ম্যানহাটনে ম্যানহান্ট (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত

শেয়ার করুনঃ

এক

সকালে ঘুম ভেঙে গেল কিচেনে খুটখাট আওয়াজ শুনে। বুঝলাম প্রমথ আর একেনবাবু যথারীতি ওপরে উঠে এসে ব্রেকফাস্ট নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন! এটা আমাদের প্রায় ডেইলি রুটিন। ব্রেকফাস্টটা আমার অ্যাপার্টমেন্টেই হয়, আর ডিনারটা নীচে প্রমথর অ্যাপার্টমেন্টে। অবশ্য শুধু প্রমথর অ্যাপার্টমেন্টে বলাটা আর ঠিক নয়। অবিনাশ চলে যাওয়ার পর একেনবাবু বেশ পাকাপাকি ভাবেই প্রমথর সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টটা শেয়ার করছেন। আসলে গত বছর উনি গেস্ট হিসাবে আমার কাছে এক মাসের মতো ছিলেন। সেই অল্প সময়ের মধ্যেই ম্যানহাটানে বিখ্যাত ‘মুনস্টোন মিস্ট্রি’ সলভ করে ওঁর একটা ফিল্ড হয়ে গেল যে, তার জোরেই এবার একটা ফুলব্রাইট স্কলারশিপ ম্যানেজ করে পুরোপুরি দু’বছরের মেয়াদে এখানে এসেছেন। আমাদের নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতেই ক্রিমিনোলজির ওপর রিসার্চ করছেন।

 

হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে দেখি ফ্রেঞ্চ টোস্ট তৈরি হচ্ছে। খুন্তি হাতে ব্যস্ত একেনবাবু। মুখে আবার একখাবলা দাড়ি, চুলগুলো উসকোখুসকো, গায়ে আধময়লা পাঞ্জাবি, সেটাও আবার বিচ্ছিরিভাবে কোঁচকানো। পাশে দাঁড়িয়ে প্রমথ। হাত-পা নেড়ে প্রচন্ড ভাবে একেনবাবুকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছে! আর একটু ভাজুন, ‘ব্যস, আর নয়, এবার উলটে দিন, ‘তেল বেশি গরম হয়ে গেছে, হিটটা একটু কমান,’ এইসব আর কি। একেনবাবু অনুগত শিষ্যের মত সেগুলো শুনছেন, আর গুরুকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছেন, ‘কেমন হচ্ছে স্যার, ‘বেশি ভেজে ফেলছি না তো, ইত্যাদি।

 

ব্রেকফাস্টের মেইন কোর্সটা দেখেই আমার মেজাজ বিগড়োল। ফ্রেঞ্চ টোস্ট কথাটা শুনতেই শুধু গালভরা। আসলে ওটা হল প্লেন এন্ড সিম্পল ডিম-পাঁউরুটি ভাজা- নো পেঁয়াজকুচি, নো কাঁচালঙ্কা, নো কিছু! সায়েবরা আবার এগুলোই খায় মিষ্টি মিষ্টি মেপল সিরাপের সঙ্গে! কী ডেডলি কম্বিনেশন!

 

আমি প্রমথকে বললাম, “কী রে একটু পেঁয়াজ দিতে পারলি না?”

 

“ফ্রেঞ্চ টোস্টে!” প্রমথ চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই একটা ইডিয়ট!”

 

“ফ্রেঞ্চ টোস্টের দরকার কী ছিল, আমাদের দেশি মতে করলেই তো পারতিস!”

 

“শুনছেন বাপিটার কথা,” প্রমথ একেনবাবুকে বলল, “এদিকে উনি উঠতে বসতে আমেরিকানদের তেল দেন, শুধু খাবার সময় হলেই ভেতো বাঙালি।”

 

“চুপ কর স্টুপিড, আমি মোটেও আমেরিকানদের তেল দিই না!” আমি প্রতিবাদ করলাম।

 

“থাক, আর নিজের সাফাই গাইতে হবে না। কষ্ট করে ব্রেকফাস্টটা খা। রাত্রে তো ফুল কোর্স বাঙালি খাবার জুটবেই।”

 

“তার মানে?”

 

“এর মধ্যেই ভুলে মেরে দিলি?” শ্যামলদার বাড়ি আমাদের নেমন্তন্ন না?

 

.

 

প্রমথর কথায় মনে পড়ে গেল। সত্যিই তো, শ্যামলদা আমাদের সবাইকে আজ ডিনারে ডেকেছেন। সাধারণত এরকম একটা সম্ভাবনায় আমি প্রচণ্ড উৎফুল্ল হই। কিন্তু আজকে হতে পারলাম না। অবশ্য তার কারণ শ্যামলদা বা রীনা বৌদি নন। ওঁরা দুজনেই অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ লায়ন –হার্টেড লোক, যখন তখন আমাদের জুলুম সহ্য করেন। সত্যি কথা বলতে কি, এই নিউ ইয়র্কের আমেরিকান মরুভূমিতে বাঙালি ওয়েসিস বলতে যদি কিছু থাকে –সেটা হল এঁদেরই বাড়ি! কিন্তু ইদানীং সেখানে ঢোকার জন্য একটা বাড়াবাড়ি রকমের মাসুল দিতে হচ্ছে। মাসুলটা হল, বেন্টুমাসির বাক্যবাণে জর্জরিত হওয়া! বেন্টুমাসি হলেন আমার দূরসম্পর্কের মাসি, শ্যামলদার মা। মাস তিনেকের জন্য ছেলের কাছে বেড়াতে এসেছেন। না, গুরুজনদের নিন্দা করতে নেই আমি জানি। আসলে সব কিছুই হচ্ছে রিলেটিভ। বলতে কি, যে বিশেষ কারণে আমি বেন্টুমাসিকে সদা সর্বদা এড়াতে চাই, পুলিশের চাকরিতে ঠিক তার জন্যই লোকে রেগুলার প্রমোশন পেয়ে যায়! আমি ওঁর জেরা করার অসাধারণ ক্ষমতাটার কথা বলছি। মায়ের কাছে শুনেছি যে, ওঁর জেরার কাছে উত্যক্ত হয়ে বেন্টুমেসো নাকি একদিন প্রায় সন্ন্যাসীই হয়ে যাচ্ছিলেন! বাস্তবিকই, অত্যন্ত ডেঞ্জারাস মহিলা আমার এই বেন্টুমাসি! এদেশে এসে শুধু প্রথম ক’দিন একটু ড্যাম্প মেরে ছিলেন। এখন আবার ফুল ফর্মে। তার ওপর হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এখানকার ভারতীয়দের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন। ছেলেবেলায় স্কুলেরম্যাগাজিনে উনি নাকি দারুণ দারুণ সব ভ্রমণকাহিনি লিখতেন! সেই স্টাইলেই একটু রং টং ফলিয়ে একটা ভ্রমণ-কাম-উপন্যাস লিখে ফেলবেন, সেটাই হচ্ছে প্ল্যান! তার জন্য অবশ্য অনেক রসদ চাই। ফলে সামনে একবার পড়লেই হল! চেপে ধরে পেটের কথা মুচড়ে মুচড়ে টেনে বার করবেন!

 

.

 

শ্যামলদার বাড়ি খুব দূরে নয়, জার্সি সিটিতে। হল্যান্ড টানেল পার হওয়ার পর মাত্র পাঁচ মিনিট। আমরা পৌঁছলাম সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। বাইরের ঘরে লেজিবয় চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন বেন্টুমাসি। চুলে একটু একটু পাক ধরায় মুখটা আজকাল যেন আরও ভারিক্কি দেখায়। সোনালি ফ্রেমের চশমাটা নাকের ডগায় লাগানো। নাকের ঠিক নীচেই রোঁয়া রোঁয়া এত লোম যে, হঠাৎ গোঁফ বলে ভুল হতে পারে! আর তার বাঁ দিক ঘেঁসে কিসমিস সাইজের একটা আঁচিল। সাহেবদের দেশে এসেছেন বলেই বোধহয় শাড়ির ওপর একটা হাউসকোট চড়িয়েছেন! এমনিতেই উনি দশাসই, তার উপর বেঢপ সাইজের হাউসকোট, দেখে মনে হচ্ছে ছোটখাটো একটা পাহাড়।

 

“এই যে তোরা সব এসে গেছিস!” বেন্টুমাসি আমাকে আর প্রমথকে দেখে সোফা থেকেই চেঁচিয়ে উঠলেন, “কই, তোদের গোয়েন্দাবন্ধুটি কোথায়?”

 

“একেনবাবু গাড়িতে কী যেন ফেলে এসেছেন, সেটা নিয়ে আসছেন।” কথাটা বলেই আমি সুট করে কিচেনে গা-ঢাকা দিলাম।

 

রীনা বৌদি রান্নাঘরে ফিশফ্রাই করছিলেন। মুখ টিপে হেসে বললেন, “কী, মাকে বেশ এড়িয়ে এলেন যে!”

 

এরকম হাতেনাতে ধরা পড়ে যাব বুঝিনি! আমতা-আমতা করে বললাম, “না, না, বৌদি, আসলে ভাবলাম আপনার যদি কোনো হেল্প –মানে যোগান-টোগান দেয়ার দরকার পড়ে, সেইজন্যই …।”

 

“বুঝেছি, বুঝেছি,” রীনা বৌদি আমাকে থামিয়ে বললেন, “কিন্তু কোনো সাহায্যের দরকার নেই ভাই। বসে গল্প করুন, তাহলেই সাহায্য হবে!”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ বৌদি।” বলে রান্নাঘরের সঙ্গে ব্রেকফাস্টের যে জায়গাটা সেখানেই জাঁকিয়ে বসলাম।

 

রীনা বৌদি ফ্রাই ওলটাতে ওলটাতে বললেন, “মা আজ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন।”

 

“কেন বলুন তো?”

 

“একটা রহস্যের গন্ধ পেয়েছেন, তাই নিয়ে খুব উত্তেজিত! সকাল থেকে অনেক গবেষণা চলছে।”

 

ঠিক বুঝতে পারলাম না রীনা বৌদি ঠাট্টা করছেন কিনা। তাই দরজার ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বেন্টুমাসি কী বলছেন শুনবার চেষ্টা করতেই একেবারে চোখাচোখি হয়ে গেল!

 

“এই বাপি, রান্নাঘরে কী করছিস পেটুক কোথাকার! এদিকে আয়!”

 

এই ডাক কখনোই উপেক্ষা করা যায় না। গুটিগুটি সোফায় গিয়ে বসলাম। বেন্টুমাসি ইতিমধ্যে ওঁর পুরোনো প্রসঙ্গে ফিরে গেছেন, “বুঝলে একেন, একেবারে জলজ্যান্ত মার্ডার!”

 

মার্ডার কী করে জলজ্যান্ত হয়, সেটা অবশ্য বুঝলাম না। একেনবাবু কিন্তু অম্লান বদনে বললেন, “তাই নাকি ম্যাডাম, কী সর্বনাশ!”

 

“তোমার এই ম্যাডাম, ম্যাডাম ছাড় তো! মুখ দিয়ে কি মাসিমা কথাটা বেরোয় না?”

 

“না ম্যাডাম, মানে মাসিমা, নিশ্চয়ই বেরোয়।”

 

“তাহলে, সেটাই বলবে। ম্যাডাম কথাটা শুনলেই আমার গা জ্বলে! হ্যাঁ কী জানি বললে… সর্বনাশ … সর্বনাশ বলে সর্বনাশ! একেই বলে দুধকলা দিয়ে সাপ পোষা! যে তোকে এতদিন খাওয়াল, পরাল তাকেই কিনা শেষে খুন করলি!”

 

“কার কথা বলছ বেন্টুমাসি?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

 

“কার আবার, সাহানিদের বাড়িতে বেড়াতে এসে যিনি খুন হলেন, তাঁর সার্ভেন্টের কথা বলছি।”

 

কারোর উপর খুব না চটলে বেন্টুমাসি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন না। কিন্তু সাহানি বলতে কার কথা বলছেন, ধরতে পারলাম না।

 

“কোন সাহানির কথা বলছো তুমি?” জিজ্ঞেস করলাম।

 

‘ক’টা সাহানি আছে তোদের এমুলুকে,” বেন্টুমাসি আমাকে ধমক দিলেন, “অরুণ আর অশোক ছাড়া?”

 

অরুণ বা অশোক কাউকেই আমি চিনি না। তবে শ্যামলদার কাছে ওদের গল্প অনেক শুনেছি। বড় ভাই অশোক আই.বি.এম বা ওরকম কোনো একটা বড় কোম্পানিতে কাজ করে, আর অরুণের একটা বিজনেস আছে। নিউ ইয়র্ক সিটির লাগোয়া হোয়াইট প্লেইন্স শহরে ওরা থাকে। শ্যামলদারাও আগে ওখানে থাকত। তাই এখনও খুব যাতায়াত আছে।

 

“কী বলছো তুমি, সাহানিদের গেস্টকে তাঁর কাজের লোকটা খুন করেছে?”

 

“না করেনি,” বিরক্ত হয়ে বেন্টুমাসি বললেন, “আমি তোদের বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছি!”

 

“তা বলছি না। কিন্তু এটা যে মার্ডার সেটা তুমি জানলে কী করে! পুলিশ কি তাই বলছে?”

 

“আরে রাখ তোদের পুলিশ!” আমাকে এক ধমক দিলেন বেন্টুমাসি।

 

“আমাদের কি চোখ-কান নেই! আচ্ছা বল তো একেন, সার্ভেন্টটা যদি নির্দোষই হবে, তা হলে মনিব মরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে হাওয়া হল কেন?”

 

একেনবাবু দেখলাম প্রশ্নটা দিব্যি পাশ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ভদ্রলোক মরলেন কী করে ম্যাডা… মাসিমা?”

 

শ্যামলদা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। রান্নাঘর থেকে রীনা বৌদির ডাক শুনে উঠতে উঠতে বললেন, “ন্যাচারাল কজ। পিওর অ্যান্ড সিম্পল হার্ট অ্যাটাক।”

 

শ্যামলদার এই কথায় আমার আর সন্দেহ রইল না যে, বেন্টুমাসি তিল থেকে তাল করছেন!

 

“তোর তো সেই এক কথা,” পুত্রকে নস্যাৎ করলেন বেন্টুমাসি। “সবই যদি নর্মাল হবে, তাহলে অমন চুরিটা হবে কেন?”

 

.

 

শ্যামলদা ঘর থেকে বেরোবার আগে মাকে আড়াল করে আমার দিকে চোখটা একটু টিপে চলে গেলেন। অর্থাৎ ‘মার কথাগুলোকে গুরুত্ব দিস না।’

 

প্রমথ একটু ভারিক্কি চালে বলল, “আমার মনে হয়, এটা দুটো ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্যাপার। মানে এই ভদ্রলোকের মৃত্যু, আর চাকরের চুরিটা। এ দুটো মিক্স করা উচিত হবে না। বিশেষ করে ডেথটা যখন ন্যাচারাল।”

 

“তুই তো দেখছি তোর শ্যামলদার মতো কথা বলছিস! ধর, লোকটার খুব হার্টের ব্যামো ছিল, আর গন্ডায় গন্ডায় বড়ি গিলতে হতো। এবার ধর, ওই সার্ভেন্টটা ফন্দি করে আসল বড়ির বদলে ভেজাল কিছু দিয়ে দিল। তাহলে কী হবে, লোকটা হার্ট অ্যাটাকে মরবে না?”

 

বেন্টুমাসি যে এরকম বৈজ্ঞানিক ভাবে চিন্তা করবে, সেটা আমি কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে প্রমথটা হচ্ছে গোঁয়ার। বলল, “না বেন্টুমাসি, ইট ডাজ নট মেক সেন্স। সেটা হবে, কিলিং এ গুজ দ্যাট লেইজ গোল্ডেন এগস। যে খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে –তাকে মারা মানেতো রুইনিং ওয়ানস স্টেডি সোর্স অফ ইনকাম!”

 

“থামা তো বাপু তোর ইংরেজি কচাকচি! কচু বুঝেছিস!” প্রমথ তাও ছাড়ে না। বলল, “কেন কচু বুঝব? মারার কী মোটিভ থাকতে পারে?” বেন্টুমাসি হতাশ ভাবে মাথা নাড়লেন। “নাহ তোর মাথায়ও দেখছি বাপির মতোই গোবর! খামোখা কি মেরেছে! যেই জানতে পেরেছে যে, মনিবের ব্যাগ হিরে জহরতে ভর্তি, সঙ্গে সঙ্গে মুখে বিষ তুলে দিয়েছে!”

 

“বিষ?”

 

“ওই হল। মরণাপন্ন হার্টের রুগিকে ওষুধ না দেওয়া, আর বিষ তুলে দেওয়ার মধ্যে তফাত কোথায়?”

 

“পুলিশে মিসিং রিপোর্টটা করা হয়েছে তো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“তা কী আর হয়নি। কিন্তু এখানকার পুলিশগুলো সব অকস্মার ভেঁকি! প্রতিদিন টিভিতে দেখিস না, গণ্ডায় গণ্ডায় লোক খুন হচ্ছে। ধরতে পারছে কাউকে? সে জন্যই একেনের ওপর খোঁজার ভারটা আমি দিতে চাই। সার্ভেন্টটাকে ধরতে পারলেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। কী একেন চুপ করে আছ যে?” বেন্টুমাসি প্রশ্ন করলেন।

 

“কিছু না মাসিমা, একটু ভাবছিলাম। “ এবার খুব সতর্ক হয়ে মাসিমা’ বললেন একেনবাবু। বেন্টুমাসি বলে কথা!

 

“শুধু ভাবলে চলবে না, কাজে লেগে যাও। আর কোনো কেস আছে নাকি তোমার হাতে?”

 

“না, তা ঠিক নেই।”

 

“কেন বাপু, কেউ আর ডাকছে না তোমায়?”

 

“আসলে আমি এবার এখানে এসেছি শুধু রিসার্চ করতে, সেইজন্যই…।”

 

“এটা আবার কী রকম কথা বললে! গোয়েন্দারা যদি শুধু গবেষণা করেই কাটায়, তাহলে খুনে বদমাশদের ধরবে কে?”

 

“তা তো বটেই,” একেনবাবু কাঁচুমাচু মুখে একটু হাসলেন।

 

“ব্যস, তাহলে আর কী, কাজ শুরু করে দাও।”

 

“তা করব। আসলে সময়েরই যা একটু অভাব, মানে…।”

 

“ঘুম থেকে কখন ওঠো?”

 

“আজ্ঞে?”

 

“জিজ্ঞেস করছি, ঘুম ভাঙে কখন?”

 

“এই সাতটা নাগাদ।”

 

“কখন শুতে যাও?”

 

“শুতে শুতে প্রায় এগারোটা হয়।”

 

“বল কী, এই ছেলে ছোকরা বয়সে আট ঘন্টা ধরে ঘুমোচ্ছ! রাত্রি বারোটায় শোবে, ভোর পাঁচটায় উঠবে। যাও, তিন ঘন্টা তোমার একস্ট্রা সময় করে দিলাম, খুঁজে বের করো ব্যাটাকে। আর এই বাপি আর প্রমথটাকেও কাজে লাগাও। এইসব করে যদি ওদের বুদ্ধিটা একটু খোলে!”

 

প্রমথটার কী স্পর্ধা, বলে কিনা, “বাপিকে বলছ বলো বেন্টুমাসি, কিন্তু আমাকে গালমন্দ করছ কেন?”

 

বেন্টুমাসি সেই ছেলেবেলার মতো চটাস করে প্রমথর মাথায় চাঁটা মারলেন, “চুপ কর! তোকে দেখছি সেই এইটুকুন থেকে। তারপর শুধু লম্বাতেই বেড়েছিস, বুদ্ধিতে আর বাড় হয়নি!”

 

এমন সময় শ্যামলদা ঘরে ঢুকে বলল, “মা, তোমার যা বলার শেষ হয়েছে?”

 

প্রমথ চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “অনেকক্ষণ, কেন বল তো শ্যামলদা?”

 

“আরে একটা দুর্দান্ত ফ্রিজার কিনেছি, তোদের দেখাব।”

 

ফ্রিজার দেখার আমার এতটুকু উৎসাহ নেই, কিন্তু বেন্টুমাসির হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আমি বললাম, “তাই নাকি? ওয়ান্ডারফুল, চলো চলো!”

 

বেন্টুমাসি স্বগতোক্তি করলেন, “মোলো যা, বরফকল কখনো দেখিসনি আগে?”

 

সিঁড়ি দিয়ে বেসমেন্টে নামতে নামতে শ্যামলদা বললেন মায়ের কাছে বসে বোর হচ্ছিস বলে নিয়ে এলাম। তবে ফ্রিজারটা খুব ভাল দাঁওয়ে পেয়েছি। লেস দ্যান থ্রি হানড্রেড!”

 

শ্যামলদা ভুল বলেননি। থার্টি টু কিউবিক ফিটের একটা বিশাল ফ্রিজার!

 

“এত বড় ফ্রিজার দিয়ে করবে কী, এর মধ্যে তো বাঘ লুকিয়ে থাকতে পারে!” আমি প্রশ্ন করলাম।

 

“আরে বুদ্ধিটা সেদিন অশোক সাহানি দিল। মাছ-মাংস বা ফ্রোজেন খাবার সস্তায় পেলেই একগাদা কিনে ফ্রিজারে ঢুকিয়ে ফেলব, তারপর মাসের পর মাস খাব! ইনফ্যাক্ট, ও ক্যালকুলেট করে দেখাল, দেড় বছরের মধ্যে ফ্রিজাররের দাম উঠে আসবে!”

 

“নাহ, তোমাদের বাড়ি আর আসব না।” প্রমথ নাক সিঁটকে বলল, “এলেই ছ-মাসের পুরোনো মাছ খাইয়ে দেবে।”

 

“স্টুপিডামো করিস না!” শ্যামলদা ধমক দিলেন। “সুপারমার্কেট থেকে যখন মাছ। কিনিস, তখন কি তোর জন্য নদী থেকে ওগুলো ফ্রেশ তুলে আনে? জায়ান্ট ফ্রিজারে ওগুলো যেসব স্টোর করা থাকে, সেটা জানিস না!” ।

 

একেনবাবু এতক্ষণ ফ্রিজারটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শ্যামলদার কথাগুলো শুনছিলেন। মাথা নাড়তে নাড়তে ওঁর অনুকরণীয় ভঙ্গীতে মন্তব্য করলেন, “দিস কানট্রি ইস ট্রলি অ্যামেজিং স্যার।”

 

খাবার সময় আমরা আবার বেন্টুমাসির খপ্পরে পড়লাম। ফলে রীনা বৌদির দুর্দান্ত রান্না যে একটু প্রাণভরে উপভোগ করব, তা আর হয়ে উঠল না। ওঁর মাথায় এখন রহস্যের পোকা ঢুকেছে, সেটাকে তাড়াবে কে? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই এককথা! যিনি মারা গেছেন তাঁর নাম অন্তত কুড়ি বার বললেন বেন্টুমাসি, পাছে একেনবাবু ভুলে যান। অথচ নামটা এমন কিছু কমপ্লিকেটেড নয়, শ্যাম মিরচন্দানি। আর সার্ভেন্টটার নাম হল গোভিন্দ। সাধে কি আর শ্যামলদার ওখানে যেতে চাই না!

 

.

 

বিকেলে ফেরার পথে একেনবাবু হঠাৎ বললেন, “একটা জিনিস ইন্টারেস্টিং স্যার, এদেশে মেডসার্ভেন্ট দেখেছি। কিন্তু কারো বাড়িতে কখনও সার্ভেন্ট দেখিনি।”

 

“তার কারণ মশাই অতি সিম্পল,” প্রমথ বলল। “এখানে আপনি শুধু চেনেন আমাদের বন্ধুদের। হাই সোসাইটিতে যান না, বাটলার, সার্ভেন্ট, গর্ডনার, কুক সব কিছুই পাবেন।”

 

আমি বললাম, “একেনবাবুর অবজার্ভেশনে কিন্তু কোনো ভুল নেই এখানকার অনেক বড়োলোক ইন্ডিয়ান দেশ থেকে মহিলাদের নিয়ে আসেন বাড়ির কাজ করার জন্য। কিন্তু কাজের লোক কেউ এনেছেন বলে শুনিনি। আই ওয়ান্ডার হোয়াই!”

 

এ নিয়ে অবশ্য আর কোনো কথা হল না। যথারীতি একেনবাবুর চিন্তা ইতিমধ্যে অন্যদিকে চলে গেছে। বললেন, “যাই বলুন স্যার, আপনার বেন্টুমাসি কিন্তু খুব ফোর্সফুল মহিলা।”

 

প্রমথ বলল, “এত ভদ্রতা করছেন কেন মশাই, বলুন না জাঁহাবাজ!”

 

“ছি, ছি, কী যে বলেন স্যার, বাপিবাবুর মাসি!”

 

“আমারও তো পাড়াতুতো মাসি তা বলে মুখে এক পেটে একের মধ্যে আমি নেই।”

 

দুই

একেনবাবু বেন্টুমাসিকে ভালোভাবে চেনেন না। নইলে সেদিন ফিরে এসেই গোভিন্দ সন্ধানে তৎপর হতেন। কোনো কিছু একবার মাথায় চাপলে সেটা চট করে ভুলে যাবার লোক, আর যেই হোক, আমার বেন্টুমাসি অন্তত নন! দু’দিনও পার হয়নি, সাত সক্কালে ওনার ফোন! সাধারণত এই সময়ে আমি ঘুমে অচেতন, নিতান্ত আজ সরস্বতী পুজো বলে অ্যালার্ম দিয়ে উঠেছি। ফোনে তুলতেই, কী খবর, কেমন আছিস’ –কিছু নয়। আমাকে সোজা জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, একেন হদিশ পেল কিছু, কোনো সাড়া-শব্দ নেই তোদের?”

 

ভাগ্যিস একেনবাবু সামনেই বসে ছিলেন, আমি তাড়াহুড়ো করে একেনবাবুর হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিলাম। তারপর ঝাড়া পাঁচ মিনিট একেনবাবুর তরফ থেকে শুধু “হ্যাঁ”

 

“তাই নাকি,”

 

“আচ্ছা,” আর “না” ছাড়া –আর কিছু কানে এল না!

 

ফোনটা নামিয়ে একেনবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “মাসিমা স্যার, আমাদের ওপর খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন!”

 

প্রমথ বলল “দাঁড়ান, দাঁড়ান, এর মধ্যে আবার আমাদের কথাটা এল কোত্থেকে? খোঁজার ভার তো আপনার ওপর মশাই? “

 

আমি বললাম, “চুপ কর, ওঁকে আর জ্বালাস না। আচ্ছা সত্যিই, লোকটা গেল কোথায় বলুন তো?”

 

“নো আইডিয়া স্যার। গতকাল আমি ইনস্পেকটর লান্ডিকে ফোন করেছিলাম।”

 

“সে আবার কে?” একেনবাবুকে থামিয়ে প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

 

“হোয়াইট প্লেইন্স পুলিশের লোক। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের অফিসে একবার ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেই সূত্রেই …।”

 

“ও হরি! তার মানে আপনি এ-ব্যাপারে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় নন! আমাদের আড়ালে আবডালে অনেক কিছু চালিয়ে যাচ্ছেন!” প্রমথ ঠেস দিয়ে বলল।

 

“কী মুশকিল স্যার,” একেনবাবু আমাকে সাক্ষী মানলেন, “প্রমথবাবু এদিকে বলবেন টিমে নেই, আবার খেলতে না ডাকলে রাগ করবেন!”

 

“সত্যি,” আমি প্রমথকে বললাম, “তুই গাছেরও খাবি, তলারও কুড়োবি –সেটা তো চলে না!”

 

“তুই চুপ কর, আর ওকালতি করতে হবে না!” প্রমথ আমাকে ধমকে একেনবাবুকে হুকুম করল, “বলুন, যা বলছিলেন।”

 

“ও হ্যাঁ, স্যার, ইন্সপেক্টর লান্ডির কথা। উনিই গোভিন্দ জসনানির কেসটা হ্যাঁন্ডেল করছেন।”

 

“গোভিন্দ জসনানি! বাঃ, এই তো একটা নতুন তথ্য!”

 

“কী নতুন তথ্য স্যার?”

 

“এই যে পদবীটা বললেন, ‘জসনানি’ –সেইটে। এদ্দিন পর্যন্ত তো লোকটা ছিলেন সার্ভেন্ট গোভিন্দ! ঠিক আছে, চালিয়ে যান।”

 

“বলার বিশেষ কিছুই নেই স্যার। পুলিশের কোনো ধারণাই নেই যে, লোকটা কোথায়!”

 

“ব্যাপারটা সত্যিই খুব স্ট্রেঞ্জ,” আমি বললাম। “হঠাৎ এভাবে একজনের হাওয়ায় উবে যাওয়া!”

 

“হাওয়ায় উবে যাবে কেন,” প্রমথ বলল, “নিশ্চয়ই কারো বাড়িতে আছে, বা কাছাকাছি কোনো হোটেলে গিয়ে উঠেছে! এই ঠান্ডায় তো আর কারোর পক্ষে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো সম্ভব নয়!”

 

“হোটেলে কখনোই ওঠেনি,” আমি বললাম। “তাহলে পুলিশ খবর পেত।”

 

“সেক্ষেত্রে অ্যানসার ইজ সিম্পল। লোকটা পরিচিত কারোর বাড়িতে উঠেছে। সুতরাং কাজ হচ্ছে চেনা-জানা সবাইকে ফোন করে খোঁজ নেওয়া। কী মশাই, ওরকম ভুরু কুঁচকে বসে আছেন কেন? কিছু ভুল বলছি?” প্রমথ একেনবাবুকে জিজ্ঞসে করল।

 

“কী যে বলেন স্যার, ভুল বলবেন কেন? আমি আসলে একটা অন্য কথা ভাবছিলাম।”

 

“আঃ, একটু ঝেড়ে কাশুন না! কী অন্য কথা?”

 

“মাসিমা একটু আগে বললেন যে, চেনা পরিচিত কারোর কাছ থেকেই নাকি কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তাই উনি ভাবছেন যে, কোনো আমেরিকানের বাড়িতে গিয়ে হয়তো উঠেছে। আপনাদের কী মনে হয় স্যার?”

 

“আই ডাউট ইট,” আমি বললাম। “অন্য জায়গার কথা বলতে পারব না, তবে নিউ ইয়র্কের কেউই কোনও অচেনা লোককে বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে আসতে দেবে না! কাজ দেওয়া তো দূরের কথা!”

 

“আমিও সেটাই ভাবছিলাম। তবে কিনা স্যার, আপনার হচ্ছেন এখানকার ভেটারেন লোক, এদের স্বভাবচরিত্র আপনারাই জানবেন বেশি।”

 

“তা হলে লোকটা গেল কোথায়?” প্রমথ খানিকটা আত্মগত ভাবেই প্রশ্নটা করল। “দ্য অ্যানসার টু দ্যাট পাজল উইল হ্যাভ টু ওয়েট। এখন যা, চানটান করে রেডি হয়ে নে। পুজোয় যাবি না!”

 

“ওই যাঃ, আপনাদের তো বলাই হয়নি স্যার! পুজোর কথায় মনে পড়ল। মাসিমা বললেন, আজ হোয়াইট প্লেইন্সেও সরস্বতী পুজো। সেখানে যদি যাই, তা হলে অরুণ, অশোক, মানে মিস্টার সাহানিদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। আমাদের কথা মাসিমা ওঁদের বলেছেন। ওঁরাও স্যার খুব উৎসুক আমাদের সঙ্গে কথা বলতে।”

 

“শুধু এই বলেছেন, না ওখানে যাবার হুকুম দিয়েছেন?” প্রমথ চোখ দুটো কুঁচকে প্রশ্নটা ছুঁড়ল।

 

“তা একরকম প্রায় হুকুমই স্যার।” একেনবাবু ধরা পরে স্বীকার করলেন। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি একটু কনফিউসড।”

 

“কী ব্যাপারে?”

 

“মাসিমা বললেন যে, জার্সি সিটিতে নাকি নেক্সট উইকে পুজো। সেটা কী করে হয়?”

 

“তার কারণ খুব সিম্পল মশাই, আমেরিকাতে দেশের মতো অত লগ্ন-ফগ্ন বিচার করে পুজো হয় না। পুজো করতে হলে করতে হবে উইকএন্ডে, সে আপনাদের পাঁজি যাই বলুক না কেন।”

 

প্রমথর কথা শুনে একেনবাবু হাঁ হয়ে আছেন দেখে আমি আবার যোগ করলাম, “শুধু তাই নয়, সব জায়গায় পুজো যদি একদিনে হয়ে যায়, তা হলে তো এক উইকএন্ডেই সব কিছু ফুরিয়ে গেল! ঘুরেঘুরে আমরা আনন্দ করব কী করে!”

 

“দিস ইস অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং!” একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন।

 

.

 

সাধারণত আমরা ব্রুকলিনের একটা পুজোতে যাই। নিউ ইয়র্ক আর তার আশপাশ নিয়ে দুর্গাপুজোই হয় প্রায় গোটা দশেক। সরস্বতী পুজো তো অগুনতি! ভক্তি থাকলে অবশ্য যে কোনো পুজোয় গিয়ে অঞ্জলি দিলেই হয়। তবে আমি আর প্রমথ দু’জনেই হলাম অ্যাগনস্টিক। এইসব পুজোয়-ফুজোয় আমাদের বিশ্বাস নেই। আমাদের পুজোয় যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, পিওর অ্যান্ড সিম্পল আড্ডা মারা! সেটা আবার চেনাপরিচিত জায়গায় না গেলে হয়ে ওঠে না। সুতরাং আমার কাছে হোয়াইট প্লেইন্সে যাওয়াটা আউট অফ দ্য কোয়েশ্চেন, গেলে নিঃসন্দেহে প্রচণ্ড বোর হব! বিশেষ করে আমার বেন্টুমাসি যেখানে থাকবেন! তার ওপর গতকাল প্রচণ্ড বরফ পড়েছে। রাস্তাঘাট এর মধ্যে কতটা পরিষ্কার করেছে কে জানে! ক’দিন তবু টেম্পারেচারটা ফ্রিজিং পয়েন্টের ওপরে ছিল। কিন্তু আজ যা ঠান্ডা, রোদ্দুরেও বরফ গলবে না –এখন অ্যাকসিডেন্ট না হলেই বাঁচি! একেনবাবু অবশ্য আমাকে উৎসাহিত করার জন্য একটা বাড়তি আকর্ষণের কথা বললেন,

 

“ওখানে শুনলাম ভালো কালচারাল প্রোগ্রাম হয় স্যার।”

 

একেনবাবু আমেরিকাতে নতুন বলে ঠিক জানেন না যে, এখানকার বাঙালিদের কালচারাল সাইডটা আবার বড় উইক। ভালো প্রোগ্রাম মানে দু-চারটে আনট্যালেন্টেড নাছোড়বান্দা গাইয়ে হারমোনিয়ামে প্যাঁ পোঁ করে নর্মাল লোককেও পাগল করে ছেড়ে দেবে! কিন্তু আমার ওজর আপত্তি কেউই বিশেষ কানে তুলল না। প্রমথ যে প্রমথ, সেও দেখলাম হোয়াইট প্লেইন্সের দিকে ঝুঁকে বসেছে! আমি একা আর কত বাধা দেব! পুজোটা হচ্ছে হোয়াইট প্লেইন্সের একটা জুনিয়র হাই স্কুলে। প্রমথ ফোন করে শ্যামলদার কাছ থেকে ঠিকানা আর ডিরেকশনটা নিয়ে নিল।

 

তিন

স্কুলের হলঘরটা বিশাল। তার একদিকে পুজোর জায়গা, অন্যদিকে টেবিল-চেয়ার পেতে খাবারের আয়োজন। আমাদের টাইমিংটা একেবারে পারফেক্ট, ভোগ বিতরণটা সবে শুরু হয়েছে। প্রত্যেক পাড়ার পুজোর স্ট্রং পয়েন্ট হল ভোগের নাম করে খাবারের দেদার আয়োজন! গরম গরম পাতলা অতি সুস্বাদু খিচুড়ি। তার সঙ্গে তিন রকমের তরকারি আর ভেজিটেবল চপ। গ্র্যান্ড ফিনালি হল পাঁপড়, চাটনি, দই আর দু’রকমের মিষ্টি দিয়ে। অবশ্য এবারের আয়োজনটা নাকি একটু বেশিই! সেটা শুনলাম ওখানকার এক কর্মকর্তা সুধীর শিকদারের কাছ থেকে। লোকটাকে শ্যামলদার বাড়িতে আগে কয়েকবার দেখেছি। চোখে পিচুটি কুমড়োপটাস টাইপের হাইলি আনহাইজিনিক অ্যান্ড আনহেলদি চেহারা। লোকটা অসম্ভব কথা বলে, তার ওপর মুখ দিয়ে থুতু ছেটায়! বিশ্বশুন্ধু এত লোক থাকতে আমার ওপর হঠাৎ এত কেন সদয় হল, ভগবান জানেন! ঝাড়া পঁচিশ মিনিট হলের কোণে আমাকে কবজা করে অফুরন্ত বকলেন! ভাগ্যিস একেনবাবু এসে সাহানিদের খোঁজ করলেন! সাহানিদের কথা উঠতেই শিকদারমশাই বললেন, “চেনেন নাকি ওঁদের? কী স্যাড ব্যাপার বলুন তো! বাড়ির গেস্ট ডেড, আর আঙ্কল মিসিং!”

 

আমি বললাম, “আঙ্কল মিসিং মানে? আমি তো শুনেছিলাম মিসিং পার্সন হল গেস্ট ভ ভদ্রলোকের কাজের লোক!”

 

“ওয়েল,” বলে শিকদারমশাই আমার ঠিক মুখের সামনে একগাদা জার্ম স্প্রে করে নোংরা রুমালে সশব্দে নাকটা ঝাড়লেন।

 

আমি জার্মগুলো এড়ানোর জন্য দম চেপে দাঁড়িয়ে আছি, সেই ফাঁকে পাশ থেকে একেনবাবু প্রশ্ন করলেন। “কী ‘ওয়েল’ স্যার?”

 

“আসলে,” শিকদারমশাই চারিদিকে একবার চট করে তাকিয়ে নিয়ে খুব মাই ডিয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “মিসিং ম্যান ঠিক ভৃত্য নন। আই মিন নট অ্যান অর্ডিনারি সার্ভেন্ট। ওঁর আসল পরিচয় হল উনি সাহানিদের এক দূর সম্পর্কের কাকা। সাহানিরা অবশ্য এটা কাউকে বলে না। এনিওয়ে হি ইজ অলসো শ্যাম মিরচন্দানি, মানে যে ভদ্রলোক মারা গেছেন, তাঁর গ্রামেরই লোক এবং মিরচন্দানির বন্ধুও। মিরচন্দানির সঙ্গে সাহানিদের পরিচয় এই কাকার সুত্রেই।”

 

“দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান। আপনি বলছেন ছেলেবেলার বন্ধু, কিন্তু তাঁকে দিয়ে মিস্টার মিরচন্দানি গৃহ ভৃত্যের কাজ করাচ্ছিলেন!”

