ঋজুদার সঙ্গে সুফকর-এ – বুদ্ধদেব গুহ
গত রাতেই ঋজুদার সঙ্গে তিতির আর আমি নাগপুর থেকে ঋজুদার ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসের বন্ধু পরিহার সাহেবের এক পরিচিতর জীপে করে কানহারে মুক্কি ফরেস্ট লজ-এ এসে উঠেছি সন্ধ্যের পর। ফরেস্ট লজটা ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম ডেভালাপমেন্ট কর্পোরেশনের, যেমন লজ ওঁরা নানা জঙ্গলেই বানিয়েছেন। সাম্প্রতিক অতীতে বানিয়েছেন পালামৌর বেতলাতেও। লজগুলি চমৎকার। তবে দোষের মধ্যে ভীষণ এক্সপেনসিভ। ঋজুদা যদি বনবিভাগের একটি বিশেষ সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে না আসত তবে এখানে আমাদের নিয়ে উঠত না। আমাদের সব খরচ অবশ্য ঋজুদা ব্যক্তিগতভাবেই দিচ্ছে।
এই লজটা সত্যিই চমৎকার। খাওয়ার ঘরটি দোতলার ওপরে। পুরো কাঁচ দিয়ে ঘেরা একপাশ। আর সে পাশেই জঙ্গল গভীর। একটি নদী বয়ে গেছে লজ-এর একেবারে পা ছুঁয়ে। বড় বড় সাদা পাথরে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে উচ্ছ্বসিত, উৎসারিত, চঞ্চল জল চলেছে। কলরোলে।
লজ-এর সামনে দিয়ে পথ চলে গেছে। বাঁ দিকে গেলে নানা জায়গা পেরিয়ে লতাপুর। ডানদিকে গেলে সোজা সুফকর গ্রাম–তার কিছু আগে ডানদিকে ঘুরে গেলে মোতিনালা। সেখানে কালো হলো নদী পেরুতে হয়। জব্বলপুরেও যাওয়া যায় সে নদী পেরিয়ে বাঁ দিকে গেলে–মান্দলা হয়ে। আবার কিলি হয়েও যাওয়া যায়, চিপি হয়ে। হাঁলো নদী পেরিয়ে। মালার পাশে পাশে অনেক দূর অবধি নর্মদা চলেছে। আশ্চর্য সুন্দর নদ নর্মদা।
রাতে অত্যন্ত ক্লান্ত থাকাতে বেশি কথাবার্তা হয়নি আর। আমি আর ভটকাই এক ঘরে শুয়ে পড়েছি গিয়ে। তিতির এক ঘরে। আর অন্য ঘরে ঋজুদা। প্রতিটি ঘরই নদীমুখো। চমৎকার অন্দরসজ্জা। সস্তা, স্থানীয় সব জিনিস দিয়ে করা হয়েছে, মাদুরের গালচে থেকে বাঁশের টেবল পর্যন্ত। প্রতি ঘরের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দা। মনে হয়, হাত বাড়ালেই হাত ছোঁওয়ানো যাবে। এখন কৃষ্ণপক্ষ। চাঁদ ওঠেনি এখনও। তারাদের নীলাভ আলোতে নদীর ফেনিল সাদা জল মাঝে মাঝেই ব্যথায় নীল হয়ে উঠছে। সামান্যক্ষণের জন্যে হলেও। নদীর নাম জানা হয়নি এখনও।
যে কোনও নদীই আমাকে বড় টানে। ইচ্ছে হয়, তার গতিপথ ধরে পাথরে পাথরে, বালিতে বালিতে পা ফেলে ফেলে চলে যাই তার সঙ্গে। দেখি, সে কোথায় যায়! তবে একথা বুঝি যে, পথের মতো নয় নদী। পথ কোথাওই থামে না। অন্য কোনও পথে গিয়েই মেশে। সেখান থেকে আবারও অন্যতর পথে। কিন্তু নদী, সে উপনদী, শাখানদী বা মূল নদী যাই হোক না কেন একসময়ে স্ফীত হতে হতে সাগরে গিয়ে থামেই। তাকে থামতেই হয়। তার চলা অনন্তকালের নয়। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালাতে আছে, ঋজুদা একদিন পড়ে শুনিয়েছিল আমাদের লবঙ্গীর জঙ্গলে যাওয়ার আগে ওড়িশার বাঘ্যমুণ্ডার বাংলোতে বসে; যে, হারিয়ে যাওয়া বা থেমে যাওয়া। মানেই মৃত্যু নয়; ফুরিয়ে যাওয়া নয়। এই থামার মধ্যেও একধরনের শান্ত সমর্পণ আছে, পূর্ণতা আছে। স্থবিরের চলা। গাছেদের চলার মতন। রবীন্দ্রনাথ ঠিক এমন করে বলেননি। কিছুটা হয়তো ঋজুদার, আর কিছুটা আমার কষ্টকল্পনা।
যাই হোক কলকাতায় ফিরে বইটা জোগাড় করে পড়তে হবে জায়গাটি ভাল করে। উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে এতদিন পরে, ঋজুদা ঠিক কী বলেছিল তা মনে নেই।
সবই ভাল, কিন্তু মুশকিল হয়েছে ভটকাই প্রায় পার্মানেন্ট ফিচার হয়ে উঠেছে আমাদের দলে। ঋজুদা একটা সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র আমারই ছিল। তারপর ঋজুদাই তিতিরকে ইনট্রোস করল আফ্রিকাতে রুআহা অ্যাডভেঞ্চারের আগে। অ্যালবিনো, এমন কী আফ্রিকার গুগুনোগুরের দেশে পর্যন্ত আমিই ছিলাম ঋজুদার একমাত্র সঙ্গী। তারপর আমারই বন্ধু, বন্ধুও বলব না : বলব জাস্ট অ্যাকোয়েন্টেন্স; এই ভটকাইকে ঋজুদার প্রায় হাতে-পায়ে ধরে দলে নিতে রাজী করাই। নিনিকুমারীর বাঘ, যে বাঘ সাংঘাতিক মানুষখেকো হয়ে গেছিল, তাকে মারবার জন্যে যখন আমরা যাই ওড়িশার এক পূর্বতন করদ রাজ্যে, তখন ভটকাই প্রথমবার আমাদের সঙ্গী হয়। তারপর থেকে সেই যে ঋজুদার ঘাড়ে সিন্দবাদ দ্য সেইলার-এর মতো চেপে বসেছে আর নামার লক্ষণটি পর্যন্ত নেই। শুধু তাই নয়, ঋজুদাকে ও প্রায় মনোপলাইজ করেও ফেলেছে। কী জাদু যে করেছে তা ঐ জানে! কিন্তু এও মনে হচ্ছে ওই এখন ঋজুদার সবচেয়ে কাছের লোক। এ নিয়ে আমার আর তিতিরের রীতিমত গাত্রদাহ হচ্ছে আজকাল। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার, ঋজুদাকে মোটেই মান্যিগন্যি করে না সে। এমন ভাব করে যেন ঋজুদার সে ইয়ার-দোস্ত। গুগুনোগুম্বারের দেশ থেকে আহত ঋজুদাকে যদি বাঁচিয়ে না নিয়ে আসতে পারতাম দেশে, তবে কী করে হত তারপরের আরও এত সব অ্যাডভেঞ্চার?
ব্রেকফাস্টের পর আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঠিক সকাল নটাতে কাঁটায় কাঁটায়। সময়ের ব্যাপারে আমরা সেনাবাহিনীকেও হার মানাতে পারি। ঋজুদার নটা মানে, নটা বাজতে পাঁচ-এ আমাদের সকলের ঋজুদার কাছে। রিপোর্ট করতে হবে। সকাল নটা না হয়ে যদি রাত দুটো হয়, তবেও তাই। সবচেয়ে বড় কথা ঋজুদা গুড অ্যাডভটকাইস অ্যান্ড ব্যাড এগজাপল-এ বিশ্বাস করে না। প্রতিদিনই ঋজুদা আমরা রিপোর্ট করার আগেই নিজে পুরো তৈরি হয়ে বসে থাকে। ঋজুদার কাছে থেকে থেকে, তার সঙ্গে বহু অ্যাডভেঞ্চারে গিয়ে গিয়ে নিয়মানুবর্তিতা আমাদের রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। ঋজুদা কখনও কখনও স্বগতোক্তির মতো বলে যে, যে মানুষ বা যে জাতির জীবনে নিয়মানুবর্তিতা নেই তার বা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। স্কুলেই যাও বা অফিসেই যাও, সভাতেই যাও বা গান শুনতেই যাও, গানের অনুষ্ঠান অথবা স্টাডি সার্কল যারই আয়োজন করো, অনুষ্ঠান যেন ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় আরম্ভ হয়। যাঁরা পরে আসবেন তাঁদের ঢুকতে দিও না। সময় মতো প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিও। তাতে যা হয় হবে।
ভটকাই প্রথম প্রথম বলত, ওর শ্যামবাজারী ভোকাবুলারিতে বড় জ্ঞান দেয়রে মানুসটা।
কিন্তু এখন বলে, ঋজুদা আমার লাইফ-স্টাইল চেঞ্জ করে দিয়েছে র্যা। আমার গলির সবাই আমাকে দেখে ঘড়ি মিলোয় আজকাল। পঞ্চমী নামের একজন ঠিকে কাজের লোক, ঘোষবাবুদের বাড়ি ঠিকে কাজ করে; যে সেদিন আমাকে গলিতে দেখেই বলল, হেই যা গো! পৌনে-নটা বেইজে গেল গো! তুমি যে কালিজে বেইরে পইড়েচো গো দাদাবাবু।
ভটকাই-এর কথা শুনে আমরা হেসেছিলাম খুব।
ঋজুদা বলল, তুইই চালা রুদ্র। পাইপ নিয়ে এত ঝকমারী হয় যে জীপ বার বার থামাতে হয় নিজে চালালে।
ভটকাই ফুট কাটল, আহা! রুদ্র চালালেও যেন থামতে হয় না। তোমার পাইপ খাওয়ার দরকার কী? প্রতি পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড অন্তরই ত নিভে যায়! তার চেয়ে তুমি থেলো-হুঁকো খাও। হুঁকোর মাথাতে টিকে দিয়ে তার উপরে টিনের চাকতি ফুটো-ফুটো করে মাপ করে বসিয়ে দেব। ফাসক্লাস হবে।
জীপ স্টার্ট করে মুক্তি লজ থেকে ডান দিকে মোড় নিতেই নদীটার উপরের কংক্রীটের ব্রিজের উপরে এসে উঠলাম আমরা।
বাঃ।
আমার মুখ ফুটে বেরিয়ে গেল।
কী সুন্দর নদীটা। মেমসাহেবের গায়ের রঙের মতো সাদা বালি, নরম, পেলব শুয়ে রয়েছে স্রোতস্বিনীর দুপাশে। শীতের সকালের রোদে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। বড় বড় সাদা পাথর। বিজ্ঞ হনুমানের দল তাদের ব্লন্ড দাড়ি আর গায়ের চুল নিয়ে কী যেন এক জরুরী সভাতে বসেছে। এ ওর দাড়ি ও মাথার চুল থেকে সাবধানে সযত্নে উকুন বেছে বের করছে।
ভটকাই বলল, তোমার অফিসে ফোন করলে তোমার সেক্রেটারী যখন বলে যে, মিঃ বোস ইজ ইন কনফারেন্স ন্যাও তখন আমার এই ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
আমরা সকলে হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলাম। ঋজুদার মুখ থেকে হাসির তোড়ে পাইপ প্রায় ছিটকে বেরিয়ে গেল।
সকলের হাসি থামলে ঋজুদা বলল, কথাটা খুব একটা মন্দ বলিসনি ভটকাই। তিতির একটা ছবি তোলতো নেমে, আমাদের কনফারেন্স রুমের দেওয়ালে এনলার্জ করে বাঁধিয়ে রাখব। সত্যি! কনফারেন্স, মীটিং কথাগুলো চালু হয়েছে বটে। ঘরে বসে হয়তো কেউ মাসতুতো দিদির মেজছেলের মাধ্যমিকে ফেল হওয়া নিয়ে আলোচনা করছে আর জরুরী ব্যাপারে যাঁরা ফোন করছেন তাঁদের বলে দিচ্ছে সেক্রেটারী হি ইজ ইন আ কনফারেন্স। কনফারেন্স আর মীটিং এ না থাকলে যেন বড় সাহেব যে কেউ হয়েছে তা প্রমাণই হয় না। এমনই ভাব হয়েছে একটা আজকাল। কাজ করার চেয়ে কাজ দেখানোটাই অনেক বড় ব্যাপার হয়ে গেছে।
বাঃ ওগুলো কী ফুল ঋজুদা? পাথরের মধ্যে মধ্যে জলের গায়ে ফুটেছে। মাছ ধরছে একটা বুড়ো লোক। কী সুন্দর দেখাচ্ছে, না, ছবিটা এই শীতের সকালে?
ঋজুদা প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল হ্যাঁ। যা বলেছিস।
তিতির ছবি তুলে ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়েই সেদিকে চেয়ে রইল। যেখানে বুড়ো বসে মাছ ধরছিল।
ভটকাই বলল, কী মাছ পায় এখানে ওরা, ঋজুদা? আর বললে না, কী ফুল। ওগুলো?
ঋজুদা স্বপ্নোত্থিতর মতো বলল, ওগুলো গান্ধালা ফুল, আর ঐ যে দেখছিস ও পাশে, জলের কিনারায়, ওগুলোর নাম গাংগারিয়া। স্থানীয় নাম। এই নামেই জানি। ওদের বটানিকাল নাম বলতে পারব না।
আর মাছের নাম বললে না, কী মাছ ধরছে?
মাছ কী আর ধরছে? তবে মাছের নাম, পাড়হেন, সাওয়ার, এই সব। পাহাড়ী নদীতে হয় এই সব মাছ।
তা মাছ ধরছে না তো কী করছে ঐ বুড়ো?
ঋজুদা হাসল, হাঃ হাঃ করে।
তারপর বলল, বড় হলে জানতে পাবি বৃদ্ধদের কতরকম কষ্ট থাকে। শুধু বৃদ্ধ কেন, সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরই থাকে। সেই সব কষ্ট থেকে পালিয়ে আসার জন্যে মাছ ধরার বাহানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাথরের ওপর রোদে বসে থাকে, জলের শব্দ, রোদের চিকমিক, গাছ পাতা লতার শব্দ, মাছেদের হঠাৎ ডিগবাজী আর মাছরাঙার হঠাৎ ছোঁতে যখন চারদিকে হাজার হাজার হীরে ছিটকোতে থাকে তখন বুড়ো দু পা জোড়া করে বসে জহুরী বনে যায়। পিটপিট চোখে হীরে দেখে, পরখ করে, জিভ দিয়ে চাটে, নাক দিয়ে গন্ধ নেয়; হীরের ফুল দেখে, হীরের মাছ দেখে, তার সারা জীবনের দারিদ্র, শীত, খিদে সব ভুলে গিয়ে উষ্ণ রোদের মধ্যে বসে এক দারুণ সুখের দেশে চলে যায়। যে দেশে মৃত্যুর আগে তার যাওয়ার কোনও উপায়ই নেই।
তারপর বলল, যখনই দেখবি কোনও মানুষ একা বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাৎনার দিকে চেয়ে আছে তখনই বুঝবি, ফাৎনা নড়াটা একটা বাহানা, ছুতো; মানুষটি অবশ্যই অন্য গভীর কিছুর সন্ধানে ঐ সাধনাতে বসেছেন। তার শিশু সন্তানের মুখ থেকে তার বৃদ্ধ বাবার মুখ, তার চাকরীর জায়গা, তার ফেলে-আসা খেলাধুলোর মাঠ, কোনও পরীক্ষায় তার ফেল করার দুঃখময় স্মৃতি, তার জীবনের পথ, সেই পথের গন্তব্য; কত কিছুই যে ফাত্রার সঙ্গে হাওয়ায় দুলতে থাকে চোখের সামনে, মনের সামনে তা যে মাছ ধরে, সেই শুধু জানে! আসলে বড় হলে বুঝতে পারবি যে সংসারে এই সত্যটাই মস্ত বড় সত্য। অ্যাপারেন্ট ইজ নট রিয়্যাল। নে, এবার চল।
বলেই বলল, এই বানজার নদীর মতো সুন্দরী নদী সত্যিই কম আছে। এখানের বানজার এর রূপ অনেকটা পালামৌ-এর লাবনবাংলোর কাছের কোয়েলের মতো। না, বানজার বোধ হয় আরও অনেক বেশি সুন্দরী। বানজার মেমসাহেব আর হাঁলো দিশিমেয়ে। একজন ফর্সা অন্যজন কালো। তবে রূপসী দুজনেই সমান।
তিতির বলল, এই তাঁবুগুলো কিসের?
এগুলো অ্যান রাইট-এর কোম্পানির তাঁবু।
কোন্ অ্যান রাইট?
ভটকাই শুধোল।
তুই যার কথা ভাবছিস, সেই।
ঋজুদা বলল।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড-এর অ্যান রাইট?
ইয়েস স্যার।
আমি বললাম।
ওঁর কোম্পানি আছে। বিদেশিদের জানোয়ার দেখাতে নিয়ে আসেন। আগে বিহারের পালামৌয়ের বেতলা ন্যাশনাল পার্কেও ছিল। এখন মধ্যপ্রদেশের কানহা-কিসলি অঞ্চলে।
সামনের নদীটা কী নদী ঋজুদা?
এটাই তো হাঁলো রে!
আর কাহার মুক্তি ট্যুরিস্ট লজ-এর পাশে তো বাজার, তাই না?।
হ্যাঁ।
একটা বাঁক ঘুরতেই দূরে সুফকর-এর বন-বাংলোটা দেখা গেল। খড়ের চাল এর। ছবির মতো।
ঋজুদা বলল, দেখছিস তো রুদ্র।
বাঃ।
জীপের গতি কমিয়ে বললাম আমি। আমার মুখ থেকে ছিটকেই বেরিয়ে গেল শব্দটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
এই হচ্ছে সুফকর।
দারুণ।
তিতির আর ভটকাই দুজনেই একসঙ্গে বলল।
অ্যান রাইট কি এখানে আসছেন নাকি? আছেন এখন?
আসতে পারেন। তবে সুফকর-এ নেই। থাকলে, কানহা অথবা চিপিতেই আছেন।
তুমি চেনো ওঁকে?
ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তবে পালামৌর বিভিন্ন জঙ্গলে অনেকবারই দেখেছি যখন শিকার করতে গেছেন। পঞ্চাশের দশকে, ষাটের দশকে।
ঋজুদা বলল।
সে কী! উনি শিকার করেন নাকি? উনি তো কনসার্ভেশানিস্ট। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফাণ্ডের একজন মাতব্বর তো।
তাতে কী? যাঁরা এক সময়ে ভাল শিকারী ছিলেন তাঁরাই সবচেয়ে ভাল কনসার্ভেশানিস্ট হন। নিয়ম মেনে শিকার করাটা কখনওই পৃথিবীর কোথাওই অপরাধ বলে গণ্য হয়নি। আজও হয় না। যে-কোনও ব্যাপারেই অনিয়মানুবর্তিতা আর বাড়াবাড়িই সব কিছু সর্বনাশের মূলে। ইংরেজ আমলে তো এমন কনসার্ভেশানের প্রয়োজন হয়নি। আমরা যেই স্বাধীন হলাম, সঙ্গে-সঙ্গে ভাবলাম অনিয়মানুবর্তিতাই স্বাধীনতার চরম প্রকাশ। অকাট্য প্রমাণ! ফলে, যা হবার তাই হল।
বোদ্ধা কাকু যে বলেন, শিকার করার মতো পাপ আর নেই? শিকারিরা ঘৃণ্য।
ভটকাই বলল।
বোদ্ধা কাকুটি কে?
বাঃ। বোদ্ধা কাকুকে চিনিস না? তাঁকে কেনা চেনে! কলকাতার অ্যানাদার আঁতেল!
তাই? তিতির বলল, ইমপ্রেসড হয়ে।
তাই।
ভালই তো। এমন মানুষ দু-চারজন ধারে কাছে থাকলেও নিজেদের জ্ঞানের সঙ্গে তাঁদের জ্ঞানের ঠোকাঠুকি লেগে সকলেরই জ্ঞানের দীপ্তি বাড়ে।
ঋজুদা বলল।
হ্যাঁ, ঘৃণ্য শব্দটা অনেককেই ব্যবহার করতে দেখি আজকাল। অথচ ভদ্রলোকমাত্রেরই জানা উচিত যে, ঘৃণ্য শব্দটাই ঘৃণ্য। যাঁরা ঘৃণ্য শব্দটি ব্যবহার করেন তাঁরাই ঘৃণ্য। তবে সব দেশেই অশিক্ষিত, সবজান্তা মানুষেরা অমন অনেক কিছুই বলেন। সকলের কথাই যদি শুনতে হয় তবে তো নিজেদেরই পাগল হয়ে যেতে হয়।
অ্যান রাইট একা যেতেন পালামৌতে? শিকারে?
একা কখনওই আমি দেখিনি। ওঁর স্বামী বব রাইট তখন বেঙ্গল পেপার মিল, (আনন্ডু উইল) কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ডালটনগঞ্জের এম এল বিশ্বাস অ্যান্ড কোম্পানি তাঁদের কাগজের কলের জন্যে বাঁশ সাপ্লাই করতেন। পালামৌ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্রতি বছরই ইজারা নিতেন ওঁরা, বাঁশ সাপ্লাই করার জন্যে। প্রতি বছর শীতকালে বব এবং অ্যান রাইট আসতেন শিকারে। একবার অ্যান রাইটকে দেখেছিলাম, জন নামের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রলোকের সঙ্গেও। যতদূর মনে পড়ে, শীতকালেই।
তুমি কী করতে যেতে?
আমিও শিকারেই যেতাম। ঢেঁকি তো ধান ভানতেই যাবে। যেতাম বিশ্বাসদেরই অতিথি হয়ে। আমার জন্যেও অন্য ফরেস্ট ব্লক এবং ফরেস্ট বাংলো বুক করা থাকত। শিকারের পারমিটও। রাইট-দম্পতির প্রিয় জায়গা ছিল গাড় আর মারুমার। তখন গাড়র বাংলো ছিল ছোট্ট। কোয়েল নদীর পাশে। নতুন বাংলোটা তো এই সেদিন হল।
ততক্ষণে জিপটা সুফকর-এর বাংলোর হাতায় ঢুকে পড়ল।
ভটকাই বলল, চা তো আমাদের সঙ্গে ফ্লাস্কেই আছে। বাংলোর বারান্দায় বসে চা খেতে-খেতে তোমার সুফকর-এর সেই জোড়া বাঘের গল্পটা আমাদের বলতে হবে কিন্তু। ঊ্য প্রমিসড আস।
হ্যাঁ। তবে বাঘ তো আমার নয়। আমার কৃতিত্ব ও ব্যাপারে কিছুমাত্রই ছিল না। অকৃতিত্বও অবশ্য ছিল না। বলবখন।
তিতির বলল, না বললে কিন্তু কথার খেলাপ হবে।
জীপটা থামতেই ঋজুদা নামল। আর নামতেই, চৌকিদার এসে সেলাম করল। চৌকিদারের কোয়াটার থেকে একজন বুড়ো মানুষ ফোকলা দাঁতে একগাল হেসে ঋজুদাকে বলল, পররনাম হুজৌর।
ঋজুদা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, কেমন আছ হিরু পানকা?
ভাল হুজৌর। আপনি?
চলে যাচ্ছে হিরু। ইঠা বাইগা আর দেবী সিং কেমন আছে?
কোনও খোঁজ জানি না হুজৌর। কতদিনের কথা! কে যে কোথায় চলে গেছে ছটকে-ছাটকে।
নাম দুটি চেনা চেনা লাগছে যেন! তিতির বলল।
বলেই বলল, মনে পড়েছে। কোনও উপন্যাসে এই চরিত্রদুটি আছে। তাই না?
আছে নাকি? হতে পারে। অনেকেই হয়তো চেনেন এঁদের। জঙ্গলের গভীরে যাঁরা ঘোরেন তাঁরা তো চিনবেনই।
তারপরই ঋজুদা আমাদের দিকে ঘুরে বলল, বুঝেছিস। সুফকর-এর জোড়া বাঘের নাটকে এই মানুষটিই প্রধান-চরিত্র ছিল। এই হিরু পানকা। আমি আসব খবর পেয়েই দেখা করতে এসেছে। দ্যাখ। হাউ নাইস অব হিম! আর কতদূর থেকে এসেছে! একসময়ে ওর বাড়ি ছিল এই সুফকর গ্রামেই। .এখন দূরে চলে যেতে হয়েছে কোর-এরিয়া ছেড়ে, উদ্বাস্তু হয়ে; বনবিভাগের নির্দেশে। পুরো এলাকাটাই তো টাইগার-প্রোজেক্ট নিয়ে নিয়েছে, খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে বৃহত্তর স্বার্থে।
একটু চুপ করে থেকে ঋজুদা বলল, আমরা পূর্ববঙ্গের মানুষ তো! উদ্বাস্তু হতে কেমন যে লাগে, তা বুঝি।
তিতির বেতের চৌকো বাস্কেটটা নামিয়ে ফ্লাস্ক খুলে চা ঢেলে দিল ঋজুদা ও আমাদের। ও নিজে তো এখনও দুগ্ধপোষ্য। তাও আবার সকালে ও বিকেলে ঘড়ি ধরে দুধ খায়।
আমরা সকলে ঋজুদার দু পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। ঋজুদা চা খেতে। খেতে পাইপটাতে তামাক পুরল। তারপর চা শেষ করে ধরাল পাইপটা।
ভটকাই অর্ডার করল, এই তোরা কথা বলবি না আর একটাও। স্টার্ট ঋজুদা।
ভটকাইয়ের দুঃসাহস কমবার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বরং দিনকে দিন তা বেড়েই চলেছে। ঋজুদাকেও ও এমনভাবে ট্যাক্স করে, যেন মারাদোনার পায়ে বল পড়েছে! জানি, উপমাটা ভাল হল না। আমরা ওর সাহস দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যাই। তিতিরের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে আলোচনাও হয় এই নিয়ে কিন্তু করার কিছুই নেই। ঋজুদাই ওকে লাই দিয়ে মাথায় চড়িয়েছে।
একরাশ ধোয়া ছাড়ল ঋজুদা। ইংলিশ গোল্ড-ব্লক টোব্যাকোর মিষ্টি গন্ধে ৩৬৪
ভরে গেল বারান্দাটা। ঋজুদার বন্ধু জ্যাক হিগিন্স আগে পাপুয়া আইল্যান্ডে থাকতেন। এখন লন্ডনেই থাকেন। তিনিই পাঠান ওই টোব্যাকো ওখান থেকে। প্রতি মাসে একটি করে পার্সেল আসে।
