শান্তিনিকেতনে অশান্তি (একেনবাবু) – সুজন দাশগুপ্ত

শেয়ার করুনঃ

এক

দেশে ছুটি কাটাতে যাব, যাবার মাত্র সাতদিন বাকি। ঠিক এই সময়ে সুভদ্রামাসির বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যাবার মোটেই ইচ্ছে ছিল না। কেনাকেটা ছাড়াও যাবার আগে বেশ কিছু কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু সুভদ্রামাসি ছাড়লেন না। শুধু আমি না, একেনবাবু আর প্রমথকে নিয়ে আসা চাই। প্রমথ তো কথাটা শুনে খেঁকিয়ে উঠল, “নিয়ে আসা চাই মানে? তুই আমার গার্জেন নাকি? তোর ইচ্ছে হয় যা, তোর ঐ ডিপ্রেসিং সুভদ্রামাসির বাড়ি আমি যাচ্ছি না।” বলেই গটগট করে ইউনিভার্সিটি চলে গেল।

 

প্রমথর এই রিয়্যাকশনে আমি আশ্চর্য হইনি। জানি শেষমেষ ও ঠিকই যাবে। প্রমথটা ভোজনরসিক, আর সুভদ্রামাসির কুক সুজাতা দুর্দান্ত রান্না করে বিশেষ করে বাঙালি রান্না। তবে ফ্রান্সিস্কার সঙ্গে কোনো প্ল্যান থাকলে অন্য কথা। একেনবাবু সুভদ্রামাসিকে চেনেন না, তাও একেনবাবুকে নিয়ে সমস্যা হবে না জানতাম। যে কোনো জায়গায় যেতে উনি এক পায়ে খাড়া। আমায় শুধু জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাডাম কি স্যার ডিপ্রেশনে ভুগছেন?”

 

“আরে না, প্রমথকে তো চেনেন। তবে হ্যাঁ, ওর জীবনটা একটু স্যাড ঠিকই।”

 

“কেন স্যার?”

 

“মা’র কাছে শুনেছি এদেশে পড়াশুনা করতে এসে এক সায়েবকে বিয়ে করেন। ওঁর বাবা-মা সেটা অ্যাকসেপ্ট করেননি। বহুদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না দেশের সঙ্গে। তার ওপর নিজের ছেলেপুলে হয়নি। একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করেছিলেন, সে আবার স্কুলে যাবার পথে অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়।”

 

“মাই গড! কতদিন আগের ঘটনা স্যার?”

 

“তা অনেক বছর হল, আমার বয়স তখন চোদ্দো-পনেরো।”

 

“সে তো অনেক বছর আগেকার কথা।”

 

“তাতে কি, ছেলেমেয়ে হারানোর দুঃখ কখনো যায় নাকি! শুধু তাই নয়, কয়েক বছরের মধ্যে আবার বাবা-মা-স্বামী সবাইকে হারান।”

 

“কিন্তু স্যার, মা-বাবার সঙ্গে তো যোগাযোগ ছিল না বললেন।”

 

“ছেলে মারা যাবার পর হয়েছিল। তখন কলকাতাতে স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে আসতেন নিয়মিত। ইনফ্যাক্ট তখনই আমি ওঁকে আর রিচার্ডমেসোকে দেখি। রিচার্ডমেসো বেশ ইন্টারেস্টিং লোক ছিলেন, খুব ক্রিপ্টিকালি কথাবার্তা বলতেন।”

 

“আপনি বলছিলেন স্যার কয়েক বছরের মধ্যে সবাই মারা যান..” একেনবাবু খেই ধরিয়ে দিলেন।

 

“ও হ্যাঁ, তখন আমি বি.এসসি পড়ছি। বাথরুমে পড়ে মাথা ফেটে মারা গেলেন সুভদ্রামাসির মা। হাসপাতালে থাকার সময়ে রক্তের দরকার রিচার্ডমেসো আর আমি রক্ত দিয়েছিলাম। কিন্তু সুভদ্রামাসির মা’র জ্ঞান আর ফিরল না। এক বছর পেরোতে না পেরোতেই সুভদ্রামাসির বাবা মারা গেলেন একটা সিম্পল অ্যাপেনডিক্স অপারেশনে।”

 

“হোয়াট ওয়েন্ট রং স্যার?”

 

“হু নোজ। রিচার্ডমেসোকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। ওঁর উত্তর টুথ অ্যাস অফটেন ইজ নট নোন। এর পরপরই রিচার্ডমেসোর ক্যানসার ধরা পড়ে। বছর দুই-তিন বেঁচে ছিলেন। তারমধ্যেও কলকাতায় এসেছিলেন শুনেছি, কিন্তু আমি তখন বাইরে পড়তে চলে গেছি।”

 

“তার মানে স্যার, ম্যাডাম এখন একেবারেই একা।”

 

“হ্যাঁ, তার ওপর আথ্রাইটিস-এর কোপে গৃহবন্দি। দ্যাটস দ্য স্যাড পার্ট।”

 

ঐ যাঃ, গল্প শুরু করতে গিয়ে ভুলেই গেছি স্থান-কাল-পাত্রের কথা। স্থান নিউ ইয়র্ক। কাল ২০০২ সাল। আমি বাপি দে, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়াচ্ছি বছর দুয়েক হল। প্রমথ আমার ছেলেবেলার বন্ধু। কেমিস্ট্রিতে পোস্ট ডক করছে একই ইউনিভার্সিটিতে। এই কাহিনীর মুখ্য চরিত্র অবশ্য একেনবাবু। এককালে উনি কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদপ্তরে কাজ করতেন। সেই সময়ে নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন একটা এক্সচেঞ্জ পোগ্রামে। নিউ ইয়র্ক পুলিশ তখন ম্যানহাটানের মুনস্টোন মিস্ট্রি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল, একেনবাবু সেটির সমাধান করেন। সেই থেকেই নিউ ইয়র্ক পুলিশের ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একেনবাবুর গুণমুগ্ধ ভক্ত। অল্প কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। আবার ফিরে এসেছেন। এবার এসেছেন একটা ফুলব্রাইট ফেলোশিপ বাগিয়ে ক্রিমিনোলজির উপর রিসার্চ করবেন। আমার আর প্রমথর সঙ্গে ওয়াশিংটন স্কোয়ারের কাছে একটা থ্রি বেডরুম অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করছেন।

 

একেনবাবু দেখলে অবশ্য ডিটেকটিভ বলে মনে হবে না। বেঁটেখাটো মোস্ট আনইম্প্রেসিভ চেহারা। জামাকাপড়ের অবস্থাও তথৈবচ। হাবেভাবে মনে হয় একটা স্টেট অফ কনফিউশনের মধ্যে আছেন। মাঝেমধ্যেই উলটোপালটা কথা বলেন। তবে যেটা সবচেয়ে ইরিটেটিং, সেটা হল কথায় কথায় ‘স্যার’ আর ‘ম্যাডাম’ বলা। দেশে হয়তো সেটা চলে, কিন্তু আমেরিকায় নয়। বিটকেল অ্যাকসেন্টের ইংরেজির মধ্যে স্যার আর ম্যাডামের বন্যা বইয়েও উনি যে দিব্যি করে খাচ্ছেন, তাতে অচেনা লোকেরা অবাক হলেও আমরা আর হই না। তলে তলে উনি যে একজন ধুরন্ধর ডিটেকটিভ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

 

ও হ্যাঁ, ফ্রান্সিস্কার পরিচয়টা এখনও দেওয়া হয়নি। ফ্রান্সিস্কা সুইটজারল্যান্ডের মেয়ে, ভারি মিষ্টি চেহারা। কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছে। সেই সূত্রেই প্রমথর সঙ্গে আলাপ। সে আলাপটা এখন যে পর্যায়ে তাতে ওকে প্রমথর গার্লফ্রেন্ড বলা চলে। প্রমথ অবশ্য গার্লফ্রেন্ড কথাটা শুনলেই ক্ষেপে ওঠে। ‘ফ্রেন্ড বলতে পারিস না, সঙ্গে গার্ল যোগ করতে হবে কেন!’

 

মেয়েটির চেহারাটাই শুধু মিষ্টি নয়, স্বভাবটাও চমৎকার। কেমিস্ট্রি সাবজেক্ট হলেও মিউজিক এবং আর্টের ব্যাপারেও প্রচুর ইন্টারেস্ট যেটা আমাদের তিনজনের কারোর মধ্যেই তেমন নেই।

 

একেনবাবুর সঙ্গে সুভদ্রামাসির কথা শেষ হতে না হতেই ফ্রান্সিস্কার ফোন। প্রমথর খোঁজ করছে। প্রমথ ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছে বলার পর আমার কি মনে হল, জিজ্ঞেস করলাম উইক-এন্ডে ওর কোনো প্ল্যান আছে কিনা।

 

“তেমন কিছু নেই।”

 

“তাহলে চলো না, আমার মায়ের এক বন্ধু সুভদ্রামাসির কাছে যাচ্ছি। তুমি গেলে, প্রমথও যাবে।”

 

আমি অবশ্য এক্সপেক্ট করিনি ফ্রান্সিস্কা রাজি হবে এভাবে যেতে। ও আমায় জিজ্ঞেস করল, “উনিই তো গান গাইতেন, তাই না?”

 

সুভদ্রামাসি এক কালে খুবই ভালো গাইতেন– মার কাছেই শুনেছি। কথা প্রসঙ্গে হয়তো সেটা একবার বলেছিলাম। কিন্তু ফ্রান্সিস্কার যে সেটা মনে থাকবে ভাবিনি।

 

আমি বললাম, “হ্যাঁ।”

 

“আই উইল কাম।”

 

ফ্রান্সিস্কার কথা শুনে আমি থ্রিলড। অর্থাৎ প্রমথ ব্যাটাকেও আসতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *