বাংলা গল্প ‘সম্পর্ক’ – প্রফুল্ল রায়

শেয়ার করুনঃ

বাংলা গল্প 'সম্পর্ক' - প্রফুল্ল রায়

 

অফিস ছুটি হতে কয়েক মিনিট বাকি। এখন ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে সাত।

আধ ঘণ্টা আগে আজকের সব কাজ শেষ করে ফেলেছিলেন অবনীশ। তখনই বেরিয়ে পড়তে পারতেন। কিন্তু সারা জীবন তিনি ডিসিপ্লিন মেনে এসেছেন। অফিস আওয়ার্স দশটা থেকে পাঁচটায়। তিরিশ বছর এই নিয়মেই চলে আসছে।

অবনীশ স্যানাল একটা মালটিন্যাশনাল কোম্পানীর টপ একজিকিউটিভ। বয়স চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন। চওড়া কপালের ওপর থেকে ব্যাক-ব্রাশ করা চুল ; বেশির ভাগটাই কুচকুচে কালো, ফাঁকে ফাঁকে দু-চারটে রূপোর তার হয়ে গেছে। নিখুঁত কামানো মুখ অবনীশের, থুতনির মাঝখানে অল্প একটি ভাঁজ। পুরু লেন্সের চশমার পিছনে উজ্জ্বল চোখ। অ্যাভারেজ বাঙালীদের চেয়ে তাঁর হাইট বেশ ভাল, প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি। তাঁকে ঘিরে রয়েছে ব্যক্তিত্বের একটা কোটিং, তবে, সেটা দুর্ভেদ্য নয়। আলাপ হলে বোঝা যায় মানুষটি ভদ্র, মার্জিত এবং সহানুভূতিশীল! ব্যবহার চমৎকার।

এই মুহূর্তে চেম্বারে অবনীশ ছাড়া আর কেউ নেই। বেয়ারাকে দিয়ে অ্যাটাচি কেস আগেই গাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর সাত মিনিট পর তিনি উঠবেন। শোফার অফিসের পার্কিং জোনে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে।

অবনীশের চেম্বারটি বড়ো মাপের। ফ্লোর নীল কার্পেটে মোড়া। দেওয়ালের প্লাস্টিক পেইন্ট থেকেও নীলাভ দ্যুতি বেরিয়ে আসছে। সীলিং ধবধবে সাদা।

ঠিক মাঝখানে আধখানা বৃত্তের আকারে বিরাট গ্লাস-টপ টেবিল। সেটার পেছনে রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন অবনীশ। সামনে টেবিলটাকে ঘিরে গদীমোড়া ফ্যাশনেবল দশটি চেয়ার। ফাইল কোম্পানি ল, লেবার ল এবং ইনকাম ট্যাক্স, ট্রেড এবং ইন্ডাষ্ট্রি বিষয়ে বিভিন্ন বই, ইয়ার বুক, ম্যাগাজিন ইত্যাদি রাখার জন্য দেয়ালের ভেতর ক্যাবিনেট বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। সামনে দিকে শুধু টানা কাচের পাল্লা। আরেকটা দেয়াল কেটে অ্যাকুয়েরিয়াম বসিয়েছেন, সেখানে লাল- নীল মাছেদের খেলা। একটি দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের অন্য দেয়ালে যামিনী রায়ের বড় দু’টি পেইন্টিং। তার সামনের টেবিলে নানা রঙের চারটে ফোন, পেন স্ট্যান্ড, টেবল ক্যালেণ্ডার ইত্যাদি। মোট কথা চেম্বারটিতে সুরুচির ছাপ রয়েছে।

এটা তো মে মাস, এই বিকেলেও যে কলকাতার ওপর দিয়ে প্রায় লু বাতাস ছুটছে, অবনীশদের এয়ার কণ্ডিসাণ্ড অপিসে বসে টের পাওয়া যায় না। এখানে রয়েছে আরামদায়ক শীতলতা।

পাঁচটা বাজতে যখন কয়েক সেকেণ্ড বাকি সেই সময় ফোন এলো। ‘হ্যালো’—বলতেই লাইনের ওপার থেকে চেনা গলা ভেসে আসে, ‘আমি বুবুন—’

বুবুন এবার অনেক দিন বাদে ফোন করল। তার ফোন এলে কিংবা ক্বচিৎ কখনও সে নিজে এসে পড়লে খুবই খুশি হন অবনীশ, সেই সঙ্গে নিজের অজান্তে এক ধরনের আড়ষ্টতা বোধ করেন। তাঁর সঙ্গে বুবুনের সম্পর্কটা অদ্ভুত। রীতিমত জটিল বলা যায়, কিন্তু সে কথা পরে।

অবনীশ বললেন,—‘তিন উইক পর তোমার গলা শুনলাম। কেমন আছ?”

বুবুন বলল, ‘ভাল না। আমার—আমার’ তার গলা ধরা ধরা জড়ানো। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেছে সে।

এরকম আগে কখনও হয়নি! চমকে উঠলেন অবনীশ, ‘কি হয়েছে বুবুন?’ তাঁর কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা মাখানো।

টেলিফোনের তারের ভেতর দিয়ে বুবুনের কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো? সে সমানে ফোঁপাচ্ছে।

অবনীশের উদ্বেগ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বলেন, ‘কী হয়েছে বুবুন? বল— বল’।

ফোঁপাতে ফোঁপাতে বুবুন বলে, ‘আমার বাবা, আমার বাবা—

ফোনটা প্রায় মুখের ওপর চেপে ধরে অবনীশ জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাবার কী হয়েছে?’

‘আজ সকালে মারা গেছেন।’

অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন অবনীশ। তারপর খুব আস্তে, কাঁপা গলায় বললেন, ‘তোমার বাবা অসুখে ভুগছিলেন বলে তো শুনিনি। কী হয়েছিল?’

বুবুন বলল, ‘স্ট্রোক। এরপর সে যা বলে তা এইরকম। সকালে সোমনাথ ঘুম থেকে উঠে বাসিমুখে মিনিট পনেরো ফ্রী-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতেন। শরীরে যাতে এক্সট্রা ফ্যাট না জমে সেদিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। ব্যায়ামের পর পনেরো মিনিট জিরিয়ে, শেভ-টেভ করে ঠাণ্ডা জলে স্নান। স্নানের পর চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়া। তারপর সাড়ে আটটা থেকে ন’টার ভেতরে অফিসে বেরিয়ে পড়তেন। সকালের দিকে এটাই ছল তাঁর প্রতিদিনের রুটিন। অবশ্য ছুটির দিনগুলো এই রুটিনের বাইরে। সে সব দিনে তিনি একটু আধটু অনিয়ম করতেন।

আজ সকালে স্নান-টানের পর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে স্ট্রোকটা হয়। ম্যাসিভ অ্যাটাক! হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কিছুই করা যায়নি। তার আগেই সব শেষ!

সোমনাথ সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানেন না অবনীশ! বুবুনকে যদিও বছর দশেক দেখছেন তবু তার বাবার ব্যাপারে কোনদিন একটি কথাও হয়নি। তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাপন কেমন ছিল, সে সম্পর্কে সামান্য কিছু খবর আজ প্রথম জানা গেল। যিনি স্বাস্থ্য এবং বাড়তি মেদ সম্বন্ধে এতটা সতর্ক, হঠাৎ তাঁরই কিনা স্ট্রোক হয়ে বসল। কোন মানে হয় না।

অবনীশ ভারী গলায় বললেন, ‘ডেড বডি এখন কোথায়?’

‘হাতপাতাল থেকে রিলিজ করে দেবার পর কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। আধ ঘণ্টার ভেতরে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে।’

‘এমন একটা সাডেন আন—এক্সপেক্টড ডেথ্ ভাবাই যায় না। তোমাকে কী যে বলব, বুঝতে পারছি না। এ সময় ভেঙে পড়লে চলবে না বুবুন। মনে জোর আনো।’ খুব আন্তরিকভাবেই বললেন অবনীশ। কণ্ঠস্বরে সহানুভূতি মাখানো!

বুবুন উত্তর দিল না, টেলিফোনের লাইনের ভেতর দিয়ে তার চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল।

সস্নেহে ভারী গলায় অবনীশ বললেন, ‘কেঁদো না বুবুন। এখন বল, শ্মশানে যাবার ব্যাপারে আমাকে কি কিছু করতে হবে?’

বুবুন ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘না। জ্যেঠামশাই আর কাকারা সব ব্যবস্থা করছেন।’ একটু থেমে আবার বলল, মাকে কি খবরটা দেব?

হকচকিয়ে গেলেন অবনীশ। বুবুনের বাবার মৃত্যুর সঙ্গে অন্য একটা দিক যে জড়িয়ে আছে তা খেয়াল ছিল না। কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো বসে থাকার পর রুদ্ধশ্বাসে বললেন হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই খবর দেবে। আমাদের বাড়িতে ফোন কর।’

‘আচ্ছা।’ বুবুন লাইন কেটে দিল।

আস্তে আস্তে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন অবনীশ। নিচে শোফার যে গাড়ি নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে, তা একেবারেই ভুলে গেলেন।

বুবুনের মা অর্থাৎ শোভনা একসময় ছিল সোমনাথের স্ত্রী। বারো বছর আগে তার ডিভোর্স হয়ে যায়। এর বছর দুই বাদে অবনীশের সঙ্গে রেজিস্ট্রী ম্যারেজ। আগের পক্ষের একটি ছেলে রয়েছে শোভনার——বুবুন! অবনীশের সঙ্গে বিয়ের সময় বুবুনের বয়স ছিল দশ। ইকনমিক অনার্স-এ পার্ট টু দিয়েচে। ডিভোর্সের সময় কোর্ট থেকে যে রায় দেওয়া হয়েছিল, তাতে ছেলের অধিকার পেয়েছিলেন সোমনাথ। বুবুন তাঁর কাছেই থাকে। তবে শোভনার বা বুবুনের ইচ্ছে হলে পরস্পরকে দেখে আসতে পারে। পূর্বতন স্বামীর বাড়ীতে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসার প্রশ্নই নেই! প্রথম প্রথম দু-তিন বছর ড্রাইভারকে দিয়ে বুবুনকে শোভনার কাছে পাঠিয়ে দিতেন সোমনাথরা। একটু বড়ো হবার পর বুবুন একাই আসতে শুরু করে।

Bengali Story Golpo Shomporko written by Prafulla Roy

শোভনার সঙ্গে অবনীশের আলাপ পহেলগাঁওয়ে। সেবার কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়েছিল অবনীশ! রোজই তাঁর চোখে পড়ত লিডার নদীর পাড়ে বসে একটি অত্যন্ত সুশ্রী তরুণী ছবি আঁকছে। দূর থেকে তাকে অবাঙালী মনে হয়েছিল।

দু-তিন দিন লক্ষ্য করার পর নিজেই এগিয়ে গিয়ে আলাপ করেছিলেন অবনীশ ; প্রথমে ইংরেজিতে। তারপর নাম এবং পদবী শুনেই জানা গিয়াছিল মেয়েটি বাঙালী।

পহেলগাঁও-এর সেই আলাপ কলকাতায় এসে ঘনিষ্ট হয়েছিল, শোভনা কিছুই লুকোয়নি। সে ডিভোর্সী এবং তার একটি সন্তান আছে—সবই অসঙ্কোচে জানিয়ে দিয়েছে। শোভনার স্বভাবটি খুবই নরম, তবু তারই মধ্যে কোথায় যেন দৃঢ়তা আছে। সে যে নিজের অতীত গোপন করেনি, এই অকপটতা ভাল লেগেছিল। অবনীশের, তার সম্বন্ধে শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল।

এমন একটি নম্র স্নিগ্ধ স্বভাবের মেয়ের সঙ্গে কারো যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটতে পারে, তা যেন ভাবাই যায় না। সোমনাথের সঙ্গে কেন বনিবনা হলো না, কী কারণে সম্পর্কটা চিরকালের মতো ছিঁড়ে গেল—এ বিষয়ে কখনও কিছু বলেনি শোভনা, অবনীশও জানতে চাননি। বুবুন, না থাকলে জানাই যেত না আগেই তার একটি বিবাহিত জীবন ছিল। সোমনাথের সঙ্গে আদৌ তার শারীরিক এবং মানসিক সম্পর্ক ঘটেছিল, এটা কোনদিন বুঝতে দেয়নি শোভনা। অন্য একটি পুরুষের সঙ্গে জড়ানো জীবনের কয়েকটা বছর একেবারে মুছে দিয়ে অবনীশের কাছে এসেছিল শোভনা।

বিয়ের আগে শোভনা শুধু জানিয়েছিল, বুবুন যদি মাঝে মধ্যে আসে বা ফোন করে, অবনীশের আপত্তি হবে কিনা। অবনীশ তক্ষুণি জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। শুধু তা-ই না, বুবুন ইচ্ছা করলে তাদের কাছে এসে থাকতে পারে। কোনো দিক থেকে বাধা না এলে বুবুনের সব দায়িত্ব নিতে যে তিনি রাজী, এটাও আভাসে জানিয়ে দিয়েছিলেন। বাধা আসার কথা সোমনাথের দিক থেকে! তাঁর নাম না করেই ইঙ্গিতটা দিয়েছিলেন। অবশ্য এ ব্যবস্থায় সায় ছিল না শোভনার। কেননা বুবুনের ব্যাপারে কোর্টের রায় সোমনাথের পক্ষে।

প্রথম প্রথম বুবুন এলে খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে যেতেন অবনীশ। কিন্তু ছেলেটা পুরোপুরি মায়ের স্বভাব পেয়েছে—তেমনই মধুর কোমল এবং নম্র। আস্তে আস্তে তার সঙ্গে চমৎকার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে লাগল। সেটা বুবুনের গুণে। কোনো কিছু বলেই তাঁকে ডাকে না বুবুন। মায়ের দু’নম্বর স্বামীকে কী বলে ডাকা যায়, সে জানে না। অবনীশও অবশ্য জানেন না। তিনি লক্ষ্য করেছেন, সম্বোধনটা খুবই কৌশলে এবং সতর্কভাবে এড়িয়ে যায় বুবুন। মজাই পান অবনীশ।

বুবুন তাঁর সম্পর্কটা অনেক সহজ এবং স্বাভাবিক করে দিয়েছে। তবু কোথায় যেন অল্প একটু জট থেকেই গেছে। সেটা হয়তো থাকত না, যদি তাঁর নিজের ছেলে কি মেয়ে হতো।

 

কতক্ষণ বসে ছিলেন, খেয়াল নেই অবনীশের। হঠাৎ একটা ভীরু গলার ডাক কানে আসে, ‘সাব—’

চমকে সামনে তাকাতেই চোখ পড়ে শোফার এবং তাঁর নিজস্ব বেয়ারা দাঁড়িয়ে আছে।

শোফার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘সাব, আপকা তবিয়ত আচ্ছা নেহি?’

শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ান অবনীশ, না না, আমি ঠিক আছি।’ দ্রুত ঘড়ি দেখে বলে, ‘সাতটা বেজে গেছে। অনেকক্ষণ তোমাদের আটকে রেখেছি!’ বলতে বলতে এগিয়ে যান। বেয়ারার সসম্ভ্রমে দরজা খুলে দেয়।

বাড়ি ফিরে অবনীশ খবর পান, একটা ফোন পেয়ে বিকেলে বেরিয়ে গেছে শোভনা। ফোনটা কার তিনি জানেন। কিন্তু সে কোথায় গেছে, সোমনাথদের বাড়িতে কিনা, এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত নন।

বেডরুমে গিয়ে অফিসের পোশাক ছেড়ে সোজা বাথরুমে চলে যান অবনীশ। ‘স্নান-টান করে পাজামা পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এসে সোফায় বসতে না বসতেই কাজের মেয়েটা চা এবং খাবার নিয়ে আসে। বাড়িতে থাকলে এসব শোভনাই নিজের হাতে করে।

কাজের মেয়েটি অর্থাৎ কমলা বলল, ‘বৌদি আপনাকে খেয়ে নিতে বলেছেন।’

অবনীশের খাওয়ার ইচ্ছা নেই। অন্যমনস্কর মতো চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বলেন, ‘কখন ফিরবে, বলে গেছে?’

‘না’।

একটু ভেবে দ্বিধান্বিতভাবে এবার অবনীশ জিজ্ঞেস করেন, কোথায় গেছে, জানো?’

‘না।’ কমলা মাথাটা সামান্য কাত করে বলে, ‘কিছু বলে যায়নি।’

অবনীশ আর কোনো প্রশ্ন না করে বললেন, ‘খাবারগুলো নিয়ে যাও।’

চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে কমলা। তারপর ভয়ে ভয়ে বলে, ‘খাবেন না? বৌদি শুনলে—’

তার মনোভাব বুঝতে পারেন অবনীশ! তিনি খাননি জানতে পারলে শোভনায়কমলার ওপর বিরক্ত হবে, হয়তো বকাবকিও করবে। অল্প হেসে বললেন, ‘ভয় নেই। বৌদিকে যা বলার আমি বলব—’

কমলা খাবারের প্লেটগুলো তুলে নিয়ে চলে যায়। আর অবনীশ চা খেয়ে দু তিনটে ম্যাগাজিন নিয়ে বিছানায় এসে আধশোয়া ভঙ্গিতে পাতা ওল্টাতে থকেন। কিন্তু একটা লাইনও পড়া হয় না ; চোখের সামনে অসংখ্য কালো হরফ একেবারে দুর্বোধ্য হয়ে আছে যেন।

এই ঘরের দেয়ালে শোভনার কয়েকটি ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। ওয়াশের কাজ করা ছবিগুলো এক কথায় চমৎকার। শোভনা একজন দুর্দান্ত আর্টিস্ট। আর্ট কলেজের ডিগ্রি আছে তার।

ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে দেয়ালের দিকে তাকান অবনীশ। কিন্তু ছবিগুলো তাঁর কাছে ঝাপ্‌সা লাগে। এই শোবার ঘর, খাট, ডিভান, ফ্যাশনেবল ক্যাবিনেট, জানালার বাইরে রাতের কলকাতার দৃশ্যাবলী—কিছুই যেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। দূরমনস্কর মতো শোভনার কথাই ভাবতে থাকেন। এখনও ফিরে আসছে না কেন সে?

বাইরে একটা ওয়াল ক্লক হারমোনিয়ামের মতো আওয়াজ করে বেজে যায়। মিউজিক্যাল ঘড়িটায় যখন দশটা বাজে সেই সময় হঠাৎ মৃদু শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকান অবনীশ। দরজার ফ্রেমের মাঝখানে স্থির একটা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে শোভনা ; তার লালচে এবং ফোলা ফোলা চুল উস্কখুস্ক পরণের শাড়িটা অগোছালো। উগ্রভাবে কখনোই সাজে না সে, তার সাজের মধ্যে থাকে রুচির ছাপ। কিন্তু এই মুহূর্তে শোভনার পোশাক-টোশাকে পরিপাট্য নেই। বোঝা যায় তার ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে।

অবনীশ কয়েক পলক শোভনার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর আস্তে আস্তে উঠে আসেন। বলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে—বুবুনদের বাড়ি?’

চোখ নামিয়ে নেয় শোভনা। আস্তে মাথা নাড়ে অর্থাৎ সেখানে যায়নি।

অবনীশ জিজ্ঞেস করেন, ‘তা হলে?’

কাঁপা গলায়, শোভনা বলে, শ্মশানে গিয়েছিলাম।’

‘এখানকার কাজ শেষ হয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

অবনীশ লক্ষ্য করেন, কথা বলতে গিয়ে শোভনার ঠোঁট দুটি ভীষণ কাঁপছে।

গভীর সহানুভূতিতে স্ত্রীর কাঁধে একটি হাত রেখে তাকে কাছে টেনে আনেন অবনীশ। কোমল স্বরে বলেন, ‘ঘরে এস।’

অবনীশের স্পর্শে শোভনার মধ্যে বিপর্যয়ের মতো কিছু ঘটে যায়। স্বামীর বুকে মুখ রেখে হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে কেঁদে ওঠে সে।

স্ত্রীর কান্নার শব্দ শুনতে শুনতে অবনীশ টের পান, অতীতটা পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি শোভনা। সোমনাথের জন্যও তার বুকের কোথাও অনাবিষ্কৃত গোপন একটি দিকও ছিল।

 

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments