ঘনাদাকে ভোট দিন – প্রেমেন্দ্র মিত্র
ঘনাদাকে ভোট দিন (এক)
অন্য কিছু কেউ যদি শুনে থাকেন তা ভুল।
সেই বাহাত্তর এখনও।
না, বাহারে কিছু নয়, বাহাত্তর নম্বর সেই বনমালি নস্কর লেন।
সেই ট্রাম, বাস, লরি, মোটর, রিকশা, ঠেলা আর মানুষের ভিড়ের ধাক্কায় যেন টলতে টলতে ছিটকে পড়া নোংরা, সরু, আঁকাবাঁকা গলিটা। সেই উপচে-পড়া ডাস্টবিন আর খুঁটে-লেপটানোপোড়া বাড়ির দেওয়াল বাঁচিয়ে, একবার ডাইনের। খাটালের সুবাসে আর একবার বাঁয়ের টিনের কারখানার ঝাঁপতাল সংগীতে দিশাহারা হয়ে খাপরা আর টিনের চালের বস্তির মধ্যে যেন থমকে দাঁড়ানো বেঢপ বেমানান পলস্তারা-খসা সেকেলে বাড়িটা।
সেই আমাদের বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের মেস ঠিক যেমনটি ছিল তেমনিই আছে।
ওর আর অদল বদল হবার কোনও আশা নেই।
কিন্তু কী সুবিধেটাই না হয়েছিল! একেবারে আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতো। সে চেরাগ হাতে পেয়েও কেন যে সব ভেস্তে গেল, সে কাহিনী বলতে গেলে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়।
এ বিয়োগান্ত নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্য ওই বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের মেসবাড়ির দোতলার আড্ডা ঘর। সময় রবিবারের বিকেল। কুশীলব বলতে শিশির, গৌর এবং আমি ছাড়া তৎকালে আর কেউ নয়। আমরা তেতলার একটি ঘরের দিকে উৎকর্ণ হয়ে থাকার সঙ্গে প্রত্যেকে নিজের নিজের পছন্দসই দৈনিকে ও সাপ্তাহিকের সব চেয়ে দামি পাতায় মাঝে মাঝে মনঃসংযোগ করে নীরস বিকেলের একঘেয়েমিটা একটু ভুলতে চেষ্টা করছি। তেতলার ঘর থেকে সেদিন কিছু হবার আশা নেই বলেই জানি। শনিবার থেকেই অসহযোগ শুরু হয়েছে, শুরু হয়েছে করপোরেশনের আসছে নির্বাচনের এক প্রার্থী দলবল সমেত এসে খানিক হইচই করে যাবার পর। কেন ওই সব বক্তিয়ার খিলজিদের নিয়ে মাতামাতি করেছি—এইতেই ঘনাদার রাগ। সে রাগ এখনও পড়বার লক্ষণ নেই।
গৌর নামকরা একটি দৈনিকের পাতা থেকে মুখ তুলে হতাশ ভাবে সেটাকে টেবিল থেকে মেঝেয় গড়িয়ে যেতে দিয়ে বলল, না, এ-হপ্তায় আর কিছু হবার নয়।
কেন? কেন? আমরা যে যার কাগজ নামিয়ে সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম।
কেন? গৌর মেঝে থেকে কাগজটা আবার তুলে নিয়ে বললে, জায়গাটা পড়ে শোনাচ্ছি। তা হলেই বুঝবে কেন? লিখছে, সর্বদিকে ইঙ্গিত লক্ষিত হইতেছে। অত্যন্ত সাবধানে না থাকিলে বিশেষ বিপদের সম্ভাবনা। রাহু মিথুনে ও কেতু ধনুতে অবস্থান করার দরুন সম্পত্তি হস্তান্তরের ব্যাপারে শঠ ও প্রবঞ্চকের ছলনায় ভুলিতে হইবে। বৈদেশিক বাণিজ্যেও তত্রস্থ আকস্মিক শাসন বিপর্যয়ে প্রচুর সঞ্চিত সম্পদ ধ্বংস হইতে পারে। জামাতা বা শ্বশুর স্থানীয় কাহারও কঠিন পীড়া অবশ্যম্ভাবী…
গৌরের পড়া ফিরিস্তি শুনে আমরাও সবাই প্রথমে যাকে বলে একেবারে মুহ্যমান-থুড়ি, মোহামান।
শিশিরই প্রথমে যেন সাড় ফিরে পেল। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কিন্তু বিপদ কি খুব গুরুতর?
গুরুতর নয়? গৌর রীতিমতো ক্ষুণ্ণ।
আমিও এতক্ষণে একটু সন্দিগ্ধ হয়েছি।
বললাম, কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না। তোর সম্পত্তিই কোথায় যে হস্তান্তর করলে ঠকবি? বিদেশে কোন বাণিজ্যটা তুই করিস? আর বিয়েই যার হয়নি তার আবার শ্বশুর-জামাই-এর ভাবনা কীসের?
এ মোক্ষম যুক্তিতেও গৌরকে টলানো গেল না। গম্ভীর মুখে আমাদের নির্বুদ্ধিতায় যেন হতাশ হয়েই বললে, আসল ব্যাপারটাই তোদের মাথায় ঢুকছে না। ও সব যদি
হয় তা হলে অন্য কিছু অনিষ্ট একটা নির্ঘাৎ হবে। কারণ এ হপ্তায় কর্কটের রাশিফল অত্যন্ত খারাপ।
হুঁ! তোর কর্কট রাশি ঠিক জানিস! শিশির একেবারে গোড়ায় কোপ দিতে চাইলে।
তা আর জানি না। সারা জীবন ওর দাঁড়ায় নাজেহাল হচ্ছি। অথচ আর মিনিট খানেক পরে জন্মালেই সিংহ রাশিতে পড়ে একটা কেওকেটা হতাম, গৌর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
সিংহ রাশিটা মিনিট খানেকের জন্য ফসকে যাওয়ায় এ রকম দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়তেই পারে। সমবেদনা জানাতে যাচ্ছিলাম। শিশির কিন্তু অবিচলিত ভাবে জিজ্ঞাসা করলে, কার গণনা পড়ছিস? সায়নাচার্যের তো! কিন্তু জ্যোতিষার্ণবের মত আলাদা!
আলাদা মানে? গৌর বেশ অসন্তুষ্ট।
হ্যাঁ, এই তো জ্যোতিষার্ণব লিখছেন এই পত্রিকায় কর্কট রাশির পক্ষে অত্যন্ত সুসময়। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক হইতে সৌভাগ্যের উদয় হইতে পারে। অত্যন্ত সুবিধাজনক শর্তে একটি গাড়ি কিংবা বাড়ি পাইবার সম্ভাবনা। সেরূপ সুযোগ আসিলে অবহেলা করিবেন না। স্থানান্তরিত হইলে প্রচুর লাভের আশা।
লিখছে কর্কট রাশি সম্বন্ধে? গৌরের মুখে অবিশ্বাস ও উল্লাসের দ্বন্দ্ব।
হ্যাঁ, স্পষ্ট লেখা রয়েছে কর্কট। নিজেই দেখ না! শিশির কাগজটা এগিয়ে দিলে।
গৌর এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলে কেমন একটু হতভম্ব হয়ে বললে, আশ্চর্য! কিন্তু গাড়ি কি বাড়ি কোথা থেকে আসবে! একটা সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল অবশ্য কিনব কিনব ভাবছিলাম। কিন্তু বাড়ি..
আমারও কিন্তু বাড়ির কথা লিখছে! বাধা দিয়ে আমাকে এবার জানাতেই হল।
শিশির ও গৌর দুজনেই একসঙ্গে অবজ্ঞার হাসি হাসল, তোর আবার বাড়ির কথা লিখছে কে?
এই তো স্বয়ং জ্যোতিষরাজ লিখছেন,আমি আহত অভিমানের সুরে জানালাম, লিখেছেন তুলা রাশির পক্ষে এ সপ্তাহ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চন্দ্রের প্রভাবের দরুন প্রাথমিক বাধা দেখা দিলেও পরিশেষে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হইবে। বাসভবন পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। গৃহপ্রাপ্তিযোগ প্রবল।
তার মানে তোরা দুজনেই বাড়ি পেয়ে উঠে যাবি! শিশিরের গলা বেশ ঈর্ষাকাতর, আর আমি শুধু এই মেসে বসে ভেরেন্ডা ভাজব!
আহা, অত মন খারাপ করছিস কেন? আমি শিশিরকে সান্ত্বনা দিলাম, আমরা বাড়ি পেলে কি আর তোকে থাকতে দেব না! তুই তো গৌরের বাড়িতেও অনায়াসে থাকতে পারিস।
না, না আমার বাড়িতে সুবিধে হবে না! গৌর সোজাসুজি জানিয়ে দিল, আমি বাড়িটা বিক্রিই করে দেব ভাবছি।
বিক্রি করে দিবি? গৌরের আহাম্মকিতে না চটে পারলাম না, ওই ছোট্ট একটা বাড়ি বিক্রি করে কী-ই বা পাবি? তার চেয়ে আমার মতে ভাড়া দে। আজকালকার দিনে যা ভাড়া পাবি তাতে রোজ আমাদের সিনেমা থিয়েটার দেখিয়েও হোটেলে খাইয়ে আনতে পারবি।
এমন সুযুক্তিটা গৌরের মনে ধরল না। প্রায় দাঁত খিচিয়ে বললে, আমার বাড়ি ছোট দেখলি কোথায় শুনি! দস্তুর মতো সায়নাচার্যের গণনা করা বাড়ি সে খেয়াল আছে! তোর তো জ্যোতিষরাজের বাড়ি। খোলার কি খড়ের চাল হয় তাই আগে দেখ। তারপর ভাড়া দিস!
এ ধরনের হিংসে আমার ভাল লাগে না। না হয় আমার বাড়িটা বেশ বড়ই হচ্ছে। কিন্তু আমি কি তাই বড়াই করছি যে আমার ওপর হিংসে হবে!
সেই কথাই গৌরকে বোঝাতে যাচ্ছিলাম। শিশির তার সুযোগ দিলে না। হঠাৎ বিদ্রুপ করে বলে বসল, বাড়ি যে তোরা পেয়েই গেছিস মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ, পেয়েই গেছি!
আমাদের মুখ থেকে নয়, জবাবটা এল পেছন থেকে।
চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি শিবু। কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। আমাদের চমকে দিয়ে শিবু যেন যুদ্ধ জয় করে এসেছে এমনই উত্তেজিতভাবে সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললে, সত্যি পেয়ে গেছি বাড়ি!
তুই বাড়ি পেয়ে গেছিস মানে? আমি আর গৌর দুজনেই অত্যন্ত বিরক্ত, রাশিফল আমাদের আর বাড়ি পেলি তুই! সক্কলের পাওয়া!
কীরকম? এ উদারতায় একটু অপ্রস্তুত হয়েই জিজ্ঞাসা করতে হল।
মানে বাড়ি পেয়েছি মেসের জন্যে। এই এঁদোগলির ঝরঝরে হাড়গোড়ভাঙা বাড়ির বদলে বড় রাস্তায় প্রকাণ্ড ঝকঝকে নতুন বাড়ি ভাড়াও এই একই।
তা কখনও হয়! তোর মাথা খারাপ হয়েছে। এবার সকলে আমরা একমত।
আহা, আমার মাথা খারাপ হবে কেন? খারাপ হয়েছে তো বিপিনবাবুর! শিবু আমাদের ভুল সংশোধন করলে।
কে বিপিনবাবু? আর তার মাথা খারাপ হওয়ার সঙ্গে আমাদের বাড়ি পাওয়ার সম্পর্কটা কী?
বাঃ, সম্পর্ক নেই? শিবু আমাদের মূঢ়তায় বিষণ্ণ, বিপিনবাবুর সঙ্গেই যে আমার সম্পর্ক। তিনি যে আমার নিকট আত্মীয়, মানে খুব আপনার লোক?
তাতে তোর মাথার দোষের কারণটা না হয় পেলাম, কিন্তু বাড়ি পাচ্ছি কী করে?
বাড়ি পাচ্ছি কতবার বলব—আত্মীয়তার জোরে! শিবু বোঝাতে গিয়ে বুঝি ক্লান্ত।
কীরকম আত্মীয়তা? শিশিরের তবু সন্দিগ্ধ প্রশ্ন।
আত্মীয়তা যেমন হয়, আবার কীরকম? শিবু বিরক্ত হয়ে সম্পর্কটা যা বুঝিয়ে দিলে তাতে আমরা একেবারে চুপ।
কোনওরকম ঢোঁক-টোক না গিলে একেবারে গড়গড় করে শিবু বলে গেল, বিপিনবাবু হলেন পিসতুতো ভাই-এর মাসতুতো বোনের খুড়তুতো ভাই-এর পিসশ্বশুর, কিংবা মামাতো বোনের পিসশ্বশুরের জ্যেঠিমার বাড়িওয়ালার অফিসের বড়বাবুও হতে পারেন। আসল কথা, তাঁর হঠাৎ মাথা খারাপ না হলে কিংবা আগে থাকতেই খারাপ না থাকলে কিছুই হত না।
শিবুর ব্যাখ্যার ধাক্কাটা সামলাতে একটু দেরি হল। তারপর গৌরই প্রথম কৌতূহল প্রকাশ করতে সাহস করলে, বিপিনবাবু মাথা খারাপ হয়ে তোকে তা হলে বাড়িটা দিয়েছেন?
তিনি দেবেন কোথা থেকে? শিবু অধৈর্যের সঙ্গে জানালে, তিনি তো এখন অ্যাসাইলাম-এ, মানে মাথার রুগিদের আশ্রমে।
তবে? হতভম্ভ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বাড়ি তা হলে কার কাছে কেমন করে পাচ্ছিস?
পাচ্ছি অ্যাটর্নির কাছে। বিপিনবাবু অ্যাটর্নিকে লিখে যা হুকুম দিয়ে রেখেছেন তারই জোরে।
এতক্ষণে যেন কুয়াশাটা একটু খাটল। বললাম, তাই বল! তোর সেই পরমাত্মীয় বিপিনবাবু অ্যাটর্নিকেই হুকুম দিয়ে গেছলেন, তোকে বাড়িটা দিতে।
না। শিবুর গলা চড়া মেজাজের, তিনি যা হুকুম দিয়ে গেছলেন তাতে ও বাড়ির ব্যবস্থা করতে অ্যাটর্নিই অকুল পাথারে। অথচ বিপিনবাবুর খরচ মেটাতে বাড়ির একটা ব্যবস্থা না করলেও নয়।
কী হুকুম দিয়েছিলেন?
যা দিয়েছিলেন তাইতেই বাজিমাত! শিবুর মুখে এবার একটু মুচকি হাসি, ওই হুকুমের জোরেই বাড়িটা আদায়ের ব্যবস্থা করে এলাম।
হুকুমটা কী?
হুকুমটা হল ও বাড়িতে কেউ যেন কোনওদিন সংসার না পাতে। কারণ সংসারই তাঁর মতে সব গণ্ডগোলের কারণ—এমন কী তাঁর মাথারও।
ওই হুকুম থেকেই তুই কাজ বাগালি? শিশিরের মুখে আমাদের সকলের সংশয়।
তা বাগাব না! শিবু যেন এতক্ষণে তুরুপের টেক্কা বার করে দেখাল, সংসার পাততে দিলে ও বাড়ির কী ব্যবস্থা হতে পারে? অফিস হয় বটে। কিন্তু ও বেপোট জায়গায় অফিস করতে চাইবে কে? তাই অ্যাটর্নিকে বুঝিয়ে দিলাম ও বাড়ির মেস হওয়া ছাড়া আর কোনও গতি নেই। মেস তো আর সংসার নয়। তা হলেই বুঝতে পারছিস, বিপিনবাবুর যদি মাথা খারাপ না হত, তাইতে তিনি যদি অমন আজগুবি হুকুমনা দিতেন, তাঁর সঙ্গে আমার অমন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা না থাকত, আর সে যেমনই হোক, মামাতো বোনের বাড়ি গিয়ে খবরটা যদি না পেতাম, আর মামাতো বোনের বাড়ির কাছে হঠাৎ যদি আজ গিয়ে না পড়তাম, অর্থাৎ কারেন্ট বন্ধ হয়ে গিয়ে ট্রামটা যদি ওইখানেই না থামত আর বিরক্ত হয়ে যদি না ওখানে নেমে পড়তাম…
শিবুকে না থামালে সে বোধহয় কার্যকারণ বোঝাতে বোঝাতে ইডেন উদ্যানে আমাদের নিষিদ্ধ ফল খাওয়া পর্যন্ত পৌঁছে যেত।
বুঝেছি! বুঝেছি! বলে সমস্বরে তাই তাকে থামাতেই হল। শিবুর আনা খবরের সঙ্গে রাশিফলের গণনা মিলে গিয়ে আমাদের তখন ধৈর্য ধরবার মতো অবস্থা নেই। পারলে তখুনি লরি ডেকে মাল-টাল তুলে ফেলি।
শিশির সোৎসাহে বলল, আচ্ছা বাড়ি ভাড়ার বায়নাটা আজই দিয়ে এলে হয়?
আর আমাদের বাড়িওয়ালাকে একটা নোটিশ! গৌর স্মরণ করিয়ে দিলে।
গোটা কয়েক লরিও আগে থাকতে বলে রাখতে হয়! সুযুক্তি দিলাম আমি।
কেন, লরি কী হবে? শিশির আমার সুযুক্তির গোড়াতে কোপ দিলে, এখানকার এইসব রদ্দি ফার্নিচার ওই বাড়িতে নেব নাকি! সব নিলেমে বিক্রি করে যাব।
তারপর সেখানে মেঝেয় কানি পেতে শোব, কেমন? একটু বিদ্রুপ করতেই হল আমায়।
কানি পেতে শোয়া যার অভ্যাস, সে শোবে! শিশির একটু যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল, কলকাতা শহরে ফার্নিচারের দোকানের তো ঘাটতি নেই। যেমন বাড়ি, তেমনই ফার্নিচার না হলে মানায়!
ঝগড়াটা এরপর কোন দিকে যেত বলা যায় না, কিন্তু শিবুই হঠাৎ বেয়াড়া খোঁচা তুলে সব ঠাণ্ডা করে দিলে।
কানি পেতে, না, ল্যাজারাসের খাটে শোবে সে ঝগড়া রেখে আসল বেড়াটা আগে ডিঙোও দেখি। তেতলার উনি বেঁকে দাঁড়াবেন না তো? চিন্তিতভাবে বলল শিবু।
ঘনাদা বেঁকে দাড়াবেন! উত্তেজিত হয়ে উঠল শিশির, এমন একটা দাঁও পাওয়ার মর্ম তিনি বুঝবেন না!
আলবত বুঝবেন! বোঝাতেই হবে তাঁকে। এখুনি। গৌর মূর্তিমান সংকল্পের মতো উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও।
তারপর সোৎসাহে সশব্দে সিঁড়ি কাঁপিয়ে দোতলা থেকে তেতলা।
ঘনাদাকে ভোট দিন (দুই)
খানিকবাদেই সেই সিঁড়ি দিয়ে যখন নামলাম তখন আর সে আওয়াজ নেই। পাগুলো যেন নড়তেই চায় না।
ঘনাদাকে আমাদের অনুরোধ-উপরোধ, যুক্তি তর্ক, প্রলোভন কিছুতে টলানো যায়নি। তাঁর ধনুকভাঙা পণ ওই তেতলার ঘর ছেড়ে পাদমেক ন গচ্ছামি।
খবরের কাগজে হলে নিশ্চয় একটা জুৎসই শিরোনাম দিত। সংকটজনক পরিস্থিতি গোছের কিছু।
তবু হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলে তো চলে না। আমাদের মন্ত্রণাসভা বসল।
আমাদের অবশ্য উভয় সংকট। ঘনাদাকে বাদ দিয়ে নতুন বাড়িতে উঠে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না। আবার ঘনাদার জেদের কাছে হার মানলে এমন একটা দাও ফসকে যায়!
সুতরাং যেমন করে হোক ঘনাদাকে এ বাড়ি ছাড়তে রাজি করাতেই হবে।
কিন্তু তা কী করে সম্ভব?
ভূতের ভয় দেখিয়ে! শিবুর প্রস্তাব।
প্রস্তাবটা মন্দ নয়। কিন্তু ভয় দেখালে হিতে বিপরীতে যদি হয়! একটা ছুতোনাতা করে আমাদের রামভুজকেই হয়তো ভোলা ছাদে শুতে বাধ্য করবেন। একবার চোরের ভয় হতে যেমন করেছিলেন। রামভুজ বেচারারই প্রাণান্ত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঘনাদার বন্ধ দরজার ভেতর থেকে ডাক, রামভুজ জেগে আছ তো? তার সঙ্গে নুনের ছিটেটুকু আরও অসহ্য! রামভুজ হাঁ, বড়বাবু বলে সাড়া দেবার পর ঘনাদার উদার আশ্বাস,দেখো, ভয় পেও না। আমি তো আছি, তোমার ভয় কী?
না, ভূতের ভয় দেখানোটা বেকার। তা ছাড়া সদ্য সদ্য বাড়ি বদলের প্রস্তাবের পরই ভূতের ভয় দেখানোর মানেটা ধরেও ফেলতে পারেন।
শিবুর প্রস্তাব বাতিল হতেই শিশির নিজেরটা পেশ করল, মহামারির আতঙ্ক!
কীসের আতঙ্ক? আমাদেরই বিহুল প্রশ্ন।
মহামারির আতঙ্ক! শিশির নাটকীয় সুরে বুঝিয়ে দিলে, সারাক্ষণ বাড়িতে কী রকম একটা বিশ্রী গন্ধ। শুয়ে বসে কারুর শান্তি নেই। নিশ্চয় গুরুতর কিছু হবে। এই রকম গন্ধ পাবার পর কোন মেস বাড়িতে কোথায় নাকি সব ক-জন বোর্ডারকে ঝোল ভাত খাইয়ে ছেড়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে বাড়ি নাকি করপোরেশন থেকে ভেঙে ফেলতে হয়। সকাল বিকেল ঘনাদার কাছে এই সব গল্প।…
কিন্তু ঘনাদার নাকেও তো গন্ধটা যাওয়া চাই! আমাদের বাধা দিতে হল শিশিরের রাশছাড়া কল্পনায়।
নিশ্চয় যাওয়া চাই। শিশির জোরের সঙ্গে সায় দিলে, আমাদের সকলের নাকে যাবে, ঘনাদার যাবে না?
গন্ধটা কীসের? আমাদের সন্দিগ্ধ প্রশ্ন।
একটা বিতিকিচ্ছি কিছুর! শিশির সোৎসাহে ব্যাখ্যা শুরু করলে, সালফিউরিক অ্যাসিড খানিকটা কিংবা…
কিংবা তোমার মগজে যে বস্তুটি আছে সেইটি! গৌর খিচিয়ে উঠল। আমাদেরও বক্তব্য তাই। ঘনাদাকে বাড়ি ছাড়া করতে নিজেদের নাড়ি ছাড়াতে আমরা রাজি নই। শিশিরের প্রস্তাব সুতরাং সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল।
কিন্তু একটা কিছু ফন্দি তো না বার করলে নয়।
ভাবতে ভাবতে চমৎকার একটা মতলব মাথায় এসে গেল।
আচ্ছা, হঠাৎ একজনের মাথা খারাপ হয়ে যাক না? সগর্বে সকলের মুখের দিকে চাইলাম।
নাঃ, দুনিয়ায় সরেস কোনও কিছুরই কদর নেই। এমন একটা চমৎকার প্রস্তাবে সবাই মিলে আমার দিকে অমন অবজ্ঞাভরে চাইবার কী মানে হয়? তার ওপর হয়ে যাক কেন, হয়েছে তো! বলে চিপটেন কাটাটা একটু বাড়াবাড়ি নয়?
নেহাত ব্যাপারটা জরুরি বলেই অপমানটা গ্রাহ্য না করে কর্তব্যের খাতিরে বসে রইলাম।
হঠাৎ গৌর বললে, আচ্ছা, কাল থেকেই ঘনাদা খেপে আছে, কেমন? ব্যস! আর ভাবনা নেই।
তার মানে? আমরা বিমূঢ়।
মানে, অটোভ্যাকসিন! গৌর সংক্ষিপ্ত।
অটোভ্যাকসিন কী রকম?
রোগের বীজ থেকেই তার ওষুধ, আবার কী রকম? গৌরের মাথাগুলোনো ব্যাখ্যা!
ব্যাখ্যা যেমনই হোক মতলবটা যে পাকা মাথার তা আমাদের স্বীকার করতেই হল অভিযান আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
অভিযান সেই দিন থেকেই শুরু হল। ঘনাদা তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক সান্ধ্যভ্রমণে বেরুবার জন্য নামবার আগেই আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পয়লা কাজ সেরে এলাম।
তারপর ঘনাদার লেক-বৈঠক থেকে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকা।
ঘনাদা দোতলায় উঠে তেতলায় পা বাড়াবার আগেই তাঁকে যেন সন্ত্রস্ত করে ঘিরে ধরা। মুখের ঘনঘটা দেখে মনে হল ওষুধ ধরেছে। ঘনাদা অবশ্য পাশ কাটিয়ে চলে যাবার উপক্রমই করছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ আর তাঁকে দেওয়া হল না।
বড় মুশকিল হয়ে গেছে ঘনাদা! আমাদের মুখে উদ্বেগ, আশঙ্কা, উত্তেজনা।
ঘনাদাকে শিশিরের এগিয়ে-ধরা সিগারেটটা নিয়ে আড্ডাঘরে এসে বসতেই হল।
শিশির লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে দিলেও ঘনাদার মুখের অন্ধকার যেন কাটল না।
পাড়ার সবাই তো মেতে উঠেছে! শিবু শুরু করল।
আমরা কত করে বোঝালাম! আমি চালিয়ে গেলাম, কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা।
অবশ্য ওদেরই বা দোষ কী! গৌর সত্যের মর্যাদা না রেখে যেন পারল না, আপনার মতো লোক পাড়ায় থাকতে আর কার কাছে যাবে?
ঘনাদা সত্যিই একটু কি গললেন নাকি?
ঠিক বোঝা গেল না। উলটো হাওয়া চালাতে হল তাই তৎক্ষণাৎ।
বললাম, কিন্তু এটা একটু বাড়াবাড়ি নয়? ঘনাদার মত না নিয়েই আগে থাকতে ওঁর নাম দিয়ে কাউন্সিলার হবার জন্য উনি প্রার্থী বলে দরখাস্ত করে দেওয়া!
শুধু তা-ই! শিবুও পোঁ ধরলে, রাস্তায় এরই মধ্যে ওগুলো সব!
শিশির যেন আকাশ থেকে পড়ল, রাস্তায় আবার কী হল?
ও, তা-ও বুঝি জানো না! শিবু বিজ্ঞ সাজল, ঘনাদার চোখেও কি আর পড়েনি! উনি তো এই মাত্র ফিরলেন।
আমরা উৎসুক ভাবে ঘনাদার দিকে তাকালাম। এইবার একটা সাড়া যদি পাওয়া যায়। কিন্তু না লাল, না সবুজ। এখনও শুধু হলদে। কোন দিকে যাবে বোঝবার জো নেই।
ঘনাদার সিগারেটের টানটা একটু লম্বা হল।
আবার খোঁচাতেই হল অগত্যা।
শিবুকে যেন ধমকে বললাম, হেঁয়ালি রেখে আসল কথাটা বলবি! কী হয়েছে
রাস্তায়?
এরই মধ্যে রাস্তায় পোস্টার পড়ে গেছে।
পোস্টার! আমরা যেন হতভম্ব, কীসের পোস্টার?
ঘনাদার জন্যে ভোটের, শিবু রহস্য তরল করলে, আজ শুধু দেয়ালে দেয়ালে খড়ি দিয়ে লিখেছে। কালই শুনলাম ছাপানো পোস্টারে এ তল্লাট ছেয়ে দেবে! তা স্লোগান কিন্তু দিয়েছে ভাল।
শিবুর গদগদ হওয়াটাকেই যেন সন্দেহ করে জিজ্ঞাসা করলাম, কী স্লোগান দিয়েছে?
দিয়েছে, শিবু সুর করে আওড়ালে,
দেশের নাড়ি বড় ক্ষীণ
ঘনাদাকে ভোট দিন।
ঘনাদার দিকে আড়চোখে চেয়ে আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করলাম, এ আর কী স্লোগান হল এমন!
আরও আছে শিবু আশ্বাস দিলে, যেমন,
সফেদ হবে লাল-চীন।
ঘনাদাকে ভোট দিন।
শিবুর স্লোগান শুনে গৌরেরও যেন নেশা ধরে গেল। বললে, তার চেয়ে আরও ভাল স্লোগান দিলেই পারত। যেমন,
ভোট দেবেন কাকে?
বিশ্ব-ঘনাদাকে!
কী করবেন তিনি?
কালো বাজার সাদা করে
সস্তা চাল তেল চিনি।
গৌর যদি এগোতে পারে আমিই বা পিছিয়ে থাকি কেন? বললাম স্লোগান আরও জবর হতে পারে!
কী রকম? গৌরের গলাটাই যেন একটু বেশি রুক্ষ।
বেশ কাঁপানো গলায় শোনালাম,
শুন শুন সর্বজন, শুন দিয়া মন
ঘনাদাকে ভোট দিতে কহি কী কারণ।
ঘোর কলিকাল এবে পাইতে উদ্ধার–
ঘনাদার স্কন্ধে হও দুঃখসিন্ধু পার।
ত্বরা করি ভোট দাও যে চাও তরিতে—
বিলম্বে হতাশ হবে ধন্দ নারি ইথে।
ছো? গৌরই সবার আগে সশব্দে তার মতামত জানালে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই।
ওটা একটা স্লোগান হল?
একি পাঁচালি পেয়েছিস?
ভোটাররা ও স্লোগান শুনলে হাসতে হাসতেই ভোট দিতে ভুলে যাবে!
প্রতিভার আদর যে এ দেশে নেই তা অনেক কাল আগেই বুঝেছি। গুম হয়ে তাই চুপ করে রইলাম। কিন্তু নিজেদের মধ্যে খাওয়াখাওয়ি করে আসল কাজটা তো ভেস্তে দেওয়া যায় না!
সকলেরই বোধহয় সে হুঁশ হল। শিশিরই হাওয়াটা ঠাণ্ডা করবার জন্যে প্রথম বললে, যাক গে। ঘনাদা ইলেকশনে নামলে স্লোগান ঢের জুটবে। বাংলা দেশের বাঘা বাঘা কবিকে সব লাগিয়ে দেব। কিন্তু দেয়ালে দেয়ালে এখনই এই সব লেখা কি উচিত হয়েছে? আবার কাল বলছে, ছাপানো পোস্টার ছাড়বে! ঘনাদার মতটা তো তোর আগে নেওয়া উচিত ছিল।
মত নেবে ওরা! শিবু আসল রাস্তা ধরলে, ওদের তো চেনো না। ঠিক যখন একবার করে ফেলেছে তখন ঘনাদাকে ওরা দাঁড় করাবেই।
ঘনাদা যদি রাজি না হন তবু? গৌর যেন রেগে কাঁই। রাজি ঘনাদাকে হতেই হবে। না হয়ে উপায় নেই। শিবু নিজেই যেন নাচার।
একি জুলুম নাকি! এতক্ষণে অভিমানটা সামলে আমিও সুর মেলালাম।
জুলুম জবরদস্তি যাই বলল, দেয়ালে যখন খড়ির দাগ কেটেছে, ওরা ঘনাদাকে দাঁড় করিয়ে ছাড়বে না! শিবু সার কথা শুনিয়ে দিলে।
ঘনাদা এতক্ষণে একটা সিগারেট শেষ করে আর একটা ধরিয়েছেন শিশিরের এগিয়ে দেওয়া টিন থেকে। কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ তাঁর দিক থেকে শোনা যায়নি। চোখ দুটো মাঝে মাঝে কোঁচকানো ছাড়া কোনও ভাবান্তরও নয়।
কিন্তু এরকম শালগ্রাম শিলা হলে আমাদের তো চলবে না। আশেপাশে ঝোপঝাড় না নেড়ে একেবারে সোজাসুজি তাই খোঁচাতে হল।
আপনাকে তো দাঁড়াতেই হচ্ছে দেখছি, ঘনাদা!
আমাদের চার জোড়া চোখ যাকে বলে ঘনাদার মুখে নিবদ্ধ।
ঘনাদা সিগারেটের ছাই ঝেড়ে শুধু বললেন, হুঁ!
হু! শুনেই আমরা কিন্তু হাঁ। ঘনাদা বলেন কী! শেষে নিজেদের ফাঁসে নিজেরাই গলা গলিয়ে দিলাম নাকি!
তাড়াতাড়ি যা যা প্যাঁচ হাতে ছিল সব ছাড়তে হল।
অবশ্য ঘনাদাকে দাঁড় করাবার গরজ ওদের আলাদা। শিবু গম্ভীরভাবে জানালে।
কী গরজ? গৌর যেন অবাক।
ওদের দুজন কন্ট্রাক্টরকে কাজ পাইয়ে দিতে হবে। শিবু গোপন রহস্যটা ফাঁস করে দিলে যেন অনিচ্ছায়, আরবারে চুরির দায়ে তাদের নাম কাটা গেছল কিনা!
আর ওই চাঁইদের বাড়ির ট্যাকস কমানো! শিশির জোগান দিলে, দাড় করাবার কড়ারই তো তা-ই।
জন কয়েককে চাকরিও দিতে হবে। আমি জুড়ে দিলাম, শুনলাম এসবের মধ্যে বাঁ হাতের পাওনাও কিছু মিলবে!
তার মানে ঘুষ! আর ঘনাদা এতে রাজি হবেন! গৌরের গলায় আগুনের জ্বালা।
না হলে যে ছাড়ানছিঁড়েন নেই! শিবুর হতাশ মন্তব্য।
কেন, সাফ না বলে দেবেন। কী, করবে কী ওরা! গৌর রোখ দেখাল।
কী করবে! শিবুর মুখে যেন আতঙ্কের ছায়া, এ-পাড়ায় তা হলে বাস করতে পারব? রাস্তা দিয়ে হাঁটা যাবে না। চাকর পালিয়ে যাবে, ইলেকট্রিকের লাইন কাটা যাবে। দিন নেই, রাত নেই, মেসে ঢিল পাটকেল পড়বে। তারপর বোমা-ই বা ফেলতে কতক্ষণ!
একি মগের মুল্লুক নাকি! একটু প্রতিবাদ জানাতেই হল, থানা পুলিশ নেই?
থানা পুলিশ! শিবু তাচ্ছিল্য ভরে উড়িয়ে দিলে, রাতদিন পুলিশ পাহারায় নিজেরাই জেলখানায় থাকব নাকি!
কিন্তু এ তো হেঁজিপেঁজির কথা হচ্ছে না, কে এখানে আছে তা দেশে দশে জানে। বিধানসভা কেঁপে উঠবে না তা হলে? দিল্লির পর্যন্ত টনক নড়বে না? গৌরের গর্জন।
তা নড়লেও লাভটা হচ্ছে কী! শিশিরের বিজ্ঞ বিশ্লেষণ, তখন তারা বলবে, ও ছাই করপোরেশন কেন, ঘনাদার জন্য রাজসভা, লোকসভাই তো হা-পিত্যেশ করে আছে। সেখানে চালান করে দিয়ে দিল্লির সাউথ কি নর্থ অ্যাভেনিউ-এর এমপি কোয়ার্টারে তুলতে চাইবে। ঘনাদা কি তাতে রাজি হবেন? সে সাধ থাকলে ওঁকে আটকাতে পারত কেউ? উনি নিরিবিলিতে অজ্ঞাতবাসে থাকতে চান বলেই না আমাদের এই অখদ্দে মেসে পড়ে আছেন।
কিন্তু এখানে থাকতে হলেও যে ইলেকশনে দাঁড়াতে হয়? গৌরের দুর্ভাবনা।
আর না দাঁড়ালেও ওদের জুলুমবাজি সইতে হয়! আমার দুশ্চিন্তা।
তা হলে উপায়টা কী? গৌরের ব্যাকুল জিজ্ঞাসা।
উপায় হল, শিবুর সুচিন্তিত বিধান, এ পাড়াই ছেড়ে দেওয়া। এমন পাড়ায় যাওয়া যেখানে এ-সব ঝামেলাই নেই, পাড়াপড়শিও এমন ওঁচা নয়।
এটা তো খুব ভাল বুদ্ধি! আমরা সকলে একসঙ্গে উৎফুল্লভাবে মাথা নেড়ে ঘনাদার দিকে তাকালাম।
কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা!
যাঁর হয়ে এত তর্কাতর্কি, বিচার-বিশ্লেষণ, তিনি যেন আমাদের মধ্যে থেকেও নেই। বাইরের দরজার দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় সিগারেটও প্রায় শেষ করে এনেছেন তখন নির্লিপ্ত উদাসীনভাবে।
অগত্যা জিজ্ঞেস করতেই হল, নতুন সেই বাড়িটাই কি তা হলে দেখব নাকি, ঘনাদা? এখনও চেষ্টা করলে হয়তো পাওয়া যাবে।
ঘনাদা এতক্ষণে মুখ খুললেন। কিন্তু যা বেরিয়ে এল তা দার্শনিক বুজকুড়ি। মানে, যেমন খুশি বোঝো!
বললেন, হ্যাঁ চেষ্টা করলে তো অনেক কিছুই পাওয়া যায়।
তার পরই হঠাৎ উত্থান ও আমাদের হতভম্ব করে রেখে প্রস্থান-শিশিরের সিগারেটের টিনটা সমেতই অবশ্য।
পরের দিন আরও কড়া দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করতেই হল। দলের সব কটি একেবারে বাছা বাছা। নিজেদের পাড়ার নয়। এধার ওধার নানা তল্লাট চষে চারটি যে চেহারা জোগাড় হয়েছে, সিনেমায় পেলে বোধ হয় তাদেরকে লুফে নেয়।
দশরথ শিবুর মামার বাড়ির পাড়ায় কুস্তি করে। ছোটখাটো একটি হাতি বিশেষ। কামানো মাথাটা ঘাড়ের মাংসের মধ্যে কখন ড়ুবে যাবে সন্দেহ হয়। কাত হয়ে ছাড়া গেরস্ত বাড়ির দরজা দিয়ে যেতে পারে না। আর দশরথের চেলা বিশে তারই কিঞ্চিৎ সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। এদের সঙ্গে পাল্লা ঠিক রাখতে নফর আর হাবুল দুজনে দুটি সিড়িঙ্গে সুপুরি গাছ।
দশরথ আর বিশের গায়ে মোটা খদ্দর, নফর আর হাবুলবাবুর কোঁচানো শান্তিপুরি ধুতি, কলিদার গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি। চার জনের শুধু একটি মিল কানে শুনে যাচাই করে নেওয়া। সবাই এরা স্যামবাজারের সসিবাবু।
সাতসকালেই তারা আমাদের ফরমাস মতো এসে হাজির। আমরাও হন্তদন্ত হয়ে একেবারে তেতলার ঘরে।
কী হবে, ঘনাদা? ওঁরা যে এসে গেছে!
ঘনাদা সবে শিশিরের কালকের কৌটো থেকে একটি সিগারেট বার করে সামনে বনোয়ারির আনা চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে মৌজ করতে বসেছেন।
আমাদের আর্তনাদে প্রথমে চমকে প্রায় লাফিয়েই উঠলেন। তারপর অবশ্য সামলে গিয়ে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কারা?
ওই সেই ইলেকশনের পাণ্ডারা। আমরা তখনও যেন হাঁপাচ্ছি, একেবারে দল বেঁধেই এসেছেন!
ওঃ! ঘনাদা চায়ের পেয়ালাটা তুলতে গিয়ে আবার নামালেন।
গলাটা যেন একটু ভারীই লাগল বেশ। মুখেও যেন আর-এক পোঁচ ছায়া।
উৎসাহিত হয়ে বললাম, পরে আসতে বলব, ঘনাদা? বলব যে বেড়াতে বেরিয়ে গেছেন?
তাতে কী লাভ হবে? গৌর আমার প্রস্তাব সংশোধন করলে, ওরা তো তা হলে মাটি কামড়ে বসে থাকবে ঘনাদার ফেরার অপেক্ষায়। চা সিগারেট জোগাতে আমরা ফতুর। তার বদলে বলি, ঘনাদার কাল রাত থেকে, কী বলে, খুব বাড়াবাড়ি অসুখ, নস্ট্যালজিয়া কি হাইড্রোফোবিয়া!
তোর যেমন বুদ্ধি! ঘনাদার কুটিটুকু দেখা দিতে না দিতেই শিবু গৌরকে ধমক দিয়ে সামলাল, ঘনাদার হাইড্রোফোবিয়া হতে যাবে কোন দুঃখে। ও-রোগ তো কুকুরে কামড়ালে হয়। আর নস্ট্যালজিয়া কি রোগ নাকি? ও তো নিজের বাড়ি কি আগেকার দিনের জন্য মন কেমন করা!
আহা কে অত বুঝবে! শুধু ইয়া দিয়ে যাহোক একটা হলেই হল! গৌর ভাঙবে তবু মচকাবে না, ওই ইয়া লাগালেই রোগ লোগ বলে মনে হয়। ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, নিউমোনিয়া, অ্যানিমিয়া, পায়োরিয়া..
থাক, থাক! শিশির ব্যস্ত হয়ে গৌরকে থামাল, একেবারে হাসপাতাল করে তুললি যে! এর পর তেলাপিয়া, বোগেনভিলিয়াও রোগ বলে মনে হবে।
কিন্তু ওদিকে ওরা নীচে দাঁড়িয়ে, সে খেয়াল আছে! শিবু স্মরণ করিয়ে দিলে, ওদের যা হোক একটা কিছু বলে বিদায় না করলে তো নয়!
ঘনাদার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে শিবু তার প্রস্তাবটা জানালে, বলে দিই, ঘনাদাকে কাল হঠাৎ গুয়াতেমালা যেতে হয়েছে। কবে ফিরবেন, ঠিক নেই।
গুয়াতেমালা কেন? শিশিরের আপত্তি, যাবার আর জায়গা নেই?
থাকবে না কেন! শিবু বোঝাবার চেষ্টা করলে, ঘনাদা তো ইচ্ছে করলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি যেখানে খুশি যেতে পারেন। কিন্তু শুনলে একটু ভড়কে যায় এমন জায়গায় যাওয়াই ভাল নয়?
যদি জানতে চায় গুয়াতেমালায় কেন? শিশির ফ্যাকড়া তুলল।
সেখানে যাকে বলে জাতীয় সংকট! জবাবটা যেন শিবুর জিভের ডগাতেই ছিল। রাজ্য টলমল। প্রেসিডেন্ট জরুরি তার করে প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছে। ঘনাদা না গেলে কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে।
তা বলা যায় বটে! আমি প্রস্তাবটার পোকা বাছলাম, কিন্তু ঘনাদা তো আর ঘরবন্দী হয়ে থাকতে পারবেন না। এ পাড়ায় যাওয়া আসা করলেই ওদের চোখে পড়ে যাবে যে!
থাকবেন কেন এ পাড়ায়? শিবুর সহজ সমাধান, কালই আমরা রাতের অন্ধকারে নতুন পাড়ায় নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠছি। তখন আর আমাদের নাগাল পাবে কে? তা হলে ওই গুয়াতেমালাতেই আপনি গেছেন, কী বলেন ঘনাদা?
না! ঘনাদা আমাদের একেবারে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ওঁদের নীচে বসাও, আমি যাচ্ছি।
ওঁদের মানে…আপনি…? আমাদের বাকবোধ হবার উপক্রম।
তবু শেষ আশায় ভর করে নীচে নেমে গিয়ে ভাড়াটে দলকে আর একটু তালিম দিয়ে দিলাম ঘনাদা আসবার আগে। তাদের বোলচালে যদি কিছু কাজ হয়।
প্রথমটা শুভ লক্ষণ-ই দেখা গেল।
এই যে, ঘনশ্যামবাবু! আসুন, আসুন! দশরথের বাজখাঁই গলার অভ্যর্থনা শুনেই ঘনাদাকে একটু যেন কাহিল মনে হল।
তার ওপর বিশের মন্তব্যে বেশ যেন ফ্যাকাশে। দশরথেরই কপি করা গলায় বিশে রীতিমতো মেজাজ দেখিয়ে বললে, অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছেন কিন্তু স্যার। কাউন্সিলার আপনাকে বানিয়ে দেব, কিন্তু আমাদের কাছে এসব চাল-ফাল চলবে না। আমরা গাছে তুলতেও জানি আবার মই কেড়ে নিতেও।
আহা, খ্যামা দে না, বিশে। দশরথই বিশেকে সামলাল, দেখছিস না, কাঁচা ইট, এখনও পোড় খায়নি। আপনি বিশের কথা কিছু ধরবেন না, ঘনশ্যামবাবু। ওর মেজাজটা বড় গরম! মুখ চালাতে কখন হাত চালিয়ে দেবে তাই আমি সামলে সামলে রাখি।
কিন্তু ঘনশ্যামবাবুর কাছে আমাদের আর্জিটা আগে পেশ করা দরকার নয় কি? বললেন নফরবাবু। যেমন তাঁর হাত জোড় করা বিনয়ের ভঙ্গি, তেমনই সরু-সুতো কাটা গলা।
আজি-ফার্জি আবার কীসের? বিশে গর্জে উঠল, আমরা ঠিক করেছি, ঘনশ্যামবাবুকে কাউন্সিলার বানিয়ে দেব, ব্যস, মামলা চুকে গেছে। উনি কি না বলবেন নাকি? ঘাড়ে তো দেখছি মাথা একটাই।
আঃ, ফের বিশে! দশরথ ধমক দিলে না আদর জানালে বোঝা গেল না, তুই বড় ফজুল বকিস! ঘনশ্যামবাবু আগে না বলুন তবে তো মেজাজ করবি? তারপর ঘনাদাকে মধুর আশ্বস, আপনি কিছু ভাববেন না, ঘনশ্যামবাবু। আমরা থাকতে আপনার কোনও ভাবনা নেই।
প্যাকাটি মার্কা হাবুলবাবু মিহি সুরে সায় দিলেন, আপনার গায়ে আঁচটি লাগতে দেব না আমরা। সব ঝঞ্জাট আমাদের, আপনার শুধু ওই হাজার দশেক যা খসবে!
হাজার দশেক খসবে, মানে? আমরাই যেন ঘনাদার জন্য কাতরে উঠলাম, ঘনাদাকে দশ হাজার টাকা দিতে হবে?
তা নয়তো কি মিনিমাগনা কাউন্সিলার হবেন নাকি? বিশে মুখ বেঁকিয়ে হেঁড়ে গলা ছাড়ল, হেঁড়া ন্যাকড়ায় শালের জোড়া! দশহাজার তো সস্তা, মশাই!
তা ঠিকই বলেছেন! একটা ভোটের লড়াই-এ দশহাজার তো নস্যি!
নিজেদের কানকেই বিশ্বাস করব কি না বুঝতে না পেরে থ হয়ে গেলাম।
এ যে ঘনাদার গলা! ঘনাদা বলছেন, দশহাজার নস্যি!
না, কানের কি চোখের ডাক্তারের কাছে দৌড়বার দরকার নেই। ঘনাদাই তাঁর মৌরসি আরামকেদারাটিতে বসে শিশিরের সিগারেটের টিনটিই অতিথিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সহাস্য বদনে বলে চলেছেন, এত সস্তায় হবে আমি তো ভাবতেই পারিনি। দু-চার হাজার উপরি অবশ্য আমি ধরেই রাখছি।
আমাদের শুধু নয়, এবার ভাড়াটে দলেরও সকলের চোখই ছানাবড়া।
গৌর কোনওরকমে ঢোক গিলে তোতলাতে তোতলাতে বলল, আপনি…কী বলে…তা হলে ইলেকশনে দাঁড়াতে রাজি?
কী করি, বলো! নিজের পাড়ার লোক। এত করে ধরেছেন। সামান্য দশ-পনেরো হাজারের জন্যে ওঁদের নিরাশ করতে তো পারি না। কোটি কোটি টাকাই যখন যাচ্ছে তখন বোঝার ওপর ওই শাকের আঁটিটুকু সইতে পারব।
কথা বলব কি, আমাদের হাঁ করা মুখ আর বুজতেই চায় না। চোয়াল যেন আটকে গেছে।
ঘনাদাই ততক্ষণে নিজের একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলে আবার বললেন, শুধু ওই শুশুকগুলোর কথা ভাবছি।
কাদের কথা? সিড়িঙ্গে নফরবাবুর মিহিসুতোকাটা গলাটাই প্রথম কিচকিচিয়ে উঠল।
ওই শুশুকগুলোর! মানে, ম্যানাটি বললে তো আপনারা বুঝবেন না। তাই শুশুক বলছি। ডিমপাড়া মাছ নয়। ওই শুশুকের মতোই একরকম হাওয়ায় নিশ্বাস নেওয়া স্তন্যপায়ী জলের জানোয়ার! তবে খায় শুধু নিরামিষ, জলের পানা-টানা, দাম-শ্যাওলা—এই সব।
তাদের কথা ভাবছেন কেন? এবার বিশের হেঁড়ে গলা, কিন্তু কেমন যেন একটু ধরা ধরা, ভ্যাবাচাকা খাওয়া।
ভাবছি, ওগুলোকে জংলিরা সব সাবাড় করে দেবে বুঝতে পেরে। ঘনাদার একটু দীর্ঘনিঃশ্বাস।
জংলিরা শুশুকগুলো সাবাড় করে দেবে প্যাকটি মার্কা হাবুলবাবু একেবারে থ। শুশুকগুলো আপনার?
হ্যাঁ, আমারই বলতে পারেন। আর কাপলান-এর।
কাপলান! কাপলান কে? পিপের দোসর বিশের হাঁ করা প্রশ্ন।
কাপলান আমার বন্ধু আর অংশীদারও বটে! সে-ই এখন ব্রিটিশ গায়নার ঘাঁটিতে কাজ করছে আমার হয়ে।
কী কাজ? ও! শুষ্ক চরানো? সিড়িঙ্গে নফরবাবু ধরা গলায় শুধোলেন।
তা-ও একরকম বলতে পারেন।
তা হলে জংলিরা শুশুকগুলো সাবাড় করবে কেন? বিশের ব্যাপারটা বুঝবার প্রাণান্ত চেষ্টা।
সাবাড় করবে কাপলান আর ওখানে থাকবে না বলে! আমার এ-খবর তার কানে গেলে সে সোজা উঠবে গিয়ে হাইতিতে! ঘনাদা অতি সহজ করে বোঝালেন।
কোথায়! মূর্তিমান জালা দশরথের হাবুড়ুবু খাওয়া অবস্থা।
হাইতিতে! ঘনাদা ধৈর্যের অবতার হয়ে বোঝালেন, হাইতির নাম শুনছেন কিনা জানি না। তবে আজকালকার খবরের কাগজে কিউবার খবর নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে। হাইতি আর কিউবা হল উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকার কোলের কাছে অতলান্তিক মহাসাগরের দুটো পাশাপাশি দ্বীপ। হাইতি অবশ্য একটা বড় দ্বীপের অংশ। ম্যাপে কিউবাকে গেলবার জন্য একটা কুমিরের মাথা যেন হাঁ করে আছে। দেখবেন। ওই মাথাটাই হল হাইতি আর বাকিটা ডোমিনিয়ন রিপাবলিক।
ওই কাপলান, না কে বললেন, আপনার সেই অংশীদার? তা তিনি শুশুক চরানো ছেড়ে হাইতিতে গিয়ে উঠবেন কেন? সিড়িঙ্গে নফরবাবু গুছিয়ে প্রশ্নটা করে ফেললেন কোনওমতে!
উঠবে ওখানে কুরুক্ষেত্র বাধাতে। একবার তাকে ঠেকিয়েছি, আর তো সে আমার কথা শুনবে না! ঘনাদা যেন নিরুপায়, সব লণ্ডভণ্ড করে ওই দুশমন শয়তান ডিক্টেটার দুলিয়েরটাকে যদি সরায় তাতে অবশ্য আপত্তিকর কিছু নেই। একটু আফশোস শুধু এই যে সোনার পালকগুলো যেখান থেকে মাঝে মাঝে এদিকে-ওদিকে ছিটকে এসে দুনিয়াকে চমকে দেয়, ব্রিটিশ গায়নার অজগর জঙ্গলে লুকোনো সেই রহস্যপুরী এলডোরাডোর হদিস আর কেউ কোনওদিন পাবে না। একেবারে নাকের ডগা দিয়ে কুবেরের ভাণ্ডার ফসকে যাবে!
একটু থেমে ঘনাদা যেন তাচ্ছিল্যভরেই সব উড়িয়ে দিয়ে হেসে বললেন, তা যাক! তোক না কোটি কোটি টাকা! টাকাটাই তো আর সব নয়। দেশের কাজ তারও আগে। হ্যাঁ, বলুন কী করতে হবে?
মাথায় চরকি বাজি থামাতেই আমরা তখন যে যেখানে পারি বসে পড়েছি।
নেহাত কুস্তির রদ্দা-খাওয়া-ঘাড়ে বসানো বলেই জালা প্রমাণ দশরথ আর পিপের দোসর বিশের মাথা দুটো একটু বোধ হয় বেশি মজবুত আর নিরেট। তারা দুজনেই তখনও পর্যন্ত ততটা কাবু হয়নি।
জালা প্রমাণ দশরথই ভাঁটার মতো চোখ দুটো প্রায় ঠেলে বার করে বললেন, না, দাঁড়ান। ওই কুবেরের ভাঁড়ার যা বললেন, আপনার ওই কাপলান শুশুক চরানো ছেড়ে চলে আসবে বলেই আর তার খোঁজ পাওয়া যাবে না? তা কাপলান চলে আসবে কেন?
আসবে আমার খবর পেয়ে। আমি কড়ার ভাঙছি বলে—ঘনাদার মুখের হাসিটা দুঃখের-ই নিশ্চয়। কিন্তু আমরা তাইতেই প্রমাদ গনলাম।
কী কড়ার! আমাদের ভাড়াটে চার মূর্তির মুখে একই প্রশ্ন সমস্বরে উঠবে আমরা যেন জানতাম।
কী কর? ঘনাদা আমাদের সকলের মুখের উপরই একবার যেন ক্লান্তভাবে চোখ বুলিয়ে নিয়ে অনিচ্ছার সঙ্গে প্রকাশ করলেন, সে কড়ার বোঝাতে গেলে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সান্টা মেরিয়া জাহাজ ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ঠিক বড়দিনের সকালে যেখানে চড়ায় আটকে গিয়েছিল আর চল্লিশ জন শ্বেতাঙ্গ নাবিককে যেখানে নামিয়ে রেখে গিয়ে নতুন আবিষ্কৃত মহাদেশে প্রথম ইউরোপের উপনিবেশ তিনি পত্তন করেছিলেন—সেই ক্যাপ হাইতিয়েনে একবার যেতে হবে।
এখন? জালা মূর্তি দশরথের সশঙ্ক প্রশ্ন।
ঘনাদা একবার শুধু দশরথের দিকে তাকালেন। মনে হল দশরথের জালা যেন সে-দৃষ্টির সামনে ঘড়া হয়ে গেল।
সিড়িঙ্গে নফরবাবু তাড়াতাড়ি সামাল দিতে দশরথকে ধমক দিয়ে বললেন, কিছু বুঝে যা তা বলে বসেন কেন? যেতে হবেটা হল কথার প্যাঁচ। বুঝলেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ঠিক বুঝেছি! পিপের দোসর বিশে নিজের উৎসাহটা আর চেপে রাখতে পারলে না। আজকাল গল্পেটল্পে ওই রকম সব প্যাঁচ-ট্যাঁচ থাকে। আপনি বলে যান ঘনশ্যামবাবু, ওরা না পারে আমি ঠিক সমঝে যাব।
আমরা চারজনে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কখন যে এ-আসরে আমরা ফালতু হয়ে গেছি, টেরও পাইনি।
উপযুক্ত সমঝদার পেয়েই বোধহয় খুশি হয়ে ঘনাদা ধরলেন, তারিখটা বলবার দরকার নেই। তবে একটা ছোট মাছধরা লঞ্চে কিউবার সান্তিয়াগো বন্দর থেকে জেলে সেজে লুকিয়ে হাইতির ক্যাপ হাইতিয়েন বন্দরে যখন গিয়ে নামলাম তখন হাইতির হাওয়া গরম হয়ে আছে চাপা বিদ্রোহের আগুনে। হাইতির পক্ষে এরকম ব্যাপার অবশ্য নতুন নয়। কলম্বাস যেদিন এই দ্বীপটিতে নোঙর ফেলেন সেদিন থেকে শাস্তির মুখ এ-দেশ দেখেনি বললেই হয়। কলম্বাস চল্লিশজন ইস্পাহানিকে উপনিবেশ গড়বার জন্য সেখানে রেখে যান। তাদের অমানুষিক অত্যাচারে ও-দেশের আদিবাসীরা নির্মূল হয়ে গিয়ে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে বিশ বছর বাদেই কাজ করবার লোকের অভাবে ওখানে কাফ্রি ক্রীতদাস আমদানি শুরু হয়ে যায়। ইতিহাসের পাতা উলটোবার পর দেখা যায়, সেই কাফ্রিবংশের লোকেরাই হাইতির প্রধান বাসিন্দা। তারা স্বাধীন হয়েছে দেড়শো বছরের ওপর, কিন্তু সে স্বাধীনতা আগাগোড়া মারামারি কাটাকাটির রক্তে ছোপানো।
আমি যখন হাইতি-তে গিয়ে পৌঁছলাম তখন দুটি দলের ক্ষমতার লড়াই-এ সমস্ত হাইতি ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ছে।
দুটি দলের একটি হল দুভালিয়েরের আর একটি বার্বটের। তখন দুজনের কেউই ডিক্টেটার হয়ে বসতে পারেনি। শুধু তার তোড়জোড় চলছে। তোড়জোড় মানে বাইরে তোক দেখানো সভা-সমিতি-মিছিল, রাজ্যময় পোস্টার আর খবরের কাগজের লেখা। আর তলে তলে বিপক্ষদলের বড় ছোট যাকে পারা যায় গোপনে, হয় হাইতি থেকে, নয় তো একেবারে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়া।
দভালিয়ের কি বার্বট, কারুর দলের সঙ্গেই আমার সদ্ভাব নেই। দুজনেই যে সমান পাষণ্ড তা আমি ভাল করেই জানি। আমার হাইতি-তে থাকা কোনও দলেরই মনঃপূত নয়। যে-দলই হোক আমায় একবার ধরতে পারলে যে ছেড়ে কথা কইবে না, এ-বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। বিশেষ করে দুভালিয়েরের দল তো আমায় পেলে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। কারণ তাদের অনেক কীর্তি এর আগে ইউরোপ-আমেরিকার ওপর মহলে আমি ফাঁস করে দিয়েছি।
দুই দলের কারুর কাছেই রেহাই পাব না জেনেও লুকিয়ে যমরাজের আপন দেশে ঢুকেছিলাম শুধু একটি মানুষকে খুঁজে বার করতে। যেমন করে থােক তাকে খুঁজে না বার করলেই আমার নয়। নাম, ধাম সব কিছুই সে যে এখানে এসে বদলেছে তা
জানতাম। শুধু একটি চাবিকাঠি ছিল আমার ভরসা।
কিছুদিন নানা সাজে গোপনে ক্যাপ হাইতিয়েন থেকে পোর্ট-অ-প্রিন্স হয়ে লেস কেয়েস, এমনকী পশ্চিম প্রান্তের ডেমন মেরি পর্যন্ত চক্কর দিয়ে বেড়িয়ে কোনও হদিস না পেয়ে সেই চাবিকাঠিটাই কাজে লাগালাম।
পোর্ট-অ-প্রিন্সের এক ভু-ড়ুর আসরে ওঝা সেজে গিয়ে ঢুকলাম একরাত্রে।
কী…কী…কীসের আসর বললেন? দশরথ কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলে।
ভু-ড়ু-র, ঘনাদা চকিতে একবার আমাদের চারজনকে দেখে নিয়ে বুঝিয়ে বললেন, ভু-ড়ু হল ঝাড়ফুক তন্ত্র-মন্ত্রের একরকম ডাকিনী বিদ্যা। হাইতি-র লোকেরা নামে ক্রিশ্চান, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আফ্রিকার পূর্বপুরুষদের ধর্মকর্মসংস্কার তাদের মধ্যে এখনও প্রবল। প্রতি শনিবার রাত্রে হাইতির নানা জায়গায় গোপনে এই সব ভু-ড়ুর আসর বসে। সেখানে ভু-ড়ুর ওঝারা নানারকম অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ দেখায়।
গিয়ে দেখি ভু-ড়ু অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।
ঢোলক বাজছে আকাশ ফাটিয়ে আর সেই সঙ্গে ঘোড়ার নালে লোহার শিকের আওয়াজ।
দুটো কালো মুরগি জবাই করবার পর উদ্দাম নৃত্য শুরু হল। সেনাচ থামবার পর আরম্ভ হল ভু-ড়ু ওঝার বাহাদুরির খেল।
কার খেতে গতবার ভাল আখ ফলেনি। এবছরও অজন্মা যাবে কি না সে জানতে এসেছে ওঝার কাছে।
ওঝা দুটো লম্বা কাঠি মেঝের উপর রেখে খানিক খুব ভড়ং করে হিজিবিজি মন্তর আউড়ে বললে, দেবতারা তো কথা বলেন না। তাঁরা এই কাঠি দুটো দিয়েই তাঁদের মত জানাবেন। ডান ধারের কাঠিটা যদি নিজে থেকে নড়ে এগিয়ে যায় তা হলে শুভক্ষণ। আখ হবে বাঁশের মতো মোটা। আর বাঁ ধারের কাঠি যদি এগোয় তা হলে আখের খেত শুকিয়ে ঝাঁটার কাঠি হয়ে যাবে।
তারপর বিজ বিজ করে ওঝা আবার খানিক মন্তর পড়তেই সত্যি-সত্যি কাঠি দুটো নড়ে উঠল। প্রথমে ডানদিকেরটা, তারপর বাঁদিকের।
ওঝার তখন কী বড়াই! হেঁকে হেঁকে শোনালে সকলকে, দেবতা সাড়া দিয়েছেন। তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেন! কাঠিগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠেছে তার মন্তরে!! এবার যে কাঠি এগিয়ে যাবে তা-ই দিয়েই বোঝা যাবে, চাষির কপাল এবছরে ভাল না মন্দ!!
ওঝার কথা শেষ হতেই হো হো করে হেসে উঠলাম।
ভু-ড়ু-র আসরের সবাই প্রথমে একেবারে যেন জমে পাথর।
ওঝার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। ছোবল দিতে ফণা তোলা সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলল, কে হাসল, কে? কে করলে দেবতার অপমান?
সকলের চোখ তখন আমার দিকে। এখুনি বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
চোখের একটা পাতাও না ফেলে সোজা এগিয়ে গিয়ে কাঠি দুটোর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, হেসেছি আমি—তোমার বিদ্যের দৌড় দেখে। কিন্তু দেবতার অপমান আমি করিনি, করেছ তুমি।
আমি করেছি দেবতার অপমান! ওঝা প্রায় আমার গলা টিপে ধরে আর কী?
হ্যাঁ, ভুল মন্তর পড়ে অপমান করেছ! কাঠিগুলোর ওপর হাত নেড়ে বললাম, দেবতার রাগে কাঠিগুলো তোমার ডাকে আর তাই নড়বে না। কই নড়াও দেখি, কতবড় তোমার মুরোদ।
পারলে শুধু চোখের আগুনেই ওঝা আমায় তখন ভস্ম করে দেয়। কিন্তু তখন আসরের সবাই ভু-ড়ু-র লড়াইয়ের লোভে মেতে উঠেছে। ওঝার দলেরই লোক হলেও তারা আমাকে জব্দ করবার জন্যই ওঝার বাহাদুরি দেখতে চায়। সবাই প্রায় এক সঙ্গে চেঁচাতে লাগল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাঠি নাড়িয়ে দেখিয়ে দাও এই নচ্ছার বেয়াদপটাকে। কাঠি যদি নড়ে তা হলে ওর ওই ঝুটো কথার জিভটা আমরা টেনে ছিঁড়ে নেব।
আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ওঝাকে অগত্যা আবার বিজ বিজ করে মন্তর পড়তেই হল।
কিন্তু কাঠি আর নড়ে না।
ওঝা হাত পা ছুঁড়ে পাগলে মতো লাফ দিয়ে চিৎকার করে চুল ছিঁড়ে দাঁত খিচিয়ে হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেলল, তবু কাঠি দুটো যেমন ছিল তেমনই রইল পড়ে।
প্রথমে একটু আধটু গুনগুন তারপর ভনভন তারপরে একেবারে খোলাখুলি দূর দূর!
হেসে বললাম, দেবতাকে অপমান করেছ কি না বুঝলে এখন? আরও প্রমাণ দেখাচ্ছি। যেকাঠি তোমার অত চেষ্টাতেও নড়েনি, আমার কথায় এখুনি তা নড়বে। আর, শুধু নড়বেই নয়, দেবতাকে কে অপমান করেছে দেখিয়েও দেবে?
বলতে বলতে কাঠি দুটো যেন লাফ দিয়ে মেঝে থেকে উঠে ওঝারই গায়ে গিয়ে পড়ল।
অ্যাঁ!
না, আওয়াজটা কাঠির খোঁচা-খাওয়া ওঝার নয়, ঘনাদার মুখ থেকেও বার হয়নি। নিজের অজান্তে সশব্দ বিস্ময়টা প্রকাশ করে ফেলেছেন সিড়িঙ্গে নফরবাবু। কোনওরকমে হাঁ করা মুখের দুটো ঠোঁট আবার মিলিয়ে তিনি বললেন, আপনি সত্যিসত্যি ভূতের ওঝাটাকে হারিয়ে দিলেন। তার মানে, আপনি ওই ভু-ড়ু না কী বললেন, তার ওস্তাদ! কোথায় শিখলেন?
হুডিনির কাছে! শিবুর বোধহয় মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল।
কী বলছেন, মশাই! পিপের মাসতুতো ভাই বিশে-ই আগে খেপে উঠল, হুডিনি মানে সেই জাদুকরের কথা বললেন তো! সে ভু-ড়ুর জানত কী? ঘনশ্যামবাবু তার কাছে শিখতে যাবেন কোন দুঃখে! ভু-ড়ু আর ভোজবাজি এক নয়, বুঝেছেন?
টিপ্পনি কাটতে যাচ্ছিলাম, হ্যাঁ, ভোজবাজি হলে তো কাঠিতে বাঁধা কালো সুতো দুটো হাত নাড়বার ছলে হাতিয়েই তাক লাগিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু জনমত যেরকম চড়া তাতে সুশীল সুবোধ হয়ে পিপের ভাই বিশের কথাই মেনে নিয়ে নীরব হতে হল এর পর।
ঘনাদা আমাদের দুরবস্থাটা যেন দেখতে চান না এই ভাবে চার মূর্তির দিকেই মুখ ফিরিয়ে রেখে আবার ধরলেন, কাঠি দুটো ওঝার গায়ে গিয়ে লাগতেই একেবারে হইচই পড়ে গেল।
হাত তুলে গণ্ডগোল থামিয়ে বললাম, শোনো, হাইতির ভাই সব। এ-সব পুঁচকে ওঝার সঙ্গে লড়ে সময় নষ্ট করতে আমি আসিনি। আমি এসেছি হাইতির ভু-ড়ুর চেয়ে আমার দেশের ভু-ড়ুর তেজ যে বেশি তাই চোখের সামনে প্রমাণ করতে। আর শনিবারে সেই ভু-ড়ুর লড়াই হোক। তোমাদের সর্দার ওঝা যদি কেউ থাকে, ডাকো। তার জারিজুরি যদি আমি না ভেঙে দিতে পারি তো আমার মাথা মুড়িয়ে গাধার পিঠে চড়িয়ে তোমরা আমায় নিজের দেশে পাঠিয়ে দিয়ো।
তা-ই পাঠাব! তবে তার আগে ছাল চামড়াটা ছাড়িয়ে নিয়ে!ওঝা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, কিন্তু কোথায় তোর দেশ? কোথাকার ভুড়ু নিয়ে তুই লড়তে এসেছিস?
হেসে বললাম, দেশ আমার অনেক দূর। কিন্তু যেখানে দুনিয়ার সব চেয়ে বড় অজগর অ্যানাকোন্ডা নদী-জলার তলায় কুণ্ডলি পাকিয়ে এল ডোরাডোর যখের ধন পাহারা দেয়, সেই গায়নার ভু-ড়ু আমি শিখে এসেছি। আর শনিবারে সেই ভু-ড়ুর দাপটই দেখাব। মর্জি হলে এল ডোরাডোর সোনার পালক আমদানি করেও তোমাদের চক্ষু সার্থক করতে পারি।
শেষ কথাগুলো শুনতে নেহাত অবান্তর। কিন্তু তাতেই আসল কাজটা হবে আঁচ করে ভুল করিনি।
ঘনাদাকে ভোট দিন (তিন)
পরের শনিবার পর্যন্ত ভু-ড়ুর লড়াইয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হল না। হাইতি দেশটাই ভু-ড়ুর নামে পাগল। ছেলে বুড়ো গরিব বড়লোক শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাইকারই প্রকাশ্যে বা গোপনে ভু-ড়ুর সঙ্গে একটু আধটু সংস্রব আছেই। আমার কথা দু-তিন দিনের মধ্যেই ললাকের মুখে আর ঢাকের বাদ্যিতে প্রায় সারা হাইতিতেই ছড়িয়ে গেছে।
যেখানে দরকার সেখানেও যে টনক নড়েছে, তা হপ্তা পুরো হবার আগে বৃহস্পতিবারই বুঝতে পারলাম।
পোর্ট-অ-প্রিন্সের রুম্যাকাজু নামে একটা রাস্তায় একটা সাধারণ সস্তা গোছের হোটেলে ইচ্ছে করেই তখন আছি।
বৃহস্পতিবার রাত বারোটার পর হঠাৎ ঘরের ফোন বেজে উঠল।
নীচে থেকে রাত্রের হোটেল ক্লার্কই ফোন করছে। ইনিয়েবিনিয়ে এত রাত্রে বিরক্ত করবার জন্যে মাপ চেয়ে সে যা বললে তার মর্ম হল এই যে আমার সঙ্গে দুজন ভদ্রলোক হঠাৎ দেখা করতে এসেছেন। আমি কি তাঁদের জন্যে নীচের লবিতে নামব, না তাঁরাই আমার ঘরে যাবেন, জানতে চায় সে। ভদ্রলোকেরা বলছেন, বড় জরুরি দরকার, তাই বাধ্য হয়েই আমাকে এ ভাবে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে হোটেল ক্লার্ক দুঃখিত।
গলাটা ঘুমে যেন জড়িয়ে আসছে এই ভাবে বললাম, আমিও দুঃখিত। ওদেরকে বলে দিন, এত রাত্রে কোনও ভদ্রলোক কারুর সঙ্গে আগে থাকতে কথা না থাকলে। দেখা করতে আসে না। সুতরাং, যাঁরা এসেছেন তাঁরা আপাতত জাহান্নমে গিয়ে কাল সকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।
বলেই ফোনটা সশব্দে নামিয়ে রাখলাম।
মতলব ভেঁজে নিয়েই তারপর বসে ছিলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হল না। কয়েক সেকেন্ড বাদেই কাঠের সিঁড়িতে চার জোড়া ভারী বুট জুতোর আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল।
দুজনই দেখা করতে এসেছেন ফোনে শুনেছিলাম। বাকি দুজন বুঝলাম ফাউ।
প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। দরজায় প্রথম ধাক্কাটায় সাড়া দিলাম না।
দ্বিতীয়বার ধাক্কা দিতে জড়ানো গলায় বললাম, কে? কে এত রাত্রে বিরক্ত করছে?
ভারী গলায় হাইতির বিচিত্র ফরাসি উচ্চারণে হাঁক এল, দরজা খোলো।
কে হে তোমরা বাপু! রাতদুপুরে জ্বালাতন করতে এসেছ? এটা হোটেল, না শুড়িখানা? দরজা খুলব না। কালই আমি এখানকার পুলিশকে সব জানাচ্ছি! বেশ ঝাঁজিয়ে বললাম।
কাল জানাতে হবে না, এখনই জানাতে পারবে! আমরাই পুলিশ!
পুলিশ! শুনে যেন আঁতকে ওঠার ভান করলাম। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়ে মুখটা কাঁচুমাচু করে বললাম, আমার কাছে পুলিশ নে? আমি কোনও অপরাধ তো করিনি।
কী করেছ না করেছ, যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে গিয়ে বোলো!
চারজনের মধ্যে সবচেয়ে যার জাঁদরেল চেহারা, সে-ই আমায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঠেলে বললে, নাও, তৈরি হয়ে নাও, জলদি!
কী তৈরি হব? কেন? আমি যেন দিশেহারা।
চারজন ষণ্ডাই তখন ঘরের ভেতর ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েছে। সবাইকারই চেহারা যমরাজের চেলার মতন। তার মধ্যে আমার সঙ্গে যে কথা বলেছে সেই-ই সর্দার। একেবারে যমরাজের দোসর বললেই হয়।
সেই সর্দার একেবারে রক্তচক্ষু হয়ে বললে, কেন সে কৈফিয়ত তোমায় দিতে হবে নাকি? ভালয় ভালয় জামাকাপড় পরে নেবার সময় দিচ্ছি। নইলে ওই শোবার পোশাকেই যেমন আছ সেই হালেই হেঁচড়ে নিয়ে যাব।
শুনে যেন ঘাবড়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু তোমরা যে পুলিশ তার প্রমাণ কী?
চারজনের হাতেই এবার একসঙ্গে রিভলভার উঠে এল খাপ থেকে।
সর্দার বললে, প্রমাণ এই। এখন জ্যান্ত যেতে চাও, না লাশ হয়ে—সেটা ভেবে নাও।
ভয়ে একেবারে যেন কেঁচো হয়ে বললাম, না, না—লাশ হয়ে যাব কেন! এখুনি আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। দোহাই তোমাদের, ওই রিভলভারগুলো একটু সরিয়ে রাখো।
যাক, সুবুদ্ধি তা হলে হয়েছে, বলে সর্দার রিভলভারটার খোঁচা দিয়েই পোশাক ছাড়বার স্ক্রিনের দিকে আমায় ঠেলে দিলে।
খানিকটা বাদেই তৈরি হয়ে ফ্যাকাশে মুখে বেরিয়ে এসে করুণ মিনতির সুরে বললাম, আচ্ছা, ওই ড্রয়ারটা খুলে আমার একটা জিনিস সঙ্গে নিতে পারি?
কী? গর্জন করে উঠল সর্দার।
ছোট্ট একটা পিস্তল। তোমাদের ওই কোল্ট রিভলভারের চেয়ে অনেক ছোট। প্রায় ওর ছানাপোনার মতো। বিপদে আপদে সঙ্গে থাকা ভাল।
জবাবে ঘাড়ে একটা রদ্দা খেয়ে যেন নেতিয়ে পড়লাম।
সর্দারের ইঙ্গিতে দুজনে পাঁজাকোলা করে সিঁড়ি দিয়ে আমায় নামিয়ে নিয়ে গেল। নীচে হোটেল ক্লার্ক সভয়ে তার কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।
যেতে যেতে করুণ সুরে তাকে বলে গেলাম, তোমাদের হোটেলের বিল কিছু বাকি রইল। বকশিশটাও দিয়ে যেতে পারলাম না!
মাথায় একটা গাঁট্টা দিয়ে যমদূতেরা হোটেলের বাইরে আমায় এনে ফেললে।
একটা কালো রঙের ঢাকা গাড়ি সব আলো নিবিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে। গাড়ির ভেতর আমায় ঢুকিয়ে, সামনে দুজন আর পেছনে দুজন আমার দুপাশে বসে আমার চোখের ওপর একটা কালো রুমাল বেঁধে দিলে।
কাতরস্বরে বললাম, আমি কিন্তু বাবা মুস্তাফা নই।
কী বকছিস, হতভাগা! সর্দার মুখে একটা থাবড়া দিলে। ককিয়ে উঠে বললাম, আমোক মারছ কেন? বাবা মুস্তাফার নাম শোনোনি? আলিবাবার গল্প তো শুনেছ? না শুনে থাকো তো বলতে পারি। খুব মজার।
আর একটা থাবড়া দিয়ে সর্দার বললে, তোর নিজের মজার কথা এখন ভাব, হতভাগা। টু শব্দটি আর করেছিস তো দাঁতগুলো উপড়ে দেব।
অগত্যা ভয়ে ভয়েই যেন চুপ করে রইলাম।
বেশ একটু ঘুরপাক রাস্তায় আধঘণ্টা বাদে এক জায়গায় এসে গাড়িটা থামল। গাড়ি থেকে আমায় টেনে নামিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থাতেই একটা বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল তারপর।
যেতে যেতে দুবার আমি কাশলাম, হোঁচট খেলাম একবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময়। আর, পায়ে পায়ে জড়িয়ে পড়েই গেলাম একবার প্রায় আছাড় খেয়ে।
হেঁচকা টানে আমায় তুলে প্রায় ঝুলোতে ঝুলোতে একটা বড় ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে সর্দার আমার চোখের বাঁধনটা খুলে দিয়ে বললে, মর্কটটাকে জ্যান্তই এনেছি, হুজুর।
বাঁধা চোখ এতক্ষণ বাদে খোলার পর প্রথমটা মিটমিট করে তাকিয়ে সব একটু ঝাপসা লাগল। তাতেও হুজুর বলে কাকে সম্বোধন করা হয়েছে বুঝতে কষ্ট হল না।
আমি যদি মর্কট হই তা হলে তিনি গোরিলার খুড়তুতো ভাই। সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করা একটি বেশ বড় ঘরের এক পাশের একটি বিরাট টেবিলের ধারে কয়লার পাহাড়ের মতো বসে আছেন।
তাঁর দিকে কিয়ে বেশ সসম্ভ্রমে কাঁদো কাঁদো গলায় নালিশ করলাম, আপনার
পোষা গুণ্ডাগুলো মিছিমিছি আমায় হয়রান করেছে, হুজুর।
ভাঁটার মতো চোখ দুটো কুঁচকে বিদ্রুপের স্বরে হুজুর বললেন, তাই নাকি? বড় অন্যায় তো!
আজ্ঞে হ্যাঁ, অন্যায় নয়? আমি গলায় সরলতা মাখিয়ে বললাম, আমি পাশের হোটেলে থাকি, সেখান থেকে এখানে আনবার জন্যে আধঘণ্টা এ রাস্তা ও রাস্তা ঘোরাবার কিছু দরকার ছিল?
গোরিলা-হুজুরের চোখ দুটো এক মুহূর্তে আগুনের ভাঁটাই হয়ে উঠল। গুণ্ডা চারটের দিকে ফিরে ইঞ্জিনের স্টিম ছাড়ার মতো আওয়াজ ছাড়লেন, কী শুনছি!
খানিক আগে পর্যন্ত কেঁদো বাঘ হয়ে যে হুঙ্কার ছেড়েছে, সেই সর্দার এক নিমেষে নেংটি ইদুর হয়ে চি চি করে যেন কাতরে উঠল, আমরা হুকুমমতো চোখ বেঁধেই এনেছি, হুজুর! আপনার সামনেই তো ওর চোখের বাঁধন খুললাম।
তা হলে ও জানল কী করে? হুজুর গর্জন করে উঠলেন।
জানি না হুজুর! সর্দারের গলার সঙ্গে সমস্ত শরীরটাই বুঝি তখন কাঁপছে!
নেহাত হাঁদা বেকুফ সেজে বললাম, আপনার হয়ে ওর কানটা মলে দেব, হুজুর?
কী! হুজুর প্রথমটা রাগেই ফেটে পড়বেন মনে হল, তারপর হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে বললেন, কান মলে দিবি! তুই? তাই দে, দেখি। অবশ্য যদি নাগাল পাস।
নাগাল ঠিক পাব, হুজুর! কিন্তু গুলিগোলা যদি ছোঁড়ে তাই ভয়!
না, না গুলি ছুঁড়বে না! হুজুর তখন আমার মতো গাঁইয়া একটা উজবুকের নাকাল দেখবার জন্য মেতে উঠেছেন। হুকুম করলেন, রিভলভার ফেলে দে, গোবো।
সর্দার, মানে গোবো, রিভলভারটা খাপ থেকে বার করে ফেলে দিয়ে আবার কেঁদো বাঘ হয়েই আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল। আক্রোশে অপমানে তার দাঁত কিড়মিড়ের আওয়াজ পর্যন্ত আমি তখন শুনতে পাচ্ছি।
গাছ থেকে যেন ফুল পাড়তে যাচ্ছি এমনই ভাবে আনাড়ির মতো একটা হাত তুলে গোবোর দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
সেই হাত মুচড়ে ধরে গোবো যে ঝটকানি দিলে তাতে মেঝেয় আছড়ে পড়ে যেন কাতরাতে কাতরাতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনার গোবো একটু বেয়াড়া হুজুর! কান মলতে দিতে চায় না!
হুজুরের হাসিতে ছাদটাই বুঝি খসে পড়ে! হাসতে হাসতেই বললেন, তুই কী চাস তা-ই বল। এখনও কান মলার সাধ আছে?
আছে বই কী হুজুর! আমি একেবারে সাদাসিধে ভালমানুষ, ওর কান না মললে আমার মান থাকবে না যে!
এবার হুজুরের সঙ্গে তাঁর বাহনদের হাসিও থামতে চায় না।
হুজুর হাসি থামিয়ে শেষে বললেন, হুঁ, বেজায় মানী লোক তুই বুঝতে পারছি। মানটা যাতে থাকে তা হলে তাই দেখা
যে আজ্ঞে হুজুর! বলে আবার আগের মতোই একটা হাত তুলে এগিয়ে গেলাম। গোবো মোচড় দিয়ে ধরলও হাতটা কষে। তারপর হুজুরের টেবিলটাই মড় মড় করে উঠল দু-মণি গতরটা সচাপটে তার ওপর পড়ায়।
জানি! জানি! ধোবিকা পাট! বিশে আর নিজেকে সামলাতে পারল না উচ্ছাসের চোটে, এই একটি প্যাঁচ ঠিক মতো লাগাতে পারলে কুম্ভকর্ণও কাবু!
না রে না, ধোবিকা পাট নয়, দশরথ মুরুব্বির মতো বিশেকে শোধরালে, ও হল বাংলা কাঁচি।
উঁহু! ওটা হাফ নেলসন! এতক্ষণ ধৈর্য ধরে থেকে গৌর আর ফোন না দিয়ে পারল না।
দূর! স্রেফ জুডো। আমিই বা কেন কম যাই!
উঁহু! সুমো! শিশির আমাদের সকলের উপর টেক্কা দিতে চাইল।
ঘনাদা অবজ্ঞাভরে আমাদের দিকে চেয়ে, শেষ পর্যন্ত কী বুঝে দশরথকেই গাছে তুললেন। বললেন, না, দশরথবাবুই ঠিক ধরেছেন। বাংলা কাঁচিই চালিয়েছিলাম। হুজুরকে তখন নিজেকে বাঁচাতে পেছনে হেলতে হয়েছে। ধীরে সুস্থে এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে আধমরা লাশটাকে তুলে যেন ফাঁপরে পড়ে বললাম, কিন্তু কোন কানটা মলব ঠিক করতে পারছি না যে, হুজুর! আপনি যদি বলে দেন!
হুজুর তখন সামলে উঠে অত্যন্ত সন্দিগ্ধভাবে আমার দিকে চেয়ে আছেন।
তাঁর কাছে জবাব না পেয়ে আবার বললাম, কান মলাটা আজ বরং মুলতুবি থাক, হুজুর। কান টানতে কোন মাথা এসে পড়ে, তাই আমার ভাবনা। আজ বরং এদের বিদেয় করে দিন। এত ঘটা করে যখন নেমন্তন্ন করে এনেছেন, তখন নিরিবিলিতে দুটো প্রাণের কথা বলাবলি করি।
হুজুর কী যেন ভেবে নিয়ে অনুচরদের চলে যাবার ইঙ্গিতই করলেন। তারা গোববাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাবার পর আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুই?
সে কী হুজুর! আমি যেন অবাক। আপনি এখানকার পুলিশের চাঁই। আমার পরিচয় না জেনে কি আর মিছিমিছি ধরে আনিয়েছেন। কিন্তু হোটেলের পাশের এ বাড়িটা যে পুলিশের আস্তানা তা তো জানা ছিল না।
পাশের বাড়িতেই যে তোমাকে আনা হয়েছে, তা কী করে বুঝলে? তুই থেকে তুমি-তে তুলে খাতির দেখালেও হুজুরের গলা বেশ তীক্ষ, চোখের বাঁধন আলগা ছিল?
না, হুজুর! আমি আশ্বস্ত করলাম, সে বিষয়ে ওদের কোনও কসুর নেই। কিন্তু আমি যে এ ঘর পর্যন্ত আসতে দুবার কেশেছি, একবার হোঁচট খেয়েছি, পায়ে পায়ে জড়িয়ে পড়তে পড়তেও বেঁচেছি।
তাতে কী হয়েছে! হুজুর খাপ্পা হয়ে উঠলেন, আমার সঙ্গে রসিকতা হচ্ছে!
জিভ কেটে বললাম, ছিঃ ছিঃ! বলেন কী হুজুর! আপনার সঙ্গে আপনারই থাবার তলায় থেকে রসিকতা করতে পারি? শুধু-হাতে গোবোকেই না হয় একটু শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু এ-বাড়িতে অমন কত গোবো পোষা আছে কে জানে! আপনার একটু ইশারা পেলে এবার শুধু-হাতেও আর লড়তে আসবে না। তা ছাড়া, আপনি নিজেই আমার মতো একটা পোকাকে তো বুড়ো আঙুলে টিপে মারতে পারেন।
চুপ! হুজুর ধমকে উঠলেন, তোমার বাজে বকবকানি শুনতে চাইনে। তোমার হোটেলের পাশের বাড়ি কী করে বুঝলে?
ওই তো বললাম, হুজুর। দুবার কেশে তার আওয়াজে বুঝলাম, একবার একটা বড় হল ঘর, আরেক বার একটা ঢাকা করিডরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ধাপ গুনতে গুনতে সিড়ি দিয়ে ওঠবার সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে, হাত বুলিয়ে বুঝে নিলাম সিঁড়িগুলো মার্বেল পাথরের। ধাপ গুনেও টের পেলাম দস্তুরমতো উঁচু চারতলা বাড়ি ছাড়া এটা হতে পারে না। আর তারপর, পায়ে পায়ে জড়িয়ে প্রায় আছাড় খেয়ে পড়তে পড়তে, একটা বারান্দার রেলিং ধরে ফেলে, তার ওপর যে বাহারে কারুকাজের নমুনা পেলাম তাতে সব সুদ্ধ মিলিয়ে আর সন্দেহ রইল না যে, হোটেলের পাশের বাড়িতেই ঘুরপাক খাইয়ে আমায় আনা হয়েছে। হাইতির পোর্ট-অ-প্রিন্স শহরে একমাত্র রু-ম্যাকাজু রাস্তাতেই একটিমাত্র এতবড় শৌখিন বাড়ি আছে, একথা এখানকার চাষাভুষোও জানে। এ-বাড়িটা হাইতির বিখ্যাত এক সদাগর নিজের শখ মেটাতে অজস্র খরচ করে তৈরি করেছিলেন জানি। আপনাদের কোন রাজনৈতিক দলের কোপে পড়ে তিনি নাকি এক বছর নিরুদ্দেশ। তাঁর বাড়িটা যে কবে পুলিশের আস্তানা হয়েছে, এইটুকু শুধু জানতাম না
হুজুর আমার কথা শুনতে শুনতে ইতিমধ্যে গোবোর ফেলে যাওয়া রিভলভারটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। এবার টেবিলের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে আমার সামনে বাজিকরের মতো রিভলভারটা হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, তুমি হাইতির লোক নও জানি। কোথা থেকে কেন তুমি হাইতিতে এসেছ? ভু-ড়ুর আসরে ও-রকম বাহাদুরির জাঁক করবার মানে কী? কী জানো তুমি এল ডোরাডোর সোনার পালকের?
প্রশ্নগুলো বড় বেশি হয়ে গেল না, হুজুর? সবিনয়ে বললাম, তবে একটা কথা বললেই তা থেকে সব কটা প্রশ্নের জবাব বোধহয় পেতে পারেন। আমি ব্রিটিশ গায়না থেকে হাইতিতে এসেছি এক নরপিশাচের সন্ধান করতে?
কে সে? হুজুরের চোখ দুটো যেন ছুরির ফলার মতো আমায় চিরে ফেলবে।
এখানে নাম ভাঁড়িয়ে কী যে হয়েছে জানি না, তবে তার আসল নাম হল সেভিল। ডেভিল হলেই অবশ্য মানানসই হত। হুজুর যেন একটু চমকে উঠলেন! চেনেন নাকি?
না। হুজুরের গলা থেকে চাপা গর্জন শোনা গেল। কিন্তু তুমিই বা তার কী জানো? তাকে খুঁজছই বা কেন?
চোখে আগে না দেখলেও তার আসল নাড়ির খবরই জানি। আর তাকে খুঁজছি পৃথিবীর সবচেয়ে দামি এক টুকরো ভাঁজ করা কাগজ তার কাছে থেকে আদায় করব বলে, যে কাগজে কুবেরেরও ঈর্ষা করবার মতো কল্পনাতীত ঐশ্বর্যের ভাণ্ডারের হদিস দেওয়া আছে। যে কাগজে তার সত্যিকার মালিক সরল উদার কাপলান নামে এক বৃদ্ধ পর্যটক, সারা জীবন অজানা ভয়ংকর জলা-জংলায় পদে পদে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝে অতি গোপন মানচিত্র আর নির্দেশ টুকে রেখেছিলেন। যে কাগজ বৃদ্ধ কাপলানের বিশ্বাসী সহকারী সেজে তাঁকেই অজানা গভীর জঙ্গলে মুম্ষু অবস্থায় ফেলে সেই শয়তান চুরি করে পালিয়ে এসেছিল।
উদ্দেশ্য তোমার সাধু! হুজুরের গলায় এবার ঠাট্টার সুর, কিন্তু সেই সেভিল না ডেভিলকে তুমি পাবে কোথায়? সে যদি হাইতিতেই থাকে তবে তোমার হাতে ধরা দিতে হাত বাড়িয়ে নেই নিশ্চয়!
হাত তাকে বাড়াতেই হবে। ওই সোনার পালকের টানে! হুজরের দিকে চেয়ে হেসে বললাম, বুড়ো কাপলান এল ডোেরাডোর আসল ঘাঁটির সন্ধান তখনও না পেলেও কিছু কিছু সম্পদ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। জলা-জংলায় ঘোরবার সময় তিনি সাংঘাতিক ভাবে একবার অসুস্থ হন। সেই সুযোগে তাঁকে অসহায় ভাবে ওই বিপদের মধ্যে ফেলে সেভিল তাঁর খুঁজে পাওয়া সম্পদ আর ওই কাগজটা চুরি করে পালিয়ে আসে। সে তারপর এসে হাইতিতে রাজনীতির খেলায় মেতেছে, এ বিষয়ে পাকা খবর আমি পেয়েছি। গুপ্তঘাতকের দল গড়ে সে হাইতির দুদলের একটিকে মোটা টাকা নিয়ে যে সাহায্য করছে তা-ও জানি। এখানে একটা বড় দাঁও সে মারতে চায়, কিন্তু এল ভোরাডোর কথাও সে ভোলেনি। তার মতো শয়তান ভুলতে পারে না। এখানকার পালা চুকলে, সে আরেকবার ওই চুরি-করা কাগজের সাহায্যে এল ডোরাডোর আসল ঘাঁটির সন্ধান করে পারবে না। গায়নার সোনার পালকের খবর টোপের মতো ফেলে তাই তাকে গাঁথবার চেষ্টা করেছি।
হুজুর মোটা মোটা ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে বিশ্রীভাবে হাসলেন-কিন্তু তাকে টোপে গাঁথতে গিয়ে নিজেই তার জালে জড়িয়ে মরতেও তো পারো!
তা তো পারিই। সে ঝুঁকি না নিয়ে কি নেমেছি!
হুঁ! হুজুর যেন দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, শুকনো নারকেল দড়িতে তেল আছে। দেখছি। কিন্তু এ-শব কথা তুমি জানলে কোথা থেকে?
জেনেছি হুজুর—ওই ওরিনোকো নদীরই দুই শাখাকারোনি আর পারাকুয়ার মাঝামাঝি এক অজানা অঘোর জঙ্গলে। সেখানে নিঃসহায় অবস্থায় মরতে বসা এক বুডোর দেখা পাই। ভাঙা ঘেঁড়াখোঁড়া একটা তাঁবুর তলায় মৃত্যুশয্যায় তিনি আমায় সব কথা জানিয়ে যান। তাঁকে সেখানে কবর দেবার সময় প্রতিজ্ঞা করি—পৃথিবীর যেখানেই লুকিয়ে থাক, শয়তান সেভিলকে খুঁজে বার করে তাকে কিছু শিক্ষা দিয়ে ও কাগজ আমি উদ্ধার করবই।
হুজুরের ভাঁটার মতো চোখ দুটো তখন আবার জ্বলতে শুরু করেছে। রিভলভারটা ঘোরানো বন্ধ করে, একটু শক্ত করেই যেন চেপে ধরে চাপা গর্জনের আওয়াজে তুমি থেকে আবার তুইতোকারিতে নেমে বললেন, হ্যাঁ, তোর সাধ শিগগিরই পূর্ণ হবে মনে হচ্ছে। কিন্তু ও-জঙ্গলে তুই কী করতে গিয়েছিলি তাই আগে বলে যা।
বলব বই কী, হুজুর! কৃতার্থ হয়ে বললাম, আপনাকে বলবার এ-সুযোগ ছাড়তে পারি! কিন্তু তার আগে আপনার টেবিলের ধারের ওই ইলেকট্রিক বোতামটা যদি একটু টেপেন।
কেন? হুজুর অগ্নিমূর্তি হয়েও যেন একটু হতভম্ব।
না, এক গেলাস জল দরকার ছিল। বোতাম টিপে কাউকে দিয়ে যদি আনাতেন!
ও! গলা শুকিয়ে গেছে বুঝি! হুজুরের মুখে হিংস্র বিদ্রুপ।
না, হুজুর! সবিনয়ে প্রতিবাদ জানালাম, এ-শুকনো গলা আর শুকোবে কি? তবে জল এক গেলাস কাছে থাকা ভাল! কখন কী দরকার হয় কে জানে?
দরকার হলে তখন পাবি? হুজুর আবার গর্জালেন, এখন যা জিজ্ঞেস করছি, বল তাড়াতাড়ি।
তাড়াতাড়িই বলছি, হুজুর। তবে জলটা আনিয়ে রাখলে পারতেন। অবশ্য ও-বোতাম টিপে জল আনানো যায় কিনা ঠিক জানি না। ওর আওয়াজে আপনার সব ক-টা পোষা নেকড়ে দাঁত বার করে ছুটেও আসতে পারে হয়তো এখানে! বোতামটা সেই জন্যই, কী বলেন?
হুজুর বুঝি এবার ফেটেই পড়েন। তাঁকে যেন ঠাণ্ডা করতে তাই তাড়াতাড়ি আবার বললাম, রাগ করবেন না, হুজুর। যা বলবার এখনই বলছি। কী করতে ওই জঙ্গলে গেছলাম, জিজ্ঞেস করেছেন তো! একবার গেছলাম ওই ম্যানাটি মানে শুশুকগুলোকে ছাড়তে, আর একবার গেছলাম তাদেরই খবর নিতে।
কাদের খবর নিতে! হুজুরের জালার মতো মুখের সবটাই বুঝি এখন হাঁ।
ওই ম্যানাটি, মানে একরকমের শুশুকগুলোর। বছরখানেক আগে ওই অঞ্চলের এক জলায় ছেড়ে এসেছিলাম কি না!
ওই জঙ্গলে ম্যানাটি ছেড়ে এসেছিলে? আবার খবর নিতে গেছলে তাদের? কেন? হুজুরের মাথাটা তখনও বেশ গুলিয়ে আছে বোঝা গেল।
আর বলেন কেন হুজুর! আমি যেন বিরক্ত—পাঁচজনের উসকানিতে।
চালাকি করবার আর জায়গা পাওনি! হুজুরের গলায় আবার এতক্ষণে গর্জন শোনা গেল, পাঁচজনের উসকানিতে অজানা জঙ্গলে তুমি শুশুক ছেড়ে এসে আবার খবর নিতে গেছলে? কার উসকানিতে? কে তারা?
আজ্ঞে, বললাম তো ওই পাঁচজন। নিরীহ গোবেচারার মতো বললাম, তবে তাদের নাম বললে কি চিনবেন! তাঁরা তো আজকের লোক নয়, এদেশেরও না।
কে তারা? কবেকার? কোথাকার?
আজ্ঞে, প্রায় সবাই চারশো বছর আগেকার। তার মধ্যে চারজন স্পেনের আর একজন ইংল্যান্ডের। ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে বাদ দিলে প্রথম যিনি সবচেয়ে উসকেছেন তাঁর নাম হল মার্টিনেজ। ও-অঞ্চলে সবার আগে সবচেয়ে বড় অভিযান যিনি করেছিলেন, সেই দিয়েগো দ্য অর্দাজের লেফটেন্যান্ট ছিলেন মার্টিনেজ। ১৫৩১ সালে জাহাজড়ুবি হবার পর কীভাবে তাঁকে উদ্ধার করে, সোনা যেখানে খোলামকুচি সেই ওমোয়া-য় নিয়ে গিয়ে, সোনায় মোড়া রাজা এল ডোরাডো তাঁর খাতির করেন, মার্টিনেজ তার বিবরণ দিয়ে গেছেন। মার্টিনেজের পর উসকানি পেয়েছি ওরেল্লানার কাছে। তাঁর অভিযান ১৫৪০ থেকে ১৫৪১-এ। তারপর আছেন ফিলিপ হটেন, ১৫৪১ থেকে ১৫৪৬ পর্যন্ত যিনি অভিযান চালান। ইস্পাহানিদের মধ্যে শেষ উসকানি পেয়েছি গনজালো জিমেনেস দ্য কোয়েদার কাছে। তাঁর অভিযান ১৫৬৯ সালের।
এরপর যিনি উসকানি দিয়েছেন তাঁর নামটা হয়তো শুনে থাকতে পারেন। তিনি হলেন স্যার ওয়ালটার র্যালে। র্যালে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অসামান্য বীর। কিন্তু তখনকার আরও অনেক বীরের মতো সুযোগ-সুবিধে হলে জলদস্যুতায় তিনি পেছপাও হতেন না। স্পেনের কয়েকটা এমনইভাবে লুট করা জাহাজের কাগজপত্রে, সোনায় মোড়া রাজ্য মানোয়া বা ওমোয়া-র খবর পেয়ে স্যার ওয়ালটার র্যালে ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে একটি অভিযানে যান। সে অভিযানের পর ১৫৯৬-এ তিনি আবার লরেন্স কেমিস নামে একজনকে এল ডোরাডোর সন্ধানে পাঠান। তারপর শেষবার ১৬১৭ সালে মৃত্যুর একবছর আগে তিনি নিজেই আবার সেই সন্ধানে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল তাঁর ছেলে আর আগেকার প্রতিনিধি সেই লরেন্স কেমিস। এই অভিযান থেকেই স্যার ওয়ালটারের চরম দুর্ভাগ্য শুরু। জ্বরে পড়ে তাঁকে ত্রিনিদাদে আটকে থাকতে হয়। তাঁর ছেলে আর লরেন্স কেমিস পাঁচটি ছোট ছোট জাহাজ নিয়ে এল ডোরাভোর সন্ধানে যাবার পথে ইস্পাহানি দলের সামনে পড়ে। যুদ্ধে স্যার ওয়ালটারের ছেলে মারা পড়ে, কেমিস সে-দুঃসংবাদ নিয়ে ফিরে আসার পর, স্যার ওয়ালটারের বকুনি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। আর এ-অভিযান থেকে হতাশ হয়ে ইংল্যান্ডে ফেরার পর, বন্দী হয়ে এক বছর পরেই স্যার ওয়ালটারকে ফাঁসি কাঠে ঝুলতে হয়। তাই বলছিলাম হুজুর, এই পাঁচজনের উসকানি…
থাক! হুজুর কথাটা আর আমায় শেষ করতে দিলেন না। এতক্ষণ ধৈর্য ধরে যে চুপ করে ছিলেন সেইটেই আশ্চর্য। এবার গনগনে মেজাতে গর্জে উঠলেন, এ সব পালাকীর্তন তোর কাছে শুনতে চেয়েছি?
তাই তো চাইলেন, হুজুর। তা ছাড়া শুনতে শুনতে আপনি একটু আনমনা হন কি , ফালতু কথা বাড়িয়ে তা-ও পরখ করে দেখছিলাম!
তা-ই দেখছিলি? হুজুর চিড়বিড়িয়ে উঠলেন, আমায় আনমনা করে তুই এখান
থেকে সটকাতে পারবি ভেবেছিস? জানিস তুই কোথায় আছিস?
জানি বই কী হুজুর। এই চারতলা পেল্লায় যমপুরীর দরজায় দরজায়, সিড়িতে সিঁড়িতে পাহারা। ঘরে ঘরে আপনার সব সাঙ্গপাঙ্গ ছোরা পিস্তল নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছে। ওই বোতাম টিপলেই সব ছুটে আসবে। তবু ভাবছিলাম, ওদিকের বন্ধ জানালাটা খুললে হয়তো একটা খোলা বারান্দা পাওয়া যাবে। ওখান দিয়ে নিয়ে আসবার সময় বাইরের দমকা হাওয়া একটু গায়ে লাগল কি না, তাই ভাবলাম বারান্দায় একবার পৌছোতে পারলে, সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পাশের বাজারের ছাদের ওপর পড়া খুব শক্ত নয়। এ পথে যেতে-আসতে বাজারের ছাদটা অনেকবার চোখে পড়েছে। করোগেটের ঢালু চাল হলেও মাথাটা বেশ উঁচু। আর তেতলার বারান্দা থেকেও খুব বেশি লাফাতে হবে না। তারপর একবার বাজারের মধ্যে গিয়ে পড়তে পারলে…
আর তোর ভাবনা নেই, কেমন?হুজুরের মুখে, বেড়াল যেন ইদুর ধরে খেলাচ্ছে এমনই হাসি—আমি তখন শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকব। কী বলিস?
আজ্ঞে, আশা করতে দোষ কী? আমি করুণ সুরে বললাম। চোপ রও! বেয়াদব! হুজুর আবার বজ্রনাদ ছাড়লেন, সোজাসুজি বলবি কি না ও জঙ্গলে কী করতে গিয়েছিলি? কোনও নিশানা কারুর কাছে পেয়েছিলি কিনা!
সোজাসুজিই তো বললাম হুজুর, নিশানা যা পেয়েছি ওই পাঁচজনের কাছেই, আর গিয়েছিলাম সবাই যে-জন্য যায় সেই জন্যেই। আমি তো আর একলা ও-অপরাধ করিনি হুজুর, আজ চারশো বছর ধরে হাজার হাজার মানুষ জান-প্রাণ তুচ্ছ করে ওই যমের দক্ষিণ দোরের দিকে ছুটেছে, সেই হারানো ওমোয়র সন্ধান করতে। পুমা, জাগুয়ার আর অসভ্য জংলিরা কতজনকে শেষ করেছে, নদী-জলায় অ্যানাকোন্ডা আর ও দেশের রাক্ষুসে কুমির কেম্যানের পেটে কতজন গেছে, দুর্দান্ত বিষধর ল্যাবেরিয়া বুশমাস্টার ব্যাটল সাপের ছোবলে কতজন প্রাণ দিয়েছ তার লেখা-জোখা নেই। তবু মানুষের লোভ, দুঃসাহস আর কৌতূহল কোনও বাধা মানেনি। বহুদিন পর্যস্ত মানুষের ধারণা ছিল, গায়নার পারিমা হ্রদের ধারে ওমোয়া শহর পাওয়া যাবে। অভিযাত্রীরা সেই পারিমা হ্রদ খুঁজেছে হন্যে হয়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ফন হুমবোন্ড প্রমাণ করে দেন যে, এতদিন দেশবিদেশের মাপে যে পারিমা হ্রদের চিহ্ন দেওয়া থাকত, তার কোন অস্তিত্বই নেই। তবু কি মানুষের অভিযান বন্ধ হয়েছে, হুজুর! কোথাও এল ডোরাডোের সোনায় মোড়া রাজধানী ওই অজানা জলা-জংলার দেশে লুপ্ত হয়ে আছেই এ-ধারণা সহজে যাবার নয়। যাবেই বা কী করে? এখনও ওই দেশের অজানা গহন অঞ্চল থেকে ওখানকার আদিবাসীদের হাত-ফেরতা হতে হতে একটা-দুটো যে আশ্চর্য সোনার পালক সভ্যমানুষের জগতে এসে পৌছোয়, তার রহস্যের তো কিনারা হয়নি।
ফের বকবকানি ধরেছিস! হুজুর জ্বলে উঠলেন, ওখানে শুশুক ছাড়ার কথা কী বলছিলি?
সত্যি কথাই বলছিলাম, হুজুর। শুশুক ছাড়ার মতলবটা অবশ্য হঠাৎ মাথায় এসেছিল। দু বছর আগে এমনই জুন মাসের এক গরমের দিনে ত্রিনিদাদ থেকে ব্রিটিশ গায়নার জর্জ টাউনে যাবার একটি জাহাজে কাপলানের সঙ্গে আলাপ না হলে
অবশ্য এ মতলব খাটাবার কথা ভাবতাম না।
দু বছর আগে, জুন মাসে কাপলানের সঙ্গে তোর জাহাজে দেখা হয়। হুজুর একেবারে মারমুখখা। আমার কাছে ধাপ্পা!
আজ্ঞে, ধাপ্পা আপনাকে দিতে পারি! কাপলানের সঙ্গেই সত্যি আমার দেখা হয়। তবে শয়তান সেভিল যে কাপলানের সর্বস্ব চুরি করে জংলিদের মাঝে মৃত্যুর মুখে ঠেলে ফেলে আসে সে কাপলান নয়। কিন্তু সেই বৃদ্ধেরই ছেলে। বহুকাল নিরুদ্দেশ বাপের কোনও খবর না পেয়ে ছোট কাপলান তাঁরই সন্ধানে গায়না যাচ্ছিল। আমিও গায়নার অজানা গহন জঙ্গলে যাবার জন্য বেরিয়েছি জেনে সে আমায় সঙ্গী হতে বলে। সেবারেই বুড়ো কাপলানের সঙ্গে যদি দেখা হত, আর যে-কাগজটা পরে সেভিল তাঁর কাছ থেকে চুরি করে পালায় সেটা যদি তখন পেতাম, তা হলে ওই ম্যানাটি মানে শুশুকগুলোর ভেলকি তখনই দেখিয়ে দিতে পারতাম।
হাইতি-মার্কা একটা কড়া গালাগাল দিয়ে হুজুর গর্জালেন, নিকুচি করেছে তোর শুশুকের। সেবারে গিয়ে বুড়ো কাপলানের দেখা তা হলে পাসনি! কী করছিলি তা হলে?
পারিমা হ্রদের পাত্তা যদি পাওয়া যায়, সেই আশায় ওই শুশুকগুলোকে ছেড়ে এসেছিলাম।
চুলোয় যাক তোর শুশুক! আরও কী হুজুর বলতে যাচ্ছিলেন।
তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, অমন কথা বলবেন না, হুজুর! ওই শুশুকের ভরসাতেই আছি।
হ্যাঁ, তোর মতো কুচোচিংড়ির আর কে ভরসা হবে! শুশুকের ল্যাজেই গড় কর।হুজুর খিচিয়ে উঠলেন। এখন আমার কথার চটপট জবাব দে। পারিমা হ্রদ তো গল্প কথা বলে হুমবোন্ড প্রমাণ করে গেছেন। তার পাত্তা পাবার আশা তা হলে কোথায়?
হুজুরের যেন একটু নেশা লেগেছে মনে হচ্ছে? খুশি মুখে বললাম, শুনুন। আশা এইখানে যে হুমবোন্ডের প্রমাণ তো শেষ কথা নয়। হতে পারে না। ১৫৩১-এ মার্টিনিজ ওমোয়া-য় গেছলেন বলে বিবরণ দিয়েছেন, আর হুমবোল্ড পারিমা হ্রদ বলে কিছু নেই বলে প্রমাণ করেছেন উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। মাঝখানে তিনশো বছর কেটে গেছে। তার মধ্যে পৃথিবীর গায়ের ওপর অনেক কিছু ওলট-পালট হয়েছে, বিশেষ করে গায়নায় ওই অঞ্চলে পাহাড় ডাঙা নদী জলা অনেক ওঠা-নামা করেছে বলে অনেক পণ্ডিতের ধারণা। যে পারিমা হ্রদের ধারে ওমোয়া শহর ছিল, তা যে পৃথিবীর নীচের তলার মাথা ঝাঁকুনিতে পাড় ছাপিয়ে ওমোয়া শহর ভাসিয়ে, হ্রদের বদলে অন্য চেহারা নেয়নি তা কে বলতে পারে! সেইরকম কিছুই হয়েছে বলে আমার অন্তত বিশ্বাস, কারণ পারিমা হ্রদ কি তার তীরের ওমোয়া শহর আর সোনায় মোড়া রাজা এল ডোরাডো নিছক গাঁজাখুরি গল্প হলে সোনার পালকগুলোও তা-ই হত। কিন্তু সেগুলো তো চোখে-দেখা হাতে-ছোঁয়া পরখ করা জিনিস। তাই পারিমা হ্রদকে অন্য চেহারায় খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি। বুড়ো কাপলানও তা-ই মনে করতেন, আর শেষ পর্যন্ত তিনি এমন কিছু হদিস পেয়ে ওই কাগজে টুকে রেখেছিলেন যার সাহায্যে এল ডোরাডোর কুবেরের ভাণ্ডার উদ্ধার করা এখনও অসম্ভব নয়। সেই কাগজখানা সেভিলের কাছ থেকে তাই আমার না নিলেই নয়!
হুঁ! হুজুরের গলায় আর ঝাঁজ নেই, শোন, তোর সব বেয়াদবি আমি মাপই করে দেব ভাবছি!
হুজুরের কী মহানুভবতা! আমি গদগদ হলাম।
গলাটা আরও একটু মোলায়েম করে হুজুর বললেন, এল ডোরাডো সম্বন্ধে তুই বেশ ওয়াকিবহাল মনে হচ্ছে। তোকে তাই একটা কাজ দিতে চাই।
বান্দা তৈয়ার, হুজুর!
আমার ফৌজি সেলামে একটু ভুরু কোঁচকালেও গলাটা তেমনই মোলায়েম রেখে হুজুর বললেন, সেভিলের কাছ থেকে সেকাগজ আমিই আদায় করব। তারপর তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে সেই গায়নায়। পারিমা হ্রদ খুঁজে বার করে এল ডোরাডোর কুবেরের ভাণ্ডার যদি সত্যি উদ্ধার করতে পারিস, তা হলে তোকে এমন বকশিশ দেব যা তুই ভাবতে পারিস না।
শুনেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, হুজুর! কিন্তু বেচারা কাপলানের কী হবে তা হলে?
কাপলান? মানে সেই বুড়োর বেটা? হুজুর নাক সেটকালেন, সে আবার এর মধ্যে আসছে কোথা থেকে?
আসছে তার বাপের কাছ থেকে। বুড়ো কাপলান হদিস দিয়ে গৈছে বলেই না কুবেরের ভাণ্ডার উদ্ধার করবার আশা করছি। সুতরাং তাকে কী করে বাদ দিই, বলুন? তার চেয়ে আরেক কাজ করুন, হুজুর! সেভিল না ডেভিল যার কাছ থেকে হোক, কাগজটা আমায় ফিরিয়ে দিন। আমি বকশিশ আর আপনাকে কী দেব? একটু বরং আপনার পিঠ চাপড়ে যাই।
বোমার মতো ফাটতে গিয়েও হুজুর কী যেন ভেবে অতি কষ্টে নিজেকে সামলালেন। তারপর তখানি সাধ্য গলাটা খাটো রেখেই বললেন, শেষ সুযোগ তোকে দিচ্ছি, এইটুকু মনে রাখিস। এক কথায় জবাব দে—আমার কথায় রাজি কি না?
বড় ফাঁপরে ফেললেন যে হুজুর! এখন আমাকে দেখছি টি-ম্যালিসেরই শরণ নিতে হয়।
টি-ম্যালিস কে? হুজুর চোখ পাকালেন।
আজ্ঞে, আপনাদের এই হাইতিরই রূপকথার একজন মানুষ। রাজা টি-ম্যালিসের ওপর কী কারণে চটেছেন। টি-ম্যালিসকে তলব করে বললেন-কাল সুয্যি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার পদ্মদীঘির সব কটা রাজহাঁস দুয়ে এক বালতি দুধ আনতে হবে। না আনতে পারলে তোমার গর্দান নেব। পরের দিন রাজা ভোরে উঠে বসে আছেন, টি-ম্যালিস আর আসে না। অনেক বেলায় টি-ম্যালিস আসতে রাজা হুংকার দিয়ে উঠলেন—দুধ কই রাজহাঁসের? ডাকো জল্লাদকে এখনই। টি-ম্যালিসের ভ্রুক্ষেপ নেই। বললেন—একটু সবুর করুন হুজুর, আগে আমার ঝামেলাটা শুনুন। কী তোমার ঝামেলা—রাজা রেগে শুধোলেন। আজ্ঞে পিপড়ের কামড়ে আঙুল ফুলে গেছে, দুধ দুইব কী করে? বললে টি-ম্যালিস। তা আঙুল ফোলে কেন? কেন গেছলে পিপড়ে ঘাঁটাতে? রাজা ধমকালেন। কী করি বলুন, নইলে যে সূয্যি ওঠে না— বললে টি-ম্যালিস। সূয্যি ওঠে না! রাজা হতভম্ব। আজ্ঞে হ্যাঁ, মহারাজ! অম্লানবদনে বললে টি-ম্যালিস-মাঠের শেষে ভেঁয়ো পিপড়ের বাসা ছিল, সুয্যি ঠাকুর জানত না। ভোরবেলা যেই উঠতে যাবে অমনই লাল মিঠাই মনে করে একেবারে হেঁকে ধরলে ঝাঁক ঝাঁক পিপড়ে। ছুটে গিয়ে তাই ছাড়াতে বসতে হল। পিপড়ে না ছাড়ালে সুয্যি উঠবে না। আর সুয্যি না উঠলে রাজহাঁসের দুধ আপনাকে দেখাব কী করে? পিপড়ের কামড়ে তাই তো আঙুল ফুলল। রাজামশাই এবার তেলেবেগুন। বললেনধাপ্পাবাজির আর জায়গা পাওনি? সূয্যির গায়ে কখনও পিপড়ে ধরে? ধরে, মহারাজ, ধরে!—টি-ম্যালিস এক গাল হেসে বোঝালে— রাজহাঁসের দুধ দোয়াতে হলেই ধরে!
একটু থেমে মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম, আপনার কথায় টি-ম্যালিসের মতোই তা হলে রাজি হতে হয়। কোন সুয্যির গায়ে কী পিপড়ে ধরাতে হবে তা না হয় পরে ভাবা যাবে।
এবার সত্যিই বোমা ফাটল। হুজুর হুংকার ছাড়লেন, তবে রে, চিমড়ে চিমসে ছারপোকা! একটু ঢিলে দিয়েছি বলে কোঁকাকে কাতুকুতু ভেবেছিস! শমনের ডাক তোর এসে গেছে। নে, ইস্টনাম কিছু থাকে তো জপ করে নে।
কিন্তু কটা কাজ যে বাকি আছে, হুজুর! করুণ সুরে নিবেদন করলাম, কাপলানের কাছে ওই কাগজটা আর নতুন এক পাল ম্যানাটি না পৌঁছে দিলে যে কথার খেলাপ হবে।
তা একটু হবে। তবে তুই শুশুক না পৌঁছোত পারিস, তোর ফুটো লাশটা না হয় হাইতির সেন্ট মার্ক উপসাগরের জলে শুশুকদের বদলে হাঙরদের কাছেই পৌঁছে
দেব। হুজুরের মুখে যেন হাঙরেরই হাসি এবার।
বললাম, ধ্যেৎ!
হুজুর শুনেই ভ্যাবাচাকা। লজ্জা লজ্জা ভাব করে এবার বললাম, হাঙরের কামড়ে আমার যে সুড়সুড়ি লাগে। তা ছাড়া কথার নড়চড় আমার যে কিছুতেই হবার নয়। প্রথমবার গায়নায় বাপের খোঁজ না পেয়ে হতাশ হয়ে কাপলান এই হাইতিতে ফিরে এসে রাজনীতির লড়াইতেই মাতে। দ্বিতীয়বার শুশুকগুলোর খোঁজ নিতে গায়নায় গিয়ে, সেগুলো জংলিরা মেরে শেষ করেছে দেখলাম বটে, কিন্তু ভাগ্যক্রমে বুড়ো কাপলানের দেখা পেলাম। তাঁর শেষ খবর নিয়ে হাইতিতে এসে বহু কষ্টে ছোট কাপলানকে খুঁজে বার করি। তারপর কত বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে রাজনীতির নেশা ছাড়িয়ে আবার গায়নায় পাঠিয়েছি। কথা দিয়েছি সেভিলের কাছ থেকে কাগজটা আর, ওই যে বললাম, নতুন একপাল শুশুক নিয়ে তার কাছে দুদিন বাদেই যাচ্ছি। আর দেরি করলে তাই যে আর চলে না, হুজুর!
না, দেরি আর তোকে করতে হবে না। হুজুর রিভলভারের সেফটি ক্যাচটা সরালেন, সেভিল না ডেভিলের কাছ থেকে কী করে কাগজটা নিবি ভেবে রেখেছিস আশা করি।
তা একটু ভেবেছি বই কী! আপনার মতো সাদাসিধে হোঁৎকা কেউ হলে ভাবনারও বিশেষ কিছু নেই।
তাই নাকি! হুজুর রিভলভারটা আমার দিকে উঁচোলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ। যত বড় শয়তানই হোক, আপনার মতো হাঁদা হলে বিশ্বাস করে সেকাগজটা সে বাকস প্যাঁটরা সিন্দুকে কোথাও রেখে স্বস্তি পাবে না। নিজের কাছে আপনার কোমরের বেলটের মতোই কোথাও নিশ্চয়ই রাখবে।
আর, তুই লড়ে সেটা কেড়ে নিবি! হুজুরের যেন ব্যাঙের লপচপানিতে সাপের ফোঁস।
আজ্ঞে না, হুজুর! নাক সিটকে বললাম, ও সব ধস্তাধস্তি বড় নোংরা কাজ। টিবিয়া বলে পায়ের হাড়ের নাম শুনেছেন বোধ হয়। এই যে আপনি আমার মুখের দিকেই চেয়ে আছেন। এখন আচমকা দুপায়ের সেই দুই টিবিয়ায় ঠিক জুৎসই ঠোক্কর দিলে সে আপনার মতোই কাহিল দিশাহারা হয়ে নাচতে শুরু করবে। তারপর দুই কনুইয়ের আলনার নার্ভ মানে স্নায়ু যেখান দিয়ে গিয়েছে সেখানে ফানি বোন-এ নির্ভুল জায়গা মাফিক দুটো ঘা দিলেই দুটো হাত ঝিনঝিন করে অবশ হয়ে রিভলভারটা এমনই করে পড়ে যাবে। তারপর সেটা তুলে নিয়ে দু কানের নীচের এই দুটো জায়গায় মোক্ষম একটু টিপুনি দিয়ে কণ্ঠার ডেলাটায় দুবার ওস্তাদের হাতের টোকা দিলেই কিছুক্ষণের জন্য হাত পা শরীর অবশ, জিভ অসাড়। তখন কোমরের বেলটের ব্যাগ থেকে কাগজটা এমনই করে বার করে নিয়ে, সাবধানের মার নেই বলে পেটের উপর সোলার প্লেক্সাসে একটা কিল দিয়ে, টেবিলের ধারের বোতামটা একবার টিপলেই এ-বাড়ির পোষা গুণ্ডাগুলো পড়ি কি মরি করে এই ঘরের দিকেই সবাই ছুটে আসবে। জলের গ্লাসটা আনানো থাকলে আপনার মুখে চোখে জল ছিটিয়ে তারা চাঙ্গা করতে পারত। কিন্তু তা আর হবার নয়। আমি অবশ্য ওধারের জানালাটা তার আগেই খুলে ফেলে খোলা বারান্দায় নেমে সেখান থেকে বাজারের টিনের চালের মটকায় ঝাঁপ দিয়ে এমনই করে হাওয়া!
ঘনাদা থামলেন। সিগারেটটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে তখন প্রায় তাঁর আঙুলের ফাঁকে এসে পৌঁছেছে। সেটা ফেলে দিয়ে কৌটোটা নিয়েই উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন। আমাদের আর কিছু করতে হল না, ভাড়াটে চারমূর্তিই ধরাধরি করে তাঁকে বসিয়ে দিল।
আপনি তাহলে সত্যিই অমনই করে কাগজটা কেড়ে নিয়ে পালালেন? সিড়িঙ্গে নফরবাবু যেন এখুনি সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করবেন, ওই গোরিলার মতো দুশমনের কাছ থেকে?
ওই গোরিলাই হল সেভিল! আমি কিন্তু আগেই বুঝেছি! পিপের দোসর বিশে নিজের বুদ্ধির বাহাদুরিতে নিজেই গদগদ।
আপনি তারপর ওই কাগজ আর শুশুকের পাল সেই কাপলানের কাছে পৌঁছে দিলেন! ভক্তিভরে শুধোল দশরথ।
তা দিলাম বইকী! ঘনাদা সবিনয়ে জানালেন, কথা যখন দিয়েছি তখন না রেখে পারি।
আচ্ছা, কাগজটার দাম না হয় বুঝলাম, সিড়িঙ্গে নফরবাবু প্রায় করজোড়ে নিবেদন করলেন, কিন্তু এই শুশুকগুলো কেন, ঠিক ধরতে পারছি না তো।
পারছেন না! ঘনাদা এরকম অবিশ্বাস্য মূঢ়তায় যেন ক্ষুণ্ণ, ওরাই যে ভরসা! এল ডোরাডোর কুবেরের ভাণ্ডার উদ্ধার হবার হলে ওদের দিয়েই হবে।
ওরাই মানে ওই শুশুকগুলো দিয়ে! চারমূর্তির সব কটা চোখই তখন কপালে উঠেছে।
হ্যাঁ! ঘনাদা করুণভাবে ব্যাখ্যা করলেন, ওই ম্যানাটি মানে শুশুকগুলো হল নদীতে জলায় যা কিছু পানা, দাম প্রভৃতি জলজ আগাছা জন্মায় তার যম। পাঁচশো ধাঙড় সাত হপ্তায় যা না পারে, ওদের পাঁচটাতে সাত দিনে তা খেয়েই সাফ করে দেয়। পৃথিবীর থেকে থেকে মাথা চাড়ার দরুন এল ডোরাডোর ওমোয়া রাজধানী, যার ধারে ছিল সেই পারিমা হ্রদ, কোনও কারণে হয়তো পাড় ছাপিয়ে সে রাজধানী ড়ুবিয়ে অন্য চেহারা নিয়েছে—এ সন্দেহের কথা আগেই বলেছি। চারশো বছরে সে জলাবাদা কিন্তু জংলা আগাছায় এমন ছেয়ে গেছে যে হদিস পেলেও খুঁজে বার করা অসম্ভব। ওই ম্যানাটির পাল সেই জন্যেই ও-অঞ্চলে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করি। ও দেশের জংলিরা বনের আড়াল থেকে বিষমাখানো তীর ছুঁড়ে পালাতেই জানে। তাদের দিয়ে তো আর ধাঙড়ের কাজ হয় না। আর সে অসম্ভব সম্ভব হলেও ম্যানাটির মতো এমন পরিপাটি সাফ করা আর সাফ রাখা মানুষ তো মানুষ, কোনও যন্ত্রেরও সাধ্যে কুলোবে না। ম্যানাটিরা জলা সাফ করলে হারানো হ্রদ পারিমার চৌহদ্দি বেরিয়ে পড়বে, এ বিশ্বাস আমার ছিল।
তাহলে ওই কুবেরের ভাঁড়ার আবার খুঁজে পাওয়া যাবে? পিপের ভাই বিশের চোখ প্রায় ঠেলে বেরোয়।
নাঃ, আর কী করে যাবে! ঘনাদা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কাপলান তো আর ওখানে থাকবে না। সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে আসবে।
কেন? কেন? সমস্বরে আকুল প্রশ্ন।
আর কেন! হাইতির রাজনীতির লড়াই থেকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে যখন তাকে গায়নায় পাঠাই তখন সেই কড়ার-ই আমায় দিয়ে করিয়ে নিয়েছিল যে! বলেছিল—তোমার কথায় আমি যাচ্ছি দাস, কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে কোনওদিন কোথাও কোনও ভোটের লড়াইয়ে আর নামবে না। সেরকম কোনও খবর পেলেই জানবে আমি সব ছেড়ে হাইতিতে ফিরেছি।
সমস্ত ঘরটার চোখেই যেন সরষে ফুল।
ঘনাদা উদাস ভাবে বললেন, ওই ম্যানটিগুলোর জন্যই একটু দুঃখ হয়। এল ডোরাডোর যখের ধন আর অবশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার আর কী করা যাবে! আপনারা সবাই যখন দাঁড়াতে বলছেন তখন সে কথা তো আর ঠেলতে পারি লো?
খুব পারেন! আলবত পারেন!! একশো বার পারেন!!! আপনাকে দাঁড়াতে দিচ্ছে কে? চারমূর্তি একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে যেন আমাদের ওপরই মারমুখখা।
আপনাকে ব্যাগোত্তা করছি, ঘনশ্যামবাবু, চারজনের মুরুব্বি হয়ে জালা-প্রমাণ দশরথই হাত কচলে আর্জি জানালে, আপনি এ ভোটাভুটির নোংরামিতে নামবেন না। দিন, কথা দিন আমাদের। তারপর দেখি, কে আপনাকে নামাতে চায়!
শেষ কথাগুলো আমাদের দিকেই চোখ রাঙিয়ে।
ঘনাদা যেন নিরুপায় হয়ে বললেন, বেশ, আপনারাই যখন মানা করছেন তখন নামব না।
হঠাৎ আমাদের দিকে নজর পড়ায় যেন অবাক হয়ে বললেন, আরে, তোমরা অমন চুপটি করে বসে কেন? ভদ্রলোকেরা এসেছেন, চা জলখাবার আনাও। আর এই নাও হে শিশির, অনেকক্ষণ শুকনো মুখে আছো, একটা সিগারেট খাও।
শিশিরের কৌটো থেকেই ঘনাদা উদারভাবে তাকে একটা সিগারেট দান করলেন।
হ্যাঁ, এখনও সেই বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেন!
এই সিরিজের আরও গল্প পরের পাতায়