 

“এই তো আপনাদের নিয়ে মুশকিল, আপনার বড় বেশি সেন্টিমেন্টাল। এ জব ইজ এ জব। শ্যাম মিরচন্দানির সাতকূলে কেউ নেই। ভদ্রলোক কিছুদিন আগে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে ফুলটাইম লোক রাখার খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। কিছুদিন প্রাইভেট নার্স রেখেছিলেন। কিন্তু এখানে প্রাইভেট নার্স রাখতে হলে যে কী খরচ সেটা তো

 

জানেনই। তাই বুদ্ধি করে দেশ থেকে গরীব বন্ধুকে আনিয়ে নিয়েছিলেন। ফ্রেন্ড কাম ফ্রেন্ড, হেল্পার কাম হেল্পার! বন্ধুকে মাইনেপত্র কী দিতেন অবশ্য জানি না, বাট আই বেট, যাই দিতেন না কেন –তাতে ওঁরও লাভ, ওঁর বন্ধুরও লাভ!”

 

সুধীর শিকদার হাঁড়ির এত খবর পেলেন কোত্থেকে কে জানে! আমরা হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে, শিকদারমশাই বললেন, “যাক, এসব আবার কাউকে বলবেন না যেন! সাহানি ব্রাদার্স হচ্ছেন আমাদের পুজোর একজন বড় পেট্রন। শুধু শুধু চটিয়ে দিলে, বুঝতেই তো পারছেন … কী মিন করছি!”

 

“তা বেশ পারছি স্যার,” একেনবাবু বললেন, “থাক ওসব কথা। তবে একটা কথা স্যার, অবাঙালিরা সরস্বতী পুজোয় চাঁদা দিচ্ছে, শুনতেও ভালো লাগে!”

 

“না, তা ওঁরা দেন। মানুষের ভালো পয়েন্ট দেখলে, সেটা না বলার পাত্র এই সুধীর শিকদার নয়। দোষ দেখলে দোষ বলব, গুণ দেখলে গুণ।”

 

“সেটা হল মহৎ লোকের লক্ষণ স্যার।” বুঝলাম একেনবাবু একটু তেল দিলেন। তারপর বললেন, “ভালো কথা, কে জানি বলছিলেন যে, এখানকার ফুডের ইনচার্জ হলেন আপনি? যাই বলুন স্যার, আপনাদের এখানে ভোগের আয়োজনটা কিন্তু সত্যিই প্রচণ্ড!”

 

“ভাল লেগেছে?” শিকদারমশাই খুব খুশি হয়ে প্রশ্নটা করলেন।

 

“যেমন ভ্যারাইটি স্যার, তেমনি রান্নার কোয়ালিটি।” একেনবাবু শিকদারমশাইয়ের আত্মতৃপ্তিটা বলতে গেলে প্রায় চরমে তুলে দিলেন।

 

“কোয়ালিটির জন্য দায়ী এই শর্মা,” নিজেকে দেখালেন শিকদারমশাই। “বুঝলেন মশাই, সারা বছরে এই একদিনই আমি রাঁধি। কিন্তু যখন রাঁধি, তখন চারশো লোকের জন্য রাঁধি! একটু পানবাহার চলবে নাকি?” পাঞ্জাবির পকেট থেকে টিনের একটা দোমড়ানো কৌটো বার করলেন সুধীর শিকদার।

 

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ!” একেনবাবু এক টিপ পানবাহার মুখে পুরে বললেন, “এখন একটু স্নাফ পাওয়া গেলেই সোনায় সোহাগা হত!”

 

“স্নাফ!”

 

“হ্যাঁ স্যার স্নাফ, মানে নস্যি।”

 

“অ্যাাঁ, আপনিও নস্যিরসিক!” শিকদারমশাই এমন ভাবে একেনবাবুর দিকে তাকালেন, যেন বহুদিন বাদে ভাগ্যচক্রে হঠাৎ টুইন ব্রাদারকে আবিষ্কার করেছেন! “তাহলে একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে। আনলিমিটেড নস্যি সাপ্লাই একেবারে গ্যারান্টিড! আই কান্ট গিভ ইউ নাউ। গিন্নী নস্যির ডিবে নিয়ে বেরোলেই বড় চ্যাঁচামেচি করে! তাই তো একটু আগে সুট করে বাড়ি গিয়ে একটিপ নিয়ে এলাম।” তারপর আমার মুখের সামনে মুখ এনে বললেন, “আপনিও আসুন না মশাই, শেয়ার দ্য এক্সপিরিয়ান্স!”

 

কী ডিসগাস্টিং! মনেমনে ভাবলাম। মুখে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম, “না আমি নস্যি নিই না।”

 

আমার গলার সুরে নিশ্চয় বিরক্তির ভাবটা স্পষ্ট ছিল। শিকদারমশাই তাতে একটু দমে যাচ্ছেন দেখেই বোধহয় একেনবাবু বেশ গদগদ স্বরে আবার বলে উঠলেন, “যাই বলুন। স্যার, প্রতি বছর চারশো লোকের জন্য এত ভ্যারাইটি রান্না, তাও আবার এরকম দারুণ স্বাদ বজায় রাখা! ট্রলি অ্যামেজিং স্যার।”

 

শিকদারমশাই একেনবাবুর দিকে দারুণ অ্যাপ্রিশিয়েটিভ চোখে তাকালেন। ভাবটা, গুণীকে গুণী না চিনিলে, আর কে চিনিবে! তারপর বললেন, “হ্যাঁ, চারশোটা বরাবরই চারশো। তবে কিনা মিথ্যে বলব না, এত ভ্যারাইটি প্রতি বছর হয় না। এবারেরটা হল কমপ্লিমেন্ট অফ গ্রেট সাহানি ব্রাদার্স। ওরাই…”

 

শিকদারমশাই আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু একটা কমবয়েসি ছেলে এসে ওঁকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল। শিকদারমশাই সামনে থেকে যেতে না যেতেই শুনলাম কেউ চাপা গলায় বলছে, “ফ্রোজেন ফুড!”

 

পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি প্রমথ। ও যে কখন এসেছে, টেরই পাইনি।

 

“ফ্রোজেন ফুড! কী বলতে চাচ্ছিস তুই?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

 

“এই পুজোয় সাহানিদের কনট্রিবিউশন! ফ্রিজারে বোধহয় পচছিল, তাই সুযোগ বুঝে ডাম্প করেছে এখানে।”

 

“আপনি কী করে জানলেন স্যার?”

 

“কেন মশাই, আপনিই কি একা গোয়েন্দা এখানে! আমাদের চোখ-কান নেই?” তারপর বলল, “কয়েকটা ছেলে বলাবলি করছিল, কানে এল। অবশ্য আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। তরকারিগুলো কেমন যেন জল জল লাগছিল, তাই না?”

 

জল জল না মুণ্ডু! প্রমথটার ফ্রোজেন জিনিসের প্রতি একটা ভয় আছে। সব সময় বাজার থেকে ফ্রেশ ভেজিটেবল কিনবে। ফ্রেশ না পেলে ক্যানড। কিন্তু ফ্রোজেন কখনোই কিনবে না! লোকে বরং ক্যানড ফুডের ব্যাপারে সাবধান হয় –বচুলিজমের জন্য! কিন্তুকে কাকে বোঝায়!

 

“এই বাপি বিচ্ছুর মতো ওখানে লুকিয়ে আছিস কেন –এদিকে আয়!” বেন্টুমাসি উদাত্ত গলায় হলের অন্য প্রান্ত থেকে ডাক দিলেন।

 

.

 

আমি বিচ্ছু নই, লুকিয়েও নেই। তাছাড়া আমি একা নই, আরও দু’জন –একেনবাবু ও প্রমথ আমার পাশে দাঁড়িয়ে। তবু সম্বোধনটা শুধু আমাকে কেন করা হল বুঝলাম না! তবে কানটা ঝাঁঝাঁ করে উঠল, যখন দেখলাম হলভর্তি লোক বেন্টুমাসির এই বিচ্ছু বোনপোর দিকে তাকিয়ে আছে!

 

“কী ব্যাপার, চাঁচামেচি করছ কেন?” বেন্টুমাসির সামনে গিয়ে একটু বিরক্ত হয়েই প্রশ্নটা করলাম।

 

বেন্টুমাসি আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে একেনবাবুকে বললেন, “এই যে একেন, এ হচ্ছে অশোক, আর এ হল অরুণ। এরা তোমার কথা খুব ভালো করে জানে।”

 

“এঁরা?” অশোক আমাদের দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন।

 

“ও হ্যাঁ, এবার আমাদের কথা মনে পড়ল বেন্টুমাসির। “এই অকালকুষ্মও হতভাগা হচ্ছে আমার বোনপো বাপি, আর এটা হল ওর যোগ্য সহচর প্রমথ।”

 

এরকম একটা ইনট্রোডাকশনের পর কার না দিল খুশ হয়!

 

চার

অশোক অরুণ কারও চেহারাই টিপিক্যাল ভারতীয় নয়। এঁদের মধ্যে অশোকের রঙ একটু চাপা। অরুণকে অন্য কোথাও দেখলে আমি নির্ঘাত ইটালিয়ান আমেরিকান বলে ভুল করে বসতাম! শুধু চেহারা নয়, ওঁদের হাবভাবটাও বেশ সাহেবি। আসলে ওঁরা সিন্ধি। তবে কোলকাতায় বড় হয়েছেন বলে দু’জনেই খুব ভালো বাংলা জানেন। কথোপকথন তাই বাংলাতেই হল। প্রাইভেসির জন্য হলঘরে দাঁড়িয়ে না থেকে, একটা ক্লাসরুম খোলা দেখে সেখানে সবাই ঢুকলাম। ক্লাসরুমটা নিশ্চয় কিন্ডারগার্ডেনের বাচ্চাদের। ঘরের একপাশে বাক্সভর্তি খেলনা, দেয়াল জুড়ে কাঁচা হাতে আঁকা অজস্র ছবি, আর চেয়ারগুলোরও যা সাইজ, তাতে আমরা কেন, টিঙটিঙে একেনবাবুও আঁটবেন কিনা সন্দেহ!

 

“বসে পড় সবাই,” বেন্টুমাসি আমাদের ওপর হুকুম জারি করে নিজে অবশ্য টিচারের চেয়ারটা দখল করলেন।

 

“এগুলোতে আবার বসা যায় নাকি, এত ছোটো!” বিড়বিড় করে এরকম কিছু বলে প্রমথ আবার একটা কমপ্লেন পেশ করার চেষ্টা করেছিল। বেন্টুমাসি পুরোপুরি সেটা উপেক্ষা করলেন।

 

কী আর করা, অগত্যা অনেক কসরত করে বাচ্চা চেয়ারগুলোতেই কোনোমতে সবাই বসলাম। বলা বাহুল্য, সমস্ত ব্যাপারটাতে বেন্টুমাসির উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। অশোক বা অরুণ কেউই মনে হল না আলোচনায় খুব একটা উৎসুক। তাতে অবশ্য তারা নিস্তার পেল না। বেন্টুমাসি অর্ডার করলেন, “অশোক, একেনকে বিস্তারিত বল, তোমাদের গেস্ট কবে এসেছিলেন, কী করে মারা গেলেন, কখন তোমাদের সন্দেহ হল, যা যা মনে আছে। কোনো কিছু বাদ দিও না। ডিটেকটিভদের সব কিছু জানা দরকার।”

 

অশোক বেচারা আমতা আমতা করে বলল, “তা বলছি আন্টি। তবে কিনা এটা একেবারেই পিওর সন্দেহ। মানে বলতে চাইছি, হয়তো পুরোপুরি ভুল সন্দেহই।”

 

সাক্ষী প্রথমেই বিগড়োচ্ছে দেখে বেন্টুমাসি ধমক দিলেন, “আঃ, সন্দেহ ভুল না ঠিক, সেটা তো একেন বিচার করবে। তুমি শুধু বলে যাও কী কী ঘটেছিল!”

 

অশোক আমাদের দিকে একটু অসহায় ভাবে তাকিয়ে শুরু করলেন, “দিন দশেক আগে শ্যাম আঙ্কল, মানে মিস্টার মিরচন্দানি, আমাদের বাড়ি আসেন। সঙ্গে ওঁর পার্সোনাল অ্যাটেনডেন্ট।”

 

“মিস্টার মিরচন্দানি কি স্যার আপনার কাকা হন?”

 

“না, না, আমরা ওঁকে আঙ্কল বলে ডাকি, কারণ উনি আমার কাকার পরিচিত বলে। নো রিলেশন।”

 

“মিরচন্দানি কোথায় থাকতেন একেনকে বলো।” বেন্টুমাসি অশোককে বললেন। “ও হ্যাঁ, সান ফ্রানসিস্কোতে।”

 

“আরেকটু বিশদ করে বলো। একা, না ফ্যামিলি নিয়ে? ছেলেপুলে ক’টা? এসব ডিটেলস না বললে চলবে কেন!”

 

“রাইট আন্টি।” অশোক সসম্ভ্রমে বলল। “হ্যাঁ মিস্টার সেন, মানে উনি একাই থাকতেন। ওঁর স্ত্রী মারা যান শুনেছি প্রায় আট বছর আগে, নিঃসন্তান অবস্থায়। এখানে ওঁর আপনজন বলতে শুধু বন্ধুবান্ধব।”

 

“ওঁর এই পার্সোনাল অ্যাটেনডেন্টটি কোথাকার স্যার?” এবার একেনবাবুর প্রশ্ন।

 

“উনি শ্যাম আঙ্কলের গ্রামের লোক। বছর পাঁচেক আগে শ্যাম আঙ্কল খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওঁকে দেশ থেকে আনিয়ে নেন। হেল্পার কাম সঙ্গী হিসেবে কাজ করার জন্য।”

 

“আপনারা এই হেল্পারটিকে আগে চিনতেন?”

 

প্রশ্নটাতে অশোক একটু হতচকিত হয়ে বললেন, “মানে হ্যাঁ, গোভিন্দ আঙ্কলকেও আমরা চিনতাম। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল ওঁর পাশের গ্রামে।”

 

“তারপর স্যার?”

 

“শ্যাম আঙ্কল নিউ ইয়র্কে আসার আগে আমাদের ফোন করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দু’জনের স্ত্রীই দেশে বেড়াতে গেছেন শুনে, প্রথমে আমাদের বাড়িতে এসে উঠতে চাননি। আমরাই জোরজার করে আসতে রাজি করাই।”

 

“এই দেখো, উনি এসেছিলেন কী করতে, সেটাই তো বলছ না!” মনে হল বেন্টুমাসির উত্তরটা জানা। তবু আমাদের খাতিরেই যেন অশোককে প্রশ্ন করলেন, “উনি কি বেড়াতে এসেছিলেন?”

 

“নো, ইট ওয়াজ এ বিজনেস ট্রিপ।”

 

“তা কী ধরনের বিজনেস সেটা না বললে একেন বুঝবে কী করে!” বেন্টুমাসির সদা সতর্ক দৃষ্টি, অশোক সূক্ষ্ম কোনো পয়েন্ট যাতে না মিস করে!

 

“মানে, আসলে আই অ্যাম নট শিওর। উনি এসব নিয়ে খুব একটা কথা বলতেন না। তবে আমার ধারণা প্ৰেশাস স্টোনের ব্যাবসা।”

 

“মানে হিরে-জহরতের কারবার! পাছে একেনবাবু প্ৰেশাস স্টোন কথাটার মানে ধরতে না পারেন, তাই বেন্টুমাসি বিশদ করে দিলেন!“

 

“এবার ওঁর মারা যাবার ব্যাপারটা বল।” বেন্টুমাসির নেক্সট হুকুম।

 

“ওয়েল, আজ থেকে ঠিক ছ’দিন আগে ম্যানহাটানে একটা কাজ সেরে ফিরেই উনি হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমাদের বাড়ির একদম কাছেই আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের অফিস। অরুণ সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ডেকে আনে। ইট ওয়াজ এ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তার আসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই উনি মারা যান।”

 

“এসব যখন ঘটছে স্যার, তখন মিস্টার জসনানি কোথায়?”

 

“উনি বাইরে ছিলেন। শ্যাম আঙ্কল ম্যানহাটান থেকে ফিরেই ওঁকে একটা প্যাকেজ কাউকে ডেলিভারি করতে পাঠান।”

 

“কাকে পাঠান জানেন স্যার?”

 

“তা তো বলতে পারব না।”

 

“কখন ফেরেন উনি?”

 

“টাইমটা বলতে পারব না। আমরা দুজনেই তখন অ্যাট এ স্টেট অফ ডেইজ! আমাদের মানসিক অবস্থা দেখে ডক্টর রাসেল, মানে আমাদের ফিজিশিয়ান, ডেথ সার্টিফিকেট লিখে, সিটি অথরিটির পারমিশন নিয়ে একটা ফিউনারেল হোমের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন ক্রিমেশনের ব্যবস্থা করতে। আমরা যখন শ্যাম আঙ্কলের পরিচিত এখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের ফোন করার চেষ্টা করছি, তখন গোভিন্দ আঙ্কল বাড়িতে ঢোকেন।”

 

“উনি কীভাবে রিয়্যাক্ট করেছিলেন স্যার?” উনিও কি আপনাদের মতই শকড হয়েছিলেন?

 

“আমার তো তাই মনে হয়েছিল। অ্যাট লিস্ট দ্যাটস হোয়াট উই ফেল্ট। উনি শ্যাম আঙ্কলের বিছানায় বসে ভীষণ কাঁদছিলেন! “

 

“তারপর?”

 

“আমি আর অরুণ ওঁকে একা রেখে, লিভিংরুমে বসে ফোন-টোনগুলো করতে থাকি। কিছুক্ষণ বাদে গোভিন্দ আঙ্কল লিভিংরুমে আমাদের কাছে এসে বসেন। ইতিমধ্যেই উনি অনেকটা সামলে উঠেছেন। আমাদের বলেন যে, উনি সান ফ্রানসিস্কোতে কতগুলো লং ডিস্টেন্স কল করতে চান। আমাদের কোনো অসুবিধা আছে নাকি। এটা আবার কোনো কথা হল! আমি বলি, নিশ্চয়। তারপর আমরা দু’জনে ওঁকে লিভিং রুমে রেখে, আমাদের অন্য ফোনটা ব্যবহার করার জন্য ওপরে যাই।”

 

“কখন আপনার খেয়াল হল স্যার যে, মিস্টার জসনানি অদৃশ্য হয়েছেন?”

 

“যখন খবর পেয়ে লোকজন আসতে শুরু করে তখন। অরুণই প্রথম নোটিস করে।”

 

“দ্যাট্‌স কারেক্ট,” অরুণ সায় দিল। আমার খেয়াল হয় এই কারণে যে, শ্যাম আঙ্কলের পায়ের কাছে একটা স্যামসোনাইট ব্রিফকেস ছিল। ইন ফ্যাক্ট ম্যানহাটানে যাবার সময় ওই ব্রিফকেসটা উনি আমার কাছ থেকেই চেয়ে নিয়েছিলেন। ব্রিফকেসটা খুলে শ্যাম আঙ্কল যখন গোভিন্দ আঙ্কলকে প্যাকেজটা দিচ্ছিলেন, তখন আমার চোখে পড়ে ব্রিফকেসটা ক্যাশ টাকায় ভর্তি। তাই লোকজন আসার আগে আমি ভাবলাম ব্রিফকেসটা সরিয়ে একটা সেফ জায়গায় রেখে দেব। কিন্তু তাকিয়ে দেখলাম ব্রিফকেসটা পায়ের কাছে নেই। আমি ভাবলাম গোভিন্দ আঙ্কল বোধহয় বুদ্ধি করে ওটা সরিয়ে রেখেছেন। কিন্তু গোভিন্দ আঙ্কলকেও কোথাও খুঁজে পেলাম না। তখনও আমি বুঝিনি যে হি লেফট ফর গুড। কারণ ওঁর সুটকেস, জামাকাপড় সব কিছুই ওঁর ঘরে যেমন ছিল তেমনই রয়েছে!”

 

“কত টাকা ওই ব্রিফকেসে ছিল বলে তোমার মনে হয় অরুণ?” বেন্টুমাসির প্রশ্ন।

 

“ঠিক বলতে পারব না মাসিমা। আমি শুধু কয়েক পলকের জন্যই দেখেছিলাম। তবে মনে হয়েছিল যে একশো ডলারের নোটে ভর্তি ওটা। ইন ফ্যাক্ট আমি শ্যাম আঙ্কলকে বলেছিলাম যে, হি শুড নেভার ক্যারি সো মাচ ক্যাশ ইন ম্যানহাটান।”

 

“একেই বলে ভবিতব্য!” বেন্টুমাসি মন্তব্য করলেন, “ম্যানহাটানে সাত গুণ্ডা কিছু করতে পারল না। মরলি তুই ঘরের শত্রু বিভীষণের হাতে!”

 

অশোক কাঁচুমাচু মুখে বলল, “ওঁর ডেথটা কিন্তু নর্মাল হার্ট অ্যাটাকে মাসিমা।”

 

“সেটা বাপু তোমাদের ভালোমানুষের বিচার! একেনের ওপর ভার ছেড়ে দাও। দেখবে কেমন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোয়!”

 

“ভালো কথা স্যার, একেনবাবুর অরুণকে প্রশ্ন করলেন, “উনি আপনার ব্রিফকেসটা নিতে গেলেন কেন?”

 

“সেদিন সকালেই ওঁর ব্রিফকেসের হিঞ্জটা ভেঙে গিয়েছিল। গোভিন্দ আঙ্কল দোকানে গিয়েছিলেন একটা নতুন ব্রিফকেস কিনতে। কিন্তু ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে, আমারটা নিয়েই উনি চলে যান।”

 

“আরেকটা কথা স্যার, মিস্টার জসনানির আত্মীয়স্বজন এদেশে কেউ আছেন কি?”

 

“নট দ্যাট আই নো অফ। তবে লং আইল্যান্ডে ওঁর এক দূর সম্পর্কের ভাই থাকেন। তাঁর কাছে খোঁজ করা হয়েছিল। তিনি কিছুই জানেন না।”

 

“ওঁর ফোন নম্বর-টম্বরগুলো একেনকে দিয়ে দিও।” বেন্টুমাসি অশোককে বললেন।

 

“এক্ষুণি তো আমার কাছে নেই মাসিমা। আপনার ফোন নম্বটা দিন মিস্টার সেন, আমি ফোন করে পরে আপনাকে জানিয়ে দেব।”

 

“ফোনের কোনো দরকার নেই স্যার। বরং আমিই একসময় আসব। সেই সময় ওঁর সুটকেস টুটকেসগুলোও একটু ঘেঁটে দেখব, যদি কোনো ক্ল পাওয়া যায়।”

 

“শিওর, এনি টাইম।” অশোক বললেন।

 

“এনি টাইমের আবার দরকার কী বাপু, আজই যাও না!” বেন্টুমাসি একেনবাবুকে বললেন।

 

“আজ একটু অসুবিধা আছে মাসিমা। আমরা এখান থেকে কানেক্টিকাটে এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। কাল সকালে আসুন না,” একেনবাবুকে বললেন অরুণ।

 

“ঠিক আছে স্যার, কালই আসব।” কথাটা বলে একেনবাবু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী স্যার, কোনো অসুবিধা আছে?”

 

“নট অ্যাট অল।” আমি উত্তর দিলাম।

 

.

 

ইতিমধ্যে শ্যামলদা ঘরে ঢুকেছেন। অরুণ শ্যামলদাকে দেখে বললেন, “শ্যামলভাই, কিংস সুপারমার্কেটে গোয়িং আউট অফ বিজনেস সেল চলছে। ফ্যান্টাস্টিক বার্গেন। খুব ভাল শাকসবজি পাওয়া যায় ওখানে। অজস্র ভ্যারাইটি। কিন্তু আজকেই লাস্ট দিন।”

 

“তাই নাকি, তাহলে তো যেতে হয়!”

 

আমি শ্যামলদার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে। শ্যামলদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে, যাবি আমার সঙ্গে?”

 

আমি তো এক পায়ে খাড়া, এনি প্লেস অ্যাওয়ে ফ্রম বেন্টুমাসি! প্রমথ আর একেনবাবুও দেখলাম গুটিগুটি সঙ্গ নিয়েছেন!

 

কিংস সুপারমার্কেট স্কুল বিল্ডিং থেকে মাত্র এক ব্লক দূরে। চকচকে ঝকঝকে বিশাল মার্কেট। এরকম একটা বিজনেস কী করে ফেল করে কে জানে! অবশ্য এদেশে যা কম্পিটিশান! দোকানটা লোকে গিজগিজ করছে, কী ভিড়, কী ভীড়! হবে নাই বা কেন। থার্টি টু ফর্টি পার্সেন্ট অফ নর্মাল প্রাইসে সব কিছু বিক্রি হচ্ছে! শ্যামলদা তো প্রায় আড়াইশো ডলারের ফ্রোজেন ফুডই কিনলেন। তারপর আমাকে বললেন, “দেখলি এক চালেই ফ্রিজারের দাম অনেকটাই তুলে নিলাম। এগুলোর নর্মাল প্রাইস অন্তত চারশো ডলার, ঠিক কিনা?”

 

নাঃ, সাহানি ব্রাদার্স খুব একটা ভুল বলেনি! আমার অ্যাপার্টমেন্টটা আরেকটু বড় হলে, আমিও একটা বড় দেখে ফ্রিজার কিনতাম!

 

পাঁচ

পরদিন দুপুর নাগাদ সাহানিদের বাড়ি গেলাম। একেনবাবুর অবশ্য সাতসকালেই ওখানে যাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমার আর প্রমথর জন্য পেরে ওঠেননি! আসলে একেনবাবু এখনও এগুলো ঠিক বোঝেন না। এদেশে হুট করে কারুর বাড়িতে কেউ গিয়ে হাজির হয় না। যাবার আগে অন্তত একটা ফোন করে জেনে নেয় কখন গেলে সুবিধা হবে। অবশ্য মনে হবে, সেটা আবার কী হাতিঘোড়া ব্যাপার? ফোন তো যখন খুশি করা যায়! কিন্তু সেটাই ঠিক যায় না। আসলে শুক্র-শনিবার এখানে অনেকেই লেট নাইট করে শোয়। সুতরাং, আটটা-ন’টায় ফোন করা মানে ডেফিনেটলি তার কাঁচা ঘুম ভাঙানো! উইকেন্ডে তাই দশটা-এগারোটার আগে সাধারণত কেউ কাউকে ফোন করে না –নিতান্ত দায় না পড়লে।

 

.

 

যাক সে কথা। সাহানিদের বাড়িটা হল হোয়াইট প্লেইন্সের একেবারে নর্থ এন্ডে। উঁচু টিলার ওপরে একটা কাল-ডি-স্যাক, তারই একেবারে শেষের বাড়িটা হচ্ছে ওদের। বাড়ির ঠিক পেছন থেকেই শুরু হয়েছে ঢাল। জমিটা ওখানে এত ঢালু যে, পেছনের ডেকবারান্দাটাকে ঠ্যাকা দিতে হয়েছে উঁচু-উঁচু কাঠের গুঁড়ি দিয়ে। বাড়ির পেছন থেকে শুরু করে ঢালের নীচ পর্যন্ত পুরোটাই মেপেল, স্তুস, আর ডগউডের জঙ্গল। হরিণের পাল এসে প্রায়ই নাকি ওখানে খেলে বেড়ায়। মাঝে মাঝে ভালুকও দেখা যায়। একবার নাকি একটা ভালুক একবারে ডেকের ওপর উঠে এসেছিল। খবরটা অশোক দিলেন, আমাদের সবাইকে ডেকটা দেখাতে এনে। ডেকটা অবশ্য দেখারই মতো। যেমন বিশাল, তেমনই শক্তপোক্ত। তবে সুরক্ষিত বিশেষ নয়। হরিণ ইজ ওকে। কিন্তু চিড়িয়াখানার বাইরে ভালুকগুষ্টির সঙ্গে মোলাকাত করার ইচ্ছে আমার এতটুকু নেই! আমি ভাবছিলাম, পৃথিবীতে এত সুন্দর সুন্দর জায়গা থাকতেও লোকে খুঁজে খুঁজে এই ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি করে কেন?

 

এমন সময় প্রমথ ডেকের রেলিংটা ধরে ঝুঁকে আমাকে বলল, “বুঝলি এই বারান্দা থেকে কেউ যদি লাফিয়ে পড়ে, তাহলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না! গড়াতে গড়াতে একদম ভ্যানিশ হয়ে যাবে!”

 

নিশ্চয়ই নির্দোষ উক্তি। কিন্তু কেন জানি না, আমার হঠাৎ গোভিন্দ জসনানির কথা মনে এল। এটা কী সম্ভব যে, উনি শোক সামলাতে না পেরে সেদিন এই ডেক থেকেই

 

নীচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন?

 

আমার মনের কথাটা অরুণ টের পেলেন কিনা জানি না, হঠাৎ নিজের থেকেই বললেন,”পুলিশ এই জঙ্গলটা বেশ ভালো করে খুঁজেছে, যদি কোনো কারণে মিস্টার জসনানি সুইসাইড করে থাকেন, এই ভেবে।”

 

“ধরে নিচ্ছি স্যার, তারা কিছুই পায়নি,” একেনবাবু বললেন।

 

“না, কিচ্ছু না।” উত্তর দিলেন অরুণ।

 

এমন সময় একটা দমক হাওয়া এসে সবারই হাড় কাঁপিয়ে দিল।

 

“চলুন স্যার, ভেতরে যাওয়া যাক,” একেনবাবু বললেন। “বড্ড ঠান্ডা বাইরে।”

 

.

 

ভেতরে ঢুকে আমরা ফায়ার প্লেসের পাশে গিয়ে বসলাম। ডেকের সঙ্গে লাগোয়া এই ঘরটা হল সাহানিদের ফ্যামিলি রুম। খেয়াল করলাম, এই ঘরের কার্পেটের অবস্থাটা অন্যান্য ঘরের তুলনায় খানিকটা জরাজীর্ণ। অর্থাৎ আড্ডা দেবার জন্য এ ঘরটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। যদিও বসার ঘরের কোনো কমতি বাড়িটাতে নেই। একটা বিশাল লিভিং রুম তো আছেই, তার ওপর বেশ ভদ্র সাইজের একটা ডেন, এবং বেসমেন্টে একটা রিক্রিয়েশন রুম! আমার অ্যাপার্টমেন্টের লিভিং

 

কাম-কিচেন-কাম-ডাইনিং এর ব্যাপার এটা নয়! প্রমথটা অবশ্য হিংসুটে! এর ফাঁকেই ফিসফিস করে আমাকে বলল, “শুধু টাকা থাকলেই হয় না রে, টেস্ট থাকা চাই। দেয়ালের ছবিগুলো দেখেছিস, নো কালচার!”

 

প্রমথর কথাটা নির্দয় হলেও, অসত্য খুব একটা নয়। আমি ওদের এটিজারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, ভারতবর্ষের হেন জায়গা নেই যেখানকার কোনো জিনিস ওখানে রাখা নেই। কিন্তু একের ওপর একটা জিনিস চাপিয়ে ঠাসাঠাসি করে জগাখিচুড়ি করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে শুধু একেনবাবুই দেখলাম মুগ্ধ। বললেন, “কী কালেকশন স্যার আপনাদের, একেবারে অ্যামেজিং, সত্যিই স্যার, ডুলি অ্যামেজিং!”

 

এই স্তুতিবাক্যটার জন্যই বোধহয় চায়ের সঙ্গে বড় গুলাবজামুনগুলো উনিই পেলেন! এটা অবশ্য প্রমথর অবজার্ভেশন। আমি নিজে সাইজের কোনো তফাৎ ধরতে পারিনি! তবে এটা ঠিক যে, সাহানি ব্রাদার্স একেনবাবুকেই খাতিরটা বেশি করছিলেন। করবেন নাই-বা কে, বেন্টুমাসি আমার আর প্রমথর যে ইনট্রোডাকশনটা গতকাল দিয়েছেন, তাঁতে ওরা যে আমাদের খেতে দিচ্ছেন, সেটাই যথেষ্ট!

 

খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা ওপরে গেস্ট রুমে গিয়ে মিস্টার জসনানির বাক্সপত্রগুলো ঘাঁটলাম। ইন্টারেস্টিং বলতে কিছুই পাওয়া গেল না। বেশ কিছু জামাকাপড়, সান ফ্রানসিস্কোতে ফিরে যাবার রিটার্ন টিকিট, কয়েকটা ম্যাগাজিন, পানবাহারের দু’টো কৌটো, আর একটা ডায়েরি। ডায়েরিটার পাতা উলটে দেখলাম তাতে ডেইলি এনট্রি বলতে প্রায় কিছুই নেই। থাকার মধ্যে অনেকগুলো লোকের ফোন নম্বর আছে। এরিয়া কোড দেখে বুঝলাম যে, সেই লোকগুলোর বেশিরভাগই বে-এরিয়া, মানে সান ফ্রানসিস্কো, বা তার আশেপাশে কোথাও থাকে। অরুণ জানালেন যে, এদের সকলের সঙ্গেই পুলিশ যোগাযোগ করেছে, কিন্তু কেউই মিস্টার জসনানির কোনো হদিশ দিতে পারেনি।

 

“এদেশের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা স্যার। একজন অর্ডিনারি মিসিং ওল্ড ম্যানের জন্য পুলিশ কত খোঁজখবর করছে!” একেনবাবু মন্তব্য করলেন।

 

অশোক বললেন, “আসলে কেসটা এখন আর ঠিক অর্ডিনারি নয়। পুলিশ জানে যে, গোভিন্দ আঙ্কল প্রায় মিলিয়ন ডলার ক্যাশ নিয়ে অদৃশ্য হয়েছেন।”

 

“তাই নাকি স্যার! মিলিয়ন ডলারের কথাটা তো আগে শুনিনি?”

 

“কাল রাত্রেই আমরা পুলিশের কাছে শুনলাম। শ্যাম আঙ্কল যার সঙ্গে বিজনেস করতে এসেছিলেন, তাঁকে পুলিশ খুঁজে বার করেছে। তিনিই পুলিশকে টাকার অঙ্কটা বলেছেন।”

 

অরুণ যোগ করলেন, “আমি অবশ্য তাতে আশ্চর্য হইনি। দ্যাট ব্রিফকেস ওয়াস ফুল অফ ডলার বিপ্স!”

 

“মিলিয়ন ডলার্স! মানে তো প্রায় ছ’কোটি টাকা! অত টাকা ব্রিফকেসের মধ্যে? একেবারে আনবিলিভেবল স্যার!”

 

“কেন?” প্রমথ বলল। “এক মিলিয়ন ডলার মানে এক হাজার ডলারের এক হাজারটা নোট। বড় ব্রিফকেসও লাগবে না, একটা ছোট ব্রিফকেসেই দিব্যি এঁটে যাবে!”

 

“না, না, তা বলছি না। আসলে টাকার অঙ্কটা স্যার মাথা ঘুরিয়ে দেয়!”, বলে একেনবাবু সাহানি ব্রাদার্সকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ভালো কথা স্যার, মিস্টার জসনানির কি কোনো ফটো আপনাদের কাছে আছে?”

 

“খুব রিসেন্ট ফটোই আছে। ক’দিন আগের তোলা।” বলে অরুণ পাশের ঘর থেকে ফটোম্যাটের একটা খাম নিয়ে এলেন। সেখান থেকে একটা ফটো বার করে আমার হাতে দিলেন।

 

চশমা-চোখে সৌম্য চেহারার এক ভদ্রলোক বসে-বসে বই পড়ছেন। চুলগুলো সব পাকা। ফটোতে অবশ্য বয়সটা সব সময় বোঝা যায় না। তাও আন্দাজ করলাম ষাটের কোঠায় প্রায় হবে।

 

“এই যে আরেকটা ফটো।”

 

এই ফটোটাতে মিস্টার জসনানি গাড়ির ড্রাইভার্স সিটে বসে আছেন। পাশে অশোক।

 

“গোভিন্দ আঙ্কল গাড়ি চালাতে খুব ভালোবাসতেন। আই মিন বাসেন। আই অ্যাম সরি, আই ডোন্ট নো হোয়াট আই অ্যাম সেইং!”

 

“তাতে কী হয়েছে স্যার। আমরা তো কেউই জানি না, উনি বেঁচে আছেন না নেই!”

 

.

 

হঠাৎ আমার মনে একটা সন্দেহ হল। আচ্ছা, মিস্টার জসনানি কি একটা ফলস পাসপোর্ট জোগাড় করে ইন্ডিয়াতে চলে যেতে পারেন? এরকম একটা সৌম্য চেহারার লোককে কে সন্দেহ করবে?

 

একেনবাবুর অ্যাটেনশন ইতিমধ্যে ছবি থেকে ক্যামেরায় চলে গেছে। অরুণের কী ক্যামেরা, তার কত দাম, কোথায় ভাল ক্যামেরা সস্তায় পাওয়া যায় ইত্যাদি অজস্র প্রশ্ন। উনিও বহুদিন ধরে একটা ক্যামেরার খোঁজ করছেন, কিন্তু আমি বা প্রমথ কেউই ও বিষয়ে কিছু জানি না। অরুণ বুঝলাম, ক্যামেরার একজন সমঝদার! সুতরাং একেনবাবুকে আর পায় কে! আমি আর প্রমথ বের হচ্ছি দেখে অশোক আমাদের নীচে বেসমেন্টে ওঁদের রিক্রিয়েশন, সংক্ষেপে রেকরুমে নিয়ে গেলেন।

 

রেক রুমটা ঠিক আলাদা নয়। ওপেন বেসমেন্টের কিছুটা অংশ কার্পেট দিয়ে ঢেকে, আর সাইড প্যানেল লাগিয়ে একটা আলাদা অস্তিত্ব দেওয়া হয়েছে। বেসমেন্টের অন্য দিকটা রেকরুম থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। সেখানে সারা বাড়িতে গরম জল সাপ্লাই করার জন্য বিশাল ওয়াটার হিটার, সেন্ট্রাল হিটিংয়ের ফার্নেস। এছাড়া ওয়াশিং মেশিন, ড্রায়ার, ফ্রিজার, সব সারি সারি করে সাজানো। রেক রুমের একপাশে একটা বিলিয়ার্ড টেবিল, অন্য দিকে বসার জায়গা, আর একটা বইয়ের আলমারি।

 

প্রমথটা দুর্দান্ত বিলিয়ার্ড খেলে। ওঁর সঙ্গে খেলার কোনো অর্থ হয় না। আর কিছু না পেলে হয়তো খেলতেই হত, কিন্তু লাকিলি বুক শেলফে সময় কাটানোর কয়েকটা ভালো রসদ পেয়ে গেলাম। মডার্ন পেইন্টিংয়ের ওপর কতগুলো চমৎকার বই। প্রমথ আর অশোক এখন যত খুশি বিলিয়ার্ড খেলুক, আই ডোন্ট কেয়ার!

 

বইগুলো ফ্যাসিনেটিং, কিন্তু পাতা ওলটাবার বেশি সময় পেলাম না কারণ, খানিক বাদেই একেনবাবু নেমে এলেন। কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে ধপ করে আমার পাশে বসে বললেন, “দেখেছেন স্যার, ওঁদের ফ্রিজারটাও শ্যামলবাবুর বাড়ির মত।”

 

দেখছেন আমি বই পড়ছি, কিন্তু তাতে একেনবাবুর বকবকানি কিছু আটকাল না! আমি বই থেকে চোখ না সরিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, দেখেছি।”

 

“ওয়াশিং মেশিনটা ডিফারেন্ট কোম্পানির স্যার, এটা হল হট পয়েন্টের তৈরি। শ্যামলবাবুদেরটা বোধহয় জি.ই–র, তাই না?”

 

হু কেয়ার্স! আমি মনে মনে ভাবলাম। কিন্তু মুখ ফসকে বলে ফেললাম, “জি.ই. আর হট পয়েন্ট একই কোম্পানির প্রোডাক্ট। শুধু লেবেলটাই আলাদা।”

 

“সেটা কী করে হয় স্যার? এক কোম্পানির জিনিস হলে দুটো আলাদা নাম কেন?”

 

“কেন হবে না,” আমি বললাম। “ক্যাডিলাক, বিউইক, শেভ্রলে –এই নামে তো হরেক রকমের গাড়ি রাস্তায় দেখতে পান। কিন্তু সবগুলোর পেরেন্ট কোম্পানি হচ্ছে। জেনারেল মোটরস, এটা জানেন না?”

 

একেনবাবু আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে বললেন, “নাউ ইট মেকস সেন্স স্যার।”

 

“হোয়াট মেকস সেন্স?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

 

“কাল খবরে শুনছিলাম যে, জেনারেল মোটরস ইজ ইন ফাইনান্সিয়াল ট্রাবল। আর আমি বোকার মতো ভাবছিলাম, জেনারেল মোটরস আবার কোন গাড়ি বানায়! এই এখন জানলাম, ক্যাডিলাক, বিউইক, শেভ্রলে! মাই গুডনেস! যাই হোক স্যার, আমার কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে।”

 

“কী প্রশ্ন?”

 

“গাড়ি নিয়ে নয় স্যার, ওয়াশিং মেশিন নিয়ে।”

 

এর পর কি আর কনসেনট্রেট করে কিছু পড়া যায়! আর যতসব ফালতু কোয়েশ্চেন! কী করে ওয়াশিং মেশিন কাজ করে, নর্মাল সাইকেল আর পার্মানেন্ট প্রেস সাইকেলের তফাত কী, চালাতে কত ইলেকট্রিসিটি খরচা হয় –এইসব! তারপরে ফ্রিজার নিয়ে প্রশ্ন। কী করে ভেতরটা এত ঠান্ডা হয়? কমপ্রেসার কী, ফ্রিয়ন কেন ব্যবহার করা হয়? সেখান থেকে চলে গেলেন গ্যাস ফার্নেসে। শুধু প্রশ্ন নয়, সেই সঙ্গে নেড়েচেড়ে সব দেখা! এটা ওঁর অত্যন্ত ব্যাড হ্যাবিট। নতুন কিছু দেখলেই হলো, তার নব ঘুরিয়ে, বোতাম টিপে, ডালা খুলে সব কিছু দেখা চাই! আর ইন দ্য প্রসেস একটা কিছু ঘোঁট পাকান। হ্যাপাটা পরে আমাদেরই সামলাতে হয়! সেইজন্য খুটখুট শুরু করলেই আমি কিংবা প্রমথ গিয়ে আটকাই। অবশ্য ভাগ্য ভালো আজ তেমন কোনো অঘটন ঘটল না। শুধু ফ্রিজারের ডালাটা পুরো বন্ধ না করেই দেখি উনি চলে গেছেন। ভাগ্যিস আমি পরে সব কিছু চেক করছিলাম! ঠিক করে বন্ধ করে দিলাম। ফ্রিজারটা চললেও লাকিলি ভেতরে কিছু ছিল না। সুতরাং নষ্ট হবার আর প্রশ্ন ওঠে না। তাও একেনবাবুকে ওঁর অপকর্মের কথাটা বলে লজ্জা দিলাম।

 

আমরা যখন ফিরছি, তখন দেখি অরুণ খুব যত্ন করে টেবিলে পড়ে থাকা এক্সট্রা খাবারগুলো প্যাক করে রেফ্রিজারেটরে ঢোকাচ্ছেন। আমরা অবশ্য চেটেপুটেই খেয়েছিলাম। সুতরাং বাকি বলতে বিশেষ কিছু ছিল না। বড়জোর এক-আধটুকরো মিষ্টি, একটা বা দুটো পুরি, তরকারির একটা সার্ভিং –তাও ছিল কিনা সন্দেহ! যাই হোক আমি বুঝিনি যে, প্রমথরও সেটা চোখে পড়েছে। গাড়িতে উঠেই ও বলল, “এই জন্যই আমরা কোনোদিন বড়লোক হতে পারব না। দেখলি তো খুদকুঁড়ো পর্যন্ত এরা ফেলে না!”

 

ছয়

সন্ধ্যেবেলায় বেন্টুমাসির ফোন। দারুণ উত্তেজিত। এইমাত্র উনি সাহানিদের কাছ থেকে খবর পেয়েছেন যে, ট্যাপান জি ব্রিজের কাছে পুলিশ নাকি গোভিন্দ জসনানির ডেড বডি আবিষ্কার করেছে! একেনবাবু বাড়ি নেই শুনে খুব নিরাশ হলেন। তারপর যখন শুনলেন যে, একেনবাবু একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে গেছেন তখন বললেন, “আচ্ছা লোক তো একেন! কোথায় খুনি ধরবে, না ঘোড়ার ডিম বক্তৃতা শুনে বেড়াচ্ছে! যত্তসব! যাই হোক, একেন এলেই আমাকে ফোন করতে বলিস।”

 

“তা তো বলব। কিন্তু আমাকে একটু বল না কী ব্যাপার?”

 

“ব্যাপার আর কী, ধর্মের কল বাতাসে নড়ছে! পাপ করেছিস, তার ফল ভোগ করতে হবে না!”

 

“কার পাপের কথা বলছ?”

 

“কোন রাজ্যে থাকিস তুই। অ্যাঁ? মনিবকে খুন করে কোটিকোটি টাকা নিয়ে একটা লোক পালাল, আর তুই বলছিস, কার পাপের কথা হচ্ছে!”

 

.

 

বেন্টুমাসির ওয়ান ট্র্যাক মাইন্ড। মাথায় যখন একবার ঢুকেছে যে, গোভিন্দ জসনানি একটা খুনি, শিবেরও সাধ্য নেই সেটার নড়চড় করানোর! সুতরাং শ্যাম মিরচন্দানির ডেথ যে ন্যাচারাল, আবার সে প্রসঙ্গ তুলে সময় নষ্ট করলাম না।

 

“বুঝেছি বুঝেছি,” আমি বললাম। “কিন্তু গোভিন্দ জসনানিকে মারল কে?”

 

“আরে বাপু, সেই জন্যেই তো একেনের সাহায্য দরকার। আমি বুঝতে পারছি, কে। মেরেছে। কিন্তু প্রমাণটমানগুলো একেনকে একটু খুঁজে পেতে বের করতে হবে।”

 

“দাঁড়াও, দাঁড়াও,” আমি বললাম, “হু ইজ দ্য মার্ডারার, সাহানিদের কেউ?”

 

“তোর ঘটে কী আছে রে? এদিকে তো শুনি পিএইচ.ডি. না কী ছাই করেছিস! নিশ্চয় টুকে পাশ করেছিস, নইলে বলিহারি এদেশের পিএইচ.ডি.!”

 

“আঃ, ওসব কথা থাক! বলো না তোমার সাসপেক্ট কে?”

 

“কে আবার? যে লোকটা জানত, ব্যাগে ওই টাকাগুলো আছে!”

 

“সেটা তো অরুণ!” আমি বললাম।

 

“কেন, অরুণ ছাড়া আর কেউ জানত না? যে-লোকটা শ্যাম মিরচন্দানিকে টাকাটা দিয়েছিল সে কোথায় গেল, সে জানত না?”

 

“দ্যাটস ট্রু।”

 

“আমি তো বলি যে, ওই লোকটার সঙ্গেই বুড়ো গোভিন্দের ষড় হয়েছিল। গোভিন্দ টাকাটা সরিয়ে প্রথমে ওর বাড়িতে গিয়ে গা ঢাকা দেবে। ভাগ-বাঁটোয়ারা সব সেখানেই হবে। তারপর সবকিছু ঠান্ডা হলে খুনি গোভিন্দ ভালোমানুষ সেজে আবার উদয় হবেন!”

 

“দেন হোয়াই ওয়াজ হি মার্ডারড, গোভিন্দ খুন হলেন কেন?”

 

“উত্তরটা তুই একটু ঘটের বুদ্ধি খরচা করে দে!”

 

“আমার মাথায় কিছু খেলছে না, তুমিই বলো।”

 

“আঃ, এত একেবারে ব্যোমকেশের গল্পের মত! গোভিন্দ যখন টাকা নিয়ে ওই লোকটার কাছে গিয়ে হাজির হল, তখন লোকটা ভাবল, বাঃ, এই তো সুযোগ! গোভিন্দকে যদি এখন আমি মারি, তাহলে তো আর ভাগ দেবার প্রশ্নই ওঠে না, পুরো টাকাটাই আমার হয়ে যায়!”

 

আমায় স্বীকার করতেই হবে যে, বেন্টুমাসি মে হ্যাভ এ পয়েন্ট। বেন্টুমাসির থিওরি যদি সত্যি হয়, তাহলে তার আরও একটা ইমপ্লিকেশন আছে। সেটা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আর কারও জানার কথা নয় যে, গোভিন্দ জসনানি ওই লোকটার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। সুতরাং, মিস্টার জসনানিকে মার্ডার করে, বডিটা দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে এলে, খুনের সঙ্গে ওই লোকটাকে জড়ানো বেশ কঠিনই ব্যাপার হবে!

 

.

 

একেনবাবু ফিরলেন বেন্টুমাসির ফোনের আধ ঘন্টা পরে। আমরা ভেবেছিলাম, জসনানির মার্ডারের খবরটা দিয়ে ওঁকে বেশ একটু অবাক করে দেব। কিন্তু ও হরি, উনি ইতিমধ্যেই সব জেনে বসে আছেন! আসলে উনি যে সেমিনারে গিয়েছিলেন, ইন্সপেক্টর লান্ডিও সেখানে ছিলেন। তার কাছ থেকেই খবরগুলো উদ্ধার করেছেন বুঝলাম। একেনবাবুর ভার্সান থেকে পরিষ্কার হল যে, বেন্টুমাসি একটা তথ্য জানতেন না। হুইচ ইজ ভেরি কুশিয়াল। সেটা হচ্ছে গোভিন্দ জসনানির মৃত্যুর কারণ। শ্যাম মিরচন্দানির মতো গোভিন্দ জসনানির মৃত্যুটাও সম্ভবত স্বাভাবিক হার্ট অ্যাটাক। অবশ্য অটপসির রিপোর্ট এখনও পুরো পাওয়া যায়নি।

 

একেনবাবু বললেন, “আমাকে একটু হোয়াইট প্লেইন্স পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে। একটা রাইড দেবেন স্যার?”

 

কেন, কী, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন মাথায় এল। কিন্তু সেগুলো জিজ্ঞেস না করে বললাম “শিওর।”

 

প্রমথ বলল, “চল, আমিও যাব।”

 

সাত

ইন্সপেক্টর লান্ডি একেনবাবুর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের কথাও নিশ্চয়ই একেনবাবু ওঁকে বলেছিলেন, তাই আমরাও সাদর অভ্যর্থনা পেলাম। আমি আগে কখনও কোনও পুলিশ স্টেশনের ভেতরে ঢুকিনি। দেখলাম একটা বড় ঘরে বেশ কয়েকজন জুনিয়র অফিসার বসে। সেই ঘরের এক সাইডে একটা বড় দরজা।

 

সেখান থেকে লোহার গারদ দেওয়া লক আপ এরিয়াটা চোখে পড়ে। লক আপ এরিয়ার উলটোদিকে যে লাগোয়া ঘর, সেটা হল ইন্সপেক্টর লান্ডির। সারা ঘর উঁচু উঁচু ফাইভ-ড্রয়ার ফাইল ক্যাবিনেটে ভর্তি। দেওয়ালের শুধু একটু অংশই ফাঁকা। সেখানে হোয়াইট প্লেনস ও তার পাশাপাশি অঞ্চলের একটা ডিটেল ম্যাপ।

 

ইন্সপেক্টর লান্ডি ম্যাপটাতে আঙুল দিয়ে দেখালেন, ঠিক কোথায় ডেড বডিটা পাওয়া গেছে। টাপান জি ব্রিজটা পার হয়ে আপস্টেট নিউ ইয়র্ক যাবার পথে, ব্রিজ থেকে আধ মাইলও হবে না। ‘আপস্টেট নিউ ইয়র্ক’ এখানকার খুব একটা চলতি কথা। আসলে নিউ ইয়র্ক শহরটা হচ্ছে আবার নিউ ইয়র্ক স্টেটের মধ্যে, যেটা আমেরিকার একটা বিশাল স্টেট। আপস্টেট নিউ ইয়র্ক’ বলতে ওই স্টেটেরই উত্তর দিকটা বোঝায়।

 

.

 

যাক সে কথা। বডিটা পাওয়া গেছে হাইওয়ের পাশে, তবে অনেকটা নীচে। ওই জায়গায় হাইওয়েটা খুব উঁচু জমির ওপরে। সুতরাং মনে হয়, বডিটাকে কেউ ওপর থেকে রোল করে ফেলে দিয়েছে! যেহেতু জায়গাটা বরফে ভর্তি ছিল, সেইজন্য একেবারে গড়িয়ে নীচে চলে যায়নি, খানিকটা গিয়ে ঢালুর ওপরই একটা গর্তে বরফের মধ্যে আটকে গেছে। বডিটা বোধহয় কয়েকদিন ধরেই ওখানে পড়ে ছিল। কিন্তু বরফে ঢাকা ছিল বলে কারও নজরে পড়েনি। রোদে বরফ কিছুটা গলে যাওয়ায়, হাইওয়ে পেট্রল ওঁর ব্রাউন ব্রিফকেসটা বরফের ওপর দেখে, গাড়িটা থামিয়েছিল। ব্রিফকেসটা তুলতে গিয়ে বডিটা আবিষ্কার করে।

 

আমি অবশ্য ঠিক বুঝলাম না, কেন ইন্সপেক্টর লান্ডি অনুমান করছেন যে, কেউ মিস্টার জসনানির বডিটাকে হাইওয়ে থেকে নীচে ফেলে দিয়েছে। ইন ফ্যাক্ট উনি যেজায়গায় বডিটা পাওয়া গেছে বললেন, আমি জানি সেখানে অনেক কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিল। শীতকাল বলে বেশিরভাগ কাজই এখন বন্ধ। ফলে অনেক টেম্পোরারি শেড ওখানে ফাঁকা পড়ে আছে। তা হলে কি মিস্টার জসনানি তারই কোনো একটায় আশ্রয় নিয়েছিলেন? হয়তো গতকাল হিচ হাইক করবেন বলে হাইওয়েতে উঠে আসার পথে ঠান্ডায় ওভার এক্সারশনে হার্ট ফেল করে মারা যান। সেটা হওয়া কিছু মাত্র অসম্ভব নয়। এদেশে ঠান্ডায় বরফ পরিষ্কার করতে গিয়ে তো কত কমবয়েসি লোকই মারা যায়, আর উনি তো বৃদ্ধ! আমি আমার সন্দেহের কথাটা বলতেই ইন্সপেক্টর লান্ডি মুচকি হেসে ক্লিয়ারলি ব্যাপারটা এক্সপ্লেন করে দিলেন। বললেন, “প্রথমত, ওই শেডগুলোতে কোনো হিটিং নেই। বাইরে যা ঠান্ডা, ইট ইজ হার্ড টু বিলিভ দ্যাট হি উড হ্যাভ সার্ভাইভড দেয়ার। দ্বিতীয়ত, ওঁর ব্রিফকেসটা পাওয়া গেছে ওঁর বডিটা থেকে অন্তত পাঁচ ফুট দূরে। মাটিতে বরফ না থাকলে বুঝতাম যে, ওটা গড়িয়ে দূরে চলে গেছে। এক্ষেত্রে সে প্রশ্ন ওঠে না। তৃতীয়ত, বরফের ওপর কোনো পায়ের ছাপ নেই। অবভিয়াসলি, হি ওয়াজ নট ওয়াকিং।

 

হ্যাঁ, বলতে পারেন যে, বরফ পড়া শুরু হবার আগে উনি ওখানে উঠে এসে মারা যান। সেক্ষেত্রে উনি বা ওঁর ব্রিফকেস, দুটোই বরফে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে থাকত। ফাইনালি, ওঁর চোখে যে চশমাটা ছিল, সেটা হল প্লাস পাওয়ারের, অর্থাৎ রিডিং গ্লাস। কেন একটা লোক রিডিং গ্লাস চোখে দিয়ে হাঁটতে বেরোবে?”

 

ইন্সপেক্টর লান্ডির কথা শুনে আমার ভারি অপ্রস্তত লাগল। আসলে প্রাইভেট ডিটেকটিভদের গল্প পড়ে পড়ে আমার এমন অবস্থা হয়েছে –আমি ধরেইনি, পুলিশেরা সব গবেট, কিছুই ঠিকমতো ধরতে পারে না!

 

একেনবাবু বললেন, “স্যার ব্রিফকেসটা একটু দেখতে পারি?”

 

“নিশ্চয়ই।”

 

ব্রিফকেসটা ইন্সপেক্টর লান্ডির পেছনেই ছিল। উনি আমাদের সামনে ওটা রেখে বললেন, “কম্বিনেশনটা হচ্ছে থ্রি-টু-টু।”

 

.

 

কম্বিনেশনটা লক লাগানো স্যামসোনাইটের সচরাচর যে ধরনের ব্রিফকেস চোখে পড়ে, সেরকমই একটা ব্রিফকেস। আমি স্যামসোনাইট কখনো ব্যবহার করিনি। কিন্তু নিশ্চয়ই খুব মজবুত হবে। হাইওয়ে থেকে নীচে পড়াতেও কোনো টোল খায়নি। অবশ্য বরফ ছিল বলেই হয়তো।

 

“হাত দেব স্যার?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

 

“স্বছন্দে। ব্রিফকেসে কোনো ফিঙ্গার প্রিন্টই পাওয়া যায়নি। ইট ওয়াজ ওয়াইপড ক্লিন!”

 

লকের থাম্ব হুইলগুলোকে থ্রি-টু টু পজিশনে আনতেই ব্রিফকেসের ডালাটা খুলে গেল। দেয়ার ইজ নাথিং ইনসাইড, একেবারে শূন্য!

 

“আপনি শিওর স্যার যে, এটাই রাইট ব্রিফকেস? এরকম তো অনেক ব্রিফকেসই আছে।”

 

“ইয়েস, আই অ্যাম শিওর। সাহানিরা এসে আইডেন্টিফাই করে গেছেন। দেখুন লেফটে সাইডে একটা ছোট্ট স্ক্র্যাচ আছে, ওটাই হল আইডেন্টিফিকেশন মার্ক। তাছাড়া লকের কম্বিনেশনটাও এক।”

 

“সবই এক। শুধু টাকাগুলোই নেই!”

 

“এগজ্যাক্টলি।”

 

“দিস ইজ কনফিউসিং স্যার,” একেনবাবু মাথা নাড়লেন। “মৃত্যুর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই, অথচ মিস্টার জসনানির বডিটা আর ফাঁকা ব্রিফকেসটা একই সঙ্গে রাস্তায়

 

ফেলে দেওয়া হল!”

 

“ইট ইজ কনফিউসিং।” ইন্সপেক্টর লান্ডি মাথা নেড়ে বললেন।

 

“আর কিছু পাননি স্যার। চশমা আর ব্রিফকেস ছাড়া?”

 

“ও ইয়েস। লেট মি শো ইউ। এটা হচ্ছে ওর ওয়ালেট, আর ওঁর কোর্টের পকেটে এই কার্ডটা ছিল।” ড্রয়ার থেকে জিনিস দুটো বার করে ইন্সপেক্টর লান্ডি একেনবাবুকে দিলেন।

 

ওয়ালেটে দেখলাম ড্রাইভার্স লাইসেন্স, দুটো ক্রেডিট কার্ড, আর কয়েকটা শুধু ডলার। কোটের পকেটে যে কার্ডটা পাওয়া গেছে, সেটা হল একটা বিজনেস কার্ড। কার্ডে লেখা সলোমান লাজারাস, প্রেসিডেন্ট, এস.এল.প্ৰেশাস স্টোনস। নীচে ব্রুকলিনের একটা ঠিকানা, আর ফোন নম্বর।

 

“হু ইজ দিস পার্সন স্যার?”

 

ইন্সপেক্টর লান্ডি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “এর থেকেই স্যাম মিরশন্ডানি মিলিয়ন ডলারের ক্যাশ নিয়েছিলেন।”

 

স্যাম মিরশন্ডানি মানে অবশ্যই শ্যাম মিরচন্দানি। মাই গড! তাহলে কি বেন্টুমাসির থিওরিই ঠিক!

 

প্রমথ নিশ্চয়ই একই কথা ভাবছিল। জিজ্ঞেস করল, “ইজ দেয়ার এনি কানেকশন? আই মিন বিটুইন দ্য ডেথ অ্যান্ড দিস কার্ড।”

 

“কানেকশন ফর হোয়াট, দ্য ম্যান ওয়াজ নট মার্ডারড!”

 

“সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু টাকাটা কোথায় গেল, কে চুরি করল? আমি প্রশ্ন করলাম।

 

“দ্যাট্‌স এ ভেরি গুড কোয়েশ্চেন, এ ভেরি গুড কোয়েশ্চেন,” বলে টেবিলের ওপর ঠ্যাং তুলে দিয়ে ইন্সপেক্টর লান্ডি একটা চুরুট ধরালেন।

 

আট

মাঝেমাঝে এমন হয় যে, আমরা শুরু করি একটা সমস্যা নিয়ে, কিন্তু হঠাৎ সেই সমস্যাটা আর থাকে না, তার বদলে অন্য একটা সমস্যা এসে হাজির হয়! নতুন সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আবার নতুনতর কোনো সমস্যার সম্মুখীন হই!

 

বেন্টুমাসির কাছ থেকে প্রথম দিকে রেগুলার তাড়া না খেলে, জসনানির অন্তর্ধান নিয়ে আমরা হয়তো কেউই খুব একটা মাথা ঘামাতাম না। বেন্টুমাসি জসনানিকে মার্ডারার ভাবলেও, আমরা তো জানতাম যে, হি হ্যাড নাথিং টু ডু উইথ এনি মার্ডার। আমার যে কারণে একটু ইন্টারেস্ট জেগেছিল, সেটা হল একটি বৃদ্ধ ভারতীয়, হু ইজ বাই নো মিনস এ রিচ পার্সন, তিনি কীভাবে এই অচেনা অজানা জায়গায় লুকিয়ে থাকতে পারবেন? যাই হোক, সমস্যাটা পালটে গেল যখন জানলাম যে, উনি খালি হাতে উধাও হননি, এক মিলিয়ন ডলার নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন! যাঁর পকেটে এক মিলিয়ন ডলারস আছে, তাঁর অন্তত এই পৃথিবীর কোনো জায়গাতেই খাওয়া পড়ার অভাব হবে না! এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, সেক্ষেত্রে পুলিশ বা এফ.বি.আই.-এর নজর এড়িয়ে থাকা তাঁর পক্ষে বেশ কঠিন ব্যাপার হবে! কিন্তু এখানে ঘটনাচক্র সম্পূর্ণ অন্য দিকে মোড় নিয়েছে! জসনানিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তবে সেই মৃত্যুতে কারও কারসাজি নেই, কেউ তাঁকে হত্যা করেনি! এদিকে টাকাগুলোর কোনো হদিশ নেই! প্রশ্ন, জসনানিই কি টাকাটা চুরি করেছিলেন? না, আর কেউ? শুধু ইন্সপেক্টর লান্ডি নয়, আমাদের সবার কাছেই, ‘দ্যাট্‌স এ ভেরি গুড কোয়েশ্চেন। কিন্তু তার উত্তর যদি পাওয়াও যায়, দ্যাট উইল নট এক্সপ্লেইন যে, জসনানির ডেডবডিটা ওখানে পাওয়া গেল কেন!

 

.

 

পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে যখন উঠলাম, তখন শুধু আমি আর একা নই, প্রমথ আর একেনবাবুও দেখলাম গম্ভীর ভাবে কী সব যেন ভাবছেন। বেশ খানিকটা পথ কেউ আর কোনো কথা বললাম না। কয়েকটা ব্লক যাবার পর একটা সুপারমার্কেটে আমরা থামলাম। একেনবাবুর সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। ছাড়ব-ছাড়ব করেও এখনও উনি ব্যাড হ্যাবিটটা ছাড়তে পারেননি। আমি আর প্রমথ গাড়িতে বসে আছি, কিছুক্ষণ বাদে দেখি সুধীর শিকদার –একেনবাবুর সঙ্গে গল্প করতে করতে ফিরছেন! আমাদের দেখে বললেন, “কোনো কথা শুনব না, একটু চা খেয়ে যেতে হবে।”

 

লোকটা অত্যন্ত নাছোড়বান্দা। আমার আর প্রমথর অনেক আপত্তি ছিল, কিন্তু এমন পীড়াপীড়ি শুরু করলেন যে, আশেপাশে সবাই আমাদের দিকে তাকাতে শুরু করল, যেন কী না কী হচ্ছে! আমি শেষ চেষ্টা করলাম। বললাম, “আমার ভীষণ রাস্তা গুলিয়ে যায়।”

 

শিকদারমশাই বললেন, “ঠিক আছে, তাহলে গাড়িটা রেখে আমার গাড়িতে আসুন। চা-টা খেয়ে আমি আপনাদের এখানে পৌঁছে দিয়ে যাব।”

 

এর পর আর ‘না’ বলা যায় কী করে!

 

ওঁর গাড়িতে উঠে অবশ্য বুঝলাম, এত পীড়াপীড়ির কারণটা কী! একেনবাবুকে বললেন, “বুঝলেন মশাই, বেরিয়েছিলাম সেই ছ’টায়, গিন্নীর জন্য স্কিমড মিল্ক কিনতে। আর এখন বাজে সাড়ে আটটা! টু এন্ড হাফ আওয়ার্স! ভাগ্যিস আপনারা সঙ্গে আছেন, নইলে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড হত!”

 

“কী করছিলেন স্যার এতক্ষণ?”

 

“একটা লন মোয়ারের খোঁজ করছিলাম। রবার্টসে বুঝলেন মশাই প্রচুর কালেকশন –নিউ, ইউজড, ফ্যাক্টরি রিকন্ডিশন্ড, কী চান! একেবারে মাথা ঘুরে যায় দামগুলো দেখে! নতুন হলে তো কথাই নেই, আকাশছোঁয়া দর মশাই!”

 

শিকদারমশাইয়ের প্রফেশন কী জানি না, কিন্তু ওঁর উচিত ছিল মাস্টারি করা।

 

সত্যি, কী অসম্ভব ভালোবাসেন লেকচার দিতে!

 

“বুঝলেন মিস্টার সেন, এভরিথিং আই বাই ইজ ইউজড। এই যে গাড়িটা দেখছেন –এটাও কিন্তু ইউজড কার। কিন্তু বোঝার জো আছে?”

 

একেনবাবুর মুখ দেখে বুঝলাম এদেশের ‘ইউজড’ কথাটার তাৎপর্যটা ওঁর জানা নেই। তাই বললাম, “ইউজড মানে হল সেকেন্ড হ্যান্ড।”

 

“ও তাই বলুন স্যার। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমি তো বুঝতেই পারিনি এটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি, ভাবছিলাম একদম ব্র্যান্ড নিউ!”

 

.

 

গাড়ির কমপ্লিমেন্ট শুনে শিকদারমশাইয়ের মুখ আত্মপ্রসাদে ভরে উঠল।

 

“দ্য ফ্যাক্ট ইজ, লোকে অবশ্য বোঝে না, ইউজড গুডস আর ওয়ার্থ এভরি পেনি। প্রথমত, আপনি জলের দরে কিনছেন, দ্বিতীয়ত, পুরোনো বলে এই বুঝি ভেঙে গেল’ ‘এই বুঝি চুরি হল’ –এইসব নিয়ে দুর্ভাবনা করবেন না। তার থেকেও বড় কথা ইউজড জিনিস সাধারণত রিলায়েবল হবে।”

 

হোয়াট ননসেন্স! মনে মনে বললাম। সেই সঙ্গে প্রমথর হাতে একটা চাপ দিলাম, যাতে হঠাৎ অপমানকর কিছু না বলে ফেলে! কিন্তু একেনবাবু দেখলাম শিকদারমশাইয়ের বক্তৃতাতে একেবারে মুগ্ধ।

 

“এটা খুব গভীর তাৎপর্যের কথা বললেন স্যার। আমার মাথাতে একদম আসেনি।”

 

শিকদারমশাই তাতে উৎসাহিত হয়ে বললেন, “আরে বাড়ির কথাই ধরুন না কেন। আমার বন্ধুবান্ধব, যারা একদম নতুন বাড়ি কিনেছে, তারা যে কী ভুগেছে!

 

বেসমেন্টে জল লিক করছে, দেয়াল ক্র্যাক করছে, প্লাম্বিং ঠিকমতো কাজ করছে না –থাউসেন্ড অ্যান্ড ওয়ান প্রবলেমস মশাই। অথচ আমার বাড়ি দেখবেন। কিনেছি যখন তখন টোয়েন্টি ইয়ার্স ওল্ড, বাট ডিভয়ড অফ অল প্রবলেমস!”

 

ভাগ্যক্রমে খুব বেশিক্ষণ বকবকানি শুনতে হল না, ওঁর বাড়ি এসে গেল। মিসেস শিকদার বেশ মারমূর্তি ধরেই দরজাটা খুলেছিলেন, আমাদের দেখে একটু থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। সুধীর শিকদারও আমরা যে কত মান্যগণ্য লোক স্ত্রীকে বারবার বোঝালেন। তারপর কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “একটু চা হলে বোধহয় মন্দ হত না, কী বল?” তারপরই বললেন, “না, না, তুমি বস, আমি বানাচ্ছি।”

 

মিসেস শিকদার বাধা দিলেন, “থাক তোমাকে আর রান্নাঘরে যেতে হবে না, যে অবস্থা করে রাখবে, আমার কাজ আরও বাড়বে!”

 

“আহা, কী মুশকিল! তাতে আর কি, পরিষ্কার করে দেবো!”

 

শিকদারমশাই আমাদের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা এক্সপ্লেন করলেন, “পুজোর রান্নাটা আর কি! নর্মালি একটা কিচেন ভাড়া করি। এবার হঠাৎ আগে কিছু জিনিসপত্র এসে পড়ায়, আমার বাড়িতেও কিছু কিছু করতে হয়েছে।”

 

“সে তো তোমার দোষ, না করলেই পারতে।”

 

“কী যে বলো, ভোগের জন্য দেওয়া জিনিস ফেলে দিতে আছে?”

 

আমাদের অবশ্য বেশ কিছুক্ষণ লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে। মিসেস শিকদারই পরে পরিষ্কার করে বললেন। মিস্টার সাহানিদের ফ্রিজার হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়ায় ওঁরা অনেক ফ্রোজেন ভেজিটেবল শিকদারমশাইকে পুজোর দিন পাঁচেক আগে দিয়ে যান। নর্মালি শীতকালে ওগুলো বাড়ির বাইরে রাখলে হয়তো ফ্রোজেনই থাকত, কিন্তু পুজোর ক’দিন আগে একটু গরম পড়ায়, মিস্টার শিকদার আর রিস্কই নিতে চাননি। নিজের বাড়িতেই ওগুলো রান্না করে ফেলেন। চারশো লোকের রান্না তো আর ছেলেখেলা নয়। কিচেনের অবস্থা তাই সহজেই অনুমেয়!

 

মিসেস শিকদার রান্নাঘরে যেতেই, শিকদারমশাই দেখলাম অদৃশ্য হয়েছেন।

 

এই ফাঁকে প্রমথ বললল, “কী রে তোকে সেদিন আমি বলিনি যে, ফ্রোজেন ফুড! তখন তো পাত্তা দিলি না!”

 

আমি বললাম, “চুপ কর, ফ্রোজেন, নট ফ্রোজেন, কী এসে যায়? ফুড ইজ ফুড!”

 

“তোর মুণ্ডু! পুজোর ভোগ রান্না হচ্ছে দু’শো বছরের পুরোনো ভেজিটেবল দিয়ে! কী পার্টি রে সব!”

 

“বাজে বকিস না,” আমি ধমক দিয়ে বললোম, “বড়জোর ছ’মাস কি এক বছরের পুরোনো ফসল।”

 

“তাই বা হবে কেন,” বলে প্রমথ আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু সুধীর শিকদার ঘরে ঢুকছেন দেখে থেমে গেল।

 

শিকদারমশাই দু’-আঙুলে একটা ডিবে নাচাতে নাচাতে সোফায় এসে বসলেন। ডিবেটার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু প্রশ্ন করলেন, “বস্তুটা কী স্যার?”

 

“গেস করুন তো?”

 

“নস্যি?” একেনবাবুর চোখ দেখি জুলজুল করছে। তেলোর ওপর ডিবেটা ঠুকতে ঠুকতে শিকদারমশাই বললেন, “আদি এবং অকৃত্রিম হানড্রেড পার্সেন্ট ইন্ডিয়ান নস্যি!” তারপর আমাকে আর প্রমথকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কী মশাই, চলবে?”

 

আমি সোজা বললাম “না।” কিন্তু প্রমথটা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “দিন একটু ট্রাই করি। তবে একটা টিস্যু পেপার দিন, যদি হাঁচি আসে!”

 

শিকদারমশাই বাথরুম থেকে টিস্যু পেপার আনতে যেতেই আমি ফিসফিস করে প্রমথকে বললাম, “ওদিকে তো ফ্রোজেন ফুড নিয়ে চেঁচামেচি করিস। আর এদিকে ওরকম একটা আনহাইজিনিক লোকের নস্যি তুই নিচ্ছিস?”

 

প্রমথ উলটে বলল, “চুপ কর, তুই এখানে চা খাচ্ছিস না!”

 

টিস্যু পেপার এল। তারপর সেই টিস্যু পেপার হাতে ধরে তিনজনের নস্যি নাকে টেনে জলভেজা চোখে আঃ, আঃ করা! জাস্ট ডিসগাস্টিং! আমি আর সহ্য না করতে পেরে সোজা ডাইনিং রুমে গিয়ে দেয়ালে বাটিকের কয়েকটা কাজ ছিল, সেগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। তখনই কিচেনে চোখ পড়ল। উঃ কী নোংরা! চা যখন এল, তখন সেটা গলা দিয়ে নামছিল না। তার ওপর সুধীর শিকদার এক প্লেট নিমকি সামনে ধরে আদর আপ্যায়নের চেষ্টা করলেন যে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি-র অবস্থা! প্রমথটা এদিকে অম্লান বদনে পেট খারাপ হয়েছে বলে সব কিছু অ্যাভয়েড করল। আমি জানি, কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে। আজ দুপুরেও ও একটা মিডিয়াম সাইজের পিৎজা সাঁটিয়েছে। শুধু একেনবাবু হাসিমুখে সবকিছু খেলেন, আর যথারীতি অজস্র প্রশংসা করলেন!

 

নয়

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে প্রমথ একেনবাবুকে প্রশ্ন করল, “কী মশাই, কী বলবেন কিছু ঠিক করেছেন?”

 

একেনবাবু অবাক হয়ে বললেন, “কাকে কী বলব স্যার?”

 

“এক্ষুণি বেন্টুমাসির যে ফোন কলটা আসবে, তার কথা বলছি। কী বলবেন বেন্টুমাসিকে?”

 

প্রমথটা একেবারে যেন সাইকিক! কথা শেষ হতে না হতেই বেন্টুমাসির ফোন! “কে বাপি?”

 

“হ্যাঁ। বলে আমি ফোনের মাউথপিসটা হাতে ঢেকে একেনবাবু আর প্রমথকে শব্দ না করে মুখ নেড়ে বললাম, “বেন্টুমাসি।” তাতে একেবারে ম্যাজিকের মত রিয়্যাকশন হল! প্রমথটা গা দুলিয়ে নাচা শুরু করল। আর একেনবাবু হাত দুটো জোড়া করে ঘন ঘন মাথে নেড়ে ‘না’ বলে চললেন।”

 

“একেন কি তোর ওখানে?” বেন্টুমাসি প্রশ্ন করলেন।

 

আমি হাত তুলে একেনবাবুকে অভয় দিয়ে বেন্টুমাসিকে বললাম, “না, উনি তো নেই।”

 

“কোন চুলোয় গেছে এই সাতসকালে?”

 

“তা তো ঠিক জানি না। এলে ফোন করতে বলব?”

 

“হ্যাঁ বলিস। আর তুই কি জানিস, একেন ওই ব্যাপারটার কোনো হদিশ পেল কিনা?”

 

“ঠিক বলতে পারছি না বেন্টুমাসি। তবে অনেক খোঁজখবর করেছেন জানি।”

 

“তোরা কী করছিস, তোরা কোনো খোঁজখবর করছিস না?”

 

“আমরাও করছি, কালই তো ইন্সপেক্টর লান্ডির কাছে সবাই গিয়েছিলাম।”

 

“কী বলল সে?”

 

“বললেন, অটপসির প্রিলিমিনারি রেজাল্ট অনুসারে মিস্টার জসনানির ডেথ ন্যাচারাল। সুতরাং, ডাজ নট লুক লাইক ইট ওয়াজ এ মার্ডার।”

 

“হনুমানদের যতসব উড়ুটে কথা!”

 

“হনুমান! কাদের কথা বলছো তুমি?”

 

“কাদের আবার, এইসব ডাক্তারগুলোর! জ্যান্ত লোকদের রোগই ধরতে পারে না, আর কিনা মড়া লোক দেখে খুঁটিনাটি সব জেনে বসে আছে! দ্যাখ বাপি, আমি তোকে বলে রাখছি, এটা হল একটা ডাহা খুন! যে লোকটা মিরচন্দানিকে টাকা দিয়েছিল, তাকে থানায়

 

এনে দু’চার ঘা দে, তারপর দেখ কবুল করে কি না!”

 

বেন্টুমাসির ফোন শেষ হলে আমি একেনবাবুকে বললাম, “আপনার ফেইলিওরের জন্য মশাই আমাকে ধমক খেতে হচ্ছে! না পারছেন খুনি ধরতে, না পারছেন টাকা উদ্ধার করতে!”

 

একেনবাবু বললেন, “কেসটা সত্যিই পাজলিং স্যার। একটু আগে ইন্সপেক্টর লান্ডিকে ফোন করেছিলাম। পোস্ট মর্টেম ইজ নাউ কমপ্লিট। কোনো সন্দেহই নেই যে, ডেথ ইজ ন্যাচারাল।”

 

“তাই যদি হবে মশাই, তাহলে কেন বডিটা ওভাবে লাম্প করা হল, আর টাকাটাই বা অদৃশ্য হল কেন? “ প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

 

আমি বললাম, “আমারও একবার সেটা মনে হয়েছিল। কিন্তু ব্রিফকেসে যে অত টাকা ছিল সেটা তো পুলিশ বা আমরা কেউই জানতাম না, যদি না অরুণ সাহানি আমাদের বলতেন! সাহানি ব্রাদার্স যদি সত্যিই টাকাটা চুরি করতেন, সেক্ষেত্রে টাকা থাকার কথাটা পুরোপুরি চেপে যেতেন।”

 

প্রমথ বলল, “দেয়ার ইজ অ্যানাদার বিগ আন-অ্যানসার্ড কোয়েশ্চেন। সাহানিদের বাড়ি থেকে অদৃশ্য হওয়ার পর প্রায় এক সপ্তাহ মিস্টার জসনানি কোথায় ছিলেন?”

 

একেনবাবু চুপ করে আছেন দেখে প্রমথ বলল, “কী মশাই, আমরা অ্যামেচাররা স্পেকুলেট করে যাচ্ছি, আর আপনি প্রফেশনাল গোয়েন্দা ব্যোম মেরে আছেন যে?”

 

একেনবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, “দিস কেস ইজ ভেরি কনফিউসিং স্যার।”

 

সেদিন সন্ধ্যেবেলা একেনবাবু বললেন, “স্যার, হঠাৎ খেয়াল হল মিস্টার সাহানিদের বাড়িতে আমার ডায়েরিটা ফেলে এসেছি।”

 

আমি বললাম, “আপনি শিওর?”

 

“প্ৰায় শিওর স্যার। আমি সেদিন ক্যামেরার কতগুলো ইনফরমেশন ডায়েরিতে টুকে ওটা হাতে নিয়েই ওঁদের রেকরুমে যাই। সেখানে আপনার সঙ্গে গল্প করার সময় বোধহয় চেয়ারে বা কোথাও ওটাকে রাখি। তারপর আর আমি ডায়েরিটা ব্যবহার করিনি। সুতরাং, ওটা ওখানেই আছে।”

 

দশ

ডায়েরি উদ্ধার করতে সেই রাত্রেই আমরা সাহানিদের বাড়ি গেলাম। সাহানিদের বাড়িতে সে রাত্রে গেস্ট আসার কথা, তাও যখন ফোন করলাম অশোক বললেন, “ঠিক আছে, চলে আসুন।”

 

আমি এরকম ভাবে শর্ট নোটিসে কারুর বাড়ি যাওয়াটা পছন্দ করি না। লোকের ওপর শুধু শুধু ইম্পোস করা। কিন্তু মনে হল ডায়েরিটা একেনবাবুর হঠাৎ ভীষণ জরুরি দরকার! একেনবাবু বাইরে ভাব দেখান চূড়ান্ত ফ্লেক্সিবল, কিন্তু আসলে ভেতরে ভেতরে অসম্ভব রিজিড় আর একগুঁয়ে। ডায়েরিটা যখন দরকার, তখন সেই মুহূর্তেই দরকার!

 

নোটিস শর্ট হলেও আমাদের অভ্যর্থনার কিছুমাত্র কমতি হল না। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই অরুণ কফির আয়োজন করলেন, আমি একটু আপত্তি জানাবার চেষ্টা করতেই বললেন, “কী মুশকিল, আমরা খাব না! শুধু কী আপনাদের জন্য করছি নাকি!”

 

অবশ্য এর আগেই যে একপ্রস্থ কফি খাওয়া হয়ে গেছে, সেটা টেবিলে পড়ে থাকা কাপগুলো থেকে বুঝলাম।।

 

ওঁদের গেস্ট দু’জন কমবয়েসি, নিশ্চয়ই অশোকের অফিসের। দু’জনেই খুব এক্সাইটেড হয়ে অফিসের নানান গল্প করছিল। আমি অবশ্য কিছুই শুনছিলাম না। কী হবে শুনে? গল্পের সেটিং জানা নেই, না চিনি ক্যারেক্টারগুলোকে, না জানি তাদের পাস্ট হিস্ট্রি! রসটা তাহলে পাব কোত্থেকে?

 

.

 

একেনবাবু ইতিমধ্যে নীচ থেকে ওঁর ডায়েরিটা উদ্ধার করে এনেছেন। নিতান্ত কফি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসা যায় না। নইলে তাই করতাম।

 

সাহানিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা ছোটো একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। রেস্টুরেন্টটা ইটালিয়ান। আমি অর্ডার করলাম শ্রিম্প স্ক্যাম্পি, প্রমথ নিল চিকেন পার্মাজাঁ। একেনবাবু রেস্টুরেন্টে অর্ডার দেবার বেলায় সাধারণত আমাদের লিড ফলো করেন। এবার ওস্তাদি করে পাস্তা আরাবিয়েত্তা অর্ডার করে খাবার সময় আফশোস করা শুরু করলেন।

 

“এ তো শুধু নুডুল আর ঝাল সস স্যার। আমি ভেবেছিলাম ল্যাম্ব-ট্যাম্ব কিছু থাকবে। দারুণ মিসটেক করলাম স্যার অর্ডারটা দিয়ে। কী করে খাই এটা?”

 

আমি বললাম, “কী আর করবেন, আপনি বরং আমার থেকে কিছুটা নিন।”

 

“তা কী করে হয় স্যার, আপনার তাহলে কম পড়ে যাবে!”কিচ্ছু কম পড়বে না, আপনি নিন।”

 

“তাহলে আপনি স্যার আমারটা একটু নিন,” বলেই একেনবাবু সস শুদু একগাদা পাস্তা আমার প্লেটে ফেলে দিয়ে শ্রিম্প স্ক্যাম্পির পুরো টেস্টটাই বরবাদ করে দিলেন। তারপর প্রমথকে জিজ্ঞেস করলে, “আপনি কী খাচ্ছেন স্যার?”

 

“চিকেন।”

 

“লুকস গুড! ওটাই স্যার আমার অর্ডার করা উচিত ছিল।”

 

“তাহলে নিন মশাই একটু। নইলে আমার আবার পেট খারাপ করবে।”

 

“আরে না না স্যার, আমার প্লেট একেবারে ফুল। এই তো বাপিবাবু এতগুলো চিংড়ি মাছ দিলেন।”

 

“তা বললে শুনব কেন মশাই! লোভ যখন একবার করেছেন, তখন নিতেই হবে!” বলে প্রমথ ওর কিছুটা পোরশন একেনবাবুকে দিল।

 

একেনবাবু এই সুযোগে ওঁর পাস্তার বাকিটুকু প্রমথকে পাস করে দেবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু প্রমথ বলল, “না, ওসব আমি নিচ্ছি না। আপনার কর্মফল মশাই আপনি ভোগ করবেন।”

 

আমরা যেখানে বসেছিলাম, তার ঠিক সামনেই একটা বড় টিভি মনিটর।

 

সেখানে দেখি আমার একটা ফেভারিট পুরোনো গেম শো ‘টেল দ্য টুথ’ –এর রি-রান হচ্ছে। ‘টেল দ্য টুথ’ –এর প্রত্যেকটা শো-ই এক ধাঁচের। প্রথমে মোটামুটি একটা ইন্টারেস্টিং লোকের একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দেওয়া হয়। তারপর সেই লোকটি ছাড়া আরও দুজন এসে দাবি করে, তারাই হচ্ছে সেই লোক। শো-তে প্রশ্ন করার জন্য কয়েকজন সেলিব্রেটি থাকে। তারা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে এই তিনজনকে নানান ধরনের প্রশ্ন করে বের করার চেষ্টা করে, কে আসল, এবং কারা নকল!

 

ন্যাচারালি দর্শকরাও সেই সঙ্গে গেস করার চেষ্টা করে। শো-র শেষে যারা প্রশ্ন করছিল, তাদের বলা হয় নিজেদের অনুমানগুলো জানাতে। তারপর আসল লোকটি উঠে দাঁড়ায়।

 

এবার যে লোকটা এসেছিল, তার নাম, এডওয়ার্ড ব্র্যান্ডো। সে হচ্ছে একজন পেস্ট্রি মেকার। ব্র্যান্ডোর তৈরি পেস্ট্রি নাকি আমেরিকার তাবৎ গণ্যমান্য লোকে খেয়েছে! ওর স্পেশালিটি হচ্ছে ওয়েডিং কেক বানানো। মাত্র কয়েকমাস আগে এই নিউ ইয়র্কেই নাকি ব্র্যান্ডো একটা আট ফুট উঁচু ওয়েডিং কেক বানিয়েছে! ইত্যাদি, ইত্যাদি।

 

মাত্র আধ ঘন্টার শো। খেতে খেতেই শেষ হয়ে গেল। আমি আগে এই এপিসোডটা দেখিনি, তার ওপর শো-টা দেখছি বহুদিন বাদে। তাই খুব এনজয় করছিলাম। যথারীতি, প্রশ্নের শেষে শো-র হোস্ট গ্যারি মোর প্যানেলকে জিজ্ঞেস করলেন, আসল ব্র্যান্ডো কে? কে যে আসল, আমি তো কিছুতেই ভেবে পেলাম না। কিন্তু প্যানেলের সবাই দেখলাম একবাক্যে বলল, তিন নম্বর চেয়ারে বসা লোকটা।

 

তখন গ্যারি মোর বললেন, “উইল মিস্টার রিয়েল এডওয়ার্ড ব্র্যান্ডো প্লিজ স্ট্যান্ড আপ!”

 

কী আশ্চর্য! দ্য প্যানেল ওয়াজ রাইট!

 

একেনবাবুও একেবারে স্টান্ড! কিছুতেই ভেবে পেলেন না প্রশ্নকারীর তিন-তিনজনেই কী করে আসল লোকটাকে বের করে ফেললেন!

 

আমাকে বললেন, “আমার তো মনে হচ্ছিল স্যার, প্রত্যেকেই চমৎকার উত্তর দিয়েছেন! তিন নম্বরের বদলে দু’নম্বর উঠে দাঁড়ালেও মেনে নিতুম।”

 

প্রমথও নিশ্চয়ই ভুল লোককে বেছেছিল। তাই বলল, “ধস, যাকেই ভোট দিন না, থার্টিথ্রি পারসেন্ট চান্স যে, ইউ আর রাইট। আই বেট, আজ সবাই লাকে মেরে দিয়েছে!”

 

“মোটেও নয়,” বলে আমি প্রমথর সঙ্গে তর্ক জুড়তে যাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম একেনবাবু কেমন একটু অন্যমনস্ক।।

 

আমি বললাম, “কী ব্যাপার, সামথিং রং?”

 

একেনবাবু বললেন, “আই ওয়াজ এ ফুল স্যার। ইট ওয়াজ রিয়েলি সো সিম্পল!”

 

আমি আর প্রমথ অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকালাম। কী সিম্পল, কিসের কথা উনি বলছেন?

 

“এখনো লিঙ্কটা বুঝতে পারছেন না স্যার? টু ডেথস, অ্যান্ড ফ্রোজেন ফুড, আই মিন ইটস ডাম্পিং!”

 

“কী বলছেন মশাই যা তা? একটু খোলসা করে বলুন তো?” প্রমথ ধমকে বলল।

 

উনি উত্তর না দিয়ে বললেন, “স্যার, আপনাদের কাছে একটা কোয়ার্টার হবে, একটা জরুরি ফোন করতে হবে।”

 

.

 

প্রমথ একটা কোয়ার্টার দিতেই হুড়মুড় করে চলে গেলেন।

 

কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বললেন, “চলুন স্যার, আর একবার একটু মিস্টার সাহানিদের বাড়িতে যেতে হবে।”

 

আমি বললাম, “সে কী, কেন?”

 

“আপনি সেদিন বললেন না যে, ওঁদের ফ্রিজারটা চলছে, কিন্তু ভেতরটা ফাঁকা। সেটা মোটেও সুবিধার নয় স্যার!”

 

সত্যি কথা বলতে কি, আমি একেনবাবুর এই কথাটার কোনো অর্থই খুঁজে পেলাম না। উনি কি হঠাৎ খেপে গেছেন!

 

“তাতে হয়েছেটা কী?” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল, “ইট ইজ নট গোয়িং টু গেট ড্যামেজেড ফর দ্যাট।”

 

“চলুন স্যার, আর কোনো প্রশ্ন করবেন না, আই অ্যাম স্টিল লিটল কনফিউজড।” কথাটা বলে একেনবাবু মুখে একেবারে কুলুপ দিয়ে বসে রইলেন।

 

এগার

অশোক সাহানি দরজা খুলে আমাদের দেখে একেবারে অবাক, একটু যেন বিরক্তও।

 

“কী ব্যাপার, আপনারা এত রাত্রে?”

 

কথাটা শুনেই একেনবাবু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওই যাঃ স্যার, এত যে রাত হয়েছে, সেটা তো একদম খেয়াল হয়নি। না স্যার, আপনাকে এখন আর ডিস্টার্ব করা উচিত হবে না।”

 

ইতিমধ্যেই অরুণও দেখলাম অশোকের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

 

“কী ব্যাপার?” অরুণ আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন।

 

“নাথিং দ্যাট আর্জেন্ট স্যার,” একেনবাবু একেবারে হাত দুটো জোড়া করে বললেন। “দোষটা সম্পূর্ণ আমার। আমরা যদি একটু খেয়াল করতাম যে, এগারোটা বেজে গেছে, তাহলে কখনোই ডোর বেলটা বাজাতাম না, নেভার স্যার! যাক, যা হওয়ার হয়ে গেছে। উই মাস্ট লিভ রাইট নাউ। আপনারা স্যার নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে পড়ুন। দেয়ার ইজ অলওয়েজ টুমরো।”

 

এই কথার পর অত্যন্ত নির্লজ্জ না হলে কেউ বলবে না যে, ঠিক আছে,কাল দেখা হবে।

 

অশোক বললেন, “ভেতরে আসুন। উই মাস্ট হ্যাভ সামথিং ইমপর্ট্যান্ট টু সে।”

 

“আপনি শিওর স্যার? আই মিন ইট ইজ নট টু লেট?”

 

“ডাজ’ন্ট ম্যাটার, আসুন।”

 

“থাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।”

 

.

 

আবার আমরা সাহানি ম্যানসনের ফ্যামিলি রুমে গিয়ে বসলাম। ওঁদের গেস্টরা দেখলাম চলে গেছেন। কফির কাপগুলো তখনও ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। সেগুলো দেখে প্লাস টেনশনে –আমার বেশ কফির পিপাসা পাচ্ছিল। কিন্তু এবার আর কেউ চা- কফির জন্য আপ্যায়ন করলেন না। অরুণ ‘আমি একটু আসছি’ বলে ভেতরে চলে গেলেন। আর অশোকও আমাদের সামনে বসলেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফায়ার প্লেসের কাঠগুলোকে খোঁচাতে খোঁচাতে প্রশ্ন করলেন, “বলুন মিস্টার সেন, হাউ ক্যান উই হেল্প ইউ?”

 

প্রশ্নটা একেনবাবুর কানে ঢুকল কিনা জানি না, কারণ উনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ফায়ার প্লেসটা দেখছেন। বললেন, “যাই বলুন স্যার, এই ফায়ার প্লেস জিনিসটা কিন্তু একেবারে মার্ভেলাস। হ্যাঁ বাড়িতে আপনাদের সেন্ট্রাল হিট আরও কীসব আছে জানি ঠিকই, কিন্তু এই উড বার্নিং ফায়ার প্লেসের আগুনের গরম স্যার, একেবারে আউট অফ দ্য ওয়ার্লর্ড! আমি আবার স্যার ঠান্ডায় বড় কাবু হই! এই যে আপনার এখানে বসে আমি গনগনে তাপ পোয়াচ্ছি –ইট ইজ জাস্ট…!”

 

একেনবাবুর বকবকানি শুরু করতেই দেখলাম অশোকের ভুরু দুটো একটু একটু করে কুঁচকোচ্ছে। বলতে কী আমারও অস্বস্তি লাগছিল, রাত দুপুরে উনি এই খেজুরে আলাপ শুরু করেছেন দেখে!

 

“প্লিজ,” একেনবাবুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অশোক বললেন, “এটা বলার জন্য নিশ্চয়ই এত রাত্রে আসেননি!”

 

“ইউ আর রাইট স্যার। সত্যি কথা বলতে কী স্যার, আমি গরমের কোনো কথাই ভাবছিলাম না, বরং তার উল্টোটাই ভাবছিলাম। আমার মাথায় আপনাদের ফ্রিজার নিয়ে একটা প্রশ্ন ঘুরছিল।”

 

“ফ্রিজার!”

 

“হ্যাঁ স্যার। আপনাদের বেসমেন্টে বোধহয় একটা ফ্রিজার আছে। আসলে স্যার, আমি ফ্রিজার-টিজার ঠিক চিনি না। তবে কিনা শ্যামলবাবুর বাড়িতে ক’দিন আগে একটা ফ্রিজার দেখেছিলাম। আপনাদের বেসমেন্টে যে বক্সটা আছে, সেটাও হুবহু এক সাইজ,

 

এক চেহারা। তাই মনে হল ফ্রিজারই নিশ্চয়ই হবে!”

 

“আই অ্যাম নট সারপ্রাইজড। আই ডু হ্যাভ এ ফ্রিজার ইন মাই বেসমেন্ট।”

 

বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে, অশোক তার বিরক্তিটা প্রাণপণে চাপার চেষ্টা করছেন।

 

“ইজ ইট ওয়ার্কিং স্যার?”

 

“ইয়েস।”

 

“আমি তো শুনেছিলাম ওটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।” একেনবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন।

 

এত রাত্রে কারোর বাড়িতে এসে কেউ যে এরকম ননসেন্স প্রশ্ন করে যেতে পারে, সেটা বোধহয় অশোক কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু অন্যপক্ষে উনি আমাদের একেনবাবুকে চেনেন না!

 

“কার কাছে শুনলেন?”

 

“মিস্টার শিকদার স্যার…।”

 

“ও এবার বুঝেছি!” অশোক একেনবাবুর কনফিউশনের সূত্রটা ফাইনালি ধরতে পারলেন। “ইয়েস, ওটা খারাপ হয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। ঠিক খারাপ নয়। জাস্ট এ সার্কিট ব্রেকার প্রব্লেম। কোনো কারণে ওভারলোড হয়ে গিয়ে বোধহয় ট্রিপ করেছিল। অরুণ তখন সেটা বোঝেনি। তাই সবজিগুলো মিস্টার শিকদারকে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে এসেছিল, নষ্ট না হয়ে যাতে পুজোর ভোগে লাগে।”

 

“নাউ ইট ইজ ক্লিয়ার স্যার। অ্যান্ড ইট মেকস সেন্স। আমি স্যার অস্বীকার করব না, আগের দিন আপনাদের বেসমেন্টে গিয়ে আমি একটু কনফিউজডই হয়ে গিয়েছিলাম! আই নো ইট ইজ নান অফ মাই বিজনেস স্যার, কিন্তু হঠাৎ কী খেয়াল হল, আমি আপনাদের ফ্রিজারের ডোরটা একটু খুলেছিলাম। আর খোলামাত্র বুঝলাম যে, ভেতরটা একেবারে আইস কোল্ড! অথচ মিস্টার শিকদার বলেছিলেন যে, ফ্রিজার খারাপ হয়ে গেছে বলে আপনারা সরস্বতী পুজোর ভেজিটেবলগুলো পাঁচ দিন আগে ডেলিভারি করেছেন! কিন্তু এখন ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। আসলে আপনাদের ফ্রিজারটা সত্যি খারাপ হয়নি!”

 

“ইউ আর রাইট।” কথাটা বললেন অরুণ। কোন ফাঁকে উনি যে ঘরে ঢুকেছেন আমি খেয়ালও করিনি!

 

একেনবাবু ঘাড়টা ঘষতে ঘষতে বললেন, “বাট দ্যাট ব্রিংস অ্যানাদার কোয়েশ্চেন স্যার। আমি সেদিন খেয়াল করেছিলাম যে, আপনাদের ফ্রিজারটা একেবারে ফাঁকা। এবং আজও যখন ডায়রিটা খুঁজতে নীচে গিয়েছিলাম, দেখলাম ওটা ফাঁকা পড়ে আছে!”

 

দাদা আর ভাই এক পলকের জন্য চোখাচোখি করলেন। অশোক বললেন, “ওয়েল কারণ আমরা ফ্রিজারটা বিক্রি করে একটা নতুন ফ্রিজার কিনব ঠিক করেছি।”

 

“মাই গড স্যার! আমার তো মনে হল ফ্রিজারটা প্রায় ব্র্যান্ড নিউ!”

 

“ইট ইজ নট ওল্ড,” অশোক স্বীকার করলেন, “তবে বুঝলেন তো, একবার যখন ব্রেকার ট্রিপ করেছে, তখন গন্ডগোল কিছু নিশ্চয়ই আছে।”

 

“এবার বুঝলাম স্যার। আমি এতক্ষণ খালি ভাবছিলাম, কিংসে জলের দরে ফ্রোজেন ভেজিটেবল বিক্রি হয়ে গেল, অথচ আপনারা সেগুলো কিনলেন না কেন! এদিকে শ্যামলবাবু বলছিলেন আপনারা দু’জনে এত হিসেব করে চলেন। আই মিন ভাল সেন্সেই বলছিলেন। শুধু শ্যামলবাবু কেন, আমি নিজেই তো সেদিন দেখলাম স্যার, খাবার পর লেফট ওভারগুলো কেমন যত্ন করে আপনারা তুলে রাখছেন। ভেরি গুড হ্যাবিট স্যার, ভেরি গুড হ্যাবিট। এনিওয়ে, আই ওয়াজ ভেরি কনফিউসড! কিংসে এরকম বার্গেন পেয়েও আপনারা তার সদ্ব্যবহার করলেন না। আসলে বুঝলেন কি না, আমার সমস্যা হচ্ছে…”

 

একেনবাবু বোধহয় একটা দীর্ঘ বক্তৃতার প্ল্যান করছিলেন, কিন্তু অরুণ সেটা থামিয়ে দিলেন।

 

“মিস্টার সেন, আমার দাদার অসম্ভব ধৈর্য, বাট আই ডোন্ট হ্যাভ দ্যাট। আপনার কি আর কিছু বলার আছে?”

 

“আছে স্যার।”

 

“দেন সে ইট, বাট ডু হারি, ইট ইজ গেটিং লেট!”

 

“হ্যাঁ স্যার।” বলে একেনবাবু পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরাতে গিয়ে কী ভেবে থেমে বললেন, “সিগারেট খেলে আপনাদের অসুবিধা হবে না তো? মানে যদি কোন অসুবিধা হয়, তাহলে…।”

 

“না হবে না,” অরুণ বেশ রূঢ়ভাবেই বললেন, “জাস্ট গেট গোইং।”

 

“না, থাক স্যার। বড় ব্যাড হ্যাঁবিড়!” ‘মিস্টার সেন, আই অ্যাম রানিং আউট অফ পেশেন্স! আপনার বক্তব্যটা তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন!” অরুণ অসহিষ্ণু ভাবে বললেন।

 

“আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম স্যার, গোভিন্দ জসনানির মৃত্যুটা আমার কাছে একটু মিস্টিরিয়াস?”

 

“তার মানে?” অশোক প্রশ্নটা করলেন।

 

“মানে ওঁর হঠাৎ এই ব্রিফকেস নিয়ে অদৃশ্য হওয়াটা, আর তার এক হপ্তা বাদে ওঁর মৃতদেহটা ব্রিফকেস সমেত প্রায় অক্ষত অবস্থায় ট্যাপান জি ব্রিজের কাছেপাওয়াটা। সামথিং ইজ নট কোয়ায়েট রাইট স্যার। “

 

“হোয়াটস রং দেয়ার?” এবার অরুণ প্রশ্নটা করলেন। “আমার তো ধারণা, ইন্সপেক্টর লান্ডির বিশ্বাস যে, সামবডি ফার্স্ট রবড় হিম অফ অল দ্য মানি। তারপর ওঁকে ধাক্কা দিয়ে হাইওয়ে থেকে নীচে ফেলে সে অদৃশ্য হয়।”

 

“এটা মন্দ বলেননি স্যার। কিন্তু ঘটনাটা হচ্ছে, উনি মারা যান হার্ট অ্যাটাকে। যদি মনে করি স্যার, ওঁর হার্ট অ্যাটাকটা হয়েছিল রাস্তা থেকে ওকে ফেলে দেবার পর, তা হলে কিন্তু ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে যায়!”

 

“গোলমেলে হয়ে যায়?” এবার অরুণ প্রশ্নটা করলেন।

 

“হয়ে যায় না স্যার?” যেলোকটা অতগুলো টাকা কেড়ে নিল, সে কেন তার ভিক্টিমকে। জীবিত অবস্থায় ওভাবে ফেলে রেখে চলে যাবে! বুঝতে পারছেন স্যার আমি কী বলছি? মিস্টার জসনানি তো সেক্ষেত্রে পরে পুলিশের সামনে লোকটাকে আইডেন্টিফাই করতে পারতেন!

 

“হু নোজ, তার মুখে হয়তো মুখোশ ছিল।” অরুণ বললেন। “সুতরাং আইডেন্টিফাই করার প্রশ্নই ওঠে না।”

 

“ঠিক, সেটা অবশ্যই একটা পসিবিলিটি স্যার।” স্বীকার করলেন একেনবাবু।

 

“তাহলে? এ ছাড়াও অনেক পসিবিলিটি আছে মিস্টার সেন,” এবার অশোক বললেন। “আমি ধরে নিচ্ছি যে, গোভিন্দ আঙ্কল কারও কাছ থেকে গাড়িতে রাইড নিচ্ছিলেন। সে লোকটা যখন আঁচ পায় যে, আঙ্কলের ব্রিফকেসে এত টাকা আছে। হি স্টপড দ্য কার এবং ব্যাগটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এরকম একটা ফিজিক্যালি স্ট্রেসফুল সিচুয়েশনের মধ্যে পড়ে গোভিন্দ আঙ্কল হার্ট অ্যাটাকে কোলান্স করেন। দ্য রেস্ট ইজ সিম্পল। হি ডাম্পড দ্য বডি। আফটার অল, এ ডেড ম্যান উইল নেভার বি এবল টু আইডেন্টিফাই, তাই না?”

 

“আমিও ঠিক এটাই ভেবেছিলাম স্যার। তবে কিনা একটা ব্যাপার তাতে ক্লিয়ার হয় না।”

 

“হোয়াট ডু ইউ মিন?”

 

“ব্রিফকেসের লকটা একেবারে পারফেক্ট অবস্থায় পাওয়া গেছে! আমি নিজেই দেখেছি স্যার। আমি তো ভেবেছিলাম লকটা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যাবে। না স্যার, তা নয় –দ্য লক ওয়াজ স্পটলেসলি ক্লিন, অ্যান্ড কমপ্লিটলি ইনট্যাক্ট!”

 

অশোক ভুরু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললেন, “পারহ্যাপস, লোকটা পিস্তল দেখিয়ে গোভিন্দ আঙ্কলকে দিয়েই ব্রিফকেসটা খুলিয়েছিল।”

 

“ট্রুলি অ্যামেজিং স্যার! বিশ্বাস করুন আমিও তাই ভেবেছিলাম! কিন্তু তখন আমার মনে পড়ল স্যার, ব্রিফকেসটা তো আপনাদের বাড়ির। লকের কম্বিনেশনটা জানেন আপনারা, আর আপনাদের কাছ থেকে জেনেছিলেন শ্যাম মিরচন্দানি। মিস্টার জসনানির তো সেটা জানার কথা নয়! কারণ, যখন ব্রিফকেসটা আপনাদের কাছ থেকে মিস্টার মিরচন্দানি ধার নেন, তখন মিস্টার জসনানি ওয়াজ আউট অফ দ্য হাউস। তাই না?”

 

“আমি হয়তো অন্য কোনো সময় ওঁকে কম্বিনেশনটা বলেছিলাম,” অরুণ বললেন। “ইন ফ্যাক্ট, আমার এখন মনে পড়ছে, আই ডিড টেল হিম।”

 

“কিন্তু আরেকটা সম্ভবনা আছে স্যার।”

 

“সেটা কি?” দু’জনেই প্রায় একসঙ্গে প্রশ্নটা করলেন।

 

“ধরুন স্যার, আপনাদের দু’জনের মধ্যেই কেউ টাকাটা ব্রিফকেস থেকে সরিয়েছেন!”

 

“বি কেয়ারফুল মিস্টার সেন, কী যা তা বলছেন আপনি!”

 

“এখানে স্যার সম্ভবনার কথা হচ্ছে। হতে তো পারে যেমন আপনাদের মধ্যে একজন। বা দু’জন মিলেই টাকাগুলো আত্মসাৎ করে, শুক্রবার রাত্রে মিস্টার জেসনানির বডিটা হাইওয়ের পাশে ডাম্প করে এসেছেন!”

 

“দিস ইজ আটারলি ননসেন্স!” অশোক বেশ কড়া গলায় বললেন, “টাকার কথা ছাড়ন। শুধু শুধু আমরা বাড়ির গেস্টের ডেডবডি বাইরে ওভাবে ডাম্প করতে যাব কেন? ইউ আর নট ইমপ্লায়িং দ্যাট উই কিলড হিম!”

 

“নো স্যার, অ্যাবসলুটলি নট। ওঁর মৃত্যু পুরোপুরো স্বাভাবিক।”

 

“তাহলে?”

 

“সেটাই ছিল আমার পাজল স্যার। অস্বীকার করব না, পাজল হিসাবে এটা ছিল অতি মোক্ষম! আমি স্যার পুরোপুরি কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। আপনারা যদি সত্যি খুন না করে থাকেন, তাহলে ওভাবে ডেড বডিটা ডাম্প করতে যাবেন কেন? আর তখনই চিন্তাটা আমার মাথায় এল স্যার –আমার মন বলল, আপনারা কিছু একটা ঢাকার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ আমার মনে পড়ল এরকম একটা কেসের কথা আমি কোথাও পড়েছি। এমনকি সিনেমাতেও বোধহয় দেখেছি।”

 

.

 

একেনবাবু যে কী বলতে চাচ্ছেন, আমি তখনও বুঝতে পারছি না! কিন্তু অশোক আর অরুণ বোধহয় কিছুটা আঁচ করতে পারছিলেন। কারণ ওঁদের চোখে-মুখে বিস্ময়ের বদলে একটা চাপা আতঙ্ক ফুটে বেরোচ্ছে! অরুণ দেখলাম দেওয়াল-আলমারিটার দিকে আস্তে আস্তে এগোচ্ছেন।

 

একেনবাবু সেটা লক্ষ্য করে অরুণকে বললেন, “স্যার, ইন্সপেক্টর লান্ডি কিন্তু বাইরে তাঁর লোকজন নিয়ে অপেক্ষা করছেন। পাপের বোঝা আর বাড়াবেন না!”

 

কথাটা শোনামাত্র ম্যাজিকের মত কাজ হল! অরুণ দাঁড়িয়ে পড়লেন।

 

“আমি বুঝতে পারছি না, আপনি কী বলছেন! শুকনো গলায় অরুণ বললেন।”

 

“আমি শ্যাম মিরচন্দানির খুন হওয়ার কথাটা বলছি!”

 

“হোয়াট!” এবার আর সাহানি ব্রাদার্স নয়, আমার মুখ দিয়েই কথাটা বেরিয়ে গেল।

 

“হ্যাঁ স্যার।” আমার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন।

 

“শ্যাম মিরচন্দানি যখন নিউ ইয়র্কে ওঁর কাস্টমারদের কাছ থেকে পাওনা-গন্ডা আদায় করছেন, সেই সময়ে এখানে এই বাড়িতে এঁদের দু’জনের সামনেই মিস্টার জসনানি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। এই দু’ভাই জানতেন যে, মিস্টার মিরচন্দানি সেদিন প্রায় মিলিয়ন ডলার ক্যাশ নিয়ে বাড়িতে ফিরবেন। তখনই বোধহয় স্যার, ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়াটা এঁদের মাথায় আসে। ইট ইজ এ কমপ্লিকেটেড প্ল্যান। কিন্তু ঠিক মত এগজিকিউট করতে পারলে, দে উইল বি এ মিলিয়ন ডলার্স রিচার! যেটা করতে হবে, সেটা হচ্ছে একটা মার্ডার, তারপর এ সুইচ বিটুইন টু ডেড বডিজ।

 

“ওঁদের পরিচিত ডাক্তার যখন মিস্টার জসনানিকে দেখতে বাড়িতে এলেন, তখন তাঁকে এঁরা মিথ্যে করে পেশেন্টের নাম বলেন শ্যাম মিরচন্দানি। নাউ হাউ উইল দ্য ডক্টর নো! তিনি কোনো রকম সন্দেহ না করে স্যার, শ্যাম মিরচন্দানির নামে ডেথ সাটিফিকেট লিখে চলে গেলেন। তারপর যখন শ্যাম মিরচন্দানি বাড়িতে ফিরলেন, এই দু’ভাই মিলে তাকে হত্যা করলেন। হয় বিষ খাইয়ে, নয় গলা টিপে। ঠিক কী করে সেটা শুধু ওঁরাই জানেন। নাউ দে হ্যাভ মিরচন্দানিস ডেডবডি অ্যান্ড এ ভ্যালিড ডেথ সার্টিফিকেট! দাহ করার সময় ফিউনারেল হোম বা লোকাল অথরিটির সন্দেহ করার কোনো কারণ থাকবে না।

 

“নেক্সট স্টেপ স্যার, মিস্টার জসনানির বডিটাকে পাচার করা, কারণ আদারওয়াইজ দেয়ার উইল বি ওয়ান ডেডবডি টু মেনি! কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে স্যার। দ্বিতীয় ডেড বডিটা যদি খুব তাড়াতাড়ি পুলিশের নজরে আসে, তাহলে একটু ঘোঁট পাকতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি বডিটা আট-দশ দিন পরে খুঁজে পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে কারও কোনো সন্দেহ জাগবে না। ওয়েদার যদি ঠান্ডা থাকত তাহলে এই সময়ের জন্য বডিটা ওঁদের ব্যাক ইয়ার্ডেই লুকিয়ে রাখতে পারতেন। কিন্তু মনে আছে স্যার, ক’দিন হঠাৎ কীরকম আনইউজুয়াল গরম পড়েছিল! তখনই ওঁরা ঠিক করলেন যে, বডিটা ফ্রিজারে রেখে দেবেন।

 

“তার পরের সব খবর আপনি জানেন। বাঙালি ক্লাব হঠাৎ এক ফ্রিজার ভেজিটেবল পেল, পুলিশে খবর গেল জসনানি ব্রিফকেস নিয়ে অদৃশ্য হয়েছেন! শ্যাম মিরচন্দানিকে যোগ্য সমারোহের সঙ্গে দাহ করা হল, যাতে কারও মনে কোনো সন্দেহ না জাগে! তারপর গত শুক্রবার যখন বরফ পড়তে শুরু করল, তখন এঁরা জসনানির বডিটা ফ্রিজার থেকে বের করে হাইওয়ের পাশে নিয়ে গিয়ে ডাম্প করে এলেন। সেই সঙ্গে ফাঁকা ব্রিফকেসটা, যাতে জসনানি যে টাকা চুরি করে পালিয়েছেন, সেই থিওরিটা প্রমাণিত হয়। ওঁরা ভেবেছিলেন যে, জসনানির মৃত্যুটা নিয়ে খুব একটা তদন্ত হবে না, কারণ ইট ইজ নট এ মার্ডার। কী স্যার, আমি ভুল বলছি?” অরুণ আর অশোকের দিকে তাকিয়ে একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

 

“ইউ হ্যাভ নো প্রুফ,” অরুণ মনে হল আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা করছেন। “অল ইউ সেইড ইজ জাস্ট ইয়োর ইমাজিনেশন।”

 

“অন দ্য কনট্রারি স্যার, আই ক্যান গেট অল দ্য প্রুফ আই ওয়ান্ট। আপনাদের ডাক্তারকে মিস্টার জসনানির ফটোটা দেখালেই উনি সাক্ষী দেবেন যে, ওঁর ডেথ সাটিফিকেটই উনি লিখেছিলেন। ইন্সপেক্টর লান্ডি আপনাদের ফ্রিজারটা ফরেন্সিক এক্সপার্টের কাছে নিয়ে যাবেন। বিলিভ মি স্যার। এদেশের ফরেন্সিক সায়েন্স হচ্ছে ট্রলি অ্যামেজিং! কী থেকে যে এরা কী বের করে…।”

 

বাইরে এদিকে ইন্সপেক্টর লান্ডি দরজায় বেল বাজাচ্ছেন ঘরে ঢোকার জন্য।

 

বারো

শ্যামলদার বাড়িতে বসে গল্প হচ্ছিল। শ্যামলদা একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “কখন আপনার সন্দেহ হল একেনবাবু যে, সাহানিরা এর মধ্যে জড়িত?”

 

“যখন স্যার আমি ব্রিফকেসটা দেখলাম, তখনই বুঝলাম, ওঁরাই, সম্ভবত অরুণ সাহানিই টাকাটা সরিয়েছেন। কিন্তু মিস্টার জসনানির অদৃশ্য হওয়া, আর তার প্রায় এক হপ্তা পরে ওঁর বডিটা হঠাৎ ওভাবে হাইওয়ের পাশে পেয়ে যাওয়াটা কুড নট বি এক্সপ্লেইনড়। বিশেষ করে মৃত্যুটা যখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। সো আই ওয়াজ রিয়েলি পাজলড স্যার।”

 

“কখন আপনি বুঝলেন যে, এর মধ্যে কোথাও একটা খুন জড়িয়ে আছে?”

 

“যখন রেস্টুরেন্টে বসে ‘টু টেল দ্য টুথ’ শো-টা দেখছিলাম স্যার। আই ওয়াজ ওয়াচিং দ্য শো। বাট আই হ্যাড নো আইডিয়া স্যার, হু দ্য রাইট পার্সন ওয়াজ! আর ঠিক তখনই আমার চোখ খুলে গেল! আসলে ব্যপারটা খুব সিম্পল স্যার! আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে, শ্যাম মিরচন্দানির ডেথটা ন্যাচারাল। কারণ ডাক্তার সেটাই বলেছেন। হ্যাঁ ডাক্তার একজনকে স্বাভাবিক ভাবে মারা যেতে দেখতে পারেন। কিন্তু কী করে তিনি জানবেন, যে সেই লোকটাই হচ্ছে শ্যাম মিরচন্দানি? যখন এই প্রশ্নটা মাথায় এল, এভরিথিং কুড বি এক্সপ্লেইনড।”

 

“কিন্তু আপনি যে বললেন এরকম একটা কেসের কথা কোথাও পড়েছেন– একটা সিনেমাতেও বোধহয় দেখেছেন।”

 

“নিশ্চয়ই পড়েছি বা দেখেছি স্যার, কিন্তু ঠিক কোথায় সেটাই এখন মনে পড়ছে না। আসলে স্যার লক্ষ লক্ষ বই আর সিনেমারহস্য আর খুনের সবরকম সম্ভবনাই কোথাও না কোথাও কভার হয়ে আছে!”

 

বেন্টুমাসি ফ্লোরিডা থেকে আনা পান চিবোতে চিবোতে শ্যামলদাকে বললেন,

 

“এবার বোঝ, আমার তো কোনো কথাই কানে দিস না। তোকে বলিনি যে, ন্যাচারাল ডেথ-ফেথ নয়, ওটা হচ্ছে পুরো মার্ডার?”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


সূচিপত্র