সিলভার ব্লেজ (শার্লক হোমস) – আর্থার কোনান ডয়েল

শেয়ার করুনঃ

সূচিপত্রঃ—

এক

সকালবেলা। আমরা চা খাচ্ছিলাম। হোমস বলল, “ওয়াটসন, আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে।”

 

“বাইরে? কোথায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 

“কিংস পাইল্যান্ড, ডার্টমুরে।”

 

হোমসের কথায় আমি মোটেই অবাক হলাম না। সত্যি কথা বলতে কী, এই ব্যাপারে হোমসের এত দিন ডাক পড়েনি কেন এই ভেবেই আমি মনে মনে আশ্চর্য হচ্ছিলাম। ডার্টমুরে যে কাণ্ড ঘটে গেছে, তার আলোচনায় সারা ইংল্যান্ড একেবারে সরগরম। কাল সারা দিনটা হোমস ঘরের ভেতরে তার পরিচিত ভঙ্গিতে বুকের ওপর দু’হাত রেখে মাথা নিচু করে অনবরত পায়চারি করেছে। আর একটার পর একটা পাইপে কড়া তামাক পুরে সেগুলো টেনেছে। আমি তার সঙ্গে দু’-এক বার কথা বলবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার কোনও কথাই তার কানে ঢোকেনি। আমাদের খবরের কাগজওয়ালা একটার পর একটা কাগজ এনে দিচ্ছিল। আর হোমস একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই কাগজগুলো ঘরের কোণে ছুড়ে দিচ্ছিল। হোমস চুপচাপ থাকলেও কী নিয়ে যে এমন গভীর ভাবে চিন্তা করছে, সেটা আমি টের পেয়েছিলাম। ঠিক এই মুহূর্তে সারা দেশের সামনে একটিই সমস্যা। আর সেই সমস্যার সমাধান করতে পারাটা শার্লক হোমসের সামনে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। সমস্যাটা হল যে, ওয়েসেক্স কাপ বাজিতে যে-ঘোড়াটা জিতবে বলে সকলে ধরে নিয়েছিল, সে ঘোড়াটাই বা লোপাট হয়ে গেল কোথায়, আর তার ট্রেনারকেই বা খুন করল কে? তাই হোমস যখন হঠাৎ যেখানে ওই মারাত্মক ঘটনাটা ঘটেছে সেখানে যাওয়ার কথা বলল, তখন আমার বেশ স্ফূর্তি হল।

 

আমি বললাম, “তোমার যদি অসুবিধা না হয় তো আমি তোমার সঙ্গে যেতে চাই।”

 

“ওয়াটসন, তুমি সঙ্গে থাকলে আমার খুব সুবিধে হবে। তোমাকে এটুকু বলতে পারি যে, ওখানে গেলে তোমার সময়টা নষ্ট হবে না। এই ব্যাপারটার মধ্যে এমন কতকগুলো জিনিস আছে, যেগুলো সত্যিই খুব ভাববার। সে কথা থাক। এখনই আমাদের তৈরি হয়ে প্যাডিংটনের দিকে যেতে হয়। ট্রেনের খুব দেরি নেই। সব কথা আমি তোমাকে গাড়িতে যেতে যেতে বলব। ভাল কথা, তুমি তোমার সেই দারুণ বায়নাকুলারটা সঙ্গে নিতে ভুলো না।”

 

ঘণ্টাখানেক পরে ট্রেনের একটা ফার্স্টক্লাস কামরার জানলার ধারের দুটো সিট দখল করে আমরা ডার্টমুরের পথে একজিটারের দিকে ছুটে চললাম। হোমস প্যাডিংটন স্টেশনে একগাদা খবরের কাগজ কিনেছিল। সে গম্ভীর মুখে একমনে কাগজগুলো পড়তে লাগল।

 

হোমস যখন খবরের কাগজ পড়া শেষ করল, তখন আমরা রেডিং স্টেশন ছাড়িয়ে চলে গেছি। কাগজগুলো বেশ ভাল করে ভাঁজ করে একপাশে সরিয়ে রেখে হোমস নিজের সিগার কেসটা আমার দিকে এগিয়ে দিল।

 

হোমস জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল। একবার হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল, “গাড়িটা বেশ ভালই যাচ্ছে। আমরা এখন ঘণ্টায় সাড়ে তিপ্পান্ন মাইল বেগে যাচ্ছি।”

 

“এ দিকে বুঝি সিকি মাইল অন্তর পোস্ট আছে। একদম খেয়াল করিনি তো,” আমি বললাম।

 

“না, আমিও দেখতে পাইনি। তবে লক্ষ করলে দেখবে, লাইনের ধারে টেলিগ্রাফের খুঁটিগুলো ষাট গজ পর পর বসানো। তার থেকে গাড়িটা কত মাইল স্পিডে যাচ্ছে, সেটা কষে বের করে নেওয়া মোটেই শক্ত নয়। সে কথা থাক। জন স্ট্রেকার লোকটির খুন হওয়া আর সিলভার ব্লেজ নামে ঘোড়াটার লোপাট হওয়ার খবরটা তুমি নিশ্চয়ই মোটামুটি জানো?”

 

আমি বললাম, “হ্যাঁ, ‘টেলিগ্রাফ’ আর ‘ক্রনিকল’ পত্রিকায় যতটুকু বেরিয়েছে, ততটুকুই জানি।”

 

“এই রহস্যের মামলাটা একটু অন্য ধরনের। এই ধরনের রহস্যের জট খুলতে গেলে গোয়েন্দার প্রথম কাজ হল, ঘটনাগুলো পর পর যেমন যেমন ঘটেছে সেই ভাবে সাজিয়ে নেওয়া। নতুন কোনও তথ্য বা সূত্রের সন্ধান পরেও করা যেতে পারে। এই ব্যাপারটা এমনই অদ্ভুত, এমনই আটঘাট বেঁধে ভেবেচিন্তে করা যে, তার ফলে আমাদের সামনে নানান মত, উদ্ভট কল্পনা, মিথ্যে গালগল্পের পাহাড় জমে উঠেছে। তাই সব চাইতে গোড়ার কাজ যেটা, সেটা হল এই সব আবোলতাবোল মিথ্যে গালগল্পের মধ্য থেকে সত্য ঘটনাকে ঝেড়েবেছে নিয়ে রহস্যের কাঠামোটা ঠিক করা। সেটা করে নিয়ে প্রত্যেকটা ঘটনাকে আলাদা আলাদা করে বিশ্লেষণ করতে হবে। সেই বিশ্লেষণ থেকে কতগুলো অনুমান করা যাবে। সেই অনুমানগুলোকে বিচার করলে বোঝা যাবে, কোন পথে গেলে রহস্যের জট খোলা যাবে। মঙ্গলবার সন্ধেবেলায় আমি দুটো টেলিগ্রাম পেয়েছি। একটা তার পাঠিয়েছেন সিলভার ব্লেজ ঘোড়ার মালিক, কর্নেল রস। আর একটি তার পাঠিয়েছেন ইন্সপেক্টর গ্রেগরি, যিনি এই রহস্যের অনুসন্ধান করেছেন। গ্রেগরি আমার সাহায্য চেয়েছেন।”

 

আমি একটু রেগেই বলে উঠলাম, “টেলিগ্রাম পেয়েছ মঙ্গলবার, আর আজ হচ্ছে বৃহস্পতিবার। তুমি গতকালই গেলে না কেন?”

 

“না, যাইনি। আমি ভুল করেছি। ওয়াটসন, তোমার লেখা পড়ে সাধারণ লোকের মনে আমার সম্বন্ধে যে-ধারণা গড়ে উঠেছে সেটা ঠিক নয়। সকলে ভাবে আমার ভুল হয় না। তা নয়, আমারও ভুল হয়। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, এমন কাণ্ড ঘটতে পারে এ কথা আমি বিশ্বাস করতেই পারিনি। ডার্টমুর এমনিতেই খুব নির্জন জায়গা। লোকজনের বসতি কম। সিলভার ব্লেজের মতো নামডাকওয়ালা ঘোড়াকে, যাকে লোকে দেখলেই চিনতে পারবে, কেউ লুকিয়ে রাখতে পারবে বলে আমার মনে হয়নি। কাল সারা দিন আমি আশা করেছি। সিলভার ব্লেজকে ফিরে পাওয়ার আর স্ট্রেকারের আততায়ীর গ্রেফতারের খবর পাওয়ার জন্যে আমি সকাল থেকে উদ্‌গ্রীব হয়ে বসে থেকেছি। কিন্তু আজ সকালে খবরের কাগজ পড়ে যখন জানতে পারলাম, পুলিশ ফিটস রয় সিমসনকে গ্রেফতার করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি তখনই ঠিক করে ফেললাম, এ ভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। তবে কালকের দিনটা একদম বৃথাই যায়নি।”

 

“ও, তুমি তা হলে একটা হদিস পেয়েছ?”

 

“না, তা ঠিক নয়। তবে মূল ঘটনাটা যে কী, তা জানতে পেরেছি। তোমাকে সব খুলে বলছি, মন দিয়ে শোনো। সব কথা না জানলে তোমার পক্ষে আমাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, তোমাকে ব্যাপারটা বললে সবকিছু আমার নিজের কাছেও স্পষ্ট হবে।”

 

একটা সিগার ধরিয়ে গদিতে হেলান দিয়ে আমি বেশ জুত করে বসলাম। হোমস সামনের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকে পড়ে ডান হাতের আঙুল দিয়ে বাঁ হাতের চেটোয় দাগ টানতে টানতে কথা বলতে শুরু করল।

 

“সিলভার ব্লেজ ইসোনমি বংশের ঘোড়া। খুব ভাল ঘোড়া। মাত্র পাঁচ বছর বয়স। এর মধ্যেই ঘোড়াটা যত নামকরা বাজি আর দৌড় আছে, সব ক’টায় জিতেছে। সেদিক দিয়ে সিলভার ব্লেজের মালিক কর্নেল রসকে বেশ ভাগ্যবান বলতে হয়। সকলেই ধরে নিয়েছে যে, ওয়েসেক্স কাপ দৌড়েও সিলভার ব্লেজই ফার্স্ট হবে। তা হলে বুঝতেই পারছ যে, ঘোড়াটাকে লোপাট করে দিতে পারলে অনেক লোকেরই সুবিধে হবে।

 

“আর এ কথা কিংস পাইল্যান্ডে, যেটা কর্নেল রসের আস্তাবল, সকলেই জানে। আর সেই কারণে সিলভার ব্লেজকে সর্বদাই কড়া পাহারায় চোখে চোখে রাখা হত। সিলভার ব্লেজকে দেখাশোনার ভার, তাকে দৌড়ের জন্যে ঠিকঠাক রাখার ভার ছিল ওই জন স্ট্রেকারের ওপর। স্ট্রেকার প্রথমে ছিলেন ‘জকি। প্রায় বছর পাঁচেক তিনি কর্নেল রসের জকি ছিলেন। ইদানীং তিনি এত বেশি মোটা হয়ে গেছেন যে জকি হতে পারেন না। গত সাত বছর উনি কর্নেল রসের ঘোড়ার তদারকি করেন। আজ পর্যন্ত তাঁর কাজে কোনও গাফিলতি ধরা পড়েনি। স্ট্রেকারকে সাহায্য করবার জন্যে আরও তিন জন ছোকরা আছে। কর্নেল রসের আস্তাবলটাও খুব বড় নয়। মোটে চারটে ঘোড়া আছে। আস্তাবলে কাজের জন্যে যে-ছেলেগুলি আছে, তারা এক এক জন পালা করে সারা রাত্তির পাহারা দেয়। আর বাকি দু’জন আস্তাবলের উপরে যে-মাচা আছে, সেখানে ঘুমোয়। ওই ছেলেগুলির স্বভাবচরিত্র খুবই ভাল। জন স্ট্রেকারের স্ত্রী আছে। আস্তাবল থেকে আন্দাজ পাচশো গজ দূরে একটা ছোট বাংলো ধরনের বাড়িতে ওঁরা থাকেন। ওঁদের ছেলেপিলে নেই। ঘর সংসারের কাজ করবার জন্যে একটা মেয়ে আছে। সে ওই বাড়িতেই থাকে। স্ট্রেকারের অবস্থা বেশ ভাল। ওঁরা যেখানে থাকেন, সেখানটা ফাঁকা ফাঁকা। লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। আস্তাবল আর স্ট্রেকারের বাড়ির কাছাকাছি জনবসতি বলতে কতকগুলো ছোট বাড়ি। ট্যাভিস্টকের এক কন্ট্রাক্টর ভদ্রলোক এই বাড়িগুলো তৈরি করিয়ে দেন। যাঁরা শরীর সারাবার জন্যে ‘চেঞ্জে’ আসেন তাঁরা ওই সব বাড়িতে ভাড়া দিয়ে থাকেন। এই বাড়িগুলো স্ট্রেকারের বাড়ি আর আস্তাবলের খাড়া উত্তরে আধমাইলটাক দূরে। এখান থেকে পশ্চিমে ট্যাভিস্টক, মাইল দুয়েক দূরে। কর্নেল রসের আস্তাবল থেকে দু’-আড়াই মাইল দূরে ঠিক মাঠের উলটো দিকে লর্ড ব্যাকওয়াটারের আস্তাবল কেপলটন। সাইলাস ব্রাউন হচ্ছে এই আস্তাবলের কর্তা। এ ছাড়া চার দিকে ধুধু করছে তেপান্তরের মাঠ। মাঝে মাঝে জিপসিদের এই মাঠে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। এই রকম অবস্থায় গত সোমবার রাত্তিরে দুর্ঘটনাটি ঘটল।

 

“সে দিনও সন্ধেবেলায় ঘোড়াগুলোকে নিয়মমতো ছুটিয়ে আনা হয়। তারপর জল দিয়ে ঘোড়াগুলোর গা ধুইয়ে, ভালমতন দলাইমলাই করে ঠিক রাত ন’টার সময় আস্তাবলের দরজায় তালা-চাবি দিয়ে দেওয়া হয়। দু’জন ছোকরা রাতের খাওয়া সেরে নিতে স্ট্রেকারের বাড়ি যায়। আর একজন, তার নাম নেড হান্টার, আস্তাবল-বাড়ির পাহারা দেবার জন্যে থেকে যায়। ন’টা বাজবার কিছুক্ষণ পরেই স্ট্রেকারের বাড়ির কাজের মেয়েটি, নাম এডিথ বাক্সটার, নেডের খাবার নিয়ে আস্তাবলের দিকে আসছিল। খাবার বলতে মাটনকারি। জলের ব্যবস্থা আস্তাবলেই আছে। যে-রাতে যার উপর আস্তাবল পাহারার ভার থাকে, তাকে সে রাতে জল ছাড়া অন্য কোনও পানীয় দেওয়া হয় না। একে তো কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার ওপর রাস্তাটা গেছে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে। তাই আস্তাবলে আসবার সময় এডিথ একটা লণ্ঠন নিয়ে বেরিয়েছিল।

 

“এডিথ যখন আস্তাবলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তখন অন্ধকার ফুঁড়ে একটি লোক তার সামনে হাজির হল। এডিথ বেশ আশ্চর্য হয়ে পড়েছিল। তাই লোকটি তাকে দাঁড়াতে বললে সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। লোকটি যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এডিথের হাতের লণ্ঠনের আলো পড়ছিল। লণ্ঠনের আলোয় এডিথ দেখল যে, লোকটির চেহারা এবং বেশবাস ভদ্রলোকের মতো। তাঁর মাথায় ছিল কাপড়ের টুপি আর গায়ে ছাই রঙের কোট-প্যান্ট। ভদ্রলোকের হাতে একটা খুব মোটা লাঠি। আর লাঠির হাতলটাও বেশ মজবুত। ভদ্রলোককে দেখে এডিথের চোখে যে-জিনিসটা সবচেয়ে বেশি করে পড়েছিল, সেটা হল ভদ্রলোকের অস্বাভাবিক সাদাটে মুখ-চোখ আর একটা গোরুচোর গোরুচোর ভাব। এডিথের মনে হয়েছিল ওঁর বয়স তিরিশের বেশি, কম কিছুতেই নয়।

 

“এডিথকে ডেকে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, আমি ঠিক কোথায় এসে পড়েছি বলতে পারেন? ভাবছিলাম আজকের রাতটা বুঝি এই ফাঁকা মাঠেই কাটাতে হবে। এমন সময় হঠাৎ আপনার লণ্ঠনের আলোটা চোখে পড়ল।’

 

‘“এটা হল কিংস পাইল্যান্ড আস্তাবলের কাছাকাছি।’

 

‘“তাই নাকি! খুব জোর বরাত বলতে হবে’, ভদ্রলোক বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। ‘শুনেছি আস্তাবলে রাত্তিরে পাহারা দেবার জন্যে একটি ছেলে থাকে। আপনি বোধহয় তার খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। আচ্ছা, আমি যদি আপনাকে একটা নতুন পোশাকের দাম উপহার দিতে চাই, আপনি কি তা হলে রেগে যাবেন?’ এরপর ভদ্রলোক তাঁর ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে ভাঁজ-করা একটা কাগজ এডিথের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই কাগজটা যদি এক্ষুনি আস্তাবলের পাহারাওলা ছেলেটিকে পৌঁছে দিতে পারেন তো, সব চাইতে দামি পোশাকটি আমি আপনাকে কিনে দেব।’

 

“ভদ্রলোক এমন গম্ভীর ভাবে কথাগুলো বললেন যে, এডিথের ভয় হয়ে গেল। সে আর সেখানে এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ভদ্রলোককে কোনও রকমে পাশ কাটিয়ে আস্তাবলের দিকে দৌড় লাগাল। খাবারদাবার দেবার জন্যে আস্তাবলে একটা ঘুলঘুলির মতো জানলা আছে। জানলাটা খোলাই ছিল। আস্তাবলের ভেতরে জানলার কাছে হান্টার একটা টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসেছিল। এডিথ হান্টারকে যখন সব কথা বলছে, তখন সেই ভদ্রলোক সেখানে গিয়ে হাজির।

 

‘“গুড ইভনিং’, জানলার কাছে এসে এডিথের পাশে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকটি হান্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে দু’-একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’ এডিথ পুলিশকে বলেছে যে ভদ্রলোকটি যখন হান্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তাঁর হাতে সে একটা মোড়ক-করা কাগজ দেখেছিল।

 

‘“এখানে আপনার কী দরকার?’ হান্টার বেশ বিরক্ত হয়ে লোকটিকে প্রশ্ন করেছিল।

 

‘“আমার একটু দরকার আছে বই কী। আর সেই দরকার থেকে তোমারও দু’-চার পয়সা রোজগার হতে পারে। ওয়েসেক্স কাপ বাজিতে তোমাদের দুটো ঘোড়া ছুটবে, সিলভার ব্লেজ আর বেয়ার্ড। এখন আমি যা জানতে চাইছি তুমি যদি তার ঠিক ঠিক জবাব দিতে পারো, তো তোমার লোকসান হবে না। বাজারের খবর হচ্ছে, পাঁচ ফার্লংয়ের দৌড়ে বেয়ার্ড নাকি সিলভার ব্লেজকে একশো গজে হারিয়ে দিতে পারে। এটা কি খাঁটি খবর?’

 

“ভদ্রলোকের কথায় হান্টার চিৎকার করে বলে, ‘পাজি, শয়তান, দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমায় মজা। কিংস পাইল্যান্ডে তোমার মতো দালালদের কী দাওয়াই দেওয়া হয় দেখাচ্ছি।’ তারপর চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে সে ছুটে যায় আস্তাবলের কুকুরটাকে লোকটির পেছনে লেলিয়ে দেবার জন্যে। গোলমাল দেখে এডিথ তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পালায়। তবে দৌড়ে পালাবার সময়ে সে একবার পেছন দিকে ফিরে তাকাতে দেখতে পায় যে, লোকটি জানলার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কী যেন দেখছে। মিনিটখানেক পরে হান্টার কুকুরটাকে নিয়ে আস্তাবলের বাইরে এসে লোকটিকে আর দেখতে পায়নি। পরে আস্তাবলের চার দিকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার টিকিটি দেখা যায়নি।”

 

হোমসকে বাধা দিয়ে আমি বললাম, “এক মিনিট। হান্টার ছোকরা যখন লোকটিকে তাড়া করে বেরিয়ে আসে তখন সে আস্তাবলের দরজায় তালা-চাবি দিয়েছিল কি?”

 

“চমৎকার, ওয়াটসন, চমৎকার,” হোমস আমাকে তারিফ করল, “কথাটা আমার গোড়াতেই মনে হয়েছিল। সঠিক ব্যাপারটা জানবার জন্যে কালকে আমি ডার্টমুরে একটা বিশেষ টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম। জানতে পেরেছি হান্টার তালা-চাবি লাগিয়েছিল। আর ওই জানলা বা ঘুলঘুলি যাই বলো না কেন, সেটা এত ছোট যে, তার মধ্য দিয়ে ঢোকা বা বেরিয়ে আসা একেবারেই অসম্ভব।

 

“এরপর হান্টার তার অন্য দু’জন সঙ্গী ফিরে না-আসা পর্যন্ত আস্তাবলেই বসেছিল। তারা ফিরে এলে সে যা যা ঘটেছে সেই খবর স্ট্রেকারকে পাঠায়। খবরটা শুনে স্ট্রেকার খুবই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই ঘটনার আসল তাৎপর্যটা যে কী সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি, তবে তিনি বেশ ভাবনায় পড়ে যান। রাত্তির একটা নাগাদ মিসেস স্ট্রেকারের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি দেখেন যে, মিঃ স্ট্রেকার বাইরে যাওয়ার জন্য জামাকাপড় পরছেন। মিঃ স্ট্রেকার তাঁর স্ত্রীকে বলেন যে, আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়াগুলো সব ঠিকঠাক আছে কিনা, একবার দেখে না এলে তাঁর শান্তি হচ্ছে না। তিনি ঘুমোতে পারছেন না। বাইরে তখন বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই বৃষ্টির মধ্যে মিসেস স্ট্রেকার তাঁর স্বামীকে বাইরে যেতে বারণ করেন। কিন্তু তাঁর কথায় কান না দিয়ে মিঃ স্ট্রেকার ম্যাকিন্টশটা গায়ে চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন।”

 

দুই

হোমস বলে, “পরের দিন মিসেস স্ট্রেকারের যখন ঘুম ভাঙে, তখন সাতটা বেজে গেছে। তিনি উঠে দেখেন যে, তাঁর স্বামী তখনও বাড়ি ফেরেননি। তিনি তখনই কাজের মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে আস্তাবলের দিকে যান। আস্তাবলে ঢোকবার দরজাটা খোলাই ছিল। ভেতরে ঢুকে তাঁরা দেখতে পান যে, হান্টার ছোকরা একটা চেয়ারে বেহুঁশ হয়ে এলিয়ে পড়ে আছে। সিলভার ব্লেজ আস্তাবলে নেই। স্ট্রেকারও নেই।

 

“আস্তাবলে কাজের জন্যে আর যে-দু’জন ছোকরা ছিল, তারা মাচায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। ওরা কিছুই জানত না। ওদের ঘুম খুবই গাঢ়। বোঝা গেল যে, হান্টারকে কড়া ধরনের কোনও কিছু খাইয়ে বেহুঁশ করে দেওয়া হয়েছে। তার কাছ থেকে তখন কোনও কথাই জানা গেল না। তখন অন্য দু’জনকে নিয়ে মিসেস স্ট্রেকার আর তাদের কাজের মেয়েটি মিঃ স্ট্রেকার আর সিলভার ব্লেজকে খুঁজতে বললেন। ওঁদের মনে হয়েছিল যে মিঃ স্ট্রেকার সিলভার ব্লেজকে দৌড় করাতে নিয়ে গেছেন। আস্তাবল থেকে বেরিয়ে একটু দূরে একটা ঢিবি আছে। সেই ঢিবিটায় উঠলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ওরা ওই ঢিবিটায় চড়ল। যত দূর দেখা যায়, ধুধু করছে প্রান্তর। জন স্ট্রেকার বা সিলভার ব্লেজের টিকি পর্যন্ত দেখা গেল না। চার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা জিনিসের ওপর নজর পড়ায় ওঁরা বেশ ঘাবড়ে গেলেন।

 

“আস্তাবল থেকে আন্দাজ সিকি মাইল দূরে একটা ফার্জ ঝোপ। সেই ঝোপের ওপরে স্ট্রেকারের ম্যাকিন্টশটা পতপত করে উড়ছিল। ওঁরা সেই দিকে যান। সেই ঝোপের আড়ালে একটা বড় ডোবা। ডোবার মধ্যে ওঁরা জন স্ট্রেকারের মৃতদেহ দেখতে পান। খুব ভারী কোনও কিছুর আঘাতে তাঁর মাথাটা থেঁতলে গেছে। এ ছাড়া তাঁর ঊরুতেও একটা কাটা দাগ। স্ট্রেকারের ডান হাতে একটা রক্তমাখা ছুরি ছিল। বোঝা গেল যে আততায়ী যখন তাঁকে আক্রমণ করে, তখন স্ট্রেকার নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন। স্ট্রেকারের বাঁ হাতের মুঠোয় একটা লাল-নীল সিল্কের টাইয়ের ছেঁড়া টুকরো পাওয়া যায়। সেই টুকরোটা দেখে তাঁদের কাজের মেয়েটি চিনতে পারে। এই টাইটা সে সেই অচেনা লোকটির গলায় আগের রাত্তিরে দেখেছিল।

 

“হান্টারও সুস্থ হয়ে উঠে জোর গলায় বলে যে, এই টাইটা সেই লোকটির গলায় ছিল। হান্টার আরও বলে যে, ওই লোকটিই তার খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। আর সেই কারণেই সেই লোকটির আস্তাবলে ঢুকতে বা বেরোতে কোনও অসুবিধে হয়নি।

 

“ঘোড়াটার অবশ্য কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। তবে যে-ডোবায় জন স্ট্রেকারের মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেখানকার ভিজে মাটিতে ঘোড়াটার পায়ের অনেক ছাপ ছিল। তার থেকে বোঝা গেল যে, স্ট্রেকার যখন আততায়ীর হাতে খুন হন তখন ঘোড়াটা সেইখানেই ছিল। এখনও পর্যন্ত ঘোড়াটার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ডার্টমুরের যে-সব জায়গায় জিপসিদের যাতায়াত আছে, সে সব জায়গায় খোঁজখবর করা হয়েছে। এমনকী ঘোড়াটার খবর দিতে পারলে মোটা টাকার পুরস্কার দেওয়া হবে বলা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ঘোড়াটা যেন উবে গেছে। আর-একটা ইন্টারেস্টিং খবর হল যে, হান্টারের থালায় এঁটো খাবার পরীক্ষা করে আফিমের গুঁড়ো পাওয়া গেছে। সেই একই খাবার আর সবাই খেয়েছিল, কিন্তু তাদের কিছু হয়নি। এর ওপর আরও নানা গালগল্প গুজব শোনা যাচ্ছে। তবে ঘটনা বলতে যা কিছু, সেটা হল এইটুকুই। এইবার এই ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে শোনো।

 

“এই রহস্য সমাধানের ভার দেওয়া হয়েছে ইন্সপেক্টর গ্রেগরিকে। গ্রেগরি বেশ কাজের লোক। তবে ওর যদি একটু কল্পনাশক্তি থাকত তো চাকরিতে ও আরও অনেক উন্নতি করতে পারত। যাই হোক, ঘটনাস্থলে পৌঁছেই গ্রেগরি সেই রাতচরা লোকটিকে গ্রেফতার করে। লোকটিকে খুঁজে বের করতে গ্রেগরির কোনও অসুবিধে হয়নি। ওই লোকটিকে ও দিকের অনেকে চেনে। ওর নাম ফিটসরয় সিমসন। ভাল বংশের ছেলে, লেখাপড়াও করেছে। তবে ঘোড়দৌড়ের মাঠে গিয়ে ও সব হারিয়েছে। এখন ওর কাজ হচ্ছে ঘোড়দৌড়ের টুকিটাকি খবর সংগ্রহ করা আর দালালি করা। সিমনের ডায়েরি পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সিলভার ব্লেজ ওয়েসেক্স দৌড়ে জিতবে না বলে সে পাঁচ হাজার পাউন্ড বাজি ধরেছে।

 

“পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলে সে সব কথা মেনে নেয়। সে বলে যে, সে এখানে এসেছিল কিংস পাইল্যান্ডের সিলভার ব্লেজ আর কেপলটনের ডেসবরোর সম্বন্ধে খোঁজখবর করতে। ডেসবরোর নাকি এই ওয়েসেক্স কাপ জেতবার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে সে জোর গলায় বলেছে যে, কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে সে আসেনি। সে এসেছিল কিছু হাঁড়ির খবর বা ঘোড়ার মুখের খবর জানতে। এরপর পুলিশ যখন তাকে স্ট্রেকারের হাতে পাওয়া ছেঁড়া টাইয়ের টুকরোটা দেখায় আর সেটা কী ভাবে সেখানে গেল জানতে চায়, তখন সিমসন রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে উলটোপালটা কথা বলতে থাকে। তার চোখ-মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ আরও লক্ষ করে যে, তার কাপড়চোপড় তখনও সামান্য ভিজে রয়েছে। তার মানে, কাল রাত্তিরে বৃষ্টির সময় সে ঘরের বাইরে ছিল। সিমসনের হাতে একটা মোটা ধাতব হাতল-দেওয়া ‘পেনাং লয়্যার’ ছড়ি ছিল। স্ট্রেকারের মাথায় যে-ধরনের আঘাত লেগেছে, তা সহজেই এই ধরনের লাঠি থেকে আঘাত হতে পারে।

 

“কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, সিমসনের শরীরে কোনও কাটাছেঁড়া কি আঘাতের দাগ পাওয়া যায়নি। অথচ স্ট্রেকারের হাতে একটা রক্তমাখা ছুরি পাওয়া গেছে। তার থেকে এ কথা বোঝা যাচ্ছে যে, তাঁকে যারা মারতে চেয়েছিল তাদের অন্তত এক জনকে তিনি আঘাত করতে পেরেছিলেন। এই হল ব্যাপার। এখন তুমি যদি ভেবেচিন্তে আমাকে একটা হদিস দিতে পারো, তো আমার পক্ষে সুবিধে হবে।” একটানা এতক্ষণ কথা বলে হোমস চুপ করল।

 

হোমসের কথা আমি খুবই মন দিয়ে শুনছিলাম। হোমস সব কথা বেশ গুছিয়ে সহজ করে বলতে পারে। এটা তার একটা মস্ত গুণ। তবে এ ব্যাপারের বড় ঘটনাগুলো আমার জানাই ছিল। যেটা জানতাম না বা বুঝতে পারিনি, সেটা হল এই ঘটনাগুলোর মধ্যে যোগাযোগটা কী ধরনের। এখন সেটা পরিষ্কার হল।

 

আমি বললাম, “দেখো, মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে কোনও কোনও সময়ে আহত ব্যক্তির মধ্যে খিঁচুনির ভাব দেখা যায়। এমন তো হতে পারে, স্ট্রেকারের সেই রকম হয়েছিল। আর তার ফলে তাঁর নিজের হাতের ছুরিতে তাঁর ঊরু কেটে যায়।”

 

“এটা একদমই অসম্ভব নয়। বরং ব্যাপারটা এই রকমই হয়েছে বলে মনে হয়। আর তোমার কথা যদি সত্যি হয় তো, সিমসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে যে বড় অভিযোগ সেটা আর টেকে না।

 

“পুলিশ এই রহস্য সম্বন্ধে কী ভাবছে, জানতে পারলে ভাল হত,” আমি বললাম।

 

হোমস বলল, “যে-ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক না কেন, তার বিপক্ষে কিছু-না-কিছু আপত্তি তোলা যাবে। আমার মনে হয় পুলিশ এই রকম ভাবছে, সিমসন হান্টার ছোকরার খাবারের সঙ্গে আফিমের গুঁড়ো মিশিয়ে দেয়। আর সেই খাবার খেয়ে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সিমসন তখন কোনও ভাবে একটা আস্তাবলের দরজার চাবি কোথাও থেকে জোগাড় করে নিয়ে আস্তাবলের দরজা খুলে সিলভার ব্লেজকে নিয়ে চম্পট দেয়। ওর মতলব ছিল ঘোড়াটাকে গায়েব করে দেওয়া। এই ধারণার কারণ সিলভার ব্লেজের লাগাম, জিন পাওয়া যায়নি। সিমসন নিশ্চয়ই লাগাম আর জিন লাগিয়ে ঘোড়াটাকে নিয়ে পালাচ্ছিল। আস্তাবল থেকে বেরিয়ে সিমসন যখন মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তখন হয় স্ট্রেকারের সঙ্গে হঠাৎই তার দেখা হয়ে যায়, নয় স্ট্রেকার তাদের ধাওয়া করে আসেন। তারপর সেখানেই ওদের মধ্যে কথাকাটাকাটি শুরু হয়ে যায়। শেষকালে সিমসনের লাঠির আঘাতে স্ট্রেকারের মৃত্যু হয়। এরপর দুটো জিনিস হয়ে থাকতে পারে। এক, সিমসন ঘোড়াটাকে কোথাও লুকিয়ে ফেলে, আর দুই, ঘোড়াটা ওই মারামারির সময় ভয় পেয়ে পালায়। পুলিশের এই ব্যাখ্যার মধ্যে অনেক গলতি আছে ঠিকই, তবে মুশকিল হচ্ছে অন্য ব্যাখ্যাগুলোর ভেতর আরও গোঁজামিল আছে বলে মনে হয়। তবে ঘটনাস্থলে হাজির হলে আমি সবকিছুই নিজের চোখে দেখতে পাব। আশা করি তখনই জানতে পারব কোন ব্যাখ্যাটা ঠিক আর কোনটা ভুল। তাই যতক্ষণ না সেই সুযোগটা আসছে ততক্ষণ এ নিয়ে অযথা মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই।”

 

শিল্ডের ঠিক মধ্যিখানে যেমন প্রতীক-চিহ্নের ছাপ মারা থাকে, ট্যাভিস্টক শহরটাও তেমনই গোলাকৃতি ডার্টমুর অঞ্চলের একদম মাঝখানে। আমরা যখন ট্যাভিস্টকে এসে পৌঁছোলাম তখন সন্ধে হয়ে গেছে। স্টেশনে আমাদের জন্য দু’জন লোক অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বেশ ফরসা আর লম্বা। মুখে দাড়ি। তাঁর মাথার চুল দেখলেই সিংহের কেশরের কথা মনে পড়ে। তাঁর চোখদুটি নীল। তবে তাকাবার ভঙ্গিটা এমন যে, সে চোখের দিকে তাকালে মনে হয় যে, মনের ভেতরের সব কথা টের পাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গী ভদ্রলোকটি বেঁটেখাটো। তবে বেশ চটপটে। পোশাকেআশাকে যাকে বলা যায় পুরোদস্তুর বাবু। শৌখিন জুলপি। চোখে চশমা। এই বেঁটেখাটো ভদ্রলোকটি কর্নেল রস। আর অন্য লোকটি ইন্সপেক্টর গ্রেগরি। ইংল্যান্ডের গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগে গ্রেগরির মতো কাজের লোক খুব কমই আছে।

 

কর্নেল রস বললেন, “মিঃ হোমস, আপনি আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি। এই ইন্সপেক্টর অবশ্য যা কিছু করা সম্ভব তা সবই করেছেন। তবে কী জানেন, স্ট্রেকারের খুনিকে ধরবার জন্যে আর সিলভার ব্লেজকে ফিরে পাওয়ার জন্যে সমস্ত রকম চেষ্টাই আমাকে করতে হবে।”

 

হোমস জিজ্ঞেস করল, “নতুন কোনও খবর আছে কি?”

 

ইন্সপেক্টর দুঃখিত ভাবে বললেন, “না। আর নতুন কিছু জানা যায়নি। বাইরে গাড়ি রয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই আগে ঘটনাস্থলে যাবেন? তা হলে চলুন আরও অন্ধকার হওয়ার আগে আমরা বেরিয়ে পড়ি। কথাবার্তা সব গাড়িতে যেতে যেতেই হবে।”

 

একটা বেশ শৌখিন আর আরামদার ল্যান্ডো গাড়িতে আমরা উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। আমরা ডেভনশায়ারের এই অদ্ভুত পুরনো শহরটির মধ্যে দিয়ে গড়গড়িয়ে চললাম। ইন্সপেক্টর গ্রেগরি তাঁর হাতের এই মামলাটা নিয়েই মশগুল। তিনি এক মিনিটও না চুপ করে সব কথা হোমসকে বলে যাচ্ছিলেন। হোমস মাঝে মাঝে দু’-একটা প্রশ্ন করছিল। কর্নেল রস বুকের উপর দু’হাত রেখে চোখ বন্ধ করে গদিতে ঠেস দিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। আমি হোমস আর গ্রেগরির কথাবার্তা দম বন্ধ করে শুনছিলাম। গ্রেগরি নিজের ব্যাখ্যাটা হোমসকে শোনাচ্ছিলেন। আশ্চর্যের কথা, হোমস ট্রেনে পুলিশদের ব্যাখ্যাটা আমাকে যা বলেছিল, গ্রেগরির ব্যাখ্যাটা হুবহু সেইরকম।

 

গ্রেগরি বললেন, “ফিটসরয় সিমসনকে বেড়াজাল দিয়ে ঘিরে ফেলা গেছে। সে-ই যে এ কাজ করেছে, এতে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তবে এ কথাও ঠিক তার বিরুদ্ধে যা প্রমাণ তা সবই যাকে আইনের ভাষায় বলে, সারকমস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স, মানে স্থানকালের সাক্ষ্য। নতুন কোনও তথ্য পেলে এ প্রমাণ না-ও টিকতে পারে।”

 

“স্ট্রেকারের ছুরির ব্যাপারটার কিছু ফয়সালা হল?”

 

“আমার মনে হয় যে, আঘাত পেয়ে পড়ে যাবার সময়ে স্ট্রেকারের হাতের ছুরিটাই ঊরুতে বসে যায়।”

 

“আমার বন্ধু ডাঃ ওয়াটসন আসবার সময় ট্রেনে এই রকম কথাই আমাকে বলছিলেন। সত্যি হলে এটা সিমসনের পক্ষে যাবে।”

 

“নিশ্চয়ই। ওর কাছে কোনই ছুরি পাওয়া যায়নি। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, ওর শরীরে কোনও রকম আঘাতের চিহ্ন নেই। তবে ওর বিরুদ্ধে যে-তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো কিন্তু কম মারাত্মক নয়। প্রথমত হল, সিলভার ব্লেজকে গায়েব করে দেওয়ার তার যথেষ্ট স্বার্থ ছিল। তারপর ধরুন, হান্টার ছেলেটার খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশাবার ব্যাপারে ওর ওপরই সন্দেহটা গিয়ে পড়ে। আরও ধরুন, আমরা জানি যে সেই ঝড়জলের রাত্তিরে ও এ অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করেছে। ওর সঙ্গে যে-লাঠিটা ছিল সেটা দিয়ে লোকের মাথায় আঘাত করে তাকে মেরে ফেলা যায়। সব চাইতে বড় কথা হল যে, মৃত ব্যক্তির হাতের মুঠোয় ওর গলার টাইয়ের ছেঁড়া টুকরো পাওয়া গেছে। আমার মনে হয়, এসব তথ্যের ওপরই ওর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা যায়।”

 

হোমস মাথা নাড়ল, “না, সে রকম ঝানু উকিল হলে, এসব তথ্য তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। কেন ও ঘোড়াটাকে আস্তাবলের বাইরে নিয়ে যাবে? ঘোড়াটাকেই যদি ও ঘায়েল করতে চেয়ে থাকে, তবে সে কাজটা ও আস্তাবলেই সারল না কেন? ওর কাছে কি আস্তাবলের ডুপ্লিকেট চাবি পাওয়া গেছে? তারপর কোন ওষুধের দোকান বা কেমিস্টের কাছে ও আফিমগুঁড়ো কিনেছিল? সবচেয়ে বড় কথা, ও এদিককার লোক নয়। একজন বাইরের লোকের পক্ষে সিলভার ব্লেজের মতো নামকরা ঘোড়াকে কি লুকিয়ে রাখা সম্ভব? আচ্ছা এডিথের হাতে ও হান্টার ছোকরাকে যে কাগজটা পাঠাতে চেয়েছিল, সে সম্বন্ধেও নিজে কী বলছে?”

 

“ও বলছে যে ওটা একটা দশ পাউন্ডের নোট। একটা দশ পাউন্ডের নোট অবশ্য ওর পার্সে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু আপনার অন্য যুক্তিগুলো খুব টেকসই নয়। প্রথমত এ অঞ্চলটা ওর কাছে মোটেই অচেনা নয়। গরমকালে ও দু’-দু’ বার ট্যাভিস্টকে এসেছিল। আফিমটা অবশ্যই ও লন্ডন থেকে কিনে এনেছিল। তারপর ডুপ্লিকেট চাবিটা কাজ হওয়ার পরই কোথাও ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। আর ঘোড়াটা হয়তো এখন খনির কোনও গর্তে পড়ে আছে।”

 

“টাইটার সম্বন্ধে ও কী বলে?”

 

“ও স্বীকার করেছে, টাইটা ওর। তবে বলছে যে, টাইটা হারিয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে একটা নতুন ব্যাপার জানা গেছে। তার থেকে বোঝা যাচ্ছে কেন ও ঘোড়াটাকে আস্তাবল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছিল।”

 

হোমস একটু নড়েচড়ে বসল।

 

“আমরা প্রমাণ পেয়েছি, সোমবার রাতে একদল জিপসি, যেখানে স্ট্রেকারকে খুন করা হয়েছিল, তার মাইলখানেকের মধ্যে আস্তানা গেড়েছিল। মঙ্গলবার তারা পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়েছে। মনে হয় যে, সিমসনের সঙ্গে এই জিপসিদের একটা বোঝাপড়া ছিল। আর ঘোড়াটাকে নিয়ে সিমসন যখন জিপসিদের আড্ডার দিকে যাচ্ছিল তখন স্ট্রেকার ওকে দেখতে পেয়ে বাধা দিতে আসেন। ঘোড়াটা হয়তো এখনও জিপসিদের কাছেই আছে।”

 

“এটা হতে পারে বটে।”

 

“এখন ওই জিপসিদের ধরবার জন্যে আমরা জোর তল্লাশ চালাচ্ছি। এ ছাড়া ট্যাভিস্টকের দশ মাইলের মধ্যে যত আস্তাবল আছে সব আমরা চষে ফেলেছি।”

 

“আমি শুনেছি, কাছাকাছির মধ্যে আরও একটা আস্তাবল আছে।”

 

“হ্যাঁ, সে কথাটা আমার খেয়াল আছে। বিশেষত ওই আস্তাবলের একটা ঘোড়া ডেসবরোর এই বাজি জেতার খুব সম্ভাবনা। সকলেই মনে করে, সিলভার ব্লেজ প্রথম আর ডেসবরো দ্বিতীয় হবে। তাই সিলভার ব্লেজকে লোপাট করার ব্যাপারে ওদের স্বার্থ থাকতেই পারে। ডেসবরোর ট্রেনার সাইলাস ব্রাউন আর জন স্ট্রেকারের মধ্যে ভাব তো ছিলই না বরং অসদ্ভাব ছিল। আমরা ওদের আস্তাবল তন্ন তন্ন করে দেখেছি। এ ব্যাপারের সঙ্গে ওদের কোনও যোগ আছে বলে প্রমাণ পাইনি।”

 

“আচ্ছা, সিমসনের সঙ্গে ওদের কোনও যোগাযোগ ছিল কিনা জানতে পেরেছেন,” হোমস প্রশ্ন করল।

 

“না, কোনও প্রমাণই পাইনি।”

 

 

হোমস গাড়ির গদিতে আরাম করে ঠেস দিয়ে বসল। আর কোনও কথা হল না। একটু পরেই আমাদের গাড়িটা একটা লাল রঙের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়িটা রাস্তার ওপরেই। বাড়িটার থেকে সামান্য একটু দূরে একটা ছোট ঘোড়া ছোটাবার মাঠ। আর মাঠের পরে একটা ছাই রঙের টালির বাড়ি। এ ছাড়া যে-দিকে তাকানো যায় মাঠ আর মাঠ। শুকনো ফার্নের জন্যে মাঠের রং কেমন অদ্ভুত তামাটে দেখাচ্ছে। বহু দূরে ট্যাভিস্টকের চার্চের আর বড় বড় বাড়ির চুড়োগুলো দেখা যাচ্ছে। পশ্চিম দিকে বেশ খানিকটা দূরে কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়ে। ওটা কেপলটন আস্তাবল।

 

আমরা সকলেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। হোমস নামল না। সে গাড়ির গদিতে হেলান দিয়ে বসে রইল। লক্ষ করলাম, সে অপলক ভাবে সামনের মাঠ আর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম যে, গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছে বলেই তার আর কোনও দিকে খেয়াল নেই। খানিক পরে আমি তার কাঁধটা নাড়িয়ে দিতেই তার চটকা ভেঙে গেল। হোমস তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এল।

 

কর্নেল রস তার হাবভাব দেখে অবাক হয়ে গেছেন বুঝতে পেরে হোমস বলল, “এক্সকিউজ মি, কর্নেল। আমার বোধহয় একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল।”

 

হোমসের দিকে তাকিয়ে আমি দেখলাম, হোমসের চোখদুটো খুব চকচক করছে। আর তার মধ্যে কেমন একটা উত্তেজনার ভাব। হোমসের চলনবলন সবই আমার জানা। বুঝলাম সে কোনও একটা দরকারি সূত্র পেয়েছে। তবে সূত্রটা যে কী, তা আমি কিছুতেই ধরতে পারলাম না।

 

গ্রেগরি বললেন, “মিঃ হোমস, আগে খুনের জায়গাটা দেখতে যাবেন নিশ্চয়ই।”

 

“না। আগে এইখানে কয়েকটা ব্যাপার একটু পরিষ্কার করে নিতে চাই। স্ট্রেকারের মৃতদেহ এখানে আনা হয়েছিল কি?”

 

“হ্যাঁ। ভাল কথা, করোনার কোর্ট হচ্ছে আগামী কাল।”

 

হোমস কর্নেল রসের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “কর্নেল, জন স্ট্রেকার আপনার কাছে অনেক দিন কাজ করছে তো?”

 

“হ্যাঁ। লোকটা খুব খাঁটি আর কাজের ছিল।”

 

“ইন্সপেক্টর, স্ট্রেকারের পকেটে যে-সব জিনিস পাওয়া গিয়েছিল তার একটা ফর্দ আছে কি?”

 

“হ্যাঁ। তা ছাড়া জিনিসগুলো বসবার ঘরে রাখা আছে। দেখবেন নাকি?”

 

“একবার দেখব।”

 

আমরা দল বেঁধে বসবার ঘরের দিকে গেলাম। ঘরের মাঝখানে একটা বেশ বড় আকারের টেবিল। আমরা সেই টেবিলটার চারপাশে বসলাম। গ্রেগরি একটা চৌকো বাক্সের তালা খুলে তার ভেতর থেকে একগাদা জিনিস বের করল। একবাক্স দেশলাই, একটা দু’ইঞ্চি মতো লম্বা মোমবাতির টুকরো, একটা ব্রায়ার পাইপ, একটা সিলমাছের চামড়ার তামাক রাখবার থলি, থলিতে আধ আউন্স মতো কাভেন্ডিস তামাক, একটা সোনার চেন লাগানো রুপোর ঘড়ি, একটা অ্যালুমিনিয়ামের পেনসিল রাখার বাক্স, কয়েকটা কাগজ, কিছু খুচরো পয়সা, একটা হাতির দাঁতের বাঁটওলা ছোট ছুরি। ছুরিটা মোড়া যায় না। ছুরির ফলাটা খুব সরু। ফলাটার ওপরে ভাইস অ্যান্ড কোং, লন্ডন ছাপ মারা।

 

ছুরিটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে হোমস বলল, “অদ্ভুত ছুরি। রক্তের দাগ লেগে আছে দেখছি। এই ছুরিটাই তা হলে স্ট্রেকারের হাতে ছিল। …ওয়াটসন, এ ছুরিটা বোধহয় তোমাদের লাইনের জিনিস।”

 

“হ্যাঁ, একে বলে ক্যাটারাক্ট নাইফ”, আমি বললাম।

 

“আমি সেই রকমই অনুমান করেছিলাম। এই ছুরির ফলাটা যে রকম খুব সরু আর পাতলা তাতে মনে হয় যে, খুব সূক্ষ্ম কাটাকাটির কাজে এই ধরনের ছুরি ব্যবহার করা হয়। ছুরিটা আবার মুড়ে রাখা যায় না। ঝড়জলের রাতে আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে এটাকে সঙ্গে রাখা একটু অদ্ভুত নয় কি?”

 

গ্রেগরি বললেন, “ছুরির মুখটা একটা শোলার টুকরো দিয়ে ঢাকা দেওয়া ছিল। সেটা আমরা মৃতদেহের কাছেই পেয়েছি। মিসেস স্ট্রেকার বলেছেন যে, ওটা কয়েক দিন ধরেই ড্রেসিংটেবিলের ওপর পড়ে ছিল। মিঃ স্ট্রেকার সেই রাতে বেরিয়ে যাবার সময় ওটা পকেটে পুরে নেন। আমার মনে হয়, হাতের কাছে আর কোনও কিছু না পেয়েই উনি ওটা নিয়ে নেন।”

 

“খুব সম্ভব আপনার ধারণাই ঠিক। ওই কাগজগুলো কী?”

 

“কাগজগুলোর মধ্যে তিনটে হচ্ছে যারা ঘোড়ার খাবার পাঠাত তাদের হিসেব, একটা কর্নেল রসের চিঠি আর একটা বন্ড স্ট্রিটের মাদাম লেসুরিয়ারের পোশাকের দোকানের সাঁইত্রিশ পাউন্ড পনেরো শিলিংয়ের বিল। বিলটা অবশ্য স্ট্রেকারের নামে নয়। তাঁর বন্ধু উইলিয়ম ডার্বিশায়ারের। ডার্বিশায়ারের নামে চিঠিপত্র বিল প্রায়ই স্ট্রেকারের ঠিকানায় আসত।”

 

বিলটা পড়তে পড়তে হোমস বলল, “মিসেস ডার্বিশায়ারের চালচলনে বড়মানুষি দেখছি। একটা জামার দাম বাইশ গিনি। যাক, এখানে আর কিছু দেখবার নেই। চলুন, অকুস্থলে যাওয়া যাক।”

 

আমরা যখন বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে আসছি, তখন একজন ভদ্রমহিলা পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ইন্সপেক্টরের হাতটা চেপে ধরলেন। তিনি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, “আপনারা কি সেই লোকটাকে ধরতে পেরেছেন? তার খোঁজ পেয়েছেন?”

 

“না, মিসেস স্ট্রেকার। তবে লন্ডন থেকে মিঃ হোমস এসেছেন। এ ব্যাপারে তিনি আমাদের সাহায্য করছেন। আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।”

 

হোমস বলল, “আমার মনে হচ্ছে প্লিমথে একটা গার্ডেন পার্টিতে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, মিসেস স্ট্রেকার।”

 

“না, আপনি ভুল করছেন।”

 

“কী আশ্চর্য। আমি হলফ করে বলতে পারি। আপনি একটা সুন্দর পাঁশুটে রঙের সিল্কের পোশাক পরেছিলেন। সেই পোশাকে উটপাখির পালক দিয়ে ভারী সুন্দর কাজ করা ছিল।”

 

“না, স্যার, আমার ও রকম কোনও পোশাকই নেই।”

 

“ও। তা হলে তো চুকেই গেল।” এরপর মিসেস স্ট্রেকারের কাছে তার ভুলের জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে হোমস ইন্সপেক্টরের পিছন পিছন বেরিয়ে এল। মাঠ দিয়ে সামান্য একটু হাঁটতেই, যে-ডোবাটায় জন স্ট্রেকারের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম। ডোবার ধারে ফার্জের ঝোপ। ওই ঝোপেই স্ট্রেকারের ওভারকোটটা পাওয়া গিয়েছিল।”

 

হোমস জিজ্ঞেস করল, “সে রাতে জোরে বাতাস বইছিল না নিশ্চয়ই?”

 

“না, তবে বেশ জোরে বৃষ্টি পড়ছিল।”

 

“তা হলে বাতাসে ওভারকোটটাকে উড়িয়ে আনেনি। ওটা ওখানেই রাখা হয়েছিল।”

 

“হ্যাঁ, কোটটা ঝোপের ওপর বিছিয়ে রাখা ছিল।”

 

“আপনার কথা শুনে আমার কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এখানে অনেক লোক সোমবারের পর এসেছে। তাদের অসংখ্য পায়ের ছাপ এখানে পড়েছে।”

 

“না। ওধারে মোটা ক্যাম্বিশটা বিছিয়ে আমরা তার ওপর দাঁড়িয়েছিলাম।”

 

“চমৎকার।”

 

“আমার এই ব্যাগটাতে স্ট্রেকার আর সিমসনের এক পাটি করে জুতো আর সিলভার ব্লেজের একটা নাল আছে।”

 

“ইন্সপেক্টর, আপনার জুড়ি মেলা শক্ত।”

 

হোমস ব্যাগটা নিয়ে ডোবাটার মধ্যে নেমে গেল। তারপর সেই ক্যাম্বিশটা আর একটু ডোবার মাঝখানে সরিয়ে নিল। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে জমিটা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

 

এক সময়ে হোমস উত্তেজিত ভাবে চেঁচিয়ে উঠল, “আরে, আরে, এটা কী?”

 

জিনিসটা একটা আধপোড়া দেশলাই। কাদা লেগে একটা কাঠের টুকরোর মতো দেখাচ্ছে।

 

“বুঝতে পারছি না কী করে জিনিসটা আমার চোখ এড়িয়ে গেল।” ইন্সপেক্টরের কথার ভাবে বোঝা গেল যে, তিনি নিজের ওপরে খুবই বিরক্ত হয়েছেন।

 

“এটা কাদার তলায় ছিল, ওপর থেকে দেখা যাচ্ছিল না। আমি এটা খুঁজছিলাম বলেই দেখতে পেয়েছিলাম।”

 

“কী! আপনি এটা পাবেন জানতেন?”

 

“পাবই জানতাম না, তবে পাবার আশা করেছিলাম।” ব্যাগ থেকে জুতোগুলো বের করে হোমস সেখানকার পায়ের ছাপের সঙ্গে মেলাতে লাগল। তারপর ডোবা থেকে উঠে এসে ডোবার চার ধার ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।

 

ইন্সপেক্টর বললেন, “ওখানে আর কোনও পায়ের দাগ নেই। আমি চার দিকের একশো গজ জমির প্রত্যেকটি ইঞ্চি খুব ভাল করে পরীক্ষা করেছি।”

 

“ঠিক ঠিক। আপনি যখন বলছেন তখন আমি আর পরীক্ষা করে সময় নষ্ট করব না। তার চেয়ে আমি বরং একবার মাঠের চার পাশে একটু ঘুরে আসি। যাতে কাল সকালে আমার কাজের সুবিধে হয়। আমি এই নালটা সৌভাগ্যের চিহ্ন হিসেবে আমার কাছে রেখে দিচ্ছি।”

 

হোমসের কাজ করবার ধরন দেখে কী জানি কেন কর্নেল রস বিরক্ত আর অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন। তিনি তাঁর হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলেন।

 

তিনি গ্রেগরিকে বললেন, “ইন্সপেক্টর, আপনি যদি আমার সঙ্গে আসেন তো ভাল হয়। কয়েকটা বিষয়ে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। বিশেষ করে সাধারণ লোকের কথা ভেবে সিলভার ব্লেজের নাম দৌড় থেকে তুলে নেওয়া উচিত নয় কি?”

 

হোমস বেশ জোর দিয়েই বলল, “মোটেই না। আমার মতে সিলভার ব্লেজের নাম থাকাই দরকার।”

 

কর্নেল হোমসের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, “আপনার মত জেনে খুশি হলাম। আমরা স্ট্রেকারের বাড়িতেই আছি। আপনি ঘুরে এলে সকলে মিলে একসঙ্গে ট্যাভিস্টকে ফিরব।”

 

ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে নিয়ে কর্নেল ফিরে গেলেন। আমি আর হোমস মাঠের দিকে চললাম। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। চার পাশ গোধূলির আলোয় একেবারে ঝলমল করছে। হোমস কিন্তু এসব কিছুই দেখছিল না। নিজের চিন্তায় একদম বুঁদ হয়ে ছিল।

 

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর হোমস বলল, “দেখো ওয়াটসন, ব্যাপারটাকে এই দিক দিয়ে বিচার করা যেতে পারে। জন স্ট্রেকারকে কে খুন করেছে, সে প্রশ্নটা এখন তোলা থাক। বরং ঘোড়াটার কী হল, সেই কথাটা আলোচনা করা যাক। ধরো, যখন খুনি জন স্ট্রেকারকে খুন করছিল তখন ঘোড়াটা পালায়। কিন্তু পালিয়ে গেল কোথায়? ঘোড়ারা দলে থাকে। যদি সিলভার ব্লেজ পালিয়ে থাকে, তবে সে হয় কিংস পাইল্যান্ডেই ফিরে যাবে, নয়তো যাবে কেপলটন আস্তাবলে। এই ধুধু মাঠে ঘোড়াটা একা একা ঘুরে বেড়াবে বলে মনে হয় না। আর তা যদি হত, তা হলে ঘোড়াটা কারও-না-কারও নজরে পড়ত। জিপসিরা কেন ওকে ধরে রাখতে যাবে? জিপসিরা পুলিশের খপ্পরে পড়তে চায় না। ওরা নিশ্চয়ই জানে যে, ও ঘোড়াটাকে কারও কাছে বিক্রি করতে পারবে না। সুতরাং ঘোড়াটাকে ওরা যদি লুকিয়ে রাখে তো ওদের লাভ নেই, উলটে লোকসানের ভয়। এ কথাটা মানবে তো”

 

“তা হলে ঘোড়াটা কোথায়?”

 

“আমি তো আগেই বলেছি যে, ঘোড়াটা হয় কিংস পাইল্যান্ডে আছে, নয়তো কেপলটনে আছে। কিন্তু ঘোড়াটা কিংস পাইল্যান্ডে নেই, তা হলে নিশ্চয়ই কেপলটনে আছে। এই অনুমানের ওপর নির্ভর করে আমরা একটু খোঁজাখুঁজি করে দেখি, কত দূর কী হয়। ইন্সপেক্টর বলছিলেন যে, এ দিকের জমি একটু শক্ত। কিন্তু এখান থেকে তাকিয়ে দেখলে তুমি বুঝতে পারবে যে, কেপলটনের দিকে জমিটা ঢালু হয়ে গেছে। গত সোমবার রাত্রে ওই জায়গাটা নিশ্চয় বেশ ভিজে নরম হয়ে গিয়েছিল। আমরা যা ভেবেছি, তা যদি ঠিক হয়, তা হলে ঘোড়াটা নিশ্চয়ই ওই ঢালুটার ওপর দিয়ে গেছে। আর ওই জায়গায় গিয়ে আমরা ঘোড়াটার পায়ের ছাপ আছে কিনা দেখব।”

 

আমরা বেশ তাড়াতাড়িই হাঁটছিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা ঢালু জায়গাটায় পৌঁছে গেলাম। হোমসের কথামতো আমি ঢালু জায়গাটার বাঁ দিক দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। হোমস গেল ডান দিকে। বড়জোর গজ-পঞ্চাশ গেছি, এমন সময় হোমস চেঁচিয়ে উঠল। তার দিকে তাকাতে দেখলাম যে, সে আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে। হোমসের সামনে ভিজে মাটিতে পর পর ঘোড়ার পায়ের ছাপ। হোমস পকেট থেকে নালটা বের করে ছাপের সঙ্গে মেলাল। হুবহু এক।

 

“কল্পনার ক্ষমতাটা দেখলে তো,” হোমস বলল। “গ্রেগরির এই গুণটা নেই। ব্যাপারটা কী হতে পারে, সেটা আমরা কল্পনা করবার চেষ্টা করেছিলাম। তারপর সেই অনুযায়ী কাজ করেছি। আর তার ফল তো হাতেনাতে পেলাম। চলো এগোনো যাক।”

 

আমরা জলা জমিটা পেরিয়ে গেলাম। তারপর আধ মাইল মতো শুকনো ঘাসের একটা মাঠ। আবার একটা ঢাল। সেই ঢালের কাছে গিয়ে ফের ঘোড়ার পায়ের ছাপ পাওয়া গেল। তারপর কিছু দূর পর্যন্ত কোনও ছাপ দেখতে পেলাম না। পায়ের ছাপ দেখা গেল কেপলটন আস্তাবলের কাছাকাছি এসে। হোমসই পায়ের ছাপটা দেখেছিল। হোমসের মুখ খুশিতে চকচক করছিল। ঘোড়ার পায়ের ছাপের পাশাপাশি একটি লোকের পায়ের ছাপ।

 

আমি বললাম, “ঘোড়াটা তো এতক্ষণ একা একাই ছিল।”

 

“ঠিকই। একলাই ছিল। আরে আরে, এটা আবার কী?”

 

জোড়া পায়ের ছাপ উলটো দিকে ঘুরে কিংস পাইল্যান্ডের দিকে গেছে। হোমস শিস দিয়ে উঠল। আমরা উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। হোমস ওই ছাপগুলোর দিকে তাকিয়েছিল। আমি মাঝে মাঝে এদিকে-ওদিকে দেখছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম যে, পায়ের ছাপগুলো ফের কেপলটনের দিকে ঘুরে এসেছে।

 

আমি হোমসকে ডেকে দেখালাম। “ওহ্‌ ওয়াটসন, তুমি একটা বড় জিনিস আবিষ্কার করেছ। আমাদের অনেক পরিশ্রম বেঁচে গেল। চলো, আমরা আবার ফিরে যাই।”

 

আমাদের বেশি দূর যেতে হল না। কেপলটন আস্তাবলের অ্যাসফল্ট-বাঁধানো রাস্তার মুখ পর্যন্ত পায়ের ছাপ বরাবর চলে এসেছে। আমাদের দেখতে পেয়ে একটা ছোকরা সহিস ছুটে এল।

 

সে বলল, “এখানে অচেনা লোকের ঘোরাঘুরি আমরা পছন্দ করি না।” হোমস কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, “আমি একটা কথা জানতে এসেছি। আমি যদি কাল ভোর পাঁচটার সময়ে মিঃ সাইলাস ব্রাউনের সঙ্গে দেখা করতে চাই, সেটা কি খুব সকাল সকাল আসা হবে?”

 

“না স্যার। এখানে যদি কেউ সকাল করে ওঠে তো তিনি মিঃ ব্রাউন। ওই তো উনি আসছেন। আপনি ওঁকেই জিজ্ঞেস করুন।…না, না, আমি আপনার টাকা নিতে পারব না। উনি দেখতে পেলে আমার চাকরি চলে যাবে। পরে কোনও এক সময়ে আপনি যদি দিতে চান তো সে কথা আলাদা।”

 

হোমস যখন হাফ ক্রাউনটা পকেটে ঢোকাচ্ছিল তখন একজন জাঁদরেল চেহারার লোক একটা চাবুক দোলাতে দোলাতে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। লোকটিকে দেখলে মনে হয় সদাই রেগে রয়েছে।

 

“ডাউসন, কী গুজগুজ ফুসফুস করছ। যাও, নিজের কাজে যাও। কী মশাই, আপনারা এখানে কী মতলবে ঘোরাঘুরি করছেন?”

 

হোমস খুব ভদ্র ভাবে বলল, “আপনার সঙ্গে দু’-চারটে কথা বলতে চাই।”

 

“আজেবাজে লোকের সঙ্গে কথা বলবার সময় আমার নেই। এখানে অচেনা লোকের আমদানি আমরা মোটে পছন্দ করি না। এখান থেকে যাবেন, না কুকুরটা ছেড়ে দিতে হবে?”

 

হোমস সামান্য ঝুঁকে পড়ে সাইলাস ব্রাউনের কানে কানে কী যেন বলল। হঠাৎ লোকটির মুখটা রাঙা টকটকে হয়ে উঠল, “মিছে কথা। এ সম্পূর্ণ মিছে কথা!”

 

“বেশ। তা হলে এইখানেই ব্যাপারটার ফয়সালা করা যাক। নাকি বসবার ঘরে যাওয়া হবে?”

 

“আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি ভেতরেই আসুন।”

 

হোমস মুচকি হাসল। “ওয়াটসন, আমার বেশি দেরি হবে না।”তারপর বলল, “চলুন মিঃ ব্রাউন, ভেতরে যাই।”

 

প্রায় মিনিট-কুড়ি পরে হোমস ফিরে এল। এত কম সময়ের মধ্যে কোনও লোকের চেহারা হাবভাব এত পালটাতে আমি কখনও দেখিনি। মিঃ ব্রাউনের মুখ-চোখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। তার হাতটা থরথর করে কাঁপছিল। হাতের চাবুকটা এমন দুলছিল যে, মনে হচ্ছিল যেন ঝোড়ো বাতাস দিচ্ছে। তার সে হামবড়া ভাব আর নেই। হোমসের পিছনে পোষা কুকুরের মতো সে ঘুরঘুর করছিল।

 

“আপনার কথা মতোই সব কাজ হবে,” ব্রাউন বলল।

 

তার দিকে ফিরে হোমস বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু গোলমাল বা ভুল যেন না হয়।”

 

“না, না, কোনও গোলমাল হবে না। ওখানে ঠিক হাজির হবে। ওটাকে কি আমি আগেই পালটে ফেলব?”

 

হোমস একটুখানি চিন্তা করে হাসতে হাসতে বলল, “না, পালটাবে না। …এ ব্যাপারে আমি পরে জানাব। …তবে ভাল কথা, কোনও রকম চালাকি করবার চেষ্টা কোরো না।”

 

“না, না। আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন।”

 

“তোমার নিজের জিনিস হলে যে ভাবে দেখাশোনা করতে, সেই ভাবে দেখবে।”

 

“সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।”

 

“বেশ। কালই আমি খবর দেব।” বলে হোমস কিংস পাইল্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

 

“বুঝলে ওয়াটসন, একই সঙ্গে গুন্ডা অথচ নীচ আর ভিতুর ডিম এই তিন ধরনের লোককে একসঙ্গে মেলালে যে-লোকটির চেহারা পাওয়া যাবে, সে হচ্ছে এই ব্রাউন।”

 

“তা হলে ঘোড়াটা ওর আস্তাবলেই আছে?”

 

“প্রথমে ও অবশ্য সব কথা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। তখন আমি ওকে সেদিন সকালে যা যা ঘটেছিল সব বললাম। বললাম, ঘোড়ার পায়ের ছাপের পাশে পাশে যে-চৌকো জুতোর ছাপ আছে, তা তার পায়ের ছাপের সঙ্গে মিলে গেছে। আমি ওকে আরও বললাম, ভোরে সে যখন একটা ঘোড়াকে ঘুরে বেড়াতে দেখে, তার কী মনে হয়েছিল। তারপর বললাম, যখন ঘোড়াটার কপালে সাদা দাগ দেখে ও বুঝতে পারে যে ওটা সিলভার ব্লেজ, তখন ওর কী মনে হয়েছিল। তারপর প্রথমে সে ঘোড়াটাকে নিয়ে যখন কিংস পাইল্যান্ডের দিকে যাচ্ছিল, তার মাথায় কী ভাবে বদবুদ্ধি চাপল। ঘোড়াটাকে দৌড়ের সময় গায়েব করে দিতে পারলে তার নিজের ঘোড়ার কী সুবিধে হবে। আর এই ভেবে সে আবার ঘোড়াটাকে নিয়ে ফিরে আসে। যখন সব কথা খুলে বললাম, তখন ওর একমাত্র চিন্তা হল কী করে নিজেকে বাঁচানো যায়।

 

“কিন্তু ওর আস্তাবলে তো পুলিশ খোঁজ করে এসেছিল।”

 

“ওর মতো একজন ঝানু লোকের পক্ষে একটা ঘোড়াকে লুকিয়ে রাখাটা কোনও ব্যাপারই নয়।”

 

“কিন্তু ঘোড়াটা ওর জিম্মায় রেখে আসাটা কি ঠিক হল? ঘোড়াটার কোনও ক্ষতি হলে তো ওরই লাভ।”

 

“না হে, না। এখন ঘোড়াটাকে ও প্রাণ দিয়ে রক্ষা করবে। কেন না, ও জানে যে, ওর বাঁচবার একমাত্র পথ হল ঘোড়াটাকে বহাল তবিয়তে রাখা।”

 

“কিন্তু কর্নেল রস এ ব্যাপারে ব্রাউনকে ক্ষমা করবেন বলে মনে হয় না।”

 

“এটা কর্নেল রসের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ছে না। আমি আমার মতে কাজ করব। যতটুকু কর্নেলকে বলা দরকার বলে মনে করব, আমি ততটাই বলব। স্বাধীন ভাবে কাজ করবার এইটেই সুবিধে। তুমি লক্ষ করেছ কিনা জানি না, কর্নেল আমার সঙ্গে একটু মুরুব্বিয়ানা করছেন। এখন আমি ওঁকে একটু লেজে খেলাব। ঘোড়ার কথা ওঁকে কিছু বোলো না।”

 

“নিশ্চয়ই না। তোমার মত না নিয়ে কোনও কথা বলব না।”

 

“তবে এই ঘোড়া উদ্ধারের ব্যাপারটা তো আসল কথা নয়। আসল কথা হল, কে জন স্ট্রেকারকে খুন করল।”

 

“এবার তুমি ওই সমস্যার সমাধানে মন দেবে?”

 

“না, ঠিক উলটোটা। আমরা আজ রাতের ট্রেনেই লন্ডন ফিরে যাব।”

 

হোমসের কথা শুনে আমার মনে হল যে, আমার মাথায় বাজ পড়ল। আমরা এই তো ক’ঘণ্টা আগে ডেভনশায়ারে এসে পৌঁছেছি। হোমস আসতে-না-আসতেই একটা জট খুলে ফেলেছে। আর ঠিক যখন ব্যাপারটা জমে উঠছে, তখনই কেন যে হোমস ফিরে যেতে চাইছে আমি বুঝতে পারলাম না। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও হোমসের কাছ থেকে আর কোনও কথা বের করতে পারলাম না। আমরা চুপচাপ স্ট্রেকারের বাড়িতে ফিরে এলাম। কর্নেল আর ইন্সপেক্টর বৈঠকখানায় বসেছিলেন।

 

“আমরা আজ মাঝরাতের ট্রেনে লন্ডন ফিরে যাব। আপনাদের ডার্টমুরের সুন্দর আবহাওয়া খুব উপভোগ করলাম।” হোমস বলল।

 

ইন্সপেক্টর চোখ বড় বড় করে তাকালেন। কর্নেলের মুখে একটা চাপা বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল। কর্নেল বললেন, “তা হলে স্ট্রেকারের খুনিকে ধরবার আশা আপনি ছেড়ে দিচ্ছেন।”

 

হোমস খানিকটা নাচার ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল, খুনিকে ধরবার ব্যাপারটা অত সহজ নয়। তবে আমার বিশ্বাস, আপনার ঘোড়া মঙ্গলবার দৌড়োবে। আপনি শুধুমাত্র আপনার জকিকে তৈরি থাকতে বলবেন। আমাকে কি জন স্ট্রেকারের একটা ফোটোগ্রাফ দিতে পারেন?”

 

ইন্সপেক্টর তাঁর কোটের পকেট থেকে একটা ফোটোগ্রাফ বের করে দিলেন।

 

“মিঃ গ্রেগরির কাছে চাওয়ামাত্র জিনিসটি পাওয়া যায় দেখছি। আপনারা যদি একটু অপেক্ষা করেন তো ভাল হয়। আমি ওই কাজের মেয়েটির সঙ্গে দু’-একটা কথা বলতে চাই।”

 

হোমস ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই কর্নেল বেশ রূঢ় ভাবে বললেন, “নাহ্‌, আমাদের লন্ডনের গোয়েন্দামশাইয়ের কাজকর্মে আমি সত্যিই খুব হতাশ হয়েছি। আমি তো দেখছি উনি আসবার আগে আমরা যেখানে ছিলাম, এখনও সেখানেই আছি।”

 

আমি বললাম, “কিন্তু হোমস তো আপনাকে কথা দিয়েছে যে আপনার ঘোড়াটা পাওয়া যাবে।”

 

কর্নেল অবজ্ঞার ভাব দেখিয়ে বললেন, “উনি কথা না দিয়ে ঘোড়াটাকে এনে হাজির করলে আমি বেশি খুশি হতাম।”

 

আমি একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় হোমস ঘরে ঢুকল।

 

“চলুন, আমরা এখন ট্যাভিস্টকের দিকে যাই।”

 

আমরা গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই আস্তাবলে একটি ছেলে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। হঠাৎ হোমসের কী খেয়াল হল, সে ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার আস্তাবলে ভেড়া আছে নিশ্চয়ই! সেগুলোর দেখাশোনা কে করে?”

 

“আজ্ঞে আমি করি।”

 

“আচ্ছা, ভেড়াগুলোর কি কোনও অসুখবিসুখ করেছে?”

 

“না। তবে তিনটে ভেড়া খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে।”

 

আমি দেখলাম হোমসের খুব স্ফুর্তি হয়েছে। সে হাত ঘষতে ঘষতে হাসতে লাগল। আমার হাতে ছোট্ট একটা চড় মেরে হোমস বলল, “ওয়াটসন, স্রেফ আন্দাজে ঢিল ছুড়েছিলাম। গ্রেগরি, ভেড়াদের এই অসুখটার দিকে আমি তোমাকে একটু মন দিতে বলছি।… ওহে, গাড়ি ছাড়ো।”

 

কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, তিনি শার্লক হোমসের কার্যকলাপে মোটেই খুশি হতে পারেননি। কিন্তু ইন্সপেক্টরের মুখ-চোখ দেখে মনে হল, তিনি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন।

 

“ব্যাপারটা আপনি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন?” গ্রেগরি জিজ্ঞেস করলেন।

 

“খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।”

 

“এ ছাড়া আর বিশেষ কোনও কিছুর দিকে নজর দিতে বলছেন?”

 

“সেই রাত্রে কুকুরটার অস্বাভাবিক ব্যবহারটা বিবেচনা করুন।”

 

“সেই রাত্রে কুকুরটা তো কিছু করেনি।”

 

হোমস বলল, “সেইটাই তো অস্বাভাবিক।”

 

ঠিক চার দিন পরে আমি আর হোমস আবার ট্রেনে করে চললাম। এবার আমরা যাচ্ছি উইনচেস্টার। সেখানে ওয়েসেক্স কাপের দৌড় হবে। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে কর্নেল রস স্টেশনের বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। তাঁর চোখ-মুখ গম্ভীর। কথাবার্তায় একটা ছাড়া ছাড়া ভাব।

 

“আমি এখনও আমার ঘোড়ার সন্ধান পাইনি।” কর্নেল বললেন।

 

“আপনি আপনার ঘোড়াকে দেখে চিনতে পারবেন বলে আশা করি।”

 

হোমসের কথায় কর্নেল দারুণ চটে গেলেন, “আমি বিশ বছর ধরে এই নিয়ে আছি। আমাকে কখনও কেউ এ রকম প্রশ্ন করতে সাহস করেনি। সিলভার ব্লেজকে দেখলে একটা ছোট ছেলেও চিনতে পারবে। কপালে সাদা দাগ আর সামনের পায়ে ছিট ছিট দাগ আছে।”

 

“সিলভার ব্লেজের বাজার কেমন?”

 

“কাল পর্যন্ত ভাল ছিল। কিন্তু আজ দাম পড়ে গেছে।”

 

হোমস বলল, “ভেতরের খবরটা কেউ জানে বলে মনে হচ্ছে।”

 

আমরা যখন গ্রান্ডস্ট্যান্ডে আমাদের বসবার জায়গায় গেলাম, তখন দেখলাম ওয়েসেক্স কাপে যে-সব ঘোড়া ছুটবে তাদের নামের লিস্ট টাঙানো রয়েছে:

 

১৷ মিঃ হিথ নিউটনের দ্য নিগ্রো (লালটুপি, দারচিনি রংয়ের জামা)

 

২৷ কর্নেল ওয়ার্ডলয়ের পিউজিলিস্ট (গোলাপি টুপি, নীল কালো জামা)

 

৩৷ লর্ড ব্যাকওয়াটারের ডেসবড়ো (হলদে টুপি, লম্বা হাতা)

 

৪৷ কর্নেল রসের সিলভার ব্লেজ (কালো টুপ, লাল জামা)

 

৫৷ ডিউক অব বালমোলারের আইরিশ (হলদে-কালো ডোরা)

 

৬৷ লর্ড সিঙ্গলফোর্ডের র‍্যাসপার (কালচে-লাল টুপি, কালো হাতা)

 

“আপনার কথার ওপর ভরসা করে আমাদের অন্য ঘোড়াটার নাম কাটিয়ে দিয়েছি কিন্তু। আরে এ কী, সিলভার ব্লেজ জিতবে বলে লোকে এখনও বলাবলি করছে।”

 

গেটের মুখে কিছু লোক কোন ঘোড়ার জেতার সম্ভাবনা কী রকম, তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল।

 

আমি বললাম, “ওই যে এবার নম্বর লাগিয়ে দিচ্ছে। ছ’টা নম্বরই আছে।”

 

কর্নেল বললেন, “যাক, তা হলে আমার ঘোড়া ছুটছে। কিন্তু আমার ঘোড়া কই?”

 

বুঝলাম, কর্নেল ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।

 

“এই তো পাঁচটা বেরোল। তা হলে ছ’ নম্বর ঘোড়াটাই আপনার ঘোড়া হবে। আমার কথা শেষ হবার আগেই একটা সুন্দর তেজি ঘোড়া টগবগ করতে করতে বেরিয়ে এল।

 

কর্নেল চিৎকার করে বলে উঠলেন, “এটা আমার ঘোড়া নয়। এটার গায়ে একগাছি সাদা চুল নেই। এ আপনি কী করছেন, মিঃ হোমস।”

 

একটুও না ঘাবড়ে হোমস বলল, “ব্যস্ত হবেন না। এ এখন কেমন ছোটে দেখা যাক।”

 

তারপর আমার ফিল্ড গ্লাসটা চেয়ে নিয়ে হোমস দেখতে লাগল। “বাঃ বাঃ, দারুণ ছুটছে তো। এইবার বেঁকছে…দারুণ!”

 

আমরা যেখানে বসেছিলাম, সেখান থেকে এখন ঘোড়াগুলোকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ছ’টা ঘোড়া পাশাপাশি এক লাইনে ছুটছিল। আমার মনে হল, একটা চাদর ছুড়ে দিলে ঘোড়াগুলো চাপা পড়ে যাবে। একটু পরেই কর্নেলের ঘোড়া সব ঘোড়াকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। সিলভার ব্লেজ ডেসবরো আর ডিউক অব বালমোরালের ঘোড়া আইরিশকে অনেক পেছনে ফেলে দৌড়ের শেষ মুখে পৌঁছে গেল।

 

কর্নেল রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “যাক, দৌড়ে আমি জিতেছি। কিন্তু আমি তো এ সবের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। মিঃ হোমস, আপনি কি দয়া করে সব খোলসা করে বলবেন?

 

“নিশ্চয়ই। তার আগে চলুন একবার ঘোড়াটাকে দেখে আসি।”

 

যেখানে ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়েছিল আমরা সেখানে গেলাম। হোমস বলল, “আপনি এর মুখ আর সামনের পা স্পিরিট দিয়ে ধুয়ে ফেললেই দেখবেন যে, এই আপনার সিলভার ব্লেজ।”

 

“আপনার কথা শুনে তো মাথা ঘুরে যাচ্ছে।”

 

“আমি একে যার কাছে যে-অবস্থায় পাই, সেই ভাবেই ছোটাবার ব্যবস্থা করি।”

 

“আপনি তো মশাই ম্যাজিক দেখালেন। ঘোড়াটা খুব যত্নে ছিল বলে তো মনে হচ্ছে। এর আগে ঘোড়াটা এত ভাল ভাবে কখনও দৌড়োয়নি। দেখুন, আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। মিঃ হোমস, ঘোড়াটাকে খুঁজে বের করে আপনি আমার মস্ত বড় উপকার করেছেন। এখন স্ট্রোকারের খুনিকে যদি ধরতে পারেন তো আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।”

 

“আমি তো তাকে ধরে ফেলেছি,” হোমস আস্তে আস্তে বলল।

 

আমি আর কর্নেল আশ্চর্য হয়ে হোমসের দিকে তাকালাম। “আপনি তাকে ধরে ফেলেছেন। কই কোথায়?”

 

“সে এখানেই আছে।”

 

“এখানে? কোথায়?”

 

“আমাদের কাছাকাছি আছে।”

 

রাগে কর্নেলের মুখ লাল হয়ে গেল। “আপনি আমার খুবই উপকার করেছেন মিঃ হোমস। কিন্তু তাই বলে আপনি আমাকে অপমান করলে সেটা আমি বরদাস্ত করব না।”

 

হোমস হেসে উঠল। “না, না, খুনের সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই। খুনি হচ্ছেন এই ইনিই,” বলে হোমস ঘোড়াটার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল।

 

“ঘোড়াটা খুনি!” আমি আর কর্নেল রস একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম।

 

“হ্যাঁ। ঘোড়াটাই খুনি বটে। তবে জন স্ট্রেকারকে ও খুন করেছে নিজেকে বাঁচাবার জন্যে। তাই ওকে খুনের দায়ে দায়ি করা যাবে না কোনওমতেই। জন স্ট্রেকার অত্যন্ত খারাপ ধরনের লোক ছিলেন। ওঁকে বিশ্বাস করাটাই আপনার ভুল হয়েছিল।…যাই হোক, এই বাজিগুলো শেষ হোক, তখন সব কথা বলব।”

 

সন্ধেবেলা আমরা লন্ডনের ট্রেনে চাপলাম। হোমসের কথা শুনতে শুনতে কী ভাবে যে সময় কেটে গেল, আমরা বুঝতেই পারিনি।

 

“গোড়াতেই বলি, খবরের কাগজ পড়ে ব্যাপারটা সম্বন্ধে যে-ধারণাটা আমার হয়েছিল, সেটা একদম ভুল। খবরের কাগজে যে-সব সত্যি-মিথ্যে কথা ছাপা হয়েছিল, তার মধ্যে আসল কথাটা একদম চাপা পড়ে গিয়েছিল। ডেভনশায়ারে যাবার সময় আমার মনে হয়েছিল যে, ফিটসরয় সিমসনই অপরাধী। যদিও এটা জানতাম যে, তার বিরুদ্ধে জোরালো কোনও প্রমাণ নেই।

 

“মনে আছে বোধহয়, ল্যান্ড করে যাবার সময় স্ট্রেকারের বাড়ির সামনে গাড়ি থামলে আপনারা সবাই নেমে পড়েছিলেন। আমি গাড়ির ভেতরে বসেছিলাম। আসলে তখনই আমার কাছে সব জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আর আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে, এত বড় সূত্রটা আমার চোখ এড়িয়ে গেল কেমন করে। সে সূত্রটা হল মাটনকারি।”

 

কর্নেল বললেন, “আমি কিন্তু এখনও মাটনকারির সূত্রের তাৎপর্যটা ধরতে পারিনি।”

 

“আমার বিশ্লেষণের পদ্ধতিতে এইটেই প্রথম ধাপ বলতে পারেন। আফিমগুঁড়োর একটা স্বাদ আছে। সাধারণ ভাবে কোনও খাবারের সঙ্গে মেশালেই তার গন্ধটা ধরা পড়বেই। আর তখনই যাকে সেটা খেতে দেওয়া হবে, সে আর খাবে না। মাটনকারি হচ্ছে সেই ধরনের রান্না, যাতে আফিম মেশালে তার গন্ধটা আর টের পাওয়া যাবে না। তা যদি হয় তবে ফিটসরয় সিমসনের পক্ষে কী ভাবে জানা সম্ভব যে, সেই দিন আস্তাবলের ছেলেদের জন্যে মাটনকারি রান্না হবে? সিমসনের পক্ষে এ কথা জানা একেবারেই অসম্ভব। তা হলে সিমসনকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে হয়। তখন সন্দেহটা গিয়ে পড়ে স্ট্রেকার আর তাঁর স্ত্রীর ওপর। কেন না, সেই রাতে মাটনকারি রান্না হবে কিনা এটা তারাই ঠিক করেছেন। হান্টারের জন্যে যে-তরকারিটা আলাদা করে রাখা হয়েছিল সেই ডিশটাতেই আফিম মেশানো হয়েছিল। তা হলে বাড়ির কাজের মেয়েটির অজান্তে কার পক্ষে ওই ডিশে আফিম মেশানো সম্ভব?

 

“কে এ কাজ করে থাকতে পারে, এটা ঠিক করতে গিয়ে আর একটা ব্যাপার আমার চোখে পড়ল। সেটা হল, সেই রাতে আস্তাবলের কুকুরটা চুপচাপ ছিল। যদি একটা সঠিক সিদ্ধান্ত করা যায় তো তার থেকে আরও অনেক সিদ্ধান্ত করা সম্ভব। সিমসনের ব্যাপারটা থেকে আমি জানতে পারি যে, আস্তাবলে একটা কুকুর থাকে। রাত্তিরবেলায় কেউ ঘোড়াটাকে আস্তাবল থেকে বের করে নিয়ে গেল অথচ কুকুরটা ডাকল না কেন? কুকুরটা ডাকাডাকি করলে তো আস্তাবলের আরও দুটো ছেলের ঘুম ভাঙত। তা হলে সেই রাত্তিরে এমন একজন কেউ আস্তাবলে এসেছিল যাকে কুকুরটা চেনে।

 

“আমি তখন মোটামুটি ভাবে নিশ্চিত যে, জন স্ট্রেকারই রাতে আস্তাবলে আসেন আর ঘোড়াটাকে বের করে নিয়ে যান। কিন্তু কী জন্যে? নিশ্চয়ই কোনও বদ মতলবে তিনি এ কাজ করেছেন, তা না হলে কেন তিনি যে-ছেলেটি আস্তাবলে পাহারা দিচ্ছিল তাকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু উদ্দেশ্যটা তখনও আমি ধরতে পারিনি। অবশ্য ঘুষ খেয়ে কখনওসখনও ঘোড়ার ম্যানেজার যে নিজের ঘোড়া যাতে না দৌড়োতে পারে, সে কাজ যে করেনি তা নয়। এটা কী করে হয়, জকিকে ঘুষ দিয়ে, না হয় অন্য কোনও উপায়ে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে জন স্ট্রেকার কোন উপায় নিতে চেয়েছেন? আমার মনে হল যে, স্ট্রেকারের জামাপ্যান্টের পকেট পরীক্ষা করে দেখলে একটা হদিস পাব।

 

“হলও ঠিক তাই। আপনাদের নিশ্চয়ই সেই ছুরিটার কথা মনে আছে। স্ট্রেকারের হাতের সেই ছুরিটা দেখে ওয়াটসন বলেছিল যে, ওই ধরনের ছুরি ডাক্তারবাবুরা অপারেশন করবার সময় ব্যবহার করেন। হ্যাঁ, সেই রাতে খুব একটা সূক্ষ্ম অপারেশন করবার জন্যই ওই ছুরিটা নেওয়া হয়েছিল। কর্নেল রস, আপনি তো বহু দিন ঘোড়া নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, ঘোড়ার পায়ের একটা বিশেষ উপশিরা সামান্য একটু ছড়ে দিলেই ঘোড়া সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবে। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যাবে না। মনে হবে ঘোড়াটা বোধহয় অতিরিক্ত পরিশ্রমে কাহিল হয়ে পড়েছে।”

 

“পাজি! শয়তান!” কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন।

 

“ঘোড়াটাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার দরকার হয়েছিল এই কারণে যে, আস্তাবলের মধ্যে ওই কাজ করতে গেলে ঘোড়ার চিৎকারে আস্তাবলের ছোকরাদের ঘুম ভেঙে যেত।”

 

“ওহ, আমি কিছুই ধরতে পারিনি। সেই জন্যেই শয়তানটা সঙ্গে দেশলাই আর মোমবাতি নিয়ে গিয়েছিল।”

 

“ঠিক তাই। স্ট্রেকারের জিনিসপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম কেন তিনি এ কাজ করতে গিয়েছিলেন। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, স্ট্রেকারের পকেটে কতগুলো বিল পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটা ডার্বিশায়ার বলে একজনের নামে। আমরা নিজেদের বিল মেটাতেই হিমশিম খেয়ে যাই, আর স্ট্রেকার অন্যের বিল রেখে দিয়েছেন? আমার তখনই সন্দেহ হয়। মিসেস স্ট্রেকারকে গার্ডেন পার্টির গল্প ফেঁদে ওই পোশাকটার কথা জেনে নিলাম। ওই পোশাক ওঁর নেই। তা হলে? এর উত্তর পেলাম লন্ডনের সেই দোকানে। স্ট্রেকারের ফোটো দেখাতেই ওরা ওঁকে ডার্বিশায়ার বলে চিনতে পারল। তারপর সবকিছুই সহজ হয়ে গেল।

 

“স্ট্রেকার ঘোড়াটাকে নিয়ে বেরিয়ে ছিলেন। কুকুরের তাড়া খেয়ে সিমসন যখন পালাচ্ছিল তখন ওর টাইটা পড়ে যায়। স্ট্রেকার সেটা দেখতে পেয়ে কুড়িয়ে নেন। তিনি ঠিক করেছিলেন, ওইটে দিয়ে ঘোড়াটার পা বাঁধবেন। তারপর ডোবার মধ্যে ঘোড়াটাকে নিয়ে নামেন। অন্ধকারে ফস করে দেশলাই জ্বালতে ঘোড়াটা ভয় পেয়ে যায়। জন্তুরা অনেক জিনিস টের পায়। স্ট্রেকারের হাবভাবে ও কিছু টের পেয়েছিল নিশ্চয়ই। তাই স্ট্রেকার ওর কাছে যেতেই ঘোড়াটা চাঁট ছুড়তে থাকে। লোহার নাল-লাগানো পায়ের এক মোক্ষম চাঁটেই স্ট্রেকার মারা পড়েন। কী, সব পরিষ্কার হল তো?”

 

“হ্যাঁ। এমন ভাবে বললেন যে, মনে হল ঘটনাগুলো আপনার চোখের সামনেই ঘটেছে।”

 

“আর ভেড়ার ব্যাপারটা আন্দাজে ঢিল ছুড়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, স্ট্রেকার যে রকম ঘড়েল মানুষ, তাতে এ কাজ করবার আগে তিনি হাত পাকিয়ে নিতে চাইবেন। ভেড়াই হল এ কাজে হাত পাকাবার সবচেয়ে উপযুক্ত জন্তু। তাই ভেড়ার দিকে নজর পড়াতে আমি ছেলেটির কাছে ভেড়াদের কুশল সংবাদ জানতে চাই।”

 

“আপনি সব সমস্যারই তো সমাধান করলেন। ঘোড়াটা কী ভাবে পেলেন সেটা বলুন।”

 

“স্ট্রেকারকে আঘাত করে ঘোড়াটা পালিয়ে যায়। আপনারই একজন প্রতিবেশী ঘোড়াটাকে রেখে দেয়। ও ব্যাপারটা ভুলে যান। আর মিনিট-দশেকের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাব। এরপর আপনার যদি আর কিছু জানবার থাকে তো সেটা আমাদের ফ্ল্যাটেই হবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


সূচিপত্রঃ—

সূচিপত্র