স্বর্ণলতার প্রেম পত্র গল্প রমাপদ চৌধুরী

শেয়ার করুনঃ

স্বর্ণলতার প্রেম পত্র গল্প রমাপদ চৌধুরী Shorno lotar prem potro golpo Ramapada Choudhury

 

ব্যাপারটা আমি তখনো বুঝতে পারিনি। অলক কি এমন কথা বলতে চায় ; বলতে চায়ই যদি, তো এত উসখুস করছে কেন। বলেই ফেলুক না।

অলক তখন আমাদের সকলের কাছেই হিরো হয়ে গেছে।

হিরো হবারই তো কথা। আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট ইয়ার আর্টসের ছেলেদের মধ্যে ওর মতো সুন্দর চেহারা একজনেরও ছিলো না। না, একজনের ছিলো – অমিয়। কিন্তু তার কেমন মেয়েলী-মেয়েলী চেহারা, মুখে পাউডার মাখতো, কোঁচানো শান্তিপুরী ধূতি পরতো, কথা- বার্তাতেও তার কেমন একটা সখী-সখী ভাব ছিলো। আমরা তাই ঠাট্টা করে বলতাম, সখী- বাবু।

অলক কিন্তু অমিয়র মতো ছিলো না। একেবারে অন্যরকম চেহারা, অথচ সন্দর। দোতলা বাসের সামনের সীটে ও একদিন বসেছিলো কলেজে আসবার সময়, আমি পিছনে, হাওয়ায় ওর শ্যাম্পু-করা হালকা চুল উড়ছিলো, পিছন থেকে ওর ঘাড়, টিকোলো নাক, চিবুক সব মিলে এমন ছবির মতো লাগছিলো, আর ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ দেখলাম কি, ওপাশের সীটে বসা একটি সুশ্রী মেয়ে একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে আছে।

আমি নিজের মনেই হেসে ফেলেছিলাম মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে। একসঙ্গে কলেজের সামনে বাস থেকে নেমেই সে কথা বলেছিলাম অলককে।

বলেছিলাম, তোর মতো চেহারা হলে কি করতাম জানিস?

লজিকের ক্লাসে প্রক্সির ব্যবস্থা করে যখন রানার কেবিনে এসে সবাই জড় হলাম, বাসে দেখা দৃশ্যটা রসিয়ে রসিয়ে আমি বর্ণনা করে মণীন্দ্রকে জিগ্যেস করলাম, ওর মতো চেহারা পেলে কি করতিস তুই, বল তো!

মণীন্দ্র হেসে বললো, কি আবার, চুটিয়ে প্রেম করতাম।

অমূল্য আমাকে প্রশ্ন করলো, তুই ?

বললাম, স্রেফ পকেট মারতাম। ওই চেহারায় ধরা পড়লেও কেউ বিশ্বাস করতো না।

মেয়েটিকে বাসের মধ্যে ওর দিকে ওভাবে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেলেছিলাম নিজের মনেই, কিন্তু ও বয়সে বুকের মধ্যে কি একটা, জ্বালা বোধ করিনি? একটু হিংসে? সেজন্যেই হয়তো বললাম, ওকে পেলে পকেটমাররা মাইরি লুফে নেবে।

অলক কিন্তু চটলো না, ও শুধু হাসলো। আসলে ও বোধ হয় কারও ওপর চটতে জানতো না, এত মিষ্টি ব্যবহার ছিলো ওর, এমন মোলায়েমভাবে কথাবার্তা বলতো যে ওর কাছে নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হতো।

কিন্তু একটা ব্যাপারে আমরা সবাই একমত ছিলাম—আমি, অমূল্য, মণীন্দ্র। আমরা তখন সেভেন-ও-ক্লকে দাড়ি কামিয়ে সিগারেট ধরিয়ে বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে যে-কোনো একটি মেয়ের চোখে বিশেষ হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু মনে মনে তখন আমরা সকলেই জানতাম, আমাদের কারও জীবনে কোনো দিন যদি সত্যি সত্যি প্রেম আসে তা হলে তা নিঃসন্দেহে আসবে অলকের জীবনে।

অথচ অলক নিজেও তখন হা-হতাশ করছে; অমিয়র অর্থাৎ সখীবাবুর বানানো প্রেমের গল্পে ডুব দিয়ে আমাদের মতোই আনন্দ পাচ্ছে।

এমন সময় সেই অঘটন ঘটে গেল।

কয়েক দিন ধরেই লক্ষ করছিলাম, অলক কি যেন বলবার জন্যে উসখুস করছে।

আমি শেষ অবধি আর থাকতে পারলাম না। বললাম, কি হয়েছে বল তো তোর? এত অন্যমনস্ক হয়ে যাস কেন মাঝে মাঝে ?

অলক কিছু বললো না, শুধু, মুচকি হেসে বললো, যাঃ।

অথচ অপ্রতিভ ভাব দেখে, ওর লাজুক-লাজুক তাকানোর মধ্যে সব রহস্য ধরা দিলো।

আমি বললাম, নির্ঘাত তুই প্রেমে পড়েছিস, বল সত্যি কি না?

অলক এস-বি’র ক্লাসে কোনো দিন নোট নেয়নি। তবে, সেদিন নোট নেওয়ার ছলে মুখ নামালো খাতার ওপর। তারপর ধীরে ধীরে বললো, বলবো, বলবো।

তা হলে সত্যিই কিছু ঘটেছে? সত্যিই কোনো মেয়েকে ভালোবেসেছে ও? শুনে অদ্ভুত এক ধরনের আনন্দ হলো। আর অদম্য এক কৌতূহল। যেন অলক নয়, আমি নিজেই কাউকে ভালোবেসে ফেলেছি।

ক্লাস শেষ হতেই রানার কেবিনে চা খেতে এলাম দুজনে।

আর অলক বললো, অমূল্যদের বলবি না বল ?

—না, কক্ষনো না।

একে একে সব কথা বলে গেল অলক, মনে হলো এ ক’দিন কারও কাছে তার এই গোপন আনন্দের খবরটুকু না দিতে পেরে ও নিজেও যেন দম বন্ধ হওয়া যন্ত্রণায় ভুগছিলো।

কি আশ্চর্য, অলকের ওপর আমার কিন্তু একটুও হিংসে হলো না। খু’টিয়ে খু’টিয়ে  আমি সব কথা জিগ্যেস করলাম। আর অলক যখন মেয়েটির সঙ্গে প্রথম আলাপ হওয়ার কথা, তার নিজের ভয়-সংশয়-অনিশ্চয়তার কথা বিশদভাবে বলে যেতো তখন আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম। যেন অলক নয়, আমি নিজেই একটি উপন্যাসের নায়ক হয়ে উঠেছি।

যেটকু দূরত্ব ছিলো, এই একটি ঘটনায় অলক আর আমি যেন আরো অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলাম।

আমি জিগ্যেস করলাম, কি নাম রে তার ?

—স্বর্ণ, স্বর্ণলতা। অলক মৃদ, হেসে কেমন সলজ্জভাবে বললো, বলেই প্রশ্ন করলো, ভারি মিষ্টি নাম, তাই না?

নামটা আমার খুব সেকেলে লাগলো, তবু, তবু, কেন জানি না খুব ভালো লাগলো। বললাম, খুব মিষ্টি নাম।

স্বর্ণকে দেখবার জন্যে আমার তখন প্রচণ্ড আগ্রহ। আলাপ করার তীব্র ইচ্ছে। আমি কি তা হলে অলকের মুখে তার কথা শুনে শুনে নিজের অজান্তেই স্বর্ণর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম! কি জানি।

অলক কিন্তু কিছুতেই আমাকে নিয়ে যেতো না, এমন কি চোখের দেখাতেও তার যেন আপত্তি। আমি বুঝতাম, ও আমাকে ভয় পায়, কিংবা বিশ্বাস করে না। সে কথা ভেবে হাসি পেতো, কখনো বা রাগ হতো। আমি কি ওর হাত থেকে স্বর্ণকে ছিনিয়ে নেবো? ছিনিয়ে নেওয়া কি সম্ভব? তবু ও কেন এড়িয়ে যেতে চায় আমি বুঝতে পারতাম না।

আমি তাই মাঝে মাঝে ওকে ঠাট্টা করতাম। বলতাম, আমার সঙ্গে আলাপ হলেই আমার প্রেমে পড়ে যাবে নাকি তোর স্বর্ণ ?

স্বর্ণকে নিয়ে কোনো ঠাট্টা অলক কিন্তু একেবারেই সহ্য করতে পারতো না। ওর উজ্জল মুখখানা তখন কেমন যেন হঠাৎ ম্লান হয়ে যেতো।

এমন সময়ে হঠাৎ একদিন খুব খুশী-খুশী মুখ নিয়ে হাজির হলো অলক। যেন পৃথিবী জয় করে এইমাত্র ফিরে এলো।

বললাম, কি ব্যাপার? এত ফুর্তি কিসের?

অলক লাজুক হাসি হেসে একটা চিরকুট বের করলো বুকপকেট থেকে। এগিয়ে দিলো আমার দিকে।

মাত্র দু লাইনের একটা চিঠি। স্বর্ণর লেখা। যেন এর চেয়ে মূল্যবান পৃথিবীতে আর কিছুই নেই, থাকতে পারে না, এমনভাবে চিরকুটটা ফেরত নিলে, অলক, সযত্নে নরম হাতের স্পর্শে সেটা ভাঁজ করলো করে পকেটে রাখলো।

তারপর ওর কপালে দুশ্চিন্তা দেখা দিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, কি করি বল তো? উত্তর চেয়েছে।

—উত্তর দিবি!

অলক চুপ করে রইলো, তারপর বললো, যা হাতের লেখা আমার…

আমি হেসে ফেললাম। সত্যি, বেচারীর হাতের লেখা সত্যিই একেবারে বিশ্রী। ওই হাতের লেখায় কি প্রেমপত্র লেখা যায় ?

অলক নিজের মনেই বললো যেন, স্বর্ণর হাতের লেখাটা খুব সুন্দর, না রে?

সুন্দর না হলেও বেশ পরিচ্ছন্ন, বেশ স্পষ্ট।

অলক কি যেন ভাবলো, তারপর বললো, তোর মতো হাতের লেখা যদি হতো আমার শুনে ভীষণ ভালো লাগলো আমার, বুকের গোপনে একটা গর্বের ফুল যেন পাপড়ি মেলতে চাইলো। অলকের সঙ্গে কোনো দিক থেকেই তো আমার কোনো তুলনা হয় না, তবু তবু একটা জায়গায় আমার মাথা যেন অলককে ছাড়িয়ে অনেক উচুতে উঠে গেল। আমার হাতের লেখা সুন্দর, খুব সুন্দর। আর প্রেমের চিঠিও হয়তো আমি ওর চেয়ে অনেক ভালো করে লিখতে পারবো। ও কি লিখবে? ও তো বনলতা সেন পড়েইনি।

অলক তখনো উসখুস করছে। কি যেন বলতে চায়। যদি বলতেই চায় বলেই ফেলুক না। যদি চায়, ওর হয়ে আমি একটা চিঠি ড্রাফট্ করেও দিতে পারি, ও সেটা নকল করে স্বর্ণকে পাঠিয়ে দিতে পারে।

আমি অপেক্ষা করে রইলাম, ও কি বলে শোনবার জন্যে।

অলক অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর হঠাৎ বললো, স্বর্ণ তো আমার হাতের লেখা চেনে না, তুই লিখে দে না!

আমি হেসে ফেললাম। – আহা রে, তোমার হয়ে আমি চিঠি লিখি, তারপর বাপের কাছে ধরা পড়লে আমাকে ঠ্যাঙানি খেতে হোক আর কি!

অলক বাধা দিলো। —যাঃ, তা কেন হবে। তোকে তো কেউ চেনেই না।

ওঃ হো, আসলে হাতের লেখা-টেখা তা হলে বাজে কথা। ধরা পড়ার ভয়ে নিজের হাতে চিঠি লিখতে চাইছে না অলক। তা ছাড়া আর কি, যাকে ভালোবাসিস তার কাছ থেকে হাতের লেখাটা লুকোবার কি দরকার শুনি !

অলক কিন্তু ততক্ষণে আমার কাঁধে হাত রেখে অনুনয়ের কণ্ঠে বলছে, শোন আনন্দ, তোকে লিখে দিতেই হবে।

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ‘না’ বলতে পারলাম না। অনেক সুন্দর সুন্দের কবিতার  লাইন দিয়ে, অনেক ফুল-তারা-পালক সাজিয়ে একটা চিঠি লিখে দিলাম। লিখতে লিখতে মনে হলো যেন অলক নয়, আমিই না-দেখা না-জানা একটি ষোল বছরের মেয়ের উদ্দেশে আমার বুকের সুপ্ত অনুভূতিগুলো উজাড় করে দিচ্ছি।

কিন্তু একখানা চিঠি লিখেই কি নিস্তার আছে। দিন কয়েক পরেই স্বর্ণর উত্তরটা নিয়ে এসে হাজির হলো অলক।–দেখ আনন্দ, তোর চিঠির, তোর হাতের লেখার কত প্রশংসা করেছে।

সত্যিই। স্বর্ণর চিঠিটা পড়তে পড়তে আমার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠলো। অলকের লেখা মনে করে স্বর্ণ যা কিছু লিখেছে, যা কিছ, প্রশংসা, তা যেন আমারও প্রাপ্য।

আমি তাই ঠাট্টা করে বললাম, দেখিস অলক, শেষ অবধি স্বর্ণ না আমার প্রেমে পড়ে যায়।

শনে অলক হাসলো। বললো, এবারে আরো ভালো করে লিখে দে উত্তরটা।

আমি কি অলকের অনুরোধ শুনে ভালো করে লিখতে চেষ্টা করতাম? না। জীবনে যে কোনো দিন প্রেমের স্পর্শ পায়নি, প্রেম যার কাছে শুধু, বইয়ে-পড়া অনেক দূর থেকে দেখা অস্পষ্ট অভিজ্ঞতা, অথচ অভাবে হতাশায় কল্পনার রঙে মেশানো একটা অনুভূতি, একটা চিঠি লেখার সংযোগ পেয়ে তার হৃদয়ই হয়তো কপাট খুলে দিয়েছিলো।

একদিন তাই সন্দেহ হলো, আমি অলকের হয়ে স্বর্ণকে চিঠি লিখছি, না আমি নিজেই তার কাছে কৃপাপ্রার্থীর মতো ছুটে যেতে চাইছি।

স্বর্ণ কে, সে কেমন দেখতে, আমাকে দেখে সে ঘৃণায় মুখে ফেরাবে কি না এসবের হিসেব নিতে ইচ্ছে হতো না। আমার শুধ, মনে হতো, আমি নিজেই যেন স্বর্ণ নামের কোনো একটি মেয়েকে প্রেম নিবেদন করছি।

এক-একসময় তাই অলককে আমার অসহ্য লাগতো, অসহ্য লাগতো স্বর্ণ’র চিঠিগুলো।

কারণ, সে চিঠিতে আনন্দর কোনো ভূমিকা নেই। সেখানে দেখতাম স্বর্ণর সমস্ত মন জুড়ে বসে আছে অলক। আনন্দ বলে কেউ আছে এ খবরও সে জানতো না।

সেদিন তাই অলক যখন আবার একটা চিঠি লিখে দিতে বললো, আমি হেসে বললাম, ওসব চলবে না রোজ রোজ। স্বর্ণকে একটা চুমু খেতে দিবি বল, তা হলে লিখে দেবো।

তা না হলে যাও বাবা, নিজে লিখে নেবে যাও।

আমি ভেবেছিলাম আমার কথা শুনে অলক হাসবে। কিন্তু ও হাসতে পারলো না।

অসহ্য কোনো কষ্টে ওর সমস্ত মখ মুহূর্তে কেমন বিকৃত হয়ে গেল। বুঝলাম, ও খুব  আঘাত পেয়েছে। তখন তো জানতাম না, কাউকে যখন আমরা ভালোবাসি তখন ভিতরে ভিতরে আমরা তাকে শ্রদ্ধাও করি।

অলক অসহায় দুর্বলের মতো আমার হাতের ওপর হাত রাখলো। বললো, তুই আনন্দ, তুই এসব বলিস না।

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অপ্রতিভ বোধ করলাম। মনে হলো এখনই বুঝি ওর দু চোখ ঠেলে জল গড়িয়ে পড়বে।

 

অলক আমাকে বলেছিলো, অমূল্যদের তুই এসব কথা বলিস না। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বলবো না। কিন্তু আমার মাঝে মাঝেই ভয় হতো, যদি কোনো কারণে স্বর্ণ তার বাবা-মার কাছে ধরা পড়ে, যদি অলকের বাবার কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন তাঁরা…

মণীন্দ্র প্রথম শুনেই বলেছিলো, করেছিস কি তুই ? ধরা পড়লেই তো ও শালা বলবে তোর লেখা। মরবি তুই, দেখিস।

বাড়ি জিনিসটা তখন আমাদের কাছে একটা কঠোর শাসনের রক্তচক্ষু। বাবাকে কোনো কোনো পারিবারিক অশান্তির মূহুর্তে দেখে মনে হতো পুলিস ফাঁড়ির দারোগা। সাদা কথায়, বাবা, মা, মেজকা, বড়দা, এমন কি সেজদিকেও আমরা ভয় পেতাম।

তাই প্রায়ই মনে হতো প্রতিজ্ঞা চুলোয় যাক, অমূল্যদের সব কথা খুলে বলি, ওরা অন্তত সাক্ষী দেবে যে চিঠিগুলো আমার লেখা নয়। অর্থাৎ হাতের লেখাটাই শুধু আমার।

সেদিন রানার কেবিনে এসে বসেছি, মণীন্দ্র অমূল্য ওরা সখীবাবুকে ঘিরে ধরেছে, আর কোঁচানো ধুতির ডগাটা কাগজের ফুলের মতো বাঁ হাতের মুঠোতে তুলে ধরে অমিয় দিব্যি তার প্রেমের গল্প বলে যাচ্ছে। ছেলেটাকে দেখলেই আমার গা জালা করতো। আমরা যে এমন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াই, কই, একটি মেয়েও তো ফিরে তাকায় না। অথচ প্রতি দিনই এক-একজন নতুন প্রেমিকা জোটে ওর।—আমি তো দেখিনি, বাস থেকে নামতেই একটা মেয়ে বললো, শুনুন…

সখীবাবু বলে যাচ্ছিলো, আর অমূল্য মণীন্দ্র গোগ্রাসে গিলছিলো তার বানানো গল্প।

আমি অমিয়কে আঘাত দেবার জন্যেই বললাম, আরে দূর, ওসব কে শুনতে চায়। অলক আসুক, তার কাছে শুনবি।

—অলক? ওরা সকলেই চমকে উঠলো।

আর আমি যতখানি সম্ভব বাড়িয়ে বাড়িয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে, যতখানি সম্ভব সুন্দর করে তার প্রেমের গল্প শোনালাম ওদের। চিঠি লিখে দেওয়ার কথাও।

মণীন্দ্র সব শুনে বললো, ও ব্যাটা ধরা পড়লে মরবি তুই, ও স্রেফ তোর ঘাড়ে দোষ চাপাবে।

তা চাপাক, ওরা তো সাক্ষী রইলো, তখন দেখা যাবে। কিন্তু আমার ইচ্ছে হতো, অলক তার স্বর্ণকে বলুক, চিঠিগুলো আমার লেখা, তার প্রতিটি শব্দ আমার অনুভূতি দিয়ে গড়া, হাতের লেখাটাও।

কিংবা সেসবই ও গোপন করে রাখুক, শুধু, একটি দিন ও স্বর্ণকে দেখতে দিক। শুধু চোখের দেখা, আর কিছু নয়।

আমি তখন কল্পনায় স্বর্ণকে দেখি, স্বর্ণর একটা মিষ্টি সুন্দর চেহারা আমার বুকের  মধ্যে আঁকা হয়ে গেছে।

এদিকে অলক আমার ওপর খুব চটে গিয়েছিলো, আমি কেন সব কথা অমূল্যদের বলে দিয়েছি।

আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম, বেশ করেছি, তুই আর আসিস না আমার কাছে চিঠি লিখতে।

কিন্তু বেচারী না এসেই বা পারবে কেন! তখন ও আমার হাতের মুঠোর মধ্যে, তখন ইচ্ছে করলে আমি ওকে দু আঙুলে ধরা ফড়িঙের মতো ছটফটিয়ে মারতে পারি, ইচ্ছে করলে ওকে কাশের আকাশে উড়িয়ে দিতে পারি।

অর্থাৎ তখন আর হাতের লেখা বদলানোর উপায় নেই অলকের। আমার শরণাপন্ন তাকে হতেই হবে। তখন আর সব কথা স্বর্ণকে খুলে বলারও সাহস নেই তার, পাছে সব কথা শুনে স্বর্ণ তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে, অবিশ্বাস করতে শুরু করে।

আমি তাই সেদিন আবার বললাম, এক-একটা চিঠির দাম এক-একটা চুমু। স্বর্ণকে একটা চুমু খেতে দিবি বল, তবে লিখে দেবো।

অমূল্য আর মণীন্দ্র হো হো করে হেসে উঠলো, বললো, ঠিক বলেছে আনন্দ।

কিন্তু অলকের মুখ সাদা হয়ে গেল ও এক অসহ্য যন্ত্রণা লুকিয়ে হাসবার চেষ্টা করতেই ওর মুখটা কেমন বিশ্রী দেখালো।

তা দেখাক, ওই বা আমাকে এভাবে এড়িয়ে এড়িয়ে চলবে কেন? স্বর্ণকে একটা দিন কি ও চোখের দেখা দেখাতে পারে না? একটা দিন আলাপ করানোর সুযোগ পায় না? আমি বুঝতাম, ও নানা অজুহাতে স্বর্ণকে আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখতে চায়।

কিন্তু ও প্রায়ই বলতো, স্বর্ণর সঙ্গে দেখা হলো, স্বর্ণ কি বলেছে জানিস? বলেছে, আমাকে না পেলে সারা জীবন…

—রেখে দে তোর স্বর্ণ! আমি বিরক্ত হয়ে একদিন বলেছিলাম। তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু কষ্ট হয়েছিলো। বলেছিলাম, হ্যাঁ রে, প্রায়ই তো তোদের সঙ্গে দেখা হয়, তা হলে এত চিঠি লেখালেখি কেন?

অলক খুব লজ্জা পেয়েছিলো, তারপর বলেছিলো, মুখে কি মনের কথা বলা যায় রে!

কিন্তু চিঠিতে তো অলকের মনের কথা আমি লিখতাম না, লিখতাম বোধ হয় নিজেরই মনের কথা। স্বর্ণকে নয়, যে-কোনো একটি মেয়েকে। আমার কামনা বাসনা অতৃপ্তির রঙ বুলিয়ে লিখতাম সেসব চিঠি।

এমনিভাবেই চলছিলো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।

হঠাৎ একদিন অলককে কেমন উদ্ভ্রান্ত দেখালো। দিনে দিনে ওর শরীরের সমস্ত রক্ত যেন কে ধীরে ধীরে নিঙড়ে নিচ্ছে। ওর চোখের দৃষ্টি বদলে গেল। কেমন একটা রক্ষ প্রতিবাদের মতো ওকে মনে হতো।

একদিন জিগ্যেস করলাম, কি হয়েছে রে অলক? আর তো চিঠি লেখাস না?

একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে অলক বললো, বলবো, বলবো।

সেদিন কলেজ ছুটির পর আমরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কার্জন পার্কের দিকে চলে গেলাম। তখন কার্জন পার্কের অন্য চেহারা, অন্য রূপ। ট্রামের ঘর্ঘর ছিলো না, লোকের ভিড় ছিলো না এত, অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফুল-ফুল ঘাস নিঃশব্দতা ম্লান আলো অন্ধকার ‘মা-লি-শ’।

আমরা দুজনে এসে আরো নির্জন একটা কোণ বেছে নিয়ে বসলাম, বাঁ কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া, দাঁতে ঘাসের একটা লম্বা শীর্ষ কাটলাম, জিগ্যেস করলাম, বল তো কি ব্যাপার।

অলক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো, স্বর্ণর বিয়ে।

—কার সঙ্গে? আমি চমকে উঠে জিগ্যেস করলাম।

অলক তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো, কে জানে, আমি জানতে চাইওনি।

তারপর পকেট থেকে একটা বাণ্ডিল বের করলো। সেই চিরকুট থেকে শুরু করে যত চিঠি স্বর্ণ তাকে লিখেছিলো, যেগুলো উত্তর লেখার জন্যে দরকার এই অজুহাতে আমি মাঝে মাঝেই পড়ে নিতাম, পড়ে ভালো লাগতো, নতুন করে বেচে উঠতে ইচ্ছে হতো, যেগুলো পড়ে মনে হতো যেন কোনো একটি মেয়ে, একটি শান্ত স্নিগ্ধতার শরীর, একটি উজ্জজ্জ্বল গভীর মন, আমাকেই লিখেছে, আমাকে। আমার সমস্ত অতৃপ্তি আর শূন্যতা ভরে যেতো।

অলক সেই বাণ্ডিলটা সামনে রাখলো। তারপর দীর্ঘশ্বাসের স্বরে বললো, সব শেষ হয়ে গেল আনন্দ, সব শেষ।

বলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে একটা দিলো, একটা প্যাকেটের গায়ে ঠুকে ঠুকে নিজের ঠোঁটে চেপে রইলো। তারপর অনেকক্ষণ কি যেন ভাবলো ও।

দেশলাই বের করে ফস্ করে একটা কাঠি জ্বেলে আমার সিগারেটটা ও ধরিয়ে দিলো, নিজেরটা ধরালো।

কে. সি. দাসের মাথায়, একেবারে আকাশ ছুয়ে আলো জ্বলে জ্বলে তখন খেলার খবর লেখা হয়ে যাচ্ছে, খবর জ্বলে উঠছে এক-এক লাইন।

কিন্তু আমার সেদিকে কোনো আগ্রহ নেই তখন।

অলক আবার বললো, আজ রাত্রেই সব শেষ হয়ে গেল।

— আজ রাত্রে? আমি চমকে উঠলাম।

—হ্যাঁ। আজ স্বর্ণর বিয়ে।

আমার মনে হলো আমি ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়েছি। আমার মনে হলো আমার শরীরে কোনো শক্তি নেই, আমি ভেঙে পড়েছি। ‘সব শেষ হয়ে গেল’ কথাটা বারবার আমার কানের কাছে বাজলো। আমার মনে হলো যেন আমি নিজেই আমার কোনো প্রেমিকার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। মনে হলো কেউ আমার জীবনের সমস্ত আনন্দ শুষে নিয়ে চলে গেল। আমি বুঝতে পারলাম, আমি স্বর্ণকে কোনো দিন দেখিনি, চিনি না, তার কণ্ঠস্বরও আমার অচেনা, তবু আমি যেন নিজেরই অজান্তে তাকে কখন ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

অলক সিগারেটে পর পর কয়েকটা টান দিলো, তারপর ফস করে আরেকটা দেশলাই কাঠি জেলে চিঠির বাণ্ডিলটা তার ওপর ধরলো।

—অলক ! আমি চীৎকার করে উঠলাম।

আমি চিঠির বাণ্ডিলটা দ্রুত হাতে কেড়ে নিলাম।

বললাম, এ কি করছিস অলক?

অলকের মুখ আবছা দেখা যাচ্ছিলো। মনে হলো একটা অসহ্য যন্ত্রণাকে ও বুকের মধ্যে চেপে রাখার চেষ্টা করছে।

ও অনেকক্ষণ চোখ বুজে রইলো। তারপর বললে, দে আনন্দ, পুড়িয়ে শেষ করে দিই।

ওগুলোকে বড় ভয় আমার। কাছে থাকলে জানি না কবে কি করে বসি। ছি ছি, শেষে স্বর্ণর যদি কোনো ক্ষতি করে বসি, যদি রেগে পাগল হয়ে গিয়ে…

আমি ওর হাত চেপে ধরলাম। বললাম, তোর ভয় নেই, এগুলো আমার কাছে থাক।

যখন এ চিঠিগুলোকে তোর আর কোনো ভয় থাকবে না, যখন জ্বালা জুড়িয়ে গিয়ে শুধু, একটা মিষ্টি স্মৃতি হয়ে থাকবে চিঠিগুলো, তখন তোকে এগুলো দিয়ে দেবো।

অলক আর স্বর্ণর চিঠিগুলো ফেরত চায়নি। নাকি একবার চেয়েছিলো, আমি খুজে  পাচ্ছি না এই অজুহাতে ফেরত দিইনি।

এ চিঠিগলো যে তখন আমার, আমারই। কতদিন কতবার যে পড়েছি, কতবার লিখে দেওয়া উত্তরের লাইনগুলো মনে পড়েছে।

এক-একসময় আমার মনে হয়, আমি স্বর্ণকে দেখেছি, আমি স্বর্ণকে চিনি, স্বর্ণর কথা শুনেছি, ঐ তো হেসে হেসে কত মিষ্টি করে ও বলছে, এই, তুমি শরীরের যত্ন নিচ্ছো না কেন বলো তো! এই, তুমি ওভাবে চলন্ত বাস থেকে কোনো দিন নামবে না।

আজ অলক কোথায় চলে গেছে জানি না। অলক কি করে, কোথায় আছে, বে’চে আছে কি না কিছুই জানি না। কয়েকটা যুগ পার হয়ে গেছে। অলক আজ দূরে সরে গেছে, অনেক দূরে।

কিন্তু স্বর্ণ আজও আমার কাছে কাছে, আমার পাশে পাশে। যেদিনই নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়, যেদিনই কোনো গভীর বেদনা আমার বুকে পাথর হয়ে চেপে বসে, সেদিনই স্বর্ণর সেই চিঠিগুলো বের করে খুলে দেখি, পড়ি।

আর মনে মনে কল্পনায় ভাবতে ইচ্ছে করে, স্বর্ণ কোথায় জানি না, অনেক দূরে, অনেক বিস্মৃতি পেরিয়ে কোন এক অশান্ত অতৃপ্ত মহূর্তে তার স্বামী-সন্তানদের লুকিয়ে হয়তো, হয়তো তার ভাঙা তোরঙ্গের নীচ থেকে দুপুরের নির্জনতায় আমার লেখা চিঠিগুলো খুঁজে বের করে, সে চিঠি পড়ে। পড়তে পড়তে…অলকের চেহারা এখন নিশ্চয় তার কাছে ঝাপসা হয়ে গেছে, অলককে সে ছুঁতে পারে না, চিঠিগুলো পড়তে পড়তে তাই কোনো একসময় আমার লেখা তারা-ফুল-কাশ-আকাশ গভীর যন্ত্রণা অনুভব করতে করতে আমাকেই ছুয়ে যায়। আমাকে।

ঠিক যেভাবে আজও আমি মাঝে মাঝে স্বর্ণর চিঠিগুলো…

তবে কি আমরা যখন গল্প লিখি, গল্প পড়ি, তখন এমনি কোনো অদেখা স্বর্ণ আর বিস্মৃত অলকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই!

 

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments