ঋজুদার সঙ্গে স্যেশেলসে – বুদ্ধদেব গুহ
স্কুল থেকে ফিরতেই মা বললেন, ঋজু ফোন করেছিল। তোদের সকলকে যেতে বলেছে আগামীকাল সন্ধেবেলা। রাতে ওখানেই খেয়ে আসতে বলেছে।
সন্ধেবেলা?
হ্যাঁ। সিক্স-ও-ক্লক শার্প।
সেটা না বললেও হত।
মনে মনে বললাম।
ঋজুদার সঙ্গে এতদিন ঘুরছি আর সময়জ্ঞান হয়নি কি আর! পারলে, পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছব। পরে যাইনি কখনই। কিন্তু সকলকে মানে?
জিজ্ঞেস করলাম মা-কে। জুতো খুলতে খুলতেই জিজ্ঞেস করলাম।
তার মানে আমি কী করে জানব? তোদের পুরো দলই হবে।
মানে, তিতির কি ফিরেছে নাকি?
আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
আশ্চর্য তো! তা আমি কী করে জানব? সে গেছে কোথায়?
মা বিরক্তির গলাতে বললেন।
বাঃ, সে তো কবেই দিল্লি চলে গেছে। জে এন ইউ-তে পড়ে তো এখন।
তা কেন পড়বে না? পড়াশুনোতে তো সে তোমাদের মতো নয়। ভাল মেয়ে, ভাল করছে। আর তোমরা তো বনে-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরেই দিন কাটাচ্ছ। তোমাদের ঋজুদাই তো তোমাদের তার সব সম্পত্তি দিয়ে যাবে। তাই ভাঙিয়েই চলবে। আর চিন্তা কী? ভাবছ তাই।
আমি বললাম। হাঃ! ঋজুদা বলে, লেখাপড়া করে যে, গাড়ি চাপা পড়ে সে। তা ছাড়া, জীবনে স্কোয়ার হতে হয়। শুধু বুক-ওয়ার্ম হলেই হয় না। তুমিই না বলো যে, আমাকে পূর্ণ মানুষ হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যেমন মানুষ হওয়ার কথা বলতেন।
হ্যাঁ। তা তো বলিই। কিন্তু এমন করে ঋজুর সঙ্গে বনে বনে ঘুরে বেড়ালে আর পূর্ণ মানুষ হতে হবে না। বনমানুষ হবে। পূর্ণ বনমানুষ!
মা বললেন।
তারপরই বললেন, এবারে দয়া করে খেয়ে নিয়ে আমাকে ধন্য করো। বড়মামা দুপুরে আম পাঠিয়েছেন নবীনকে দিয়ে, বহরমপুর থেকে। আর মাখনদি পাটিসাপটাও দিয়ে গেছেন।
আমি বললাম, বাঃ। ফারস্ট ক্লাস। কিন্তু নোনতা কিছুই নেই?
সত্যি! ঋজু বোসের যোগ্য চেলা হয়েছিস বটে। খাদ্যরসিক!
তারপরেই বললেন, আছে। ডালপুরি।
ডালপুরি খাব কী দিয়ে? আলুরদম?
তারপর স্বগতোক্তি করলাম, আমার একটাই চিন্তা। ঋজুদা আবার না ভটকাইকে সঙ্গে নেয় এবারেও। নিনিকুমারীর বাঘ মারতে গিয়ে কী কেলোটাই না করেছিল! ঋজুদার লাই পেয়ে পেয়ে ও দিনে দিনে একেবারে আনম্যানেজেবল হয়ে উঠছে। নাগাল্যান্ডের কাঙ্গপোকপি’-তে গিয়েও কি কম ঝামেলা করেছিল?
সে সব তুমি আর তোমার ঋজুদাই বুঝে। এখন মুখ হাত পা ধুয়ে দয়া করে খেয়ে নাও। আলুরদমটা মাখোমাখোই করেছি, তুই যেমন ভালবাসিস।
আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, এই নইলে আমার মা। ইউ আর গ্রেট। মা-আ-আ।
.
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। বিশপ লেফ্রয় রোডে পৌঁছে দেখি, তিনি আমার আগেই গিয়ে পৌঁছে গেছেন। আর ঋজুদা, যথারীতি বাড়ি নেই। তবে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম দশ মিনিট দেরি আছে। আর ঋজুদা ঠিক সময়েই এসে যাবে। কারণ, ঋজু বোস কথা দিলে বা সময় দিলে, তার ‘ডেড বডিও কথা এবং সময় রাখবে।
গদাধরদা বলল, তিনি এই এইলেন বইলে। তোমরা কী খাবেন তাই বল। এটু লেমন স্কোয়াশ কইরে দেব কি? আর চারটে কইরে কে. সি. দাসের রসগোল্লা?
সে প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বললাম, রাতে কি না-খাওয়াবার মতলব করেছ। নাকি? তোমার বাবু কি এতই গরিব হয়ে গেলেন?
আরে না না। সে কী কতা গো! আমার বাবু কোন শত্তুরের অভিশাপে গরিব হবেন! তুমি নোক মোটেই ভাল লয় গো রোদদুর দাদা। আজ অবধি একদিনও কি এমন হইয়েচে যে ঋজু বোসের বাড়ি এইয়ে পেটপুরে না খেইয়ে গেছ তোমরা কেউ?
আমি রোদদুর বাবু নই। আমার নাম রুদ্র। তোমার কি ভীমরতি ধরেছে?
ওই হল। আমি তোমাকে আজ থেকে রোদদুর বলেই ডাকব।
সে আবার কী কথা?
হ্যাঁ। আমার ওই নামটাই একনে পছন্দ।
ভটকাই বলল, রোদদুর না বলে ওকে বরং অন্ধকার বলো।
তারপরই বলল, তোমার বয়স ক’কুড়ি হল গো গদাধর দাদা?
তা তিন-চার কুড়ি হবে বইকী!
তবু বুদ্ধি পাকল না? তোমার রোদদুরবাবু যে লোক খারাপ তা বুঝতে তোমার এত বছর লাগল?
এমন সময়ে ডোর-বেলটা বাজল।
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে ভটকাই মালিককে তেল-মারা ডোবারম্যান কুকুরের মতো লেজ নাড়াতে-নাড়াতে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। খুলেই, সঙ্গে সঙ্গে অ্যাবাউটটার্ন করেই ঘরের ভেতরে সেঁধিয়ে গিয়ে আমার দিকে ফিরে প্রায়। কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, এক সায়েব এয়েচে।
সাহেব দেখলেই ভটকাইয়ের অবস্থা মুখে নুন-পড়া জোঁকের মতো হয়ে যায়।
বাইরে না দেখালেও, মনে মনে খুবই খুশি হলাম আমি।
এগিয়ে গিয়ে দেখি, এক সাহেব দরজায় দাঁড়িয়ে। চেহারা দেখে মনে হল না ইংরেজ বলে। তবে কোথাকার মানুষ আমি ঠিক বুঝলামও না। আমি অবশ্য কতটুকুই বা বুঝি।
সাহেব তাঁর হাতের পাতেক ফিলিপ’ ঘড়িটার দিকে এক ঝলক চেয়ে বললেন, অ্যাম আই আর্লি? ইজ নট মিস্টার বোস ইন?
বললাম, প্লিজ কাম অন ইন। হি উইল বি হিয়ার এনি মোমেন্ট। প্লিজ বি সিটেড।
তারপরে সাহেবকে আমার আর ভটকাইয়ের পরিচয় দিয়ে, আমরাও বসলাম। সাহেব কিন্তু নিজের পরিচয় দিলেন না আমাদের।
আগন্তুক সাহেব মাঝবয়সী, ছিপছিপে। পরনে একটি নীল জিনসের ট্রাউজার, এবং ওপরে লালরঙা গেঞ্জি। ব্যাঙ্গলনের। চোখে রিমলেস চশমা। প্লাস্টিক লেন্সের। তার রং, হালকা হলুদ। পায়ে নীল মোজা এবং হালকা খয়েরি-রঙা মোকাসিন। চেহারাটা ধূর্ত-ধূর্ত। সাহেব তিনি বিলক্ষণ। কিন্তু ইংরেজ নন। কোন দেশি তা বুঝলাম না। তবু বুঝলাম যে, আমাদের চেহারা-ছবি সাহেবের বিশেষ পছন্দ হল না। আমাদের দুজনের দিকেই সন্দিগ্ধ চোখে তাকাতে লাগলেন উনি বারবার।
ভাবলাম, বয়েই গেল! আমরা ওর জামাই থোড়াই হতে যাচ্ছি।
ভটকাই আবার আজকে ডান পায়ে লাল আর বাঁ পায়ে নীল মোজা পরে। এসেছিল ভুল করেই। সম্ভবত আমার চেয়ে আগে ঋজুদার বাড়িতে পৌঁছনোর তাগিদেই এমন ভুলটা করেছিল। আমার অ্যাডিডাসের হলুদ গেঞ্জির ডান কাঁধের কাছে ঘেঁড়া ছিল কিছুটা। সাহেব সবই লক্ষ করলেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। সাহেব মাঝে মাঝেই বুনো শুয়োরের মতো একটা ঘোঁৎ-ঘোঁৎ আওয়াজ করছিলেন নাক দিয়ে। তবে খুবই আস্তে। আর তারই সঙ্গে নিকার-বোকারের লাল-রঙা ইলাস্টিকটাকে টেনে টেনে বারবার ওপরে তুলছিলেন।
আমি ভাবলাম, সাহেব বাতিকগ্রস্ত। ভটকাইয়ের দিকে তাকালাম। ভটকাই তার বেগুনচেরা চোখের নীরব দৃষ্টি দিয়ে আমার ভাবনাকে সমর্থন করল।
এমন সময়ে ডোর-বেলটা আবারও বাজল। ভটকাই-ই গিয়ে খুলল আবার।
ঋজুদা ঘরে ঢুকেই বলল, হাই! মঁসিয়ে পঁপাদু। আই অ্যাম অ-ফুলি সরি।
তারপরেই বলল, হাউ লং?
ওনলি আ কাপল অফ মিনিটস।
মঁসিয়ে পঁপাদু বললেন। ঋজুদা মঁসিয়ে পঁপাদুর চোখমুখ দেখেই বুঝেছিল যে, আমাদের তাঁর বিশেষ পছন্দ হয়নি। তাই হুড়হুড়িয়ে আমাদের গুণপনার কথা সবিস্তারে বলতে লাগল মঁসিয়ে পঁপাদুকে।
লজ্জাই করতে লাগল আমার। এমনকী নির্লজ্জ ভটকাইয়ের মুখ দেখে মনে হল, তারও লজ্জা করছে। ঋজুদাই যেন আমাদের ভিজিটিং কার্ড। এমন সব ভাল ভাল কথা বলছে আমাদের সম্বন্ধে ওই বুনো শুয়োর-মার্কা পাদুকে যে, কাছাকাছি কোনও মেয়ের বাবা থাকলে আমাদের দুজনের একজনকে জামাই না করেই ছাড়তেন না।
পঁপাদু সাহেব বড় ঘন ঘন ঘড়ি দেখেন। এও যেন নাক ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করারই মতন আরেক বাতিক।
এবারে মঁসিয়ে পঁপাদু তাঁর হাতের ব্রিফকেসটি খুলে একগোছা প্লেনের টিকিট বের করলেন। তারপর একটি প্লাস্টিকের ফোল্ডার। বললেন, এতে পাঁচ হাজার ডলার আছে। আমার সঙ্গে আপনার সেখানে দেখা না হওয়াই ভাল। আমি সেখানে থাকবও না। থাকব মরিশাসে। হয়তো। অথবা পারিতেই। ফোনেই যোগাযোগ রাখব। আমার মোবাইল ফোনের নাম্বারটা রেখেছেন তো ঠিক করে? সেখানে পৌঁছানোমাত্র ওখানের কনটাক্টের নাম ঠিকানা, ফোন নাম্বার সব দিয়ে দেবে যে আপনাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করবে। আমারই লোক। সে কিন্তু নিয়ে যাবে না আপনাকে সঙ্গে করে। একটা ক্যাব নিয়ে নেবেন। গতবার আপনি যে বাড়িতে উঠেছিলেন মাহে এয়ারপোর্টের একেবারে গায়েই, সেই বাড়িতে নেমে ক্যাব ছেড়ে দেবেন। ক্যাব চলে গেলেই একটি কালো টয়োটা গাড়ি এসে আপনাদের তুলে নেবে। এয়ারপোর্টের দিক থেকেই আসবে। আপনারা ওখানে পৌঁছালে আপনাদের যা কিছুর দরকার, আর্মস-অ্যামুনিশানসুন্ধু, আমার কনটাক্টই জুগিয়ে যাবে। মানে, যদি দরকার হয়। আর ডলারের দরকার হলে তাও সে দেবে।
মঁসিয়ে পঁপাদু হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এবার আমি উঠব। একজনের সঙ্গে দেখা করার আছে। তারপর বললেন, কতদিনের মধ্যে কাজটা শেষ করতে পারবেন বলে মনে হয়?
ঋজুদা বলল, ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, নো আইডিয়া। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করে ফিরে আসার চেষ্টাই করব।
মঁসিয়ে পঁপাদু বললেন, আমার কাজটা কিন্তু হওয়া চাই মিস্টার বোস।
ঋজুদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হবে।
তারপর বলল, কাল যাওয়ার আগে একটা ফোন করলে আপনার কনটাক্ট সম্বন্ধে আর একটু বিস্তারিত কথা বলে নেব।
ঠিক আছে।
আমি একটু অবাকই হলাম। কোথায় যাবে, কোন বিদেশে তাও অজানা, কী কাজ তাও জানা নেই, আর্মস-অ্যামুনিশানের প্রশ্ন যখন উঠছে, তখন কাজটা যে। বিপজ্জনক তাতেও সন্দেহ নেই, কিন্তু কাজটা যে হবেই এমন গ্যারান্টি ঋজুদা যে কলকাতার বিশপ লেফ্রয় রোডে বসেই দেয় কী করে তা একটুও বুঝলাম না। তা ছাড়া, ঋজুদা ভদ্রলোককে আর একটু বসতে বলল না, চা-কফি কিছু খেতেও বলল না। অবাক হওয়ারই কথা।
ভটকাই আমার চেয়ে বেশি অবাক হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল ঋজুদার মুখে।
ঋজুদা মঁসিয়ে পঁপাদুকে ল্যান্ডিং অবধি এগিয়ে দিল। সঙ্গে চামচে ভটকাইও গেল। ফিরে এসে ড্রইংরুমে ঢুকেই বলল, গদাধরদা, এই সৈন্যদের কিছু খাইয়েছ।
এই ভাবতে চিনু কী খাওয়াই।
সে কী! তোমার ভাবনা শেষ হতে হতে ওরা যে আমার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। তুমি কি চেনে না ওদের?
রাতের জন্যে কী রান্না হচ্ছে এখনও তো বললে না গদাধরদা।
ভটকাই বলল, মাঝে পড়ে।
সেই কথাই তো শুরু করেছিলাম কিন্তু শেষ করার সুযোগ আর পেলাম কোতা? কে একটা হলুদ ব্যাঙের মতো দেখতে উটকো লোক এইসে হাজির হল যে। তা আজ রাতে রাঁধতিচি হলুদ পোলাউ…
মিষ্টি তো?
আমি বললাম।
হ্যাঁ গো হ্যাঁ, মিষ্টিই। আমি কি এই পরথম হলুদ…
আর কী? ভটকাই ইন্টারাপ্ট করল।
আর ভাপা-ইলিশ, চিংড়ি মাছের কাটলেট, দই-রুই, রুই মাছের মাথা-দেওয়া মুগের ডাল, আর আর মুড়িঘণ্ট।
ভটকাই বলল, তুমি কি গো গদাধরদা। বলছ যে চার কুড়ি বয়স হল আর এটাও জানো না যে, পোলাউ দিয়ে মুড়িঘণ্ট খাওয়া যায় না?
আঃ। তাও কি জানিনি নাকি। ভাতও করতেছি, গোবিন্দভোগ চালের। জুইফুলের মতন, মুড়িঘণ্ট আর ডাল দিয়ে খাবে বলে।
আর টক? ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে টক করবে না?
করব তালে।
গুড। আর কী? মধুরেণ সমাপয়েৎ নেই? ভটকাই আবার বলল।
সেটা আবার কী মিষ্টি? কখনও তো নামও শুনিনি বাপের জন্মে।
গদাধরদা বলল।
তারপর বলল, না মধুরেণ-টেন নেই। তবে আচে কে সি দাসের রসগোল্লা। রবিদাদা নিজে পাইট্যে দেচেন।
রবিদাদাটা আবার কে?
ঋজুদা বলল, আরে কে সি দাসের রবি দাস। আমাদের নরেনের দাদা রে। আমাদের সকলেরই রবিদাদা।
ও বুঝেছি।
আর নেপালচন্দ্রের রাবড়িও। শর্মার রাবড়িতে তো আবার তোমার পোড়া পোড়া গন্দ লাগে।
গদাধরদা বলল।
এবারে আমার জন্যে এক কাপ লেবু-দেওয়া চায়ের লিকার দাও আর এরা কী খাবে তা জিজ্ঞেস করে নাও তো গদাধরদা। তারপর নিজের কাজ করো গিয়ে। আমাদেরও কাজ আছে। ততক্ষণে আমরা তা সেরে ফেলি।
ঠিক আ।
গদাধরদা আমাদেরও পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মতো শেষ অক্ষর ফেলে দিয়ে শব্দ উচ্চারণ করে।
গদাধরা দিনকে দিন মড, মডার, মডেস্ট হচ্ছে।
ভটকাই বলল।
আমি আর ঋজুদা হেসে উঠলাম ভটাকাইয়ের কথাতে।
আমি বললাম, ইংরিজিটা একটু কম বল ভটকাই, নইলে অন্যে ভাবতে পারে খাদ্য হচ্ছে Fodder।
ভটকাই চুপ করে গেল।
.
গদাধরা চলে গেলে ঋজুদা ভটকাইকে বলল, গ্লোবটা বের কর তো কাঁচের আলমারি থেকে।
ভটকাই ল্যাজারাস কোম্পানির কারুকার্য করা কাঁচের আলমারি থেকে মস্তবড় গ্লোবটা বের করে এনে সেন্টার-টেবলের ওপরে রাখল।
ঋজুদা তখন আমাদের দুজনেরই দিকে তাকিয়ে থাকল এক মুহূর্ত। তারপর বলল, আমি চাটা খেয়ে একটু পাইপ খাই, তোরা এই গ্লোবের মধ্যে একটা দেশ খুঁজে বের কর তো দেখি। দেশটা ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপপুঞ্জ। নাম…
বলেই, কী ভেবে বুক পকেট থেকে ম ব্লা কলমটি তুলে নিয়ে স্লিপ প্যাডে ক্যাপিটাল লেটারে লিখল SEYCHELLES. তারপর বলল, একজন পর্তুগিজ ভদ্রলোব এই দেশটার কথা অস্পষ্ট উল্লেখ করেন তাঁর Plainsphere-এ। ভদ্রলোকের নাম ছিল অ্যালবার্টো ক্যানটিনেনা।
Plainsphere মানে কী?
প্লেইনস্ফিয়ার হচ্ছে এই যে গ্লোব দেখছিস, তারই পূর্বসূরি। প্লেইন কাগজের ওপরে বিভিন্ন, Sphere, বৃত্ত এঁকে বোঝানো হতনৰ্থ পোল, সাউ পোল, তারাদের অবস্থান। সেই বৃত্তগুলোকে ওপরে নীচে করে আবার অ্যাডজাস্ট করা যেত। এই Plainsphere সামনে ফেলেই পালতোলা জাহাজের নাবিকেরা সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরত তখন।
ভটকাই বানান করে বলল, SEYCHELLES. এ আবার কী দেশ রে বাবা। দেশের নাম সাইকেল?
সাইকেল হয় নাকি অক্ষরগুলো জুড়লে?
ঋজুদা একটু বিরক্তির গলাতে বলল।
খুব খুশি হলাম ভটকাইয়ের কিঞ্চিৎ হেনস্থা দেখে।
রুদ্র?
বললাম, সিকেলেস।
তাও নয়।
নয়? কেন?
নয়, কারণ, শব্দটা ফরাসি। উচ্চারণ স্যেশেলস।
আমরা বোকা বনে গেলাম।
এবারে খুঁজে বের কর দেশটাকে। গ্লোব-এ ভারত মহাসাগরে। ভারত উপমহাদেশ আর আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে।
তারপর ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসে, পাইপটা ভরে নিয়ে ধরাল। গোল্ড-ব্লক পাইপ টোব্যাকোর মিষ্টি গন্ধে ঘর ভরে গেল। এদিকে গোলাকৃতি গ্লোবটাকে চাঁটি মেরে মেরে ভটকাই প্রায় ফ্ল্যাট করে আনল। কিন্তু ভটকাইয়ের সাইকেল বা আমার সিকেলেস এবং ঋজুদার স্যেশেলসকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না।
ঋজুদা কী যেন ভাবছিল, বুদ্ধির গোড়াতে পাইপের ধোঁয়া দিতে দিতে, অন্যমনস্ক হয়ে। হঠাৎই যেন মনে পড়ে যাওয়াতে বলল, কী হল রে? পেলি?
কী আবার হবে? পবননন্দন হনুমানকে বললেও খুঁজে পেতেন না। আমরা তো কোন ছার।
ভটকাই বলল।
মানে?
ঋজুদা অবাক হয়ে বলল।
মানে, গন্ধমাদন পর্বতের মধ্যে যদি বা বিশল্যকরণী খুঁজে পাওয়া যায়, ভারত মহাসাগরে তোমার স্যেশেলস খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
আমি বললাম।
ইমপসিবল।
ভটকাই জোর দিয়ে বলল।
ইমপসিবল ইজ আ ওয়ার্ড ফাউন্ড ইন দ্যা ডিকশনারি অফ ফুলস।
ঋজুদা বলল।
তারপর ঋজুদা তার ইজিচেয়ারের ওপরে সোজা হয়ে বসে বলল, আন দেখি এদিকে।
গ্লোব নিয়ে আমরা দুজনেই ঋজুদার কাছে গেলাম। যেতেই, ঋজুদা দেখিয়ে দিল আমাদের। তবে চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে দেখা আদৌ যেত না হয়তো। সরষে দানার চেয়েও ছোট ছোট প্রায় অদৃশ্য কতগুলি দ্বীপ, দারুচিনি, লবঙ্গ এবং আরও নানা মশলার দেশ জাঞ্জিবার আর মরিশাসের কাছাকাছি।
আমরা লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করলাম।
ঋজুদা বলল, তোরা কি ভাবিস দেশ মানেই হাজার হাজার মাইল লম্বা-চওড়া হতে হবে? ইয়ারোপে গেলে দেখবি একদিনে গাড়ি করে চারটি দেশ পেরিয়ে গেলি। দেশ তো বড় শুধুমাত্র আয়তন দিয়েই হয় না রে, দেশ বড় হয় সেই দেশের মানুষের চরিত্র দিয়ে, জাত্যাভিমান দিয়ে, দেশপ্রেম দিয়ে।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, এই স্যেশেলসের রাজধানী যে দ্বীপটিতে, তার নাম মাহে। রাজধানীর নাম অবশ্য ভিক্টোরিয়া। সে দ্বীপ সতেরো মাইল লম্বা আর তিন মাইল চওড়া। অর্থাৎ একান্ন বর্গমাইল। বোঝ তা হলে।
তা এই পুঁচকে দেশ নিয়ে আমরা কী করব? দেশ-দেশ পুতুল খেলব?
হেসে ফেলল ঋজুদা, ভটকাইয়ের ফাজলামিতে।
ওই মঁসিয়ে পঁপাদু মানুষটি কে?
ভটকাই বলল।
ছটফট করছিল ও জানবার জন্যে।
সময়ে সবই জানতে পারবি, মানে, তুই যখন আমাকে আর রুদ্রকে দমদমের এয়ারপোর্টে ছাড়তে যাবি।
ঋজুদা বলল।
ভটকাইয়ের মুখটা একেবারে কালো হয়ে গেল। তুতুলে বলল, তা-তা হলে আ-আ-আ-মি কি যাব না?
না। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হয় তা কি জানো না? এবারের ব্যাপারটা খুবই ডেঞ্জারাস। তোমাকে এবারে হয়তো নেওয়া সম্ভব হবে না ভটকাই। সরি!
ভটকাই, গরম দুধে-ফেলা মুড়িরই মতন চুপসে গেল। পরক্ষণেই তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘নিনিকুমারীর বাঘ’ মারতে যাওয়া বা ‘কাঙ্গপোকপি’-তে চুরি-যাওয়া হিরে উদ্ধার করতে যাওয়া কি কিছু কম বিপজ্জনক ছিল?
গদাধরদা হাতের ট্রে-তে করে ঋজুদার জন্য এক কাপ চায়ের পাতলা লিকার নিয়ে এসে ঋজুদাকে দিয়ে, আমাদের বলল, দাদাবাবুরা, তোমরা এসো দিকিনি এবার খাবারঘরে। খাবার নাইগ্যে দিচি।
এখানে কী দোষ করল?
মনমরা ভটকাই বলল।
নতুন কার্পেট এইয়েচে দিকতিচো না। রসগোল্লার রস-টস ফেইল্যে তাকে তো দেবে একিরি চিক্কিরি চইটকে। তোমায় নিয়েই তো ভয়টা বেশি আমার। বড় ট্যালা তুমি!
অগত্যা ভটকাই এল আমার পেছন পেছন। আসার আগে আমার সঙ্গে ঋজুদার একটি চকিত দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল। ভটকাইটা আজকাল এমনই চালু হয়েছে যে সেটুকুও তার দৃষ্টি এড়াল না।
বিড়বিড় করে খাওয়ার ঘরে যেতে যেতে বলল, সে সব দিন চলে গেছে। ভটকাইকে এখন আর তোমাদের লায়াবিলিটি বলে ভেব না। এখন আমি তোমাদের অ্যাসেট। আমাকে না নিয়ে উপায় আছে তোমাদের কোনও?
.
কলকাতা থেকে বম্বের সান্টাক্রুজ এয়ারপোর্টে আসতে আসতে ঋজুদা আমাকে আর ভটকাইকে একটু ব্রিফ করল। সান্টাক্রুজে পৌঁছে আমরা শাটল বাস ধরে সাহার-এর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যাব। তারপর এয়ার-ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরে যাব স্যেশেলসের ‘মাহে’-তে।
ঋজুদা বলছিল উনিশশো ঊনআশিতে যখন প্রথমবার স্যেশেলসে আসে, তখন তানজানিয়ার দার-এস-সালাম যাওয়ার পথে নেমেছিল কয়েক ঘণ্টার জন্যে মাত্র। তখন এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানের স্যেশেলস হয়ে দার-এস-সালামে যাওয়ার বাধা ছিল। কেনিয়ার নাইরোবি যেতে পারত অবশ্য।
পরে আরেকবার স্যেশেলশে এসেছিল ঋজুদা, ছুটি কাটাতে। পনেরো দিন ছিল। আফ্রিকা ফেরত।
ঋজুদা আমাদের যা বলল, তার সারাংশ এরকম।
স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের ভৌগোলিক অবস্থান ম্যাডাগাসকারের উত্তরে বিষুবরেখার চার ডিগ্রি দক্ষিণে। পুরনো দিনে যে সব চালু জলপথ ছিল, সে পথে যেতে-আসতে ওই সর্ষেদানার মতন দ্বীপপুঞ্জ কোনও নাবিকেরই চোখে পড়ত না। পশ্চিমের আরব দেশ, পূর্বের ইন্দোনেশিয়া (আগের সুমাত্রা ও জাভা) থেকে আসা জাহাজের কিছু কিছু নাবিক মিষ্টি জল ও খাবারের খোঁজে ওই দ্বীপপুঞ্জের দু-একটি ছোট দ্বীপে নেমেছিল। তারা যে আদৌ নেমেছিল, তা অনুমান করেন ভৌগোলিকেরা অনেকদিন পরে সেখানে কিছু কবরের খোঁজ পেয়ে। তারপরে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দের গোড়াতে ভাসকো-দা-গামা তাঁর ভারতযাত্রার পথে এই দ্বীপপুঞ্জের মধ্যের একটি দ্বীপ, যার নাম ‘আমিরান্টেস’, দেখতে পান। সেই কারণে, সেই দ্বীপের আদি নাম বদলে রাখা হয় অ্যাডমিরাল দ্বীপ। কোনও কোনও দ্বীপ পর্তুগিজ নাবিকদেরও চোখে পড়ে। তারা এই দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ করে ASSETE IRAMS (সাত বোন) এবং OSIR MAUS (সাত ভায়ারা)।
নানা দেশের জলদস্যুরাই এই নির্জন দ্বীপপুঞ্জে তাদের গোপন আস্তানা গড়ে তোলে। এই দ্বীপপুঞ্জ চালু জলপথের ওপরে নয় বলেই তাদের সুবিধেও হত নানারকম। বহু জলদস্যুর গুপ্তধন এখনও পোঁতা আছে এই স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের নানা দ্বীপে। এমনই শুনতে পাওয়া যায়।
পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অ্যালবার্ট ক্যানটিনো নামের এক মানচিত্রী, যিনি, PLAINSPHERE এর প্রবর্তক, তাঁর আঁকা মানচিত্রে প্রথম স্যেশেলসকে আঁকেন। তার অনেকই পরে, ষোড়শ শতাব্দীর গোড়াতে, ইংরেজ বণিকদের একটি দল যখন ভারতের পশ্চিম উপকূলের সুরাটের দিকে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে আসছিলেন, তখন তাঁদের চোখে পড়ে যায় এই স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জ। এক ইংরেজ সাহেব, জন জরডেইনের লেখা, স্যেশেলস সম্বন্ধে বিবরণ প্রথম প্রকাশিত হয় উনিশশো পাঁচ সালে। তারপর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সোড়শ নয় খ্রিস্টাব্দে ‘Ascension’ এবং ‘Good Hope’ জাহাজে করে কিছু ইংরেজ ব্যবসায়ী স্যেশেলসের মাহে এবং অন্য একটি দ্বীপে নেমেছিলেন। তারও পর, সতেরশো শতাব্দীর মাঝামাঝি ফরাসিরা এসে, বলতে গেলে, স্যেশেলসে রীতিমতো একাধিপত্য জারি করে। জাঞ্জিবার থেকে তারা বারবার আক্রমণ করে পুরো দ্বীপপুঞ্জের মালিক বনে যায়। সবচেয়ে আগে যে দ্বীপটি তারা দখল করে, তার নাম ST. ANNE ISLAND.
এখনও দ্বীপটি ওই নামেই পরিচিত।
তখন ফরাসি রাজত্বের প্রথম ভাগ। ফরাসি দেশের কন্ট্রোলার-জেনারেল যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল ভাইকাউন্ট মোরে দ্য স্যেশেলস। ওঁরই নামানুকরণে জয় করা নতুন দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখেন ফরাসিরা ‘স্যেশেলস’। কিন্তু তখন ওই দ্বীপপুঞ্জে কোনও জনবসতি ছিল না। আদিবাসী বলতেও কেউই ছিল না। ফরাসিরা তাই মধ্য ও পূর্ব আফ্রিকা, মরিশাস এবং ফরাসি দেশ থেকেও অনেক পরিবারকে এনে ওখানে বসতি করিয়ে দারুচিনি, নারকেল, তামাক, তুলো ইত্যাদি চাষ শুরু করল। কিন্তু হলে কী হয়, তার বছর-পঞ্চাশের মধ্যেই ইংরেজরা এসে ওই দ্বীপপুঞ্জ ফরাসিদের কাছ থেকে কবজা করে নিল। তারও কিছু পরে, কিছু ভারতীয় এবং অবাক কাণ্ড, চীনারাও এসে হাজির হল। তার ফলে কালো, সাদা এবং বাদামি নানা ধরনের মানুষের বাসভুমি হয়ে উঠল স্যেশেলস। তবে যেহেতু আফ্রিকানরাই শ্রমিক হিসেবে বেশি সংখ্যাতে এসেছিল, তাদের প্রভাবই এখনও তাই বেশিই আছে।
কোন ভাষাতে কথা বলে স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের মানুষেরা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ভাষা চলে স্যেশেলসে তিনটি। ফরাসি, ইংরেজি এবং…
এবং সোয়াহিলি?
বাহাদুরি করে বললাম আমি।
ঋজুদা আমার বাহাদুরির মাথাতে জল ঢেলে দিয়ে বলল, না রে! এখানের সেই মিশ্র ভাষার নাম ক্রেওল। তাতে সোয়াহিলির প্রভাব আছে কি না জানি না, কিন্তু ফরাসি ভাষার প্রভাব বেশ আছে। তবে, ইংরেজির প্রভাবও কিছু আছে। ভাষাতত্ত্ববিদেরা সঠিক বলতে পারবেন। ক্রেওল এক খিচুড়ি ভাষা। তবে ওই তিন ভাষাই সরকারিভাবে স্বীকৃত।
বম্বেতে সান্টাক্রুজ এয়ারপোর্টে নেমে, শাটল বাসে উঠে সাহার এয়ারপোর্টের দিকে যখন আমরা যাচ্ছি, তখন ভটকাই প্রায় চিৎকার করে উঠল। অ্যাই রে। ঋজুদা। কেলো হয়েছে। আমাদের স্যুটকেসগুলোই নেওয়া হল না!
আমি বললাম, ওগুলো চলে যাবে আমাদের নতুন প্লেনে। তোর মাথাব্যথা নেই। তোর হ্যান্ডব্যাগটা নিয়েছিস তো?
হ্যাঁ। এই তো।
তা হলেই হবে।
ভটকাই বলল, আচ্ছা ঋজুদা, স্যেশেলসে যাওয়ার কারণটা কী তার আভাস তো কিছু দেবে? তোমার মিস্টার পাদু কি ভূগোল পড়াতেই নেমন্তন্ন করেছেন? না ইতিহাস?
ঋজুদা ভটকাইয়ের কথাতে হেসে ফেলল।
ঋজুদা হাসে কম, কিন্তু হাসলে দারুণ দেখায়।
আমি বললাম, তোর মুখের ভূগোল পাল্টাবে এবারে মঁসিয়ে পঁপাদু। তাই তো ঋজুদা তোকে নিয়ে এসেছে এবারে।
রহস্য সবে জমাট বাঁধছে। একবার এসেই সেই রহস্যের ফোঁড়া-ফাটানো যাবে কি না তাও বলতে পারছি না। তবে রহস্য অবশ্যই আছে। নইলে মিস্টার পাদু ওখান থেকে পুরো ভারতবর্ষ পেরিয়ে পূর্বপ্রান্তের কলকাতাতে এসে পৌঁছবেন কেন হাঁচোর-পাঁচোর করে এই ঋজু বোসের ডেরাতে?
টার্মিনাল-বিল্ডিংয়ে ঢুকে ঋজুদা বলল, একসঙ্গে থাকব না কিন্তু আমরা। এবার থেকে একটু ছাড়া ছাড়া থাকব। যেন একে অন্যকে চিনি না। অথচ নজর রাখব অন্য দুজনের ওপরে প্রত্যেকেই। পিয়েরের লোকজন এখানেও থাকতে পারে।
বললাম, এবার আমারও হেঁয়ালি-হেঁয়ালি ঠেকছে। যা বলবে তা একটু খুলেই বলো না ঋজুদা। এই পিয়েরটি আবার কোথা থেকে এল? এক পপাদুকে নিয়েই তো ভটকাই হয়রান।
বলব, বলব। সবই বলব যথাসময়ে। তাড়া কীসের? বম্বে থেকে প্লেন ছাড়লেই তো সাড়ে চার ঘণ্টাতে পৌঁছে যাব একেবারে অপারেশনাল এরিয়াতে। তখন সব যদি জানা না থাকে তা হলেই তো কড়াক-পিঙ।
কড়াক-পিঙটা আবার কী জিনিস?
ভটকাই বোকার মতো প্রশ্নটা অত্যন্ত বিজ্ঞর মতো করল।
বললাম, অপার অশিক্ষিত তুই। সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেবের দেশে বিদেশে বইটা পড়ে নিস। অমন বই বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি লেখা হয়নি।
.
বোয়িং প্লেনটা যখন নীচে নামতে লাগল, সমুদ্রকে যখন সমুদ্র বলেই চেনা গেল, তখনই বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলাম। প্লেন যখন উঁচু দিয়ে ওড়ে তখন সমুদ্রকে সমুদ্র বলে বোঝাই যায় না। মেঘের নীচেই থাকে। এখন আকাশে মেঘ নেই বলে সমুদ্রকে একটা কালো চাদরের মতো দেখাচ্ছে, যার ওপরে সাদা সাদা অসংখ্য অস্থির রেখা। সেগুলো ফেনা-ভাঙা ঢেউ আর কী! অত ওপর থেকে ওইরকমই মনে হয়।
প্লেনটা ঘুরে ঘুরে নীচে নামতে লাগল। মনে হল, একেই বোধহয় বলে। পরীদের দেশ, স্বর্গের দেশ। সমুদ্রের মধ্যে মধ্যে পাহাড় ঘেরা সব ছোট ছোট দ্বীপ। কোনও দ্বীপকে ঘিরে রয়েছে কমলা-রঙা ছায়া চারদিকে, কোনও দ্বীপকে ফিকে নীল, কাউকে বা গাঢ় গোলাপি। আরও কত যে রং, তা কী বলব! এমন সুন্দর কোনও দেশ যে পৃথিবীতে আছে, তা জানাই ছিল না।
