ঋজুদার সঙ্গে পুরুণাকোটে – বুদ্ধদেব গুহ
আমরা ওড়িশার অঙ্গুল ফরেস্ট ডিভিশনের পুরুণাকোটের বন-বাংলোর বারান্দাতে বসেছিলাম। আমরা মানে, ঋজুদা, তিতির আর আমি। ডিসেম্বরের শেষ। হাড়কাঁপানো শীত। রোদটা তেরছাভাবে এসে পড়েছে মাটি থেকে অনেকই উঁচু বারান্দায়। হাতির ভয়ে বড় বড় শালের খুঁটির উপরে মস্ত পাটাতন করে নিয়ে তার উপরে বাংলো বানানো। ঋজুদা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে একটা মোড়ার উপরে পা দুটি তুলে দিয়ে পরপর তিন কাপ চা খাওয়ার পর গায়ে একটা ফিকে-খয়েরি রঙা পশমিনা শাল জড়িয়ে জম্পেশ করে পাইপ ধরিয়েছে।
তিতির বলল, বাঃ ঋজুকাকা, ফিকে-খয়েরি জমিতে গাঢ় খয়েরি রঙা পাড়টা দারুণ খুলেছে তোমার শালের।
ঋজুদা বলল, শালটা কে দিয়েছিল জানিস?
কী করে জানব? তিতির বলল।
শোনপুরের এই ওড়িশারই এক করদ রাজ্যের মহারাজা সিং দেও সাহেব। এক সময়ে উনি তাঁর রাজ্যের রাজধানী বলাঙ্গীরের একটা মার্ডার-কেস নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। সেই থেকে খুবই বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমাকে বহুবার বলাঙ্গীরে শিকারে যেতেও নেমন্তন্ন করেছিলেন কিন্তু তখন আমার প্রিয় শিকারভূমি ছিল কালাহান্ডি।
কালাহান্ডি! কী অদ্ভুত নাম রে বাবা। কালোহাঁড়ি?
ইয়েস। ওড়িশার কালাহান্ডি এক আশ্চর্য সুন্দর করদ রাজ্য ছিল। সুন্দর কিন্তু ভয়াবহ। অমন নৈসর্গিক দৃশ্য ভারতের কম জায়গাতেই আছে। মানে, বলতে চাইছি আলাদা রকম। বড় বড় কাছিমপেঠা, ন্যাড়া, বাদামি-রঙা পাহাড়গুলো, মনে হয়, অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক জন্তুরই মতো শুয়ে আছে।
যখন পুব-আফ্রিকাতে প্রথমবার যাই তখন সেখানকার কোনও কোনও জায়গা দেখে কালাহান্ডির কথা আমার বারবারই মনে পড়েছিল।
কী শিকার করতে যেতে কালাহান্ডিতে?
আমি বললাম।
বাঘ। আবার কী! যদিও অন্য শিকার, বিশেষ করে বড় বড় ভালুক, বুকে সাদা ‘V’ চিহ্ন আঁকা, অনেকই ছিল। SLOTH BEAR ছাড়াও। সুন্দরবনের সব বাঘই যেমন মানুষখেকো (পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগ যাই বলুন না কেন), কালাহান্ডির সব বাঘও মানুষখেকো ছিল। অন্তত আমি যে সময়ের কথা বলছি, আজ থেকে বছর পঁয়ত্রিশ আগের কথা, সেই সময়ে ছিল।
তিতির বলল, তুমি তো তখন ছেলেমানুষ ছিলে।
আমি এখনও ছেলেমানুষ। তোর মা অন্তত তাই বলেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে এমনই বেড়েছে ও বাড়ছে যে, গিনিপিগ বা শুয়োরেরাও লজ্জা পাবে। এখন মানুষই সর্ব-খেকো হয়ে গিয়ে অন্য সব প্রাণীদের হয় বংশ নাশ করছে নয়তো তাড়িয়ে দিয়েছে তাদের পুরনো বাসভুমি থেকে সেসব জায়গাতে, যেখানে এখনও কিছু গভীর জঙ্গল বেঁচে আছে।
তিতির কী একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময়ে একটা কালো অস্টিন গাড়ি এসে দাঁড়াল পুরুণাকোট বন বাংলোরই সামনে। গাড়িটা জঙ্গলের দিক থেকে এল।
ঋজুদা বলল, অস্টিন। এই গাড়িগুলোই লন্ডন শহরের ট্যাক্সি। লন্ডন-এর ট্যাক্সি হিসেবে অন্য কোনও গাড়ি দেখাই যায় না। ট্যাক্সি বলতে শুধু ইংলিশ গাড়ি। অস্টিন, কালো-রঙা।
ঋজুদার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে এক ছোট্টখাট্ট ভদ্রলোক নামলেন। ধুতি ও শিয়ালেরঙা সার্জ-এর গরম পাঞ্জাবি পরা তার উপরে কালো রঙা জওহর কোট। ফ্লানেলের। গাড়ি থেকে নেমেই উপরের দিকে মুখ করে ঋজুদাকে জোড়হাতে নমস্কার করে বললেন, প্রণাম আইজ্ঞাঁ।
ঋজুদা সম্ভবত গাড়ি থেকে নামার সময়ে ভদ্রলোককে চিনতে পারেনি কিন্তু। গলার স্বর শুনে চিনতে পেরেই রেলিং-ঘেরা বারান্দার রেলিং-এর সামনে এসে করজোড়ে নমস্কার করে বলল, হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! নমস্কার পট্টনায়েকবাবু। আপনি কেমিতি জানিলানি যে, মু এটি আসিচি? আসন্তু আসন্তু।
পট্টনায়েকবাবু হেসে বললেন, আইজ্ঞা আপনংকুতে আগমন নাহি, সে তো আবির্ভাব হেদা। সব্বেমানে জানিচি।
ঋজুদা জোরে হেসে উঠল।
পট্টনায়েকবাবু ছোট ছোট পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে খুটখুট করে দোতলাতে উঠে এসে বললেন, এই সাত সকালেই কেন এলাম তা নিশ্চয়ই ভাবছেন আপনি।
তা তো ভাবছিই! কিন্তু কোথা থেকে এলেন এখন?
ঢেনকানল থেকে, অঙ্গুল হয়ে। অঙ্গুলেও থাকতে হয়। ঢেনকানলেও কাজ হচ্ছে আমার। তাই অন্ধকার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়লাম, আপনি কোথাও বেরোবার আগেই যাতে আপনাকে ধরতে পারি।
তিতির ভিতর থেকে একটা কাপ নিয়ে এসে চা ঢেলে দিল পট্টনায়েকবাবুকে। বিস্কিটের প্লেট এগিয়ে দিল। তারপর বলল, চিনি ক’ চামচ?
না না, চিনি দেবেন না, দুধও নয়। আমি ডায়াবেটিক। আর দুধ খেলেও অম্বল হয়, বয়স তো হল।
পরিষ্কার বাংলাতে বললেন তিনি।
আমাদের অবাক হতে দেখে ঋজুদা বলল, অধিকাংশ শিক্ষিত ওড়িয়াই বাংলা শুধু বলতেই পারেন না, পড়তেও পারেন। অথচ শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে সম্ভবত হাজারে একজন ওড়িয়া বলতে পারেন বা পড়তে পারেন। এমনি কি আর আমি বাঙালিকে কূপমণ্ডুক বলি! পশ্চিমবঙ্গের নেতা থেকে সেক্রেটারি, সেক্রেটারি থেকে কেরানি সকলেই কূপমণ্ডুক।
পট্টানায়েকবাবু একটা মুচকি হেসে বললেন, তা ছাড়াও একটা ব্যাপার আছে।
কী ব্যাপার?
বাঙালিরা প্রায় সকলেই এক দুরারোগ্য সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স-এ ভোগেন, সুপিরিয়রিটির কারণ সম্বন্ধে অনুসন্ধান না করেই।
কথাটা শুনে আমাদের কারুরই ভাল লাগল না। কারণ, আমরা বাঙালি।
ঋজুদা একটু চুপ করে থেকে বলল, কথাটা আমাদের শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা হয়তো সত্যিই। ওতে বাঙালির ভালর চেয়ে খারাপই হয়েছে অনেক বেশি।
তারপর বলল, এবারে বলুন, ভোর রাতে এই শীতের মধ্যে বেরিয়ে এখানে আসা হল কেন?
গরজ বড় বালাই ঋজুবাবু। আপনি তো বাঘমুণ্ডাতে বহুবার গিয়ে থেকেছেন।
তা থেকেছি। বাঘঘমুণ্ডা খুবই প্রিয় জায়গা ছিল আমার। যখন এদিকে আসতাম নিয়মিত বছর পঁচিশ-তিরিশ আগেও। এবারে এসেছি আমার এই দুই সাগরেদ, রুদ্র আর তিতিরকে ‘সাতকোশীয়া গন্ড’ ঘুরিয়ে দেখাব বলে। শুনতে পাচ্ছি নাকি। দু-এক বছরের মধ্যেই এই অঞ্চল অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষিত হবে।
হুঁ। অভয়ারণ্য! মানুষের জন্যও অভয় দিতে বলুন। মানুষও বড় ভয়ে ভয়ে আছে।
তারপর বললেন, আপনার কি একছেলে এক মেয়ে? এরাই? আর নেই?
ওঁর কথাতে ঋজুদাতো বটেই, আমরাও হো হো করে হেসে উঠলাম।
পট্টনায়েকবাবু অপ্রতিভ হলেন।
হাসির দমক কমলে, ঋজুদা বলল, কোনও মেয়ে আমাকে বিয়েই করল না মশাই তার ছেলে-মেয়ে আসবে কোথা থেকে?
তবে? এরা?
এরা আমার কমরেডস। এদের দেখে ভাববেন না এরা সাধারণ বাঙালি এবং খোকা-খুকু। এরা আমার সঙ্গে আফ্রিকাতে, সেশেলস-এ এবং ভারতের বহু। জায়গায় গেছে এবং বন্দুক-রাইফেল চালাতে এবং বুদ্ধিতেও এরা আমাকেও সহজেই হার মানায়।
তিতির বলল, আমি তো সেশেলস-এ যাইনি। তা ছাড়া এটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে ঋজুকাকা। বিনয় ভাল, কিন্তু অতিরিক্ত বিনয় নয়। সেটা বরং লক্ষণ হিসাবে খারাপই।
পট্টনায়েকবাবু বললেন, তবে তো চমৎকার। আমি যে কাজে এসেছি সে কাজ আরও সহজ হবে।
এখন বলুন কাজটা কী?
বাঘমুণ্ডাতেও আমার কাজ চলেছে। অঙ্গুলের নিলামে এবারে ঢেনকানলের অনেকগুলো ব্লক এবং বাঘমুণ্ডার ব্লকও ডেকেছিলাম। ভাল কাঠ আছে বাঘঘমুণ্ডাতে সে কথা তো আপনি জানেনই। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে সিজন খোলার পরে মার্কা মারা শেষ হতে না হতে এক আপদ এসে উপস্থিত হল। বাঘঘমুণ্ডাতে হাতিরই যা বিপদ ছিল। তাও দিনে তত নয়। কিন্তু এবারে সিজন খোলার পর অক্টোবর থেকে নভেম্বর অবধি আমার ন’জন কাবাড়িকে খেয়ে ফেলল এক মানুষখেকো বাঘে। তারা সবাই আবার করতপটা গ্রামের মানুষ। অঙ্গুল থেকে দিনমানে আমার এখানে আসার উপায়ই নেই। কারণ, আপনি তো জানেনই, আসতে গেলে করতপটার উপর দিয়েই আসতে হয়। তাইতো অন্ধকারে এলাম। ফিরতেও হবে অন্ধকারেই।
তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ডিসেম্বরের গোড়াতে সব কাবাড়িরাই কাজ বন্ধ করে ফিরে গেল। প্রত্যেক পরিবারকে মোটা ক্ষতিপূরণও দিলাম। কিন্তু জীবনের ঘাটতির ক্ষতি কি পয়সা দিয়ে কোনওদিনও পূরণ করা যায়? বিবেকেও লাগে। আমি ঠিকাদার, পয়সা রোজগারের জন্য ঠিকাদারি করি আর আমার হয়ে কাজ করতে এসে এই ন’জন গরিব মানুষ প্রাণ দিল মানুষখেকোর মুখে। তাই অঙ্গুলের ফরেস্ট অফিস থেকে আপনি আসছেন খবর পাওয়া মাত্রই ঠিক করে রেখেছিলাম যে, যেদিন এসে পৌঁছোবেন বিকেলে বা রাতে, তার পরদিনই ভোরে আপনাকে এসে ধরব।
ডিসেম্বরে বাঘটা কোনও মানুষ ধরেনি?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
আমার সব লোক এবং করতপাটার সব কাবাডিরা সদলে চলে গেল নভেম্বরের ত্রিশ তারিখের মধ্যেই। তার ধরবে কাকে?
তারপরেই বললেন, তবে ধরেনি, তা নয়। ধরেছে, পুরুণাকোটেরই এক ভিখারিনী বাইয়ানীকে আর টুকা আর পুরুণাকোটেরই মাঝে যে ছোট্ট গ্রামটা আছে, নাম ভুলে যাচ্ছি, সেই গ্রামের একটা ছেলেকে।
তিতির বলে উঠল, বাইয়ানী মানে কী?
ঋজুদা বলল, ওড়িয়াতে পাগলিনীকে বাইয়ানী বলে।
অন্য জায়গাতেও তো মানুষ ধরেছে। তা হলে বাঘটার নাম বাঘঘমুণ্ডার বাঘ। হল কেন?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল, পট্টনায়েকবাবুকে।
উনি বললেন, অন্য জায়গাতে বিশেষ যায় না, বাঘমুণ্ডা গ্রামের কাছাকাছিই ঘোরে-ফেরে। বাঘটার হেডকোয়ার্টাস হচ্ছে বাঘঘমুণ্ডার হাতিগির্জা পাহাড়ে।
হাতিগির্জা পাহাড়!
তিতির বেশ জোরেই চেঁচিয়ে উঠল। বলল, ‘পর্ণমোচী’ পত্রোপন্যাসে পড়েছি হাতিগির্জা পাহাড়ের কথা।
আমি বললাম, এখানের হাতিরা বুঝি খ্রিস্টান? গির্জাতে গিয়ে উপাসনা করে?
সকলেই হেসে উঠল আমার কথাতে।
তিতির বলল, বাঘঘমুণ্ডার কথাও পড়েছি আমি নগ্ন নির্জন’ উপন্যাসে।
পট্টনায়েকবাবু চায়ের কাপটা সশব্দে ডিশ-এর উপরে নামিয়ে রেখে একটু অধের্য গলায় বললেন, তা হলে কী হল আমার আর্জির ঋজুবাবু? আমাকে কি ফেরাবেন আপনি?
ঋজুদা একটু চুপ করে থেকে বলল, এদের নিয়ে একটু ঘুরতে এসেছি। তবে, মানুষখেকো বাঘটা আমরা থাকতে থাকতে যদি কোনও মানুষ মারে তা হলে একটা চেষ্টা করা যেতেই পারে অবশ্য। আপনি যখন এমনভাবে দৌড়ে এসেছেন।
মানুষ না মেরে যদি গোরু-টোরু মারে?
গোরু-টোরুও মারে নাকি? তবে তো বাঘটা বেশ বহাল তবিয়তেই আছে বলতে হবে। যে সব বাঘ বুড়ো, বা যে-কোনও কারণেই হোক অশক্ত হয়ে যায়, তারাই সাধারণত মানুষ ধরে। মানুষ তো বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য নয়। গোরুও অবশ্য নয়।
তা জানি না, কিন্তু এই বাঘটার তো দেখি বাছ-বিচার নেই। চেহারাতেও সে দশাসই। বাঘঘমুণ্ডার বন-বাংলোর পিছনের মাঠ থেকে একটা নধর গোরু ধরে সেটাকে হাতিগির্জা পাহাড় অবধি কিছুটা পিঠে তুলে, কিছুটা টেনে, কিছুটা হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে খেয়েছিল। তা হলে কতখানি শক্তি ধরে বুঝতেই পারছেন।
তাই? তা হলে যদি কোনও kill হয়, আমাকে খবর দেবেন। চেষ্টা করে দেখব। আমরা কিন্তু এই অঞ্চলে ঠিক সাতদিনই আছি। ফেরার রিজার্ভেশনও করা আছে। কটক থেকে। ফিরতেই হবে। তারই মধ্যে এদের দু’জনকে মহানদীর এপার-ওপারের সব জঙ্গল দেখাতে হবে, অতএব বুঝতেই পারছেন! তবে যেখানেই যাই, রাতে ফিরে এসে পুরুণাকোটেই থাকব। এখানেই খবর পাঠাতে বলবেন। রাতে kill হলে যেন ভোরেই এসে খবর দেয়। এবং এমন লোককেই খবর দিতে পাঠাবেন যে, সে-ই যেন আমাদের kill-এর জায়গাতে নিয়ে যেতে পারে।
হ্যাঁ। হ্যাঁ। তাতো বটেই।
কিন্তু মানুষখেকো বাঘ শিকার তো আর তা বলে তুড়ি মেরে করতে পারব না। মানুষ-মারা পিস্তল ছাড়া তো সঙ্গে কিছুই আনিনি এবারে। মানে, অন্য কোনও আগ্নেয়াস্ত্র।
ঋজুদা বলল, পট্টনায়েকবাবুকে।
আরে সেজন্য চিন্তা নেই। ঢেনকানল-এর ছোট রাজকুমার, মানে, নিনি কুমারের বাড়ি থেকে নিয়ে আসব।
ও। নিনি কুমারের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তিনি তো আমার চেয়ে অনেকই ভাল শিকারি। তাঁকে এই বাঘ মারতে বলেননি কেন?
আরে তিনি থাকলে তো এখানে! চার মাসের জন্য ইউরোপে গেছেন। ফিরবেন জানুয়ারির শেষে।
তা তিনি না থাকলে বন্দুক-রাইফেলই বা পাবেন কী করে?
সে আমার দায়িত্ব। তা ছাড়া ঢেনকানল-এর রাজবাড়ি ছাড়াও আমার অন্য অনেক বন্ধু আছে।
পরের ওয়েপন দিয়ে এররকম বিপজ্জনক শিকার কখনও করিনি! করা বিপজ্জনকও বটে।
ঋজুদা চিন্তিত মুখে বলল।
একবার না হয় আমাকে ধনে-প্রাণে বাঁচাতে একটু বিপদের ঝুঁকি নিলেনই ঋজুবাবু। তা ছাড়া, আপনার কোনও বিপদ হবে না। আপনি ঋদ্ধিমান পুরুষ।
বিপদের কথা কি কেউ বলতে পারে পট্টনায়েকবাবু? কার যম যে পিছনে কখন এসে দাঁড়ায়, সে কথা মানুষ যদি জানত!
তারপর কী একটু ভেবে ঋজুদা বলল, ঠিক আছে। কথা দিলাম আপনাকে for old times sake!
পট্টনায়েক বাবু চেয়ার ছেড়ে ওঠার সময় বললেন, বাবাঃ। সাতটা বেজে গেল। কত জায়গাতে যেতে হবে। কত কাজ! কিন্তু নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছি। এবারে একটা সুরাহা হলেও হতে পারে।
.
অনেক গল্প-টল্পর পর এক এক করে চান সেরে ব্রেকফাস্ট খেয়ে অঙ্গুলের বিমলবাবু, শ্রীবিমলকৃষ্ণ ঘোষ, যে জিপটা আমাদের ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলেন, সেটা নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম টিকরপাড়ার দিকে। আমিই জিপ চালাচ্ছিলাম। মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রার জিপ। এখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে।
ঋজুদা বাঁদিকের সিটে বসে পাইপ ধরাতে ধরাতে বলল, জিপে বসে পাইপ খাওয়ার এই অসুবিধা। চারদিক থেকে হাওয়া ঢুকতে থাকে। পইিপ ধরানোতে মহা হাঙ্গামা। যদিও বা ধরল, তো নিভে যায় পরক্ষণেই। ধৈর্যের পরীক্ষা!
আমি একটু আস্তে করলাম গতি। তিতির পিছন থেকে ফুট কাটল, পাইপ খাওয়াটা তো ছেড়ে দিলেই পার। পাইপ খেলে জিভে ক্যানসার হয় তা বুঝি তুমি জানো না?
জানব না কেন? তবে পাইপ তো তিরিশ বছর ধরে খাচ্ছি। ভাত না খেলেও চলে, পাইপ না খেলে চলে না। আমাদের বাড়ির উলটো দিকের বাড়ির যোগেনবাবু পান-তামাক-মদ কিছুই খেতেন না। একেবারে সদাচারী, সদালাপী, অজাতশত্ৰু মানুষ। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে জিভের ক্যানসারে মারা গেলেন। কীসে যে কী হয়, তা আল্লাই জানেন!
পথটা গেছে সোজা আর তার ডানদিক দিয়ে একটা উপল-বিছানো পাহাড়ি নদী চলেছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘন বনের ভেঁড়া-ঘেঁড়া চন্দ্রাতপের নীচে নীচে রোদ আর ছায়ার সঙ্গে খেলা করতে করতে। নদীর মাঝে মাঝে অনেকগুলো ছোট ছোট প্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। চলকে-যাওয়া নুপূর-পরা জল ঝিলমিল করে উঠছে শীত সকালের রোদ গায়ে পড়াতে। একটা বাদামি কালো কুম্ভাটুয়া পাখি ডাকছে। নদীর ওপার থেকে, গুব-গুব-গুব-গুব করে। শীতের হাওয়াতে নলি আর কণ্টা বাঁশের বনে কটকটি আওয়াজ উঠছে। বাঁশের গায়ের হালকা পাতলা হলুদ আর পেঁয়াজখসি-রঙা খোলস উড়ে উড়ে পড়ছে পথের উপর আলতো হয়ে।
নদীতে কত্ত রকমের যে পাথর! এরকম নদী দেখলেই আমার ইচ্ছে করে চড়ুইভাতি করতে বসে যাই।
তিতির বলল।
যা বলেছ!
আমি বললাম।
এই নদীর, নদী নয়, একে স্থানীয় মানুষরা নালা বলে, নাম বোষ্টম নালা। পুরুণাকোটের আগে বাঁক নিয়ে চলে গেছে বাঁয়ে বাঘমুণ্ডার দিকে। সেখানে আবার এর নাম নন্দিনী।
বাঃ। ভারী সুন্দর নাম তো। এই নালাদের কথাও পড়েছি ‘জঙ্গলের জার্নাল’-এ।
তারপরে একটু চুপ করে, থেমে ঋজুদা বলল, আমরা মহানদী পেরোব ফেরি-নৌকোতে। গাড়ি, বাস, ট্রাক, সবই ফেরি করেই পেরোয়। যে মহানদী দেখবি, তাই ওড়িশার মুখ্য নদী। আমাদের যেমন গঙ্গা। আসামের যেমন ব্রহ্মপুত্র।
‘সাতকোশীয়া গন্ড’ শব্দ দুটির মানে কী ঋজুকাকা?
তিতির বলল।
‘গন্ড’ মানে ওড়িয়াতে গিরিখাত বা Gorge। আর ‘কোশ’ মানে হচ্ছে ক্রোশ। ‘সাতকোশীয়া’ মানে হল সাত ক্রোশ অর্থাৎ চোদ্দো মাইল। কিলোমিটারের হিসাব তো এই সেদিন হল।
মহানদীর উৎস যদিও অনেক দূরে, এখানে মহানদী দুপাশের ঘন জঙ্গলাবৃত উঁচু পাহাড়ের মধ্যের গিরিখাত দিয়ে বয়ে গেছে চোদ্দো মাইল। গন্ড শেষ হয়েছে বডোমূল-এ গিয়ে। বিনকেই থেকে বড়োমূল। তারপর মহানদী চওড়া হয়ে ছড়িয়ে গেছে। এই নদী বেয়েই লক্ষ লক্ষ বাঁশ বেঁধে এক একটি ভেলা বানানো হত। তারই উপর ভেলার জিম্মাদারদের রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া, গানবাজনা, লণ্ঠন জ্বেলে রাতে তাস খেলা। গোরু-বাছুরও উঠত তাতে কখনও সখনও। পেট্রল লাগত না, দাঁড় লাগত না, কোনও তাড়াই ছিল না। নদী যখন যেমন গতিতে ভাসিয়ে নিয়ে যেত, কখনও ধীরে, কখনও জোরে, তেমনই যেত তারা। চোদ্দো মাইল যেতেই দু থেকে তিন দিন লাগত।
লাগত কেন? এখন লাগে না?
এখন কাগজ তো আর কাঠের মণ্ড বা বাঁশ থেকে তৈরি হয় না। পরিবেশ বাঁচাতে এখন রি-সাইক্লিং করেই কাগজ তৈরি হয়। আরও নানা উপায়ে বানানো হয়ও এবং হবে ভবিষ্যতে।
তবে তো জঙ্গল অনেক বাড়বে।
আমি বললাম।
বাড়ছে আর কোথায় বল? সরষের মধ্যেই যে ভূত ঢুকে গেছে। আমরা মানুষরাই রাহুগ্রস্ত হয়ে গেছি, আমাদের লোভেই চুরি করে বন নষ্ট করছি। এত মানুষ যদি কোনও দেশে থাকে এবং তাদের সংখ্যা যদি রোজই বাড়তে থাকে, জন্মহার যদি কমানো না যায় তবে পরিবেশ কেন, বন্যপ্রাণী কেন, কোনওকিছুই বাঁচবে না। সবই বুভুক্ষু আর লোভীদের হাতে নষ্ট হয়ে যাবে। অবধারিতভাবে নষ্ট হবে। আমাদের কেতাবি অর্থনীতিবিদরা যাই বলুন না কেন, তাঁরা যেহেতু নিজের দেশকে তেমন করে চেনেন না, জানেন না, তাঁদের বই-পড়া বিদ্যেতে এ দেশের প্রকৃত কোনও উন্নতিই হবে না।
আমরা চুপ করেই রইলাম। বারেবারেই আমরা বুঝতে পারি ঋজুদা আমাদের দেশকে কতখানি ভালবাসে। অথচ সে ইচ্ছা করলে মহাসাহেব হতে পারত। পৃথিবীর কোন দেশে যে যায়নি! আমাদেরও তো সঙ্গে করে নিয়ে গেছে কত দেশে। আর স্বদেশের কথা তো ছেড়েই দিলাম। এ দেশকে এত ভালভাবে কম মানুষই জেনেছেন।
বিদেশে গেলেই দেশে ফিরে লোকে আমাদের দেশকে তাচ্ছিল্যর চোখে দেখে, ঠোঁট বেঁকায়। একমাত্র ঋজুদাকেই দেখলাম, সারা পৃথিবী বহুবার ঘুরেও যে বলে আমার দেশের মতো দেশ হয় না, এ দেশের গ্রামীণ মানুষদের মতো মানুষ হয় না।’ তিতির, আমার আর ভটকাই-এর মধ্যে অজানিতেই এক গভীর দেশাত্ববোধ জন্মেছে ঋজুদার সংস্পর্শে এসেই।
তিতির হঠাৎ বলল, ভটকাইটা এবারে খুব মিস করবে। সাতকোশীয়া গন্ড ওর দেখা হল না।
মায়ের অসুখে যদি সেবাই না করল, তা হলে সে ছেলের সব গুণ জলে গেল। এখন তো ওর বেড়াতে আসার কথা নয়। ছেলেটার অনেক গুণ কিন্তু এইসব শিক্ষা তাকে দেওয়া হয়নি সম্ভবত। স্কুলে বা কলেজে ভাল রেজাল্ট করা, বড় চাকরি করা বা ব্যবসা করা, এসবের কোনওই দাম নেই আমার কাছে, যদি কোনও মানুষের কর্তব্যজ্ঞান না থাকে, বিবেক না থাকে। ও কী করে যে মায়ের এমন অসুখ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গে আসতে চাইছিল তাই ভেবে পাইনা।
আর কতক্ষণ লাগবে ঋজুদা? টিকরপাড়া পৌঁছোতে?
আমি বললাম।
ধর, আর মিনিট পনেরো। খুব বেশি হলে। দেখছিস না জঙ্গল কেমন ফিকে হয়ে এল, আগে পথের পাশে দু-একটা তৈলা দেখা যাচ্ছিল। আর এখন তো দুধারেই চষা মাঠ।
তৈলা মানে কী?
তৈলা একটা ওড়িয়া শব্দ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গল পরিষ্কার করে যেখানে চাষাবাদ করা হয়, তাকে বলে তৈলা। মানে, সেই জায়গাটাকে। জঙ্গলের খামার আর কী!
এমন সময়ে রিয়ার-ভিউ মিরারে দেখলাম পিছন থেকে একটা মোটর সাইকেল ঝড়ের মতো আসছে ধুলো উড়িয়ে, বিপজ্জনক এবং অবিশ্বাস্য গতিতে। মোটর সাইকেল তো না, যেন মনো-এঞ্জিন প্লেন নিয়ে ট্যাক্সিইং করছে। আমি জিপ বাঁয়ে করলাম যাতে তার অসুবিধে না হয় আমাদের পেরিয়ে যেতে। ততক্ষণে সে এসে পৌঁছোলো আমাদের পাশে। কিন্তু ওভারটেক না করে বাঁ হাত দিয়ে আমাকে জিপ থামাতে ইশারা করল, করেই জিপের সামনে উঠে এল পথে।
কীরে! আমাদের পাইলটিং করে নিয়ে যেতে পাঠাল না কি কেউ একে? ব্যাপারটা কী?
ঋজুদা বলল।
তিতির বলল, ডাকাত-টাকাত নয় তো?
ঋজুদা বলল, সুন্দরী তুই ছাড়া আমাদের কাছে নিয়ে পালাবার মতো তো আর কিছুই নেই। তোকেই বোধহয় নিতে এসেছে।
ততক্ষণে মোটর সাইকেলের গতি কমে এসেছে। সে যেহেতু রাস্তার মাঝখানে আছে আমারও গতি কমাতে হল জিপের। গতি একেবারেই কমে এল মোটর সাইকেলের। দেখলাম, ঋজুদা কোমরের বেল্ট-এর সঙ্গে বাঁধা পিস্তলের হোলস্টারের বোতামটা পুটুস করে খুলল।
লোকটা মোটর সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে জিপের বাঁদিকে ঋজুদার কাছে এসে বলল, কাম্ব সারিলা স্যর।
হেল্বা কেন?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
সেই বাঘাঘটা পট্টনায়েকবাবুর ছেলেটাকে ধরে নিয়ে গেল।
সে কী? কোথায় ছিল সে? মরে গেছে?
মরবে না? বড় বাঘে যাকে ধরে, সে কি আর বাঁচে স্যার!
তাকে মেরে বনের মধ্যে টেনে নিয়ে গেছে।
কোথায় ধরল?
বোস্টম নালার পাশে একটা বড়ো কুচিলা গাছ আছে না? সেই গাছের তলাতে ধরেছে। এখন আর কথা বলে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না স্যর। তাড়াতাড়ি আসুন আপনি। সেই পট্টনায়েক বুড়োটা হার্টফেল করে এতক্ষণে মরেই গেল না কি, কে জানে!
বলেই, মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, মু পলাইলি। আপনি দয়া করিকি চঞ্চল আসন্তু।
ঋজুদা আমাকে বলল, ঘোরা জিপ। সবই তোদের কপাল। কথায় বলে না, চেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে। মনে আছে রুদ্র, হাজারিবাগের মুলিমালোঁয়ায় খুনের পরে খুন, না ভেনেও বা উপায় ছিল কী?
মনে আবার নেই!
আমি বললাম।
‘অ্যালবিনো’ বইটা কিন্তু তুমি দারুণ লিখেছিলে রুদ্র। আমার বড়মামা পর্যন্ত উচ্ছ্বসিত। যিনি বলেন, বাংলা ভাষায় সব ম্যাদামারা সাহিত্য হয়। বাংলা বই ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেন না। সেই তিনিই স্বয়ং প্রশংসার ঝড় বইয়ে দিলেন। আনন্দ পাবলিশার্স-এর বই, না?
তিতির বলল।
হ্যাঁ। ঋজুদা সমগ্রতে আছে।
আমি বললাম, জিপ ঘোরাতে ঘোরাতে। পুরুণাকোটে পৌঁছে দেখলাম, বনবাংলোর সামনেটাতে একটা ছোটখাটো জটলা মতো হয়েছে। গাড়ির পিছনের দরজা খুলে পট্টনায়েকবাবু বিভ্রান্ত হয়ে বসে আছেন। দুটো শটগান নিয়ে দুজন লোক সেই জটলার মধ্যে আছে। আরও একজন আসছে দেখলাম একটা একনলা গাদা বন্দুক নিয়ে।
আমরা যেতেই সকলে একসঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করল, বিভিন্ন স্বরগ্রামে। তখন মোটরসাইকেল চালিয়ে-আসা লোকটা তাদের ধমক দিয়ে বলল পট্টি করুনান্তি। সব্বে চুপ যাউ।
ঘটনাটা জানা গেল। পট্টনায়েকবাবু যখন আমাদের কাছে এসেছিলেন বাংলোয়, তখন তার বড় ছেলে যুধিষ্ঠির ড্রাইভিং-সিটেই বসেছিল। সে-ই নাকি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছিল ঢেনকানল থেকে। যদিও ড্রাইভারও ছিল। আমরা তাকেই ভেবেছিলাম ড্রাইভার। যুধিষ্ঠির খুবই লাজুক প্রকৃতির ছেলে ছিল। পট্টনায়েকবাবু বলা সত্ত্বেও সে নামতে চায়নি গাড়ি থেকে। তার বিয়েও নাকি ঠিক করে ফেলেছিলেন পট্টনায়েকবাবু।
বাংলো থেকে নেমেই ওঁরা গাড়ি করে জঙ্গলে গিয়েছিলেন। জঙ্গলে বিপুল পরিমাণ গাছ, কাটা অবস্থায় পড়ে ছিল, যা মোষ দিয়ে জঙ্গল থেকে ঢোলাই করে এনে পথপাশের কোনও উঁচু জায়গাতে সাজিয়ে রেখে ট্রাক-এ লোড করার কথা ছিল। কাবাড়িরা তো পালিয়েইছে, অতজন মানুষকে বাঘে নেওয়ার পর থেকে কোনও লোক মোষ নিয়ে ঢোলাই করতেও যেতে চায়নি। ট্রাক ড্রাইভার এবং খালাসিরাও না। দামি, কাটা গাছের বল্লাগুলো কেউ চুরি-টুরি করছে কি না তাই সরেজমিনে তদন্ত করতেই গাড়ি করে পট্টনায়েকবাবু, তাঁর ছেলে যুধিষ্ঠির এবং তাঁদের মুহুরি মহান্তিবাবু জঙ্গলে গিয়েছিলেন। তাঁরা গাড়ি থেকে নামবেন নাই ঠিক করেছিলেন। আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে তাঁরা পুরো জঙ্গলটা ঘুরে রাস্তা থেকেই যতটা দেখা এবং অনুমান করা যায় তা দেখে এবং করে ফিরে আসছিলেন।
মহান্তিবাবুর তত্ত্বাবধানেই গাছ সব কাটা হয়েছিল। জঙ্গলের গভীরে নন্দিনী নালার পাশে তাঁদের বাঘমুণ্ডার ক্যাম্প ছিল। নামেই ক্যাম্প কিন্তু তাঁবু নেই। বাঁশ বেড়ার গায়ে মাটি লেপা এবং উপরে ঘাসের ছাউনি দেওয়া তিনখানি ঘর। একখানি ছিল মহান্তিবাবুর। তাতে একটা কাঠের পাটাতনের খাট আর হিসাবপত্র করার কাগজ-টাগজ থাকত। অন্য দুটো ঘরে কাবাড়িরা খড় পেতে মাটিতে শুত ঘরের মধ্যে আগুন করে। বাইরে মাটির হাঁড়িতে রান্না করত। এখন সে সব ঘর হাট করে খোলা পড়ে আছে। জঙ্গল দেখে এসে ওঁরা যখন ক্যাম্পের কাছে পৌঁছোন তখন মহান্তিবাবু বলেন, বাঘমুণ্ডা ছেড়ে তড়িঘড়ি পালিয়ে যাওয়ার সময়ে তাঁর গড়গড়াটা ঘরে ফেলে এসেছেন। এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে সেটা নিয়ে আসবেন। কাগজপত্র সব আগেই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
ঝকঝক করছে রোদ্দুর জঙ্গলময়। ডিসেম্বরের সুনীল আকাশ। এই দিনমানে কোনওরকম ভয়কে প্রশ্রয় দিতেও লজ্জা করে। তা ছাড়া, বাঘ তো আর ওঁদের ক্যাম্পের ঘরে ঢুকে মহান্তিবাবুর খাটে শুয়ে থাকবে না।
ক্যাম্পের সামনে ও পিছনে এবং পাশেও আগাছা পরিষ্কার করা ছিল। হরজাই ও জ্বালানি কাঠের গাছও কেটে ফেলায় ফাঁকা ছিল এলাকাটুকু। ওখানেই মুহুরি আর কাবাড়িদের, ঢোলাইওয়ালাদেরও ওঠা-বসা রাতে আগুন করে আগুন পোয়ানো, সকালে ও রাতে রান্নাবান্না। পাশ দিয়েই বয়ে গেছে নন্দিনী নালা। জলের সুবিধে দেখেই ওখানে ক্যাম্প করা হয়েছিল।
মহান্তিবাবু বললেন, আপনারা গাড়িতেই বসুন, আমি যাব আর আসব। রাস্তা থেকে ক্যাম্পটি দেখাও যাচ্ছিল।
মহান্তিবাবু নেমে গেলে যুধিষ্ঠির বলল, বড় হিসি পেয়েছে, বাবা, মহান্তিবাবু ফিরে আসতে আসতে আমি নেমে হিসি করে নিই।
ক্যাম্পটা, হাতিগির্জা পাহাড়ের দিক থেকে এলে পথের ডানদিকে পড়ে। ওঁরা হাতিগির্জা পাহাড়ের দিক থেকেই আসছিলেন জঙ্গল দেখে-টেখে। যুধিষ্ঠির, ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে, ঘুরে গাড়ির পিছন দিকে দুপা সামনে গিয়ে, বাঁদিকে মুখ করে উবু হয়ে হিসে করতে বসল। গ্রামের মানুষেরা শহুরেদের মতো দাঁড়িয়ে হিসি করে না। পুরুষরাও বসেই হিসি করে। এমন সময়ে হঠাৎ যুধিষ্ঠিরের চোখ পড়ল পথের ধুলোর উপরে। বাঘের পায়ের দাগ। একেবারে টাটকা। হিসি করতে করতেই সে চেঁচিয়ে মহান্তিবাবুকে ডেকে বলল, চঞ্চল আসন্তি মহান্তিবাবু, বাঘটা এইঠি অছি।
সে কথা শুনে পট্টনায়েকবাবু গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছেলে এবং মহান্তিবাবু দুজনেরই উদ্দেশে হাঁক পেড়ে চললেন, চাল যুধিষ্ঠির! চালন্তু মহান্তিবাবু। চঞ্চল পলাইবি। আউ এঠি রহি হেব্বনি।
যুধিষ্ঠির যখন হিসি করা সেরে বাঁদিক থেকে এসে গাড়ির পিছন ঘুরে গাড়ির ডান দিকের ড্রাইভিং সিটে উঠতে যাবে, ঠিক তখুনি বাঁদিকের জঙ্গল থেকে বাঘ অতর্কিতে এক লাফ দিয়ে যুধিষ্ঠিরের ঘাড়ে পড়ে, তাকে এক ঝটকাতে মাটিতে ফেলে, তার ঘাড় ভেঙে, টুটি কামড়ে ধরে টানতে টানতে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে জঙ্গলের গভীরে চলে গেল পট্টনায়েকবাবু কিছু বোঝার আগেই। বাঘকে দেখে হনুমানেরা হুপ-হুঁপ-হুঁপ করে উঠল। ময়ূর ডেকে উঠল কেঁয়া-পেঁয়া করে। মহান্তিবাবু ধপ করে কিছু একটা মাটিতে পড়ার শব্দ শুনে গড়গড়াটা হাতে নিয়ে উর্ধশ্বাসে দৌড়ে এলেন গাড়ির দিকে। এবং ওই বীভৎস দৃশ্য দেখলেন।
