শ্যামনিবাস-রহস্য (ভাদুড়ি) – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

শেয়ার করুনঃ

(১)

পাঁচ নম্বর পীতাম্বর চৌধুরি লেনের একতলার ভাড়াটে নকুলচন্দ্র বিশ্বাস যে খুন হয়েছে, বাড়িওয়ালা সদানন্দবাবুই সে-কথা প্রথম জানতে পারেন কি না, বলা শক্ত, তবে তার ডেডবডি যে তিনিই প্রথম দেখেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেসব কথা যথাসময়ে হবে। ভদ্রলোকের পরিচয়টা আগে দেওয়া দরকার।

সদানন্দবাবুর পুরো নাম সদানন্দ বসু। সস্ত্রীক তিনি দোতলায় থাকেন। আগে একটা সওদাগরি কোম্পানির শিপিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন, বার দুয়েক এক্সটেনশান পাবার পরে রিটায়ার করেছেন। তা সেও প্রায় বছর দশেক হল।

ভদ্রলোকের বয়স এখন বাহাত্তর। সন্তানাদি হয়নি, তবে তা নিয়ে তাঁর কোনও আক্ষেপ নেই। বরং অন্যেরা আক্ষেপ করলে বলেন, ‘রাখুন মশাই। ছেলে হলেই যে সেটা বনমানুষ না-হয়ে মানুষ হত, তার কোনও গ্যারান্টি আছে? গুন্ডার দলে নাম লিখিয়ে ব্যাটা হয়তো বোমবাজি করে বেড়াত, আর আমাকে তার হ্যাপা সামলাতে হত। না রে ভাই, তার চেয়ে এই দিব্যি আছি।

সদানন্দবাবু সত্যিই যে ‘দিব্যি’ আছেন, এটা যে নেহাত কথার কথা নয়, সে তাঁর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। পার্ক সার্কাস এলাকার যে বাড়িটাতে এর আগে আমি থাকতুম, বাড়িওয়ালা সেটা বিক্রি করে দেওয়ায় বছর দশেক আগে আমি এখানে উঠে আসি। পাড়াটা ঘিঞ্জি, প্রথম প্রথম তাই একটুও ভাল লাগত না। কিন্তু সবই তো আস্তে-আস্তে সয়ে যায়, আমারও গিয়েছে। তা ছাড়া সদানন্দবাবুর মতো একজন প্রতিবেশী যে পৈয়েছি, এটাকেও আমার মস্ত একটা সৌভাগ্য বলে মনে হয়। সদানন্দ সত্যিই সার্থকনামা পুরুষ। মুখ নাকি মনের আয়না। তা সদানন্দবাবুর ক্ষেত্রে সেই আয়নাটা আমি কখনও ঝাপসা হতে দেখিনি, প্রশান্ত হাস্যে ভদ্রলোকের মুখখানা একেবারে ঝকঝক করত।

হালে অবশ্য সেই ঝকঝকে মুখেই একটু-একটু মেঘ জমতে শুরু করেছিল। কিন্তু সে-কথায় একটু পরে আসছি।

সদানন্দবাবুর বয়স যে সত্তর ছাড়িয়েছে, সেটা আমি তাঁর কাছে শুনি। দেখে অবশ্য বয়া বুঝবার উপায় নেই। ভদ্রলোকের চুল এখনও পুরোপুরি পাকেনি, সাদার হামলার বিরুদ্ধে কালো এখনও সমানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বছর দুয়েক আগে ছানি কাটিয়েছিলেন; দৃষ্টিশক্তি তার পরেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি বটে, তবে দেহযন্ত্রের অন্য কোনও কলকবজায় জং ধরেছে বলে মনে হয় না। শরীর মোটামুটি পোক্ত। উদরে মেদ জমতে দেননি, টান হয়ে হাঁটাচলা করেন।

আমি রোগাভোগা মানুষ। একে তো খবরের কাগজে কাজ করি বলে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে নিয়ম-টিয়ম মেনে চলার উপায়ই নেই, তার উপরে আবার নিয়ম-টিয়ম মেনে চলার উপায় থাকলেই যে মান্যি করতুম তাও নয়। বেশ কিছুকাল ধরেই আমাকে তার মাসুল গুনতে হচ্ছে। অম্বলের অসুখ তো আছেই, তার সঙ্গে জুটেছে গেঁটেবাতের যন্ত্রণা। শীত পড়লেই আঙুলের গাঁট ফুলে যায়, ভাল করে তখন কলমটা পর্যন্ত ধরতে পারি না, ব্যথায় যেন হাতখানা একেবারে ঝন্‌ঝন্ করতে থাকে।

সদানন্দবাবু বলেন, “সিগারেট ছাড়ুন মশাই। চা অবশ্য আমিও ছাড়তে পারিনি, আপনিও পারবেন বলে মনে হয় না, তবে এই যে দিনের মধ্যে পনরো-বিশ কাপ চা খাচ্ছেন, এটা তো একেবারে সর্বনেশে ব্যাপার। মেরেকেটে তিন কাপ পর্যন্ত চলতে পারে। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ, সকালে জলখাবারের সময় এক কাপ আর বিকেলে এক কাপ। ব্যস ওই হচ্ছে লিমিট। তাও দুধ নয়, চিনি নয়, স্রেফ হালকা লিকার। দেখবেন, অম্বলের অসুখ একেবারে বাপ-বাপ বলে পালাবে।”

বেজার হেসে আমি বলি, “তা কি পারব?”

“পারতেই হবে। নইলে বাঁচবেন কী করে? আর হ্যাঁ, মর্নিং ওয়াকটা ধরুন। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে, চোখমুখ ধুয়ে হালকা এক কাপ চা খেয়ে রোজ মাইল দুয়েক হেঁটে আসুন দেখি, স্রেফ মাসখানেকের মধ্যেই টের পেয়ে যাবেন যে, শরীরের কলকবজাগুলো আবার ঠিকমতো “লতে শুরু করেছে।”

“আপনি রোজ মর্নিং ওয়াক করেন?”

“করি বই কী।” একগাল হেসে সদানন্দবাবু বলেছিলেন, “ঘড়িতে রোজ দম দিতে হয় না? ‘চা এই মর্নিং ওয়াকটা হচ্ছে শরীরকে দম দেওয়ার ব্যাপার। দমটা নিয়মিত দিচ্ছি বলেই ঘড়িটা এখনও বন্ধ হয়নি, একেবারে কাঁটায় কাঁটায় কারেক্ট টাইম দিয়ে যাচ্ছে।”

এ-সব কথা বছর দশেক আগেকার। সদ্য তখন আমি পার্ক সার্কাস থেকে মধ্য-কলকাতার এই গলিতে এসে ঢুকেছি। খবরের কাগজে কাজ করি, দুপুর এগারোটা বারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোই, কাজ চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে রাত নটা-দশটা বেজে যায়। রবিবারটা ছুটির দিন, রাস্তায় কি বাজারে সে-দিন সদানন্দবাবুর সঙ্গে দেখাও হয়। দেখা হলে উনিও নমস্কার করেন, আমিও করি। কিন্তু কথাবার্তা বিশেষ এগোয় না।

এই রকমই এক রবিবারের সকালবেলা। বাজার থেকে ফিরে রান্নাঘরে আনাজ আর মাছের থলি নামিয়ে রেখে বসবার ঘরে ঢুকে সদ্য সেদিনকার কাগজের উপরে চোখ বুলোতে শুরু করেছি, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি সদানন্দবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। বললুম, “আরে কী আশ্চর্য, আসুন আসুন।”

ভদ্রলোক হাসতে-হাসতে ঘরে ঢুকলেন, তারপর একটা সোফায় বসে হাসতে-হাসতেই বললেন, “আপনি নতুন এসেছেন, তাই খবর নিতে এলুম কোনও অসুবিধে হচ্চে কি না। অবিশ্যি আরও আগেই আমার আসা উচিত ছিল। কোনও ব্যাপারে যদি দরকার হয়, তো নিঃসংকোচে জানাবেন, যদি কিছু করতে পারি তো খুশি হয়ে করব। আমার বাড়িটা আপনি চেনেন তো?”

বললুম, “চিনব না কেন? বলতে গেলে আমাদের প্রায় উল্টোদিকেই তো আপনারা থাকেন, তাই না?”

সদানন্দবাবু বললেন, “হ্যাঁ, আমরা থাকি পাঁচ নম্বরে। দোতলায় থাকি।”

“একতলায় কারা থাকেন?”

“কেউ না। একতলাটা ফাঁকাই পড়ে আছে। ভাড়াটে বসাইনি, বসাবার ইচ্ছেও নেই।”

“কেন?”

“ও মশাই অনেক ঝঞ্ঝাট। আজ বলবে রান্নাঘরের কলের ওয়াশারটা কেটে গেছে, প্লাম্বার ডেকে সারিয়ে দিন, কাল বলবে শোবার ঘরের ছিটকিনিটা ঠিকমতো লাগানো যাচ্ছে না, ছুতোর ডেকে আনুন। ও-সব ঝঞ্ঝাট কে সামলাবে? এক-একটা ভাড়াটে এমন পাজি হয় যে, সে আর কহতব্য নয়।” আমার বাড়ি নেই, অন্যের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আছি, তাই সদানন্দবাবুর কথায় আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারলুম না। কাষ্ঠ হেসে বললুম, “তা বটে।”

সদানন্দবাবু বললেন, “ও কথা ছাড়ুন। এখন কী জন্যে এসেছি, তা-ই বলি। কাল বিকেলে আপনার মিসেস আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন।”

বললুম, “ তাই বুঝি?”

“হ্যাঁ। আমার গিন্নিরও তাই আসা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি বাতের রুগি, হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়, তাই আমাকে একাই আসতে হল। তা ছাড়া আরও এইজন্যে এলুম যে, আপনার অসুখের কথা আমি শুনেছি। ওটা আমি সারিয়ে দেব।”

অবাক হয়ে বললুম, “আমার আবার কী অসুখ?”

সদানন্দবাবু বললেন, “সে কী, আপনার হাইপার-অ্যাসিডিটি নেই? বুক-জ্বালা নেই? চোঁয়া-ঢেকুর ওঠে না? আপনার স্ত্রী তো আমার স্ত্রীকে কাল তা-ই বলে এলেন।”

বাসন্তী এসে ঘরে ঢুকল। সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার গলা শুনে এলুম। এক্ষুনি চলে যাবেন না যেন। চা করে আনছি।”

সদানন্দবাবু বললেন, “তা আনুন, তবে চায়ের সঙ্গে দুধ-চিনি চলবে না।”

জিজ্ঞেস করলুম, “ডাক্তারের নিষেধ?”

“ডাক্তারের নয়, গুরুর নিষেধ। গুরু মানে সাক্ষাৎ মহাগুরু, অর্থাৎ আমার পিতৃদেব। তিনি বলতেন, চা খাচ্ছ খাও, কিন্তু খবর্দার তার সঙ্গে দুধ-চিনি খাবে না। খেয়েছ কি মরেছ, সারা জীবন অম্বলের ব্যথায় কষ্ট পেতে হবে।”

আমি বললুম, “তাই?”

সদানন্দবাবু বললেন, “অফ কোর্স। সার পি সি রায় বলতেন, চা-পান মানেই বিষপান আর আমার স্বর্গত পিতৃদেব বলতেন, বিষপান তো বটেই, তবে কিনা দুধচিনি মিশিয়ে যদি খাই।”

বাসন্তী বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনার জন্যে স্রেফ লিকার, কেমন?”

“হ্যাঁ, স্রেফ লিকার, তাও খুব হালকা হওয়া চাই।”

বাসন্তী চলে গেল।

সদানন্দবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দিনে আপনি ক’কাপ চা খান?”

হেসে বললুম “কী করে বলব? গুনে তো কখনও দেখিনি।”

“তাও?”

“তা পনরো-বিশ কাপ তো বটেই।”

“দুধ-চিনি মিশিয়ে?’

“বিলক্ষণ।”

“সিগারেটও পনরো-বিশটা?”

“পনেরো-বিশটা কী বলছেন, চল্লিশ-পঞ্চাশটা তো হবেই।”

কথাটা শুনে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ স্রেফ হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তা হলে মশাই আমি তো কোন্ ছার, বিধান রায় বেঁচে নেই, কিন্তু বেঁচে থাকলেই বা কী হত, তিনিও আপনাকে বাঁচতে পারতেন না। যদি বাঁচতে চান তো সিগারেট ছাড়ুন, আর চা’ও মাত্র তিন কাপ, তাও দুধ-চিনি না দিয়ে স্রেফ হালকা লি’র। পারবেন?”

“পারা শক্ত। কিন্তু যদি পারি, মানে ধরুন যে, আমি পেরেই গেলুম, তা হলেই কি আর অম্বল আমাকে জ্বালাবে না?”

চওড়া হেসে সদানন্দবাবু বললেন, “তবে আর বলচি কী! অম্বু কি আর আপনার একার অসুখ, এই কলকাতার অন্তত নাইনটি পার্সেন্ট লোক অম্বলে ভোগে। অঙ্ক আমার গিন্নিরও ছিল। কিন্তু এখন আর নেই। বেন নেই? না মাথার দিব্যি দিয়ে আমি তাঁর দুধ `নি দিয়ে চা খাওয়ার অভ্যেসটা ছাড়িয়েছি। বাতব্যাধিও সারিয়ে দিতে পারতুম। পারলুম না কে জানেন?”

“কেন?”

কাজের মেয়েটি এসে চা-জলখাবার দিয়ে গেল। সদানন্দবাবুর জন্যে স্রেফ হালকা লিকার। ভদ্রলোক তাঁর জলখাবারের প্লেটটা ছুঁলেন না পর্যন্ত। বললেন, “জলখাবার আমি খেয়ে এসেছি, এক সকালে দুবার জলখাবার খেতে পারব না। তবে হ্যাঁ, আপনাদের এখানে চা খেতে বলবেন, সেটা জানতুম তো, তাই বাড়িতে আর সেকেন্ড কাপ চা খাইনি।”

ভদ্রলোক চায়ে চুমুক দিলেন, তারপর বললেন, “ কী কথা যেন হচ্ছিল?”

“আপনার স্ত্রীর বাতব্যাধি কেন সারাতে পারলেন না, সেই কথা।”

“ও হ্যাঁ, তা হলে শুনুন, রোজ যদি আমার সঙ্গে বেরিয়ে দু’মাইল মর্নিং ওয়াক করতেন তা হলে ওটাও সেরে যেত। তা ভদ্রমহিলা সকাল সাতটার আগে বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন না যে!”

“মাথার দিব্যি দিয়েছিলেন?”

“দিয়েছিলুম বই কী, কিন্তু তাও পারলেন না। আরে মশাই সাতটায় ঘুম থেকে উঠলে কি আর মর্নিং ওয়াক হয়? তখন রোদ্দুর উঠে যায়। হাঁটায় তখন আর মজা থাকে না।”

নিজের চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বাসন্তী ইতিমধ্যে ঘরে এসে ঢুকেছিল। বলল, “আপনি কখন ঘুম থেকে ওঠেন?”

“সাড়ে চারটেয়।”

“ওরে বাবা,” বাসন্তী যেন আঁতকে উঠল, “ওই সময়ে ওঠা যায় নাকি?”

“কেন যাবে না, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেই তাড়াতাড়ি ওঠা যায়। আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ…..ছেলেবেলায় পড়া সেই ছড়াটা তো আর ভুলে যাইনি, তাই সাড়ে নটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি, আর উঠেও পড়ি কাঁটায় কাঁটায় একেবারে সাড়ে চারটেয়। হিসেব করে দেখুন ঝাড়া সাত ঘন্টা ঘুমোই। কম হল?”

ঢোক গিলে বললুম, “না, তা হল না বটে, তবে অত সকাল-সকাল শুয়ে পড়ব কী করে? অফিস থেকে বাড়িতে ফিরতে ফিরতেই তো দশটা বেজে যায়। তারপর খাওয়া আছে, টুকটাক লেখাপড়ার কাজও থাকে, শুতে শুতে সেই বারোটা। সকাল সাতটার আগে তা হলে আর কী করে উঠব? মর্নিং ওয়াকই বা কী করে করব?”

সদানন্দবাবুর চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা হলে আর আমার কিছু করার নেই। মর্নিং ওয়াক না করলে আপনার কর্তার ওই গেঁটে বাত সারবে না। তবে সিগারেটটা যদি ছাড়িয়ে দিতে পারেন, আর দুধ-চিনি বাদ দিয়ে আমি যে রকম চা খেলুম, কিরণবাবুর যদি তাতে আপত্তি না হয়…….তবে হ্যাঁ, তিন কাপের বেশি খাওয়া চলবে না……অম্বল তা হলে সারবেই।”

বাসন্তী বলল, “ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই?”

“কিছু না। আজ তা হলে চলি। পরে আবার খবর নেব।”

সদানন্দবাবু চলে গেলেন।

তা এ হল দশ বছর আগের কথা। সদানন্দবাবুর কথামতো আমি মর্নিং ওয়াকটা ইতিমধ্যে ধরতে পারিনি বটে তবে চায়ের পেয়ালা থেকে দুধচিনি একেবারে বাদ দিয়েছি। সিগারেটটা অবশ্য অনেক চেষ্টা করেও ছাড়তে পারছি না, তবে আগের চেয়ে অনেক কম খাই। মেরেকেটে চার-পাঁচটা। তা দেখছি, ভদ্রলোক মোটেই বাড়িয়ে বলেননি। সত্যি আর এখন আমার অম্বল হয় না, বুকজ্বালা করে না, চোয়া ঢেকুরও ওঠে না। গেঁটেবাতের ব্যাপারটা অবশ্য এখনও আমাকে সমানে জ্বালাচ্ছে। তাই ভাবছিলুম যে, শিগগিরই তো রিটায়ার করব, তখন তো আর রাত দশটায় বাড়ি ফিরতে হবে না, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব, উঠেও পড়ব তাড়াতাড়ি, তারপরে সদানন্দবাবুর সঙ্গে রোজ বেরিয়ে পড়ব মর্নিং ওয়াক করতে।

সদানন্দবাবুও আমাকে খুব উৎসাহ দিচ্ছিলেন। কথায় কথায় সেদিন বললেন, “দেখলেন তো, সিগারেটটা কমিয়ে দিয়ে শুধু যে অ্যাসিডিটির হাত থেকে বেঁচে গেলেন তা নয়, সর্দিকাশিও বলতে গেলে আর আপনার হয় না। তা ছাড়া দমও বেড়েছে। তা এখন ওই দমটাকে কাজে লাগান। মর্নিং ওয়াক করুন, রোজ শেষ-রাত্তিরে বেরিয়ে পড়ুন আমার সঙ্গে। মাইল দুয়েক হাঁটুন। ঘাম ঝরান। দেখবেন, অম্বল যেভাবে হটেছে গেঁটেবাতও ঠিক সেইভাবেই হটে যাচ্ছে। কী, বেরিয়ে পড়বেন আমার সঙ্গে?”

বললুম, “এখন নয়। রিটায়ার করি, তারপর বেরুব।”

সেই রকমই কথা ছিল, কিন্তু তা আর হল না। তার আগেই খুন হয়ে গেল নকুল বিশ্বাস। আর ভাড়াটে খুন হবার সঙ্গে-সঙ্গেই তার বাড়িওয়ালা সদানন্দ বসুও গ্রহের ফেরে পড়ে গেলেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments