মেয়ে মানুষ, যে গল্পটি লিখেছেন রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ
বৈশাখের দুপরবেলা।
চপলা আধঘন্টা না ঘুমোতেই জেগে গেল। জানালার ফাঁক দিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো দেখা যায়—ফুল ঝরছে।
পাশের রুমে কড়া চুরুটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে—স্বামী অফিস থেকে ফিরে এসেছে তাহলে?
চপলা উঠে দাঁড়াল। চুরুট হাতে হেমেন্দ্র ঢুকলো; চপলার দিকে একবার তাকিয়ে বললে—মোটর ফিট করতে বলে দিয়েছি
চপলা আড়মোড়া দিয়ে বললে—থাক, আজ আর যাব না।
—বাঃ তুমিই তো বলেছিলে আজ শনিবার আছে—
—বলেছিলাম তো কিন্তু কোথায় যাব? সিনেমায়? কী আছে আজ? হেমেন বললে—দেখি কাগজটা নিয়ে আসি।
কাগজ নিয়ে হেমেন ঘরে ঢুকতেই চপলা বললে,—থাক্, সিনেমা, ভালো লাগে না।
হেমেন ঈষৎ হতাশ হয়ে বললে—মনসুনের আগে রেস তো আর শুরু হবে না—
—থাক রেসফেসে আর দরকার নেই—অনেক টাকা খুইয়ে—দেখি কাগজটা—
হেমেন কাগজটা স্ত্রীর দিকে ঠেলে দিয়ে অবসন্ন হয়ে একটা কুশনের ওপর বসে চুরুটটা হাতে করে হাঁফাতে লাগল। একটা কোলা ব্যাঙ যেন টাই বেঁধে ছিটের কোট ঝুলিয়ে বসেছে।
চপলার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে—হেমেনের ঊনপঞ্চাশ। দুজনেরই শরীর মোটা হয়ে চলেছে—মাথায় চুল পাতলা হয়ে আসছে—
হেমেনের প্যান্টের বেল্ট তার ভুঁড়িটাকে যেন আর সামলাতে পারে না; হেমেনের মুখও যেন তার ভুঁড়ির মতোই; চপলার মুখও হেমেনের মতোই যেন —কল্পনা বা স্বপ্নের কোনো চিহ্ন যেন এদের মুখাবয়বের ত্রিসীমানায়ও কোনোদিন ছিল না। হেমেনের নিজের অফিস। কয়েকখানা মাঝারি গোছের ট্রাক—ইট সুরকি ও সিমেন্ট নিয়ে কলকাতার শহরে ছোটাছুটি করছে—দশবছর ধরে। আরো নানারকম ব্রাঞ্চ বিজিনেস আছে। সামান্য কনট্রাক্টর হয়ে চব্বিশ পরগনায় জীবন শুরু করেছিল সে। এখন তার সমস্ত ব্যবসার হেড অফিস কলকাতায়—দু-তিন লাখ টাকা খাটছে।
চপলা কাগজখানা দেখছিল।
ঢনঢনিয়া মাড়োয়াড়ি মস্তবড় এক ভোজ দিয়েছে; নিমন্ত্রিত লোকজন-এর ভিতর প্রায় শতখানেক নাম উঠেছে; চপলা অত্যম্ভ গভীর অভিনিবিষ্ট হয়ে একটি একটি করে নাম দেখছিল—সমস্তটুকু দেখতে তার আধঘন্টা লাগল, হেমেনের চুরুট ফুরিয়ে গেল; চপলা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কাগজটা রোখ দিলে। না, এখন তারা এত বড়লোক হয় নি যে ওসব কলমে নাম তাদের উঠবে—কিন্তু ঢনঢনিয়ার বাড়ি ভোজে তার স্বামীও তো গিয়েছিল—চপলা নিজেও তো গিয়েছিল। না—নিজেদের যতটা তারা মনে করে ততটা নয়, এখনো তার ঢের পেছনে; একশোটা নামের লিস্টের ভিতর তাদের নাম কোথাও নেই, আজও নেই—এখন তাদের বয়স প্রায় পঞ্চাশ হতে চলল।
চপলা ঈষৎ অস্থির হয়ে উঠল। চুপচাপ বসে থাকলে মনটা কেমন বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে—মানুষদের ওপর—পৃথিবীর ওপর—নিজেদের জীবনের অকৃতকার্যতার ওপর।
চপলা নড়ে-চড়ে উঠে-বসে বললে—চলো, লীলাদের বাড়ি যাই।
—বেশ টয়লেট করে এস।
আধঘন্টার ভেতর টয়লেট সেরে সাজসজ্জা করে চপলা এসে বললে—চা খেয়েছিলে?
হেমেন মাথা নেড়ে বললে—না।
—তাহলে ইয়াসিনকে বলি; একটু করে দিক।
—থাক, আমি আর একটা চুরুট জ্বালাই তার চেয়ে, কোথায় যাবে?
—চলো লীলাদের ওখানে যাই—
—লীলা? দ্বিজেন ওকে নিয়ে চলে যাবে শুনেছিলাম।
—কোথায়?
—শিলঙে।
—কেন?
—কলকাতায় এই গরমে আমরাও তো দু-চারদিনের জন্য কোথাও গেলে পারতাম; সবাই তো যাচ্ছে—
—একটু চেপে থাকো, কয়েকটা বড় অর্ডার এসেছে—ভালো ছেলেটির মতো এখন একটু চেপে থাকো তো লক্ষ্মীটি কিন্তু লীলাকে নিয়ে দ্বিজেন যাচ্ছে? সত্যি!
হেমেন একটু হাসলা
চপলা বললে—ওদের দুজনে তো একদম বনে না—জানো?
দ্বিজেনের জন্য দুঃখ করতে লাগল চপলা। হেমেনেরও দুঃখ—দ্বিজেনের জন্য।
মোটরকারটা কেমন বিগড়ে গেছে; হেমেন হতাশ হয়ে কারটার দিকে একবার তাকাল,—মোটরকার—এর কী হয়েছে যেন।
চপলা বললে—এই যা,—তাহলে আর—, চল ওপরে চলে যাই—
হেমেন যন্ত্রপাতিগুলো পরিষ্কার করে ঘাঁটিয়ে দেখল, মোটরকারটার দিকে হাঁ করে একবার তাকাল—পাঁচ মিনিটের মতো নটখাট করলে সে, কিন্তু গাড়ি একচুলও নড়ল না।
ড্রাইভারের হাতে গাড়িটা ফেলে দিয়ে হেমেন বললে—চলো, বাসে যাই। বাসেই গেল তারা।
হেমেন বাসা করেছে বালিগঞ্জ অ্যাভিনিউতে—দ্বিজেন এখনো সেই সাবেকি শ্যামবাজারে থাকে, অনেক বলেকয়েও তাকে অ্যাভিনিউর দিকে টেনে আনা গেল না; সে কেবল বলে আচ্ছা আসছি—আসছি—কিন্তু আসে না, এই দশ বছরের ভিতরেও সে আসতে পারল না; টাকা দ্বিজেনের কম কি? কঞ্জুস সে একেবারেই না—লীলাও না; কিন্তু আসলে এদের বনে না, কেন যে পরস্পরের ভিতর এরকম বনে না—স্বামী স্ত্রীতে—হেমেন বুঝে উঠতে পারছিল না। কেন যে এরা পরস্পরকে আঘাত করে শুধু?
বাস ভরতি, চপলাকে দেখে কেউ উঠে দাঁড়াল না। পরের স্ট্যান্ডে একজন উঠে গেল—হেমেন চপলাকে সেই দিকেই পাঠিয়ে দিল। দু-এক মিনিট পরে যখন তার বোধ হল যে একটা কুলি না কী চপলার পাশে বসে আছে তখন তাড়াতাড়ি স্ত্রীর হাত ধরে তাকে বাস থেকে নামিয়ে ছাড়ল হেমেন।
এরপর এরা টাক্সি করল।
তেতলায় না পৌছতেই লীলার গলা—
হয়তো চাকরবাকর ধমকাচ্ছে। খুব বেয়াড়া বেয়াদব চাকরই বটে—লীলার আওয়াজও তেমনি খনখনে। হেমেনের মনে হল এই হচ্ছে জাঁদরেল আওয়াজ—তার স্ত্রীর যা নেই। এ না হলে ঘরের চাকরবাকরগুলোই লাই পেয়ে যায়,বন্ধুর কামিন দাবড়ে রাখতে পারা যায় না। কিন্তু তার নিজের এরকম গলা নেই পদে-পদে কত ব্যবসার কাজ জলের মতো হাসিল হয়ে গেছে। এরকম ভাবতে ভাবতে হেমেন তৃপ্তির সঙ্গে দোতলায় পাপোসে নিজের বুটজোড়া ভালো করে ঘষে নিলে—চপলা হাই হিল ঘষলে।
চপলাকে বললে—লীলার সঙ্গে খবরদার লেগো না কিন্তু। ফর্ম ঠিক রেখো কিন্তু বুঝল?
চুরুটটা জ্বালাবে কিনা বুঝতে পারলে না সে; পকেটের থেকে বের করলে অন্তত; কিন্তু তেতলায় উঠতে না-উঠতেই সেটা পকেটের ভিতর ফেলে দিল।
লীলার গলার আওয়াজ ডাইনিং রুমের দিক থেকে আসছে—হয়তো চাকরবাকর নিয়ে কী-না-কী—হেমেনরা সেদিকে গেল না। দ্বিজেনটা হয়তো ড্রয়িংরুমে আছে—চেপলাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমের ভিতর ঢুকল হেমেন। কিন্তু কই, কেউ তো এখানে নেই।
—দ্বিজেন—
কোনো শন্দ নেই।
ঘড়িতে পৌনে তিনটে।
বেডরুমেও কেউ নেই।
অগত্যা ডাইনিংরুমের দিকে গেল তারা; ঢুকে দেখল ডিনার টেবিলের ওপর লীলা বসে—এ কী দারুণ রণচণ্ডী; হাতে তার দুখানা রুটিকাটা ছুরি নাচছে; দ্বিজেন একপাশে একটা চেয়ারে বসে এক স্লাইস পাঁউরুটি হাতে করে চুপ করে রয়েছ।
—দ্বিজেন—
—দ্বিজেনবাবু
লীলা আগবাড়িয়ে বললে—হয়েছে হয়েছে—ওকে আর আশকারা দিতে হবে না—
একটা রুটিকাটা ছুরি ডিসের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল লীলা; আর একখানা নিজর হাতের ভিতর রেখে বললে—এই আমাদের চা খাওয়া শেষ হল। চপলা বললে—ভালোই।
হেমেন একটা চেয়ার টেনে এনে দ্বিজেনের গলায় হাত জড়িয়ে ফিসফিস করছিল। লীলা বললে—ওকে আর আশকারা দিও না ঠাকুরপো।
চপলা বললে—আহা বেচারা সারাদিন খেটেখুটে আসে—
লীলা চোখ গরম করে বললে—বেচারা মানে?
—আমি বলছিলাম দ্বিজেনবাবু—
—দ্বিজেনবাবু বেচারা, আর আমি?
চপলা কোনো কথা বললে না
—বেচারা সারাদিন খেটেখুটে আসে—তারপর চপলা চুপ করে রইল।
লীলা বললে—সারাদিন খেটেখুটে আসে বলে তাকে নিয়ে কী করতে হবে, ঠাকুরঝি?
চপলা বললে—তোমরা নাকি বেড়াতে যাচ্ছ?
ছুরিটা দিয়ে নখ কাটতে-কাটতে লীলা বললে—কে বলেছে? কোথায়?
দ্বিজেন বললে—ছুরিটা দিয়ে নখ কেটো না—
লীলা দৃঢ়মুষ্টিতে ছুরির বাঁটটা ধরে দ্বিজেনের দিকে তাকাল—হেমেনের প্রাণ কেঁপে উঠল; দ্বিজেনের গলার থেকে হাত তুলে নিয়ে অত্যন্ত দাক্ষিণ্যের সঙ্গে লীলার দিকে তাকাল সে।
দ্বিজেন বললে—এটা রুটিকাটা ছুরি নয়? ভুলে যাও কেন?
হেমেন দ্বিজেনের কাঁধ আস্তে চাপড়ে দিয়ে বললে—আহা থাক্, থাক্ না।
—থাকবে? কেমন থাকবে দেখাচ্ছি আমি! দ্বিজেনের কপাল লক্ষ্য করে লীলা হঠাৎ ছুরিঢা মারল। ছুরিটা ফসকে দেওয়ালে গিয়ে লাগল।
কয়েকমিনিট সকলেই স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল।
আরো একটা ছুরি ছিল টেবিলে—কিন্তু লীলাও সেটা আর তুললে না। দ্বিজেন চশমাটা চোখ থেকে খসিয়ে নিয়ে মুছতে মুছতে বললে—ভোঁতা একটা রুটি কাটা ছুরি কপালে লাগলেও বা কী হত?
লীলা বললে—কিন্তু চোখে লাগত যদি—
—তাহলে কী হত?
—কী হত—ডিম বেরিয়ে যেত আর কী হত।
হেমেন বললে—ছি!
চপলা বললে—তোমার স্বামীর ওরকম হলে তোমার ভালো লাগত না কি লীলা?
লীলা বললে—স্বামী আমার! বড্ড স্বামী!
হেমেন আশ্চর্য হয়ে বললে—বলে কী?
চপলা হেমেনকে চোখ ইশারা করে বললে—’চুপ’।
দ্বিজেন মাথা নিচু করে মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। লীলা খানিকক্ষণ গোঁজ হয়ে চুপ করে রইল। তারপর বললে—সকলে মিলে ছোটছেলের মতো তুইয়েবুইয়ে নজর দিয়ে মাথা একেবারে খেয়ে ফেলেছে—
হেমেন বললে—কার মাথা? দ্বিজেনের?
—আর কার!
—কে খেয়েছে?
—কেন তুমি—আর তোমার স্ত্রী—
হেমেন রক্তাক্ত জমাট মুখে লীলার দিকে তাকাল। সেও হয়তো একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসবে, চপলা সভয়ে হেমেনের দিকে তাকিয়ে দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল।
দ্বিজেন হেমেনকে একটা ঠোনা দিয়ে বললে—চা খাবে নাকি?
চপলা বললে—দ্বিজনবাবুর ভালো খাওয়া হয় নি বুঝি… আচ্ছা আমি তৈরি করছি।
লীলা আগুন হয়ে বললে—কেন তুমি তৈরি করে দিলে ভালো খাওয়া হবে আর আমি তৈরি করে দিলে হবে না?
চপলা সে কথায় কোনো জবাব না দিয়ে স্টোভ জ্বালাতে গেল।
লীলা চপলার কব্জি চেপে ধরে বললে—
—জ্বালাও তো দেখি স্টোভ—জ্বালাবে! হাঁ?
দারু মোচড় খেয়ে চপলা টপকাতে টপকাতে নিজেকে সামলে নিয়ে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল—সমন্ত শরীর তার রিমঝিম করে উঠেছে যেন।
দ্বিজেন ফ্যানটা খুলে দিয়ে চেয়ারসুদ্ধ চপলাকে তুলে নিয়ে ফ্যানের নীচে বসাল। তারপর আস্তে আস্তে চপলার মাথায় হাত বুলোতে লাগল। লীলা বললে—জানি নে আবার! এই সবই তো করো তুমি!… সাধে কি আমি চটি তোমার ওপর—যেই একটু নজর দিতে ভুলেছি—
লীলা উঠে দাঁড়াল।
দ্বিজেন আস্তে আস্তে সরে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।
লীলা বললে—তোমার লজ্জা করে না? চপলার সঙ্গে তোমার রক্তের কোনো সম্বন্ধ নেই—কী করে চেয়ারসুদ্ধ তুমি তাকে টেনে নিলে? তার গায়ে হাতই-বা দিলে কী করে।
হেমেন নড়ে চড়ে উঠল; চপলা চোখ ইশারা করে তাকে থামতে বললে।
লীলা বললে—আর যদিও-বা কোনো আত্মীয়তা থাকত, সে তো তোমার স্ত্রী নয়, বোনও নয়, কী করে তার গায়ে হাত দিলে তুমি? আমার চোখের সামনেই এত; চব্বিশটা ঘণ্টা হাইকোর্টের নাম করে তুমি কী কর জানি না?
হেমেন বললে—কী করে?
লীলা বললে—এর ওপর আবার বিজিনেস ফেঁদেছে—
হেমেন বললে—বিজিনেস করেই তো—
চপলা বলাল—কীসের বিজিনেস? দ্বিজেনবাবুর?
—কেন জে, বি, এ্যান্ড কোং—তুমি জানো না?
এতক্ষণ পরে কথাবার্তা ব্যবসার দিক মোড় নিয়েছে দেখে হেমেন যথেষ্ট শান্তি বোধ করল। সে চুরুটটা এতক্ষণ পরে বের করলে; জ্বালিয়ে নিয়ে একটা টান দিয়ে অত্যন্ত আয়েসের সঙ্গে বললে—জে, বি, এ্যান্ড কোং কোম্পানি হচ্ছে—
লীলার মুখের দিকে তাকিয়ে চপলা বললে—থাক্—
হেমেন বললে—বাঙালি ফার্ম; এর ভেতর একজনও বিলেতি মানুষ নেই, না ইওরোপের না আমেরিকার, এমনকি মাড়োয়াড়ি অবদি নেই।
হেমেনের মনে হল সকলকে সে কোম্পানির রহস্য উদ্ঘাটন করে স্তম্ভিত করেছে; কিন্তু কেউই স্তম্ভিত হয় নি; কেউ তার কথা শুনছিল না।
হেমেন বলে চললে—মাড়োয়াড়ি নেই, ভাটিয়া নেই, পশ্চিমা মুসলমান নেই—শুধু বাঙালি হিন্দু—ব্যস্!
হেমেন বললে—ওয়ার-এর সময় এই কোম্পানি স্টার্ট করা হয়; প্রথম হয় রেঙ্গুনে, তখন অনেক কিছুই বুজরুকি হয়েছিল বটে, কিন্তু এটা বুজরুকি নয়, একেবারে কৌশলে, তখন দ্বিজেনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না।
দু-মিনিট গভীর আনন্দের সঙ্গে চুরুট টেনে পরম পরিতৃপ্ত হয়ে হেমেন বললে—দ্বিজেন তো এর গুডউইল কিনেছে তিনবছর আগে—লীলার দিকে অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে তাকাল হেমেন।
বললে—প্র্যাকটিশ শিগগিরই ছেড়ে দেবে।
চপলা বললে—কেন?
হেমেন জ্বলন্ত চুরুটটার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বললে—এই বিজিনেসের কাছে প্র্যাকটিশ আবার কী?
লালা বললে—বিজনেস করে টাকা জমিয়ে হবে কী?
হেমেন অত্যন্ত বিস্মত হয়ে লীলার দিকে তাকাল।
লীলা বললে—এই তো চোখের সামনে দেখলাম চপলার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করল। চপলা তার কেউ না—মাথায় হাত রেখে পিঠ বুলিয়ে ফিস ফিস করে কানে কানে কথা বলে কি নোংরামির পরিচয় দিল বলো তো ঠাকুরপো? আমার চোখের সামনেই এই—বাইরে কী কেউ কি জানে? আমি ঘড়ি ধরে দেখেছি এগারো-বারো ঘন্টা বাইরে থাকে—
হেমেনের মন গজগজ করে উঠছিল—লীলার কথা ফুরোতে না-ফুরোতেই যষ্ক ফুক করে হেসে উঠল।
চপলা বললে—উনি তো আঠারো ঘন্টা বাইরে থাকেন—
লীলা বললে—হ্যাঁ উনি—তোমার ওঁর ওই টেকো মাথা বোঁদা চেহারা দেখে কোনো মেয়ে ওর সঙ্গে গাঁট বাঁধতে আসবে?
হেমেনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে লীলা বললে—ঠাকুরপো, তোমার নাক যেন বুড়ো আঙুলের মতো উঁচিয়ে আছে—বাপরে বাপরে!
লীলা হো হো করে হেসে গড়াতে লাগল—ট্যাবা-ট্যাবা মুখ—নাক টেবু-টেবু—চোখদুটো প্যাঁট—প্যাঁট করছে—কোনো মেয়ে এসব দেখে এগোয়—
হেমেন লাফিয়ে উঠে বললে—বটে। খুব দমফাই হচ্ছে বুঝি? আজও যদি চোখ মারি তো কুড়ি-পঁচিশটা মেয়ে এমন ফ্যা ফ্যা করে আমার পায়ের কাছে এসে গড়াবে।
লীলা হেসে কুটিকুটি হয়ে বললে—চোখ মারি! ঠাকুরপো মারবে আবার চোখ—তাহলেই হয়েছে—
চপলা বললে—ছিঃ! চোখ মারাটারা আবার কী। তুমি কক্ষনো যা কর না সেইসব নিয়ে আবার বড়াই করে বলো কেন?
লীলাকে বললে—না কক্ষনো না, বুঝলে দিদি এই কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে ওঁর সঙ্গে আছি—একদিনের জন্যও কোনো মেয়ে মানুষের দিকে উনি ফিরেও তাকান নি—ওঁর ব্যবসায়ের সমস্ত লোক জানে যে ওঁর কীরকম অকলঙ্ক চরিত্র—কলকাতা শহরের সমস্ত লোক জানে—
হেমেন অত্যন্ত অপমানিত হয়ে রয়েছিল—চপলার কোনো কথা তার কানেও গেল না। লীলা তার পুরুষত্বকে কী কঠিনভাবেই না আঘাত করেছে! আপাদমস্তক গা জ্বলে যাচ্ছিল তার। রাগে কাঁপতে-কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর দড়াম দড়াম করে ঘুঁষি মারতে-মারতে হেমেন ক্রোধান্ধ হয়ে বললে—চুলোয় যাক চরিত্র! মেয়েরা আবার আমার ফোঁপর দালাল আছ না—আমার সমস্ত
হাঁড়ির খবর আমি বের করে দিচ্ছি।
চপলা বললে—তুমি পাগল হলে নাকি?
হেমেন হুংকার দিয়ে বললে—কলকাতার সমস্ত বড় ঘরের মেয়েদের আমি পথে দাঁড় করাতে পারি, জানো লীলা?
চপলা বললে—দ্বিজেনবাবু—
দ্বিজেন বললে—চলো, তোমাদের মোটরে দিয়ে আসি—
হেমেন এক ঝটকায় দ্বিজেনকে ঠেলে দিয়ে বললে—ভেবেছ একেবারে চরিত্র হাতে ধরে বসে আছি—হেমেন খুব সচ্চরিত্র ছেলে—মেয়েরা তাকে একটা গয়ারাম বলে ভাবে—কলকাতার শহরে তিনদিন পরে সাঁওতাল পরগনা বানিয়ে দিতে পারি।
কাঁপতে-কাঁপতে বললে—কলকাতা তো কলকাতা…লীলার মতো যত সব প্যাঁচা—পেঁচি, চপলার মতো যত সব প্যাঁচা-পেঁচি—সেবার যখন জয়পুরে গেলাম পাথরের বাড়ি দেখতে—ফিরছি এমন সময়—
কিন্তু রাজপুতবাঘিনী দেবলা দেবী চঞ্চলকুমারীদের সঙ্গে রোমান্সের কথা শেষ করলে না আর হেমেন; শুরুই শুধুকরে রাখল; কেউ কোনো জবাবও দিচ্ছে না দেখে, লীলাকেও যথেষ্ট প্যাঁদানি দেওয়া হয়েছে বলে মনটা তার নিরস্ত হয়ে আসছিল।
নতুন একটা চুরুট বার করে হেমেন শান্তি পাচ্ছে; চুরুটটা জ্বালিয়ে, টেনে, মনটা তার ঠাণ্ডা হয়ে উঠছে, চপলার প্রতি, দ্বিজেনের প্রতি, এমনকি লীলার প্রতিও অনুকম্পায় মমতায় তার সমস্ত প্রাণ ভরে উঠল।
বললে—চল লিলি, বায়োস্কোপ দেখতে যাই।
কিন্তু ঘড়িতে তখন চারটে বেজে গেছে; প্রথম শোতে গিয়ে আর লাভ নেই। ছটার ‘পারফরমেন্সের জন্য এদের সবাইকে সে তৈরি হতে বললে। তার নিজেই স্টোভ উনে নিলে।
লীলা বললে কেন?
—গরম জল করব।
—কেন?
—বাঃ, দ্যাখো না? তোমরা মেয়েরা তো আর করবে না, এখন পুরুষদেরই মশলা পিষতে হবে, চা বানাতে হবে, দেখো, কী রকম খাসা চা করি।
কিন্তু লীলার কাছ থেকে কোনো সহানুভূতি বা আশ্বাস পেলে না হেমেন।
চপলা বললে—এখন আবার চা খাবে কে? কারু খাবার দরকার নেই—
হেমেন বললে—আলবাৎ খাবে—
চপলা বললে—কেউ খাবে না—তুমি স্টোভ নিবিয়ে ফেল।
হেমেন একটু চোখ টিপে মুচকি হেসে বললে—দিদিমারা খাবে—
চপলা বললে—কারা?
স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখল সে—বাস্তবিকই হেমেনকে সুন্দর দেখাচ্ছে না মোটেই, টেবু-টেবু নাক, ট্যাক-ট্যাক মুখ, চোখ প্যাট-প্যাট করছে।
হেমেন বললে—তুমি আর লীলা।
লীলা বললে—আমরা দিদিমা?
হেমেন বললে—জানলে দ্বিজেন, এরা আবার আমাদের চেহারা নিয়ে ঠাট্টা করে, কে বলবে এরা আধবয়সী মেয়েমানুষ? একটু হ্যাঁচকা দেখলেই মনে হবে বাপরে বাপ, ঠানদিদি-ঠাকমা এল আবার, মনে হয় না দ্বিজেন?
কিন্তু দ্বিজেন, কিছু বলবার আগেই লীলা এক ঝটকায় স্টোভসুদ্ধ প্যান উলটে ফেলে দিল। গরম জলটা হুস করে চারদিকে ছিটকে পড়ল। হেমেন পুড়তে-পুড়তে বেঁচে গেল। স্টোভটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। দ্বিজেন আর প্যানট্রির থেকে ননকু এসে সমস্ত নিভিয়ে নিস্তব্ধ করে দিল।
সিনেমায় আর যাওয়া হল না।
দিন তিনেক কেটে গিয়েছে।
টি বি আমস্ট্রং কোম্পানির পাশ দিয়ে হেমেনের মোটর আস্তে আস্তে চলছিল; একবার ভিতরে ঢুকে শ্রীমানকে দেখে যাবে নাকি ভাবছিল হেমেন। বড়রাস্তায় একটা গলির কাছে মোটর থামিয়ে আমস্ট্রং কোম্পানির দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল হেমেন। ব্যবসায়ের যে কোনো পত্তনের দিকে তাকাতেই গিয়েই সে কোমল সবুজ হয়ে ওঠে—তার জীবনের সমস্ত কল্পনা ও কুহক পৃথিবীর সমস্ত সওদাসদায়ের রাজোর ভিতরে শুধু।
হেমেনের মনে হল আমস্ট্রং—এর ফ্ল্যাট এমন বড় না কিছু—স্টিফেন হাউসের কিংবা একশো নম্বর ক্লাইভ স্ট্রিটের একটা কামরার মতো শুধু যেন।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল হেমেন; তার নিজের অফিসটাই কতটুকু? কিন্তু চুনকাম করে নিয়েছে সে হুইটলির আমস্ট্রং—এর মতো একটা বাঙালি কোম্পানি এসে কাজ করে দিয়ে গেছে—কিন্তু আমস্ট্রং এখনো তেমনি বিবর্ণ, জায়গায় জায়গায় চুন খালি খসে পড়ছে। মোটর থেকে নামল হেমেন।
হাঁটতে হাঁটতে মনে হল সমস্ত ব্যবসাই আজকাল বসে যেতে বসেছে—গত দেড় বছর ধরে ক্রমাগত ক্ষতি দিয়ে আসছে সে। আর কিছু কাল এরকম চললে ব্যবসা বন্ধ করে দেবে সে—ব্যাঙ্কে এখনো যা টাকা আছে তার সুদ দিয়ে তাদের দুজনার এখনো বেশ চলবে। কোনো ছেলেপিলে হয় নি তাদের। একটা অপরিসীম শান্তিতে চুরুটটাকে জ্বালাল।
দ্বিজেন উঠে পড়বে ভাবছিল।
হ্যালো খাস্তগির—অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে হেমেনের দিকে তাকাল সে।
আজ শুধু বাবসায়ের কথাই হল, তিন দিন আগের ঝক্কি ঝকমারির বেদনার নিরাশার কেউ কোনো উল্লখই করল না। ব্যবসায়ের দুর্গতিই দুজনকে সব থেকে বেশি বিষণ্ণ করে দিয়েছে ব্যর্থ করে ফেলেছে।
চার-পাঁচ দিন পরে হেমেনের অফিস থেকে তাকে নামিয়ে নিয়ে গেল দ্বিজেন। শাহেবপাড়ার একটা গ্রিল ফিলের দিকে মোটর ঘুরিয়ে চলল দুজনে।
—নাঃ ঢুকেই পড়া যাক।
গিয়ে বসল। শুয়োর ভেড়া মুরগির মাংসের নানারকম জিনিশ, কফি, কিছু পুডিং ফল আইসক্রিম এক-একে আসছিল। হেমেন বললে ব্যাপারটা কী জানলে দ্বিজেন—ব্যাঙ্কে এখনো লাখ দেড়েক রয়েছে—
দ্বিজেন বললে—লাখ দেড়েক!
হেমেন বললে—এখনো ট্রাকগুলো দস্তুর মতো অর্ডার নিয়ে কলকাতা শহরে ছুটে বেড়াচ্ছে।
হেমেন বললে—এই দেড় লাখ টাকার ইন্টারেস্টে আমি আর চপলা দুজন মানুষ তো শুধু এলাহি চালে থেকে যেতে পারি—বালিগঞ্জের বাড়ি তো রয়েইছে।
একটু থেমে—করবও তাই। ব্যবসা—কী হবে ব্যবসা করে আর।
—ভালো লাগে না কিছু—সত্যি।
দ্বিজেন জিজ্ঞেস করতে গেল না কেন ভালো লাগে না। ব্যাঙ্কে দ্বিজেনেরও লাখখানেক রয়েছে। বালিগঞ্জে না হোক শ্যামবাজারে তারও বাড়ি রয়েছে। বেশ ভালো বাড়িই। কিন্তু তবুও কেমন একটা বিমর্ষতা নিরর্থকতা পেয়ে বসেছে তাকে। অনেকদিন ধরে। হেমেনের এই সদ্যোজাত ভালো না লাগার চেয়ে সে ঢের আলাদা জিনিশ।
হেমেন বললে—সত্যি কিছু ভালা লাগে না কেন বল তো দ্বিজু?
—কেন ভালো লাগে না বল তো হেমেন?
—কী যেন, মনটা কেমন টসকে গেছে—
—কেন?
—বাস্তবিক, টাকাই কি সব দ্বিজু?
দ্বিজেনের কাছ থেকে কোনো জবারর অপেক্ষা না করেই হেমেন বললে—বাস্তবিক, লীলা যা বলেছিল ঠিকই, আমাকে একটা খটকা লাগিয়ে দিয়েছে—
দ্বিজেন ঘাড় হেঁট করে খাচ্ছে।
হেমেন বললে—এই ভুঁড়ি—টাক মাথা-ট্যাবা-ট্যাবা মুখ—টেবে-টেবু নাক—চোখ দুট প্যাঁট-প্যাঁট করছে—বাস্তবিক আমি কী হয়েছি বলো তো—?
দ্বিজেন বললে—একটু হালকা হয়ে নাও না—
হালকা হয়ে কী হবে, চেহারাই অত্যন্ত বদ নজরের। সেদিন একজন মেয়ের পিছনে লেগেছিলাম।
—সে কী।
—মেয়েদের ফেরে-ফেরে আমি না থাকি যে তা নয়। কিন্তু চপলা তা জানে না; কিন্তু এদ্দিন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছুঁড়িদেরকে এনে বায়স্কোপ দেখিয়ে ভাবতাম সব সাধ মিটল বুঝি। কিন্তু তাতে শুধু হয় না—আরো কী একটা জিনিশের প্রয়োজন যেন—
দ্বিজেন বললে—কেন চপলাই তো রয়েছে—
—কিছু না—
রোস্ট খেতে খেতে ছুরিঢার দিকে একবার তাকাল।
হেমেন বললে—না চপলা তো রয়েইছে; এমন চমৎকার গিন্নি, ও না থাকলে কি আর চলত, এসব মেয়েদের নামে কোনো নালিশ চলতে পারে না
একটু থেমে—কিন্তু আমি চাই কী জানো?
দ্বিজেন মুখ তুলল, একটা ভালো ছুরি বেছে নিলে।
হেমেন বললে—মেয়েরা আমাকে দেখে ভুলে যায়—আমার কাছে এসে নিজেদের নিবেদন করে। এসব কোনো পুরুষ না চায় দ্বিজেন?
এরপর দু-তিন মিনিট স্তব্ধ হয়ে খুব তাড়াতাড়ি করে কাঁটা ছুরি চালিয়ে নিতে লাগল হেমেন।
হেমেন তারপর বললে—কিন্তু লীলা যা বলেছে—ঠিকই সে পুরুষ আমি নই যার পেছনে মেয়েরা পইপই করে ঘুরবে। কেন ঘুরবে? আমার পেছনে? আমি কী?
দ্বিজেন বললে—আমিই—বা কী?
—নাও-নাও—তোমার সুন্দর চেহারা আছে। আমি আমার গুডউইল দিয়ে দিতে রাজি, তোমার চেহারা যদি পাই—
হেমেন বললে—তুমি তো বরাবরই মেয়ে পটকে এসেছ, আমি জানি না নাকি। বিলেতে, ইন্ডিয়ায়। বড়লোকের ছেলে, নিজে রোজগার করেছ তার ওপর এই এমন চেহারাখানা সে আমি জানি—তুমি ঢের মেয়ে পটকে এসেছ—
হেমেন কিছুতেই এই বাথা উতরে উঠতে পারছিল না আর, ওই বেদনা তাকে অভিভূত করে ফেলেছে।
দ্বিজেন বললে—মেয়ে পটকানোই কি সব?
—এসেছ তো পটকে—অনেক মেয়ে!
—মেয়ে পটকে আর কী হয় হেমেন?
—ও অনেক হয়; জীবনে অনেক ফূর্তি করেছ। এখন তুমি চোখ বুজে তৃপ্তিতে মরতে পার, পার না কি?
হেমেন বললে—পার না কি।
কোনো জবাবের প্রতীক্ষা না করেই বললে—পারা উচিত তোমার; আমি হলে তো পরম শান্তিতে চোখ বুজতে পারতাম—
গভীর ক্ষোভে হেমেন কফির পেয়ালা ধরল।
বললে—এই যে এখনো আধবুড়ো হয়ে গেছ, চার পাঁচজন ব্যারিস্টার গিন্নির সঙ্গে এখনো তোমার ইয়ার্কি চলে, আমি দেখেছি না নিজের চোখে?
দ্বিজেন বললে—ইয়ার্কি শুধু, আর কিছু না হেমেন?
—কিন্তু ইয়ার্কিটাই ঢের মিষ্টি—আমি তো নিজেই চেয়ে চেয়ে কতবার দেখলাম।
আমাদের সঙ্গে ওরকম ইয়ার্কিই-বা করতে আসে—
—কেন, চপলা?
—ঠাট্টা করো না দ্বিজেন—
দ্বিজেন বললে—নিজের বধূর সঙ্গে হাসি তামাসাই তো সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে।
হেমেন একটা চুরুট ধরিয়ে বললে অবিশ্যি সেখানে তুমি ঠকেছ।
দ্বিজেন কোনো এক জায়গায় খানিকটা ঠকে গেছে বলে কয়েক মুহর্ত যেন তৃপ্তির সঙ্গে হেমেন চুরুট টেনে নিল।
কিন্তু তারপরেই দ্বিজেনের সুন্দর মুখ চমৎকার টাই ও সুন্দর সুন্দর ব্যারিস্টার বধূদের সঙ্গে এর ছেনালির কথা ভেবে হেমেনের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। মনের ভিতর একটা আঘাত পূষে খানিকটা সে চুরুট টেনে গেল। তারপর বললে—তোমার ব্যবসা গেলেই বা তোমার কি হয় দ্বিজেন? মানুষের জীবনের আসল জিনিশটাই তো তুমি পেয়েছ; মেয়েরা তোমাকে ভালোবাসে। নিজের সেন্টিমেন্টালিজম তুমি কত জায়গায় গিয়ে মেটাতে পার—
দ্বিজেন সিগারেট কেস বের করলে।
হোমন বললে—তোমার বেশ মজা, লীলা তোমার মনটাকে দিয়েছে খিচড়ে—ওদিকে তাই তোমার জমে ভালো। লীলা যদি ভালো গিন্নি হত তাহলে মেয়েদের সঙ্গে ছেনাল করে বেড়াবার তাগিদও থাকত না তোমার। সেটা তেমন ভালোও লাগত না হয়তো। লাগতো?
একটু পরে—অবিশ্যি ছেনালপনা সব সময়ই ভালো লাগে, বিশেষত যে রকম বাগিয়ে নিয়েছ চারদিক; কিন্তু এখন যেমন লীলার ওপর বিমুখ বৈরাগ্য করে একা মোটরখানা নিয়ে বিরহীর মতো ঘুরে-ঘুরে উচ্ছ্বাস করবার সুবিধে পাও লীলা অন্যরকম হলে কি পেতে?
ক্ষোভ—আকাঙ্ক্ষায় হেমেনের মন ভরে উঠল। দ্বিজেনের একদিনের জীবনও যদি সে পেত। হলই-বা দ্বিজেনের নিজের স্ত্রী ফটফটে—পরের স্ত্রীদের এমন হাতে পায়ে গুছিয়ে রাখতে ওর মতো কে পেরেছে।
হেমেন বললে—সেন্টিমেন্টালিজম শুধু? ওদের সঙ্গে তুমি কী করো না করো—আজীবন তুমি পথেঘাটে কত বাড়ি ভেঙে এসেছ কেউ কি তার খবর রাখে?
একটু থেমে—আমি যদি সমস্ত জীবনও ক্ষয় করি তবু একটি মেয়ের সাচ্চা খাঁটি ভালোবাসা পাব না, আর তোমাকে কত মেয়ে যেচে ভালোবাসতে আসে—
একট পরে—কেন এমন হয় দ্বিজু?
হেমেনই বললে—অবিশ্যি আমার চেহারাটা? এ নিয়ে মেয়ে পটকানো যায় না দ্বিজেন।
নিরাশার অতল অন্ধকূপের ভিতর ডুবে গিয়ে হেমেন স্তব্ধ হয়ে চুরুট টানতে লাগল। জীবনে প্রেম হল না, প্রণয় হল না, ছেনালি অবদি হল না। একজন পরের স্ত্রীকে আটকে রেখে মোকদ্দমায় যদি সে পড়ত তাহলেও যেন একটা ক্ষোভ মিটত। এখন যেন রক্ত মাংস বিবেচনা বুদ্ধি বিবেক সমস্তই কামড়াচ্ছে তাকে—হালু-হালু করে কামড়াচ্ছে। কেন এমন হল? সারা জীবন, জীবন বলে জীবন, এমন গয়ারাম সেজে গেল কেন সে। মেয়ে পটকানোর একটা সময় থাকে। ত্রিশের পর ওসব কথা আর না—
হেমেনের সমস্ত মুখ মাথা টাক টস টস করে ঘামাতে লাগল।
ভুল করে চুরুটের জ্বলন্ত দিকটা একবার কামড়ে ধরে হেমেন শরীরের যন্ত্রণাও যথেষ্ট পেল। সব রকম যাতনার একশেষ হল তার।
দ্বিজেন বলে— বলাই ভালো আমরা বুড়ে হয়ে গেছি ওসব দিয়ে আমাদের আর কী হবে—
—কে বুড়ো? তুমিও না—আমিও না।
—পঁচিশের পর সকলের বুড়ো—মেয়ে-মানুষ নিয়ে খেলা করার দিক দিয়ে সতেরো—আঠারো—কুড়ি-বাইশ এই হচ্ছে বয়স।
হেমেন হাঁ করে তাকাল।
দ্বিজেন বললে—আমারও যা হয়েছে—এই বয়সেই।
—কেন, এখনো তো—
—কিছু না, কিছু না, আমি তোমার হাত ছুঁয়ে বলছি—আমি এখন শুধু একটু শান্তি চাই—মোয়েদের পিছু-পিছু ঘুরে নয় হেমেন,—কিন্তু নিজেরই ঘরে, নিজের স্ত্রীকে নিয়ে, জানো না তুমি, কিন্তু কেউ আমাকে ভালোবাসে না
কেউ না?
—না।
হেমেন হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
দ্বিজেন বললে—কুড়ি বছরের মেয়েরা আমাকে ভালোবাসবে কেন—আমার বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি হতে চলল। সে ভদ্রলোকের মেয়েরাই হোক বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানই হোক! আঠারো কুড়ি-বিশ-বাইশ বছরের মেয়েদের হৃদয়ের ওপর কোনোরকম কিছু দাবি আমরা অনেক দিন হারিয়ে ফেলেছি আমাদের তারা জ্যাঠামশাই ভাবে; হয়তো ঠাকুর্দাও।
হেমেন আমোদ পেয়ে হিহি করে হাসতে লাগল। দ্বিজেনের এই সব সাফ কথা শুনে মনের ভারটা যেন তার অনেকখানি কমে গেছে। বাস্তবিক দ্বিজেন যা বলে তাই। না হলেও ব্যারিস্টার তো। এমন মিঠে করে জিনিশের আঁশটি বার করে নিয়ে আসে।
পরে একটু হেমেন খুব অভিনিবিষ্ট হয়ে বললে—কুড়ি না-হোক, পচিশ না-হোক—অন্তত ত্রিশ বছরের মেয়েরা।
—তাও না। তাদের জন্য ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের ছোকরারা রয়েছে। পৃথিবীতে সৌন্দর্যেরও অভাব নেই। আমি ঢের দেখেছি এমন-কি কুড়ি-পঁচিশ বছরের ছোকরাদের সঙ্গেও তারা প্রেম করবে—প্রেম করবে একেবারে মরীয়া হয়ে। আমি দেখেছি—ঢের।
দ্বিজেন বললে—একজন চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের গিন্নি হয়তো এক আধ মুহূর্তের জন্য তোমার প্রতি একটু নরম হতে পারে, তুমিও যেমন একটু গদগদ হয়ে উঠতে পার তাকে দেখে—কিন্তু তা ভালোবাসা নয়—কিছুই নয়—একবারে রাবিশ।
দ্বিজেন মাথা তুলে বললে—ভেবে দেখো, হয়তো মোটরে চড়ে চলেছি, একটি বিশ আর একটি ত্রিশ বছরের ছোকরাকে সঙ্গে নিয়ে। আঠারো বছরের, চল্লিশ বছরের, পঞ্চাশ বছরের তিনটি মেয়েমানুষ দেখলাম পাশের মোটরে; ধরো তিনজনেই বেশ দেখতে। কিন্তু, তবুও, হয়তো আঠারো বছরের দিকেই আমার মন যাবে।
হেমেন বললে—তা যাবে।
—কিন্তু সেই মেয়েটির মন কি এই পঞ্চাশ বছরের বুড়োর দিকে আকৃষ্ট হবে—সমস্ত পৃথিবী বিকিয়ে দিলেও।
হেমেন হাঁ করে তাকাল।
তারপর হি হি করে হাসতে লাগল।
দ্বিজেন বললে—আমার ভাইপোকেই সে ভালোবাসবে—না হয় আমার ছেলেকে—আমাকে কিছুতেই নয়—!
—ভালোবাসা, রোমান্স, এমন-কি কামনার কথাও আর বলো না হেমেন! ওসব ভাবতে গোলও ঢের ব্যথা।
পকেটের থেকে দেশলাই বের করে দ্বিজেন বললে—আমাদের এই পড়ন্ত বয়সে সৌন্দর্য আর ভালোবাসার কথা চিন্তা করতে গেলেও জীবনকে এমন থুককুড়ি মনে হয়!
সিগারোটটা নিভে গিয়েছিল; জ্বালিয়ে নিয়ে দ্বিজেন বললে—আমাদের পকেটে এমন আর কিছু উঠবে না, শুধু ঘরের বধূ ছাড়া, আমাদের জন্য আর কিছু নেই।
দ্বিজেনের সেই ঘরের বধূ যে লীলা এবং নিজের চপলা—এই ভেবে হেমেন ঢের পরিত্বপ্তি পেলে।
বিল সে নিজেই মিটিয়ে দিল।
দ্বিজেন বললে—খোকা তুমি, আহা তোমার মা নেই বোন নেই—তোমার জনা ভারি কষ্ট হয়।
সন্ধা হয়ে গিয়েছিল। হেমেন বললে—দ্বিজু, চলো আমরা টালিগঞ্জ আলি, চেতলা, বেহালা বেড়িয়ে আসি।
—সত্যি এত সব জায়গা ঘুরবে তুমি?
—নিশ্চয়ই। হেমেন সজোরে মাথা নেড়ে বললে।
—কেন?
—এমনিই
—কোনো ব্যবসা-ট্যাবসার সুবিধের জন্য—
—না।
—এমনিই?
—অনেক বদভ্যাস বসেছিল মনের ভিতরে—
—ফিরতে যে অনেক রাত হয়ে যাবে।
—হোক।
—দ্বিজেন বললে—তুমি যাও; আজ আমার দরকার আছে।
বিজিনেস! তাহলে দ্বিজেনকে ছেড়ে দিতে পারে সে। হেমেনের সমস্ত মন এখন প্রেম কামনা ও মেয়েমানুষের থেকে উঠে এসে আবার ব্যবসার গদিতে পরম আরামে ও নিবিড় শ্রদ্ধায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে বসেছে গিয়ে। জীবনটা তার কাছে ব্যর্থ নয় আর, প্রাণের ভেতর কোনো খোঁচ নেই, সমস্ত পৃথিবী অসীম অর্থে ভরা।
হেমেন আকাশটার দিকে তাকাল—আতার বিচির মতো অন্ধকারে সমস্ত কলকাতায় আকাশটা গেছে ভরে; মেঘের অন্ধকার—টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল; তার এখন ভালো লাগল, চপলার কথা মনে হল। বধূর মমতা ও ভালোবাসায় তার সমস্ত মনটা ভরে উঠল। হেমেনের মতন এমন নিবিড় পরিতৃপ্ত মানুষ কলকাতার রাস্তায় আজ আর একটিও নেই যেন। আজ সমন্ত রাত চপলাকে ভালোবাসবে সে—আজ সমস্ত বাদলের রাত ভরে এমন একটা অপরিসীম শান্তি পাবে সে।
কিন্তু তবুও এখনই চপলার কাছে যাবে না সে।
বিজিনেস ইজ বিজিনেস। সে বিজিনেসের মানুষ। সে সঙ্কল্প করেছে, দ্বিজেনের কাছে, স্বীকার পেয়েছে যে টালিগঞ্জ আলিপুর চেতলা বেহালা বেড়িয়ে আসবে। বেড়ানোটা এমনিই—কোনো ব্যবসার উপলক্ষ নিয়ে না, হোক তাই। ফিরতে ফিরতে এগারোটা বাজবে; বাজুক। কিন্তু দ্বিজেনকে বলেছে সে যে টালিগঞ্জ আলিপুর চেতলা বেড়াবে, বলেছেই নড়চড় নেই, সেটা দুর্বলতা; একজন ব্যবসায়ীর পক্ষে সে-রকম ঢিলেমি ব্যবসা পথটাই পরিষ্কার ভরে দেয়।
স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে হেমেন চলল।
একটা ট্যাক্সি নিয়ে দ্বিজেন পিছু-পিছু চলল।
বালিগঞ্জ অ্যাভিনিউ-এর দিকে দ্বিজেন যখন মোড় নিল—হেমেন তার ঢের আগেই টালিগঞ্জের দিকে ছুটে চলেছে। দ্বিজেন এ-গোঁয়ারকে খুব ভালো করেই চেন; রাত বারোটার আগে ও আর ফিরবে না।
দ্বিজেন তেতলায় উঠে দেখল চপলা—গড়াচ্ছে।
এই বিরাট মেদকে দেখে প্রথমটা তার মন কেমন কুঞ্চিত হয়ে উঠল; কিন্তু তবুও এই মেদের নীচে যে হৃদয় রয়েছে তা এমন চমৎকার—এত নমনীয়। এই মেয়েটিকে নিয়ে আধঘন্টা-একঘন্টা-দুঘন্টা কাটল দ্বিজেনের। কিন্তু তারপরে—রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে—বুকটা কেমন ঢিবঢিব করতে লাগল দ্বিজেনের। হেমেন যে-কোনো মুহূর্তেই এসে পড়তে পারে—খটখট খটখট করে—একটা বেতো টাট্টুর মতো।
এমন বিরক্তি লাগতে লাগল তার।
কিন্তু তবুও বেরিয়ে যেতে হবে—। ড্রয়িংরুম থেকে ড্রয়িংরুমে অনেক ঘোরে সে বটে, কিন্তু তবুও তারপর বেরিয়ে যেতে হয়। গিন্নিরাও চায় যে তাদের স্বামী আসুক—এ অতিথি বেরিয়ে যাক বেরিয়ে যাক। বেরিয়ে সে গেলই।