জুজুমারার বাঘ (ঋজুদা) – বুদ্ধদেব গুহ

শেয়ার করুনঃ

এক

ওড়িশার সম্বলপুর শহর থেকে মহানদীর অন্য পাশে একটি পথ গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রেঢ়াখোল। রেঢ়াগোল হয়ে আরও এগিয়ে গেলে পৌঁছনো যায় বড়কেরাছক হয়ে অঙ্কুলে। এটি ওড়িশার একটি বিখ্যাত বনাঞ্চল।

এই অঙ্গুল ডিভিশনেরই অধীনে পুরানাকোট, বাঘমুণ্ডা, টুকা, লবঙ্গী ইত্যাদি বিভিন্ন ফরেস্ট ব্লক। ঋজুদার দৌলতে এই সবের মধ্যে অনেক জায়গাতেই যাওয়ার সুযোগ আমার, তিতিরের এবং ভটকাইয়েরও হয়েছিল। তবে ওড়িশার এদিকটাতে আগে ঋজুদা যদিও এসেছিল, আমরা কেউই আসিনি।

সম্বলপুর শহরের নাম সমলেশ্বরীর মন্দিরেরই নামে। মস্ত বড় সাদারঙা মন্দির। সম্বলপুরের রাজারাই সমলেশ্বরীর এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মা দুর্গারই আরেক নাম সমলেশ্বরী। কটক শহরে আবার এই দেবীরই নাম চণ্ডী। কটকচণ্ডীর মন্দির বিখ্যাত সেখানে যে পথে কটকের মন্দির সেই পথের নামই মন্দিরের নামে কটকচণ্ডী রোড।

কটক শহরের রাস্তাঘাটের নামগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত। তবে প্রত্যেকটি নামেরই মানে আছে। একটি পথের নাম বজ্ৰকপাটি রোড।

কটক শহর খুবই প্রাচীন শহর তো। প্রাচীন তার ঐতিহ্য। কলকাতা শহরের মতো স্বল্পদিনের এবং সর্বজ্ঞদের শহর নয় কটক।

সম্বলপুরের কাছেই কোল ইন্ডিয়ার সাবসিডিয়ারি কোম্পানি মহানদী কোলফিল্ডস-এর সদর দপ্তর। ঋজুদার কী কাজ ছিল মহানদী কোলফিল্ডস-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর শর্মা সাহেবের সঙ্গে। আমরা কলকাতা থেকে ট্রেনে গিয়ে ঝাড়সুগদাতে নেমে সেখান থেকে চমৎকার মসৃণ এবং চওড়া রাউরকেলা-সম্বলপুর এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে মহানদী কোলফিল্ডস-এর গেস্ট হাউসে গতকাল সকালেই এসে পৌঁছেছিলাম। চমৎকার গেস্ট হাউস। এয়ারকন্ডিশনড। খাওয়া-দাওয়া চমৎকার।

গতকাল সারাদিন ঋজুদা কাজ সেরেছে। তাই আজ সকালেই গাড়ি করে বেরিয়ে পড়েছিলাম ব্রেকফাস্টের পরে, অঙ্গুলে যাব বলে। কিন্তু দুপুরবেলা জুজুমারা আর চারমল-এর মাঝামাঝি হাইওয়ের উপরের একটি ধাবাতে খাওয়া সেরে বেরোবার দশ মিনিট পরেই দেখা গেল গাড়ির ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছে না। আসলে, চার্জ দিচ্ছিল না অনেকক্ষণ আগে থেকেই। না ড্রাইভার, না সামনের সিটে বসা ঋজুদা তা নজর করেছিল। গাড়ি থামিয়ে বনেট খুলে দেখা গেল যে দোষ ব্যাটারির নয়, অ্যাম্বাসাডর গাড়ির আর্মেচারই পুড়ে গেছে।

ড্রাইভার ত্রুষ্ণ দাস গোমড়ামুখে বলল, আর্মেচার সারাবার মতো মিস্ত্রি ওখানে এক রেঢ়াখোল ছাড়া অন্য কোথাওই নেই। তাই তাকে বাস বা ট্রাকে করে যেতে হবে আর্মেচার নিয়ে রেঢ়াখোল-এ। এই বিয়াল্লিশ নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরেই।

যদিও মে মাসের শেষ, কিন্তু বৃষ্টি নেমে গেছে। সারা পৃথিবীর আবহাওয়াই ওলট-পালট হয়ে গেছে আমাদের অসীম লোভে। এই অন্যায়ের গুণাগার আমাদের তো গুনতে হবেই। আমাদের ছেলেমেয়েদেরও হবে।

ঋজুদা সব সময়েই বলে একথা।

ত্রুষ্ণ অঙ্গুলগামী বাসে চড়ে চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে, পাকা তাল-এর মতো দেখতে, তামার তার জড়ানো ভীষণ ভারী আর্মেচারটি দু’হাতে বয়ে নিয়ে কোঁত দিতে দিতে বাসে উঠে। এখন আমাদের কতক্ষণ হা কৃষ্ণ! হা কৃষ্ণ!’ করে প্রাণভোমরাহীন গাড়িতে বসে থাকতে হবে, তা কে জানে। ত্রুষ্ণ বলে গেছে, তার ফিরতে দু’ ঘণ্টাও হতে পারে আবার রাতও হয়ে যেতে পারে। অতএব…

সামনে-পিছনে এবং দু’পাশেই অত্যন্ত গভীর জঙ্গল কত বর্গকিলোমিটার হবে তা জানি না। তবে শ পাঁচেক কিলোমিটার তো হবেই স্বচ্ছন্দে। তার মধ্যে-মধ্যে নানা পাহাড়শ্রেণী। স্থানীয় লোকেরা বলে ‘পর্বত। ধাবাতে খেতে খেতে শুনছিলাম। আর কত বিচিত্ৰই না তাদের নাম সব। সাগমুলিয়া-গড়াখুল, বনতুলে-খকর, রেঙ্গানিকানি, যসুয়া–এই রকম। পর্বত বলে, কারণ আসল পর্বত, যেমন গাড়োয়াল বা কুমায়ুন বা সিকিমের হিমালয় তো দেখেনি এরা চর্মচোখে। তাই তিলকেই তাল মনে করে।

ঋজুদা বলল, আমরা জনবসতির খুব দূরে নেই। জুজুমারার থেকে একটুই এসেছি। চারমল পেরিয়ে পৌঁছতে হবে রেঢ়াখোলে।

জুজুমারা!

কী নামরে বাবা।

ভটকাই স্বগতোক্তি করল।

তিতির বলল, শেকসপিয়ার তো পড়নি তুমি ভটকাই। শেকসপিয়ার বলেছিলেন, ‘হোয়াটস ইন আ নেম।

শেকসপিয়ার তো আমি পড়িনি, তুমি কি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা তারাশঙ্কর বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়েছ? রবীন্দ্রনাথও কি পড়েছ ভাল করে?

ঋজুদা বলল, এই শুরু হল তোদের খুনসুটি! তার পরে বলল তিতিরকে, শেকসপিয়ারের কথা বললি তুই তিতির, তাই মনে পড়ে গেল, ছেলেবেলায় বাংলা বইয়েতে শেকসপিয়ারের উল্লেখ থাকত ‘শেক্ষপিয়ার’ বলে আর জার্মান দার্শনিক ম্যাক্সমুলারের উল্লেখ থাকত ‘মোক্ষমুলার’ বলে।

আমরা হেসে উঠলাম ঋজুদার কথাতে।

ভটকাই বলল, কেন?

–কেন? তা কী করে বলব। তখন মানুষের ইংরেজি-জ্ঞান কম ছিল। পরাধীন ভারতে ইংরেজির যা পরাক্রম ছিল, স্বাধীন ভারতে তার চেয়ে একশো গুণ বেশি। তবে যে যেটুকু জানতেন তা তিনি ভালভাবেই জানতেন। এতকিছু জানতে গিয়ে সব গুবলেট করে ফেলেনি মানুষ। তাঁরা বাংলা জানতেন ভাল করে। তাঁদের মধ্যে ইংরেজি জানতেন খুব কম মানুষই। সে কারণেই হয়তো এমন সীমাবদ্ধতা দেখা যেত। তবে একথাও বলব যে, তখন রুই-কাতলার রাজত্ব ছিল, আজকের মতো খলসে আর পুঁটি ফরফর করে বেড়াত না চারদিকে।

তাই?

অবাক হয়ে বলল তিতির।

আমি প্রসঙ্গ বদলে বললাম, ঋজুদা এ অঞ্চলে তুমি কখনও শিকার করোনি?

বলতে গেলে, না-ই। এ অঞ্চলের গল্প শুনতাম কটকের চাঁদুবাবু আর অঙ্গুলের বিমলবাবুর কাছে। এইসব জঙ্গলের রোমহর্ষক সব গল্প বলতেন চাঁদুবাবু। গণ্ডার এবং বুনোমোষ ছিল না অবশ্য। কিন্তু হাতি, বাঘ, বাইসন মানে গাউর, চিতা, ভয়াবহ সব ভাল্লুক, ইয়া ইয়া দাঁতের বড়কা বড়কা শুয়োর, তোর কাঁধ সমান উঁচু কাঁটা ঝনঝনানো শজারু, নানা জাতের হরিণ এবং অ্যান্টেলোপ, ময়ূর, মুরগি, সবুজ হরিয়াল, গাঢ় নীলরঙা রক-পিজিয়ন, বড়কি এবং ছুটকি ধনেশ, ওড়িশাতে যাদের বলে কুচিলা-খাঁই এবং ভালিয়া-খাঁই।

তিতির বলল, মানে, গ্রেটার এবং লেসার হর্নবিল বলছ ঋজুকাকা?

-হ্যাঁ।

তবে এখানে ওদের এরকম অদ্ভুতুড়ে নাম কেন?

হোমিয়োপ্যাথিক ওষুধ নাকসভোমিকার ফল যে গাছে হয় তাদের ওড়িয়াতে বলে কুচিলা। আর ওই কুচিলা খুব ভালবেসে খায় এবং শীতকালে যখন সে গাছে ফল আসে তখন বড়কি ধনেশরা ওই গাছেতেই আড্ডা গাড়ে বলেই তাদের ওরা নাম দিয়েছে কুচিলা-খাঁই। ভালিয়াও এক রকমের গাছই। তবে কুচিলা গাছেদের চেয়ে অনেক ছোট হয় সে গাছ। পাহাড়ি এলাকাতে ঘন বনের মধ্যেই হয় এইসব গাছ। ছোটকি ধনেশ ভালিয়া ফল খেতে ভালবাসে বলেই ওদের নামও ভালিয়া-খাঁই। মানে, ভালিয়া খায় আর কী!

তবে কি আমার নাম হওয়া উচিত ছিল পান্তুয়া-খাঁই?

আমরা সবাই হেসে উঠলাম ভটকাইয়ের কথা শুনে।

তিতির বলল, সত্যি! তুমি যে কত্ব জানো ঋজুকাকা!

ঋজুদা হেসে বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে? একটু-আধটু জানা ভাল কিন্তু কেউ যদি সর্বজ্ঞ হয়ে যায় তবেই বড় বিপদ। প্রার্থনা করিস ঈশ্বরের কাছে, তা যেন কখনও না হই।

তারপরই বলল, বৃষ্টি তো থেমে গেছে। চল আমরা গিয়ে আম কুড়োই। পরে নুন-লঙ্কা জোগাড় করে রেলিশ করে খাওয়া যাবে।

পথের দু পাশে মস্ত মস্ত প্রাচীন আমগাছ আর প্রত্যেকটাই আমে ভরে আছে। মে মাসের শেষ। এখানে পৌঁছবার আগে দেখে এসেছি যে, গ্রামের কাছাকাছি সব জায়গাতে পথ-পাশের আমতলিতে ছোট-বড় অনেকেই আম পাড়তে আর আম কুড়োতে ব্যস্ত। অনেকে গাছে উঠেও পাড়ছে আম। দেখেছিলাম। অনেকে আবার জমিতে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে অথবা আঁকশি দিয়েও পাড়ছে। এখানে কাছাকাছি জনবসতি নেই বলেই গাছতলিতে মানুষ নেই। বৃষ্টি থামার পরে নানা রকম পাখি ডাকছে দু’ পাশের বন থেকে। যে-পাখিটা রাতের বেলা ভুতুড়ে গলাতে গুব-গুব গুব গুব করে ডাকে সে এই ভর দুপুরেই ডাকতে আরম্ভ করেছে। পাখিটার নাম জানতে হবে ঋজুদার কাছ থেকে।

তিতির বলল, ঋজুকাকা তোমার মধ্যে একজন চিরশিশু আছে বলেই তোমাকে আমাদের এত ভাল লাগে। তুমি বুড়ো হলে কখনও আম কুড়োবার কথা বলতেই পারতে না।

ঋজুদা বলল, এইটাই তো আমার রোগ। মহারোগ। বুড়ো আমি ইচ্ছে করলেও কোনওদিনও হতে পারব না। হয়তো পক-কেশ, লোলচর্ম হয়ে যাব কোনওদিন, হয়তো কেন, অবশ্যই হব, কারণ সকলেই হয়, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ছেলেমানুষটিই থাকব। আঠারোই আমার চিরকালীন বয়স। সে বয়স আর বাড়বে না কোনওদিনও।

ভটকাই বলল, তাই থেকো, তাই থেকো, এভার গ্রিন।

আমি বললাম, আমরা রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুনীর নবযৌবনের দল’ হয়েই থাকব চিরটা কাল।

ঋজুদা বলল, তাই যেন থাকি।

অনেকগুলো আম কুড়োনো হয়ে গেলে একটা মস্ত আমগাছের নীচের বড় বড় কালো পাথরের উপরে আমরা গিয়ে ছড়িয়ে বসলাম উপরে নীচে। পাথরগুলো ভিজে ছিল। ভটকাই বুদ্ধি করে গিয়ে গাড়ির গ্লাভসবক্স খুলে হলুদ আর লাল কাপড় নিয়ে এসে পাথরগুলো ভাল করে মুছে দিল।

ঋজুদা একটা বড় পাথরে বসে পাইপটা ধরাল। এখন প্রায় আড়াইটে বাজে। দুপুর। বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশের মুখ ভার। মনে হচ্ছে যে-কোনও সময়েই আবার কেঁদে উঠতে পারে।

ভটকাই কাপড়গুলো গাড়িতে রেখে এসে ঋজুদাকে বলল, ঋজুদা, রুদ্র যে জিজ্ঞেস করল তোমাকে এই অঞ্চলে শিকারের কথা, তা তুমি তো কথাটা চেপেই গেলে।

চেপে গেলাম মানে?

–চেপে গেলে না? বললে, বলতে গেলে, না-ই। তার মানেটা কী হল? এরকম ঘোরপ্যাঁচের কথা তো বলে কমিউনিস্টরা। তুমিও কি কমিউনিস্ট?

কম অথবা বেশি, আমি কোনও অনিষ্টর মধ্যেই নেই। যারাই দেশের দশের ভাল করবে আমি তাদেরই দলে। সে ভাল, যে দলই করুক না কেন?

–এই ভটকাই। তুই ওকালতি পড়। তোর হবে। এমন জেরা তো ফৌজদারি আদালতের উকিলও করে না রে!

ফাজিল ভটকাই বলল, হাঃ হাঃ। এই লাইফটাই তো একটা ফৌজদারি আদালত।

আমরা সকলেই ওর কথাতে হেসে উঠলাম।

ঋজুদা বলল, রুদ্র ভট্রাইকে ধরে এবারে একটু চটকে দে তো।

মাঝে মাঝে, তবে বেশ অনেকক্ষণ বাদে বাদে এক একটি বাস বা ট্রাক বা প্রাইভেট গাড়ি আসছিল বা যাচ্ছিল জলভেজা মসৃণ পথের উপর ছিপছিপছিপ শব্দ তুলে। যানবাহন খুবই কম। এখনও শান্তি আছে কোথাও কোথাও। জেনে ভাল লাগে।

এই কদিন আগেই কাগজে পড়ছিলাম যে, এই পথেই অঙ্গুল থেকে সম্বলপুরে আসার সময়ে একটি যাত্রীবোঝাই বাসের গায়ে একটি একরা-বাইসন গুঁতো মেরে বাস-এর গায়ে ফুটো করে দিয়েছে। পুরো অঞ্চলটাই ঘন বনাবৃত নানা পাহাড়শ্রেণীর পাহারাতে, নানা নদী-নালার মালাতে এখনও বেশ আদিম আদিম আছে। বনের গাছগাছালির অধিকাংশও আদিম। বনবিভাগের লাগানো প্ল্যানটেশন নয়।

কী হল ঋজুদা? বলো। বলতে গেলে না-ই’-এর ব্যাখ্যা কিন্তু তুমি এখনও দিলে না।

ভটকাই বলল।

–হ্যাঁ।

ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, আমাদের পেছনে ফেলে-আসা জুজুমারার একটু আগে রেঙ্গানিকানি নামের একটি পাহাড়শ্রেণী আছে। তারই পাদদেশের ঘন জঙ্গলের লাগোয়া গ্রামে একটি cattle-lifter মেরেছিলাম বহু বছর আগে। মেরেছিলাম মানে, মারতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাই বলেছিলাম শিকারের কথায়, বলতে গেলে না-ই।

বাধ্য হয়েছিলে মানে?

-মানে, নিজেই জিপ চালিয়ে যাচ্ছিলাম সম্বলপুর থেকে অঙ্গুল। জুজুমারার আগে হঠাৎই একটি আত্মহত্যাকামী ব্যর্থ-প্রেমিক বোকাপাঁঠা জিপকে বাইসনের মতো ঢু মারতে গিয়ে পা পিছলে চাকার নীচে পড়ে গিয়ে মারাত্মক রকম আহত হয়। সেই সময়টাতে আমি বামরাতে শাল জঙ্গলের ঠিকা নিয়ে জঙ্গলেই ক্যাম্প করে থাকি। সঙ্গী বলতে আমার সেবাদাস হাবা-গোবা কিন্তু নিজেকে সুপার ইনটেলিজেন্ট ভাবা, আতুপাতু ধল্ব। আমার কুক-কাম-ড্রাইভার-কাম-মুহুরি কাম-লোকাল গার্জিয়ান।

কী নাম বললে?

–আতুপাতু।

–আতুপাতু আবার কারও নাম হয় নাকি?

হবে না কেন? বাবা-মা ভালবেসে যে নাম রাখবেন সে নামই হয়।

আমি বললাম, ভটকাই-ই বা কারও নাম হয় নাকি?

ভটকাই তখন চুপ করে গেল।

তিতির বলল, ধল্বটা কী ব্যাপার?

–আহা, surname, পদবি। ওড়িয়া পদবি। আমাদের কারও কারও পদবি যদি দাড়িপা বা পোদ হতে পারে ধল্ব কী দোষ করল!

–তা ঠিকই।

তিতির বলল।

–তারপর বলল ঋজুদা।

ভটকাই বলল।

–মিনিট পাঁচেক আগেই তাকে স্টিয়ারিং ছেড়েছিলাম আমি, নইলে আমিই চালাচ্ছিলাম বামরা থেকেই। আর তারই মধ্যে সেই চালাক-পাঁঠা চাপা দিয়ে দিল এক বোকা-পাঁঠাকে। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন এসে ঘিরে ফেলল আমাদের। এই মারে কি সেই মারে। পাঁঠাটার দাম মিটিয়ে দিলেই মামলার নিষ্পত্তি হত, কিন্তু আতুপাতুর চ্যাটাং-চ্যাটাং কথাতে জনতা ক্ষেপে গেল। আর ভারতের সব জায়গার জনতাই হচ্ছে লাল পিঁপড়েদেরই মতো। একবার একজন কোথাও সেঁটে গেলে, অন্যরা সকলে কী ঘটেছে তা না জেনেই গায়ে পড়ে উড়ন-চাঁটি মেরে হাতের সুখ করে নিতে চায়। পাঁঠাটাও একেবারে মরে গেলে মামলার সহজ নিষ্পত্তি হত কিন্তু সে তো মরে তো নিই, মরবেও না। তার চিৎকার শুনে জনগণ বলতে লাগল, ‘ষড়া! সে খাসিটাকু খন্ডিয়া করিকি ছাড়ি দেলু।

-মানে?

তিতির বলল।

–মানে হল, অর্থাৎ শালা! খাসিটাকে আহত করে ছেড়ে দিল।

যখন অগণন উড়ন-চাঁটি আমার নিজের গায়ে-মাথায়ও বর্ষিত হয় হয় এমন সময়ে ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলল, ঋজুবাবু।

আহা! কানে যেন মধুবর্ষিত হল। ধড়ে প্রাণ এল।

আতুপাতুও বত্রিশপাটি বিকশিত করে বলল, বাবু! হাড়িবন্ধু।

জনতা, বিনি-পয়সার উত্তেজনায় ভাঁটা পড়াতে মনমরা হয়ে গেল।

হাড়িবন্ধুর বাড়ি লবঙ্গীতে। সেখানে ফুটুদাদের সঙ্গে যখন যেতাম তখন সেই আমাদের সবরকম খিদমদগারি করত। সে জনতাকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার বহুমুখী প্রতিভা সম্বন্ধে কাঁকড়াবিছের গুঁড়ের মতো একটি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে শান্ত করল।

তার পরে জনতারই কথাতে জানা গেল যে, রেঙ্গানিকানি পাহাড়ের পাহাড়তলিতে কুচুয়া বলে একটি গ্রামে গত রাতেই একটা মস্ত চিতা খুব বড় একটা দুধেল গোরু মেরেছে। গোরুটার কিছু খেয়েও গেছে। মড়ি’র উপরে বসলে আজ তাকে হয়তো মারাও যাবে। তবে আশা কম। এবং গোরুর ‘মড়ি’তে বাঘের ফেরার আশা কম বলেই এই পাঁঠাটাকে কিনে কুচুয়া গ্রামের লোকেরা গ্রামে ফিরে যাচ্ছিল। হাড়িবন্ধু এখন কুচুয়াতেই থাকে। কয়েক গুট জমি কিনে সে এখানেই বিয়ে করে থিতু হয়েছে।

–গুঁটটা কী জিনিস?

তিতির প্রশ্ন করল।

–গুঁট হচ্ছে ওড়িশার জমির পরিমাণ। আমাদের যেমন বিঘা।

–ও। বলো, ঋজুকাকা।

–চাষ-বাস করে হাড়িবন্ধু। তরি-তরকারিও ফলায়। জুজুমারা আর চারমল-এর হাটে বিক্রি করে। চলে যায় দিন কোনওমতে।

ঋজুদার পাইপটা একেবারেই নিভে গিয়েছিল। পাইপটা ধরিয়ে নিয়ে ঋজুদা আবার শুরু করল–

যে গোরুটাকে মেরেছে চিতা, সেটা হাড়িবন্ধুর বড় সম্বন্ধীর। হাড়িবন্ধু সকলকে বোঝাল যে, এই অধম ভারী শিকারি। ওড়িশার বহু বনেই তাঁর পা পড়েছে। আজ সাক্ষাৎ মা সমলেশ্বরীই তাঁকে চিতা-নিধনের জন্য এই পথে চালান করেছেন এবং পাঁঠাটাও বোধ হয় তা জানতে পেরে জিপের গায়ের সঙ্গে নিজের গা ঠেকিয়ে দিয়ে এই কেলো করেছে।

আমি হাড়িবন্ধুর কথার প্রতিবাদ করে বললাম, তা কী করে হবে। আমাকে অঙ্গুলে গিয়ে আজ পৌঁছতেই হবে। ঠিকাদার মহাদেব ঘোষ আর বিমল ঘোষের সঙ্গে কাজ আছে। ওখানে কাজ সেরে ঢেনকানলেও যেতে হবে একবার।

কিন্তু কে শোনে কার কথা!

বাঁচবার জন্য বললাম, আমি কি সঙ্গে বন্দুক-রাইফেল নিয়ে বেরিয়েছি নাকি? শুধু পিস্তলটা আছে বেল্টের সঙ্গে হোলস্টারে; প্রয়োজনে বেয়াদব মানুষ মারার জন্য। পিস্তল দিয়ে কি বাঘ মারা যায়?

হাড়িবন্ধু এবং তার সঙ্গীরা বলল, বহুতো বন্দুক অচ্ছি এটি। বন্দুকপাঁই কিচ্ছি। চিন্তা নাই। কিন্তু আপনাংকু রহিবাকু হেব্ব।

তারপর বলল, বন্দুক, রেঙ্গানিকানি পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশের গ্রামে গ্রামে অনেক আছে কিন্তু এমন শিকারি কেউ নেই যে ও চিতাকে মারতে পারে।

–কেন? একথা বললে আমি মানব কেন? এইসব জঙ্গল-পাহাড়ের গ্রামের যে-কোনও শিকারিই শহুরে নামীদামি শিকারিদের কানে ধরে শিকার শিখিয়ে দিতে পারে।

–চিতাটা সাধারণ চিতা নয়।

–মানে?

–মানে ওর গায়ে গুলি লাগলেও ওর কিচ্ছু হয় না। গুলি খেয়ে, পড়ে গিয়েও সে উঠে চলে যায়।

–এমন গুলিশোর চিতার কথা তো শুনিনি জন্মে।

তাকে যারাই মারতে গেছে তাদেরই নানা বিপদ ঘটেছে। প্রায় ছ মাস হল চিতাটা এই অঞ্চলে অত্যাচার করে যাচ্ছে কিন্তু বহু শিকারি চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। মা সমলেশ্বরীর যে কৃপাধন্য তাকে কি সাধারণ মানুষে মারতে পারে? এ চিতা সমলেশ্বরীর চিতা।

–তাহলে আমিই বা পারব কী করে!

ঋজুদা বলল, আমি বললাম, হাড়িবন্ধু অ্যান্ড কোম্পানিকে।

তারা বলল, আপনি তো স্থানীয় মানুষ নন। ওই চিতাকে মারতে পারলে আপনিই পারবেন।

ততক্ষণে পাঁঠাটাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে শুশ্রূষা করতে লাগল কেউ কেউ আর আমাদেরও জিপ থেকে নামিয়ে সসম্মানে চায়ের দোকানের সামনে বসিয়ে চা আর বিড়ি বড়া খাওয়াল জবরদস্তি করেই।

এদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও উপায় নেই দেখে আমি বললাম, গোরুর আধ-খাওয়া মড়ি’ যখন আছেই তখন আবার পাঁঠার জোগাড়ে গেলে কেন?

–চিতাটা তো আধ-খাওয়া মড়িতে বড় একটা আসে না। যদি বা আসেও, শিকারি কাছাকাছি থাকলে ঠিক বুঝতে পেরে ফিরে যায়।

-তাহলে তো পাঁঠা বেঁধে বসলেও ফিরেই যাবে।

হয়তো যাবে। তবু চেষ্টা করতে হবে।

কখনও কুকুর বেঁধে চেষ্টা করা হয়েছে কি?

না তো। কেন? কুকুর কেন?

বাঃ। চিতার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য কুকুর, বাঘের যেমন ঘোড়া। তাই জানো না এতদিনে হাড়িবন্ধু?

–না তো।

–তাহলে এখন বলো কী করতে হবে। এখানে থাকার জায়গা কী আছে? ডাকবাংলো-বনবাংলো কিছু আছে কি?

–আছে, তবে এখান থেকে দূরে। আমাদের গ্রামে থাকলে হয় না? হাড়িবন্ধুর এক সঙ্গী বলল।

আরেকজন মাতব্বর বলল, ধ্যাৎ। বাবু কি আমাদের বাড়ি থাকতে পারবেন? বিজলি নেই, কমোড নেই, কী করে থাকবেন শহুরেবাবু? ওঁদের সবসময়ে গরম জল লাগে–গরম জলের মেসিনকে বলে গিসার–গরমে ঠাণ্ডা হওয়ার জন্যে লাগে ইয়ারকন্ডিশন। বাথরুমই নেই তার গিসার বা কমোড় কোথায় বসবে?

ঋজুদা বলল, শব্দটা কানে লেগে গেল, বুঝলি। ইয়ারকন্ডিশন। ইয়ার-দোস্তদের কন্ডিশনার থাকলে মন্দ হত না। যাই হোক, আমি ওদের অবাক করে দিয়ে বললাম, আমি তোমাদের বাড়িতেই থাকব। তবে আমাকে একটা আলাদা ঘর দিতে হবে।

–সে কোনও সমস্যা নয়।

হাড়িবন্ধুর সঙ্গীরা বলল।

কিন্তু পরক্ষণেই সমস্যায় পড়ে বলল, গা-ধেইবি, ঝাড়া-দেইবি কুয়াড়ে?

-মানে?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল ঋজুদাকে।

-মানে, চান করবে, বাথরুম করবে কোথায়?

বললাম, নদীতেই এবং জঙ্গলে, তোমরা যেমন কর। ‘মত্বে গুট্টে ঢাল্ব দেই দিবি, আউ কিছি লাগিবনি৷

ঢাল্বটা আবার কি জিনিস? ঢাল-তরোয়াল নিয়ে বাঘ মারতে যেতে চাইছিলে নাকি?

তিতির বলল।

ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, নারে পাগলি! ওড়িয়াতে ঘটিকে বলে ঢাল্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *