এক কাবুলিওয়ালা বাংলাদেশে নতুন আসিয়াছে। বাজারে যাইয়া দেখে বড় বড় কাঁঠাল বিক্রি হইতেছে। পাকা কাঁঠালের কেমন সুবাস! না জানি খাইতে কত মিষ্টি! তাহার দেশে তো এত বড় ফল পাওয়া যায় না। মাত্র আট আনা দিয়া মস্ত বড় একটা কাঁঠাল সে কিনিয়া ফেলিল। কাঁঠালটি লইয়া সে একবার ঘ্রাণ শুঁকিয়া দেখে, আবার কাঁধে লইয়া দেখে। তারপর খুশিতে নাচিতে নাচিতে কাঁঠালটি বাসায় লইয়া গেল।
আমরা জানি, কাঁঠাল খাইতে হইলে হাতে তেল মাখাইয়া লইতে হয়, ঠোঁটে তেল লাগাইয়া লইতে হয়। তাহা না করিলে কাঁঠালের আঠা হাতে মুখে লাগিয়া যায়। সাবান পানি দিয়া কিছুতেই তোলা যায় না।
কাবুলিওয়ালা নতুন লোক। এসব কিছুই জানে না। সে দুই হাতে কাঁঠালটি ধরিয়া কামড়াইতে লাগিল। কাঁঠালের আঠা তাহার হাতে লাগিল, মুখে লাগিল, দাড়িতে লাগিয়াই দাড়ি জট পাকাইয়া গেল; কিন্তু সেদিকে কে খেয়াল করে! এমন মিষ্টি কাঁঠাল আর এমন তার খোশবু! সে ছোবড়াসমেত সমস্ত কাঁঠালটি খাইয়া ফেলিল। তারপর হাতমুখ ধুইতে যাইয়া বড়ই বিপদে পড়িল। সাবান ঘষিয়া, সোডার পানি গোলাইয়া সে হাত আর দাড়ি যতই পরিষ্কার করিতে যায়, ততই হাতে-মুখে, দাড়িতে কাঁঠালের আঠা আরো চটচট করে।
রাত্রে শুইতে যাইয়া আরো মুশকিল। এপাস হইতে ওপাশ ফিরিতে বিছানা বালিশে দাড়ি আটকাইয়া চটচট করিয়া তাহাতে কিছু দাড়ি ছেঁড়া যায়। দাড়িতে হাত বুলাইতে হাত দাড়ির সঙ্গে আটকাইয়া যায়। তাহাতে কিছু দাড়ি ছেঁড়া যায়! সারারাত সে ঘুমাইতে পারিল না।
পরদিন হাটের বার। এটা ওটা কিনিতে সে হাটে গিয়াছে। তরকারির দোকানে তরকারি দর করিতে, ঝিঙা-পটল দাড়ির সঙ্গে আটকাইয়া আসে, মাছের দোকানে মাছ তার দাড়িতে আটকাইয়া আসে। দোকানিরা দাড়ি হইতে সেগুলি ছাড়াইয়া লইতে দাড়ি চটচট করিয়া ছেঁড়ে। বেচারি কি আর করে! মনের দুঃখে কিছু না কিনিয়াই বাসায় ফিরিয়া আসিতে চায়।
তাও কি ফিরিয়া আসিতে পারে? দাড়ির সঙ্গে ওর ছাতা আটকাইয়া যায়— তার গামছা আটকাইয়া যায়। সকলে তাহাকে ধরিয়া মারিতে আসে।
মনের দুঃখে বেচারা এক যুবকের কাছে যাইয়া জিজ্ঞাসা করে, “হাঁ বাবুজি! হামি তো কাঁঠাল খাইছে। কাঁঠালের আঠা হামার দাড়িতে আর গোঁফমে লাগ গিয়া। কিছিছে ছেড়তা নেহি। আব ক্যা করেংগা সাব?”
যুবকটি দেখিল বেশ মজা হইয়াছে! সে আরও মজা দেখিবার জন্য বলিল, “আপনি দাড়িতে কিছু ছাই লইয়া মাখান, আঠা ছাড়িয়া যাইবে।”
কাবুলিওয়ালা বাসায় যাইয়া তাহাই করিল। ছাই মাখানোর ফলে তাহার দাড়িতে কাঁঠালের আঠা আরও জট পাকাইয়া গেল।
মুখের চেহারা বদ হইয়া পড়িল। কাবুলিওয়ালা কি আর করে—খাইতে গেলে হাত দাড়িতে লাগিয়া আটকাইয়া যায়, শুইতে গেলে বিছানা-বালিশের সঙ্গে দাড়ি জড়াইয়া যায়। এপাশ ওপাশ হইতে দাড়ি চটচট করিয়া ছেঁড়ে। অবশেষে সে একজন বৃদ্ধ লোকের কাছে যাইয়া সকল কথা খুলিয়া বলিল।
“য়্যা বাবুজি। হামি তো কাঁঠাল খাইছে। আওর কাঁঠাল কা আঠা হামার দাড়িমে গোঁফমে লাগ গিয়া! এক যোয়ান কা পরামর্শমে উছকা পর হাম ছাই লাগায়ে দিয়া। এসিসে এ দাড়িমে জট পাকায়া, আভি হাম ক্যা করেংগা?”
সমস্ত শুনিয়া বৃদ্ধ লোকটি বলিলেন, ‘সাহেব! একে তো কাঁঠালের আঠা তোমার দাড়িতে লাগিয়াছে, তার ওপরে মাখাইয়াছ ঘুঁটের ছাই। এর ওপরে আর কোনো মেরামতিই খাটিবে না। তুমি এক কাজ কর, নাপিতের কাছে যাইয়া গোঁফদাড়ি কামাইয়া ফেল।’
কতকাল ধরিয়া কাবুলিওয়ালা তাহার মুখের এই দাড়ি জন্মাইয়াছে। গাড়িতে ইষ্টিমারে এই দাড়ি দেখিয়া লোকে তাহাকে কত খাতির করে। নিমন্ত্রণ বাড়িতে এই দাড়ি দেখিয়া লোকে তাহার পাতে আরও দুইটা বেশি করিয়া রসগোল্লা-সন্দেশ আনিয়া দেয়। আজ সেই দাড়ি কাটিয়া ফেলিতে হইবে। মনের দুঃখে কাবুলিওয়ালা অনেকক্ষণ কাঁদিল। কিন্তু কাঁদিয়া কি হইবে? নিরুপায় হইয়া সে এক নাপিতের কাছে যাইয়া দাড়ি-গোঁফ কামাইয়া ফেলিল।
তার দুঃখের ভাগী আর কে হইবে। হাটে-পথে, মাঠে-ঘাটে সে যখন যাহাকে দাড়ি কামানো দেখে, তারই গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলে, ‘ভায়া হে! তুমভি কাঁঠাল খায়া?’
সে মনে করে, যাহাদের দাড়ি নাই, তাহারও বুঝি কাঁঠাল খাইতে কাঁঠালের আঠা দাড়িতে লাগাইয়া তাহারই মতো দাড়ি কামাইয়া ফেলিয়াছে।