ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে – বুদ্ধদেব গুহ

শেয়ার করুনঃ

এক

ঋজুদা বলল, কি রে? ক্ষিদে পেয়েছে?

–তা একটু একটু পেয়েছে বৈ কি। আমি বললাম।

–তাহলে আয় ঐ বড় শিশু গাছটার তলায় বসি। ঋজুদা আর আমি প্রকাণ্ড গাছটার নীচে একটা বড় পাথরের উপর বসে পড়লাম।

কেন জানি না, ছোটবেলা থেকেই আমি ঋজুদার দারুণ এ্যাডমায়ারার। ঋজুদার জন্যে আমি সব কিছু করতে পারি। তাছাড়া ঋজুদাই তো আমাকে শিকার শিখিয়েছে, বন-জঙ্গলকে ভালবাসতে শিখিয়েছে; ফুল, পাখি, প্রজাপতি সব চিনিয়েছে।

ঋজুদার সঙ্গে বনেজঙ্গলে ঘুরে না বেড়ালে কখনো জানতে পেতাম না যে, বন্দুকের ট্রিগার টানার চেয়ে, যাদের আমরা সহজে গুলি করে মেরে ফেলি, তাদের চেনা অনেক বড় কথা।

ঋজুদা বিয়ে-থা করেনি। করবেও না।

জঙ্গলে জঙ্গলে কাঠের ঠিকাদারী করে বেড়ায়। পুষ্যির মধ্যে সাত-সাতটা দেশী কুকুর। তাদের নাম রেখেছে সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি।

রাতে চানটান করে ঋজুদা যখন হাত-পা ছড়িয়ে নিজের ঘরে সব দরজা-জানলা খুলে শুয়ে থাকে তখন সেই সাত-সাতটা কুকুর তার ঘরে, তার খাটের চারপাশে ঘুমোয়। কোনোটা বা হাত চাটে, কোনোটা বা পা, কোনোটা কানের পাশে জিভ দিয়ে সুড়সুড়ি দেয়।

আমরা যখন খাচ্ছি, এমন সময় দূর থেকে ডালপালা ভাঙ্গার কড়মড় শব্দ শোনা গেল।

আমি উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। ঋজুদা বলল, ভাল করে খা। ব্যাটারা অনেক দূরে আছে। তারপরই বলল, কোথায় আছে বল তো?

আমি বললাম, কি? হাঁতি?

ঋজুদা হাসল; বলল, তুই কি কাবলিওয়ালা? হাতিকে হাঁতি বলছিস কেন?

ভাল করে চারধারে চেয়ে একদিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ঐদিকে।

ঋজুদা বলল, দূর বোকা। যেদিকে দেখালি, ঠিক তার উল্টোদিকে।

আমরা যেখানে বসেছিলাম, সে জায়গাটা একটা উঁচু পাহাড়ের গায়ে। আমাদের পায়ের নীচে, অনেক নীচে, খাড়া খাদের নীচে একটা পাহাড়ি ঝর্ণা বয়ে চলেছে। আমরা এখন এত উপরে আছি নদীটা থেকে যে, নদীটা প্রচণ্ড শব্দ করে বয়ে গেলেও একটা ক্ষীণ কুলকুল শব্দ ছাড়া অন্য কোনোরকম শব্দ শোনা যাচ্ছে না এখান থেকে।

ঋজুদা আঙুল দেখিয়ে বলল, দ্যাখ, ঐ দূরে ঝর্ণার্টার কাছাকাছি কতগুলো বড় গাছের মাথা কারা ঝাঁকাঝাঁকি করছে। দেখতে পাচ্ছিস?

আমি নজর করে দেখলাম; বললাম, হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি।

ঋজুদা বলল, হাতিগুলো ঐ ঝর্ণাটার আশেপাশেই আছে। ডাল ভেঙ্গে ভেঙ্গে পাতা খাচ্ছে।

আমি সবে একটা আস্ত ডিমসেদ্ধ মুখে পুরেছিলাম, আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে এল।

ঋজুদা আমার অবস্থা দেখে হেসে ফেলল। বলল, ক্যালকেসিয়ান, কোনো ভয় নেই। তুমিও তোমার খাবার খাচ্ছ, ও বেচারীরাও তাদের খাবার খাচ্ছে। ওদের গলায় গাছের ডাল আটকাচ্ছে না, আর তোমার গলায় ডিম আটকালো কেন?

আমি লজ্জা পেয়ে, ওয়াটারবটুল খুলে তাড়াতাড়ি জল খেলাম ঢকঢক করে।

ঋজুদা আড়াই কাপ চা খেয়ে পাইপটা জমিয়ে ধরিয়েছে, এমন সময় জঙ্গলের পাকদণ্ডী পথ দিয়ে কেউ আসছে বলে মনে হল।

উড়িষ্যার এ সব অঞ্চলে নানা উপজাতি আদিবাসীদের বাস। তাদের সম্বন্ধে কত কি যে জানার আছে, শোনার আছে, তা বলার নয়। তাদের কথা কেউ লেখে না। লোকেরা শহরের লোকদের দুঃখ-কষ্টর কথা নিয়ে হৈচৈ করে, মিছিল বের করে, কিন্তু এইসব লোকেরা, যাদের নিয়ে আমাদের আসল দেশ, আসল ভারতবর্ষ, তারা যে কত গরীব, তাদের যে কত কষ্ট, তা বুঝি কেউ জানেই না!

আমি যদি বড় লেখকদের মত লিখতে জানতাম তাহলে শুধু এদের নিয়েই লিখতাম। এদের নিয়ে বড় লিখতে ইচ্ছে করে, সত্যিকারের সৎ লেখা।

দেখতে দেখতে আমাদের পিছনে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে এসে হাজির। ওরা জঙ্গলের পথে খালি পায়ে এমন নিঃশব্দে চলাফেরা করে যে, শব্দ শুনে মনে হয়, কোনো জংলী জানোয়ার আসছে।

দুজনের পরনেই একটি করে ছোট কাপড়। মেয়েটির পিঠে আবার একটি বাচ্চা (এই এক বছরের হবে) সেই কাপড়টুকু দিয়েই বাঁধা। ছেলেটির কোলে আর একটি বাচ্চা, কিন্তু মানুষের নয়। বিচ্ছিরি কিম্ভুতকিমাকার দেখতে।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে ঋজুদা বলল, ওটা কি বল তো?

আমি বললাম, কি? তুমি বল।

সজারুর বাচ্চা। ঋজুদা বলল।

আমি বললাম, ওরা কি ওটা খাবে?

ঋজুদা বলল, বিক্রি করার চেষ্টা করবে। ভাল দাম পেলে নিজেরাই খেয়ে নেবে, আর কি করবে!

ঋজুদা লোক দুটিকে বসাল।

তারপর বাস্কেটের মধ্যে অবশিষ্ট স্যাণ্ডউইচ ইত্যাদি যা ছিল সব ওদের দিয়ে দিল। ওরা যে কি ভাবে চোখ বড় বড় করে ওগুলো খেল তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ঋজুদা যে ভিখিরীর মত করে ওদের খেতে দিল তা নয়, লোকে নিমন্ত্রিত অতিথিকে যেমন করে খাওয়ায়, তেমন করে আদর করে খাওয়াল। ওদের খাওয়া হলে, ওদের দুজনকে একটা একটা করে টাকা দিল।

ছেলেটি আর মেয়েটি কি সব বলতে বলতে চলে গেল।

আমি বললাম, কি বলল ওরা? ঋজুদা হাসল; বলল, ওরা আমাকে এক্ষুনি মরে যেতে বলল।

–সে কি? তার মানে?

–তার মানে আমার অনেক আয় হোক। ওদের বলার ধরনই এমন।

ওরা চলে গেলে আমরা উঠে পড়লাম। পিকনিক বাস্কেটটা গুছিয়ে নিয়ে পিঠের রাকস্যাকে পুরে ফেললাম।

ঋজুদা উঠে দাঁড়িয়ে রাইফেলটা, দূরবীনটা আর টুপিটা তুলে নিল। তারপর বলল, চল, দেখি তোর ভাল্লুকমশাই কি করছেন।

ভাল্লুকমশাই-এর খোঁজেই তো বেরিয়েছিলাম আমরা ক্যাম্প থেকে সেই ভোরে। এখনো তো তার টিকিটি দেখলাম না।

গতকাল ঋজুদার একজন কাঠ-কাটা কুলীকে একটা বিরাট ভাল্লুক ভরদুপুরে এমনভাবে আঁচড়েছে যে, সে বেচারীকে এখন বাঁচানোই মুশকিল! কালই তাকে অঙুল শহরের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এই অঞ্চলে, হাঁটতে হাঁটতে যেখানে আমরা এখন এসে পৌঁছেছি, সেখানে কতগুলো বড় বড় গুহা আছে। তার মধ্যে নাকি অনেকগুলো ভাল্লুকের বাস। এই ভালুকগুলোকে এখান থেকে তাড়াতে না পারলে এখানে কাঠের কাজ চালানোই মুশকিল।

এবার আস্তে আস্তে পাহাড় ছেড়ে আমরা সামনের সবুজ সমতল তৃণভূমিতে নেমে এলাম। উপর থেকে যে ঝর্ণাটা দেখছিলাম সেটা এখান দিয়ে কিছুটা পথ গড়িয়ে গেছে।

তৃণভূমিটি বেশী বড় নয়। এই এক হাজার বর্গফিট হবে। তার এক পাশে পাহাড়টা খাড়া উঠে গেছে। এবং সেই দেওয়ালের মত পাহাড়ে পর পর কতগুলো গুহা।

আমাদের সামনে দিয়ে জানোয়ারের একটা চলার পথ, আমরা যে পায়ে-চলা পথটা দিয়ে পাহাড় থেকে নামলাম, সেটাকে কোনাকুনি ভাবে কেটে গেছে।

ঋজুদা সেই মোড়ে গিয়ে পথটাকে ভাল করে দেখল, তারপর বলল, সত্যিই তবে এখানে ভাল্লুক আছে। ওদের যাওয়া-আসার চিহ্নে পথটা ভর্তি।

তারপর বলল, কথা বলিস না। এই বলে, সেই তৃণভূমির ডানদিকে একটু এগিয়ে গিয়ে, গুহাগুলো লমত দেখা যায় এমন একটা জায়গা দেখে, একটা বড় পাথরের আড়ালে আমাকে বসতে বলল। বলল, ভালুক জানোয়ার বড় বিচ্ছিরি। তুই এখানেই বসে থাক রুদ্র। তবে এখান থেকে গুহাটা তোর বন্দুকের পাল্লার মধ্যেই পড়বে। আমি রাইফেল নিয়ে গুহার কাছে যাচ্ছি। আমি গুহার পাশে পৌঁছে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকব। আর তুই এখান থেকে পর পর চারটে গুলি করবি ছল্লা দিয়ে গুহার মুখের নীচে। দেখিস, আমাকে মারিস না আবার। ভালুকমশাইরা যদি থাকেন তবে হয় বাইরে বেরোবেন, নইলে আওয়াজ দেবেন। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

এই অবধি বলে ঋজুদা নিঃশব্দ পায়ে ঐদিকে এগিয়ে গেল রাইফেলটা বগলের নীচে বাগিয়ে ধরে।

আমি পাথরের উপরে বন্দুকটা রেখে, গুলির বেল্ট থেকে ছা বের করতে লাগলাম। চা বের করে, দুটো বন্দুকের দু নলে পুরে, দুটো পাশে রাখলাম। একটা বুলেট ও একটা এল-জিও রেডি করে রাখলাম, যদি আমার ঘাড়ে এসে কোনো ভাল্লুক হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তার দাওয়াই হিসেবে।

আমি পর পর দুটো গুলি করলাম।

সেই গুলির শব্দের প্রতিধ্বনি পাহাড়ে পাহাড়ে এমনভাবে ছড়িয়ে গেল তা বলার নয়। এবং সেই শব্দর সঙ্গে হনুমানের ডাকের শব্দ, টি-টি পাখির ডিড-ইউ-ডু-ইট ডিড-ইউ-ডু-ইট করে কৈফিয়ত চাওয়ার চেঁচামেচিতে মাথা খারাপ হবার যোগাড় হল।

দেখলাম, ঋজুদা মনোযোগ সহকারে সামনে চেয়ে আছে।

এমন সময় খুব একটা চিন্তাশীল মোটাসোটা ভাল্লুক বড় গুহাটা থেকে বেরিয়ে গুহার সামনের পাথরে দাঁড়িয়ে পড়েই একবার ডন মারল। তারপর যখন দেখল, ধারেকাছে কেউ কোথাও নেই, তখন আকাশের দিকে চেয়ে মেঘ ডাকল কিনা তা বোঝবার চেষ্টা করল। আকাশে মেঘ না দেখে, ও বাতাসে নাকটা উঁচু করে কল এবং শুঁকতেই বাতাসে বন্দুকের টোটার পোড়া বারুদের গন্ধ পেল।

সঙ্গে সঙ্গে সে পড়ি-কি-মরি করে গুহার মধ্যে ঢুকে যাবার জন্যে এ্যাবাউট-টার্ণ করতে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঋজুদার ফোর-সিক্সটি-ফাইভ ব্বিগবী রাইফেলের গুলি ভাল্লুকটার শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। ভালুকটার শরীরের মধ্যে গুলিটা একটা ঝাঁকি তুলেই বেরিয়ে গেল।

ভালুক জাতটাই সার্কাসের জোকারের মত। এ ভাল্লুকটাও মরবার সময় জোকারের মত মরল।

ওর শরীরটা পাথর গড়িয়ে এসে নীচের ঘাসে ধপ করে পড়ল। ভাল্লুকটা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুঁই কুঁই কুঁই কুঁই করে আওয়াজ শুনতে পেলাম, ঐদিক থেকে। ভাল করে তাকিয়ে দেখি, কালো রাগবী বলের মত দেখতে দুটো ভাল্লুকের গাবলু-গুবলু বাচ্চা ঐ গুহাটা থেকে বেরিয়ে ওরকম আওয়াজ করছে।

ওগুলোকে দেখেই ঋজুদা চেঁচিয়ে উঠল, খবরদার, গুলি করিস না রুদ্র। আমি ও ঋজুদা দুজনেই ওদের কাণ্ড-কারখানা দেখতে লাগলাম। বাচ্চা দুটো পাথরের কোণা অবধি এসে নীচে একবার তাকাল, যেখানে ওদের মা (মা-ই হবে নিশ্চয়ই) পড়ে আছে। পাথরের কোণা অবধি আসতেই তারা তিন-চারবার ডিগবাজী খেল। তারপর প্রথম বাচ্চাটা নীচে একটু ভাল করে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ একেবারে চার-পা শূন্যে তুলে পপাত ধরণীতলে। পরের বাচ্চাটাও তার দাদা অথবা দিদির অধঃপতনে অনুপ্রাণিত হয়ে, আমরা যেমন করে সুইমিং পুলে ডাইভ দিই, তেমনি করে উপর থেকে নীচে ডাইভ দিল।

আমি আর ঐ উত্তেজনা সহ্য করতে পারলাম না। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ঋজুদা, ওদের ধরব?

ঋজুদা ঐখানেই দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবল, তারপর বলল, ধর।

যেই না অর্ডার পাওয়া, অমনি আমায় আর দেখে কে? বন্দুক আর গুলি ঐখানেই ফেলে রেখে বাঁই বাঁই করে আমি ওদিকে দৌড়ে গেলাম। ওখানে পৌঁছে দেখলাম, বাচ্চা দুটো মায়ের পিঠের ওপর একবার উঠছে আবার গড়িয়ে পড়ছে। প্রথম বাচ্চাটা যেটা চার-পা-তুলে পড়েছিল, সেটার বোধহয় চোট লেগেছে কোথাও। সেটা বারবার মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। জদা-দেওয়া পান খেয়ে কৃষ্ণা পিসীর বিয়েতে আমি যেমন পড়েছিলাম।

আমি দৌড়ে গিয়ে একটাকে কোলে তুলে নিতে গেলাম। কোলে নেওয়া তো দূরের কথা, এত সলিড ও ভারী বাচ্চা যে, আমিই মাটিতে পড়ে গেলাম। বুঝলাম, যতক্ষণ ওদের মা এখানে শুয়ে আছে, ওদের এখান থেকে পালিয়ে যাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

আবার উপরে তাকাতেই আমার বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। হঠাৎ দেখলাম, উপরের একটা গুহা থেকে একটা প্রকাণ্ড ভাল্লুক দ্রুত লাফিয়ে নেমে আসছে ঋজুদাকে লক্ষ্য করে।

আমি চীৎকার করে উঠলাম, ঋজুদা!

আমার চীৎকারের সঙ্গে সঙ্গে ঋজুদা ঘুরে দাঁড়াল।

ততক্ষণে সেই অতিকায় ভাল্লুকটা অদ্ভুত একটা উঁক উঁক চীৎকার করে একেবারে ঋজুদার ঘাড়ে এসে পড়েছে বলা চলে।

ঋজুদা মুখ থেকে পাইপটা বের করার সুযোগ পর্যন্ত পেল না। ঐ অবস্থাতেই রাইফেল তুলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করল।

গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে ভালুকটাও ঋজুদার উপরে এসে পড়ল। ভাল্লুকটা উপর থেকে আসছিল, তাই তার গতির সঙ্গে ভারবেগ যুক্ত হয়েছিল। ঐ ভারী ভালুত্রে তীব্র ধাক্কা ও আক্রমণে ঋজুদা উপর থেকে নীচে ছিটকে পড়ল–সঙ্গে সঙ্গে ভালুকটাও। ঋজুদার রাইফেলটাও হাত থেকে ছিটকে পড়ল।

ওদের উপর থেকে ঐভাবে পড়তে দেখেই আমি প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে আমার বন্দুকটা নিয়ে এলাম। ফিরে আসবার সময় দৌড়তে দৌড়তেই গুলি ভরে নিলাম।

কাছে এসে দেখি, ভালুকটা আর ঋজুদা প্রায় দশ হাত ব্যবধানে পড়েছে। ভাল্লুকটা তখনো পায়ে দাঁড়িয়ে ঋজুদার দিকে উঠে আসবার চেষ্টা করছে দেখে আমি তাড়াতাড়ি ওর কানের কাছে একটা এল-জি মেরে দিলাম। ওর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

ঋজুদার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখি, শরীরের নানা জায়গা কেটে গেছে। এবং কপালের ডানদিকে একটা জায়গা কেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।

ঋজুদা আমাকে কাছে ডাকল।

বুঝলাম, নিজের পায়ে উঠে চলার ক্ষমতা নেই ঋজুদার। ঋজুদা বলল, আমার রাকস্যাকে একটা বাঁশী আছে। বাঁশের বাঁশী। উপরে উঠে গিয়ে ওই বাঁশীটা বাজা, যত জোরে পারিস।

তখন আর কেন-টেন শুধোবার উপায় ছিল না।

দৌড়ে পাহাড়ের গায়ে একটা উঁচু জায়গায় উঠে গিয়ে বাঁশীটা বাজাতে লাগলাম। বাঁশীটা কয়েকবার বাজাতেই জঙ্গলের বিভিন্ন দিক থেকে গম্ভীর গৰ্গবে আওয়াজে ঢাক বাজতে লাগল। দেখতে দেখতে চারদিকের বন-পাহাড় সে আওয়াজে ভরে উঠল।

ঋজুদা হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকল।

আমি ঋজুদার মুখে একটু জল দিলাম ওয়াটার-বট থেকে। পরিষ্কার জলে মুখের রক্ত ধুয়ে দিতেই আবার ফিনকি দিয়ে নতুন রক্ত বেরোতে লাগল। আমার খুব ভয় করতে লাগল।

কিন্তু ভয় বেশিক্ষণ রইল না। দেখতে দেখতে প্রায় পনেরো মিনিটের মধ্যে পাহাড়ের চতুর্দিক থেকে অদৃশ্য সব পাকদণ্ডী পথ বেয়ে কোহো, খন্দু, মালো ইত্যাদি নানা আদিবাসীরা এসে হাজির।

তারাই সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গি দিয়ে বাঁশ কেটে স্ট্রেচার বানিয়ে পাতার গদী করে তাতে ঋজুদাকে শুইয়ে আদর করে বয়ে নিয়ে চলল। অন্য কয়েকজন মরা ভাল্লুক দুটো ও বাচ্চা দুটোকে নিয়ে আসতে লাগল।

আধঘন্টার মধ্যে আমরা ঐখানে পৌঁছে গেলাম কিন্তু মুশকিল হল–জীপ চালাবে কে? আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তখন একটু-একটু গাড়ি চালানো শিখেছিলাম, কিন্তু আমার লাইসেন্স ছিল না। ঐ জঙ্গলে অবশ্য লাইসেন্স দেখবার কোনো লোকও ছিল না, কিন্তু লাইসেন্স থাকলেও অত্যন্ত ভাল ড্রাইভার না হলে ঐ জঙ্গল ও পাহাড়ের রাস্তায় জীপ চালানো সম্ভব নয়।

ঋজুদা ব্যাপারটা বুঝে নিল। তারপর কোহহাদের ভাষায় ওদের বলল, ওকে ধরাধরি করে জীপের ড্রাইভিং সীটে বসিয়ে দিতে।

ড্রাইভিং সীটে বসে, ঋজুদা অনেকক্ষণ পর এই প্রথম হাসল। বলল, কী রে রুদ্র? ভয় পেয়েছিস? কোনো ভয় নেই। হা ঠিক হ্যায়। এই বলে, পাইপটাতে তামাক ভর্তি করে নিল ঋজুদা। আমি দেশলাইটা জ্বেলে ঋজুদার পাইপটা ধরিয়ে দিলাম। তারপর পাইপটা দাঁতে কামড়ে ধরে ঋজুদা জীপ স্টার্ট করল।

সঙ্গের লোকদের মধ্যে জনাচারেক পেছনের সীটে উঠে বসল–তারা কিছুতেই এ অবস্থায় ঋজুদাকে একা ছাড়তে চাইল না।

জীপ চালাতে খুবই যে কষ্ট হচ্ছিল তা ঋজুদার বসার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছিলাম। পথের ঝাঁকুনিতে তার ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল। ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যে, ঋজুদার পিঠের কোনো হাড় ভেঙ্গে গেছে। এত যন্ত্রণা হলে কি হবে, ঋজুদার মুখের দিকে যতবার তাকাই, ঋজুদা বলছিল, ঠিক হ্যায়, সব ঠিক হ্যায়! ঘাবড়াও মত্।

আমরা ক্যাম্পে পৌঁছতেই ক্যাম্পের মুহুরীরা এবং ট্রাকের ড্রাইভার অমৃতলাল এগিয়ে এল। এক কাপ গরম চায়ে কিছুটা ব্র্যাণ্ডি মিশিয়ে ঋজুদার খেতে যা সময় লাগে, তার জন্যে দাঁড়িয়েই আমরা আবার রওয়ানা হলাম।

ঋজুদাকে পাশের সীটে সাবধানে সরিয়ে দিয়ে অমৃতলাল জীপ চালিয়ে চলল অঙুলের হাসপাতালে। ওখানে ছাড়া হাসপাতাল নেই কোথাও কাছে-পিঠে।

হাসপাতালে ঋজুদার কতদিন থাকতে হবে কে জানে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *