শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প আয়নার মানুষ

শেয়ার করুনঃ

শক্তপোক্ত মানুষ হলে কী হয়, গদাধর আসলে বড়ো হা-হয়রান লোক। তিন বিঘে পৈতৃক জমি চাষ করে তার কোনোক্রমে চলে, বাস্তুজমি মোটে বিঘেটাক। তাতে তার বউ শাকপাতা, লাউ-কুমড়ো ফলায়। দুঃখেকষ্টে চলে যাচ্ছিল কোনোক্রমে। কিন্তু পরানবাবুর নজরে পড়েই তার সর্বনাশ।

পরানবাবু ভারি ভুলো মনের মানুষ। জামা পরেন তো ধুতি পরতে ভুলে যান, হাটে পাঠালে মাঠে গিয়ে বসে থাকেন, জ্যাঠামশাইকে ছোটোকাকা ডেকে বিপদে পড়েন। লোকে আদর করে বলে পাগলু পরান। তবে পরানবাবু মাঝে-মাঝে অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা বলে ফেলেন। একদিন গুরুপদকে বললেন, ওরে সাধুচরণ, চারদিকে চোর। খুব চোখ রাখিস বাপু।

তা সত্যিই সেই রাতে গুরুপদর বাড়িতে চোর ঢুকে বাসনপত্র নিয়ে গেল।

আর একদিন লক্ষ্মীকান্তকে বলে বসলেন, রজনীকান্ত যে! তা বিষ্ণুপুরে বেশ ভালো আছো তো ভায়া!

লক্ষ্মীকান্তর বিষ্ণুপুরে যাওয়ার কথাই নয়, যায়ওনি কোনোদিন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এর কিছুদিনের মধ্যেই বিষ্ণুপুরে একটা মাস্টারির চাকরি হয়ে লক্ষ্মীকান্ত চলে গেল। যাওয়ার আগে সবাইকে বলে গেল, পরানবাবু ছদ্মবেশী মহাপুরুষ।

 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প আয়নার মানুষ Vuter golpo aynar manush Shirshendu Mukhopadhyay

 

অনেকেরই সে কথা বিশ্বাস হল। গাঁয়ের মাতব্বর শশিভূষণ একবার পরানবাবুর খোঁড়া কুকুর ভুলুকে প্রকাশ্যে ল্যাংড়া বলায় খুব রেগে গিয়ে পরানবাবু বলেছিলেন, দ্যাখো নিশিবাবু, সব দিন সমান যায় না। ভুলু যদি ল্যাংড়া হয় তো তুমিও ল্যাংড়া।

অবাক কান্ড হল, দিনসাতেক বাদে শশীবাবু গোয়ালঘরের চালে লাউ কাটতে উঠে একটা সবুজ সাপ দেখে আঁতকে উঠে চাল থেকে পড়ে বাঁ-পায়ের গোড়ালি ভাঙেন। মাসটাক তাঁকে নেংচে-নেংচে চলতে হয়েছিল।

তা সেই পরানবাবু একদিন গদাধরকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি যেন কে হে! মুখখানা চেনা-চেনা ঠেকছে!

আজ্ঞে, আমি গদাধর লস্কর। চেনা না-ঠেকে উপায় কী বলুন! এই গাঁয়েই জন্মকর্ম, ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছেন। আপনার বাড়ির বাগান পরিষ্কার করতে কতবার গেছি, মনে নেই? পথেঘাটে হরদম দেখাও হচ্ছে।

খুবই অবাক হয়ে পরানবাবু বললেন, বটে! তা তুমি করো কী হে বাপু?

আজ্ঞে, এই একটু চাষবাস আছে। তিন বিঘে জমিতে সামান্যই হয়।

নাক কুঁচকে পরানবাবু বললেন, এঃ, মোটে তিন বিঘে! ছ্যা: ছ্যা:, ও বেচে দাও।

বলেন কী বাবু! বেচলে খাব কী?

