একেনবাবু ও কেয়াদিদি – সুজন দাশগুপ্ত

শেয়ার করুনঃ

এক

প্রায় দু’সপ্তাহ হল আমি অ্যাপার্টমেন্টে একা। প্রমথ গেস্ট ফ্যাকাল্টি হয়ে পাঁচ মাসের জন্যে বস্টন ইউনিভার্সিটিতে গেছে। একেনবাবু সাধারণত বাইরে যান না। তিনিও হোমল্যান্ড সিকিউরিটির একটা মিটিং অ্যাটেন্ড করতে ওয়াশিংটন ডিসি তে গেছেন। প্রমথর সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয়। একেনবাবু অদৃশ্য হলে যোগাযোগ করা কঠিন। গত বছর প্রায় জোর করে একেনবাবুকে দিয়ে মোবাইল কেনানো হয়েছে। কিন্তু এদেশে মোবাইলে ইনকামিং কল এলেও চার্জ হয় –এই সত্যটা জানামাত্র একেনবাবু ফোন ‘অফ’ করে রাখছেন। নিজে যদি ফোন করেন, তাহলেই কথাবার্তা হতে পারে। সেটা এবার এখনও করেননি। তবে দু’- তারিখে ফেরার কথা, অর্থাৎ এই মঙ্গলবার। একা একা বেশ খারাপই লাগছে। প্রমথর তির্যক মন্তব্য আর একেনবাবুর উলটোপালটা প্রশ্ন আর বকবকানি –দুটোই মিস করছি। খাওয়াদাওয়া আর নিউজ ছাড়া বেশির ভাগ সময় কাটছে কম্পিউটারের সামনে।

 

রবিবার সকালে ঘরে বসে ই-মেল দেখছি। বেরোতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আজ বাজার না করলেই নয়। চা, চিনি, রুটি –কিচ্ছু বাড়িতে নেই। বাজার করতে অবশ্য বেশি দূর যেতে হয় না। নীচে নেমে কয়েক পা হাঁটলেই পাড়ার রকমারি দোকান ‘হ্যাপি শপ’। তার গ্রোসারি সেকশানে মোটামুটি সবকিছুই পাওয়া যায়। দামটা একটু বেশি। মালিক ডেভ ব্রাউন আমার প্রায় বন্ধু হয়ে গেছে। আমার থেকে বয়সে অবশ্য অনেক বড়, কিন্তু দেখা হলেই খুব সম্মান দিয়ে ‘হ্যালো, প্রফেসর ডে’ বলে সম্বোধন করে। যেদিন কলেজে যাবার তাড়া থাকে ওখান থেকেই এক কাপ কফি আর চকলেট ক্রোঁসা তুলে নিয়ে কলেজে চলে যাই। ইদানীং অবশ্য প্রতিদিনই সেটা করছি, প্রমথ আর একেনবাবু না থাকায় শুধু নিজের জন্যে ব্রেকফাস্ট বানাতে ইচ্ছে করে না।

 

হ্যাপি শপে গিয়ে দেখি আজ দোকান ফাঁকা। ডেভ গল্প করতে ভালোবাসে আর খরিদ্দার না থাকলে তো কথাই নেই। বেশ খানিকক্ষণ একথা সেকথার পর জিজ্ঞেস

 

করল, “বাই দ্য ওয়ে, তুমি এজে ডাটকে চেনো?”

 

“না।”

 

“হি ইজ ফ্রম ইওর হোমটাউন!”

 

“কোলকাতা?”

 

“ইয়েস। ওর ওয়াইফের সঙ্গে পরিচয় হল। তোমার পাশের বাড়িতে কয়েকদিন হল এসেছে। আমি তোমাদের তিনজনের কথা বলেছি। এজে এখন কোলকাতায়, ক’দিন বাদেই ফিরবে। ইউ মাস্ট মিট।”

 

ডেভ এরকম মাঝে মাঝেই করে। কোনো ইন্ডিয়ান পাড়ায় এলেই আমার আর প্রমথর অজস্র প্রশংসা করে আর একেনবাবুর স্থান যে হারকিউল (বা এরকুল) পয়রোর পরেই সেটা বোঝায়। ভারি এমব্যারাসিং। এজে নিশ্চয় অজয়। ডাট যে দত্ত সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কোলকাতার লোক হলেই কি আত্মীয়তা করতে হবে। এক্ষেত্রে সহজ উত্তর হল, ‘হোয়াই নট’ বলা। তাই বললাম।

 

চা-চিনি-রুটি কিনতে গিয়ে অনেক কিছুই কিনে ফেললাম। বাজার সেরে যখন টাকা দিয়ে বেরচ্ছি, ডেভ এসে বলল, “বাই দ্য ওয়ে, এজের স্ত্রী কিন্তু ইন্ডিয়ান নয়।” তারপর একটু মুচকি হেসে বলল, “নাদিয়া ইজ ফ্রম রাশিয়া –এ রাশিয়ান ব্রাইড। খুব সুইট মেয়ে।”

 

এই মুচকি হাসার কারণ, রাশিয়ান ব্রাইডের অজস্র বিজ্ঞাপন পত্রপত্রিকায় চোখে পড়ে। ইন্টারনেটেও রাশিয়ান ব্রাইড নিয়ে বহু সাইট রয়েছে। গত রবিবারই নিউ ইয়র্ক টাইমসে বড় করে একটা লেখা বেরিয়েছিল এই নিয়ে। আসলে ডিমান্ড আর সাপ্লাইয়ের ব্যাপার। নিঃসঙ্গ আমেরিকান পুরুষদের সংখ্যা কম নয়। রাশিয়ান সুন্দরী পাওয়ার মোহে অনেকেই বিজ্ঞাপনে সাড়া দেয়। যোগাযোগ শুরু হয় ই-মেল বা টেক্সট পাঠিয়ে। এরপর ফোনে কথা, দেখাসাক্ষাৎ…কপালে থাকলে প্রেম, বিয়ে সবকিছুই ঘটে যেতে পারে। সতর্কবার্তাও ছিল লেখাটাতে। বিশেষ করে যখন অযাচিত ভাবে পুরুষদের কাছে ই-মেল আসে মেয়েদের তরফ থেকে। কলগার্ল ও প্রস্টিট্যুশন র‍্যাকেট এই ভাবেই চলে।

 

দুই 

সোমবার কলেজ যাবার পথে ডেভের দোকানে থেমেছি কফি আর ক্রোঁসার জন্যে, দেখি একটি মেয়ে দুধ কিনছে! ডেভ আমাকে দেখেই বলল, “তুমি একদম ঠিক সময়ে এসেছ।”

 

তারপর মেয়েটিকে বলল, “এই যে নাদিয়া, ইনিই প্রফসর ডে, যাঁর কথা সেদিন বলছিলাম। হি উইল বি এর টু হেল্প ইউ।” তারপর আমায় বলল, “এঁর হাজবেন্ডই এজে।”

 

কী হেল্প করব বোঝার আগেই নাদিয়া বলে মেয়েটি ঘুরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল, “হাই, প্লিজ টু মিট ইউ।”

 

চমৎকার ফিগার। মুখটাও সুন্দর, তবে ওই ফিগারের সঙ্গে পাল্লা দেবার মতো নয়। গলাটা একটু ভারী, অ্যাকসেন্ট সুস্পষ্ট স্লাভিক। হয়তো বেশিদিন এদেশে আসেনি।

 

আমি উত্তর দিলাম, “সেইম হিয়ার।”

 

“আই ব্যাডলি নিড ইওর হেল্প।”

 

“মাই হেল্প!” আমি একটু অবাক হয়েই বললাম।

 

“আপনি একটু আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসবেন? একটা জিনিস দেখাব।”

 

আমি হতভম্ব হয়ে ডেভের দিকে তাকাতে ডেভ বলল, আমি একটু আগেই দেখেছি। ইট ওয়াজ গ্রিক টু মি!”

 

“প্লিজ, দু’-এক মিনিটের বেশি সময় আপনার নষ্ট করব না।” মেয়েটি অনুনয় করল।

 

এরপর আর ‘না’ বলা যায় না।

 

হাঁটতে হাঁটতে নাদিয়া বলল, “আপনাকে এই সময় পেয়ে যাব ভাবিনি, নইলে ওটা সঙ্গে আনতাম।”

 

“আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি না, কীভাবে আপনাকে আমি হেল্প করতে পারি!”

 

“কাল রাতে আমি একটা ই-মেল পেয়েছি। ভেরি আর্জেন্ট লেখা, কিন্তু চিঠিটা ইংরেজিতে নয়। আমি এখানে কাউকেই চিনি না। আজ ভোরে ডেভ যখন দোকান খুলতে আসে তখন ওকে দেখিয়েছি। ও পড়তে না পেরে আপনার কথা বলল।”

 

আজকাল অবশ্য বিভিন্ন ভাষায় ই-মেল লেখা যায়। আমিও মাঝেমধ্যে পাই। সম্ভবত কোনো জাঙ্ক ই-মেল। জিজ্ঞেস করলাম, “ই-মেলটা কার কাছ থেকে এসেছে?”

 

“আমার কোনো ধারণাই নেই।”

 

“আজেবাজে ই-মেল কিন্তু অনেক সময়েই আসে। কে পাঠিয়েছে যদি না জানেন, ডিলিট করে দেবেন। আমি তো তাই করি।”

 

“আমিও তাই করি। কিন্তু ভাষাটা পড়তে পারছি না। যদি দরকারি কিছু হয়!”

 

“আই ডাউট ইট। আমিও মাঝেমধ্যে চাইনিজ বা জাপানিজ স্ক্রিপ্টে উলটোপালটা ই মেল পাই। খুলিও না। সোজা ডিলিট করি। চেনাজানা কেউ যদি আপনাকে খবর পাঠাতে চায়, তাহলে যে ভাষা আপনি জানেন তাতেই পাঠাবে।”

 

“আই হোপ ইউ আর রাইট।” বলে মেয়েটা আর কিছু বলল না।

 

কয়েক মিনিটের পথ। তার বেশির ভাগটাই গেল এলিভেটর অর্থাৎ দেশে যাকে লিফট বলি- তার অপেক্ষায়। পুরোনো লিফট ক্যাঁচকোঁচ করে অনেক আপত্তি জানাতে জানাতে ছ’তলায় উঠল। নাদিয়া দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আমায় বসতে বলে ভেতরে গেল চিঠি আনতে। আমি আর বসলাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘরটার চারদিক দেখলাম। আসবাবপত্র সবগুলোই বেশ পুরোনো। মনে হল অ্যাপার্টমেন্টের সঙ্গেই ছিল। এন্টারটেইনমেন্ট সেন্টারটা শুধু নতুন। একটা বড়সড় প্লাজমা টিভি তার মধ্যিখানে বসানো। সাইডে কতগুলো ইন্ডিয়ান টুকিটাকি জিনিস আর রাশিয়ান ডল। ওপরের তাকের একদিকে নাদিয়া আর তার ছেলে। অন্যদিকে একটা লোকের ছবি। চোখে সানগ্লাস, বোঝা যায় ভারতীয়। নিশ্চয়ই ওর স্বামী এজে ডাট।

 

নাদিয়া এর মধ্যে ওর ল্যাপটপ নিয়ে এসেছে। ই-মেলটা দেখাল। বাংলায় লেখা চিঠি –কোনো সম্বোধন নেই। ই-মেলের হেডিং ইংরেজিতে –‘ভেরি আর্জেন্ট’। নীচে লেখা

 

শেষ সতর্কবার্তা-Nadiya ত্যাগ করা আবশ্যক অথবা মৃত্যু…

 

বাংলাটা আড়ষ্ট এবং অশুদ্ধ –সরকারি নোটিসে অনেক সময় যেমন থাকে। নিঃসন্দেহে কারোর রসিকতা, তবে নট ইন এ গুড টেস্ট। নীচে কোনো নামও নেই।

 

নাদিয়া জিজ্ঞেস করল, “কী লেখা আছে?”

 

বন্ধু হলে মজা করে বলা যেত, মনে হচ্ছে আপনার কোনো প্রেমিকের চিঠি। কিন্তু যার সঙ্গে এই মাত্র পরিচয় হল, তাকে তো আর সেটা বলা যায় না!

 

একটা ব্যাপারে বিরক্তি লাগল, মেয়েটিকে যত সরল ভেবেছিলাম তা নয়। স্বামীর ওপর গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছে! বলেই ফেললাম, “চিঠিটা তো দেখছি আপনার স্বামীর ই-মেল অ্যাড্রেসে-এ পাঠানো হয়েছে!”

 

“হ্যাঁ,” নাদিয়া সপ্রতিভ ভাবেই বলল, “কলকাতায় ওর ই-মেল দেখার সমস্যা হয়। আমিই প্রতিদিন ওর ই-মেল চেক করি –যাতে দরকারি কিছু হলে ওকে জানাতে পারি। কাল রাতে এই ই-মেলটা দেখি। সকালে ডেভকে দেখাতে ও বলল হয়তো বাংলা– আপনি পড়তে পারবেন।”

 

“পড়তে পারছি, তবে এর মাথামুন্ডু নেই। আপনার স্বামী কবে আসছেন?”

 

“ও এখন প্লেনে।”

 

“উনি এলেই এটা ওঁর হাতে দেবেন। অনেক সময় বন্ধুদের মধ্যে চিঠিতে অনেক কিছু লেখা থাকে, শুধু বন্ধুরাই বুঝতে পারে।”

 

“এটা কোনো বন্ধুর চিঠি?”

 

“তাও বলতে পারব না।”

 

“কোনো নাম নেই নীচে?”নাদিয়া জিজ্ঞেস করল।

 

“না। ই-মেল অ্যাড্রেসটা থেকেও বোঝার উপায় নেই। xyz ইত্যাদি নানান অক্ষর দিয়ে @gmail.com খুব সম্ভবত এটা spam…junk mail।”

 

নাদিয়া আমার কথা কতটা বিশ্বাস করল বুঝলাম না। একটু উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “অন্য কিছু পড়তে পারছি না, কিন্তু আমার নামটা পড়তে পারছি। আমার সম্বন্ধে কি কিছু লিখেছে?”

 

“সেটা আমিও দেখলাম, হয়তো একই নাম দিয়ে হাজার হাজার জায়গায় পাঠিয়েছে, আপনার ক্ষেত্রে নামটা মিলে গেছে।”

 

নাদিয়া একটু চুপ করে রইল। “আমি জানি আপনার এখন তাড়া আছে। কিন্তু আপনার কি মনে হয় এতে ভয় পাবার কিছু আছে? আমি এখানে একা আছি ছেলেকে নিয়ে।”

 

“মনে হয় না,” আমি ওকে ভরসা দিলাম।

 

হয়তো আরেকটু পজিটিভলি কথাটা বলা উচিত ছিল। নাদিয়া আর কিছু বলল না।

 

তিন

সকালে পরপর দুটো ক্লাস। সেগুলো পড়িয়ে ফিরে অফিসে বসতে না বসতে যে ফোনটা এল, সেটা আমি মোটেই এক্সপেক্ট করিনি। নাদিয়া। গলার স্বরটা ভাঙা ভাঙা।

 

“আপনার নম্বরটা ডেভের কাছ থেকে পেলাম। আপনার কাজ শেষ হলে ইউ মাস্ট কাম।”

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম,”কী ব্যাপার?”

 

“আই ডোন্ট নো। একজন আমাকে ফোন করে বলল, এজের আসতে দেরি হবে। ও। দুবাইয়ে একটা কাজে আটকা পড়েছে। দু’-একদিনের মধ্যে ফোন করবে। কী কাজ কিছু বলল না, নিজের পরিচয়ও দিল না, লাইনটা হঠাৎ কেটে দিল। আমার মনে হচ্ছে এই চিঠির সঙ্গে ব্যাপারটার কিছু একটা আছে। এছাড়া, এছাড়া…”

 

“এছাড়া কী?”

 

“আপনি আসুন, তারপর আমি বলব। আমি এখানে আর কাউকে কিছু বলতে ভরসা পাচ্ছি না। প্লিজ ডু কাম। ইউ মাস্ট ফিগার আউট দ্য কনটেন্ট অফ দ্য লেটার।”

 

আমাকে কিছু বলার সুযোগ প্রায় না দিয়েই ফোনটা রেখে দিল।

 

হঠাৎ একটা অজানা আশঙ্কা আমাকে গ্রাস করল। এমন কী কথা যে নাদিয়া আর কাউকে কিছু বলতে পারবে না, শুধু আমাকেই বলতে পারবে। শি হার্ডলি নোজ মি! এবার আমার মাথাটা পরিষ্কার হতে শুরু হল, ইজ ইট এ ট্র্যাপ? রাশিয়ান ব্রাইড বস্তুটির যে দুর্নাম আছে –তার ফাঁদে আমি পড়ছি না তো। নাদিয়া চাইছে আমি একা একা ওর কাছে যাই। কী ওর মাথায় ঘুরছে? চিঠিটা কি একটা টোপ ছিল? কিন্তু আমি ধনী নই, একজন সাধারণ প্রফেসর। আমার কাছে ও কী পেতে পারে?

 

দু’-মিনিটও যায়নি, আবার ফোন। আবার কি নাদিয়া! না, বাঁচা গেল! এবার একেনবাবু।

 

“কী খবর, কাল আসছেন তো?” স্বস্তি পেয়ে আমার গলার স্বরে উচ্ছ্বাসটা একটু বেশিই প্রকাশ পেল।

 

“সেকি স্যার, মেসেজ রেখেছি, পাননি?”

 

“না, চেক করিনি।”

 

“আমি তো বাড়ি থেকে বলছি, একটু আগেই এসে পৌঁছেছি।”

 

“ এসে গেছেন! কেমন হল আপনার মিটিং?”।

 

“আই ওপনার স্যার। টেররিস্টরা এখন যা শুরু করেছে না! আপনার নাম-ধাম চুরি করে টেররিজম করে অদৃশ্য হবে। পুলিশ আপনাকে এসে ধরবে, অথচ আপনি সাতে পাঁচে ছিলেন না! ভাবুন অবস্থাটা!”

 

“কী সর্বনাশ! আগে তো আইডেন্টিটি থেফট করে শুধু ক্রেডিট কার্ড- টার্ডগুলো ফ্রড করা হতো!”

 

“এখন সবকিছু অন্য লেভেলে স্যার! সেকথা থাক, আপনার কোনো প্ল্যান নেই তো সন্ধ্যায়? একসঙ্গে খেতে যাব।”

 

“কোনো প্ল্যান নেই, ইন ফ্যাক্ট, আপনি এসে আমাকে বাঁচিয়েছেন।”

 

“কেন স্যার?”

 

“এখানে বোধহয় একটা ভয়াবহ ব্যাপার ঘটতে চলেছে।”

 

“তার মানে?” একেনবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন।

 

“অত সিরিয়াসলি নেবেন না,” বলে সংক্ষেপে নাদিয়া আর চিঠিটার কথা একেনবাবুকে বললাম।

 

“কবে এসেছিল স্যার চিঠিটা?”

 

“গতকাল।”

 

“ কী তারিখ ছিল স্যার গতকাল?”

 

“পয়লা এপ্রিল। ও মাই গড! আপনি মনে করেন এপ্রিল ফুল?”

 

“একটা পসিবিলিটি স্যার।”

 

“আই হোপ সো। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় নাদিয়া ওর ওখানে যেতে বলেছে। আমি বুঝছি কেন?”

 

“ গেলেই জানতে পারবেন স্যার। তা আপনি ওঁর কাছ থেকে ঘুরে আসুন না, আমরা হয় একটু পরেই ডিনার খাব।”

 

“খেপেছেন নাকি! আপনাকে রেখে আমি একলা যাব? আপনিও আসবেন, আমাকে পাহারা দিতে হবে না!”

 

চার

নাদিয়ার অ্যাপার্টমেন্টে আমরা পৌঁছলাম ছ’টা নাগাদ। একেনবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। একেনবাবুর কথা নাদিয়া ডেভের কাছে শুনেছে। মনে হল ওঁকে দেখে ভরসা পেল।

 

আমি বললাম, “একেনবাবুকে আমি ব্যাপারটা মোটামুটি বলেছি। কিন্তু তারপর মনে হচ্ছে আরও কিছু একটা ঘটেছে?”

 

“ইয়েস। আসলে সকালে আপনাকে আগের ফোনের কথাটা বলা হয়নি। একটা ফোন পেয়েছিলাম দু’দিন আগে। কেউ এজেকে খুঁজছিল। দ্যাট সারপ্রাইজড মি।”

 

“সারপ্রাইজড ইউ?” আমি একটু বিস্মিত মুখে তাকালাম।

 

“কারণ এই নম্বরটা আমি কাউকে দিইনি। পরিচিত দু-একজন ছাড়া কেউই এ নম্বরটা জানে না।”

 

“ডেভ আপনার নম্বর জানে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“হ্যাঁ, ডেভকে আমি দিয়েছি। দোকানে ফ্রেশ ব্রেড এলে আমাকে জানাবার জন্যে।”

 

“তাহলে ধরে নিতে পারেন, নিউ ইয়র্কের অর্ধেক লোকই আপনার নম্বর জেনে গেছে।”

 

“ইয়েস, হি ইজ এ ভেরি ফ্রেন্ডলি পার্সন। কিন্তু ফোন যে করেছিল, সে আমার বাড়ির ঠিকানা চাইছিল, কী একটা জানি ডেলিভারি করবে। আমি যখন বললাম আমি কিছু অর্ডার করিনি। বলল এজে করেছে। জানি কথাটা সত্যি নয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনি কে?’ ফোনটা কেটে দিল। আজকে যে লোকটা ফোন করেছিল এজে দেরি করে আসবে বলে –সেও মনে হল ওই একই লোক! আপনার কি মনে হয় এজে ইজ ইন সাম কাইন্ড অফ ট্রাবল?”

 

“দ্যাটস স্ট্রেঞ্জ!” আমি বললাম! “তবে সত্যিই কোনো ক্ষতি করতে চাইলে, এভাবে অ্যানাউন্স করে করবে না। মনে হচ্ছে কেউ ভয় দেখিয়ে মজা পাবার চেষ্টা করছে। আপনার কী মনে হয় একেনবাবু?”

 

একেনবাবু ঘরের চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছিলেন।

 

আমার কথায় সায় দিয়ে বললেন, “আমারও তাই মনে হয় স্যার।”

 

“আপনারও তাই মনে হয়?” একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে নাদিয়া প্রশ্নটা করল।

 

“হ্যাঁ, ম্যাডাম।”

 

“আসলে আমাকে না জানিয়ে এজের প্ল্যান চেঞ্জ করাটা আমাকে অবাক করেছে!”

 

“প্ল্যান চেঞ্জ করেছেন কি না, সেটা তো আপনি জানেন না ম্যাডাম। খবরটা তো ফক্স হতে পারে।”

 

“ইউ থিঙ্ক সো?” বলে একটু চুপ করে থেকে বলল, “আই মিস হিম, প্রায় এক মাস হতে চলল….বিয়ের পর পরই ওকে দেশে চলে যেতে হয়েছে মা ভীষণ অসুস্থ বলে। এনি ওয়ে হি উইল বি হিয়ার ভেরি সুন। তাই না?”

 

“এগজ্যাক্টলি, “আমি বললাম।

 

একেনবাবুর মনে হল ঘরের ইন্সপেকশন শেষ হয়েছে। এন্টারটেইনমেন্ট সেন্টারের ওপর ছবিটাকে দেখিয়ে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার স্বামী ম্যাডাম?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“হি ইজ ভেরি হ্যান্ডসাম।”

 

“ইয়েস হি ইজ,” স্বামীর প্রশংসায় নাদিয়া মনে হল খুশি হয়েছে। “কী দেব আপনাদের? আমার কাছে রাশিয়ান চা আছে।”

 

“নো থ্যাঙ্কস।” আমি বললাম।

 

“আপনিও কিছু খাবেন না?” একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল নাদিয়া।

 

“না ম্যাডাম, আজ না।”

 

“চিঠিটার অর্থ উদ্ধার করতে পারলেন?” প্রশ্নটা এবার আমাকে।

 

“মনে হয় ওটা একটা জোক। তবে যে পাঠিয়েছে সে বাঙালি।”

 

“আমি চিঠির একটা কপি করে রেখেছি। আপনি যদি দেখেন, “ বলে একটা কাগজ একেনবাবুকে দিল।

 

“ভেরি ইন্টারেস্টিং বাংলা স্যার,“ আমার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন।

 

“ইন্টারেস্টিং!” নাদিয়া বিস্মিত হয়ে তাকাল।

 

“মানে ম্যাডাম, আন- ইউয়াল। আপনি কোনো বাঙালিকে চেনেন?”

 

“দ্যা ওনলি বেঙ্গলি পার্সন যাকে আমি চিনি সে হল এজের বন্ধু সুব্রত। আমায় খুব সাহায্য করে। এ বাড়িটা ওই দেখে দিয়েছিল। মাঝে মাঝেই আমার কাছে আসে।”

 

“হয়তো উনিই মজা করে এটা পাঠিয়েছেন ম্যাডাম।” ই-মেলের কপিটা ফেরত দিয়ে একেনবাবু বললেন।

 

“আপনার কি তাই মনে হচ্ছে?” আমাকে জিজ্ঞেস করল নাদিয়া।

 

“অসম্ভব নয়। আপনার স্বামীর বন্ধুকে একবার ফোন করে দেখুন না?”

 

“ই-মেল পেয়েই আমি ওকে ধরার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ওর ফোন সুইচড অফ। একটা মেসেজ রেখেছি। ই-মেলটাও ফরওয়ার্ড করে দিয়েছি। যদি ও মানেটা বুঝতে পারে!”

 

এবার মনে হল ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছি। বললাম, “হয়তো উনিই ই-মেলটা করেছিলেন, সেই জন্যেই উত্তর পাননি।”

 

আমার এই কথায় নাদিয়া মোটেই স্বস্তি পেল না। আবার জিজ্ঞেস করল,”কিন্তু কী রয়েছে ই-মেলটাতে?”

 

“অ্যাবসোলুট ননসেন্স। না বোঝার চেষ্টা করাই ভাল।”

 

“আপনারা আগে থাকতেন কোথায় ম্যাডাম?” একেনবাবুর প্রশ্নগুলো সব সময়েই একটু র‍্যান্ডম –অনেক সময়ই পারস্পর্য থাকে না।

 

“আপস্টেট নিউ ইয়র্কে, উডস্টকের কাছে।” প্রশ্ন শুনে নাদিয়া একটু বিস্মিত হলেও উত্তর দিল। সেই সঙ্গে প্রশ্নও করল,” আপনি ওদিকে কখনও গেছেন?”

 

“না ম্যাডাম।”

 

“আমি গেছি,” আমি বললাম। ভারি সুন্দর জায়গা। সেই ফাঁকা জায়গা থেকে একেবারে এখানে?”

 

“এজের ইচ্ছায়। ও ম্যানহাটান ভালোবাসে। দেশে যাবার পর থেকে তাগাদা দিচ্ছে। ম্যানহাটানে একটা বাড়ি নিতে। বাড়িটা পাবার খবর পেয়ে হি ওয়াজ সো থ্রিলড।”

 

“ইট ইজ এ নাইস নেইবারহুড। এখানে আর কারও সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?”

 

“তেমন করে না।”

 

এর পর দু’-একটা মামুলি কথার পর আমরা বিদায় নিলাম। আমাদের বাড়ির ফোন নম্বরটা নাদিয়া চাইল। যদি দরকার হয়ে ফোন করবে। দিলাম। একেনবাবু আসায় রাশিয়ান ব্রাইডের ভয়টা আমার গেছে।

 

পাঁচ

বাড়িতে ফিরে স্নান-টান সেরে আমরা বেরলাম। কাছেই একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ছিল। আগে কোনো দিন যাইনি, ভাবলাম এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা যাক। একেনবাবু মেনু দেখে খুব সন্তুষ্ট।

 

“চাইনিজরা খুব এফিসিয়েন্ট স্যার, ইন্ডিয়ার রেস্টুরেন্টের থেকে অনেক কম দামে খাবার দিচ্ছে।”

 

“এতে এফিসিয়েন্সির কি আছে? ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্টের খাবারের তো অনেক বেশি দাম। ওদের থেকে কি ইন্ডিয়ানরা বেশি এফিসিয়েন্ট?”

 

“এটা ভালো বলেছেন স্যার। একেবারে মোক্ষম বলেছেন!” তারপর মেনুতে চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন,”আচ্ছা স্যার, নাদিয়া ম্যাডামের এটা কি দ্বিতীয় বিয়ে?”

 

“কেন বলুন তো?”

 

“না ছেলের বয়স তো বছর চারেক মনে হল। আর বিয়ে তো বললেন মাত্র এক মাস। আগে হয়েছে।”

 

“কেন অবিবাহিত অবস্থায় কারও বাচ্চা হতে পারে না?”

 

“তা পারে স্যার, সেটা তো বায়োলজিক্যাল ব্যাপার। আমি সোসাইটির কথা ভাবছি।”

 

“সোসাইটিও পালটাচ্ছে একেনবাবু। অবিবাহিত মেয়েদের বাচ্চা তো হামেশাই হচ্ছে এদেশে।”

 

“তাও তো বটে। আচ্ছা স্যার, টিভির নীচে পাঁচটা ডল লক্ষ্য করলেন? কেমন বড় থেকে ছোট!”

 

“ওগুলো টিপিক্যাল রাশিয়ান ডল –একটার মধ্যে একটা ঢুকে যায়।”

 

“ও হ্যাঁ, মাত্রিওস্কা ডল। “আপনি তো সবই জানেন, অথচ ভাব দেখান কিছুই জানেন না!”

 

“কী যে বলেন স্যার, কত শিখছি আপনাদের কাছ থেকে! আচ্ছা স্যার, কিংস্টন। উডস্টকের থেকে কত দূরে?”।

 

“খুবই কাছে, কেন বলুন তো?”

 

“শুনলাম কিংস্টনে একজন মার্ডারড হয়েছে। লোকটা সম্ভবত ইন্ডিয়ান।”

 

“কার কাছ থেকে শুনলেন?”

 

“ডি. সি থেকে যখন ফিরছিলাম, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট সঙ্গে ছিলেন। উনিই বললেন।”

 

“ও মাই গড, লোকটা কি নাদিয়ার স্বামী এজে ডাট হতে পারে? নাদিয়ারাও তো উডস্টকের কাছে থাকত বলল!”

 

“এখন তো আর থাকেন না স্যার। তাছাড়া এদেশে তো এখন কত ইন্ডিয়ান থাকে।”

 

“তা হোক, আপনি এখুনি খোঁজ নিন লোকটার পরিচয় কিছু উদ্ধার হয়েছে কি না!”

 

আমার বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। একেনবাবুর মোবাইল বেজে উঠল। আমার ধারণা একেনবাবু কলটা এক্সপেক্ট করছিলেন, নইলে অকারণে মোবাইল ‘অন’ রাখার পাত্র উনি নন। ঠিকই ধরেছি, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট।

 

একেনবাবুর দিক থেকে ‘হ্যাঁ স্যার’, ‘ঠিক স্যার’, ‘আপনি শিওর স্যার’, ইত্যাদি ছাড়া আর কিছুই শুনলাম না। ফোন শেষ হবার পর মনে হল একেনবাবুর মুখটা একটু যেন। গম্ভীর।।

 

“কী ব্যাপার, কোনো বাজে খবর?”

 

এর মধ্যে ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেছে।

 

“না, না, আসুন স্যার, খাওয়া যাক।”

 

একেনবাবু যখন কোনো কথার উত্তর দেন না, তখন একশোবার জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ নেই। তাই খেতে শুরু করলাম।

 

একটু বাদে একেনবাবু বললেন, “বুঝলেন স্যার, নামের মিল নামেই শেষ হয়।”

 

“কথাটার মানে কী?”

 

“নাম থেকে লোক চেনা মুশকিল। আমার এক কলিগের বন্ধু নবীন শাহ থাকে ওয়াশিংটন ডি.সি.- তে। নম্বর জানতাম না। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে দেখলাম বারো জন নবীন শাহ!” ।

 

“শেষ পর্যন্ত খোঁজ পেলেন?”

 

“নাহ, সময় পেলাম কই।”

 

“সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু হঠাৎ এই প্রসঙ্গটা এল কেন?”

 

“আসলে স্যার, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বললেন, যে লোকটি খুন হয়েছেন, তাঁর নাম অজয় দত্ত। তবে ইনি নিশ্চয় অন্য কেউ। দেশে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন।”

 

“মাই গড! নাদিয়ার স্বামীর নাম তো এজে ডাট!”

 

“তা ঠিক স্যার, কিন্তু তিনি তো বিয়ে করে গিয়েছিলেন, আর ইনি তো বিয়ে করতে গিয়েছিলেন। বিগ ডিফারেন্স!”

 

“কি বলছেন যা তা! এটা তো জাস্ট টাইমিংয়ের সমস্যা! আর পুলিশ এর মধ্যে এত ডিটেল্স জানলই বা কী করে!”

 

একেনবাবু চুপ করে রইলেন। “আই হোপ এ অন্য কেউ। নাদিয়ার স্বামী হলে আমার অপরাধবোধের সীমা থাকবে না।”

 

“কেন স্যার?”

 

“দেখুন, চিঠিটার নানা অর্থ হতে পারে। বাজে ভাবে এটা ধরলে এজে-র লাইফ কুড হ্যাভ বিন ইন ডেঞ্জার। কিন্তু আমি তো সেটা ওকে জানাইনি!”

 

“ট্রু স্যার, নাদিয়াকে পরিত্যাগ করা আবশ্যক অথবা মৃত্যু’ –সেটাই তো বোঝায়। কিন্তু স্যার পরিত্যাগ করার সুযোগটা তো দিতে হবে। তার আগেই যদি খুন করে ফেলা হয়, তাহলে চিঠিটার কোনো মানে থাকে না।”

 

“ওইটেই বাঁচোয়া। রসিকতার পাল্লাটা ওটাই ভারী করেছে। কিন্তু কে এই অজয় দত্ত? আপনি চেক করে দেখবেন না?”

 

“কেন দেখব না স্যার। খাওয়া-দাওয়ার পরই একবার পুলিশ স্টেশনে যাব। সেরকমই কথা হল স্টুয়ার্ট সাহেবের সঙ্গে।”

 

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের অফিসটা খুব দূরে নয়। আমি উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছিলাম না। প্রায় গোগ্রাসে খেলাম। একেনবাবুর ভ্রূক্ষেপ নেই। “তাড়াতাড়ি করছেন কেন স্যার, আমরা তো আর ট্রেন ধরতে যাচ্ছি না।”

 

“কী মুশকিল, এ যদি সেই অজয় দত্ত হয়!”

 

“হলেই বা আমরা কী করতে পারি স্যার? বসুন, স্যার বসুন, রিল্যাক্স করুন। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যখন এসেছি, ফ্রায়েড আইসক্রিমটা মিস করব না!” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট অফিসে ছিলেন না। কিন্তু ছবিটা দেখানোর ইনস্ট্রাকশন দিয়ে গিয়েছিলেন। ছবিটা দেখে আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। নাদিয়ার অ্যাপার্টমেন্টে যে ছবি দেখেছিলাম তার সঙ্গে এই মৃত লোকটির মুখের মিল একেবারে সুস্পষ্ট। অর্থাৎ শুধু নামেরই মিল নয়! এই ডেডম্যানই নাদিয়ার স্বামী এজে!

 

আমার যে কী খারাপ লাগছিল বোঝাতে পারব না! একেনবাবুকে বললাম, “নাউ আই ফিল টেরিবলি গিল্টি, এজেকে লেখা চিঠিটার অর্থ নাদিয়াকে বলিনি বলে।”

 

“অর্থটা নাদিয়া ম্যাডামকে বললে কি আপনি এটা ঠেকাতে পারতেন স্যার?”

 

“তা হয়তো পারতাম না। কিন্তু চিঠিটার অর্থ জানতে মেয়েটা শুধু একটুখানি সাহায্য চেয়েছিল। জেনেও সে সাহায্যটুকুও আমি করিনি। আই ওয়ান্টেড টু প্লে গড। অর্থটা ওকে বললে মহাভারত কী অশুদ্ধ হত বলুন তো! এই চিঠি এখন পুলিশ পড়বে, অর্থটাও মেয়েটাকে জানাবে। নাদিয়া কী ভাববে –কী ধরনের প্রতিবেশী আমি! ডেভের কী ধারণা হবে আমার সম্পর্কে! এত বড়ো জিনিসটা আমি চেপে রেখে দিয়েছিলাম!”

 

.

 

একেনবাবুর কানে কথাগুলো মনে হয় পৌঁছল না। ফোন বার করে বললেন, “দাঁড়ান। স্যার, স্টুয়ার্ট সাহেবকে খবরটা দিই।”

 

ওদিক থেকে কী কথা হচ্ছে বোঝার উপায় নেই। কথা শেষ হওয়ার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বললেন ক্যাপ্টেন সাহেব?”

 

নাদিয়ার বা এই বিয়ের কথা কিছু জানতেন না। তবে অবাক হলেন না। বাড়ির চাপে কেউ কেউ এখানকার বিয়ের কথা চেপে ইন্ডিয়াতে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে!”

 

“কিন্তু সেটা তো বিগ্যামি, সেকেন্ড বিয়েটা ভ্যালিডও নয়।”

 

“রাইট স্যার। তাও লোকে করে ফেলে, ভাবে দেশের বৌকে এখানে না নিয়ে এলেই হল। এরকম কেস এই নিউ ইয়র্কে সিটিতেই বেশ কয়েকটা হয়েছে।”

 

“নাদিয়াকে তো এটা জানাতে হয়।”

 

“কী জানাতে হয় স্যার –এই বিয়ের ব্যাপারটা?” একটু বিস্মিত হয়েই একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

 

“আরে না, আমি তো পাগল নই। আর কথাটা ঠিক না ভুল সেটাও তো জানি না। আমি ভাবছি এজের মারা যাবার খবরটা। কিন্তু এই দুঃসংবাদটা দেওয়া যায় কী করে!”

 

“স্যার, খবরটা তো আপনি অফিশিয়ালি পাননি। আর যে মারা গেছে তার সঙ্গে নাদিয়ার যে একটা সম্পর্ক আছে –সেটা পুলিশ আগে ভেরিফাই করুক। পুরো ব্যাপারটা শিওর না হলে –পুলিশ কাউকে মৃত্যুসংবাদ দেয় না।”

 

“কিন্তু ফটো ডোন্ট লাই।”

 

“ব্যাপারটা একটু রহস্যজনক ঠিকই। আপনি চান তো ম্যাডাম নাদিয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথাবার্তা বলা যেতে পারে। তবে মৃত্যুসংবাদটা চেপে রেখে –ওটা পুলিশই দিক।”

 

আবার আপনি আমাকে ভগবানের ভূমিকায় ফেলছেন! নাদিয়া যদি জিজ্ঞেস করে এজের কোনো খবর আমি পেয়েছি কি না।”

 

“ওটা আমি হ্যাঁন্ডেল করব স্যার। আপনি বরং চিঠিটার অর্থ ওঁকে বলতে পারেন, তাহলে আপনার গিল্টি ফিলিংটা যাবে।”

 

ঘড়িটা দেখলাম রাত দশটা। এই রাতে যাওয়াটা বোধহয় সঙ্গত হবে না।

 

কাল সকাল সকাল যাব।

 

ছয়

সকালে কলেজে যাবার পথে দেখলাম নাদিয়ার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের লবির দরজা খোলা। আমি একেনবাবুকে বললাম, “নাদিয়ার ফোন নম্বরটা জানি না। ফোন করে যেতে পারলে বোধহয় ভালো হত।”

 

“সেটা ঠিক স্যার। কিন্তু বেশি দেরি করলে আর যাবার দরকার হবে না। তার আগে পুলিশই খবরটা দিয়ে দেবে।”

 

“তাহলে চলুন।”

 

উপরে উঠে বেল বাজালাম। নাদিয়া বাড়িতেই ছিল। দরজা খুলে আমাদের দেখে অবাক। মুখটা দেখেই বোঝা যায় খুব টেন্সড হয়ে আছে।

 

“না বলে হঠাৎ করে চলে এলাম। আর কোনো ডেভেলপমেন্ট হয়েছে কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“না, আমি এখনো এজের কোনো ফোন পাইনি।”

 

এবার একেনবাবু মুখ খুললেন, “বুঝলেন ম্যাডাম, আপনার ওই ই-মেলটা নিয়ে আমরা একটু আলোচনা করলাম। মনে হল বাংলায় আপনাকে কেউ একটা ওয়ার্নিং দেবার চেষ্টা করেছে। তাই ভাবলাম বলে যাই।”

 

“ওয়ার্নিং!”

 

“হ্যাঁ”, এবার আমি বললাম, অশুদ্ধ বাংলায় লেখা– নাদিয়াকে ছাড়ো অথবা মৃত্যু। পয়লা এপ্রিলের এই চিঠিটা আমি ফাজলামি ভেবেছিলাম বলে আর কিছু তখন বলিনি।”

 

“মৃত্যু!” নাদিয়ার মুখ দেখলাম কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বলল, “আমি আজকে আবার বাংলায় ওরকম আরেকটা ই-মেল পেয়েছি।”

 

“আজকে পেয়েছেন ম্যাডাম?”

 

“বোধহয় আগেই এসেছে। এজে-র জাঙ্ক ফোল্ডারে পড়ে ছিল, আজকে সেটা খুলতে চোখে পড়ল। আপনাদের কী মনে হচ্ছে, এজেকে কি কেউ খুন করবার চেষ্টা করছে?”

 

“এটা কেন ভাবছেন ম্যাডাম? কারোর সঙ্গে কি ওঁর কোনো শত্রুতা ছিল?”

 

“ আই ডোন্ট নো, বাট সামথিং ইজ নট রাইট।”

 

“কেন ম্যাডাম?” নাদিয়া সেই অপরিচিত লোকের কাছ থেকে ফোন পাবার কথাটাই আবার বলল। “সেটা তো কালকে বলেছিলেন। এছাড়া আর কারোর কাছ থেকে?”

 

নাদিয়া চুপ করে রইলো।

 

“ম্যাডাম, আপনি যদি কিছু না বলতে চান, ঠিক আছে, আমরা বিরক্ত করব না।”

 

“না, না, না –বলার কিছু নেই। আসলে ব্যাপারটা একটু কমপ্লিকেটেড। আপনারা ভেতরে আসুন, ব্যাপারটা খুলে বলি।”

 

আমরা ঘরে ঢুকে বসার পর নাদিয়া বলল, “এজে আমার সেকেন্ড হাজবেন্ড। আমার প্রথম হাজবেন্ড মারা গেছে প্রায় আট মাস হল।”

 

“আপনার প্রথম স্বামী কি এদেশের লোক ছিলেন?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“ওঁর বয়স তো খুব বেশি হওয়া উচিত নয়, উনি কি অসুস্থ ছিলেন?”

 

“না। ওর স্বাস্থ্য খুবই ভালো ছিল। হঠাৎ বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে অ্যাকসিডেন্টালি ও মারা যায়।”

 

“আই অ্যাম সো সরি ম্যাডাম।”

 

নাদিয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “আই থিঙ্ক ইউ শুড নো দ্য হোল স্টোরি।”

 

লম্বা কাহিনি। বলতে বলতে নাদিয়া বেশ ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছিল। ইংরেজিতেও তেমন দক্ষ নয়। যেটুকু বুঝলাম সেটা হল- নাদিয়া মস্কোর মেয়ে। বন্ধুদের অনেকের মতে নাদিয়াও ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল বরের খোঁজে। সেই সূত্রেই অলিভারের সঙ্গে যোগাযোগ হয় বছর পাঁচেক আগে। অলিভার স্মিথ ছিল অটো-মেকানিক। নাদিয়ার থেকে বেশ কয়েক বছরের বড়ো। অলিভার মস্কোতে নাদিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যায়। সেখানে দু’সপ্তাহ একসঙ্গে থেকে ওরা বিয়ে করবে ঠিক করে। ন্যাডেজডা নিকোলায়েভনা ভোলকোভা হয়ে যায় নাদিয়া স্মিথ। অলিভার ফিরে আসে। তার কিছুদিন বাদে নাদিয়ার ভিসা হয়ে যায়, সে-ও চলে আসে। ওদের একটি বাচ্চা হয়। তারপর হঠাৎ অলিভারের মৃত্যু। ছোটো একটা বাচ্চা, নিজে ইংরেজি ভালো জানে না, বেশ অথই জলে পড়েছিল নাদিয়া।।

 

অলিভারের বন্ধুদের নাদিয়া একেবারেই পছন্দ করত না। ওদের কয়েকজন, বিশেষ করে স্যাম গ্রোভার, অলিভার বেঁচে থাকতেই ওকে উত্যক্ত করত। অলিভার মারা যাবার ক’দিনের মধ্যেই ওকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। নাদিয়া রিফিউজ করে। কিন্তু তাও নাদিয়াকে পাবার আশা ছাড়েনি। এ রিয়েল জার্ক। এই সময় এজে প্রচুর সাহায্য করে। এজে আর এজের বন্ধু সুব্রত এক সময় ওদের প্রতিবেশী ছিল। দু’জনেই খুব সুইট, কিন্তু অলিভারের বন্ধুরা ওদের ঘৃণা করত। এজেকে ওরা একবার এমন থ্রেট করেছিল যে ভয় পেয়ে ওরা কিংস্টনে চলে যায়। কিন্তু যোগাযোগটা ছিল। নাদিয়ার টাকাকড়ি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে দেখে এজে একটা রাশিয়ান ট্রান্সলেশন এজেন্সির সঙ্গে ওর যোগাযোগ করিয়ে দেয়। নাদিয়া সেখানে ট্রান্সলেটরের কাজ করত। মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ বুঝতে অসুবিধা হলে এজের সাহায্য নিত। এই ভাবেই ওদের বন্ধুত্বের শুরু। অলিভারের মৃত্যুর মাস সাতেক বাদে নাদিয়া ওর বাচ্চাকে এক বান্ধবীর কাছে রেখে সুব্রত আর এজের সঙ্গে ক্রস-কান্ট্রি ট্যুরে বেরোয়।

 

নেভাডায় যাবার পর সুব্রতর হঠাৎ একটা কাজ এসে পড়ায় ওকে ক্যালিফোর্নিয়া যেতে হয়। এজে আর নাদিয়া তখন একা। এজে নাদিয়াকে প্রপোজ করে। নাদিয়া রাজি হয়। নেভেড়াতে বিয়ে করাটা সহজ, ওয়েটিং পিরিয়ড নেই। ওখানেই ওরা বিয়ে করে। অলিভারের বন্ধুদের ঝামেলা এড়াতে দু’জনে ঠিক করে ম্যানহাটানে এসে সংসার পাতবে। ফেরার পথে মা মরণাপন্ন খবর পেয়ে এজে দেশে চলে যায়। একসঙ্গে ওদের সংসারও করা হয়নি। প্রথমে এজে গিয়েছিল দু’সপ্তাহের জন্যে, পরে জানায় আরও দু’- সপ্তাহ থাকতে হবে। বিয়ের খবরটা বেশি জানাজানি হওয়ার আগেই নাদিয়া ঠিক করে ম্যানহাটানে চলে আসবে। সুব্রত ওকে সাহায্য করে বাড়ি ঠিক করা, জিনিসপত্র আনার ব্যাপারে। মোটামুটি এটাই ঘটনা।

 

“মিস্টার সুব্রত এখন কোথায় ম্যাডাম –কিংস্টনে?”

 

“না, বেশ কিছুদিন হল ও কুইন্সে মুভ করেছে।”

 

“আপনাদের ওখানকার বাড়িঘরগুলোর কী হল ম্যাডাম?”

 

“আমারটা ভাড়াবাড়ি ছিল।”

 

“আপনার স্বামীরটা নিশ্চয়ই ওখানেই আছে, হঠাৎ করে চলে গেছেন যখন?”

 

“হ্যাঁ ওর জিনিসপত্র সব ওখানেই, আমি আর এর মধ্যে ওখানে যাইনি।”

 

“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। আচ্ছা আপনার ই-মেল দুটোর কপি কি পেতে পারি?”

 

“নিশ্চয়ই। দুটোই আমি কপি করে রেখেছি। নাদিয়া ঘরে গিয়ে ই-মেল দুটো একেনবাবুকে দিল।”

 

“দেখুন, যদি আর কিছু উদ্ধার করতে পারেন এগুলো থেকে।”

 

“দেখব ম্যাডাম। তবে একটা কথা বলি, আপনার স্বামীর খবর যখন পাচ্ছেন না, একবার নিউ ইয়র্ক পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তারা যদি কিছু হদিশ দিতে পারে।”

 

ফেরার পথে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ই-মেলগুলো নিয়ে কী করবেন, যা হবার তো হয়েই গেছে?”

 

“তা ঠিক স্যার।”

 

“তাহলে?”

 

“আসলে স্যার, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।”

 

এটা একেনবাবুর একটা টিপিক্যাল লাইন। কোনো কিছুর উত্তর দিতে না চাইলে হয় চুপ করে থাকেন, নয় এ লাইনটা আওড়ান।

 

বাড়ি ফিরে আমার মনটা খারাপ লাগছিল। একটু বাদেই নাদিয়া জানতে পারবে এজের খবর। পর পর দুই স্বামীর মৃত্যু –প্রথমটা দুর্ঘটনা, দ্বিতীয় জন খুন কী ট্র্যাজেডি! একেনবাবু নিজের ঘরে ঢুকে কী করছেন কে জানে! আমি কোনো কিছুতেই মন দিতে পারছিলাম না। কতগুলো টার্ম পেপার জমে ছিল, গ্রেড করা হয়নি। সেগুলো দেখার চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। তারপর ‘দুত্তোর’ বলে স্নান করতে ঢুকলাম। মাথাটা যদি একটু ঠান্ডা হয়! স্নান সেরে বেরিয়ে দেখি একেনবাবু কফি টেবিলে ঠ্যাঙ- দুটো তুলে চোখ বুজে কী জানি ভাবছেন। কোলের ওপর ই-মেল দুটো।

 

“আপনি যখন স্নান করছিলেন স্যার, তখন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে একটু কথা হল।”

 

“কী কথা –এজের সম্পর্কে?”

 

“হ্যাঁ স্যার। কিংস্টন পুলিশের চিফ টিম হোরে এজের মৃত্যুর ব্যাপারে নিজে ইন্টারেস্ট নিয়েছেন। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আমাদের কথা ওঁকে বলেছেন। আমরা যদি এ ব্যাপারে কিছু খোঁজখবর চাই, তাহলে মিস্টার হোরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি।”

 

“সেটা কি অনধিকার চর্চা হবে না, নাদিয়া তো আমাদের শুধু চিঠির অর্থ জিজ্ঞেস করেছিল। আর তো কিছু করতে বলেনি।”

 

“ট্রু স্যার।”

 

“তাহলে?”

 

“কী জানি স্যার –আসলে মাথার মধ্যে ঘুরছে, হোয়াই ওয়াজ মিস্টার এজে কিলড? এই ই-মেল দুটোর অর্থ কী –কে লিখেছেন এগুলো? জাস্ট রসিকতা, না এর সঙ্গে কি খুনের সত্যিই কোনো যোগাযোগ আছে? এইসব নানান প্রশ্ন।”

 

“সেটা তো বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা তো ম্যানহাটানের ব্যাপার নয় আর কিংস্টনের পুলিশের কর্তা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নন। আপনাকে এতে ওরা নাক গলাতে দেবে কেন? আর যদি দেয়ও, রহস্যের কিনারা করে আপনার লাভটা কী হবে– কানাকড়িও তো পাবেন না!”

 

“কী যে বলেন স্যার, পয়সার কথা আসছে কেন। একজন ফেলো –বেঙ্গলি ডেড একটা দায়িত্ব তো সবারই আছে!”

 

“ঝেড়ে কাশুন না, আপনি কিংস্টন যাবার কথা ভাবছেন?”

 

“আমার ভাবা-ভাবিতে আর কী হবে স্যার, গাড়ি তো আপনার।”

 

“তা তো বুঝলাম, কিন্তু কিংস্টন যেতে আমার তো পেট্রল খরচা হবে। সেটা দেবে কে –আপনি?” বলেই হেসে ফেললাম।

 

“আপনি না স্যার, সত্যি!”

 

সাত

কিংস্টনে আমার দূরসম্পর্কের কাকা থাকেন। ওখানে আইবিএম– এর একটা ল্যাবে দিনুকাকা কাজ করতেন। রিটায়ার করে সেখানেই থেকে যান। কাকিমা মারা গেছেন গত বছর। একমাত্র মেয়ে কেয়া পিএইচডি করে গুগলের একটা রিসার্চ ল্যাবে কাজ করে। সেও বাইরে। দিনুকাকা এখন একেবারে একা। বাড়িটা বিক্রির জন্যে দিয়েছেন। বিক্রি হলে দেশে ফিরে যাবেন –সেটাই প্ল্যান। কাকিমা থাকতে দিনুকাকার ওখানে প্রায়ই যেতাম। এখন আর যাওয়া হয় না। দিনুকাকা মাঝে মাঝে ফোন করে আসতে বলেন, কিন্তু ওই যাচ্ছি, যাব করি।

 

একেনবাবু যখন বললেন উনি কিংস্টনে যাবেন ওখানকার পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে, তখনই মনে হয়েছিল দিনুকাকার কথা। ওখানে গেলে দিনু কাকা খুশি হবেন আর আমাদের কাজটাও হবে। তবে দিনুকাকা কিংস্টনে আছেন না বাইরে কোথাও গেছেন সেটা দেখতে হবে। লাকিলি দিনুকাকাকে পেলাম। ভীষণ এক্সাইটেড আমি আসছি শুনে। কেয়াও বাড়িতে এসেছে কয়েকদিনের জন্যে। ও-ও ফোন ধরে হই হই করে উঠল। দিনুকাকাকে একেনবাবুর কথা বললাম। উনি যে একজন গোয়েন্দা সে খবরটাও দিলাম। ওরে বাবা, নিয়ে আয়, নিয়ে আয়। খুব ভালো লাগবে। ওকে বলিস, কোনো অসুবিধা নেই।

 

.

 

পরের দিন সকালে আমরা দিনুকাকার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। ওঁর বাড়ি আমার বাড়ি থেকে ১০০ মাইলের মতো দূরে। প্রায় পুরোটা পথই হাইওয়ে –শেষের কয়েকটা মাইল বাদে। কিংস্টন শহর পর্যন্ত যেতেও হয় না। লিঙ্কন টানেল বা কোথাও জ্যাম না পেলে দিনুকাকার বাড়ি পৌনে দু’ঘন্টার বেশি লাগার কথা নয়।

 

কিংস্টন আলস্টার কাউন্টিতে। জায়গাটা ভারি সুন্দর। বিশেষ করে দিনুকাকা যেখানে থাকেন পুরো অঞ্চলটাই বিশাল বিশাল অ্যাশ গাছে ভর্তি,ফাঁকে ফাঁকে ছবির মতো বাড়ি। একেনবাবু মুগ্ধ!

 

“নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি এখানে হলে স্যার বেশ হত।”

 

প্রায় এসে পড়েছি। পাড়ার রাস্তার শেষ টানটা নিতে নিতে বললাম, “এখানে ম্যানহাটানের মতো অত রেস্টুরেন্টে পেতেন না, রান্না করে খেতে হত।”

 

“কী আর করা স্যার, পজিটিভ থাকলেই নেগেটিভ থাকে।” দিনুকাকা আর কেয়া সাগ্রহে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল।

 

একেনবাবুকে কেয়া বা দিনুকাকা –কেউই আগে দেখেনি। জলজ্যান্ত গোয়েন্দা দেখে দু’জনেই খুব খুশি। আমরা পেছনের কাভারড প্যাটিওতে বসলাম। কেয়া কফি বানাতে গেল। আমিও ওর সঙ্গে কিচেনে গেলাম। আরও কিছু করার প্ল্যান করছিল। কিন্তু ব্রেকফাস্ট খেয়ে এসেছি বলে কোনোমতে ওকে নিরস্ত করলাম।

 

“ঠিক আছে, কিন্তু লাঞ্চ খেয়ে যাবে।” কেয়া ওর দাবি জানিয়ে রাখল।

 

“তোর হুকুম না মেনে উপায় আছে!”

 

“কত তো বোনের কথা রাখো!”

 

অভিমানী এই বোনটাকে আমার সবসময়েই ভাল লাগে। ওর কাজকর্মের খবর, প্রেম টেম করছে কি না –এইসব নানান রকম বিষয় নিয়ে ঠাট্টা আলোচনা চলল কিছুক্ষণ।

 

কফি নিয়ে এসে দেখি, দিনুকাকা একেনবাবুর সঙ্গে দারুণ গল্প জুড়েছেন। একেনবাবু মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। আসলে কাকিমা থাকার সময় দিনুকাকা এত কথা বলতে পারতেন না। মাঝে মাঝেই কাকিমা বলতেন, একটু চুপ কর তো। ওরা গল্প করতে এসেছে, তোমার কথা শুনতে আসেনি। এখন ওঁকে বাধা দেবার কেউ আর নেই। দিনুকাকার গল্পের এক ফাঁকে একেনবাবু চুপি চুপি চুপি বললেন, “সত্যি স্যার, আপনার কাকার নলেজের তুলনা নেই। ওশন অফ নলেজ!”

 

কথাটা ভুল নয়, দিনুকাকা খবর প্রচুর রাখেন –বিশেষ করে টেকনোলজির খবর। আমরা আসায় গল্পে ছেদ পড়ল। কফিতে চুমুক দিয়ে দিনুকাকা একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা এদিকে আসা হল কেন ডিটেকটিভ মশাইয়ের?”

 

“এসেছি স্যার এক বাঙালি ভদ্রলোক মারা গেছেন, তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর করতে।”

 

“কে অজয় দত্ত?”

 

“আপনি চেনেন স্যার?” একেনবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

 

“এ অঞ্চলে ক’জন বাঙালি আছে? না, সেটা ঠিক কথা নয়। এখন অনেকেই আছে। কিন্তু অজয়কে ভালো করেই চিনতাম। কী স্যাড ব্যাপার বল তো? কয়েক মাস আগেও ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। দ্য পুওর ফেলো।”

 

“তুমি কী করে চিনলে ওকে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“আরে সে এক কাহিনি। আমার অফিসে আই টি গ্রুপে সুব্রত বলে একটি ছেলে কনট্রাক্টর হিসেবে কাজ করত। সুব্রতই নিয়ে এসেছিল একদিন আমাদের বাড়িতে ওর বন্ধুকে। দু’টি একেবারে মানিকজোড়। দেখলে মনে হয় পিঠোপিঠি ভাই। তারপর বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। গত বছর, দীপা তখনও বেঁচে- ওকে নিয়ে একদিন বার্গার হাউসে খেতে গিয়ে দেখি অজয় সেখানে ম্যানেজারের কাজ করছে।”

 

কেয়া একেনবাবুকে বলল, “দীপা আমার মায়ের নাম।”

 

“ও হ্যাঁ, তুমি তো সেটা জান না।”

 

“আমি বুঝেছি স্যার, আপনি বলুন।”

 

“কথায় কথায় অজয়ের কাছ থেকে জানলাম আগে যেখানে কাজ করত সেখানকার চাকরি যায়। তার ওপর সুব্রত আর ও যেখানে থাকত –কী সব ঝামেলার জন্যে সে জায়গাটা ছাড়তে হয়! সুব্রতর আই বি এম- এর কন্ট্রাক্ট তখন শেষ হবার মুখে। ও নিউ ইয়র্ক শহরে একটা কাজ পেয়ে চলে যাচ্ছে। এদিকে অজয়ের চাকরি নেই, থাকার জায়গা নেই –বেশ ঝামেলার মধ্যে গেছে বেচারা। একটা ট্রান্সলেশন এজেন্সির হয়ে কিছু কাজ করত। তবে তাতে আর কতটুকু টাকা। লাকিলি এই বার্গার হাউসের মালিক ওর কলেজের এক বন্ধু। সে নতুন একটা ব্রাঞ্চ খোলায়, ও সেটা ম্যানেজ করার দায়িত্ব পায়। এর পরপরই দীপা অসুস্থ হয়ে পড়ল। অজয়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। দীপাকে হারালাম ৮ই ফেব্রুয়ারি। খবর পেয়ে ফিউনারেলে অজয় এসেছিল। দিন পনেরো আগে একদিন সুব্রত এল –কী একটা কাজ ছিল এদিকে, আমাকে হ্যালো বলে গেল। ওর কাছ থেকেই খবর পেলাম, অজয় ভালোই আছে। তবে মা অসুস্থ বলে দেশে গেছে। একটি বিধবা মেয়েকে বিয়ে করেছে। মেয়েটি রাশিয়ান –এক সময়ে ওদের প্রতিবেশীও ছিল।”

 

“মেয়েটির নাম নিশ্চয়ই নাদিয়া…”

 

“তুই তাকে চিনিস?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি বাপিদা!” কেয়া বলে উঠল।

 

“সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন, গোয়েন্দা একেনবাবুকে কর?”

 

“জিজ্ঞেস করছি। কিন্তু তার আগে আপনাকে বলি,” একেনবাবুকে উদ্দেশ্য করে কেয়া বলল। “আপনার কথা কিন্তু আমি অনেক শুনেছি। বিশেষ করে মুনস্টোন মিস্ট্রির কাহিনি তো সবাই জানে। বাপিদাও তো কয়েকটা বই লিখেছে আপনাকে নিয়ে। সত্যি কী ভাল যে লাগছে!

 

“কী যে বলেন ম্যাডাম!”

 

“ওকে আবার ম্যাডাম বলছ কেন?” দিনুকাকা বললেন।

 

“আচ্ছা স্যার ম্যাডাম বলব না। মিস কেয়াদেবী।”

 

কেয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “আমি দেবি ফেবি নই। আর ‘মিস’ ও নয়। শুধু কেয়া।”

 

“কী মুশকিল!”

 

আমি বললাম, “কেয়া ছেড়ে দে, উনি স্যার বা ম্যাডাম ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন না।”

 

“আপনি বউদিকে কী বলে ডাকেন? ম্যাডাম?” কেয়া প্রশ্ন করল।

 

“কী যে বলেন, উনি তো ফ্যামিলি!”

 

“আর আমি বুঝি আপনার বোন নই?”

 

“এরকম ভাবে বললে তো স্যার, করুণভাবে দিনুকাকার দিকে তাকালেন একেনবাবু। “..আচ্ছা, ঠিক আছে শুধু কেয়া।”

 

আমি কেয়াকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললাম, “একমাত্র তুই-ই পারলি। আমি তো এখনও ‘স্যার’।

 

“তার কারণ তুমি মানুষকে আপন করতে জানো না! থাক ওসব কথা।” তারপর একেনবাবুকে বলল, “তুমি আমার একেনদা, বাবু-টাবু নয়। আর ‘আপনি’ ‘আপনি’ নয়, শুধু তুমি’। বোনকে কেউ ‘আপনি’ ডাকে?”

 

“বেশ,” একেনবাবু হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়লেন।

 

“এবার রহস্যটা বল।”

 

“আসলে ম্যাডা… মানে কেয়া। এই নাদিয়ার সঙ্গে আমার গতকাল দেখা হয়েছে। উনি দুটো ডিস্টার্বিং ই-মেল পেয়েছেন –একই ই-মেল, কিন্তু দু’বার। বক্তব্য হল, নাদিয়াকে ছাড়ো, অথবা মৃত্যু। বাংলাটা আড়ষ্ট। মনে হচ্ছে যে লিখেছে সে বাংলা ভালো জানে না, অথবা ভান করছে না জানার। দুটোই ওঁর স্বামী এজেকে উদ্দেশ্য করে লেখা। তারপর এই মার্ডার।”

 

“ইন্টারেস্টিং। তোমাদের কাছে ই-মেলটা আছে?”

 

“তুইও কি গোয়েন্দাগিরি করবি নাকি!” আমি ঠাট্টা করলাম।

 

“কেন তুমি করতে পারলে আমি পারব না!”

 

“এই তো এখানে।” একেনবাবু পকেট থেকে ই-মেলের একটা কাগজ বার করলেন। কেয়া পড়ে বলল, “বাংলাটা তো মনে হচ্ছে খুব একটা শুদ্ধ নয়।”

 

“তুই এখনও বাংলা পড়তে পারিস?”

 

“বাপিদা! এখনও আমি সময় পেলে রবীন্দ্রনাথ পড়ি।”

 

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। দেখ, কী দেখবি।”

 

“বাংলায় কিছু লিখেছে বলেই যে বাংলা জানতে হবে তার কোনো মানে নেই, বলতে বলতে কেয়া আই- ফোনটা বার করল। তারপর কোত্থেকে একটা বাংলা অ্যাপস ডাউনলোড করে লিখল ‘শেষ সতর্কবার্তা’Nadiya ত্যাগ করা আবশ্যক অথবা মৃত্যু। তারপর একটু খুটখুট করে বলল, “গুগল ট্রান্সলেটর’ ব্যবহার করলে এই বাংলাটার ইংরেজি হয় Last warning-Nadiya must leave or Death।

 

“গুগল ট্র্যান্সলেটর কি?”একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

 

আমি ট্র্যান্সলেটর সফটওয়্যার কী সেটা বললাম। “কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে অনুবাদ করা। ওদের গুগল কোম্পানি একটা অনুবাদের সফটওয়্যার করেছে সেই সাইটে ঢুকে আপনি ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় কিছু লিখে, আরেকটা ভাষায় তার অনুবাদ করে ফেলতে পারেন।”

 

“অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং। আগেও এটা শুনেছি। এখন চোখের সামনে দেখছি! কিন্তু যেমন বাংলা, তেমনই তো দেখছি ইংরেজি। দুটোই অশুদ্ধ।”

 

“মনে হচ্ছে যে লিখেছে, সে কোনোটাই জানে না।” আমি বললাম।

 

কেয়া একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “সেটা একটা সম্ভাবনা।”

 

“আচ্ছা এরকম ধরণের আর কোনো সফটওয়্যার কি বাজারে আছে?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

 

“হ্যাঁ, আরও দু’-একটা আছে, তবে তাতে বাংলা আছে কি না জানি না।” আর কিছু না বলে কেয়া বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

 

.

 

একেনবাবু দিনুকাকার দিকে তাকিয়ে বললেন,”আপনার মেয়ে একজন জিনিয়াস স্যার! কী রকম চট করে বলে দিলেন, যে ই-মেল লিখেছে তার বাংলা না জানলেও চলবে!”

 

দিনুকাকুর মুখে কন্যাগর্বে একটা আত্মপ্রসাদের হাসি। “মেয়েটার মাথা বরাবরই খুব সাফ। শুধু বিয়েতেই আপত্তি!”

 

আমি বললাম, “আচ্ছা দিনুকাকা, তুমি আর মা কি এক স্কুলে পড়েছ, দু’জনের মুখেই খালি এক কথা –বিয়ে বিয়ে।”

 

“শুনছ একেন,” দিনুকাকা একেনবাবুকে সাক্ষী মানলেন, “ছেলেপুলেরা বিয়ে না করলে বাপ-মায়ের চিন্তা হয় না!”

 

“তা তো বটেই,স্যার।”

 

“দেখ তো কোনো ভালো যদি কাউকে পাও। শুধু রিসার্চ নিয়ে পড়ে থাকলে তো হবে! বাপিকে বলে তো কোনো লাভ নেই। ওকে কে দেখে তারই ঠিক নেই।”

 

আমার বিরক্তি লাগতে শুরু করেছে –এর থেকে টেকনোলজির জ্ঞান শোনা ভাল। তবে বেশিক্ষণ এটা চলল না। কেয়া এক গাল হাসি নিয়ে ফিরল।

 

“যা ভেবেছিলাম তাই, বাংলা ট্রান্সলেশনটা পুরোনো কোনো একটা ভার্সন থেকে করা। ফিলকে ফোন করতেই, ও চেক করে বলে দিল।”

 

দিনুকাকা জিজ্ঞেস করলেন,”ফিল কে রে, তোর বন্ধু?” দিনুকাকার ইন্টারেস্ট অন্যদিকে।

 

“না। জাস্ট এ কলিগ বাবা –তার বেশি কিছু ভাবতে যেও না।” বিরক্ত হয়ে কেয়া বলল।

 

আমি বললাম, “কী বলতে চাচ্ছিলি বল?”

 

“হ্যাঁ, যেটা জানলাম, সেটা হল বছরদুই আগের একটা ভার্সনে এই বাংলাটাকে ইংরেজি করলে হতো,Last warning– must leave Nadiya or Death।

 

“সেটাকে এখন বাংলায় ট্রানস্লেট করলে কি হত?”

 

কেয়া আবার আই-ফোনে গিয়ে ট্রানস্লেট করল।

 

“এখন হবে –’শেষবার বলছি Nadiya ত্যাগ করতে হবে বা মৃত্যু’।”

 

“ভাস্ট ইমপ্রুভমেন্ট।”

 

“ভেরি ইন্টারেস্টিং!”একেনবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন।

 

কেয়া বলল, “আসলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো শব্দগুচ্ছ ম্যাচ করে অনুবাদগুলো করা হয়। সুতরাং সময়ের সঙ্গে এগুলো পালটাতে থাকে।”

 

“সত্যি স্যার।” আমার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন। “বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু আমরা জানি! ভাগ্যিস ম্যাডাম, মানে আমাদের কেয়াদিদি ছিল।”

 

“তাহলে একেনদা, আমিও এখন থেকে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট তো?”

 

“আরে কী আশ্চর্য, অ্যাসিস্ট্যান্ট কেন? আমরা সবাই রাজা।” কিছুক্ষণ এরকম হাসিঠাট্টা চলার পর একেনবাবু দিনুকাকাকে জিজ্ঞেস করলেন,”আচ্ছা স্যার, আপনি কি এখানকার পুলিশ চিফ, টিম হোরেকে চেনেন?”

 

“হ্যাঁ, আমরা দুজনেই চিনি,” বলে দিনুকাকা কেয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।

 

কেয়া বলল, “টিম হোরে হচ্ছে, তিমির হোড়। আমার ছেলেবেলার বন্ধু। স্কুলে সবাই খ্যাপাত বলে হোড়টা হোরে করেছে। টিমির থেকে টিম হয়েছে।”

 

আমি বললাম,”তুই যখন এত চিনিস, আমাদের নিয়ে চল না।”

 

“বেশ চলো, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, আমার একটা কনফারেন্স কল আছে।”

 

“বাড়িতে এসেও অফিসের কাজ করছিস?”

 

“বেড়াতে তো আসিনি, টেলিকমিউট করছি। বাবা এত একা হয়ে গেছে, মাঝে মাঝেই আসি। কয়েকদিন থাকি, টেলিকমিউট করি বলে ছুটি নিতে হয় না।”

 

আট

টিম হোরে বা তিমির হোড় কেয়াকে দেখেই হইহই করে উঠল। মিডল স্কুল থেকে বন্ধু। কেয়া এদেশে এসেছে তেরো বছর বয়সে, কিন্তু তিমিরের জন্ম এদেশেই।

 

কেয়া বাংলাতেই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল।

 

চমৎকার বাংলা বলে তিমির। সেটা বলাতে বলল,”না বলে উপায় আছে। বাবা-মা কেউই বাড়িতে ইংরেজিতে কথা বললে উত্তর দিত না। বাড়িতে সবসময়ই বাংলা আর রবীন্দ্রসঙ্গীত। ইংরেজি অক্ষর চেনার আগে বাংলা অ-আ-ক- খ চিনেছি।”

 

“অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং। দেশে এখন তার উলটো!”একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন।

 

আমি তিমিরকে বললাম,”আপনি কিন্তু একেনবাবুর ‘স্যার’-টা ইগনোর করবেন,ওটা বারণ করেও থামাতে পারবেন না।”

 

তিমির কথাটা শুনে হেসে ফেলল। তারপর একেনবাবুকে বলল, “আপনার প্রশংসা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছে এত শুনেছি, যখন শুনলাম আপনি আসছেন- আই ওয়াজ সো এক্সাইটেড। সত্যি, ইট ইজ এ প্রিভিলেজ টু মিট ইউ।”

 

“কী যে বলেন স্যার, “ একেনবাবু লজ্জা পেলেন।

 

“আপনি জানেন কি না জানি না, আপনার মুনস্টোন মিস্ট্রি’র কেসটা এখন নিউ ইয়র্কের পুলিশ অ্যাকাডেমিতে পড়ানো হয়।”

 

“তাই নাকি!” আমি অবাক হয়ে বললাম। একেনবাবুর লজ্জা লজ্জা মুখ দেখে বুঝলাম উনি বোধহয় সেটা জানেন।

 

“আমিও ওই কেস-হিস্ট্রিটা পড়েছি। ব্রিলিয়ান্ট অ্যানালিসিস আর সাবসিকোয়েন্ট ডিডাকশন।”

 

“আমার একার কৃতিত্ব নয় স্যার, বাপিবাবু আর প্রমথবাবুও ছিলেন আমার সঙ্গে।”

 

“মাই গুডনেস, সেটা তো আমি জানতাম না। আর কেয়া, তুমি যে এই বিখ্যাত ব্যক্তিদের চেনো এতদিন আমাকে বলনি কেন!”

 

“আমার কতগুলো সিক্রেটের মধ্যে এটা একটা।”কেয়ার মুখে দুষ্টু হাসি। “এবার আসল কথায় আসি স্যার, আমরা এসেছি অজয় দত্তের মার্ডারের ব্যাপারে কিছু জানতে।”

 

তিমির গম্ভীরভাবে বললেন, “অফিশিয়ালি, নো কমেন্ট। কিন্তু আপনারা এসেছেন স্টুয়ার্ট সাহেবের কাছ থেকে, তার থেকেও বড় কথা কেয়া নিয়ে এসেছে, সুতরাং কিছু তো বলতেই হবে…তবে সব কিছুই বলব আন- অফিশিয়ালি।”

 

“ঠিক আছে স্যার, আমরাও আন- অফিশিয়ালি আপনাকে সাহায্য করব।”

 

“বেশ, এবার বলুন কী জানতে চান।”

 

“অজয়বাবু কখন কোথায় এবং কীভাবে খুন হন? এছাড়া আর যা মনে হয় আমাদের কাজে লাগতে পারে –সেগুলোও স্যার বলুন।”

 

“খুন হয়েছিলেন নিজের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। রোববার সম্ভবত রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ। বডিটা পুলিশের চোখে পড়েছিল রাত দেড়টাতে রাউন্ড দিতে গিয়ে। একেবারে সামনে থেকে কেউ গুলি করেছিল। হি ওয়াজ ডেড অন দ্য স্পট।

 

এছাড়া দেখি আর কী কী ইনফরমেশন আপনার কাজে লাগতে পারে…। হ্যাঁ, অজয় দত্ত ‘বার্গার হাউস’ বলে একটা ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টে ম্যানেজার ছিলেন। মায়ের অসুখ বলে দেশে গিয়েছিলেন। কিছুদিন বাদে ছুটি এক্সটেন্ড করিয়েছিলেন বিয়ে করবেন বলে। যেদিন মারা যান সেদিনই দুপুরবেলা ফিরেছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা দোকানে। এগুলো সব কনফার্মড দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে। দোকান বন্ধ হয়েছিল রাত সাড়ে এগারোটায়। দোকান বন্ধ করে বেরোতে বেরোতে প্রায় রাত বারোটা হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে নিজের গাড়ি ছিল না। দোকানের যে ছেলেটি ওকে রাইড দিয়েছিল, তার বাড়ি ছিল দোকান থেকে মাইল দশেক দূরে একটা মোড়ের মাথায়। সেখান থেকে অজয় দত্তের বাড়ি হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক। অজয় দত্তকে যে খুন করে সে মনে হয় জানত ওই সময় অজয় দত্ত আসবেন। দরজার কাছে আসতেই দুটো গুলি।”

 

“অ্যাপার্টমেন্টের আর কেউ সেটা টের পায়নি।”

 

“ যে ছেলেটি রাইড দিয়েছিল….”

 

“সে ক্লিয়ার। তার কোনো মোটিভ নেই। অপরচুনিটিও ছিল না। ছেলেটার বাড়িটা তো বলেছি একেবারে মোড়ের ওপরে। ওর মা জেগেছিলেন। বারোটা পঁচিশেই সে ঘরে ঢুকেছে।”

 

“বুঝলাম স্যার।”

 

“তবে দুটো জিনিস আমাকে ভাবাচ্ছে।”

 

“সেগুলো কী স্যার?”

 

“এক নম্বর, রবিবার অজয় দত্ত দেশ থেকে ফিরেই আমাকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বলল, কী একটা ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চান। সে ব্যাপারটা কী, আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু মনে হয় ব্যাপারটা ইম্পট্যান্ট, নইলে দেশ থেকে ফিরেই যোগাযোগ করতে চাইবেন কেন? দু’নম্বর হল, অজয় দত্ত দোকানের মালিককে বিয়ে করার নাম করে ছুটি বাড়ালেও উনি নাকি একটি রাশিয়ান বিধবা মেয়েকে বিয়ে করে দেশে গিয়েছিলেন। খবরটা ঠিক, নেভাডাতে কাল রাত্রেই খোঁজ নিয়ে জেনেছি। প্রশ্ন হল, এ দুটোর মধ্যে কোনো কানেকশন আছে কি না!”

 

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার।”

 

“যাই হোক, সেই রাশিয়ান মহিলাকে আমরা আজ সকালে কনট্যাক্ট করেছি। শি ইজ শ। মনে হল এমন কিছু একটা শঙ্কা করছিলেন।

 

“ওঁর নাম নাদিয়া,” আমি বললাম।

 

“আপনারা তাঁকে চেনেন?” টিম জিজ্ঞেস করল।

 

“আমাদের নেইবার।”

 

“উনি নাকি দুটো থ্রেটনিং ই-মেল পেয়েছিলেন। তার কপিও আমরা সকালে পেয়েছি। কে ওটা পাঠিয়েছে ওঁর কোনো ধারণাই নেই। একটা নাম আমরা পেয়েছি যে ওঁকে বহুবার বিয়ে করতে চেয়েছিল। লোকটা এখানকার একটা মোটরবাইক গ্যাং- এর মেম্বার। গ্যাংটা রেসিস্ট। একটা সাদা মেয়ে ওকে বিয়ে না করে একটা বাদামি চামড়াকে বিয়ে করেছে, তার পক্ষে এ ধরনের বার্তা পাঠানো অসম্ভব নয়!”

 

“কোথায় থাকেন স্যার এই লোকটি?”

 

“দলের সবাই উডস্টকের কাছাকাছি থাকে। ইন ফ্যাক্ট, নাদিয়ার আগের স্বামীও ওই রেসিস্ট গ্যাং- এর মেম্বার ছিল। এখন আমাকে বার করতে হবে, এই লোকটার কোনো অ্যালিবাই আছে কি না।”

 

“একটা কথা স্যার, ম্যাডাম নাদিয়ার প্রথম স্বামী মারা যান কীভাবে?”

 

“সেও আরেকটা ব্যাপার। পয়েজনাস মাশরুম খেয়ে। ওঁর স্বামী যার নাম ছিল অলিভার, সে এমনিতে ছিল অটো-মেকানিক। কিন্তু সময় পেলেই জঙ্গলে জঙ্গলে গিয়ে মাশরুম সংগ্রহ করত। এদিক ওদিক কয়েকটা রেস্টুরেন্টে বিক্রিও নাকি করত। হয়ত বাছতে ভুল করেছিল। কিন্তু আমার মনে একটা সন্দেহ আছে।”

 

“কেন স্যার?”

 

“হয়ত জেনেশুনেই বিষাক্ত মাশরুম খেয়েছিল। কারণ ‘ডেস্ট্রয়িং এঞ্জেল’ মাশরুমকে চিনতে না পারা, যারা মাশরুম সংগ্রহ করে, তাদের পক্ষে অস্বাভাবিক। সুতরাং ডেথটা হয়তো অ্যাকসিডেন্ট নয়, সম্ভবত সুইসাইড।”

 

“খুন বলে মনে হয়নি স্যার আপনাদের?”

 

“ওই কেসটাতে আমি ছিলাম না। ধরে নিচ্ছি, সেটা সন্দেহ করার বিশেষ কোনো কারণ পাওয়া যায়নি। তবে এও বলি –আগে যিনি চিফ ছিলেন, তিনি ওই দলটাকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। সব ক’টা মরলেই বোধহয় খুশি হতেন….জাস্ট কিডিং!”

 

“বুঝলাম স্যার। আর একটা প্রশ্ন স্যার, অ্যাকসিডেন্ট না হয়ে সুইসাইড হলে তো ইন্সিওরেন্স কোম্পানির সুবিধা –তাই না?”

 

“এক্ষেত্রে নয়। অলিভার লাইফ ইন্সিওরেন্স করেছিল মারা যাবার বছর পাঁচেক আগে। সুতরাং সুইসাইড ক্লজটা অ্যাপ্লিকেব্ল হবে না।”

 

“তাহলে তো চুকেই গেল স্যার। আচ্ছা স্যার, আরও একটা কথা, অজয় দত্ত ওঁর স্ত্রীর কাছে ম্যানহাটানে না গিয়ে এখানে এলেন কেন?”

 

“সেটাই আমার কাছে রহস্য। তবে এরকম দু’-একটা কেস আমি দেখেছি। এখানে বিয়ে করে দেশে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আবার বিয়ে করা। হয় বাবা-মা’র চাপে পড়ে বা মেয়ের বাড়ি থেকে অনেক টাকা-কড়ি পাওয়ার লোভে। তারপর এখানকার পাট চুকিয়ে দেশে ভ্যানিশ হওয়া। আবার অন্যটাও হয়।”

 

“স্কাউন্ড্রেল!” কেয়া ভীষণ রেগে বলল।

 

“আই এগ্রি।”

 

“অজয়বাবুর একজন বন্ধু ছিলেন সুব্রত বলে, তিনি হয়তো স্যার এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন।”

 

“তার খবর আমরা পেয়েছি, উনি এখন নিউ ইয়র্কে একটা কোম্পানিতে কাজ করছেন। আজ সকালেই ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। উনিও খবরটা শুনে ভীষণ আপসেট। নাদিয়া আর এজের সঙ্গে উনিও নেভোডাতে গিয়েছিলেন। নাদিয়ার প্রথম স্বামী অলিভার ও তাদের বন্ধুদেরও উনি হাড়ে হাড়ে চেনেন। ওদের ভয়েই উনি আর এজে উডস্টক ছেড়ে কিংস্টনের দিকে চলে আসেন। ওদের তল্লাটে কেন বাদামি চামড়া ঢুকেছিল –তাতেই ওদের রাগ! রাত্রে বাড়ির সামনে এসে বিয়ারের বোতল ভেঙে রাখত, টেলিফোনে গালিগালাজ করত, অশ্রাব্য কুশ্রাব্য গালিগালাজ দিয়ে ই-মেল পাঠাত! পুলিশে জানিয়ে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। যেদিন ওদের বাড়ির সামনে একটা পেট্রলের ক্যান জ্বালাল, সেদিনই ভয় পেয়ে ওরা দু’জন ঠিক করেন বাড়ি ছাড়বেন। এখন বুঝতে পারছেন, কেন আগের চিফ ওদের এত অপছন্দ করত।”

 

“এরকম এখনও এদেশে হয় স্যার?”

 

“নিশ্চয়ই কোনো কোনো জায়গায় হয়। আমি ভাবিনি এদিকে হতে পারে বলে। কল্পনা করতে পারেন, ছয়ের দশকে এটা ছিল হিপিদের স্বর্গ! বাবা- মায়ের কাছে শুনেছি জোন বায়াজ, জ্যানিস জপলিন, জিমি হেন্ড্রিক্স- এঁরা সব এখানে গান গেয়ে গেছেন! যাই হোক, এগুলো কয়েক বছর আগের ব্যাপার। এখন এই গ্যাং একেবারেই ঠান্ডা।”

 

“সুব্রতবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভালো হত।”

 

“সুব্রত কাল নাদিয়াকে নিয়ে এখানে এজের ফিউনারেল অ্যারেঞ্জ করতে আসবেন। আজকেই চলে আসতেন, কিন্তু ওঁর গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। মনে হল ভীষণ ফ্রাস্ট্রেটেড দুদিন আগে ডিলারকে দিয়ে গাড়ি সার্ভিস করিয়েছেন, দু’দিনের মধ্যে গাড়ি অচল! আবার পাঠাতে হয়েছে ডিলারের কাছে।”

 

“কী গাড়ি ওঁর?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“আমিও একই প্রশ্ন করেছিলাম। গাড়িটা তো খারাপ না –হন্ডা অ্যাকর্ড। খারাপ হচ্ছে ডিলারের সার্ভিস!”

 

“কবে ফিউনারেল হচ্ছে স্যার?”

 

“আমার কোনো ধারণাই নেই। ধরে নিচ্ছি দু’-এক দিনের মধ্যে। ইন্ডিয়ার কনস্যুলেটেও যোগাযোগ করেছি।”

 

আর বিশেষ কিছু জানার ছিল না। তিমিরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, আমরা কেয়াকে বাড়িতে নামিয়ে দিলাম। ওর ফোন কলের সময় হয়ে গেছে। তবে ও নামার আগে বার্গার হাউসের ডিরেকশনটা নিয়ে নিলাম।

 

নয়

বার্গার হাউসের মালিক দিলীপ শৰ্মা নিজেই এখন দোকানটাকে ম্যানেজ করছেন। ভেতরে অফিস ঘরে বসেছিলেন। দেখেই বুঝলাম খুবই স্ট্রেসের মধ্যে আছেন। একেনবাবুর পরিচয় দিতেই উনি চিনতে পারলেন। এখন ইস্ট কোস্টে একেনবাবুর নাম অনেকেই শুনেছেন। বললাম, “আমরা পুলিশ চিফ টিম হোড়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। একেনবাবু প্রাইভেটলি এই ব্যাপারটা একটু অনুসন্ধান করবেন।”

 

দিলীপ শৰ্মা বললেন,”আমি ব্যাপারটা সম্পর্কে অল্পই জানি। যা জানি সবই পুলিশকে জানিয়েছি। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন, এরকম একটা ভালো লোককে কে এভাবে খুন করল!”

 

“জানি স্যার,”এবার একেনবাবু বললেন। “সেটাই আমাদের বের করতে হবে। আপনি শুধু আমাকে বলুন, অজয়বাবু কি দেশে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন?”

 

“না, গিয়েছিল মায়ের অসুখের খবর শুনে। দু’সপ্তাহের জন্যে গিয়েছিল, কিন্তু দশ দিনের মাথায় ফোন করে আরও দু’সপ্তাহের ছুটি নিল। বলল, মা চাপ দিচ্ছে বিয়ে করে যাবার জন্যে। এরপর দু’-একটা ই-মেল পেয়েছি, ফোন পাইনি। মা’র মৃত্যুর খবরটা ই মেলেই পেয়েছি।”

 

“বিয়ের খবর?”

 

“না, সেটা পাইনি। ধরে নিচ্ছি হয়েছে, মাতৃশোকে হয়তো আমাকে আর জানায়নি। আর এসে তো আমার সঙ্গে ঠিকমতো দেখাও হয়নি, যেদিন এল সেদিনই মারা গেল!”

 

“ওঁর সঙ্গে কারও কোনো সমস্যার কথা জানতেন কি?”

 

“না, সেরকম তো কিছু শুনিনি। আগে যেখানে থাকত সেখানে কিছু ঝামেলা হয়েছিল।”

 

“কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত দেখেননি স্যার?”

 

“চাকরি চলে যাওয়ায় চিন্তিত ছিল টাকাকড়ি নিয়ে। তারপর তো এখানে চাকরি নিল। হইহই করে বন্ধুদের সঙ্গে তো গাড়ি নিয়ে ক্রস কান্ট্রি করতে গেল। তবে বন্ধুদের সঙ্গে মনে হয় এবার একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল।”

 

“কীরকম স্যার?”

 

“সেটা বলেনি। আমার চেনাজানা ট্রাভেল এজেন্টকে দিয়ে যখন ওর টিকিটটা বুক করছিলাম, তখনই যেটুকু কথা হয়েছিল। একটু গুম হয়েই ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম মাকে নিয়ে দুর্ভাবনা করছে। পরে হঠাৎ বলল, ‘দিলীপ, মানুষকে চেনা খুব কঠিন ব্যাপার।’ বুঝলাম অন্য কিছু, কিন্তু মায়ের অসুখ– দেশে যাচ্ছে, আমিও আর ও নিয়ে পীড়াপীড়ি করিনি।”

 

“দেশ থেকে ফিরে আসার পর আপনার সঙ্গে কথা হয়নি?”

 

“ও দোকানে আসতে না আসতেই আমাকে একটা কাজে বেরিয়ে যেতে হয়। কথা হবার মধ্যে ও বলেছিল, সোমবার ওর আসতে দেরি হবে। ওর ড্রাইভার লাইসেন্সটা খুঁজে পাচ্ছে না, সেটা করিয়ে একজনের সঙ্গে দেখা করে তারপর আসবে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওর রাইড লাগবে কি না। বলেছিল, না। আর কোনো কথা হয়নি।”

 

“কার সঙ্গে দেখা করবেন, কিছু বলেছিলেন স্যার?”

 

“না, আমি জিজ্ঞেসও করিনি… তাড়াহুড়ো করে বেরোচ্ছি তখন।”

 

“উনি যে বেড়াতে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন –সেটা নিয়ে আপনাকে কিছু বলেননি?”

 

“তাই নাকি, এটা তো জানতাম না! তাহলে কি সেটা নিয়েই চিন্তা করছিল? স্ত্রীকে নিয়ে কোনো সমস্যা?”

 

“আপনার সঙ্গে স্যার সুব্রতবাবুর দেখা হয় না?”

 

“অনেকদিন হয়নি। এখন তো আর এখানে থাকে না। মধ্যে মাঝে মাঝে কথা হয়েছে ফোনে। অজয় পয়লা আসছে শুনে বলল এসে একবার দেখা করে যাবে। অজয়ের ইনকাম ট্যাক্সের কাজগুলো সুব্রতই বরাবর করে দেয়। ১৫ তারিখে তো সেটা করার লাস্ট ডেট।”

 

দিলীপ শর্মার দোকান থেকে আমরা দিনুকাকার বাড়িতে ফিরে এলাম। লাঞ্চ না খেয়ে গেলে কেয়া আমাদেরই খুন করবে। ঘরে ঢুকে দেখি দিনুকাকা এক সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন। আমাদের দেখা মাত্র বললেন, “এসো এসো তোমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এ হল আমার বহুদিনের বন্ধু জ্যাক মিশকা। জ্যাক বোধহয় কিংস্টনের সবার লাইফ ইন্সিওরেন্স করেছে।”

 

“কাম অন ডিনু!” জ্যাক থামিয়ে দিল।

 

“এ হচ্ছে আমার ভাইপো। নিউ ইয়র্ক ইউনিভারসিটির একজন বিরাট অধ্যাপক। আর ইনি হলেন বিখ্যাত ডিটেকটিভ মিস্টার একেন্দ্র সেন।”

 

বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা দিনুকাকার স্বভাব।

 

“প্লিজড টু মিট ইউ।” জ্যাক উঠে এসে আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “আপনারা গল্প করুন, আমার কাজ শেষ। ডিনু তাহলে ওই কথাই রইল। আমার মনে হয় না এতে অসুবিধা হবে বলে। চলি।”

 

“ও হ্যাঁ, একটা ভালো কথা। ওরা এসেছিল, তাই মনে পড়ে গেল,… এজের খবর জানো তো?”

 

“এভরিবডি নোজ। হোয়াট এ ট্র্যাজেডি।”

 

“এজেও তোমার ক্লায়েন্ট ছিল নাকি?”

 

“ইয়েস। ও, ওর বন্ধু সুব্রত –দু’জনের লাইফ ইন্সিওরেন্সই আমি করেছি। অ্যামাউন্টটা খুবই অল্প। কালকেই খবরটা শুনে দেখছিলাম। বেনিফিশিয়ারি হচ্ছেন ওর মা। সুতরাং তাঁকে এখন ক্লেইম করতে হবে।”

 

“তিনি স্যার মারা গেছেন,”একেনবাবু বললেন।

 

“তাই নাকি! ঐ যাঃ, ওরটাতে তো আবার ‘পার স্ট্রাইপস’ ক্লজ আছে” মাথা নাড়লেন, জ্যাক মিশকা।

 

“তার মানে?” দিনুকাকা প্রশ্ন করলেন।

 

“তার মানে খুঁজে বার করতে হবে ওঁর মায়ের নিকটাত্মীয় কে কে আছে। সেখানকার আইন আবার কী…হু নোজ! টাকার অ্যামাউন্ট যা –এইসব খোঁজ করতেই সেটা খরচা হয়ে যাবে।”

 

“ওঁর স্ত্রী কিছু পাবে না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“এজের স্ত্রী আছে নাকি?”

 

“উনি বিয়ে করে দেশে গেছেন।”

 

“এমনিতে কিছুই পেতেন না, কিন্তু এটা তো কমপ্লিকেটেড সিচুয়েশন। তবে পান বা না পান –টাকার দিক থেকে শি উইল নট মিস মাচ।”

 

ইতিমধ্যে দেখি একেনবাবু রান্নাঘরে গিয়েছেন। নিশ্চয়ই কেয়ার সঙ্গে কথা বলতে। দিনুকাকা আমার সঙ্গে গল্প জুড়লেন।

 

বিকেল চারটেতে আমরা বাড়ি ফিরলাম। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই কেয়ার ফোন। আমার সঙ্গে নয়, একেনদার সঙ্গে ওর দরকার।

 

“বাঁদর মেয়ে!” বলে একেনবাবুকে ফোন দিলাম।

 

একেনবাবু দেখলাম খুব ‘থ্যাঙ্ক ইউ দিদি’, ‘থ্যাঙ্ক ইউ দিদি’ করছেন।

 

ফোন শেষ হলে সোফায় গা এলিয়ে বসে পা নাচাতে নাচাতে বললেন, “আচ্ছা স্যার, অজয়বাবু কিসের জন্য এত দুশ্চিন্তা করছিলেন বলে আপনার মনে হয়? মায়ের অসুস্থতার জন্য তো নয়।”

 

“এগ্রি। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এই বিয়ের খবরটা মাকে কী করে দেবেন সেই নিয়েই। আমাদের দেশের বাবা- মায়েদের ব্যাপার তো জানেন! একে বিদেশিনী, তার ওপর বিধবা। শুধু তাই নয়, একটা বাচ্চা আছে। একেবারে ত্র্যহস্পর্শ! কিন্তু মানুষকে চেনা কঠিন ব্যাপার” কথাটার অর্থ মনে হয় দিলীপ শৰ্মাই ঠিক ধরেছেন। হয়ত বিয়ের পর নাদিয়ার কোনও সিক্রেট জেনে ফেলেছেন।”

 

“সেই জন্যেই এসে নাদিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি, ভেরি গুড স্যার।”

 

চুপ করে আবার একটু পা নাচালেন, “যাই বলুন স্যার, কেয়াদিদি কিন্তু দুর্ধর্ষ।”

 

“কী ব্যাপার বলুন তো? কী এমন সংবাদ দিল আপনাকে?”

 

“ছোট বোন বলে নেগলেক্ট করবেন না স্যার। অসাধারণ বুদ্ধিমতী আমাদের দিদি।”

 

“তা তো বুঝলাম, কিন্তু ঠিক কী ভাবছেন একটু বলবেন?”

 

“বলার কিছু নেই স্যার। শুধু ভাবছি, পরশু কি আপনি খুব ব্যস্ত?”

 

“না পরশু আমার কোনো ক্লাস নেই।”

 

“তাহলে চলুন না, আরেকবার কিংস্টন যাই।”

 

“সে কী! এই তো ঘুরে এলাম!”

 

“কিন্তু সমস্যাটা এখনও তো মিটল না।”

 

দশ

দিনুকাকার বাড়িতে গিয়ে দেখি কেয়া আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। বলল, “বাবা একটু টায়ার্ড, আমি তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি।”

 

“কোথায়?”

 

“তিমিরের অফিসে।”

 

“দিলীপবাবু স্যাম গ্রোভারের ব্যাপারটা জানেন কি?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

 

“আমি বলে দিয়েছি,” কেয়া বলল, “এখন জানেন।”

 

“আচ্ছা ব্যাপারটা কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“আহ, চলো না দেখবে।”

 

.

 

তিমিরের অফিসে পৌঁছে আমি পুরো সারপ্রাইজ। ঘরের মধ্যে যারা ছিল, তাদের সবাইকে চিনি। শুধু একজনকে ছাড়া। লম্বা দোহারা চেহারা, স্পোর্টস জ্যাকেট, চোখে চশমা। নাদিয়ার পাশে বসে আছেন, নিশ্চয়ই সুব্রত।।

 

“আসুন, আসুন,” বলে তিমির আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। “অন্যদের আপনারা বোধহয় চেনেন,” বলে সুব্রতর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

 

“মিস্টার দত্তের ফিউনারেলের ব্যাপারে আমরা একটু আলোচনা করছিলাম। দু’-একটা ফর্মালিটির ব্যাপার তো আছে, সেই নিয়েই আলোচনা।”

 

“ভালোই হল স্যার, এখানেই সবাইকে পেলাম। আমারও দু’-একটা কনফিউশন আছে। এঁরা যখন আছেন, সেগুলো মিটিয়ে ফেলতে পারব।”

 

“কীসের কনফিউশন বলুন তো?” তিমির জিজ্ঞাসা করলেন।

 

“আমি খালি স্যার চিন্তা করছি, খুনটা করে লাভ কার হল?”

 

“তার মানে?” প্রশ্নটা করলেন দিলীপ শর্মা।

 

“অজয়বাবুর বহু টাকা থাকলে নাদিয়া ম্যাডামকে সন্দেহ করা যেত। কিন্তু তা তো ছিল না –তাই না?”

 

“যদ্দুর জানি, না।” দিলীপবাবুই সবার হয়ে উত্তর দিলেন।

 

“খুব বড় রকমের লাইফ ইন্সিওরেন্সও ছিল না, সুতরাং সেখান থেকেও তেমন কোনো প্রাপ্তি নেই।” নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে খানিকটা আত্মগত হয়েই কথাটা বললেন একেনবাবু।

 

প্রথমেই নাদিয়ার নাম ওঠায়, নাদিয়ার মুখে একটা ছায়া দেখছিলাম, সেটা চলে গেল।

 

“এখন স্যাম গ্রোভার নাদিয়া ম্যাডামের প্রেমে পাগল ছিলেন। নাদিয়া ম্যাডাম ওঁকে বিয়ে না করে বাদামি চামড়ার অজয়বাবুকে বিয়ে করে বসলেন! তার জন্যে কি স্যাম গ্রোভার অজয়বাবুকে খুন করতে পারেন স্যার?” এবার দিলীপ শর্মার দিকে তাকালেন। একেনবাবু।

 

“এরকম তো মাঝে মাঝে হয়।” দিলীপবাবু একটু থতমত খেয়েই বললেন।

 

“ঠিক। কিন্তু স্যাম গ্রোভার তো জানতেন না যে, নাদিয় ম্যাডাম অজয়বাবুকে বিয়ে করেছেন।”

 

“তাহলে ই-মেলটা কে পাঠাল? আর বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন, প্রেমিককেও তো মানুষ খুন করে।” এবার সুব্রতবাবু মুখ খুললেন।

 

“ট্রু স্যার, ট্রু। আবার বন্ধুকেও মানুষ খুন করে। মানছি, ই-মেলটা একটা পাজল স্যার। প্রথমে ভেবেছিলাম, স্রেফ মজা করার জন্যে! কিন্তু না, তা ঠিক নয়।”

 

“তাহলে?” সুব্রত প্রশ্ন করলেন।

 

“আপনি যখন প্রশ্নটা তুললেন স্যার, তখন বলেই দিই। অজয়বাবুকে খুন করার একটাই মোটিভ হতে পারে যে উনি কোনো একটা সিক্রেট জেনে ফেলেছিলেন, যেটা খুনির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক।”

 

.

 

হঠাৎ মনে হল ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।

 

“কী সিক্রেট?” এবার তিমির প্রশ্নটা করলেন, কিন্তু মুখে মনে হল একটা চাপা হাসি। “সেটায় আসছি স্যার, কিন্তু তার আগে বলি নেভাড়া নিয়ে আমার একটু কনফিউশন আছে স্যার।”

 

“কীরকম?” তিমির জিজ্ঞেস করলেন।

 

“আমি সুব্রতবাবুকেই জিজ্ঞেস করি। উনি হয়তো বলতে পারবেন?”

 

“কী কনফিউশন, বলুন?”

 

“স্যার, নেভাডাতে ম্যাডাম নাদিয়া আর অজয়বাবুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে আপনি হঠাৎ ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে গেলেন– সেটাই ম্যাডাম নাদিয়া আমাদের বলেছেন। সেটা কি ঠিক?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“তার মানে স্যার ওঁদের বিয়ের খবরটা আপনি জানতেন না?”

 

“বিয়ের পর নাদিয়া ফোন করে জানিয়েছিল।”

 

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। আপনার এত বন্ধু অজয়বাবু, তিনি বিয়ে করছেন। আপনি এত কাছে আছেন –তাও আপনাকে ডাকলেন না?”

 

“এর উত্তর যে দিতে পারত, সে তো নেই।”

 

“তা ঠিক স্যার। কিন্তু আপনার কী মনে হয়?”

 

“আমি কী বলব বলুন।”

 

“আপনি বিয়ের খবরটা জানার পরেও আর ওঁকে ফোন করেননি?”

 

“না।”

 

“কেন বলুন তো?”

 

“বলতে পারেন আমার অভিমান হয়েছিল।”

 

“রাইট স্যার। কিন্তু আপনি ম্যাডাম নাদিয়াকে প্রচুর সাহায্য করেছেন বাড়ি দেখে দেওয়া, জিনিসপত্র সেখানে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে।”

 

“কারণ নাদিয়া আমার বন্ধু এবং অজয়ের স্ত্রী। আর অজয়ের ওপর অভিমান হলেও সে আমার বন্ধুই ছিল।”

 

“অন্য কোনো ব্যাপার নিয়ে আপনার সঙ্গে অজয়বাবুর মনোমালিন্য হয়নি?”

 

“অন্য ব্যাপার মানে?”

 

“এই ধরুন, আপনার কোনো একটা গোপন ব্যাপার অজয়বাবু জেনে ফেলেছেন –সে নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি।”

 

“হোয়াট ননসেন্স!” এবার সুব্রত সত্যিই বিরক্ত।

 

“ঠিক আছে স্যার, এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন নয়। এবার শুধু বলুন, আপনারা কি অজয়বাবুর গাড়িতে নেভাডা গিয়েছিলেন না আপনার গাড়িতে?”

 

“আমার গাড়িতে।”

 

“তা আপনি তো স্যার ক্যালিফোর্নিয়া চলে গেলেন ওঁদের দু’জনকে ফেলে!”

 

“না ফেলে রেখে যাইনি। আমি গাড়ির চাবি অজয়কে দিয়ে গিয়েছিলাম। যাতে ওরা সময়মতো ফিরতে পারে।”

 

“এটা ঠিক কাজ করেছিলেন স্যার। কিন্তু গাড়ির কথায় মনে পড়ে গেল, তিমিরবাবু বলছিলেন, আপনার গাড়ি নাকি এই ক’দিন আগে সারানোর পরে দু’দিনের মধ্যে আবার খারাপ হয়ে গিয়েছিল?”

 

“ঠিকই বলেছেন।”

 

“এই দু’দিন কি আপনি নানান জায়গায় ঘুরেছেন –সেইজন্য?”

 

“না, শুধু অফিসে গেছি আর ফিরেছি।”

 

“কত দূরে আপনার অফিস স্যার?”

 

“মিনিট কুড়ির পথ।”

 

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার।” বলে একেনবাবু তিমিরের দিকে তাকালেন, “আচ্ছা তিমিরবাবু, আপনি কি জানেন সুব্রতবাবুর গাড়িটা দু’দিনে কত মাইল চলেছে?”

 

“হ্যাঁ, আড়াইশো মাইলের মতো।”

 

আমি এবার বুঝতে পারলাম, পুরোটাই সাজানো নাটক। তিমিরের সঙ্গে আগেই একেনবাবুর এ নিয়ে কথা হয়েছে। সুব্রতও কেমন জানি থতমত খেয়ে গেল।

 

“তিমিরবাবু এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছেন স্যার। আপনি যে হন্ডা ডিলারের কাছে দু’বার নিয়ে গেছেন, তারাই বলেছে। রিপেয়ার শপে ঢোকানোর সময়ে গাড়ির মাইলেজ লিখে রাখে কিনা।”

 

“তা হলে নিশ্চয়ই ভুল করেছে প্রথমবার।”

 

“দ্বিতীয়বার নয় কেন স্যার?”

 

“দ্বিতীয়বারও করতে পারে।”

 

“না স্যার, দ্বিতীয়বার নয়। দ্বিতীয়বার করলে, এক্ষুনি ভেরিফাই করা যেত, তাই না?”

 

“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বলুন তো?” এবার সুব্রত বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল।

 

“আপনি উত্তেজিত হবেন না স্যার, বসুন। তার আগে আর একটা কথা বলুন স্যার, আপনাকে কি বছর দুই আগে নাদিয়ার স্বামী বা স্বামীর কোনো বন্ধু ই-মেলে ভয় দেখিয়েছিলেন?”

 

“আমরা ও রকম অনেক ইমেলই পেয়েছি।”

 

“আমি শুধু আপনার কথা জিজ্ঞেস করছি। আর শুধু একটা বিশেষ ইমেল- এর কথা –যেখানে নাদিয়ার নাম উল্লেখ করা ছিল।”

 

আমি স্পষ্ট দেখলাম সুব্রতর চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে।

 

“আপনি এসব প্রশ্ন করার কে?”

 

তিমির এবার মুখ খুললেন, “ধরুন প্রশ্নটা আমিই করছি।”

 

“উত্তর হচ্ছে ‘না’।”

 

.

 

উত্তরটা শুনে তিমির একেনবাবুর দিকে তাকালেন।

 

“আপনাকে একটা কথা বলি স্যার, আপনি যদি ই-মেলটা ডিলিটও করে থাকেন, ওটা কিন্তু পুলিশের এক্সপার্টরা হার্ড ডিস্ক থেকে বার করতে পারবে। এবং গত কয়েকদিন আপনি কীভাবে কোথায় ইমেল পাঠিয়েছেন স্বনামে বা বেনামে- সেটাও কিন্তু বার করা যাবে।”

 

“আমি যেখানে বা যাকেই ই-মেল পাঠাই না কেন, তাতে কী এসে যায়?”

 

“কারণ ওটা দিয়ে স্যার একজনকে মিথ্যে করে খুনি সাজানো হচ্ছে। বোঝানো হচ্ছে, যে অজয়বাবুকে খুন করেছে, সে নাদিয়া ম্যাডামের প্রেমে পাগল এবং লোকটা আবার ভাল বাংলা জানে না! এরকম একটা লোক তো আছে স্যার।”

 

“সেটা কেন আমি করতে যাব?”

 

“সেটাই আমার প্রশ্ন স্যার, আপনি কেন সেটা করতে যাবেন, কারণ ম্যাডাম নাদিয়াকে আপনি ভালবাসেন এবং ওঁকে বিয়েও করেছেন। শুধু নামটা ব্যবহার করেছেন অজয়বাবুর। কেন?”

 

“তার মানে! সেটা করা কি এতই সোজা?” তিমির এবার গম্ভীরভাবে বললেন,”আইডেন্টিটি থেফট এখন আকচার হচ্ছে। বিয়েটা তো হয়েছে নেভাডাতে –সব কিছুই ওখানে একটু ঢিলেঢালা। একটা ড্রাইভার্স লাইসেন্স, সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর।”

 

“রাইট স্যার। অজয়বাবুর ড্রাইভিং লাইসেন্স আপনি হাতিয়েছিলেন। আপনার দু’জনের চেহারার তফাত ছবিতে চট করে ধরা পড়বে না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, কী সেই সিক্রেট, যার জন্যে আপনাকে তড়িঘড়ি এসে খুন করতে হল, ম্যাডাম নাদিয়াকে এত অ্যাক্টিং করতে হল!”

 

“আমি এই অদ্ভুত অভিযোগের কোনো উত্তর দেব না।”

 

“আপনি উত্তর না দিলেও স্যার, ম্যাডাম নাদিয়া হয়তো দেবেন। তবে শুধু এটুকু বলি অজয়বাবু দেশ থেকে ফিরে খুন হবার আগে তিমিরবাবুর কাছে দু’-একটা কথা ইতিমধ্যেই বলে গেছেন অলিভারের মৃত্যু সম্পর্কে। কে সেই মাশরুমগুলো জোগাড় করেছিলেন……..।

 

নাদিয়া দেখি ভয় থরথর করে কাঁপার পর ফোঁপাতে শুরু করেছে! “আই ওয়ার্ড হিম নট টু….।” তারপরের কথাগুলো কান্নার মধ্যে জড়িয়ে গেল।

 

এগার

দিনুকাকার বাড়িতে ফিরে আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার বলুন তো, এসব রহস্য আপনি উদঘাটন করলেন কখন?”

 

“সবই তো আমার এই কেয়াদিদির জন্যে। যে মুহূর্তে বুঝলাম বাংলা ই-মেলটা দু’বছরের পুরনো তখনই মাথায় এল, কোথাও একটা খেলা শুরু হয়েছে। তারপর নানান সম্ভাবনার কথা ভাবতে লাগলাম। তার মধ্যে একটা মনে হল হলেও হতে পারে। নেভাডাতে হয়তো সুব্রতবাবু নাদিয়া ম্যাডামকে বিয়ে করবেন বলেই বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলেন। একটা কিছু ওখানে ঘটেছিল –ওঁদের দু’জনের কথাবার্তার মধ্যে থেকেই হোক বা অন্য কোনো সূত্র থেকে অজয়বাবু সন্দেহ করলেন অলিভারের মৃত্যুর সঙ্গে সুব্রত ও নাদিয়া জড়িত। বিষাক্ত মাশরুম হয়তো সুব্রতই জোগাড় করেছিল। এ নিয়ে নিশ্চয়ই ওঁদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। এরমধ্যে অজয়বাবুর মায়ের অসুস্থতার খবরটা আসে। সুব্রতবাবু আর নাদিয়া ম্যাডাম চিন্তা করলেন, অজয়বাবু যদি ওঁর সন্দেহের কথা পুলিশকে জানান, আর নতুন করে ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়, তাহলে একটা ঝামেলা। অলিভারের মতো অজয়বাবুকেও সরাতে হবে। কিন্তু কী করে? প্রথম কাজ হল ওঁরা বিয়ে করবেন না, বিয়ে করলে অলিভার হত্যার অভিযোগটা জোরদার হবে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি দেখান যায় অজয়বাবু নাদিয়া ম্যাডামকে বিয়ে করেছেন। ব্যাপারটার মোড় তাহলে অনেকটাই ঘুরে যাবে। এটা খুবই দ্রুত ডিসিশন। সুব্রত অজয়বাবুর ড্রাইভার্স লাইসেন্সটা চুরি করেন।”

 

“তাহলে অজয় আইডেন্টিটি কার্ড ছাড়া প্লেনে উঠলেন কী করে?”

 

“কেন স্যার, গ্রিন কার্ড, পাসপোর্ট –একটা হলে তো চলে। একটা নিশ্চয়ই সঙ্গে ছিল। যাই হোক, এই প্ল্যানের টাইম লাইনে নানা রকম ফাঁক আছে ঠিকই, কিন্তু অজয়বাবুকে সরিয়ে দিলে ফাঁকগুলো আর ধরা পড়বে না। অজয়ের পরিচয় দিয়ে বিয়ে করতে খুব একটা সমস্যা হল না। অজয়বাবুর ট্যাক্সের বহু কাজই সুব্রতবাবু করে দিতেন। অজয়বাবুর সোশ্যাল সিকিউরিটি, ঠিকানা ইত্যাদি সবই ওঁর জানা।।

 

“যাক সে কথা, ফিরে এসে ওঁরা দেখেন এরমধ্যেই অজয়বাবু দেশে চলে গেছেন। তখন একটাই দুশ্চিন্তা অজয়বাবু পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে গেছেন কি না। একটু খোঁজ খবর করে সুব্রতবাবু বুঝলেন এখনও অজয়বাবু কিছু বলেননি। কিন্তু এটাও সুব্রতবাবু বুঝলেন গতিক সুবিধার নয়। ওঁর কোনো ই-মেলের উত্তর অজয়বাবু দিচ্ছেন না, ফোনও ধরছেন না। এই অবস্থায় নাদিয়া ম্যাডামকে ম্যানহাটানে বসিয়ে দিয়ে সুব্রতবাবু তক্কে তক্কে রইলেন কবে অজয়বাবু ফিরছেন। অ্যাপার্টমেন্টে অজয়বাবুর ছবি রাখা হল। অজয়বাবুর ই-মেল- এ ফেক ওয়ার্নিং পাঠানো হল- যেটা বছর দুই আগে অলিভার পাঠিয়েছিলেন সুব্রতবাবুকে। কারণ তখনই ওঁদের প্রেম শুরু হয়েছিল।”

 

“একটা কথা,” আমি প্রশ্ন করলাম,”একই সময় ভারত আর আমেরিকা থেকে ই মেল- এ ঢুকলে হ্যাঁকার ভেবে অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেওয়া হয় না?”

 

একেনবাবু কেয়ার দিকে তাকালেন। “কেয়াদিদি, তুমিই বল।”

 

কেয়া বলল, “ঠিক একই সময় ঢোকার চেষ্টা করলে হয়। আইডেন্টিটি ভেরিফিকেশন করতে বলে। আমার বিশ্বাস সেই জন্যেই সুব্রত অজয়ের নামে আরেকটা অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। সেটাই নাদিয়া ব্যবহার করছিল।”

 

“এগজ্যাক্টলি স্যার, আর নাদিয়া ম্যাডামও আমাদের ভুল পথে নিয়ে যাবার জন্যে অ্যাক্টিং করে গেলেন। তবে কি না স্যার, এসব ব্যাপারে বুদ্ধিমান লোকেরাও ভুল করে। ভেবে দেখুন স্যার, অজয়বাবু কবে আসবেন, না আসবেন –সেটা জানার জন্যে সুব্রতবাবুকে দিলীপ শর্মাকে ফোন করতে হবে কেন? বন্ধুর কাছ থেকেই তো জানতে পারতেন!”

 

“এবার বুঝেছি,” আমি বললাম, “দিলীপ শৰ্মার কাছে খবরটা জেনে পয়লা এপ্রিলই কুইন্স থেকে চলে এসেছিল। কাজ খতম করে ফিরে যায়।”

 

“শুধু শেষ রক্ষা হল না স্যার।”

 

“কারণ আমার একেনদাদার জন্যে” বলে কেয়া একেনবাবুর গলা জড়িয়ে ধরল।

 

একেনবাবু লজ্জা লজ্জা মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দিদিকে নিয়ে আর পারা যায় না স্যার। আজকের এই শেষ দৃশ্য কিন্তু দিদিরই প্ল্যান। আমারে নাকি হারকিউল পয়রো সাজাতে হবে!”

 

“এ্যরকুল পোয়ারো,” কেয়া শুদ্ধ করে দিল।

 

“আমি কি দিদি অত সব উচ্চারণ জানি!” একেনবাবু স্নেহভরা চোখে কেয়ার দিকে তাকালেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


সূচিপত্র