নিনিকুমারীর বাঘ (ঋজুদা) – বুদ্ধদেব গুহ
এক
তিতির বলল, আমি তোমাদের সঙ্গে যেতে পারি আর নাই পারি, বল ঋজুকাকা, নিনিকুমারীর বাঘের কথা ভাল করে শুনে তো নিই।
ঋজুদার বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাটে বসে পুজোর পরের এক বিকেলে কথা হচ্ছিল। আমি তিতির আর ভটকাই গেছিলাম ঋজুদাকে বিজয়ার প্রণাম করতে। বাঘটার এমন নাম কেন হল? নিনিকুমারীর বাঘ? ভটকাই শুধোল।
ভটকাই খুবই সাবধানে কথাবার্তা বলছে। কারণ ওর অলিখিত অ্যাপ্লিকেশনটা আমি বিনা কালিতে রেকমেন্ড করে ফরোয়ার্ড করে দিয়েছি ঋজুদার কাছে। ওর নিজের তো বটেই, আমারও অনেকদিনের ইচ্ছে যে ভটকাই একবার ঋজুদার সঙ্গে যায় কোনো অ্যাডভেঞ্চারে। আমাদের এই সব অ্যাডভেঞ্চারের অবশ্য অন্য নাম আছে ভটকাই-এর পরিভাষায়। ও বলে, কড়াক্-পিঙ-ডং-ডিং।
ওদিকে ওর অ্যাপ্লিকেশনের কী গতি করবে তা ঋজুদাই জানে! ঝুলিয়ে রেখেছে এখনও। এবং শেষ পর্যন্ত রাখবেও। এই ঋজুদার তরিকা! অপটিমিস্ট ভটকাই রাইট অ্যান্ড লেফট তেল দিয়ে যাচ্ছে ঋজুদাকে। কিন্তু ও জানে না তেল দেওয়াটাও আদৌ সহজ কর্মের মধ্যে পড়ে না। তেল দিতে হলে তেল-বিশারদও হতে হয়। তাছাড়া কত্ত রকমের তেল আছে। মাল্টিগ্রেড, অর্ডিনারি! চল্লিশ নাম্বার, ষাট নাম্বার। পেট্রল, নাইনটি-থ্রি অকটেইন; এ সব ভালমত জানতে হবে। তার পরেও দেওয়ার সময়ে যদি ডিফারেনশিয়ালের ফুটোতে ব্রেক অয়েল দিয়ে দেওয়া হয় তা হলেও চিত্তির! তাই আমি মাঝে মাঝেই ঋজুদার অলক্ষে ভটকাইকে চিমটি কাটছি। কিন্তু এমনই হাবা-গবা যে, বুঝেও বুঝছে না। সাধে কি ওর শ্যামবাজারের বন্ধুরা ওকে নিয়ে গান বেঁধেছে ওরে ওরে ভটকাই আয় তোরে চটকাই?
ঋজুদা বলল, কীরে রূদ্র! এই তিতির, ভটকাই, তোরা খা। লুচিগুলো যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রাবড়ি দিয়ে লুচিগুলো খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।
ভটকাই রাবড়ি সহযোগে লুচির লোভ নস্যাৎ করে দিয়ে আবারও শুধোল, বাঘটার নাম ‘নিনিকুমারীর বাঘ’ কেন, তা কিন্তু বলোনি ঋজুদা।
ঋজুদা পাইপে আগুন ধরিয়ে বলল, বুঝলি না! রাজা-রাজড়াদের ব্যাপার! সব রাজপরিবারেই রেওয়াজ ছিল যে রাজকুমারীরাও, বয়স বার-তের বছর হলেই তাঁদের প্রথম বাঘটি শিকার করবেন রাজকুমারদেরই মত। সে গোয়ালিয়র, রাজস্থান, ভূপাল বা কুচবিহার, যে রাজ্যই হোক না কেন! মহারাজা এবং বড় রাজাদের দেখাদেখি ছোট ছোট কদর রাজ্য এবং নকলনবিশ জাগিরদার, জমিদারদের পরিবারেও এই নিয়ম চালু হয়েছিল। নিয়ম না বলে বলা ভাল ঐতিহ্য! ট্রাডিশন! ভারতবর্ষ হচ্ছে ট্র্যাডিশনের দেশ।
বলেই একটু থেমে পাইপে লম্বা টান লাগাল একটা।
তারপর বলল, সাম্বপানি, যেখানে আমাদের যাওয়ার নেমন্তন্ন এসেছে নিনিকুমারীর বাঘের মোকাবিলা করতে, সেটি ছিল ওড়িশার একটি ছোট্ট, অখ্যাত রাজ্য। সেই রাজ্যের ছোট রাজকুমারীর নাম ছিল নিনি। কিন্তু যে বাঘের নাম নিনিকুমারীর বাঘ তা কিন্তু তার জীবনের প্রথম বাঘ নয়; শেষ বাঘ। সাম্বপানির নিনিকুমারী আজ বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হত প্রায় নব্বই বছর। বছর দশেক হলে উনি গত হয়েছেন। তাঁর বয়স যখন আশি টাশি তখন শীতকালে অষ্টমী পুজোর সময় বাপের বাড়ি এসে হঠাৎ তাঁর শখ চাপল যে নিজেদের খাস জঙ্গলে উনি একটি বাঘ মারবেন। প্রমাণ করবেন যে তিনি আদৌ বুড়ি হননি। কুড়িতে বুড়ি হয় মধ্যবিত্ত বাঙালী মেয়েরাই। এই নিয়ম কি আর রাজকুমারীদের বেলায় খাটে!
তারপর? আমি বললাম, জম্পেশ করে রাবড়ি মাখিয়ে একটি লুচি মুখে পুরে দিয়ে।
বাঘ তো মারবেন ঠিক করলেন নিনিকুমারী কিন্তু বাঘ শিকার তো সারা দেশেই তখন বেআইনী হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজা-রানীদের বেলা কোনো আইনই খাটে না। করদ রাজ্যের রাজা-রানীদেরও বেলাতেও নয়; গণতন্ত্রের রাজা-রানীদের বেলাতেও নয়। রাজা-রানীদের পায়ে মাথা ঠেকানোই আমাদের ঐতিহ্য।
ভটকাই বলল, ট্র্যাডিশন।
অতএব রাজত্ব থাক আর নাই থাক, প্রজারা বাঘ-শিকারের সব বন্দোবস্তই পাকা করে ফেলল।
উঁচু পাহাড়ের উপরে একটি দুর্গ ছিল। ওড়িয়াতে বলে গড়। সেটি শুটিং-লজ হিসেবে ব্যবহৃত হত। তার নাম ছিল শিকার-গড়। খবর গেল শিকার-গড়-এ। ধুলো পড়ে লাল হয়ে যাওয়া ঝাড়-লণ্ঠন যতখানি সম্ভব পরিষ্কার করা হল। শতচ্ছিদ্র গালচে নতুন করে পাতা হল। শিকারের পর সন্ধেবেলা সেখানে নাচ-গান হবে। পার্টি হবে। করদ রাজ্যের পুরনো শিকারীরা তাদের প্রায় মরচে ধরে যাওয়া বন্দুক রাইফেল বের করে। একটি খুব বড় বাঘের পায়ের চিহ্ন দেখে তার চলাফেরার খোঁজ খবর নিয়ে হাঁকোয়া শিকারের বন্দোবস্ত করে ফেললেন। শিকারের দিন লাঞ্চ খাবার পর নিনিকুমারী একটি কুরুম গাছে বাঁধা মাচাতে একেবারে একা গিয়ে বসলেন। মই বানিয়ে রেখেছিল ওরা। সিল্কের ওয়াড়-পরানো ডানলোপিলোর গদীমোড়া মোড়া পেতে। অন্য কোনও শিকারীর সাহায্য নিতে তিনি একেবারেই রাজি হলেন না সেদিন।
হাঁকা শুরু হবার একটু পরই হঠাৎ তাড়া খেয়ে নালার পাশের গুহার মুখে শীতের দুপুরের রোদে ভরপেট খেয়ে আরামে ঘুমিয়ে-থাকা বাঘ বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ে শিকারীদের পরিকল্পনা মতই চলতে লাগল একেবারে সোজা নিনিকুমারীর মাচা যেদিকে, সেদিকেই। আগের রাতে বাঘটি একটি দারুণ শম্বর মেরে তার অনেকখানিই খেয়েছিল। চলতে কষ্ট হচ্ছিল বেচারার। চলতে যে হবে তা জানাও ছিল না। বাঘ মাচার সামনে আসা মাত্র নিনিকুমারী গুডুম করে গুলি করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই এক প্রচণ্ড গর্জন করে লাফ মেরে কুরুম গাছের পেছনের দুর্ভেদ্য কন্টা বাঁশ আর হরজাই জঙ্গলের মধ্যে বাঘ তো ঢুকে গেল। নিনিকুমারীর হাতে ডাবল ব্যারেল রাইফেল থাকা সত্ত্বেও আর গুলি করলেন না উনি। কোনো শিকারীকেও তিনি বাঘের রক্তর দাগ দেখে অনুসরণ করতে মানা করলেন। মাচা থেকে নেমে বাইফোকাল চশমাটি খুলে সুগন্ধী সিল্কের রুমালে কাচ মুছতে মুছতে বললেন যে গুলি লেগেছে বাঘের বুকে। হার্টে। থ্রি-সেভেনটি-ফাইভ ম্যাগনাম-এর গুলি। বাঘ মরে পড়ে থাকবে। কাল সকালে পোড়ো নিয়ে গিয়ে খুঁজে বের করে বাঘকে নিয়ে এসো রাজবাড়িতে। বকশিস্ দেব তোমাদের।
পোড়ো কী, ঋজুদা? তিতির বলল।
ও। পোড়ো মানে মোষ। ওড়িয়াতে। উচ্চারণটা পোড়হো।
গুলি হয়েছিল দুপুরে। পরদিন ভোরেই শিকারীরা রক্তর দাগ দেখে দেখে অনেক দূর গিয়ে দেখল বাঘ শিকার-গড়-এর উঁচু পাহাড়ে উঠে গেছে। রক্তর বা পায়ের দাগও পাওয়া গেল না। ঐ রাইফেলের গুলি বুকে লেগে থাকলে বাঘের পক্ষে অত উঁচু পাহাড় চড়া সম্ভব হত না আদৌ। রক্তর রকম এবং পরিমাণ দেখেই অভিজ্ঞ শিকারীরা বুঝেছিল যে নিনিকুমারীর গুলি হয় বাঘের গা ছুঁয়ে গেছে, নয়ত সামনের দুই পায়ের এক পায়ের থাবাতে বা কব্জিতে লেগেছে। বুকে কখনই নয়।
ঐ খণ্ডিয়া বাঘকে হারিয়ে ফেলে শিকারীরা খুবই চিন্তায় পড়েছিল। পরে কী হবে তা ভেবে। এবং তাদের চিন্তা যে অমূলক ছিল না আদৌ তা তো আমরা এখন দেখছিই।
খণ্ডিয়া মানে? ভটকাই শুধোল। ঋজুদাকে।
খণ্ডিয়া ওড়িয়া শব্দ। খণ্ডিয়া মানে আহত; উনডেড। গুলি লেগেছিল বাঘের ডান কব্জিতে সামনের দিকে। বেচারার কব্জিটাই হেভি রাইফেলের গুলিতে ভেঙে যায়। তারপর থেকেই সে যাকে বলে কব্জি-ডুবিয়ে মানুষের হাড় মাংস খেয়ে যাচ্ছে।
একটু চুপ করে থেকে ঋজুদা বলল, দেশীয় রাজন্যবর্গর বিরুদ্ধে, সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে এক এক জান্তব বিদ্রোহ হয়ে উঠে সে যেন প্রতিশোধ নিয়ে যাচ্ছে সাম্বপানি রাজ্যের নিনিকুমারীর পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহের আমলের মাটিতে উবু-হয়ে-বসে দুহাতে ভক্তিভরে দণ্ডবৎ জানানো অগণ্য অভুক্ত ছিন্ন-বাস প্রজাদের অনেক এবং অনেক রকম অপমানের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই আত্মসম্মানজ্ঞানহীন, সর্বংসহ বোবা, বড় গরিব প্রজাদেরই খেয়ে। বাঘটা নিজেও তো প্ৰজাই ছিল সে রাজ্যের! আমরা তো নিজেরাই নিজেদের খাই। এটাও আমাদের ঐতিহ্য।
ভটকাই রাবড়ির প্লেটটা ট্রেতে নামিয়ে রেখে বলল, ট্র্যাডিশন!
তিতির হেসে উঠল।
ঋজুদা বলল, আশ্চর্য! জানিস, বাঘটা পুরনো সাম্বপানি রাজ্যের এলাকার বাইরে একজনও মানুষ ধরেনি আজ অবধি। যদিও গত দশ বছর ধরে সমানে সে মানুষ খেয়ে চলেছে।
কত বর্গ কিলোমিটার হবে এই রাজ্যের এলাকা ঋজুকাকা?
দুর্গম সব পাহাড় আর ঘন বনের রাজ্য। পাহাড়ী ঝরনা আর নালাতে কাটাকুটি। নদী বলতে একটাই বয়ে গেছে অন্য রাজ্য থেকে এসে সাম্বপানির মধ্যে দিয়ে। গেছে অন্য রাজ্যে। নদীর নাম কনসর। ভারী সুন্দর নদী। জেঠুমণির সঙ্গে আমি একবার বামরা করদ রাজ্যে শিকারে গেছিলাম, তখন দেখেছিলাম। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য পুরো অঞ্চলেরই! ঋজুদা বললো।
আমি বললাম, গত দশ বছরের মধ্যে এই বাঘকে মারতেই পারল না কেউ? না কি, কেউ চেষ্টাই করেনি?
না না। তা কেন? অনেক শিকারীই গেছেন এর আগে। আমাদের চেয়ে অনেকই ভাল ভাল শিকারী। তাছাড়া, কলকাতায় কজন আর ভাল শিকারী আছেন? আমাদের কান ধরে শিকার শেখাতে পারেন এমন শিকারী ভারতের যে-কোনো বনাঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জে গণ্ডা-গণ্ডা আছেন। মফস্বল শহরগুলিতে তো আছেনই। নিনিকুমারীর বাঘকে মারতে বন বিভাগের বিভিন্ন অফিসার, জেলার বিভিন্ন সময়ের ডি এম এবং পুলিস সাহেবরাও চেষ্টা করেছেন। বাইরে থেকেও অনেক শিকারীকে ওঁরা নেমন্তন্ন করেও নিয়ে গেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। স্থানীয় সকলেরই ধারণা হয়ে গেছে যে এ বাঘ, ঠাকুরানীর বাঘ। একে মারা কারওই সাধ্য নেই। ঠাকুরানীর কৃপাধন্য সে। ঐ শিকার-গড়-এর মধ্যে নাকি চণ্ডীমূর্তি আছে। কটক শহরের কটকচণ্ডীর মতই নাকি অত্যন্ত জাগ্রত দেবী তিনি। সাম্বপানির রাজারা আগে খুব ধুমধাম করে শিকার-গড়ে তাঁর পুজো করতেন। মোষ বলিও হত। এখন এই বাঘ নাকি সেই জাগ্রত দেবীরই কৃপাধন্য হয়েছে বলে স্থানীয় মানুষেরা বিশ্বাস করে। মানুষ-খেকো বাঘই এখন চণ্ডীর একমাত্র উপাসক। তাই ভয়ে অন্য কেউ সেখানে আর যায়ই না।
এই সব ওরা এখনও বিশ্বাস করে? এরকম সুপারস্টিশানে? তিতির বলল।
ভটকাই তিতিরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, না কেন? কেন না? একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে যদি রাজস্থানে এখনও ষোল বছরের মেয়ে রূপ কানোয়ার সতী হতে পারে, যদি পাকিস্তানে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেরে দোষীর প্রাণ বের করা হয়, প্রকাশ্য স্থানে, নিজের দেশকে ভালবাসেন এই অপরাধে ভুট্টোকেও যদি বিচারের প্রহসন করে ফাঁসি দেওয়া হয়, তবে ঠাকুরানীর বাঘে বিশ্বাস করে গভীর জঙ্গলের গরিব বাসিন্দারা বেশি দোষ কী করেছে? এই উপমহাদেশেই আবার সুপার-কম্পুটারও বসে! সত্যই সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ!
আলোচনাটা অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে আমি ঋজুদাকে বললাম, বাঘটাকে মারবার জন্যে আর কী করা হয়েছিল এই দশ বছরে?
কী করা হয়নি তাই জিজ্ঞেস কর বরং। ঋজুদা বলল।
পাঁচ ব্যাটেলিয়ন আর্মড পুলিসও নাকি একবার পোস্ট করা হয়েছিল সমস্ত সাম্বপানিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সি আর পি-ও দৃ ব্যাটেলিয়ন। তাদের প্রত্যেককে অটোম্যাটিক রাইফেল দেওয়া হয়েছিল। রাতের পর রাত অনেকগুলি জিপে ও ভ্যানে স্পটলাইট ফিট করে পুরো এলাকাতে তন্নতন্ন করে সরষে দানার মত বাঘ খুঁজে খুঁজে বেড়াত তারা। মানুষখেকো হয়ে যাবার পর বাঘটার ওপর নাকি কমপক্ষে পঁচিশবার গুলিও চলেছে। অনেক শিকারীই মারাত্মকভাবে তাকে আহত করার দাবি করেছেন। গুলি করার পর আহত বাঘের গর্জনও শুনেছেন নাকি তিনজন শিকারী। তবুও নিনিকুমারীর বাঘ বহাল তবিয়তেই আছে এবং বাংলার গ্রামের শেয়াল গরমের দিনে যেমন কপাকপ কই মাছ খায়, তেমন করেই অবলীলায় মানুষ ধরে খেয়ে চলেছে।
ভটকাই বলল, এ তো মহা গুলিখোর বাঘ। দেখছি রীতিমত অ্যাডিক্ট হয়ে গেছে।
ভটকাই-এর কথা বলার ধরনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম।
ঋজুদা বলল, সাম্বপানি জায়গাটা নাকি গমগম করত একসময়। হাট বসত সপ্তাহে দুবার। কাঠ, বিড়িপাতা, তামাক এ সবের কারবার ভাল ছিল। সাকাস কোম্পানি আর যাত্রাপার্টি আসত প্রতি বছর শীতকালে ধান কাটার পর। চাষাবাদ এখন প্রায় বন্ধ। যাদেরই উপায় আছে কোনো, তারাই সাম্বপানি ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্র বাড়ি-ঘর ফেলে রেখে। মহামারী লাগলে যেমন হয় তেমনই অবস্থা নাকি! কবছরের মধ্যে এই গল্প করা রমরমে জায়গাটা কঙ্কালসার শ্রীহীন বসতিতে পরিণত হয়েছে। দিনে রাত্রে মাত্র দুটি আপ আর দুটি ডাউন ট্রেন ছোট লাইনের এই স্টেশনটিতে এসে দাঁড়ায়। কোনও কারণে ট্রেন লেট হলে সন্ধের পরে প্ল্যাটফর্মে কেউ থাকে না। ট্রেনও দাঁড়ায় না সেদিন। স্টেশন মাস্টার সবুজ আলো দেখান না। সিগন্যালম্যানরা আউটার সিগন্যাল থেকে নেমে দিনে দিনে চলে আসে। কখনও কখনও নিনিকুমারীর বাঘকে সূর্য ডোবার আগে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতেও দেখা যায়। বাঘটার নাকি ভয়ডর নেই। কিন্তু শিকারীদের ধারে কাছে আসে না। কিল-এও কখনই ফেরে না।
আমি স্বগতোক্তি করলাম, খুউব কঠিন হবে তো এই বাঘকে মারা।
ঋজুদা যেন নিজের মনেই বলল, খুউবই কঠিন।
