ইয়াজদার্গিদের হিরে (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
দুই
প্রথমে চোখে পড়ল জংধরা ছোট্ট গেটের পাশে সাঁটা একটুকরো চৌকো ফলক। তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে : Human Genome Research Centre.
দোতলা বাড়িটা সত্যিই হানাবাড়ি। গেটে তালা বন্ধ। ভেতরে আগাছার জঙ্গল। চারদিকে দেওয়ালঘেরা এই বাড়ির অবস্থাও জরাজীর্ণ। পলেস্তারা খসে গেছে কোথাও-কোথাও। কার্নিসে গাছ গজিয়ে আছে। পুরোনো আমলের বাগানবাড়ি হতে পারে। ডাইনে বিশাল এলাকা জুড়ে কী কারখানা গড়া হচ্ছে। বাঁ দিকে একফালি খোয়াবিছানো রাস্তা এবং নতুন পুরোনোয় ঘেঁষাঘেষি অনেক বাড়ি। একটাতে ঘন গাছপালা। হঠাৎ করে মনে হয় গ্রাম শহরে মেশানো কোনও মফস্সল জনপদ।
কর্নেল বাইনোকুলারে গেট থেকে ভেতরটা দেখছিলেন। বললাম, এ কিসের গবেষণাকেন্দ্র?
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, জেনেটিক্সের।
হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন, ক্কী? ক্কী?
জবাব না দিয়ে কর্নেল ফুটপাত ধরে এগিয়ে গেলেন একটা পান-সিগারেটের দোকানের দিকে। হালদারমশাই আমার দিকে তাকালেন। বললাম, জেনেটিক ব্যাপারটা আমিও বুঝি না হালদারমশাই। শুধু এটুকু বলতে পারি, এখানে সম্ভবত কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেন্দ্র গড়া হবে। তাই আগেভাগেই ফলক সেঁটে দিয়েছে।
গভমেন্টের কারবার! দেখি, নস্য পাই নাকি। বলে হালদারমশাইও সেই দোকানটার দিকে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন।
আমি আমার ক্রিমরঙা মারুতি গাড়িতে গিয়ে ঢুকলাম। এভাবে একানড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। পড়েছি দু-দুজন ছিটগ্রস্তের পাল্লায়। বরাতে কী আছে কে জানে। বসে থাকতে থাকতে গেটের ভেতর দিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালাম। সেইসময় হঠাৎ দোতলার একটা জানালা খুলে গেল এবং একটা মুখ দেখলাম।
নাহ। ভূতের মুখ বলে মনে হল না। গোলগাল অমায়িক এবং বেশ সভ্যভব্য মানুষের মুখ। আপনমনে হাসছেন তিনি। উৎসাহে গাড়ি থেকে নেমে ওঁকে ডাকব ভাবছি, হঠাৎ জানালাটা বন্ধ হয়ে গেল। তা হলে বাড়িটাতে এখন কেউ আছেন। কিন্তু বাইরের থেকে গেটে তালা কেন? খটকা লাগল।
কর্নেল এবং হালদারমশাই ফিরে এলে কথাটা বললাম। কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, তুমি বসন্তবাবুকে দেখেছ। শুনলাম ভদ্রলোক বদ্ধ পাগল। তাই ওঁর ছোটোভাই রাজেনবাবু ওঁকে বাড়িতে আটকে রেখে বাইরে যান। রাজেন অধিকারী নাকি বাঙ্গালোরে কী চাকরি করতেন। সম্প্রতি এই পৈতৃক বাড়িতে এসে উঠেছেন।
হালদারমশাই ততক্ষণে গেটের কাছে হেঁড়ে গলায় ডাকাডাকি শুরু করেছেন, বসন্তবাবু! বসন্তবাবু! মি. অধিকারী।
কর্নেল বললেন, হালদারমশাই, বসন্তবাবুকে ডেকে লাভ নেই, তা ছাড়া পাগলের পাল্লায় পড়া কাজের কথা নয়। আসুন আমরা একবার এক জায়গায় যাব।
হালদারমশাই চাপা গলায় বললেন, কর্নেলসাব, এই চান্স। ছাড়া ঠিক নয়। কাল রাত্তিরে যা স্বচক্ষে দেখেছি, তার তদন্ত করা দরকার।
আপনি তা হলে তদন্ত করুন। আমরা চলি।
হালদারমশাই কান করলেন না। গেটের গ্রিলের খাঁজে পা রেখে উঠে গেট পেরিয়ে গেলেন। বললাম, সর্বনাশ। হালদারমশাই করছেন কী।
কর্নেল গাড়িতে ঢুকে বললেন, ওঁর কাজ উনি করুন। গাড়ি ঘোরাও। আমরা এবার যাব চন্দ্রকান্তবাবুর বাড়ি।
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত?
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ ডার্লিং। এই হিউম্যান জেনোম ব্যাপারটা সম্পর্কে ওঁর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।
বিজ্ঞানী চন্দ্ৰকান্তের সঙ্গে আমাদের অনেক বছরের পরিচয়। উনি থাকেন এখান থেকে এক কিমি উত্তরে একটা প্রত্যন্ত এলাকায়। সদর রাস্তা থেকে আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ রাস্তায় ঢুকে আরও জঙ্গুলে এলাকায় ওঁর ডেরা। নিরিবিলি বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপযুক্ত জায়গা। ওঁর একটি রোবট আছে। তার নাম ধুন্ধুমার। ডাকনাম ধুন্ধু। এই বিকট নামের কারণ আছে। শব্দটি উচ্চারণ করলে যে ধ্বনির সৃষ্টি হয় তা রোবটটিকে নাকি সক্রিয় করে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় মনুষ্যাকৃতি রোবটটিকে সোনিক রোবট বলা চলে।
তবে ধুন্ধুকে আমার বড় ভয় করে। যন্ত্রমানুষ আর পোষা বাঘ প্রায় একই জিনিস।
গাড়ির হর্ন দিতেই অটোমেটিক গেট খুলে গেল। বিজ্ঞানী প্রবরকে সহাস্যে এগিয়ে আসতে দেখলাম। চিবুকে তেকোনা দাড়ি, একরাশ আইনস্টাইনি চুল। বেঁটেখাটো মানুষটি বড়োই সদালাপী। কর্নেল এবং আমার সঙ্গে কড়া হ্যান্ডশেক করে ড্রইংরুমে ঢোকালেন। ধুন্ধুকে দেখতে না পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম।
আরও নিশ্চিন্ত হলাম শুনে যে, ধুন্ধুর কী ভাইরাসঘটিত অসুখ হয়েছে। ল্যাবে তার চিকিৎসা চলছে।
চন্দ্রকান্ত বললেন, আজকাল আর সিন্থেটিক কফি খাই না। ন্যাচারাল কফি খাওয়াচ্ছি।
কর্নেল বললেন, কফি পরে হবে। আগে কাজের কথা সেরে নিই।
বলুন! এ বেলা আমার হাতে অঢেল সময়।
হিউম্যান জেনোম সম্পর্কে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।
বিজ্ঞানী ভুরু কুঁচকে তাকালেন। জেনোম? আপনি কি জেমস ডি ওয়াটসনের তত্ত্বের কথা বলছেন? নোবেল- লরিয়েট ওয়াটসন?
হ্যাঁ। ওঁর হিউম্যান জেনোম প্রজেক্টের কথা শুনেছি।
চন্দ্রকান্ত হাসলেন। আমি জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের কারবারি। তবে ইদানীং কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমার লাইন জেনেটিকসের কাছাকাছি এসে পড়ছে। তো জেনোম প্রজেক্ট! মানুষের প্রতি দেহকোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম আছে। ক্রোমোজোমের মধ্যে আছে মালার মতো সাজানো অসংখ্য জিন। সঠিক হিসাব এখনও করা যায়নি। ওয়াটসনের মতে, একজন মানুষের দেহে ৫০ হাজার থেকে এক লক্ষ জিন আছে। প্রতিটি জিনে আছে তিনশো কোটি ডি এন এ। এই ডি এন এ-র মধ্যে সংকেতে লুকনো আছে মানুষের বংশগত বহু লক্ষণ বা চরিত্র। ওয়াটসন ডি এন এ-র গঠন খুঁজে সেই সংকেতগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন। সেটাই ওঁর জেনোম প্রকল্প।
জেনোমতত্ত্ব কেউ কি এ পর্যন্ত বাস্তবে কাজে লাগাতে পেরেছেন?
চন্দ্রকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। স্রেফ তত্ত্ব। তবে স্বয়ং ওয়াটসনেরই মতে, একে কাজে লাগিয়ে বড়োজোর বংশানুক্রমিক আদিব্যাধি নির্মূল করা যায়। এই পর্যন্তই।
এর অপব্যবহার করা কি সম্ভব?
বাস্তবে কাজে লাগাতে পারলে অপব্যবহার সম্ভব বইকী।
কী ধরনের অপব্যবহার?
চন্দ্রকান্ত খিক-খিক করে খুব হাসলেন। সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করা যায়। শরীরের গড়ন বদলে দেওয়া যায়। তবে তার জন্য জেনোমের দরকার কী? সেটা স্রেফ কিছু খাইয়ে বা অপারেশন করেও করা যায়। মোট কথা, তত্ত্বটা এখনও নিছক তত্ত্বই।
এ-শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটেন-আমেরিকায় জাতিগত বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য জেনেটিক্সের ইউজেনিক তত্ত্ব নিয়ে খুব হইচই বেধেছিল। নাৎসি জার্মানিতে ইউজেনিক তত্ত্ব লক্ষ লক্ষ ইহুদি হত্যার কারণ হয়েছিল। বিজ্ঞানের চেয়ে বিজ্ঞানীরা সাংঘাতিক বিপজ্জনক। ইদানীং দেখছি, জেনেটিক্সের নানা তত্ত্বের উদ্ভট-উদ্ভট ব্যাখা শুরু হয়েছে।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, জেনোম প্রকল্পের সাহায্যে কৃত্রিম মানুষ তৈরি করা সম্ভব?
চন্দ্রকান্ত আবার ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর ফিক করে হাসলেন। বহুবছর আগে নোবেলজয়ী আণবিক জীববিজ্ঞানী জাক মোদে বলেছিলেন, ল্যাবে মানুষ গড়ে ফেলবেন। ফুঃ! মানুষ ইজ মানুষ।
কৃত্রিম ডি এন এ অণু তৈরি কি সম্ভব?
চন্দ্রকান্ত অবাক হয়ে বললেন, আপনার পয়েন্টটা কী?
এই এলাকায় একটি হিউম্যান জেনোম রিসার্চ সেন্টার খোলা হয়েছে বা হবে জানেন?
চন্দ্রকান্ত ভুঁড়ি নাচিয়ে আর এক দফা হাসলেন। আপনি নিশ্চয় রাজেন অধিকারীর কথা বলছেন? আমেরিকার কোনও ইউনিভার্সিটিতে জেনেটিক্স বিভাগে অধ্যাপক ছিলেন ভদ্রলোক। শুনেছি মাত্র। আলাপ হয়নি। এ-ও শুনেছি, ভালমানুষ দাদার ওপর পরীক্ষা চালাতে গিয়ে তাকে পাগল করে ফেলেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা কী?
কর্নেল আগাগোড়া সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে বললেন, আমি আপনার সাহায্য চাই চন্দ্রকান্তবাবু!
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত চিবুকের তেকোনা দাড়ি চুলকোচ্ছিলেন। এটা ওঁর চিন্তাভাবনার লক্ষণ। একটু পরে বললেন, হালদারমশাইয়ের দেখা প্রথম ঘটনাটা, মানে পারসি ভদ্রলোককে তুলে আছাড় মারাটা চিন্তাযোগ্য বিষয়। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনাটা ওঁর দেখার ভুল হতেও পারে। মানে, চোখ উপড়ে বেসিনে দেওয়া এবং রক্ত! তারপর সেই চোখ থেকে গুলি বের করা। হালদারমশাইকে তো বিলক্ষণ জানি!
বলে চন্দ্রকান্ত হেসে উঠলেন। বললাম, গুলির শব্দ শুনেছিলেন হালদারমশাই! ঘটনাস্থলে পাওয়া রিভলভারটা তার প্রমাণ।
গুলিটা নকল পাথুরে চোখে লেগেছিল। চন্দ্রকান্ত আবার দাড়ি চুলকোতে থাকলেন। যাইহোক, লোকটার গায়ের জোরই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। কোনও কথা বললেন না। আমি বললাম, আপনি বিজ্ঞানী। এ-যুগে ফ্র্যাংকেনস্টাইন কাহিনি কি বাস্তবে সম্ভব নয়? আপনিই বললেন, জেনোমতত্ত্ব কাজে লাগিয়ে শরীরের গড়ন বদলানো যায়। শারীরিক শক্তিও তা হলে বদলানো যায়?
চন্দ্রকান্ত বললেন, তা যায়। তবে
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, আপনার ধুন্ধুমার যন্ত্রমানুষ মাত্র। কিন্তু কৃত্রিম চামড়া, কৃত্রিম পেশি-শিরা-উপশিরা, কৃত্রিম হৃৎপিন্ড-ফুসফুস এবং কৃত্রিম রক্ত তো তৈরি করা সম্ভব হয়েছে এ যুগে। বাকি রইল কৃত্রিম মগজ। কোনও বিজ্ঞানী কি এইসব জুড়ে কৃত্রিম মানুষ তৈরি করতে পারেন না?
পারেন, স্বীকার করছি। কিন্তু সেই কৃত্রিম মানুষও আসলে রোবট ছাড়া কিছু নয়। কারণ, তার কৃত্রিম মগজ মানুষের মগজের মতো স্বাধীন চিন্তা করতে পারবে না। যে তাকে তৈরি করছে, তারই চিন্তাভাবনা বা ইচ্ছা তাকে কনট্রোল করবে।
কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। তা হলে তাকে রিমোট কনেট্রোল সিস্টেমে চালানো যাবে।
ঠিক। একশোভাগ ঠিক। চন্দ্রকান্ত চাপাস্বরে বললেন, এখন কথা হচ্ছে, রাজেন অধিকারী তা করতে পেরেছেন কি না।
আমি না বলে পারলাম না, ম্যাডানসায়েবের হিরে চুরি তা হলে রাজেনবাবুরই কীর্তি। জেনোম রিসার্চের জন্য প্রচুর টাকার দরকার। হিরেটার দাম এ-বাজারে প্রায় দেড় কোটি টাকা।
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। জয়ন্ত খাঁটি সাংবাদিক হতে পারল না বলে ওর সমালোচনা করি বটে, তবে ওর মধ্যে সাংবাদিক সুলভ চটজলদি সিদ্ধান্ত করার স্বভাব আছে। ডার্লিং! তোমাকে বারবার বলেছি, বাইরে থেকে যা যেমনটি দেখাচ্ছে, ভেতরে তা তেমনটি নয়।
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। চলুন না, রাজেন অধিকারীর সঙ্গে আলাপ করে আসি। যদি উনি এতক্ষণ না ফিরে থাকেন, আমি এম পি ডি দিয়ে বাইরে থেকে কিছু ডেটা সংগ্রহ করে নেব।
বললাম, এম পি ডি মানে?
মাল্টিপারপাস ডিটেক্টর। আমারই আবিষ্কার। চন্দ্রকান্ত সগর্বে বললেন। ওঁর বাড়ির ভেতর কী কাজকর্ম হয়, তার হদিস পেয়ে যাব।
কর্নেলও উঠলেন। বললেন, আমার ভয় হচ্ছে, হালদারমশাই কোনও কেলেঙ্কারি না বাধান। একগুঁয়ে মানুষ। আত্মবিশ্বাস প্রচণ্ড। আবার ওই জিনিসটা তাকে বিপদে ফেলে। অন্তত তার অবস্থা জানার জন্যও আমাদের ওখানে আবার যাওয়া দরকার মনে হচ্ছে।
বিজ্ঞানী নিজের গাড়ি বের করলেন। ওঁর গাড়ি আগে, আমাদেরটা পেছনে। বিজ্ঞানীর গাড়ি বলে কথা! সদর রাস্তায় পৌঁছে রকেটের বেগে উধাও হয়ে গেল। বললাম, কী অদ্ভুত মানুষ!
কর্নেল হেসে বললেন, সম্ভবত আমরাও আরও অদ্ভুত মানুষের পাল্লায় পড়তে চলেছি ডার্লিং।
আপনি কি কৃত্রিম মানুষের কথা সত্যিই বিশ্বাস করেন– মানে যাকে গত রাতে হালদারমশাই দেখেছেন?
নিছক একটা থিয়োরি, জয়ন্ত। বলে কর্নেল বাইনোকুলার তুলে রাস্তার ধারের গাছে হয়তো পাখি খুঁজতে থাকলেন।
সেই বাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড় করালাম। বিজ্ঞানী প্রবরের গাড়িটা খুঁজে পেলাম না। বললাম, সর্বনাশ। চন্দ্রকান্তবাবুকে কৃত্রিম মানুষ হাপিস করে দেয়নি তো?
কর্নেল গাড়ি থেকে বেরিয়ে বললেন, চন্দ্রকান্তবাবুর অভ্যাস খোদার ওপর খোদকারী করা। ন্যাচারাল কফির বদলে সিন্থেটিক কফি খান। খিদে পেলে নাকি এনার্জি ক্যাপসুল খান। কৃত্রিম অর্থাৎ ওঁর ভাষায় সিন্থেটিক মানুষের প্রতি আসক্তি স্বাভাবিক। যাই হোক, গেটের দরজায় আর তালা আঁটা নেই। হুঁ ওই দ্যাখো ওঁর গাড়ি!
বলে কর্নেল গেট ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে গেলন! আমি গাড়ি ঢোকাতে সাহস পেলাম না। বেরিয়ে গিয়ে ওঁকে অনুসরণ করলাম।
এবড়োখেবড়ো খোয়া-ঢাকা রাস্তা। দু-ধারে বিচ্ছিরি জঙ্গল। বাড়িটার সামনে চন্দ্ৰকান্তের গাড়ি দাঁড় করানো। আমরা সেখানে যেতেই তার সাড়া পাওয়া গেল ঘরের ভেতর থেকে। চলে আসুন। কর্নেল!
সেকেলে হলঘর বললেই চলে। ঝাড়বাতিও আছে। পুরোনো আসবাবপত্রে সাজানো বনেদি পরিবারের বৈঠকখানা। চন্দ্রকান্ত আলাপ করিয়ে দিলেন রাজেন অধিকারীর সঙ্গে। রাজেনবাবুর বয়স আন্দাজ ষাটের কাছাকাছি। রোগা হাড়গিলে চেহারা। পরনে গলাবন্ধ কোট আর ঢোলা পাতলুন। মাথায় কাঁচাপাকা সন্নেসিচুল। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। কেমন ভুতুড়ে চেহারা যেন।
তবে হাসিটা অমায়িক এবং হাবভাবেও বড়ো বিনয়ী। শশব্যস্তে অভ্যর্থনা করে আমাদের বসালেন। বললেন, হিউম্যান জেনোম রিসার্চ সেন্টার সম্পর্কে ক্রমশ আপনাদের মতো বিশিষ্ট মানুষদের আগ্রহ জাগাতে পেরেছি, এ আমার সৌভাগ্য। দেশে ফিরে আসার পর বিজ্ঞানী মহলে শুধু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পাত্র হয়ে উঠেছিলাম। এখন দেখছি, সমঝদার বিজ্ঞ মানুষেরও অভাব নেই। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্যোতিঃপদার্থবিদ মি. চন্দ্রকান্ত চৌধুরীকেও আমি আকর্ষণ করতে পেরেছি।
চন্দ্রকান্ত সহাস্যে বললেন, এবং একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানীকেও! উনি কর্নেলের দিকে আঙুল তুললেন।
কর্নেল বললেন, এবং একজন নামকরা সাংবাদিককেও! কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। ঠোঁটের কোনায় দুষ্টু হাসি।
রাজেনবাবু বললেন, জয়ন্তবাবু! আমার এই প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছু লিখুন। এদেশে এই প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে জেনোম প্রজেক্ট। গভর্নমেন্ট মানেই আমলাতন্ত্র। কিন্তু সরকারি বিজ্ঞানীদের আমলাতন্ত্র আরও সাংঘাতিক। বলে, টাকা দিচ্ছি। তবে বোর্ড গড়তে হবে। তাতে ওঁরা থাকবেন। বুঝুন ব্যাপার! লাল ফিতের ফাঁসে দম আটকে শেষে আমিই মারা পড়ব।
কর্নেল বললেন, আপনার ল্যাব আছে নিশ্চয়?
আছে- মানে, সবে গড়তে শুরু করেছি।
জয়ন্তকে আপনার ল্যাব দেখিয়ে ব্যাপারটাকে বুঝিয়ে বলুন। তা হলে ও সেইভাবে কাগজে লিখবে। আর দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় লেখা মানেই প্রচণ্ড প্রভাব সৃষ্টি।
জানি, জানি। বলে উৎসাহে উঠে দাঁড়ালেন রাজেন অধিকারী। আসুন আপনারাও আসুন!
ল্যাবরেটরি মানেই বিদঘুটে যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক জিনিসপত্র, নানারকম গন্ধ। তার সঙ্গে একালে হরেক সাইজের কম্পিউটার এবং ভিশনস্ক্রিন যুক্ত হয়েছে। তা চন্দ্ৰকান্তের ল্যাব এবং রাজেনবাবুর ল্যাবের মধ্যে একটাই ফারাক চোখে পড়ল। জারে রঙিন তরল পদার্থে চুবানো ইঁদুর, আরশোলা টিকটিকি ইত্যাদি সরীসৃপ-পোকামাকড়। তারপর আঁতকে উঠলাম দেখে, কবজি থেকে কাটা একটা হাত। মানুষের হাত। আমার চমক লক্ষ্য করে রাজেনবাবু বললেন, হাসপাতালের মর্গ থেকে জোগাড় করেছি। এবার জেনোম ব্যাপার বুঝিয়ে বলি।
আমার পকেটে রিপোর্টারস নোটবই সবসময় থাকে। উনি বকবক শুরু করলে আমি নোট নেওয়ার ভান করে যা খুশি লিখতে থাকলাম। চন্দ্রকান্ত একটা কম্পিউটারের দিকে ঝুঁকে আছেন দেখলাম। কিন্তু কর্নেল কোথায় গেলেন?
প্রায় আধ ঘন্টা টানা বকবক করে এবং এটা ওটা দেখিয়ে রাজেন অধিকারী যখন থামলেন, তখন আড়চোখে তাকিয়ে কর্নেলকে ঢুকতে দেখলাম।
একটু পরে আমাদের বিদায় দিতে গেট পর্যন্ত এলেন রাজেন অধিকারী বললেন, আপনাদের জন্য সব সময় দরজা খোলা।
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত কেন কে জানে, একটি কথাও না বলে তার গাড়ি নিয়ে আগের মতোই উধাও হয়ে গেলেন। আমরা এগোলাম ভি আই পি রোডের দিকে। যেতে যেতে বললাম গোপন তদন্তের ফল বলতে আপত্তি আছে?
কর্নেল হাসলেন, বন্দি হালদারমশাইকে উদ্ধার করতে পেরেছি। তিনি ভোঁ-কাট করেছেন।
চমকে উঠে বললাম, অ্যাঁ?
কর্নেল শুধু বললেন, হ্যাঁ।
