শান্তিলতার অশান্তি (ভাদুড়ি) – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

শেয়ার করুনঃ

(১)

রাস্তা থেকে রেস্তোরাঁয় ঢুকে গোটা ঘরটার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ভদ্রমহিলা। তারপর সরাসরি আমাদের টেবিলের সামনে এসে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনিই তো মিঃ ভাদুড়ি, তা-ই না?”

 

আমাদের ডিনার শেষ হয়ে গিয়েছিল। বেয়ারা কফি দিয়ে গিয়েছে, সেই সঙ্গে একটা ফোল্ডারের মধ্যে বিল। ভাদুড়িমশাই তাঁর কফির পেয়ালায় একটা শুগারকিউব ফেলে চামচ দিয়ে সেটা নাড়ছিলেন। এতক্ষণ তিনি মুখ তুলে তাকাননি। এইবারে মুখ তুলে, ভদ্রমহিলাকে দেখে নিয়ে, বললেন, “হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলুম না।”

 

“আমার নাম শান্তিলতা মিত্র।” ভদ্রমহিলা বললেন, “আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। মানে…একটা ব্যাপারে আমি আপনার অ্যাডভাইস চাই।”

 

“এখন কী করে কথা হবে?” ভাদুড়িমশাই তাঁর কফির পেয়ালায় আলতো একটা চুমুক দিয়ে সামান্য হেসে বললেন, “আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। এবারে কফিটা শেষ করে, বিল মিটিয়ে উঠে পড়ব। এখন তো কথা বলার সময় হবে না।”

 

“যদি খুব সংক্ষেপে বলি?”

 

ভদ্রমহিলার কথা বলার ভঙ্গিতে তো বটেই, চোখেমুখেও যে একটা উদ্‌বেগের আভাস ছিল, সেটা আমার নজর এড়ায়নি। ভাদুড়িমশাইও সেটা বিলক্ষণ বুঝে থাকবেন। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনি বললেন, “ঠিক আছে, আপনি বসুন। কিন্তু কিছু না-নিয়ে একটা টেবিল আটকে রাখা তো ঠিক হবে না, আপনার জন্যেও কিছু বলি। কী খাবেন আপনি?”

 

“কিছু না। জাস্ট এক কাপ কফি।”

 

“হট অর কোল্ড?”

 

“কোল্ড।”

 

“ঠিক আছে।” ভাদুড়িমশাই আঙুল তুলে বেয়ারাকে কাছে ডাকলেন। তারপর কোল্ড কফির অর্ডার দিয়ে শান্তিলতাকে বললেন, “এবারে বলুন আপনার প্রবলেমটা কী। বাট ইট হ্যাজ টু বি শর্ট। আমার হাতে বিশেষ সময় নেই।”

 

টেবিল ঘিরে চারটি চেয়ার। তার তিনটিতে আমরা বসে আছি। আমি ভাদুড়িমশাই আর সদানন্দবাবু। চতুর্থটিতে শান্তিলতা বসলেন। তারপর, ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে, একটু ইতস্তত করে, নিচু গলায় বললেন, “আমার প্রবলেমটা প্রকাশ্যে…আই মিন পাঁচজনের সামনে আলোচনা করার মতো নয়। আমি শুধু আপনাকেই বলতে চেয়েছিলুম।”

 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ওহো, আপনার সঙ্গে তো পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। ইনি হচ্ছেন কিরণ চাটুজ্যে…আর উনি সদানন্দ বসু। দু’জনেই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু…তা ছাড়া আমার কাজেকর্মে এঁদের দু’জনের কাছ থেকে আমি প্রচুর সাহায্য পাই। তো আমাকে যা বলবার, তা এঁদের সামনে স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন।”

 

নমস্কার-বিনিময়ের পালা শেষ হবার পরেও যে ভদ্রমহিলার অস্বস্তি বিশেষ কেটেছে এমন মনে হল না। বেয়ারা ইতিমধ্যে কফি দিয়ে গিয়েছিল। স্ট্রটাকে কিছুক্ষণ কফির গেলাশের মধ্যে নাড়লেন শান্তিলতা। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে, যেন কথাটা একেবারেই বলবার ইচ্ছে নেই, তবু বলতে হচ্ছে, এইভাবে বললেন, “মিঃ ভাদুড়ি, যে-কোনও মুহূর্তে আমাকে মার্ডার করা হতে পারে!”

 

সদানন্দবাবুর কফি-খাওয়া ভাগ্যিস শেষ হয়ে গিয়েছিল। নয়তো শান্তিলতার কথা শুনে ‘ম্মাম্মামার্ডার’ বলে যে-ভাবে তিনি চমকে উঠেছিলেন, তাতে তাঁর হাত থেকে কফির পেয়ালা ছিটকে পড়ে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটে যেতে পারত।

 

চমকে অবশ্য আমিও গিয়েছিলুম। তবে ভাদুড়িমশাই দেখলুম নির্বিকার। হাতের পেয়ালাটিতে শেষ চুমুক দিয়ে সেটিকে পিরিচে নামিয়ে রেখে, পকেট থেকে রুমাল বার করে আলতোভাবে ঠোঁটে একবার চেপে ধরে রুমালটিকে ফের পকেটে ঢুকিয়ে শান্ত গলায় তিনি বললেন, “কে খুন করবে আপনাকে?”

 

“আমার স্বামী।”

 

সদানন্দবাবু বোধহয় আঁচ করে নিয়েছিলেন যে, আজ তাঁকে এই ধরনের বেশ কিছু কথা শুনতে হবে। ফলে, সময়ে সতর্ক হয়ে যাওয়ায়, এবারে আর তিনি চমকে উঠলেন না। শুধু শুকনো গলায় নিজেকে শুনিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “তারা ব্রহ্মময়ী মাগো!”

 

ভাদুড়িমশাইয়ের মুখে কোনও ভাবান্তর দেখলুম না। একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, “শান্তিলতা দেবী, আপনি বলছেন, যে, আপনার স্বামী আপনাকে খুন করবেন। এমন কথা হেলাফেলা করে বলার নয়। যা বলছেন, তার গুরুত্ব আপনি বোঝেন?”

 

“তা কেন বুঝব না?” শান্তিলতা বললেন, “আমি যা বলেছি, তা ভেবেচিন্তেই বলেছি। মিঃ ভাদুড়ি, ইদানীং আমাদের সম্পর্ক যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে আর সেটাকে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলা চলে না, স্রেফ শত্রুতার সম্পর্ক। আমরা কেউ কাউকে ভালবাসি না, আমরা দুজনেই দুজনকে ঘৃণা করি। ইন ফ্যাক্ট, পারলে হয়তো আমিই ওঁকে খুন করতুম। হয়তো কেন, নিশ্চয় করতুম।”

 

ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ দুটি দেখলুম হঠাৎই ভীষণ সরু হয়ে এসেছে। বাঁ হাতের তর্জনীটিকে ঠোটের সামনে উঁচিয়ে ধরে, শান্তিলতার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “শ্শ্, আর নয়। এক্ষুনি যে-কথাটা আপনি বললেন, তা কি আর-কাউকে বলেছেন?”

 

“কোন কথাটা?”

 

“পারলে আপনার স্বামীকে আপনি খুন করতেন, এই কথাটা। এইমাত্র এটা আমাদের কাছে বললেন। আর-কাউকে কখনও বলেছেন?”

 

কেন তাঁকে এই প্রশ্নটা করা হচ্ছে, শান্তিলতা সম্ভবত তা বুঝে উঠতে পারেননি। হয়তো সেই জন্যেই তাঁকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল। বললেন, “এ-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

 

“কারণ আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি। আর-কাউকে বলেছেন?

 

“আমার স্বামীকেই তো বলেছি।”

 

“আর-কাউকে?”

 

একটুক্ষণ ভেবে নিলেন শান্তিলতা। তারপর বললেন, “এক্ষুনি মনে পড়ছে না। …ও হ্যাঁ, যুগলকে বলেছি।”

 

“যুগল কে?”

 

“যুগলকিশোর চৌধুরি।”

 

“যুগলকিশোর…যুগলকিশোর…” অন্যমনস্কভাবে নামটা বার দুয়েক উচ্চারণ করলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “নামটা চেনা-চেনা ঠেকছে। …আচ্ছা, উনি কি গান-বাজনার লাইনের লোক?”

 

“গানের নয়, বাজনার।” শান্তিলতা বললেন, “উনি বেহালা বাজান। একটা অর্কেস্ট্রার দল করেছেন। সেটা নিয়ে মাঝে-মধ্যে এখানে-ওখানে যানও। কিছুদিন আগেও যেন কোথায় গিয়েছিলেন।”

 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাঙ্গালোরে। নামটা সেই জন্যেই চেনা-চেনা ঠেকছিল।… সম্ভবত ওখানকার কাগজের বিজ্ঞাপনে দেখেছি। তা আপনি যে পারলে আপনার স্বামীকে খুন করতেন, এ তো পাঁচজনকে বলে বেড়াবার মতো কথা নয়, ওঁকে কেন বলতে গেলেন?”

 

“বললুম, তার কারণ, যুগল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।” এই পর্যন্ত বলেই শান্তিলতা হঠাৎ সামলে নিলেন নিজেকে। বললেন, “প্লিজ মিঃ ভাদুড়ি, ঘনিষ্ঠ বলতে যেন আবার অন্য-কিছু ভাববেন না, আসলে আমি ওকে অনেক দিন ধরে চিনি।”

 

“অনেক দিন মানে কত দিন?”

 

শান্তিলতা একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “সাত বছর। আমি একটা ট্র্যাল কোম্পানিতে কাজ করতুম, নাইন্টিফোরে ও সেখানকার অ্যাকাউন্ট্স ডিপার্টমেন্টে অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার হয়ে ঢোকে।”

 

“কোন ট্র্যাল কোম্পানি?”

 

“ট্র্যাল স্টার।”

 

“সে তো বেশ বড় কোম্পানি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওদের ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার হেড আপিস বোধহয় এখানকার রবিনসন স্ট্রিটে, তা-ই না?”

 

“হ্যাঁ, আমি হেড আপিসেই কাজ করতুম। যুগলের সঙ্গে সেখানেই আমার পরিচয়। তো সেই নাইন্টিফোর থেকেই ওকে আমি চিনি। আমরা কেউই অবশ্য ওখানে এখন কাজ করি না।”

 

“কাজ ছেড়ে দিয়েছেন?”

 

“হ্যাঁ।” শান্তিলতা বললেন, “আমি ছেড়েছি নাইন্টিসিক্সে, আর যুগল ছেড়েছে নাইন্টি এইটে।”

 

“কাজ ছাড়লেন কেন?”

 

“যুগলের তো একটা আলাদা শিল্পী-জীবন রয়েছে। নিজে চমৎকার ভায়োলিন বাজায়, মোটামুটি নামও করেছে, এখানে-ওখানে টুকটাক প্রোগ্রাম করে, তা ছাড়া একটা অর্কেস্ট্রা পার্টি গড়ে তুলবে বলেও সেই তখন থেকেই ভাবতে শুরু করেছিল। তা দশটা-পাঁচটা আপিস করে তো আর এত সব করা যায় না, তাই শেষ পর্যন্ত একরকম বাধ্য হয়েই ও চাকরি ছেড়ে দেয়।”

 

“আর আপনি?”

 

শান্তিলতা হেসে বললেন, “মেয়েরা সাধারণত যে-কারণে চাকরি ছাড়ে, আমারও সেই একই কারণ। নাইন্টিসিক্সে আমার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী বড়লোক, গাড়ি বাড়ি টাকাপয়সা কোনও কিছুরই অভাব নেই। তার উপরে মেজাজি মানুষ, বউ চাকরি করবে, এটা তাঁর পছন্দ নয়। ফলে যা হয় আর কি….।”

 

“ফলে আপনাকে চাকরি ছাড়তে হয়, কেমন?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“কিন্তু যুগলের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা থেকে যায়।”

 

“হ্যাঁ, থেকে যায়।” বলেই সরাসরি ভাদুড়িমশাইয়ের চোখে চোখ রেখে শান্তিলতা যোগ করলেন, “মিঃ ভাদুড়ি, আমি আবার বলছি ওটা একেবারেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ওর অন্য-কোনও অর্থ করবেন না, প্লিজ। …আর তা ছাড়া…”

 

শান্তিলতা কথাটা শেষ করলেন না। ভাদুড়িমশাই এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “থেমে গেলেন কেন, আর তা ছাড়া কী?”

 

বলতে সম্ভবত অস্বস্তি হচ্ছিল, তাই চোখ নামিয়ে শান্তিলতা বললেন, “যুগল আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। হি ওন্ট বি মোর দ্যান থার্টিটু, অ্যান্ড আই’ম ফর্টি, আট বছরের তফাত। প্রেম-ট্রেমের কোনও প্রশ্নই এখানে উঠছে না। অথচ…অথচ…”

 

কথা শেষ না-করে আবার মধ্যপথে থেমে গেলেন শান্তিলতা। ভাদুড়িমশাই বললেন, “অথচ কী?”

 

“অথচ এই যে একটা সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্ক, এই নিয়েও আমার স্বামী আমাকে সন্দেহ করেন! জঘন্য সব কথা বলেন! এমন সব কথা, যা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়! মাথায় খুন চেপে যায়। ইন ফ্যাক্‌ট, সেই জন্যেই আর এখন আমরা একসঙ্গে থাকি না!”

 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যুগলের কথা তো মোটামুটি শুনলুম, এবারে আপনার স্বামীর কথা আর-একটু বলুন। যেটুকু বলেছেন, তাতে মাত্র এইটুকুই জানা গেল যে, তিনি খুব বড়লোক, তাঁর গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, টাকাপয়সাও অঢেল। এটাও জানলুম যে, যুগলের সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক থাক, এটা তাঁর পছন্দ নয়। কিন্তু শুধু এইটুকুই যথেষ্ট নয়, আরও দু’-একটা কথা জানা দরকার। বাই দ্য ওয়ে, ভদ্রলোক করেন কী? নাকি তাঁকে কিছুই করতে হয় না?”

 

“আমার স্বামী ব্যবসায়ী মানুষ। বেশ বড় মাপের ব্যবসায়ী। নাম শুনলে আপনি হয়তো তাঁকে চিনতেও পারবেন। ধনঞ্জয় মিত্র।”

 

ভাদুড়িমশাইয়ের মুখে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। মনে হল, তিনি চিনতে পারেননি। শান্তিলতা সেটা বুঝতে পেরে বললেন, “তা হলে তাঁর কোম্পানির নামটা বলি। দেখুন চিনতে পারেন কি না। ম্যাক্রো বিল্ডার্স।”

 

“ম্যাক্রো!” চেয়ে দেখলুম, ভাদুড়িমশাইয়ের ভুরু কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। বললেন, “সে তো বিরাট ব্যাপার! দেশ জুড়ে ওদের কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। বাঙ্গালোরে হালে একটা ফ্লাই-ওভার বানিয়েছে, তা ছাড়া ওখানে একটা ইনডোর স্টেডিয়ামের বরাতও নাকি ওরাই পাবে।”

 

সদানন্দবাবু এতক্ষণ মুখ খোলেননি। এবারে বললেন, “আমাদের জেঙ্কিস অ্যান্ড জেঙ্কিন্‌স কোম্পানির কাজও ওরা কম করেনি। বছর পনরো আগে আমাদের ঢাউস দু’-দুটো ওয়্যারহাউস তো ওরাই বানিয়ে দিল।”

 

শান্তিলতা বললেন, “ম্যাক্রো বিল্ডার্সের গোড়াপত্তন করেছিলেন আমার শ্বশুরমশাই জনার্দন মিত্ৰ। গত বছর নব্বই বছর বয়েসে তিনি মারা গেছেন। আমার স্বামী তাঁর একমাত্র সন্তান। তিনিই এখন ম্যাক্রো বিল্ডার্সের মালিক। না, সেদিক থেকে…’”

 

ভাদুড়িমশাই তাঁকে কথাটা শেষ করতে দিলেন না। মাঝপথে বাধা দিয়ে বললেন, “দাঁড়ান, দাঁড়ান, হিসেবটা একটু বুঝে নিতে দিন। জনার্দন মিত্র লাস্ট ইয়ারে মারা গেছেন অ্যাট দ্য এজ অব নাইন্টি, আর আপনার স্বামী ধনঞ্জয় মিত্র তাঁর একমাত্র সন্তান, এই তো?”

 

“হ্যাঁ।”

 

“ভেরি গুড। তো আপনার স্বামী কি তাঁর শেষ বয়েসের সন্তান?”

 

“ওহ্ নো।” শান্তিলতা তাঁর ঘাড়-ঘেঁষে-ছাঁটা চুল ঝাঁকিয়ে বললেন, “শেষ বয়েসের নয়, প্রথম বয়েসের সন্তান। ট্র্যাভ্ল-কোম্পানিতে কাজ করতুম তো, তাঁর ফিলাডেলফিয়া-ট্যুরের টিকিট কাটার সময় পাসপোর্ট দেখেছি; তাতে লেখা আছে, হি ওয়জ বর্ন ইন নাইন্টিন থার্টি সিক্স।”

 

“তার মানে তো তাঁর বয়েস এখন পঁয়ষট্টি বছর।” একটু থেমে, শান্তিলতার দিক থেকে চোখ সামান্য সরিয়ে নিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর আপনি নিজেই একটু আগে বলেছেন যে, আপনার বয়েস এখন চল্লিশ। বিয়েটা তো আপনি নাইন্টিসিক্সে করেছিলেন, তাই না?”

 

“হ্যাঁ।”

 

‘পাঁচ বছর আগের ব্যাপার। তখন আপনার বয়েস ছিল পঁয়তিরিশ আর ধনঞ্জয় মিত্রের ষাট। পঁচিশ বছরের ছোট-বড়। তফাতটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?…একটা প্রশ্ন করি মিসেস মিত্ৰ, আই হোপ ইউ ডু নট মাইন্ড, আপনি কি স্রেফ বড়লোকের বউ হবার জন্যেই এই বিয়েটা করেছিলেন?”

 

“তা কি কেউ করে না?”

 

“করবে না কেন?” ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “করে। ফলে কিছু জটিলতারও সৃষ্টি হয়। যেমন আপনাদের ক্ষেত্রে হয়েছে। তরুণী ভার্যার একজন তরুণ বন্ধু থাকবে, বৃদ্ধ স্বামী সেটা বরদাস্ত করতে পারছেন না। না-পারাই তো স্বাভাবিক।”

 

“কিন্তু আমিও তো কিছু তরুণী নই। আমারও তো চল্লিশ চলছে।” শান্তিলতা বললেন, “কথায় বলে কুড়িতে বুড়ি। সেই হিসেবে আমি ডবল-বুড়ি।”

 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও-সব পুরনো হিসেব, এককালে চলত, এখন চলে না। আর তা ছাড়া, সবটাই তো আপেক্ষিক ব্যাপার। আপনার স্বামীর বয়েস যদি বছর-পঁয়তাল্লিশ হত, তা হলে তিনি হয়তো আপনাকে তরুণী ভাবতেন না, কিন্তু আপনার স্বামীর বয়েস তো পঁয়তাল্লিশ নয়, পঁয়ষট্টি। তিনি তো আপনাকে তরুণীই ভাববেন। যুগলকে নিয়ে তাঁর সন্দেহকেও তাই খুব অস্বাভাবিক বলা যাচ্ছে না।”

 

শুনে শান্তিলতা এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে, যদিও কোনও কারণ ছিল না, এবং এখনও কোনও কারণ নেই, তবু আমি মেনে নিচ্ছি যে, যুগলকে নিয়ে তাঁর সন্দেহ হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে তিনি আমাকে খুন করতে চাইবেন কেন?”

 

“খুন করতে চাইছেন, তার প্রমাণ কী?”

 

“মাসখানেক আগে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে কথা বলতে-বলতেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে, টেবিল থেকে মেটালের ফুলদানিটা তুলে নিয়ে তিনি আমার দিকে ছুড়ে মারেন। সেটা লাগেনি। কিন্তু লাগলে আমার কপাল ফেটে যেত। আর-এক দিন ছুড়ে মারেন একটা কাট-গ্ল্যাসের অ্যাশট্রে। এটা দিন-পনরো আগের ব্যাপার। তারিখটা মনে আছে। ফিফটিথ এপ্রিল। বাংলা নববর্ষের পরের দিন। অ্যান্ড ইট ওয়জ আ সানডে।”

 

“তারপরে কী হল?”

 

“তারপরে উনি রাগমাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।”

 

“আর আপনি?”

 

“আমি বুঝতে পারি যে, এ-বাড়িতে আমি নিরাপদ নই। এখন প্রায়ই এইরকম হতে থাকবে, আর রোজ-রোজই যে আমি বরাতজোরে বেঁচে যাব, তাও নয়। ফলে, বাড়ি থেকে উনি বেরিয়ে যাবার পর, একটা স্যুটকেসে আমার জামাকাপড় আর কিছু পার্সোন্যাল জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আমিও সেইদিনই ওঁদের পৈতৃক বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি।”

 

“ওঁর পৈতৃক বাড়িটা কোথায়?”

 

“থিয়েটার রোডে। মিত্র-ম্যানশন। ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে ওই একই ফুটপাত ধরে পুবদিকে আর খানিকটা এগিয়ে গেলে বাঁ-দিকে পড়বে। শুনেছি জনার্দন মিত্র নিজে ও-বাড়ির প্ল্যান করেছিলেন। দোতলাটা দু’ভাগে ভাগ করা। একটা ভাগে আমার স্বামী থাকেন। কিছুদিন আগে অবশ্য আমিও সেখানে থাকতুম।”

 

“আর অন্য ভাগ? সেখানে কে থাকেন?”

 

“সেখানে থাকে পুরন্দর। সে তার বউ আর ছেলেকে নিয়ে থাকে।”

 

“পুরন্দর কে?”

 

“আমার স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলে।”

 

“আপনি নিজে তো ও-বাড়ি থেকে চলে এসেছেন, এখন তা হলে আছেন কোথায়?”

 

“বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটা হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে আটতলার একটা ফ্ল্যাটে।” শান্তিলতা তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বার করে ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এতে আমার ঠিকানা আর ফোন-নম্বর রইল।”

 

কার্ডটা পকেটে ঢুকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “ফ্ল্যাটটা কার?”

 

“কেন, আমার।” শান্তিলতা হেসে বললেন, “অবিশ্যি আমার স্বামীর টাকায় কেনা। বিয়ের পরেই বৃদ্ধ স্বামী তাঁর তরুণী স্ত্রীকে ওটা যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ব্যাঙ্কে পঁচিশ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট।”

 

“তা হলে তো আপনার কোনও চিন্তা থাকার কথা নয়।”

 

“কিন্তু সেটাই কি সব?” হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেলেন শান্তিলতা। বললেন, “আমার স্বামী আমার পিছনে লোক লাগিয়েছেন। সারাক্ষণ তারা আমার পিছনে-পিছনে ঘোরে। আমার উপরে নজর রাখে! আমার বিশ্বাস, সুযোগ পেলে তারা আমার বড় রকমের কোনও ক্ষতি করবে। মেরেও ফেলতে পারে। তখন ওই ফ্ল্যাট আর টাকা আমার কোন কাজে লাগবে?”

 

ভাদুড়িমশাই একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “এ-ব্যাপারে আমি ঠিক কী করতে পারি?” শান্তিলতা বললেন, “আমি প্রোটেকশন চাই।”

 

“কখন থেকে?”

 

“আজ থেকে। এখন থেকে। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আমি এই যে এখানে এসেছি, ছায়ার মতো দুটো লোক সারাক্ষণ আমার পিছনে লেগে ছিল। আমি যে এই রেস্তোরাঁয় ঢুকে আপনাদের টেবিলে এসে বসেছি, সেটাও তাদের নজর এড়ায়নি। আমার ধারণা…না, ধারণা নয়, আমি হলফ করে বলতে পারি যে, এই মুহূর্তে তারা রেস্তোরাঁর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করছে। এখান থেকে আমি বেরুবা মাত্র আবার তারা আমার পিছু নেবে।”

 

ঘরের মধ্যে যেখানে আমি বসে আছি, রেস্তোরাঁর দরজাটা সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। তাই, শান্তিলতা মিত্র পুশ-ডোর ঠেলে ঢুকবার এক মুহূর্ত বাদেই যে দুজন না-হলেও একজন লোক বাইরে থেকে ভিতরে এসে ঢুকেছিল, আর বেরিয়েও গিয়েছিল ঘরটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই, আমিও সেটা দেখেছি। সেটা জানাতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “পরে কোথাও দেখলে চিনতে পারবেন?”

 

“তা কেন পারব না?” আমি বললুম, “শ্যামলা রং, হাইট মোটামুটি সাড়ে পাঁচ ফুট, স্টকিলি বিল্ট, মাথার সামনের দিকে টাক, কানের পাশের চুল সাদা। দেখলেই চিনতে পারব।”

 

শান্তিলতা বললেন, “ওরা একা আসে না, সব সময়ে জোড়ায় জোড়ায় থাকে। তবে রোজ যে একই জুটি আমার পিছু নেয়, তা নয়। জুটি মাঝে-মাঝেই পালটে যায়।”

 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “শিফ্‌ট পালটায়, লোকও পালটায়। এরা আজ দিনের শিফটে কাজ করছে। রাত্তিরে আর-এক জুটি এসে এদের কাছ থেকে চার্জ বুঝে নেবে।”

 

শান্তিলতাকে উদ্‌বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন, “এরা সুযোগ পেলেই আমার ক্ষতি করবে। হয় বোমা ছুড়বে, নয়তো অ্যাসিড বাল্ব। গুলিও চালাতে পারে। মিঃ ভাদুড়ি, আমি আপনার ক্লায়েন্ট। আপনি আমাকে প্রোটেকশন দেবেন না?”

 

“বুঝতে পারছি, আপনি ভয় পেয়েছেন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে এখুনি এতটা ভয় পাবার কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। আমার ধারণা, ওরা জাস্ট আপনার উপরে নজর রাখছে, দেখছে আপনি কখন কোথায় যান, কী করেন, কাদের সঙ্গে মেশেন। হামলা-টামলা অনেক পরের ব্যাপার। আপাতত বোধহয় এর বেশি কিছু ওদের করতে বলা হয়নি। যা-ই হোক, আপনি যখন ভয় পাচ্ছেন, তখন প্রোটেকশানের ব্যবস্থা আমি এখুনি করে দিচ্ছি। ওটা নিয়ে ভাববেন না।”

 

কথা শেষ করে ভাদুড়িমশাই পকেট থেকে সেল-ফোন বার করলেন। মনে হল, ক্যামাক স্ট্রিটে তাঁর ব্রাঞ্চ-আপিসে প্রদীপ সেনের সঙ্গে কথা বলবেন। ঠিক তা-ই। ওদিক থেকে সাড়া পাবার পরে বললেন, “প্রদীপ, দিস ইজ ফাইভ জিরো ডাবল এইট। একটা নাম আর ঠিকানা দিচ্ছি, টুকে নাও।” ফের পকেটে হাত ঢুকিয়ে শান্তিলতার কার্ডটা বার করে বললেন, “মিসেস শান্তিলতা মিত্র…স্কাইলাইট, ফ্ল্যাট এইট জিরো টু, থ্রি নাইন নাইন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। আমি পার্ক স্ট্রিটের রয়্যাল চায়না রেস্তোরাঁ থেকে বলছি। উনি এখান থেকে ঠিক আধ ঘণ্টা বাদে বেরোবেন। পরনে মভ্ কালারের শিফন শাড়ি, বব্-ছাঁট চুল। তুমি যাকেই পাঠাও, সে এখান থেকেই একটা গাড়িতে ওঁকে ফলো করে যাবে। শি নিড্স প্রোটেকশন। দ্যাস অল।”

 

সেল-ফোন পকেটে পুরে শান্তিলতার দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন সাড়ে ন’টা বাজে। বিল মিটিয়ে এবারে আমরা বিদায় নেব। আপনি ঠিক দশটায় বেরোবেন। আপনার প্রোটেকশানের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। …আর হ্যাঁ, আপনি সম্ভবত আমার কাঁকুড়গাছির ঠিকানায় ফোন করে, আমি কোথায় আছি সেটা জেনে নিয়ে এখানে এসেছেন। কিন্তু আমার ধারণা, আপনি সব কথা আমাকে খুলে বলেননি! যদি সমস্ত কথা খুলে বলতে হয়, তা হলে আজ রাত্তিরে কিংবা কাল সকালে আমাকে ফোন করুন।”

 

বিল মিটিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে আমরা বেরিয়ে এলুম। দেখলুম, কানের পাশে-সাদা-চুল সেই লোকটি ঠায় ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। একা নয়, পাশে আর-একজন। তার সঙ্গী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *