মাতৃভাষার ব্যাকরণ পড়ার উদ্দেশ্য কি?

শেয়ার করুনঃ

Loading

 

মাতৃভাষার ব্যাকরণ পড়ার উদ্দেশ্য কি?

 

এ কথা অনস্বীকার্য, মানুষ তার পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে মাতৃভাষার প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করে। যার ফলে লিখতে-পড়তে না জেনেও পরিবেশ থেকে শুনে শুনে ও নিয়মিত ব্যবহারের মাধ্যমে যে কেউ তার মাতৃভাষা শিখে নিতে পারে। সেইজন্য দেখা যায় যখন একটি শিশু ধীরে ধীরে কথা বলতে শেখে এবং পারিবারিক জীবনে অন্যান্যদের সঙ্গে তার ভাব বিনিময় করতে সচল হয়ে ওঠে তখন সে কিন্তু ‘আমি ভাত খাব’-এর জায়গায় ‘আমি ভাত খাবে’—এ কথা বলে না। সব মাতৃভাষা শেখার ক্ষেত্রে শোনা ও নিয়মিত ব্যবহার দেখার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, অন্তত প্রাথমিক স্তরে। তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে, সে যেভাবে পরিবেশ থেকে ভাষা শেখে তা সঠিক নাও হতে পারে। অনেক সময় পরিবেশকে সঠিকভাবে বুঝতে না পারার জন্য ভাষা শেখা ও ভাষা ব্যবহারে অনেক ভুলত্রুটি থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রেই ব্যাকরণের গুরুত্ব থেকে যায়।

ব্যাকরণ শব্দের অর্থ হল বিশেষ ও সম্যকরূপে বিশ্লেষণ। অর্থাৎ যার দ্বারা শব্দকে ভেঙে তার ভিতর কী কী উপাদান আছে তা দেখানো হয় তাকেই ব্যাকরণ বলে। ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণা এতটা এগিয়ে গেছে যে ব্যাকরণকে বর্তমানে ভাষাবিজ্ঞান চর্চার সমার্থক বলে মনে করা হয়। সেদিক থেকে বললে বলতে হয়, যে-বিদ্যার দ্বারা কোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপটি আলোচনা করা হয় এবং সেই ভাষার পঠনে, লিখনে, অনুশীলনে ও কথোপকথনে শুদ্ধরূপে তার প্রয়োগ করা যায় সেই বিদ্যাকে ব্যাকরণ বলে। সুতরাং বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বলতে অনুরূপভাবে বলা যায়, যে ব্যাকরণের মাধ্যমে বাংলা ভাষার স্বরূপটি সব দিক থেকে আলোচনা করে বুঝতে পারা যায় এবং শুদ্ধরূপে পড়তে, লিখতে ও এর সাহায্যে কথোপকথন করতে পারা যায় তাকেই বাংলা ব্যাকরণ বলা হয়।

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে বঙ্গদেশে মাগধী প্রাকৃতের ব্যাপক প্রচলন ঘটে। এরপর খ্রিস্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে মাগধী অপভ্রংশের খোলস ত্যাগ করে প্রাচীন বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। সুতরাং বাংলা ভাষার ব্যাকরণ শেখার প্রয়োজন আছে। প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে প্রাথমিকভাবে যে-ভাষা শেখা হয় তা অনেকটাই অসংগঠিত থাকে, অশুদ্ধ ও অশিষ্ট প্রয়োগে ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায়। সেইজন্য সংশ্লিষ্ট ভাষার ব্যাকরণও আলাদা করে শিখতে হয়। কার্যত অক্ষরজ্ঞানের আগেই পরিবেশ মাতৃভাষা সম্পর্কে যে অভ্যাস গড়ে তোলে তাকে শুদ্ধভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে লেখাপড়ার নির্ভরযোগ্য করে তোলে ব্যাকরণ। আধুনিক জীবনবোধের সঙ্গে মাতৃভাষার বিবর্তন ও পরিবর্তন যেভাবে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে তাতে মাতৃভাষার ব্যাকরণ শেখার উদ্দেশ্য যে বহুমুখী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

  • প্রথমত, অক্ষরজ্ঞানহীন অবস্থায় পরিবেশ থেকে মাতৃভাষা শেখার ভুল ও ত্রুটিগুলি সংশোধন করার উদ্দেশ্যে মাতৃভাষার ব্যাকরণ শেখার প্রয়োজন আছে।
  • দ্বিতীয়ত, আমরা যদি একটু সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করি, তাহলে দেখতে পাব বাংলা গদ্যরীতির বিবর্তনে অনেক জটিলতা আছে। প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক গদ্যরীতির বিবর্তনে, তার স্বরুপ ও প্রয়োগে এক লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন আছে ব্যাকরণ পাঠ ছাড়া যার সম্যক পরিচয় ঘটে না। এ-ব্যাপারে সম্যক পরিচয় না থাকলে লেখা, পড়া ও প্রয়োগে যথেষ্ট ত্রুটি থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
  • তৃতীয়ত, মাতৃভাষা তো আছেই, তা ছাড়া যে-কোনো ভাষায় ধ্বনি-সম্পৰ্কীয় নিয়ম অর্থাৎ ভাষাগত ধ্বনিগুলির উচ্চারণ কেমন হবে, ধ্বনিগুলির পারস্পরিক প্রভাবে, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কী হয়, শিষ্ট সমাজে প্রচলিত ও পরিবর্তিত উচ্চারণ কী হবে, কবিতা পাঠের ছন্দবিধি কী হবে এবং গদ্যপাঠে যতি বা ছেদ বিধান কী হবে, পর্বভাগ কেমন হবে, ভাষা-লেখায় শুদ্ধ বর্ণবিন্যাস কী হবে এ-সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। আর এ-জ্ঞান আসে ব্যাকরণ পাঠে।
  • চতুর্থত, মাতৃভাষার লিখনে ভাষাশব্দের রূপ-সম্পর্কীয় নিয়ম, ভাষার বাক্যগত শব্দের ক্রম অর্থাৎ বাক্যরীতি ও বাক্য বিশ্লেষণের নিয়ম জানা একান্ত প্রয়োজন। কেননা আধুনিক বাংলা গদ্যরীতির সঙ্গে প্রাচীন এমনকি মধ্যবাংলার গদ্যরীতির এত পার্থক্য যে তা ব্যাকরণ পাঠ ছাড়া অনুধাবন করা সহজসাধ্য নয়।
  • পঞ্চমত, এক সময় আমাদের এই মাতৃভাষার ব্যাকরণ সংস্কৃত ভাষারীতির ব্যাকরণের অনুগামী ছিল। আজকের বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃত রীতির অনুগামী নয়। নানা পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিবর্তনের মাধ্যমে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। পঠনপাঠনে এর স্বাতন্ত্র্য অনুশীলন সাপেক্ষ এবং ব্যাকরণ ব্যতিরেকে তা সম্ভব নয়।
  • ষষ্ঠত, আজকের প্রজন্মের কাছে মাতৃভাষা চর্চার প্রেক্ষিতে উপভাষা চর্চার গুরুত্ব বেড়েছে এবং তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বাংলা ভাষাচর্চার পরিধি ব্যাপক। তার অভ্যন্তরীণ উপভাষাগুলির বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যগুলি অবশ্যই জানা দরকার। এর জন্য ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজন আছে।
  • সপ্তমত, মাতৃভাষা বাংলাকে উচ্চারণে ও লিখনে সহজ-সরল করে তোলার জন্য সংস্কারমুখী চিন্তা-চেতনায় যে বানানবিধি স্বীকৃত হয়েছে, ধ্বনিতত্ত্বে, রূপতত্ত্বে জটিলতা মুক্ত হওয়ার যে প্রয়াস দেখা দিয়েছে তা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে গেলে ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে শিক্ষা-শিক্ষার্থী-শিক্ষকের পারস্পরিক সমন্বয় ছাড়া আধুনিক সংস্কারমুখী চিন্তা-চেতনার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে সার্থক করে তোলা যাবে না।

 

*তথ্যসুত্র: আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি।

 

0
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

বিদ্যাকল্পে গল্প ও অডিও স্টোরি প্রকাশ করার জন্য আজই যুক্ত হন