ভাষা কি? ভাষার বৈশিষ্ট্য কি? বাংলা ভাষা কি?
ভাষা কি অথবা কাকে বলে?
বহির্জাগতিক পরিবেশে মানুষের মনে যে ভাবের উদয় হয় সে তার কণ্ঠ, নাসিকা, জিহ্বা, দন্ত প্রভৃতি বাগ্ যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা তা প্রকাশ করে থাকে। এইভাবে এক বা একাধিক ধ্বনির যোগে বিশেষ ভাব-প্রকাশক অর্থবহ এক-একটি শব্দ বা পদ গঠিত হয়। বস্তুত বিশেষ কোনো মানবসমাজে ব্যবহৃত এরূপ শব্দ বা পদের সমষ্টি নিয়ে সেই সমাজের মধ্যে প্রচলিত ভাষা গঠিত হয় এবং এর সাহায্যেই মানুষ পরস্পরের মধ্যে ভাব বিনিময় করে। সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে দেখা যায় ভাষার দুটি মুখ্য দিক আছে—একটি বহিরঙ্গ, অপরটি অন্তরঙ্গ। অন্তরঙ্গ হল অর্থ, বহিরঙ্গ হল ধ্বনি এবং ধ্বনিগুলি হল অর্থের প্রতীক। আমরা যখন ‘মানুষ’—এই শব্দটি উচ্চারণ করি তখন শুধু ‘ম্ + আ + ন্ + উ ষ্’—এই ধ্বনিসমষ্টি বুঝি না, সমগ্র ধ্বনিসমষ্টির দ্বারা মনের মধ্যে এক বিশেষ রূপ- গুণসম্পন্ন প্রাণীর স্বরূপটি অনুভূত হয়।
সুতরাং আমরা ভাষা সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে ভাষা হল— মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবহ ধ্বনিসমষ্টি, যা কোনো বিশেষ জনসমাজে স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহৃত অর্থাৎ বাক্যে প্রযুক্ত শব্দসমষ্টি। সেইজন্য দেশ-কাল-সমাজভেদে ভাষারও রূপভেদ দেখা যায়।
ভাষার বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ভাষার স্বরূপকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে প্রধানত পাঁচটি বৈশিষ্ট্য উদ্ধার করা যায়।
- প্রথমত, ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে যে-কোনো ধ্বনিসমষ্টি কিন্তু ভাষা নয়, শুধুমাত্র মানুষের বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবহ ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা।
- দ্বিতীয়ত, মানুষের বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনিমাত্রই আবার ভাষা নয়। সেই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে বিশেষ বিশেষ ভাব বা বস্তুর প্রতীক (Symbol) হতে হবে। ধ্বনি যদি কোনো ভাবের বাহন বা প্রতীক না হয় তাকে ভাষা বলা যাবে না। সেইজন্য পাগলের অর্থহীন ধ্বনি বা শিশুর অস্ফুট চিৎকার মানুষের বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি হলেও তাকে ভাষা বলা যায় না। কেননা তার দ্বারা কোনো ভাব বা বস্তুর প্রতিষ্ঠিত প্রতীক স্পষ্ট হয়ে ওঠে না।
- তৃতীয়ত, ভাষার স্বরূপ-বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণে ধ্বনির প্রতীকধর্মিতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এই প্রতীকধর্মিতার রূপভেদ আছে। বিশেষ বিশেষ ভাষা-সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ বস্তু বা ভাবকে প্রতীকী করে তোলে বিশেষ বিশেষ ধ্বনিসমষ্টি। সেইজন্য বলা যায়—ভাষার মধ্যে ব্যবহৃত কোন্ ধ্বনিটি কোন্ ভাবের প্রতীক সে সম্পর্কে কোনো কার্যকারণগত সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। ‘জল’ বলতে যে তরল পদার্থকে আমার বুঝি তার সঙ্গে ‘জল’ শব্দটির ধ্বনিসমষ্টির কোনো অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক নেই। কেননা পৃথক পৃথক ভাষার মানুষ এই পদার্থটিকে বোঝাবার জন্য পৃথক পৃথক ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহার করে। যেমন এই একই তরল পদার্থকে বোঝাবার জন্য বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ‘জল’ বলে, হিন্দি-সম্প্রদায় ‘পানি’ বলে, ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষ ওয়াটার (water) বলে। আবার ভিন্ন ভিন্ন কালের মানুষ একই শব্দকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করতে পারে। যেমন এক সময়ে ‘পাষণ্ড’ শব্দের অর্থ ছিল বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায় এখন তার অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘অত্যাচারী’। এক সময় ‘মণ্ডপ’ শব্দের অর্থ ছিল মণ্ড পান করার স্থান, এখন পূজা-প্রাঙ্গণ। ফলে কোনো ভাব বা বস্তুকে প্রকাশ করার জন্য আমরা যে-কোনো ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহার করতে পারি আর সমাজে সেটা গৃহীত হলেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
- চতুর্থত, ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিগত প্রতীকগুলি সমাজে স্বীকৃতিলাভের পর শব্দের মধ্যে বা বাক্যের মধ্যে এদের খেয়ালখুশিমতো সাজানো যায় না। এদের বিন্যাস প্রথাগত ও বিধিবদ্ধ হওয়া দরকার। সব ভাষায় বিন্যাসের রীতি ও প্রথা এক নয়। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, ফরাসি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন রীতি আছে। বাংলায় শব্দের ক্ষেত্রে ‘যমুনা’ শব্দের ধ্বনিগুলিকে উলটে ‘নাযমু’ যেমন বলা যায় না, তেমনি বাক্যের পদবিন্যাসেরও একটি বিধি আছে। ‘বাঘ মানুষ খায়’—একে যদি লেখা যায় ‘মানুষ বাঘ খায়’ তাহলে ভাবগত পার্থক্য এসে যায়, কিছুটা বাস্তবতা হারায়। সুতরাং ভাষার ক্ষেত্রে ধ্বনি বা শব্দ বিন্যাসের প্রথানির্ভর বিধিবদ্ধতা অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- পঞ্চমত, বিশেষ বিশেষ ভাষা বিশেষ বিশেষ সমাজের প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হয়, বস্তুত সমাজ না থাকলে ভাষার কোনো প্রয়োজনই হত না। ভাষা মানুষের বাগ্যন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত হলেও সামাজিক উপযোগিতাই পরোক্ষভাবে ভাষা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। সংক্ষেপে ভাষা ও ভাষার বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে আলোচনা করা হল। এই আলোচনার সূত্র ধরে বাংলা ভাষার একটি সংজ্ঞা নির্দেশ করা যেতে পারে—
বাংলা ভাষা কি ? অথবা এর সংজ্ঞা কি?
পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ত্রিপুরা এবং বিহার ও আসামের কোনো কোনো অংশে বসবাসকারী বাঙালি জনসমাজে মানুষের বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে যে-সমস্ত অর্থবহ, বিধিবদ্ধ, প্রথাসিদ্ধ ধ্বনির সাহায্যে পারস্পরিক মনের ভাব বিনিময় করা হয় তাদের সমষ্টিকে বাংলা ভাষা বলে।