ভারি বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে পরানবাবু বললেন, খাবে? কত খাবে হে হলধর? খেয়ে শেষ করতে পারবে ভেবেছ! হু:, খাবে!

কথাটা অনেকের কানে গেল। গাঁয়ের মুরুব্বিরা বললেন, ওরে গদাধর, পরান হল বাকসিদ্ধাই। যা বলে, তাই ফলে! ভালোয় ভালোয় জমিজমা বেচে দে বাবা।

শুনে ভারি দমে গেল গদাধর। শুধু একটা খ্যাপাটে লোকের কথা শুনে এরকম কাজ করাটা কি ঠিক হবে? জমি সামান্য হোক, বছর বছর সামান্য যে ফসলটুকু দেয়, জমি বেচলে যে তাও জুটবে না!

তার বউ ময়না ভারি ধর্মভীরু মেয়ে। ঘরে লক্ষ্মীর পট বসিয়েছে, ষষ্ঠী, শিবরাত্রি ব্রত-উপবাস সব করে। সেও শুনে বলল, পরানবাবু কিন্তু সোজা লোক নয়। যা বলে তাই হয়।

এসব শুনে ভারি ধন্দে পড়ে গেল গদাধর। তার মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি নেই, দূরদর্শিতা নেই, জমি চাষ করা ছাড়া আর কোনো কাজও সে পারে না। একটা পাগল লোকের কথায় ঝুঁকি নেওয়াটা ভারি আহাম্মকি হয়ে যাবে নাকি?

কিন্তু গাঁয়ের পাঁচজনের তাড়নায় আর বউ ময়নার তাগাদায় অবশেষে সে জমি বেচে এক পোঁটলা টাকা পেল। তারপর মাথায় হাত দিয়ে দাওয়ায় বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। এই কটা টাকা কয়েক মাসের মধ্যেই ফুরোবে। তারপর কী যে হবে! ভেবে বুক শুকিয়ে গেল তার।

বিপদ কখনও একা আসে না। জমিবেচা কয়েক হাজার টাকা বালিশের নীচে রেখে রাতে ঘুমিয়ে ছিল গদাধর। খাঁটিয়ে পিটিয়ে মানুষ, ঘুমটা বটে একটু গাঢ়ই হয় তার। কিচ্ছু টের পায়নি। সকালে উঠে বালিশ উলটে দেখল, তলাটা ফাঁকা। দরজার খিলও ভাঙা।

ফের মাথায় হাত দিয়ে দাওয়ায় বসে পড়ল সে।

থানা-পুলিশ করে কোনো লাভ নেই। থানা পাঁচ মাইল দূর। তার মতো চাষাভুসো থানায় এত্তেলা দিলে কেউ পুঁছবেও না। তার কাছে টাকাটা অনেক বটে, কিন্তু পুলিশ শুনে নাক সিঁটকোবে।

ময়নারও মুখ শুকিয়ে গেছে। সে মোলায়েম গলায় বলল, ভেঙে পড়ার কী আছে! আমার লক্ষ্মীর ঘট ভেঙে দু-দিন তো চলুক।

নুন-ভাত, শাক-ভাত খেয়ে কটা দিন কাটল বটে, কিন্তু তারপর আর চলছে না।

ময়না বলল, চলো, অন্য গাঁয়ে যাই। দরকার হলে তুমি মুনিষ খাটবে। আমি লোকের বাড়িতে কাজ করব। এ গাঁয়ে ওসব করলে তো বদনাম হবে।

বাপ-পিতেমোর গাঁ ছেড়ে যাব?

তবে কি মরবে নাকি?

কাহিল গলায় গদাধর বলল, তাই চলো।

পাছে কেউ দেখতে পায়, সেই ভয়ে সন্ধের পর দুটি পোঁটলা নিয়ে দুজন গাঁ ছেড়ে রওনা হল।

গাঁ ছেড়ে বেরোতে-না-বেরোতেই প্রচন্ড কালবোশেখির ঝড় ধেয়ে এল। আকাশে ঘন বিদ্যুতের চমক, বাজ পড়ার পিলে চমকানো আওয়াজ আর তুমুল হাওয়া। দুজনে হাত ধরাধরি করে পড়ি কি মরি ছুটতে লাগল। অন্ধকারে পথের মোটে হদিশই পেল না। শুধু টের পাচ্ছিল, হাওয়া তাদের প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। ঝোঁপ, জঙ্গল, মাঠঘাট পেরিয়ে তারা দিগবিদিকশূন্য হয়ে ছুটছে। বৃষ্টির তোড়ে তাদের জামাকাপড়, পোঁটলাপুঁটলি ভিজে জবজব করছে। দমসম হয়ে যাচ্ছে তারা। বাতাসের শব্দে আর বাজের আওয়াজে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ পাচ্ছে না। হাঁ করলেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস।

কালবোশেখির নিয়ম হল, সে বেশিক্ষণ থাকে না। আধঘণ্টা পরে ঝড় থামল, বৃষ্টি কমল। কিন্তু চারদিক ঘুরঘুটি অন্ধকার। কোথাও কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না।

দুজনে একটা জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

গদাধর বলল, এ কোথায় এলুম!

ময়না বলল, কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। আমার ভয় করছে।

জমিজমা আর টাকাপয়সা সব হাতছাড়া হওয়ায় গদাধরের আর ভয়ডর নেই। সে ময়নার হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরে বলল, আর ভয়টা কীসের?

ময়না বলল, চলো, ফিরে যাই।

গদাধর একটা শ্বাস ফেলে বলল, ফিরব বললেই কি ফেরা যায়? এ কোন জায়গাটায় এসে পড়লুম তাই বা কে জানে? পথঘাট আন্দাজ করা কি সোজা? ঝড়ের ধাক্কায় অনেকটা এসে পড়েছি। চলো, দেখি একখানা গ্রামট্রাম পাওয়া যায় কিনা!

অন্ধকারে ঝোঁপজঙ্গল ভেঙে তারা ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। গ্রাম বা লোকবসতি পেলেই যে আশ্রয় মিলবে এমন ভরসা নেই। উটকো লোককে কেই-বা আদর করে ঘরে জায়গা দেয়? আজকাল যা চোর-ডাকাতের উপদ্রব।

একটা জঙ্গলমতো জায়গা পেরোতেই সামনে একটা আলো দেখতে পেল গদাধর। বলল, ওই তো আলো দেখা যাচ্ছে। চলো, দেখা যাক, মাথা গোঁজার জায়গা মেলে কিনা!

সামনে এগিয়ে একখানা মাঠকোঠা দেখা গেল বটে, তবে তার বেশ দৈন্যদশা। সামনের ঘরে একখানা হ্যারিকেন জ্বলছে। বন্ধ দরজায় খুটখুট শব্দ করে গদাধর ভারি বিনয়ের গলায় বলল, আমরা বড়ো দুঃখী মানুষ। মশাই, একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া যাবে?

ভিতর থেকে বাজখাঁই গলায় কে যেন বলে উঠল, ভিতরে এসো, দরজা ভেজানো আছে।

দুজনে ভারি জড়সড়, ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকল। ঘরের কোনে রাখা হ্যারিকেনের আলোয় দেখা গেল, সামনে একটা তক্তপোশ, তাতে গোটানো বিছানা, কয়েকটা বাক্স-প্যাঁটরা, কিছু হাঁড়িকড়ি। কিন্তু ঘরে কেউ নেই।

গদাধর গলাখাঁকারি দিয়ে ভারি নরম সুরে বলল, আজ্ঞে, অপরাধ নেবেন না। উৎপাত করতেই এসেছি বলতে পারেন। তবে বিপদে পড়েই আসা। আমরা বড়ো দুর্দশায় পড়েছি কিনা!

কে যেন ভরাট গলায় বলে উঠল, দুর্দশার তো কিছু দেখছি না হে! কে বলল দুর্দশায় পড়েছ? একটু হাওয়া ছেড়েছিল আর দু-ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে, এই তো! তা চাষিবাসিকে তো ঝড়ে-জলে কতই কাজ করতে হয়।

তা বটে, বলে গদাধর হাত কচলাতে-কচলাতে বলল, যদি দয়া করে একটু আশ্রয় দেন তো দাওয়াতে বসেই রাতটা কাটিয়ে দেবখন।

দাওয়ায়! দাওয়ায় কেন হে? দিব্যি ঘরদোর রয়েছে, দাওয়ায় থাকবে কোন দুঃখে? ভিতরের ঘরে যাও, শুকনো কাপড়টাপড় পাবে। পরে নাও গে। উনুনে আঁচ দেওয়া আছে, খিচুড়ি চাপিয়ে দিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকো।

ময়না ফিসফিস করে বলল, গলা পাচ্ছি বটে, কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না কেন বলো তো!

গদাধরও ভড়কে গিয়ে বলল, তাই তো!

ময়না বলল, জিজ্ঞেস করো না!

গদাধর ফের হাত কচলে বলল, আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন আজ্ঞে? সামনে এলে একটু পদধূলি নিতুম।

ও বাবা, পদধূলি বড়ো কঠিন জিনিস। খুঁটির গায়ে একটা হাতআয়না ঝুলছে দেখতে পাচ্ছ?

গদাধর ইতিউতি তাকিয়ে দেখল, ভিতরের দরজার পাশে কাঠের খুঁটিতে একটা ছোট্ট হাতআয়না ঝুলছে বটে।

আয়নাখানা পেড়ে ওর ভিতরে তাকাও।

গদাধর অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে আয়নাটা পেড়ে তুলে ধরতেই এমন আঁতকে উঠল যে, একটু হলেই সেটা পড়ে যেত হাত থেকে। আয়নার ভিতরে একখানা সুড়ঙ্গে লম্বা মুখ। গোঁফ আছে। জুলজুলে চোখ। মাথায় বাবরি চুল। ভয়ের কথা হল, সে মুখের ঠোঁট নড়ছে আর কথা বেরিয়ে আসছে।

দুজনেরই ভিরমি খাওয়ার অবস্থা।

আয়নার লোকটা বলল, ওরে বাপ, আগে তো প্রাণ রক্ষে হোক, তারপর দাঁতকপাটি লেগে পড়ে থাকলে থেকো।

ময়না আর গদাধর কিছুক্ষণ বাক্যহারা হয়ে ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে রইল। এর পর ময়নাই প্রথম কথা কয়ে উঠল, আমরা বড্ড ভয় পাচ্ছি যে!

বলি ভয়টা কীসের, অ্যাাঁ। এই জন্যই বলে লোকের উপকার করতে যাওয়াটাই আহাম্মকি।

গদাধর সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, না না, ওর উপর কুপিত হবেন না, আমরা না-হয় ভয়ডর সব গিলে ফেলছি।

ভালো। টপ করে ওসব ফালতু জিনিস গিলে পেটে চালান করে দাও। দিয়েছ?

ময়না আর গদাধর ঘনঘন ঢোক গিলে যেন একটু সামলে নিল। গদাধর বলল, নাঃ, এখন আর তেমন বুক ঢিবঢিব করছে না। তোমার করছে ময়না?

নাঃ। মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে, এই যা!

আয়নার লোকটা বলল, ওতেই হবে। এখন গিয়ে রান্নার জোগাড়যন্তর করে ফ্যালো।

গদাধর আমতা-আমতা করে বলল, ফস করে অন্দরমহলে ঢুকব? কেউ যদি কিছু বলে?

লোকটা হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, বলার মতো আছেটা কে হে? এই আমি ছাড়া এ বাড়িতে আর জনমনিষ্যি নেই। যাও যাও, ভেজা কাপড়ে বেশিক্ষণ থাকলে নিউমোনিয়া ধরে ফেলবে।

কথা না-বাড়িয়ে তারা ভিতরের ঘরে এসে দেখল, দিব্যি ব্যবস্থা। আলনায় কয়েকখানা পাটভাঙা ডুরে শাড়ি, দুটো বোয়া ধুতি আর মোটা কাপড়ের কামিজ রয়েছে।

কুয়ো থেকে জল তুলে হাতমুখ ধুয়ে, ভেজা কাপড় বদল করে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, উনুনে আঁচ উঠে গেছে। চালডাল খুঁজতেই বেরিয়ে পড়ল। আলু, লঙ্কা, ফোড়ন, তেল সবই অল্পস্বল্প রয়েছে।

ময়না বলল, হ্যাঁ গা, আয়নার জ্যাঠামশাইকে জিজ্ঞেস করো না, উনি আমাদের সঙ্গে খাবেন কিনা।

গদাধর গিয়ে আয়নাটা নিয়ে এল, তারপর সুড়ঙ্গে মুখখানার দিকে চেয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, আজ্ঞে, আপনি পেরসাদ করে না-দিলে কোন মুখে খিচুড়ি খাই বলুন। ময়নার বড়ো ইচ্ছে আপনাকেও একটু ভোগ চড়ায়।

না হে বাপু, ওসব আমার সহ্য হয় না। আমার অন্য ব্যবস্থা আছে। তোমরা খাও।

কী আর করা, অন্যের বাড়িতে ঢুকে এরকম বেঁধেবেড়ে খাচ্ছে বলে ভারি সংকোচ হচ্ছে তাদের। তবে খিদেও পেয়েছে খুব। তাই তার লজ্জার সঙ্গেই পেটপুরে খেয়ে নিল।

তারপর দুজনে ক্লান্ত শরীরে আর ভরা পেটে মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর গদাধরের মনে হল, গতকাল ঝড়ে-বৃষ্টিতে পড়ে তার মাথাটাই গুলিয়ে গিয়েছিল। তাই বোধ হয় একটা আজগুবি স্বপ্ন দেখেছে। ময়নাকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করতে ময়না বলল, দুজনে কি একই স্বপ্ন দেখতে পারে?

তাহলে ব্যাপারটা কী?

তার আমি কী জানি! বাইরে কে যেন কে আছো হে! কে আছো? বলে চেঁচাচ্ছিল। গদাধর তাড়াতাড়ি উঠে সদর দরজা খুলে দেখল, নাদুসনুদুস একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। দড়িতে বাঁধা দুটো হালের বলদ, একটা দুধেল গাই, আর একটা হাল।

লোকটা গম্ভীর হয়ে বলল, এই নাও ভাই, ষষ্ঠীপদর গচ্ছিত হাল-গোরু সব বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছি আর এই নাও, এক বছরের হাল-গোরুর ভাড়া আর দুধ বাবদ দাম। সাতশো টাকা আছে।

গদাধর জিভ কেটে পিছিয়ে গিয়ে বলল, না না, ছি :-ছি :, এসব আমার পাওনা নয়। আমাকে কেন দিচ্ছেন?

লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না-দিলে কি রেহাই আছে হে! ষষ্ঠীপদ ঘাড় মটকাবে। বুঝে নাও ভাই, কাল রাতেই ষষ্ঠীপদ হুকুম দিয়ে গেছে।

আজ্ঞে, ষষ্ঠীপদ কে বটেন?

কেন, পরিচয় হয়নি নাকি? বলি, সে এখন আয়নার মধ্যে ঢুকেছে বলে তো আর গায়েব হয়ে যায়নি। তার দাপটে এখনও সবাই থরহরি কাঁপে। ওই পুবে খালধারের জমিটা তোমার। দশ বিঘে আছে।

কিছুই বুঝতে পারল না গদাধর। লোকটা চলে যাওয়ার পর গোরু আর বলদদের নিয়ে গোয়ালে বেঁধে টাকাগুলো ট্যাঁকে খুঁজে সে গিয়ে আয়নাটা পেড়ে আনল। কিন্তু দিনমানে আয়নায় আর সেই সুড়ঙ্গে মুখখানা দেখা গেল না। নিজের বোকা-বোকা হতভম্ব মুখখানাই দেখতে পেল সে।

এরপর আর একজন রোগাপানা লোক এসে হাজির সঙ্গে মুটের মাথায় দুটো ভরা বস্তা।

এই যে ভায়া, আমি হচ্ছি শ্যামাপদ মুদি। দু-বস্তা চাল দিয়ে গেলুম। ষষ্ঠীপদর হুকুম তো, আর অমান্যি করতে পারি না। এই দু-বস্তাই পাওনা ছিল তোমাদের। আর এই হাজারটা টাকা।

গদাধর কথা কইতে পারছে না। কেবল ঢোক গিলছে। জিভ, টাগরা সব শুকনো।

একটু বেলার দিকে একজন বউমানুষ এসে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা ময়নার কাছে হাজির। একটা পোঁটলা খুলে কিছু সোনার গয়না বের করে বলল, নাও বাবু। তোমার জিনিস বুঝে নাও। মোট আটগাছা সোনার চুড়ি, বাঁধানো নোয়া, বিছেহার, এক জোড়া বালা আর ঝুমকো দুল।

ময়না অবাক হয়ে বলল, এসব আমার হবে কেন?

তা জানি না, ষষ্ঠীপদ গচ্ছিত রেখেছিল। এখন হুকুম হয়েছে, তাই দিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু আমি তো ষষ্ঠীপদবাবুকে চিনিই না।

চিনবে বাপু, এ গাঁয়ে থাকলে তাকে না-চিনে উপায় আছে? তা তোমাদের কপাল ভালো যে, তার নেকনজরে পড়েছ। তার ভয়ে আমরা কাঁটা হয়ে থাকি কিনা!

সারাদিনে আরও অনেকে এসে অনেক জিনিস দিয়ে গেল। কেউ দা আর কুড়ুল, কেউ শীতলপাটি, কেউ কুয়োর বালতি আর কাঁটা, কেউ কাঠের টুল, কেউ বাসনকোসন বা কড়াই আর হাতা, এমনকী একগাছ ঝাঁটা অবধি। সবই নাকি ষষ্ঠীপদর গচ্ছিত রাখা জিনিস।

গদাধর আর ময়নার দিশেহারা অবস্থা। গরিব হলেও তারা লোভী লোক নয়। এসব জিনিস তাদের ঘরে ছিল না। তার ওপর ষষ্ঠীপদর রহস্যটাও তাদের মাথায় সেঁধোচ্ছে না।

খুব ভাবনাচিন্তার মধ্যেই দিনটা কাটল তাদের। সন্ধে হতেই হঠাৎ সেই বাজখাঁই গলা, সব জিনিস ফেরত দিয়ে গেছে তো?

গদাধর তাড়াতাড়ি আয়নাটা পেড়ে দেখল, সেই সুড়ঙ্গে মুখ। কাঁপা গলায় বলল, এসব কী হচ্ছে বলুন তো মশাই? আমরা যে কিছুই বুঝতে পারছি না।

লোকটা ধমক দিয়ে বলল, বেশি বুঝবার দরকার কী তোমার? কাল থেকে তেঁতুলতলার জমিতে হাল দিতে শুরু করো।

আমরা কি তবে এখানেই থাকব?

তবে যাবে কোন চুলোয়?

ময়না পিছন থেকে ফিসফিস করে বলল, ওগো, রাজি হয়ে যাও। গদাধর গদগদ হয়ে বলল, যে আজ্ঞে!

 

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments