মউলির রাত (ঋজুদা) – বুদ্ধদেব গুহ
কাড়ুয়া
একপাশে গোন্দা বাঁধ, অন্য পাশে শালের জঙ্গল, টাঁড়; বড় বড় মহুয়া ও অশ্বত্থ গাছ। মধ্যে দিয়ে লাল পাথুরে পথটা করোগেটেড শিটের মতো ঢেউ খেলানো। সেই পথ ছেড়ে পায়ে-চলা পথে তিতির আর কালিতিতিরের ডাক শুনতে শুদতে খোয়াইয়ে ও টাঁড়ে টাঁড়ে হেঁটে গেলে একটু এগিয়ে গিয়েই বোকারো নদী পড়ে। নদীর হাঁটুজল পেরিয়ে অন্য পাশের খাড়া পাড় ডিঙিয়ে আরও আধ মাইলটা গেলেই কুসুভা গ্রাম।
প্রথম আমার সঙ্গে কাড়ুয়ার এখানেই দেখা হয়। সেদিনটার কথা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে।
গাঁয়ের সীমানায় ও কতগুলো কালো ছাগল চরাচ্ছিল। এক ফালি কাপড় মালকোচা মেরে পরা। হাতে একটা ছোট লাঠি। মাথার চুল কদম-ছাঁটে ছাঁটা–পিছনে একটা আধহাত লম্বা টিকি।
ছেলেটাকে দেখতে একেবারে কাকতাড়ুয়ার মতো।
আমাদের দেখতে পেয়েই কাড়ুয়া দৌড়ে এল। তাড়াতাড়িতে আসতে গিয়ে একটা ছাগল-ছানার পা মাড়িয়ে দিল। সেটা ব্যাঁ–অ্যা–অ্যা করে ডেকে উঠল।
কাড়ুয়া যখন এগিয়ে আসছিল, ঠিক সেই সময় দেখি ওর পিছনে পিছনে একটা এক-ঠ্যাঙা সাদা গোবক লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে।
কাড়ুয়া এসে কোমর ঝুঁকিয়ে বলল, পরনাম।
গোপালের পুরোনো সাকরেদ ও। গোপাল আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।
কাড়ুয়ার কথা এত শুনেছি যে, নতুন করে শোনার কিছু ছিল না। আমাদের দেখামাত্র ছাগলদের আপন মনে চরতে দিয়ে ও আমাদের সঙ্গে হেঁটে চলল। খোঁড়া বকটাকে কোলে তুলে নিল।
গোপাল বকটার গায়ে হাত ভুলিয়ে আদর করে দিয়ে বলল, কেয়ারে বগুলা, আচ্ছা হ্যায়?
বগুলা মুখ ঘুরিয়ে গোপালের দিকে তাকাল।
দেখলাম, তার এক চোখ কানা।
গোপাল বলল, এ হচ্ছে কাড়ুয়ার বুজুম-ফ্রেণ্ড।
কাড়ুয়াদের গ্রামে একটা বড় দাঁতাল শুয়োর খুব অত্যাচার আরম্ভ করেছে। কাড়ুয়াও শিকারী। ওর নিজের একটা গাদাবন্দুক আছে। গোপাল সেটার নাম দিয়েছে যন্তর।
কাড়ুয়ার বন্দুকটা সম্বন্ধে একটু বলে নিই। বন্দুকটা কথাটথা বলত কাড়ুয়ার সঙ্গে। একেবারে মন-মৌজী বন্দুক। রাতে হয়তো ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে– কাড়ুয়ার মাটির ঘরের দেওয়ালে বন্দুকটা টাঙানো আছে– হঠাৎ বন্দুক ফিসফিস করে কাড়ুয়াকে বলল, শটিক্ষেতোয়ামে শুয়ার আওল বা।
কাড়ুয়া শুনতে না পেলে আবারও বলল আর একটু জোরে, আর অমনি কাড়ুয়া হুম্মচকে তিন অংগুলি ককে বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শটিক্ষেতের উদ্দেশে।
হুম্মচকে মানে বাংলায় কী বলব জানি না। ধরো, বলা যায়, তেড়ে-খুঁড়ে। আর তিন অংগুলি কত্সকে মানে হচ্ছে, জোরসে তিন আঙুল বারুদ গাদা বন্দুকে পুরে। জানোয়ার বুঝে ঐ বন্দুকে বারুদ গাদাগাদির তফাত হয়। মুরগী মারতে এক আঙুল, কোটরা হরিণ মারতে দু আঙুল, তার চেয়ে বড় জানোয়ার মারতে তিন আঙুল। আরও বেশি আঙুল গাদলে অনেক সময় বন্দুকের মুঙ্গেরী নল ফেটে গিয়ে শিকারীই হয়তো আঙুল-হারা হয়ে যায়। শিকার-ফিকার করলে এসব রিসক্ একটু থাকেই। কী করা যাবে!
আমরা গিয়ে গাঁয়ের তেঁতুলতলায় বসলাম, আসোয়ার ঘরের পাশে। খিচুড়ি চাপালাম। খেয়ে-দেয়ে ঘুম। তারপর সন্ধের পর শুয়োরের কল্যাণে লাগা যাবে।
কাড়ুয়া স্বভাবকবি। ইতিমধ্যেই শুয়োরটার উপরে একটা কবিতা বানিয়ে ফেলেছে দেখলাম।
“আর এ-এ শুয়ারোয়া
ব–ড়কা শুয়ারোয়,
কা–কহি তুমহারা বাত
ছুপকে ছুপকে গাওমে ঘুষতা
হর শনি–চ্চর রাত।
কালা বিলকু বদন তুমহারা
হাসসে ভি কালা, কোই বাত্?
ভোগল-ভুচুন্দর বড়কা ছুছন্দর
কিঁউ মজা হামারি সাথ?
বোলা লিয়া ম্যায় দোস্তলোগোঁকো
নিকা লেগা তেরী দাঁত,
গোপালবাবু লায়া ভোপাসে বন্দুক
আজ-হি আখীর কা রাত।”
গোপাল বলল, সাবাস্ সাবাস্ সাবাস্! বহত্-খুউব।
তারপর ও বলল, কাড়ুয়া, তোকে নিয়ে আমিও একটা কবিতা লিখেছি, শোন্ বলি।
কাড়ুয়া টিকিটা এদিক-ওদিক নাড়িয়ে কুচকুচে কালো মুখে সাদা দাঁতের সুন্দর হাসি হেসে বলল, বোলো গোপালবাবু, বোলো–
গোপাল ছড়ার মতো করে ছন্দ মিলিয়ে বলল :
“আরে এ–এ কাড়ুয়ারে
কাক–হি তাড়য়ারে,
তুমহারা নেহি কোই জওয়াব–
বগুলাসে দোস্তি, খাতা হায় জাস্তি
তিতিরকা বনা-হুঁয়া কাবাব।
শোচ্ সমঝ কর, শিকার তু খেলনা,
কই রোজ ঝামেলামে গিড়ে গা–
বড়কা শুয়ারোয়া দাঁতোয়া ঘুষানেসে
দাওয়াই ত হিয়া নেহি মিলেগা।
বহত সামহাকে কদম বাড়হা তু
জলদি বাজী নেহি, আইস–তা–
তিন–অংগলি ককে,
হু-হু-হু হুম্মিচ্কে–
শুয়ার্কা পেট তব্হি ফাসতা।”
আমি তো দুই কবিয়ালের কবিতা শুনে থ!
সন্ধের পর পরই গোপাল আর কাড়ুয়ার সঙ্গে নয়াতালাওর পাশের শটিক্ষেতের দিকে রওনা হলাম আমরা।
বর্ষাকাল। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেঘগর্জনের সঙ্গে। সেই বিজলীতে চতুর্দিকের জঙ্গল আর টাঁড় রুপোলি আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে।
আমরা গ্রামের দেওতার ঠাঁই পেরিয়ে, ঝুরিওয়ালা অশ্বথ গাছটার পাশ দিয়ে অনেকখানি হেঁটে গিয়ে নয়াতালাওর পাশের শটিক্ষেতে গিয়ে উপস্থিত হলাম।
কাড়ুয়া দেখাল শুয়োটা সাধারণত কোন দিক দিয়ে এসে ঢোকে শটিক্ষেতে।
আমরা তিনজনে ভিজে মাটির উপরেই সাপ-খোপ বাঁচিয়ে শটিক্ষেতের আড়ালে গা-লুকিয়ে বসলাম।
গোপাল মারবে আগে। কোন এক মহারাজার পরিবারের এক লোকের কাছ থেকে সদ্য-কেনা বারো বোরের ওভার-আণ্ডার দশ-হাজারী বন্দুক দিয়ে। গোপালের নিবেদনের পর, কাড়ুয়া তার মুঙ্গেরী গাদা বন্দুক দিয়ে মহার্ঘ্য নিবেদন করবে।
আমি দর্শক।
বসে বসে মশার কামড় খেয়ে খেয়ে সারা গা-মুখ সিন্দুরের মতো লাল হয়ে উঠল। শুয়োরের বাচ্চার কোনও পাত্তা নেই।
বোধ হয় ঘণ্টা দুয়েক বসে থাকার পর তিনি এলেন। দাঁতের জোরে এবং লাথি মেরে মেরে ভিজে নরম মাটি ফুলঝুরির মতো ছিটোতে ছিটোতে এবং শটিগাছ ও কচুগাছ উপড়োতে উপড়োতে আসতে লাগলেন।
জঙ্গলের দিক থেকে একটা ভিজে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল। গা শিরশির করছিল। চারধারে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, আমার পেছনে একটা পন্ন গাছ আছে। আমিই একমাত্র নিরস্ত্র।
শুয়োরটা দেখতে দেখতে একেবারে কাছে এসে গেল।
এমন সময় মেঘ ফুঁড়ে এক ফালি চাঁদ বেরোল। সেই চাঁদের লাজুক আলোয় শুয়োরটার ইয়া-ইয়া দাঁত দুটো চৰ্চ করছিল।
গোপাল ভাল করে নিশানা নিয়ে গুলি করল। কিন্তু গুলি হল না। কট করে আওয়াজ হল একটা।
আওয়াজটা শুনেই শুয়োরটা শটি খাওয়া থামিয়ে এদিকে মুখ তুলল।
গোপাল আবার মারল। আবারও কটু। নট-কিচ্ছু।
এবার শুয়োরটা আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
কলকাতা থেকে আসার আগে নতুন গুলি নিয়ে এসেছিল গোপাল চৌরঙ্গীর এক দোকান থেকে। দু-দুটো এল-জির একটাও ফুটল না। দোকানদার গোপালের বন্ধু। বিনি পয়সার গুলি তো। বড় ভালবাসার গুলি।
আবারও গুলি ভরার জন্যে ও যেই বন্দুকটা খুলেছে, ইজেকটরটা গুলি দুটোকে পটাং শব্দ করে বাইরে যেই ছুঁড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে রে–রে করে বড়কা শুয়ারোয়া সটান আমাদের দিকে একটা ট্যাঙ্কের মতো তেড়ে এল।
আর আমি ওখানে থাকি?
এক দৌড়ে আমি পন্নন গাছে এসে উঠলাম।
ওদের ঘাড়ের কাছ দিয়ে আমার হুড়মুড় করে দৌড়ে পালানোর শব্দে গোপাল ও কাড়ুয়া চমকে উঠে ভাবল, অন্য একটা শুয়োর বুঝি অন্যদিক থেকে যুঁ মারার জন্যে তেড়ে আছে।
ওরা ব্যাপারটা কী বোঝার আগেই আমি গাছে।
ততক্ষণে শুয়োরটাও ওদের একেবারে কাছে এসে গেছে। গোপাল আর গুলি ভরার সময় পেল না। দেখলাম কাড়ুয়া ওর বন্দুকটাকে শুয়োরের দিকে বাগিয়ে ধরে কখন শুয়োরের নাকের সঙ্গে ওর বন্দুকের নলের ঠেকাঠেকি হয় সেই অপেক্ষায় প্রস্তুত হয়ে রইল। সেকেন্ডের মধ্যে শুয়োরও এসে পৌঁছল ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ করতে করতে আর ক রি বন্দুকও ছুটল।
দূর থেকে আবছা-আলোয় ঘটনাটা কী ঘটল বুঝলাম না। কিন্তু মারাত্মক কিছু যে একটা ঘটল, সেটা বুঝলাম। দেখলাম, তিনটে জিনিস তিনদিকে ছিটকে পড়ল আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে।
শুয়োরটা উল্টে পড়ে শটিক্ষেতে অনেকক্ষণ হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে গুচ্ছের শটিগাছ ভেঙে নষ্ট করে মাটি ছিটিয়ে একাক্কার করল। অনেকক্ষণ পর একেবারে স্থির হল।
কিন্তু শুয়োর-শিকারীরা নড়েও না, চড়েও না।
বড়ই বিপদে পড়লাম।
পরিস্থিতি শান্ত হলে, গাছ থেকে নেমে আমি পা টিপে টিপে ওদের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম।
গিয়ে যা দেখলাম, তা বলার নয়।
গোপাল তার ওভার-আণ্ডার বন্দুকের আণ্ডারে শুয়ে আছে। তার নাকটা বারুদে কালো।
কাড়ুয়া অজ্ঞান–তার সমস্ত মুখ, ডান হাত পুড়ে যাওয়ার মতো হয়ে গেছে।
আমি ওর গায়ে হাত ছোঁয়াতে, গোপাল কোঁকাতে কোঁকাতে উঠে বলল, কাড়ুয়ার বন্দুকের নল ফেটে গেছে।
আমি আতঙ্কিত গলায় বললাম, ক-আংগলি গেদেছিল?
গোপাল বলল, ও জানে!
এমন সময় কাড়ুয়া চার হাত-পায়ে কোনওরকমে উঠেই হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগল, হামারা বন্দুকোয়া, হামারা বন্দুকোয়া বলে।
গোপাল ধমক দিয়ে বলল, প্রাণে বেঁচে গেছিস, এই-ই ঢের; আর বন্দুকের জন্যে কেঁদে কাজ নেই।
কাড়ুয়া তবু কাঁদতে লাগল। বলতে লাগল, হাকো ভি এক গোলি ঠুক্ দেও, হাভি হামারা বন্দুককা সাথ মরনা চাহতা হ্যায়।
গোপাল কাড়ুয়ার মুখের দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল।
তারপর বলল, হামারা এক্কো গুলি নহী ফুট। শুয়ারকাই মারনে নহী শে, তুমকো মারেগা কৈসে?
