প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটদের জন্য ছোট গল্প কালুসর্দার
তোমরা বোধ হয় জান, তিনশো বছর আগে এই বাংলাদেশ একেবারে অরাজক ছিল। তখন মুসলমান রাজত্ব যায় যায়, অথচ ব্রিটিশ রাজত্বের পত্তন হয়নি। তখন সত্যিই এদেশ হয়েছিল মগের মুল্লুক। ‘জোর যার মুল্লুক তার’—কথাটা বোধ হয় তখন থেকেই উঠেছে।
সেই অরাজকতার সময় সমস্ত বাংলাদেশের নানাজায়গায় বড়ো বড়ো ডাকাতের দল গড়ে উঠেছিল। দেশের তারাই ছিল আসল রাজা। সাধারণ লোকে দিনরাত তাদের ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত। সেই ডাকাতের দলের প্রতিপত্তি যে কীরকম ছিল, তা বোধ হয় এই কথা থেকেই বুঝতে পারবে যে, তখনকার ডাকাতেরা দস্তুরমতো খবর পাঠিয়ে ডাকাতি করত। ডাকাতি করতে আসছে, না নিমন্ত্রণ খেতে আসছে, তাদের ভাবগতিক দেখে তা বোঝা যেত না।
জমিদারমশাই হয়তো কাছারিতে বসে আছেন, এমন সময় বিশাল যমদূতের মতো চেহারা নিয়ে একজন সেখানে এসে হাজির! জমিদারের তো তাকে দেখেই চক্ষুস্থির হয়ে গেছে! কাঁপতে কাঁপতে তিনি বললেন, ‘কী চাই বাপু, তোমার ?
ভীমসেনের যমজ ভাই কায়দা-দুরস্তভাবে লম্বা কুরনিশ করে জলদগম্ভীরস্বরে বললেন, ‘সর্দার আপনাকে সেলাম দিয়েছেন হুজুর।’ তারপর মালকোঁচা-মারা কাপড়ের ট্যাক থেকে এক চিঠি বেরোল।
জমিদারমশাই চিঠি নেবেন কী, হাতের তাঁর কাঁপুনি থামে না। অনেক কষ্টে চিঠি যদিই-বা নিলেন, তো পড়তে আর সাহস হয় না।
কিন্তু চিঠিতে তা বলে খুব ভয়ংকর রকমের ধমক-ধামক বা হুমকি ছিল বলে মনে কোরো না। সে চিঠি একেবারে মাখনের মতো মোলায়েম! চিঠি পড়ে মনে হয়, যিনি লিখেছেন, তিনি যেন পায়ে কাঁটা ফুটলে কাঁটার কাছেও হাতজোড় করে ক্ষমা চান। চিঠিতে জমিদারের শ্রীচরণকমলে কোটি কোটি প্রণাম জানিয়ে লেখা হয়েছে যে, অমুক দিনে অমুক সময়ে জমিদারমহাশয়ের একান্ত শ্রীচরণাশ্রিত ভৃত্য বাবলাডাঙার কালুসর্দার শ-খানেক বাছা বাছা লাঠিয়াল নিয়ে হুজুরকে সেলাম দিতে আসবে। হুজুর যেন তাদের বকশিশের বন্দোবস্ত করে রাখেন।
জমিদারমশাই চিঠি পড়ে পাখার হাওয়া খেতে খেতেও ঘেমে উঠলেন। বুড়ো নায়েবমশাই তো মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়!
ভীমসেনের যে যমজ ভাই চিঠি এনেছিল, এবার সে লম্বা আর একটা কুরনিশ করে— হঠাৎ পেছন ফিরে এক ‘কুকি’ দিল।
সে ‘কুকি’ তো নয়, একসঙ্গে সাতটা বাজ পড়লে বুঝি অত শব্দ হয় না।
মানুষের গলা থেকে যে অমন আওয়াজ বেরোতে পারে, না শুনলে বিশ্বাস করবার জো নেই। জমিদারমশাইয়ের যেটুকু বাকি ছিল, এই ‘কুকি’ শুনেই তা শেষ হয়ে গেল।
তিনি কাছারি ঘরের ফরাসের ওপর আলবোলা-সমেত কাত হয়ে পড়লেন। আর একা জমিদারমশাইয়ের বা দোষ দিই কেন? কাছারিবাড়ির যে যেখানে ছিল, সবার অবস্থাই সমান! নায়েবমশাই ইতিমধ্যে কখন তক্তপোশের তলায় লুকিয়েছিলেন, সেখান থেকে তাঁর গোঙানি শোনা গেল। অমন যে জমিদারমশাইয়ের লম্বা-চওড়া ভোজপুরি দরোয়ান, সে পর্যন্ত পেতল- বাঁধানো লাঠিটা ফেলে কোথায় যে গেল, তার আর পাত্তা পাওয়া গেল না। খানিক বাদে একটু সামলে উঠে জমিদারমশাই প্রথমেই ডাকলেন, ‘নায়েবমশাই।’
তক্তপোশের তলা থেকে জবাব এল, ‘আজ্ঞে।’
নায়েবমশাইকে তক্তপোশের তলায় দেখে সবাই তো অবাক! মাকড়শার জাল-টাল মেখে তিনি বেরিয়ে আসতে জমিদারমশাই চটে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি ওখানে কী
করছিলেন?’
নায়েবমশাইয়ের উপস্থিত বুদ্ধি কিন্তু খুব বেশি, অম্লান বদনে তিনি জবাব দিলেন, ‘আজ্ঞে, একটা দলিল পড়ে গেছল, তাই খুঁজছিলাম।’
* * *
এইতো গেল সেকালের ডাকাতির দৌত্য পর্ব, তারপরের ব্যাপার আরও চমৎকার। জমিদারমশাইয়ের এতখানি পরিচয় হওয়ার পর আর বোধ হয় তাঁকে ছাড়া উচিত হবে না, সুতরাং তাঁর গল্পই বলা যাক।
আমাদের জমিদারমশাই বড়ো কেওকেটা নন। একটা আস্ত পরগনা তাঁর দখলে, গড়ের মতো তাঁর বাড়ি, পাইক-বরকন্দাজ-লাঠিওয়াল তাঁরও বড়ো কম নয়! কিন্তু তবুও তাঁকে কালুসর্দারের ভয়ে অস্থির দেখে সেকালের ডাকাতদের প্রতাপ বোধ হয় কিছু বোঝা যায়।
নায়েবের পর জমিদার পরামর্শ করবার জন্যে ডাকতে পাঠালেন, তাঁর বড়ো ছেলে ধনঞ্জয়কে। অবশ্য ধনঞ্জয়ের মতামতের ওপর তাঁর বিশেষ আস্থা ছিল, এমন নয়।
গোঁয়ার বলে তার আশা তিনি একরকম ছেড়েই দিয়েছিলেন। তবু হাজার হোক, বড়ো ছেলে তো—একবার ডাকা উচিত বলেই তাঁর মনে হল।
কিন্তু পাইক খানিক খুঁজে এসে খবর দিল, ‘তিনি নেই হুজুর!’
জমিদারমশাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নেই কীরে? দেখগে যা—আখড়ায় গিয়ে হয়তো লাঠি চালাচ্ছে! ব্যাটার ওই তো কাজ, চাযা হয়ে কেন যে জন্মায়নি তাই ভাবি।’
‘আজ্ঞে, তিনি সকালে বাহান্ন গ্রাম গেছেন।’
জমিদারমশাই এবার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। ‘মারলে, এরা সবাই মিলে আমায় মারলে! জানি আমি, একদিন গোঁয়ার্তুমি করে প্রাণটা দেবে। এই সময়ে বাবালাডাঙা পেরিয়ে মাথা খারাপ না হলে কেউ যায়!’
হঠাৎ কী মনে করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে সঙ্গে কারা গেছে?”
‘আজ্ঞে, সঙ্গে তিনি কাউকেও যেতে দেননি।
এবার জমিদারমশাইয়ের মুখ দিয়ে আর কথাও বেরোল না। খানিক বাদে নায়েবমশাইকে শুধু তিনি হতাশভাবে বললেন, ‘মঙ্গলবার সিংদরজা খোলাই থাকবে। তাদের যেন কেউ বাধা না দেয়।
নায়েবমশাই মনে মনে একরকম খুশি হয়েই ঘাড় নাড়লেন। ভীতু মানুষ, ডাকাতদের সঙ্গে মারমারির ভাবনায় তাঁর পেটের ভাত এতক্ষণ চাল হয়ে যাচ্ছিল।
* * *
গভীর জঙ্গলের ভেতর ডাকাতদের আড্ডা! নামে বাবালাডাঙা হলেও বাবলা হয় সব গাছই সেখানে আছে এবং সেসব গাছের ঝোপ এত ঘন যে, দিনের বেলাতেও সেখানে অন্ধকার হয়ে থাকে।
তিন-চারজন লোক মিলে নতুন গোটাকতক ‘রণপা’ তৈরি করছে, কালুসর্দার বসে বসে তাই তদারক করছিল, এমন সময় কাছেই জঙ্গলের ভেতর ভয়ানক হট্টগোল শোনা গেল। হট্টগোল নয়, মনে হল, বেশ একটা যেন দাঙ্গা চলছে!
কালুসর্দারের শাসন একেবারে বজ্রের মতো কঠোর। তার দলের লোকেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করবে, এ তো সম্ভব নয়। হট্টগোল অত্যন্ত বেড়ে ওঠাতে কালুসর্দারকে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটার সন্ধান নিতে যেতেই হল!
কিন্তু কয়েক-পা এগোতেই যে-দৃশ্য তার চোখে পড়ল, তাতে কালুসর্দারকে পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হল।
কুড়ি-একুশ বছরের একটি গৌরবর্ণ যুবক কালুসর্দারের দলের একজন সেরা লাঠিয়ালের সঙ্গে লড়ছে—না, শুধু লড়ছে বললে তার কিছুই বলা হয় না ; কায়দার পর কায়দায় বিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে যেন ছেলেখেলা করছে!
কালুসর্দার মনে মনে এরকম ওস্তাদ খেলোয়াড়কে তারিফ না করে পারল না। দেখতে দেখতে ছেলেটির লাঠির একঘায়ে কালুসর্দারের দলের লাঠিয়ালের হাত থেকে লাঠি খসে পড়ল! তখন দলের অনেক লোক তাদের চারধারে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। এত লোকের সামনে অপমানে ও লজ্জায় লোকটা রাগে অন্ধ হয়ে পাশের একজনের হাত থেকে একটা বল্লম নিয়ে ছুঁড়তে যাচ্ছিল, হঠাৎ কালুসর্দার সামনে এগিয়ে এসে বলল, ‘খবরদার!’ তারপর লোকটার হাত থেকে বল্লমটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘লজ্জা করে না, ওইটুকু ছেলের কাছে লাঠি ধরতে না পেরে আবার বল্লম ছোঁড়া?’ তারপর ছেলেটির দিকে ফিরে সর্দার জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী ভাই?’
কালুসর্দারের বিশাল সিংহের মতো বলিষ্ঠ চেহারার ওপর ছেলেটি দুবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘তাতে তোমার দরকার?’
দলের সবাই তো অবাক! কালুসর্দারের মুখের ওপর এরকম জবাব! কিন্তু কালুসর্দার একটু হেসে বলল, ‘তা ঠিক বলেছ, তোমার নামে কোনো দরকার নেই, তোমার পরিচয় তোমার হাতের লাঠিই দিয়েছে, তুমি আমাদের দলে আসবে?’
খানিক চুপ করে থেকে একটু হেসে ছেলেটি বলল, ‘যদি না আসি।’
কালুসর্দার তেমনি হেসে ধীরে ধীরে বলল, ‘আমাদের গোপন আড্ডা দেখবার পর আমাদের দলের না হলে জ্যান্ত যে কেউ ফিরতে পারবে না ভাই। তুমি এপথে এসে ভালো করনি।’
ডাকাতের দলের সংখ্যা দেখে মনে মনে কী ভেবে ছেলেটি বলল, ‘বহুত আচ্ছা, এত তাড়াতাড়ি মরবার সাধ আমার নেই, আজ থেকে আমি তোমাদের।’
কালুসর্দার এবার একটু হেসে বলল, ‘তোমার নাম তো তুমি বললে না, কিন্তু তোমায় ডাকা হবে তাহলে কী বলে?
ছেলেটি একটু চিন্তা করে বলল, ‘ধরো আমার নাম ফ্যালারাম।’
দু-দিনের মধ্যে ডাকাতের দলে ফ্যালারামের খাতির আর ধরে না। যে কাজে দাও,
ফ্যালারামের জুড়ি মেলা ভার। লাঠি খেলতে, বল্লম ছুঁড়তে, ‘রণপায়ে’ দৌড়োতে, লাঠিতে ভর দিয়ে লাফ দিতে ফ্যালারামের সমান ডাকাতদের ভেতর খুব কমই আছে দেখা গেল। কালুসর্দার পর্যন্ত একদিন বলে ফেলল, ‘একদিন তুমিই এদলের সর্দার হবে দেখছি!’
ফ্যালারাম একটু হেসে বলেছিল, ‘আহা বাবা শুনলে কী খুশিই হতেন!’ কালুসর্দার কথাটা ঠিক বুঝতে পারেনি।
পরের দিন সকাল থেকে ডাকাতদের সাজগোজ দেখে ফ্যালারাম একটু অবাক হয়ে গেল।
ব্যাপার কী? একজন ডাকাতকে ডেকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, ‘বাঃ, আজ যে চৌধুরিবাড়ি লুট হবে জান না?’
ফ্যালারাম কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে বলল, ‘ও, মনে ছিল না বটে।
সমস্তদিন ধরে ডাকাতদের কালীপুজো চলল। সঙ্গে সঙ্গে ডাকাতির আয়োজন। দেখা গেল, ফ্যালারামের উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। চরকির মতো সারাদিন তার ঘোরার বিরাম নেই—সব কাজেই সে আছে।
সন্ধে হতেই ডাকাতেরা সব তৈরি, এবার ঘড়া ঘড়া সিদ্ধি এল—ফ্যালারামের পরিবেশনের উৎসাহ দেখে কে?
সর্দার বলল, ‘সিদ্ধিটা আজ বড়ো ভালো হয়েছে মনে হচ্ছে! ঘুঁটেছে কে?’
ফ্যালারাম সলজ্জ ভাবে বলল, ‘আমি।’
তারপর সেই বনের ভেতর অসংখ্য মশাল জ্বলে উঠল। ‘রণপা’ পরে ভূতের মতো রং মেখে মশাল নিয়ে শ-খানেক ডাকাত যখন সেই বন থেকে একসঙ্গে ‘কুকি’ দিয়ে বেরোল, তখন মনে হল প্রলয়ের বুঝি আর দেরি নেই।
একপ্রহর রাতে ডাকাতদের আসবার কথা! জমিদার চৌধুরিমশাই প্রাণটি হাতে নিয়ে প্রাসাদের সিংদরজা খুলে বসে আছেন। ডাকাতেরা এলে বিনা বাক্যব্যয়ে তাদের হাতে ধন-প্ৰাণ সঁপে দেবেন—তারপর তারা যা খুশি করুক।
হঠাৎ বাইরে ভীষণ শোরগোল শোনা গেল। আর দেরি নেই বুঝে জমিদারমশাই প্রস্তুত হয়ে বসলেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! শোরগোল বেড়েই চলল, অথচ ডাকাতদের আসবার নাম নেই। শোরগোলটাও যেন একটু অদ্ভুত রকমের। এ তো ডাকাতদের আক্রমণের হুংকার নয়, এ যে রীতিমতো মারমারির শব্দ! তাঁর লোকজন তো সব গড়ের ভেতর, তবে মারামারি করছে কে?
আরও কিছুক্ষণ ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করে জমিদারমশাই বাইরে লোক পাঠতে যাচ্ছেন,
এমন সময় ঊর্ধ্বশ্বাসে যে এসে ঘরে ঢুকল, তাকে দেখে তো বাড়িসুদ্ধু লাঠিয়াল একেবারে স্তম্ভিত! সে আর কেউ নয়, ধনঞ্জয়—জমিদারের বড়ো ছেলে।
প্রথম বিস্ময় কাটিয়ে উঠে জমিদারমশাই কিছু বলবার আগেই ধনঞ্জয় বলল, ‘দেরি করবার সময় নেই বাবা, শিগ্গির গোটাকতক মশাল আর কিছু দড়ি দিয়ে জনকয়েককে পাঠিয়ে দিন, আমি বাইরেই আছি।’
জমিদারমশাই আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে ধনঞ্জয় বেরিয়ে গেছে। রহস্য এর ভেতর যাই থাক, জমিদারমশাই ছেলের কথা এসময়ে অবহেলা করতে পারলেন না। জন- কতক বরকন্দাজ মশাল আর দড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
এদিকে ডাকাতদের কী হয়েছে বলি। বন থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতে না যেতেই তাদের মনে হল, সিদ্ধির নেশাটা যেন বড়ো বেশি হয়ে গেছে। সকলেরই কেমন যেন ঝিমুনির ভাব, পা চালাতে ইচ্ছে করে না। কালুসর্দারের নিজের অবস্থাও অনেকটা সেইরকম, তবুও সকলকে ধমকে দিয়ে সে একরকম তাড়িয়েই নিয়ে আসছিল। বিপদের ওপর বিপদ খানিকদূর যাওয়ার পর মশালগুলো আপনা থেকেই নিভে যেতে লাগল। কোনোরকমেই সেগুলোকে আর জ্বালিয়ে রাখা গেল না। মশালগুলোতে মশলাই কম দেওয়া হয়েছে। মশাল তৈরির ভার যাদের ওপর ছিল, তারা তো ভয়ে অস্থির! এখন কিছু না বললেও পরের দিন সর্দারের কাছে এর কৈফিয়ত দিতে তাদের কী অবস্থা হবে, তারা জানে।
মশালগুলো নিভে যাওয়ার পর অন্ধকারে তাদের পক্ষে তাড়াতাড়ি যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠল। কালুসর্দার হঠাৎ একসময়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ফ্যালারাম কোথায়?’
কে একজন জানাল যে, ফ্যালারাম তাদের ছাড়িয়ে অনেক আগে চলে গেছে!
‘চলে গেছে কী হে? পথ চিনতে পারবে না যে!’
‘কী জানি সর্দার, তার যা উৎসাহ ধরে রাখে কে?’
কিন্তু চৌধুরিবাড়ির কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ অন্ধকারে একটা লোক তাদেরই দিকে ছুটে আসছে মনে হল।
সর্দার হাঁকল ‘কে?
লোকটা তাড়াতাড়ি কাছে এসে বলল, ‘আমি ফ্যালারাম। একটু এগিয়ে ওদের ব্যাপারখানা দেখতে গেছলাম সর্দার!’
কালুসর্দার খুশি হয়ে বলল, ‘বেশ বেশ, কী দেখলে?’
‘লোকজন ওদের সব তৈরি হয়ে আছে, কিন্তু এক কাজ করলে ওদের ভারী জব্দ করা যায় সর্দার! আমরা দু-দলে ভাগ হয়ে যদি ওদের সামনে-পেছনে দু-দিক থেকে চেপে ধরি, তাহলে ওদের জারিজুরি সব একদণ্ডে ভেঙে যায়।
সর্দার খানিক ভেবে বলল, ‘এ তো মন্দ যুক্তি নয়! কিন্তু ঠিক ওরা কোথায় আছে, জান তো?’
“গিয়ে দেখে এলাম, আর জানি না!’
কালুসর্দারের হুকুমে একদল এবার চৌধুরিবাড়ির সামনে দিয়ে অগ্রসর হল, আর একদলকে পেছন দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ফ্যালারাম।
অন্ধকার রাত, সঙ্গে মশাল নেই, তার ওপর নেশায় সবাই বুঁদ হয়ে আছে ; ফ্যালারাম খানিকদূর গিয়ে—’এই জমিদারের লাঠিয়াল’—বলে দেখিয়ে দিতেই ডাকাতেরা বেপরোয়া ভাবে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কে শত্রু, কে মিত্র, বোঝবার তাদের তখন ক্ষমতা নেই।
কালুসর্দারও যে ব্যাপারটা প্রথমে বুঝেছিল, তা নয়। জমিদারের লোকের সঙ্গে যুঝছে ভেবে যে পরমানন্দে লাঠি চালাচ্ছিল। হঠাৎ চারধারের অনেকগুলো মশাল জ্বলে উঠল। ডাকাতেরা অধিকাংশই তখন নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ও নেশার ঘোরে মাটিতে শয্যা নিয়েছে। কালুসর্দার অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল — মাটিতে যারা পড়ে আছে, সবাই তারা তার দলের লোক। জমিদারের লোকেরা তখন তাদের মধ্যে যারা কম আহত হয়েছে, তাদের হাত-পা বাঁধতে শুরু করেছে। এরকম ভাবে প্রতারিত হয়ে রাগটা তার কীরকম হল, বুঝতেই পার, তার ওপর যখন সে দেখল, যে, ফ্যালারাম তার কাছেই দাঁড়িয়ে মুচকে মুচকে হাসছে, তখন তার আর দিগ্বিদিক জ্ঞান রইল না।
‘বুঝেছি, এসব তোরই কাজ। তোর শয়তানির আজ উচিত শাস্তি দেব।’—বলে উন্মাদের মতো সে ফ্যালারামে দিকে লাঠি নিয়ে লাফিয়ে পড়ল। জমিদারের একজন বরকন্দাজ সেইমুহূর্তে তাকে লক্ষ্য করে একটা বল্লম ছুঁড়ে মারল, কিন্তু সে বল্লম সর্দারের গায়ে বেঁধবার আগেই ফ্যালারামের লাঠির ঘায়ে মাটিতে পড়ে গেল।
কালুসর্দার এবার অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। লাঠিসুদ্ধ হাত তার আপনা থেকেই নেমে এল।
ফ্যালারাম একটু হেসে বললে, ‘যাক শোধ-বোধ হয়ে গেল সর্দার! আমাকেও তুমি বল্লমের ঘা থেকে বাঁচিয়েছিল! এখন ইচ্ছে হয়, লড়তে আসতে পার, আমি প্রস্তুত।’
কিন্তু সর্দারের তখন আর লড়বার ইচ্ছে নেই। মাথা নিচু করে লাঠির ওপর ভর দিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল। জমিদারের লোকজন তখন চারধার দিয়ে তাকে ঘিরে ফেলেছে একজন তাকে বাঁধতে যাচ্ছিল ফ্যালারাম হাত তুলে তাকে নিষেধ করে বলল, ‘ডাকাতি করলেও তোমার সঙ্গে মিশে দেখেছি, মন তোমার উঁচু আছে সর্দার! তোমায় ছেড়ে দিলাম। যেখানে খুশি তুমি যেতে পার!’
কালুসর্দার তবুও নড়ল না, হাতের লাঠিটা ফেলে হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, ‘মা কালী আমার ওপর বিরূপ হয়েছেন, নইলে সিদ্ধি খেয়ে আমাদের এত নেশাই হবে কেন, আর মাঝপথে মশালই বা নিভে যাবে কেন? এখন আমার আড্ডা ভেঙে গেছে, দলের লোক সব বন্দি। কোথায় আর আমি যাব! আমাকেও বেঁধে নাও।’
ফ্যালারাম মাটি থেকে লাঠিটা কুড়িয়ে সর্দারের হাতে আবার তুলে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তার বদলে যদি এবাড়ির লাঠিয়ালদের তোমায় সর্দার করে দেওয়া যায়?
কালুসর্দার অবাক হয়ে বলল, ‘আমায়? আমি তো ডাকাত!’
ফ্যালারাম হেসে বলল, ‘তোমার মতো ডাকাতই আমার দরকার। বাজে লোকের সঙ্গে লাঠি খেলতে খেলতে সব প্যাঁচ প্রায় ভুলতে বসেছি।’
‘কালুসর্দার হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার দরকার? তুমি কে তাহলে?’
ফ্যালারাম একটু হাসল। জমিদারের লাঠিয়ালেরা হেসে উঠে সর্দারকে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘বোকারাম, জমিদারমশাইয়ের বড়ো ছেলেকে চেনো না?’
এবার কালুসর্দারের হাতের লাঠিটা। আবার পড়ে গেল।
তারপর কালুসর্দার সারাজীবন চৌধুরিবাড়িতে একান্ত বিশ্বাসী হয়ে চাকরি করেছিল শোনা যায়। কিন্তু সিদ্ধি খেয়ে কেন যে সেদিন তার অত নেশা হয়েছিল, আর মশালগুলোই বা কেন যে মাঝপথে নিভে গিয়েছিল, কোনোদিন সে তা বুঝে উঠতে পারেনি ।