শেষের রাত্রি গল্প – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শেয়ার করুনঃ

শেষের রাত্রি গল্প - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Sesher Ratri Golpo Story Rabindra Nath Tagore

 

পর্ব- ১

“মাসি! ”

“ঘুমোও, যতীন, রাত হল যে।”

“হোক-না রাত,আমার দিন তো বেশি নেই। আমি বলছিলুম,মণিকে তার বাপের বাড়ি— ভুলে যাচ্ছি,ওর বাপ এখন কোথায়—”

“সীতারামপুরে।”

“হাঁ সীতারামপুরে। সেইখানে মণিকে পাঠিয়ে দাও, আরো কতদিন ও রোগীর সেবা করবে। ওর শরীর তো তেমন শক্ত নয়।”

“শোনো একবার! এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে বউ বাপের বাড়ি যেতে চাইবেই বা কেন।”

“ডাক্তারেরা কী বলেছে সে কথা কি সে—”

“তা সে নাই জানল— চোখে তো দেখতে পাচ্ছে। সেদিন বাপের বাড়ি যাবার কথা যেমন একটু ইশারায় বলা অমনি বউ কেঁদে অস্থির।”

মাসির এই কথাটার মধ্যে সত্যের কিছু অপলাপ ছিল, সে কথা বলা আবশ্যক। মণির সঙ্গে সেদিন তাঁর এই প্রসঙ্গে যে আলাপ হইয়াছিল সেটা নিম্নলিখিত-মতো।

“বউ,তোমার বাপের বাড়ি থেকে কিছু খবর এসেছে বুঝি? তোমার জাঠততো ভাই অনাথকে দেখলুম যেন।

হাঁ, মা ব’লে পাঠিয়েছেন, আসছে শুক্রবারে আমার ছোটো বোনের অন্নপ্রাশন। তাই ভাবছি—”

“বেশ তো বাছা, একগাছি সোনার হার পাঠিয়ে দাও, তোমার মা খুশি হবেন।”

“ভাবছি, আমি যাব। আমার ছোটো বোনকে তো দেখিনি, দেখতে ইচ্ছে করে।”

“সে কী কথা, যতীনকে একলা ফেলে যাবে? ডাক্তার কী বলেছে শুনেছ তো? ”

“ ডাক্তার তো বলছিল, এখনো তেমন বিশেষ—”

“তা যাই বলুক, ওর এই দশা দেখে যাবে কী ক’রে।”

“আমার তিন ভাইয়ের পরে এই একটি বোন, বড়ো আদরের মেয়ে– শুনেছি, ধুম করে অন্নপ্রাশন হবে— আমি না গেলে মা ভারি—”

“তোমার মায়ের ভাব, বাছা, আমি বুঝতে পারি নে। কিন্তু যতীনের এই সময়ে তুমি যদি যাও, তোমার বাবা রাগ করবেন, সে আমি বলে রাখছি।”

“তা জানি। তোমাকে এক লাইন লিখে দিতে হবে মাসি, যে কোনো ভাবনার কথা নেই— আমি গেলে বিশেষ কোনো—”

“তুমি গেলে কোনো ক্ষতিই নেই সে কি জানি নে। কিন্তু তোমার বাপকে যদি লিখতেই হয়, আমার মনে যা আছে সব খুলেই লিখব।”

“আচ্ছা, বেশ— তুমি লিখো না। আমি ওঁকে গিয়ে বললেই উনি—”

“দেখো বউ, অনেক সয়েছি— কিন্তু এই নিয়ে যদি তুমি যতীনের কাছে যাও, কিছুতেই সইব না। তোমার বাবা তোমাকে ভালো রকমই চেনেন, তাঁকে ভোলাতে পারবে না।”

এই বলিয়া মাসি চলিয়া আসিলেন। মণি খানিকক্ষণের জন্য রাগ করিয়া বিছানায় উপর পড়িয়া রহিল।

পাশের বাড়ি হইতে সই আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এ কি সই, গোসা কেন।”

“ দেখো দেখি ভাই, আমার একমাত্র বোনের অন্নপ্রাশন— এরা আমাকে যেতে দিতে চায় না।”

“ওমা, সে কী কথা, যাবে কোথায়। স্বামী যে রোগে শুষছে।”

“আমি তো কিছুই করি নে, করিতে পারিও নে ; বাড়িতে সবাই চুপচাপ,আমার প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। এমন ক’রে আমি থাকিতে পারি নে, তা বলছি! ”

“তুমি ধন্যি মেয়েমানুষ যা হোক।”

“তা আমি, ভাই, তোমাদের মতো লোক দেখানে ভান করতে পারি নে। পাছে কেউ কিছু মনে করে বলে মুখ গুঁজড়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা আমার কর্ম নয়।”

“তা, কী করবে শুনি।”

“আমি যাবই, আমাকে কেউ ধরে রাখতে পারবে না।”

“ইস্‌, তেজ দেখে আর বাঁচি নে। চললুম, আমার কাজ আছে।”

পর্ব- ২

বাপের বাড়ি যাইবার প্রসঙ্গে মণি কাঁদিয়াছে— এই খবরে যতীন বিচলিত হইয়া বালিশটাকে পিঠের কাছে টানিয়া তুলিল এবং একটু উঠিয়া হেলান দিয়া বসিল। বলিল, “মাসি, এই জানালাটা আর-একটু খুলে দাও,আর এই আলোটা এ ঘরে দরকার নেই।”

জানালা খুলিতেই স্তব্ধ রাত্রি অনন্ত তীর্থপথের পথিকের মতো রোগীর দরজার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইল। কত যুগের কত মৃত্যুকালের সাক্ষী ঐ তারাগুলি যতীনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।

যতীন এই বৃহৎ অন্ধকারের পটের উপর তাহার মণির মুখখানি দেখিতে পাইল। সেই মুখের ডাগর দুটি চক্ষু মোটা মোটা জলের ফোঁটার ভরা— সে জল যেন আর শেষ হইল না, চিরকালের জন্য ভরিয়া রহিল।

অনেকক্ষণ সে চুপ করিয়া আছে দেখিয়া মাসি নিশ্চিত হইলেন। ভাবিলেন, যতীনের ঘুম আসিয়াছে।

এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “মাসি,তোমরা কিন্তু বারবার মনে করে এসেছ,মণির মন চঞ্চল,আমাদের ঘরে ওর মন বসে নি। কিন্তু দেখো—”

“না,বাবা,ভুল বুঝেছিলুম– সময় হলেই মানুষকে চেনা যায়! ”

“মাসি! ”

“যতীন, ঘুমোও, বাবা।”

“আমাকে একটু ভাবতে দাও, একটু কথা কইতে দাও! বিরক্ত হোয়ো না মাসি।”

“আচ্ছা, বলো,বাবা।”

“আমি বলছিলুম, মানুষের নিজের মন নিজে বুঝতে কত সময় লাগে ! একদিন যখন মনে করতুম, আমরা কেউ মণির মন পেলুম না, তখন চুপ করে সহ্য করেছি। তোমরা তখন—”

“না, বাবা, অমন কথা বোলো না— আমিও সহ্য করেছি।”

“মন তো মাটির ঢেলা নয়, কুড়িয়ে নিলেই তো নেওয়া যায় না। আমি জানতুম, মণি নিজের মন এখনো বোঝে নি; কোনো একটা আঘাতে যেদিন বুঝবে সেদিন আর—”

“ঠিক কথা, যতীন।”

“সেইজন্যই ওর ছেলেমানুষিতে কোনোদিন কিছু মনে মরি নি।”

মাসি এ কথার কোনো উত্তর করিলেন না; কেবল মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। কতদিন তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন, যতীন বারান্দায় আসিয়া রাত কাটাইয়াছে, বৃষ্টির ছাট আসিয়াছে তবু ঘরে যায় নাই। কতদিন সে মাথা ধরিয়া বিছানায় পড়িয়া ; একান্ত ইচ্ছা,মণি আসিয়া মাথায় একটু হাত বুলাইয়া দেয়। মণি তখন সখীদের সঙ্গে দল বাঁধিয়া থিয়েটার দেখিতে যাইবার আয়োজন করিতেছে। তিনি যতীনকে পাখা করিতে আসিয়াছেন, সে বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে। সেই বিরক্তির মধ্যে কত বেদনা তাহা জানিতেন। কতবার তিনি যতীনকে বলিতে চাহিয়াছেন, ‘বাবা, তুমি ঐ মেয়েটার দিকে অত বেশি মন দিয়ো না – ও একটু চাহিতে শিখুক – মানুষকে একটু কাঁদানো চাই।’ কিন্তু এ-সব কথা বলিবার নহে, বলিলেও কেহ বোঝে না। যতীনের মনে নারীদেবতার একটি পীঠস্থান ছিল, সেইখানে সে মণিকে বসাইয়াছে। সেই তীর্থক্ষেত্রে নারীর অমৃতপাত্র চিরদিন তাহার ভাগ্যে শূন্য থাকিতে পারে, এ কথা মনে করা তাহার পক্ষে সহজ ছিল না। তাই পূজা চলিতেছিল, অর্ঘ্য ভরিয়া উঠিতেছিল, বরলাভের আশা পরাভব মানিতেছিল না।

মাসি যখন আবার ভাবিতেছিলেন যতীন ঘুমাইয়াছে, এমন সময়ে হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “আমি জানি, তুমি মনে করেছিলে, মণিকে নিয়ে আমি সুখী হতে পারি নি। তাই তার উপর রাগ করতে। কিন্তু, মাসি, সুখ জিনিসটা ঐ তারাগুলির মতো, সমস্ত অন্ধকার লেপে রাখে না, মাঝে মাঝে ফাঁক থেকে যায়। জীবনে কত ভুল করি, কত ভূল বুঝি, তবু তার ফাঁকে ফাঁকে কি স্বর্গের আলো জ্বলে নি। কোথা থেকে আমার মনের ভিতরটি আজ এমন আনন্দে ভরে উঠেছে।”

মাসি আস্তে আস্তে যতীনের কপালে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। অন্ধকারে তাঁহার দুই চক্ষু বাহিয়া যে জল পড়িতেছিল তাহা কেহ দেখিতে পাইল না।

“আমি ভাবছি, মাসি, ওর অল্প বয়স, ও কী নিয়ে থাকবে।”

“অল্প বয়স কিসের, যতীন? এ তো ওর ঠিক বয়স। আমরাও তো, বাছা, অল্প বয়সেই দেবতাকে সংসারের দিকে ভাসিয়ে অন্তরের মধ্যে বসিয়েছি— তাতে ক্ষতি হয়েছে কী। তাও বলি, সুখেরই বা এত বেশি দরকার কিসের! ”

“মাসি, মণির মনটি যেই জাগবার সময় হল অমনি আমি—”

“ভাব কেন যতীন? মন যদি জাগে তবে সেই কি কম ভাগ্য! ”

হঠাৎ অনেক দিনের শোনা একটা বাউলের গান যতীনের মনে পড়িয়া গেল—

                ওরে        মন, যখন জাগলি না রে

                তখন        মনের মানুষ এল দ্বারে।

                তার         চলে যাবার শব্দ শুনে

                            ভাঙল রে ঘুম,

               ও তোর ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে॥

“মাসি, ঘড়িতে কটা বেজেছে।”

“নটা বাজবে।”

“সবে নটা? আমি ভাবছিলুম, বুঝি দুটো, তিনটে, কি কটা হবে। সন্ধ্যার পর থেকেই আমার দুপুর রাত আরম্ভ হয়। তবে তুমি আমার ঘুমের জন্যে অত ব্যস্ত হয়েছিলে কেন।”

“কালও সন্ধ্যার পর এইরকম কথা কইতে কইতে কত রাত পর্যন্ত তোমার আর ঘুম এল না,তাই আজ তোমাকে সকাল-সকাল ঘুমোতে বলছি।”

“মণি কি ঘুমিয়েছে।”

“না, সে তোমার জন্যে মসুরির ডালের সুপ তৈরি ক’রে তবে ঘুমোতে যায়।”

“বলো কী, মাসি, মণি কি তবে—”

“সেই তো তোমার জন্যে সব পথ্যি তৈরি করে দেয়। তার কি বিশ্রাম আছে।”

“আমি ভাবতুম,মণি বুঝি –”

“মেয়েমানুষের কি আর এ-সব শিখতে হয়। দায়ে পড়লেই আপনি করে নেয়।”

“আজ দুপুরবেলা মৌরলা মাছের যে ঝোল হয়েছিল তাতে বড়ো সুন্দর একটি তার ছিল। আমি ভাবছিলুম, তোমারই হাতের তৈরি।”

“কপাল আমার! মণি কি আমাকে কিছু করতে দেয়। তোমার গামছা তোয়ালে নিজের হাতে কেচে শুকিয়ে রাখে। জানে যে, কোথাও কিছু নোংরা তুমি দেখতে পার না। তোমার বাইরের বৈঠকখানা যদি ঐকবার দেখ তবে দেখতে পাবে, মণি দুবেলা সমস্ত ঝেড়ে মুছে কেমন তক্‌তকে ক’রে রেখে দিয়েছে ; আমি যদি তোমার এ ঘরে ওকে সর্বদা আসতে দিতুম তা হলে কি আর রক্ষা থাকত! ও তো তাই চায়।”

“মণির শরীরটা বুঝি –”

“ডাক্তাররা বলে রোগীর ঘরে ওকে সর্বদা অনাগোনা করতে দেওয়া কিছু নয়। ওর মন বড়ো নরম কি না, তোমার কষ্ট দেখলে দুদিনে যে শরীর ভেঙে পড়বে।”

“মাসি, ওকে তুমি ঠেকিয়ে রাখ কী ক’রে।”

“আমাকে ও বড্ডো মানে বলেই পারি। তবু বার বার গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হয়— ঐ আমার আর-এক কাজ হয়েছে।”

আকাশের তারাগুলি যেন করুণা-বিগলিত চোখের জলের মতো জ্বল্‌জ্বল্‌ করিতে লাগিল। যে জীবন আজ বিদায় লইবার পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যতীন তাহাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতার প্রণাম করিল— এবং সম্মুখে মৃত্যু আসিয়া অন্ধকারের ভিতর হইতে যে দক্ষিণ হাত বাড়াইয়া দিয়াছে যতীন স্নিগ্ধ বিশ্বাসের সহিত তাহার উপরে আপনার রোগক্লান্ত হাতটি রাখিল।

একবার নিশ্বাস ফেলিয়া, একটুখানি উস্‌খুস্‌ করিয়া যতীন বলিল , “মাসি, মণি যদি জেগেই থাকে তা হলে একবার যদি তাকে—”

“এখনি ডেকে দিচ্ছি, বাবা।”

“আমি বেশিক্ষণ তাকে এ ঘরে রাখতে চাই নে— কেবল পাঁচ মিনিট— দুটো একটা কথা যা বলবার আছে—”

মাসি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মণিকে ডাকিতে আসিলেন। এদিকে যতীনের নাড়ী দ্রুত চলিতে লাগিল। যতীন জানে, আজ পর্যন্ত সে মণির সঙ্গে ভালো করিয়া কথা জমাইতে পারে নাই। দুই যন্ত্র সুরে বাঁধা,একসঙ্গে আলাপ চলা বড়ো কঠিন। মণি তাহার সঙ্গিনীদের সঙ্গে অনর্গল বকিতেছে হাসিতেছে,দূর হইতে তাহাই শুনিয়া যতীনের মন কতবার ঈর্ষায় পীড়িত হইয়াছে। যতীন নিজেকেই দোষ দিয়াছে— সে কেন অমন সামান্য যাহা-তাহা লইয়া কথা কহিতে পারে না। পারে না যে তাহাও তো নহে,নিজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যতীন সামান্য বিষয় লইয়াই কি আলাপ করে না। কিন্তু পুরুষের যাহা-তাহা তো মেয়েদের যাহা-তাহার সঙ্গে ঠিক মেলে না। বড়ো কথা একলাই একটানা বলিয়া যাওয়া চলে, অন্য পক্ষ মন দিল কি না খেয়াল না করিলেই হয়, কিন্তু তুচ্ছ কথায় নিয়ত দুই পক্ষের যোগ থাকা চাই ; বাঁশি একাই বাজিতে পারে, কিন্তু দুইয়ের মিল না থাকিলে করতালের খচমচ জমে না। এইজন্যে কত সন্ধ্যাবেলায় যতীন মণির সঙ্গে যখন খোলা বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে, দুটো-চারটে টানাবোনা কথার পরেই কথার সূত্র একেবারে ছিঁড়িয়া ফাঁক হইয়া গেছে ; তাহার পরে সন্ধ্যার নীরবতা যেন লজ্জায় মরিতে চাহিয়াছে। যতীন বুঝিতে পারিয়াছে, মণি পালাইতে পারিলে বাঁচে; মনে মনে কামনা করিয়াছে, এখনই কোনো একজন তৃতীয় ব্যক্তি যেন আসিয়া পড়ে। কেননা, দুই জনে কথা কহা কঠিন, তিন জনে সহজ।

মণি আসিলে আজ কেমন করিয়া কথা আরম্ভ করিবে, যতীন তাহাই ভাবিতে লাগিল। ভাবিতে গেলে কথাগুলো কেমন অস্বাভাবিক রকম বড়ো হইয়া পড়ে— সে-সব কথা চলিবে না। যতীনের আশঙ্কা হইতে লাগিল, আজকের রাত্রের পাঁচ মিনিটও ব্যর্থ হইবে। অথচ,তাহার জীবনে এমনতরো নিরালা পাঁচ মিনিট আর কটাই বা বাকি আছে।

পর্ব- ৩

“একি, বউ, কোথাও যাচ্ছ না কি।”

“সীতারামপুরে যাব।”

“সে কী কথা। কার সঙ্গে যাবে।”

“অনাথ নিয়ে যাচ্ছে।”

“লক্ষী মা আমার, তুমি যেয়ো, আমি তোমাকে বারণ করব না, কিন্তু আজ নয়।”

“টিকিট কিনে গাড়ি রিজার্ভ করা হয়ে গেছে।”

“তা হোক, ও লোকসান গায়ে সইবে— তুমি কাল সক্কালেই চলে যেয়ো— আজ যেয়ো না।”

“মাসি, আমি তোমাদের তিথি বার মানি নে, আজ গেলে দোষ কী।”

“যতীন তোমাকে ডেকেছে, তোমার সঙ্গে তার একটু কথা আছে।”

“বেশ তো, এখনো একটু সময় আছে, আমি তাঁকে ব’লে আসছি।”

“না, তুমি বলতে পারবে না যে যাচ্ছ।”

“তা বেশ, কিছু বলব না, কিন্তু আমি দেরি করতে পারব না। কালই অন্নপ্রাশন— আজ যদি না যাই তো চলবে না।”

“আমি জোড়হাত করছি, বউ, আমার কথা আজ একদিনের মতো রাখো। আজ মন একটু শান্ত করে যতীনের কাছে এসে বসো— তাড়াতাড়ি কোরো না।”

“তা, কী করব বলো, গাড়ি তো আমার জন্যে বসে থাকবে না। অনাথ চলে গেছে— দশ মিনিট পরেই সে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এই বেলা তাঁর সঙ্গে দেখা সেরে আসি গে।”

“না, তবে থাক— তুমি যাও। এমন করে তার কাছে যেতে দেব না। ওরে অভাগিনী, তুই যাকে এত দুঃখ দিলি সে তো সব বিসর্জন দিয়ে আজ বাদে কাল চলে যাবে— কিন্তু যত দিন বেঁচে থাকবি এ দিনের কথা তোকে চিরদিন মনে রাখতে হবে— ভগবান আছেন, ভগবান আছেন, সে কথা একদিন বুঝবি।”

“মাসি, তুমি অমন ক’রে শাপ দিয়ো না বলছি! ”

“ওরে বাপরে, আর কেন বেঁচে আছিস রে বাপ। পাপের যে শেষ নেই— আমি আর ঠেকিয়া রাকতে পারলুম না।”

মাসি একটু দেরি করিয়া রোগীর ঘরে গেলেন। আশা করিলেন, যতীন ঘুমাইয়া পড়িবে। কিন্তু ঘরে ঢুকিতেই দেখিলেন, বিছানার উপর যতীন নড়িয়া-চড়িয়া উঠিল। মাসি বলিলেন, “এই এক কাণ্ড করে বসেছে।”

“কী হয়েছে। মণি এল না? এত দেরি করলে কেন, মাসি।”

“গিয়ে দেখি, সে তোমার দুধ জ্বাল দিতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে ব’লে কান্না। আমি বলি, ‘হয়েছে কী, আরো তো দুধ আছে।’ কিন্তু, অসাবধান হয়ে তোমার খাবার দুধ পুড়িয়ে ফেলেছে, বউয়ের এ লজ্জা আর কিছুতেই যায় না। আমি তাকে অনেক ক’রে ঠাণ্ডা ক’রে বিছানায় শুইয়ে রেখে এসেছি। আজ আর তাকে আনলুম না। সে একটু ঘুমোক।”

মণি আসিল না বলিয়া যতীনের বুকের মধ্যে যেমন বাজিল, তেমনি সে আরামও পাইল। তাহার মনে আশঙ্কা ছিল যে, পাছে মণি সশরীরে আসিয়া মণির ধ্যান-মাধুরীটুকুর প্রতি জুলুম করিয়া যায়। কেননা,তাহার জীবনে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে। দুধ পুড়াইয়া ফেলিয়া মণির কোমল হৃদয় অনুতাপে ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে, ইহারই রসটুকুতে তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিতে লাগিল।

“মাসি! ”

“কী, বাবা।”

“আমি বেশ জানছি, আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু, আমার মনে কোনো খেদ নেই। তুমি আমার জন্যে শোক কোরো না।”

“না, বাবা, আমি শোক করব না। জীবনেই যে মঙ্গলই আর মরণে যে নয়, এ কথা আমি মনে করি নে।”

“মাসি, তোমাকে সত্য বলছি, মৃত্যুকে আমার মধুর মনে হচ্ছে।”

অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাইয়া যতীন দেখিতেছিল,তাহার মণিই আজ মৃত্যুর বেশ ধরিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে আজ অক্ষয় যৌবনে পূর্ণ– সে গৃহিণী,সে জননী; সে রূপসী, সে কল্যাণী। তাহারই এলোচুলের উপরে ঐ আকাশের তারাগুলি লক্ষীর স্বহস্তের আর্শীবাদের মালা। তাহাদের দুজনের মাথার উপরে এই অন্ধকারের মঙ্গলবস্ত্রখানি মেলিয়া ধরিয়া আবার যেন নূতন করিয়া শুভদৃষ্টি হইল। রাত্রির এই বিপুল অন্ধকার ভরিয়া গেল মণির অনিমেষ প্রেমের দৃষ্টিপাতে। এই ঘরের বধূ মণি, এই একটুখানি মণি, আজ বিশ্বরূপ ধরিল; জীবনমরণের সংগমতীর্থে ঐ নক্ষত্রবেদীর উপরে সে বসিল ; নিস্তব্ধ রাত্রি মঙ্গলঘটের মতো পুণ্যধারায় ভরিয়া উঠিল। যতীন জোড়হাত করিয়া মনে মনে কহিল, ‘এতদিনের পর ঘোমটা খুলিল, এই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে আবরণ ঘুচিল— অনেক কাঁদাইয়াছ— সুন্দর,হে সুন্দর,তুমি আর ফাঁকি দিতে পারিবে না।’

 

পর্ব- ৪

“কষ্ট হচ্ছে, মাসি, কিন্তু যত কষ্ট মনে করছ তার কিছুই নয়। আমার সঙ্গে আমার কষ্টের ক্রমশই যেন বিচ্ছেদ হয়ে আসছে। বোঝাই নৌকার মতো এতদিন সে আমার জীবন-জাহাজের সঙ্গে বাঁধা ছিল; আজ যেন বাঁধন কাটা পড়েছে, সে আমার সব বোঝা নিয়ে দূরে ভেসে চলল। এখনো তাকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তাকে যেন আর আমার ব’লে মনে হচ্ছে না— এ দুদিন মণিকে একবারও দেখি নি, মাসি।”

“পিঠের কাছে আর-একটা বালিশ দেব কি যতীন।”

“আমার মনে হচ্ছে, মাসি, মণিও যেন চলে গেছে। আমার বাঁধন-ছেঁড়া দুঃখের নৌকাটির মতো।”

“বাবা, একটু বেদানার রস খাও, তোমার গলা শুকিয়ে আসছে।”

“আমার উইলটা কাল লেখা হয়ে গেছে – সে কি আমি তোমাকে দেখিয়েছি— ঠিক মনে পড়ছে না।”

“আমার দেখবার দরকার নেই, যতীন।”

“মা যখন মারা যান আমার তো কিছুই ছিল না। তোমার খেয়ে তোমার হাতে আমি মানুষ, তাই বলছিলুম—”

“সে আবার কী কথা। আমার তো কেবল এই একখানা বাড়ি আর সামান্য কিছু সম্পত্তি ছিল। বাকি সবই তো তোমার নিজের রোজগার।”

“কিন্তু এই বাড়িটা—”

“কিসের বাড়ি আমার! কত দালান তুমি বাড়িয়েছ, আমার সেটুকু কোথায় আছে খুঁজেই পাওয়া যায় না।”

“মণি তোমাকে ভিতরে ভিতরে খুব—”

“সে কি জানি নে, যতীন। তুই এখন ঘুমো।”

“আমি মণিকে সব লিখে দিলুম বটে, কিন্তু তোমারই সব রইল, মাসি। ও তো তোমাকে কখনো অমান্য করবে না।”

“সে জন্য অত ভাবছ কেন, বাছা।”

“তোমার আশীর্বাদেই আমার সব, তুমি আমার উইল দেখে এমন কথা কোনোদিন মনে কোরো না—”

“ও কী কথা যতীন। তোমার জিনিস তুমি মণিকে দিয়েছ বলে আমি মনে করব? আমার এমনি পোড়া মন? তোমার জিনিস ওর নামে লিখে দিয়ে যেতে পারছ বলে তোমার যে-সুখ সেই তো আমার সকল সুখের বেশি,বাপ।”

“কিন্তু, তোমাকেও আমি –”

“দেখ্‌, যতীন, এইবার আমি রাগ করব। তুই চলে যাবি,আর তুই আমাকে টাকা দিয়ে ভুলিয়ে রেখে যাবি? ”

“মাসি, টাকার চেয়ে আরো বড়ো যদি কিছু তোমাকে—”

“দিয়েছিস, যতীন, ঢের দিয়েছিস। আমার শূন্য ঘর ভ’রে ছিলি, এ আমার অনেক জন্মের ভাগ্য। এতদিন তো বুক ভ’রে পেয়েছি, আজ আমার পাওনা যদি ফুরিয়ে গিয়ে থাকে তো নালিশ করব না। দাও, সব লিখে দাও, লিখে দাও— বাড়িঘর, জিনিসপত্র, ঘোড়াগাড়ি, তালুকমুলুক— যা আছে সব মণির নামে লিখে দাও— এ-সব বোঝা আমার সইবে না।”

“তোমার ভোগে রুচি নেই— কিন্তু মণির বয়স অল্প, তাই— ”

“ও কথা বলিস নে, ও কথা বলিস নে। ধনসম্পদ দিতে চাস দে, কিন্তু ভোগ করা—”

“কেন ভোগ করবে না, মাসি।”

“না গো না, পারবে না, পারবে না! আমি বলছি, ওর মুখে রুচবে না! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে, কিছুতেই কোনো রস পাবে না।”

যতীন চুপ করিয়া রহিল। তাহার অভাবে সংসারটা মণির একেবারে বিস্বাদ হইয়া যাইবে, এ কথা সত্য কি মিথ্যা, সুখের কি দুঃখের, তাহা সে যেন ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিল না, আকাশের তারা যেন তাহার হৃদয়ের মধ্যে আসিয়া কানে কানে বলিল, ‘এমনিই বটে— আমরা তো হাজার হাজার বছর হইতে দেখিয়া আসিলাম, সংসার-জোড়া এই-সমস্ত আয়োজন এত-বড়োই ফাঁকি।”

যতীন গভীর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “দেবার মতো জিনিস তো আমরা কিছুই দিয়ে যেতে পারি নে।”

“কম কী দিয়ে যাচ্ছ, বাছা। এই ঘরবাড়ি টাকাকড়ি ছল ক’রে তুমি ওকে যে কী দিয়ে গেলে তার মূল্য ও কি কোনোদিন বুঝবে না। যা তুমি দিয়েছ তাই মাথা পেতে নেবার শক্তি বিধাতা ওকে দিন, এই আর্শীবাদ ওকে করি।”

“আর একটু বেদানার রস দাও, আমার গলা শুকিয়ে এসেছে। মণি কি কাল এসেছিল— আমার ঠিক মনে পড়ছে না।”

“এসেছিল। তখন তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। শিয়রের কাছে ব’সে ব’সে অনেকক্ষণ বাতাস করে তার পরে ধোবাকে তোমার কাপড় দিতে গেল।”

“আশ্বর্য! বোধ হয় আমি ঠিক সেই সময়েই স্বপ্ন দেখছিলুম, যেন মণি আমার ঘরে আসতে চাচ্ছে— দরজা অল্প-একটু ফাঁক হয়েছে— ঠেলাঠেলি করছে কিন্তু কিছুতেই সেইটুকুর বেশি আর খুলছে না। কিন্তূ, মাসি, তোমরা একটু বাড়াবাড়ি করছ— ওকে দেখতে দাও যে আমি মরছি— নইলে মৃত্যুকে হঠাৎ সইতে পারবে না।”

“বাবা, তোমার পায়ের উপরে এই পশমের শালটা টেনে দিই— পায়ের তেলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।”

“না, মাসি, গায়ের উপর কিছু দিতে ভালো লাগছে না।”

“জানিস, যতীন? এই শালটা মণির তৈরি, এতদিন রাত জেগে জেগে সে তোমার জন্যে তৈরি করছিল। কাল শেষ করেছে।”

যতীন শালটা লইয়া দুই হাত দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করিল। মনে হইল পশমের কোমলতা যেন মণির মনের জিনিস; সে যে যতীনকে মনে করিয়া রাত জাগিয়া এইটি বুনিয়াছে, তাহার মনের সেই প্রেমের ভাবনাটি ইহার সঙ্গে গাঁথা পড়িয়াছে। কেবল পশম দিয়া নহে, মণির কোমল আঙুলের স্পর্শ দিয়া ইহা বোনা। তাই মাসি যখন শালটা তাহার পায়ের উপর টানিয়া দিলেন তখন তাহার মনে হইল, মণিই রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া তাহার পদসেবা করিতেছে।

“কিন্তু, মাসি, আমি তো জানতুম, মণি সেলাই করতে পারে না— সে সেলাই করতে ভালোই বাসে না।”

“মন দিলে শিখতে কতক্ষণ লাগে। তাকে দেখিয়ে দিতে হয়েছে— ওর মধ্যে অনেক ভুল সেলাইও আছে।”

“তা ভুল থাক্‌-না। ও তো প্যারিস এক্‌জিবিশনে পাঠানো হবে না— ভুল সেলাই দিয়ে আমার পা ঢাকা বেশ চলবে।”

সেলাইয়ে যে অনেক ভুল-ত্রুটি আছে সেই কথা মনে করিয়াই যতীনের আরো বেশি আনন্দ হইল। বেচারা মণি পারে না, জানে না, বার বার ভুল করিতেছে,তবু ধৈর্য ধরিয়া রাত্রির পর রাত্রি সেলাই করিয়া চলিয়াছে— এই কল্পনাটি তাহার কাছে বড়ো করুণ,বড়ো মধুর লাগিল। এই ভুলে-ভরা শালটাকে আবার সে একটু নাড়িয়া-চাড়িয়া লইল।

“মাসি, ডাক্তার বুঝি নীচের ঘরে? ”

“হাঁ, যতীন, আজ রাত্রে থাকবেন।”

“কিন্তু আমাকে যেন মিছামিছি ঘুমের ওষুধ দেওয়া না হয়। দেখেছ তো, ওতে আমার ঘুম হয় না, কেবল কষ্ট বাড়ে। আমাকে ভালো ক’রে জেগে থাকতে দাও। জান, মাসি? বৈশাখ-দ্বাদশীর রাত্রে আমাদের বিয়ে হয়েছিল— কাল সেই দ্বাদশী আসছে— কাল সেইদিনকার রাত্রের সব তারা আকাশে জ্বালানো হবে। মণির বোধ হয় মনে নেই— আমি তাকে সেই কথাটি আজ মনে করিয়ে দিতে চাই ; কেবল তাকে তুমি দু মিনিটের জন্যে ডেকে দাও। চুপ ক’রে রইলে কেন। বোধ হয় ডাক্তার তোমাদের বলেছে,আমার শরীর দুর্বল, এখন যাতে আমার মনে কোনো— কিন্তু, আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি, মাসি, আজ রাত্রে তার সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নিতে পারলে আমার মন খুব শান্ত হয়ে যাবে— তা হলে বোধ হয় আর ঘুমোবার ওষুধ দিতে হবে না। আমার মন তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে বলেই,এই দু রাত্রি আমার ঘুম হয় নি। মাসি, তুমি অমন করে কেঁদো না। আমি বেশ আছি,আমার মন আজ যেমন ভরে উঠেছে,আমার জীবনে এমন আর কখনোই হয় নি। সেইজন্যই আমি মণিকে ডাকছি। মনে হচ্ছে,আজ যেন আমার ভরা হৃদয়টি তার হাতে দিয়ে যেতে পারব। তাকে অনেক দিন অনেক কথা বলতে চেয়েছিলুম, বলতে পারি নি, কিন্তু আর এক মুহূর্ত দেরি করা নয়, তাকে এখনি ডেকে দাও— এর পরে আর সময় পাব না। না,মাসি,তোমার ঐ কান্না আমি সইতে পারি নে। এতদিন তো শান্ত ছিলে, আজ কেন তোমার এমন হল।”

“ওরে যতীন, ভেবেছিলুম, আমার সব কান্না ফুরিয়ে গেছে— কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, এখনো বাকি আছে, আজ আর পারছি নে।”

“মণিকে ডেকে দাও— তাকে ব’লে দেব কালকে রাতের জন্যে যেন— ”

“যাচ্ছি, বাবা। শম্ভু দরজার কাছে রইল, যদি কিছু দরকার হয় ওকে ডেকো।”

মাসি মণির শোবার ঘরে গিয়ে মেজের উপর বসিয়া ডাকিতে লাগিলেন, “ওরে,আয়— একবার আয়— আয় রে রাক্ষসী,যে তোকে তার সব দিয়েছে তার শেষ কথাটি রাখ্‌— সে মরতে বসেছে,তাকে আর মারিস নে।”

যতীন পায়ের শব্দে চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “মণি! ”

“না, আমি শম্ভু। আমাকে ডাকছিলেন? ”

“একবার তোর বউঠাকরুনকে ডেকে দে।”

“কাকে? ”

“বউঠাকরুনকে।”

“তিনি তো এখনো ফেরেন নি।”

“কোথায় গেছেন? ”

“সীতারামপুরে।”

“আজ গেছেন? ”

“না, আজ তিন দিন হল গেছেন।”

ক্ষণকালের জন্য যতীনের সর্বাঙ্গ ঝিম্‌ঝিম্‌ করিয়া আসিল— সে চোখে অন্ধকার দেখিল। এতক্ষণ বালিশে ঠেসান দিয়া বসিয়াছিল, শুইয়া পড়িল। পায়ের উপর সেই পশমের শাল ঢাকা ছিল, সেটা পা দিয়া ঠেলিয়া দিল।

অনেকক্ষণ পরে মাসি যখন আসিলেন যতীন মণির কথা কিছুই বলিল না। মাসি ভাবিলেন, সে কথা উহার মনে নাই।

হঠাৎ যতীন এক সময়ে বলিয়া উঠিল, “মাসি, তোমাকে কি আমার সেদিনকার স্বপ্নের কথা বলেছি।”

“কোন্‌ স্বপ্ন।”

“মণি যেন আমার ঘরে আসবার জন্য দরজা ঠেলছিল— কোনোমতেই দরজা এতটুকুর বেশি ফাঁক হল না, সে বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল,কিন্তু কিছুতেই ঢুকতে পারল না। মণি চিরকাল আমার ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। তাকে অনেক ক’রে ডাকলুম, কিন্তু এখানে তার জায়গা হল না।”

মাসি কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। ভাবিলেন, ‘যতীনের জন্য মিথ্যা দিয়া যে একটুখানি স্বর্গ রচিতেছিলাম সে আর টিঁকিল না। দুঃখ যখন আসে তাহাকে স্বীকার করাই ভালো— প্রবঞ্চনার দ্বারা বিধাতার মার ঠেকাইবার চেষ্টা করা কিছু নয়।’

“মাসি,তোমার কাছে যে স্নেহ পেয়েছি সে আমার জন্মজন্মান্তরের পাথেয়, আমার সমস্ত জীবন ভ’রে নিয়ে চললুম। আর-জন্মে তুমি নিশ্চয় আমার মেয়ে হয়ে জন্মাবে, আমি তোমাকে বুকে করে মানুষ করব।”

“বলিস কী যতীন, আবার মেয়ে হয়ে জন্মাব? নাহয়,তোরই কোলে ছেলে হয়েই জন্ম হবে— সেই কামনাই কর্ -না।”

“না, না, ছেলে না। ছেলেবেলায় তুমি যেমন সুন্দরী ছিলে তেমনি অপরূপ সুন্দরী হয়েই তুমি আমার ঘরে আসবে। আমার মনে আছে, আমি তোমাকে কেমন করে সাজাব।”

“আর বকিস্‌ নে, যতীন, বকিস্‌ নে— একটু ঘুমো।”

“তোমার নাম দেব লক্ষ্মীরানী।”

“ও তো একেলে নাম হল না।”

“না, একেলে নাম না। মাসি, তুমি আমার সাবেক-কেলে— সেই সাবেক কাল নিয়েই তুমি আমার ঘরে এসো।”

“তোর ঘরে আমি কন্যাদায়ের দুঃখ নিয়ে আসবে, এ কামনা আমি তো করতে পারি নে।”

“মাসি, তুমি আমাকে দুর্বল মনে কর?— আমাকে দুঃখ থেকে বাঁচাতে চাও? ”

“বাছা,আমার যে মেয়েমানুষের মন,আমিই দুর্বল— সেইজন্যেই আমি বড়ো ভয়ে ভয়ে তোকে সকল দুঃখ থেকে চিরদিন বাঁচাতে চেয়েছি। কিন্তু,আমার সাধ্য কী আছে। কিছুই করতে পারি নি।”

“মাসি, এ জীবনের শিক্ষা আমি এ জীবনে খাটাবার সময় পেলুম না। কিন্তু, এ সমস্তই জমা রইল, আসছে বারে মানুষ যে কী পারে তা আমি দেখাব। চিরটা দিন নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা যে ফাঁকি, তা আমি বুঝেছি।”

“যাই বল, বাছা, তুমি নিজে কিছু নাও নি,পরকেই সব দিয়েছ।”

“মাসি, একটা গর্ব আমি করব, আমি সুখের উপরে জবরদস্তি করি নি— কোনোদিন এ কথা বলি নি, যেখানে আমার দাবি আছে সেখানে আমি জোর খাটাব। যা পাই নি তা কাড়াকাড়ি করি নি। আমি সেই জিনিস চেয়েছিলুম যার উপরে কারো স্বত্ব নেই –সমস্ত জীবন হাতজোড় করে অপেক্ষাই করলুম ; মিথ্যাকে চাই নি ব’লেই এতদিন এমন ক’রে বসে থাকতে হল— এইবার সত্য হয়তো দয়া করবেন। ও কে ও— মাসি,ও কে।”

“কই, কেউ তো না,যতীন।”

“মাসি, তুমি একবার ও ঘরটা দেখে এসো গে,আমি যেন— ”

“না, বাছা, কাউকে তো দেখলুম না।”

“আমি কিন্তু স্পষ্ট যেন—”

“কিচ্ছু না যতীন— ঐ যে ডাক্তারবাবু এসেছেন।”

“দেখুন,আপনি ওঁর কাছে থাকলে উনি বড়ো বেশি কথা কন। কয়রাত্রি এমনি ক’রে তো জেগেই কাটালেন। আপনি শুতে যান, আমার সেই লোকটি এখানে থাকবে।”

“না, মাসি, না, তুমি যেতে পাবে না।”

“আচ্ছা, বাছা, আমি নাহয় ঐ কোণটাতে গিয়ে বসছি।”

“না, না, তুমি আমার পাশেই বসে থাকো— আমি তোমার এ হাত কিছুতেই ছাড়ছি নে— শেষ পর্যন্ত না। আমি যে তোমারই হাতের মানুষ, তোমারই হাত থেকে ভগবান আমাকে নেবেন।”

“আচ্ছা বেশ, কিন্তু আপনি কথা কবেন না, যতীনবাবু। সেই ওষুধটা খাওয়াবার সময় হল—”

“সময় হল? মিথ্যা কথা। সময় পার হয়ে গেছে— এখন ওষুধ খাওয়ানো কেবল ফাঁকি দিয়ে সান্ত্বনা করা। আমার তার কোনো দরকার নেই। আমি মরতে ভয় করি নে। মাসি,যমের চিকিৎসা চলছে, তার উপরে আবার সব ডাক্তার জড়ো করেছ কেন— বিদায় করে দাও, সব বিদায় ক’রে দাও। এখন আমার একমাত্র তুমি— আর আমার কাউকে দরকার নেই— কাউকে না— কোনো মিথ্যাকেই না।”

“আপনার এই উত্তেজনা ভালো হচ্ছে না।”

“তা হলে তোমরা যাও, আমাকে উত্তেজিত কোরো না।— মাসি, ডাক্তার গেছে? আচ্ছা, তা হলে তুমি এই বিছানায় উঠে বোসো— আমি তোমার কোলে মাথা দিয়ে একটু শুই।”

“আচ্ছা, শোও, বাবা, লক্ষ্মীটি, একটু ঘুমোও।”

“না, মাসি, ঘুমোতে বোলো না— ঘুমোতে ঘুমোতে হয়তো আর ঘুম ভাঙবে না। এখনো আর-একটু আমার জেগে থাকবার দরকার আছে। তুমি শব্দ শুনতে পাচ্ছ না? ঐ যে আসছে। এখনই আসবে।”

পর্ব- ৫

“বাবা যতীন, একটু চেয়ে দেখো— ঐ যে এসেছে। একবারটি চাও।”

“কে এসেছে। স্বপ্ন? ”

“স্বপ্ন নয়, বাবা, মণি এসেছে— তোমার শ্বশুর এসেছেন।”

“তুমি কে? ”

“চিনতে পারছ না, বাবা, ঐ তো তোমার মণি।”

“মণি, সেই দরজাটা কি সব খুলে গিয়েছে।”

“সব খুলেছে, বাপ আমার, সব খুলেছে।”

“না মাসি, আমার পায়ের উপর ও শাল নয়, ও শাল নয়, ও শাল মিথ্যে, ও শাল ফাঁকি।”

“শাল নয়,যতীন। বউ তোর পায়ের উপর পড়েছে— ওর মাথায় হাত রেখে একটু আশীর্বাদ কর্।— অমন করে কাঁদিস নে, বউ,কাঁদবার সময় আসছে— এখন একটুখানি চুপ কর্।”

 

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments