মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘টিকটিকি’

শেয়ার করুনঃ

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছোটগল্প 'টিকটিকি' Bengali Story Tiktiki Golpo Manik Bandopadhyay

 

দোতলা বাড়ি। শহরের যে অঞ্চল বেজায় শহুরে বলে খ্যাত সেইখানে। তিনদিকে গাদা করা বাড়ির চাপ, একদিকে রাজপথের চটুল ফাজলামি, আবেস্টনীকে লক্ষ করলে সন্দেহ হয় সমস্তটাই বুঝি হাই মায়োপিয়ার লীলা। তা ছাড়া, এমন চেহারা বাড়িটার যে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা অসবর্ণ রহস্যের মতো কুৎসিত। সস্তা মেয়েমানুষ যেন পথিকের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, আমি ভীরু ও সরলা, খাঁটি গাঁয়ের মেয়ে, তবে অসতী। বে-আবরু সমতল পিঠে পুরানো বাদামি রঙের আবরণটা চোখেই পড়তে চায় না, প্রাচীনতার ছাপ এত বেশি।

দোতলা বাড়ি বটে, একতলা-দোতলায় কিন্তু সিঁড়ির যোগাযোগ নেই। তিনটি সদর দরজার ডাইনেরটি দিয়ে ঢুকলেই খাঁচাবন্দি দোতলার সিঁড়ি। অকারণ নড়াচড়ার একটু স্থান অবশ্য আছে, কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠা অথবা পথে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই কোনোদিকেই। দোতলায় থাকেন ইতিহাসের প্রফেসার, সদর দরজাটির পাশে ছোট পিতলের ফলকে যিনি এম. এ.। একতলায় থাকেন জ্যোতিষার্ণব, বাকি দুটি সদর দরজার উপরে কাঠের ফ্রেম লাগানো রঙিন টিনের মস্ত সাইনবোর্ডে যিনি প্রথিতযশা। দুটি দরজাই একটি ঘরের, যার বেশির ভাগ জ্যোতিষার্ণবের গণনালয়, বাকিটুকু অন্দরের প্যাসেজ। তিনটি সদর দরজার মাঝেরটি দিয়ে ঢুকলেই ডাইনে দোতলার সিঁড়ি আড়াল করা দেয়াল আর বাঁয়ে দুটি বই-ভরা আলমারির বে-আবরু পিঠ। এগিয়ে এগিয়ে যখন অন্দরের দরজা ডিঙিয়ে জ্যোতিষার্ণবের আবছা অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে অন্দরে পদার্পণ না করে প্রায় আর উপায় থাকে না, তখন দেখা যায়, আলমারির দেয়াল একেবারে অন্দরের দেয়ালে গিয়েঠেকেনি, ফাঁক  আছে হাতখানেক। এই ফাঁকটুকু দিয়ে জ্যোতিষার্ণব নিজে আর তার নিজের লোক অন্দর থেকে গণনালয়ে যাতায়াত করে।

বাইরের লোক আসে তিন নম্বর সদর দরজা দিয়ে। এসে ডবল চৌকির ময়লা ফরাশেই হোক আর অয়েলক্লথ-মোড়া টেবিলের সামনে কাঠের চেয়ারেই হোক, বসে। বসে চারিদিকে তাকায়, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধা, আশা-নিরাশার ভারে বিব্রত চোরের মতো। যা চোখে পড়ে তাই মনকে নাড়া দেয়, দেয়ালের টিকটিকি পর্যন্ত। সস্তা মেয়েমানুষ যেন সমস্ত পরপুরুষের দৃষ্টি নিয়ে নিজের সমালোচনা করছে, আমার কী উপায় হবে?

আসলে, এছাড়া প্রশ্নও নেই জগতে। সবকিছুতেই এই সমস্যার ছাপ মারা। ভবিষ্যৎ কি সবকিছুকে গ্রাস করে নেই?

জ্যোতিষার্ণবের কপালে চন্দনের ফোঁটা দেবার সময় তার ছেলেমেয়ের মা মাথা কাত করে, চোখ উলটে দেয়, মোটা আলগা ঠোঁট দুটিকে টান করে হাসে। জ্যোতিষার্ণবের অপরাধ, সাত বছর আগে এই ভঙ্গি তাকে ভুলিয়েছিল। তবে কেবল ভঙ্গি নয়। সেই সঙ্গে জিজ্ঞাসাও করে, ‘আমি মরলে তোমার কী উপায় হবে?

জিজ্ঞাসা করে সকালবেলা আর মরে যায় সেই সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে, তবু মনে হয় প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করেই যেন সে মরে গেল।

অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ যার নখদর্পণে সেও বুঝতে পারে না ব্যাপারখানা কী। তার ছেলেমেয়ের মা মরণের কথা বলবে মনে করার আগেই মাথার উপর কড়িকাঠে যে টিকটিকিটার লেজ নড়তে আরম্ভ করেছিল, তার ছেলেমেয়ের মা মরণের কথা বলার পরে সেই টিকটিকিটাই যে আর একটা টিকটিকিকে তার ছেলেমেয়ের মা হতে ডেকেছে, এইটুকু কেবল জ্যোতিষার্ণব জানে না। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? আর সব তো তার জানা আছে, যা কিছু মানুষের জানা দরকার। ওই জ্ঞানটুকু লাভ করলেই কী তার মনের এ ধাঁধা মিটে যেত যে, তার ছেলেমেয়ের মা মরবে বলে টিকটিকিটা ডেকেছিল অথবা টিকটিকিটা ডেকেছিল বলেই তার ছেলেমেয়ের মা মরে গেছে?

ছেলেমেয়েরা ছোটো। বড় ছেলেটি প্রথমভাগের বানান শেখে, ছোটো ছেলেটি শেখে কথা বলতে। এদের মাঝখানেরটি মেয়ে, বোবা বলে সে কথা বলতে শেখেনি। মার সম্বন্ধে তাই প্রশ্ন করে শুধু বড় ছেলেটি।

‘মা কোথায় গেছে বাবা?’

‘স্বর্গে।’

ব’লে প্রমাণের জন্য জ্যোতিষার্ণব কান পেতে থাকে। টিকটিকি বাড়িতে আট-দশটার কম নয়, কিন্তু একটাও জ্যোতিষার্ণবের কথায় সায় দেয় না। নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে বোকা মনে করার লজ্জায় করুণভাবে একটু হেসে জ্যোতিষার্ণব নিজে নিজেই কয়েকবার মাথা নাড়ে। স্বর্গে যদি গিয়েও থাকে তার ছেলেমেয়ের মা, এতদিনে সেখানে পৌঁছে গেছে। অতীত ঘটনার সঙ্গে কি সম্পর্ক টিকটিকির যে তার ছেলেমেয়ের মা স্বর্গে গেছে সে একথা বললে সঙ্গে সঙ্গে সায় না দিয়ে টিকটিকি থাকতে পারবে না? তা ছাড়া স্বর্গে যাওয়া না-যাওয়া তো জীবনের ঘটনা নয় মানুষের। মরে মানুষ যে-স্বর্গে যায় ইহলোকে কী সে-স্বর্গ আছে? স্বৰ্গই নেই ইহলোকে!

মনে মনে এত গভীর ও জটিল যুক্তিতর্ক নাড়াচাড়া করেও কিন্তু সন্দেহ যায় না। তার ছেলেমেয়ের মা স্বর্গে যায়নি বলেও তো চুপ করে থাকতে পারে ত্রিকালদর্শী টিকটিকিগুলি? স্বর্গে গিয়ে থাকলে অন্যগুলি না হোক, যে টিকটিকিটা তার ছেলেমেয়ের মার মৃত্যুর কথা ঘোষণা করেছিল, সেটা অন্তত একবার ডেকে উঠত। হোক না অতটুকু জীব, একবার যে অতখানি জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে তার কি এতটুকু কাণ্ড-জ্ঞান নেই? জ্যোতিষার্ণবের বিপদ এই, সে জানে তার ছেলেমেয়ের মার স্বর্গে যাওয়া নিষেধ। অবিবাহিতা বউদের জন্য স্বর্গ নয়। কিন্তু কুমারী জীবন থেকে একজন পুরুষের সঙ্গে যারা জীবন কাটিয়ে দেয়, তাদের জন্যও কি স্বর্গে যাওয়ার কড়া ব্যবস্থা একটু শিথিল হয় না? তার ছেলেমেয়ের মার পারলৌকিক জীবন সম্বন্ধে এইটুকুই আশাভরসা জোতিষার্ণবের।

মার জন্য ছোটো ছেলেটা ককায়। মেয়েটা বোবাকান্না কাঁদে। বড়ো ছেলেটা কাঁদে আর জিজ্ঞাসা করে, ‘মা কোথায় গেছে বাবা?’

জিজ্ঞাসা করে গণনালয়ে, তিনজন ক্লায়েন্টের সামনে। জ্যোতিষার্ণব দেয়ালে টাঙানো যোগিনীচক্রের পাশে নিস্পন্দ টিকটিকিটার দিকে একবার তাকিয়েই উঠে দাঁড়ায়। ক্লায়েন্টদের সবিনয়ে বলে, ‘একটু বসুন, আসছি।’

ব’লে ছেলেকে নিয়ে অন্দরে শোবার ঘরে ঢুকে দেয়ালে আর সিলিং-এ ব্যাকুল দৃষ্টিতে খুঁজে বেড়ায় তার টিকটিকিকে। সেদিন ঘরে যা কিছু ছিল আজও তার সবই আছে, কেবল নেই শৃঙ্খলা আর সেই টিকটিকিটা । শৃঙ্খলা সত্যই নেই, শৃঙ্খলা লুকিয়ে থাকে না, কিন্তু টিকটিকি তো ফাকেফোকরে জিনিষপত্রের আড়ালে অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে, অতটুকু জীব টিকটিকি? একটু আশ্বস্ত হয় জ্যোতিষার্ণব। ছেলেকে বলে, ‘কী বলছিলি তুই খোকা?’

বাপের কোলে উঠে ছেলের মন এতক্ষণে শান্ত হয়েছে।

‘কখন বাবা?’

‘আপিসে ঢুকে কী বললি না আমাকে?’

‘কিছু বলিনি তো।’

ছোট বোন আর ভাইটি বাপের যে লোমশ বুকখানায় আজকাল রাজত্ব করে, সেখানে উঠে স্মৃতিভ্রংশ হবার বয়স থোকার পার হয়ে যায়নি। তবে বয়সের তুলনায় ওজনটা তার হয়েছে অস্বাভাবিক। ছেলেকে জ্যোতিষার্ণব মেঝেতে নামিয়ে দেয়। মৃদুস্বরে সন্তর্পণে বলে, ‘তোর মার কথা কী জিজ্ঞেস করলি না?’

‘মা কোথায় গেছে বাবা?’

বোমা নিয়ে খেলা করবার মতো অসহায় সাহসের সঙ্গে জ্যোতিষার্ণব বলে, ‘নরকে।’ বলে কান পেতে থাকে। কানে আসে ছোটো ছেলেটার কান্না, দোতলায় ইতিহাসের প্রফেসারের স্ত্রীর হঠাৎ গাওয়া দুলাইন গান, রাজপথের চটুল ফাজলামি।

বড়ো ছেলেটা বাপের মুখ দেখেই বোধহয় কেঁদে উঠবার উপক্রম করেছিল।

জ্যোতিষার্ণব চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘কাঁদিস না।’

খোকা কাঁদে না।

‘শোন, আমি ভুল বলেছি। তোর মা এখনও নরকে যায়নি, যাবে। বুঝলি? যাবে, ভবিষ্যতে যাবে।’

আবার জ্যোতিযার্ণব কান পেতে থাকে। বড়ো ছেলেটা কেঁদে ওঠা মাত্র হাত চাপা দেয় তার মুখে। কানে আসে ছোটো ছেলেটার থেমে আসা ছাড়া ছাড়া কান্না, দোতলায় ইতিহাসের প্রফেসারের স্ত্রীর থেমে আসা দুলাইন গানের দুর্বোধ্য গুনগুনানো সুর, রাজপথের চটুল ফাজলামি আর টিকটিকির ডাক।

সেই টিকটিকিটার নয়। সে যাকে সেদিন তার ছেলেমেয়ের মা হতে ডেকেছিল, সেটার। দুটি টিকটিকির আকারে, চামড়ার রঙে, চালচলনে পার্থক্য অবশ্য আছে অনেক, কিন্তু সব টিকটিকিরই এক রা।

মনে যার ব্যথা থাকে তার শখ চাপে মনের কথা বলবার। মনের ব্যথা যে মনকে কামডায় এটা তার একটা লক্ষণ। ছেলেমেয়ের মা যার নরকে যাবে, মনে তার ব্যথা থাকা স্বাভাবিক। জ্যোতিষার্ণব তাই হাত দেখাতে, ঠিকুজি মেলাতে, ভাগ্য গনাতে, মাদুলি-কবচ বিধান-ব্যবস্থা নিতে, পূজাপার্বণ শাস্তিস্বস্ত্যয়ন নির্বাহের আহ্বান জানাতে যারা আসে, তাদেরও যেমন মনের কথা বলে, শুধু দেখা করতে যে বন্ধুরা আসে, তাদের তেমনই মনের কথা বলে। জ্যোতিষ-বচনের মতো মনের কথা বলার কথা তার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে।

এযুগের মানুষের অবিশ্বাসপ্রবণতা দিয়ে আরম্ভ করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও যে কেউ কিছু বিশ্বাস করতে চায় না, এ পর্যন্ত আসতে আসতে জ্যোতিষার্ণবের মুখ বড়ো বিমর্ষ হয়ে যায়। গভীর আর্ত বিষাদের ছাপ। তা ছাড়া গলাও কাঁপে। ফরাশে বা চেয়ারে যেখানেই তার শ্রোতা বসে থাক, কথার চেয়ে কথার সুর আর জ্যোতিষার্ণবের চেয়ে তার মুখের ভাব শ্রোতাকে বিচলিত করে বেশি। জ্যোতিষার্ণবের ভণ্ডামিতে আর যেন বিশ্বাস থাকে না, অন্তত তখনকার মতো।

প্রমাণ? বিশ্বাসের জন্য প্রমাণ চাই? আমার নিজের জীবনেই কত বড় বড় প্রমাণ ঘটেছে। এইতো সেদিন আমার স্ত্রী মারা গেলেন, আমি কি জানতাম না তিনি ওই দিন ওই সময় মারা যাবেন?

‘জানতেন?’

গণনালয়ের টিকটিকিটা সব সময় নিজেকে প্রকাশ করে রাখে। হস্তরেখার প্রকাণ্ড ম্যাপ, রাশিচক্র, বর্ষচক্র, পতাকীচক্র, যোগিনীচক্রের ছবি, সুকেশিনীর ছবিযুক্ত কেশতৈলের দেয়ালপঞ্জি-বিজ্ঞাপন, দেয়ালে বসানো তাক, জানালার চতুষ্কোণ গহ্বর, ফাঁকা দেয়াল, ছাদ, কড়িবরগার আড়াল, সমস্ত জায়গা পাঁতিপাঁতি করে খুঁজে তাকে আবিষ্কার করতে হয় না, এদিক ওদিক একটু তাকালেই নজরে পড়ে। জ্যোতিষার্ণব খানিকক্ষণ আনমনে তাকিয়ে থাকে টিকটিকিটাব দিকে, তারপর মাথা হেলিয়ে বলে, ‘প্রথমে জানতাম না। নিজের লোকের মৃত্যুর দিন গণনা করতে নেই, মানুষের মন তো, মন বিচলিত হয়ে পড়ে। সেদিন সকালরেলা হল কি, তামাশা করে আমায় বললেন, আমি মরে গেলে তোমার কি উপায় হবে? মানে, সংসার তো একরকম চালাতেন তিনি, তাই হঠাৎ পরিহাস করে বললেন আর কি যে, তিনি যদি মরে যান এসব কাজকর্মই বা কে করবে, ছেলেমেয়ে মানুষই বা কে করবে। যেই বললেন কথাটা, সঙ্গে সঙ্গে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল।’

‘টিকটিকি?’

‘হ্যাঁ, টিকটিকি। মনে কেমন খটকা বাধল। হস্তরেখা বিচার করে ওঁর বয়স জিজ্ঞেস করলাম। বয়স অবশ্য আমি জানতাম, বিয়ের সময় থেকেই জানতাম, তবু জিজ্ঞেস করলাম। তারপর বললাম, তোমার কুণ্ঠিটা বার করো তো, কালো তোরঙ্গের তলায় আছে। উনি হাসতে হাসতে কুষ্ঠি বার করে দিলেন। তখনও আমার মন বলছে, থাকগে কাজ নেই, মরণ যদি ওঁর ঘনিয়ে এসে থাকে, কি হবে আগে থেকে জেনে? লাভ তো কিছুই হবে না, মাঝখান থেকে কিছুদিন অতিরিক্ত মনোকষ্ট ভোগ করব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গণনা না করে পারলাম না। গণনার ফল দেখে মাথা ঘুরে গেল। সেদিন গোধূলিবেলা পর্যন্ত ওঁর আয়ু। ওঁর দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন একটা শবের দিকে তাকিয়ে আছি, ঠিক পিছনে আবছা মতন—

শ্রোতা স্তব্ধ। গলা শুকিয়ে গেছে। ভয়ে নয়, প্রকৃত তৃষ্ণায়। কিন্তু এখন জল চাওয়া যায় না।

‘জানতাম কোনো লাভ নেই, ওঁর বাবা ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান সত্যবাদী পণ্ডিত, তবু একবার জিজ্ঞাসা করলাম, বিয়ের সময় তোমার বয়স তো দু-এক বছর কম করে বলা হয়নি? কুষ্ঠি ঠিক আছে তো? বিয়ের সময় যদি —থাকগে ওসব কথা। আপনাকে যা বলছিলাম, পার্শ্বমূখ নক্ষত্র—’

নয়টি পার্শ্বমুখ নক্ষত্রের একটির নাম রেবতী। ছমাস পরে জ্যোতিষার্ণব ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য রেবতীকে বিয়ে করে আনে। মরে গেলে স্বর্গে যাবার অধিকার নিয়েই রেবতী এ বাড়িতে আসে বটে, বাড়িতে কিন্তু একটিও টিকটিকির দেখা সে পায় না।

তবু সাবধানের মার নেই ভেবে জ্যোতিষার্ণব বউকে সতর্ক করে দেয়, ‘দ্যাখো, কোনো দিন মরার কথা মুখে এনো না।’

রেবতী তখনও পার্শ্বমুখী, সোজা জ্যোতিষার্ণবের মুখের দিকে তাকাতে পারে না।জ্যোতিষার্ণব হরদম তাকায়। নিজে যোটক বিচার করে সে রেবতীকে বিয়ে করেছে। বিপদ দুজনের নক্ষত্র নিয়ে। তার নিজের শতভিষা নক্ষত্র আর রেবতীর উত্তরভাদ্রপদ নক্ষত্র তাদের মিলনকে করেছে রাক্ষস ও নরের মিলনের মতো।

এখন এই যে জ্যোতিষার্ণব, আমি এর জীবনে উদিত হয়েছিলাম, কি এ-ই আমার জীবনে উদিত হয়েছিল, আজও আমি এ সমস্যার মীমাংসা করতে পারিনি।

কত আর বয়স তখন আমার হবে, রেবতীর চেয়ে অনেক ছোটো। কিছুদিনের জন্য থাকতে গিয়েছি ইতিহাসের প্রফেসারের বাড়ি, কি ভীষণ ভাবটাই যে হয়ে গেল রেবতীর সঙ্গে। বয়সের তুলনায় কি প্রকাণ্ড তখন আমার দেহ, কত পরিণত মন,—কারও স্ত্রীর সঙ্গে ভাব হওয়াটাই তখন আমার পক্ষে পরমাশ্চর্য। অথচ রেবতীর সঙ্গে সারাদিন এত বেশি কড়ি আর তাস খেলতাম যে, ইতিহাসের প্রফেসারের স্ত্রী অভিমানে আমার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলত না।

তাতে আমার সুবিধাই ছিল। আমায় যে ভালোবাসে তার সঙ্গে কথা বলতে আমার বড় কষ্ট হয়। মনে হয়, শব্দ দিয়ে অনেক দামি কী যেন আদায় করে নিচ্ছি।

আমি রেবতীর সঙ্গে কড়ি খেলি, জ্যোতিষার্ণব দুবার ঘুরে গিয়ে তৃতীয়বার কাছে এসে উবু হয়ে বসে।

‘দেখি হে ছোকরা তোমার হাতটা। আরে বাস রে, এ কী হাত, এত হিজিবিজি রেখা পেলে কোথায়? ভালো করে দেখতে হবে তো হাতটা তোমার। বাঁচবে অনেক দিন, তবে—’

রেবতী আমার হাত কেড়ে নেয়।

‘খুব হয়েছে, ছেলেমানুষকে ভয় না দেখালেও চলবে।’

অন্দর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় গণনালয়ে জ্যোতিষার্ণব আমায় পাকড়াও করে, শোনায় ভূতের গল্প। প্রথমে কান দিয়ে আরম্ভ করে শেষে লোমকূপগুলিকেও শোনার কাজে লাগিয়ে দিই। ক্ষুধাতৃষ্ণার তাগিদটা চাপা পড়ে যায়, তাকিয়ে দেখি রেবতী এসে আলমারির পাশের ফাঁকটাতে দাঁড়িয়ে আছে।

জ্যোতিষার্ণবের গল্প শেষ হতে বলি, ‘আরেকটা।’

রেবতী ম্লান মুখে চুপ করে থাকে।

জ্যোতিষার্ণব হাসির ভান করে বলে, ‘এ বাড়ির টিকটিকিগুলি যদি মেরে ফ্যালো,তাহলে বলব। একটা টিকটিকির জন্যে একটা গল্প। এ ঘরেই তো তিনটে আছে, লাঠিটা দিয়ে মারো না একটা?’

আমি বলি, ‘লাঠি দিয়ে বুঝি টিকটিকি মারে? দাঁড়ান, আমার তির-ধনুক নিয়ে আসি।’

রেবতী বলে, ‘মানিক, মেরো না, টিকটিকি মারতে নেই।’

আমি একটু দাঁড়াই। হিসাব করে দেখি যে রেবতীর মতো মেয়ে যখন একবার আমাকে ভালোবেসেছে, কথা না শুনলেও ভালো না বেসে সে পারবে না। আমার সঙ্গে কড়ি আর পাতাবিত্তি খেলবার জন্য সে যেরকম পাগল হয়ে উঠেছে, সে পাগলামি যাবার নয়। গল্প না বলে আমায় কষ্ট দেবার সুযোগ পেলে জ্যোতিষার্ণব কিন্তু কিছুতেই সে সুযোগ ছাড়বে না। সোজা দোতলায় গিয়ে আমার বাঁশের ধনুক আর শরের তির নিয়ে আসি। তির আমার সাংঘাতিক মারণাস্ত্র, ডগায় দুটি আলপিন বসানো আছে।

এককোণে একটা টিকটিকি ছিল, ফরাশে উঠে দাঁড়ালে আমার তিরের আয়ত্তে আসে এইরকম স্থানে। নিস্পন্দ শরীর, নিস্পলক চোখ, ধূসর জীবটিকে দেখলেই মায়া হয়।

রেবর্তী আবার বলে, ‘মানিক মেরো না, মারতে নেই।’

রেবতীকে আমি ত্যাগ করিনি, কিন্তু তার কথার কোনো দাম আমার কাছে নেই। আকণ সন্ধান করে চার ইঞ্চি তফাৎ থেকে বাণ নিক্ষেপ করি। এমন আশ্চর্য জীব টিকটিকি যে শিকারিকে গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখলেও নড়ে না।

বাণবিদ্ধ টিকটিকি নীচে পড়ে যায়। বাণটি টেনে খুলে নিয়ে দেখি দুটি আলপিন বিধে টিকটিকিটার চোখের পাশে দুটি রক্তের ফোঁটা জমেছে—যেন নূতন দুটি চোখ। মানুষের রক্তের মতো লাল রক্ত টিকটিকির নয়—

জ্যোতিষার্ণব হাসি চেপে হাসতে আরম্ভ করে।

‘চারচোখো করে দিলে! টিকটিকিকে চারচোখো করে দিলে? তোমাকেও চারচোখো হতে হবে মানিক।’

সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালে কোথায় যেন একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে। কে জানে বাণবিদ্ধ টিকটিকির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক। ছেলেমেয়ের বাপ-মা হবার জন্য তারা যদি পরস্পরকে কোনোদিন ডাকাডাকি করে থাকে, সে খবর কেবল তারাই জানে।

রেবতী নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে বলে, ‘ফের? ফের ছেলেমানুষকে ভয়

দেখাচ্ছ?’ বলে জ্যোতিষার্ণবের গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে নিজেই ভয়ে মুষড়ে যায়।

স্কুলে বোর্ডের লেখা দেখতে না পাওয়ায় এক মাসের মধ্যে আমাকে চশমা নিতে হয়।

চশমা চোখ নয়, কিন্তু বন্ধুরা আমায় চারচোখো বলে কত যে তামাশা করে ঠিক নেই।

তারপর ইতিহাসের প্রফেসারের বাড়িতে আমি কোনোদিন যাইনি। চারচোখে রেবতীকে একবার চোখেও দেখিনি। রেবতীর কথা মনে হলেই সেই বাণবিদ্ধ টিকটিকিটার দুটি ধূসর চোখ, তার চোখ দুটির পাশে দুটি ফ্যাকাসে রক্তবিন্দুর ছবি মনে ভেসে আসে, দারুণ বিতৃষ্ণায় আমার মন ভরে যায়। রেবতীর প্রতি বিতৃষ্ণা,—রেবতীর কোনো দোষ ছিল না, তবু।

হয়তো রেবতী জ্যোতিষার্ণবের ছেলেমেয়ের মা হয়েছে। হয়তো টিকটিকির জন্য জ্যোতিষার্ণবের প্রথম ছেলেমেয়ের মা স্বর্গে যেতে না পারলেও, টিকটিকির জন্যই রেবতীর স্বর্গে যাবার পথ বন্ধ হবার বিপদ কেটে গিয়েছে, এবং স্বর্গে যাবার প্রতীক্ষায় সে পৃথিবীতেই স্বর্গসুখ ভোগ করছে।

এদিকে আমার বেড়েছে চশমার পাওয়ার। কখনো দেয়ালের টিকটিকি না দেখবার ইচ্ছা হলে আমার চোখ বুজতে হয় না—চশমাটা খুলে ফেললেই চলে।

 

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments