হরপ্পার শিলালিপি (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত
এক
গোয়েন্দা হিসেবে একেনবাবুর দেশে যতটা পরিচিতি থাকা উচিত নিঃসন্দেহে তা নেই। প্রমথ কয়েক বছর আগে কলকাতা গিয়ে একটা র্যান্ডাম স্যামপ্লিং করেছিল। পঞ্চাশ জনকে প্রশ্ন করেছিল, তাদের একজনও একেনবাবুকে চিনতে পারেননি। আগেই বলে রাখি প্রমথর উদ্যোগী হয়ে এই স্যাম্পেল সার্ভে করার উদ্দেশ্য একেনবাবুর পপুলারিটি বিচার নয়। একেনবাবু নিজে প্রচারবিমুখ। একেনবাবুর কীর্তিকলাপ আমিই এক আধ সময়ে পত্রপত্রিকায় লিখেছি। প্রমথর এই উদ্যোগ লেখক হিসেবে আমি কতটা অক্ষম সেটা প্রমাণ করা।
এরপর একেনবাবু সম্পর্কে আমি আর কিছু লিখব না বলে ঠিক করেছিলাম, কিন্তু আবার কলম ধরলাম ভৈরব মিত্রের তাগাদায়। ভৈরববাবু কুইন্সে থাকেন। ম্যানহাটানের ‘রাজা-অ্যাণ্ড-রাণী’ রেস্টুরেন্টের মালিক। যখনই ওঁর সঙ্গে দেখা হয় জিজ্ঞেস করেন, “কী মশাই, একেনবাবুর লেখাটা কদ্দূর এগোল?”
আমার লেখা নিয়ে ভৈরব মিত্রের এই আগ্রহটা অবশ্য একেবারে নিঃস্বার্থ নয়। ওঁর রেস্টুরেন্ট থেকে বেশ কিছুদিন ধরে কাপ-ডিশ, কাঁটা-চামচ এইসব চুরি হচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল রেস্টুরেন্টেরই কেউ এর মধ্যে জড়িত। একেনবাবু ওখানে এক-আধবার খেয়েছেন। ভৈরব মিত্র এসে ধরলেন একেনবাবুকে। দুদিনের মধ্যে বামাল-সমেত চোর গ্রেফতার। ভৈরব মিত্রের খুব ইচ্ছে সেই সম্পর্কে আমি লিখি। ওঁর রেস্টুরেন্টের তাতে একটা পাবলিসিটি হবে। প্রমথর র্যান্ডাম স্যামপ্লিং-এর খবরটা নিশ্চয়ই জানতেন না। সে কথা থাক, ভৈরব মিত্রের ছিঁচকে চুরির গল্প লেখার জন্য আমি কলম ধরিনি। আমার লেখা কেউ পড়ুক না পড়ুক, একেনবাবুর কীর্তিকে আমি কোনোমতেই খাটো করতে চাই না। লিখছি অন্য একটা কাহিনি… গোড়া থেকেই শুরু করি।
.
আমি, একেনবাবু আর প্রমথ ধীরে সুস্থে আয়েস করে শনিবার সকালে ব্রেকফাস্ট শেষ করেছি। কলেজ নেই, তাই কোনো তাড়াও নেই। এমন সময় ডোর বেল। দরজা খুলে দেখি এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে, হাতে একটা হলুদ রঙের খাম। ভদ্রলোক একেনবাবুকে খুঁজছেন। আমি আঙুল দিয়ে একেনবাবুকে দেখিয়ে দিতেই ভদ্রলোক কেমন জানি নিষ্প্রভ হয়ে গেলেন। একেনবাবুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে এরকম রিয়্যাকশন অল্প বিস্তর সবারই হয়। ওঁর পোশাক বা চেহারা কোনোটাই ইম্প্রেসিভ নয়। যাঁরা প্রথম দর্শনের এই ধাক্কা সামলাতে পারেন, আখেরে অবশ্য তাঁরাই লাভবান হন। দ্য নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ-এর প্রফেসর জন গেরহার্ট যে সেই দলেই পড়বেন বুঝলাম। ভেতরে ভেতরে দমে গিয়ে থাকলেও বাইরে তা মোটেই প্রকাশ পেল না। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, “অসময়ে এসে পড়েছি। ফোন নম্বরটা ছিল না, তাই ফোন করতে পারিনি…”
বলতে বলতেই ওঁর নজরে পড়ল ব্রেকফাস্টের কাপডিশগুলো তখনও টেবিলে।
“আপনাদের বোধহয় ব্রেকফাস্ট শেষ হয়নি।”
“কী যে বলেন স্যার, আসার আবার সময় অসময় কি। তাছাড়া খাওয়া শেষ হয়ে গেছে।”
ভদ্রলোক আমার আর প্রমথর দিকে তাকালেন বোধহয় কনফার্মেশনের জন্য।
আমি কাপ-ডিশগুলো সরাতে সরাতে বললাম, “হ্যাঁ, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা গল্প করছিলাম। আপনি প্লিজ বসুন।”
“থ্যাঙ্ক ইউ” বলে অধ্যাপক চেয়ারে বসলেন।
আমাদের দুজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে একেনবাবু সবাইকে যা বলেন সেটাই আওড়ালেন। “আপনার যা বলার স্যার, এঁদের সামনে স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। আমরা এক টিমে।”
দুয়েকটা মামুলি কথাবার্তার পর প্রফেসর বললেন, “আসলে কাহিনিটা একটু দীর্ঘ।”
“তাতে কী হয়েছে। বলুন স্যার, আমরা তো বসেই আছি।”
“বেশ, বলছি,” প্রফেসর শুরু করলেন। “কিছুদিন আগে ওয়াশিংটন স্কোয়ার পার্কে আপনাদের দেশের এক মহিলা দীপা রয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পার্কে যখন হাঁটতাম, দীপাকে দেখতাম একা একা বেঞ্চে বসে আছেন। একদিন নিজেই গিয়ে আলাপ করলাম। আলাপ হয়ে যাবার পর থেকে হাঁটার আগে কিছুক্ষণ ওঁর পাশে গিয়ে বসতাম। সেই ‘কিছুক্ষণ’টা বাড়তে লাগল। একটু একটু করে ওঁর ব্যক্তিগত অনেক কথাই জেনে গেলাম।”
এরপর যা বললেন সেটা সত্যিই দীর্ঘ কাহিনি, সংক্ষেপে লিখছি…
দীপার স্বামী দেবেশ রয় ইণ্ডিয়ান আর্কিওলজিকাল সার্ভেতে কাজ করতেন। রিটায়ার করার কিছুদিন আগে একটা ফেলোশিপ নিয়ে আমেরিকা এসেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ হরপ্পায় গিয়ে রিসার্চ করার একটা সুযোগ এসে যায় বলে ফেলোশিপ শেষ না করেই দেশে ফিরে যান। দেশে কয়েকদিন থেকেই হরপ্পা। হরপ্পা যাবার পর দেবেশের কাছ থেকে শুধু কয়েকটা চিঠি আর একটা ফোন এসেছিল। হরপ্পা-ক্যাম্পসাইটে ফোন না থাকায় চিঠি ছাড়া যোগাযোগ করারও কোনো উপায় ছিল না। বেশ ক’দিন চিঠি আসছে না। হঠাৎ পুলিশ এসে জানাল দেবেশ একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ওঁর ডেডবডি ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। এর থেকে বেশি স্থানীয় পুলিশ জানে না। দীপা নানান জায়গায় চেষ্টা করে শেষে ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনের অফিস থেকে জানতে পারেন যে ক্যাম্পের সিকিউরিটির সঙ্গে ডাকাতের গুলি চালাচালির সময়ে দেবেশের মৃত্যু ঘটেছে। ওঁর জিনিসপত্র লুঠ হয়ে গেছে। পাকিস্তান পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউই ধরা পড়েনি।
এটা প্রায় চার বছর আগের ঘটনা। মাস ছয়েক আগে আরিফ নামে একটি লোক বাড়িতে আসে। সে নাকি হরপ্পায় দেবেশের দেখাশোনা করত! আরিফের কাছ থেকে দীপাদেবী জানতে পারেন, কোনো জরুরি কাজে দেবেশ ওঁর স্যুটকেস নিয়ে স্টেশনে যাচ্ছিলেন, আরিফও সঙ্গে ছিল। দেবেশ গাড়িতে ওঠার সময়ে কেউ ওকে গুলি করে। ড্রাইভার ভয় পেয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয়। আরিফ গাড়িতে উঠে পড়েছিল বলে নামতে পারেনি। যাইহোক, আরিফ যখন স্যুটকেস নিয়ে ক্যাম্পসাইটে ফিরে আসছে তখন শোনে দেবেশ মারা গেছেন, পুলিশ আরিফকে খুঁজছে। সেই শুনে আরিফ পালিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে লুকিয়ে থাকে। দেবেশের দিল্লীর ঠিকানা আরিফ জানত না। কিছুদিন আগে কারোর কাছ থেকে পায়। কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলায় আগে আসতে পারেনি। তারপর লোকটি দীপাকে বলে –দেবেশসাব ওকে অনেক সাহায্য করেছেন, সুটকেসটা মেমসাবের কাছে পৌঁছে না দিলে ওর গুণাহ হবে।
স্ট্রেঞ্জ স্টোরি। যাইহোক, সুটকেসটা দেবেশরই। জামাকাপড় আর টুকিটাকি জিনিস ছাড়া আরও দুটি জিনিস সেখানে ছিল, একটা নোটবই আর চিত্রবিচিত্র খোদাই করা চ্যাপ্টা মতো একটা পাথরের টুকরো। নোটবই নানান স্কেচে ভর্তি। এক জায়গায় লেখা, ‘ফাইনালি দ্য মিস্ট্রি উইল বি সলভড়। কিসের মিস্ট্রি তার উল্লেখ অবশ্য নেই। এত বছর বাদে হঠাৎ স্বামীর জিনিসগুলো দেখে দীপা ন্যাচেরালি খুবই আপসেট হয়ে যান। এদেশে ওঁর ছেলেকে ফোন করেন। মায়ের মানসিক অবস্থা বুঝে সেই উদ্যোগ করে মা-কে এখানে নিয়ে আসে।
পাথরটার ব্যাপারে প্রফেসর গেরহার্টের যদিও ঔৎসুক্য ছিল, কিন্তু প্রসঙ্গটা এত ডেলিকেট ওঁদের মধ্যে এ নিয়ে তখন আর কোনো কথা হয় না। কয়েকদিন বাদে দীপা নিজেই প্রফেসরকে জানান উনি স্বামীর স্যুটকেসে পাওয়া পাথরটাকে নিয়ে এসেছেন। শোনামাত্র প্রফেসর বলেন দীপার উচিত কোনো মিউজিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করা। দীপা কাউকেই এদেশে চেনেন না। ওঁর ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, তার এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহই নেই। তখন প্রফেসর গেরহার্ট নিজেই উদ্যোগী হয়ে মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট-এ ওঁর এক পুরোনো বন্ধুকে ফোন করেন। বন্ধুটি নিজে এককালে সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। এছাড়া প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসরকে চেনেন যাঁর হরপ্পার ব্যাপারে ইন্টারেস্ট আছে। বন্ধু পাথরটা দেখতে চাওয়ায় দীপা ওঁদের দু’জনকে বাড়িতে আসতে বলেন। পরের দিন দীপার বাড়িতে গিয়ে ওঁরা দেখেন একটা চৌকো চ্যাপটা পাথর। লম্বায় বড়োজোর আট ইঞ্চি, চওড়া হবে ইঞ্চি চারেক। পাথরটার দু’দিকেই অনেক চিহ খোদাই করা। আঁকিবুকিগুলো দু’রকমের দেখে বন্ধুর মনে হল এটা ‘রোসেটা স্টোন’-এর মতো কিছু হতে পারে। কয়েকটা ছবিও তুললেন, পরে ভালো করে স্টাডি করবেন বলে।
এখানে বলে রাখি ‘রোসেটা স্টোন’ জিনিসটা কী আমার কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু প্রফেসর গেরহার্ট এমনভাবে কথাটা বললেন যেন আমাদের সবার সেটা জানা উচিত। আমি আর প্রমথ চুপ করে ছিলাম, একেনবাবু বললেন, “আমি স্যার কনফিউজড়, রোসেটা স্টোন…?”
“না, না, ঠিক রোসেটা স্টোন নয়, আমি বলতে চাইছিলাম বাই-টেক্সট স্টোন।”
এই প্রাঞ্জল ব্যাখ্যাটাও আমার মাথায় ঢুকল না। প্রমথও চুপ। শুধু একেনবাবু বললেন, “তাও বুঝলাম না স্যার।”
প্রফেসর গেরহার্ট তখন ব্যাপারটা বিশদ করলেন। মিশরের লিপির সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছিল রোসেটা স্টোন পাবার পর। কারণ পাথরের ওই টুকরোর উপরে মিশরীয় ও গ্রীক ভাষায় একই কথা তিনটি বিভিন্ন লিপি –হাইরোগ্লিফিক, ডেমোনিক ও প্রাচীন গ্রীক ব্যবহার করে লেখা ছিল। যেহেতু গ্রীক লিপিটা পন্ডিতদের জানা ছিল, পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মিশরের লিপির পাঠোদ্ধারও সম্ভব হয়। দীপাদেবীর পাথরটা দেখে ওঁর বন্ধুর মনে হয়েছিল একদিকের আঁকিবুকিগুলো সিন্ধুলিপির মতো, অন্যদিকটা মোটেই সেরকম নয়। সুতরাং এটা সম্ভবত বাই-টেক্সট অর্থাৎ দু’রকমের লিপি-যুক্ত পাথর। অন্য লিপিটা জানা থাকলে, সিন্ধু-লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হতে পারে।
এইবার বুঝলাম। সেইজন্যই মনে হয় দেবেশবাবু নোটবইয়ে লিখেছিলেন, ফাইন্যালি দ্য মিস্ট্রি উইল বি সলভড়। সেকথা থাক, আগে প্রফেসরের কাহিনিটা শেষ করা যাক —
কয়েকদিন আগে প্রফেসর গেরহার্টের বন্ধু ফোন করে জানান তিনি প্রিন্সটনে খোঁজ নিয়েছেন। হরপ্পার সবচেয়ে বড়ো অথরিটি রবার্ট উড বছর পাঁচেক হল রিটায়ার্ড। রিসার্চ প্রফেসর হিসেবে বছর দেড়েক আগেও ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এখন আর নন। ফোনে যোগাযোগ করার উপায় নেই, পুরোনো নম্বরটা ডিসকানেক্টেড। রবার্ট উডের ঠিকানা অবশ্য পেয়েছেন, নিউজার্সি আর পেনসিলভ্যানিয়ার বর্ডারে ছোট্ট পাহাড়ি শহর পোকোনোর একটা ঠিকানা। তবে যেটা মোস্ট এক্সাইটিং নিউজ, সেটা হল মেট্রোপলিটান মিউসিয়াম অফ আর্ট পাথরটা কিনতে খুবই ইন্টারেস্টেড। এক্সপার্টদের দিয়ে আসল নকল বিচার করার পর এ নিয়ে ফাইনাল কথা হবে। প্রফেসর উডের ঠিকানা আর মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম আর্ট-এর কনট্যাক্ট পার্সনের নাম আর ফোন নম্বর সঙ্গে সঙ্গে লিখে নিলেন প্রফেসর গেরহার্ট। পরের দিন দীপার সঙ্গে দেখা হতেই সেগুলো দীপাকে দিলেন। দীপা কিন্তু পাথর বিক্রির ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখালেন না। সোজাসুজি
বললেন স্বামীর স্মৃতিচিহ হিসেবে ওটা উনি কাছে রাখতে চান।
এর মধ্যে তিন দিনের জন্য প্রফেসর গেরহার্টকে বাইরে যেতে হল। ফিরে এসে পার্কে কয়েকদিন দীপাকে দেখতে না পেয়ে বাড়িতে খোঁজ নিতে গেলেন। গিয়ে দেখেন দীপা শারীরিক ও মানসিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত। শুনলেন ওঁর সেই পাথর কেউ চুরি করেছে।
প্রফেসর গেরহার্ট স্তম্ভিত। জিজ্ঞেস করলেন, “কারা ওই পাথরের কথা জানত?”
দীপার উত্তর, শুভ, প্রফেসর গেরহার্ট আর গেরহার্টের বন্ধু ছাড়া আর কেউই না।
প্রফেসর গেরহার্ট জানতে চাইলেন, দীপা পুলিশে খবর দিয়েছেন কিনা।
দেননি।
দীপাদেবীর ছেলে শুভ সেখানে ছিল। তার ধারণা কোনো বড়ো চক্র নিশ্চয় এর পেছনে কাজ করছে। কারণ দেশেও একবার ওটাকে চুরি করার চেষ্টা হয়েছিল।
এই খবরটা অবশ্য গেরহার্ট সাহেব আগে জানতেন না। কিন্তু দীপা বললেন কথাটা সত্যি ।
শুভ বারবার বলছিল, পাথরটা নিশ্চয় খুব মূল্যবান। যদিও সোজাসুজি কিছু বলেনি, কিন্তু মনে হল শুভ বিরক্ত যে অধ্যাপক গেরহার্ট পাথরটার কথা বাইরে প্রচার করেছেন।
দীপা সেটা আঁচ করলেন। প্রফেসরের অস্বস্তি এড়ানোর জন্যই বোধহয় শুভকে বললেন, ‘চুপ কর শুভ, যা গেছে তা গেছে। এখন সব কিছু ভুলে যাওয়াই আমার উচিত।’
প্রফেসর গেরহার্ট ওঁর কাহিনি শেষ করে বললেন, “দেখুন, দীপা কেন পুলিশকে রিপোর্ট করেননি জানি না। কিন্তু আমি এই চুরির মধ্যে জড়িয়ে গেছি। যেহেতু আমিই পাথরটার কথা প্রথম জেনেছি আর আমার জন্য আর কয়েকজন জেনেছেন। বুঝতে পারছেন কি বলছি?”
“বোধহয় পারছি স্যার,” একেনবাবু মাথা চুলকে বললেন। আপনি হয়তো ভাবছেন দীপাদেবী আপনাকে সন্দেহ করেন আর সেই কারণেই থানা-পুলিশ করছেন না।”
“হয়তো। কিন্তু উনি হলেন খাঁটি ভদ্রমহিলা। সন্দেহ করলেও সেটা জানতে পারব না। যাইহোক ব্যাপারটা নিয়ে অত্যন্ত ডিসট্রেসড হয়ে আছি। কালকে মেট্রোপলিটাম মিউজিয়াম অফ আর্ট-এর সেই বন্ধুকে ফোন করেছিলাম। ওই বলল নিউ ইয়র্ক পুলিশের ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নাকি আপনার গুণমুগ্ধ। আপনার এই বাড়িটা ও চিনত। কিন্তু ফোন নম্বর জানত না। মিস্টার সেন, ওটা প্লিজ খুঁজে দিন, একটা বিরাট বোঝা বুক থেকে নেমে যাবে।”
একেনবাবু বললেন, “তা তো বুঝতে পারছি স্যার, কিন্তু ম্যাডাম যদি ইন্টারেস্টেড না হন।”
প্রফেসরের মুখে একটা বিস্ময় লক্ষ্য করে আমি বললাম, “উনি দীপা রয়ের কথা বলছেন।”
“না, না, দীপা পুলিশের কাছে যেতে চান না, কিন্তু আপনি এ নিয়ে খোঁজখবর করলে ওঁর কোনো আপত্তি নেই। আমি সকালে ওঁর সঙ্গে কথা বলেই আপনার কাছে এসেছি।” তারপর একটু চুপ করে বললেন, “দেখুন আমি মাস্টারি করি, বড়োলোক নই। আপনার ফি আমি যতটা সম্ভব মেটাবার চেষ্টা করব। কিন্তু আমার সামর্থ অল্প।”
“ছি ছি স্যার, টাকাকড়ি নিয়ে ভাবছেন কেন। আমাদের দেশের লেডি বিপদে পড়েছেন, এটা তো আমাদের কর্তব্য স্যার। ভালোকথা, আপনার কাছে পাথরটার কোনো ছবি আছে কি?”
“আছে। আমার বন্ধু যে ছবিগুলো তুলেছিল তার একটা করে কপি।” হাতে ধরা হলুদ খামটা খুলে প্রফেসর কয়েকটা ছবি বার করলেন। সেইসঙ্গে একটা কাগজ যেখানে নিজের, ওঁর মিউজিয়ামের বন্ধু, প্রিন্সটনের রিটায়ারড প্রফেসর উড, দীপাদেবীর বাড়ির ঠিকানা –সবকিছুই গুছিয়ে লেখা রয়েছে। “আর এইটাও আপনি রাখুন বলে এক হাজারের ডলারের একটা চেক একেনবাবুর হাতে দিলেন। কিছু খরচাপাতি তো হবে আপনার।”
“এটা না দিলেই চলত স্যার।”
“আমার চলত না, ওটা দয়া করে রাখুন। আরেকটা কথা, দীপা জানেন যে আপনি এ ব্যাপারে খোঁজখবর করবেন। কিন্তু উনি নিজে এর মধ্যে জড়াতে চান না। স্বভাবতই একটু ভয় পাচ্ছেন। তাই আমার অনুরোধ যতটা সম্ভব দূরত্ব বাঁচিয়ে কাজটা আপনি করবেন।”
“তা করব, কিন্তু একবার ওঁর সঙ্গে আমার কথা বলা প্রয়োজন। এখানে আসতে পারলে ভালো হয়। অবশ্য আমরাও যেতে পারি ওঁর কাছে।”
“ঠিক আছে, আজ বিকেলে উনি পার্কে এলে ওঁকে বলব এখানে আমার সঙ্গে একবার আসতে। মনে হয় না ওঁর আপত্তি হবে বলে।”
“শুধু আরেকটা প্রশ্ন স্যার, কাদের সঙ্গে ওঁর স্বামী হরপ্পায় গিয়েছিলেন?”
“সেই প্রশ্নটা আমি প্রথমেই করেছিলাম। কিন্তু উনি স্বামীর কাজকর্মের খবর একেবারেই রাখতেন না। শুধু জানতেন মাস তিনেকের প্রজেক্ট, কিন্তু দু’মাস যেতে না যেতেই সব শেষ।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”
দুই
দীপাদেবী সেই বিকেলেই প্রফেসর গেরহার্টের সঙ্গে এলেন। দেখলে বোঝা যায় এককালে খুব সুন্দরী ছিলেন। তবে বয়সের ভাবে সেই সৌন্দর্য অনেকটাই চাপা পড়েছে। তার ওপর নিঃসন্দেহে উনি মানসিক অবসাদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। চোখের নীচে কালি, মুখটা বিষাদময়, নিজেকে যেন টেনে টেনে বয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রফেসর সঙ্গে ছিলেন বলে উনি ইংরেজিতেই কথাবার্তা বললেন। কনভেন্টে পড়াশুনা করেছেন নিশ্চয়, আমাদের মতো হোঁচট খাওয়া ইংরেজি নয়। একেনবাবুকে বললেন, “দেখুন এ নিয়ে আমি একেবারেই জলঘোলা করতে চাইছি না। আমার অনেক গিয়েছে। একটা পাথরের টুকরো থাকল না গেল, তাতে কিছু এসে যায় না।”
একেনবাবু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি পাথরটা খুঁজে বার করি ম্যাডাম, সেটা আপনি চান না?”
“না,” স্পষ্টভাবেই দীপাদেবী বললেন, “যা যাবার তা গেছে।
প্রফেসর গেরহার্ট বিশদ করলেন, “দীপা আর এ নিয়ে খোঁজ খবর করতে চাইছেন না। আমি খুব সরি, আমার প্রথমে মনে হয়েছিল আপনি কেসটা নিলে ওঁর হয়তো আপত্তি হবে না। কিন্তু উনি সত্যিই ব্যাপারটা ভুলে যেতে চান।”
“তাহলে তো স্যার আমাদেরও ভুলে যেতে হয়,” কথাটা বলে একেনবাবু ঘরে গিয়ে গেরহার্ট সাহেবের চেকটা নিয়ে ওঁর হাতে ধরিয়ে দিলেন।
গেরহার্ট সাহেব লজ্জিতভাবে বললেন, “এটা কেন ফেরৎ দিচ্ছেন!”
“সে কি স্যার, আমি তো কোনো কাজই করিনি আপনার জন্য।”
“কিন্তু এতটা সময় দিলেন আমার কথা শুনতে…।”
“কী যে বলেন স্যার!”
.
দীপাদেবীকে নিয়ে প্রফেসর চলে যাবার পর, একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “ভেরি কনফিউজিং।”
“তা তো বটেই, প্রমথ বলল, “তার ওপর ডিপ্রেসিং, ধাঁ করে হাজার ডলার ঘরে এল আবার সাঁ করে বেরিয়ে গেল!”
আমি বললাম, “যাই বলিস, এই বয়সেও ভদ্রমহিলা কিন্তু খুবই সুন্দরী।”
প্রমথ বলল, “শালা, তোর লজ্জা করে না, মায়ের বয়সি মহিলা।”
“ইডিয়টের মতো কথা বলিস না। একটা জেনারেল স্টেটমেন্ট করছি। আর সেই সঙ্গে এও বলছি, ভদ্রমহিলার মস্তিষ্কে একটু ব্যামো আছে।”
আমার ধারণা প্রমথও সেটা বুঝেছে। কিন্তু তর্কের খাতিরে বলল, “এটা কেন বলছিস?”
“কারণ, জিনিস চুরি হয়েছে, পুলিশকে রিপোর্ট করছেন না। একেনবাবুকে ভার দিতে রাজি হয়ে পরে বেঁকে বসেছেন। এতো পিওর ক্ষ্যাপামি।”
“দুটোরই এক্সপ্লানেশন আছে, প্রমথ বলল। “এক নম্বর, উনি দেশ থেকে এসেছেন। দেশে থানা-পুলিশ করা মানে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। ভালোর থেকে মন্দ বেশি হয়। উনি নিশ্চয় এদেশেও তাই হবে ধরে নিয়েছেন। দ্বিতীয়, একেনবাবুর কেপেবিলিটি সম্পর্কের ওঁর আস্থা থাকার কোনো কারণ নেই। উইথ অল ডিউ রেস্পেক্ট একেনবাবু, আপনার চেহারাটা মোটেই ইমপ্রেসিভ নয়। কতদিন ধরে বলছি পোষাকটা অন্ততঃ একটু ভদ্রস্থ করুন।”
“তুই থামবি!” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম।
একেনবাবু প্রমথর অপমানগুলো গায়েই মাখেন না। বরং বললেন, “প্রমথবাবুর কথাগুলো কিন্তু একেবারে ফ্যালনা নয় স্যার, মানতেই হবে।”
“তুই অত্যন্ত ডিসরেস্পেক্টফুল,” আমি প্রমথকে বললাম।
“ডিসরেস্পেক্টের কী দেখলি? আমি তো একেনবাবুর ক্ষমতাকে অস্বীকার করছি না, ওঁর প্যাকেজিংটা ঠিক নয়। মাল ভালো হলে তো শুধু চলবে না, মার্কেটিংটাও দেখতে হবে। ভালোকথা, কী বুঝছেন একেনবাবু, কেসটা সম্পর্কে?”
“খুবই কনফিউজিং স্যার।”
“কিচ্ছু কনফিউজিং নয়,” প্রমথ কনফিডেন্টলি বলল, “আমার থিওরি শুনবেন?”
“বলুন স্যার।”
“দীপাদেবীর সুপুত্র শুভই এই অশুভ কাজটি করেছে। পাথরটা চড়া দামে কোথাও বেচে মা-কে থানাপুলিশ না করতে বলেছে।”
“ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট স্যার। শুভবাবুকে আমরা সন্দেহের লিস্ট থেকে বাদ দিতে পারি ।”
“ফ্যাঙ্কলি আমি অবাক হব না, যদি আপনার ম্যাডাম দীপাদেবীও এর সঙ্গে জড়িত থাকেন।”
আমি বললাম, “কী সুপিডের মতো কথা বলছিস! গেরহার্ট সাহেব তো ওটা বিক্রি করার বন্দোবস্ত করছিলেন। টাকার জন্য হলে তো সেটা করলেই হত, এত লুকোচুরির কী দরকার?”
“তুই একটা ইডিয়ট,” প্রমথ বলল। “পাথরটা স্মাগলড গুডস। এখানে যে-কোনো মিউজিয়াম কেনার আগে কাগজপত্র, টাইটেল বা ওনারশিপ সার্টিফিকেট, ইত্যাদি দেখতে চাইবে, তখন এক আফগান বা পাকিস্তানী এসে বাড়িতে বয়ে পাথরটা দিয়ে গেছে বললে তো চলবে না!”
একেনবাবু মাথা নেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সত্যি স্যার, প্রমথবাবু আমার ভাত মারবেন।”
“কী করে মারবে?” আমি বললাম, “কেসটা তো আপনি পেলেনই না!”
“তা পেলাম না স্যার,” একেনবাবু ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “তবে সত্যিই পাস্টটা বেশ কনফিউজিং।”
“পাস্ট-টা মানে?”
“এই যে স্যার দেবেশবাবু, হরপ্পায় গিয়ে হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে পাথরটা বাক্সে পুরে পালাবার প্ল্যান করছিলেন কেন?”
“পালাবার প্ল্যান! সেটা কোত্থেকে পেলেন?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“আমার অনুমান স্যার, কারণ ঐ সময় তো ওঁর বাড়ি আসার কথা ছিল না। তার ওপর একটা দামি পাথরের টুকরো নিয়ে! উনি কি রিসার্চ করতে গিয়েছিলেন, না কোনও প্রত্ন চোরের দলে যোগ দিয়ে রাতারাতি বড়োলোক হবার ধান্ধা করছিলেন?”
“বুঝেছি। তার মানে সেটা করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটির শিকার হয়েছিলেন আর সেই দলটাই এখন পাথরটা উদ্ধার করার চেষ্টা করছে।” প্রমথ যোগ করল।
“ঠিক স্যার। সম্ভাবনাটা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
“আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই, এক মুহূর্তে একটা গবেষককে ক্রিমিন্যাল বানিয়ে দিলেন। আর প্রমথ, তুইও তাতে তাল দিচ্ছিস!”
“না, না, স্যার, আমরা শুধু সম্ভাবনাগুলো ভাবছি। ভেরি কনফিউজিং।”
.
এসব ঘটে যাবার ক’দিন বাদে হঠাৎ করে ভৈরব মিত্রের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। “কী খবর,” বলেই জিজ্ঞেস করলেন, “শুনলাম একেনবাবু নাকি সোনাবৌদির বাড়ির চুরি নিয়ে ইনভেস্টিগেট করছেন?”
“সোনাবৌদি!” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“মানে দীপা রায়, আমি ওঁকে সোনাবৌদিই ডাকি।”
“আপনি ওঁকে চিনলেন কী করে?”
“আরে মশাই, ওঁকে কি আমি এখন চিনি! আমার জ্যাঠতুতো দাদার কলিগ ছিলেন দেবেশদা, মানে সোনাবৌদির স্বামী। আমার থেকে অবশ্য ওঁরা অনেক বড়ো। সোনাবৌদি এককালে যা সুন্দরী ছিলেন না, সুচিত্রা সেনকেও টেক্কা দেবার মতো।”
“এখনও উনি যথেষ্ট সুন্দরী,” আমি বললাম।
“এখন তো দেখছেন শুধু টেন পারসেন্ট, কি তাও নয়,” ভৈরব মিত্র মুখ বাঁকালেন। তারপর গলাটা একটু নিচু করে বললেন, “বিটুইন ইউ এণ্ড মি, কতজন যে ওঁর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন গুণে শেষ করা যায় না। উনি অবশ্য কাউকে পাত্তা দেননি। ভার্চুয়াস লেডি। অলওয়েজ টু টু দেবেশদা, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। বরং দেবেশদাই শুনেছি অন্য মহিলাদের সঙ্গে একটু-আধটু.. বুঝতে পারছেন তো? আচ্ছা ভাবুন তো, এমন সুন্দরী যাঁর স্ত্রী! আরে মশাই বড়োদের কথা ছেড়ে দিন, আমরা ছোটোরাই ওঁর কাছাকাছি ঘুরঘুর করার সুযোগ পেলে ছাড়তাম না। উনি আমাদের কারোর সঙ্গে এসে কথা বললে বর্তে যেতাম, অন্যরা সবাই হিংসায় জ্বলত। কোনো খিদমত খাটতে বললে তো আমরা সেভেন্থ হেভেনে পৌঁছে যেতাম!..”
“তাই নাকি!” ওঁর বাল্য-কাহিনি থামাতে কথার মাঝেই বললাম। কাজ হল না, উনি বলেই চললেন, “শুধু সুন্দরী ছিলেন না, ভালো গাইতেন, নাচতেন, চিত্তরঞ্জন পার্কের কালচারাল অনুষ্ঠানগুলোতে এককালে ওঁকে ছাড়া চলত না। তবে এখানে এসে একেবারে একা হয়ে পড়েছেন। ছেলে তো সারাদিন অফিস করছে। উনি তো ঘরের মধ্যে আটকা। কোথায় যাবেন, কার সঙ্গেই বা বেরোবেন? চেনা-জানারা তো সব দেশে!…”
সোনাবৌদির প্রসঙ্গ হয়তো আরও অনেকক্ষণ চলত। কিন্তু আমার একটু তাড়া ছিল, তাই কথা ঘোরাবার জন্য বললাম, “আপনি কোত্থেকে জানলেন যে একেনবাবুকে উনি চোর ধরতে বলেছেন?”
“আরে সেদিন শুভ ওঁকে নিয়ে আমার দোকানে এসেছিল। একথা সেকথার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, একেনবাবুকে আমি চিনি কিনা। আমি বললাম, “চিনি না মানে, উনি একজন ফ্যান্টাস্টিক গোয়েন্দা। ওঁর জন্যেই আমার দোকানে চুরি বন্ধ হয়েছে। তখনই জানলাম একেনবাবুর ব্যাপারটা…।”
আমি কথাটা শেষ করতে দিলাম না। “খবরটা ভুল, একেনবাবু এখন ওঁর কাজটা আর করছেন না।”
“সত্যি!”
“হ্যাঁ, সত্যি।” বলে আমি বিদায় নিলাম।
.
সেই রাতে বাড়িতে ডিনার খেতে খেতে একেনবাবু বললেন, “বুঝলেন স্যার, গেরহার্ট সাহেব ঠিক খবরই এনেছিলেন, প্রফেসর উড হরপ্পার একজন অথরিটি।”
“আপনি কি এখনও ওই নিয়ে ভাবছেন নাকি? ফ্রি-তে কাজ করা তো আপনার হ্যাবিট নয়!” প্রমথ বলল।
“কী যে বলেন স্যার, গতকাল ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে গল্প করতে করতে গেরহার্ট সাহেবের গল্পটা ওঁকে বলেছিলাম। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের এক বন্ধু স্ট্যানফোর্ডে আছেন, হরপ্পা নিয়ে রিসার্চ করেন। স্টুয়ার্ট সাহেবকে তো আপনারা জানেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুকে ফোন। ভদ্রলোক প্রফেসর উডকে খুব ভালো করে চেনেন। যেটা মোস্ট ইন্টারেস্টিং, সেটা হল দেবেশবাবুকেও উনি চেনেন। এক সপ্তাহের মতো দেবেশবাবু ওঁর ডিপার্টমেন্টে ছিলেন। পরে আবার এক সপ্তাহের জন্য আসার কথা ছিল। কিন্তু প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করে দেবেশবাবু দেশে ফিরে যান। প্রফেসর উডের ডিপার্টমেন্টেও দেবেশবাবু কাজ করেছেন বললেন। উনি আর প্রফেসর উড অনেকবারই হরপ্পায় গেছেন, দুয়েকবার এক সঙ্গেও।”
“দেবেশবাবু কি ওঁদের সঙ্গে হরপ্পায় গিয়েছিলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“না, ওঁর সঙ্গে যাননি। দেবেশবাবু হরপ্পার উপর কোনো কাজ করেননি। তাই হরপ্পায় গিয়েছিলেন শুনে উনি একটু আশ্চর্যই হলেন।”
.
এইসব নিয়ে যখন আমরা আলোচনা করছি, তখন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের একটা ফোন। পুরোনো এক কলিগের সঙ্গে দেখা করতে উনি পোকোনো যাচ্ছেন, আমরা যেতে চাই কিনা জানতে। স্টুয়ার্ট সাহেব মাঝেমাঝে আমাদের দুয়েক জায়গায় নিয়ে যান। উনিও একেনবাবুর মতো বকবক করতে ভালোবাসেন, লম্বা ড্রাইভে ওঁর দুয়েকজন শ্রোতার দরকার –এটা অবশ্য প্রমথর কনক্লশন।
একেনবাবু বেড়াতে ভালোবাসেন। আমিও। তারওপর কাল কোনো ক্লাস নেই। সুতরাং না বলার প্রশ্ন ওঠে না। প্রমথ যেতে পারবে না, ল্যাব-এ ওর এক্সপেরিমেন্ট চলছে। আমি বললাম, “যখন যাচ্ছিই, তখন প্রফেসর উডের সঙ্গে দেখা করবেন নাকি?”
“কী হবে স্যার, পাথরটা থাকলে না হয় দেখা করার একটা মানে হত।”
“তা ঠিক।”
তিন
পোকোনো ঘন্টা দুয়েকের পথ। পথে তিন জায়গায় টোল দিতে হয়। আগে টোল দিতে গাড়ির লম্বা লাইন হতো। আজকাল নিউ ইয়র্ক অঞ্চলে যারা থাকে তাদের প্রায় সবার গাড়িতেই E-ZPass রেডিও ট্রান্সমিটার থাকে। টোল বুথের E-ZPass লেন দিয়ে যাবার সময়ে বুথের কম্পিউটার রেডিও থেকে গাড়ির মালিকের অ্যাকাউন্ট নম্বর বেতারেই জেনে যায় আর সঙ্গে সঙ্গেই মালিকের E-ZPass অ্যাকাউন্ট থেকে টোলটা নিয়ে নেয়। খুবই চমৎকার ব্যবস্থা, গাড়ি থামিয়ে পয়সা বার করার কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু আজকে কম্পিউটার সিস্টেম বিগড়ে বসে আছে, তাই সবাইকে টোল বুথে থামতে হচ্ছে। দু’ঘন্টার বদলে আড়াই ঘন্টা লেগে গেল।
ভেবেছিলাম স্টুয়ার্ট সাহেব কোনো কেস নিয়ে আলোচনা করতে এসেছেন। ও হরি, এসেছেন ওখানকার পুলিশ চিফ বিল ক্রসের সঙ্গে জমি কেনা নিয়ে আলোচনা করতে! বিল ক্রস ফ্লরিডাতে একটা নতুন রিয়েল এস্টেট ডেভালপমেন্টের খবর পেয়েছেন, খুব সস্তায় সেখানে প্লট আর বাড়ি বিক্রি করা হচ্ছে। জায়গাটা এখনও বিশেষ ডেভালপড নয়। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ওখানে একটা গল্ফ কোর্স হচ্ছে –রাস্তাঘাট বাড়িঘর শপিং মল-এ ভরে উঠবে। তখন জমি বাড়ি দুটোর দামই আকাশ ছোঁয়া হবে। বিল ক্রস সেখানে একটা বাড়ি কিনছেন আর বন্ধুবান্ধবদের উদ্বুদ্ধ করছেন সেখানে কিছু কিনতে। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে জায়গাটার ম্যাপ, বাড়িগুলোর ছবি, ভবিষ্যতে জায়গাটা কী দাঁড়াবে আর্টিস্টের আঁকা ছবিতে দেখালেন। আমাদেরও বললেন, “কিনে ফেলুন, এর থেকে ভালো ইনভেস্টমেন্ট আর কোথাও পাবেন না।”
বাড়ি কেনার টাকা বা সাহস কোনোটাই আমার নেই। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট মনে হল ইন্টারেস্টেড, কিছু কাগজপত্র বিল ক্রসের কাছ থেকে নিলেন। এই ফাঁকে একেনবাবু বিল ক্রসকে জিজ্ঞেস করলেন উনি রবার্ট উডকে চেনেন কিনা। পোকোনো খুবই ছোটো শহর, বড়োসড়ো গ্রামই বলা চলে, এখানকার বাসিন্দাদের অনেককেই হয়তো পুলিশ চিফ চেনেন। বিল ক্রস একেনবাবুর দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, “আপনি এঁকে চেনেন?”
“না স্যার, তবে শুনেছি উনি হরপ্পার একজন অথরিটি।”
“তা হতে পারেন, কিন্তু হি ইজ ডেড।”
“ডেড!”
“হ্যাঁ, সাত দিন আগে একটা খাদের মধ্যে ওঁর ডেডবডিটা দেখতে পেয়ে একজন খবর দেয়, সেই নিয়ে এখনও তদন্ত চলছে।”
“মাই গড!” আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
“কেসটা ইন্টারেস্টিং,” বলে বিল ক্রস যা বললেন তার মর্মার্থ হল :
রবার্ট উড বছর পাঁচেক আগে পোকোনোতে একটা বিশাল বাড়ি তৈরি করেন। ফ্যান্সি গাড়িও ছিল কয়েকটা। বহু বছর রবার্ট উড অকৃতদার ছিলেন। নিজে খুব খরচে ছিলেন না, আর বেশ কিছু সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। সুতরাং টাকাপয়সা ওঁর ভালোই ছিল। রিটায়ার করার মুখে ভদ্রলোক হঠাৎ নিজের এক ছাত্রীকে বিয়ে করে বসেন। ছাত্রী ক্লারার বয়স বছর পঁয়ত্রিশ, খুবই সুন্দরী। এর আগেও বোধ হয় বার দুই বিয়ে হয়েছিল। নানা ঘাটের জল খেয়ে আবার কলেজে এসে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রফেসর উডের ক্লাসে পড়তে এসে দেখতে না দেখতে প্রফেসরের প্রেমে পড়ে যান। পড়াশুনা খতম, অল্পদিনের মধ্যে ওঁদের বিয়েও হয়ে যায়। রিটায়ার করার পর রাবার্ট উড স্ত্রীকে নিয়ে পোকোনোতেই থাকতে শুরু করেন। প্রতিবেশীদের কাছে ওঁরা ছিলেন অত্ কাপল। একজন ভিভেশাস, হইচই করে পার্টি করতে ভালোবাসেন, আরেকজন সময় কাটান বই পত্তরে মুখে গুঁজে আর পুরোনো পাথর ঘেঁটে। তবে প্রফেসর আধখ্যাপা লোক হলেও স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ওঁদের ঐ বাড়ি আর ফ্যান্সি গাড়িগুলো তার প্রমাণ। পোকোনোতে আসার এক বছর বাদে প্রফেসর রিসার্চের কাজে কিছুদিনের জন্য বাইরে ছিলেন, ফিরে এসেই ওঁরা আলাদা হন। প্রতিবেশীদের ধারণা এর মধ্যে মহিলা নিশ্চয় আর কারোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এগুলো নিতান্তই সন্দেহ। ডিভোর্স হয়েছিল মিউঁচুয়াল কনসেন্টে। সেটলমেন্টে প্রফেসর যা দেবার তার থেকে অনেক বেশিই ক্লারাকে দেন। বাড়িটা আর গাড়িগুলো ক্লারা পান। সেই সঙ্গে ভালো একটা মাসোহারাও। দু একজন শুনেছি ওঁকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন এতটা না দিতে। কিন্তু উনি কারোর কথা শোনেননি। কিছু বলতে গেলে চটে যেতেন। ফলে কেউই ওঁদের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাত না। ডিভোর্সের পর পরই ক্লারা বাড়ি বিক্রি করে চলে যান। প্রফেসর উড ওঁদের পুরোনো বাড়ির খুব কাছেই একটা ছোট্ট টু-বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন। এমনিতেই প্রফেসর মিশুকে ছিলেন না, কিন্তু ডিভোর্সের পর প্রায় কারোর সঙ্গেই কথা বলতেন না। প্রথম দিকে ওঁর পুরোনো অধ্যাপক বন্ধুরা মাঝেমধ্যে আড্ডা দিতে বা কাজের সূত্রে আসতেন। পরে তাঁদের আসাও খুব কমে যায়। আত্মীয়স্বজন ওঁর ছিল না। তবে ক্লারা ছাড়াছাড়ি হলেও মাঝেমাঝে ওঁকে দেখতে আসতেন। ইতিমধ্যে ক্লারা একবার বিয়েও করেছিলেন কিংবা কারোর সঙ্গে থাকতেন। সেই সম্পর্কটাও টেকেনি। প্রতিবেশীদের ধারণা হয়েছিল ক্লারা হয়তো আবার প্রফেসরের কাছে ফিরে আসতে চান। মাস তিন চার আগে ক্লারা একবার আসেন। তখন ওঁদের দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়, বাইরে থেকেও ওঁদের চেঁচামেচি অনেকের কানে আসে। তারপর থেকে ক্লারা আসেননি। প্রফেসর উড যেন আরও ডিপ্রেসড হয়ে যান। বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। বিকেলে ওঁর বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা উঁচু টিলার উপরে যে বেঞ্চিগুলো আছে তার একটাতে বসে থাকতেন। জায়গাটা নির্জন, চোখের একটু আড়ালে। হয়তো সেইজন্যেই সেখানে যেতেন, যাতে কেউ এসে বিরক্ত না করে। ডিপ্রেসড মানুষদের এইসব আচরণ কিছু অস্বাভাবিক নয়। তবে ওঁর আচরণে একটা ব্যাপার রহস্যময়। দৈনন্দিন খরচের জন্য একশো দুশো ডলার তোলা ছাড়াও চার পাঁচ মাস অন্তর অন্তর উনি একটা মোটা অঙ্কের টাকা, প্রায় হাজার দশ-পনেরো ব্যাঙ্ক থেকে তুলতেন। কী করতেন সেই টাকা নিয়ে সেটা পুলিশের কাছে স্পষ্ট নয়। আর এটা ইদানীং কালের ব্যাপারও নয়, গত প্রায় চার বছর ধরে এটা করে যাচ্ছিলেন। শুধু মাস চারেক হল এই টাকা তোলা বন্ধ ছিল। সাধারণভাবে এটা আত্মহত্যা বলেই ধরা হতো, কিন্তু এই টাকা-রহস্যের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কেসটা ক্লোজ করা যাচ্ছে না।
“উডের এক্স-ওয়াইফের সঙ্গে কি তোমার কথা হয়েছে?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বিল ক্রসকে জিজ্ঞেস করলেন।
“হয়েছে, কিন্তু ফোনে। ক্লারা মাস তিনেক ধরে ক্যালিফোর্নিয়াতে একটা ডে-কেয়ার সেন্টারে কাজ করছেন। গত তিনমাস রবার্ট উডের সঙ্গে ওঁর কোনো যোগাযোগই নেই। তিনমাস আগে ওঁদের ঝগড়া নিয়ে প্রশ্ন করাতে উনি বললেন, ওটা ওঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। রবার্ট ফোন করে ক্ষমাও চেয়েছে তার জন্যে। যখন জানতে চাইলাম, শেষবার ওঁদের কবে কথা হয়েছে? উত্তরে বললেন, আর কথা হয়নি। রবার্ট বলেছিল ফোনে আর ওকে ধরা যাবে না, লাইনটা ডিসকানেক্ট করা হচ্ছে।
আমি যখন জানলাম যে রবার্ট উড মারা গেছেন, মনে হল শুনে খুবই আপসেট। একটু সামলে নিয়ে বললেন, সবে চাকরিতে ঢুকেছেন, এক্ষুণি ওঁর পক্ষে আসা সম্ভব নয়, তবে ফিউনারেল এক্সপেন্স-এর জন্য যা লাগবে উনি তা পাঠিয়ে দেবেন।”
কথাগুলো বলে বিল ক্রস একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “সরি, আপনার কথার প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলে ফেললাম।… আপনি রবার্ট উড ‘ইউরোপা’ না কীসের অথরিটি বলছিলেন?”
“ইউরোপা নয় স্যার, হরপ্পা।”
“সেটা কি?”
“ওটা ইন্ডিয়ার একটা পুরোনো সিভিলাইজেশন।”
বিল ক্রস চোখটা একটু কুঁচকে বললেন, “ইণ্ডিয়ার না পাকিস্তানের?”
আমি মনে মনে ভাবছি কী ভাবে এর উত্তর বিল ক্রসের মাথায় ঢোকানো যাবে। কিন্তু প্রয়োজন নেই বুঝলাম। প্রশ্নটা করার জন্য করা। উত্তরটা ওঁর জানা। বললেন, “এইসব ব্যাপারেই উনি পাকিস্তান গর্ভর্নমেন্টের কনসাল্টেন্ট বা কিছু ছিলেন। মাঝে মাঝে পাকিস্তান থেকে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে লোকে আসত। যেদিন উনি মারা যান, সেদিনও এসেছিল একজন, প্রতিবেশীর কাছে ওঁর খোঁজ করছিল।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার।”
“ইন্টারেস্টিং কিনা জানি না, কিন্তু এটা একটা হেডেক। গত দু’বছরে তিনটে ডেথ কেস আমরা ক্লোজ করতে পারিনি, তার মধ্যে দুটো ডেফিনিটলি হোমিসাইড। এটা নিয়ে হবে চারটে আনরিসলভড কেস।”
ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বললেন, “বিল, তুমি একেনকে কাজে লাগাও। হেডেক কমানোর এমন চমৎকার ওষুধ কোথাও পাবে না। কি বলো একেন?”
“কী যে বলেন স্যার। ওঁর অফিসে কি আর ডিটেকটিভের অভাব!”
“অভাব না থাকুক, আপনি একটু সাহায্য করলে তো সুবিধাই হয়। স্টুয়ার্ট তো আপনার প্রশংসায় সবসময়ে পঞ্চমুখ।”
“উনি স্যার, আমাকে একটু বেশি স্নেহ করেন।”
“যোগ্য লোককেই নিশ্চয় করেন, “ বিল ক্রস বললেন।
“তোমার কোনো আপত্তি আছে নাকি প্রফেসরের অ্যাপার্টমেন্ট আর যেখানে ওঁর ডেডবডি পাওয়া গেছে –সে জায়গাটা দেখাতে?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বিল ক্রসকে জিজ্ঞেস করলেন।
“সে কি কথা, আপত্তির কী আছে?” বলে বিল ক্রস আমাদের নিয়ে বেরোলেন।
চার
আমরা অল্প পরেই একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে পৌঁছলাম। পোকোনোর এই দিকটা পুরোনো, দুয়েকটা ম্যানশন ছাড়া ছোটো ছোটো বাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ ভরা। সংস্কারের অভাবে অনেকগুলোরই জরাজীর্ণ অবস্থা। একটা ডুপ্লেক্স বিল্ডিং-এর বাঁদিকের দরজা খুলে বিল বললেন, “এটাই প্রফেসরের অ্যাপার্টমেন্ট। কোনো কিছু সরানো হয়নি।”
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে একেনবাবু প্রশ্ন করলেন, “মারা যাবার ঠিক আগে দুয়েকদিনের মধ্যে ওঁর বাড়িতে কি কেউ এসেছিলেন?”
“কেবল সার্ভিসের একটি লোক এসেছিল। তার কাছে জেনেছি ওঁর কেবল টিভি কাজ করছিল না, সার্ভিস কল ছিল। আর কুরিয়র সার্ভিসের একটা লোক এসেছিল পার্সেল ডেলিভারি করতে।”
“কিসের পার্সেল স্যার?”
“বইয়ের।” বলে একটা বেডরুম, যেটা প্রফেসর মনে হয় স্টাডি হিসেবে ব্যবহার করতেন সেখানে ঢুকে টেবিলের ওপর রাখা বইয়ের একটা ভোলা পার্সেল দেখালেন। টেবিলের উপরে বেশ কয়েকটা ভাঙা পাথরের মূর্তি আর কিছু কাগজপত্র ছড়ানো। একেনবাবু দেখলাম খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেগুলো দেখছেন।
“ও একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস, সেটাও আপনাকে দেখাই,” বলে টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা চিঠি বের করলেন। চিঠিটা পুরোনো, পাতার নানা জায়গায় খাঁজ পড়া, কোনো তারিখ দেওয়া নেই। ইংরেজিতে লেখা চিঠি যার অনুবাদ–
প্রিয়তম R,
তুমি ভয় পাচ্ছো আমাদের সম্পর্কের কথা ও আঁচ করছে। সে তো আগেও করেছে, তাতে কী হয়েছে? আমি মনঃস্থির করেছি ওকে ছেড়ে তোমার সঙ্গেই থাকব; আর দেরি কোরো না। আগেও লিখেছি, আবার লিখছি এক্ষুণি চলে এসো।
তোমার জানোই তো কে, C
“কার লেখা স্যার এটা?”
“রবার্ট উডের এক্স-ওয়াইফের। ওঁর বহু প্রেমিক ছিল বলে বাজারে গুজব। প্রফেসর উড ছিলেন সেই প্রেমিক দলের সপ্তম বা অষ্টম।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার, ভেরি ইন্টারেস্টিং। আর কোনো চিঠি পেয়েছেন?”
“না, পার্সোনাল চিঠি বলতে ওই একটাই।”
আবার ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং’ বলে একেনবাবু এদিক ওদিক ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। একটা আলমারিতে বেশ কিছু ছোটোবড়ো পাথরের টুকরো, কয়েকটা ভাঙ্গা মূর্তি, পাথরের ফলা, ধাতুতে গড়া ছোটোখাটো কয়েকটা জিনিস –ঠিক কী বুঝলাম না, তবে সবগুলোই ধূলিধূসরিত অবস্থায় পড়ে আছে। বইপত্র কিছু আলমারিতে, কিছু মেঝেতে –বলতে গেলে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। টেবিল ল্যাম্পের শেডটা ভাঙ্গা। সমস্ত ঘরটাই অত্যন্ত অগোছালো।
একেনবাবু আলমারির জিনিসগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “এগুলোর দাম কত হবে স্যার?”
“গুড কোয়েশ্চেন। এত পুরোনো জিনিস যখন, কালেকটারদের কাছে দাম নিশ্চয় আছে।” বিল ক্রস বললেন।
“ওঁর কোনো ইন্সিওরেন্স ছিল?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জিজ্ঞেস করলেন।
“সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট ইন্সিওরেন্স। জিনিসপত্রের জন্য বড়োজোর পঞ্চাশ হাজার ডলারের কাভারেজ।”
আমার নিজের এইসব জিনিস সম্পর্কে ধারণা নেই। তাও মনে হল যতগুলো জিনিস রয়েছে দেখলাম, সেগুলোর দাম কম হবে না। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একটা পাথরের মূর্তি তুলে বললেন, “হয়তো হাজার হাজার ডলার খরচা করে উনি এগুলোই কিনতেন। কুড বি স্মাগলড গুডস।”
আমিও তাই ভাবছিলাম। প্রফেসর উডের সঙ্গে নিশ্চয় কোনো ইন্টারন্যাশনাল গ্যাং-এর যোগাযোগ ছিল যারা এইসব প্রত্নতাত্বিক জিনিস চুরি করে ওঁকে বিক্রি করত।
বিল ক্রসের মাথায় বোধ হয় সেই চিন্তাটা আগে আসেনি। একটু চিন্তিত ভাবেই বললেন, “কোয়াইট পসিবল। এইসব লোকদের সঙ্গে ক্যাশ দিয়েই কারবার করতে হয়।”
একেনবাবু দেখলাম গম্ভীরভাবে, কী জানি ভাবছেন। বললেন, “এবার চলুন স্যার, খাদটার কাছে যাই।”
“নিশ্চয়।”
.
জায়গাটা খুব একটা দূরে নয়। হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক। যে পথটা পাহাড়ের ধার দিয়ে নেমে বড় রাস্তায় পড়েছে তার পাশ দিয়ে বেড়িয়েছে একটা সরু পায়ে হাঁটার পথ। চারিদিক গাছপালায় ঢাকা। শেষ হয়েছে ছোট্ট একফালি মাঠে। সেখানে দু’টো বসার বেঞ্চি যেখান থেকে নীচে পোকোনো মেইন রোডটা এঁকে বেঁকে গেছে দেখা যায়। বেঞ্চিগুলোর ফিট দশেক সামনে নীচু জরাজীর্ণ তারের বেড়া। সেখানে কিছু দূর অন্তর অন্তর সাবধানবাণী আটকানো। বেড়াটা অনেক জায়গাতে ভেঙ্গে পড়েছে। সেখানে ‘ওয়ার্নিং সাইন ঝুলিয়ে প্লাস্টিকের হলুদ ফিতে লাগানো। কিন্তু বেড়া বা প্লাস্টিকের ফিতে কোনোটাই খুব একটা সুরক্ষা দিচ্ছে না। বেড়ার ঠিক পেছন থেকেই শুরু হয়েছে গভীর খাদ। সতর্ক না হয়ে পাশ দিয়ে হাঁটলে উলটে খাদে পড়ে যাওয়াটা অসম্ভব নয়। সেই খাদেই মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছিল।
আমরা সেদিকে তাকিয়ে আছি দেখে বিল ক্রস বললেন, “বেড়টা বেশ কিছুদিন ধরেই ভাঙ্গা। পুলিশ রিপোর্টও করেছে সারানোর জন্য, কিন্তু পোকোনো মিউনিসিপ্যালিটি। এখনও সময় করে উঠতে পারেনি। হলুদ ফিতেটা ডেডবডিটা পাওয়ার পরে পুলিশ লাগিয়েছে।”
একেনবাবু এগিয়ে গিয়ে খাদের সামনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে খানিকক্ষণ দেখলেন। আমার কোনো উঁচু জায়গা থেকে নীচের দিকে তাকালেই মাথা ঘুরতে থাকে। আমি কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে সরে এলাম। তারমধ্যেই দেখলাম প্রায় তিরিশ ফুট নীচে পাথরের একটা চাঁই বারান্দার মতো বেড়িয়ে আছে। সেখানেই নাকি ডেডবডিটা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু খাদের শেষ অন্ততঃ আরও একশো ফুট নীচে হবে।
বিল ক্রস সঙ্গে একটা ফাইল নিয়ে এসেছিলেন খেয়াল করিনি। সেটা খুলে যে অবস্থায় প্রফেসর উডের মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়েছিল তার কয়েকটা ক্লোজ-আপ ছবি দেখালেন। মৃতদেহের ছবি দেখতে আমার অসুবিধা হয়। তাই ভালো করে তাকালাম না। তবু দেখলাম রক্তাক্ত একটা দেহ চিৎ অবস্থায় ছেতরে পড়ে আছে। মাথার পাশে একটা মলাট খোলা বই আর কয়েকটা পাথরের টুকরো।
একেনবাবু দেখলাম খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখছেন। “ছবিটার একটা কপি পেতে পারি স্যার?”
“নিশ্চয়, কিন্তু কী বুঝছেন?” বিল ক্রস জিজ্ঞেস করলেন।
“ভেরি ইন্টারেস্টিং, স্যার।”
“বইটা আর পাথরের টুকরোগুলোর কথা বলছেন?” বিল ক্রস বললেন। “বইটা প্রফেসর উডের। পাথরের টুকরোগুলোও ওঁর বাড়ির আলমারির পাথরগুলোর সঙ্গে ম্যাচ করেছে। উনি বাড়ি থেকে বইপত্র, পাথরের মূর্তি –এইসব নিয়ে এখানে এসে প্রায়ই বসতেন। এখানে বসেই নাকি ভাবনা-চিন্তা গবেষণা সব করতেন।”
“টিপিক্যাল খ্যাপা প্রফেসর,” স্টুয়ার্ট সাহেব মন্তব্য করলেন।
“এক্সাক্টলি,” বিল ক্রস স্টুয়ার্ট সাহেবকে বললেন। “আমার বিশ্বাস এটা আত্মহত্যাই। শুধু টাকার ব্যাপারটাই রহস্য হয়ে ছিল। কিন্তু তোমার অ্যাঙ্গেল ধরে এগোলে, সেটাও মনে হয় এক্সপ্লেইন করা যাবে।”
সেদিন ফিরতে ফিরতে আমাদের সন্ধ্যা হল। ফেরার পথে নানান কথার মধ্যে একেনবাবু আচমকা বলে উঠলেন, “আমি এখনও পাজলড স্যার।”
“কীসের কথা বলছ?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জিজ্ঞেস করলেন।
“এই যে গবেষণা করার জন্য বাড়ি থেকে বইপত্তর আর পাথর এনে সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আত্মহত্যা। খুবই পিজলিং। কেন অধ্যাপক মশাই সেটা করলেন? কেন স্যার উনি কেবল টিভি সারাতে ডাকলেন, বই কিনলেন? মরে যাবার পর তো কেউ টিভি দেখে না, বইও পড়ে না… আমি সত্যিই কনফিউজড স্যার।”
বুঝলাম আমরা নানান কথা বলছি, কিন্তু প্রফেসরের মৃত্যুটা ওঁর মাথায় এখনও ঘুরছে।
পাঁচ
বাড়িতে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে একটু রিল্যাক্স করার জন্যেই অমিয় চক্রবর্তীর একটা কবিতার বই নিয়ে বসলাম। একেনবাবু দেখলাম বিল ক্রসের কাছ থেকে আনা ছবিটা মগ্ন হয়ে দেখছেন। সেটা দেখতে দেখতেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী পড়ছেন স্যার?”
“অমিয় চক্রবর্তীর একটা কবিতা। শুনবেন?”
“পড়ুন স্যার, আমি অবশ্য এগুলো বুঝি না।”
আমি ‘সংগতি’ কবিতাটা পড়লাম। যখন পড়লাম,
‘তোমার সৃষ্টি, আমার সৃষ্টি, তাঁর সৃষ্টির মাঝে
যত কিছু সুর, যা-কিছু বেসুর বাজে
মেলাবেন।’
মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “এটা কিন্তু কবি মোক্ষম লিখেছেন স্যার।” বলে চেয়ার থেকে উঠে এসে বিড়বিড় করে নিজেই লাইন তিনটে কয়েকবার পড়লেন। তারপর বোঁ করে নিজের ঘরে চলে গেলেন। টিপিক্যাল একেনবাবু।
খানিকবাদে কান চুলকোতে চুলকোতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “এক কাপ কফি চলবে নাকি স্যার?”
এমন সময় একটা ফোন। অন্যপ্রান্তে অধ্যাপক গেরহার্ট। একটা ভীষণ দুঃসংবাদ, দীপা আত্মহত্যা করেছেন। ওঁর ডেডবডি নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে।
আমরা সবাই ছুটলাম। গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টও সেখানে। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নিউজ ট্র্যাভেল ফাস্ট।”
একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার স্যার, সুইসাইড?”
“তাইতো মনে হচ্ছে।”
একটা সুইসাইড নোট রেখে গিয়েছেন। সুইসাইডে নোটের বয়ানটাও শুনলাম
‘আমার জীবনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। শুভ, তোকে আশীর্বাদ করে যাচ্ছি, তুই সুখে থাক।
মা’
ডেডবডি অটোন্সি না করে ছাড়া হবে না। শুভ দেখলাম লাল চোখে এক কোণে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। কাউকেই আমি চিনি না, নিশ্চয় ওঁর বন্ধুবান্ধব। চেনাজানার মধ্যে একমাত্র ভৈরববাবু। ভৈরববাবুই বললেন, “সোনাবৌদি হেভি ডোজে কোডিন খেয়েছেন, সম্ভবতঃ শুভ কাজে চলে যাবার পরপরই। ফিরে এসে দেখে সোনাবৌদি আর বেঁচে নেই”
কোডিন ব্যথা কমানোর ওষুধ বলে জানতাম, কিন্তু এটা খেলে যে এত তাড়াতাড়ি মৃত্যু হতে পারে সেটা জানা ছিল না।
প্রমথ দেখলাম জানে। বলল, “কোডিন, মরফিন বা যে কোনও ওপিয়েট নাকি বেশি খেলে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম অ্যাফেক্ট করে। ফলে কোমাতে চলে গিয়ে রেস্পিরেটরি বা সাকুলেটরি ফেইলিওর হয়।”
একেনবাবু দেখলাম একটু গম্ভীর হয়ে গেছেন। এদিক ওদিক কিছুক্ষণ উশখুশ করলেন। তারপর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে গিয়ে কী জানি বললেন।
ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট মনে হল শেষে সম্মতি জানালেন। তারপর দুজনে গিয়ে শুভকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে গেলেন। আমি আর প্রমথও পিছু পিছু গেলাম।
একেনবাবু শুভর হাতটা ধরে বললেন, “আমি জানি না স্যার, এই দুঃখে আপনাকে আমি কী বলে সান্ত্বনা দেব। কিন্তু এই চরম দুঃখের সময়েও আমি দুয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে করব।”
শুভকে এর আগেও নিশ্চয় ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের লোকজন অনেক প্রশ্নই করেছে। বিষণ্ণ মুখে শুভ একেনবাবুকে বললেন, “বলুন।”
“মাস কয়েক আগে আরিফ বলে একটি লোক আপনার বাবার একটি স্যুটকেস আপনাদের বাড়িতে দিয়ে এসেছিলেন, আপনি সেটা জানেন?”
প্রশ্নের আকস্মিকতায় শুভ দেখলাম হতভম্ব এবং বিরক্ত। “এই প্রশ্ন এখন আমায় কেন। করছেন?”
“দরকার আছে স্যার, প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
“হ্যাঁ, জানি। মা ফোন করে জানিয়েছিলেন।”
“কী বলেছিলেন আপনাকে?”
“মা খুবই আপসেট ছিলেন। ঠিক কী বলেছিলেন আমার স্পষ্ট মনে নেই।”
“আপনি মাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি স্যার, মা এত আপসেট কেন হয়েছেন?”
“করেছিলাম।”
“আপনার মা কী বলেছিলেন?”
“মা বারবার বলছিলেন, তুই বুঝবি না, তোকে বোঝানো যাবে না।”
“আপনি সিওর এই কথাটা মা আপনাকে বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ, আমার পরিষ্কার মনে আছে।”
“আপনার মা কি এরকম আপসেট মাঝে মাঝে হতেন?”
“না, মা খুবই ধীর-স্থির ছিলেন, চট করে বিচলিত হতেন না। তাই আমি একটু চিন্তিতই হই, আর সেইজন্যই মা-কে চলে আসতে বলি।”
“আই সি। শেষ প্রশ্ন স্যার, আপনি কি দশ বারো দিনের মধ্যে নিউ ইয়র্কের বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন?”
“না, গত দুসপ্তাহ আমাকে প্রতিদিন কাজে যেতে হয়েছে, এমন কি শনি-রবিবারেও। মা নায়াগ্রা দেখতে চেয়েছিল। গত উইক-এণ্ডে নায়াগ্রা নিয়ে যাব ভেবেছিলাম, কাজের জন্য পারিনি। কোনোদিন আর পারবও না।” গলাটা বুজে এল শুভর।
“আই অ্যাম সরি স্যার, কিন্তু থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।”
ছয়
দীপাদেবীর ফিউনারেল হল তিনদিন বাদে। ফিউনারেল হোম থেকে ভৈরববাবুর অনুরোধে আমরা সবাই রাজা-ও-রাণী রেস্টুরেন্টে গেলাম। আমরা মানে– প্রমথ, আমি, একেনবাবু, গেরহার্ট সাহেব আর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট। শুভ আসতে রাজি হল না। ভৈরববাবুও পেড়াপেড়ি করলেন না। শুভর এক বন্ধু কয়েকদিন ওঁর সঙ্গে থাকবেন বলে এসেছেন। দ্যাটস নাইস অফ হিম। এ সময়ে একজনের কাছে থাকাটা দরকার।
কোনো ফিউনারেল থেকে ফিরলে মনের যে অবস্থা থাকে, আমাদেরও তাই। প্রিয়জন বা পরিচিতকে চিরতরে হারানোর বেদনা তো থাকেই, সেইসঙ্গে জীবনের অসারতা, অনিত্যতা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে মনটা ভারাক্রান্ত করে তোলে। শুভকে বাদ দিলে দীপাদেবীর মৃত্যু প্রফেসর গেরহার্টকে বোধ হয় শোকাপ্লুত করেছে সবচেয়ে বেশি। ভৈরববাবুর মনও যথেষ্ট খারাপ। সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্যই নিজেকে নানানভাবে ব্যস্ত রাখছেন। ওয়েটারকে অনেক রকম নির্দেশ দিলেন মেনু নিয়ে।
রেস্টুরেন্টটাকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। নতুন একটা ভিডিও সিস্টেম পার্টিরুমে লাগিয়েছেন। সেটা সবাইকে ডেকে দেখালেন। দেয়ালের ওয়ালপেপার বদলানো হয়েছে। অনেক নতুন ছবি টানানো হয়েছে দেখলাম। আমার এসব ব্যাপারে উৎসাহ নেই, কিন্তু একেনবাবু আর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আগ্রহভরে এগুলো দেখলেন, প্রশ্নটশ্নও কিছু করলেন। এরমধ্যেই একটি ওয়েটার এক প্রস্থ স্পেশাল কফি আর মশলা চা নিয়ে এল, সেই সঙ্গে কিছু পেস্ট্রি আর ডেনিশ। ভৈরববাবু জিজ্ঞেস করলেন, টোস্ট বা অমলেট কেউ খেতে চাই কিনা। সবাই ‘না’ বললাম।
একটু বাদে প্রফেসর গেরহার্ট উশখুশ করে আমি আর বসব না’ বলে উঠে দাঁড়ালেন। বারবার ভৈরববাবু অনুরোধ করাতেই উনি এসেছিলেন। সারাক্ষণই অন্যমনস্ক ছিলেন। মানসিকভাবে দীপাদেবীর সঙ্গে যে উনি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।
“একটু বসুন স্যার, আপনি আমায় একটা কাজের ভার দিয়েছিলেন। যদিও দীপাদেবী সেই দায়িত্ব থেকে আমাকে মুক্তি দেন, তবু তার রিপোর্টটা অন্ততঃ আপনাকে দিই।”
“তার কি আর কোনো দরকার আছে?” গলার স্বরেই স্পষ্ট সেটা জানার আগ্রহ ওঁর তরফ থেকে অন্তত নেই।
“আছে স্যার, আপনি শুনলে বুঝতে পারবেন।”
গেরহার্ট সাহেব অত্যন্ত ভদ্রলোক। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসলেন।
একেনবাবু চায়ে একটা চুমুকুদিয়ে হঠাৎ ভৈরববাবুকে প্রশ্ন করলেন, “স্যার আপনি এরমধ্যে দীপাদেবীকে নিয়ে পোকোনোতে গিয়েছিলেন?”
প্রশ্নটা এত আকস্মিক যে ভৈরববাবুর হাত কেঁপে কিছুটা চা চলকে মাটিতে পড়ল।
“ত-তার মানে?” ভৈরববাবু কোনোমতে কথাটা বললেন।
“মানেটা পরে আসছি স্যার, কিন্তু সত্যি কথা বলবেন, কারণ আপনি গিয়েছিলেন কিনা, সেটা টোল-বুথের রেকর্ড থেকে স্টুয়ার্ট সাহেব অতি সহজেই বার করতে পারবেন। তাছাড়া পোকোনোতে আপনাকে দেখেছেন এমন লোকও আছেন।”
চায়ের কাপটা ভৈরববাবু তখনও ধরে আছেন, কিন্তু হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে। একটু চুপ করে অনুচ্চস্বরে বললেন, “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।”
“কেন স্যার?”
ভৈরববাবু চুপ।
“প্রফেসর উডের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল, সেটা আমি জানি। কিন্তু কেন গিয়েছিলেন আর কী ঘটেছিল সেখানে, সেটা স্যার আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই। কিছু লুকোনোর চেষ্টা করবেন না, প্লিজ।”
ভৈরববাবু দেখলাম একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। মুহূর্তের মধ্যে কারও গলা ভেঙে যেতে পারে, সেটা আমি এই প্রথম দেখলাম। ভাঙা ভাঙা গলায় থেমে থেমে ভৈরববাবু বললেন, “সোনাবৌদি পোকোনোতে যেতে চেয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম বেড়াতে যেতে চান। সেখানে পৌঁছনোর পর উনি প্রফেসর উডের ঠিকানা দিলেন। বললেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। প্রফেসর বাড়িতে ছিলেন না। পাশের বাড়ির একজন বললেন যে প্রফেসর উপরে একটা টিলায় বসে পড়াশুনা করেন। সেখানে সোনাবৌদিকে নিয়ে যেতেই সোনাবৌদি এগিয়ে গিয়ে ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেন। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলাম সব কিছু ভালো শুনতে পাইনি।” এটুকু বলে ভৈরববাবু চুপ করলেন।
“যা শুনেছিলেন তাই বলুন স্যার। আর ঠিক কী কী ঘটেছিল সেটা বলুন।”
“প্রফেসর বেঞ্চে বসে একটা বই পড়ছিলেন। সোনাবৌদি সামনে গিয়ে একটা পাথর প্রফেসরকে দিতে উনি অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সোনাবৌদি বললেন, এটা আপনার পাথর।
প্রফেসর বললেন, ‘এটা আপনি কোত্থেকে পেলেন?”
সোনাবৌদি বললেন, ‘বলছি, কিন্তু তার আগে বলুন দেবেশ রায়কে মারা হল কেন বা ঐরকম একটা কিছু। প্রফেসর কথাটা শুনে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন। সোনাবৌদি এগিয়ে গিয়ে পাথর শুদ্ধ ওঁর হাতটা চেপে ধরে বললেন, এই পাথর আপনার, কিন্তু আপনাকে বলতেই হবে কেন আমি আমার স্বামীকে হারালাম?’ তারপর এগোতে এগোতে সোনাবৌদি আরও কিছু বললেন। প্রফেসর পেছোচ্ছিলেন, কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু আমি ঠিক শুনতে পাইনি। তবে সোনাবৌদির এই মূর্তি আমি আগে দেখিনি। ওঁকে প্রায় উন্মাদিনীর মতো মনে হচ্ছিল। সমস্ত ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটছে যে আমার বোধ-বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। প্রফেসর ওঁর হাত ছাড়াবার চেষ্টা করছিলেন। না পেরে শেষে ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে পালাতে গিয়ে খাদের মধ্যে পড়ে যান। সমস্ত ঘটনাটাই কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ। সোনাবৌদি তখন ভীষণ কাঁদছেন, খালি বলছেন, ‘আমি তো এটা চাইনি, আমি তো এটা চাইনি, এখন কী হবে?’
আমিও পুরো নার্ভাস। কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভীষণ ভয় পেয়ে কোনোমতে সোনাবৌদিকে গাড়িতে তুলে আমি চলে আসি। বিশ্বাস করুন প্রফেসরের মৃত্যুটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট, সোনাবৌদির কোনো দোষ নেই।” কথাগুলো বলে ভৈরববাবু কপালে হাত দিয়ে মাথা নীচু করে বসে রইলেন।
ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট উঠে এসে ওঁর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “আপনি আমার সঙ্গে চলুন, পুলিশ স্টেশনে গিয়ে আপনাকে স্টেটমেন্ট দিতে হবে।”
ভৈরববাবু আকুলদৃষ্টিতে একেনবাবুর দিকে তাকালেন।
“ভয় পাচ্ছেন কেন স্যার, যা সত্যি তাই বলবেন,” একেনবাবু বললেন।
সাত
আমরা সবাই একেবারে হতবাক হয়ে বসে আছি। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ভৈরববাবুকে নিয়ে যাবার পর প্রমথ বলল, “আপনি অবাক করলেন মশাই, কীভাবে জানলেন ভৈরববাবু প্রফেসর উডের মৃত্যুর ব্যাপারটা জানেন?”
“সন্দেহটা একটু একটু করে হচ্ছিল স্যার, কিন্তু দীপাদেবীর সুইসাইডের পর প্রায় নিশ্চিত হলাম।”
“হেঁয়ালি ছেড়ে ভালো করে ব্যাপারটা বলুন তো।” প্রমথ ধমক দিল। “আর একটু সহজ করে বলুন, বাপিকে তো আবার লিখতে হবে আপনার কীর্তিকাহিনি। সহজ করে না বললে ওর মাথায় ঢুকবে না।”
একেনবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!”
আমি বললাম, “ওর কথায় কান দেবেন না। যেমনভাবে বলতে চান, বলুন।”
একেনবাবু বাকি চা-টুকু খেয়ে শুরু করলেন, “আসলে দীপাদেবীর কেসটাতে কতগুলো ব্যাপার আমাকে ভীষণ কনফিউজড করছিল। এক নম্বর –দেবেশবাবু হরপ্পা বিশেষজ্ঞ না হয়েও হরপ্পায় যাবার সুযোগ কেন পেলেন? দু’নম্বর –স্বামীর মৃত্যুর পর চার বছর বাদে তাঁর একটা স্যুটকেস পেয়ে দীপাদেবী কেন অত বিচলিত হলেন? তিন নম্বর –সেই স্যুটকেস থেকে একটা পাথর দীপাদেবী নিয়ে এলেন, কিন্তু সেটা হারিয়ে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েও সেটা ফেরৎ পাবার কোনো চেষ্টাই করলেন না।
কোনো প্রশ্নেরই সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না স্যার। এরপর পোকোনোতে গিয়ে রবার্ট উডের মৃত্যুর ব্যাপারে যা শুনলাম তাও বেশ কনফিউজিং। কেন উনি হরপ্পা থেকে ফিরে এসে মাত্র এক বছরের বিবাহিত স্ত্রী ম্যাডাম ক্লারাকে সম্পত্তির অধিকাংশ জিনিস দিয়ে ডিভোর্সে রাজি হলেন? কাকে তিনি কিছুদিন অন্তর অন্তর মোটা টাকা দিতেন? কেন তিনি ম্যাডাম ক্লারার পুরোনো একটা প্রেমপত্র রেখে দিয়েছিলেন? কেন উনি হঠাৎ আত্মহত্যা করতে গেলেন, যেখানে দুয়েকদিন আগেও আত্মহত্যার কোনো ইচ্ছে ছিল না? ফ্র্যাঙ্কলি স্যার আই হ্যাড নো ব্লু, কী থেকে কী হচ্ছে। তারপরেই বাপিবাবু আমার চোখখুলে দিলেন।”
“আমি!” অবাক হয়ে বললাম।
“হ্যাঁ স্যার, ঐ যে কবিতাটা, যত কিছু সুর, যা-কিছু বেসুর বাজে, মেলাবেন। ঠিক তখনই আমার মনে হল দেবেশবাবুর মৃত্যু, প্রফেসর উডের মৃত্যু –এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় স্যার। ধীরে ধীরে ক্লিয়ার হতে শুরু করল প্রফেসর উডের পাশে পাওয়া পাথরের টুকরোগুলোর সঙ্গে দীপাদেবীর পাথরের মিলটা।”
“আঃ, এতকথা না বলে বলুন ব্যাপারটা কী?” প্রমথ অধৈর্য হয়ে বলল।
“বলছি স্যার, বলছি। দেবেশবাবু রিটায়ার করার কিছুদিন আগে একটা ফেলোশিপ পেয়ে আমেরিকাতে এসেছিলেন। প্রথমে স্ট্যানফোর্ডে এসেছিলেন পরে প্রিন্সটনে যান। প্রিন্সটনে কাজ করছিলেন প্রফেসর উডের সঙ্গে। প্রফেসর উড তখন রিটায়ার করে রিসার্চ প্রফেসর। ধরে নিচ্ছি নিজের বাড়িতেই রিসার্চের কাজ অনেক করতেন। সেই সূত্রে দেবেশবাবুর সঙ্গে রবার্ট উডের স্ত্রী ক্লারার পরিচয় হয়। রবার্ট উডের অজান্তেই সেই চেনাজানাটা দ্রুতগতিতে ঘনিষ্টতার পর্যায়ে পৌঁছয়। প্রফেসর উড সেটা জানতে পারেন, সে নিয়ে এঁদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটিও নিশ্চয় হয়। কিন্তু এবার হল মুশকিল, রিসার্চের কাজে প্রফেসরকে যেতে হবে হরপ্পায়। নিজের সুন্দরী স্ত্রীকে ওঁর বিশ্বাস নেই, দেবেশবাবুকেও নয়। তখন রবার্ট সাহেব একটা প্ল্যান ফাঁদলেন। উনি দেবেশবাবুকে হরপ্পায় ওঁর সঙ্গে যেতে বললেন, যদিও দেবেশবাবুর কাজ হরপ্পার উপরে নয়। মনে আছে স্যার, স্টুয়ার্ট সাহেবের বন্ধু স্ট্যানফোর্ডের সেই প্রফেসরের কথা– যিনি খুব অবাক হয়েছিলেন দেবেশবাবুর হরপ্পা যাবার কথা শুনে। ধরে নিচ্ছি দেবেশবাবুর খরচা পাতি প্রফেসর উড নিজেই দিয়েছিলেন… ম্যাডাম ক্লারাকে দেবেশবাবুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এটা কোনো খরচই নয়।
দেবেশবাবুও প্রস্তাবে রাজি হলেন। হয় ওঁর নেশা কেটে গিয়েছিল, নয় উনি ভয় পাচ্ছিলেন প্রফেসর ওঁর অফিসে যদি ব্যাপারটা রিপোর্ট করেন, তাহলে একটা কেলেঙ্কারি হবে। বাকি প্রোগ্রাম ক্যানসেল করে উনি দেশে ফিরে গেলেন। এই জন্যই ওঁর ফেলোশিপে স্ট্যানফোর্ডে যাওয়ার কথা থাকলেও উনি আর যেতে পারেননি। তারপর দীপাদেবীকে বলে দেবেশবাবু হরপ্পায় গেলেন।”
“একটা প্রশ্ন”, প্রমথ বলল, “দেবেশবাবু যে রবার্ট উডের সঙ্গে যাচ্ছেন সেটা দীপাদেবীকে জানালেন না কেন।”
“ভেরি গুড কোয়েশ্চেন স্যার, একটু বাদেই সেখানে আসছি। হ্যাঁ, যা বলছিলাম প্রফেসর উড সাহেব যেটা বোঝেননি, সেটা হল ম্যাডাম ক্লারা দেবেশবাবুর জন্য একেবারে পাগল। দেবেশবাবুর মনোভাব জানা কঠিন, কিন্তু উনি নিশ্চয় ফাটা বাঁশের মাঝখানে স্যার। একদিকে দীপাদেবী, ম্যাডাম ক্লারাকেও এড়াতে পারছেন না, আবার প্রফেসর উডেরও ভয় আছে। হরপ্পায় ফোনে যোগাযোগ করতে পারাটা কঠিন, তাই মনে হয় ম্যাডাম ক্লারা তাঁর মনের কথা জানিয়ে দেবেশবাবুকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। হয়তো একাধিক চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু একটা চোখে পড়েছিল রবার্ট উডের। এটুকু বলে আমার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন, প্রফেসর উডের বাড়িতে যে চিঠিটা আপনি আর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দেখেছিলেন, সেটা প্রফেসর উডকে উদ্দেশ্য করে লেখা নয়, সেটা দেবেশবাবুকে লেখা চিঠি। প্রিয়তম R-এর R হল রয়, দেবেশবাবুর পদবি, রবার্ট নয়। আমার বিশ্বাস ঐ চিঠিটাই প্রফেসর উডের হাতে কোনো-না-কোনোভাবে পৌঁছেছিল। মানুষের মন বিচিত্রভাবে কাজ করে স্যার। কেন ম্যাডাম ক্লারার আর কোনো চিঠি বাড়িতে না রেখে, শুধু এই চিঠিটাই প্রফেসর রেখে দিয়েছিলেন, সেটা মনোবিদরাই বলতে পারবেন।”
“যাইহোক,” একেনবাবু বলে চললেন, “প্রফেসর উড নিশ্চয় এই চিঠিটা দেখে ক্ষেপে উঠলেন। তারপর কী হল আমরা শুধু অনুমান করতে পারি স্যার। আমার ধারণা, দেবেশবাবু ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটবে আশঙ্কা করেছিলেন। সেই ভয়ে স্যুটকেস প্যাক করে, ক্যাম্প ছেড়ে পালাবার উদ্দেশ্যে স্টেশনে যাচ্ছিলেন। ওঁদের দুজনের মধ্যে তিক্ততা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে দেবেশবাবু ওঁর রিসার্চ পণ্ড করার জন্য ওঁদের যেটা সবচেয়ে বড় আবিষ্কার সেই পাথরটা নিজের স্যুটকেসে প্যাক করে নিয়েছিলেন। কিন্তু অদৃশ্য হতে পারার আগেই তিনি খুন হন। প্রফেসর উড নিজে দেবেশবাবুকে খুন করেছিলেন, না অন্য কেউ ওঁর হুকুমে গুলি চালিয়েছিল, সেটা স্যার জানা অসম্ভব। তবে উনি যে দেবেশবাবুর মৃত্যুর জন্য দায়ী সে বিষয় আমি নিশ্চিত।”
“ওয়েট এ মিনিট, প্রমথ বলল, “এটা তো শ্রেফ আপনার কল্পনা বলে আমি উড়িয়ে দিতে পারি।”
“তা পারেন স্যার, কিন্তু তাহলে প্রফেসর উডের পরের অ্যাকশনগুলো এক্সপ্লেইন করতে পারবেন না।”
“তার মানে?”
“একটু ভাবুন স্যার, প্রফেসর ফেরা মাত্র ম্যাডাম ক্লারা ডিভোর্স চাইলেন আর প্রফেসর উচ্চবাচ্য করে ম্যাডামকে বাড়ি, গাড়ি, ইত্যাদি –যা প্রাপ্যের থেকে অনেকে বেশি দিয়ে দিলেন। কেন?”
“আই ডোন্ট নো।”
“তার একটাই সম্ভাব্য কারণ স্যার, প্রফেসর উডের সঙ্গে যখন দেবেশবাবুর ঝগড়া চলছে, তখন দেবেশবাবু নিশ্চয় আঁচ করতে পেরেছিলেন যে ওঁর জীবনসংশয় হতে পারে। সেটা তিনি ম্যাডাম ক্লারাকে জানিয়েছিলেন। দেবেশবাবুর মৃত্যুর পর, সেটাই হয়ে দাঁড়াল ম্যাডাম ক্লারার তুরুপের তাস। প্রেমিককে তিনি পেলেন না, কিন্তু তার জন্য খেসারত পুরোপুরি আদায় করলেন প্রফেসর উডের কাছ থেকে। শুধু তাই নয়, আমার বিশ্বাস ডিভোর্সের পরেও যখন প্রয়োজন হতো সোজা এসে দশ পনেরো হাজার ডলার নিয়ে চলে যেতেন। টাকা না দিলে পুলিশের কাছে সব কিছু ফাঁস করে দেবেন ভয় দেখিয়ে। প্রফেসরের ভাঁড়ার যখন শূন্য হয়ে আসে তখন ম্যাডাম ক্লারা ক্যালিফোর্নিয়া চলে যান।”
“বুঝলাম, কিন্তু দীপাদেবী কেন সন্দেহ করলেন স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে রবার্ট উড জড়িত?”
“দীপাদেবীর চরিত্রটা স্যার মোস্ট কমপ্লেক্স। উনি পাথরটা নিয়ে এসেছিলেন অনেক ঝুঁকি নিয়ে। এইসব জিনিস বাইরে আনা বে-আইনি নিশ্চয় উনি জানতেন। তবু ওটা এনেছিলেন যাঁর প্রাপ্য তাঁকেই ফেরত দিতে। উনি জানতেন কার সঙ্গে দেবেশবাবু হরপ্পা গিয়েছিলেন, তবে জানতেন না কোথায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। নিজের অজান্তেই ওঁকে সাহায্য করলেন প্রফেসর গেরহার্ট।”
প্রফেসর গেরহার্ট বললেন, “দীপা তো প্রফেসর উড সম্পর্কে কিছু জানতে চাননি, আমিই বরং উদ্যোগী হয়েছিলাম।”
“তা চাননি স্যার, কিন্তু পাথরের প্রসঙ্গটা উনিই তুলেছিলেন। শুধু তাই নয় বলেছিলেন পাথরটা উনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। স্বামীর মৃত্যু-কাহিনিতে এই পাথরের গল্পটা যোগ করা আমার একটু অবান্তর মনে হয়েছিল স্যার। কিন্তু দীপাদেবী জানতেন যে এই পাথর সম্পর্কে ইন্টারেস্ট শুধু কয়েকটি লোকের থাকবে। তাঁদের কাছ থেকেই প্রফেসর উডের খবর পাওয়া যাবে।”
প্রমথ বলল, “কিন্তু এত বাঁকা পথে এগোনোর কি দরকার ছিল, সোজাসুজি গেরহার্ট সাহেবকে বললেই তো হত।”
“তার কারণ খুব সিম্পল, উনি চাননি প্রফেসর উড আগের থেকেই জানুন যে দেবেশ রায়ের স্ত্রী ওঁর খোঁজ করছেন। দীপাদেবী আঁচ করেছিলেন স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে প্রফেসর উড সম্ভবত জড়িত। সন্দেহ শুরু হয়েছিল ওই স্যুটকেসটা পাবার পর থেকে। হয় যে নিয়ে এসেছিল তার দেওয়া কোনো খবরে অথবা স্যুটকেসের ভেতর ম্যাডাম ক্লারার কোনো চিঠিপত্র থেকে। দেবেশবাবু যে নারীঘটিত কোনো একটা সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁর আকস্মিক মৃত্যুটা কোনো ডাকাতের আক্রমণে নয়, এই সন্দেহ মনে হয় তাঁর জেগেছিল। যেটা আমরা জানি স্যার, সেটা হল স্যুটকেস পেয়ে দীপাদেবী খুবই বিচলিত হয়েছিলেন। শুভবাবু মাকে ধীরস্থির মহিলা বলেই জানতেন। তিনি মা-কে এরকম আপসেট হতে দেখে যখন প্রশ্ন করেছিলেন, দীপাদেবীর উত্তর, ‘তুই বুঝবি না, তোকে বোঝানো যাবে না। বাবার মৃত্যুতে মায়ের দুঃখ হয়তো ছেলেকে বোঝানো যায় স্যার। কিন্তু বাবার পদস্খলনে মায়ের দুঃখটা ছেলেকে বোঝানো শক্ত।”
এটুকু বলে একেনবাবু একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “দীপাদেবী একজন রিমার্কেবল লেডি স্যার। ওঁর কর্তব্যজ্ঞান প্রবল। বহুমূল্য পাথরটা উনি যাঁর প্রাপ্য, যিনি এর সুব্যবহার করতে পারবেন –তাঁর হাতেই ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অন্যপক্ষে শি ওয়াজ ইন এ মিশন টু ফাইণ্ড দ্য ট্রুথ।”
“তা বুঝলাম, কিন্তু ভৈরববাবু এ ব্যাপারে জড়িত –সেটা সন্দেহ করলেন কেন?”
“কারণ মনে হল স্যার, এ ব্যাপারে যিনি ওঁকে সাহায্য করতে পারেন তিনি হচ্ছেন ভৈরববাবু। ভৈরববাবুকে দীপাদেবী বহুদিন ধরে চিনতেন। তিনি ছিলেন প্রায় ভাইয়ের মতো এবং ওঁর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। একমাত্র তাঁর সাহায্যই চাওয়া যায় প্রফেসর উডের বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য। ওই একটা জায়গাতেই আমি একটু চান্স নিয়েছিলাম স্যার। শুভর কোনো বন্ধুর সাহায্য নিতে পারতেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল এই মিশনে ছেলের কোনো বন্ধুকে জড়াবেন না। কিন্তু দেখলাম ভৈরববাবুকে চেপে ধরতেই বেশ মিলে গেল।”
“তাহলে পাথর চুরি হয়ে যাবার ব্যাপারটা পুরো সাজানো?”
“হ্যাঁ স্যার, হয়তো ভৈরববাবুর সঙ্গে পরামর্শ করেই গল্পটা বানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রফেসর উডের মৃত্যুর জন্য যে তিনি দায়ী এই চিন্তাটা কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছিলেন না। সেইজন্যই ওই ঘটনার পরে উনি মানসিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এরমধ্যে অধ্যাপক গেরহার্ট আমাকে নিযুক্ত করলেন চুরির কিনারা করতে। তখনই হল মুশকিল। খবরটা শুনে ভৈরববাবু নিশ্চয় ওঁকে সতর্ক করেছিলেন, কারণ ওঁর আবার আমার ক্ষমতার উপর একটু বেশি আস্থা। তাই প্রথমে ‘হ্যাঁ’ বলেও দীপাদেবী পিছিয়ে যান। ভৈরববাবুও স্যার নিশ্চিত হতে চাইছিলেন যে চুরি নিয়ে আমি আর তদন্ত করছি না, তাই বাপিবাবুকে দিয়ে সেটা কনফার্ম করার চেষ্টা করেছিলেন। চুরি-রহস্যের সমাধান হয়ে গেলে উনিও তো সমস্যায় পড়বেন। এদিকে বাঁচার ইচ্ছে দীপাদেবীর ফুরিয়েই আসছিল, সেটা তো দেখলেনই স্যার।”
আমি আর প্রমথ চুপ। প্রফেসর গেরহার্ট শুধু মাথা নেড়ে বললেন, হোয়াট এ ট্র্যাজেডি।
