বাঘের মাংস (ঋজুদা) – বুদ্ধদেব গুহ

শেয়ার করুনঃ

আউ কেত্তে বাট্ট হব্ব দণ্ডধর টুল্লকা বাংলো? দণ্ডধরকে প্রশ্ন করলাম চলতে চলেতে।

আমার দিকে মুখ না ফিরিয়েই, ডোন্ট কেয়ার উত্তর দিল দণ্ড, হব্ব, দ্বি কোশখণ্ডে। আউ কঁড়?

বাপ্পালো বাপ্পা! দ্বি ক্বোশ? মু আউ চালি পারিবনি। হতাশ গলায় বললাম আমি।

চালি পারিবুনি? ইঃ, আউ কঁড় করিবি? এই ভীষ্বণ গহন জঙ্গলরে রহিবি কি মরিবা পাঁই? চঞ্চল করিকি চালুন্ত ঋজুবাবু। এইঠি বহত্ব গন্ধ আছি। বড্ড বড্ড গল্ব।

প্রায় কেঁদে ফেলে একটা পাথরে বসে পড়ে দণ্ডকে বললাম, না ম। মোর গোডুটা কেম্বতি ফুলি গল্লা দেখিলু! মু আউ জমারু চালি পারিবুনি।

কাম্ব সারিলা! বলেই, প্রচণ্ড বিরক্তির সঙ্গে আমি যে পাথরে বসে পড়েছিলাম, তারই পাশেরই একটা পাথরে বসল সে। নিজে বসার লোক দণ্ডধর আদৌ নয়; যদিও অন্যকে যখন-তখন পথে বসানোই তার কাজ।

আমাদের জিপটা খারাপ হয়ে গেছিল পুরুনাকোট থেকে টুল্বকাতে আসার পথে। এ পথে এমন জঙ্গল পাহাড় যে, দিনমানে চলতেই বুক দুরুদুরু করে। আর এখন তো রাত বারোটা। তাও আবার কৃষ্ণপক্ষের রাত। চাঁদ উঠবে শেষ রাতে। কেন যে জিপেই শুয়ে থাকলাম না। তাই ভাবছিলাম। এই দণ্ডটার পাল্লায় পড়ে আজ যে কত দণ্ড দিতে হবে তা ভগবানই জানেন। জীবনটাই যাবে হয়তো। পাঁচটা নয়, দশটা নয়, মাত্র একটাই জীবন।

দণ্ড জলের বোতলটা এগিয়ে দিল কথা না বলে। রেগে গেলে ও কথাবার্তা বলে না। মাঝে-মাঝে গলা দিয়ে পিলে-চমকানো একটা আওয়াজ করে, আর পিচিক পিচিক করে তিনহাত দূরে থুথু ফেলে। মিস্টার ডাকুয়ার এই ব্যাপারটা ঠিক কাসিও নয় হাঁচিও নয়, গলা-খাঁকারিও নয়। এক কথায় তাকে কাহাঁখাঁ বলা চলে। ওর ওই কাঁহাঁখা হঠাৎ শুনে আমি কোন্ ছার অনেক বড় বড় হিম্মতদার লোককে পর্যন্ত ঘাবড়ে যেতে দেখেছি।

ডিসেম্বরের রাতেও আমার জার্কিন ঘামে ভিজে গেছে। বসে, বন্দুকটা দু হাঁটুর মধ্যে রেখে একটু জিরিয়ে নেওয়ার পর পাইপের পোড়া তামাক খুঁচিয়ে ফেলে আবার নতুন করে টোব্যাকো ঠাসতে লাগলাম। দণ্ডকে খুশি করার জন্যে পাইপের টোব্যাকো এগিয়ে দিয়ে বললাম, টিকে তামাকু?

মুখে শব্দ না করে ও দুদিকে মাথা নাড়ল দক্ষিণ ভারতীয়দের মতো। তারপর নেড়েই চলল।

বুঝলাম প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছে আমার উপর। ও যখন তামাক নিলই না। অগত্যা তখন দেশলাই ঠুকে পাইপটা ধরালাম। ঠিক সেই সময়েই মহানদীর দিক থেকে একটা বড় বাঘ জঙ্গলের গভীরে ডেকে উঠল। অবশ্য বেশ দূরে। তার এবং আমাদের পথের মধ্যে একটা বড় টিলাও ছিল। ডাক শোনামাত্রই দণ্ড তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। অন্ধকারে তার চোখ দুটো বাঘের চোখের মতোই জ্বলে উঠল। বলল, ই সে বাঘটা হব্ব নিশ্চয়ই।

আমি ইচ্ছে করেই টিপ্পনী কেটে বসলাম, হঃ। তাংকু বদনরে টিক্কিট্ব লাগিছি। তু ত সব্ব জানিচি!

ভীষণ রেগে গিয়ে দণ্ড বলল, মু জানিচি না কঁড় তম্বমানংকু সান্যাল ডি. এফ. ও. জানিচি?

সান্যাল ডি. এফ. ও.-এর উপর দণ্ডর ভীষণ রাগ। আমারও রাগ কম নয়। কিন্তু সে-গল্প এখানে নয়। এই সব্ব জানিচি কথাটা প্রায়ই দণ্ড দর্পভরে বলত বটে কিন্তু সেই দর্প বা দম্ভ মিথ্যা আস্ফালন একেবারেই ছিল না। সব কৃতী মানুষেরই বোধহয় একটু দম্ভ থাকে। বিশেষ করে সেই কৃতিত্ব যদি চালাকি বা চুরি করে না অর্জিত হয়। দণ্ড সেইসব সত্যিকারের কৃতীরই একজন। আসলে, একে দম্ভ না বলে বোধহয় আত্মসম্মান বলাই ভাল। বার্ট্রাণ্ড রাসেলের ভাষায় যা হচ্ছে দ্য বেটার হাফ অফ প্রাইড। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে এই অঞ্চলের বনজঙ্গল দণ্ডর মতো ভাল করে কেউ জানত বলে আমার মনে পড়ে না। তবে বাঘেদের ঠিকানায় তো আর পিনকোডের ছাপ মারা থাকে না। কখনও কখনও এক রাতে তারা পঞ্চাশ মাইলও টহল মেরে ফেলে। এইটাই বাঘমুণ্ডার বাঘ, এ-কথাটা আন্দাজে ঢিল।

আমার পাইপ-খাওয়া আর সহ্য হল না। ধমকে বলল, চালুন্ত, চালুন্ত, আউ কেত্তে ভুশভুশ করিবে?

উঠলাম অগত্যা।

জিপটা পথের বাঁ পাশে ঠেলে পার্ক করে রেখে এসেছি আমরা। ভয় হচ্ছে, রাতে হাতিতে ফুটবল না খেলে তা দিয়ে। অংগুল থেকে ফার্স্টক্লাস পোড়-পিঠা কিনেছিলাম। সেগুলো সঙ্গে নিয়ে এলে অথবা পেটে ভরে নিয়ে এলেও মন্দ হত না। জিপ খারাপ হয়েছিল পুরুনাকোটের গেট পেরুনোর মাইলখানেক পরেই। পুরুনাকোটে গেলেই ভাল হত। অনেক কাছেও হত। কিন্তু কে কার কথা শোনে! টুকা বাংলোতে দণ্ডর দুই চেলা ভীম আর দুর্যোধন গুরান্টির নলা-পোড়া বানিয়ে রাখবে যত্ন করে। রাতে ফিরে নলা-পোড়ার সঙ্গে খিচুড়ি না খেতে পারলে এ ছার জীবন রাখারই আর কোনও মানে হয় না’ বলে জেদ ধরল দণ্ড। নলা-পোড়া খেতে অবশ্য চমৎকার। গুরান্টি অর্থাৎ মাউস্-ডিয়ারের মাংস ডুমো ডুমো করে কেটে নুন না-ছুঁইয়ে কাবারের মশলা মাখিয়ে নলা বাঁশের একমুখ ফুটো করে তার ভেতরে পুরে কাদা দিয়ে সেই মুখ সেঁটে বন্ধ করে ক্যাম্প ফায়ারের আগুনের মধ্যে ফেলে দিতে হয়। তারপর বাঁশের মধ্যে কাবাব তৈরি হয়ে গেলে ফটাং শব্দ সহকারে নলুবাঁশ ফেটে যায়। তখন আগুন থেকে বের করে প্লেটে জম্পেশ করে নুন মাখিয়ে, কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে খেতে এক্কেবারে ফাসটোকেলাস। হাজারিবাগের হান্নানের দোকানের কাবাবও হেরে যাবে নলাপোড়ার কাছে। এসব দণ্ডধরের পক্ষেই সম্ভব। নইলে, ভীম আর দুর্যোধনের মধ্যে এমন গলাগলি ভাবই বা কী করে যে হয় তাও আমার মোটা বুদ্ধির বাইরে। এমন অহি-নকুলের ভালবাসা একমাত্র গ্রেট দণ্ডধর ডাকুয়াই ঘটাতে পারে।

জিপ থেকে নেমে মাইলখানেক আসার পরেই আমার ডানপায়ের জুতোটি বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার সোটিকে মুক্তি দিয়েছিল। একটি ধারালো পাথরের মুখে পড়ে তার কিছু আগে হিলটিও হাপিস হয়ে যায়। তাই ডান পায়ে আমার জুতোর উপরের খোলসটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ঐ ঠাণ্ডা আইসক্রিমের মতো ধুলো, বরফের ছুরির মতো পাথর আর আলপিনের মতো কাঁটায় পা আমার ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল।

রাত আড়াইটে নাগাদ টুল্বকায় পৌঁছে মুগের ডাল খিচুড়ি এবং গুরান্টির নলা-পোড়া খেয়ে পায়ের সব কষ্টই যেন লাঘব হয়ে গেল। পথে ঘটনা তেমন আর বিশেষ ঘটেনি। একটা ভাল্লুকের সঙ্গে কুস্তি লড়তে হত, যদি না দণ্ড তার রোলেক্স গামছা মাথার উপর ধরে ‘ওরে মোরো সজনী, ছাড়ি গল্লা গুণমনি, কা কর ধরিবি’ গেয়ে গেয়ে তাকে নাচ না দেখাত। রুপোলি জরি বসানো ঘোরতর লাল রঙের রোলেক্স গামছাটি দণ্ডর সব সময়ের সঙ্গী। এমন মালটিপারপাস গামছা বড় একটা দেখিনি। সবসময়ই কাঁধে শোভা পায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *