গুগুনোগুম্বারের দেশে (ঋজুদা) – বুদ্ধদেব গুহ

শেয়ার করুনঃ

এক

আমরা। পথ। হারিয়েছি।

কথা তিনটে কেটে কেটে, ওজন করে করে, থেমে থেমে, যেন নিজের মনেই বলল ঋজুদা।

আমরা একটা কোপির উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোপি হল এক ধরনের পাহাড়। তখন ভর-দুপুর। সামনে দূরদিগন্তে কতগুলো ইয়ালো-ফিভার অ্যাকাসিয়া গাছের জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া আর কোনো বড় গাছ বা পাহাড় বা অন্য কিছুই নেই। বিরাট দলে জেব্রারা চরে বেড়াচ্ছে বাঁ দিকে। ডান দিকে একদল থমসনস গ্যাজেল। হু-হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। ভুষুণ্ডা আর টেডি মহম্মদ মাথা নিচু করে ল্যাব্রাডর গান-ডগের মতো মাটি শুঁকে-শুঁকে পথের গন্ধ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে হাজার-হাজার মাইল সাভানা ঘাসের রাজ্যে। নীচে আমাদের ছাইরঙা ল্যাণ্ড-রোভার গাড়িটা ট্রেলারের মধ্যে তাঁবু এবং অন্যান্য সাজসরঞ্জাম সমেত স্তব্ধ হয়ে রয়েছে কোপির ছায়ায়।

 

আমি ঋজুদার মুখের দিকে চাইলাম।

 

খাকি, গোর্খা টুপিটা খুলে ফেলেছে ঋজুদা। মাথার চুলগুলো হাওয়ায় এলোমলো হচ্ছে। দাঁতে-ধরা পাইপ থেকে পোড়া তামাকের মিষ্টি গন্ধভরা ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে পেছনে। কপালের রেখাগুলো গম্ভীর হয়ে ফুটে উঠেছে।

 

আমি মনে-মনে একটু-আগে-শোনা ঋজুদার কথা ক’টি আবৃত্তি করলাম।

 

আমরা। পথ। হারিয়েছি।

 

এবং করেই, ঐ সামান্য তিনটি কথার ভয়াবহতা প্রথমবার বুঝতে পারলাম।

 

ঋজুদা আফ্রিকাতে আমাকে আনতে চায়নি। মা-বাবারও প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। সব আমারই দোষ। আমিই নাছোড়বান্দা হয়ে ঋজুদার হাতে-পায়ে ধরে এসেছি।

 

ভুষুণ্ডা আর টেডি আস্তে-আস্তে ফিরে আসছে আবার গাড়ির দিকে। ঋজুদা ওদের ফিরে আসতে দেখে কোপি থেকে নীচে নামতে লাগল। আমিও পিছন-পিছন নামলাম। আমরা যখন ল্যাণ্ড-রোভারের কাছে গিয়ে পৌঁছেছি তখন ওরাও ফিরে এল। ওদের মুখ শুকনো। মুখে ওরা কিছুই বলল না।

 

ঋজুদা গাড়ির পকেট থেকে ম্যাপটা বের করে, বনেটের উপর বিছিয়ে দিয়ে ঝুঁকে পড়ল তার উপর। পড়েই, আমাকে বলল, দ্যাখ তো রুদ্র, ট্রেলারের এবং জীপের পেছনে সবসুন্ধু ক’টা জেরিক্যান আছে আমাদের। আর এঞ্জিনের সুইচ টিপে দ্যাখ গাড়ির ট্যাঙ্কে আর কত পেট্রল আছে।

 

আমি পেট্রলের হিসেব করতে লাগলাম। ঋজুদা ম্যাপ দেখতে লাগল। তেলের অবস্থা দেখে, জেরিকান গুনে, হিসেব করে বললাম, হাজার কিমি যাওয়ার মতো তেল আছে আর।

 

ঋজুদা বলল, বলিস কী রে? তাহলে তো অনেকই তেল আছে?

 

তারপরই, ঐ অবস্থাতে ও আমার দিকে ফিরে বলল, আর তোর তেল? ফুরোয়নি তো এখনও?

 

আমি ফ্যাকাসে মুখে স্মার্ট হবার চেষ্টা করে বললাম, মোটেই না। আমার তেল অত সহজে ফুরোয় না।

 

আমি বুঝলাম, ঋজুদা আমাকে সাহস দিচ্ছে। আসলে আমি জানি যে, আফ্রিকার এই তেরো হাজার বর্গকিমির সাভানা ঘাসবনে পথ-হারানো আমাদের পক্ষে মোটে হাজার মাইল যাওয়ার মতো তেল থাকা মোটেই ভরসার কথা নয়।

 

ঋজুদার গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। ভুষুণ্ডা মাটিতে বসে দাঁত দিয়ে ঘাস কাটছিল। টেডি পেছনের গাড়ির মাডগার্ডে হেলান দিয়ে উদাস চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

 

ঋজুদা বলল, লেটস্ গো।

 

আমি বললাম, কোন দিকে?

 

ঋজুদা বলল, ডিউ নর্থ।

 

তারপর গাড়ির বাঁ দিকের দরজা খুলে উঠতে-উঠতে বলল, তুই-ই চালা। আমি একটু পাইপ খেয়ে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে নিই।

 

ভুষুণ্ডা আর টেডি পেছনে বসল।

 

সুইচ টিপে গীয়ারে দিলাম গাড়ি। তারপর একটু লাফাতে-লাফাতে হলুদ সোনালি হাঁটু সমান ঘাসের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের ল্যাও-রোভার।

 

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি ঋজুদাকে একটি কাজের ভার দিয়েছিলেন। সেরেঙ্গেটির ঘাসবন ও গোরোংগোরো আগ্নেয়গিরির উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে যেসব চোরাশিকারীরা আছে তাদের সম্বন্ধে একটি পেপার সাবমিট করতে হবে ঋজুদাকে। এই অভিযানের সব খরচ জুগিয়েছেন সোসাইটি। পূর্ব আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ান সরকার ঋজুদাকে সবরকম স্বাধীনতা দিয়েছেন। নিজেদের প্রয়োজন এবং প্রাণরক্ষার জন্যে আমরা যে-কোনো জানোয়ার শিকার করতে পারব। চোরাশিকারীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে যদি আমাদের প্রাণসংশয় হয় তবে আমরা তাদের উপর গুলিও চালাতে পারি। তার জন্যে কাউকে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না!

 

কিন্তু এর মধ্যে কথা একটাই। সমুদ্রে যেমন একা নৌকো, এই ঘাসের সমুদ্রেও তেমনই একা আমরা, একেবারেই একা।

 

বোম্ব্বে থেকে প্লেনে ডার-এস-সালামে এসেছিলাম, সেশেলস্ আইল্যাণ্ডস্ হয়ে। তারপর ডার-এস-সালাম থেকে কিলিমানজারো এয়ারপোর্টে। মাউন্ট কিলিমানজারোর কাছের সেই এয়ারপোর্ট থেকে ছোট প্লেনে করে এসে পৌঁছেছিলাম সেরোনারাতে। সেখানেই আমাদের জন্যে এই ল্যান্ড-রোভার, মালপত্র এবং ভুষুণ্ডা ও টেডি অপেক্ষা করছিল। তিনমাস আগে আরুশাতে এসে ঋজুদা ভুষুণ্ডা ও টেডিকে ইন্টারভ্যু করে মালপত্রের লিস্ট বানিয়ে ওখানে দিয়ে এসেছিল। ওরা দুজনই ল্যাও-রোভারটা চালিয়ে নিয়ে এসেছে আরুশা থেকে লেক মনিয়ারা এবং গোয়রাংগোরো হয়ে, সেরোনারাতে।

 

মোটে দশদিন বয়স হয়েছে আমাদের এই অভিযানের। গোলমালটা ভুষুণ্ডাই করেছে। ওরই ভুল নির্দেশে গত কদিনে আমরা ক্রমাগত আড়াই হাজার মাইল গাড়ি চালিয়েছি। এখন দেখা যাচ্ছে যে আমরা একটি বৃত্তেই ঘুরে বেড়িয়েছি। চোরাশিকারীদের সঙ্গে একবারও মোলাকাত হয়নি, কিন্তু একটি হাতির দল আমাদের খুবই বিপদে ফেলেছিল। যা পেট্রল ছিল তাতে আমাদের গোয়রাংগোরোতে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল সহজেই অভিযানের পর্ব শেষ করে। ওখানে পেট্রল স্টেশান আছে। যে-পথ ধরে ট্যুরিস্টরা যান, স্বাভাবিক কারণেই সেই পথে আমরা যাইনি। কারণ চোরা শিকারীরা ঐ পথের ধারেকাছেও থাকে না; বা আসে না। টুরিস্টরা যে-পথে যান সেও সেই রকমই। ধু-ধু, হাজার-হাজার মাইল ঘাসবনে একটি সরু ছাইরঙা ফিতের মতো পথ চলে গেছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আমরা তাতেও না গিয়ে ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে ম্যাপ দেখে এবং ভুষুণ্ডা ও টেডির সাহায্যে গাড়ি চালাচ্ছি।

 

ভুষুণ্ডা চিরদিন এই সাভানা রাজ্যেই শিকারীদের কুলির কাজ করেছে। পায়ে হেঁটে মাসের পর মাস এই ঘাসবনে কাটিয়েছে প্রতি বছর। এইসব অঞ্চল নিজের হাতের রেখার মতোই জানা ওর। অথচ আশ্চর্য! ভুষুণ্ডাই এ-রকম ভুল করল!

 

কম্পাসের কাটাতে চোখ রেখে স্টীয়ারিং সোজা করে শক্ত হাতে ধরে অ্যাকসিলারেটরে সমান চাপ রেখে চালাচ্ছি আমি। তিরিশ মাইলের বেশি গতি নেই। বেশি জোরে চালানোতে বিপদ আছে। হঠাৎ ওয়ার্ট-হগদের গর্তে পড়ে গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

 

এই ওয়ার্ট-হগগুলো অদ্ভুত জানোয়ার! অনেকটা আমাদের দেশের শুয়োরের মতো দেখতে। কিন্তু অন্যরকম। ওরা যখন দৌড়োয়, ওদের লেজগুলো তখন উঁচু হয়ে থাকে আর লেজের ডগার কালো চুলগুলো পতাকার মতো ওড়ে। ওরা মাটিতে দাঁত দিয়ে বড়-বড় গর্ত করে এবং তার মধ্যেই থাকে–ঐ গর্তে শেয়াল ও হায়নারাও আস্তানা গাড়ে মাঝে মাঝে। ঘাসের মধ্যে কোথায় যে ও-রকম গর্ত আছে আগে থাকতে বোঝা যায় না–তাই খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়।

 

কেউ কোনো কথা বলছে না। গাড়ি চলছে, পিছনে ধুলোর হালকা মেঘ উড়িয়ে। এখানের ধুলো আমাদের দেশের ধুলোর মতো মিষ্টি নয়। আগ্নেয়গিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত নানারকম ধাতব পদার্থ মিশে আছে মনে হয় এইসব জায়গার ধুলোয়। ধুলোর রঙও কেমন লালচে-কালচে সিমেন্টের মতো। ভীষণ ভারী। নাকে কানে ঢুকলে জ্বালা করতে থাকে।

 

গাড়ির দুদিকেই নানারকম জানোয়ার ও পাখি দেখা যাচ্ছে। ডাইনে বাঁয়ে। কত যে জানোয়ার তার হিসেব করতে বসলে হাজার পেরিয়ে লক্ষে পৌঁছনো কঠিন নয়। দলে দলে থমসনস গ্যাজেল, গ্রান্টস গ্যাজেল, টোপী, এলাণ্ড, জেব্রা, ওয়াইল্ড-বীস্ট। চুপি-চুপি শেয়াল। রাতের বেলায় বুক-হিম-করা-হাসির হয়না। কোথাও বা একলা সেক্রেটারি বার্ড মাথার ঝাঁকড়া পালকের টুপি নাড়িয়ে বিজ্ঞের মতো একা একা হেঁটে বেড়াচ্ছে। কোথাও ম্যারাবু সারস। কোথাও একা বা দোকা উটপাখি বাঁইবাঁই করে লম্বা লম্বা ন্যাড়া পায়ে দৌড়ে যাচ্ছে। জিরাফগুলো এমন করে দৌড়োয় যে, দেখলে হাসি পায়। মনে, হয় ওদের পাগুলো বুঝি হাঁটু থেকে খুলে বেরিয়ে যাবে যখন-তখন।

 

প্রথম দু-তিন দিন অত-সব জানোয়ার দেখে আমার উত্তেজনার শেষ ছিল না। এখন মনে হচ্ছে যে, যেন চিরদিন আমি আফ্রিকাতেই ছিলাম। জানোয়ার দেখে-দেখে ঘেন্না ধরে গেল। সিংহও দেখেছি পাঁচবার এই কদিনে দিনের বেলা। উদলা মাঠে। তারাও একা নয়; সপরিবারে। আমাদের দিকে অবাক চোখে দূর থেকে চেয়ে থেকেছে।

 

ঋজুদা বলল, কত কিলোমিটার এলি রে?

 

আমি গাড়ির মিটার দেখে বললাম, সত্তর কিলোমিটার।

 

ঋজুদা ঘড়ি দেখে বলল, দু’ঘন্টায়! তারপর নিজের মনেই বলল, নট ব্যাড।

 

এদিকে সূর্য আস্তে-আস্তে পশ্চিমে হেলছে। এখানে গাছগাছালি নেই, তাই ছায়া দেখে বেলা বোঝা যায় না।

 

দূরদিগন্তে হঠাৎ একটি নীল পাহাড়ের রেখা ফুটে উঠল।

 

টেডি বিড়বিড় করে বলল, মারিয়াবো। মারিয়াবো।

 

তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, পোলে পোলে : পোলে সানা।

 

ঋজুদা বলল, পোলে পোলে কেন? কী হল টেডি?

 

সোয়াহিলি ভাষায় ‘পোলে পোলে’র বাংলা মানে হচ্ছে আস্তে আস্তে।

 

টেডি বলল, মাসাইরা থাকে ঐ পাহাড়ের নীচে। ওদিকে যেতে সাবধান। ওয়াণ্ডারাবোরাও চলে আসে মাঝে মাঝে।

 

ভুষুণ্ডার চোয়াল শক্ত। ও কথা বলছিল না কোনো।

 

ওদের দুজনের মধ্যে ভুয়া অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে, কম কথা বলে; টেডির চেয়ে ভাল ইংরিজিতে বাতচিত্ চালায় আমাদের সঙ্গে। টেডির চেয়ে অনেক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও। টেডির স্বভাবটা ছেলেমানুষের মতো, কিন্তু সে সাড়ে ছ’ফিট লম্বা। ওর হাতের আঙুলগুলো কলার কাঁদির মতো। আর ভুষুণ্ডা বেঁটেখাটো, কার্পেটের মতো ঘন ঠাসবুনুনির কোঁকড়া চুল মাথায়। পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর জিনের প্যান্টের পকেট থেকে বের করে সিগারেট খায়। টেডি সিগারেট খায় না; নস্যি নেয়। ওর সেই নস্যি আবার মাঝে-মাঝে হাওয়াতে উড়ে এসে আমাদের নাকে আচমকা পড়ে দারুণ হাঁচায়।

 

পরশু দিন একটা থমসনস গ্যাজেলের বাচ্চাকে শেয়ালের মুখ থেকে বাঁচিয়েছিলাম আমরা। তাকে হাভারস্যাকের মধ্যে রেখেছি। শুধু মুখটা বের করে সে চকচকে চোখে চেয়ে থাকে। হরিণ-ছানাটার নাম রেখেছি আমি কারিব্যু। সোয়াহিলি ভাষায় কারিব্যু মানে স্বাগতম। সেই ছোট্ট হরিণটা বেদম হাঁচতে শুরু করে দিলে হঠাৎ।

 

ঋজুদা পিছন ফিরে টেডিকে বলল, টেডি, তোমার নস্যি ওর নাকে গেছে। হাঁচতে-হাঁচতে মরার চেয়ে হায়নার হাতে মরা কারিব্যুর পক্ষে অনেক সুখের ছিল।

 

টেডি ঋজুদার কথায় হেসে উঠে বাচ্চাটাকে আদর করে বলল, নুজরি, নুজরি।

 

মানে, ভালই আছে, ভালই আছে; কিছুই হয়নি ওর।

 

তারপরই বলে উঠল, কোনো মরাই সুখের নয় বানা। সে হেঁচেই মরো, আর নেচেই মরো। এই যেমন আমাদের এখানের ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে মরা।

 

ওর কথা শুনে ঋজুদা হেসে উঠল। আফ্রিকার এই ঘাসের সমুদ্রে পথ হারিয়ে যাওয়ার পরও এত হাসি আসছে কী করে ঋজুদার তা ঋজুদাই জানে। তাছাড়া, এই ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে মরা ব্যাপারটা হাসির নয় মোটেই।

 

সেরেঙ্গেটিতে খুব সেৎসি মাছি। বড় বড় কালো কালো মাছি। আমাকে পরশু একটা কামড়েছিল। অসহ্য লাগে কামড়ালে। কলকাতার একশোটা মশা একেবারে কামড়ালেও বোধহয় অমন লাগত না।

 

এই সেৎসি মাছির কামড়ে এক রকমের অসুখ হয় আফ্রিকাতে। তাকে ওরা সোয়াহিলিতে বলে নাগানা। ইংরিজিতে বলে ইয়ালো-ফিভার। রুগীর খুব জ্বর হয়, শরীর হলুদ হয়ে যায়, মাথার গোলমাল দেখা দেয়, আর রুগী পড়ে-পড়ে শুধুই ঘুমোয়। তাই এই অসুখের আরেক নাম স্লিপিং-সিকনেস। অনেকরকম সেৎসি মাছি আছে এখানে। সব মাছি কামড়ালেই যে এই অসুখ হবে এমন নয়, কিন্তু কামড়াবার আগে তাদের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দেখানোর কথা বলা তো যায় না মাছিদের।

 

এই ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে মরার অসুখকে টেডিরা যমের মতো ভয় পায়।

 

ঋজুদা আর আমিও আফ্রিকাতে আসবার আগে খিদিরপুরে গিয়ে ইয়ালো-ফিভারের প্রতিষেধক ইনজেকশান নিয়ে এসেছিলাম। ভীষণ লেগেছিল তখন। কিন্তু সেৎসি মাছি যখন সত্যি-সত্যি কামড়াল তখন মনে হয়েছিল যে, ইনজেকশানের ব্যথা কিছুই নয়।

 

উচ্চারণ সেৎসি যদিও, কিন্তু বানানটা গোলমেলে। ইংরিজি বানান হচ্ছে Tsetse।

 

আসলে, এখানে এসে অবধি দেখছি বানান নিয়ে বড়ই গণ্ডগোল। গোরোংগোরো বলছে উচ্চারণের সময়, কিন্তু বানান লিখছে NGORONGORO। সোয়াহিলি শব্দের উচ্চারণে প্রথম অক্ষর যেখানে-সেখানে লোপাট হয়ে যাচ্ছে; যেন তারা বেওয়ারিশ।

 

এইসব ভাবতে-ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, হঠাৎ ঋজুদা আমার স্টীয়ারিং ধরা হাতের ওপরে হাত ছোঁয়াল। ব্রেকে পা দিলাম। ঐ মারিয়াবো পাহাড়শ্রেণীর সামনে এক জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে। মানুষ আছে? ঘাসবনে আগুনও লাগতে পারে। কিন্তু বনে আগুন লাগার ধোঁয়া অন্যরকম হয়। জায়গাটা মাইল দশেক দূরে।

 

ঋজুদা বলল, গাড়ি থামা।

 

বললাম, এগোব না আর?

 

ঋজুদা বলল, গাধা!

 

ভাগ্যিস ভুষুণ্ডা আর টেডি বাংলা জানে না।

 

আমি বললাম, এগোবে না কেন?

 

ঋজুদা বলল, পাহাড়ের কাছ থেকে আমাদের গাড়ি সহজেই দেখতে পাবে ওরা। ওই সেরেঙ্গেটিতে আইনত কোনো মানুষের থাকার কথা নয়। যারা ওখানে উনুন ধরিয়েছে বা অন্য কিছুর জন্যে আগুন জ্বেলেছে তারা নিশ্চয়ই আইন মানে না। আমরা ওখানে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধের অন্ধকার নেমে আসবে। আজ এখানেই ক্যাম্প করা যাক। আসন্ন রাতে এগোনো ঠিক হবে না।

 

নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, তুই কী বলিস রুদ্র?

 

আমি বললাম, ওরা আমাদের দেখেই যদি থাকে, তাহলেও তো রাতের বেলা আক্রমণ করতে পারে।

 

ঋজুদা আমার দিকে ফিরে বলল, রুদ্রবাবু একটু ভয় পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে যেন!

 

আমি বললাম, ভয় নয়, সাবধানতার কথা বলছি।

 

ঋজুদা বলল, দেখে থাকতেও পারে, না-ও দেখে থাকতে পারে। তবে যদি দেখে থাকে, তাহলেও আক্রমণও করতে পারে। এবং সেই জন্যে রাতে আমাদের সজাগ থাকতে হবে; পালা করে পাহারা দিতে হবে। আক্রমণ করতে গেলে তাদেরও তো এই দশ মাইল ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে আসতে হবে। তাই পাহাড় থেকে এই দূরেই তাঁবু ফেলতে চাই। এলে তাদের দূর থেকে দেখা যাবে।

 

আমি বললাম, ঠিক আছে।

 

তারপর ঋজুদা আর টেডি নীচের ঘাস পরিষ্কার করে তাঁবু খাটাতে লেগে গেল।

 

আমি আর ভুষুণ্ডা চায়ের জল বসিয়ে দিলাম স্টোভে। এখানে খুব সাবধানে আগুন-টাগুন জ্বালতে হয়। যখন-তখন ঘাসে আগুন লেগে যেতে পারে।

 

তাঁবু খাটাতে-খাটাতে ঋজুদা বলল, চা-ই কর রুদ্র। রাতে বরং খাওয়া যাবে।

 

তারপর বলল, তুই প্রথম রাতে জাগবি, না শেষ রাতে?

 

আমি বললাম, একবার ঘুমিয়ে পড়ল ঠাণ্ডাতে মাঝরাতে ঘুম ছাড়ে না চোখ। আমি প্রথম রাতে জাগি; তুমি শেষ রাতে।

 

তারপর শুধোলাম, কটা অবধি জাগব আমি?

 

ঋজুদা বলল, বারোটা অবধি জাগিস। খেয়েদেয়ে আমরা তো নটার মধ্যেই শুয়ে পড়ব সব শেষ করে। নটা থেকে বারোটা, তিন ঘন্টা ঘুমুলেই বাকি রাত জাগতে পারব আমি। রুদ্রবাবু বলে ব্যাপার। তাকে কি বেশি কষ্ট দেওয়া যায়। অনার্ড গেস্ট। ক্যালকেশিয়ান মাখনবাবু!

 

আমি বললাম, ঋজুদা! অনেক বছর আগেও আমাকে যা বলতে, এখনও তাইই বলবে এটা কিন্তু ঠিক নয়।

 

ঋজুদা বলল, আলবত বলব, আজীবন বলব; তোর যখন আশি বছর বয়স হবে তখনও বলব, অবশ্য যদি তখন আমি বেঁচে থাকি।

 

হঠাৎ-হঠাৎ এই সব কথায় আমার মন বড় খারাপ হয়ে যায়। ঋজুদার সঙ্গে গত কয়েক বছর বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে এমনই দশা হয়েছে আমার যে, ভাবলেও দম বন্ধ হয়ে আসে।

 

ঋজুদা না থাকলে আমার কী হবে?

 

কলকাতায় আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সেখানে যে আকাশ দেখা যায় না। তারা, চাঁদ, সূর্য কিছুই দেখা যায় না। সেখানে কখন ভোর হয় কেউই খোঁজ রাখে না তার। সন্ধে, চুপিসারে দিগন্তে দিগন্তে আলোছায়ার কত দারুণ দারুণ ছবি এঁকে রোজ কেমন করে নিত্যনতুন হয়ে আসে, অথবা চলে-যাওয়া দিনের সঙ্গে ফিরে-আসা রাতের কোন্ আঙিনাতে কেমন করে দেখা হয় রোজ-রোজ, তার খবরও কেউই নেয় না। হাওয়ায় সেখানে ডিজেল আর কয়লার ধোঁয়া, সেখানে গাছ থেকে একটি পাতা খসে পড়ার যে সুস্পষ্ট আওয়াজ তা কেউই শোনে না, শুনতে পায় না; পায় না জানতে শিশিরের পায়ের শব্দ, দুপুরের একলা ভীরু পাখির চিকনগলার ডাক, অথবা ভোরের পাখিদের গানও শোনে না সেখানে কেউ। ফুলের গন্ধ পায় না নাকে। তাদের নাক, কান, চোখ সব অকেজো, অব্যবহৃত যন্ত্রের মতোই তারা মিছিমিছি বয়ে বেড়ায়। তাদের মন আটকে থাকে পাশের বাড়িতে, গলির মোড়ে, অফিসের ঘর অথবা রাস্তার ভিড়ে। দিগন্তরেখা কাকে বলে, বিস্তৃতি বা ব্যাপ্তি কী, উদারতা কোথায় অনুভব করা যায় এসব কিছুরই খবর জানে না শহরের মানুষ। অথচ আমাদের সকলেরই হাতের কত কাছে এই সবই ছিল এবং আজও আছে তা ঋজুদা যদি এমন করে আমাকে হাতে ধরে না চেনাত, না বোঝাত, তাহলে বুঝতাম বা চিনতাম কি কখনও? ঋজুদাই তো হাত ধরে নিয়ে এসে এই আশ্চর্য আনন্দের, অনাবিল, সুন্দর, সুগন্ধি বনের কাকলিমুখর জগতে, প্রকৃতিমায়ের কোলে এনে বসিয়ে আমাকে আসল মজার উৎস, আসল আনন্দের ফোয়ারার খোঁজ দিয়েছে।

 

আমি যে ঋজুদার কাছ থেকে কী পেয়েছি তা আমার ক্লাসের কোনো বন্ধুই জানবে না। ভাবতেও পারে না ওরা। সেই কারণেই শুধু আমিই জানি, ঋজুদা কখনও থাকব না বললে কেন আমার এত পাগল-পাগল লাগে।

 

এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। পশ্চিমাকাশে আস্তে আস্তে নিচু হয়ে সূর্যটা একটা বিরাট কমলা-রঙা বলের মতো ঘাসের হলুদ দিগন্তকে কমলা আলোর বন্যায় ভাসিয়ে মিলিয়ে গেল। কিন্তু তারপরও বহুক্ষণ গাঢ় ও ফিকে গোলাপির আভা লেগে রইল আকাশময়।

 

ঘাস পরিষ্কার করে নিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তারই চারপাশে বসেছি আমরা চারজনে। ভুষুণ্ডা আমাদের পথপ্রদর্শক, অন্য কাজ করতে বললে বিরক্ত ও অপমানিত বোধ করে। আমরা বলিও না। টেডি রান্না চাপিয়েছে। আমি থমসন্স গ্যাজেলের বাচ্চাটাকে কোলে করে বসে আছি। ওর গলার কাছের শেয়ালের কামড়ের ঘা এখনও শুকোয়নি। খুব ভাল করে লাল মার্কুরিওক্রোম লাগিয়ে দিয়েছিল টেডি।

 

ঋজুদা যখন আরুশাতে এসেছিল তখন ওর একজন আফ্রিকান বন্ধু একটা মীরশ্যাম্ পাইপ উপহার দিয়েছিলেন। আরুশাতে একটি কোম্পানি আছে, তারা মীরশ্যাম্ কাদা দিয়ে পাইপ, অ্যাশট্রে, ফুলদানি ইত্যাদি বানায়। মীরশ্যাম্ আসলে সমুদ্রের এক বিশেষ রকম কাদা। এ দিয়ে তৈরি পাইপের রঙ বদলাতে থাকে খাওয়ার সময়, আগুনের তাপের সঙ্গে সঙ্গে। অগনন ব্ল্যাকউড-এর লেখা শিকারের বইয়ে প্রথম এই মীরশ্যাম পাইপের কথা পড়ি আমি।

 

টেডি সকলের জন্যে একটিই পদ রান্না করেছে। খিচুড়ির মতো। কিন্তু ঠিক আমাদের খিচুড়ির মতো নয়। ওরা সোয়াহিলি ভাষায় বলে, উগালি। ভুট্টার দানার মধ্যে গ্রান্টস্ গ্যাজেলের মাংস দিয়ে সেই উগালি রান্না হচ্ছে। দারুণ গন্ধ ছেড়েছে। খিদেও পেয়েছে ভীষণ। একটি গ্রান্টস গ্যাজেল ও একটি থমসন্স গ্যাজেল শিকার করে আমরা তাদের মাংস স্মোকড করে নিয়েছি। ট্রেলারের মধ্যে বস্তা করে রাখা আছে সে-মাংস।

 

পাইপের তামাকের মিষ্টি গন্ধ ভাসছে হাওয়ায় আর মীরশ্যাম্ পাইপের রঙ বদলানো দেখছি। ভুষুণ্ডা ম্যাপটা খুলে ঋজুদার সঙ্গে কথা বলছে। মাঝে-মাঝে সোয়াহিলিতেও বলছে। এখানে আসার আগেই ঋজুদা সোয়াহিলি শিখে নিয়েছে মোটামুটি। আমাকেও একটা বই দিয়েছিল, কিন্তু কয়েকটা শব্দ ছাড়া বেশি শিখিনি আমি। বড় খটমট শব্দগুলো। জাম্বো মানে হ্যালো, সিম্বা মানে সিংহ, টেম্বো মানে হাতি, চুই মানে লেপার্ড। কারো সঙ্গে দেখা হলে ইংরিজিতে যেমন আমরা বলি হ্যালো বা আমেরিকান-ইংরিজিতে হাই! সোয়াহিলিতে সেই সম্বোধনকে বলে জাম্বো! আমি যদি কাউকে বলি জাম্বো, সে উত্তরে বলবে সিজাম্বো।

 

শীত বেশ বেশি। যদিও এখন জুলাই মাস, কিন্তু আফ্রিকাতে এখন শীতকাল। হাজার-হাজার মাইল ঘাসবনের উপর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে আসছে হু-হু করে। আমার উইণ্ডচিটারের কলারের কোনাটা পতপত্ করে উড়ছে। ঋজুদার জার্কিনের বুকপকেট থেকে টোবাকোর পাউচটা উঁকি মারছে আর ডানদিকের নীচের পকেটের মধ্যে পয়েন্ট থ্রি কোস্ট পিস্তলটা পোঁটলা হয়ে আছে।

 

কথাবার্তা শুনে মনে হল, ভুষুণ্ডার আপত্তি আছে ভীষণ মারিয়াবো পাহাড়ের দিকে যেতে। ও বলছে, ওদিকে চোরাশিকারীদের এত বড় আস্তানা আছে এবং ওদের কাছে এতরকম অস্ত্র-শস্ত্র আছে যে, আমাদের ওরা গুলিতে ভেজে নিয়ে খেয়ে ফেলবে বেমালুম।

 

ঋজুদা জেদ করছে, আজ রাতে কোনো ঘটনা না ঘটলে কাল সকালে আমরা ওদিকেই যাব।

 

ঋজুদার সিদ্ধান্তে ভুষুণ্ডা বেশ অসন্তুষ্ট হল। যে-লোক গাইডের কথা না শুনে নিজের মতেই চলে, তার গাইডের দরকার কী? এই কথা বলল ভুষুণ্ডা বেশ জোর গলায়।

 

তার উত্তরে ঋজুদা বলল, যে গাইড সেরেঙ্গেটির মধ্যে রাস্তা ও দিক হারিয়ে ফেলে তেমন গাইড থাকা-না-থাকা সমান।

 

ঋজুদা কখনও এমন করে কথা বলে না কাউকে। তাই অবাক হলাম। তারপর আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে ঋজুদা ভুষুণ্ডাকে বলল, ইচ্ছে করলে, যে-কোনো জায়গাতে, যে-কোনোদিন তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারো।

 

এই কথা শুনে আমি ভয়ও পেলাম, চমকে উঠলাম।

 

ভুষুণ্ডা ঠাণ্ডা চোখে ঋজুদার দিকে চাইল।

 

ঋজুদা ভুষুণ্ডার চোখের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে, ভুষুণ্ডার চোখে নিজের চোখ দিয়ে এক বালতি বরফ জল ঢেলে দিল।

 

ব্যাপার বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। এসে বিদেশ-বিভুঁই, হাজার-হাজার মাইল জনমানবহীন হিংস্র জানোয়ারে, নানারকম দুর্দান্ত উপজাতিতে এবং সাংঘাতিক সব চোরাশিকারীতে ভরা আফ্রিকার বন-জঙ্গলে স্থানীয় গাইড ছাড়া আমরা কী করে চলব তা ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। গাইড থাকতেও পথ হারালাম। আর গাইড না থাকলে যে কী হবে! এদিকে তেলও বেশি নেই সঙ্গে। তেল ফুরোলে ত গাড়ি ফেলে রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। কিন্তু কোনদিকে যাব? হাজার-হাজার মাইল তো আর পায়ে হেঁটে যেতে পারব না! খাওয়ার জলের অভাবে তো এমনিতেই মরে যাব, খাবারের অভাবে যদি না-ও মরি।

 

ঋজুদাকে বললাম, ঋজুদা, তুমি রেগে গেছ, কিন্তু কাজটা কি ভাল হচ্ছে? ভেবে দ্যাখো।

 

ঋজুদা বলল, খুব ভাল হচ্ছে। তুই পাকামি না করে রান্নার কতদূর দ্যাখ। দরকার হলে টেডিকে সাহায্য কর একটু।

 

আমি চুপ করে গেলাম। ভাবলাম, সাহায্য আর কী করব? রাঁধছে তো শুধু উগালি। তাও প্রায় হয়ে এসেছে।

 

আমাদের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেল। ভুষুণ্ডা গাড়িতেই শোয়। টেডি ভীষণ লম্বা বলে গাড়িতে শুতে পারে না। ছোট তাঁবুটাতে শোয় ও। আমি আর ঋজুদা শুই বড় তাঁবুটাতে। আজ আমি শোব না এখন। পাহারা দিতে হবে। তাই রাইফেলে গুলি ভরে, টুপি পরে আমি তাঁবুর বাইরে আগুনের পাশে ক্যাম্প-চেয়ারে বসলাম। বাইরে যদি শীত বেশি লাগে, তবে মাঝে-মাঝে ল্যান্ড-রোভারের সামনের সীটেও গিয়ে বসব।

 

ঋজুদা বলল, কিছু দেখতে পেলে আমাকে ডাকিস। আর ঠিক রাত বারোটাতে তুলে দিস আমাকে।

 

বললাম, আচ্ছা।

 

ঋজুদা পরদা ঠেলে তাঁবুর মধ্যে গিয়ে ঢুকল। আমি ক্যাম্পচেয়ারে বসে জুতোসুদ্ধ পা-দুটো লম্বা করে আগুনের দিকে ছড়িয়ে দিলাম।

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই টেডি মহম্মদের নাক-ডাকার আওয়াজ সেই প্রায়-নিস্তব্ধ রাতের ঘাসবনে বিকট হয়ে উঠল। সেই ডাকের কী আরোহণ অবরোহণ, কত গমক আর গিটকিরি। টেপ-রেকর্ডার আছে সঙ্গে, কিন্তু তাতে টেডির নাক-ডাকার আওয়াজ টেপ করলে ঋজুদা মার লাগাবে। তাঁবুর মধ্যে, পিস্তলের গুলি খুলে আবার পিস্তল কক করার শব্দ শুনলাম। রি-লোড করে পিস্তল কক করল ঋজুদা, তার শব্দ শুনলাম। রোজ শোবার সময় মাথার বালিশের নীচে পিস্তলটাকে রাখে ঋজুদা। আর সারাদিন জার্কিনের কোটের পকেটে।

 

গাড়ির মধ্যে ভুষুণ্ডা ঘুমুচ্ছে। কোনো শব্দ নেই। মাঝে মাঝে নড়াচড়ার উসখুস আওয়াজ।

 

আধ ঘন্টা পর শুধু টেডির নাকডাকার আওয়াজ ছাড়া অন্য আর কোনো আওয়াজই রইল না।

 

একটু পরে আগুনটা ফিসফিস করে কী যেন বলে নিভে গেল। কাঠের না যে অনেকক্ষণ জ্বলবে। কটন ওয়েস্ট-এর সঙ্গে পোড়া মবিল মিশিয়ে তার সঙ্গে টুকিটাকি ও ঘাসটাস ফেলে আগুন করা হয়েছিল। কাল থেকে আগুন জ্বালারও কিছু রইল না। সঙ্গে কোরোসিনের স্টোভ আছে অবশ্য, তাতেই রান্না হবে।

 

উপরে তারাভরা আকাশ। এখন একটু চাঁদও উঠেছে। হাওয়াটা আরও জোর হয়েছে। হঠাৎ পিছন দিক থেকে হাঃ হাঃ হাঃ করে বুকের ভিতরে চমক তুলে হায়না ডেকে উঠল। তারপর ঘাসের মধ্যে খসখস করে তাদের এদিকে এগিয়ে আসবার শব্দ পেলাম।

 

কারিব্যুর ঘা-টা এখনও পুরো শুকোয়নি। হয়তো রক্তের গন্ধ পেয়ে থাকবে হায়নাগুলো। পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা ওদের দিকে ফেললাম। ওরা কিছুক্ষণ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।

 

হঠাৎ কী একটা জন্তু উড়তে-উড়তে, লাফাতে-লাফাতে এদিকে আসতে লাগল। জানোয়ারটা ছোট। কী জন্তু যে, তা বুঝতে পারলাম না। সামনে থেকে টর্চ ফেললাম। দেখলাম লোমওয়ালা একটা জানোয়ার–আমাদের দেশের বড় হিমালয়ান কাঠবিড়ালির মতো অনেকটা–গায়ের রঙ যদিও অন্যরকম। আর যেই সেই জানোয়ারটা আমাদের তাঁবুকে পাশে রেখে, তাঁবু দেখে ঘাবড়ে গিয়ে উড়ে সরে যেতে গেল তখন পাশ থেকে আলো ফেলতেই চোখ জ্বলে উঠল জ্বলজ্বল করে। কিন্তু একটা চোখ। অথচ যখন সামনাসামনি আলো ফেলেছিলাম তখন একবারও জ্বলেনি চোখ দুটো। কী জন্তু কে জানে? কাল জিজ্ঞেস করতে হবে ঋজুদাকে। এমন কিছু আমাদের দেশের জঙ্গলে দেখিনি, আফ্রিকাতে আছে বলে পড়িওনি।

 

উড়ে-যাওয়া জন্তুটা যে-দিকে মিলিয়ে গেল সেই দিকে চেয়েছিলাম, এমন সময় দূর থেকে বারবার সিংহের গর্জন ভেসে আসতে লাগল। কিছুক্ষণ পরই পায়ে-পায়ে জোর খুরের শব্দ তুলে ওয়াইল্ড বীস্টদের বিরাট একটি দল তাঁবুর দুশো গজের মধ্যে দিয়ে শিশির-ভেজা মাটির গন্ধ উড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল। সিংহের দল বোধহয় তাড়া করেছে ওদের।

 

ঠাণ্ডা লাগছিল বেশ। গিয়ে ল্যাণ্ড-রোভারের সামনের দরজা খুলে বসলাম। ভুষুণ্ডা গাঢ় ঘুমে আছে মনে হল। কোনো সাড়াশব্দই নেই।

 

মারিয়াবো পাহাড়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে-থাকতে বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখতে যাব কটা বাজে, এমন সময় মনে হল, মারিয়াবো পাহাড়ের দিক থেকে কী একটা জানোয়ার আসছে এদিকে। একলা জানোয়ারটা বেশ কাছে এসে গেছে। তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে নেমে গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে খুব ভাল করে তাকালাম ওদিকে।

 

আশ্চর্য! জানোয়ার তো নয়! মনে হচ্ছে মানুষ। দুবার চোখ কচলে নিলাম। পৃথিবীর মানুষ এ-রকম হয়? কী লম্বা! প্রায় সাত ফিটের মতো হবে। চলে আসছে সোজা হয়ে আমাদের তাঁবুর দিকে অদ্ভুত পোশাক তার। হাতে একটা বিরাট লম্বা লাঠি।

 

টর্চ ফেলব কি-না ভাবলাম একবার। তারপর ভাবলাম, ঋজুদাকে ডাকি। আরেকবার ভাবলাম, ঘড়িটা দেখি কটা বেজেছে; কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। কে যেন আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিল। আমার সারা শরীর অসাড় হয়ে গেল। এই কি তবে টেডির ঊনকুলুকুলু? সেদিন রাতে টেডি আমাকে এই গল্প বলেছিল।

 

লোকটি যখন আরো কাছে এসে গেছে তখন কানের কাছে হঠাৎ কে যেন ফিসফিস করে বলল, মাসাই চীফ। গ্রেট ট্রাবল্। শূট হিম্। কিল হিম্।

 

এক পলকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, ভুষুণ্ডা গাড়ির ভিতরে সোজা শক্ত হয়ে বসে উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে ঐদিকেই তাকিয়ে আছে।

 

রাইফেলটা কাঁধে তুললাম। কাঁধে তুলতে অনেকক্ষণ সময় লাগল। তারপরে রাইফেল স্টেডি পজিশানে ধরে ট্রিগারের দিকে হাত বাড়ালাম। ঠিক সেই অবস্থাতে আমার হঠাৎ মনে হল যে, মানুষটা অন্য মহাদেশের অজানা ভাষা-বলা কোনো অদ্ভুত মানুষ বটে, বিকট দেখতে বটে, কিন্তু সে তো আমার কোন ক্ষতি করেনি। সে চোরাশিকারী কি না, তাও জানি না। ঠাণ্ডা মাথায় একজন মানুষকে গুলি করে মারতে পারব কি আমি? আমার হাত কাঁপবে না?

 

ভুষুণ্ডা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, য়ু ডোন্ট কিল, হি কিল যু।

 

আমি ট্রিগারে হাত ছোঁওয়ালাম।

 

ততক্ষণে মানুষটা প্রায় এসে গেছে। সে সোজা আমারই দিকে আসছে।

 

কী সাহস! এই রাতে, এইরকম হিংস-জানোয়ারে ভরা রাতে একা-একা শুধু একটা লাঠি হাতে দূর থেকে হেঁটে আসার কথা ভেবেই আমার শরীর খারাপ লাগতে লাগল। লোকটা দেখতে পেয়েছে যে, তার বুক লক্ষ করে আমি রাইফেল তুলেছি। তবু তার ভ্রূক্ষেপমাত্র নেই। পৃথিবীর কোনো মানুষ তার ক্ষতি করতে পারে এমন কথা বোধহয় তার ভাবনারও বাইরে।

 

তবে? লোকটা কি পৃথিবীর মানুষ নয়? ঊনকুলুকুলু?

 

এ কী! লোকটা যে এসে গেল! লালচে-কানো ভারী মোটা কাপড়ের পোশাক, লুঙ্গির মতো অনেকটা; বুকের কাছে গিট দিয়ে বাঁধা। আরেক খণ্ড ঐরকম কাপড় চাদরের মত জড়ানো বুকে কাঁধে। ডান হাতে ওটা লাঠি নয়, একটা বর্শা, তার সাত ফিট মাথা ছাড়িয়ে আরো উঁচু হয়ে আছে। কোমরে বাঁধা আছে একটা প্রকাণ্ড দা। গলায়, কানে, অদ্ভুত সব বড় বড় রঙিন পাথরের আর হাড়ের গয়না। চাঁদের ফিকে আলোতেও তার মুখ আর কপালের রঙিন আঁকিবুঁকি অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

 

রাইফেল ধরেই আছি, লোকটাও এগিয়েই আসছে, আসছে; এসে গেল।

 

ভুষুণ্ডা গাড়ির ভিতর থেকে আবার চাপা গলায় বলল, কিল হিম, য়ু ফুলিশ বয়।

 

আমাকে বয় বলতেই রেগে গিয়ে যেন হুঁশ ফিরে পেলাম। আর হুঁশ ফিরে পেয়েই, যেই ট্রিগার টানতে যাব, তার আগেই লোকটা আমার রাইফেলটাকে ঠিক মাঝখানে তার দারুণ লম্বা মিশকালো হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে ফেলে ডান দিকে ঠেলে তুলে সরিয়ে দিল। আর সেই অবস্থাতেই, নলের মুখ থেকে আগুনের ঝলকের সঙ্গে গুলিটা বেরিয়ে গেল আধো-অন্ধকারে। রাইফেলের গুলির সেই আওয়াজ শূন্য প্রান্তরে ছড়িয়ে গেল হু-হু হাওয়ার সঙ্গে হাঃ হাঃ হাঃ করে, যেন আমাকেই ঠাট্টা করে।

 

লোকটা রাইফেলের নলটা ধরেই ছিল। নলটা ঐ অবস্থাতেই ধরে থেকে আমার চোখে সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে এল। কী ভয়াবহ জ্বলন্ত দৃষ্টি। কীরকম খোদাই করা কালো মুখ!

 

তারপরই, এক ঝটকায় রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে সে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

 

এমন সময় ঋজুদা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা ডান কাঁধের সামনে তুলে বলল, জাম্বো।

 

লোকটাও বলল, জাম্বো!

 

বলেই পিচিক করে, প্রায় আমার মুখের উপরেই, একগাদা থুতু ফেলল।

 

তারপর কাটা-কাটা সংক্ষিপ্ত গম্ভীর স্বরে ছোট্ট ছোট্ট শব্দে ঋজুদার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। সেই ভাষা সোয়াহিলি নয়। হয়তো মাসাইদের ভাষা।

 

ঋজুদা তাকে ক্যাম্প-চেয়ার পেতে বসাল। তারপর তাঁবুর ভিতরে গিয়ে এক টিন কনডেনসড মিল্ক আর একটা আয়না এনে মাসাই চীফকে উপহার দিল। কাউকে উপহার দেবে বলে, নতুন চকচকে আয়না যে ঋজুদা সঙ্গে করে আনতে পারে আফ্রিকার বনেও, তা আমার জানার কথা ছিল না।

 

এমন সময় মারিয়াবো পাহাড় যেদিকে, সেই দিক থেকে বহু লোকের গলার চিৎকার এবং দ্রিদিম, দ্রিদিম, দ্রিদিম গম্ভীর, গায়ে কাঁটা দেওয়া মাদলের শব্দ ভেসে আসতে লাগল। লোকগুলো মাঝে মাঝে একসঙ্গে বুক কাঁপানো চিৎকার করে উঠছিল।

 

ঋজুদা এসে আমাকে বলল, তুই একটা ইডিয়ট। আমাকে ডাকলি না কেন? কে তোকে গুলি করতে বলল? দ্যাখ তো এখন কী কাণ্ড বাধালি।

 

তারপরই বলল, এক্ষুনি ক্ষমা চা তুই মাসাই-সর্দারের কাছে। ওরা আমাদের বন্ধু। শত্রু নয়।

 

হাত-পা সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। আমরা এই কজন আর ওরা কত লোক। ওরা বর্শা দিয়েই সিংহ শিকার করে শুনেছি, তার উপর বিষাক্ত তীরও আছে ওদের। আমার তলপেট গুড়গুড় করছিল ভয়ে। দূরের মাদলের শব্দে আর চিৎকারে। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে, হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলাম আমি।

 

ঋজুদা কী যেন বলল মাসাই-সর্দারকে। শুধু দুটো শব্দ উচ্চারণ করল। এবং সর্দার সঙ্গে সঙ্গে আরেকবার পিচিক করে থুতু ফেলে একটু থুতু নিজের ডান হাতের তেলোতে নিয়ে দুহাতের পাতা ভাল করে ভিজিয়ে আমার মুখটাকে দুহাত দিয়ে ধরল। আমার মনে হল, সিংহের মুখে নেংটি ইঁদুর পড়েছে। আমার মুখটা দুহাতে ধরা অবস্থাতেই সর্দার আমার মাথার ঠিক মধ্যিখানে আবার সশব্দে থুতু ফেলল। কী দুর্গন্ধ! গা গুলিয়ে উঠল আমার। এর চেয়ে এদের তীর খেয়ে মরাও ভাল ছিল।

 

ঋজুদার উপর ভীষণ রাগ হতে লাগল। একে তো হাঁটুগেড়ে বসিয়ে ক্ষমা চাওয়াল, তারপর থুতু খাওয়াল। এখন থুতু দিয়ে চান করাল।

 

ততক্ষণে ভুষুণ্ডা এবং টেডি মহম্মদও চলে এসেছে। কিন্তু অন্ধকারে দিগন্তে অসংখ্য মশাল জ্বেলে রংবেরং-এর ঢাল পালক-লাগানো বল্লম হাতে শয়ে শয়ে মাসাইরা এগিয়ে আসছে আমাদের তাঁবুর দিকে।

 

ওদের আসতে দেখেই ঋজুদার হাত থেকে টর্চটা নিয়ে সর্দার ল্যাও-রোভারের বনেটের উপরে উঠে দাঁড়াল সাবধানে। টর্চ দিয়ে আকাশে আলো ফেলে-ফেলে সেই আগন্তুক লোকদের যেন কী ইশারা করল। তারপর ডান হাত তুলে বলল, মারিয়াবো, সিরিঙ্গেট, মিগুংগা; নীয়ারাবোরো।

 

বলেই, পিচিক করে আরেকবার থুতু ফেলে এক লাফ দিয়ে গাড়ির বনেট থেকে নামল। সঙ্গে সঙ্গেই আগন্তুক লোকগুলো দূর থেকেই হৈ-চৈ করতে করতে ফিরে যেতে লাগল, যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে। কী সব বলতে বলতে।

 

ঋজুদা আমাকে বলল, রুদ্র, এখানে তো স্নানের জল নেই। আমার হ্যাভারস্যাকে বড় এক শিশি ওডিকোলন আছে। বুকে মাথায় মেখে শুয়ে পড় গিয়ে। তোর আর থাকতে হবে না। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা হয়েছে।

 

মুখ নিচু করে রাইফেলটা যেখানে পড়ে ছিল, সেখানে গিয়ে সেটাকে কুড়িয়ে নিয়ে তাঁবুর মধ্যে গিয়ে ওডিকোলনের শিশি উপুড় করেও কিছুই সুরাহা হল না। সেই দুর্গন্ধ আরো বেড়েই গেল।

 

শুনেছিলাম, মাসাইরা নাকি শুধু রক্ত আর দুধ খেয়ে থাকে। তাই বোধহয় ওদের থুতুতে এ-রকম দুর্গন্ধ!

 

উত্তেজনায় ও দুর্গন্ধে ঘুম আসছিল না, তবুও ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলাম। ঋজুদা কোনোদিনও আমাকে ইডিয়ট বলেনি। আজই প্রথম বলল। কিন্তু এতই ভয় পেয়েছিলাম আর উত্তেজিত হয়েছিলাম যে, এত বড় অপমানটাও সর্দারের থুতুর সঙ্গে হজম করে ফেললাম।

 

শুয়ে শুয়ে সর্দারের মুখটা মনে করছিলাম। ঋজুদা বলেছিল, মাসাই চীফ-এর নাম নাইরোবি সর্দার।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments