ধারেই রাস্তা। রান্নাবাড়ির দরজার কাছে এক জন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে ছিল। হোমস কনস্টেবলকে বলল, “দরজাটা খুলে দাও তো অফিসার।” তারপর কর্নেলকে বলল, “ওই যে সিঁড়িটা দেখতে পাচ্ছেন, ওখানে অ্যালেক কানিংহাম দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখানে উইলিয়ম আর তার খুনি ধস্তাধস্তি করছিল। বাঁ দিকের ওই যে দ্বিতীয় জানলাটা দেখতে পাচ্ছেন ওখানে দাঁড়িয়ে মিঃ কানিংহাম দেখে ছিলেন যে, ওই ঝোপটা দেখছেন, ওই ঝোপের বাঁ দিক দিয়ে লোকটা ছুটে পালাচ্ছে। একই দৃশ্য অ্যালেকও দেখতে পান। ওই ঝোপটার জন্যেই কানিংহামরা জায়গাটা দেখাতে পেরেছে। মিস্টার অ্যালেক আহত লোকটির কাছে ছুটে যান। তারপর তার শুশ্রূষা করতে থাকেন। এখানকার জমিটা খুব শক্ত। তাই কোনও পায়ের ছাপ পড়েনি যা পেলে আমরা রহস্য সমাধানে এগোতে পারতাম।”

 

হোমস যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলছিল তখন বাগানের রাস্তা ধরে বাড়ির পেছন দিক থেকে দু’জন লোক এগিয়ে আসছিলেন। দু’জনের মধ্যে এক জন বেশ বয়স্ক। আর এক জন কমবয়সি। বয়স্ক ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালে চোখে পড়ে তাঁর মোটা মোটা ভুরু আর বড় বড় চোখ। ভদ্রলোকের মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। কমবয়সি লোকটি, যাকে বলে বেশ শৌখিন যুবক। পরনে বেশ রংদার বাহারি পোশাক। চোখেমুখে হাসিখুশির ভাব। আমার মনে হল যে, পরিবেশের সঙ্গে ছোকরা একেবারেই বেমানান।

 

ছোকরাটি হোমসকে লক্ষ্য করে বলল, “এখনও তদন্ত করছেন? আমার ধারণা ছিল আপনারা মানে লন্ডনওয়ালারা কখনও ভুল করেন না। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি খুনিকে ঝটপট ধরে। ফেলার এলেম আপনাদের নেই।”

 

হোমস হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমাকে আর একটু সময় দিন।”

 

অ্যালেক কানিংহাম বলল, “সময় আপনার লাগবেই তো। খুনিকে যে ধরবেন তার কোনও সূত্রই পাওয়া যাচ্ছে না।”

 

ইন্সপেক্টর বললেন, “না, একটা সূত্র আমরা পেয়েছি। আমাদের মনে হচ্ছে যে, যদি আমরা…আরে আরে আরে। মিঃ হোমস, কী হল আপনার?”

 

হোমসের মুখের চেহারা কী রকম যেন হয়ে গেল। চোখের তারা বড় বড় হয়ে ঘুরতে লাগল। চাউনি কেমন ঘোলাটে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে হোমস মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। তার মুখ দিয়ে চাপা গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হোমসের শরীরের অবস্থা দেখে সকলেই রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। হোমসকে ধরাধরি করে রান্নাবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একটা বড় আরামকেদারায় তাকে শুইয়ে দেওয়া হল। বেশ কিছুক্ষণ পরে হোমস সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াল। তার মুখ দেখে বোঝা গেল যে, সে খুব লজ্জা পেয়েছে।

 

“আপনারা হয়তো ওয়াটসনের কাছে শুনে থাকবেন যে, কিছু দিন আগে আমার খুব বড় রকমের অসুখ করেছিল। এখন সেরে উঠেছি, তবে পুরোপুরি সুস্থ হইনি। মাঝে মাঝে শরীরটা কেমন করে, তখন এই ধরনের একটা নার্ভাস শকের মতো হয়।”

 

মিঃ কানিংহাম বললেন,“আমাদের গাড়ি তা হলে আপনাকে বরং বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসুক।”

 

হোমস বলল, “যখন আমি এখানে এসেই পড়েছি একটা ব্যাপার যতক্ষণ না যাচাই করতে পারছি ততক্ষণ আমার মনে শান্তি হবে না। ব্যাপারটা সত্যি কিনা সেটা সহজেই জানা যেতে পারবে।”

 

“কী জানতে চান বলুন?”

 

“আমার মনে হচ্ছে, উইলিয়ম বেচারা হয়তো ডাকাত পড়বার আগে নয়, পরেই বাড়ির ভেতর ঢুকেছিল। আপনারা কেন ধরে নিচ্ছেন যে, দরজা ভাঙা হলেও ডাকাত বাড়িতে ঢুকতে পারেনি।”

 

মিঃ কানিংহাম গম্ভীর ভাবে বললেন, “এটা তো জলের মতো পরিষ্কার। আমার ছেলে অ্যালেক তখনও শুতে যায়নি। বাড়ির মধ্যে কেউ ঢুকলে সে নিশ্চয়ই টের পেত।”

 

“উনি ঠিক কোথায় বসেছিলেন?”

 

“আমি আমার বসার ঘরে বসে ধূমপান করছিলাম।”

 

“সে ঘরের জানলা কোনটা?”

 

“বাঁ দিকের শেষ জানলা। বাবার ঘরের পাশেরটা।”

 

“আপনার ঘরের সব আলো জ্বলছিল তো?”

 

“অবশ্যই।”

 

হোমস হেসে উঠে বলল, “হুঁ, অদ্ভুত কাণ্ড! ঘরে আলো জ্বলছে। সে আলো বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। তার মানে বাড়ির লোকজন এখনও জেগে আছে। এ সব জেনেও ডাকাত, যে কিনা কিছু দিন আগেই এই এলাকার আর একটি বাড়িতে চুরি করেছে, বাড়ির দরজার চাবি ভেঙে ভেতরে ঢুকবে? এটা খুবই আশ্চর্যের কথা নয় কি?”

 

“এমনও তো হতে পারে যে, লোকটা ঘাগি।”

 

“আর তা ছাড়া কেসটা বেশ গোলমেলে বলেই তো আপনার সাহায্য আমরা চাইছি। তবে,” মিঃ অ্যালেক বলে চললেন, “আপনি যে বললেন ডাকাত বাড়ির ভেতর ঢোকবার পর উইলিয়ম ঘটনাস্থলে এসে হাজির হয় তা কিন্তু একেবারেই অসম্ভব। তা যদি হত তা হলে হয় কোনও-না-কোনও জিনিস চুরি যেত, নয় জিনিসপত্র ওলটপালট হয়ে থাকত।”

 

“কোনও কিছু চুরি গেছে কিনা তা অবশ্য ধরা পড়বে কী ধরনের জিনিস চুরি গেছে তার ওপর। এ কথাটা ভুলবেন না যে, আমরা এমন একজন অপরাধীর খোঁজ করছি যার কাজকর্ম উদ্ভট। লোকটা হয়তো খুব খামখেয়ালি। অ্যাক্টনের বাড়ি থেকে সে কী জিনিস চুরি করেছে ভাবুন। চুরি করেছে এক বান্ডিল সুতো, একটা সাধারণ পেপারওয়েট আর এই রকমের সব বাজে জিনিস।”

 

মিঃ কানিংহাম বললেন, “আমরা তো আপনাদের হাতে সব দায়িত্ব যখন দিয়েছি তখন আপনি বা ইন্সপেক্টর যা করতে বলবেন আমরা তাই করব।”

 

হোমস বলল, “তা হলে আমি আপনাকে প্রথমেই বলব যে, আপনার দিক থেকে আপনি একটি পুরস্কার ঘোষণা করুন। সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কার ঘোষণা করাতে অনেক দেরি হবে। প্রথমত কত টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে সেটা ঠিক করতেই মাসখানেক লেগে যাবে। সরকারি দফতরে তাড়াতাড়ি কিছু করা যায় না। আমি একটা মুসাবিদা করেছি। আপনি যদি এটা পড়ে সই করে দেন তো কাজটা চটপট হয়ে যায়। আমি পঞ্চাশ পাউন্ড পুরস্কার দেওয়ার কথা লিখেছি।”

 

মিঃ কানিংহাম হোমসের হাত থেকে কাগজটা নিতে নিতে বললেন, “পঞ্চাশ পাউন্ড কেন পাঁচশো পাউন্ড দিতেও আমি রাজি আছি।”

 

তারপর কাগজটা পড়তে পড়তে তিনি হোমসকে বললেন, “কিন্তু আপনি এখানে যা লিখেছেন তা তো ঠিক নয়।”

 

হোমস বলল, “খুব তাড়াহুড়ো করে লিখতে হয়েছে কিনা…”

 

“এই দেখুন না, আপনি লিখেছেন, ‘গত মঙ্গলবার রাত্রে পৌনে এগারোটার সময় এক দুঃসাহসিক…।’ আসলে ব্যাপারটা হয়েছিল পৌনে বারোটার সময়।”

 

হোমসের কাণ্ড দেখে আমার মনখারাপ হয়ে গেল। আমি জানি এই ধরনের ভুলটুল হোমস মোটেই পছন্দ করে না। হোমসের চরিত্রের প্রধান বিশেষত্বই হল যে-কোনও অবস্থাতেই সে কখনও তথ্য-সংক্রান্ত কোনও ভুল করে না। তার এই সামান্য ভুল থেকে আমি বুঝতে পারলাম যে, হোমস এখনও মোটেই সুস্থ হয়নি। হোমস নিজেও খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। ইন্সপেক্টর ভুরু কুঁচকে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলেন আর মিস্টার অ্যালেক হোহো করে হেসে উঠলেন। মিঃ কানিংহাম কাগজটা ঠিক করে হোমসকে ফেরত দিয়ে দিলেন।

 

“এটা তাড়াতাড়ি ছাপিয়ে সব জায়গায় বিলি করার ব্যবস্থা করুন। খুব ভাল বুদ্ধি ঠাউরেছেন মিঃ হোমস,” মিঃ কানিংহাম বললেন।

 

হোমস মিঃ কানিংহামের কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে যত্ন করে মুড়ে তার ডায়েরির মধ্যে ভাল করে রেখে দিল। তারপর বলল, “এবার চলুন, আমরা সকলে মিলে সারা বাড়িটা ভাল করে খুঁজে দেখি যে, পাগলা ডাকাত কিছু নিয়ে পালাতে পেরেছে কিনা।”

 

বাড়ির ভেতরে যাবার আগে হোমস যে-দরজার চাবি ভাঙা হয়েছে সেটাকে খুব খুঁটিয়ে নিয়ে দেখে নিল। বোঝা যাচ্ছিল ছুরির শক্ত ফলা অথবা উকো ঢুকিয়ে দরজার চাবিটা ভাঙা হয়েছে। যেখান দিয়ে ফলা বা উকো চাড় দিয়ে ঢোকানো হয়েছে সেখানে কাঠের গায়ে ঘষা দাগ পড়েছে।

 

হোমস বলল, “আপনারা দরজায় খিল লাগান না দেখছি।”

 

“না, কখনও খিল লাগাবার প্রয়োজন হয়নি।”

 

“আপনারা কুকুর রাখেননি?”

 

“হ্যাঁ। তবে সেটা বাড়ির অন্য দিকে চেনে বাঁধা থাকে।”

 

“লোকজনেরা কখন শুতে যায়?”

 

“দশটা নাগাদ।”

 

“উইলিয়মও নিশ্চয়ই ওই সময়ে শুয়ে পড়ত?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“আশ্চর্য! কাল রাত্তিরেই উইলিয়ম অতক্ষণ জেগে ছিল। চলুন মিঃ কানিংহাম, এখন আমরা একবার সারা বাড়িটা ঘুরে দেখে নিই।”

 

পাথরের টাইল বসানো একটা প্যাসেজ। প্যাসেজের এক দিকে রান্নাঘর। প্যাসেজের আর-এক মাথায় একটা কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যাওয়া যায়। সিঁড়ির সামনে একটা ঢাকা চাতাল। চাতালের এক দিকে একটা কারুকার্য-করা এক ধাপের সিঁড়ি। তার পরেই বিশাল হলঘর। চাতালের আর এক পাশে সারি সারি ঘর। তারই একটা বসার ঘর। বাকিগুলো শোবার ঘর। এই ঘরগুলোর একটাতে থাকেন মিঃ কানিংহাম, আর-একটায় তাঁর ছেলে মিস্টার অ্যালেক। হোমস খুব আস্তে আস্তে হাঁটছিল। বাড়িটার প্ল্যানটা সে বুঝে নিচ্ছিল। হোমসের হাবভাব দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে, সে কোনও নতুন সূত্র পেয়ে গেছে। তবে অনেক মাথা ঘামিয়েও সূত্রটা যে কী তা বুঝতে পারলাম না।

 

মিঃ কানিংহাম একটু অধৈর্য হয়ে বললেন, “মিঃ হোমস, এটা একটু পণ্ডশ্রম হয়ে যাচ্ছে না কি? ওই যে ঘরটা দেখতে পাচ্ছেন, ওইটেই আমার ঘর। তার পরের ঘরটা আমার ছেলের। আপনি নিজেই বিবেচনা করে দেখুন না, এখানে যদি কেউ আসত তা হলে কি আমরা টের পেতাম না?”

 

মিস্টার অ্যালেক তামাশা করে বললেন, “আপনি কি আবার কেঁচেগণ্ডুষ করে নতুন কোনও সূত্রের সন্ধান করছেন?”

 

“ঠিকই বলেছেন আপনারা। তবে আমার অনুরোধ আপনারা আর খানিকক্ষণ আমার এই পাগলামি সহ্য করুন। যেমন ধরুন ঘরের জানলা দিয়ে সামনে কত দূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় সেটা জানা আমার বিশেষ দরকার। এই ঘরটা বোধহয় আপনার ছেলের?” হোমস হাত দিয়ে ঠেলে ঘরের দরজাটা খুলে ফেলল। “আর এই ঘরটা বসার ঘর বুঝি? এই ঘরে বসে উনি যখন পাইপ খাচ্ছিলেন তখনই গোলমাল শোনা গিয়েছিল, তাই না? আচ্ছা ওই ঘরের জানলা দিয়ে কী দেখা যায় দেখি তো,” বলেই হোমস শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে মশমশ করে বসার ঘরে চলে গেল। তারপর ঘরের ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল।

 

মিঃ কানিংহাম বিরক্ত হয়ে বললেন, “এখন আপনি নিশ্চিন্ত হয়েছেন তো?”

 

“ধন্যবাদ। আমার মনে হচ্ছে এখানে যা দেখবার ছিল দেখা হয়েছে।”

 

“তা হলে যদি দরকার মনে করেন তো আমার ঘরে যেতে পারি।”

 

“যদি অসুবিধে না হয় তো চলুন যাই—”

 

মিঃ কানিংহাম নাচার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন। তারপর আমাদের নিয়ে ওঁর ঘরে গেলেন। ঘরটা খুবই সাধারণ ভাবে সাজানো গোছানো। ঘরের যে-দিকে জানলা রয়েছে সকলেই সে দিকে চললেন। হোমস আস্তে আস্তে হাঁটছিল বলে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। আমি তার পাশেই ছিলাম। ঘরের মাঝখানে খাট। খাটের পাশে একটা ছোট চৌকো টেবিল। টেবিলের ওপর একটা কাচের জগে জল। জগের পাশে একটা ডিশে কয়েকটা কমলালেবু রাখা ছিল। সেখান দিয়ে যাবার সময় আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে, হোমস আমার সামনে এসে ঝুঁকে পড়ে ইচ্ছে করে সেই টেবিলটা উলটে ফেলে দিল। কাচের জগটা মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। জল পড়ল। কমলালেবুগুলো গড়াতে গড়াতে পাশে ছড়িয়ে পড়ল।

 

হোমস খুব শান্ত ভাবে বলল, “তোমার কাণ্ডটা কী হে ওয়াটসন? কী করলে বলো দেখি। কার্পেটটা একদম নষ্ট করে দিলে!” আমি লজ্জা পাওয়ার ভান করে নিচু হয়ে বসে কাচের টুকরোগুলো কুড়োতে লাগলাম। বুঝলাম কাণ্ডটা হোমস ইচ্ছে করেই করেছে। আর ইচ্ছে করেই সে দোষটা আমার ঘাড়ে চাপিয়েছে। আমার দেখাদেখি অন্যেরাও কাচ তুলতে লেগে গেল। টেবিলটা কে একজন সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল।

 

“আরে, আরে,” ইন্সপেক্টর হঠাৎ বলে উঠলেন, “মিঃ হোমস কোথায় গেলেন?”

 

হোমস উধাও!

 

অ্যালেক ক্যানিংহাম বললেন, “আপনারা এখানে দাঁড়ান। আমি দেখছি। ভদ্রলোকের মাথার গোলমাল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আসুন, আসুন, আমরা খুঁজে দেখি ভদ্রলোক গেলেন কোথায়!” আমি, ইন্সপেক্টর আর কর্নেল কিছু বলবার আগেই ওঁরা প্রায় বাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

 

ইন্সপেক্টর হতাশ ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “বিশ্বাস করুন, আমার মনে হচ্ছে যে, অ্যালেক কানিংহাম ভুল কথা বলেননি। হয়তো অসুখের জন্যে ওঁর মাথার গোলমাল হয়ে—”

 

ইন্সপেক্টরের মুখের কথা শেষ হবার আগেই একটা চিৎকার, “বাঁচাও, বাঁচাও, মেরে ফেলল,” আমাদের কানে এল। হোমসের গলা চিনতে আমার ভুল হল না। আমি পাগলের মতো ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। চিৎকারটা হঠাৎ থেমে গেল। শুধু একটা গোঁ গোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমার বুঝতে ভুল হল না যে, শব্দটা প্রথম যে-ঘরে গিয়েছিলাম সেখান থেকেই আসছে। আমি বসবার ঘরে গেলাম। শার্লক হোমস মাটিতে পড়ে রয়েছে। কানিংহাম আর তার ছেলে অ্যালেক হোমসের ওপর চেপে বসে আছে। অ্যালেক দু’হাতে সজোরে হোমসের গলা টিপে ধরেছে। আর তার বাবা হোমসের ডান হাতটা মুচড়ে দিচ্ছে। আমরা তিনজনে ওদের দু’জনকে ধরে হোমসকে ছাড়িয়ে নিলাম। হোমস আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তার চোখমুখ দেখে বুঝলাম যে, রোগা শরীরের ওপর এই অমানুষিক আক্রমণে বেচারা বেশ কাহিল হয়ে গেছে।

 

হোমস দম নিতে নিতে বলল, “ইন্সপেক্টর, এদের দু’জনকে গ্রেফতার করুন।”

 

“কোন অপরাধে গ্রেফতার করতে বলছেন?”

 

“উইলিয়মকে খুন করার অপরাধে।”

 

ইন্সপেক্টর তো হোমসের কথা শুনে হাঁ। বেশ খানিকক্ষণ পরে সুস্থ হয়ে বললেন, “মিঃ হোমস, আপনি নিশ্চয়ই তামাশা করছেন।”

 

হোমস বেশ রেগে উঠে বলল, “মোটেই ঠাট্টা করিনি। ওদের দিকে তাকিয়ে দেখুন।”

 

ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। তাঁরা যে দোষী কথাটা তাঁদের মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল। মিঃ কানিংহামের হতাশা, বিস্ময় আর গ্লানি ফুটে উঠেছিল। অ্যালেকেরও সেই ‘ডোন্টকেয়ার’ভাবটা নেই। উলটে তার দিকে তাকাতেই আমার বন্য জন্তুর কথা মনে পড়ে গেল। অ্যালেক কানিংহাম যেন মানুষ নয় ভয়াবহ একটা দানব। ইন্সপেক্টর কিছু না বলে পকেট থেকে একটা পুলিশের বাঁশি বের করে বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন কনস্টেবল ছুটে এল।

 

“মিঃ কানিংহাম, এই মুহূর্তে আপনাকে গ্রেফতার করা ছাড়া কোনও রাস্তা নেই। পরে হয়তো প্রমাণ হবে যে, কোথাও একটা বড় রকমের ভুল হয়েছে। না না, আপনি ও চেষ্টা করবেন না। ওটা ফেলে দিন,” বলেই ইন্সপেক্টর অ্যালেককে প্রচণ্ড জোরে ঘুসি মারলেন। অ্যালেকের হাত থেকে একটা রিভলভার ছিটকে পড়ল।

 

রিভলভারটা পা দিয়ে চেপে ধরে হোমস বলল, “এটা রেখে দিন। আদালতে মামলার শুনানির সময় প্রমাণ হিসেবে এটা দাখিল করবেন। তবে আমরা আসলে যে-জিনিসটা খুঁজছিলাম সেটা পেয়ে গেছি।” হোমস একটা দোমড়ানো কাগজ আমাদের দিকে মেলে ধরল।

 

ইন্সপেক্টর চেঁচিয়ে উঠলেন, “ছেড়া কাগজের বাকি অংশটা!”

 

“হ্যাঁ।”

 

“এটা কোথায় ছিল?”

 

“যেখানে এটাকে পাওয়া যাবে বলে জানতাম। যাই হোক, একটু পরে সব কথা বুঝিয়ে বলব। কর্নেল, আপনি আর ওয়াটসন বাড়ি ফিরে যান। আমি ঘণ্টাখানেক পরে ফিরব। আমি আর ইন্সপেক্টর এখন বন্দিদের সঙ্গে কথা বলব। তবে দুপরের খাবারের আগে অবশ্যই ফিরব।”

 

হোমস কথা রেখেছিল। বেলা একটার কিছু আগে সে ফিরে এল। তার সঙ্গে একজন বেঁটেখাটো বয়স্ক ভদ্রলোক। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে হোমস বলল, “ওয়াটসন, ইনিই মিঃ অ্যাক্টন। এঁর বাড়িতে অদ্ভুত চুরির মধ্যে দিয়ে এই রহস্যের শুরু। আমার মনে হয়েছিল তোমাদের কাছে যখন সব কথা খুলে বলব তখন এঁর হাজির থাকা দরকার। কেন না, এ বিষয়ে ওঁর কৌতূহলও নিশ্চয়ই কম নয়। তবে আমার ভয় হচ্ছে যে, আমাদের এখানে বেড়াতে আসতে বলে কর্নেল, আপনি বোধহয় বিপদে পড়ে গেলেন।”

 

কর্নেল ভীষণ রকম আপত্তি জানিয়ে বললেন, “মোটেই নয়। বরং খুব কাছে থেকে আপনার রহস্য সমাধানের কায়দা দেখার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনার সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম আপনি তার থেকে ঢের বড়। তবে স্বীকার করছি যে, আপনার সঙ্গে থেকে এবং সবকিছু দেখেও আমি কোনও সুতো তো দুরের কথা, আঁশও দেখতে পাইনি।”

 

হোমস বলল, “আমি যখন সব কথা বুঝিয়ে দেব, তখন আপনি খুবই হতাশ হবেন। কিন্তু আমার বন্ধু ওয়াটসনের কাছে, যার আমার কাজের সম্বন্ধে কিছু উৎসাহ আছে, তার কাছে আমার বিশ্লেষণের পদ্ধতি কখনও আমি গোপন করি না। কিন্তু সবচেয়ে আগে শরীরটা একটু চাঙ্গা করে নিতে হবে। সারা সকাল বড্ড ধকল গেছে।”

 

কর্নেল সঙ্গে সঙ্গে হোমসের জন্য গরম পানীয়র ব্যবস্থা করে দিলেন। তারপর বললেন, “আমরা চলে আসার পর আপনার কি আবার শরীর খারাপ হয়েছিল?”

 

হোমস হোহো করে হেসে উঠল, “সে কথায় পরে আসছি। আমি যে ভাবে ধাপে ধাপে কেসটার ফয়সালা করেছি আগে সেটা বলি। যদি বুঝতে কোথাও অসুবিধে হয় তো বলবেন।

 

“গোয়েন্দাগিরি করতে গেলে প্রথমে অদরকারি খবরগুলো বাদ দিয়ে দরকারি খবরগুলো বেছে নিতে হয়। তা না করতে পারলে মিছিমিছি বহু পরিশ্রম করতে হয়। অনেক বাজে জিনিসের পেছনে ছুটে সময় নষ্ট হয়। এখন উইলিয়মের মৃত্যুর তদন্ত করতে গিয়ে আমি গোড়াতেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, রহস্যের সূত্র আছে ওই ছেঁড়া কাগজের মধ্যেই।

 

“তার আগে আপনাদের একটা কথা একটু ভেবে দেখতে বলি। অ্যালেক কানিংহাম যদি সত্যি কথাই বলে থাকেন আর খুনি যদি গুলি ছুড়েই সেখান থেকে পালিয়ে থাকে তো কিছুতেই সে ওই কাগজখানা মৃত ব্যক্তির হাত থেকে নিয়ে পালাতে পারে না। সে যদি কাগজটা না নিয়ে থাকে তা হলে কাগজটা নিল কে? অ্যালেক কানিংহামের পক্ষেই নেওয়া সম্ভব। কেন না অ্যালেক ঘটনাস্থলে যাবার অল্প পরেই তার বাবা সেখানে গিয়ে হাজির হন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির চাকরবাকররা সেখানে গিয়েছিল। এই কথাটা বোঝা মোটেই শক্ত নয়। ও ব্যাপারটা অবশ্য পুলিশ ইন্সপেক্টরের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। তার কারণ হচ্ছে যে, কানিংহামদের মতো অবস্থাপন্ন নামডাকওয়ালা লোকেদের যে এই ধরনের কাজের সঙ্গে কোনও যোগ থাকতে পারে, তিনি ভাবতে পারেননি। কিন্তু আমার কাজের ধারা অন্য রকম। আমি সব সময়ে তথ্যের ওপর চলি। কে বড়লোক কে গরিব লোক, এ সব নিয়ে মাথা ঘামাই না। তাই অ্যালেক কানিংহামকে আমি গোড়া থেকেই একটু সন্দেহের চোখে দেখি।

 

“ইন্সপেক্টর যখন আমাকে কাগজের ছেঁড়া টুকরোটা দিলেন সেটা আমি খুঁটিয়ে দেখে এমন কিছু দেখতে পেয়েছিলাম যে, আমার মনে হয়েছিল, এটাই রহস্য সমাধানের সব চাইতে বড় সূত্র। এই সেই টুকরোটা। আপনারা দেখুন তো এই কাগজটার মধ্যে সন্দেহজনক কিছু দেখতে পান কিনা।”

 

“কাগজটা কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে,”—কর্নেল বললেন।

 

“যদি একটু নজর করে দেখেন তো দেখতে পাবেন কাগজটায় দু’জন লোকের হাতের লেখা রয়েছে। প্রত্যেকে একটা করে শব্দ লিখেছে। আচ্ছা ‘at’ আর ‘to’-এর ‘t’টা ভাল করে দেখুন। আর ‘quarter’ আর twelve’-এর ‘t’-এর সঙ্গে মিলিয়ে নিন। তা হলেই তফাতটা নজরে পড়বে। এক জনের হাতের লেখা গোটা গোটা বলিষ্ঠ। আর এক জনের লেখা একটু জড়ানো। যদি লক্ষ করেন, দেখবেন ‘learn’ আর ‘maybe’ যে লিখেছে তার লেখার ধাঁচটা বেশ শক্তপোক্ত। কিন্তু what যে লিখেছে তার হাতের লেখাটা কেমন কাঁপা কাঁপা।”

 

“তাই তো। এ তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। কিন্তু দু’জন লোক কেন এমনি করে চিঠি লিখল,” কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন।

 

“ব্যাপারটা খুবই নোংরা। মনে হয় এদের এক জন আর-এক জনকে বিশ্বাস করে না। তাই এই ভাবে চিঠি লিখেছে। পরে কোনও কারণে কোনও গোলমাল হলে যাতে অন্য জন বলতে না পারে যে, সে কিছুই জানত না তাই এই রকম করা হয়েছিল। যে লোকটা ‘at’ আর ‘to’ লিখেছে সেই যে সবকিছুর মূলে আছে এতে কোনও সন্দেহ নেই।”

 

কর্নেল বললেন, “এটা কী করে অনুমান করলেন?”

 

“এটা দু’জনের লেখার ছাঁদ মিলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারা যায়। তবে সেটা ছাড়াও অন্য প্রমাণ আছে। কাগজটা যদি ভাল করে লক্ষ করা যায় তা হলে দেখা যাবে যে, যার লেখার ছাঁদ গোটা গোটা ও বলিষ্ঠ সেই লোকটি তার ভাগের শব্দগুলো প্রথমে লিখেছিল। দ্বিতীয় লোকটির জন্যে সে ফাঁক রেখে দিয়েছিল। কিন্তু সব জায়গায় সমান ফাঁক রাখতে পারেনি। তাই দ্বিতীয় লোকটিকে at আর to এর মধ্যে quarter শব্দটা জোর করে ঢুকিয়ে দিতে হয়েছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, প্রথম যে-লোকটি লিখেছে সেই হচ্ছে পাণ্ডা।”

 

মিঃ অ্যাক্টন বললেন, “চমৎকার চমৎকার।”

 

হোমস বলল, “না না, খুবই সাধারণ ব্যাপার। তবে এবার যে কথাটা বলব সেটা কিন্তু খুবই দরকারি কথা। আপনারা জানেন কিনা জানি না, হাতের লেখা পরীক্ষা করে লেখকের বয়স বলে দেওয়া যায়। যদি সুস্থ স্বাভাবিক লোকের হাতের লেখা পরীক্ষা করতে দেওয়া হয় তা হলে তার মোটামুটি নির্ভুল বয়স বলা সম্ভব। হয়তো এক-আধ বছরের এদিক-ওদিক হবে। তবে যদি দুর্বল বা অসুস্থ লোকের হাতের লেখা হয় তবে সঠিক বয়স অনুমান করা সম্ভব না-ও হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি যে, যার লেখা স্পষ্ট গোটা গোটা তার বয়স কম। আর জড়ানো হাতের অক্ষরগুলো কোনও প্রবীণ লোকের লেখা।”

 

মিঃ অ্যাক্ট বললেন, “দারুণ। দারুণ।”

 

“এ ছাড়া আরও একটা পয়েন্ট আছে। দুটো লেখার মধ্যেই কতকগুলো হরফের ছাঁদে বেশ মিল আছে। ‘e’ অক্ষরটা একটু গ্রিক এপসিলোনের ধরনের। এ ধরনের মিল সাধারণত বংশানুক্রমিক হয়। সুতরাং দুই লেখকের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক থাকা অসম্ভব নয়। আমি এই কাগজটা পরীক্ষা করে মোট তেইশটা সিদ্ধান্ত করতে পেরেছি। তার মধ্যে গোটাচারেক সিদ্ধান্তের কথা আপনাদের বললাম। তবে সব সিদ্ধান্ত থেকে আর-একটা সিদ্ধান্ত টানা গেলে বলা যায়, কানিংহামরাই এই চিঠি লিখেছে।

 

“এরপর আমার কাজ হল, যেখানে খুন হয়েছে সেখানে গিয়ে দেখা নতুন কোনও তথ্য পাওয়া যায় কিনা। ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে নিয়ে আমি তো ওদের বাড়িতে গেলাম। যা দেখবার দেখলাম। মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখলাম যে, অন্তত চার গজ দূর থেকে রিভলভার ছোড়া হয়েছিল। জামাকাপড়ে বারুদের পোড়া দাগ নেই। তা হলে অ্যালেক যে কথা বলেছে যে, দু’জন লোক ধস্তাধস্তি করছিল এমন সময় একজন আর-একজনকে গুলি করে, তা একদম মিছে কথা। তা ছাড়া মিঃ কানিংহাম ও তাঁর ছেলে দু’জনেই ঠিক কোনখান দিয়ে খুনি পালিয়ে ছিল তা ইন্সপেক্টরকে দেখিয়ে দিয়েছেন। সেই জায়গায় গিয়ে দেখলাম যে, একটা বেশ বড় গর্ত রয়েছে। গর্তের মাটি ভিজে। সেখানে কোনও জুতোর ছাপ নেই। তা হলে এ ব্যাপারেও ওঁরা মিছে কথা বলেছেন। সুতরাং যে-লোকটির কথা বলা হচ্ছে সে লোকটি ওঁদেরই মনগড়া।

 

“এ পর্যন্ত সব ঠিকই আছে। ধরে নিলাম ওঁরাই উইলিয়মকে খুন করেছেন। কিন্তু কেন খুন করলেন? কী জন্যে খুন করলেন? এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আমি মিঃ অ্যাক্টনের বাড়ির চুরির কথাটা ভাবতে লাগলাম। আর তখনই মনে পড়ল যে, মিঃ অ্যাক্টনের সঙ্গে ওঁদের একটা মামলা চলছে। তখনই আমার মনে হল যে, ওঁরা হয়তো আপনার লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন এমন কোনও দলিল বা নথি চুরি করতে যেটা পেলে সমস্ত মকদ্দমাটা কেঁচে যাবে।”

 

মিঃ অ্যাক্টন বললেন, “আপনি ঠিকই ধরেছেন। ওদের সম্পত্তির বেশির ভাগ অংশের মালিকানা আমার ওপর বর্তাবে। এই মকদ্দমার একটা কাগজ ওরা সরাতে পারলে গোটা মামলাটাই ফেঁসে যেত। তবে সেই কাগজখানা আমি আগে থেকে সিন্দুকে সরিয়ে রেখে ছিলাম।”

 

হোমস বলল, “তাই বলুন। সেই কাগজটার জন্যেই এত বড় বিপদের ঝুঁকি ওঁরা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর এই কাজ করতে অ্যালেকই, আমার ধারণা, ওর বাবাকে জোরজুলুম করে রাজি করিয়েছিল। সেই কাগজটা না পেয়ে ওঁরা লোককে ভুল পথে চালাবার জন্যে ওই সব অদরকারি জিনিস নিয়ে চলে আসেন। এ পর্যন্ত কোথাও কোনও গোলমাল নেই। কিন্তু দু’-একটা প্রশ্নের উত্তর মিলছিল না। প্রথম প্রশ্ন হল, বাকি কাগজটা গেল কোথায়? অ্যালেকই যে কাগজটা সরিয়েছে সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ ছিল না। আমার ধারণা অ্যালেক উইলিয়মের মুঠো থেকে কাগজটা নিয়ে তার ড্রেসিং গাউনের পকেটে পুরেছিল। এ ছাড়া সেই সময়ে আর কোথায়ই বা সে কাগজটা রাখতে পারত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এখন সেই কাগজটা কোথায়? ওটা কি ড্রেসিং গাউনের পকেটেই আছে? আমার প্রথম কাজ হল কাগজটা উদ্ধার করা। আর সেটা করতে হলে আমাকে প্রথমে বাড়ির ভেতরে যেতে হবে।

 

“আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়, রান্নাঘরের দরজার কাছে কানিংহামদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। আমার প্রথম লক্ষ্য হল যে ওরা যেন কোনওমতেই কাগজটার কথা টের না পায়। ইন্সপেক্টর কথাটা ফাঁস করে ফেলছিলেন। সেই সময়ে আমি এমন একটা কাণ্ড বাধালাম যে, কথার মোড় অন্য দিকে ঘুরে গেল।”

 

কর্নেল হেসে উঠে বললেন, “আপনার অসুখটা তা হলে সত্যি নয়? ওটা অসুখের অভিনয়? হায় হায়, আমাদের এত উদ্‌বেগ মাঠে মারা গেল।”

 

আমি বললাম, “অভিনয় হিসেবে দেখলে ওটা কিন্তু খুবই উঁচুদরের অভিনয় বলে মানতে হবে। হোমস আমাকে প্রতি বারই অবাক করে দেয়।”

 

হোমস বলল, “হ্যাঁ, অভিনয় করার ক্ষমতাটা মাঝে মাঝে খুব কাজে লেগে যায়। সুস্থ হয়ে উঠে আমি আর-একটা চালাকি করলাম। কায়দা করে মিঃ কানিংহামকে দিয়ে ‘twelve’টা লিখিয়ে নিলাম। ভুলটা আমি ইচ্ছে করেই করেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল আসল কাগজটার ‘twelve’-এর সঙ্গে এই ‘twelve’টা মিলিয়ে নেওয়া।”

 

আমি বললাম, “আমি একটি আস্ত গাধা।”

 

হোমস হেসে বলল, “আমার ভুল দেখে তুমি যে মনে মনে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছ তাতে আমারও কষ্ট হয়েছিল। যাই হোক, আমরা তো ওপরতলায় গেলাম। অ্যালেকের ঘরে দরজার পিছনে ড্রেসিং গাউনটা ঝুলতে দেখেছিলাম। তাই মিঃ কানিংহামের ঘরে টেবিল উলটে একটা গোলমাল বাধিয়ে আমি চুপিসারে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। তারপর যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। ড্রেসিং গাউনের পকেটে কাগজটা পেয়ে গেলাম। আর ঠিক তখনই ওরা দু’জন এসে আমাকে পাকড়ে ফেলল। অ্যালেক আমার গলা টিপতে লাগল আর মিঃ কানিংহাম আমার হাতে মোচড় দিতে লাগলেন যাতে আমি কাগজটা ফেলে দিই। ওহ্‌, গলাটা এখনও টাটিয়ে রয়েছে। সেই সময়ে আপনারা হাজির হলেন। তখন ওরা বুঝতে পারল যে খেল খতম। আর তাতেই ওদের হাবভাব সব পালটে গেল।

 

“পরে মিঃ কানিংহামের সঙ্গে খুনের উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলি। ওঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। কিন্তু অ্যালেকের সঙ্গে কথা বলা যায় না। সে তো খ্যাপা কুকুরের মতো হয়ে আছে। হাতের কাছে যাকে পাবে তাকেই শেষ করে দেবে। যখন মিঃ কানিংহাম দেখলেন যে ওঁদের বাঁচবার আর কোনও রাস্তা নেই তখন তিনি সব কথা স্বীকার করলেন। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, উইলিয়ম সেই রাত্রে ওঁদের কাজকর্ম সব দেখে ফেলে এবং পরে ওঁদের ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করে। কিন্তু উইলিয়ম বুঝতে পারেনি যে মিঃ অ্যালেক অত্যন্ত সাঙ্ঘাতিক প্রকৃতির লোক। চুরির ব্যাপারটাকে এ ভাবে ব্যবহার করা থেকে বোঝা যায় যে, ছোকরা কী পরিমাণ বুদ্ধিমান। উইলিয়মকে ভুলিয়ে ডেকে এনে খুন করে। যদি ওরা পুরো কাগজটা ছিনিয়ে নিতে পারত, আর পালাবার রাস্তাটা সম্বন্ধে আগে থেকে ভেবে রাখতে পারত, তা হলে ওদের ওপর সন্দেহ হত এবং ওরা ধরাও পড়ত না।”

 

আমি বললাম, “গোটা কাগজটায় কী লেখা ছিল?”

 

হোমস জোড়া দেওয়া কাগজটা আমাদের দিকে এগিয়ে দিল।

 

“জানতাম, এই রকমই কিছু লেখা থাকবে। তবে অ্যালেক কানিংহাম, উইলিয়ম কিরান আর অ্যানি মরিসনের সঙ্গে কী ধরনের যোগাযোগ ছিল তা আমি জানতে পারিনি। তবে উইলিয়মের জন্যে ভাল ফাঁদই পাতা হয়েছিল। কাগজটা পরীক্ষা করলে ‘p’ আর ‘g’ গুলোর মধ্যে এক ধরনের বংশানুক্রমিক মিল লক্ষ করবেন। আর-একটা জিনিস, মিঃ কানিংহাম ‘i’-এর মাথায় ফোঁটা দেন না।…যাকগে ওয়াটসন, এখানে এসে শরীর আর মনের ভাল রকম হাওয়া বদল হয়েছে বলতে হবে। কাল আমরা বেকার স্ট্রিটে ফিরে যাব।”

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments