মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘অসহযোগী’
রমানের বাবা হর্ষনাথ ধনেশগঞ্জের মস্ত আড়তদার। বছরখানেক আগে রমেনকে সে তার পিসতুতো ভগ্নীপতি সূর্যপদর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল— ছেলেটাকে একটু শান্তশিষ্ট ভদ্র বানাবার আশায়। রমেন একেবারে মারাত্মক – রকম দুরন্ত হয়ে উঠেছিল ; কিছুতেই সে তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছিল না। দু -তিনবার কোর্টে পর্যন্ত তাকে দৌড়োতে হয়েছিল ছেলের জন্য। শেষে রমেন যখন একদিন ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার বসুর ছেলেকে মেরে রক্তারক্তি করে দিল, তখন সে পরিষ্কার বুঝতে পারল যে এ ছেলেকে সামলে
চলা তার সামর্থ্য নয়। এ ছেলে তার সর্বনাশ করবে। যুদ্ধের বাজারে কতভাবে কত কামাচ্ছে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবেকে চটালে রক্ষা আছে?
দামি দামি ভেট নিয়ে সে সটান গিয়ে হাজির হল একেবারে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে, মার- খাওয়া ছেলেটির জন্যই উপহার রইল দুশো টাকার। লুটিয়ে পড়ল মিসেস বসুর পায়ের তলে। প্রার্থনা করল রমেনের নিস্তার। ছেলের সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা করবে আগেই ভেবে ঠিক করে ফেলেছিল, তাই বিনাদ্বিধায় জানিয়ে দিল যে, ভয় পেয়ে রমেন কোথায় পালিয়ে গিয়েছে, ফিরে এলে, খুঁটিতে বেঁধে তাকে চাবকে লাল করে দেবে।
সেইদিনই রমেনকে নিয়ে সে কলকাতা রওনা হয়ে গেল, ছেলেদের সূর্যপদর জিন্মা করে দেবার জন্য।
রমেনের মা একটু আপত্তি করেছিল।
‘ উনি স্বদেশি- টদেশি করেন শুনেছি, খোকাকে আবার না বিগড়ে দেন।’
হর্ষনাথ বলেছিল, ‘স্বদেশি না ছাই!
জেলে যেতে না স্বদেশি করলে? ওসব টাকা উপায়ের ফিকির। ছেলেদের নিয়ে দল- টল সমিতি-টমিতি করে চাঁদা তুলবার জন্যে। মাস্টারিতে কি কারও পেট চলে?’
শহরতলিতে সূর্যপদর বাড়ি। এক রাত্রির বেশি হর্ষনাথ থাকতে পারেনি। কার কত কাজ ধনেশগঞ্জে। সূর্যপদকে সব জানিয়ে অনুরোধ করেছিল, ‘ছেলেটাকে তোমায় মানুষ করে দিতে হবে ভাই। শুধরে দিতে হবে।’
সূর্যপদ হেসে বলেছিল, ‘দেব। ছেলেকে তোমার মানুষ করে দেব।’
একটা শর্ত করেছিল সূর্যপদ যে, এক বছরের মধ্যে রমেনকে ধনেশগঞ্জে নেওয়া চলবে না আর সোজাসুজি রমেনকে টাকা পাঠানো চলবে না। হর্ষনাথ রাজি হয়ে ফিরে গিয়েছিল।
রমেনের খরচের জন্য পঞ্চাশ টাকা দিতে চাইলে সূর্যপদ মোটে পঁচিশ টাকা নিয়েছিল।
বলেছিল, ‘আমি গরিব মাস্টার, তোমার ছেলের খরচ চালাবার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু পঁচিশ টাকার বেশি খরচ ওর লাগবে না।’
পরের মাসে হর্ষনাথ পঞ্চাশ টাকা পাঠিয়েছিল। কয়েকদিন পরে পঁচিশ টাকা ফেরত আশায় খুশি হয়ে রমেনের মা কে বলেছিল, ‘না, লোকটি সত্যি ভালো। ছেলেটাকে শুধরে দিতে পারবে বলে মনে হয়।’
এক বছর পরে পুজোর ছুটিতে রমেন বাড়ি এল।
তার পরিবর্তন দেখে প্রথম ক-দিন, হর্ষনাথ পরম খুশি যেমন চেহারায়, কথায়, ব্যবহারেও। তেমনই সে শান্তশিষ্ট- ভদ্র হয়ে এসেছে। উশকো-খুশকো ঝাঁকড়া চুল ছোটো ছোটো করে ছাঁটা কিন্তু তাও আঁচড়ানো, জামাকাপড় সস্তা দামের কিন্তু দিব্যি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন— মুখখানা হাসিখুশি, কথা মিষ্টি, চালচলন নম্র। গুন্ডার মতো চেহারা নিয়ে সারাদিন সে টো টো করে ঘুরে বেড়াত, খেলা আর মারামারি নিয়ে মেতে থাকত এমনই সে চঞ্চল ছিল এক বছর আগে, অকাজের পর অকাজ না করলে তার স্বস্তি ছিল না। একটা কথা কোনোদিন সে কারও শুনত না। সে চাপল্য, শয়তানি আর অবাধ্যতা কোথায় উড়ে গেছে।
সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, এই যা একটু দোষ। কিন্তু কোনো অকর্মের খবর না পেয়ে এবং বাড়ি ফিরলে ছেলের দেহে বা
কাপড়জামায় দুরন্তপনার চিহ্ন না দেখে হর্ষনাথ নিশ্চিন্ত হয়। ভাবে, এতদিন পরে দেশে এসেছে, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে হয়তো আড্ডা দিচ্ছে সাধ মিটিয়ে। ওতে আর কী আসে যায়?
দিন -সাতেক পরেই কিন্তু তার মনে খটকা লাগে।
আড়ত থেকে ভাত খেতে বাড়ি ফিরে দেখে কী, শ-তিনেক এর দুর্ভিক্ষের কাঙালি মেয়ে -পুরুষ, ছেলে -বুড়ো বাড়ির পাশে ফাঁকা বটগাছতলায় পাতা পেতে ভাত খাচ্ছে, পরিবেশন করছে রমেন আর তারই বয়সি পঁচিশ-ত্রিশটি ছেলে।
দেখে মুখ হাঁ হয়ে যায় হর্ষনাথের।
বাড়ির ভিতরে ধপাস করে বসে পড়ে ছেলেকে সে ডেকে পাঠায়।
‘এ সব কি হচ্ছে?’
রমেন তখন উৎসাহে ফুটেছে-‘ওদের খাওয়াচ্ছি বাবা! কত হিসেব করে খাওয়াতে হচ্ছে
জান? কদ্দিন ধরে খায়নি, বেশি খেলেই মরবে। তা কি বোঝে ব্যাটারা? সবাই চ্যাঁচাচ্ছে আরও দাও, আরও দাও। সামলানো দায়।’
‘চাল-ডাল সব পেলি কোথায়?’
‘মা দিয়েছে।’
রহমানের মা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘আহা, আবদার ধরেছে, খাওয়াক না! সবাই আশীর্বাদ করছে ভালো হবে’।
‘ভালো হওয়াচ্ছি।’
বাড়ির ভাঁড়ারটাই প্রায় ছোটখাটো একটি গুদামঘর। আগে হর্ষনাথ রমেনের মার কাছ থেকে ভাঁড়ারের চাবি সংগ্রহ করল। তারপর বটতলায় খাওয়া শেষ হলে সকলকে হাঁকিয়ে দিল।
আঁধার নেমে এল রমেনের মুখে। সে বললে, ‘আমি ওদের সাতদিন রোজ খাওয়ার কথা বলেছি বাবা। তারপর ওরা গাঁয়ে ফিরে যাবে।
‘চুপ কর, বেয়াদব কোথাকার। সাতদিন ধরে খাওয়াবে! আমাকে ফতুর করার মতলব।’
দিন যায়। পতিদিন চারিদিকে ক্ষুধিতের কান্না হু- হু করে বেড়ে যেতে থাকে। রমেন আর হাসে না। খেতে বসে ভাত ছড়িয়ে উঠে যায়। দুধ পড়ে থাকে দুধের বাটিতে, সন্দেশ পিঁপড়েয় খায়।
হর্ষনাথ রাগ করে বলে, ‘কি জ্বালা বাপু! কেন হয়েছে কী?’
‘সবাই না খেয়ে মরে যাবে, তুমি কিছু করবে না বাবা ?’
‘দিলাম যে কুড়ি মন চাল রিলিফ ?’
‘কুড়ি মন! তোমার আড়তে হাজার হাজার মন চাল রয়েছে। সবাই ছি ছি করবে বাবা। সবাই আমায় ঘেন্না করছে তোমার ছেলে বলে।’
‘চুপ কর! বেয়াদব কোথাকার!’
দু-দিন রমেন কে খুঁজে পাওয়া যায় না। রহমানের মা কেঁদে- কেটে অস্থির হয়। মনে মনে যথেষ্ট শঙ্কিত হলেও হর্ষনাথ বাইরে মুখ গম্ভীর করে থাকে। রাগে ভয়ে দুশ্চিন্তায় তার মেজাজটা যায় বিগড়ে। ভাবে, রমেন ফিরলে মেরে তাকে আস্ত রাখবে না। দু-দিন পরে রমেন ফিরলে তার চোখের চাউনি দেখে দুটো ধমক দিতেও কিন্তু তার সাহস হয় না। কেমন এক খাপছাড়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে রমেন আজকাল তার দিকে তাকাতে আরম্ভ করেছিল, দেখে তার কেমন ভয় ভয় করে।
‘কোথায় গিয়েছিলি না বলে?’
‘অনাথবাবুর সঙ্গে সাতগাঁয়ে।’
অনাথবাবুর সঙ্গে! তার পরম শত্রু
অনাথবাবু, এই সেদিন যার জন্য প্রায় হাজার মন চাল গুদামে তোলার বদলে বাঁধাদামে বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাকে।
রমেন আবেদন আর আবদারের সুরে বলে, ‘কি অবস্থা হয়েছে তুমি ভাবতে পারবে না বাবা। তুমি এক কাজ করো বাবা। যে দামে
কিনেছিলে, এক টাকা লাভ রেখে চার বেচে দাও।
তোমার তো লোকসান হবে না, কত লোক বাঁচবে ভাব দিকি!’।
‘লোকসান হবে না, না? চল্লিশ টাকার জায়গায় চোদ্দো টাকায় বেচলে লোকসান হবে না, কি হিসেব তুই শিখেছিস?’ কথাটা হর্ষনাথ উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে।
তখন রমেন বলে, ‘তা হলে তোমার সব চাল আমি বিলিয়ে দেব বাবা। আগে থেকে বলে রাখলাম। তোমায় আমি মানুষ খুন করতে দেব না।’
‘ছোটো মুখে বড়ো কথা বলিসনি, থাবড়া খাবি।’
‘বলে রাখলাম। দেখো।’
ছেলেমানুষের হালকা কথা, কে তা মনে রাখে? আড়তে তার কত লোকজন, গুদাম তালাবন্ধ, চাইলেই কি আর চাল বিলিয়ে দিতে পারবে রমেন— পঞ্চাশজন বন্ধু আর অনাথবাবুকে সঙ্গে নিয়ে এলেও নয়।
সেই জন্য হর্ষনাথের ভাবনা হল না। ছেলের পাগলামি দেখে মনটা শুধু খারাপ হয়ে গেল। কী কুক্ষুণেই ছেলেকে মানুষ হতে পাঠিয়েছিল সূর্যপদর কাছে! এর চেয়ে ছেলেটা শয়তান গুন্ডা থাকাও ভালো ছিল— বয়স বাড়লে আপনি শুধরে যেত।
দিনকতক পরে হর্ষনাথ ব্যবসার কাজে তিন দিনের জন্য বাইরে গেল। আড়তে বলে গেল, রমেন এসে গোলমাল করলে যেন ভালোভাবে শাসন করে দেওয়া হয়। অনাথ এসে হাঙ্গামা করলে যেন সাজা পুলিশ ডেকে করিয়ে দেওয়া হয়। একবার থানাটও ঘুরে গেল, অনাথ কিভাবে তার ছেলের মাথা বিগড়ে দেবার চেষ্টা করছে জানিয়ে দেবার জন্য।
পরের দিন সকালে আড়তে ও আড়তের সামনে হইহই কান্ড শুরু হয়ে গেল। নিতাই চরণ আড়তের প্রধান কর্মচারী, বাবু নেই বলে আড়ত
খুলতে লোক পাঠিয়ে নিজে একটু বেলা করে হেলতে দুলতে এসে দেখে কি প্রায় শ-পাঁচেক লোক জমা হয়েছে আড়তের সামনে। তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকে নিতাইচরণের চক্ষুস্থির। আড়তের যে কোণে হাজার টিন টেন ছিল পরশু পর্যন্ত, সেখানে মেঝেতে তেল আর ময়লার পুরু পাঁকের ওপরেই আড়তের সবাই বসে আছে। তফাতে হর্ষনাথের দু-নলা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে রমেন। রমেনের সমবয়সি ছেলেতে আড়ত বোঝাই।
‘আসুন নেতাই কাকা। গুদামের চাবিটা দিন তো।’
‘চাবি? চাবি কোথায় পাব? চাবি তোমার বাবার কাছে।’
‘তাহলে ওখানে গিয়ে বসুন। দরজা ভাঙতে হবে।’
রমনের এক বন্ধু তার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে তেল গাদায় ধপ্ করে বসিয়ে দেয়। রমেন বলে, ‘এই বন্দুক নিয়ে একজনের ঠ্যাং খোঁড়া করে দিয়েছিলাম মনে আছে তো? কেউ কোনো
ফন্দি-ফিকির- চালাকি করবার চেষ্টা করবেন না। সত্যি গুলি করব কিন্তু।’
সেইখানে দাঁড়িয়ে থেকে রমেন ওদের পাহারা দেয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। দেড়শো ছেলে গুদাম থেকে চাল বার করে বিতরণ করে। কাছে ও দূরের অনেকগুলি গাঁ থেকে হাজার হাজার লোক আছে যাদের জন্য। রমেন গাঁয়ে গাঁয়ে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিয়েছিল।
পুলিশ দু-চারজন আসে কিন্তু ঢুকবার চেষ্টা করে না। বরং বিরার হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণে কিছু কিছু সাহায্য করে। ভোরে রমেন নিজে গিয়ে থানায় খবর দিয়ে ছিল তার বাবা আজ চাল বিতরণ করবেন। এই মর্মে বড়ো বড়ো কয়েকটা
ইস্তাহারও আড়তের বাইরে টাঙ্গিয়ে রেখেছিল।
সন্ধ্যার সময় চাল শেষ হল।
খবর পেয়ে পরদিনই হর্ষনাথ ফিরে এল। ছেলেকে সামনে রেখে গুম খেয়ে রইল। তার কান্না পাচ্ছিল।