মেলাবেন তিনি মেলাবেন (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত
(প্রমথর মতে এটা গোয়েন্দা গল্প নয়, প্রেমকাহিনিও নয়– জগাখিচুরি। অবশ্য প্রমথর অ্যাপ্রুভাল নিয়ে কিছু ছাপতে হলে, আমি একটা গল্পও ছাপতে পারতাম না। তবু খাঁটি রহস্য-সন্ধানী পাঠকদের আগেভাগেই সতর্ক করছি।)
(১)
একেনবাবু অ্যালাস্কা ক্রুজে যাবার তিনটে টিকিট পেয়েছেন। পারফেক্ট টাইমিং, ফল সেমিষ্টার শুরু হবার একটু আগে। কী করে টিকিটগুলো পেয়েছেন সে নিয়ে বেশি আলোচনা না করাই ভালো। এটা হল ওঁর একটি আন-অফিসিয়াল কর্মের পুরস্কার। আন অফিসিয়াল, কারণ নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ক্রিমিনোলজি ডিপার্টমেন্টের ফেলোশিপের শর্ত অনুসারে ওঁর বাইরের কোনো কাজ করার অনুমতি নেই। কিন্তু একেনবাবুর সুনাম নিউ ইয়র্কের পুলিশমহলে ও নানান প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে বেশ ভালোই ছড়িয়েছে। না চাইলেও এদিক-ওদিক থেকে বছরে কয়েকবার ওঁর ডাক পড়ে। উনি অবশ্য বিনা পারিশ্রমিকেই কাজগুলি করেন। করেন স্রেফ নিজের মগজ খেলানোর তাগিদে।
প্রমথ এই নিয়ে প্রায়ই খোঁচায়। “এইসব ফালতু সার্ভিস না দিয়ে ঘরদোরগুলো তো একটু পরিষ্কার করতে পারেন। আপনার নিজের বেডরুমের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, ওটা তো একটা আস্তাকুঁড়। কিন্তু বাইরের ঘর আর রান্নাঘরটাও তো গোবর বানিয়ে রেখেছেন।”
“আসলে স্যার আমি একটু অগোছালো।” একটু মাথা চুলকে এটাই হল একেনবাবুর স্ট্যান্ডার্ড উত্তর।
“ওসব হেঁদো এক্সকিউজ আপনি বাপিকে (অর্থাৎ আমাকে) দেবেন। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়।”
ঠিক এই সময়ে একেনবাবু তাঁর মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়েন। “ঠিক আছে স্যার, আপনারা বসুন, আমি কফি বানাই।”
“থাক, ওটি করে আর কফিতে অরুচি ধরাবেন না। “ বলে প্রমথ রান্নাঘরে যায়।
এই ব্যাপারটার পুনরাবৃত্তি মাসে অন্ততঃ একবার করে হয়। এইবারও যখন হচ্ছিল, তখন একেনবাবু হাসি হাসি মুখে প্রমথর হাতে টিকিটগুলো ধরিয়ে দিলেন।
“এটা আবার কি?”
“অ্যালাস্কা ক্রুজের টিকিট স্যার।”
প্রমথ ভুরু কুঁচকে একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোত্থেকে পেলেন?”
“এই পেলাম স্যার। আপনি একদিন ক্রুজে যাবার কথা বলেছিলেন, তাই ভাবলাম।”
একেনবাবু ওঁর বক্তব্য শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই প্রমথ বলল, “নিজের গাঁটের পয়সা নিশ্চয় খরচা করেননি। করেছেন বললে, এক্ষুনি আপনাকে বেলভিউয়ে (নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত মেন্টাল হসপিট্যাল) পাঠানোর বন্দোবস্ত করব।”
“কী যে বলেন স্যার, পয়সার কথা আসছে কোত্থেকে, এটা একেবারেই কমপ্লিমেন্টারি।”
প্রমথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, “চুপ কর, হু কেয়ার্স ফর দোজ ডিটেইলস। টিকিট পেয়েছিস, চল।”
অ্যালাস্কা ক্রুজের এক একটা টিকিটের দাম হাজার ডলারের বেশি। বোঝাই যায় ভালোবেসে কেউ এই তিনটে টিকিট একেনবাবুকে দান করেননি। কিন্তু সে নিয়ে আমার আর প্রমথের মাথাব্যথা কেন হবে! প্রমথ অনেক দিন ধরেই অ্যালাস্কা ক্রুজের কথা বলছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিন-এর ফলে ওখানকার গ্লেশিয়ারগুলো গলতে শুরু করেছে। বছর কুড়ি বাদে হিমবাহের কিছুই নাকি আর অবশিষ্ট থাকবে না! শেষের কথাটা অবশ্য প্রমথর নিজস্ব অভিমত। তবে বরফগুলো যে দ্রুত গতিতে জল হয়ে যাচ্ছে, সেটা তো পত্রপত্রিকায় সবসময়েই পড়ছি। আমার নিজেরও অ্যালাস্কা যাবার ইচ্ছে অনেকদিন ধরেই ছিল। বইয়ে অ্যালাস্কা সম্পর্কে এত পড়েছি। ওখানকার ন্যাচারাল বিউটি নাকি একেবারে ভার্জিন কন্ডিশনে আছে, সভ্যতায় কলুষিত হয়নি। দেখলে ভুলতে পারা যায় না!
আমাদের টিকিট হল প্রিন্সেস ক্রুজ লাইনের। যে জাহাজে আমরা উঠব, সেটার নাম আইল্যান্ড প্রিন্সেস। ক্রুজ শিপ ছাড়বে ক্যানাডার পশ্চিমপ্রান্তে ভ্যানকুভার শহর থেকে। থামবে মোট চার জায়গায়– কেচিকান, স্ক্যাগওয়ে, জুনো আর উইটিয়ার। তারপর
উইটিয়ার থেকে বাসে চড়ে অ্যাঙ্কারেজ এয়ারপোর্ট। প্লেনে ব্যাক টু নিউইয়র্ক মোট পাঁচ দিন। হুইটিয়ার ছাড়া বাকি জায়গাগুলোতে ট্যুর-এর বন্দোবস্ত আছে, কিন্তু তার দামের বহর দেখে একেনবাবু আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জাহাজে বসে থাকবেন।
প্রমথ ধমক লাগিয়েছে, “আপনি তো আচ্ছা নোক মশাই, এতদূর গিয়ে বেড়াবেন না? তাহলে যাচ্ছেন কেন?”
কিন্তু একেনবাবু অনড়। তখন ঠিক হল, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে। পোর্টে নেমে দেখব সস্তায় কোথাও যাওয়া যায় কিনা। তেমন হলে আমি আর প্রমথ ঘুরে আসব, একেনবাবু না হয় জাহাজেই থাকবেন।
