মিনুর মামামণি আজ সন্ধেবেলা কোথা থেকে অনেকগুলাে কেয়া ফুল কিনে এনেছেন। বায়না করে তার ভিতর থেকে একটা মিনু চেয়ে নিয়ে তার ঘরে এনে রেখেছে।
কাঁটা-দেওয়া লম্বা-লম্বা পাতার আড়ালে নরম শাদা ফুলটি যেন লাজুক একটি সুন্দরী মেয়ে। আর, কী মিষ্টি তার গন্ধ! সমস্ত ঘর যেন ঢুলে পড়েছে সেই নেশায়।
বাইরে ঝিম্ ঝিম্ করে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের বাতি নেবানাে। একলা বিছানায় শুয়ে-শুয়ে মিনুর কী ভালই লাগছে! কেয়াফুলের গন্ধ নয়, যেন ভারি মিষ্টি কার আদর। সমস্ত মন জুড়িয়ে যায়।
কেয়াফুলটা পাশের টেবিলের উপর ফুলদানিতে মিনু রেখেছে। ঘরের ভিতর বাতি নেভানাে, কিন্তু জানলা-দরজা দিয়ে একটু-আধটু আলাে চুইয়ে যে না এসেছে তা নয়।অস্পষ্টভাবে ফুলদানিটা দেখা যাচ্ছে। টেবিলের উপর ফুলটি যেন সাদার একটা আবছা ছােপ অন্ধকারে।
বাইরের রিম্ ঝিম্ বৃষ্টির আওয়াজ, আর ঘরের ভিতর কেয়ার মিষ্টি গন্ধে মিনুর চোখ ঘুমে ক্রমশ জড়িয়ে আসছিল; হঠাৎ ঠুক করে একটা আওয়াজে তার ঘোর কেটে গেল।
মিনু একটু অবাক হয়ে উঠে বসল; বাইরে বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ও হচ্ছে একটু। দমকা হাওয়ায় জানালার একটা পাল্লা গেছে খুলে। হয়ত তারই শব্দ। মিনু আবার চোখ বুজোতে যাবে—হঠাৎ টেবিলের পাশে স্পষ্ট কার মিষ্টি গলা শােনা গেল। তাই তাে! ভারি আশ্চর্য তাে! কেয়া ফুলটির ভিতর থেকেই যেন কার কথা শোনা যাচ্ছে!
‘শুনছো!’
মিনু প্রথমটা বিশ্বাস করতে চাইল না; কেয়া ফুল আবার কথা কয় নাকি! কিন্তু আবার যখন মিঠে গলার মিনতি শোনা গেল, ‘শুনছ!’ তখন সে বলে ফেলল আপনা থেকেই, ‘কী?’
‘আমায় একটু জানালার ধারে রাখবে!’
‘কেন বল তাে?’ মিনু জিজ্ঞেস করলে অবাক হয়ে।
‘এখান থেকে ভাল দেখতে পাচ্ছি না।’
‘দেখতে পাচ্ছ না! জানালার ধারে কী দেখবে?’
‘বিদ্যুৎ কুমারকে।’
মিনু একটু অবাক হল বৈকি? বিদ্যুৎই তো সে জানে, বিদ্যুৎ কুমার আবার কী! কে জানে, হয়ত ভুলই শুনেছে, কিংবা কেয়া ফুলেরা হয়ত বিদ্যুতের ঐ রকমই বানান করে! কিন্তু কেয়াফুলের অনুরােধটা তাে রাখা দরকার।
মিনু ফুলদানিটা ধরে জানালার ধারে বসিয়ে দিলে, তারপর বললে, ‘পড়ে যাও যদি!’
‘না, পড়ব না। এই তলােয়ারের ফলাগুলাে যদি একটু ফাঁক করে দাও, আমি বেরোতে পারি।’
নাঃ, ক্রমশ যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে! মিনু অবাক হয়ে বললে ‘তলােয়ার কোথায় ? পাতা বলো।’
‘না-না, পাতা হবে কেন, তলােয়ার! একটা রাজপুত্রের, একটা মন্ত্রীপুত্রের, একটা কোটালপুত্রের, একটা সদাগরপুত্রের!’
‘সে আবার কী!’ জিজ্ঞেস করলে মিনু, ‘তলোয়ার কোথা থেকে এল?’
‘বা-রে, আমায় পাহারা দিতে তারা তলােয়ার পুঁতে রেখে গেছে, জান না!’
‘না তাে!’
‘সে অনেক কথা!’
‘বল না লক্ষ্মীটি!’ মিনু অনুরােধ জানায়।
‘শুনবে তাহলে!’
মিনুকে কি আর দু-বার বলতে হয়। সে তাড়াতাড়ি উঠে বসে কেয়া ফুলের পাতা-থুড়ি, তলােয়ারগুলি সরিয়ে ধরল।
ওমা! সত্যিই যে পালকের চেয়ে হালকা, ধোঁয়ার মত মিহি, রেশমের চেয়ে নরম, দুধের মত শাদা ওড়নায় ঢাকা, জোছনার মত সুন্দর একটি ছােট্ট মেয়ে বেরিয়ে এসে জানালার ধারে পা ঝুলিয়ে বসল।
মিনু অবাক হয়ে বলল, ‘তুমিই ছিলে ঐ কেয়া ফুলের ভিতর?’
‘হ্যাঁ, আমিই ছিলাম ঐ কেয়া ফুল হয়ে, কত বছর—কত যুগ—তুমি ভাবতেই পার না।’
‘কেন, কেন?’
‘সেই গল্পই তো তােমায় বলছি! বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির দেশ জান?’
‘জানি না, তবে রূপকথায় যেন পড়েছি।’
‘তােমরা আজকাল কি-ই বা জান!’
‘বাঃ, আমাদের ভূগোলে কত-সব অদ্ভুত দেশের কথা আছে। বেচুয়ানাল্যাণ্ড, আলাস্কা, ক্যামাস্ কাট্ কা!’
‘ও-সব নয়!, আমাদের ভূগোলে নেই!’
‘তোমাদের ভূগোলের কিচ্ছু নেই।’
অন্য সময় হলে মিনু এত সহজে ভূগোলের অপমান হজম করত না, কিন্তু এখন তর্ক করলে গল্প-শােনাটা যদি ফস্কে যায়, এই ভয়ে সে চুপ করে রইল।
কেয়া ফুল বললে, ‘সেই ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর দেশের শেষে ঘুমন্ত-পুরী।’
‘ঘুমন্ত-পুরী জানি! যেখানে সবাই ঘুমিয়ে আছে; রাস্তায় লােকজন, রাজবাড়ির দরজায় সেপাই-শাস্ত্রী, দরবারে পাত্র মিত্র, কোটাল মন্ত্রী, রাজা; আর জলের মত পরিষ্কার স্ফটিকের ঘরে নরম বিছানার উপর ঘুমিয়ে আছে আফোটা পদ্মের মত অপরূপ রাজকুমারী! তার পাশে সােনার কাঠ আর রূপাের কাঠি পড়ে রয়েছে। রুপার কাঠির ছোঁয়ায় সে ঘুমিয়েছে, সোনার কাঠি ছোঁয়ালে সে জাগবে; কিন্তু কে ছোঁয়াবে সােনার কাঠি! ঘুমন্ত-পুরী পাহারা দেয় অগুন্তি রাক্ষসী, তারা দিনে চড়ে বেড়ায় দেশ-বিদেশে, সন্ধে হলেই কোথা থেকে দলে-দলে এসে হয় হাজির। মানুষ তাদের চোখে দেখতে হয় না, নাকে শুকেই টের পায়।
মিনু হাঁপিয়ে উঠে একটু থামল।
কেয়া ফুলের মেয়ে একটু ভারি গলায় বলল, ‘তাহলে তাে তুমিই সব জান, আমি আবার কী বলব।’
মিনু বুঝল, ভারি ভুল হয়ে গেছে, গল্প বলতে-বলতে মাঝখানে ফোড়ন দিলে ঠাকুমাও তাে চটে যায়। কেয়া ফুলের মেয়ে যে অভিমান করবে, তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে!
সে খুব অপরাধীর মত বলে ‘না ভাই, আমি আর কী জানি। তােমার কাছেই তো শুনতে চাইছি।’
কেয়া ফুলের মেয়ের মনটা হাজার হলেও নরম, এইটুকুতেই গলে গিয়ে সে বলল, ‘না-না, তুমি তাে অনেকটা ঠিকই বলেছ, তবে তােমরা তাে সব জান না, আমাদের দেশের ভুল খবর তােমাদের দেশে কারা সব রটিয়েছে, কে জানে।’
উৎসাহভরে মিনু সায় দিয়ে বললে, ‘তা হতে পারে। বাবা বলেন—খবরের কাগজের রােজ কত ভুল খবর বেরােয়, যদুর ধড়ে রামের মাথা বসিয়ে তারা রামযদু তৈরি করে।’
কেয়া বলল, ‘তবে! তােমাদের নিজেদের খবরই যদি এত ভুল, তাহলে আমাদের কথা তােমরা আর ঠিক কী করে জানবে? ঘুমন্ত-পুরীতে কোথা থেকে এল এত ঘুম তা জান?’
মিনু যা জানত, তা বললে হয়ত আবার কেয়া রাগ করবে! তাই সে সাবধান হয়ে বলল, ‘কই না তাে!’
‘ঘুমন্ত-পুরীতে একলা কে জাগে, তাও জান না?’
মিনু অবাক হয়ে বলল, ‘কই না তো।’
‘একলা জাগে রাজকন্যা নিজে। পুরীর মানুষ ঘুমে অসাড়, পুরীর পাথর ঘুমে নিঝুম, শুধু ঘুম নেই রাজকন্যার একচোখে!’
‘একচোখ! সে আবার কী?’
সেই তাে গল্প। একদিন রাজপুরী ছিল জমজমাট। পথে-পথে হৈ-হৈ রৈ রৈ, ঘরে-ঘরে লােক থইথই, রাজপুরী গম্-গম্ করে রাতদিন। হঠাৎ একদিন রাজকন্যা বাগানে গিয়ে না-জানি ফুলের দো-দানি পাতা ছিড়ে বসল।
‘তাতে কী?’
‘বলেছি তাে, শােনই না।’
‘না-জানি ফুলের দো-দানি পাতা তাে শুনি নি কখনো !’ বলে ফেলেই মিনু বুঝল, কাজটা ভাল হয় নি। কেয়া-মেয়ের ঠোঁট তখনই ফুলেছে।
‘অত খিচ-খিচ করলে গল্প বলা যায় না।’
মিনু তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলল, ‘না-না, এইবারটি মাপ কর, আর বলব না ।’
কেয়া অবশ্য তক্ষুনি খুশি হয়ে বললে, ‘পাতা তাে নয়, জোছনা-রাতের দুই পরী দিনের বেলা গলা-জড়াজড়ি করে পাতা হয়ে ঘুমিয়ে ছিল। ছিড়ে তারা মাঠিতে পড়ল, মাটিতে পড়ে শামুক হল, শামুক হয়ে শাপ দিল—
‘শামুক হল কেন?’
‘বাঃ, দিনের বেলায় কেউ ছুঁয়ে দিলেই ভাঙা চাঁদ পুরস্ত না-হওয়া অবধি পরীদের যে শামুক হয়ে কাটাতে হয়। কোথায় চাঁদের আলোয় হালকা পাখায় উড়ে বেড়াবে মনের খুশিতে, না শামুক হয়ে মাটির ওপর গুটি-গুটি নড়তে হবে। পরীদের রাগ তো হবেই।’
তারা শাপ দিল—
এক ছিলাম, দুই করলি,
দিনে ছুঁয়ে ঘুম ভাঙালি,
দু-চোখের পাতা তাের
এক হবে না!
‘রাজকন্যা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরল। শাপের কথা শুনে রানী কাঁদেন, রাজা কাঁদে, রাজ্য শুদ্ধ লােক কাঁদে। রাজকন্যার চোখে আর ঘুম নেই।’
‘দিন যায়, সপ্তাহ যায়, পক্ষ যায়, মাস যায়, রাজকন্যা দু-চোখের পাতা আর এক করতে পারে না। রাজা বৈদ্য ডাকলেন, ওঝা ডাকলেন, কত শান্তি-স্বস্ত্য়ন, যাগ-যজ্ঞ করলেন— রাজকন্যার চোখে আর ঘুম নামে না।
শেষে রাজা দেশ-বিদেশে ঢেঁড়া দিলেন ‘রাজকন্যাকে ঘুম পাড়াতে পারলে মস্ত বখশিস।’ বখশিসের বহর বেড়ে চলল। মােহরের থলের বদলে মণিমুক্তো, মণিমুক্তোর জায়গায় হীরে-মানিক; কিন্তু কেউ রাজকন্যাকে ঘুম পাড়াতে পারল না।
কত গুনিন এল, ওঝা এল, নামের-চেয়ে-উপাধি-বড় বৈদ্য এল, রাজকন্যার হায়রানিই সার। কেউ সারা দিনরাত মন্ত্র পড়ে, কেউ হরেক-রকম জড়িবুটি খাওয়ায়, রাজকন্যা তবু ঘুমের উপােসী। দিনে দিনে রাজকন্যা শুকিয়ে কাঠিটি হয়ে গেল।
রানীর চোখের জল আর শুকোয় না, রাজা ভেবে সারা। বলেন, অর্ধেক রাজত্ব দেব, মেয়ে যদি ঘুমায়। এমন সময় রাজপুরীর টিকারায় ঘা।
কে-আসে? কে আসে? না— নিশুত-নগরের মস্ত গুনিন আসে; কিন্তু বড় বেশি তার খাই। অর্ধেক রাজত্বে তার কাজ নেই, ঘুম পাড়িয়ে স্বয়ং রাজকন্যাকে সে চায়। তাও বড় সহজ শর্তে নয়। নিশুতি রাতে একলা আসবে রাজকন্যার ঘরে, একলা জাগবে। চোখে যদি কেউ চেয়ে দেখে, তাহলে আজীবন তার অ-নিদ কাটবে, আর সমস্ত পুরীর ঘুম যুগ-যুগান্তরেও ভাঙবে না।
রাজা অনেক ভাবলেন অনেক চিন্তা করলেন; কিন্তু উপায় তাে আর নেই রাজি তাকে হতেই হল।
নিশুতি রাতে রাজপুরীতে টু শব্দটিও নেই। সবাই আছে যে-যার ঘরে চোখ বুজে। দেউড়িতে পায়ের আওয়াজ, পায়ের আওয়াজ স্ফটিকের সিঁড়িতে। রাজকন্যার বুক কাপছে পালঙ্কে শুয়ে। পায়ের আওয়াজ ঘরের কাছে! পালঙ্কের কাছে খস্ খস্, ফোস-ফোস, কার বুঝি ভারি নিশ্বাসের শব্দ।
রাজকন্যা, চোখ যেন খুলাে না।
না, রাজকন্যা চোখ কিছুতেই খুলবে না। ঘরে কিসের ঠান্ডা-মিষ্টি গন্ধ, গন্ধ নয় বুঝি ঘুমের ঘাের, নিশ্বাসে নিশ্বাসে ঝিমিয়ে আসে গা, ঘুমের সাগর উথলে উঠছে, ঢেউ ভেঙে পড়ে পায়ের কাছে, ঢেউ এল হাঁটুর উপর, ঢেউ গেল কোমর ছাড়িয়ে, হিমের মত ঠাণ্ডা ঢেউ গলার কাছে খেলা করে, রাজকন্যার সকল দেহ এলিয়ে পড়েছে! হিমেল ঘুমের ঢেউ এগিয়ে আসে।
‘রাজকন্যা চোখ খুলাে না!’
কিন্তু রাজকন্যা আর কি পারে! দুটি চোখ ঘুমে এসেছে জড়িয়ে, কার সঙ্গে বিয়ে হতে যাচ্ছে একবার না দেখে যে থাকা যায় না!
রাজকন্যা একটি চোখ বুজে একটি চোখ খুলে তাকালে। সঙ্গে সঙ্গে বুকের রক্ত হিম! রাজকন্যা আঁতকে উঠে চীৎকার করল।
আঁতকে উঠল কি সাধে! মেঝের কুণ্ডলি পাকিয়ে ছাদ পর্যন্ত বিরাট ফণা তুলে অজগরের রাজা নাগেশ্বর তার দিকে তাকিয়ে আছে!
চোখাচোখি এক পলক শুধু, হঠাৎ ঘরের বাতি নিভল, জানলা-দরজা আছাড় খেল ঝড়ের দাপটে।
‘অন্ধকারে শোনা গেল শুধু দারুণ স্বর—
যে চোখে দেখেছ, সে চোখে জাগবে,
নিঝুম-পুরীর ঘুম না ভাঙবে।’
‘রাজকন্যা কেঁদে ফেলে বলল আর কি তবে উদ্ধার নেই?’ ‘অট্টহাসির সঙ্গে শোনা গেল—আছে, যদি আমার রানী হও এখন।’
‘রাজকন্যা শিউরে উঠে বললেন-না! সে হয় না।’
তবে যেমন আছ, তেমনি থাক, যতদিন না—
জলের তলায় আগুন জ্বলে,
সেই আগুনে শিলা গলে।
সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাসি শোনা গেল! সেই থেকে রাজকন্যা একচোখে জেগে কাটায়, রাজপুরীর ঘুম আর ভাঙে না।
‘রাজকন্যা জানে, উদ্ধার আর নেই। জলের তলায় আবার আগুন কেউ জ্বালাতে পারে নাকি! আর পারলেও এ ঘুমন্ত পুরীতে আসছে কে!’
মিনু এতক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে গল্প শুনছে, এইবার উৎসুক হয়ে বললে, ‘কেন, রাজপুত্র কোথায় গেল?’
কেয়া ফুল একটু চুপ করে থেকে বলল, কোথায় আর যাবে। রাজপুত্র সবে পথে বেরিয়েছে,দুয়োরানীর ছেলে বলে সুয়োরানী রাতদিন দূর-দূর করেন, রাজা চোখে দেখেও কিছু করতে পারেন না। মনের দুঃখে রাজপুত্র ঘােড়াশাল থেকে ঘােড়া খুলে নিশুতি রাতে যেদিকে দু-চক্ষু যায় বেরিয়ে পড়েছে। দু-চক্ষু আর কোথায় যায়! পুরীর বাইরে মশান; রাজপুত্র সেইদিকে চলছে। মশানের মাঝে পথ আগলে কোটালপুত্র দাঁড়িয়ে —
কোথায় যাবে বন্ধু?
যেদিকে দু-চক্ষু যায়।
আমিও তােমার সঙ্গে যাব।
রাজপুত্রের কোন মানা না শুনে কোটালপুত্র সঙ্গে চলে। মশান ছাড়িয়ে শ্মশান, সেখানে আর দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে মন্ত্রীপুত্র আর সদাগরপুত্র। কোন মানা তারা শুনল না। রাজপুত্রের সঙ্গে তারা দেশান্তরী হবেই।
শ্মশানে দাঁড়িয়ে চিতার আগুন সাক্ষী করে চার বন্ধু প্রতিজ্ঞা করলে – জীবনে মরণে তাদের ছাড়াছাড়ি হবে না।
তারপর চার বন্ধু কত দেশ, কত বন, কত পাহাড় ডিঙিয়ে চলে, পিছন ফিরে
আর তাকায় না। শেষে একদিন ঘুরতে ঘুরতে—
মিনু বলে ফেললে, ‘ঘুমন্ত-পুরী।’
কেয়া তাড়াতাড়ি বললে, ‘কি করে বুঝলে? আমি তো বলিনি। মিনু গম্ভীর হয়ে বললে, ‘ও-সব আমি বুঝতে পারি।’
কেয়া ফুল বােধহয় খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। সে খানিক চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করলে, ‘ঘুমন্ত-পুরীর সে কী হাল! তার দেওয়াল টলােমলাে, পড়ে-পড়ে; তার ঘর-দোর জঙ্গল ঝােপ-ঝাড়ে।
তবু রাজপুত্রের কেমন শখ—ভিতরে যাবে। বন্ধুরা মানা করে, রাজপুত্রের সেই এক গো। কী আর করে, চার বন্ধু মিলে তলােয়ারে জঙ্গল সাফ করতে-করতে ভিতর ঢুকল। যেদিকে চায়, জানলা-দরজা খসে পড়েছে, দেয়াল ধসে পড়েছে। তারই ভেতর ঘরে ঘরে মরা মানুষ!
কী আশ্চর্য! মরা তাে নয়, জ্যান্ত মানুষ! মরা হলে কবে পচে খসে যেত। জ্যান্ত মানুষ ঘুমিয়ে আছে অঘাের ঘুমে! চার বন্ধু এক-এক করে সব ঘর-দালান ঘুরে ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠে। ঘরের পর ঘর ঘুরতে ঘুরতে
মিনু বলল, ‘রাজকন্যার ঘরে—’
কোয়া বললে, তুমি তো ঠিক ধরতে পার! রাজকন্যা একচোখ ঘুমায় আর একচোখে জাগে; ঘরের ভিতর চার বন্ধুকে দেখে অবাক! ঘুমের চোখে স্বপ্ন, না জাগার চোখে সত্যি দেখছে ভেবে পায় না।
চার বন্ধু তাে অবাক! মণি-মাণিক্যের পালঙ্কে পরমা সুন্দরী রাজকন্যা একচোখে চেয়ে আছে। এ আবার কে!
রাজপুত্র এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললে—’অনেক দেশ বিদেশ ঘুরেছি, এমন পুরী তাে দেখিনি! কেন তােমাদের এমন দশা?’
ঘুমের চোখে স্বপ্ন নয়, জাগার চোখে সত্যি দেখা!
রাজকন্যা চমকে উঠে বলল সে কথা শুনে কাজ নেই, নাগেশ্বরের পুরী, অজগর পাহারা; এক্ষুনি পালাও, নইলে মারা পড়বে!
চার বন্ধুর তবু জেদ, সব কথা না শুনে তারা যাবে না।
কী আর করে, রাজকন্যা দু-চার কথায় সব বুঝিয়ে দিলে। বলতে বলতে গাল বেয়ে একফোঁটা চোখের জল পড়ল।
চার বন্ধু বলে কেঁদো না রাজকন্যা! আমরা তােমায় উদ্ধার করব।
রাজকন্যা দুঃখের হাসি হেসে বললে—আমার উদ্ধার হবেনা।জলের তলায় । আগুন জ্বলবে, সে আগুনে শিলা গলবে, তবে আমার উদ্ধার। সে তাে হওয়ার নয়!
রাজপুত্র খানিকক্ষণ চুপ করে কি ভেবে নিয়ে হেসে বললেন এই কথা! এ আবার শক্ত কী! তােমার উদ্ধার হয়ে গেছে তাহলে।
রাজকন্যা বড় দুঃখেও হেসে ফেললে রাজপুত্রের কথায়। রাজপুত্রের কাণ্ড দেখে আরাে অবাক।
ঘরে ছিল স্ফটিকের পাত্র। রাজপুত্র তাতে জল ভরল। কোটালপুত্রকে বলল, হাতে করে ধরে রাখ। তারপর শুকনাে ঘাস-পাতা কুড়িয়ে আনলে মন্ত্রীপুত্র। সদাগরপুত্র চকমকি ঠুকে স্ফটিক পাত্রের তলায় আগুন জ্বালালে। ঘরে ছিল বাতিদানে মােমের বাতি, রাজপুত্র খুলে নিয়ে সেই আগুনে গলিয়ে ফেলল।
কাণ্ড দেখে রাজকন্যা হেসেই খুন। হাসতে হাসতে রাজকন্যা উঠে বসল। বসে বললেন এতে যদি সাপ কেটে যেত!
কেটে যেতে কি, গেছে তাে!
তাই তাে! অবাক কাণ্ড! রাজকন্যা হাসতে হাসতে যে উঠে বসেছে!
শুধু কি রাজকন্যা? পুরীর লোকজন সবাই উঠে অবাক!
থমথম পুরী আবার গমগম করে উঠল। রাজকন্যা পালঙ্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
হঠাৎ রাজকন্যার মুখের হাসি গেল মিলিয়ে। পুরীর চারিধারে হি হি, ফো-ফোস শব্দ, হাওয়ায় ভেসে আসে হিমেল নিশ্বাস।
নাগরাজ ক্ষেপে আসছে ছুটে, সঙ্গে তার সাঙ্গোপাঙ্গ।
পালাও বন্ধুরা, পালাও! রাজকন্যা চেঁচিয়ে উঠল।
যদি যেতে হয়, তােমায় সঙ্গে না নিয়ে যাব না!
চার বন্ধু রাজকন্যার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। বাইরে ঘােড়া বাঁধা। রাজপুত্র রাজকন্যাকে নিয়ে উঠল নিজের ঘােড়ায়। পিছনে তিন বন্ধু।
ঘােড়া ছুটছে হাওয়ার বেগে। মাঠ-ঘাট, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে চার বন্ধু চলছে রাজকন্যাকে নিয়ে।
কিন্তু কত দূর আর যাবে! নাগরাজের মায়ার তাে শেষ নেই! তার হাত থেকে কি নিস্তার আছে! দেখতে দেখতে তেপান্তরের মাঝে অকুল নদী জেগে উঠল পথ রুখে।
ফেরাও ঘােড়া, ফেরাও ঘোড়া!-ফেরাবে কোথায়? পিছনে নাগরাজের চর অনুচর নাগনাগিনী ছুটে আসছে, সামনে অকূল নদীতে দুরন্ত বান।
কী হবে রাজপুত্র?
চার বন্ধু রাজকন্যাকে নিয়ে ঘােড়া থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে।
ভয় নেই রাজকন্যা, তােমায় আমরা রক্ষা করব।
চার বন্ধু রাজকন্যাকে ঘিরে দাঁড়াল। খাপ থেকে তলোয়ার খুলে মাটিতে গেঁথে রেখে বলল এই রইল তােমার চিরদিনের পাহারা। মন্ত্রিপুত্র, সদাগরপুত্র, কোটালপুত্রও নিজের নিজের তলােয়ার খুলে চারিধারে পুঁতে দিলেন।
নির্ভরে থাক রাজকন্যা, এ তলােয়ারের বেড়া ডিঙ্গোবার সাধ্য কারো নেই!
রাজকন্যা কেঁদে উঠে বললেন কিন্তু তোমাদের কী হবে?
আমাদের? চার বন্ধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলে। মন্ত্রীপুত্র বলল আমি পবন-মন্ত্র জানি, ঝড় হয়ে বইব। কোটালপুত্র বলল আমি মেঘ মন্ত্র জানি, মেঘ হয়ে আকাশ ছেয়ে দেব। সদাগরপুত্র বললেআমি বরুণ-মন্ত্র জানি, বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ব।
আর রাজপুত্র !—
রাজপুত্র বললে আমি বিদ্যুৎ মন্ত্র জানি, বজ্র হয়ে জ্বলে উঠব। শােনো রাজকন্যা, আমাদের একসেঙ্গ দেখা না হলে তুমি মুখ তুলো না।
মিনু প্রায় চুপি-চুপি বললে, তুমিই বুঝি সেই রাজকন্যা ?
হ্যা, আমিই সেই রাজকন্যা ঘুমন্ত পুরীর। নাগেরা আমায় ঘিরে থাকে, তবু সেই তলােয়ারের বেড়া ডিঙোতে পারে না। চার বন্ধু যেদিন একসঙ্গে দেখা দেয়, সেদিন আমি মুখ তুলে চাই, গন্ধে জানাই মনের কথা।
কড়-কড়-কড়ক্কড়! হঠাৎ বাজের শব্দে মিনু চমকে জেগে উঠে বসল বিছানায়। ওমা! কোথায় গেল রাজকুমারী? কেউ যে কোথাও নেই।
কেয়া ফুলের গন্ধে ঘর শুধু আমােদ হয়ে গেছে।