সাঁঝবেলাতে – বুদ্ধদেব গুহ

শেয়ার করুনঃ

তোমার হাসিটি কিন্তু ঠিক সেরকমই আছে।

 

তাই?

 

হুবহু।

 

রুবি বলল, বাজে কথা। মুখের পেশীর সঞ্চালন আর দাঁতের সারি হয়তো একই রকম আছে। হাসি মরে গেছে কবে।

 

কী জানি! আমি তো দেখছি তুমি দাঁড়িয়ে আছ দোতলার বারান্দাতে। মুখ ঝুঁকিয়ে দেখছ পথের দিকে। মুখের দু-পাশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তোমার কোমর-ছাপানো চুল। আর তুমি হাসছ।

 

কত বছর আগের কথা?

 

ত্রিশ বছর আগের কথা?

 

ত্রিশ বছর তো হল।

 

ত্রিশ বছর?

 

তাই তো। এবং তোমার হাসিটি বদলায়নি একটুও। তুমি আগের থেকে আরও সুন্দরী হয়েছ।

 

ছাই।

 

বলেই, রুবি আবারও হাসল। সেই হাসি।

 

তোমার ছেলে-মেয়ে কী?

 

আমার এক ছেলে, এক মেয়ে।

 

কত বড়ো হল।

 

বড়ো ছেলে চাকরিতে ঢুকেছে।

 

কোথায়?

 

টেলকোতে।

 

ইঞ্জিনিয়র?

 

হ্যাঁ।

 

আর মেয়ে?

 

মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে।

 

কোথায়!

 

গোখেল-এ।

 

আর আপনার?

 

আমারও এক ছেলে, এক মেয়ে।

 

কত বড়ো হল?

 

বড়ো, মেয়ে। একটি স্কুল পড়াচ্ছে বাংলায় এম এ করে।

 

আর ছেলে?

 

সে বকে গেছে। ড্রগ-অ্যাডিক্ট। কিছুই করে না।

 

আপনার তো কোনো নেশা ছিল না। সেসব ছিল সুপ্রতীপের। নেশাতেই তো সর্বস্বান্ত হল।

 

কী?

 

কী না, তাই বলুন।

 

মদ, সিগারেট, ড্রাগ। নইলে কেউ এত অল্পবয়সে চলে যায়?

 

চলে যাওয়ার কোনো বয়স নেই রুবি।

 

তা ঠিক।

 

যে যায় সে বেঁচে যায়। এই পৃথিবীতে বাঁচা বড়ো কঠিন কাজ। বিশেষ করে সুপ্রতীপের মতো ছেলের পক্ষে। ও বড়ো সোজা সরল ছেলে ছিল।

 

জানি।

 

তবু, নেশা করে মরার কোনো মানে নেই। ছেলেও তখন পায়ে দাঁড়ায়নি। মেয়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম।

 

অনেক নেশা আছে, তাতে মানুষ প্রাণে মরে না। মনে মরে।

 

সে কী নেশা?

 

আছে।

 

যেমন?

 

যেমন তুমি।

 

রুবি আবার হাসল। ওর চোয়ালটি চওড়া। এবং সুন্দর দু-পাটি ঝকঝকে দাঁত। এখনও তেমনই সুন্দর দেখায় হাসলে।

 

বলল, বাজে কথা। আপনিও এখনও সেরকমই আছেন।

 

বললে তো আর হল না। জুলপি আর মাথার দু-পাশ সাদা। রিটায়ার করব আর চার বছর বাদে।

 

সে তো বাইরেটা। ভেতরে একই মানুষ। সেই কলেজে পড়ার দিনের মতো।

 

সেইটাই তো অসুখ। মনের বয়স এখনও সতেরোই রয়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়াই না, তাই। আমার বহিরঙ্গ-রূপের সঙ্গে অন্তরঙ্গ-রূপের কোনো মিলই নেই। এর চেয়ে বেশি কষ্টর কোনো অসুখ নেই।

 

তারপর বললাম, তোমার একটা লাইলাক রঙের শাড়ি ছিল। মনে আছে? তোমার স্কুল ফাইনাল পাশের পর মেলোমশাই খুব বড়ো পার্টি দিয়েছিলেন। সেদিন তুমি সেই শাড়িটা পরেছিলে, চুলে দিয়েছিলে লাইলাক-রঙা ফুল।

 

আশ্চর্য। মনে আছে আজও আপনার?

 

আছে। তোমার এই লাইলাক-রঙা শাড়ি-পরা মূর্তি সেদিনও স্বপ্নে দেখেছি।

 

ছেলেরা তো শুনেছি স্বপ্নে শাড়ি-পরা অবস্থায় কাউকেই দেখে না।

 

তা ঠিক। কিন্তু তোমাকে তাই দেখেছি আমি। যে বয়সে এসে পৌঁছেছি, তাতে শাড়ি না-পরার চেয়ে শাড়ি-পা চেহারাই বেশি ভালো লাগে।

 

আপনি যে আমাকে…। কোনো দিনও তো বলেননি। অবশ্য একটা চিঠি। একটাই অবশ্য।

 

আমাদের সময়টা তো অন্যরকম ছিল। তুমিও তো বলনি কখনো। অথচ আজ সুপ্রতীপ নেই, ত্রিশটা বছর চলে গেছে মাঝে, অথচ এই বিয়েবাড়িতে এসে তোমাকে হঠাৎ দেখে মনে হচ্ছে,

 

সেদিন কিছু না বলেই বোধহয় ভালো করেছিলাম। মানে, বলতে যে পারিনি…

 

কেন?

 

আমাদের সময়ে মোহটাকেই প্রেম বলে জানতাম আমরা।

 

প্রেমের সঙ্গে মোহর কি ঝগড়া?

 

আবার হাসল রুবি।

 

আমার বড়ো শালি এসে বললেন, খাওয়া হয়েছে সুপ্রকাশ? খেয়ে নাও। বিয়ে শুরু হয়ে যাবে।

 

দিদি।

 

তুমি রুবিকে চিনলে কী করে?

 

বলতে পারেন, বিনা চেষ্টাতেই। আমাদের উলটোদিকের বাড়িতে থাকত ওরা। রুবির বাবার মস্ত ব্যবসা ছিল ওষুধের।

 

তাই?

 

হ্যাঁ। আমার সঙ্গে রুবির বিয়ে হলেও হতে পারত।

 

অ্যাই। বলে, রুবি আবারও হাসল।

 

দিদি হেসে বললেন, বিয়ে হলে আর এমন ভাব ভাব কদমের ফুল থাকত না। চামেলি কি এ কথা জানে?

 

আমি বললাম, না। দয়া করে আপনার ছোটোবোনটিকে আজ আর ওসব বলবেন না। কাল থেকে মেয়ের স্কুলের পরীক্ষা আরম্ভ। অত্যন্ত টেনসানে আছে।

 

তোমার মেয়ের কীসের পরীক্ষা?

 

আহা মিলির নয়। মিলি যে স্কুলেপড়ায় সেই স্কুলের মেয়েদের পরীক্ষা শুরু।

 

দিদি হেসে উঠলেন।

 

রুবি আবার হাসল।

 

বৌদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন না? থাক না। তুমিও তো কখনো সুপ্রতীপের সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দাওনি। কিছু সম্পর্ক সংসারে থাকা উচিত যা শুধুমাত্রই দু-জনের। আর কোনো দাবিদার থাকাই ভালো সে সম্পর্কে।

 

রুবি হাসল।

 

বলল, সত্যি, এই বয়সেও আপনার মতো এত রোমান্টিক মানুষ দেখা যায় না।

 

ভুল। বয়স আমার হয়েছে। তোমারও হয়েছে। যদিও তুমি আমার চেয়ে অনেকই ছোটো। কিন্তু আমার সতেরো বছরের প্রথম প্রেম, তার গায়ে তো আঁচড়টি পড়েনি। সে তো এই তিরিশটি। বছরেও আরও চিকন, আরও সবুজ, আরও নবীন হয়েছে। কোনো প্রেমেরই বয়স হয় না রুবি, যদি সে প্রেম আসলে প্রেম হয়।

 

নকল প্রেমও আছে বুঝি?

 

রুবি হাসল।

 

নেই?

 

জানি না।

 

জানি। স্বীকার করছ না। যে প্রেম ব্যবহারে, প্রয়োজনে, গ্যাস সিলিন্ডারের চিন্তায়, ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যতের ভাবনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, তা আর প্রেম থাকে না।

 

তবে তা কী?

 

অভ্যেস?

 

অভ্যেস?

 

আবার হাসল রুবি।

 

বলল, সত্যিই, তেমন পাগলই আছেন আপনি। প্রার্থনা করো, যেন থাকি। এই তো একমাসে গোপালকাকু আর বাঘাকে ইলেকট্রিক ফারনেসে ঢুকিয়ে দিয়ে এলাম। সেই লাল আভাটা চোখে লেগে আছে এখনও। আঁচ লেগে আছে কপালে। এই তো পরিণতি আমাদের। আমার তোমার সকলের। প্রার্থনা কোরো, যেন যে কটা দিন আর আছি এমন পাগলের মতোই বাঁচি।

 

গম্ভীর হয়ে গেল রুবি।

 

বলল, মেয়ের বিয়ে দেবেন না?

 

আমি? আমি কে? মেয়ের বিয়ে মেয়েই দেবে। পছন্দ তো তাদেরই। আমাদের দিন তো আর নেই। বোকা বোকা দিন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে তুমি আমার আসা-যাওয়ার সময়ে। বাথরুমের জানলাটা একটুখানি ফাঁক করে রেখে জোরে গান গাইতাম, যাতে তোমার শোওয়ার ঘর অবধি সে গান পৌঁছোয়। আমাদের প্রেমের প্রকাশ তো ওইরকমই ছিল। বাছুরের প্রেম ছিল আমাদের। পৃথিবী আর নাবালক নেই রুবি। সাবালকদের দিন এখন। আমাদের ছেলে-মেয়েরা যে কতবড়ো দায় থেকে বাঁচিয়েছে আমাদের তা কী বলব! হালকা লাগে না তোমার?

 

তা লাগে।

 

রুবি বলল।

 

চামেলির দিদি টগরদি এসে বললেন অ্যাই। সুপ্রকাশ তোমরা বসে পড়ো। লাস্টব্যাচ। এখনও…

 

চলো, রুবি।

 

আমার তো খাওয়া হয়ে গেছে সুদা।

 

সত্যি?

 

সত্যি।

 

বহরমপুরের কোন পাড়ায় থাক তোমরা? চলে যাব এক উইক এন্ডে।

 

গ্রান্ট হল রোডে। লালগোলার হাইওয়ে দিয়ে ঢুকতে যে রাস্তা, সে রাস্তাতে। আসবেন সত্যি? খুব খুশি হব। বৌদি ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আসবেন।

 

না। গেলে একাই যাব। একা গেলে ভয়?

 

ভয়, রুবি আবারও হাসল।

 

তারপর হাসি থামিয়ে বলল, না। ভয় নয়। ভয় কীসের? সব ভয়কেই মাড়িয়ে এসেছি। ঠিক আছে। তাই আসবেন।

 

২.

 

বহরমপুর শহরটা অনেক বদলে গেছে। রাস্তাঘাট বিরাট চওড়া হয়েছে। চেনা যায় না। আগে বাড়ি ছিল ক-টা, হাতে গুনে বলা যেত। এখন ট্রাক বাস গাড়ির জন্যে পথচলাই দায়।

 

রুবির-স্বামী সুপ্রতীপকে সকলেই চেনে। তবে সেই চেনাটা শ্রদ্ধার চেনা নয়। মাতাল, দেনায় ডোবা, সর্বস্বান্ত সুপ্রতীপকে লোকে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই মনে করে।

 

বহরমপুরে একবার ফুটবল খেলতে এসেছিলাম বছর পঁচিশেক আগে। তখন সুপ্রতীপের বাবা বেঁচে। জমজমাট পসার ছিল। বিরাট উকিল। উনি আমার জন্যে ব্যুইক গাড়ি পাঠিয়েছেন ওঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে। রুবির চিঠি নিয়ে এসেছিল ড্রাইভার আর চাপরাশি।

 

আমি যাইনি।

 

রুবিকে অন্য কারো স্ত্রী হিসাবে দেখতে আমার ইচ্ছা করেনি।

 

খুব রাগ হয়েছিল আমার। জ্বর হয়েছে বলে, মিথ্যা বলে, তাদের বিদায় করেছিলাম।

 

রুবির বিয়েতেও আমি যাইনি।

 

একবার ভেবেছিলাম পিঁড়ি ঘোরাতে গিয়ে ফেলে দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেব বড়োলোকের মেয়ের। তারপর ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিলাম। সানাই-এর শব্দ, গাড়ির শব্দ, হাজার লোকের হাসি শুনছিলাম শুয়ে শুয়ে। কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজে গেছিল। প্রেম যে একধরনের অসুখ, বড়ো মারাত্মক অসুখ, তা জেনেছিলাম সেই রাতে। অসুখটা সেরে গেছিল রুবি পরদিন বহরমপুরে চলে যাওয়াতে। কিন্তু আসল বসন্তর মতো অসুখ চলে গেলেও তার দাগ রয়ে গেছিল গভীর হয়ে, মনময়। এতগুলো বছর।

 

সাইকেল রিক্সাটা যখন ভাঙা-পাঁচিলের পাশের, মরচে-পড়া গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল দীন বাড়িটায় তখন মনটা খারাপ হয়ে গেল।

 

যাকে ভালোবাসে মানুষ, তাকে খুশি না দেখলে যে বড়ো কষ্ট হয়, এই কথা পঞ্চাশ বছরের আমি আগে জানি নি।

 

একটি ছাগল চরছিল ন্যাড়া মাঠে। আগে বোধহয় এইখানেই সবুজ লন ছিল। অনেক ফুল।

 

যারা চিরদিনই দরিদ্র তাদের কাছে দারিদ্র্য যে কী তা বোধহয় প্রতীয়মান হয় না। যারা একদিন ধনী ছিল তাদের কাছে যেমন হয়। সেই ন্যাড়া মাঠে খাকি-রঙা ঘেঁড়া হাফ-প্যান্ট পরা বছর দশেকের একটি ছেলে, একটি সাদা ছাগলছানার কানের মধ্যে মুখ ঠেকিয়ে ফুঁ দিচ্ছিল।

 

ছেলেটি নৈর্ব্যক্তিক ও অভদ্র গলায় বলল, কাকে চাই?

 

রুবি আছেন?

 

কে রুবি?

 

সুপ্রতীপবাবুর স্ত্রী?

 

ও। বড়ো কাকিমা? দাঁড়াও। ডেকে দিচ্ছি।

 

বলেই বলল, তুমি হাবলাকে একটু ধরো তো!

 

কে হাবলা?

 

ধ্যেত! ধরো না।

 

বলেই, ছাগলছানার জিম্মা আমায় দিয়ে ভিতরে চলে গেল।

 

রুবি ছেলেটির সঙ্গে বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। একটু পরেই।

 

অন্দরমহল অন্ধকার। রুবি সেই মহল আলো করে এল।

 

আমাকে দেখেই, ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।

 

এক মুহূর্ত মুখ কালো করেই রুবি হাসল। সেই হাসি।

 

বলল, সুদা! একটা পোস্টকার্ড ফেলে আসতে পারলেন না?

 

চলে যাই তবে?

 

না, না।

 

বলেই, এগিয়ে এসে, আমার হাত ধরল। সারা শরীরে আমার শিহরন খেলে গেল।

 

কোনোদিনই আমরা দুজনে দুজনকে স্পর্শ করিনি।

 

বলল, আসুন। ভিতরে আসুন।

 

আমার মন বলল, ভিতরেই তো আসতে চেয়েছিলাম। সেই উনিশ-শো পঞ্চাশ থেকে। তখন তুমি বিকেলবেলার আলোয় রাঙা একটি স্থলপদ্মর মতো ছিলে।

 

যে সালংকারা রুবিকে সেদিন চুমকির বিয়েতে দেখেছিলাম, এ রুবি সে রুবি নয়। আজ তার পরনে একটি ফলসা-রঙা শাড়ি। অর্জুনগাছের ছালের মতো রঙের পাড়। অফ-হোয়াইট একটি ব্লাউজ। বাঁ-দিকের বগলের কাছে ছিঁড়ে গেছে সেটা। পদ্মফুলের মতো দেখাচ্ছে বগলতলির সেই জায়গাটি।

 

ভাঙা ও মলিন সোফা সেটএ এনে বসাল আমাকে রুবি।

 

বলল, এক মিনিটে আসছি।

 

দু-মিনিট পরে শাড়ি জামা বদলে, হাতের রেকাবিতে একটি সন্দেশ ও এক গ্লাস লেবু চিনির শরবত এনে দাঁড়াল রুবি। আমাকে ঘরের চারদিকে তাকাতে দেখে বলল, এজমালি সম্পত্তি। ভাগের মা গঙ্গা পায় না। শ্বশুরমশাই তো শয্যাশায়ী। কিন্তু উইল করেছেন। আমার নিজের সামর্থ্য নেই। দেওরেরা উইলে কী লেখা আছে জানতে না পারায় কেউই আর গাঁটের কড়ি খরচ করে না। আমার জন্যে বরাদ্দ হয়েছে একতলার একটি ঘর। চলুন, সেখানে গিয়ে বসি।

 

দেওরদের কাউকে তো দেখছি না।

 

তারা চলে গেছে। লালদিঘিতে বাড়ি করেছে একজন। অন্যজন ধুলিয়ানে। ভালো ব্যবসা তাদের।

 

শ্বশুরমশাইকে দেখে কে?

 

আমি। আর ওই ভ্যাবলা।

 

ভ্যাবলা কে?

 

যে ছেলেটি খবর দিল। ওর বাবা ছিল শ্বশুরমশায়ের খাস চাকর। সেও মারা গেছে পাঁচ বছর হল। তার স্ত্রী আগেই মারা গিয়েছিল। বাড়ি ছিল জলঙ্গীতে। সেই থেকে ভ্যাবলা এখানেই আছে।

 

একা থাকো, তোমার ভয় করে না?

 

ভয়? নাঃ।

 

চলুন।

 

রুবির ঘরটি বেশ বড়ো। ওই ঘরেই এক কোনায় রান্না করে জনতা-স্টোভে। অন্য কোণে কালীমায়ের মূর্তি। জবাফুল দেওয়া আছে, টাটকা। খাটটি বিরাট। লেজারাস কেম্পানির। রাজা মহারাজারা যেমন খাটে পত্নী-উপপত্নীদের আদর করতেন।

 

ইলেকট্রিসিটি নেই। হাওয়াও নেই। গুমোট গরম।

 

রুবি বলল, হাত-পা ধুয়ে এসে খাটেই বসুন।

 

তাই করলাম। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বিরাট বাথরুম। মার্বেলের। নোংরা হয়ে, কালো হয়ে গেছে।

 

একটি তালপাখা নিয়ে রুবি হাঁটু মুড়ে বসল খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে। হাওয়া করতে লাগল আমাকে।

 

কিছুক্ষণ আগেই চান করেছে। আমলা তেলের গন্ধ বেরুচ্ছে ভিজে চুল থেকে। রুবি ঠিক তেমনই সুন্দরী আছে। সরু কোমর, সুন্দর বুক, মরালি গ্রীবা, বিলিতি ডল-এর মতো দুটি নীলাভ চোখ। ঝাঁপানো চুল। আর হাসি।

 

স্বগতোক্তির মতো বলল, আপনি আসতে চাইলেন, না করতে পারলাম না কিন্তু…

 

করতে কেন? আমি তো তোমার বৈভব দেখতে আসিনি। তোমাকে দেখতে এসেছি।

 

তাই?

 

রুবি বলল।

 

সত্যি বলুন তো কেন এসেছেন এই গরমে? এত কষ্ট করে?

 

সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না। বলতে পারলাম না যে, গত ত্রিশ বছর তোমার জন্যে অনেকই কষ্ট পেয়েছি অথচ একথা জেনেই যে, সেই কষ্টের কোনো পরিণতি ছিল না। আজকের কষ্ট সে কষ্টর তুলনায় কিছুমাত্রই নয়।

 

রুবির একটা ফোটো আছে আমার কাছে। ও জানে না সেকথা। চামেলি বা আমার ছেলে মেয়েরাও কেউই তা জানে না। রুবি আমারই একার। ওদের কোনো দাবি বা অধিকার নেই রুবির উপরে।

 

মুখে বললাম, তুমি জান না?

 

রুবি বলল, জানি, আবার জানিও না।

 

একদৃষ্টে ওর দু-চোখে চেয়ে থাকাতে ও বলল, কী দেখছেন অমন করে?

 

তোমাকে।

 

অস্বস্তি পেল রুবি। ওই গরমেও বুকের কাপড় টানল ভালো করে।

 

আমি বললাম, কী খাওয়াবে আমাকে?

 

আমি যা খাব। আমি যে গরিব সেকথা আপনার কাছে লুকোতে চাই না। লাভও নেই।

 

কে বলে, তুমি গরিব?

 

আমি জানি। হাওয়া খাচ্ছেন? ইস গরমে মুখটা লাল হয়ে গেছে।

 

আমি কিছু বললাম না।

 

আমরা অনেক কথা বললাম দুজনে। ছেলেবেলার কথা। এমন সব কথা, যা শুধু দু-জনেই বলা যায়।

 

ও বলল, বাবাকে দেখে আসি একটু। দীর্ঘজীবন বড়ো অভিশাপের। জানেন সুদা!

 

জানছি।

 

ঘরে ফিরে এসে রুবি বলল, এবার আপনাকে খেতে দিই? তার আগে ভ্যাবলাকে দিয়েই দিই। আমরা গল্প করতে করতে খেতে পারব তাহলে।

 

ভ্যাবলাকে ডেকে, এনামেলের থালায়, অনেকখানি ভাত ডাল আর তরকারি দিল।

 

শাড়ির পাড় দিয়ে বানানো আসন পেতে পেতলের মস্ত থালা গেলাস দেরাজ থেকে বের করে পেতে দিয়ে ডাকল, আসুন।

 

ভাত বেড়েই বলল, দাঁড়ান। ভালো ঘি আছে একটু। আপনাকে দি। ঘিও বের করল। দেরাজ থেকেই।

 

কাঁচাকলাই-এর ডাল, আলুপোস্ত আর চালতার টক। তার আগে ঘি।

 

আমি বললাম, তুমি কী খাবে? সব ভাতই তো দিয়ে দিলে।

 

আজ আমার উপপাস।

 

কীসের উপপাস?

 

দেব দর্শনের।

 

আমার বুকের মধ্যেটা যেন মুচড়ে উঠল।

 

বাইরের মাঠে ছাগল-মা কাঁদছিল। শালিক ডাকছিল কিচিরমিচির। বড়ো রাস্তা দিয়ে চলে-যাওয়া ট্রাক, গাড়ি আর সাইকেল-রিকশার সম্মিলিত আওয়াজ মাথার মধ্যে ধাক্কা দিচ্ছিল। আমার চোখ জলে ভিজে এল। বড়োলোকের মেয়ে, বড়োলোকের বউ, রুবির অবস্থা দেখে।

 

আমি বললাম, তুমি না খেলে আমি খাব না। আমি এক্ষুনি চলে যাব।

 

ও বলল, আপনার পায়ে পড়ি। অমন করবেন না।

 

আমি ভাত মাখছি। তুমি আমার সঙ্গে খাবে।

 

বলে, ঘি দিয়ে ভাত মেখে আমি এক গ্রাস রুবির মুখে দিলাম। সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল আমার। হয়তো রুবিরও।

 

রুবির গাল বেয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল।

 

নিজেকে সামলে নিয়ে ও বলল, আমার মা ছাড়া, কেউ আমাকে…

 

দুজনে মিলে খেতে খেতে বললাম, তোমার বড়ো কষ্ট, না রুবি। অনেকরকম কষ্ট। কী করা যাবে? আমার চেয়েও অনেক বেশি কষ্টেও তো আছে অনেক মানুষ।

 

তা আছে। তুমি ছেলের কাছে গিয়ে থাকো না কেন?

 

রুবী উত্তর দিল না।

 

কী?

 

ও যে-বাড়িতে পেয়িং-গেস্ট ছিল সেই বাড়ির মেয়ের সঙ্গেই ওর ভালোবাসা হয়েছে। তাকেই বিয়ে করবে। সেখানে, মানে, ছেলের শ্বশুরবাড়িতে থাকি কী করে? তাছাড়া আমার।

 

শ্বশুরমশাইকে তো এ অবস্থায় ফেলে যেতে পারি না। উনি যতদিন আছেন, আমার এখানে না থেকে কোনো উপায় নেই।

 

ছেলে তোমাকে টাকা পয়সা পাঠায় না? জিগ্যেস করছি বলে কিছু মনে কোরো না।

 

রুবি চুপ করে থেকে বলল, পুজোয় আর পয়লা বৈশাখে শাড়ি দেয়। আর কী দেবে? সকলেরই খরচ আছে তো। তা ছাড়া, চাকরি তো বিরাট কিছু করে না…।

 

৩.

 

খাওয়া-দাওয়ার পর আবার অনেক গল্প হল।

 

আমরা একবার হাড়োয়াতে পিকনিক-এ গেছিলাম। সমুদ্রর মতো ঝিল। কত পাখি। জলজ আঁশটে গন্ধ। রুবি সেদিন অনেকক্ষণ আমার পাশে বসেছিল। সূর্য ডুবেছিল আমাদের চোখের সামনে। সেই লালিমা এখনও যেন ওর মুখে মাখানো আছে।

 

সেকথা বলতে, ও হেসে উঠল।

 

উঠে, চা করল ট্রেনের সময় হওয়ার আগে। কুচো নিমকি দিল দেরাজ খুলে, কাচের বয়াম থেকে।

 

তারপর বলল পান খাবেন।

 

ভ্যাবলাকে দিয়ে পান আনাল।

 

তুমি?

 

নেশা করার জন্যে সারা পৃথিবীর কাছে বড়ো ঘৃণা পেয়ে গেছে ও। অথচ মানুষটা চমৎকার ছিল। নেশা বড়ো খারাপ জিনিস সুদা। আমি আর কী করতে পারি? পান খেতাম, তাই ছেড়ে দিলাম ওর কথা মনে করে।

 

পান খেতে খুব ভালোবাসতাম কিন্তু ও চলে যাবার পর খাইনি। তবে এখন খাই আপনার সঙ্গে একটা। একটু জর্দা দিন আমায়।

 

রুবির মেয়ে, কলকাতায় তার দাদার বাড়িতে থেকে পড়ে। কিন্তু এখানে থাকতেও সাহস পাই না।

 

বলল, কাছে রাখতে পারলে খুশি হতাম।

 

ভ্যাবলা, সাইকেল-রিকশা ডেকে দিল।

 

রুবি ওদের ভাঙা ফটক অবধি এল এগিয়ে দিতে। বেলা পড়ে এসেছিল। আমি রিকশায় ওঠার আগে বললাম, আমি কি তোমার জন্যে কিছুই করতে পারি না রুবি?

 

রুবি দুদিকে মাথা হেলাল। পানে ওর ঠোঁট রাঙা হয়ে উঠেছিল। ও হেসে বলল, না। কিছুনা।

 

তোমার জন্যে কিছু করতে পারলে আমার যে ভালোলাগাটা, তা কি কিছুই নয়?

 

নিশ্চয়ই! এই যে এলেন কত ভালো লাগল। এই তো মস্ত পাওয়া কোনোদিন কি ভেবেছিলাম এমন হবে? পঁচিশ-তিরিশ বছর পরে? ভালোলাগায় মরে যাচ্ছি আমি। রাতে আমার ঘুম হবে না আজ। স্বপ্ন বলে মনে হবে। আপনারও তো…

 

তোমাকে আমি কিছুই কী দিতে পারি না রুবি?

 

অনেকই তো দিয়েছেন। আপনি জানেন না?

 

তবু, কিছু চাও তুমি আমার কাছ থেকে। তখন আমরা গরিব ছিলাম, তোমরা বড়োলোক। এখন আমি বড়োলোক। নেবে না কিছুই আমার কাছ থেকে?

 

রুবি হাসল।

 

বলল, নেব। সেই যে একটা চিঠি দিয়েছিলেন আমাকে হাড়োয়া থেকে ফিরে, মমতা ঝি-এর হাত দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পাঠিয়েছিলেন, মনে আছে? তা আজও আছে আমার কাছে। চিঠিই দেবেন। মাঝে মাঝে আমায়। যখনি মনে পড়বে। তার চেয়ে বড়ো পাওয়া তো আর কিছুই হতে পারে না।

 

অন্তত আমার কাছে।

 

আমি রিকশাতে উঠলাম।

 

বললাম, যাই রুবি।

 

যাওয়া নেই। আসুন। ভালো থাকবেন।

 

তুমি ভালো থেকো।

 

আমি সবসময়ই ভালো থাকি।

 

বলেই, রুবি হাসল।

 

সাইকেল রিকশা এগিয়ে চলল। সামনে আলো, ভিড়, আওয়াজ, পেছনে অন্ধকার, নির্জনতা, থমথমে নিস্তব্ধতা।

 

একবার মুখ ঘুরিয়ে পেছনে চাইলাম। দেখলাম, মরা আলোয় বিকেলের স্থলপদ্মর মতো জ্বলজ্বল করছে রুবি, মরচে-পড়া গেটটি ধরে দাঁড়িয়ে, হাসছে।

 

আমার হারিয়ে-যাওয়া, কুড়িয়ে-পাওয়া রুবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *