হুমায়ূন আহমেদের গল্প ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু

শেয়ার করুনঃ

Loading

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। লেকচারার থেকে অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হয়েছি। বেতন বাড়েনি, যন্ত্রণা বেড়েছে। আমাকে দূর-দূরান্তরে পরীক্ষা নিতে পাঠানো হচ্ছে। পটুয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর। কলেজগুলোতে পড়াশোনা হয় না বললেই চলে। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের সুযোগ-সুবিধাও নেই। ছাত্ররা কিছুই পারে না। অতি সহজ প্রশ্নে মাথা চুলকায়, ঘাড় চুলকায়। মাথা এবং ঘাড় থেকে প্রশ্নের উত্তর আসে না।

 

হুমায়ূন আহমেদের গল্প ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু Moyurakhir tire prothom himu

 

অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছে এমন ছেলেকে যখন জিজ্ঞেস করি, পানির ফর্মূলা কী? সে আমতা আমতা করে বলে, H2O। যেন তার সন্দেহ আছে আসলেই H2O কিনা৷ তারপর জিজ্ঞেস করি, D2O কী? যারা কেমিস্ট্রি জানেন না তাদের বলছি, D2O হচ্ছে হেভি ওয়াটার। হাইড্রোজেন অ্যাটমে প্রটোন থাকে একটা, এখানে দুটা। D হলো হাইড্রোজেনের একটা Isotope৷ অতি সহজ এই প্রশ্নে পরীক্ষার্থী পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে বলে, স্যার হচ্ছে D2O ঢাকার পানি। তাহলে রাজশাহীর পানির ফর্মূলাটা কী? স্যার R2O। বরিশালের পানি? স্যার B2O। বরগুনার পানি? এইবার ছাত্র উৎসাহী। সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। সে হাসিমুখে জবাব দেয়, বরগুনার পানিরও স্যার একই ফর্মূলা B2O।

আমি হতাশ চোখে পরীক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে থাকি। ইন্টারনাল একজামিনার হাত কচলাতে কচলাতে বলেন, পাস করিয়ে দিতে হবে স্যার। গরিবের ছেলে। কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। ভাবটা এ রকম যে, ধনীর ছেলেমেয়েদের কেমিস্ট্রি জেনে পাস করতে হবে। গরিবের ছেলের পাসটা প্রয়োজন। কেমিস্ট্রি জানা প্রয়োজন না।

বাইরে পরীক্ষা নিতে গেলে ভাইভা বিষয়ক অতি ক্লান্তিকর অবস্থার ভেতর যেতে হয়। ছাত্রদের ফেল করাতে ইচ্ছা করে না, আবার পাস করাতেও ইচ্ছা করে না। ভাইভা নিতে কষ্ট। থাকা-খাওয়াতেও কষ্ট।

এক্সটারনাল শিক্ষকদের থাকার জায়গা হয় সাধারণত ল্যাবরেটরির লাগোয়া ঘরে। উদাহরণ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ। সেখানে পরীক্ষা নিতে গিয়ে ওই ঘরে অনেকদিন থেকেছি। একবার ভূতও দেখেছিলাম। যেসব কলেজে এ রকম কোনো ঘর নেই সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয় কোনো শিক্ষকের বাসায়। ভদ্রলোক হয়তো পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করছেন, সেখানে মূর্তিমান উপদ্রবের মতো অচেনা অজানা একজন মানুষ থাকতে আসেন। যাকে আপন করে নেওয়া যায় না, আবার দূরেও ঢেলে রাখা যায় না।

এক্সটারনাল ভদ্রলোক ইচ্ছা করলেই ভাইভায় প্রচুর ফেল করিয়ে ঝামেলা করতে পারেন। একবার কেমিস্ট্রির এক শিক্ষকের বাসায় আমার থাকার জায়গা হলো। ভদ্রলোকের বাসায় একটা বাথরুম। সেই বাথরুম স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘরের সঙ্গে এটাচড। আমার আবার রাতে কয়েক দফা বাথরুমে যেতে হয়। ভদ্রলোক অবশ্য খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, আমার শোবার ঘরের দরজা খোলা থাকবে। আপনার যতবার ইচ্ছা বাথরুমে যাবেন। কোনো সমস্যা নেই।

দীর্ঘ ভূমিকা দিলাম, এখন মূল গল্পে আসি। আমি পরীক্ষা নিতে গেছি পটুয়াখালীতে। ল্যাবরেটরির পাশের টিচার্স রুমে খাট পেতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গরমকাল। বেশির ভাগ সময় ইলেকট্রিসিটি নেই। ফ্যান চলে না।

প্রথম রাতে একফোঁটা ঘুম হলো না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি। রাত তিনটায় মশারির ভেতর থেকে বের হলাম। সঙ্গে সঙ্গে শত শত মশা আমাকে ছেঁকে ধরল। আবার মশারির ভেতর ঢুকলাম। গরমে টিকতে না পেরে আবার বের হলাম। মশাদেরকে বললাম, তোমরা যারা এখানে আছ তারাই আমার রক্ত খাও, বাইরে থেকে কাউকে ডেকে এনো না। ঘরটাকে আমার মনে হলো হাজতখানা। এই হাজতে সাতটা রাত পার করতে হবে ভেবে খুবই দমে গেলাম। এর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় কীভাবে? হঠাৎ করে মনে হলো একটা নদী কল্পনা করলে কেমন হয়?

নদীর পাড়ে একটা গাছের নিচে আমি বসে আছি। উথাল পাতাল হাওয়া নদীর উপর দিয়ে উড়ে আসছে। এমন হাওয়া যে আমার সামান্য শীত শীত ভাব হচ্ছে। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মশক বানিহীকে সম্পূর্ণ অগ্রহ্য করে নদী কল্পনা শুরু করলাম। নদীর একটা সুন্দর নামও দিলাম – ময়ূরাক্ষী। যারা আমার লেখা পড়ছেন তারা হয়তো পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন না যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার গরম লাগা কমে গেল। নদীর প্রবল হাওয়ায় মশারা উড়ে গেল। আমার খানিকটা শীত শীতও করতে লাগল।

এভাবেই তৈরি হলো হিমু, যে যেকোনো অবস্থায় কল্পনার নদী ময়ূরাক্ষীর কাছে চলে যেতে পারে। হিমুকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম উপন্যাসটির নাম ময়ূরাক্ষী। ময়ূরাক্ষীর হিমু আমি নিজে। প্রথম লেখা হিমু বিষয়ক বইয়ে ময়ূরাক্ষী নদী কীভাবে চলে এল, একটু দেখা যাক।

ছোটবেলার কথা। ক্লাস সিক্সে পড়ি। জিওগ্রাফি পড়ান মফিজ স্যার। তিনি ক্লাসে ঢুকলে চেয়ার-টেবিলগুলো পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে। স্যার মানুষটা ছোটখাটো, কিন্তু হাতের থাবাটা বিশাল। আমাদের ধারণা ছাত্রদের গালে চড় বসাবার জন্য আল্লাহতালা স্পেশালভাবে স্যারের এই হাত তৈরি করে দিয়েছেন। স্যারের চড়েরও নানা নাম ছিল – রাম চড়, শ্যাম চড়, যদু চড়, মধু চড়।

এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চড় হচ্ছর রাম চড়, সবচেয়ে নরমটা হচ্ছে মধু চড়। স্যার সেদিন পড়াচ্ছেন – বাংলাদেশের নদ-নদী। ক্লাসে ঢুকেই আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এই একটা নদীর নাম বল তো। চট করে বল। মফিজ স্যার কোনো প্রশ্ন করলে কিছুক্ষণের জন্য আমার মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়। কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। মনে হয় মাথার খুলির ভেতর জমে থাকা কিছু বাতাস কানের পর্দা ফাটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।

কী ব্যাপার চুপ করে আছিস কেন? নাম বল। আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, আড়িয়াল খাঁ। স্যার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলেন। খুব সম্ভব রাম চড়। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এত সুন্দর সুন্দর নাম থাকতে তোর মনে এল আড়িয়াল খাঁ? সব সময় ফাজলামি? কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক। আমি কানে ধরে সারাটা ক্লাস দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘন্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক আগে পড়ানো শেষ করে স্যার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে আয়।

আরেকটি বড় খাবার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি বিষন্ন গলায় বললেন, এখনো কানে ধরে আছিস কেন? হাত নামা। আমি হাত নামালাম। স্যার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, তোকে শাস্তি দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে, খুবই অন্যায়। তোকে নদীর নাম বলতে বলেছি, তুই বলেছিস। আয় আরও কাছে আয়, তোকে আদর করে দেই।

স্যার এমন ভঙ্গিতে মাথায় এবং পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন যে আমার চোখে পানি এসে গেল। স্যার বিব্রত গলায় বললেন, আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম, আর তুই বললি আড়িয়াল খাঁ। আমার মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে। আচ্ছা এখন সুন্দর একটা নদীর নাম বল। আমি শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললাম ময়ূরাক্ষী।

ময়ূরাক্ষী? এই নাম তো শুনিনি। কোথাকার নদী?

জানি না স্যার।

এই নামে আসলেই কি কোনো নদী আছে?

জানি না স্যার।

স্যার হালকা গলায় বললেন, আচ্ছা থাক। না থাকলে নেই। এটা হচ্ছে তোর নদী। যা জায়গায় গিয়ে বস। এমনিতেই তোকে শাস্তি দিয়ে আমার মনটা খারাপ হয়েছে। তুই তো দেখি কেঁদে কেঁদে আমার মন খারাপটা বাড়াচ্ছিস। আর কাঁদিস না।

 

0
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

বিদ্যাকল্পে গল্প ও অডিও স্টোরি প্রকাশ করার জন্য আজই যুক্ত হন