স্পোকেন ইংলিশ মার্ডার মিস্ট্রি (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত
এক
ডিসেম্বর মাস শেষ হবার মুখে। অন্যান্য বছরের তুলনায় কলকাতায় শীত নাকি একটু বেশি পড়েছে। রাস্তায় দেখছি শাল সোয়েটার কোট আর মাফলারের ছড়াছড়ি। কান-ঢাকা মাঙ্কি ক্যাপও চোখে পড়ছে, বিশেষ করে ভোরবেলায় আর সন্ধ্যার পরে। আমার শীত তেমন লাগছে না, বোধহয় নিউ ইয়র্কে ঠান্ডায় অভ্যস্ত বলে। গেঞ্জির ওপর ফুল হাতার সার্ট পরেই ঘোরাঘুরি করছি। এই বাহাদুরির ফলে না শ্রেফ পলুশনের জন্যে খুক-খুকে একটা কাশি হয়েছে যা কিছুতেই যাচ্ছে না! প্রমথর দেখছি কিছুই হয়নি, হালকা একটা সোয়েট সার্ট চাপিয়ে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে!
ওই যাঃ, যেটা বলতে ভুলে গেছি –এবার আমি, প্রমথ আর একেনবাবু সবাই একসঙ্গে কলকাতায় এসেছি। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে এই সময় চার সপ্তাহের ছুটি। একেনবাবু অবশ্য আমার বা প্রমথর মতো নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়ান না। ক্রিমিনোলজি নিয়ে হাবিজাবি কী রিসার্চ করছেন জানি না, কিন্তু সাইডে গোয়েন্দাগিরি করে টু-পাইস কামাচ্ছেন। একেনবাবু ইচ্ছে করলে কলকাতায় বেশিদিন থাকতে পারতেন, কিন্তু থাকছেন না। প্রমথ জিজ্ঞেস করেছিল, এত তাড়াতাড়ি ফিরছেন কেন? বউদির সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে তারপর আসুন! ঘোড়ার ডিম রিসার্চ যা করেন তা তো কলকাতায় বসেও করতে পারেন! ওঁর উত্তর, “কী যে বলেন স্যার, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন! তাছাড়া ফ্যামিলি তো নেক্সট ইয়ারে আসছেই।
‘ফ্যামিলি’ মানে একেনবউদি। তবে একেনবাবুর নেক্সট ইয়ারের ডেফিনেশনটা আমি আর প্রমথ এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। গত তিন বছর ধরে উনি এই ‘নেক্সট ইয়ার’ কথাটা বলে আসছেন। এবার এসে বুঝতে পারছি সমস্যাটা একেনবউদির দিক থেকে। নিউ ইয়র্কে গিয়ে থাকতে উনি রাজি নন। উলটে একেনবাবুকে চাপ দিচ্ছেন ওখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতায় ফিরে আসার। একদিন তো আমাদের সামনে বলেই ফেললেন, “ব্যোমকেশবাবু ফেলুদারা যদি কলকাতায় ডিটেকটিভগিরি করে সংসার চালাতে পারেন, তাহলে উনিই বা পারবেন না কেন!”
একেনবাবু আমাদের সাক্ষী মানলেন, “শুনছেন স্যার ফ্যামিলির কথা, কাদের সঙ্গে কার তুলনা! ওঁরা হলেন লেজেন্ডারি ফিগার। ওঁদের ব্রেন-ক্যাপাসিটির দশ পার্সেন্টও যদি আমার থাকত গর্ব বোধ করতুম!”
স্বামী-স্ত্রীর এইসব কথাবার্তার মধ্যে নাক না গলানোই ভালো। আমি চুপ করে ছিলাম। কিন্তু প্রমথকে চুপ করায় কার সাধ্যি! একেনবাবুকে বলল, “নিজেকে এত ছোটো ভাবছেন কেন, নাই-বা হল দশ পার্সেন্ট, সাত-আট পার্সেন্ট তো আছে।”
এই কথাতে যে বউদিকেও কষ্ট দেওয়া হল, সে বোধটাও ব্যাটার নেই! পরে বোধহয় বুঝল। একেনবউদিকে বলল, “ঠাট্টা করছিলাম বউদি, ম্যানহাটনে একেনবাবুর খুব নামডাক হয়েছে। দশ পার্সেন্টটা ওঁর বিনয়। কিন্তু সামনে বেশি প্রশংসা করতে চাই না, ল্যাজ মোটা হয়ে যাবে।”
ওই এক কথাতেই কাজ, আরেক প্রস্থ চা চলে এল।
.
কলকাতায় এসে আমরা তিন জায়গায় থাকলেও আড্ডাটা বেশ ভালোই চলছে। বিকেলে প্রায়ই একেনবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। একেনবউদির বানানো লুচি, আলুর দম, ঘুঘনি, পেঁয়াজি –নিত্যনতুন নানান স্ন্যাকস আর বেশ কয়েক কাপ চা খেয়ে কলকাতার প্রত্যেকটি সমস্যারই সহজ সমাধান আবিষ্কার করে ফেলি। মুশকিল হল, সেগুলো শোনানোর মতো তেমন লোক পাই না। একেনবাবুর এক পরিচিত, নাম মনোজ রায়, তিনি একদিন গল্প করতে এসেছিলেন। ভদ্রলোক আমাদের থেকে বয়সে একটু বড়োই হবেন, কলকাতা কর্পোরেশনে কাজ করেন। সেটা জানতে পেরে মনোজবাবুকে কলকাতার জঞ্জাল পরিষ্কার করার একটা স্কিম বললাম। আমার নিজের বানানো নয়, ব্রেজিলের কুরিচিবা শহরে এটা চালু করা হয়েছিল। ওখানেও জঞ্জাল পরিষ্কার করার লোকেরা ছিল ফাঁকিবাজ। তাদের দিয়ে হবে না বুঝে মেয়র বড়ো বড়ো প্লাস্টিক-ব্যাগ গরিবদের বিলি করলেন। যারা জঞ্জাল-ভর্তি ব্যাগ পিক-আপ সেন্টারে জমা দেবে, তারা এক দিনের খাবার আর পয়সা দুই-ই পাবে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই কুরিচিবা শহর পরিচ্ছন্ন হয়ে গেল!
মনোজবাবু দেখলাম সব কিছুতেই খুব নেগেটিভ। আমার কথা শেষ হতে না হতেই বললেন, “ওসব এদেশে চলবে না। পয়সা খরচা হবে ঠিকই কিন্তু জঞ্জাল পরিস্কার হবে না।”
“কেন?”
“সুপারভাইসার বিলি করবে একশোটা ব্যাগ, বলবে হাজার। বাকি নয়শোটা ব্যাগ দোকানে বেচবে। হাজার ব্যাগ জঞ্জাল জমা পড়েছে বলে খরচার হিসেব দেবে, যদিও জমা পড়বে মেরে কেটে একশো। বাকি টাকাটা কার পকেটে যাবে গেস করুন?”
“সেটা কি করে হয়, সুপারভাইজারদেরও তো সুপারভাইজার আছে!”
“ক্ষেপেছেন, অফিসাররা কি নোংরা ব্যাগ গুনতে যাবেন? আর অফিসাররাও তো ধোয়া তুলসীপাতা নন, কাট তো সবারই থাকে!”
এসব ব্যাপারে আমাদের দেশের লোকদের মাথা অতি পরিষ্কার সন্দেহ নেই। আমেরিকায় আট বছর কাটিয়ে আমিই ভোঁতা হয়ে গেছি!
“কিচ্ছু হবে না মশাই এদেশে। টপ-টু-বটম করাপশন, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে! আগে শুধু পুলিশ আর ট্যাক্সের লোকেদের ঘুষ দিতে হত, এখন ঘুষ-সংস্কৃতি শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে পাড়ার ক্লাব পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ব্লিক ফিউচার মশাই, অতি ক্লিক ফিউচার। আমেরিকায় আছেন ভালো আছেন, এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।”
মনোজবাবু এত উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললেন যে আমি আর উচ্চবাচ্য করলাম না। প্রমথ শুধু ফাজলামি করে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার, আপনি এত চুপচাপ বসে অপমানটা হজম করছেন?”
“কী অপমান স্যার?”
“এই যে উনি বললেন পুলিশরা ঘুষখোর, আপনিও তো এখানকার পুলিশে ছিলেন?”
মনোজবাবু এবার লজ্জিত হলেন। “আরে না, না, একেনবাবু একজন এক্সেপশন। ওঁর মতো লোক এখনও কয়েকজন আছেন বলে দেশটা উচ্ছন্নে যায়নি।” তারপর একেনবাবুকে বললেন, “যাই বলুন, আপনার অ্যাবসেন্স এবার আমরা খুব মিস করেছি।”
“কেন স্যার?”
“আমার ডিপার্টমেন্টে কাজ করত একটি ছেলে, তার পিসতুতো বোন ছ’মাস আগে খুন হল। ব্রুটালি মার্ডারড। কল সেন্টারে কাজ করত মেয়েটা, বিধবা মা’র একমাত্র সন্তান। ওর টাকাতেই সংসার চলত। এতদিন হয়ে গেল পুলিশ কোনো কিনারাই করতে পারল না!”
“সে কি স্যার!”
“আর এটা তো শুধু একটা কেসের কথা। তারও মাস তিনেক আগে আরেকটা মেয়ে খুন হল প্রায় একইভাবে। ট্র্যাভেল এজেন্সিতে কাজ করত। একা থাকত গোলপার্কের কাছে। সেটাতেও কেউ ধরা পড়েনি। কী ভয়ানক ব্যাপার বলুন তো! এই যে চাকরির জন্যে এত মেয়ে কলকাতায় একা থাকে, তাদের মানসিক অবস্থাটা চিন্তা করুন? কোনো নিরাপত্তা যদি পুলিশ না দিতে পারে, তাহলে চলে কী করে!”
আমরা সবাই একেনবাবুর দিকে তাকালাম। বেচারা একেনবাবু, কলকাতা পুলিশের এই অকর্মণ্যতার দায় যেন ওঁর!
“পুলিশ কি হাল ছেড়ে বসে আছে, না এখনও ইনভেস্টিগেট করছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম মনোজবাবুকে।
“কে জানে! আমাদের দেশের পত্রিকাগুলোও তো সেরকম। প্রথম ক’দিন একেবারে প্রথম পাতার খবর, সেই নিয়ে চর্বিতচর্বণ। তারপর অন্য কিছু এলেই আগেরটা আউট অফ ফোকাস। ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেলগুলোও তাই। কেউ ধরা পড়লে হয়তো শুনতে পাওয়া যেত। এনিওয়ে একেনবাবু যখন এসেছেন, আমি শুভেন্দুকে বলব এসে দেখা করতে।”
“শুভেন্দু কে স্যার?”
“ওই যে-ছেলেটা আমার ডিপার্টমেন্টে ছিল, যার বোন খুন হয়েছে। মেয়েটার মা একেবারে ডিভাস্টেটেড। খালি নাকি কাঁদেন আর বলেন আমার ফুলের মতো মেয়েটাকে যে মারল, সে এখনও পাড়ায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে –আর আমায় তা শুনতে হচ্ছে!”
“তার মানে? মহিলা কি কাউকে সাসপেক্ট করেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“নিশ্চয় করেন। কিন্তু এখানে তো অনেক পার্টির ব্যাপার আছে। রুলিং পার্টির লোক হলে ফরগেট ইট!”
বুঝলাম ভদ্রলোক দেশকে নিয়ে একেবারে তিতিবিরক্ত, কোনো ভালো ওঁর চোখে পড়ে! এমন কি বউদির চমৎকার চা খেয়েও মন্তব্য করলেন, “বুঝলেন, আজকাল ভালো চা-ও পাওয়া যায় না এদেশে, সব এক্সপোর্ট হচ্ছে।”
মনোজবাবু চলে যাবার পর আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভদ্রলোক কর্পোরেশনে করেন-টা কি, মনে তো হচ্ছে অপজিশন পার্টির লোক!”
“ঠিক জানি না স্যার, তবে খুব রিসোর্সফুল। একবার মিউটেশনের ব্যাপারে খুব সাহায্য করেছিলেন।”
“আপনার সঙ্গে ওঁর পরিচয় হল কী করে?”
“সে এক কাহিনি স্যার। ওঁর দাদা মৃত্যুঞ্জয়বাবুর একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে একবার ডাকাতি হয়েছিল।..”
“রেস্টুরেন্টে ডাকাতি! গয়নার দোকানে হয় শুনি।” কথার মাঝখানেই প্রমথ ফোড়ন কাটল।
“ব্যাপারটা স্যার একটু স্ট্রেঞ্জ ঠিকই। দু’জন ড্রাগ ডিলার রেস্টুরেন্টে বসে টাকার লেনদেন করছিল। ডাকাতরা ঢুকেছিল সেই টাকা লুট করতে। গোলাগুলি চলে। শেষে অবশ্য সবাই ধরা পড়ে। মধ্যে থেকে গুলি লেগে মৃত্যুঞ্জয়বাবু জখম হন। সেটা বার করতে হাসপাতালে সার্জারি করতে হয়! যাচ্ছেতাই ব্যাপার স্যার! মৃত্যুঞ্জয়বাবু খুব ভয় পাচ্ছিলেন এই নিয়ে পুলিশ বোধ হয় ওঁকে হ্যারাস করবে। উনি স্যার নির্দোষ, হ্যারাস করার প্রশ্ন উঠছে কেন? আমি ওঁকে ভরসা দিয়ে বলেছিলাম কেউ ঝামেলা করার চেষ্টা করলে আমায় খবর দিতে। সেই সময় মনোজবাবুকে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়বাবু কয়েকবার আমার কাছে এসেছিলেন।”
“কতদিন আগের ব্যাপার এটা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“তা স্যার প্রায় বছর ছয়েক হল। আপনারা হয়তো ওঁর দাদার রেস্টুরেন্টটা দেখেও থাকবেন। মেনকা সিনেমা থেকে হাঁটা পথ, মিলনী কাফে।”
“দেখে থাকব মানে!” প্রমথ একটু উত্তেজিত হয়েই বলল, “কতবার ওখানে খেয়েছি! কিরে বাপি, তুইও তো খেয়েছিস?”
“বহুবার খেয়েছি,” আমি বললাম। “দারুণ মোগলাই করে! মালিকের নামটা জানতাম না, খুব গপ্পে লোক। হ্যাঁ ঠিকই, মনোজবাবুর সঙ্গে খানিকটা মিল আছে।”
“এক কাজ করুন না,” প্রমথ প্রস্তাব দিল। “চলুন, বউদিকে নিয়ে সবাই মিলে একদিন ওখানে মোগলাই খেয়ে আসি।”
একেনবাবু ইতস্তত করছেন দেখে প্রমথ যোগ করল, “আর কিপটেমি করে ‘না’ বলবেন না। আপনার একটা পয়সাও খরচা হবে না, আমরা খাওয়াব বউদিকে।”
একেনবাবু লজ্জিত হয়ে বললেন, “কী যে বলেন স্যার, কলকাতায় আপনাদের আমি একদিন খাওয়াতে পারব না!”
“খাঁটি কথা, এটা তো ম্যানহাটান নয়, অনেক সস্তায় ব্যাপারটা সারতে পারবেন!” প্রমথ খোঁচা দিল। সামনে একেনবউদি বসে, প্রমথটার স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞান নেই!
“চুপ কর তো! উনি যেন আমাদের নিউ ইয়র্কে খাওয়ান না!”
দুই
মনোজবাবুর সঙ্গে গল্প করার পর দু’দিন বাদে একেনবাবুর বাড়িতে আড্ডা মারছি, এক ভদ্রলোক একেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। দেখে মনে হল আমাদেরই বয়সি। তাই “আপনি’ করে লিখছি না। পরিচয় দিল শুভেন্দু মিত্র বলে।
“মনোজদার কাছে আপনার কথা শুনে এসেছি।”
সঙ্গে সঙ্গেই কানেক্ট করতে পারলাম। এর বোনই মার্ডারড হয়েছে!
আমাদের দিকে একঝলক তাকিয়ে শুভেন্দু একেনবাবুকে বলল, “অসময়ে এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো?”
“আরে না স্যার। ছুটিতে আছি, সময় অসময় কি? এমনি বসে বসে গল্প করছি।” তারপর একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, “বসুন, স্যার, বসুন।”
শুভেন্দু বসতে বসতে বলল, “আমাকে আবার ‘স্যার’ বলছেন কেন, আপনি আমার দাদার মতো।”
প্রমথ গম্ভীর ভাবে বলল, “উনি ওঁর ভাইপোকেও ‘স্যার’ বলেন।”
অচেনা কারোর কথার পিঠে এ ধরণের মন্তব্য করা যে নিতান্ত অভদ্রতা সেটা প্রমথকে কে বোঝায়! শুভেন্দু যে একটু অপ্রস্তুত হয়েছে পরিষ্কারই বুঝলাম।
“স্যার’-টা ইগনোর করুন।” প্রমথ যোগ করল। “হ্যাঁ, আচ্ছা মানে.” শুভেন্দু ঠিক কী বলবে বুঝতে না পেরে একেনবাবুর দিকে তাকাল।
একেনবাবু আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনি যা বলার এঁদের সামনে স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। আমাকে এঁরা নানা ভাবে সাহায্য করেন। আমরা একটা টিম।”
এই কথায় কাজ হল। শুভেন্দু শুরু করল, “আমি মনোজদার আন্ডারে কাজ করতাম। মনোজদাই বললেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। মনোজদা বোধ হয় আপনাকে বলেছেন আমার বোনের কথা।”
“হ্যাঁ স্যার, আমি শুনেছি। খুবই স্যাড ব্যাপার স্যার।”
“ছ-মাস হয়ে গেল ও মার্ডারড হয়েছে, কিন্তু পুলিশ কিছু কিনারাই করতে পারেনি। আমার মনে হয় পারবেও না বা করতে চায় না।”
“এটা কেন বলছেন স্যার?”
“প্রথমে যিনি তদন্ত করছিলেন, তিনি ভরসা দিয়েছিলেন দোষী ধরা পড়বেই। তারপর তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। তার বদলে যিনি এসেছেন তিনি কোনো কথাই বলেন না। প্রশ্ন করলে বলেন, যা করার আমরা করছি।”
“এখন কে ইনভেস্টিগেট করছেন?”
“অধীর মুখার্জী বলে একজন।”
“আমি তো তাকে চিনি!”
“চেনেন! তাহলে আপনি যদি ওঁকে একটু চাপ দেন। তার থেকেও ভালো হয় আপনি নিজে প্রাইভেটলি যদি কেসটা নেন। মনোজদার কাছে আপনার অনেক সুখ্যাতি শুনেছি। আপনার কীর্তিকাহিনির কথাও বইয়ে পড়েছি…।”
আরও হয়তো দুয়েকটা প্রশংসাসূচক মন্তব্য করতে যাচ্ছিল শুভেন্দু। কিন্তু একেনবাবু থামিয়ে দিয়ে বললেন, “অধীরের কাছে আমি নিশ্চয় খোঁজ নেব স্যার। কিন্তু আমি এখানে আছি আর সপ্তাহ দুয়েক। এর মধ্যে তো কিছু করে উঠতে পারব না।”
“আপনার কথা আমি পিসিকে বলেছি। ওঁর একান্ত অনুরোধ আপনি কেসটা নিন। পিসি নিজেই আসতেন, কিন্তু খাট থেকে পড়ে গিয়ে ক’দিন হল উনি শয্যাশায়ী। বেবি ছিল পিসির একমাত্র মেয়ে। তার খুনি এত বড়ো পাপ করেও শাস্তি পাবে না, তিনি ভাবতে পারছেন না। আমি অবশ্য এখানে আসার আগে পিসিকে বলেছিলাম, আপনি নিউইয়র্কের ডিটেকটিভ, নিশ্চয় আপনার ফি কয়েক লাখ টাকা। পিসি আপনাকে বলতে বলেছেন নিজের সোনাদানা যা আছে সব বেচে আপনার প্রাপ্য উনি মিটিয়ে দেবেন, শুধু খুনিকে ধরিয়ে দিন।”
“আরে ছি ছি, স্যার, টাকার প্রশ্ন উঠছে কেন! সমস্যাটা ফি নিয়ে নয়, সমস্যাটা হল সময়ের।”
শুভেন্দু একটু চুপ করে থেকে বলল, “পিসিকে তাহলে কী বলব?”
আমার খারাপ লাগল। আমি একেনবাবুকে বললাম, “কেসটা না হয় নাই নিলেন, কিন্তু একটু দেখুনই না, পুলিশকে কিছু সাহায্য করতে পারেন কিনা।”
এতে যেটুকু কাজ হল, তার থেকে বেশি কাজ হল একেবউদির কথায়। একেনবউদি কখন কাজের মেয়েটিকে নিয়ে চা দিতে ঢুকেছেন খেয়াল করিনি। একেনবউদি বোধহয় ভেতর থেকে আমাদের কথা শুনছিলেন। একেনবাবুকে বললেন, “একটা মেয়ে খুন হল, দেখো না কী করতে পারো।”
একেনবাবু শুভেন্দুবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এরপর আর ‘না’ বলি কী করে স্যার। কেসটা না নিলেও যতটুকু পারি সাহায্য করব। নিন স্যার, চা খান।”
“থ্যাঙ্ক ইউ।” শুভেন্দু একেনবউদির দিকে একবার কৃতজ্ঞদৃষ্টিতে তাকাল।
.
চা খেতে খেতে দুয়েকটা মামুলি কথাবার্তার পর একেনবাবু বললেন, “এবার আপনার বোন আর খুনের ব্যাপারে যতটুকু জানেন বলুন।”
শুভেন্দু একটু চুপ করে থেকে শুরু করল
“নন্দিতা আমার একমাত্র পিসির একমাত্র মেয়ে। আমার থেকে বছর আটেকের ছোটো, পঁচিশ বছর সবে পূর্ণ হয়েছিল যখন মারা যায়। পিসেমশাই মারা গিয়েছিলেন নন্দিতা যখন স্কুলে পড়ে। সেই থেকে ও বড়ো হয়েছে ওর ঠাকুরদার বাড়িতে, বর্ধমান জেলার গুসকরা টাউনে। আমার নিজের কোনো বোন নেই, ওকে আপন বোন হিসেবেই দেখেছি চিরকাল। পিসেমশাই মারা যাবার পর পিসি প্রায়ই কলকাতায় আমাদের বাড়িতে আসতেন, আমরাও নিয়মিত গুসকরায় দেখা করতে যেতাম।
নন্দিতা যখন স্কুলের পড়া শেষ করে কলকাতায় পড়বে ঠিক করল, তখন বাবা বললেন, আমাদের সঙ্গে ও থাকবে। পড়াশুনোয় ভালো ছিল, যাদবপুরে চান্স পেয়ে গেল। ও যখন ফাইনাল ইয়ারে, বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে আমরা কোথায় যাব সে নিয়ে অনিশ্চয়তা। নন্দিতার কাকা তখন কলকাতায় মেয়েদের এক হস্টেলে ওর থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন। বি.এ পাশ করে আর পড়া হল না। বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। নিজের চেষ্টাতেই সাউথ সিটি মল-এ সেলসের কাজ জোগাড় করে ফেলল। সেখানে কাজ করতে করতেই সল্টলেকে ভালো মাইনের একটা চাকরি পেয়ে গেল। কল সেন্টারের কাজ। নাইট ডিউটি –রাত সাড়ে নটা থেকে সকাল সাড়ে ছটা। অফিসের গাড়ি রাত আটটার সময়ে তুলে নিয়ে যেত আর সকাল আটটা নাগাদ বাড়ি পৌঁছে দিত। ফলে ওর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কমই হত।
মাস ছয়েক আগে নন্দিতার অফিস থেকে একটা ফোন পেলাম। এমার্জেন্সির জন্যে আমার নম্বরটা ওদের কাছে ছিল। তখনই জানতে পারলাম অফিসের গাড়ি গতকাল রাতে তুলতে গিয়ে ওকে পায়নি। ফোনেও ওকে পাওয়া যাচ্ছে না! নন্দিতা বাইরে কোথাও গেলে আমাকে অন্তত জানায়। দু’দিন আগেও কথা হয়েছে। কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি তো?
যার সঙ্গে নন্দিতা মাঝে মাঝে ঘুরত, তাকে আমার মোটেই ভালো লাগত না। বয়সে নন্দিতার থেকে অনেকটাই বড়ো, চল্লিশের কাছাকাছি। পড়াশুনো কদুর কে জানে! স্কুল প্রকৃতি, কথাবার্তায় সোফেস্টিকেশনের অভাব। রেন্টাল কারের বিজনেস ছিল, প্রমোটারিও করত শুনেছি। নন্দিতা ওকে সমুদা ডাকত। ওর হস্টেলের কাছে মোড়ের মাথায় ছিল সমুদার অফিস। আমি মাকে কিছু না জানিয়ে সোজা সেখানে চলে গেলাম। লাকিলি সমুদাকে অফিসে পেয়ে গেলাম। নন্দিতা কোথায় জিজ্ঞেস করাতে সমুদা কেমন জানি থতমত খেয়ে গেল। আমি বললাম কাল রাত থেকে নন্দিতার খবর পাওয়া যাচ্ছে না, এর মধ্যে নন্দিতার সঙ্গে ওর কোনো কথা হয়েছে কি না। যদিও মুখে বলল হয়নি, কিন্তু বলার ধরনটা আমার ভালো লাগল না। মনে হল কিছু যেন গোপন করছে!
আমি সমুদাকে নিয়েই নন্দিতার হস্টেলে গেলাম। হস্টেলের সিকিউরিটি আমায় চেনে। বুঝলাম সমুদাকেও চেনে। তাই গেট খুলে দিল। নন্দিতার ঘরের দরজাটা বন্ধ, কিন্তু একটু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। তখনই দেখলাম বীভৎস দৃশ্যটা! বিছানায় শোয়া অর্ধ-নগ্ন দেহ –উপর দিকটায় কিছু নেই, নীচে শুধু শালোয়ারটা রয়েছে। মাথাটা একদিকে হেলানো, গলায় দড়ি বাঁধা, বুক পেট রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
আমি আর্তনাদ করে ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়ে এসে কোনোমতে পুলিশকে ফোন করলাম। আমার ভয়ার্ত চিৎকার শুনে নীচের সিকিউরিটি গার্ডও ছুটে এসেছে। পুলিশ না আসা পর্যন্ত আমরা নীচেই দাঁড়িয়ে রইলাম। হস্টেল-সুপার, নামটা ঠিক মনে নেই, পাশের বাড়িতে থাকেন। সিকিউরিটির কাছ থেকে খবর পেয়ে তিনিও এলেন। ওঁর কাছেই শুনলাম আগের রাতে নাকি নন্দিতা ফোন করেছিল হোস্টেলে ফিরতে একটু দেরি হবে বলে। উনি রাত দশটার সময় একবার দেখে যান সবাই ঘরে ফিরেছে কি না। কেউ যদি রাত করে তাহলে ওঁকে জানিয়ে রাখে, যাতে তিনি অযথা দুশ্চিন্তা না করেন। সুতরাং নন্দিতা কারোর সঙ্গে বাইরে বেশ রাত করে ছিল। সেইজন্যেই আমার মনে হচ্ছিল সমুদা কিছু একটা লুকাচ্ছে!”
“ইন্টারেস্টিং স্যার,” একেনবাবু এতক্ষণ বাদে মুখ খুললেন। “কখন মিস নন্দিতা ফিরেছিলেন সেই রাতে?”
“সেটা কেউ জানে না। হস্টেলে ঢোকার দুটো দরজা। বোর্ডাররা সাইডের দরজা চাবি দিয়ে খুলে ঢুকতে পারে। ভিসিটারদের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতে হয়।”
“ব্যাপারটা ঠিক ক্লিয়ার হচ্ছে না স্যার। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকলে সিকিউরিটি গার্ডের সামনে দিয়ে যেতে হয়, আর সাইডের দরজা শুধু লক থাকে, সেখানে কোনো গার্ড থাকে না সেটা বুঝলাম। কিন্তু সেখান দিয়ে ঢুকলে সিকিউরিটি গার্ড দেখতে পারে না কেন?”
“আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। হস্টেলটা চারতলা। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকলে একটা লবি। সেখানে সিকিউরিটি গার্ড বসে থাকে। লবির পেছনে বাঁদিকে ওপরে যাবার লিফট। ডানদিকে দুটো সিঁড়ি নেমে একটা ছোট্ট প্যাসেজ। তার পাশে সাইডের দরজা। চাবি দিয়ে সাইডের দরজা খুলে লবিতে আসা যায় আবার উলটো দিকের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে যাওয়া যায়। কেউ যদি সাইডের দরজা দিয়ে ঢুকে সেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে যায়, তাহলে সিকিউরিটি গার্ডের চোখে নাও পড়তে পারে।”
“পায়ের আওয়াজ তো কানে আসবে স্যার।”
“মেট্রন যখন প্রশ্ন করেছিলেন তখন গার্ড বলেছিল কোনো আওয়াজ ও শোনেনি। পুলিশ অবশ্য গার্ডকে অনেক জেরা করেছে শুনেছি। পুলিশ আর কিছু জেনেছে কি না জানি না। সমুদাকেও জেরা করেছে। আমাকেও একবার থানায় ডেকেছিল, কাদের সঙ্গে নন্দিতার পরিচয় আছে জানতে। এছাড়া আমি সন্ধ্যেবেলা থেকে কোথায় ছিলাম, রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম কি না, এই নিয়ে নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল। বাড়িতে এসে মা’র সঙ্গেও কথা বলে গিয়েছিলেন বিকাশবাবু, অধীরবাবুর আগে যিনি কেসটা হ্যাঁন্ডেল করছিলেন।”
“ঠিক আছে স্যার, আমি অধীরের সঙ্গে কথা বলব। তবে এই অল্প সময়ের মধ্যে কী করে উঠতে পারব বলতে পারছি না। আপনার মোবাইল নম্বরটা দিয়ে যান।”
শুভেন্দু নম্বরটা একটা কাগজে লিখে পকেট থেকে একটা ফোটো বার করল।
“নন্দিতা মারা যাবার কয়েকদিন আগে তুলেছিলাম।” চোখটা চিকচিক করে উঠল শুভেন্দুর। “জানি না ছবিটা আপনার কোনো প্রয়োজনে লাগবে কি না, কিন্তু আপনার জন্যেই একটা কপি এনেছি।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার,” ছবিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে একেনবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন।
প্যান্টস আর টপস পরা একটি যুবতী। অবিন্যস্ত ঘন চুল কানের ওপর দিয়ে আলগা করে পেছনে বাঁধা, কপালে ছোট্ট একটা টিপ, কানে ঝুমকো দুল। টানা ভুরুর নীচে আয়ত চোখ, নাকটা টিকালো, নীচের ঠোঁটটা একটু মোটা। দীর্ঘ গ্রীবা, সেটাকে জড়িয়ে একটা সরু হার বুকের খাঁজ পর্যন্ত নেমে এসেছে। শুধু সুন্দরী নয়, বেশ একটা সেক্সি ভাব আছে।
“কিছুদিন থাকুক স্যার এটা আমার কাছে,” একেনবাবু বললেন। “ আচ্ছা, মিস নন্দিতার পুরো নামটা কী ছিল?”
“নন্দিতা ঘোষ।”
“আর এই যে সমুবাবুর কথা বললেন, তাঁর পুরো নামটা কি?”
“সেটা বলতে পারব না। ভালো নাম বোধহয় সৌমেন বা সমীর।”
“আই সি। সমুবাবুর ঠিকানাটা কি আপনার জানা আছে?”
“গোলপার্ক থেকে বেরিয়ে কাঁকুলিয়া রোডের মোড়ে সাউথ কার রেন্টাল। বড়ো সাইনবোর্ড লাগানো, নম্বরটা মনে নেই।”
“ইনি ছাড়া অন্য কোনো বন্ধুর নাম বা ঠিকানা স্যার?”
“ভাস্বতী বলে ওর আরেক বন্ধু ছিল। মাঝেমধ্যে সে আমাদের বাড়িতে এসেছে।”
“উনিও কি কল সেন্টারে কাজ করতেন?”
“না, ভাস্বতী ওর সঙ্গে যাদবপুরে পড়ত। পরে কোনো একটা এয়ার লাইনে কাজ পেয়েছিল শুনেছি।”
“আর কেউ?”
“না, আর কারও কথা আমি জানি না।”
“সমুবাবুর সঙ্গে আপনার পরিচয় হল কী করে স্যার?”
“হঠাৎ করেই পরিচয়। একদিন নন্দিতার হস্টেলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখি নন্দিতার সঙ্গে সমুদা হস্টেল থেকে বেরোচ্ছে। নন্দিতা আমাকে এক্সপেক্ট করেনি। যাই হোক, তখনই পরিচয় হল।”
“ঠিক আছে স্যার, আপনার ফোন নম্বরটা তো দিয়েছেন, এরমধ্যে দরকার পড়লে যোগাযোগ করব।”
শুভেন্দু নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিল।
তিন
এরমধ্যে মা-কে নিয়ে দিন কয়েকের জন্যে এক বিয়ে উপলক্ষে ধানবাদ যেতে হল। ফিরে এসে প্রমথর কাছে শুনলাম একেনবাবু পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এই খুনের ব্যাপারে পুলিশ নাকি খুব একটা এগোতে পারেনি। একেনবাবু নন্দিতার কেসটা হাতে নিয়েছেন দেখে অধীরবাবু নাকি খুবই খুশি। একেনবাবুর সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করছেন। এই হত্যাকাণ্ডের খুনি ধরা পড়লে ওঁর মাথা থেকে একটা মস্ত বোঝ নামবে। বিস্তারিত খবর আজ বিকেলেই জানা যাবে, ‘মিলনী কাফে’তে একেনবাবু আমাদের মোগলাই পরোটা খাওয়াচ্ছেন!
.
মানতেই হবে ধন্য প্রমথর অধ্যবসায়! কী যে বলেন স্যার, আপনাদের একদিন খাওয়াতে পারব না’ বলে ঘোষণা করলেও এ নিয়ে অনেক টালবাহানা চলছিল।
কিন্তু প্রমথ হাল ছাড়েনি। ফ্যামিলির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না বলে ব্যাপারটা স্থগিত রাখার শেষ চেষ্টাও ধোপে ঠিক টেকেনি।
‘বাড়িতে লুচি পরোটা রান্না করলে কি বউদির শরীর ভালো হয়ে যাবে? পয়সা খসাতে চান না সোজাসুজি বলুন, এরকম ফালতু এক্সকিউজ দিচ্ছেন কেন!’ প্রমথর এই বাক্যবাণের সঙ্গে যখন যোগ হয়েছে একেনবউদির প্রশ্ন, ‘আমার আবার শরীর খারাপ কোথায় দেখলে?’ একেনবাবুকে তখন রণেভঙ্গ দিতে হয়েছে। সুতরাং মোগলাই আজ হবেই।
.
মিলনী কাফে-টা বাইরে থেকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পুরোনো বিশাল সবুজ সাইন বোর্ডটা আর নেই, সেখানে লাল রঙের একটা বোর্ডে লেখা ‘আইডিয়াল স্পোকেন ইংলিশ ইনস্টিটিউশন’। দোতলায় জানলার ফাঁক দিয়ে বেশ কয়েকটা ছেলেমেয়ের মুখ চোখে পড়ল। বুঝলাম ভাড়াটেদের তুলে দিয়ে ওখানে স্কুল হয়েছে। মিলনী কাফেটা স্ব-স্থানেই আছে। দরজার ওপরে মেটাল প্লেটে খোদাই করে নামটা রয়েছে, কিন্তু রাস্তা থেকে চট করে চোখে পড়বে না। উলটোদিকে গানের যে স্কুলটা ছিল সেটাও নেই। সেখানে এখন একটা কোচিং সেন্টার। সেখানে খুব ভিড়, সম্ভবত অ্যাডমিশন চলছে। কাছাকাছি কোনো পার্কিং-এর জায়গা পাওয়া গেল না। দূরে গাড়ি রেখে অনেকটা হাঁটতে হল।
বড়ো সাইন বোর্ডটা অদৃশ্য হলেও মিলনী কাফের পপুলারিটি দেখলাম কমেনি। মাত্র একটা টেবিলই ফাঁকা পড়েছিল। সেটা দখল করে আমিই মোগলাই পরোটা অর্ডার করলাম। সেই সঙ্গে মাংস আর একেনবউদির জন্য আলুর দম। ক্যাশিয়ার কাউন্টারে দেখলাম মৃত্যুঞ্জয়বাবু বসে আছেন। এই আট বছরে বেশ খানিকটা বুড়িয়েছেন! চুলে পাক ধরেছে, একটু যেন কুঁজোও হয়ে গেছেন। একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নানান
দিকে তাকাচ্ছেন। দেখে যেন মনে হয় কাউকে খুঁজছেন। হঠাৎ আমাদের দিকে চোখ পড়ল। লোকটির সঙ্গে কথা বলা শেষ করে আমাদের টেবিলে এসে দাঁড়ালেন।
“কবে এলেন?” একেনবাবুকে প্রশ্নটা করলেন বটে, কিন্তু গলার স্বরে আন্তরিকতার অভাব, যেন করার জন্যই প্রশ্নটা করা।
“এই তো ক’দিন আগে। আপনি কেমন আছেন স্যার?”
“চলছে, আমাদের আর থাকা না থাকা।”
“কেন স্যার, আবার কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?”
“ঝামেলা, কেন বলুন তো!” কেমন একটা শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকালেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু।
“সেই যে ড্রাগ-ডিলার চক্র?”
“না না, ওরকম আর কিছু হয়নি। এর পর কিছু একটা বলতে গিয়ে কেমন জানি চুপ করে গেলেন। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাদেরও তো অনেক দিন দেখিনি।”
প্রমথ বলল, “আমরাও তো ওঁর সঙ্গে বাইরে আছি।”
“তাই নাকি, কোথায়?”
এমন সময় অন্য প্রান্তে বসা ফুলহাতা সোয়েটার গায়ে মাঝবয়সি গোঁফ-অলা মুষকো একটা লোক উচচস্বরে কাউকে বলল, “যা, তোর বাবুকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর, চা কি পাওয়া যাবে, না অনন্তকাল এখানে বসে থাকতে হবে!”
লোকটির মুখোমুখি বসা কমবয়সি একটি মেয়ে। দূর থেকে দেখছি, তাই জোর করে কিছু বলা শক্ত, কিন্তু মনে হল মেয়েটার মুখে একটা অস্বাচ্ছন্দ্যের ভাব।
যে ছেলেটি পাশের টেবিলে খাবার দিচ্ছিল, মৃত্যুঞ্জয়বাবু তাকে বললেন, “দ্যাখ তো রতন, চা দিতে দেরি হচ্ছে কেন!”
রতন বলল, “দেরি কেন হবে! উনি তো এইমাত্র হরিদাকে অর্ডার দিলেন, আমি নিজে শুনেছি!”
মৃত্যুঞ্জয়বাবু নিচুস্বরে বললেন, “এই এক জ্বালা হয়েছে এঁকে নিয়ে।”
“ইনি কে স্যার?”
“ওই ওপরে স্পোকেন ইংলিশের মালিক।”
“আগে তো স্কুলটা ছিল না, তাই না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“না, এই বছর চারেক হল হয়েছে। তার পরেই এই উৎপাত! শনির দশা!”
কেন শনির দশা, সেটা আর জিজ্ঞেস করা হল না। কিছু না বলে অ্যাব্রাপ্টলি মৃত্যুঞ্জয়বাবু চলে গেলেন। খানিকক্ষণ বাদে দেখলাম নিজেই ঘুরে ঘুরে কাস্টমারদের অর্ডার নিচ্ছেন, রতন বা রতনের হরিদার ওপর ভরসা না রেখে।
আমাদের খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে গেল। এনে দিল সেই রতন। রতনকে এবার আমি চিনতে পারলাম। বছর সাতেক আগেও এখানে কাজ করত। বড়ো জোর বছর দশ কি বারো বয়স ছিল তখন। শিশুশ্রম আইন-টাইনগুলো কেউ মানত না। এখনও তেমন মানে কি?
খাবার দিতে দিতে রতন আমাদের জিজ্ঞেস করল, “আমাকে চিনতে পারছেন দাদাবাবুরা?”
“পারব না কেন!” প্রমথ বলল, “কেমন আছিস?”
“আপনাদের আশীর্বাদে ভালোই আছি।”
“হ্যাঁরে, মৃত্যুঞ্জয়বাবু কি অসুস্থ? শরীরটা একেবারে ঝরে গেছে! আগের মতো কথাবার্তাও বলছেন না।”
“বাবুর ট্র্যাজেডি হয়েছে দাদাবাবু।”
“ট্র্যাজেডি!”
“আবিরদা সুইসাইড করলেন যে!”
“আবিরদা কে?”
“দেখেননি আপনারা? বাবুর ছেলে!”
“সুইসাইড করল কেন?”
উত্তরটা রতনের দেওয়া হল না, তার আগেই মৃত্যুঞ্জয়বাবু রতনকে এসে ধমক লাগালেন। “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিস এখানে! দেখছিস না, কাস্টমার বসে আছে অর্ডার দেওয়ার জন্য!”
রতন তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। মৃত্যুঞ্জয়বাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিছু মনে করবেন না, দিনকে দিন ফাঁকিবাজ হচ্ছে ছেলেটা। খালি কথা আর কথা!”
মৃত্যুঞ্জয়বাবু চলে যেতেই এবার আবছা মনে পড়ল। আমাদের থেকে একটু ছোটো, মাঝেমাঝে ক্যাশবাক্স সামলাতো একটা ছেলে। হয়তো সেই আবির হবে। ট্র্যাজেডি বলে
ট্র্যাজেডি! সন্তানের এভাবে মৃত্যু ঘটার থেকে আর কী দুঃখের হতে পারে! বেশ খারাপই লাগল কথাটা শুনে। কিন্তু সেটা সাময়িক। সামনে গরম গরম মোগলাইপরোটা আর মাংস। সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হাইলাইট অফ দ্য ডে হল একেনবাবু খাবারের বিলটা মেটালেন।
চার
দিন কয়েক আমার আর একেনবাবুর কাছে যাওয়া হয়নি। যাদবপুরে একটা সেমিনার ছিল, সেই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এর মধ্যে প্রমথ এসে বলল একেনবাবু নাকি বেশ তেড়েফুড়ে নন্দিতার কেস নিয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যেই পুলিশের কাছ থেকে ক্রাইম সিনের বিস্তারিত রিপোর্ট জোগাড় করেছেন। ভাস্বতী নামে মেয়েটার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। সমুবাবুকে এখনও ধরতে পারেননি।
বিস্তারিত রিপোর্টটা কী জিজ্ঞেস করাতে প্রমথ গড়গড় করে যা বলল সেটা হল আততায়ী মনে হয় নন্দিতার পরিচিত। ঘরের দরজা ভাঙা হয়নি, সম্ভবত নন্দিতাই তাকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছিল বা তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। অর্ধনগ্ন দেহে অত্যাচারের চিহ দেখে বোঝা যায় বলাঙ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মনে হয় নন্দিতা বাধা দেওয়ায় আততায়ী গলা টিপে ধরে। পরে গলায় দড়ির একটা ফাঁসও লাগায়। ফাঁসটা কেন লাগাতে হল, সেটা স্পষ্ট নয়। তারপরেও বুকে পেটে এলোপাথারি ছুরি চালিয়েছে, বোধহয় মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। চুরি ডাকাতি করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। ব্যাগ থেকে টাকাপয়সা কিছুই খোওয়া যায়নি। আলমারি খোলা বা ভাঙার চেষ্টা করা হয়নি। বলাকার করতে বাধা পেয়ে খুন করার থিওরিটাও ধোপে টেকে না। খুন করার উদ্দেশ্য প্রথম থেকে না থাকলে ছুরি, দড়ি এসব এনেছিল কেন? যাইহোক, একেনবাবুর কাছে গেলে নিশ্চয়ই আরও কিছু জানা যাবে।
.
দুপুরে প্রমথ আর আমি যাদবপুরের কফি হাউসে গিয়েছিলাম পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। বন্ধুদের একজন থাকে একেনবাবুর বাড়ির কাছে। তাকে নামিয়ে দিয়ে ঠিক করলাম একেনবাবুকে সারপ্রাইজ দেব। গিয়ে দেখি একেনবাবু বেরোচ্ছেন।
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“খুব ভালো সময়েই এসেছেন স্যার। চলুন, ম্যাডাম ভাস্বতীর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।”
“ব্যাপারটা কি!” প্রমথ কপট রাগ দেখাল। “আমাদের ছাড়াই আপনি ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছেন!”
“কী যে বলেন স্যার। বাপিবাবু তো এ ক’দিন ব্যস্ত ছিলেন। আর আপনি তো সব কথাই জানেন।”
“ভাস্বতী মানে নন্দিতার সেই বন্ধু?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ স্যার, আজ হিন্দুস্থান পার্কে ওঁর মাসির কাছে বেড়াতে এসেছেন। ওখানে গেলে দেখা হবে।”
“ভাস্বতীর ঠিকানা পেলেন কোত্থেকে?”
“তুই একটা ইডিয়ট!” প্রমথ আমাকে ধমক দিল। “কার কাছ থেকে আবার, ইনস্পেক্টর অধীর মুখার্জীর কাছ থেকে!”
ভাস্বতীর মাসির বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। ওই পাড়ায় আগে বহুবার গিয়েছি।
ভাস্বতীর মাসি বাইরের ঘরে বসে উল বুনছিলেন। মাথার চুল বেশির ভাগই সাদা, চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।
একেনবাবু নিজের পরিচয় দিতেই আমাদের বসতে বলে কাজের মেয়েটিকে চা আনতে বললেন, আপত্তি শুনলেন না।
উল বুনতে বুনতেই বললেন, “ভাস্বতী একটু বেরিয়েছে, এখনই ফিরবে। তোমাদের অপেক্ষা করতে বলে গেছে। ওই যাঃ, ‘তুমি’ বলে ফেললাম, রাগ করলে না তো! তোমরা আমার ছেলের থেকেও ছোটো।”
“একেবারেই না,” প্রমথ বলল, “সবার হয়েই আমি বলছি। কী বলেন একেনবাবু?”
“কী যে বলেন স্যার, সে তো অবশ্যই।”
উনি দেখলাম একেনবাবুর পরিচয় ভালোভাবেই জানেন। নন্দিতার কেসটা যে একেনবাবু নিয়েছেন তার জন্যে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। নন্দিতা ভাস্বতীর প্রাণের বন্ধু ছিল, ওঁর বাড়িতে অনেকবার এসেছে। মারা যাবার কয়েকদিন আগেও গল্পগুজব করে গেছে।
“মিস নন্দিতার আর কোনো বন্ধুর কথা জানেন ম্যাডাম?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।
“আমাকে ম্যাডাম বোলো না, মাসিমা বলে ডেকো।”
“সরি ম্যাডাম, মানে মাসিমা। আমি জানতে চাইছিলাম, মিস নন্দিতার আর কোনো বন্ধু ছিল কি না।”
মাসিমা একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ওর সঙ্গে একজনকে দেখেছি। বন্ধু কি না বলতে পারব না। বয়সে অনেকটাই বড়। ওর গাড়িতে করে বার দুয়েক আমার কাছে এসেছিল। ট্যাক্সির মালিক বা ওরকম কোনো একটা ব্যাবসা করে।”
“কী নাম ভদ্রলোকের?”
“নাম তো বলতে পারব না। লোকটাকে আমার পছন্দ হয়নি। কথাবার্তাগুলো শুনে মনে হয় না পড়াশুনো জানা ভদ্ৰপরিবারের বলে। আমি ভাস্বতাঁকে বারণও করেছিলাম লোকটার সঙ্গে মেলামেশা করতে। তবে জান তো, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি আমাদের কথা তেমন শুনবে! তা তোমরা দুজনে কী করো?”
আমার আর প্রমথর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
প্রমথই আমাদের পরিচয় দিল।
“বাঃ, দু’জনই শিক্ষার জগতে আছ! তা বিয়ে-থা করেছ?”
“না মাসিমা, আমার একটু কমপ্লিকেশন আছে।” তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল, “তবে বাপির জন্যে আমরা সবাই সুপাত্রী খুঁজছি!”
“তাই নাকি!” মাসিমা সোৎসাহে বললেন।
আমার ইচ্ছে হচ্ছিল প্রমথর মাথায় একটা চাঁটা মারি! ভাগ্যিস এই সময়ে ভাস্বতী ঘরে ঢুকল! ভাস্বতী বাঙালি মেয়েদের তুলনায় অনেকটাই লম্বা। পাঁচফুট আট ইঞ্চির মতো হবে। মুখের দিকে তাকালে চোখের দিকেই প্রথম নজর পড়ে। চোখদুটো যেন কথা বলছে! একটু লম্বাটে মুখ, কিন্তু অসুন্দর নয়। গায়ের রঙ মাজা। টানটান করে বাঁধা চুল। ঠোঁটে খয়েরি-লাল লিপস্টিকের ছোঁয়া। লাল-হলুদ সালোয়ার কামিজে চোখে পরার মতোই চেহারা।
নমস্কার করে বলল, “সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল।”
মাসিমা বললেন, “আয় আয় বোস। এঁরা অনেক্ষণ বসে আছেন।”
“ইসস, কী খারাপ যে লাগছে। আসলে ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না। বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে এসে শেষ পর্যন্ত পেলাম।”
“তাতে কী হয়েছে ম্যাডাম। আমরা তো গল্পই করছিলাম।”
ম্যাডাম শুনে ভাস্বতী লজ্জা পেল।
“প্লিজ, আমাকে ম্যাডাম বলবেন না! ভাস্বতী বলে ডাকবেন।”
“সেটা সম্ভব নয়,” প্রমথ গম্ভীরভাবে বলল। “অন্তত মিস ভাস্বতীতে আপনাকে অভ্যস্ত হতে হবে।”
প্রমথর কথার কারণে ভাস্বতী হেসে ফেলল। ঝকঝকে হাসি। অতি সপ্রতিভ মেয়েটা।
“এঁরা দুজন আমেরিকায় প্রফেসরি করেন। আমাদের দেখিয়ে মাসিমা বললেন।
“ওমা, আমাকে তাহলে ভাস্বতী তুমি বলবেন।”
“আমরা বলতে পারি, কিন্তু একেনবাবুকে দিয়ে কি সেটা বলাতে পারব!”এমনভাবে প্রমথ কথাটা বলল শুধু ভাস্বতী নয়, মাসিমাও হেসে উঠলেন।
এরকম খেজুরে আলাপ চলতে চলতেই আমাদের মধ্যে ‘তুমি’ সম্বোধনটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, ব্যতিক্রম একেনবাবু। কাজের প্রসঙ্গ এল। একেনবাবু ভাস্বতাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “মিস নন্দিতা আপনার খুব বন্ধু ছিলেন শুনেছি। ওঁকে আপনি কতদিন চিনতেন?”
“তা প্রায় বছর ছয়েক।”
“কোথায় আপনাদের পরিচয় হল?”
“আমরা একসঙ্গে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। তারপর এক বছর স্পোকেন ইংলিশ-এর কোর্সও নিয়েছি।”
“আই সি, তারপর?”
“ও কল সেন্টারে চাকরি নিল, আমি এয়ারলাইনসের চাকরিতে ঢুকলাম। তারপর থেকে দেখা-সাক্ষাৎ কমই হতো। কিন্তু ফোনে যোগাযোগটা সবসময়েই ছিল। রবিবার সকালে মাঝেমধ্যে আমরা এই বাড়িতে মিট করতাম।”
“শেষ কবে ওঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয়?”
“প্রায় মাস ছয়েক আগে। কোনো একটা ছুটির দিন ছিল। আমরা দু’জনেই এখানে এসে একসঙ্গে লাঞ্চ করি। তার কয়েকদিন বাদেই ও খুন হয়।”
“ওঁর এক বন্ধু ছিলেন সমুবাবু বলে, তাকে আপনি চেনেন?”
ভাস্বতী চকিতে একবার মাসিমার দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ, বার কয়েক ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।”
“কী করেন উনি?”
“শুনেছিলাম রেন্টাল কারের বিজনেস আছে। তার বেশি কিছু জানি না।”
“উনি কি মিস নন্দিতার বয়ফ্রেন্ড ছিলেন?”
উত্তরটা দিতে ভাস্বতী একটু ইতস্তত করল, “ঠিক বলতে পারব না।”
“আর কারও সঙ্গে কি মিস নন্দিতার ঘনিষ্ঠতা ছিল?”
“কল সেন্টারের একজনের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ছিল শুনেছি, কিন্তু তাকে আমি চিনি না।”
বুঝতে পারছিলাম মাসিমার সামনে অকপটে সবকিছু বলতে ভাস্বতী অসুবিধা বোধ করছে।
সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় একেনবাবু বললেন, “আজকে আমাদের একটু তাড়া আছে। আরেকদিন কি আপনি আমাদের একটু সময় দিতে পারবেন?”
ভাস্বতী কিছু বলার আগেই মাসিমা বললেন, “চলে এসো না তোমরা একদিন এখানে। ভাস্বতীও আসবে, বিকেলে সবাই মিলে ভালো করে চা জলখাবার খাবে। কবে আসবে বলো?”
“তা তো করাই যায় ম্যাডাম, সরি… মাসিমা। ফোন করে পরে না হয় সময়টা ঠিক করে নেব।” একেনবাবু বললেন।
“তোমাদের নম্বরটাও ভাস্বতাঁকে দিয়ে দাও,” মাসিমা আমাদের বললেন।
প্রমথ বলল, “হ্যাঁ, বাপি, তোর নম্বরটা ভাস্বতাঁকে দে।”
প্রমথটাকে ঠ্যাঙাতে হয়!
.
পরের দিন সকালে অচেনা মোবাইল থেকে একটা ফোন পেলাম,
“বাপিদা, আমি ভাস্বতী।”
ফোনটা একেবারেই এক্সপেক্ট করিনি, তাই উত্তর দিতে একটু সময় লাগল।
“ও হ্যাঁ হ্যাঁ, একেনবাবুর তো তোমাকে ফোন করার কথা। করেননি?”
“না, কিন্তু কালকে পিসি থাকায় অনেক কিছুই তোমাদের বলতে পারিনি।”
“সেটাই মনে হচ্ছিল। তা কবে আমাদের মিট করতে চাও?”
“আজকে আমার ডে-অফ। একটু আগে আমাকে জানাল যে কাল সকালে আমাকে দু সপ্তাহ ট্রেনিংয়ের জন্য মুম্বাই যেতে হবে। তাই আজকে ছুটি দিয়েছে।”
“ঠিক আছে, আমি একেনবাবুকে ফোন করি। দেখি ধরতে পারি নাকি। তারপর তোমাকে ফোন ব্যাক করছি।”
একেনবাবুকে পেলাম না। একেনবউদি বললেন, ফিরতে রাত হবে। লাঞ্চ ডিনার সব নাকি বাইরে খাবেন। হঠাৎ কি এত কাজ বুঝলাম না, আমাদেরও কিছু জানাননি! এ তো একটা সমস্যা হল! প্রমথকে ধরার চেষ্টা করলাম। ও গেছে কোন্নগরে মামাবাড়িতে, সন্ধেবেলা ফিরবে।
ভাস্বতাঁকে কথাটা জানালাম। বললাম, “আমাকে যা বলার বলতে পার। আমি একেনবাবুকে জানিয়ে দেব।”
“ফোনে এগুলো বলতে চাই না।”
“ঠিক আছে। কোথায় কথা বলতে চাও?”
“খুব শর্ট নোটিস দিচ্ছি, তুমি এখন ব্যস্ত?”
“তেমন না।”
“আমি বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে এক বন্ধুর বাড়িতে আছি। তুমি কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি এসে আমাকে ফোন করলেই সেখানে তোমাকে মিট করতে পারি।”
সত্যিকথা বলতে কি, একা একা এভাবে একজন অত্যন্ত স্বল্প পরিচিত মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। অনেক রকমের সমস্যা কলকাতায় আজকাল হয় শুনেছি। একটাই বাঁচোয়া ওর মাসির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে, মেয়েটিকেও পুলিশ ইতিমধ্যে জেরা করেছে। তেমন কোনো সমস্যা হয়তো হবে না। একটা জিনিস ভাবছিলাম, কোথায় বসে কথাবার্তা বলব? রেস্টুরেন্টে নিশ্চয় বলা যাবে না।
.
কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টের সামনেই ভাস্বতী দাঁড়িয়েছিল। আজকে দেখলাম একটা মেরুন রঙের শাড়ি পরেছে। মুখে প্রসাধনের ছাপ সুস্পষ্ট, অফিসে গিয়েছিল বলেই বোধ হয়। সাইড করে গাড়িটা দাঁড় করাতেই ও দরজা খুলে উঠে বলল, “আমার বন্ধুর বাড়িতে বসে কথা বলতে পারব। খুব কাছেই।”
বন্ধুর বাড়িতে বুঝলাম ভাস্বতীর অবারিত দ্বার। বন্ধু কাজে গেছে। বন্ধুর বৃদ্ধা মা দোতলায় শয্যাশায়ী। বন্ধুর দাদা ডাক্তার, পাশেই তাঁর চেম্বার। বাড়িতে কমলা নামে একটি কাজের মেয়ে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না।
আমরা বসলাম।
“চা খাবে? কমলাকে বললেই করে দেবে।”
“না, আগে কাজের কথাটা শোনা যাক।”
ভাস্বতী একটু চুপ করে থেকে বলল, “নন্দিতার জীবন খুব কমপ্লিকেটেড ছিল। বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে– অনেক স্ট্রাগল করেছে, অনেকে আবার তার অ্যাডভান্টেজ নিয়েছে।”
“কী রকম?”
ভাস্বতীর মুখটা এবার লাল হল। “কলকাতায় অভিভাবকহীন অবিবাহিত মেয়েদের পদে পদে বিপদ। রক্ষক এখানে ভক্ষক হয়।”
ধরে নিলাম এটা ভূমিকা, আরও কিছু বলবে, তাই চুপ করে রইলাম।
“তোমাকে আমি প্রায় চিনিই না বাপিদা, কিন্তু এগুলো তোমাকে বললে যদি ভাস্বতীর খুনের কোনো কিনারা হয়, তাই লজ্জা না করেই বলব।”
“লজ্জা পাবার কোনো কারণ নেই, তুমি বলো।”
“স্পোকেন ইংলিশ ইনস্টিটিউডের মালিক ধ্রুব দত্ত ওকে সেক্সয়ালি হ্যারাস করত। একটু আধটু সবার সঙ্গেই লোকটা অসভ্যতা করার চেষ্টা করত। নন্দিতা ছিল খুব সফট, ওকেই বেশি করত। নন্দিতাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিল সমুদা। পরে জানলাম সে আরও জঘন্য চরিত্রের লোক। নন্দিতাকে ব্ল্যাকমেল করে… ওর সঙ্গে… ওর সঙ্গে শুত!” ।
এ ধরণের ঘটনা আগেও শুনেছি। তাও জিজ্ঞেস করলাম, “কী করে ব্ল্যাকমেল করত?”
“নন্দিতার ড্রিঙ্কে কিছু মিশিয়ে ওকে বেহুস করে অনেক নোংরা ছবি তুলেছিল, সেগুলো ওর বিধবা মাকে দেখিয়ে দেবে বলে ভয় দেখাত।”
“পুলিশকে নন্দিতা জানায়নি কেন?”
“তুমি এদেশের পুলিশকে কতটা জানো জানি না, এগুলো জানালে ওর ভালো থেকে মন্দ হতো!”
“তুমি জানালে না কেন?”
“আমি পুলিশের কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। যখন একেনবাবুর ফোন পেলাম, তখন ঠিক করলাম ওঁকে এটা জানাব। শুধু পুলিশ মহল নয়, বাইরের অনেকেও ওঁর সততা আর রহস্য উদ্ঘাটন করার ক্ষমতার কথা জানে। ওঁকে নিয়ে তোমার লেখাও পড়েছি। কিন্তু বড্ড কম লেখো।”
“আমি তো লেখক নই, বাট থ্যাঙ্ক ইউ। আর কী বলবে বলো।”
“হ্যাঁ আরও আছে, বলছি। এইবার সমুদার হাত থেকে মুক্তি পেতে নন্দিতা রাজা বলে একটি ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। রাজার কথা ও শুনেছিল স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসে কারও কাছ থেকে। সে নাকি গুন্ডামি ছাড়াও উপকার করে বেড়ায় রবিনহুডের মতো। সেই রাজা নাকি সমুদাকে বেশ কড়কে দিয়েছিল। কিন্তু তার জন্যে রাজাকেও পারিশ্রমিক দিতে হয়েছিল। পারিশ্রমিকটা টাকা নয় এটা জানি।”
“এটা কোন সময়ের ঘটনা?”
“আমার সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার দিন দশেক আগের।”
এবার আমি বুঝলাম শুভেন্দু যখন সমুদাকে নন্দিতার কথা জিজ্ঞেস করছিল সমুদা কেন থতমত খেয়ে গিয়েছিল। রাজার কাছে কড়কানি খেয়ে নন্দিতার সঙ্গে সমুদা যোগাযোগ রাখতে সাহস পায়নি। কেন যোগাযোগ রাখেনি, সেই সত্যটা বলতে পারেনি, আর শুভেন্দু ভাবছিল সমুদা কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা করছে!
আমি চুপ করে আছি দেখে ভাস্বতী বলল, “কী ভাবছ?”
“কিছু না, বলো।”
“বাড়িতে সে সময়ে নন্দিতার জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছিল। আমি ওকে ভরসা দিচ্ছিলাম, বিয়ের পর এইসব ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবি। নন্দিতা শুধু বলেছিল– ভার্জিনিটি নেই, কোন মুখে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে, তার আগে সুইসাইড করবে।”
“দ্যাক্স ননসেন্স!” আমি বললাম। “প্রি-ম্যারিটাল সেক্স ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক, কোনো অপরাধ নয়।”
“আমিও তাই বলি, কিন্তু এদেশের সব ছেলেরা তো তোমার মতো নয়, বিয়ের সময় সবাই খোঁজে পবিত্র মেয়ে!”
“স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসের মালিককে আমি দেখেছি।” আমি বললাম, “দেখলেই মনে হয় বাজে ক্যারেক্টার!”
“বাজে বলে বাজে, আমরা সবাই ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি!”
“আর এই রাজা লোকটা, সে কোথায় থাকে?”
“শুনেছি তিলজলায় বাড়ি। ঠিক কার কাছ থেকে নন্দিতা ওর খোঁজ পেয়েছিল সেটা আমাকে বলেনি। তবে আমি ধরে নিচ্ছি পুলিশের খাতায় ওর নাম আছে।”
“আর কিছু?”
“না, এটাই। তোমরা কবে ফিরে যাচ্ছ?”
“জানুয়ারির ১২ তারিখে।”
“তাহলে তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।” ভাস্বতীর মুখটা যেন বিষণ্ণ।
পকেট থেকে আমার একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললাম, “এখানে আমার ইমেল আছে। যোগাযোগটা থাকবে।”
“আরেকটা কার্ড দাও।”
আমি একটু অবাক হয়ে আরেকটা কার্ড দিলাম। কার্ডের উলটোদিকে কিছু লিখে কার্ডটা ফেরৎ দিল। হাতের লেখাটা সুন্দর –ভাস্বতী মিত্র, নীচে ওর ইমেল অ্যাড্রেস।
“আমি কিন্তু প্রথমে ইমেল করব না, তুমি করবে।”
আমি ওর কথার ধরণে হেসে ফেললাম।
“ফেসবুকে আছ?” জিজ্ঞেস করল ভাস্বতী।
“না, কলেজে পড়াই, তাই একটু লুকিয়ে থাকি।”
“আমিও আমার ছবি ফেসবুকে রাখি না, তার বদলে একটা কুকুরের ছবি।” তারপর একটু মুখ টিপে হেসে বলল, “আচ্ছা, আমি পবিত্র কি না জিজ্ঞেস করলে না তো?”
তাজ্জব! এই সাত বছরে কলকাতা কি পালটে গেছে? এই মেয়ের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের হিপ মেয়েদের তো কোনো তফাতই নেই!
আমিও তালে তাল রাখলাম, “ঠিক কথা, সত্যি করে বলো তো, তুমি কি পবিত্র?”
দুজনেই হাসলাম।
“আমাকে মাসির বাড়িতে নামিয়ে দিতে পারবে?”
“নিশ্চয়, চলো।”
গাড়িতে আর কোনো কথা হল না। ও কি ভাবছে আমি জানি না, আমি কিন্তু ওর কথাই ভাবছিলাম। সত্যি, এরকম সপ্রতিভ মেয়ে বেশি দেখিনি। হঠাৎ প্রমথর একটা কথা মনে পড়ায় হাসি পেয়ে গেল। আমার সব লেখাতেই নাকি একটা ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি থাকে!
“হাসছ কেন?”
“কিছু না।”
ভাস্বতী ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না।
নামার সময় আমার কাঁধটা আলতো করে ছুঁয়ে বলল, “ভালো থেকো।”
“তুমিও। আবার নিশ্চয় দেখা হবে।“
ওর চোখটা যেন বলে উঠল, সত্যি বলছ?”
এর উত্তর কথায় হয় না।
পাঁচ
পরের দিন সকালে একেনবাবুর ফোন, “কী করছেন স্যার, চলে আসুন।”
আমি তো এক পায়েই খাড়া। গিয়ে দেখি প্রমথও এসে হাজির।
“আপনাদের প্রোগ্রেস রিপোর্ট দিই”, বলে ভাস্বতীর সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কথা বললাম।
একেনবাবু মন দিয়ে ভাস্বতী যা যা বলেছে শুনলেন। ব্যক্তিগত অপ্রয়োজনীয় অংশটুকু বাদ দিলাম।
প্রমথ বলল, “কিছু তো লুকোচ্ছিস বুঝতে পারছি। যাক, সব কিছু বলতে হবে না। তোর প্রাইভেট ব্যাপারে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”
“গো টু হেল!”
একেনবাবুর ফোকাস অন্যদিকে। “বুঝলেন স্যার, এই সমুবাবুকে একটা শাস্তি দেওয়া দরকার। কিন্তু যাকে ব্ল্যাকমেল করে এই দৈহিক অত্যাচারটা করতেন তিনিই তো বেঁচে নেই যে কমপ্লেন করবেন! আর খুনের দায়েও ওঁকে ধরা যাবে না।”
“সেটা কেন বলছেন?”
“পুলিশের সাসপেক্ট লিস্টে উনি ছিলেন, কিন্তু ব্লাড টেস্ট করে ম্যাচ পাওয়া যায়নি।”
“তার মানে?”
“মিস নন্দিতাকে খুনি যখন ছুরি মেরেছিল, তখন ধ্বস্তাধ্বস্তিতে খুনিও জখম হয়। আইডেন্টিফিকেশনের প্রথম স্টেপ হল ব্লাড টাইপ ম্যাচ করা। তারপর পজিটিভ হবার জন্যে ডিএনএ টেস্ট।”
“এবার বুঝেছি। তাহলে তো ওই রাজা নামের লোকটাকে খুঁজে বার করা দরকার।”
“ঠিক কথা স্যার। আমি এখুনি ফোন করছি”, বলে অধীরবাবুকে ফোন করতে গেলেন।
একেনবাবু যখন ফোন করছেন তখন প্রমথ বলল, “ভাস্বতী না হয় ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিল, কিন্তু এই সমু ক্যারেক্টারকে পুলিশ যখন জেরা করছিল, তখন সে রাজার কথা বলেনি কেন?”
“বললে তো নিজের কীর্তি ফাঁস হয়ে যেত!”
ইতিমধ্যে চা নিমকি ভাজা এসে গেছে। একেনবউদিও এসে বসেছেন।
একেনবাবু ফোন সেরে এসে দুটো নিমকি মুখে দিয়ে বললেন, “বুঝলেন স্যার, চায়ের সঙ্গে নিমকির কোনো বিকল্প নেই।”
“বিকল্প! কী ব্যাপার মশাই, বেশ কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করছেন!” প্রমথ বলল।
“কেন স্যার, ‘বিকল্প’ শব্দটা তো বেশ ভালো। আমাদের উচিত ভালো ভালো বাংলা শব্দ বেশি করে ব্যবহার করা।”
“আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? আপনার এই বাঙলা-প্রীতির মূল কারণ হল স্পোকেন ইংলিশ মার্ডার মিস্ট্রির হাতে আপনার ল্যাজে-গোবরে হওয়া।”
“এটা ভালো বলেছেন স্যার। তবে কী জানেন, ইংরেজি বলতে শেখাটা ভালো, কিন্তু তা বলে বাংলায় যখন-তখন ইংলিশ ব্যবহার সাপোর্ট করা যায় না।”
“বলতে চাইছেন ‘সমর্থন করা যায় না। কিন্তু আগে তো সেটাই করতেন! ঠিক আছে, তাহলে এখন ‘স্যার’ ছেড়ে মহাশয়’ বলা শুরু করুন।”
“শুনছেন স্যার, প্রমথবাবুর কথা,” এবার একেনবাবু আমাকে সাক্ষী মানলেন। ‘মহাশয়, মহাশয় বলে কথা বলা যায় নাকি!”
“আপনি ছাড়ন ওর কথা। এখন বলুন তো কালকে সারাদিন আপনি কোথায় ডুব মেরেছিলেন?”
“ডুব মারব কেন স্যার, অধীরের এক কলিগের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম।”
“কী ব্যাপারে?”
“মিস নন্দিতার আগে স্যার আর একটি মেয়ে প্রায় একইভাবে খুন হয়েছিল। কাল তারই খবরাখবর নিচ্ছিলাম।”
“কী জানলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“বিশেষ কিছু জানতে পারলাম না। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার ছুটিতে আছেন। ফাইলগুলো তালাবন্দি। যেটুকু জানতে পারলাম, তা হল মেয়েটির নাম ছিল মিস শর্মিলা দত্ত। ট্র্যাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন।”
“দাঁড়ান দাঁড়ান, এর কথাই তো সেদিন মনোজবাবু বললেন!”
“হ্যাঁ, স্যার। শর্মিলা থাকতেন গোলপার্কে একটা মেয়েদের হস্টেলে। হস্টেলটা মিস নন্দিতার হস্টেল থেকে খুব দূরেও নয়। একইভাবে গলা টিপে ধরে গলায় দড়ির ফাঁস দেওয়া। তবে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়নি। আততায়ী আধমরা অবস্থায় ফেলে রেখে গিয়েছিল। কিন্তু জ্ঞান আর ফেরানো যায়নি। আর একটা মিল, মিস শর্মিলাকেও মলেস্ট করা। হয়েছিল, কিন্তু রেপ নয়।”
আমি বললাম, “আপনি কি দুটো খুনের মধ্যে লিঙ্ক খুঁজছেন? মোডাস অপারেন্ডি তো এক নয়, নন্দিতাকে তো ছুরিও মারা হয়েছিল!”
“হয়তো খুনি দ্বিতীয়বার চান্স নিতে চায়নি।” প্রমথ বলল।
“এটা ভালো বলেছেন স্যার। তবে যেটা মোস্ট ইনটারেস্টিং সেটা হল এই মেয়েটিও আইডিয়াল স্পোকেন ইংলিশ ইনস্টিটিউশনে পড়েছিল।”
“ওয়েট এ মিনিট, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন? একজন খুনি শুধু একটা বিশেষ স্কুলের মেয়েদের খুন করছে!”
“সম্ভাবনাটাকে তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না স্যার।”
“কিন্তু কেন?”এবার প্রমথ প্রশ্নটা করল।
“আই হ্যাভ নো ক্লু স্যার।”
“তাহলে কাল সারা দিন ধরে করলেনটা কী?”
একেনবাবু উত্তর না দিয়ে পা নাচাতে লাগলেন। উনি কিছু একটা ভাবছেন, কিন্তু সেটা ঠিক কী– জানাতে এখনও রাজি নন!
আমি মনে মনে ভাবছিলাম, এই দু’টো খুনের সঙ্গে স্পোকেন ইংলিশ স্কুলেরই কোনো একটা লোকের যোগাযোগ থাকতে হবে। সেদিন যে অভদ্র লোকটা মিলনী কাফেতে চা পাচ্ছি না বলে চ্যাঁচামেচি করছিল, সে যদি হয় আশ্চর্য হব না। লোকটা যে বদ সে তো জানিই, চেহারাটাও ক্রিমিন্যাল টাইপের। জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, ওদিন মিলনী কাফেতে স্কুলের যে মালিককে দেখলাম, তার সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে?”
“অধীর তো বলল হয়েছে। লোকটার অ্যালিবাইও আছে।”
“ওখানকার ছাত্রদের জেরা করেছে?”
“সন্দেহের তালিকায় যে ক’টা ছেলে ছিল সবাইকেই করা হয়েছে। কিন্তু আমি ভাবছি স্যার,খুনি তো পুরুষ মানুষ নাও হতে পারে।”
“এটা কেন বলছেন?”
“মলেস্ট করা হয়েছে, কিন্তু রেপ করা হয়নি।” একটু অন্যমনস্ক ভাবে একেনবাবু বললেন।
“ভেরি ইনটারেস্টিং, প্রমথ বলল। “খুনি মেয়ে হলে হস্টেলের দারোয়ানদের চোখ এড়িয়ে যাওয়াটাও সহজ।”
“কিন্তু মোটিভটা কী?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“কি স্টুপিডের মতো কথা বলছিস! লাভ ট্রায়াঙ্গেল। প্রেমের প্রত্যাখ্যানও হতে পারে।”
“প্রেমের প্রত্যাখ্যান বলতে কী বলতে চাইছিস, লেসবিয়ান কোনো সমস্যা?”
“সেটা হতে অসুবিধা কি!” প্রমথ সবজান্তার ভাব করল।
“তাহলে নেক্সট স্টেপটা কি?” আমি একেনবাবুকে প্রশ্নটা করলাম।
“সেটাই ভাবছি স্যার। মুশকিল হচ্ছে হাতে আমাদের সময় বেশি নেই। আমাকে একবার অধীরের কাছে যেতে হবে। আপনারা আসতে চান?”
“নিশ্চয়,” আমি প্রমথ দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলাম।
“অধীর স্পোকেন ইংলিশ স্কুলের স্টুডেন্ট অ্যাডমিশন রেকর্ডগুলো কোর্ট অর্ডার দিয়ে আনিয়েছে। আজকের রাতটা পুলিশের হেফাজতে ওগুলো থাকবে। আমরা এখন গেলে দেখতে পারব।”
“ওগুলো দেখে কী লাভ হবে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“জানি না স্যার। তবে শুক্তির মধ্যে থেকেই তো হঠাৎ করে মুক্তো বেরিয়ে পড়ে।”
বুঝলাম, একেনবাবু কিছু একটা খুঁজছেন।
পুলিশ থানায় অধীরবাবু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। একেনবাবু আমাদের পরিচয় একটু বাড়িয়ে বাড়িয়েই করলেন, যেমন সাধারণত করেন।
“আসুন স্যার, এই ঘরেই ফাইলগুলো আছে।” ওঁর অফিসের পাশে ছোট্ট একটা ঘরে আমাদের নিয়ে গেলেন। “যা দেখার আজকেই দেখতে হবে, কাল সকালে সব ফেরত চলে যাবে।”
অধীরবাবুর বোধ হয় কোথাও যাবার ব্যাপার ছিল, ওঁর এক জুনিয়র অফিসার বিজয়বাবুকে রেখে গেলেন। বিজয়বাবু মনে হল একেনবাবুকে প্রায় দেবতা জ্ঞান করেন।
.
প্রত্যেকটা বছরের জন্য এক একটা করে চারটে ফাইল ফোল্ডার। প্রত্যেকটা ফোল্ডারের প্রথম পাতায় নামের একটা লিস্ট। লিস্টে যাদের নাম আছে, তাদের ভর্তি হবার অ্যাপ্লিকেশনগুলো ফোল্ডারের ভেতর আছে। প্রতিটি ফোল্ডারে প্রায় একশোটার মতো অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম। ছাত্রছাত্রীর ছবি, ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ফোন নম্বর, হাবিজাবি অনেককিছু সেখানে রয়েছে। ছাত্রীদের সংখ্যাই মনে হল বেশি।
একেনবাবু চট করে লিস্টগুলিতে চোখ বুলিয়ে একটা ফর্ম বার করলেন। তারপর প্রায় নিজের মনেই বললেন, “ছবিটা তো দেখছি মিসিং!”
“কার ছবি?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
উত্তরে কাগজটা আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন একেনবাবু। শর্মিলা দত্তর অ্যাপ্লিকেশন। তারপর ফোল্ডার থেকে আরেকটা ফর্ম বার করে বিজয়বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “এ দুটো ফর্ম কি কপি করা যাবে?”
বিজয়বাবু একটু কাচুমাচু মুখে বললেন, “কপি মেশিনটা স্যার খারাপ হয়ে বসে আছে। কালকে মিস্ত্রি আসবে।”
“ঠিক আছে, তাহলে হাতেই ঢুকতে হবে।” বিজয়বাবুকে কথাটা বলে প্রমথের হাতে দ্বিতীয় ফর্মটা দিলেন। ফর্মটা নন্দিতার। আমাকে ধরিয়ে দিলেন শর্মিলার ফর্মটা।
“এ দুটো থেকে নাম ঠিকানা কোথায় পড়াশুনো করেছেন–যা যা আছে সেগুলো একটু টুকে নেবেন স্যার?”
বিজয়বাবুর কাছ থেকে দুটো সাদা কাগজ নিয়ে আমরা আমাদের কাজে লাগলাম।
একেনবাবু দেখলাম ঝড়ের বেগে অন্য ফর্মগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন। কী দেখছেন, ভগবান জানেন। আমাদের কাজ শেষ। ওঁর জন্য অপেক্ষা করছি।
“আপনাদের কাজ শেষ স্যার?” ফর্মগুলোর ওপর চোখ বোলাতে বোলাতেই জিজ্ঞেস করলেন।
“আমাদের কাজ তো শেষ। কী দেখছেন এত?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“এখনও জানি না স্যার। মনে হচ্ছে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি!” ফর্মগুলো ফোল্ডারে পুরতে পুরতে বললেন। গলার স্বর শুনে মনে হল একটু যেন নিরাশ।
“আচ্ছা মিস শর্মিলার পার্মানেন্ট অ্যাড্রেসটা কি?”
প্রমথ উত্তর দিল, “বারুইপুর। পুরো ঠিকানাটা জানতে চান?”
“তার দরকার নেই স্যার, বারুইপুর তো কাছেই।” তারপর একটু মাথা চুলকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কালকে কি ওখানে একবার যাওয়া যায় স্যার?”
এখানে গাড়িধারী বলতে আমি। বারো বছরের পুরোনো গাড়ি। বাবা কিনেছিলেন, কিন্তু এখনও মোটামুটি চলছে।
“তা নিশ্চয় যাওয়া যায়, কিন্তু কারণটা কী?”
“দেখি স্যার, একটু কথা বলে আসি।”
.
রাত্রে বাড়ি ফিরে কী হল জানি না ফেসবুক খুলে বসলাম। ভাস্বতী যখন ফেসবুকে আছি কিনা জিজ্ঞেস করেছিল, তখন পুরো সত্যি কথা আমি বলিনি। ফেসবুকে আমার একটা অ্যাকাউন্ট আছে ‘দে দে’ নামে, কিন্তু সেটা নামে মাত্র। কালেভদ্রে সেখানে ঢুকি, বন্ধুবান্ধব সেখানে বিশেষ নেই। ফেসবুকে ঢুকে আমি ভাস্বতীর খোঁজ করলাম। কার্ডে ওর নাম ইমেল দুটোই ছিল। অনেকগুলো ভাস্বতী মিত্র আছে, তারমধ্যে একটাতে কোনো মুখই নেই, আরেকটাতে একটা কুকুরের ছবি। সেটাকেই খুললাম। দেখলাম বেশ কিছু বন্ধুর ছবি, বেশির ভাগই ওর বয়সি মেয়েদের। নন্দিতার কোনো ছবি দেখলাম না। হয়তো ও ফেসবুকে ছিল না। কয়েকটা মাত্র ছেলের ছবি। ফেসবুক একজনের বন্ধু-বান্ধব কারা, নিজের ওয়ালে সে কী লেখে, অন্যের লেখায় কী কমেন্ট করে –এসব থেকে তার চরিত্রের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ভাস্বতী? একটা ছেলের ছবি ক্লিক করে মনে হল এয়ারলাইনের কোনো বন্ধু। আরেকটা ছেলে আর্টিস্ট। আরেকটা ছেলে কী করে বুঝলাম না, কিন্তু তার ফেসবুক পাতায় একটা ছবি দেখে চমকে উঠলাম। শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘সুবর্ণরেখা’-র সামনে তোলা ছবি। ভাস্বতীর ফেসবুকের বন্ধুর পাশে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে, তাকে দেখতে অনেকটা নন্দিতার মতো! ছবির কোয়লিটিটা ভালো নয়। জোর করে কিছু বলা অসম্ভব। ছেলেটির নাম বীর, বীর রায়। মুখটা চেনা চেনা, কিন্তু প্লেস করতে পারলাম না।
দেখামাত্র একটা অশুভ চিন্তা আমাকে গ্রাস করল। একেনবাবু বলেছিলেন, খুনি। পুরুষমানুষ নাও হতে পারে। বীর রায় কি আগে ভাস্বতীর প্রেমিক ছিল? ভাস্বতাঁকে ডাম্প করে সে নন্দিতার কাছে যাওয়ার জন্য ভাস্বতী নন্দিতাকে খুন করেছিল? কিন্তু ভাস্বতাঁকে দেখে তো… ও মাই গড!
রাত্রি হয়ে গেছে পরের দিন সকালেই একেনবাবুকে ফোন করলাম। সব শুনে একেনবাবু বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। আমি একবার ছবিটা দেখতে চাই, কিন্তু আমার এখানে তো ইন্টারনেট নেই।”
“নো প্রব্লেম, আমি আজ মোবাইলে ছবিটা আপনাকে দেখাব। অন্য পসিবিলিটি হল, এই বীর রায়ও নন্দিতাকে খুন করতে পারে।”
“এটা কেন বলছেন স্যার?”
“নন্দিতার সঙ্গে শোবার পর ও বুঝতে পারে নন্দিতা ভার্জিন ছিল না। তখনই একটা তীব্র ঘৃণা জন্মায়। সেই ঘৃণাবশত পরে এসে খুন করে! আরও সম্ভবনা আছে। ধরুন, একাধিক যৌন-সঙ্গী থাকার ফলে নন্দিতার যৌনরোগ হয়েছিল। সেটা বীর রায়ের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিল। ঘৃণা হবার তো নানা কারণ থাকতে পারে!”
“সবই সম্ভব স্যার, সবই সম্ভব। বারুইপুর যেতে যেতে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।”
বারুইপুর যাবার সময়ে আমি আমার আই-ফোনে ফেসবুক খুলে একেনবাবুকে বীর রায় আর নন্দিতার ছবি দেখালাম। একেনবাবু ভালো করে ছবিটা দেখে জিজ্ঞেস করলেন “ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, মিস নন্দিতা কি না, তবে মিল আছে ঠিকই। আর কোনো ছবি আছে এঁদের দুজনের?”
আনফচুনেটলি ফেসবুক ফোল্ডারে বীর রায়ের বেশ কিছু সেলফি ছিল, কিন্তু নন্দিতার ছবি ছিল না। বীর রায়ের ছবিগুলো মন দিয়ে দেখলেন একেনবাবু।
“কী বুঝলেন?”
“আমি একটু কনফিউজড স্যার।”
“তার মানে?”
“তার মানে আপনি যা বলছেন, তা হতে পারে আবার নাও হতে পারে।”
প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল, “প্রোফাউন্ড স্টেটমেন্ট –হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে!” বলে পেছনের সিটে বসে একটা বই পড়ছিল তাতে মন দিল।
ছয়
বারুইপুরে পৌঁছে একটু ঘোরাঘুরির পর গন্তব্যস্থল খুঁজে পেলাম। একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত কলোনির ছোট্ট বাড়ি। বয়স্ক এক ভদ্রলোক বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন।
আমাদের দেখে পত্রিকাটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা?”
একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, আপনাদের একটু বিরক্ত করতে এসেছি। এটাই কি মিস শর্মিলার বাড়ি?”
শর্মিলার নামটা শুনে ভদ্রলোকের মুখটা কী রকম জানি হয়ে গেল। বললেন, “ছিল, কিন্তু সে তো আর বেঁচে নেই।”
“জানি স্যার। তাঁর খুনিকে ধরবার জন্যেই আমরা চেষ্টা করছি।”
“আপনারা কি পুলিশ?”
“না স্যার।”
“পত্রিকার লোক?”
“তাও না স্যার।”
“তাহলে!” ভদ্রলোকের চোখে বিস্ময় ও বিরক্তি।
আমি তখন এগিয়ে গিয়ে একেনবাবুর পরিচয় দিলাম। একটু ফলাও করেই দিলাম।
ভদ্রলোক চুপ করে শুনলেন।
“আমি শর্মিলার দাদু।”
একেনবাবু বললেন, “আমাদের দুয়েকটা প্রশ্ন ছিল স্যার, মিস শর্মিলা সম্পর্কে।”
“দেখুন, প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি। কাজের কাজ কিছু হয়নি। আমার মেয়ে এ নিয়ে আর কারোর সঙ্গে কথা বলছে না।”
“বুঝতে পারছি স্যার আপনাদের বেদনার কথা। কিন্তু শুধু দু-একটা প্রশ্নই করব।”
ভদ্রলোক পত্রিকাটা পাশে সরিয়ে রাখলেন। “বেশ, করুন।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আচ্ছা এই খুনের ব্যাপারে আপনাদের কাউকে সন্দেহ হয়?”
“না। আমার দিদিভাইয়ের কোনো শত্রু থাকতে পারে আমি কল্পনাও করতে পারি না।”
“কলকাতার মিস শর্মিলার বন্ধুবান্ধবদের কাউকে চেনেন?”
“না, তেমন কারও কথা তো আমরা শুনিনি।”
“মিস নন্দিতার কথা?”
“নন্দিতা, নন্দিতা..” একটু ভাবলেন ভদ্রলোক। “একজন নন্দিতা তো খুন হয়েছে কিছুদিন আগে, তার কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ, স্যার।”
“না, তার কথা দিদিভাইয়ের কাছ থেকে শুনিনি। আপনি কি ভাবছেন ওদের মৃত্যুর মধ্যে কোনো যোগ আছে?”
“জানি না স্যার। তবে আর একটা অনুরোধ করছি, মিস শর্মিলার কোনো ফোটো আছে কি আপনাদের কাছে?”
“আছে। কিন্তু দিতে পারব না।”
“আমাদের দিতে হবে না স্যার, শুধু ছবিটা একটু দেখতে চাই।”
“বাইরের ঘরেই আছে। দরজা দিয়েই দেখতে পারবেন।” ভদ্রলোক দরজার দিকে আঙুল দেখালেন।
দরজা খোলাই ছিল। দরজার উলটোদিকের দেওয়ালে ঝুলছে মালা দেওয়া একটা ফোটো। কী আশ্চর্য এরকম ফোটো তো আগেও দেখেছি!
“অনেকটা নন্দিতার মতো চেহারা না?”প্রমথ চাপাস্বরে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল।
“অথবা ফেসবুকে বীর রায়ের সঙ্গে যে মেয়েটা, তার ছবি!” আমিও গলা নীচু করে বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাটা বললাম।
একেনবাবু দেখছি মাথা চুলকাচ্ছেন। “ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার।”
তারপর বৃদ্ধ ভদ্রলোককে বললেন, “আর বিরক্ত করব না স্যার, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”
ভদ্রলোক কিছু বললেন না। মুখের ভাবটা যেন আরেকটা আপদ বিদায় হল!
গাড়িতে উঠতে উঠতে প্রমথ বলল, “মনে হচ্ছে উই আর ফেসিং এ ডেঞ্জারাস সিরিয়াল কিলার! আপনার কী মনে হয় একেনবাবু?”
“সেই কিলার কি বীর রায় হতে পারে?” আমি প্রশ্ন তুললাম।
যাকে প্রশ্নটা করা সারাটা পথ তিনি একটা কথা বললেন না।
“দুত্তোর” বলে আমরা অন্য গল্প করতে লাগলাম।
গল্প করতে করতে যখন গোলপার্কে এসে পৌঁছেছি, একেনবাবু হঠাৎ বললেন, “চলুন স্যার, মিলনী কাফেতে মোগলাই খাই।”
“খাই মানে কি? খাবেন না খাওয়াবেন?” প্রমথ প্রশ্ন করল।
“দুটোই স্যার।”
“কী ব্যাপার বলুন তো? এই তো সেদিন খাওয়ালেন!”
“কেন স্যার, আমি কি আপনাদের দু’দিন খাওয়াতে পারি না?”
“তা অবশ্যই পারেন, কিন্তু সেটা আপনার ক্যারেক্টারের সঙ্গে খাপ খায় না।”
“তুই চুপ কর তো!” আমি প্রমথকে ধমক লাগালাম। তারপর একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম। “কবে যেতে চান?”
“এখনি।”
“এখনি মানে! বউদি?”
“ফ্যামিলি গেছে দিদির বাড়িতে, খেয়েদেয়ে রাত্রে ফিরবে।”
“বুঝতে পারছি আপনার বাড়িতে খাবার নেই, কিন্তু একা গেলে তো খরচা কম পড়বে!” প্রমথ টিপ্পনি কাটল।
“একসঙ্গে খাবার আনন্দ তো পাব না স্যার!” এইরকম উতোর-চাপান চলতে চলতে আমরা মিলনী কাফেতে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের দেখে মৃত্যুঞ্জয়বাবু কাউন্টার থেকে উঠে এসে বললেন, “আমার সৌভাগ্য আবার আপনারা এলেন!”
“কী যে বলেন স্যার, মোগলাইয়ের স্বাদ যা পেলাম, ওটা কি একবার খেয়ে মন ভরে!”
“বেশ, আর কী খাবেন বলুন?”
“স্রেফ চা আর মোগলাই।” প্রমথই আগ বাড়িয়ে অর্ডার দিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বেশি খসাতে চাই না একেনবাবুকে।”
“কী মুশকিল স্যার, আরেকটা কিছু নিন!”
“আমি নেব না, বাপি তুই?”
“আমিও না।”
“তাহলে সবার জন্যে তাই হোক স্যার। ভালো কথা স্যার, আপনার ভাই মনোজবাবুর একটু সাহায্য লাগবে। ওঁর নম্বরটা আছে আপনার কাছে?”
“নিশ্চয়, দাঁড়ান আমি লিখে দিচ্ছি।”
একটা কাগজে নম্বরটা লিখে আমাদের চা আর মোগলাই পরোটার অর্ডার নিয়ে মত্যুঞ্জয়বাবু চলে গেলেন।
একেনবাবু দেখলাম চারিদিকে তাকাচ্ছেন।
“কাকে খুঁজছেন?”
“আপনার সেই রতনকে তো স্যার দেখছি না।”
“ছুটিতে নিশ্চয়।”
“তাই হবে।”
খানিকবাদে যে ছেলেটি আমাদের খাবার দিতে এল, সেই বোধ হয় হরি।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “রতন কোথায়?”
চারিদিকে তাকিয়ে একটু চাপা গলায় বলল, “রতনকে বাবু তাড়িয়ে দিয়েছেন?”
“সে কী! কাজে ফাঁকি দিচ্ছিল?”
ছেলেটি কোনো উত্তর দিল না।
“ও কী করছে এখন জানো?”
“না। তবে ফটিকদা বলতে পারবে, ওর দোকানে আসে।”
ফটিকের দোকান আমি চিনি। পাশের রাস্তায় একটু দূরে একটা পানের দোকান ছিল ফটিকের। এখনও যে দোকানটা আছে জানতাম না।
খেয়ে দেয়ে একেনবাবু বললেন, “চলুন স্যার, একবার ওই ফটিকবাবুর দোকানে যাওয়া যাক।”
“কী ব্যাপার! রতনের এত খোঁজ কেন?”
একেনবাবু উত্তর দিলেন না।
.
আমাদের ভাগ্য বলতে হবে। ফটিকের দোকানে গিয়ে দেখি রতন বাইরের টুলে বসে আছে।
“কী রে তোকে নাকি মৃত্যুঞ্জয়বাবু তাড়িয়ে দিয়েছেন! কী করেছিলি?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
আমাদের বিশেষ করে একেনবাবুকে দেখে রতনের মুখ সাদা হয়ে গেছে। ভীতভাবে একেনবাবুকে বলল, “বাবু আপনাকে কী বলেছেন জানি না, আমি কিন্তু চুরি করিনি বাবু।”
একেনবাবু সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “একটা কাজ করতে পারবে?”
“পারব বাবু, যা করতে বলবেন তা-ই করব।”
“ছেলেটা ভালো,” ফটিক রতনের হয়ে ওকালতি করল।” কেউ ওকে ফাঁসিয়েছে!”
“তাহলে এসো,” বলে একটু দূরে গিয়ে রতনকে কিছু একটা দেখালেন, একেনবাবু।
আমরাও যাচ্ছিলাম কী বলছেন শুনতে, কিন্তু ফটিক আটকাল, “আপনাদের জন্যে একটা ইস্পেশাল পান বানাচ্ছি। দারুন মশলা, খেয়ে দেখুন।”
ফটিকের পান এমনিতেই দুর্ধর্ষ। তার ওপর ইস্পেশাল মশলা! আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম।
সেখান থেকেই একেনবাবু কথা অস্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
“এরকম চেহারা?”
রতন দেখলাম মাথা নাড়ছে।
“কোথায় থাকে?”
মাথা নাড়া দেখে মনে হল জানে না।
আরও কিছু প্রশ্ন করলেন একেনবাবু। প্রশ্নগুলো শুনতে পেলাম না। মাথা নাড়া দেখে মনে হল দুয়েকবার ‘হ্যাঁ’ বলছে, কিন্তু বেশির ভাগ উত্তরই মনে হল রতনের জানা নেই।
ফেরার পথে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী দেখালেন রতনকে?”
“মিস নন্দিতার ছবি।”
“কী বলল?”
“বলল, আরও একটা মেয়েকে দেখেছে, ওই ধরণের চেহারার।”
“হয়তো শর্মিলার কথা বলছে।” প্রমথ বলল।
“অথবা অন্য কোনো মেয়ে,” একেনবাবু বললেন। “আজকাল স্যার সাজাগোজের জন্যে অনেকের মধ্যেই মিল খুঁজে পাওয়া যায়।”
“বীর রায়ের সেই মেয়েটা হতে পারে কি?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“কিছুই অসম্ভব নয় স্যার।”
“কী করে হয়? আমরা তো সবার ছবিই দেখলাম কালকে।”
“হয়তো সবার ছবি দেখিনি স্যার।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং। মিস শর্মিলার ছবি অ্যাপ্লিকেশন থেকে খুলে নেওয়া হয়েছিল সেটা তো দেখেছি। আপনি কি মনে করেন, এই মেয়েটির অ্যাপ্লিকেশনের পুরো ফর্মটাই ফোল্ডার থেকে কেউ সরিয়ে রেখেছিল!”
প্রমথ সোজাসুজি বলল, “কোচিং ক্লাসের মালিক ওই ধ্রুব দত্তকে আমার মোটেই পছন্দ নয়। ওর মধ্যে কিছু গোলমাল আছে। আই থিঙ্ক এ ব্যাপারে হি ইজ ইনভলভড।”
একেনবাবু শুধু বললেন, “এ মেয়ে যদি অন্য কেউ হয়, তাহলে আমাদের মেয়েটিকে খুঁজে বার করতে হবে স্যার।”
আমি বললাম, “সিরিয়াল কিলার যদি এই চেহারার মেয়েদের ধরে ধরে খুন করে, তাহলে তো শি ইজ ইন ডেঞ্জার!”
“সেটাই ঠেকাতে হবে স্যার।”
“কী করে?”
“ভাবার চেষ্টা করছি স্যার।”
“আপনি ভাবুন, আমি চললাম,” প্রমথ বলল। “সেই সকাল থেকে দৌড়াদৌড়ি! নিউ ইয়র্ক যাবার আগে এক গন্ডা জিনিস কিনতে হবে, ফালতু সময় নষ্ট হচ্ছে!” প্রমথ কখন ক্ষেপে যায় প্রেডিক্ট করা কঠিন।
আমার অপেক্ষা না করেই একটা ট্যাক্সি ধরে প্রমথ অদৃশ্য হল।
“আপনি কোথায় যাবেন, বাড়ি?” একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম।
“না স্যার, ফ্যামিলির ফিরতে এখনও দেরি। অধীর তো কাছেই থাকে, ওকে এই ব্যাপারটা জানিয়ে আসি। যদি মেয়েটার কোনো হদিশ করতে পারে।”
“চলুন, পৌঁছে দিই।”
“আরে না স্যার, এই তো কাছেই –হেঁটেই যাব।”
সাত
প্রমথর মতো আমারও বেশ কিছু কেনাকাটা ছিল। দু’টো দিন সেইসব জিনিস খুঁজে খুঁজে কিনতেই কাটল। এরমধ্যে একেনবাবু বা প্রমথ কারোর সঙ্গেই কথা হয়নি। একেনবাবুকে কয়েকবার ধরার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সব সময়েই ওঁর ফোন বিজি। শেষমেশ ধরতে পারলাম।
“কী ব্যাপার, আপনাকে তো ধরতেই পারা যায় না আজকাল!”
“কী যে বলেন স্যার আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।”
“কেন বলুন তো?”
“বিকেলে কয়েকজনকে আসতে বলেছি মিস নন্দিতার ব্যাপারে। আপনি প্রমথবাবুকে নিয়ে আসুন স্যার কেসটা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাবে।”
“আলোচনা মানে? রহস্যের কিনারা করে ফেলেছেন না কি?”
“একটু প্রোগ্রেস তো হয়েছে। কিন্তু কনফিউশনও কিছু আছে। সবার সাহায্য নিয়ে যদি ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে ফেলা যায়।”
“ঠিক আছে আসব। দেখি, প্রমথকে ধরতে পারি কি না।”
“কোথায় আসবেন, সেটা তো বলিনি স্যার।”
“কোথায়?”
“মিলনী কাফের ওপরে স্পোকেন ইংলিশ স্কুলে স্যার।”
“স্পোকেন ইংলিশ স্কুল!”
“হ্যাঁ স্যার, ওখানে অনেককে ডেকেছি। অধীরবাবুও থাকবেন।”
আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন দেখি, একেনবাবু আর অধীরবাবু মিলনী কাফের সামনে দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে কী জানি আলোচনা করছেন। সামনে আসতেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে চিনতে পারলাম শর্মিলার সেই দাদু! আমাদের দেখে একেনবাবু কথাবার্তা থামিয়ে বললেন, “চলুন স্যার, ওপরে যাওয়া যাক।”
ওপরে যাবার সিঁড়ি মিলনী কাফের পাশ দিয়ে। উঠে ল্যান্ডিং-এর ডানদিকে একটা মিটিং রুম। ইতিমধ্যেই সেখানে শুভেন্দু, মনোজবাবু, মৃত্যুঞ্জয়বাবু, ধ্রুব দত্ত এবং একজন অপরিচিত ভদ্রলোক বসে আছেন। রতনকেও দেখলাম বসে আছে একটা টুলের ওপর।
অধীরবাবু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মিস নন্দিতার মৃত্যুর খুনের ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত গোয়েন্দা একেনবাবুকে আমি অনুরোধ করেছি। তিনি এ ব্যাপারে কতগুলো প্রশ্ন আপনাদের করতে চান। সেইজন্যেই আপনাদের এখানে ডাকা হয়েছে।”
একেনবাবু কোনো ভনিতা না করেই শুরু করলেন, “দিন দশেক আগে মনোজবাবুর কাছে খবর পেয়ে শুভেন্দুবাবু আমার কাছে এসেছিলেন তাঁর বোন মিস নন্দিতার খুনিকে খুঁজে বার করতে।” এইটুকু বলে শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক কি না স্যার?”
শুভেন্দু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
“শুভেন্দুবাবু আমাকে বলেছিলেন, মিস নন্দিতার খোঁজ করতে উনি প্রথমে মিস নন্দিতার বিশেষ পরিচিত সমুদা মানে সমুবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। শুভেন্দুবাবু কি আমাকে ঠিক বলেছিলেন স্যার?”
অপরিচিত মাঝবয়সি যে ভদ্রলোক বসে ছিলেন তাঁকে উদ্দেশ্য করে একেনবাবু প্রশ্নটা করলেন। বুঝলাম উনিই হচ্ছেন সমুবাবু।
সমুবাবু মনে হল প্রশ্নটা শুনে একটু অস্বস্তি বোধ করছেন, কিন্তু ‘হ্যাঁ’ বলে মাথা নাড়লেন।
“তারপর আপনি আর শুভেন্দুবাবু মিস নন্দিতার ঘরে ঢুকে ওঁর মৃতদেহ আবিষ্কার করলেন। অর্থাৎ এর আগে স্যার আপনি জানতেন না যে মিস নন্দিতা মারা গেছেন। এটা কি ঠিক?”
সমুবাবু মাথা নাড়লেন।
“মনে হয় আপনি ঠিকই বলছেন স্যার, কারণ কোনো একটা কারণে মারা যাবার কয়েকদিন আগে থেকে মিস নন্দিতার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল না। কারণটা একটু বলবেন স্যার?”
সমুবাবুর মুখটা দেখলাম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চেয়ারের হাতলের ওপর রাখা হাতটা নার্ভাসনেসে একটু একটু কাঁপছে।
“ঠিক আছে স্যার, সে নিয়ে পরে আলোচনা হবে– অধীরবাবুই সেটা করবেন।”
এই কথায় সমুবাবু দেখলাম হাতলটা চেপে ধরে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছেন। একেনবাবু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে স্পোকেন ইংলিশ অ্যাকাডেমির মালিক ধ্রুব দত্তকে নিয়ে পড়লেন, “মিস নন্দিতা তো আপনাদের এখানে পড়তেন ধ্রুববাবু, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি কি ওঁকে ভালো করে চিনতেন স্যার?”
“হ্যাঁ, এখানে যারা পড়ে তাদের যেমন করে চিনি, সেরকমভাবেই চিনতাম।”
“আই সি। এখানে যাঁরা পড়েন স্যার, তাঁদের সবাইকে কি আপনি নিয়মিত রেস্টুরেন্টে নিয়ে যান?”
“দূর দূর থেকে অনেকে এখানে পড়তে আসে। তাদের অনেকেই পড়ার পর নীচে মিলনী কাফে বা কাছাকাছি রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। মাঝেমধ্যে আমিও তাদের সঙ্গে খাই।”
“সে তো অবশ্যই স্যার, তবে বিশেষ কারও কারও সঙ্গে কি ঘন ঘন খান?”
“কী বলতে চান আপনি?” ধ্রুববাবু আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বললেন।
প্রশ্নটা উপেক্ষা করে একেনবাবু মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে বললেন, “আপনি পুরো রেস্টুরেন্ট সামলাতে ব্যস্ত থাকেন সবার দিকে তাকানোর সময় আপনার থাকে না, তাই রতনকেই জিজ্ঞেস করি।”
একেনবাবু রতনকে কাছে ডাকলেন। তারপর নন্দিতার ছবিটা দেখিয়ে বললেন, “রতন, এঁকে তুমি আগে দেখেছ?”
“হ্যাঁ বাবু, নন্দিতাদি।”
“এঁর সঙ্গে কি ধ্রুববাবু মিলনী কাফেতে খেতে আসতেন?”
“হ্যাঁ বাবু।”
“মাঝেমধ্যে আসতেন, না প্রায়ই আসতেন?”
“প্রায় প্রতিদিনই আসতেন বাবু।”
“যতদিন এখানে মিস নন্দিতা পড়তেন ততদিন আসতেন?”
“না বাবু, শেষের দিকে আর আসতেন না।”
“আই সি। ঠিক আছে, তুমি যাও।”
একেনবাবু মাথাটা একটু চুলকোলেন। “আচ্ছা, আমাকে একটু বলুন তো স্যার, মিস নন্দিতার সঙ্গে কি আপনার ঝগড়া হয়েছিল?”
“এগুলো আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাকে আমি উত্তর দিতে বাধ্য নই।” ধ্রুববাবু বিরক্ত মুখে বললেন।
“স্যার, মিস নন্দিতা খুন হয়েছেন। আপনার সঙ্গে যদি ওঁর ঝগড়া হয়ে থাকে, তাহলে আপনি তো রাগবশত ওঁকে খুনও করতে পারেন, পারেন না?”
“কী উন্মাদের মতো কথা বলছেন আপনি, কারোর সঙ্গে খাচ্ছি না বলে তাকে আমি খুন করব!” ধ্রুব দত্ত রেগে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। “আর আমি তো পুলিশকে আগেই জানিয়েছি সেই রাত্রে আমি কোথায় ছিলাম!”
“ও হ্যাঁ স্যার, আমি তো সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। তাছাড়া আরও একজন খুন। হয়েছেন যাঁর নাম মিস শর্মিলা। তিনিও আপনার এই স্কুলে পড়তেন। তাঁর সঙ্গে তো আপনি বেশি খেতেনও না, তাই না?”
ধ্রুব দত্ত উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলেন। কিন্তু বুঝলাম রাগে ফুঁসছেন।
“ঘাবড়াবেন না স্যার, মিস নন্দিতার খুনের সঙ্গে আপনি জড়িত বলে মনে হয় না। আসলে স্যার, আপনার আর সমুবাবুর ব্যাপারটা একটু আলাদা। আপনারা খুনি নন ঠিকই, কিন্তু আপনাদের আচরণের মধ্যে যে সব রহস্য জড়িত সেগুলোও ক্লিয়ার হওয়া দরকার। অধীরবাবু সেগুলো নিয়ে পরে মাথা ঘামাবেন, আমাকে সেই কাজের ভার দেওয়া হয়নি। আমাকে বলা হয়েছেমিস নন্দিতার খুনিকে ধরতে সাহায্য করতে। আমি স্যার অন্যদিকে যাবই না, বরং এই খুনটা নিয়েই একটু ভাবি। মিস নন্দিতাকে খুন করা হয়েছে গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে। তারপর খুনি ছুরিও চালিয়েছে। এতে কোনো সমস্যা নেই স্যার, কিন্তু মিস নন্দিতার গলায় দড়ির ফাঁসও লাগানো ছিল। সেটা কেন? দিস ট্রাবলড মি স্যার, ট্রাবলড মি এ লট!”
“তারপর জানলাম আরও একজন প্রায় একইভাবে খুন হয়েছিলেন। তিনি হলেন মিস শর্মিলা। তাঁকেও শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। পরে গলায় একটা দড়ির ফাঁস লাগানো হয়। শর্মিলা কিন্তু শ্বাসরোধের সঙ্গে সঙ্গে মরেননি। মারা গিয়েছিলেন হাসপাতাল যাবার পথে। দ্বিতীয়বার মনে হয় খুনি সেই চান্সটা নিতে চায়নি, মৃত্যু নিশ্চিত করতে সেই সঙ্গে ছুরিও চালিয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই খুনি ভিকটিমের পরিচিত, নইলে দরজা না ভেঙে ঘরে ঢুকে গলা টিপে হত্যা করা সম্ভব হতো না। দুটো ক্ষেত্রেই শরীরের অনাবৃত অংশে অত্যাচারের চিহ, দুজনের ওপরেই খুনির একটা তীব্র রাগ ও ঘৃণা যেন প্রকাশ পেয়েছে। যাঁরা খুন হয়েছেন তাঁদের কল্পনাতেও আসেনি খুনির এই মনোভাবের কথা।
আরেকটা দিক স্যার খুবই ইন্টারেস্টিং –মিস শর্মিলা আর মিস নন্দিতার চেহারা অনেকটা একই ধরণের, একজনকে দেখলে আরেকজনের কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক। তখনই আমি বুঝলাম স্যার, আমরা এখানে একজন খুনির খোঁজ করছি যে হল ‘মিশন ওরিয়েন্টেড কিলার’। এ ধরণের খুনিরা মনে করে, এক ধরণের চেহারার মানুষের পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার নেই! কেন সেটা মনে করে, তার নানান রকমের সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যা থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে মিস নন্দিতা বা মিস শর্মিলার চেহারা দেখে তাদের প্রতি খুনির একটা তীব্র বিদ্বেষ নিঃসন্দেহে জেগে উঠেছিল। কিন্তু কেন, সেটাই আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম, তখন আমার মনে পড়ল, বাপিবাবুই তো চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে সেটা দেখিয়েছিলেন!”
কথাটা শুনে আমি অবাক হয়ে একেনবাবুর দিকে তাকালাম!
“হ্যাঁ স্যার, আপনি। আপনি ফেসবুক থেকে বীর রায়ের পাতাটা দেখালেন, যেখানে বীর রায় তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই বান্ধবীর চেহারা দেখে আপনি ভেবেছিলেন মিস নন্দিতা। না তিনি মিস নন্দিতা ছিলেন না। কিন্তু কে এই বীর রায়? মনোজবাবুকে ফোন করে জানলাম আবীর রায়ের ডাক নাম ছিল বীর। আবীর রায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন যখন তাঁর বান্ধবী তাঁকে ছেড়ে দিয়ে চলে যান।”
এবার একেনবাবু মৃত্যুঞ্জয়বাবুর দিকে তাকালেন।
“স্যার, একমাত্র সন্তানের মৃত্যুশোক এমনিতেই বিষম শোক, আরও অসহনীয় হয় যখন সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। আপনি শুধু ভেঙে পড়েননি স্যার, আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ। আপনার সন্তানের মৃত্যুর জন্যে দায়ী করছেন শুধু সেই বান্ধবীকে নয়, তার মতো চেহারার প্রত্যেকটি মেয়েকে। সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে চলেছেন। তাদের হত্যা করে, গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে, অত্যাচার করে! কোন অছিলায় আপনি ঢুকেছিলেন জানি না, কিন্তু দুটি মেয়েই আপনাকে স্নেহশীল কাকা বা জ্যাঠা ভেবে ঘরে ঢুকতে দিয়েছিল…।”
মৃত্যুঞ্জয়বাবু দেখলাম উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওঁর নির্লিপ্ত মুখটা দেখে বোঝার উপায় নেই যে কী নৃশংস কাজ উনি করেছেন! বিচিত্র এই পৃথিবী, বিচিত্র এই মানুষের মন!
.
৷৷ পরিশিষ্ট ৷৷
আমি একেনবাবুকে বললাম, “আমি তো বুঝতেই পারিনি কেন সেদিন আপনি মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কাছে মনোজবাবুর ফোন নম্বর চাইছিলেন? কিন্তু শিওর হলেন কী করে যে মৃত্যুঞ্জয়বাবুই খুনি?”
“স্যার, আবীরবাবু আর মনোজবাবুর মুখের মধ্যে একটা আদল আছে। তারপর যখন জানলাম ওঁর ডাকনাম বীর। তখন অধীরকে দিয়ে খুঁজে বার করলাম মৃত্যুঞ্জয়বাবুর ব্লাডগ্রুপ।”
“খুঁজে বার করলেন মানে?”
“সে কী স্যার, মনে নেই রেস্টুরেন্টে ডাকাতির সময় ওঁর গুলি লাগে! গুলি বার করতে যখন ওঁর সার্জারি হয়, হাসপাতালে রুটিন ব্লাড টেস্ট করা হয়েছিল। ব্লাড গ্রুপটা মিস নন্দিতার বিছানায় পাওয়া রক্তের সঙ্গে ম্যাচ করল। এখন ডিএনএ-র বেজাল্ট পেতে হবে কেসটা ফুল-প্রুফ করার জন্যে।”
